অধ্যায় ১০
অনেকদিন পর বাবলুকে দেখে খুশিই হলো শুটার সামাদ। সে অবশ্য জানতো না বাবলু কাজ ছেড়ে দিয়েছিলো। ধারণা করেছিলো পুলিশি ঝামেলার কারণে আত্মগোপন করে আছে। আজকে হঠাৎ করে তার আগমন এবং অস্ত্র চাওয়ার কারণে কিছুটা অবাক হলেও বেশি অবাক হয়েছে ডাকাইত শফিকের মতো নিম্নমানের কোনো সন্ত্রাসীর খবর জানতে চাইছে বলে।
একেবারে ছিঁচকে এক সন্ত্রাসী এই ডাকাইত শফিক। বিক্রমপুর লাইনের কিছু লঞ্চ ডাকাতি করে অপরাধ জগতে হাতেখড়ি হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় চলে এলে ছিনতাই, চাঁদাবাজির সাথে জড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় কিছুদিন কাজ করার পর নিজেই একটি বাহিনী গড়ে তোলে। অপরাধ জীবনের প্রথম দশ বছর সে বেশ কয়েকজন বড় বড় সন্ত্রাসীর সাথে কাজ করেছে। মাথামোটা, বদমেজাজি আর খুনখারাবিতে ওস্তাদ এই লোক। তার ডানহাত হিসেবে পরিচিত দুদু মামুই তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে থাকে। ডাকাইত শফিক নিজে দুদু মিয়াকে মামু সম্বোধন করে তাই দলের সবাই তাকে দুদু মামু বলেই ডাকে। ইদানিং ব্ল্যাকরঞ্জুর কারণে চাঁদাবাজিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ডাকাতি আর ফেন্সিডিলের ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছিলো। যদিও ব্ল্যাকরঞ্জু খুন হয়েছে বেশ কয়েক মাস আগে, ওর দলটাও ভেঙে গেছে, তারপরও ঢাকা শহরেরচাঁদাবাজি করার মতো লোকবল আর নেটওয়ার্ক এখনও গড়ে তুলতে পারে নি ডাকাইত।
“মজার ব্যাপার কি জানো,” বললো শুটার সামাদ। বাবলু বসে আছে তার সামনে। চায়ে চুমুক দিচ্ছে সে। “ডাকাইত শফিক এক সময় ব্ল্যাকরঞ্জুর দলেও কাজ করেছে।”
কথাটা শুনে একটু অবাক হলো বাবলু। “তাই নাকি।” আর কিছু বললো না।
“কিন্তু টিকতে পারে নি,” চেয়ারে হেলান দিলো অস্ত্র ব্যবসায়ি। “স্বভাব খুবই খারাপ। একেবারে গ্রামেগঞ্জের ডাকাতদের মতো। তার বদমেজাজ স্বভাবের কারণে রঞ্জু তাকে দল থেকে বের করে দেয়।” শুটার সামাদ একটু থামলো, তারপর আস্তে করে জানতে চাইলো, “আচ্ছা, ঘটনাটা কি আমাকে বলা যাবে? যদিও আমি জানি তুমি এসব বিষয় নিয়ে কারো সাথে কথা বলো না।”
চায়ের কাপটা রেখে দিলো বাবলু। “ওরা আমার এক ঘনিষ্ঠ লোককে কিডন্যাপ করেছে,” অবলীলায় বলে দিলো সে।
শুটার সামাদ মাথা নেড়ে সায় দিলো শুধু, নিজের বিস্মিত ভাবটা লুকানোর চেষ্টা করলো। সে জানে বাবলুর কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। ঘনিষ্ঠ বলতে যা বোঝায় সেরকম কোনো লোকের কথাও তার জানা নেই। বলতে গেলে এ দুনিয়ায় একদম একা সে। কাজও করে একা একা। অবশ্য অমূল্য বাবুর কথা তার জানা নেই।
“যতো দ্রুত সম্ভব ওর নাগাল পেতে হবে,” বললো বাবলু। “আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই।”
একটু ভাবলো সামাদ। “ডাকাইত শফিকের ব্যাপারে আমি যা জানি তা তো বললামই, এর বেশি কিছু জানি না। মানে, বর্তমানে কোথায় থাকে, কিভাবে কাজ করে, দলে কতজন লোক আছে, কিছু জানি না।”
বাবলুও জানে কাজটা সহজ নয়। এসব সন্ত্রাসী কোথায় থাকে সেটা সবার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাকে খুঁজে বের করাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সমস্যা হলো অতো সময় তার হাতে নেই।
“দুদু মামু আগে আমার কাছ থেকে অস্ত্র ভাড়া নিতো এখন আর নেয় না। মনে হয় ওদের ভাণ্ডারে ভালো অস্ত্রই আছে। তবে মাঝেমধ্যে গুলিটুলি কিনতে এলে একটু আধটু কথা হয়।”
বাবলু সিদ্ধান্ত নিলো, ঐ দুদু মামুই হবে তার প্রথম টার্গেট।
“মামুর বয়স হয়েছে, তিন-চারটা ছেলেমেয়ের বাপ, বড় মেয়েটা নাকি কলেজে পড়ে কিন্তু এখনও ডাকাইতের দলে কাজ করে। তার আসল ধান্দা ফেন্সিডিলের ব্যবসা।”
“সে কোথায় থাকে?” আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো বাবলু।
“এখন কোথায় থাকে জানি না। আগে থাকতো স্বামীবাগে। হাতকাটা বুদ্দিনের সাথে ঝামেলা হবার পর অন্য কোথাও চলে গেছে।”
এই হাতকাটা বুদ্দিনকে বাবলু চেনে। স্বামীবাগ এলাকায় ফেন্সিডিলের ব্যবসায়ি। সন্ত্রাসী জীব র শুরুতে বোমা বানাতে গিয়ে ডান হাতের কব্জি উড়ে গেছিলো।
“তার খোঁজ পাবো কিভাবে?”
বাবলুর কথায় চুপ মেরে গেলো শুটার সামাদ। বাবলুর ধারণা, শুটার সামাদ হয়তো ভাবছে তার কাছে দুদু মামুর খোঁজ দেয়া মানে ঐ লোকের মৃত্যুপরোয়ানা জারি করা।
“আমি জানি কোনো ক্লায়েন্টের ব্যাপারে কাউকে কোনো তথ্য দেন না কিন্তু আজকে আমি কাজের প্রয়োজনে এখানে আসি নি। আমি এসেছি ছয় সাত বছরের একটি শিশুর জীবন বাঁচাতে।” এক দমে কথাগুলো বলে চুপ মেরে গেলো বাবলু।
ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো সামাদ। “শিশু?” আর কিছু বললো না।
মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু। “ছয়-সাত বছরের একটি মেয়ে।”
“ওহ্,” হামিদের বুকের ভেতর থেকে কথাটা বেরিয়ে এলো যেনো। তার নিজেরও ঠিক একই বয়সের কন্যাসন্তান রয়েছে
“ঐ মেয়েটার সাথে আমার কি সম্পর্ক সেটা জিজ্ঞেস করবেন না, প্লিজ,” বললো বাবলু।
আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো সামাদ। অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো, “তুমি এখন মেয়েটাকে উদ্ধার করতে চাইছে ওদের হাত থেকে?”
“হুম।”
“কঠিন কাজ,” বললো সাবেক শুটার। “মেয়েটাকে ওরা কোথায় আটকে রেখেছে কে জানে।”
“আমাকে আজ রাতের মধ্যেই সেটা জানতে হবে।”
“হায় হায়, বলো কি,” শুটার সামাদের কপালে ভাঁজ পড়লো। “এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে সম্ভব!”
“দেরি করলে ওরা মেয়েটাকে মেরে ফেলবে।” কথাটা বলতে একটু কষ্টই হলো তার।
স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সামাদ। সেও জানে কিডন্যাপাররা আজকাল জিম্মিদের সাথে কি রকম ব্যবহার করে। মেয়েটা যে এখনও বেঁচে আছে সে-ব্যাপারে কি তুমি নিশ্চিত?”
“হ্যাঁ।” মেঘলাকে বাবলু যা যা করতে বলেছে তা যদি ঠিকমতো করতে পারে তাহলে ছোট্ট দিন অন্তত আরো একটা দিন বেঁচে থাকবে।
“মুক্তিপণের টাকা কবে চাইছে তারা?”
“আগামীকাল সকালের মধ্যে।”
আবারো চিন্তার ভাঁজ পড়লো শুটারের কপালে। “তাহলে তো হাতে একদম সময় নেই।”
আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু।
“মেয়েটার বাবা-মা নিশ্চয় পুলিশকে জানায় নি?”
“পুলিশ এখনও কিছু জানে না।”
অধ্যায় ১১
হোমিসাইডের কমিউনিকেশন্স রুমে বসে আছে জেফরি বেগ আর জামান। কিছুক্ষণ আগে এহসান চৌধুরির বাসার ল্যান্ডফোন ট্যাপ করে তারা মিসেস চৌধুরি আর অপহরণকারীদের কথাবার্তা শুনেছে। ইতিমধ্যে জামান অপহরণকারীদের সেলফোন নাম্বারটি ট্র্যাকডাউন করে জেনে গেছে কোত্থেকে কলটা করা হয়েছিলো।
অনেকক্ষণ ধরে ডেস্কের উপর পড়ে থাকা কফির মগটা তুলে নিলো জেফরি। আনমনে চুমুক দিতেই বুঝতে পারলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মগটা নামিয়ে রেখে জামানের দিকে ফিরলো সে। ছেলেটা কাজ করে যাচ্ছে। যে কিডন্যাপার একটু আগে ফোন করেছিলো সে ঘটনাস্থলে নেই। কলটা করা হয়েছে চৌধুরি সাহেবের বাড়ির খুব কাছ থেকে। অপহরণকারীরা ঐ বাসার আশেপাশেই আছে! হয়তোপুলিশ কিংবা মেয়েটার বাবা-মায়ের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখছে তারা।
“খুব সহজেই কিন্তু ওই ব্যাটাকে ধরা সম্ভব, তাকে চুপ থাকতে দেখে জামান বললো।
“না। ওকে ধরে লাভ হবে না।”
জেফরির এ কথায় জামান কিছুটা নিরাশ হলো। এমন সহজ সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হচ্ছে না। কিডন্যাপিং দলের একজনকে ধরলেই তো খোলাসা হয়ে যাবে সব। তারপর ঝটিকা অভিযান চালালেই সব ব্যাটাকে ধরে ফেলা যাবে, উদ্ধার করা যাবে মেয়েটাকেও।
“আমার ধারণা ওকে ধরলে কিডন্যাপাররা টের পেয়ে যাবে,” আস্তে করে বললো জেফরি বেগ। যেনো সহকারীর মনোভাব বুঝতে পেরেছে। “আমরা অপেক্ষা করবো…মেয়েটার সাথে তার মায়ের কথা হলেই লোকেশনটা জানতে পারবো। মেয়েটার লোকেশন না জানা পর্যন্ত মুভ করা ঠিক হবে না।”
জামান বুঝতে পারলো তার বস একদম নিশ্চিত হতে চাইছে। একটি শিশুর জীবন জড়িয়ে আছে এ ঘটনায়। তাই বাড়তি সতকর্তা নিচ্ছে।
“সম্ভবত কিডন্যাপাররা এমন একজনকে বাড়ির আশেপাশে রেখেছে, যে মেয়েটার অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানে না,” বললো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। ইদানিং অনেকগুলো কিডন্যাপিং কেসে এরকম ঘটতে দেখা গেছে। কিডন্যাপাররা বাড়তি সতকর্তা অবলম্বন করছে আজকাল। হয়তো আগের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট হয়ে গেছে তারা।
জামান মাথা নেড়ে সায় দিলো। হতে পারে। ওরা নিশ্চয় এতোটা বোকা নয়। এ কাজে এমন একজনকে নিয়োজিত করেছে যে ধরা পড়লেও তেমন কিছু জানাতে পারবে না।
“তাহলে আমরা অপেক্ষা করবো, স্যার?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। আশা করছি একটু পরই মেয়েটার সাথে তার মায়ের কথা হবে…হোপ ফর দি বেস্ট।”
.
নবাবপুরের আড়াইতলার একটি রুমে বসে আছে বাবলু আর শুটার সামাদ। একটু আগে তাদের কথাবার্তা মোড় নেয় ব্ল্যাকরঞ্জুর হত্যার ঘটনায়। যদিও গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য দিয়ে বাবলুকে তখন সাহায্য করেছিলো সামাদ, তাকে ফোন করে জানিয়েছিলো ব্ল্যাকরঞ্জু মরে নি, বেঁচে আছে; কোলকাতায় যাকে সে খুন করেছে সে অন্য কেউ, কিন্তু পুরো ঘটনাটি বিস্তারিত শোনা হয় নি তার। আজ সুযোগ পেয়ে অনেক কিছু জেনে নিলো। বাবলু অবশ্য বার বার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলো। নষ্ট করার মতো সময় তার নেই। ব্যাপারটা ধরতে পেরে শুটার সামাদও আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
“এখন বলো আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” সরাসরি কাজের কথায় চলে এলো সে।
“দুদু মামুর খোঁজ কিভাবে পাবো?” বাবলু বললো।
শুটার সামাদ বন্ধ দরজার দিকে তাকালো তারপর বাবলুর দিকে ফিরে বললো, “একজন ফেন্সিডিলের ব্যবসায়িকে খুঁজে বের করাটা কঠিন কিছু হবে না। আমার ধারণা ওকে তুমি সহজেই পেয়ে যাবে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছে। বুঝতে পারলো দুদু মামু যেহেতু শুটার সামাদের ক্লায়েন্ট তাই নিজে তার খোঁজ দেবে না। এটা তার নিজস্ব নিয়ম। তবে কিভাবে খোঁজ পাবে সেটা বুঝে গেলো বাবলু।
“তাহলে এখন কি করবে? জিনিস-টিনিস কিছু নেবে না?”
বাবলু জানে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এখান থেকে দ্রুত নিয়ে নিতে হবে। একটু ভেবে বললো, “দুটো পিস্তল…একটা ভারি ক্যালিবারের, অন্যটা হালকা। প্রত্যেকটার জন্য বাড়তি ম্যাগাজিন লাগবে।”
“আমার মনে হয় অটোম্যাটিক নাইন এমএম আর পয়েন্ট টু ফাইভ হলেই ভালো হবে। ওগুলোর গুলি আমার স্টকে বেশি আছে। বাড়তি ম্যাগাজিনও আছে বেশ কয়েকটি…কয়টা দেবো?”
“প্রত্যেকটার জন্য তিনটা করে,” বললো বাবলু।
“গুলি?”
“তিনটা ম্যাগাজিনে যে কয়টা লাগে।”
“আলগা গুলি নেবে না?”
“না।” বাবলুর ধারণা ম্যাগাজিনে গুলি লোড করার মতো সময় আর সে পাবে না। তিনটি ম্যাগাজিনই যথেষ্ট। কাজ হলে এতেই হবে নইলে শত রাউন্ড নিয়েও লাভ নেই।
“আমার মনে হয় তোমার আরেকটা জিনিস দরকার হবে।” কথাটা বলেই শুটার সামাদ মুচকি হাসলো।
“কি?”
