রেহানার শরীর ভয়ঙ্কর খারাপ করেছে। রক্তে সুগার ওঠানামা করছে। হার্টবিট মিস করছে। এই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাইগ্রেনের তীব্র যন্ত্রণা। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কড়া সিডেটিভ দিয়ে ডাক্তাররা তাকে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন।
সিডেটিভের ঘুম স্বপ্নহীন হয়। কিন্তু ঘুমের মধ্যে তিনি ভয়ঙ্কর এক স্বপ্ন দেখলেন। কয়েকজন মিলে শুভ্ৰকে বস্তায় ভরে পানিতে ফেলে দিয়েছে। শুভ্র বস্তার ভেতর থেকে ডাকছে, মা! মা!
রেহানা জেগে উঠলেন। বাচ্চামেয়েদের মতো চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমার শুভ্র কোথায়? আমার শুভ্র!
নার্স-ডাক্তার ছুটে এল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ডাক্তার সাহেব, আমার শুভ্ৰকে ওয়া বস্তায় ভরে পানিতে ফেলে দিয়েছে।
তাঁকে পেথিড্রিন ইনজেকশন দিয়ে আবারও ঘুম পাড়াতে হলো।
শুভ্র চরের পাড় ঘেসে হাঁটছে। সে খবর পেয়েছে, একটা মাঝারি সাইজের হিজল গাছে কয়েকটা মাছরাঙা পাখি বাসা বেঁধেছে। ডিম পেড়েছে। শুভ্র যাচ্ছে মাছরাঙা পাখির বাসা দেখতে। পাখির গায়ের রঙের মতো ডিমগুলির গায়েও নাকি রঙ। কয়েকদিন আগে শুভ্র একটা সাপের ডিম পেয়েছে। ডিমের খোসার রঙ হালকা নীল। ভয়ঙ্কর এক সরীসৃপ নীল রঙের ডিম পাড়ছে—ব্যাপারটা অদ্ভুত। শুভ্র সাপের ডিমটা ফেলে নি। খড় দিয়ে পেঁচিয়ে রেখে দিয়েছে।
শুভ্রর সন্ধানে মুন্সিগঞ্জ থেকে যুথী খেয়া নৌকায় উঠেছে। মাঝি বলল, আপা, কই যাবেন? শুভ্রর চর?
যুথী বলল, হ্যাঁ। যার নামে চরের নাম তিনি কি সেখানেই আছেন?
মাঝি বলল, এত কিছু তো আপা বলতে পারব না। চরে নাইম্যা খোঁজ নেন।
নৌকার এক যাত্রী বলল, শুভ্ৰ ভাইজান চরেই থাকেন। আপনি তার কাছে যেতে চান?
হুঁ।
আত্মীয় হন?
না। পরিচিত। উনি মানুষ কেমন?
পাগলা কিসিমের। ভালো মানুষ পাগলা কিসিমের হয়, এইটা আল্লাপাকের বিধান।
উনি কী পাগলামি করেন?
প্রত্যেক শনিবারে বক্তৃতা হয়।
যুথী আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিসের বক্তৃতা?
ছাইনছের বক্তৃতা। যেমন ধরেন গিয়া পিথিমি ভন ভন কইরা ঘুরতেছে। কিন্তুক উত্তর-দক্ষিণে ঘুর্ণা নাই। সবই ছাইনছের কথা।
এইসব কথা শোনার জন্যে সবাই আসে?
যার ইচ্ছা হয় যায়। না গেলে তো কেউ থানা-পুলিশ করবে না।
বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া উনি আর কী করেন?
গলাপানিতে ড়ুইব্যা বইসা থাকেন।
নৌকার আরেক যাত্রী বলল, উনার মধ্য পীরাতি আছে। অনেকেই দেখেছে উনি যখন রাতে হাইট যান। তখন তার পিছনে পিছনে একজন যায়। কে বইল্যা আওয়াজ দিলে সে মিলায়া যায়।
যুথী বলল, আপনি নিজে দেখেছেন?
