শুকদেবের গৃহ নীরব। বেলা দ্বিপ্রহর, কিন্তু জনমানব কোথাও আছে বলে মনে হয় না। সে ক্ষণেক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে। তাতে বিচিত্র একটি ভাব তার উপলব্ধি হয়। মনে হয়, নীরব পল্লীটিতে বিষাদ এবং হতাশা পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। তার কাছে পরিবেশটি অদ্ভুত এবং দুর্বোধ্য লাগে। সে একটি রাখাল বালককে ডাকলো। বালকটি সংবাদ দিতেই শুকদেব বাইরে এলেন। ক্ষণেক পর দীনদাসকেও দেখা গেলো। যোগীটিকে দেখে দীনদাস বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে হলো। বললেন, যোগী মহাশয় কি এই গ্রামেই অবস্থান করবেন?
শ্যামাঙ্গ অবাক হয়। দীনদাসের ব্যবহার তো পূর্বে কখনও রূঢ় দেখেনি সে? এই অল্প কদিনে এমন কী ঘটলো যে
মহাশয়, শুকদেব জানান, আপনি বরং অন্য পল্লীতে যান, আমরা এই পল্লীবাসীরা, বর্তমানে বিপদগ্রস্ত আছি।
দুজনের কেউই শ্যামাঙ্গকে কিছু বলেন না।
শ্যামাঙ্গ বিমূঢ় এবং হতবাক। এমন আচরণ কেন করলেন এঁরা? কী বিপদ এঁদের যে বহিরাগত একজন সংসার ত্যাগী যোগীপুরুষকে পর্যন্ত সহ্য করতে পারেন না? শ্যামাঙ্গ অধিক বাক্য ব্যয় আর করলো না। যোগীগুরু সিদ্ধপাকে কোথায় পাওয়া যাবে–শুধু এই সন্ধানটুকু সে প্রৌঢ় দুজনের কাছে জানতে চাইলো।
দীনদাস সম্মুখে হাত তুলে নির্দেশ করলেন, ঐ যে, ঐ গৃহে যাও।
শ্যামাঙ্গের বিস্ময়ের অবধি থাকে না। ঐ গৃহ তো লীলাবতীদের। ঐ গৃহে যে একজন সিদ্ধ যোগী থাকেন–এ সংবাদ তো কেউ তাকে পূর্বে দেয়নি।
সঙ্গী যোগীটি নির্দিষ্ট গৃহাভিমুখে অগ্রসর হলো। শ্যামাঙ্গকে শুধু বললো, আমি গুরুদেবের কাছে যাই।
দীনদাস জানতে চাইলেন, এই লোকটি লীলাবতীর মাতুলের কাছে কেন এসেছে, জানো?
শ্যামাঙ্গ বুঝতে পারে, লীলাবতীর মাতুলই তাহলে যোগী সিদ্ধপা। বলে, না আমাকে সে কিছু বলেনি, শুধু জানি, সে সিদ্ধপার শিষ্য এবং তার নিবাস পশ্চিমে।
যোগমায়া সম্মুখে এলে শ্যামাঙ্গ তাকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে। সে লক্ষ্য করে, মাতার মুখখানি বিষাদময়।
সে জানতে চাইলো, মাতঃ, মায়াবতাঁকে যে দেখছি না।
ঐ কথায় যোগমায়ার রুদ্ধ আবেগ উদ্বেল হয়ে উঠলো। বললেন, হতভাগিনী বাইরে আসবে না বৎস, তার বড় দুর্ভাগ্য এখন।
অতঃপর যোগমায়াই বললেন–খণ্ডে খণ্ডে, ইতস্তত, পূর্বাপর সঙ্গতিবিহীন, তবু তিনি বললেন, আর তিনি বললেন বলেই শ্যামাঙ্গ ঘটনাগুলি জানতে পারলো।
বৎস, বড় দুর্ভাগ্য আমাদের, জামাতার সন্ধানে প্রতিদিন সামন্ত হরিসেনের গৃহ থেকে দুজন করে লোক আসছে–জামাতা গৃহত্যাগ করেছে–কবে ফিরবে, কিছুই বলা যায় না। এদিকে আবার বালকদের খেলাধুলার সময় দণ্ডগুলির একটি গুলি মস্তকে লেগে এক জ্ঞানার্থী ব্রাহ্মণের রক্তপাত ঘটায় ভয়ানক একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এ স্থানে এ পল্লীতে ভিক্ষু আর যোগীদের সন্ধান করছে গূঢ়পুরুষেরা–কী অঘটন ঘটবে ভবিষ্যতে, কে জানে–আমরা সম্মুখে অন্ধকার দেখছি, তুমি বৎস, বড় দুর্দিনে এলে।