“তোমার খুব প্রিয় জিনিস,” রহস্য করলো অস্ত্র ব্যবসায়ি।
বাবলু বুঝতে পারলো না। অনেক জিনিসই তার প্রিয়, কোনটার কথা বলছে কে জানে।
“বুলেটপ্রুফ ভেস্ট,” নিঃশব্দে হাসতে লাগলো সামাদ।
ও, মনে মনে বললো সে। দীর্ঘদিন এ লাইনে কাজ করে নি, তাই এটার কথা ভুলেই গেছিলো। “এরকম কিছু আছে নাকি?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সামাদ। “আছে। এবারেরটা আরো বেশি সফিসটিকেটেড। খুবই পাতলা। মেইড ইন জার্মানি। এসব জিনিস আমি যাকে তাকে ভাড়া দেই না।”
মুচকি হাসলো বাবলু। “তাহলে ওটা আমার লাগবে।”
“অবশ্যই লাগবে,” বেশ জোর দিয়ে বললো সামাদ। “আচ্ছা, দুটো অস্ত্রের জন্যেই সাইলেন্সার লাগবে?”
“না,” একটু ভেবে নিলো সে। “নাইন এমএমের জন্যে একটা সাইলেন্সর দিলেই হবে। টু ফাইভের জন্য লাগবে না।”
“ওকে।” শুটার সামাদ উঠে ভেতরের ঘরে চলে গেলো।
পেছন ফিরে বন্ধ দরজার দিকে তাকালো বাবলু। ভালো করেই জানে ওপাশে কেউ একজন আছে। তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দেখা দিলো।
কিছুক্ষণ পর একটা বাক্স নিয়ে ফিরে এলো সামাদ। দুটো পিস্তল, ম্যাগাজিন আর বুলেটপ্রুফ ভেস্টটা বের করে বাবলুর সামনে রাখলো। “ম্যাগাজিনগুলো ফুল লোড করা আছে, চাইলে তুমি চেক করে দেখে নিতে পারো।”
বাবলু চেক না করেই চারটা ম্যাগাজিন পকেটে ভরে পিস্তল দুটো কোমরে গুঁজে নিলো। তারপর শার্ট খুলে বুলেটপ্রুফ ভেস্টটা পরে নিলো শুটার সামাদের সামনেই। পকেট থেকে টাকার বান্ডিল বের করে ডেস্কের উপর রাখলো সে। “ষাট হাজার আছে।”
সামাদ বান্ডিলটা নিয়ে ড্রয়ারে রেখে দিলো।
এবার অন্য পকেট থেকে কিছু ডলার বের করে সামাদের দিকে বাড়িয়ে দিলো বাবলু। দিল্লি থেকে দেশে ফেরার পর এগুলো আর ভাঙানো হয় নি। “তিন শ’ ডলার আছে।”
একটু অবাক হয়ে ডলারগুলোর দিকে তাকালো শুটার।
“অনেকদিন ধরে আমার কাছে পড়ে আছে, কাজে লাগছে না। আপনি ভাঙিয়ে নিয়েন।”
ডলারগুলো হাতে নিয়ে সামাদ বললো, “এটার তো কোনো দরকার ছিলো না, পরে দিলেও চলতো।”
মুচকি হাসলো বাবলু। “বলা তো যায় না, হয়তো দেখা গেলো আমি আর ফিরে এলাম!”
শুটার সামাদ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো তার দিকে। কথাটার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার চেয়ে বাস্তবতার উপলব্ধিই বেশি আছে বলে মনে হলো।
অবশ্য বাবলুও জানে না কেন তার মুখ দিয়ে কথাটা বের হয়ে গেলো। “আপনার কাছে আর ঋণী থাকতে চাই না।”
“ধুর, তুমি যে কী বলো না,” কথাটা বলেই সামাদ হেসে ফেললো। “ঐসব থার্ডক্লাস ছ্যাচরদের সাফ করে সহিসালামতে ফিরে আসবে। শুধু একটু সাবধানে থাকতে হবে তোমাকে। আবেগের বশে কাজ কোরো না। এটা আমার অনুরোধ।”
মুচকি হাসলো বাবলু। পুরো ব্যাপারটাই তো আবেগের তোড়ে করছে! আবেগ ছাড়া কেউ কি তার ভালোবাসার মানুষটির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে? তাও যদি সে মানুষটা তার হতো!
হাত বাড়িয়ে দিলো বাবলু।
“দাঁড়াও,” সামাদ তার হাতটা না ধরে বাক্স থেকে একটা গ্রেনেডজাতীয় জিনিস বের করে আনলো।
অবাক চোখে জিনিসটার দিকে চেয়ে রইলো বাবলু।
“এটা কিন্তু গ্রেনেড না। একধরণের টিয়ারগ্যাস সেল…গ্রেনেডের মতো পিন খুলে ব্যবহার করা হয়।”
“এ জিনিস আপনি পেলেন কোথায়?”
এবার দাঁত বের করে হাসলো সামাদ। “পুলিশের এক লোকের কাছ থেকে কিনেছিলাম। সম্ভবত এরকম কিছু গ্যাস-গ্রেনেড স্যাম্পল হিসেবে তাদের কাছে ছিলো, ওখান থেকে একটা বেহাত হয়ে আমার কাছে চলে আসে।”
বাবলু জানে শুটার সামাদ অসৎ পুলিশদের কাছ থেকে জব্দ করা গুলি আর অস্ত্র কেনে।
“আমার কাছে যারা আসে তাদের তো এ জিনিসের দরকার পড়ে না। খালি খালি পড়ে ছিলো।”
আর কথা না বাড়িয়ে জিনিসটা পকেটে ভরে নিলো বাবলু।
“এর জন্য অবশ্য তোমাকে কোনো দাম দিতে হবে না,” হেসে বললো সামাদ। “ওটা আমি গিফট হিসেবে দিলাম।”
“থ্যাঙ্কস ভাই,” বললো বাবলু।
“আমার মনে হয় ওটার দরকার হবে তোমার।”
শুটার সামাদের সাথে হাত মিলিয়ে বেরিয়ে এলো সে। যেমনটি ভেবেছিলো, সিঁড়ির কাছে দেখা হয়ে গেলো বোবা ছেলেটার সাথে। সামাদের এই ভবনের সবকিছু দেখাশোনা করে এই ছেলে। বোমা বানাতে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় তার ভোকাল কর্ড নষ্ট হয়ে গেলে চিরতরের জন্য বোবা হয়ে যায়। ছেলেটাকে খুব স্নেহ করে বাবলু। যখনই আসে বখশিস দেয়। ব্ল্যাকরঞ্জুর দলের নাগাল পেতে এই ছেলেটা বেশ সাহায্য করেছিলো। সম্ভবত আজকেও কিছু সাহায্য পাবে এর কাছ থেকে। একটু আগে কথা বলার সময় শুটার সামাদ সেটার ইঙ্গিত দিয়েছিলো তাকে।
পকেট থেকে দুটো এক হাজার টাকার নোট বের করে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিলে সে মুচকি হেসে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো বাবলুর হাতে। চিরকুটটা পকেটে ভরে নেমে এলো আড়াইতলা থেকে।
একটু হেঁটে পকেট থেকে চিরকুটটা বের করে পড়লো :
মালিটোলার ফেন্সি পলাশের কাছে যান। মনিরের ক্যারামবোর্ডে পাবেন। আমার নাম বলবেন। দুদু মামু কোথায় আছে সে জানে।
চিরকুটটা পেয়ে বাবলুর মধ্যে একটু উত্তেজনা তৈরি হলো। ফুটপাতের একপাশে দাঁড় করানো বাইকটায় উঠে বসলো সে। ঠিক এভাবেই বোবা ছেলেটার কাছ থেকে ছোট্ট একটি সূত্র পেয়ে ব্ল্যাকরঞ্জর দলের পেছনে। লেগেছিলো সে। খুব দ্রুতই নাগাল পেয়ে গেছিলো শীর্ষসন্ত্রাসীর ঘনিষ্ঠজনদের। এবারও তাই হবে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, ঐ দুদু মামুকে খুব বেশি সময় দেবে না। তার কাছ থেকে খুব দ্রুত জেনে নেবে সব।
বাবলুর বাইকটা যানবাহনের ভীড়ের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে চললো পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।
অধ্যায় ১২
অন্ধকারে বসে আছে দিহান। ঘুমে ঢলে পড়ছে সে। আজ সকাল থেকেই ঘুমের মধ্যে আছে। এতো লম্বা সময় ধরে কখনও ঘুমায় নি। শরীরটা কেমন জানি করছে এখন। সে বুঝতে পারছে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হৃদস্পন্দন যে একটু ধীরগতির হয়ে গেছে সেটা অবশ্য ধরতে পারছে না।
এক অজানা আশংকায় জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করছে ছোট্ট মেয়েটি। তার কোলে প্রিয় টেডিবিয়ারটা। বদমাশগুলো তাকে তুলে আনার সময় এটাকে আকড়ে ধরে রেখেছিলো বুকের কাছে। ড্রাইভার মামার খুন হবার দৃশ্যটা তার চোখে বার বার ভাসছে। ভয়ঙ্কর দেখতে এক লোক পিস্তল বের করে সোজা গুলি করে বসে বাতেন মামার মাথায়। তারপর তাকে পাজাকোলা করে তুলে নেয়া হয় কালো রঙের একটি মাইক্রোবাসে। একজন শক্ত করে তার মুখটা চেপে রেখেছিলো। কানে কানে ভয় জাগানিয়া কণ্ঠে বলেছিলো, একদম চুপ থাকতে। টু শব্দ করলে তাকেও মেরে ফেলা হবে। দিহান অবশ্য কোনো শব্দ করতে পারে নি। এতোটাই ভয় পেয়েছিলো যে নিঃশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছিলো। খারাপ লোকগুলো যা যা করতে বলেছে সে তা-ই করেছে। ওদের অবাধ্য হওয়ার কোনো চেষ্টাই করে নি। তারপরও সে ভয় পাচ্ছে এই লোকগুলো হয়তো তাকে মেরে ফেলবে।
কথাটা ভাবতেই হাত-পা কেঁপে উঠলো। সারাদিন সে কিছুই খায় নি কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, তার কোনো ক্ষিদেও নেই। শুধু গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ভয়ে এতোটাই আড়ষ্ট হয়ে আছে যে একটু পানিও চাইছে না কারো কাছ থেকে। ঢোক গেলার মতো ক্ষমতাও নেই এখন। ঢোক গিলতে গেলে গলার ভেতরে জিভটা কেমন জানি আটকে আসে।
চারপাশে তাকানোর চেষ্টা করলো না দিহান। তার চোখ শক্ত করে কাপড় দিয়ে বাধা। তবে সে টের পাচ্ছে উঁচু একটা কিছুর উপরে বসে আছে। এখানে তাকে নিয়ে আসার সময় চোখ আর মুখ বাধা ছিলো। একটু আগে মুখের বাধন খুলে দিয়ে গেছে একজন। ধমকের সুরে শাসিয়ে দিয়ে বলেছে কোনো শব্দ না করতে। তারপর একটা ইনজেকশন দিয়েছে তাকে। ইনজেকশন খুব ভয় পায় দিহান, যতোবার আম্মু-আব্ব তাকে ইনজেকশন দিতে নিয়ে গেছে ততোবারই সে খুব কান্নাকাটি করেছে, কিন্তু আজ একটুও শব্দ করে নি। এই লোকগুলো তো ডাক্তার না তবুও কেন তাকে ইনজেকশন দিলো?
ছোট্ট দিহান এই প্রশ্নের জবাব জানে না। এক অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলো। ঐ বদমাশগুলো হয়তো তাকেও মেরে ফেলবে!
দিহান বুঝতে পারছে সে এমন একটা ঘরে আছে যেখানে কোনো দরজা নেই! দরজা খোলা কিংবা বন্ধ করার কোনো শব্দ শুনতে পায় নি। আরো বুঝতে পারছে তার পেছনে আস্তরবিহীণ একটি ইটের দেয়াল রয়েছে। জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করলো। তার ধারণা ঘুমিয়ে পলেই সে মারা যাবে।
টেডিবিয়ারটা বুকের সাথে চেপে ধরে ফোপানো কান্না দমিয়ে রাখলো সে। বিড়বিড় করে বললো, “মন্টি, কেঁদো না। তোমাকে ওরা কিছু করতে পারবে না! আমি আছি না?”
.
মালিটোলার একটি সংকীর্ণ গলিতে ঢুকলো বাবলু। এখানে ঢুকতেই দেখতে পেলো একটা চুল কাটার সেলুন। এই এলাকায় মনির নামে কেউ যদি ক্যারামবোর্ড ভাড়া দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তো সেলুনের নাপিতের কাছ থেকে সেটা জানা যাবে খুব সহজেই।
তাই হলো। অল্পবয়সী এক নাপিত বয়স্ক একজনের আধা কাঁচা-পাকা চুলে কলপ লাগাচ্ছে। বাবলুকে দেখে একগাল হেসে ইশারা করলো পাশের চেয়ারে বসে পড়তে।
“এই তো হয়া গেছে…একটু বহেন,” বললো সে।
কিন্তু বাবলু চেয়ারে না বসে নাপিতের কাছে জানতে চাইলো মনিরের ক্যারামবোর্ডটা কোথায়।
অল্পবয়সী নাপিত একটু হতাশ হলো। তার দিকে না তাকিয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলে দিলো, একটু সামনে গিয়ে ডাইনে মোড় নিলেই পেয়ে যাবে মনিরের ক্যারামবোর্ড।
বাইক নিয়ে সংকীর্ণ গলি দিয়ে কিছুটা পথ এগোবার পর ডান দিকে মোড় নিতেই দেখতে পেলো পাঁচ-ছয়জন লোক জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা বড়সড় ক্যারামবোর্ড ঘিরে। জটলার দিকে এগিয়ে গেলো বাবলু। এক পাশে বাইকটা রেখে নেমে গেলো সে। যে লোকগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে তারা লম্বায় বাবলুর চেয়ে খাটো, খুব সহজেই তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলো লুঙ্গি পরা দু’জন ক্যারাম খেলছে। একজনের মুখে সিগারেট। ঠোঁটের এককোণে চেপে রেখে সমানে গুটি ফেলে যাচ্ছে এক এক করে। মনে হচ্ছে বোর্ডের সবগুলো গুটিই সে ফেলে দেবে এক দানে। লোকটার খেলার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় দিনরাত এই ক্যারাম নিয়েই পড়ে থাকে। দু’হাতে বোর্ডের উপর মাখানো বোরিক পাউডার লেগে আছে। ঠোঁটে চেপেই সিগারেট টেনে যাচ্ছে সে।
বাবলুকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। নিমেষে সবগুলো গুটি ফেলে দিয়ে সিগারেটে লম্বা টান মারলো। তার প্রতিপক্ষ দারুণ হতাশ হয়ে বোর্ডে গুটি সাজাতে শুরু করলো আবার।
খেলা শেষ হবার আগেই বাবলু জেনে গেছে এই পাকা খেলোয়াড়টিই হলো ফেন্সি পলাশ। তার চারপাশে জড়ো হয়ে থাকা দুএকজন এ নামেই তাকে সম্বোধন করছিলো, বাহবা দিচ্ছিলো।
বাবলু তার কাছে এসে বললো, “আপনার নাম কি পলাশ?”