আমি দেখি নাই, তয় অনেকেই দেখেছে।
যুথী শুভ্রর চরে পৌঁছল ভরদুপুরে। তার ইচ্ছা করছে কী সুন্দর! কী সুন্দর! বলে চিৎকার করে উঠতে। খেলার মাঠের মতো বিশাল সবুজ এক প্রান্তর। নদীর ধার ঘেসে ঘরগুলিকে মনে হচ্ছে খেলনা ঘর। প্রচণ্ড বাতাস। কিছুক্ষণ পর পর তার শাড়ি ফুলে ফুলে উঠছে। নিজেকে মনে হচ্ছে নৌকার পাল।
দুটা বাচ্চামেয়ে হাঁটুপানিতে নেমে কী যেন করছে। যুথী জিজ্ঞেস করল, এই, তোমাদের চারটার নাম কী?
একজন বিরক্ত গলায় বলল, শুভের চর।
যুথী বলল, শুভের চর না। এটার নাম শুভ্রর চর। বলো শুভ্রর চর।
মেয়ে দুটি ফিরেও তাকাল না। তারা খেলায় মেতেছে।
যুথী বলল, সায়েন্সের বক্তৃতা দেয় যে শুভ্র তাকে তোমরা চেনো?
ছোট মেয়েটা বলল, দিক কইরেন না কইলাম।
যুথী হাঁটতে বের হলো। সে ঠিক করেছে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না।
প্রথমে একা একা দ্বীপে চক্কর দেবে। ছোট কোনো ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করবে, তোমাদের এই চরটার নাম কী?
আজ থেকে দেড়শ দুশ বছর পর দেশটা অনেক বদলে যাবে। শুভ্রর চর নামটা কি বদলাবে? মনে হয় না। শুভ্ৰ কে?–এই নিয়ে নানান গল্প তৈরি হবে। উনি বিরাট পীর ছিলেন। জিন পুষতেন। উনি যেখানে যেতেন তার সঙ্গে একটা জিন যেত।
শুভ্ৰ মুগ্ধ হয়ে পাখির বাসা দেখছে। একটা বাসার মা মাছরাঙা তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। মানুষ দেখে সে মোটেও ভয় পাচ্ছে না। ডিম ঢেকে সে বসে আছে বলে ডিমের রঙ দেখা যাচ্ছে না।
আপনের নাম শুভ্ৰ?
শুভ্ৰ চমকে তাকাল। দুজন চোখে সানগ্লাস পরা মধ্যম বয়সী অচেনা লোক। তাদের গায়ে চকচকে শার্ট। রোদোপোড়া চেহারা; দুজনের কেউই মনে হয় কয়েকদিন দাড়ি কামায় নি। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দুজনের একজন কথা বলছে, অন্যজন একটু পর পর গলা খাকারি দিয়ে থুথু ফেলছে।
প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি, জবাব দেন না। কী জন্যে? আপনের নাম শুভ্ৰ?
শুভ্ৰ বলল, হ্যাঁ।
ভালো আছেন?
হ্যাঁ, ভালো আছি।
পক্ষী দেখেন?
হ্যাঁ।
আমাদের সঙ্গে একটু আসতে হবে।
কেন?
কাজ আছে।
কী কাজ?
সেটা যথাসময়ে জানবেন।
আপনাদের সঙ্গে কোথায় যাব?
লাঞ্চে। একটা লঞ্চ পাড়ে ভিড়ছে, দেখেন নাই? লঞ্চের নাম এম এল সকিনা।
শুভ্র বলল, চলুন যাই, তবে মর্জিনাকে একটা খবর দেওয়া দরকার। সে দুশ্চিন্তা করবে।
তারে নিয়া আপনের ভাবার কিছু নাই। নিজেরে নিয়া ভাবেন।
শুভ্র বলল, নিজেকে নিয়ে তো আমি কখনো ভাবি না।
এখন ভাবেন। ভাবনার সময় হয়েছে।
এম এল সকিনা লঞ্চটি একতলা। চর থেকে বেশ কিছুটা দূরে নোঙ্গর করে আছে। শুভ্ৰকে নৌকায় করে সেখানে নেওয়া হলো। লঞ্চের পেছন দিকে ছোট্ট একটা রুমে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। রুমের একটাই জানালা, সেই জানালাও পুরোপুরি খোলা না। সামান্য খোলা। ভেতরটা অন্ধকার। সেখানে পার্টি পাতা। পার্টির ওপর আধশোয়া হয়ে এক লোক। অন্ধকারেও তার চোখে সানগ্লাস। তার নাম মোবারক। মোবারকের সামনে গামলাভর্তি পাকা কাঁঠাল। কাঁঠালের ওপর নীল রঙের বেশ কিছু পুরুষ্টু মাছি। মোবারক হাত দিয়ে মাছি সরিয়ে কাঁঠালের বিচি মুখে দিচ্ছে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খু করে বিচি ফেলছে। বিচিগুলি টিনের বেড়ায় লেগে ঢং করে শব্দ করছে। শব্দটা মনে হয় তার পছন্দ হচ্ছে। প্রতিবারই শব্দ শোনার পর তার মুখ হাসি হাসি হয়ে যাচ্ছে। সে শুভ্রর দিকে না তাকিয়েই বলল, কাঁঠাল খাওয়ার অভ্যাস আছে?