আমার জন্য চিন্তা করবেন না মাতঃ, শ্যামাঙ্গ জানায়, দুর্দিন সুদিন উভয়ই আমার কাছে একরূপ।
লীলাবতী গৃহদ্বার থেকে যোগীটিকে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলো। মাতুল শিষ্যকে দেখে প্রীত হলেন। অতঃপর দুজনে একটি কক্ষে প্রবেশ করে দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন। লীলাবতীর কৌতূহল হয়েছিলো সামান্য–হয়তো সে ঐ দুজনের আলাপ শুনবার চেষ্টাও করতো–কিন্তু ঐ সময়ই সে মায়াবতীদের গৃহদ্বারে শ্যামাঙ্গকে দেখতে পায়। প্রথম দৃষ্টিতেই সে বিচিত্র একটি স্পন্দন অনুভব করে নিজ রক্তধারায়। ফলে তার ক্রোধ হয়। নিজের উপর, না শ্যামাঙ্গের উপর তা অবশ্য সে স্থির জানে না। কিন্তু ইচ্ছা হয়, একবার লোকটির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াতে। সে জানে, শ্যামাঙ্গের সম্মুখীন হওয়ার আর তার প্রয়োজন নেই। কারণ আম্রপট্টলীর যে সংবাদ জানবার জন্য শ্যামাঙ্গকে তার প্রয়োজন ছিলো, সেই সংবাদ তো তার মাতুল এনে দিয়েছেন। অভিমন্যু দাস আম্রপট্টলীতে নেই, সে সামন্ত হরিসেনের সেনাদলে যোগ দিয়েছে। সুতরাং কোন যুক্তিতে সে এখন শ্যামাঙ্গের সম্মুখীন হবে? লীলাবতী বার দুই শ্যামাঙ্গকে দূর থেকে দেখলো। আর দুইবারই তার মনে হলো, লোকটা প্রতারক, ভণ্ড এবং কাপুরুষ।
লীলাবতী মায়াবতীদের গৃহে এলো অপরাহ্নে। তখনও মায়াবতী ভূমিতে শয়ান। লীলাবতীকে দেখে বললো, আয় এখানে উপবেশন কর।
লীলাবতীর ক্রোড়ে মাথাটি রেখে মায়াবতী কান্নায় ভেঙে পড়লো। বললো, সখী, এ আমার কি হলো?
লীলাবতী সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পায় না। স্বামীর সুখে বড় সোহাগিনী হয়েছিলো মায়াবতী। সেই স্বামী তার হারাবার উপক্রম হয়েছে। এই অবস্থায় সান্ত্বনা বাক্য উচ্চারণ করার কি কোনো অর্থ হয়?
সে বলতে পারে, সখী দুশ্চিন্তা করিস না, তোর স্বামী অবশ্যই ফিরে আসবে–কিন্তু কথাটা কি সত্যি হবে? কে না জানে, বসন্তদাস ভিক্ষুদলের লোক। তাকে সন্ধান করে ফিরছে হরিসেনের লোকেরা। এ অঞ্চলে কোথাও দেখতে পেলেই ওরা বসন্তদাসকে বন্দী করবে। আর একবার ওদের হাতে বন্দী হলে কোনো লোক অক্ষত দেহে ফিরে এসেছে, এমন সংবাদ কারও জানা নেই।
লীলাবতী সখীর মাথায় হাত রাখে। তার রুক্ষ কেশদামে অঙ্গুলি চালনা করে পরম মমতা ভরে। তার মনে হয়, জীবন তাহলে এইরূপই–খণ্ডিত, বিকৃত, প্রতারণাময় এবং হিংস্র। সুখী সংসার বলে জগতে কিছু আছে বলে তার মনে হয় না। সংসারে সুখনীড় রচনা করবার কথা তার, কিন্তু ঘটনা এমন ঘটলো যে, সংসারই তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো–অথচ তার কোনো অপরাধ ছিলো না। আর সখী মায়াবতী! কদিন পূর্বেও যে ছিলো সংসারবৃন্তে প্রস্ফুটিত কুসুমটি, আজ দেখো, তার কী অবস্থা, সে কেমন ধূলিতে লুণ্ঠিত হচ্ছে–তারও কোনো অপরাধ নেই, তাহলে?
