শারদীয়া সংখ্যা পত্রিকা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনার অবসান হল। শেষ ফর্মার প্রিন্ট অর্ডার দেওয়া হয়ে গেলে প্রিন্টার এসে বলেছিলেন-যান, এবার গঙ্গাস্নান করুন। কিন্তু গঙ্গাস্নানেও কি মুক্তি আছে? পত্রিকা প্রকাশের পরেও হাজার ঝামেলা। লেখকদের কাছ থেকে টেলিফোনে অনবরত তাগাদা আসছে-কী মশাই, বাজারে পত্রিকা বেরুলল, আমরা পাচ্ছি কখন? পিয়ন দিয়ে পাঠাবেন না, পেতে দেরিও হয়, খোয়ও যায়। নিজেই গিয়ে নিয়ে আসব।
দেড় মাস ধরে খাটাখাটুনির পর কোথায় একটু বায়োস্কোপ থিয়েটার দেখে চিত্তবিনোদন করব, তা নয়, ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকতে হবে কখন কে আসবেন পত্রিকা নিতে।
যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই হল। টেলিফোন বেজে উঠতেই রিসিভার তুলেছি, দূরভাষী বন্ধুর পরিচিত কণ্ঠস্বর, স্নান করুণ গম্ভীর।
হ্যালো!
বলুন, কাকে চাই?
আপনাকেই দরকার। আমার গল্পটা দিতে পারলেন না?
চেষ্টা খুবই করেছিলাম। আপনি তো নিজেই দেখে গিয়েছিলেন আপনার গল্পের ছবি প্রুফ সবই তৈরী ছিল।
সেই দেখেই তো নিশ্চিন্ত ছিলাম যে গল্পটা নিশ্চয় প্রকাশিত হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের তালিকায় নাম না দেখেও হতাশ হই নি, কারণ ইতিপূর্বে একাধিক বার বিজ্ঞাপনের তালিকায় নাম না থাকলেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। শুধু আমারই নয়, আরও অনেকের। তাই আজ আপনাদের পত্রিকা প্রকাশিত হতেই অফিস যাবার পথে এসপ্ল্যানেডের স্টল-এ পত্রিকা নেড়েচেড়ে দেখলাম আমার গল্প নেই। অফিস যাওয়া হল না। কাছেই, একটা দোকান থেকে টেলিফোন করছি।
আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। কিন্তু এই জন্যে আপনি অফিসে গেলেন না?
কি করে যাই বলুন। অফিসের সবাইকে বলেছিলাম আপনাদের কাগজেই এবার আমার সবচেয়ে ভাল গল্পটা বেরোচ্ছে।
ছি ছি, আমি খুবই লজ্জিত। আপনি আগে থেকেই সবাইকে না বললেই ভাল হত। জানেন তো অনেক অনিশ্চয়তা নিয়েই আমাদের কাজ করতে হয়।
তা জানি। তবু মনে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সত্যি করে বলুন, গল্পটা কি আপনার পছন্দ হয় নি?