শুভ্ৰ বলল, কাঁঠাল আমার পছন্দ না।
গরিবের খানা, এইজন্যে পছন্দ না?
শুভ্র বলল, ধনী-গরিবের ব্যাপার না। যে খাবার ধনী মানুষ খেতে পারে সেই খাবার গরিব মানুষও খেতে পারে।
লোকটা শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ধনী-গরিবের খানা এক না। খানা ভিন্ন। তবে গু একই। ধনীর গুতে গন্ধ, গরিবের গুতেও গন্ধ। ঠিক বলেছি না?
শুভ্র কিছু বলল না।
লোকটা চোখ থেকে চশমা খুলতে খুলতে বলল, আপনেরে নিয়া প্যাচাল পারার কিছু নাই। আমি প্যাচালের লোক না। কাজের লোক। আমার উপর হুকুম হয়েছে আপনেরো অফ করে দেয়া। এই কাজটা কিছুক্ষণের মধ্যে করব। শেষ মুহুর্তে কিছু মনে চাইলে বলেন। সিগারেট খাবেন?
সিগারেট আমি খাই না। আপনার কথা বুঝতে পারছি না। আমাকে অফ করে দিবেন। মানে কী?
অফ করা বুঝেন না?
না।
ইলেকট্রিক বাত্তি সুইচ টিপলে অফ হয়—এইটা তো জানেন?
জানি। কিন্তু আমি ইলেকট্রিক বাতি না। আমি মানুষ।
আপনেরে বস্তায় ভরে দূরে নিয়ে পানিতে ফেলা দেওয়া হবে। বস্তার ভিতর ইট থাকবে। আপনে শান্তিমতো নদীর তলে ঘুমায়া থাকবেন। কেউ আপনেরে ডিসটর্ব করবে না। আপনেও কাউরে ডিসটর্ব করতে পারবেন না। সাইন্সের বক্তৃতা শেষ। এখন বুঝছেন, অফ করা মানে পানিতে ড়ুইবা মরা? মরলেই অফ। পানিতে ড়ুবলেও অফ, ইটের ভাটার আগুনে পুড়লেও অফ।
আমাকে অফ করবেন কেন?
কারণ আপনে বিরাট ঝামেলার লোক। এই চরের নামই হয়ে গেছে। শুভ্রর চর। আপনেরো অফ কইরা ঝামেলা মিটাইতে হইবে। এই হুকুম।
হুকুম কে দিয়েছে?
তার নাম দিয়া কী করবেন? এখন তৈরি হয় যান।
কিসের জন্যে তৈরি হব?
মরণের জনে।
শুভ্ৰ অবাক হয়ে বলল, যে মানুষটা আপনার কোনো ক্ষতি করে নি তাকে খুন করতে পারবেন?
টাকার জন্যে মানুষ পারে না। এমন কাজ নাই। তবে আপনেরে সত্য কথা বলি! কাজটা আমি করব না। অন্য একজন করবে। মৃত্যুর আগে মনে কিছু চায়? চাইলে বলেন। তবে এখন যদি বলেন, পোলাও কোর্মা খাব, খাসির রেজালা খাব, তা পারব না। কাঁঠাল খাইতে মন চাইলে খান।
শুভ্ৰ তাকিয়ে আছে। লোকটার কথা এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। কোনো ঠাট্টা-তামাশা নয় তো?
আল্লাখোদার নাম নিতে চাইলে নাম নেন। তওবা করতে চাইলে তওবা করেন। নিজে নিজে তওবা করবেন। মাওলানা দিতে পারব না। অজুর পানি দিতে বলব?
ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনার মুখোমুখি হলে প্রকৃতি ব্যবস্থা নেয়। শরীরে হঠাৎ করেই প্রচুর এড্রেলিন জারিক রস চলে আসে। তখন ভয়ঙ্কর বিষয়টাকেও তেমন অস্বাভাবিক মনে হয় না। শুভ্রর মনে হয় তা-ই হলো। সে স্বাভাবিক গলায় বলল, একটা চিঠি লিখব। চিঠিটা পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। পারবেন?
ব্যবস্থা করা যাবে। চিঠি কারে লিখবেন? পিতামাতাকে?
না। তারা আমার এই চিঠি সহ্য করতে পারবেন না। চিঠিটা লিখব যুথীকে। সে শক্ত মেয়ে আছে, সে সহ্য করতে পারবে।
যুথী কে? আপনার লাভার?
সে আমার প্রেমিকা না। আমার পছন্দের একজন। তার গলার স্বর অস্বাভাবিক মিষ্টি।
তার সঙ্গে সেক্স করেছেন?
শুভ্র বলল, আপনারা যে আমাকে মেরে ফেলবেন সেটা আমি বুঝতে পারছি। মৃত্যুর আগে নোংরা কথা শুনতে ভালো লাগছে না। কাঁঠালের বিচি দিয়ে যে চং ঢং শব্দ করছেন এটাও শুনতে ভালো লাগছে না। আমাকে কাগজ-কলম দিন। চিঠি লেখা শুরু করি।
লঞ্চে চিঠি লেখার মতো কাগজ পাওয়া গেল না। দুটা বলপয়েন্ট পাওয়া গেল। মোবারক কাগজের জন্যে লোক পাঠাল। বস্তার ঝামেলাটা দ্রুত সেরে ফেলতে পারলে ভালো হতো। মোবারক কাজটা করতে পারছে না, কারণ যুথী নামের মেয়েটাকে এই লোক কী লেখে তা তার জানতে ইচ্ছা করছে। সে তার একজীবনে অনেক অদ্ভুত মানুষ দেখেছে। এরকম দেখে নি। ছেলেটিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষীণ ইচ্ছা তার হচ্ছে। ইচ্ছাটাকে সে আমল দিচ্ছে না।
যে কাগজ-কলম আনতে গেছে সে ফিরছে না, তবে লিঞ্চের সারেং-এর ঘরে রুলটোনা একটা খাতার কয়েকটা পাতা পাওয়া গেল। শুভ্ৰ খাতা নিয়ে উবু হয়ে বসেছে। লেখা শুরু করেছে। মোবারক যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে শুভ্রর কাণ্ডকারখানা দেখছে। কী লেখা হচ্ছে তা সে শুভ্রর ঘাড়ের ওপর উঁকি দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।
শুভ্ৰ লিখছে—
যুথী,
রাশিয়ান পাগলা সাধু রাসপুটিন কীভাবে মারা গেছেন জানো? তিনি মারা যান পেট্রোগ্রাডে, যার বর্তমান নাম সেন্ট পিটার্সবার্গ। ১৯১৬ সনে। তাঁকে প্রথমে প্রচুর সায়ানাইড মেশানো মদ এবং কেক খাওয়ানো হয়। তাতে তাঁর কিছুই হয় না। প্রিন্স Felix Yussup০v তখন তাঁর বুকে পিস্তল দিয়ে কয়েকটি গুলি করেন তাতেও রাসপুটিনের কিছু হয় না। বরং রাসপুটিন প্রিন্সের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন। মৃত্যুর কোনো লক্ষণ না দেখে তাঁকে ফেলে দেওয়া হয় Nova নদীতে। তাঁর মৃত্যু হয় পানিতে ড়ুবে। বলতে ভুলে গেছি, তাঁকে চটের থলিতে ভরে পানিতে ফেলা হয়েছিল।
আমার নিজেকে এই মুহূর্তে রাসপুটিনের মতো লাগছে। কারণটা বলছি।
এই পর্যন্ত লিখে শুভ্ৰ মোবারকের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে এক কাপ চ্যা খাওয়াতে পারবেন?
মোবারক বলল, অবশ্যই। দুধ চা না রঙ চা?
শুভ্র বলল, দুধ চা। আপনি একটু দূরে বসতে পারবেন? ঘাড়ের ওপর দিয়ে কেউ তাকিয়ে থাকলে আমি লিখতে পারি না। ভালো কথা, যে বস্তায় ভরে আমাকে পানিতে ফেলা হবে সেটা কি আনা হয়েছে?