ভড়কে গেলো ক্যারাম খেলোয়াড়। এতোক্ষণ বাবলুকে সে খেয়ালই করে নি। যখন খেয়াল করলো তখন বাবলু ঠিক তার বাম দিক ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে।
“আ-আপনে?…”
বাবলু আর কথা না বলে বোবার কথা বললো। হাফ ছেড়ে বাঁচলো ফেন্সি ব্যবসায়ি।
“আরে মিয়া, আমি তো ডরায়া গেছিলাম,” বলেই সিগারেটটা ফেলে দিলো পলাশ। “আপনেরে দেইহা তো ভাবছিলাম ডিবি’র লোক কিনা।” দাঁত বের করে হেসে বললো, “লোকাল থানা আমার ম্যানেজ করা আছে। মাগার ডিবি হালার পোলারা মাজেমইদ্যে জ্বালায় খায়।” একটু থেমে প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়কে ইশারা করলো সে। “ওই, তরা খ্যালতে থাক…আমি আইতাছি।”
বাবলুকে নিয়ে একটা চিপা গলিতে ঢুকলো সে। একেবারে নিরিবিলি।
গলিটা বড়জোর চার-পাঁচ ফুট চওড়া হবে। একপাশে সরু ড্রেন চলে গেছে। ওখানে মাঝবয়সী এক লোক লুঙ্গি তুলে হাটু ভাঁজ করে প্রস্রাব করছে।
লোকটার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে গজগজ করতে করতে বললো ফেন্সি পলাশ, “ওই মিয়া, আর জায়গা পান না…গলিটারে তো পায়খানা বানায়া ফালাইছেন।”
লোকটা তার আকামের মাঝখানে উঠে কাচুমাচু খেয়ে চলে গেলো গলির ভেতরে।
“এইবার কন, কামটা কি?”
বাবলু আস্তে করে বললো, “আমি দুদু মামুকে খুঁজছি।”
একটু অবাক চোখে তাকালো বাবলুর দিকে। আপাদমস্তক আরেকবার দেখে নিলো তাকে। “তারে খুঁজছেন ক্যান?”
“আছে একটা দরকার,” কথাটা বলেই পাঁচ শ’ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দিলো পলাশের দিকে।
নোটটা হাতে নিলো না ফেন্সিডিল ব্যবসায়ি। তার দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “আপনে কোন্ লাইনের লোক বুঝবার পারতাছি না।”
“আপনার অতো কিছু বোঝার দরকার নেই। শুধু বলেন দুদু মামুকে কোথায় পাওয়া যাবে,” বাবলু বেশ কাটাকাটাভাবে বললো।
“অই মিয়া, আমারে কি ইনফরমার মনে অয় নি?” চটে গেলো পলাশ। “চিপার মইদ্যে নিয়া একটা নোট দিয়া কইবেন দুদু মামু কই আর আমি তোতাপাখির মতো কইয়া দিমু?”
পাঁচ শ’ টাকার নোটটা পকেটে রেখে দিলো বাবলু। “তাহলে আমাকে কি করতে হবে?” শান্তভঙ্গিতে বললো সে।
“আপনেরে কইতে অইবো দুদু মামুর লগে আপনের কারবারটা কি…ঘটনা যাইহোক, কইতে অইবো। আমি কুনো রাস্তার পোলাপান না। একটা নোট ধরাইয়া কইবেন আর আমি তোতা পাখির মতো কইতে লাগুম, অ্যাঁ?” তিক্তমুখ করে বললো সে। “আপনে যদি আমারে বিশ্বাস করবার না পারেন তো ফোটেন।”
ফেন্সি পলাশের কথা শেষ হলে বাবলু মুচকি হাসি দিলো। ছেলেটাকে খুব ভালোভাবে বিচার না করেই টাকা দেয়াটা ঠিক হয় নি। যাইহোক, সে এবার অন্য পথে এগোলো।
“বিশ্বাস না করলে তো আর আপনার কাছে আসতাম না। বোবাও আপনার কাছে আমাকে পাঠাতো না…”
“ওইটা ঠিকই কইছেন, মাগার আপনেরে কইতে অইবো কামটা কি।” নাছোরবান্দা পলাশ।
একটু চুপ থেকে আস্তে করে বললো বাবলু, “দুদু মামু আমার এক ঘনিষ্ঠ লোকের সাথে খুব খারাপ কাজ করেছে।”
“ঐ হালায় খারাপ কাম করবো না তো ক্যাঠায় করবো?” বাঁকা হাসি দিলো পলাশ। “ইবলিশের ছোটো ভাই খান্নাসূরে চিনেন?” বাবলু মাথা দোলালো। সে খান্নাস চেনে না। “ঐ হালার বুইড়ারে দেখলে খান্নাস কারে কয় বুঝবার পারবেন। বয়স অইতাছে মাগার আকাম-কুকাম ছাড়ে না। হালায় তো সন্ত্রাসী বানাইবার কারখানা! কব্বরে যাওনের আগে শয়তানি ছাড়বোও না মনে অয়।”
“চিন্তার কোনো কারণ নেই,” বললো বাবলু। “খুব জলদি সে কবরে চলে যাবে।”
কথাটা শুনে পলাশ চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। “লগে মাল-টাল কিছু আছে নি?” তর্জনী দিয়ে পিস্তলের টুগার টেপার ভঙ্গি করলো সে। মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু। “তাইলে সোজা চইলা যান দক্ষিণ মুসুন্দি…বড় মসজিদের উল্টা দিকে যে মুদি দোকানটা আছে, ওইটার পিছনে একটা লাল রঙের তিনতলা দালানের উপরে থাকে। একলাই থাকে। কোনো সমস্যা নাই। এহন মনে অয় ঘুমাইতাছে। সারা রাইত মাল টানে আর জুয়া খেলে।”
হাত বাড়িয়ে দিলো বাবলু। “অনেক উপকার করলেন, ভাই।”
ফেন্সি পলাশ তার হাতটা ধরলো। “সাবধানে থাইকেন। বুইড়া অইলেও জিনিস কিন্তু কড়া।”
মুচকি হেসে বাবলু গলি থেকে বেরিয়ে এসে বাইকে চড়ে বসলো। তার গন্তব্য এখন খুব কাছের একটি মহল্লা দক্ষিণ মৈষণ্ডি।
অধ্যায় ১৩
কমিউনিকেশন্স রুমে বসে আছে জেফরি বেগ। তার মেজাজ খারাপ। একটু আগে রেবা ফোন করেছিলো। দেখা করতে চায়, কিন্তু পরিস্থিতি এমনই যে রুম থেকে বের হতে পারছে না। যে-কোনো মুহূর্তে টেলিফোনে। অপহরণকারীদের হাতে জিম্মি হওয়া বাচ্চা মেয়েটির সাথে তার মায়ের কথা হবে। সেই ফোনটার জন্যেই জেফরির যতো অপেক্ষা। ফোনটা আসামাত্র কাজে নেমে যেতে পারবে তারা।
রেবাকে পুরো ব্যাপারটি খুলে বলে নি, শুধু বলেছে জরুরি একটা কাজে আটকে গেছে। সম্ভবত আজ দেখা হচ্ছে না। এ কথা শুনেই ফোন রেখে দেয় রেবা। এরপর জেফরি কয়েকবার কল করেছে কিন্তু ফোন ধরে নি। একটা মেসেজ পাঠিয়েছে, তারও কোনো জবাব পায় নি। এদিকে অপহরণকারীরাও ফোন করছে না। নিষ্ফল একটা মুহূর্ত কাটছে। কিছুই করার নেই। না পারছে রেবার সাথে দেখা করতে না পারছে নতুন কোনো পদক্ষেপ নিতে। চুপচাপ কমিউনিকেশন্স রুমে বসে মগের পর মগ কফি খেতে কততক্ষণই বা ভালো লাগে। কড়া কফির কারণে মুখটাও বিস্বাদ হয়ে গেছে এরইমধ্যে।
তার সহকারী জামান মোবাইলফোনে গেম খেলে সময় পার করছে। জেফরি জানে রেবার সাথে একটু আগে যে মনোমানিল্য হয়েছে সেটা আঁচ করতে পেরেছে সে।
“স্যার?”
জামানের কথায় মুখ তুলে তাকালো জেফরি বেগ।
“মনে হচ্ছে ওরা এতো তাড়াতাড়ি ফোন করবে না।”
জেফরি কিছু বললো না। সহকারীর আসল কথাটার জন্য অপেক্ষা করলো।
“এই ফাঁকে আপনি বাইরে থেকে ঘুরে আসতে পারেন, আমি তো এখানে আছিই, নতুন কোনো আপগ্রেড পেলে আপনাকে ফোনে জানিয়ে দেবো?”
ছেলেটা মন্দ বলে নি, মনে মনে বললো জেফরি। এখানে বসে থাকতে থাকতে একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হয়ে গেছে। বাইরে থেকে একটু ঘুরে এলে ভালোই হয়, রেবার অভিমানও ভাঙানোর সুযোগ পাওয়া যাবে। মেয়েটা নিশ্চয় মন খারাপ করে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছে।
তাছাড়া জেফরিরও মনে হচ্ছে অপহরণকারীরা এতো ঘনঘন ফোন করবে না। যদি করেও জামান সেটা মনিটর করবে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানতে পেলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেবে। ঠিক করলো, বাসায় গিয়ে শাওয়ার নেবে তারপর রেবাকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াবে কাছে কোথাও।
জামানকে রেখে চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে গেলো সে।
.
দক্ষিণ মৈষণ্ডির চিপা গলিতে বাইক নিয়ে ঢুকে পড়লো বাবলু। সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে গলিগুলো। কিছু কিছু গলি এতোটাই সরু যে বাইক নিয়ে ঢোকাও মুশকিল। বাবলু এসব অলি-গলি ভালো করেই চেনে। তার আন্ডারওয়ার্ল্ডের জীবনের পুরোটা সময় এসব এলাকায়ই কেটেছে। আজ অনেকদিন পর এলেও সবকিছু আগের মতো চেনা চেনাই মনে হলো তার কাছে। সে জানে ফেন্সি পলাশ যে মসজিদের কথা বলেছে সেটা কোথায়। তিন-চারটা গলি পেরিয়ে চলে এলো মসজিদের সামনে।
মসজিদের উল্টো দিকে মুদির দোকানটা চোখে পড়লো। বাইকটা রাখলো দোকানের পাশে। মাঝবয়সি দোকানি এক কাস্টমারকে পেঁয়াজ মেপে দিচ্ছে। বাবলু গিয়ে দাঁড়ালো তার দোকানের সামনে।
“একটা হাফ লিটারের প্রাইট আর এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট দিন,” বললো সে।
ক্রেতার কাছ থেকে পেয়াজের দাম নিয়ে বাবলুর দিকে একটা প্রাইট আর বেনসনের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো মুদি।
প্রাইটটার মুখ খুলে এক ঢোক পান করলো সে। এই দুটো জিনিস কিনেছে যাতে করে মহল্লার লোকজনের কাছে তাকে বহিরাগত বলে মনে
হয়। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কোল্ডড্রিঙ্কস খেতে খেতে বাড়ি ফিরছে একজন-দৃশ্যটা এমন ধারণা দেবে যে, বাবলু এই মহল্লারই কোনো বাসিন্দা। সেই সাথে দোকানির সাথে একটু আলাপ জমিয়ে তথ্য জানার সুযোগও পাওয়া যেতে পারে। বাবলু মনে করছে এই মুদির কাছ থেকে কিছু জানা গেলেও জানা যেতে পারে।
“আর কিছু লাগবো?” দোকানি জানতে চাইলো।
পকেটে বেনসনের প্যাকেটটা রেখে এক হাজার টাকার নোট বের করে দিলো সে।
“ভাঙতি নাই?” বললো দোকানি।
মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো। তার কাছে কোনো ভাঙতি নেই। “সমস্যা নেই। আপনি টাকাটা রাখেন, একটু পরে দিলেও হবে। আমি দুদু মামুর বাসায় যাচ্ছি। ফেরার সময় ভাঙতি নিয়ে যাবো, ঠিক আছে?”
“আচ্ছা,” বলেই দোকানি টাকাটা রেখে দিলো।
“মামু তো বাড়িতেই আছে, না?” আরেক ঢোক স্প্রাইট খেয়ে বললো সে।
“হ…মনে হয় ঘুমাইতাছে।”
যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো দুদু মামু বাসায় আছে। “মামু কি সব সময় এতো দেরি করে ঘুম থেকে উঠে?” ক্যানটার মুখ লাগাতে লাগাতে বললো বাবলু।
“না, মাজেমইদ্যে সকালেও উঠে। কামকুম থাকলে আর কি।”
“ঠিক আছে, এইটা একটু দেখে রাখবেন, বাইকটা দেখিয়ে বললো। “দুদু মামুর ওখানে তো কেউ নেই, থাকলে একজনকে পাঠাতাম এটা দেখে রাখার জন্য।”
“সমস্যা নাই, আপনে যান,” বললো দোকানি।
বাবলু প্রাইটের ক্যানটা হাতে নিয়ে সোজা চলে গেলো দোকানের পাশ দিয়ে যে সরু গলিটা চলে গেছে সেখানে। গলিটা লম্বায় একশ’ ফুটের মতো হবে। দু’পাশে বেশ কয়েকটি একতলা-দোতলা বাড়ি। তবে শেষ মাথায় যে বাড়িটা আছে সেটা তিনতলা এবং লাল রঙের। এটার কথাই ফেন্সি পলাশ তাকে বলেছে।
পুরনো ঢাকার বেশিরভাগ বাড়ির মতো এই বাড়ির সদর দরজাটাও খোলা, পাহারা দেবার জন্য কেউ নেই। বিনা বাধায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলো সে। তিনতলায় থাকে দুদু মামু। কিন্তু কোন্ পাশের ঘরে থাকে সেটা ফেন্সি পলাশও জানে না। জানলে তাকে বলতো। এটা অবশ্য বড় কোনো সমস্যা নয়।
তিনতলায় উঠে দেখতে পেলো ডানে-বামে দুটো দরজা। একটা খোলা, আরেকটা বন্ধ। সময় নষ্ট না করে ডান দিকের বন্ধ দরজায় টোকা মারলো সে।
ভেতর থেকে বয়স্ক একটা কণ্ঠ জবাব দিলো : “ক্যাঠা রে?”
বাবলু আবারো টোকা দিলো।
সশব্দে দরজাটা খুলে গেলে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা মাঝবয়সি এক লোককে দেখা গেলো।
দুদু মামু? সম্ভবত। তবে নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। “স্লামালেকুম,” বললো বাবলু। এক পলকে ভেতরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো আর কেউ নেই। তাহলে এটাই দুদু মামু!
