শাহেদুর রহমানের সামনে ফরিদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সংসার। চালানোর কিছু টাকা আজ লাগবেই। বাজার হবে না এমন অবস্থা। স্যারকে ব্যাপারটা যেভাবেই হোক বুঝিয়ে বলতে হবে। বুঝিয়ে বলাটা তার জন্যে কঠিন। সে কাউকেই বুঝিয়ে কিছু বলতে পারে না। মৃন্ময়ী ম্যাডামকেও সে বুঝিয়ে বলতে পারে নি যে রাত সাড়ে এগারোটার টেলিফোনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। মৃন্ময়ী ম্যাডাম হয়ত ধরেই নিয়েছেন সে-ই টেলিফোন করে।
শাহেদুর রহমান ফরিদের দিকে না তাকিয়েই বললেন, আমাকে কিছু বলতে এসেছ?
ফরিদ বলল, জি স্যার।
টাকা লাগবে। টাকা ছাড়া সংসার অচল। এই তো বলবে?
জি স্যার!
সামনের চেয়ারটায় বোস।
স্যারের সামনে বসে ফরিদের অভ্যাস নেই। সে জড়সড় হয়ে বসল। তার মাথা আরও ঝুলে গেল।
শাহেদুর রহমান বললেন, ফরিদ তুমি তাশ খেল?
ফরিদ চমকে উঠে বলল, জি না স্যার!
তাশ চিন তো? না কি তাশও চেন না?
তাশ চিনি।
শাহেদুর রহমান হাসি হাসি মুখে বললেন, তাশ আছে দুই রঙের কালো। এবং লাল। কালো হলো রাতের প্রতীক, লাল হলো দিনের। বুঝেছ?
জি স্যার!
তাশ চার ধরনের স্পেড়, ক্লাভস, ডায়মন্ড এবং হার্ট। এই চার ধরন হচ্ছে চার ঋতুর প্রতীক— শীত, গ্রীষ্ম, শরত, হেমন্ত। বুঝেছ?
জি স্যার।
প্রতিটি গ্রুপে তাশ আছে তেরোটা করে। এই তেরো হলে লুনার সাইকেলের প্রতীক। বত্সরে লুনার সাইকেল আছে তেরোটা। ঠিক আছে?
জি স্যার!
এখন তুমি ভাশের নাম্বারগুলি যোগ কর। গোলাম এগারো, বিবি বারো, সাহেব তেরো। যদি যোগ কর তা হলে যোগফল হবে ৩৬৫, একটা বৎসরে দিনের সংখ্যা হলো ৩৬৫। পুরো ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াল?
ফরিদ কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। সংসার আটকে গেছে টাকার জন্যে, এখানে তাশের ভূমিকাটা কী?
শাহেদুর রহমান বললেন, চেক বই আন। এখন চেক ফেরত আসবে না। ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফরিদ পকেট থেকে চেক বই বের করল। শাহেদুর রহমান চেক বইয়ে দস্তখত করতে করতে বললেন, ব্যাংক থেকে টাকা আনার পথে এক প্যাকেট তাশ কিনে আনবে। গুনে দেখবে যোগ ফল ৩৬৫ হয় কি না।
জি আচ্ছা স্যার!