আরে না না, তা কেন হবে? তা ছাড়া আমার পছন্দ-অপছনয় কী যায়-আসে। আপনারা বহুদিন ধরেই লিখছেন, এবং লেখার মধ্যে দিয়ে আপনারা নিজেদের পাঠকও সৃষ্টি করে নিয়েছেন। এখন সম্পাদকের দপ্তর ছাপিয়ে দায়িত্বটা পাঠকদের কাছেই বেশী। আপনার গল্পর ভাল-মন্দর বিচারক আজ তারাই।
সেইজন্যেই তো আপনার পত্রিকায় লেখা দিতে হলে অনেক ভেবেচিন্তে লিখতে হয়। যতক্ষণ না লেখা সম্বন্ধে নিজে নিঃসন্দেহ হতে পারছি ততক্ষণ আপনার কাগজে লেখা পাঠাতে ভরসা পাই না। আপনার পত্রিকার পাঠকরা যে কড়া বিচারক তা আমরা সবাই জানি। তবু আমার লেখা সম্পর্কে এ-অঘটন কেন ঘটল সে-প্রশ্ন মন থেকে কিছুতেই দূর হচ্ছে না।
তাহলে আসল কারণটা আপনাকে খুলেই বলি। আমাদের সাহিত্য সম্রাট শেষ মুহুর্তে খবর পাঠালেন যে তিনি পূজা সংখ্যার জন্য গল্প লেখায় হাত দিয়েছেন, সুতরাং তার জন্য যেন জায়গা রাখা হয়। কতখানি জায়গা রাখতে হবে জানতে চাইলে বললেন যে, গল্প ছোটই হবে, ছ-পাতা জায়গা রাখলেই চলবে। সম্রাটের কথা তো, তাঁর ছোট গল্প মানেই বড় গল্প, বড় গল্প মানে উপন্যাস, উপন্যাস মানে আরেকটি মহাভারত। ছ-পাতার পরিবর্তে বানো পাতা জায়গা রেখেছিলাম। কিন্তু নিজের চোখেই তত দেখেছেন, সে গল্প উনিশ পাতায় এসে ঠেকল। তখন উপায়?
টেলিফোনে আমার সাহিত্যিক বন্ধু বললেন—বুঝেছি। অর্থাৎ আপনি বলতে চান। বড় গল্পটি কয়েকটি ছোট গল্পকে তাড়িয়ে জায়গার জবর দখল নিয়েছে।
হতাশার সুরে আবার বললেন–আমার দুর্ভাগ্য, কোপটা পড়ল আমারই উপর।
তার জন্য আমিই অপরাধী, সাহিত্য সম্রাটকে দোষ দেবেন না। এক্ষেত্রে একজন না একজন বাদ পড়তই। আপনার লেখা বাদ দিলাম এই ভেবে যে আপনার সঙ্গে তো আমার শুধু লেখক-সম্পাদক সম্পর্ক নয়। আমার তাই এই বিশ্বাসটুকু আছে যে আপনি অন্তত আমাকে ভুল বুঝবেন না।
ভুল আমি বুঝি নি। আমার দুঃখের আসল কারণটা তাহলে আপনাকে খুলেই বলি। আমার শালী আমার গল্পের একজন অনুরাগী পাঠিকা। তাকে বলেছিলাম গল্পটা আপনার পত্রিকায় প্রকাশিত হবে। তার কাছে আমার মুখরক্ষা হল না, সেইটিই আমার দুঃখ।
এ কথা শোনার পর স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এর পর কিছু বলা যায় না অথচ কিছু বলতেই হয়। অন্তত সহানুভূতির সঙ্গে দু-চারটি কথা। মানুষের দুর্বলতা কত রকমের থাকে। টেলিফোনে কিছু একটা বলব বলে প্রস্তুত হচ্ছি, ওপার থেকে দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে কথা ভেসে আসে-আর আপনাকে বিরক্ত করব না, নমস্কার।
টেলিফোন ছেড়ে দিলেন। বিমর্ষ মন নিয়ে বসে আছি। একে একে পূজা সংখ্যার লেখকদের আবির্ভাব ঘটতে লাগল। লেখকদের পরস্পরের মধ্যে এক প্রশ্ন—এবারে কে কটা গল্প লিখেছেন। কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টিটিই যেন এযুগে শ্রেষ্ঠতার মাপকাঠি। পুজোর বাজারে কে কতগুলি গল্প লিখেছেন সেইটিই নাকি আজকের দিনে জনপ্রিয়তার কষ্টিপাথর।