“ওয়ালাইকুম…” মাঝবয়সি লোকটা তার দিকে ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো। চোখেমুখে সন্দেহ। বাবলুকে পরখ করে নিচ্ছে দ্রুত।
“সালাম মিস্ত্রিকে চাচ্ছিলাম, উনি কি-”
বাবলুর কথার মাঝখানে বাজখাই গলায় বলে উঠলো স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি, “এইহানে কুনো সালাম মিস্ত্রি থাহে না।”
অবশ্যই থাকে না। মনে মনে বললো সে। “কিন্তু নীচের মুদি দোকানদার যে বললো তিনতলার ডান দিকের”।
আবারো কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো সম্ভাব্য দুদু মামু, “ওই মুদি হালায় এইটা কইছে নি?” মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু। “চুদানিমাগির পুতের খায়দায়া আর কাম নাই…মাইনষেরে উল্টাপাল্টা ঠিকানা দেয়।”
“তাহলে সালাম মিস্ত্রি এখানে থাকে না?”
“কইলাম না থাহে না,” যারপরনাই বিরক্ত মাঝবয়সি খিটখিটে মেজাজের লোকটা।
“মুদি হয়তো ভুলে ডান দিকের ঘরের কথা বলেছে,” একটু হেসে বললো সে।
“ঐ হালারপুতে আফনেরে পুরাটাই ভুল ঠিহানা দিছে…এইহানে সালাম মিস্ত্রি বইলা কেউ থাহে না।”
“সরি, আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম।”
আর কোনো কথা না বলে বিরক্ত হয়ে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিলো মাঝবয়সি লোকটি।
বাবলু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। প্রাইটের ক্যানটা দরজার পাশে রেখে চারপাশটা একটু দেখে নিলো। তারপর কোমর থেকে নাইন এমএম-এর সাইলের পিস্তলটা বের করে আবারো দরজায় টোকা মারলো সে।
“আবার ক্যাঠা?” বাজখাই গলাটা বলে উঠলো ভেতর থেকে।
কোনো জবাব না দিয়ে টোকা মারলো আবার।
ধপাস করে দরজাটা খুলে গেলো এবার। চোখেমুখে প্রচণ্ড ক্রোধ নিয়ে বাবলুর দিকে তাকাতেই জমে গেলো লোকটা। তার কপাল বরাবর পিস্তল তা করে রাখা।
“দুদু মামু, কোনো আওয়াজ করবেন না,” শান্তকণ্ঠে বললো বাবলু।
লোকটা এক পা পিছু হটে গেলে আস্তে করে দরজার ভেতরে ঢুকে পড়লো বাবলু। চোখ সরালো না তার দিক থেকে, একহাতে দরজাটা বন্ধ করে দিলো এবার।
“আপনে ক্যাঠা?” শান্তকণ্ঠেই বললো মামু। মনে হচ্ছে যথেষ্ট ভয় পেয়ে গেছে।
বাবলু ঘরের ভেতরটা চকিতে দেখে নিলো। একটা আমকাঠের খাট, আলমিরা, কাপড় রাখার আলনা আর মাঝারি সাইজের রেফ্রিজারেটর ছাড়া আর কিছু নেই। ঘরটার আয়তন বড়জোর বারো বাই পনেরো ফিট হবে। ডান দিকে একটা অ্যাটাচড বাথরুমের দরজা দেখতে পেলো।
দুদু মামুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে খাটের উপর বসতে ইশারা করলো তাকে। চুপচাপ বসে পড়লো ডাকাইত শফিকের মন্ত্রণাদাতা। বাবলুর পিস্তলের সাইলেন্সারের দিকে চেয়ে আছে সে। এরকম জিনিস জীবনে দেখে নি।
“আমি যা জানতে চাইবো সত্যি সত্যি বলবি, নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই,” কথাটা বলেই পিস্তলের নল ঠেকালো মামুর কপালে। “এটা দিয়ে গুলি করলে কোনো শব্দ হয় না। বুঝলি?”
মামু কিছু বললো না, শুধু ঢোক গিললো।
“মেয়েটাকে কোথায় আটকে রেখেছিস?”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো দুদু মামু, তারপরই ভুরু কুচকে ফেললো সে।
“আমি কিছু জানি না, ‘ডাকাইতকে চিনি না’…এরকম কথা বলবি না।”
“ডাকাইতরে চিনি না হেইটা আমি কমু না, কিন্তু মাইয়াটার ব্যাপার বুঝলাম না?” ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো মামু।
“ছয়-সাত বছরের একটা মেয়ে, ডাকাইতের লোকজন তাকে কিডন্যাপ করেছে।”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো মামু। “ডাকাইত হেরে কিডন্যাপ করছে!?” চোখেমুখে অবিশ্বাস।
মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু। “কি কন? এইটা কেমনে সম্ভব!” বেশ জোর দিয়ে বললো এবার।
“কেমনে সম্ভব মানে?” চোখমুখ কুচকে জানতে চাইলো সে। বাম হাতে মামুর চুলের মুঠি ধরে কানে নল ঠেকালো। “আমি তো বলেছি, আমার হাতে বেশি সময় নেই। ডাকাইতকে বাঁচানোর চেষ্টা করবি না। কোনো লাভ হবে না। যেভাবেই হোক ডাকাইতকে আমি চাই।”
দু’পাশে মাথা দোলালো মামু। তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। “আপনে ডাকাইতরে চাইতাছেন?”
বাবলু কিছু বললো না। স্থিরচোখে চেয়ে রইলো শুধু।
“এটটু দেরি কইরা ফালাইছেন, ভাইজান।”
“কি!”
দুদু মামুর ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি দেখা দিলো।
অধ্যায় ১৪
সকাল থেকে যে মানসিক চাপ শুরু হয়েছে সেটা আর সহ্য করতে পারলো না এহসান চৌধুরি। উপরতলায় নিজের একটি ছোট্ট বার আছে। এমন নয় যে নিয়মিত মদ্যপান করা তার স্বভাব, এ কাজটা সে খুব কমই করে, তবে তার ব্যবসায়িক জগতে যেসব বন্ধুবান্ধব রয়েছে তাদের জন্যে বাড়িতে এরকম আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেই হয়।
বারের রেফ্রিজারেটর খুলে জ্যাক ড্যানিয়েলের বোতলটা বের করে নিলো। গ্লাস নিয়ে কিছুটা ঢালতেই টের পেলো কেউ তার পেছনে এসে দাঁড়িছে। ঘুরে তাকানোর আগেই কণ্ঠটা শুনতে পেলো সে।
“আমার জন্যেও একটু দিও,” তার স্ত্রী আনিকা বলে উঠলো দরজার সামনে থেকে।
হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো এহসান চৌধুরি। অন্যসব ধনী পরিবারের মেয়েদের মতো তার স্ত্রীর মদ্যপানের অভ্যাস নেই। কখনও এ জিনিস ছুঁয়েও দেখে না সে, তবে স্বামীকে পানাহারের ব্যাপারে বাধাও দেয় না। বিয়ের পর ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছে। এই মেনে নেয়ার পেছনে তার পারিবারিক মূল্যবোধও কিছুটা কাজ করেছে-আনিকার বাবা আর ভায়েরা বাড়িতে পানাহার করে।
বিস্মিত হলেও চুপচাপ আরেকটা গ্লাস নিয়ে কিছুটা মদ ঢেলে দিলো এহসান। “র খেতে পারবে?” জিজ্ঞেস করলো স্ত্রীকে।
এখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আনিকা, কোনো কথা না বলে গ্লাসটা হাতে নিয়ে চলে গেলো ঘরের এককোনে সোফার দিকে।
“কখনও খাও নি তো তাই বলছিলাম একটু সফট ড্রিঙ্ক মিশিয়ে দিলে ভালো হতো,” নিজের গ্লাসটা নিয়ে স্ত্রীর পাশে এসে বসলো এহসান।
এক ঢোকে মদটুকু পান করে চোখমুখ বিকৃত করে ফেললো আনিকা।
এহসান চৌধুরি অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো। এতোদিন যে মেয়েটাকে চিনতে সে উধাও হয়ে গেছে। এখন তার সামনে যে বসে আছে সে যেনো অন্য কেউ। গ্লাসে একটা ছোটো চুমুক দিলো সে। আনিকা এখনও তেতো স্বাদটা হজম করতে পারছে না। চোখমুখ কেমন কুচকে আছে তিক্ততায়।
“খারাপ লাগছে?” জিজ্ঞেস করলো দিহানের বাবা।
মাথা দোলালো দিহানের মা।
“তোমাকে একটা কথা বলি?”
“বলো,” নিস্পৃহ গলায় বললো আনিকা।
“ঝামেলা না করে টাকাগুলো ওদের দিয়ে দেই…”
চোখ বন্ধ করে মাথা দোলালো আবার। “টাকা দিলে আমি আমার মেয়েকে ফেরত পাবো না।”
হা করে চেয়ে রইলো এহসান। “তাহলে কী করবো?” অসহায়ের মতো বললো সে। “পুলিশকেও বলতে পারছি না, আমরাও কিছু করছি …আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। এ ঘটনার শেষ কিভাবে হবে?”
স্বামীর দিকে স্থিরচোখে তাকালো সে। “আমার মেয়েকে ফিরে পাবার জন্য যা করার দরকার সবই আমি করবো।”
স্ত্রীর এমন দৃঢ়তায় মুগ্ধ না হয়ে আশ্বস্ত না হয়ে এহসান চৌধুরি বরং আরো বেশি বিস্মিত হলো। “ঠিক আছে,” সায় দিয়ে বললো সে। “যা করার করো কিন্তু কি করছে সেটা আমাকে বলবে না?”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আনিকার ভেতর থেকে।
“ওরা কি বলেছে মনে আছে?…পুলিশ জেনে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
আনিকা বুঝতে পারলো এহসান কেন এ কথা বলছে। তার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে পুলিশের অনেক বড় কর্তা রয়েছে। তার এক ফুপা বর্তমানে ডিআইজি হিসেবে কর্মরত। এক চাচাতো ভাই পুলিশ সুপার। সে হয়তো মনে করছে আনিকা গোপনে ওদের কারো সাথে যোগাযোগ করছে।
“ওরা যেভাবে সব কিছু জেনে যাচ্ছে…বুঝতেই পারছো, যদি টের পেয়ে যায় আমরা পুলিশকে সব জানিয়ে-”।
“পুলিশ কিছু জানে না, জানবেও না,” স্বামীর কথার মাঝখানে বলে উঠলো আনিকা।
কিছু একটা বলতে যাবে এহসান চৌধুরি অমনি ইন্টারকমটা বেজে উঠলো। বারের এককোণে গিয়ে সেটার রিসিভার তুলে নিলো সে। ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ নে গেলো। “হ্যা…একটু ধরো,” বলেই আনিকার দিকে তাকালো। একদৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চেয়ে আছে সে। রিসিভারে হাতচাপা দিয়ে বললো এহসান, “সবুজ বলছে, ওরা ফোন করেছে।”
সবুজ ওদের বাড়ির কাজের লোক।
“লাইনটা উপরে দিতে বলো সবুজকে,” কথাটা বলেই আনিকা সোফার পাশে সাইডটেবিলের উপর রাখা ফোনটার দিকে তাকালো।
এহসান কথাটা সবুজকে বলে দেবার কয়েক সেকেন্ড পরই ফোনের রিং হতেই আনিকা রিসিভারটা তুলে নিলো।
“হ্যালো?” আনিকা ওপাশের কথা শুনে গেলো।
“আমি মিথ্যে বলি নি…” স্বামীর দিকে তাকালো সে। এখন দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে।
“বললাম তো মিথ্যে বলি নি…হ্যা…শুনুন, আপনাদের দরকার টাকা। সেটা আপনারা আগামীকাল পেয়ে যাবেন। দিহানের বাবা সুস্থ আছে নাকি অসুস্থ আছে সেটা নিয়ে আপনাদের ভাবার দরকার নেই। ওর নার্ভ খুব দুর্বল…এখন থেকে আপনাদের সাথে আমিই কথা বলবো…হ্যা…ও সুস্থ থাকুক আর না থাকুক, আমিই কথা বলব…আপনাদের কোনো সমস্যা আছে?…ঠিক আছে, দিহানকে একটু দিন,” আনিকার চোখমুখ আবারো শক্ত হয়ে গেলো।
“আপনি কিন্তু বলেছিলেন একটু পর ওর সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দেবেন…” কিছুক্ষণ ওপাশ থেকে শুনে গেলো সে।
“ঠিক করে বলুন কখন…ও…আপনি কি সব সময় আমাদের বাড়ির আশেপাশে থাকেন নাকি?…খুব নজরদারি করছেন?…” বাঁকা হাসি হাসলো সে। “এর তো কোনো দরকার দেখছি না। পুলিশকে আমরা কিছু বলি নি, বলবোও না…ঠিক আছে…”
ফোনটা রেখে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আনিকা।
“ঘটনা কি?” এহসান চৌধুরি জানতে চাইলো।
“তুমি যে অসুস্থ নও সেটা ওরা জেনে গেছে,” চেহারায় রাগের ছাপ প্রকট। “বলছে, আপনার স্বামী তো অসুস্থ না…কেন মিথ্যা বলেছেন’…’কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না…এইসব,” নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে। “আমি বুঝতে পারছি না ওরা এসব কিভাবে জেনে যাচ্ছে!”