ফরিদের খুব ইচ্ছা করছে জানতে সমস্যার সমাধান কীভাবে হলো। বড় সাহেব কি ছেলেকে ক্ষমা করেছেন। ব্যাংকে টাকা জমা পড়েছে? ছোট মানুষের বড় বড় বিষয় জানতে চাওয়া উচিত না। কিন্তু ছোট মানুষরা তো হঠাৎ হঠাৎ অনুচিত কাজ করে ফেলে।
শাহেদুর রহমান বই হাতে তার পড়ার চেয়ারে বসলেন। তাঁর হাতে নতুন একটা বই Diseases Treated with Fruits, লেখকের নাম Xiu Zongchang. ফলমূল দিয়ে অসুখ সারানোর কৌশল জানা থাকা ভালো।
রাতকানা রোগ
ক. প্রতিদিন সকালে একটা করে গাজর দশ দিন ধরে যেতে হবে।
খ. পাঁচশ গ্রাম পালং শাক পিষে রস করে দিনে দুবার খেতে হবে। দশ দিন।
প্রতিটি অষুধই দশদিন ধরে খাওয়ার বিধান কেন এটা নিয়ে শাহেদুর রহমান চিন্তা করছেন। দশ দিনের হিসাবটা বুঝা যাচ্ছে না। লোকজ চিকিৎসা চন্দ্র হিসেবে করা হয়। দশ দিন কোনো হিসাবেই যায় না।
ব্যাংক থেকে টাকা পেতে ফরিদের সমস্যা হলো না। ইচ্ছা করলে সে ব্যাংক ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করতে পারত। জিজ্ঞেস করল না। তার টাকা তোলা দিয়ে কথা। সে টাকা তুলবে, এক প্যাকেট তাশ কিনে ঘরে ফিরবে। বসে বসে শুনবে। গুনে দেখবে ৩৬৫ হয়েছে। তার কাজ শেষ।
মৃন্ময়ী তার মার ঘরে। মৃন্ময়ীর হাতে কফির কাপ। কফিতে সে চুমুক দিচ্ছে না। কফির তিতকুটে স্বাদ তার ভালো লাগে না। তবে কফির গন্ধ ভালো লাগে। মগভর্তি কফি হাতে বসে থাকলে মাঝে মাঝে কফির গন্ধ পাওয়া যায়।
শায়লা আজ অনেক ভালো। তিনি তার ঘরের জানালা খুলে দিয়েছেন। ঘরে রোদ ঢুকেছে।
মৃন্ময়ী বলল, মা শুনলাম বাবার টাকাপয়সা সমস্যার নাকি সমাধান হয়ে গেছে।
জানি না।
মৃন্ময়ী বলল, জানবে না কেন? অবশ্যই জান। আমার তো ধারণী কলকাঠি তুমিই নেড়েছ।
শায়লা বললেন, তুই কি ঝগড়া করতে এসেছিস?
মৃন্ময়ী বলল, ঝগড়া না, আমি জানতে এসেছি।
শায়লা বললেন, তোর বাবা পাওয়ার অব এটর্নি পেয়েছে।
মানে কী?
এত কিছু ব্যাখ্যা করতে পারব না। আইনের সব কিছু আমি বুঝি না।
মৃন্ময়ী বলল, তুমি যতটুক বুঝেছ ততটুক বল।
শায়লা বললেন, কোর্ট একটা অর্ডার দিয়েছে। কোর্টের সিদ্ধান্ত হলো তোর দাদাজান মানসিকভাবে সুস্থ না। তিনি তাঁর বিরাট সম্রাজ্যের বিলিব্যবস্থা করতে অক্ষম। কাজেই উনার সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব এখন তোর বাবার।
মৃন্ময়ী বলল, কোর্ট কি দাদাজানের সঙ্গে কথা বলেছে?
শায়লা বললেন, তুই আমার সঙ্গে চিৎকার করছিস কেন? আমি তো কোর্ট?
আমি চিৎকার করছি না। তোমরা একজনকে পাগল বানিয়ে ফেললে?
শায়লা বললেন, যে তোর বাবাকে পাতার পর পাতা গাধা লিখে পাঠায় সে পাগল না? তোর বাবা গাধা?
দাদাজানের কাছে গাধা। একজন বাবার কাছে তার অতি বুদ্ধিমান পুত্রও গাধা হতে পারে।
শায়লা বললেন, তোর সঙ্গে তর্ক করব না। যে মানুষ চেনে না জানে না এমন এক কাজের মেয়েকে বারিধারার চারতলা বাড়ি লিখে দেয় সে গাধা না?
মৃন্ময়ী বলল, কাজের মেয়েকে না দিয়ে তিনি যদি কোনো ইউনিভার্সিটিকে লিখে দিতেন তাহলেও কি তাকে গাধা বলতে? না কি তখন তিনি আরেকটু উন্নত ঘোড়া বলতে?