সব রেডি। বস্তা, ইট, সব।
যে আমাকে পানিতে ফেলবে তাকে আমার দেখার ইচ্ছা ছিল। তার নাম কী?
তার নাম বলা যাবে না। তবে আপনেরে বলতে বাধা নাই। আপনে তো আর কাউরে গিয়া বলবেন না। সেই সুযোগ নাই। তারে আমরা হায়ার করে এনেছি। তার নাম কানা ছালামত।
একটা চোখ কি নষ্ট?
চোখ ঠিকই আছে, তারপরেও নাম কানা।
শুভ্ৰ বলল, কানা নাম হবার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গল্প আছে। কলেজে সবাই আমাকে কানা বাবা ডাকত। কারণ আমি চোখে কম দেখি। কানা ছালামতের নামের পেছনের গল্পটা কী?
এত কথা বলতে পারব না। চিঠি শেষ করেন। হাতে সময় নাই।
শুভ্র বলল, চা আসুক। চায়ে চুমুক দিয়ে লেখা শুরু করি।
যুথী হেকমতের চায়ের দোকানে বসে আছে। হেকমত তাকে বলল, যার জন্যে এসেছেন তার আশা ছেড়ে দেন। সে ধরা খেয়েছে কানা ছালামতের হাতে।
এতক্ষণে বস্তায় ভাইরা তারে পানিতে নামায়ে দিয়েছে। খেল খতম কইরা সে পয়সা হজম কইরা ফেলছে।
যুথী বলল, ভ্যাজর ভ্যাজার করবেন না প্লিজ।
আপনার পরিচয় কী? আপনি তার কে হন?
আমি তার কেউ হই না। তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে নিতে এসেছি। মজিনা মেয়েটার ঘর কোথায়?
জানি না কোথায়। চর তো ছোট না। বিশাল চর। কোন চিপায় ঘর তুলছে খুঁইজা বাইর করেন।
শুভ্ৰ মহাবিপদে পড়েছে, এই ব্যাপারটা যুথীর কাছে এখন পরিষ্কার। বিপদের ধরনটা বুঝতে পারছে না। সে কার কাছে সাহায্যের জন্যে যাবে তাও জানে না। চরে নিশ্চয়ই থানা-পুলিশ নেই। কানা ছালামত নামের একজন কেউ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কানা ছালামতটা কে? কোথায় তাকে নিয়ে গেছে? সত্যি মেরে ফেলবে? মানুষ মারা এত সহজ?
যুথী হেকমতের দোকান থেকে বের হয়ে মর্জিনার বাড়ি খুঁজে বের করল। চরের সবাই জড়ো হয়েছে সেখানে। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত যুথীর নিজেকে অসহায় লাগিছিল, এখন ততটা লাগছে না। চারের মানুষজন শুভ্রর নিখোঁজ হবার খবর পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছে। তাদের ব্যাকুলতা অবাক হয়ে দেখার মতো।
একজন রোগামতো মানুষ যুথীকে বলল, আফা শুনেন, শুভ্ৰ ভাইজানের ক্ষতি যদি কেউ করে তারে আমরা চাবায়া খায়া ফেলব। সে যত বড় নবাবের পুতই হউক।
সবাই সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, অবশ্যই!
একজন বলল, কানা ছালামন্তরে আমরা যদি চাবায়া না খাই তাইলে আমরা পিতামাতার জারজ সন্তান।
আবার হুঙ্কার উঠল, অবশ্যই!