বৈঠকের গাল্পিক বন্ধু বললেন—কাল সন্ধ্যায় হাজরার মোড়ের কাগজের স্টল-এ পূজা সংখ্যা পত্রিকাগুলি উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। যে-কাগজ খুলি তাতেই দেখি আমাদের নরেন্দ্রনাথ মিত্র। আমাদের পাড়ার সংহতি সংঘের সার্বজনীন পূজার উৎসাহী ছেলেরা আজ সকালে এসেছিল পত্রিকা দিতে। পাড়ায় যারা চাদা দেয় তাদের নামের তালিকা ছাপানোই এই পত্রিকার উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে সাহিত্যযশঃপ্রার্থী পাড়ার কিছু কিছু ছেলে তাদের গল্প কবিতাও প্রকাশ করে। কাগজটা খুলে দেখি সেখানেও নরেন্দ্রনাথ মিত্র। ভদ্রলোক থাকে এন্টালী, চেতলা সংহতি সংঘের সার্বজনীন পূজা-পত্রিকায় তার লেখা।
বন্ধু যে রকম ভীত শঙ্কিত চোখে কথাটা বললেন সবাই না হেসে থাকতে পারি নি। সেই সঙ্গে মনে পড়ে গেল শৈশবে সুকুমার রায় সম্পাদিত সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কবিতার কথা। কবিতার লাইনগুলি মনে নেই, ভাবার্থ হচ্ছে একটি ছেলে সুন্দরবনে তার মামাবাড়িতে প্রথম বেড়াতে গেছে। সে-দেশে সর্বত্রই সাপ। রাত্রে যে-ঘরে তাকে শুতে দিয়েছিল তার যেদিকে তার চোখ পড়ে সেখানেই দেখে সাপ। চৌকাঠে সাপ, কড়িকাঠে সাপ, মশারির দড়িতে সাপ, মশারির উপরে সাপ, খাটের তলায় সাপ। এই দেখে-দেখে ভয়ে আতঙ্কে পাশবালিশটি আঁকড়ে ধরে চোখ বুজতে যাবে, তখন পাশ বালিশটা ছুঁয়েই দেখে মস্ত একটা সাপ।
কবি-বন্ধু বললেন—আমার কাছে এটা একটা বিস্ময়ের বিষয় যে দশটাপাঁচটা চাকরি করে নরেনদা এত লেখেন কী করে?
আড্ডার সব্যসাচী লেখক বললেন–এইমাত্র আপনাদের অফিসের সামনেই নরেনবাবুর ভাই ধীরেনবাবুর সঙ্গে দেখা। দাদার সংবাদ জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, তিনি নাকি এখনও ঘাড় গুঁজে লিখে চলেছেন এবং অষ্টমীর দিন পর্যন্ত নাকি তার বায়না আছে।
গাল্পিক বন্ধু বললেন–যাক, তাহলে এমন পত্রিকাও আছে যার পূজাসংখ্যা দুর্গা পূজায় না বেরিয়ে কালীপূজায় বোয়োয়।
সব্যসাচী লেখক বললেন—পূজা-সংখ্যার সময়টা ইদানীং অনেকখানি ব্যাপক হয়ে পড়েছে। এদিকে জগন্নাথের রথ ওদিকে কালী পূজা।
আলোচনা যখন এতদুর এগিয়েছে, নিঃশব্দ পদসঞ্চারে আমাদের ঘরে আবির্ভূত হলেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ মিত্র। বৈঠকে তখন কথার তুবড়ি ছুটছিল, ঠাণ্ডা জল পড়তেই তা-যেন হু করে নিবে গেল।
দুরভাষিণীর স্বল্পভাষী লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র কথা বলেন এত আস্তে যে কান পেতে শুনতে হয়। বোধ হয় কম কথা বলেন বলেই তাঁর কলমে গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলি এত মুখর হয়ে ওঠে। কম কথা বলে বেশী লেখার শক্তি অর্জন করতে দেখেছি নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে। এর ঠিক বিপরীত উদাহরণ হচ্ছে আমাদের সৈয়দদা, ডক্টর সৈয়দ মুজতবা আলী। শতং বদ মা লিখ–পূর্বাচার্যদের এই আপ্তবাক্যটি তার জীবনের বীজমন্ত্র। ইদানীং চাপে পড়ে ছিটে-ফোঁটা কিছু লিখেছেন। রাজশেখর বসুর পরে বাংলা সাহিত্যে রসের স্রোত বইয়ে দিতে এর জুড়ি নেই। এর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইনি যতটুকু লিখেছেন, পড়েছেন তার শতগুণ এবং গল্প বলেছেন সহস্রগুণ। বাংলা সাহিত্যের এই জনসনের কোন বস্ওয়েল বন্ধু নেই, এইটিই আক্ষেপের বিষয়। সৈয়দদার গল্প অনেক বলবার আছে, বারান্তরে বলবও। এখন ফিরে আসি নরেনবাবুর কথায়। ঘরে প্রবেশ করা মাত্র টগবগানো ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িতে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেওয়ার নিস্তব্ধতা দেখে নরেনবাবু বললেন—কী ব্যাপার, বাইরে থেকে ঘরে আলোচনার জোর শোরগোল শুনেছিলাম, আমি যেন সে-আলোচনায় বাধা দিলাম বলে মনে হচ্ছে?
সবাই এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে দেখে আমিই অবশেষে বললামএই, আপনার কথাই এতক্ষণ আলোচনা করছিলাম। কথা হচ্ছিল, এবার পূজা-সংখ্যায় কে কটা গল্প লিখেছে। তাতে বৈঠকের বন্ধুরা একবাক্যে রায় দিলেন যে এবারে গল্প সবচেয়ে বেশী লিখেছেন আপনি এবং অষ্টমীর দিন পর্যন্ত আপনার লেখার বায়না আছে।
কথাটা বলতেই নরেনবাবু যেন খানিকটা মুষড়ে পড়লেন। উত্তরে কিছু একটা বলবার জন্য দম নিলেন, কিছু একটা বলতে গিয়ে মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট ধ্বনিও বেরুলো, কিন্তু থেমে গেলেন। কথার পরিবর্তে বেরিয়ে এল একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস।
এবারে সত্যিই আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বৈঠকের অন্যান্যদের চোখে-মুখেও একটা লজ্জা ও সংকোচের ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। নরেনবাবু কি ঘরে ঢােকবার আগে আমাদের আলোচনা বাইরে থেকে শুনতে পেয়েছেন? নরেনবাবু আমাদের সকলেরই অত্যন্ত প্রিয় লেখক। শুধু তাই নয়, এই নিরহঙ্কার নিরভিমানী সরল মানুষটিকে আমরা সবাই ভালবাসি, আর সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথকে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করি বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার অনন্যমনা নিষ্ঠা আর সাহিত্যবোধের প্রতি অনমনীয় দৃঢ়তার পরিচয় পেয়ে। তার মনে কোনরকম আঘাত দেওয়া আমরা তো কল্পনাই করতে পারি না। অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে আমি বললাম-দেখুন নরেনবাবু, আমার কথাটা যদি আপনার কাছে অপ্রিয় বলে মনে হয়ে থাকে তারজন্য আমি ক্ষমা চাইছি।
এবারে নরেনবাবুর মুখে একটু হাসির রেখা দেখা দিল। তিনি একটু থেমে, আমতা-আমতা করে বললেন–আমার দুঃখটা কি জানেন? নারায়ণ। এবারও আমার চেয়ে বেশী লিখেছে। আমি লিখেছি উনিশটা গল্প, ও লিখেছে তেইশটা। তাছাড়া খবর নিয়ে জানলাম ওর বায়না আছে বিসর্জনের দিন পর্যন্ত।
বৈঠকের সব্যসাচী লেখক বললেন–নারায়ণ গাঙ্গুলী তত আপনার বাল্যবন্ধু এবং অভিন্নহৃদয় বন্ধু। আপনাদের দুজনের প্রতিযোগিতায় আমরা, যারা এই মরসুমে দু-চারটে লিখে থাকি, তাদের অবস্থাটা বুঝুন। আপনাদের দুই বন্ধুর নামের নামাবলীতে সব পত্রিকার অঙ্গ আর তার বিজ্ঞাপন মোড়া। আমাদের নাম পাঠকরা আর মনে রাখবে কেন?