স্ত্রীর কাঁধে একটা হাত রাখলো সে। “আনি, প্লিজ…আমার কথা শোনো। সময় নষ্ট না করে টাকাগুলো ওদের দিয়ে দেই।”
উঠে দাঁড়ালো আনিকা। “না।”
দৃঢ়তার সাথে বলে ঘর থেকে চলে গেলো সে। দরজার কাছে আসতেই টের পেলো মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠেছে। মদের নেশা তাহলে এমন? মনে মনে ভাবলো আনিকা। কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। কিডন্যাপাররা সব কিছু জেনে যাচ্ছে দ্রুত। এই ব্যাপারটা একজনকে জানাতে হবে। এ মুহূর্তে ঐ একজনের উপরেই সে পুরোপুরি নির্ভর করে আছে।
অধ্যায় ১৫
সাপ-লুডু খেলায় সাপে খেলে যেভাবে সোজা তলানিতে চলে যায়, বাবলুর অবস্থা এখন ঠিক তেমন। আকস্মিক এই পতনের ধাক্কা সামলে উঠতে পারছে না। মাথাটাও ঠিকমতো কাজ করছে না তার।
“ভাইগনা শামসু কাইল রাইতে হেরে মাইরা ফালাইছে!” একটু আগে দুদু মামুর বলা কথাটা তার কানে বাজছে এখনও।
ডাকাইত শফিক নাকি খুন হয়েছে কাল রাতে! তারই দলের ভাইগনা শামসু তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। এখনও তার লাশ পড়ে আছে। মেডিকেলের মর্গে। চাইলে সে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারে।
দুদু মামুর এসব কথা শোনার পর কোণঠাসা রাজার মতো জমে আছে। সে। এখন সে কী করবে? দুদু মামুর কথাটা যে সত্যি সেটা খোঁজ করতে হলে তাকে মর্গে যেতে হবে। কিন্তু মামুকে জীবিত রেখে এ কাজ করতে পারবে না। আবার এই বুড়ো বদমাশটাকে খুন করে মর্গে গিয়ে দেখলো তার বলা কথাগুলো একদম মিথ্যে, তখন সে কী করবে? ডাকাইত শফিকের দলের নাগাল পাবার জন্য তার হাতে তো এই একটা সূত্রই আছে।
ডাকাইতের দলের অন্য কারোর নাগাল পেতে হলে অনেক সময় লাগবে, আর সেটাই বিরাট সমস্যা। সময় ক্রমশ কমে আসছে। সকাল থেকে দুপুর, এখন প্রায় বিকেল হতে চলেছে। সে জানে আজকের মধ্যেই তাকে ডাকাইতের নাগাল পেতে হবে। ঠিক করে বলতে গেলে আজকের রাতের মধ্যেই।
এর আগে ব্ল্যাকরঞ্জুর নাগাল পাবার জন্য যখন মাঠে নেমেছিলো তখন তার হাতে বেশ সময় ছিলো। মাঠে নামতেই দ্রুত ফল পেতে শুরু করে সে। অতোটা দ্রুত কাজ হবে সে ভাবেও নি। পরিহাসের বিষয় হলো, এখন তার হাতে একদম সময় নেই, অথচ কাজের কাজ কিছুই এগোচ্ছে না।
দুদু মামুর দিকে তাকালো। লোকটা নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে খাটের উপর।
“মিথ্যে বলছিস, বানচোত,” দাঁতে দাঁত পিষিয়ে বললো বাবলু। সব শোনার পর শুধু এটাই বলতে পারলো।
মুচকি হাসলো মামু। “দলের সবাই জানে হে মইরা গেছে, আফনে খবর নিলেই বুঝবার পারবেন আমি মিছা কইছি কিনা।”
বাবলু কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না।
“ভাইগনা শামসু আমারে ম্যানেজ করবার চেষ্টা করতাছে, ও চাইতাছে আমি যেন ওর লগে থাহি।”
এ কথাটা শোনার পরই বাবলুর মাথায় চট করে একটা আইডিয়া চলে এলো। এক চিলতে হাসি দেখা দিলো তার ঠোঁটে। তার মাথাটা যখন কাজ করতে শুরু করে তখন সে নিজেই অবাক হয়ে যায়। দ্রুত আর কার্যকর সব আইডিয়া আসতে থাকে তখন।
“তার সাথে থাকতে তোর কী সমস্যা?”
স্থিরচোখে চেয়ে রইলো দুদু মামু। “হেরে আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করার কুনো কারণও নাই। হে মানুষ ভালা না।”
“তোদের মধ্যে আবার ভালো মানুষও আছে নাকি?” ব্যঙ্গ করে বললো সে।
ইঙ্গিতটা ধরতে পারলো দুদু মামু। “জানি, আমরা সবাই খারাপ কিন্তু হের মইদ্যে বেশি খারাপও আছে। বেঈমান আর মীরজাফরগো বিশ্বাস করন যায় না। হেরে আমি দুই পয়সা দিয়াও বিশ্বাস করি না।” বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “শফিক ওরে রাস্তা থেইকা তুইলা আনছিলো…খুব আদর করতো ওরে। শফিকরে হে মামা কইয়া ডাকতো…আর দেহেন, কামটা কি করলো…” একটু চুপ থেকে আবার বললো, “আমি শফিকরে কইছিলাম ভাইগনার মতিগতি ভালা না, হের দিকে একটু নজর দিতে, কিন্তু আমার কথা হুনলো না।” যেনো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে।
“শামসু কেন শফিককে খুন করলো?” জানতে চাইলো বাবলু।
“মনে হয়, ভাইগনা হইয়া আর থাকতে চায় না, ডাকাইত হইতে চায়, বিজ্ঞের মতো বললো মামু। “যে কারণে রাজাবাদশাগো ভাইবেরাদর আর পোলারা নিজের বাপ-ভাইরে খুন করতো হেই কারণেই শফিকরে খুন করছে।”
একটু ভেবে নিলো বাবলু। “ডাকাইতের দলের বাকিদের কি অবস্থা? ওরা কি ভাইগনাকে মেনে নিয়েছে?”
“বেশির ভাগই মাইনা নিছে, খালি আমি আর নাটকা শামীম বাদে…”
“নাটকা শামীম এখন কোথায়?”
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মামু। “নাটকারে ওরা আটকাইয়া রাখছে, এতোক্ষণে মনে অয় মাইরাও ফালাইছে।”
“তাহলে তো ওর সাথে যোগ না দিলে তোকেও মেরে ফেলবে?” বললো বাবলু। “অথচ তুই নিজের ঘরে দুপুর পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিস! ব্যাপারটা ঠিক মিলছে না। তোর তো পালিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো।”
“আমি কুনো ক্যাডার না, কামলাও না,” শান্তকণ্ঠে বললো মামু। “আমারে শামসু কিছু করবো না। ওর লগে থাকলে আমার লাভ হইবো, না থাকলে হইবো না। আমি অন্য তরিকার মানুষ। ওর কুনো ক্ষতি আমি করুম না, হেইটা অয় ভালা কইরা জানে।”
“তাহলে তোকে দলে টানতে চাইছে কেন?”
“আমি দলে থাকলে ওর সুবিধা হইবো, তাই।”
“তুই ওর দলে থাকলে ওর সুবিধা, তোরও সুবিধা, তাহলে এখানে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস কেন, বানচোত?” পিস্তলের নল দিয়ে দুদুর কাঁধে একটা খোঁচা দিলো সে।
“শফিক আমার লাইগা অনেক কিছু করছে, ওর রক্তের লগে বেঈমানি করি কেমনে?”
“না,” মাথা দুলিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলো বাবলু। “তোর কথাবার্তা আমার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। তুই এতো ভালো মানুষ না যে, মৃত মানুষের সাথে বেঈমানি করতে তোর বিবেকে বাধবে।”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো মামু। সে বুঝতে পারছে না তার সামনে এই যুবকটি আসলে কী চায়। দেবদূতের মতো দেখতে, কথাও বলে শুদ্ধভাবে। দেখলেই বোঝা যায় শিক্ষিত। এই লোকের ধারণা ডাকাইত শফিক একটা পিচ্চি মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে। হয়তো ঐ মেয়েটার বাবা হবে এই যুবক।
“তোর ফোন কোথায়?” জানতে চাইলো বাবলু।
“ঐ যে,” ঘরের এককোণে ইশারা করলো মামু। আলমিরার কাছে। একটা চেয়ারের উপর রাখা। “চার্জে দিছি।”
“ওটা দিয়ে ভাইগনাকে ফোন দে,” বললো বাবলু। “ওকে বলবি তুই ওর সাথে আছিস।”
দুদু মামু বুঝতে পারলো না তাকে দিয়ে এটা কেন করাতে চাচ্ছে এই অজ্ঞাত যুবক। কিন্তু দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সে জানে অস্ত্রধারীর কথা বিনাবাক্যে মেনে নিতে হয়। মাথা ঠাণ্ডা না রাখলে বিপদ নেমে আসতে পারে। অস্ত্র যার হাতে থাকে তার মাথা মোটেও স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। যদিও দুদু মামু জানে না, তার সামনে যে আছে সে একদম ব্যতিক্রম। অস্ত্র হাতেও তার মাথা ভীষণ ঠাণ্ডা থাকে।
চুপচাপ ফোনটা তুলে নিয়ে এসে আবার খাটের উপর বসলো সে।
“শর্ত দিয়ে বলবি শফিকের লাশ মর্গ থেকে তুলে এনে দাফনের ব্যবস্থা করতে,” আদেশ করলো বাবলু।
মামু এবার বুঝতে পারলো তাকে দিয়ে কেন ফোন করানো হচ্ছে। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ভাইগনা শামসুকে ডায়াল করলো সে।
“লাউডস্পিকারে দিয়ে কথা বল,” নির্দেশ দিলো বাবলু।
দুদু মামু কথামতোই কাজ করলো। বোঝা গেলো ফোনের অপর প্রান্তে ভাইগনা শামসু কল পেয়ে অবাক হয়েছে।
“আরে মামু দেহি আমারে ফোন দিছে?” হাসিমুখে বললো সে। “আমার কপাল!” খুশি হবার অতি নাটকীয় অভিনয় করলো ভাইগনা। “মত পাল্টাইছো নি, মামুজান?”
দুদু মামু বাবলুর দিকে তাকালো। তার পিস্তলের নল আবারো কপাল বরাবর তা করা। “শামসু, আমি তোর লগে আছি কিন্তু একটা শর্তে…”
“কি কইলা?”
“আমার একটা শর্ত আছে।”
“কি শর্ত, কইয়া ফালাও মামু?”
উদ্যত পিস্তলের দিকে চেয়ে ঢোক গিলে বললো দুদু, “শফিকের লাশটা এহনও মেডিকেলে পইড়া আছে…আমি চাই ওর লাশটা তুই দাফনের ব্যবস্থা করবি।”
একটু চুপ থেকে বললো ভাইগনা শামসু, “মামু, এইটা বাদে অন্য কিছু কও…এইটা তো করন যাইবো না।”
“ক্যান যাইবো না?” জানতে চাইলো দুদু।
“আরে মামু তুমি বুজো না?…পুলিশ কেস হইছে, হের লাশটা তো বেওয়ারিশ লাশ অয়া পইড়া আছে…কেউ কেলেম করতাছে না।”
বাবলুর দিকে তাকালো মামু। সে ইশারা করলো কথা চালিয়ে যেতে।
“তুই চাইলে পারবি।”
“না, মামু, এইটা করন যাইবো না। ওই লাশ কেলেম করলেই ফাইস্যা যামু। তুমি খামোখা এইসব কইতাছো, ভাইগনা শামসু অপারগতা জানালো। “হের লাশ আঞ্জুমানে পাঠায়া দিবো…ভালামতোই দাফন অইবো। এইটা নিয়া তুমি চিন্তা কইরো না।”
শামসুর কথা মেনে নেবার জন্য বাবলু ইশারা করলো এবার।
“তাইলে কি আর করা,” আস্তে করে বললো মামু। “ঠিক আছে। আমি আছি তোর লগে। কিন্তু শফিকরে মাইরা তুই ঠিক করোস নাই…”
“আরে মামু, এইসব কথা বাদ দাও,” ওপাশ থেকে বললো ভাইগনা শামসু। “হেরে না মাইরা আমার উপায় আছিলো না। তুমারে সব খুইলা কমু নে।”
বাবলু এবার দুদু মামুর বাম কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “ওরা কোনো বাচ্চামেয়েকে কিডন্যাপ করেছে কিনা জিজ্ঞেস কর।”
“শামসু, একটা কথা সত্যি কইরা ক তো, তুই কি কোনো বাচ্চামাইয়ারে কিডন্যাপ করছোস?”
“কি!” দারুণ বিস্মিত হলো শামসু। “বাচ্চামাইয়ারে কি করছি?!”
“…কিডন্যাপ করছোস নি?”
“এই সব ফালতু কথা তুমারে কে কইলো, অ্যাঁ?”
“না, হুনলাম আর কি।”
“ধুর, কি যে কও। আমি কতো পেরেসানের মইদ্যে আছি তুমি জানো?”
“ঠিক আছে, পরে কথা অইবো, রাখি,” বাবলুর ইশারা পেয়ে বললো দুদু মামু।
“কুন হালায় এই কথা তুমারে কইছে, অ্যাঁ?” ভাইগনা শামসু তাড়া দিলো। বোঝাই যাচ্ছে সে একটু চটে গেছে কথাটা শুনে।
“আরে বাদ দে…কথাটা কানে গেলো তাই তরে জিগাইলাম…”
“ও,” একটু চুপ থেকে আবার বললো ভাইগনা, “কাইল বিকালে আমার ওইখানে আয়ো তো, মামু। কথা আছে।”
“ও,” যেনো হঠাৎ করে কিছু একটা মনে পড়ে গেছে। “আরেকটা কথা…”
“কও।”
“নাটকারে কি করছোস?”
“আছে আমার কাছে…ওরে নিয়া চিন্তা কইরো না…ওরে আমি মারুম না। একটু টাইট দিতাছি, বুজলা?”
“আর কুনো খুনখারাবি করিস না, ভাইগনা। কাইল আমি আমু নি,” বলেই ফোনটা রেখে দিলো দুদু মামু।
বাবলু এবার অনেকটাই নিশ্চিত ডাকাইত শফিকের দল দিহানকে কিডন্যাপ করে নি। তার মনে হচ্ছে কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে সে। সামনে শুধুই দেয়াল। কোণঠাসা রাজার চেয়েও খারাপ অবস্থা তার। ডাকাইত শফিকের দলটি যদি সত্যি সত্যি মেঘলার মেয়েকে অপহরণ করে থাকতো তাহলে এই দুদু মামু হতো তার জন্যে মোক্ষম একটি সিঁড়ি। এক লাফে পৌঁছে যেতো ডাকাইতের ডেরায়। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। স্বয়ং ডাকাইত গতকাল রাতে তার ঘনিষ্ঠ লোকজনের হাতে নিহত হয়েছে।
তাহলে দিহানকে কারা অপহরণ করলোর
প্রশ্নটা অসহ্যরকম যন্ত্রণা নিয়ে তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। সময় ঘনিয়ে আসছে আর সে পিছিয়ে পড়ছে। মেঘলাকে যে-কথা দিয়েছে সেটা কিভাবে রাখবে বুঝতে পারলো না। মেয়েটা অনেক আশা নিয়ে তার শরণাপন্ন হয়েছে। তাকে কোনোভাবে বিমুখ করতে পারবে না।
মাথা থেকে যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতিটা ঝেটিয়ে বিদায় করতে চাইলো সে।
“আপনেরে ক্যাঠায় কইছে শফিক কিডন্যাপ করছে?” দুদু মামুর এই প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেলো বাবলু।
মোক্ষম প্রশ্ন। এটা নিয়ে সে একটুও ভাবে নি। মেঘলার কাছ থেকে কথাটা জানার পর এ নিয়ে কোনো প্রশ্নও জাগে নি তার মধ্যে। এখন মনে হচ্ছে বিরাট বোকামি হয়ে গেছে।
“যারা কিডন্যাপ করেছে তারাই বলেছে,” কথাটা বলতে বাধ্য হলো সে।
মাথা দোলালো মামু। যেনো ছেলেমানুষির মতো একটা কাজ করে ফেলেছে বাবলু। “কিডন্যাপাররা কহনও নিজেগো আসল পরিচয় দেয়?” আবারো মাথা দোলালো সে। “বাপের জনমে হুনি নাই এরহম কথা।”
বাবলুও শোনে নি। সময় আর পরিস্থিতির কারণে সে পুরো ব্যাপারটা সূক্ষ্মভাবে না ভেবেই মাঠে নেমে পড়েছে। দীর্ঘদিন পর তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া মেঘলা একমাত্র সন্তানের জীবন বাঁচাতে তার দ্বারস্থ হওয়ার কারণে আবেগেরবশে কোনো কিছু না ভেবে নেমে পড়েছে কাজে। সময় আর পরিস্থিতি এমনই, ভাবার মতো সময়ও তার হাতে ছিলো না। শুধুমাত্র মেঘলার কাছ থেকে শোনা, কাজটা ডাকাইত শফিকের লোকজন করেছে। ব্যস! এইটুকু তথ্য নিয়েই মাঠে নেমে গেছে। আর কিছু ভাবার ফুরসতই পায় নি। তার মনে হয়েছিলো এটুকুতেই কাজ হবে। কিন্তু তথ্যটা সত্যি হলেও না হয় কথা ছিলো!