সে বললো, সখী, কাঁদিস না–জীবন বিরূপ হয়ে উঠেছে বলে কি তুই তাকে পরিত্যাগ করবি? বরং ওঠ তুই, আয় আমরা শেষ অবধি দেখি, জীবন আমাদের জন্য কিছু দান করতে পারে কি না।
কথা দুটি সে বললো এই জন্য যে এ ছাড়া তার বলবার কিছু ছিলো না। নিজের অতীত বর্তমান সে একত্রে দেখতে পাচ্ছিলো। এক অদৃশ্য বিধানের নিগড়ে আবদ্ধ সবাই। কেবলি ভয়, কেবলি নিষেধ, কেবলই হতাশা। পিতৃগৃহে দেখছে, স্বামীগৃহে দেখছে, মাতুলালয়ে দেখছে–সর্বক্ষেত্রেই জীবন পিষ্ট, সঙ্কুচিত এবং বিবর্ণ। আশা করার কিছুই নেই কারও—কেননা আশা কখনই ফলবতী হয় না। সুতরাং কেবলই চেষ্টা, কোনো প্রকারে যেন বেঁচে থাকা যায়–জীবনের ধর্মে পারা যায় না, সহজ স্বাভাবিকতায় পারা যায় না, কিন্তু তবু বাঁচতে হবে–কৌশলে হোক, ছলনা করে হোক, আত্মপ্রতারণা করে হোক। এমন ক্লান্তিকর দীর্ঘ প্রক্রিয়ার নামই কি তাহলে জীবন? সে চিন্তা করে কূল পায় না।
সন্ধ্যাকালে নদীতীরে শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর সাক্ষাৎ লাভ করলো। লীলাবতী তার মেষ শাবকটি নিয়ে গৃহে ফিরছিলো। বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে শ্যামাঙ্গ ডাকলো, লীলাবতী!
লীলাবতী ঐ ডাক শুনে স্থির হলো মুহূর্তেক, পরক্ষণেই আবার সে সম্মুখপানে অগ্রসর হয়ে চললো। শ্যামাঙ্গের ডাক সে উপেক্ষা করতে চায় বলে মনে হলো। শ্যামাঙ্গ আবার ডাকলো, লীলা–আমি আপনার সঙ্গে দুটি কথা বলতে চাই।
লীলা এবার দাঁড়ায়–এটিও বৃক্ষতল, এবং নিবিড় ছায়া এখানে।
আমি দুঃখিত লীলা, আম্রপট্টলী গ্রামে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
কেন? লীলাবতী কুণ্ঠাবনত পুরুষটির মুখ পানে চায়।
পথিমধ্যে দস্যু আক্রান্ত হয়ে আমি সর্বস্ব হারিয়েছি।
আহা! দুঃখের কথা! লীলা ক্ষুদ্র মন্তব্য করে।
আপনি বিদ্রূপ করতে পারেন, কিন্তু আমি যা বলছি, তার কণামাত্র মিথ্যা নয়।
আর কি কোনো কথা আছে সত্যবাদী পুরুষটির? লীলাবতীর কণ্ঠস্বর এবার গম্ভীর এবং অবিচলিত। জানায়, আমার কাজ আছে, গৃহে আজ অতিথি।
লীলা পদক্ষেপণ করলে শ্যামাঙ্গ বলে, আপনি কোন কারণে আমার উপর রুষ্ট হয়েছেন জানি না, তবে একটি কথা আপনাকে জানানো প্রয়োজন বোধ করি–আমি আপনাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা অবশ্যই পালন করবো।
লীলা আপন মনে যেন হাসে। অতঃপর জানায়, উত্তম কথা, আপনার ভবিষ্যৎ চেষ্টার জন্য পূর্বাহেই ধন্যবাদ। তবে জেনে রাখুন, যার সন্ধানে আপনি যাবেন, তিনি এখন সেখানে নেই–তিনি সামন্ত হরিসেনের বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন–কি, পারবেন সেখান থেকে তাঁকে আনতে?