শায়েলা বললেন, তুই রেগে যাচ্ছিস। মানুষটার কাজকর্ম একটু চিন্তা করে দেখ, দিন-রাত নেংটি পরে বসে থাকে।
উনি উনার নিজের জায়গায় নেংটি পরে থাকেন। নেংটি পরে তোমাদের
কাছে আসেন না। মহাত্মা গান্ধীও কিন্তু নেংটি পরেই ঘুরতেন।
মৃন্ময়ী তুই আমার সামনে থেকে যা। আমি তোর দাদাজানকে পাগল বলি নি। কোর্ট বলেছে। ডাক্তাররা সার্টিফিকেট দিয়েছেন। নিউরোলজিস্টরা রিপোর্ট দিয়েছেন। যে নিউরোলজিস্ট তার চিকিৎসা করছেন তাঁর রিপোর্ট আছে। প্রফেসর সালাম। তুই প্রফেসর সালামের সঙ্গে কথা বল।
মৃন্ময়ী মায়ের সামনে থেকে উঠে গেল। তার অস্থির লাগছে। বাবার সঙ্গে এক্ষুনি সে কঠিন যুদ্ধে যাবে, না কি নিজেকে খানিকটা সামলে নেবে এটা বুঝতে পারছে না। সে প্রচণ্ড রেগেছে। এত রেগে থাকলে লজিক এলোমেলো হয়ে যায়। বাবা শান্ত লাজিকের মানুষ। মৃন্ময়ী দেরি করল না। চারতলায় উঠা শুরু করল। রান্নাঘর থেকে আরেক কাপ গরম কফি নিয়ে নিল। নিজের নার্ভ ঠাণ্ডা রাখার জন্যে তার কফির গন্ধ দরকার।
শাহেদুর রহমান বই পড়ছিলেন। মেয়েকে দেখে হাত থেকে বই নামিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, হ্যালো বিবি।
মৃন্ময়ী বলল, জ্ঞানচর্চা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা যায়?
শাহেদুর রহমান, বললেন, জ্ঞানচর্চা বন্ধ রাখা অন্যায়, তবে আমার BB-র জন্য বন্ধ করা হলো। মা! বেগে আছ কেন?
মৃন্ময়ী বলল, বাবা! দাদাজান কেমন মানুষ?
শাহেদুর রহমান বললেন, অতি জটিল প্রশ্ন। প্রতিটি মানুষই একেক জনের কাছে একেক রকম। তোমার দাদাজান তোমার কাছে এক রকম, আমার কাছে আরেক রকম। আবার কাজের মেয়ে বিন্তির কাছে অন্যরকম।
তোমার কাছে কেমন?
আমার কাছে উনি ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ। প্রচণ্ড ইচ্ছা শক্তি, জানার প্রচণ্ড আগ্রহ। ক্লাস এইটে পড়া বিদ্যা নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন। টাকা রোজগারের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনার দিকে নজর দিলেন। টিচার রেখে অবসর সময়ে পড়েছেন। আমি দিনরাত পড়ি, এই জিনিসটা উনার কাছ থেকে পেয়েছি।
এই মানুষকে তুমি পাগল ডিক্লেয়ার করছ?
শাহেদুর রহমান বললেন, সামান্য ভুল হলো মা। উনি নিজেই নিজেকে পাগল ডিক্লেয়ার করেছেন। তিনি যে দানপত্র করেছেন তার কপি আমার কাছে আছে, পড়লেই বুঝবে। পড়তে চাও?
না।
একটা কথা বলি— তিনি বেশ বড় অংকের টাকা রেখেছেন ঢাকা শহরকে ভিক্ষুক মুক্ত করার পরিকল্পনার জন্যে। তার প্রস্তাব ঢাকা শহরের সব ভিক্ষুককে ধরে বড় একটা জাহাজে করে বঙ্গোপসাগরের কোনো নির্জন দ্বীপে ছেড়ে দিয়ে আসা হবে। আর খোঁজখবর নেয়া যাবে না। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। প্রতি বছর জাহাজ যাবে। সব খরচ তোমার দাদাজানের। ঢাকা ভিখিরি মুক্ত হবার পর অন্যান্য বড় শহর একে একে ধরা হবে।
উইলে এরকম আছে না কি?