অধ্যায় ১৬
রেবার মেজাজ এখন বেশ ফুরফুরে। রিক্সায় করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার পাশে জেফরি বেগ। ধানমণ্ডি চার নাম্বার দিয়ে যাবার সময় ফুটপাতে ফুচকার দোকানটা পড়লো। ফুচকা খাবার ইচ্ছে করলেও মুখে বলতে পারলো না সে। কয়েক মাস আগে এই ফুচকার দোকানে ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলো। প্রচণ্ড মানসিক চাপ আর ভীতির মধ্যে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছিলো রেবা। সে-যাত্রায় অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও ফুচকার দোকানে আসা তো দূরের কথা, তারপর থেকে তার প্রিয় ফুচকা আর চটপটিও খাওয়া হয় নি।
“ফুচকা খাবে?” যেনো তার মনের কথা পড়ে ফেলেছে জেফরি।
রেবা হ্যাঁ-না কিছু বলতে পারলো না, শুধু চেয়ে রইলো।
“ঐ ঘটনার পর আর এখানে আসা হয় নি,” বললো জেফরি বেগ। “চলো, ফুচকা খাই।”
রেবা কিছুই বললো না। নীরবতা যদি সম্মতির লক্ষণ হয়ে থাকে তাহলে সেই সত্যটা আবারো প্রমাণিত হলো।
রিক্সাওয়ালাকে ঘুরে ফুচকার দোকানের কাছে চলে আসতে বললো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।
“আমি চটপটি খাবো, তুমি?”
ফুটপাতের উপর রাখা কয়েকটি চেয়ারের মধ্যে দুটোতে বসলো তারা।
“আমিও চটপটি,” হেসে বললো রেবা।
জেফরি দোকানিকে অর্ডার দিয়ে দিলো।
“ঠিক এখানেই আমরা বসেছিলাম, না?”
রেবার কথায় মুচকি হাসলো সে। যদিও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। “হ্যাঁ।”
“জানো, ঐ ঘটনার পর আমি আর এ রাস্তা দিয়ে কখনও আসা-যাওয়া করি নি,” বললো রেবা।
“আমি অবশ্য কাজের প্রয়োজনেই অনেকবার এসেছি কিন্তু ফুচকা চটপটি খাই নি।”
“খেলেও কি আমাকে এখন বলবে?” বাঁকা হাসি দিয়ে বললো রেবা। “হয়তো অন্য কারোর সাথে?…”
জেফরি ভুরু কুচকে তাকালো তার দিকে। “তুমি কিন্তু ইদানিং বেশ ঠাট্টা-তামাশা করতে শিখে গেছে।”
নিঃশব্দে হেসে ফেললো রেবা। “এখন কিন্তু ঠাট্টা করছি না।”
“সত্যি?” জেফরি অবাক হলো।
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
“তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো?” জেফরির চোখেমুখে কৃত্রিম অভিব্যক্তি।
“হুমমম,” রেবার মুখে এখনও সেই হাসি লেগে রয়েছে।
“মাইগড,” মাথায় হাত দিলো জেফরি বেগ। “এসব সন্দেহ তোমার মধ্যে ঢুকলো কবে থেকে?”।
“আমার কি দোষ, যার সাথে প্রেম করি সে তো মারাত্মক সন্দেহপ্রবণ। আর সন্দেহ হলো ছোঁয়াচে রোগ, বুঝলে?”
“আরে বাবা, সেটা তো আমার পেশার কারণে…সন্দেহের সিঁড়ি বেয়ে আমি সত্যের কাছে পৌঁছাতে চাই।”
“আমিও তো তাই করছি।” রেবার চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাপ।
“তাই নাকি,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার ভান করলো সে। “ম্যাডাম কোন্ সত্যের কাছে পৌঁছাতে চাইছেন?”
একটু ভাবলো রেবা। “অফিসে সারাক্ষণ এডলিনের মতো হট অ্যান্ড স্পাইসি একটা চিজ থাকলে তার সাথে পুরুষ-মানুষ তো একটু লাইন মারবেই, তাই না?”
ভেতরে ভেতরে বিষম খেলো জেফরি। এ মেয়ে বলে কী! এডলিনের কথা জানলো কিভাবে?
“কি ভাবছো?”
“না, কিছু না,” বললো জেফরি বেগ। “এসব তুমি কী বলছো? আমি ঐ মেয়ের সাথে লাইন মারবো? আজব!”
“আজব হবে কেন, মেয়েটা তো দেখতে দারুণ, তাই না? আমার তো মনে হয় ও তোমাকে খুবই পছন্দ করে।”
আবারো বিষম খেলো মনে মনে। তার এতোদিন ধারণা ছিলো, এডলিন যে তার প্রতি দুর্বল সেটা তার অফিসের আর কেউ জানে না। রেবার তো জানার প্রশ্নই আসে না।
“ধ্যাত্,” এবার সত্যি সত্যি রেগে গেলো জেফরি। “কী সব বলছো? কোথায় একটু রোমান্টিক কথা বলবে, …হাবিজাবি সব গালগল্প বলছো। মুডটাই খারাপ করে দিলে।”
“ওরে বাবা, ইনভেস্টিগেটরের মুড দেখি সামান্য কারণেই খারাপ হয়ে যায়।”
রেবার দিকে সিরিয়াস চোখে তাকালো সে। “এসব ফাজলামি আমার সাথে করবে না। ভালো লাগে না।”
জেফরির থুতনিটা ধরে বললো রেবা, “আচ্ছা করবো না। এবার একটু হাসো?”
মুখটা সরিয়ে নিয়ে বললো সে, “আরে কি শুরু করলে!”
হেসে ফেললো রেবা। “একটা কথা বলবো?”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো জেফরি। “বলো।”
“আমার সাথে যদি তোমার সম্পর্ক না থাকতো তাহলে নির্ঘাত ঐ মেয়েটার সাথে…” কথাটা শেষ করার আগেই হেসে ফেললো সে।
“উফ!” বলে উঠলো জেফরি। “আজ তোমার কি হয়েছে? যা-তা বলছো। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। তোমার সাথে দেখা করাটাই ভুল হয়ে গেছে। অফিসে থাকলেই ভালো হতো।”
দু’ প্লেট চটপটি এসে পড়লো এমন সময়।
রেবা এক চামচ চটপটি নিয়ে জেফরির মুখের কাছে ধরলো।
“কি শুরু করলে?”
“খাও। আদর করে দিচ্ছি।”
“গাছের আগা কেটে এখন গোড়ায় পানি ঢালা হচ্ছে?” চটপটি মুখে নিয়ে বললো জেফরি বেগ।
রেবার ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। “আরে, রাগ করো কেন? আমার তো বোন-টোন নেই…মানে তোমার কোনো শ্যালিকা হবে না। তাই ভাবছি, এখন থেকে মাঝেমধ্যে আমি তোমার শ্যালিকা হয়ে সেই খামতিটা পূরণ করার চেষ্টা করবো।”
“শালি!” রেগেমেগে বললো জেফরি।
তা মুখ থেকে কথাটা শুনে হা-হা করে হেসে ফেললো রেবা। তার হাসির শব্দটা বাধাগ্রস্ত হলো একটা রিং বাজার শব্দে। জেফরি বেগ পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করে কল রিসিভ করলো। চুপ মেরে গেলো রেবা।
“হ্যাঁ, জামান, বলো।” ও পাশ থেকে জামানের কথা শুনে অবশেষে বললো সে, “ঠিক আছে। আমি আসছি।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রেবার ভেতর থেকে। “কেন যে পুলিশের লোকের সাথে প্রেম করতে গেছিলাম,” বোঝা গেলো না কথাটা সত্যি সত্যি বলছে নাকি এটাও ঠাট্টা-তামাশার অংশ। “ডেটিং করারও কোনো উপায় নেই।”
মুচকি হাসলো জেফরি। “সরি।”
“এই লোককে বিয়ে করলে তো আমার জীবনটা তেজপাতা হয়ে যাবে। বুঝতে পারছি, আমার কপালে অনেক দুঃখ আছে।”
জেফরি বেগ দ্রুত চটপটি খেতে শুরু করলো। “জলদি খাও, আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।”
“আবার একটা খুন হয়েছে, না?”
“খুন না, কিডন্যাপ…ছয়-সাত বছরের এক মেয়ে,” চটপটি মুখে দিতে দিতে বললো সে।
“কিডন্যাপ?” অবাক হলো রেবা। “তাহলে তোমাকে ডাকছে কেন? তুমি তো শুধু মার্ডার কেস নিয়ে কাজ করো, তাই না?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “এই কেসের শুরুটা মার্ডার দিয়েই হয়েছে…তদন্ত করতে গিয়ে দেখি ঘটনা আসলে কিডন্যাপিংয়ের।”
“ও,” রেবা আর কিছু বললো না।
“মেয়েটার বাবা-মা অবশ্য স্বীকার করে নি তাদের মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে। আমি নিশ্চত, কিডন্যাপাররা তাদের শাসিয়েছে, পুলিশকে জানালে তাদের মেয়েকে মেরে ফেলা হবে।” অর্ধেক খাওয়া চটপটির প্লেটটা সরিয়ে রাখলো সে। “আমরা এখন চেষ্টা করছি ওই কিডন্যাপারদের ট্র্যাকডাউন করতে।”
“মেয়েটার বাবা-মা খুব কষ্টের মধ্যে আছে, না?” বললো রেবা।
“হুমম। আমার আশংকা, আজকের মধ্যে ওদের ধরতে না পারলে, দ্রুত উদ্ধার করতে না পারলে সম্ভবত ওরা মেয়েটাকে মেরেই ফেলবে।”
কথাটা শুনে অস্থির হয়ে উঠলো রেবা। “আমি দোয়া করি মেয়েটার যেনো কিছু না হয়। তুমি যেভাবেই পারো মেয়েটাকে উদ্ধার করো। কথাটা শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে।”
“চিন্তা কোরো না, মনে হয় ওদের নাগাল আমরা পেয়ে যাবো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো রেবা। জেফরির উপর যতোটুকু অভিমান ছিলো সব যেনো এক নিমেষে উবে গেলো। এখন বরং তাকে নিয়ে গর্ব হলো তার। সে এমন একটা পেশায় আছে যেখান থেকে সরাসরি মানুষের সেবা করা যায়। বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করা যায়। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে মহৎ কাজ আর কী হতে পারে?
অধ্যায় ১৭
আজ একটা নিয়মের ব্যতিক্রম করলো বাবলু। এরকম কাজে যখন সে নামে তখন কোনো লিঙ্ককে জীবিত রাখে না, বিশেষ করে তার কাছ থেকে তথ্য পাবার পর। কিন্তু দুদু মামুকে কিছু করে নি। যখনই নিশ্চিত হয়েছে, দিহানকে ডাকাইত শফিক অপহরণ করে নি, এর সাথে দুদু মামুও জড়িত নেই, তখনই সময় নষ্ট না করে দক্ষিণ মৈষণ্ডি থেকে চলে আসে। খামোখা খুনখারাবি করার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া, দুদু মামু লোকটা তার জন্য হুমকিও নয়। বরং এই লোকের কারণেই সে একটা সত্য দেরিতে হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছে-কিডন্যাপাররা নিজেদের ভুয়া পরিচয় দিয়েছে মেঘলার স্বামীর কাছে। এটা তারা করেছে কৌশল হিসেবে। তাদের দিক থেকে তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেও বাবলু একটা ভুল করে ফেলেছে। কোনো কিডন্যাপার গ্রুপ যে নিজেদের সত্যিকারের পরিচয় দেবে না, এই সহজ ব্যাপারটা তার মাথায়ই ঢোকে নি।
বাইকটা নিয়ে উদভ্রান্তের মতো পুরনো ঢাকার অলিগলি ঘুরে বেড়ালো কিছুক্ষণ। তার মাথাটা কাজ করছে না। সময় যতো দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে ততোই ঘনিয়ে আসছে ব্যর্থতা। সে ভালো করেই জানে, ছোট্ট দিহানের জন্য সময় কতোটা মূল্যবান। ওয়ারির লারমিনি স্ট্রটের একটি চায়ের টঙের সামনে এসে থামলো। গলা শুকিয়ে গেছে। তার ভেতরে ক্রমবর্ধনাম দুশ্চিন্তার ঘূর্ণিপাক আরো প্রকট হচ্ছে। মাথাটা একদম কাজ করছে না। এ মুহূর্তে এটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। মাথাটা কাজ না করলে পরবর্তী পদক্ষেপ কিভাবে নেবে?
পুরনো ঢাকার অলিগলি দিয়ে বাইক নিয়ে ছুটে চলার সময় তার মনে হচ্ছিলো কোনো গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছে। এ থেকে বের হবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
“চা দিমু?”
দোকানির কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। কাস্টমার বলতে কেউ নেই। ছোট্ট দুটো বেঞ্চির একটাতে বসে পড়লো।
“সিগারেট?”