শ্যামাঙ্গের বুঝতে কষ্ট হয় না, কেন এই ক্ষোভ। লীলাবতীর শ্লেষতীক্ষ কথা তাকে বিলক্ষণ বিদ্ধ করলে সেও লীলাবতীকে জানায়–তাহলে তো আপনি এখন রাজপুরুষের গৃহিণী–আমাদের ভক্তি ও ভয় উভয়ই আপনার প্রাপ্য।
হ্যাঁ, আপনার দেখছি বুঝবার ক্ষমতাটি তীক্ষ্ণ–এখন থেকে বুঝে কাজ করবেন।
সে না হয় করবো, শ্যামাঙ্গ যেন সম্মত হয়। তারপর বলে, কিন্তু একটা কথা কি শুনেছেন?
না বললে কেমন করে শুনবো?
তাহলে শুনুন, অতি শীঘ্রই দুর্ধর্ষ এবং হিংস্র যবন জাতি এদেশে আসছে, ওরা এলে কিন্তু রাজপুরুষদের সত্যি সত্যিই যুদ্ধ করতে হবে–সে বড় কঠিন কাজ হবে তখন।
লীলাবতীর স্বরে আর বিদ্রূপ ধ্বনিত হয় না। সে ধীর পদে কাছে এগিয়ে আসে। বলে, এ সংবাদ আপনি কোথায় পেলেন? সত্যি সত্যিই কি যবন জাতি এদেশে আসবে?
সত্যি-মিথ্যা জানি না, শ্যামাঙ্গ জানায়, আপনাদের গৃহে যে যযাগীটি অতিথি, সে–ই সংবাদটি নিয়ে এসেছে।
এদিকে আবার কুম্ভকার রুহিদাসের পুত্রটিকে নিয়ে যে কাণ্ডটি ঘটেছে তাতে সকলেরই ভয়–সেই পিপ্পলী হাটের মতো কিছু ঘটে না যায়–লীলাবতী চিন্তিত স্বরে জানায়।
শ্যামাঙ্গ দেখলো, এখন লীলাবতী আর চপল নয়, তার স্বরে এখন বিদ্রূপ নেই, ক্রোধ নেই। সে বললো, সাবধানে থাকবেন–প্রয়োজন বোধ করলে এ গ্রাম ত্যাগ করুন– অহেতুক লাঞ্ছিত হওয়ার কোনো অর্থ হয় না।
এ গ্রাম ত্যাগ করে কোথায় যাবো বলুন? শ্যামাঙ্গ দেখে, লীলাবতী তার মুখপানে চেয়ে আছে।
শ্যামাঙ্গ মুখখানি দেখলো, চোখ দুটি দেখলো, কেশপাশ দেখলো, তার মুখে তখন আর বাক্য নিঃসৃত হয় না।
কই, বলুন? কোথায় যাবো এই গ্রাম ত্যাগ করে?
শ্যামাঙ্গের যেন সম্বিৎ ফেরে লীলাবতীর কথায়। মুহূর্তের জন্য সে বিভ্রান্ত হয়েছিলো। বললো, যেখানে হোক, চলে যান–এ গ্রাম নিরাপদ থাকবে না।
আপনি দেখছি আমার জন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়েছেন?
শ্যামাঙ্গ সচকিত হয়। এ কথাও কি বিদ্রূপ? সে বুঝতে পারে না। বলে, আপনার রোষ কি এখনও যায়নি?