হ্যাঁ আছে। আমাকে উনি গাধা ভাবেন, অকর্মণ্য অলস ভাবেন তাতে কিছু যায়-আসে না। আমাকে গাধা-অকর্মণ্য-অলস উনি বানিয়ে রেখেছেন। তাঁর লক্ষ্য একটাই— আমি যেন কিছু করতে না পারি। গুলশানের জমি কিনলাম খুব আগ্রহ নিয়ে, একটা কাজ শুরু করব। কোর্ট ইনজাংশান দিয়ে কাজ বন্ধ করে দিল। তার পেছনে কে? তোমার দাদাজান। উনাকে জিজ্ঞেস করলেই জানবে।
মৃন্ময়ী বলল, তিনি তোমাকে দেখতে পারেন না কেন?
একটা কারণ এই হতে পারে যে, আমি বাবার আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ বের করার চেষ্টা করেছি। যাদের পেয়েছি চাকরি দেবার চেষ্টা করেছি। তোমার দাদাজান এটা একেবারেই পছন্দ করেন নি। ফরিদ ছেলেটার কথাই ধর। তোমার দাদাজানের আপন ভাইয়ের ছেলের ছেলে।
এই ছেলে এটা জানে?
জানে না। না জানাই ভালো।
মৃন্ময়ী উঠে দাড়াল। শাহেদুর রহমান বললেন, মা রাগটা কি সামান্য কমেছে?
মৃন্ময়ী জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেল। শাহেদুর রহমান ডাকলেন ফরিদ। ফরিদ ঘরে ঢুকল। শাহেদুর রহমান বললেন, তাশের নম্বরগুলি যোগ করে দেখেছ কত হয়?
৩৬৪ হয় স্যার! ৩৬৫ হয় না।
তাশের প্রতিটি প্যাকেটে একটা জোকার থাকে। জোকারের নাম্বার এক। ঐ একও যোগ করতে হবে।
জি আচ্ছা স্যার!
মৃন্ময়ী তার কফির মগ ফেলে গেছে। মগটা দিয়ে আসো।
ফরিদ মগ নিয়ে বের হলো।
মৃন্ময়ীর ঘরের দরজা পুরোপুরি বন্ধ না, সামান্য খোলা। ফরিদ দরজায় টোকা দিল। ভীত গলায় বলল, ম্যাডাম! আমি ফরিদ। আপনার কফির মগ ফেলে এসেছিলেন।
ভেতরে আসন।
ফরিদ মগ নিয়ে ঢুকল। মৃন্ময়ী বলল, ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলুন। আমি দাদাজানকে দেখতে যাব।
জি আচ্ছা! ম্যাডাম আমার একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।
বলুন।
রাত সাড়ে এগারোটায় টেলিফোন করা বিষয়ে। আমি টেলিফোন করি না।
একবার তো বলেছেন। আবার কেন?
আপনি মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই। এইজন্য আবার বললাম। আমি প্রমাণ দিতে পারি যে টেলিফোন আমি করি নাই।
মৃন্ময়ী বলল, কী প্রমাণ?
ফরিদ হড়বড় করে বলল, আমি যদি টেলিফোন করতাম তা হলে যেদিন আমাকে ধরলেন তারপর থেকে টেলিফোন করা বন্ধ করে দিতাম। কিন্তু তারপর টেলিফোন করা বন্ধ হয় নাই।
মৃন্ময়ী বলল, আপনি কীভাবে জানলেন টেলিফোন করা বন্ধ হয় নি?
ফরিদের মাথা ঝুলে পড়ল।
মৃন্ময়ী বলল, শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সামনে থেকে যান। ঐ দিনের মতো চৌকাঠে বাড়ি খাবেন না। সাবধানে যান।
ফরিদ সাবধানেই বের হলো। তার মন খুবই খারাপ। টেলিফোন সে করে না। কী করে মৃন্ময়ী ম্যাডামকে এই কথাটা বুঝাবে? তার ইচ্ছা করছে দেয়ালে মাথা ঠুকে মাথা ফাটিয়ে ফেলতে। তাতে লাভ কী?