“না।” তার পকেটে এক প্যাকেট সিগারেট আছে। যে জন্যে কিনেছিলো তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলো ওখান থেকে
একটা নিয়ে ধরাবে কিনা। পরক্ষণেই সেটা বাতিল করে দিলো।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবলো মেঘলা যদি ফোন করে কী বলবে? কতো আশা নিয়ে তার কাছে ধর্ণা দিয়েছে মেয়েটা। কতোটা অসহায় আর নিরুপায় হয়ে তার শরণাপন্ন হয়েছে বাবলু সেটা জানে।
ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে ছ’টা বাজে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আগামীকালের মধ্যে মুক্তিপণের টাকা দিতে হবে। তা না হলে ওরা দিহানকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু বাবলু ভালো করেই জানে, আজ রাতের মধ্যে মেয়েটাকে উদ্ধার করতে না পারলে তার পরিণতি কি হবে-অপহরণকারীরা মুক্তিপণ পাবার আগেই জিম্মিকে হত্যা করবে। আরেকটু সময় দরকার তার। কিন্তু যে কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে সেখান থেকে বের হবার জন্য কতোটা সময় লাগবে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। ঠিক যেমনটি নেই পরবর্তী গন্তব্য কোথায় হবে।
মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেললো বাবল। চেষ্টা করলো শ্বাসপ্রশ্বাস ধীরস্থির করতে। গভীর করে দম নিলো চার-পাঁচবার। তারপর চোখ দুটো বন্ধ করে চায়ে চুমুক দিলো আবার। এ মুহূর্তে তার দরকার একটা আইডিয়া। কোণঠাসা রাজার মতো বোর্ডের এক কোণে জমে আছে সে।
যেকোনো পরিকল্পনা করার সময় সে বিকল্প একটি পরিকল্পনা মাথায় রাখে। আজকে অবশ্য সেটা করা হয় নি। করার মতো সময়ও তার ছিলো না। এখন বসে বসে ভাবতে লাগলো সেটা।
কিছুক্ষণ পর তার মনোযোগ ভাঙলো ফোনের রিঙে। চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করলো। কিছু না দেখেই সে বুঝতে পারলো কে কল করেছে। তার এই ফোন আর সিমটা শুধুমাত্র মেঘলার সাথে যোগাযোগ করার উদ্দেশ্যেই কেনা হয়েছে। সেলফোন ব্যবহারের বেলায় সে খুব সাবধানী। এটা শুধু মানুষের অবস্থানই জানিয়ে দেয় না, ফাঁস করে দেয় তার অনেক গোপনীয়তা। যদিও মেঘলার সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অতোটা সতর্কতার দরকার নেই, তারপরও এটা সে করছে কারণ সতর্কতা এক ধরণের অভ্যেস। সেই অভ্যেস তার রয়েছে।
কলটা রিসিভ করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলো সে। কী বলবে মেঘলাকে? বলার মতো কোনো অগ্রগতি তো নেই। অবশেষে তৃতীয়বার রিং হবার পর রিসিভ করলো কলটা।
“হ্যাঁ, বলো।” তার কণ্ঠটা নিজের কাছেই কেমন ম্রিয়মান শোনালো।
“ওরা আবার ফোন করেছিলো,” বললো মেঘলা।
“কি বললো?”
“তোমার কথামতো একটু আগে আমি ওদেরকে বলেছিলাম দিহানের বাবা অসুস্থ…এখন থেকে আমিই ওদের সাথে যোগাযোগ করবো…”
“হ্যাঁ, তারপর?”
“কিন্তু ওরা জেনে গেছে দিহানের বাবা অসুস্থ নয়।”
বাবলু চুপ মেরে থাকলো।
“চিন্তার কিছু নেই, ওদেরকে আমি ম্যানেজ করেছি।” একটু থেমে আবার বললো সে, “এখন বলো, তোমার কি খবর?”
কী বলবে ভেবে পেলো না বাবলু। কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর বললো, “শোনো, ওরা যদি আবার ফোন করে ওদেরকে বলবে কাল সকালেই টাকাগুলো দেয়া যাবে। আর সেই টাকাগুলো নিয়ে যাবো আমি।”
“কি!” দারুণ অবাক হলো মেঘলা। “তুমি নিয়ে যাবে?”
“হুমম।” মেঘলাকে সে বলেছিলো কিডন্যাপারদের মুক্তিপণ দেবার জন্য টাকা জোগার করার চেষ্টা করছে তারা। এতে করে কিছুটা সময় পাওয়া যাবে।
“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না?”
“ওদেরকে বলবে কাল সকালে তোমার এক কাজিন টাকাগুলো ওদের হাতে পৌঁছে দেবে।”
“কাজিন?” মেঘলার বিস্মিত ভাব এখনও কাটে নি।
“হ্যাঁ। ক’টার সময় কোথায় দিয়ে আসতে হবে সব জেনে নিও।”
“সত্যি সত্যি টাকা নিয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“এতো টাকা তুমি পাবে কোথায়?”
“তোমাকে এসব ভাবতে হবে না। আমি যা বললাম তাই করো।”
“ঠিক আছে।”
“তোমাকে আরেকটা কাজ করতে হবে,” অবশেষে বললো সে।
“কি কাজ?”
“ওদেরকে একটা শর্ত দিতে হবে। বলবে কাল সকালে আমি যখন টাকাগুলো ওদের দিতে যাবো তখন তুমি দিহানের সাথে ফোনে কথা বলে নিশ্চিত হতে চাইবে।”
“নিশ্চিত মানে? বুঝলাম না?” মেঘলা বললো।
কথাটা বলতে বাধলো তার। তবুও বলতে হলো। “মানে…দিহান…বেঁচে আছে কিনা…”
চুপ মেরে রইলো মেঘলা। কথাটা হজম করতে বেগ পেলো সে। মনে হলো বাবলু যে তার মেয়েকে শেষ সময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই কৌশলটা করেছে তা বুঝতে পেরেছে। “বুঝেছি,” ছোট্ট করে বললো সে।
“যেভাবেই হোক এটা তোমাকে করতেই হবে। তুমি জোর দিয়ে বলবে, দিহানের সাথে ফোনে কথা না হলে তুমি শেষ মুহূর্তে টাকাগুলো ওদের হাতে পৌঁছে দেবে না।”
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো ফোনের অপর প্রান্ত থেকে।
“আমি জানি কাজটা তোমার জন্যে খুব কঠিন কিন্তু এটা তোমাকে করতেই হবে।”
কিছুক্ষণ পর বেশ দৃঢ়ভাবে বললো মেঘলা, “আমি পারবো, বাবলু।”
“ওরা কি বলে আমাকে জানিও।”
“আচ্ছা।”
আর কোনো কথা না বলে ফোনটা রেখে দিলো। মেঘলার সাথে বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না তার। পরিস্থিতিটা এমনই, তার সাথে দরকারি কথা ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায়ও নেই। সত্যি বলতে, মেয়েটার সাথে দীর্ঘদিন পর কথা বলতে গিয়ে অসংকোচ বোধ করছে সে।
ফোনে যা বলেছে সেটা বিকল্প একটি পরিকল্পনা। হঠাৎ করেই তার মাথায় চলে এসেছে। কিডন্যাপারদের নাগাল না পেলে এটা করা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। তাছাড়া মেঘলা যদি কোনোভাবে শেষ শর্তটা আদায় করে নিতে পারে তাহলে দিহান বেঁচে থাকবে, অন্তত টাকাগুলো হাতে পাবার আগ পর্যন্ত।
চায়ের বিল দিয়ে বাইক নিয়ে চলে গেলো সে। এখন অন্য একটা জায়গায় যেতে হবে তাকে।
অধ্যায় ১৮
সারা রাত সারা দিন কাজ করার পর বিকেলের দিকে গোসল করে গরম গরম ভাত আর মুরগির ঝালাই খেয়ে একটু বিশ্রাম নেয় তনাই। তারপরই কৌশল করে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গি আমিনুলকে বাইরে পাঠিয়ে দেয় কিছু জরুরি মাল ডেলিভারি দিতে। যদিও এ কাজটা দু’এক ঘণ্টা পর করলেও হতো কিন্তু তার অন্য একটি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য আমিনুলকে বাইরে পাঠানোর দরকার ছিলো।
আমিনুল বাইরে বেরুবার আগেই মাল নেবার জন্য তসলিমা এসেছিলো। এই মেয়েটা তাদের লাইনে কাজ করে। এরকম প্রায় সাত আটজনের একটি দল আছে তাদের। ওরাই মালগুলো বিভিন্ন জায়গায় ডেলিভারি দিয়ে থাকে। আমিনুল চলে যেতেই তসলিমার সাথে লীলাখেলা শুরু করে দেয় সে। যদিও মেয়েটা চাচ্ছিলো একটু ধীরে ধীরে এগোতে কিন্তু তনাই সেসব আমলেই নেয় নি।
এই মেয়েটার সাথে কয়েকদিন ধরেই চোখের ইশারায়, ভঙ্গিতে বেশ চালাচ্ছিলো। দেখতে তেমন সুন্দর না হলেও শরীরটা মাশাল্লাহ্। স্বামী নেই। বাচ্চা-কাচ্চাও হয় নি। অন্যসব মেয়েদের মতো ঘরে বসে থাকে না বলে তার শরীরে কোনো মেদও জমে নি। তসলিমাসহ তাকে ঘরে রেখে চলে যাবার সময় আমিনুলের চোখেমুখে এক ধরণের সন্দেহ দেখেছিলো। তনাই। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে তার মতিগতি।
সমস্যা নেই। সেও পুরুষমানুষ। তারও এরকম মেয়েমানুষের দরকার আছে। ইচ্ছে করলে সে অন্য একজনকে বেছে নিতে পারে। কিন্তু এখন তসলিমা শুধুই তার।
প্রায় চার মাস ধরে নারীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত তনাই দেরি করে নি তসলিমার শরীরের স্বাদ নিতে। প্রথমবার তাড়াহুড়া করতে গিয়ে দ্রুত নিঃশেষ হয়ে গেছে। তসলিমা মিটি মিটি হেসে বলেছে, এরপর একটু রয়েসয়ে করতে। তনাইও হেসে মেনে নিয়েছে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে একটু আদর সোহাগ করার পর দ্বিতীয়বার শুরু করতে যাবে তখনই হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে উঠলো।
তসলিমাকে ঘরে রেখে লুঙ্গি আর টি-শার্ট পরে দরজার কাছে গিয়ে সতর্ক হয়ে উঠলো সে। পুলিশ তো না? সঙ্গে সঙ্গে ধুকফুকানি শুরু হয়ে গেলো। একটু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো তনাই। পুলিশের কাছে এর আগে দু’তিন বার ধরা পড়েছে সে, পিটুনিও খেয়েছে। কিন্তু খুব বেশি দিন জেলে থাকতে হয় নি তাকে। ইউসুফ খন্দকারের মতো জাঁদরেল উকিল রয়েছে তার। ঐ খচ্চরটা হাইকোর্ট থেকে জামিনের ব্যবস্থা করে দিতে পারে অনায়াসে, শুধু একটু টাকা ঢালতে হয়, এই যা।
দরজার পিপহোল দিয়ে তাকালো সে। আমিনুল! এতো তাড়াতাড়ি মাল ডেলিভারি দিলো কিভাবে? বড়জোর দশ মিনিট হয়েছে। তার তো ফেরার কথা কমপক্ষে এক ঘণ্টা পর। তাহলে? তসলিমার সাথে তাকে হাতেনাতে ধরতে চলে এসেছে? না। তার ধারণা আমিনুল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। তনাইকে এভাবে বিব্রত করার সাহস দেখাবে না সে। হয়তো ভুলে মানিব্যাগ কিংবা মোবাইলফোন ফেলে চলে গেছিলো। এই ছেলেটার সব ভালো শুধু এই একটা দিক বাদে-একটু ভুললামনা।
তারপরই দেখতে পেলো আমিনুলের পাশে এসে আরেকজন দাঁড়িয়েছে। হারামজাদা সঙ্গে করে অচেনা লোক নিয়ে এসেছে! নাকি পুলিশ?
এই ফ্ল্যাট থেকে পালাবার কোনো পথই নেই। তাই কয়েকবার টোকা মারার পর উপায়ন্তর না দেখে দরজাটা খুলে দিলো সে। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো আমিনুলের পাশে দাঁড়ানো অচেনা যুবকের দিকে।
তনাই একে জীবনেও দেখে নি।
.
হোমিসাইডের কমিউনিকেশন্স রুমে ফিরে এসেছে জেফরি। অপহরণকারীদের একজনের সাথে মিসেস চৌধুরির ফোনালাপের রেকর্ড শুনে চুপচাপ বসে আছে সে। জামান ইতিমধ্যে ইনকামিং কলটার লোকেশন ট্র্যাকড্রাউন করতে পেরেছে। ফলাফল আগের মতোই-এহসান চৌধুরির বাড়ির খুব কাছ থেকেই কলটা করা হয়েছে। এটা এখন স্পষ্ট, অপহরণকারীদের মধ্যে কমপক্ষে একজন এহসান চৌধুরির বাড়ির আশেপাশে ওৎ পেতে আছে। কড়া নজর রাখছে মেয়েটার বাবা-মার গতিবিধির উপর। হয়তো পাশের কোনো ভবন থেকে ঐ ডুপ্লেক্স বাড়িটার অনেক কিছুই দেখতে পাচ্ছে তারা। অপহৃত মেয়েটার মা বলেছিলো তার স্বামী অসুস্থ, যা কথা বলার তার সাথেই বলতে হবে। কিডন্যাপাররা সেটাও জেনে গেছে। ভদ্রমহিলা কেন মিথ্যে বলেছে সে কৈফিয়ত চেয়েছে। অবশ্য বেশ ভালোমতোই সেটা সামাল দিতে পেরেছে মিসেস চৌধুরি।
জামান আবারো বলেছিলো, ঐ বাড়ির আশেপাশে থাকা কিডন্যাপারদের গ্রেফতার করলে জানা যেতো মেয়েটাকে কোথায় আটকে রেখেছে ওরা। জেফরি এ প্রস্তাবে রাজি হয় নি। হোমিসাইডের ক্রাইম লাইব্রেরি থেকে সাম্প্রতিক সময়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ধরণ, পদ্ধতি, পরিবর্তন আর অপরাধীদের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা রয়েছে তার। ওখান থেকেই জানে, আজকাল অপহরণের কেসে কিডন্যাপাররা কতোটা সতর্ক থাকে। দু’একটি বোকামিপূর্ণ ঘটনা বাদ দিলে প্রায় সব ক্ষেত্রেই এটা লক্ষ্য করা যায়। বোকামির ঘটনাগুলো আবার ঘটিয়ে থাকে অপেশাদাররা-যারা জীবনে প্রথমবারের মতো এ কাজে নেমেছে। সুতরাং কিডন্যাপারদের একজন যদি ঐ বাড়ির আশেপাশে থেকেও থাকে তাকে ধরে কোনো লাভ হবে না। এক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা আছে। ওখানে ঠিক কতোজন আছে সে সম্পর্কে তারা নিশ্চিত নয়। ফোনে একজন কথা বললেও একাধিক লোক থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এমনও হতে পারে, ওদেরকে গ্রেফতার করার অভিযান চালিয়ে একজনকে ধরা হলেও অন্যেরা সটকে পড়তে সক্ষম হলো, তখন কি হবে? অপহরণকারীরা জেনে যাবে পুলিশ মাঠে নেমেছে। ছোট্ট মেয়েটাকে হত্যা করে যে যেদিকে পারে সেদিকে চলে যাবে।
তার এই কেসের মূল লক্ষ্য এখন-বাতেন নামের এক ড্রাইভারের খুনিকে ধরা নয়-অপহৃত একটি বাচ্চামেয়েকে জীবিত উদ্ধার করা।
মিসেস চৌধুরির সাথে অপহরণকারীদের ফোনালাপ শোনার পর থেকে জেফরির মনে একটা আশংকা দানা বাঁধছে। এই ব্যাপারটা নিয়েই সে চিন্তিত।
অপহরণকারীরা বাচ্চামেয়েটার সাথে তার মায়ের কথা বলিয়ে দিচ্ছে না। মিসেস চৌধুরি বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও তারা বলছে একটু পর কথা বলিয়ে দেবে। এরইমধ্যে মেয়েটাকে ওরা খুন করে ফেলে নি তো? জেফরির মনে বার বার এই প্রশ্নটা উঁকি দিচ্ছে।
“স্যার?” জামান বললো তার আনমনা বসকে।
“কি?”