না, যায়নি, লীলাবতী উত্তরে জানায়। বলে, আপনার উপদেশের কোনো অর্থ হয়–সমস্ত গ্রাম বিপন্ন হলে আমি কোথায় যাবো, কার সঙ্গে যাবো? আর বিপদ কি শুধু বহিরাগত যবনদের কারণে? কেন, সামন্তপতিদের উপদ্রব নেই? তারা আক্রমণ করে না? বরং আপনাকে বলি, আপনি নিজে সাবধান হন, যে কোনো দিন হরিসেনের অনুচররা এ গ্রামে আসতে পারে–
কথা কটি বলে লীলা চলে গেলো। বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শ্যামাঙ্গ।
তার কিছু বলবার নেই, করণীয়ও কিছু নেই। সে যথার্থই কি কাপুরুষ? সমূহ বিপর্যয় আসন্ন উপলব্ধি করেও সে কেবলমাত্র কটি বাক্য ব্যয় ব্যতীত আর কিছুই করতে পারে না? ধিক তোর এই নিবীর্য অস্তিত্বে–তুই কিছুই করতে পারিস না। সন্ধ্যাকালের নির্জন পথে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে ধিক্কার দিতে আরম্ভ করে।
বহির্বাটির কক্ষটিতে শ্যামাঙ্গের শয়নের স্থান হয়েছে। শ্যামাঙ্গ আহারাদির পর শয্যাগ্রহণ করলো। সমস্ত পল্লী অস্বাভাবিক নীরব। মধ্যে মধ্যে কয়েকটি পথকুক্কুর রোদন করে উঠছে। ঐ শব্দ অদ্ভুত লাগে–অজানা ভয় শিহরিত হয় মনে। কে জানে, কোন দুর্যোগ সমান্ন? বাহিরে শুকদেব ও দীনদাসের কথা শ্রবণে আসছিলো। এক সময় ঐ মৃদু আলাপও গেলো নীরব হয়ে। শ্যামাঙ্গ উপাধান দুহাতে আকর্ষণ করে শয়ন করলো এবং তার ক্লান্ত শরীর অচিরেই নিদ্রাভিভূত হয়ে গেল।
বিপর্যয় আরম্ভ হলো মধ্যরাতে। প্রথমে কিছুই বোঝা যায়নি। দূরে রুহিদাসের গৃহ থেকে যখন চিৎকার ওঠে–তখনও শ্যামাঙ্গ নিদ্রামগ্ন। ক্রমে পল্লীবাসীরা দ্রুতপদে বনভূমি লক্ষ্য করে পলায়ন আরম্ভ করলো। দুটি একটি গৃহে যখন অগ্নিসংযোগ আরম্ভ হয়েছে তখনও শ্যামাঙ্গের নিদ্রাভঙ্গ হয়নি। অকস্মাৎ সে অনুভব করে, কেউ তার কক্ষদ্বারে সজোরে করাঘাত করছে। সে জেগে উঠে বসলে মুহূর্তেক পরই চিৎকার এবং আর্তনাদ শুনতে পায়। দ্বার অর্গলমুক্ত করতেই লীলাবতী কক্ষে প্রবেশ করে। রুদ্ধশ্বাসে বলে, শীঘ্র পলায়ন করুন, বিলম্ব হলে প্রাণ হারাবেন।
শ্যামাঙ্গ বাইরে এসে বললো, মায়াবতীরা কোথায়?
লীলাবতী তার হাত ধরে জানায়, তারা বনভূমির দিকে গেছে, আপনি আসুন আমার সঙ্গে, কথা বলবেন না।
এদিকে ততক্ষণে সমগ্র পল্লীটি জ্বলে উঠেছে। কাদের এই কাজ, কিছুই বোঝ যাচ্ছিলো না। দূরে তরবারি হস্তে বীর ধটিকা পরিধানে কিছু লোককে দেখে অনুমান করা গেলো, এরা আর যাই হোক, দস্যু নয়। দুজনে অগ্রসর হতে গেলেই বাধা পায়, সম্মুখে একটি বৃদ্ধকে প্রহার করা হচ্ছে। শ্যামাঙ্গ প্রমাদ গণনা করে–আজ তবে এখানেই ইহলীলা সাঙ্গ করতে হবে। লীলাকে বলে, তুমি অগ্রে যাও–আমি তোমার পশ্চাতে আসছি। লীলা সজোরে শ্যামাঙ্গের বাহু ধরে রাখে। বলে, ওভাবে পারবেন না, পশ্চাতে যাই চলুন।
পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করতেই দেখা গেলো, লীলাবতীদের গৃহ জ্বলছে।
না এদিকে না, সম্মুখেই চলুন, লীলা ধাবিত হলো।
অন্ধকার, ধূম, অগ্নিশিখা এবং আক্রমণকারীদের সোল্লাস চিৎকার। ঐ যে পলায়– ধর ধর–বলে দুজন শ্যামাঙ্গের পশ্চাতে অনুসরণ করে। লীলাবতীর সাধ্য কি যে বলশালী সৈনিকদের পশ্চাতে ফেলবে। তারা লীলাকে ধরতে উদ্যত হওয়া মাত্র শ্যামাঙ্গ একখানি প্রজ্বলিত বংশদণ্ড দুহাতে তুলে নিলো। ওদিকে দুজনের হাতেই রক্তাক্ত তরবারি। ঐ তরবারি দুখানির বিরুদ্ধে বংশদণ্ডটি আর এমন কি অস্ত্র! লীলা, তুমি চলে যাও–শ্যামাঙ্গ চিৎকার করে। কিন্তু ঐ চিৎকার লীলাবতীর শ্রবণে যায় কি না অনুমান করা কঠিন। সৈন্য দুটি তখন ভয়ানক হাসি হাসছে। শেষ আঘাত একেবারেই আসন্ন। শ্যামাঙ্গ প্রস্তুত হলো–জীবন, তোমাকে বিদায়!