মর্জিনা কোনো আলোচনায় অংশ নিচ্ছে না। সে বাবার কবরের পাশে পাকুরগাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি অপ্ৰকৃতস্থের দৃষ্টি। তার হাত মুঠি করা। সেখানে নীল রঙের একটা ডিম। ডিমটা পাখির। শুভ্ৰ ভাইজানের সঙ্গে মজা করার জন্যে সে বলেছিল সাপের ডিম। ভাইজান তা-ই বিশ্বাস করে ডিমটা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মিথ্যা কথাটা বলার জন্যে মর্জিনার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কান্না আসছে না। ভেতরে ভেতরে মর্জিনা অনেক শান্ত। তার সবকিছু ঠিক করা আছে। নাইলনের দড়ি পর্যন্ত কেনা আছে। শুভ্ৰ ভাইজানের খারাপ খবর পাওয়া মাত্র সে ঝুলে পড়বে।
যুথীর সঙ্গে একটা মোবাইল টেলিফোন সেট আছে। মেরাজউদ্দিন দিয়ে দিয়েছেন। চরে মোবাইল সেটটা কাজ করছে না। কোনো সিগন্যাল নেই। যুথী ঢাকার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছে না। তবে সে জানে না যে মেরাজউদ্দিন হেলিকপ্টার নিয়ে রওনা হয়েছেন। পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মাথায় হেলিকপ্টার চরে নামবে। তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে আসছেন। রেহানা স্বামীর পাশে মূর্তির মতো বসে আছেন। তাঁর দৃষ্টিও অপ্রকৃতস্থ। কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না।
মেরাজউদ্দিন বললেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি তোমার ছেলেকে দেখবে। রেহানা বললেন, আচ্ছা।
তাকে প্রথম কথা কী বলবে ঠিক করেছ?
না।
আমি শিখিয়ে দিব?
দাও।
মেরাজউদ্দিন বললেন, তুমি তাকে বলবে ইউ নিটি বয়।
রেহানা বিড়বিড় করে বললেন, ইউ নটি বয়। ইউ নটি বয়। ইউ নটি বয়।
শুভ্ৰকে লঞ্চের ছাদে আনা হয়েছে। সেখানে কানা ছালামত তার দুই সঙ্গী নিয়ে বসা। তাদের সামনে ইটভর্তি চটের বস্তা! কানা ছালামত বলল, আপনি যে চিঠি লিখেছেন সেটা পড়লাম। চিঠি সুন্দর লিখেছেন। এই অবস্থায় ঠান্ডা মাথায় একটা চিঠি লিখতে পেরেছেন, এটা অনেক বড় ব্যাপার।
শুভ্র বলল, অন্যকে লেখা চিঠি পড়েছেন, কাজটা তো ঠিক করেন নি।
কানা ছালামত বলল, আমার সব কাজই তো বেঠিক।
শুভ্ৰ বলল, ঠিকানা লিখে দিয়েছি। চিঠিটা ঠিকমতো পৌঁছাবেন।
কানা ছালামত হাসল। শুভ্র বলল, আপনার চোখ তো ঠিক আছে, আপনার নাম কানা ছালামত কেন?
কানা ছালামত বলল, নিজেই নিজের নাম দিয়েছি। একেক সময় একেক নাম দেই। আমার আগের নাম ফ্রুট ফোটন। র্যাবের ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হবার পর নতুন নাম কানা ছালামত।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
কানা ছালামত বলল, বুঝতে না পারলে নাই! শুনেন, যাকে চিঠি লিখেছেন সে চরে উপস্থিত আছে। আপনি এক কাজ করেন, নিজের হাতেই তাকে চিঠিটা দেন। সে খুশি হবে।
যুথী চরে এসেছে?
হ্যাঁ।
আপনি তাকে চেনেন?
একসময় চিনতাম।
শুভ্র চমকে উঠে বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি যুথীর বড়ভাই টুলু? এতক্ষণ খেয়াল করি নি, আপনার সঙ্গে যুথীর চেহারার অস্বাভাবিক মিল। আপনার গলার স্বরও যুথীর মতোই মিষ্টি।
কানা ছালামত বলল, আমি কারোর ভাই না। কারোর স্বামীও না। আমি কানা ছালামত। কোষা নৌকা বাইতে পারেন? নৌকা বাওয়া শিখেছেন?
অল্প স্বল্প পারি।
লাঞ্চের সঙ্গে কোষা নৌকা বাধা আছে। নৌকা নিয়ে চলে যান। আমরাও লঞ্চ নিয়ে বিদায় হব। আরেকটা শেষ কথা শুনে যান। যুথীর কাছে লেখা চিঠিটা পড়ে অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছি। করিম আঙ্কেল নামের একটা লোককে গুলি করে মেরে যেরকম আনন্দ পেয়েছিলাম, সেরকম আনন্দ। দুটা সম্পূর্ণ দুরকম জিনিস, কিন্তু আনন্দ একই। এটাই আশ্চর্যের বিষয়। যাই হোক, বিদায়।
শুভ্র বলল, আপনার স্ত্রীর নাম কি লাইলি?