নরেনবাবু এবার যেন কণ্ঠে একটু উত্তেজনা ঢেলে বললেন–এই প্রতিযোগিতায় নামানোর জন্য আপনারাই দায়ী। প্রত্যেক বছর আপনারা আমাকে এই নিয়ে ঠাট্টা করেছেন। বলেছেন, যত বেশী গল্পই লিখি না কেন, নারানকে ছাড়াতে পারব না। আমি তাই এবার কোন কাগজকেই ফিরিয়ে দিই নি। কলকাতা মফস্বল যে-কোন জায়গার যে কোন কাগজের সম্পাদক এসে লেখা চাইতেই কথা দিয়েছি এবং কথা রেখেওছি। এত করেও নারানকে ছাড়াতে পারলাম না।
বৈঠকের তরুণ কবি নরেনবাবুকে সান্তনা দেওয়ার সুরে বললেন–দেখুন নরেনদা, নারানদার সঙ্গে এই কম্পিটিশনে আপনার নামাই উচিত হয় নি। নারানা হচ্ছেন প্রলিফিক রাইটার আর আপনি হচ্ছেন প্রটেকটিভ রাইটার। যতই যা-কিছু লিখুন, আত্মরক্ষা করেই আপনি লেখেন। অর্থাৎ সমালোচকরা হয়তো বলবে আপনি ইচ্ছা করলে আরও ভাল লিখতে পারতেন। কিন্তু এ কথা তারা কখনই বলবে না যে আপনি বাজে লিখেছেন।
সব্যসাচী লেখক বললেন–নারায়ণবাবু ঘটনাবহুল গল্প লিখতেই বেশী ভালবাসেন বলেই তার গল্পের গতি দ্রুত। আপনি লেখেন মনস্তত্ত্বমূলক গল্প, তাই অতি সন্তর্পণে আপনার চলা।
আমি বললাম-আমাদের সঙ্গীতশাস্ত্রে যাকে বলে দ্রুত খেয়াল, নারায়ণ বাবুর লেখা হচ্ছে তাই। দুন থেকে চৌদুনে তার গতি। নরেনবাবুর লেখার চালটা হচ্ছে ঢিমালয়ের খেয়াল, রাগের বিস্তার দেখানোই যার উদ্দেশ্য।
নরেনবাবু এবারে সলজ্জ জড়িতকণ্ঠে বললেন—আচ্ছা, আপনারা আজ আমাকে নিয়ে পড়লেন কেন বলুন তো?