“ঐ ফোনটা তো আর ইউজ হচ্ছে না।”
“হুমম,” আর কিছু বললো না। একটু আগে জামানকে আরেকটা কাজ দিয়েছে সে। মিসেস চৌধুরির সাথে যে লোক ফোনে যোগাযোগ রাখছে তার মোবাইলফোনটাও এখন মনিটর করছে জামান। জেফরির ধারণা ঐ ফোন দিয়ে দলের বাকিদের সাথে সে যোগাযোগ করবে। আর সেটা করলেই লোকেশনটা তারা জেনে যাবে। কিন্তু মিসেস চৌধুরির সাথে কলটা শেষ হতেই ফোনটা বন্ধ করে রাখা হয়।
“মনে হয় ওরা মোবাইলফোনের ট্র্যাকিং করার ব্যাপারটা জানে, বললো জামান।
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। এটার জন্য কিছু পত্রপত্রিকা আর টিভি চ্যানেল দায়ি। তারা সংবাদ পরিবেশেনের নামে, এক্সকুসিভ কিছু দেবার তাড়না থেকে এমন সব তথ্যও উপস্থাপন করে প্রকারান্তরে যা সন্ত্রাসীদেরই উপকারে আসে।
আসমান-জমিন! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো জেফরির ভেতর থেকে। এরাই প্রথম জানায় হোমিসাইডসহ এ দেশের কিছু আইন-শৃঙ্খলা রাক্ষাকারী বাহিনীর কাছে মোবাইলফোন ট্র্যাক-ডাউন করার অত্যাধুনিক ডিভাইস রয়েছে। ব্যাপারটা এ পর্যন্ত জানালেও কোনো ক্ষতি ছিলো না কিন্তু কিভাবে এই ট্রাক-ডাউনের কাজ করা হয় সেটাও বিস্তারিত ছাপিয়ে দেয় তারা।
“মনে হচ্ছে পেশাদার কিডন্যাপার। অনেক বেশি সতর্ক,” চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো সহকারী ইনভেস্টিগেটর।
“কিন্তু সবাই ভুলে করে,” আস্তে করে বললো জেফরি বেগ। “এরাও ভুল করবে।”
জামান কিছু বললো না, তবে তার কাছে মনে হচ্ছে এরা সে-রকম কোনো ভুল করবে না। এভাবে ফোনকল ট্র্যাকিং করে ওদের না ধরে ঐ বাড়ির আশেপাশে যারা ‘ডিউটি’ দিচ্ছে তাদেরকে ধরলেই কাজটা অনেক সহজে করা সম্ভব।
“আচ্ছা স্যার, মি: চৌধুরিকে বাদ দিয়ে মিসেস চৌধুরি কেন কিডন্যাপারদের সাথে ডিল করছেন এখন?” প্রসঙ্গ পাল্টে বললো জামান।
“সম্ভবত মি: চৌধুরি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।”
“এসব ক্ষেত্রে তো বাবার চেয়ে মায়েরাই বেশি ভেঙে পড়ে, তাই না?”
জেফরিও জানে কথাটা সত্যি। সন্তানের ব্যাপারে মায়ের উদ্বেগ বাবার চেয়ে অনেক বেশি থাকে। এরকম ঘটনায় মানসিকভাবে সবার আগে ভেঙে পড়ে মায়েরাই। কিন্তু আরেকটা সত্য আছে যেটা তার সহকারী জানে না।
“হুম, তা ঠিক,” সায় দিলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “জানো, মুরগির বাচ্চাদের যখন কাক কিংবা চিল ছোঁ মেরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে তখন মা-মুরগি কি করে?” জামান সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার বসের দিকে। “রেগেমেগে গায়ের পালক ফুলিয়ে শিকারীকে তাড়া করে। দারুণ দুঃসাহসের পরিচয় দেয় তখন। এমনিতে একটা চিল কিংবা ঈগলের সাথে লড়াই করার চিন্তাও করবে না, কিন্তু নিজের বাচ্চাদের জীবন হুমকির মুখে পড়লে একদম বদলে যায় ওরা।”
জামান কিছু বললো না।
“সন্তানের মা হিসেবে মিসেস চৌধুরির এমন আচরণে আমি মোটেও অবাক হই নি।”
“স্যার, আপনার কি মনে হয় ওরা মুক্তিপণের টাকা আগামীকাল সকালের মধ্যে দিতে পারবে?”
“বুঝতে পারছি না। ঐ পরিমাণ টাকা তো কারোর বাসায় থাকে না। হয়তো সকালে মি: চৌধুরি ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দিতে পারে।”
“আপনার কি মনে হয়, টাকাটা কে নিয়ে যেতে পারে?”
জেফরি একটু ভেবে নিলো। জামান ভালো একটি প্রশ্ন করেছে। তার ধারণা এহসান চৌধুরি এ কাজ করবে না। “হয়তো তৃতীয় কেউ টাকাগুলো দিয়ে আসার কাজটা করবে,” বললো সে।
“আমার মনে হয়, মিসেস চৌধুরিই টাকাগুলো দিয়ে আসবেন।”
মাথা দোলালো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। তার দৃঢ় বিশ্বাস মিসেস চৌধুরি এ কাজ করবে না। কিডন্যাপিং কেসে মুক্তিপণ দেবার বেলায় নারীদের অংশগ্রহণের কোনো রেকর্ড পুলিশের খাতায় আপাতত নেই।
“তাহলে কে নিয়ে যাবে?”
“বুঝতে পারছি না। সম্ভবত এটা আমরা ওদের ফোনালাপ থেকেই জানতে পারবো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান, তারপর একটু ভেবে আবার বললো, “আজকের রাতের মধ্যে যদি ওদের ট্র্যাক করা না যায় তাহলে মেয়েটার জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে না।”
সহকারীর দিকে চেয়ে থাকলো জেফরি। কথাটা অমোঘ সত্য। সেক্ষেত্রে মুক্তিপণ নিতে আসা অপহরণকারীদের ধরা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হবে না। কিন্তু জেফরি চাচ্ছে অপহৃত বাচ্চামেয়েটাকে জীবিত উদ্ধার করতে।
“আমরা কি তাহলে আজ রাতটা এখানেই থাকবো, স্যার?”
“হ্যাঁ,” ছোট্ট করে বললো জেফরি বেগ। একটা নিষ্পাপ শিশুর জীবন। এখন হুমকির মুখে। তাদের কর্মতৎপরতার উপর নির্ভর করছে সবকিছু। সকালের আগেই উদ্ধার করতে না পারলে মেয়েটার জীবন বাঁচানো যাবে না।
অধ্যায় ১৯
তনাইর ধরে যেনো প্রাণ ফিরে এলো। আমিনুলের সাথে বাবলুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছিলো কিছুক্ষণের জন্য। আরেকবার বুঝি সবকিছু নিয়ে ধরা পড়ে গেলো। কিন্তু আমিনুল যখন তাকে বললো ভয়ের কিছু নেই, এই লোককে সে ভালো করে চেনে, তখন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তবে তার পার্টনার তাকে আরো একটা কথা বলেছিলো, সেটা শোনার পর থেকে আগম্ভকের সাথে বুঝেশুনে কথা বলছে সে। দেবদূতের মতো দেখতে এই যুবক নাকি ভয়ঙ্কর পেশাদার খুনি। পাশের ঘরে যখন মালগুলো হিসেব করে দেখার জন্য তারা দুজনে গেলো তখনই তার বন্ধু এটা বলেছিলো তাকে। পরিচিতজনেরা নাকি একে বাস্টার্ড নামে চেনে। আজব নাম, বাস্টার্ড! মনে মনে ভেবেছিলো তনাই।
আমিনুল আর বাস্টার্ড নামের লোকটা ঘরে ঢোকার পর তসলিমার ব্যাপারটা আর লুকাতে পারে নি তনাই। তার পার্টনার ঠিকই বুঝে যায়। অবশ্য সে মুখে কিছু বলে নি। শুধু মুচকি হেসে বলেছিলো, “তসলিমারে চইলা যাইতে কও এহন, ওরে পরে আইতে কইও।”
তনাই আর কিছু না বলে তসলিমাকে চলে যেতে বলে। মেয়েটাও খুব ভয় পেয়ে গেছিলো, ঘর থেকে চলে যেতে পেরে যেনো বেঁচে যায়।
তনাই একটু চিন্তায় পড়ে গেছে, বাস্টার্ড নামের লোকটা নাকি এখানে এসেছে মাল কিনতে, আমিনুল তাকে এই কথাই বলেছে। একজন পেশাদার খুনি কেন তাদের মাল কিনবে? তাও আবার এতো বিশাল পরিমাণে!
যাইহোক, তনাই মুখে কিছু না বলে কাজে নেমে পড়েছে। হিসেব করে দেখলো এই পেশাদার খুনি যা চাইছে তার অর্ধেক মাল আছে তার স্টকে।
“ভাই, পঞ্চাশ আছে, বাকিটা বানাইতে অইবো,” আমিনুল বললো বাবলুকে।
সে বসে আছে তাদের অ্যাপার্টমেন্টের ড্রইংরুমে। এটা আসলে আমিনুলের শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বেডরুমটা ব্যবহার করা হয় তাদের কাজের জন্য, গেস্টরুমে থাকে তনাই। কিচেন আর স্টোররুম দুটোতে মাল স্টক করে রাখে তারা।
“বাকিটা আজরাতের মধ্যে বানিয়ে দাও,” বাবলু বললো। “আমি কাল সকাল আটটার মধ্যে পুরোটা চাই।”
আমিনুল তাকালো তনাইর দিকে। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে বাস্টার্ডকে। “সারা রাইত কাম করলে তো সম্ভব, তাই না?”
তনাই মাথা নেড়ে সায় দিলো শুধু।
“তাহলে আমি আসবো ঠিক আটটার দিকে। একটা ব্যাগে ভরে রেখে দিও। ঠিক আছে?”
বাবলুর কথায় তারা দুজনেই মাথা নেড়ে সায় দিলো।
“এর জন্য কতো দিতে হবে?” জিজ্ঞেস করলো সে।
আমিনুল বুঝতে পারলো না কী বলবে। বাস্টার্ডের সাথে তার পরিচয় আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকার সময়। দীর্ঘদিন তারা একসাথেই কাজ করেছে। পরে তনাইর সাথে এই পেশায় যোগ দেয় সে।
“আপনে যা দেয়ার দিয়েন,” বললো আমিনুল। সে নিজেও বাস্টার্ডকে ভয় পায়। এই লোক কি করতে পারে সেটা ভালো করেই জানে। আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকার সময় তাকে দলের সবাই বেশ সমীহ করতো।
“আমি শুধু খরচটা দেবো, হয়তো সামান্য লাভও থাকবে, কিন্তু মার্কেটে যে রেট আছে তা দিতে পারবো না।”
তনাই কিছু বললো না। তারা যে কাজ করে সেখানে এরকম কারোর সাথে দামাদামি করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। মনে মনে আমিনুলকে গালি দিলো সে। কী দরকার ছিলো এই লোককে এখানে নিয়ে আসার! সব তো চিনে গেলো। এখন যদি এই লোক উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে তাহলে তাদের কী করার থাকবে?
“একেকটা নোট তৈরি করতে কত খরচ হয়, বলো?” জানতে চাইলো বাবলু।
তনাইর দিকে তাকালো তার পার্টনার। জালটাকার এই ব্যবসার সবকিছু জানে নাই। সে কিছু বললো না। তার চোখের ভাষা পড়ে ফেললো আমিনুল। এ মুহূর্তে কথা বলতে চাইছে না, হয়তো পেশাদার খুনি শোনার পর থেকে একটু ভয়ের মধ্যে আছে সে। আমিনুল ইচ্ছে করেই বাস্টার্ডের পরিচয়টা জানিয়ে দিয়েছে তাকে। নইলে দেখা যেতো তার উপর রাগ ঝাড়তো। হয়তো বেমক্কা উল্টাপাল্টা কিছু বলে বাস্টার্ডকে রাগিয়েও দিতো সে।
“খরচ তো পড়ে…এই ধরেন, বিশ টাকা…” আন্দাজে বললো আমিনুল। বলেই তনাইর দিকে তাকালো। সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
“বিশ?” বাবলু একটু হিসেব করে নিলো। প্রতিটি এক হাজার টাকার নোট বানাতে বিশ টাকার মতো খরচ হয়। “আমি তোমাদেরকে সব মিলিয়ে পাঁচলক্ষ টাকা দেবো, চলবে?”
তনাই যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে ভেবেছিলো বিশাল লোকসান হবে আজ।
“ঠিক আছে, ভাই,” বললো আমিনুল। এরপর তাকালো তনাইর দিকে। সেও মাথা নেড়ে সায় দিলো।
“তাহলে কাল সকালে আমি টাকা নিয়ে আসবো, ওগুলো রেডি রেখো। ভালো দেখে একটা ব্যাগে ভরে দিও সবগুলো।”
“জি, ভাই,” হাসিমুখে বললো আমিনুল।
উঠে দাঁড়ালো বাবলু। “কাল সকাল আটটায় আসবো।” আমিনুলের কাঁধে চাপড় মেরে চলে গেলো সে।
“এইহানে নিয়া আইলা ক্যান?” বাবলু ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর দরজা বন্ধ করে বললো তনাই। “আমাগো জায়গাটা চিনা গেলো না?”
মুচকি হাসলো তার পার্টনার। “সমস্যা নাই। ভায়ে লোক ভালা। আমাগো কোনো ক্ষতি করবো না।”
“করে তো খুনখারাবি, তোক আবার ভালা হয় কেমনে?” তনাই অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
“তুমি হেরে চিনো না, আমি চিনি। হে আমাগো কোনো ক্ষতি করবো না। কিন্তু…” মুখে একটু বাঁকা হাসি দেখা গেলো।
“কি?” উৎসুক হয়ে উঠলো তনাই।
“তুমি যদি হের লগে উল্টাপাল্টা কিছু করো তাইলে তোমার খবর আছে। তুমি যেইহানে যাও না ক্যান, তোমারে খুঁইজ্যা বাইর করবো, তারপর ঠুস,” আঙুল দিয়ে পিস্তলের টুগার টেপার ভঙ্গি করলো সে।
একটু ভয় পেলো তনাই। “এই চিজটার লগে তোমার খাতির হইলো কেমনে?”
মুচকি হাসলো ‘মিনুল। “তুমি তো জানো আমি আন্ডারওয়ার্ল্ডে আছিলাম…ওইহানে ভায়েও আছিলো।”
তনাই আর কিছু বললো না। জাল টাকার ব্যবসা করলেও আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকজনদের সে ভয় পায়। এরা কথায় কথায় খুন খারাবি করতে পারে।
“চলো,” তাড়া দিলো সে। “মাল বানানো শুরু করি, হাতে তো টাইম নাই।” মাথা নেড়ে সায় দিলো তার পার্টনার।