আলিমুর রহমান আমবাগানে হাঁটাহাঁটি করছেন। আজ তাঁর গায়ে গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি। লুঙ্গির উপর পাঞ্জাবি পরেছেন। লুঙ্গির রঙও গেরুয়া। হাঁটার ভঙ্গিতে কোনো অস্থিরতা নেই। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে না তিনি চিন্তিত কিংবা বিষণ্ণ।
মৃন্ময়ী অনেকক্ষণ হলো এসেছে। সে বাংলার বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছে। বারান্দায় দুটা চেয়ার মুখোমুখি। মাঝখানে টেবিল। ম্যানেজার কালাম পট ভর্তি চা রেখেছে। মৃন্ময়ী চা ঢালে নি। সে দাদাজানের জন্য অপেক্ষা করছে। মৃন্ময়ী যে এসেছে তিনি জানেন। দূর থেকে দেখেছেন। হাত নেড়েছেন। আলিমুর রহমানের নির্দেশ আছে আমবাগানে হাঁটাহাঁটির সময় কেউ তার কাছে আসতে পারবে না। এই সময় তিনি কিছু জটিল চিন্তা করেন।
আলিমুর রহমানের জটিল চিন্তা মনে হয় শেষ হয়েছে। তিনি এগিয়ে আসছেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি।
মৃন্ময়ী আছিস কেমন? ভালো।
তোর জন্যে আমি নতুন একটা নাম ঠিক করেছি মীন। মীন হলো মাছ। মৃন্ময়ী কঠিন নাম। মাছ অনেক সহজ। তোর বাবা যেন তাকে কী ডাকে?
BB ডাকে। Blue Bird.
গাধা তো! গাধা মার্কা নাম দিয়েছে।
দাদাজান চা খাবে?
হুঁ।
মৃন্ময়ী চা ঢালতে ঢালতে বলল, আমবাগানে হাঁটতে হাঁটতে জটিল চিন্তা কী করলে?
আলিমুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, ঠিক করেছি বাকি জীবন ভিক্ষা করে পার করব। দুপুর বেলা এর-তার বাড়িতে থালা নিয়ে উপস্থিত হব। কান্নাকান্না গলায় বলব, মাগো চাইরটা ভাত দেন। তোদের বাড়িতেও একদিন যাব।
তোমার ভিক্ষুক জীবন কবে থেকে শুরু হচ্ছে?
যে কোনোদিন শুরু হয়ে যেতে পারে। আজ বিকেলেও বের হয়ে পড়তে পারি।
মৃন্ময়ী চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোমার মাথা তো আসলেই খারাপ।
আলিমুর রহমান বললেন, এই দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের মাথাই খারাপ। কারোর এক দাগ খারাপ, কারোর দুই দাগ খারাপ। আমার পুরোটাই খারাপ।
বাবা পাওয়ার অব এটর্নি বের করে খুব ভুল তাহলে করে নি?
যা করেছে। ঠিকই করেছে। গাধাটা যে বুদ্ধি খাটিয়ে কাজটা করেছে এতেই আমি খুশি।
মৃন্ময়ী বলল, দাদাজান তুমি কোর্টে যাও। আমি থাকব তোমার সঙ্গে। তোমার রোজগারে তোমার কোনো অধিকার থাকবে না এটা কেমন কথা?
কোনো দরকার নাই। ঝোলা হাতে রাস্তায় নামব। ভাবতেই মজা লাগছে। কেউ কিছু বলতেও পারবে না, কারণ আমি পাগল মানুষ।
মৃন্ময়ী বলল, তুমি সত্যি সত্যি ভিক্ষা করতে বের হবে?
অবশ্যই। আমবাগানে হাঁটাহাঁটি করে এইটাই ভাবছিলাম। ভিক্ষা করার এই আইডিয়া কার কাছ থেকে পেয়েছি জানিস? ফজলুর কাছ থেকে।
ফজলু কে?
জহিরের আর্টিস্ট বন্ধু। যাকে চিকিৎসার জন্যে বাইরে পাঠানোর কথা। ভালো কথা, সব ব্যবস্থা করেছি। ঐ ছেলে হয়ত চলেও গেছে। ছেলেকে দেখতেও গিয়েছিলাম। বাঁচার কোনো কারণ নেই। দেশে মরার বদলে সে মরবে বিদেশে। এইটুকু যা লাভ।
মৃন্ময়ী বলল, দাদাজান আমি কি তোমাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?