একটু আগে কী বলেছি? আমার কোনো বোন নাই। আমার কোনো স্ত্রীও নাই।
শুভ্র বলল, আপনি যদি না জানতেন যুথীকে আমি চিনি, তাহলে কি আপনি বস্তায় ভরে পানিতে ফেলতে পারতেন?
পারতাম।
শুভ্র বলল, আমার খুব শখ ছিল অতি ভয়ঙ্কর কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলব।
আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, শখ মিটার কথা। মিটে নাই?
শুভ্র বলল, আমি বইতে পড়েছি। সিরিয়াল কিলারদের মানসিক গঠন অন্যরকম। তারা ভালো এবং মন্দ আলাদা করতে পারে না। তাদের মধ্যে পাপবোধের ব্যাপার নেই। আপনারও কি তাই?
টুনু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে তার সঙ্গীকে বলল, শুভ্রকে নৌকায় তুলে দিয়ে লঞ্চ ছাড়ার ব্যবস্থা কর।
শুভ্র বলল, আর পাঁচটা মিনিট আপনার সঙ্গে কথা বলি প্লিজ। আপনি কি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ফর হুম দ্যা বেল টোলস বইটা পড়েছেন? বইটার শুরুতে গীর্জয়া মৃত্যুঘণ্টা নিয়ে একটা কথা আছে।
টুলু সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। তারা শুভ্ৰকে ধরে নিয়ে গেল।
হেলিকপ্টার নিয়ে মেরাজউদ্দিন নেমেছেন। তার স্ত্রীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছেন। যুথী ছুটে এসে তাদের পাশে দাঁড়াল। মেরাজউদ্দিন আনন্দিত গলায় বললেন, চরের লোকজন মাথা কামানো যে যুবকটিকে কাঁধে নিয়ে ছোটাছুটি করছে সে কি আমাদের শুভ্র?
যুখী বলল, জি স্যার।
রেহানা বিড়বিড় করে বললেন, শুভ্ৰ ইউ নটি কয়।
মেরাজউদ্দিন বললেন, রোদে পুড়ে গায়ের রঙ তামার মতো হয়ে গেছে। এখন তার নতুন নাম হওয়া উচিত তাম। রেহানা তুমি বলো, তাম্র ইউনিটি বয়।
রেহানা বললেন, তাম ইউ নটি বয়।
মেরাজউদ্দিন বললেন, অলিম্পিকের হাইজ্যাম্পের মতো যে মেয়েটা হাইজাম্প দিচ্ছে সে মনে হয় মার্জিনা।
যুথী বলল, জি স্যার। মেরাজউদ্দিন বললেন, মনে হচ্ছে শুভ্ৰ এই দ্বীপের যুবরাজ।
যুখী বলল, স্যার, এই চরের নাম শুভ্রর চর। আপনার ছেলে কত ভাগ্যবান! তার নামে একটা জায়গার নাম হয়ে গেছে।
মেরাজউদ্দিন বললেন, তুমি কাঁদছ কেন?
চরের বালি বাতাসে উড়ে চোখে পড়ছে, এইজন্যই বারবার চোখে পানি আসছে।
চরের কিছু বালি মনে হয় মেরাজউদিনের চোখেও পড়েছে, তার চোখ ভিজে উঠেছে; তিনি দ্রুত হিসাব করছেন। শেষ কবে কেঁদেছেন। মনে করতে পারছেন। না। তিনি নিজের ওপর সামান্য বিরক্ত হচ্ছেন।
হিজলগাছে বাসা বাধা মাছরাঙা পাখিটাও খুব বিরক্ত হচ্ছে। হেলিকপ্টারের শব্দ, লোকজনের চিৎকারে সে ঠিকমতো ডিমে তা দিতে পারছে না। তার সন্তানদের ডিম থেকে বের হয়ে আসার সময় হয়ে গেছে। অদ্ভুত সুন্দর এই পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে মা মাছরাঙা ছটফট করছে। একসময় মা পাখি ডিমের ওপর থেকে উঠে দ্বীপের ওপর দিয়ে একটা চক্কর দিল। দ্বীপে কী ঘটছে। সে দেখতে চায়। তার অনাগত সন্তানদের ক্ষতি হবে এমন কিছু ঘটছে না তো?
রেহানা মা পাখিটার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বললেন, দেখো দেখো! কী সুন্দর একটা মাছরাঙা।
Favourite one.