কিন্তু ঐ মুহূর্তেই আবার ধাবমান অশ্বের খুরধ্বনিও শোনা গেলো। ধূম এবং অগ্নিশিখার প্রক্ষিপ্ত প্রতিফলনে দ্রুতগতি ছায়ার মতো অশ্বারোহীদের আগমন নির্গমন দেখা যেতে লাগলো। এই অশ্বারোহীদের কারও হাতে উন্মুক্ত তরবারি, কারও হাতে সুদীর্ঘ শূলদণ্ড, কারও হাতের দীর্ঘদণ্ডে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা। এরাই কি পল্লীটিকে ভস্মীভূত করতে চায়? দীর্ঘদেহ, শ্মশ্রুময় মুখমণ্ডল, মস্তকে উষ্ণীষ–না, কোনো সন্দেহ নেই–এরাই সেই যবন দল। শ্যামাঙ্গ নিশ্চিত হয়।
সৈন্য দুটি যেমন, তেমনি শ্যামাঙ্গও বিমূঢ় দৃষ্টিতে ইতস্তত ধাবমান অশ্বারোহীদের দেখছিলো। ঐ সময় একজনকে সম্মুখে অগ্রসর হতে দেখে সৈন্যরা ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করলো। এবং তারপরও ওদের পশ্চাতে একজন অশ্বারোহীকে ধাবমান হতে দেখা গেলো।
লীলা তার হাত ধরে আকর্ষণ করে, চলুন, মূখের মতো দাঁড়াবেন না।
কিন্তু বারেবারেই দাঁড়াতে হলো দুজনকে। দেখলো, তরবারির আঘাতে বালকের ছিন্নমুণ্ড কেমন ভূমিতে গড়িয়ে পড়ে, শূলাঘাতে বৃদ্ধ কিভাবে দুহাত ঊর্ধ্বে তুলে মরণ চিৎকার কণ্ঠ থেকে নির্গত করে, ধাবমান অশ্বের পদাঘাতে রমণী মস্তক কিভাবে চূর্ণিত হয়। সমস্তই দেখলো দুজনে। এবং ঐসব দৃশ্য দেখতে দেখতে বনভূমির প্রান্তে উপনীত হলো তারা। সেখান থেকেই লীলাবতী চিৎকার করে পিতাকে ডাকতে লাগলো। সে তখন উন্মাদিনীপ্রায়–পিতার সন্ধান করছে, মাতুলের সন্ধান করছে, সখী মায়াবতীর সন্ধান করছে। সে জানে না, কে আছে, আর কে নেই। শ্যামাঙ্গ তখনও প্রজ্বলিত, লুণ্ঠিত, বিধ্বস্ত পল্লীটির দিকে চেয়ে আছে। তার মনে কেবলই প্রশ্ন, এরা কারা? একই স্থানে আঘাত হানে, একই গৃহে অগ্নি দেয়, একই পল্লীর মানুষকে হত্যা করে–অথচ দুটি ভিন্ন দল–এদের মধ্যে কি সত্যিই কোনো পার্থক্য আছে?
বরেন্দ্রভূমির জনপদগুলিতে তখন ঐভাবেই প্রাণ বধ হচ্ছে, গৃহ লুণ্ঠিত হচ্ছে, পল্লী প্রজ্বলিত হচ্ছে। রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে পরম ভট্টারক মহারাজ শ্রীমৎ লক্ষ্মণ সেন দেব সিংহাসনে সগৌরবে আসীন হলেও তাঁর মহাসামন্ত ও সামন্তবর্গ প্রজাপালনের কোনো কাজ করে না। বরঞ্চ তারা বিলাসব্যসন ও প্রজাপীড়নে অধিক মত্ত। ওদিকে যবন জাতির হাতে মহাকালের ডমরুতে অনাহত ধ্বনি বেজে উঠেছে। কেউ জানে না, ভবিষ্যতে কী আছে। বড় ধূসর ঐ প্রদোষকাল!
.
[পরের পর্ব – দুষ্কালের দিবানিশি]