আলিমুর রহমান বললেন, পারিস।
মৃন্ময়ী বলল, তুমি এইখানেই থাকবে। এখান থেকে বের হবে না। আমি এসে তোমার সঙ্গে বাস করব।
আলিমুর রহমান শান্ত এবং স্পষ্ট স্বরে বললেন, না। গাধাপুত্রের দয়ায় আমি বাস করব না। মীন শোন, আমি এইমাত্র ঠিক করলাম আজ রাতেই গৃহত্যাগ করব। ভিক্ষার ঝুলি হাতে বের হব।
মৃন্ময়ী বলল, ভালো।
আলিমুর রহমান আনন্দের হাসি হাসতে হাসতে বললেন, পোষাকও ঠিক করে ফেলেছি। লুঙ্গি এবং একটা চাদর।
মৃন্ময়ী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, দাদাজান আমি এখন উঠব। তোমার উদ্ভট কথা শুনতে আর ভালো লাগছে না।
ঢাকায় রওনা হবার আগে আগে মৃন্ময়ী ম্যানেজার কালামকে ডেকে বলল, আমি গেট দিয়ে বের হবার পর পর আপনি গেটে তালা লাগিয়ে দেবেন। দাদজান যেন বের হতে না পারেন। উনার মাথা এখন পুরোপুরি খারাপ। উনি ঠিক করেছেন পথে পথে ভিক্ষা করবেন। এটা করতে দেয়া যাবে না। আপনার প্রধান কাজ উনাকে এই কম্পাউন্ডে আটকে রাখা। ঠিক আছে?
জি ঠিক আছে।
সব সময় তাঁকে চোখে চোখে রাখবেন। যেন পালাতে না পারেন।
আমি বুঝতে পরছি আপা।
কোনো রকম সমস্যা হলে আমাকে টেলিফোন করবেন। কিংবা বাবাকে।
জি আচ্ছা।
আলিমুর রহমান সন্ধ্যাবেলা বের হতে গিয়ে বুঝতে পারলেন তাকে আটকে রাখা হয়েছে।
ম্যানেজার কালাম কাদো কাঁদো গলায় বলল, স্যার আপনি যা বলবেন তাই শুনব, কিন্তু গেট খুলব না।
আমার হুকুম এখন আর চলবে না?
স্যার! আপনার হুকুম অবশ্যই চলবে কিন্তু আমি গেট খুলব না।
আলিমুর রহমান পুকুরঘাটে গিয়ে বসলেন। সারারাত বসে রইলেন। পরের দিনও বসে রইলেন। কিছুই খেলেন না। রাত আটটায় শাহেদুর রহমান এসে বললেন, বাবা গেট খুলে দিয়েছি আপনি যেতে চাইলে যান।
আলিমুর রহমান বললেন, থ্যাংক য়্যু।
শাহেদুর রহমান বললেন, আমার প্রতি কি আপনার কোনো আদেশ আছে?
আলিমুর রহমান বললেন, মীনা নামের একটা মেয়ের জন্যে আমি দানপত্রে কিছু ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম সে যেন তা পায়।
শাহেদুর রহমান বললেন, বাবা আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আপনার দানপত্র অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে। শুধু ভিক্ষুক নিমূল পালন করা যাবে না, কারণ আপনিও তো ভিক্ষুক। তা হলে তো আপনাকেও জাহাজে করে দ্বীপে ফেলে দিয়ে আসতে হয়।
আলিমুর রহমান বললেন, ভিক্ষুক দেখতে পারি না, কারণ আমার বাবা ছিলেন ভিক্ষুক। হাটবারে ভিক্ষা করতেন।
শাহেদুর রহমান বললেন, আপনার সঙ্গে ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। আর হয়ত আপনার সঙ্গে দেখা হবে না। ভাত দিতে বলি?
দিতে বল। আর শোন জহির নামের যে আর্টিস্ট ছেলে আছে তার সঙ্গে মৃন্ময়ীর বিয়ে দেয়া যায় কিনা দেখিস। ছেলেটাকে কোনো কারণ ছাড়াই আমার পছন্দ হয়েছে।
শাহেদুর রহমান বললেন, বাবা আপনার হাতটা একটু ধরি?
আলিমুর রহমান বললেন, না।
তিনি রাত এগারোটায় আনন্দের সঙ্গেই গৃহত্যাগ করলেন।