আমার গাল্পিক বন্ধু বললেন–পূজা-সংখ্যা বেরিয়ে গেলে শহরসুদ্ধ লোকের মুখে আপনার কথা। যত বেশী গল্পই আপনি লিখুন, একথা কেউই অস্বীকার করবে না যে একটা স্ট্যাণ্ডার্ড আপনি সব লেখাতেই বজায় রাখেন। এ ক্ষমতা খুব কম লেখকেরই থাকে।
নরেনবাবুর চেহারার দিকে লক্ষ্য করলাম। কম কথার এই ঘোট খাটো মানুষটি লজ্জায় যেন টেবিলের তলায় ঢুকে পড়তে পারলে বাঁচেন।
তরুণ কবি বললেন—নারানদার গল্প পাঠকদের দৌড় করায় এবং একেবারে উর্ধ্বশ্বাসে। আর নরেনদা? পাঠকদের হাত ধরে ধীর পদক্ষেপ গহন অরণ্যের মাঝে এনে বলেন-কান পেতে শোন বনমর্মর আর কত বিচিত্র পাখির ডাক, আর শোন হিংস্র শ্বাপদের কবলে অসহায় হরিণীর কাতর ক্রন্দন। চেয়ে দেখ হ্রদের দিকে স্ফটিক-স্বচ্ছ জলের গভীরে কত বিচিত্র প্রাণীর
হঠাৎ নরেনবাবু পকেট থেকে একটা ডায়েরী বার করে কী যেন নিরীক্ষণ করলেন, তার পরেই হঠাৎ উঠে পড়ে বললেন—কই, আমার পূজা-সংখ্যার কাগজটা দিন। সাড়ে চারটা বাজল, পাঁচটার মধ্যে বঙ্গশ্রী অফিসে যাব বলেছি।
পত্রিকা হাতে নিয়েই নরেনবাবু প্রায় এক লাফে ঘরের চৌকাঠ পার হয়েই হাওয়া। নরেনবাবুর গল্প সম্বন্ধে তরুণ কবির কাব্যিক বিশ্লেষণেও বাধা পড়ল। শুধু বৈঠকের সব্যসাচী লেখক টিপ্পনী কেটে নরেনবাবুর পিছনে কথা ছুড়লেন-নরেনবাবু, ঝাকামুটে নিন। একা অতগুলি পূজা সংখ্যা বাড়ি বয়ে নিয়ে যাবেন কি করে?
কে একজন প্রশ্ন করল-নরেনবাবু ডায়েরী দেখতে-দেখতে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে চলে গেলেন কেন জানেন?
আমি বললাম-ওটা একটা উপলক্ষ্য। নিজের লেখার প্রশংসা শুনতে লজ্জা পাচ্ছিলেন বলেই বোধ হয় ডায়েরীর পাতায় মুখ লুকোচ্ছিলেন।
কিছুই জানেন না আপনি। ওঁর ওই ছোট্ট ডায়েরীতে লেখা থাকে কার সঙ্গে কতখানি সময়ের অপব্যয় করবেন। আপনার এখানে টাইম ছিল আধঘন্টা। পার হতেই পগারপার। কিরকম মেথডিক্যাল লোক ভেবে দেখুন। উনি কি আর আমার-আপনার মত? আড্ডায় বসে গেলুম তো কা তব কান্তা।
নরেন্দ্র-নারায়ণ আলোচনার মাথায় মুগুড় মেরে ঝড়ের মত ঘরে ঢুকলেন আমাদের আড্ডার না-লিখে-সাহিত্যিক বিশুদা, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়। ঘরে ঢুকেই চোখ বড় বড় করে বিশুদা বললেন—শুনেছেন, প্রভাতদা কি কাণ্ড করেছেন? একেবারে কেলেঙ্কারির একশেষ।
প্রভাতদা? কোন প্রভাতদা?
আরে আমাদের প্রভাত দেব সরকার গো। এবারে আপনার পূজা সংখ্যায় বিনিয়োগ নামে যে-গল্পটি লিখেছেন, সেটি নাকি ওঁরই এক বিশেষ পরিচিত বাল্যবন্ধুকে নিয়ে লেখা। ওঁর বন্ধু কাজ করে এক সরকারী অফিসে, সেখানে প্রভাতদার এক জ্যাঠতুতো দাদাও কাজ করে। বন্ধুটি গল্প পড়ে ক্ষেপে গিয়ে প্রভাতদাকে হাতের কাছে না পেয়ে অফিসের মধ্যেই তার সেই জ্যাঠতুতো দাদাকে বেদম ঠেঙ্গিয়েছে। চশমা-টশমা ভেজে একাকার। এই নিয়ে অফিসে মহা শোরগোল। এক নিশ্বাসে কথাগুলি বলে হাঁপাতে লাগলেন।
কথাটা শুনে একটু অবাক হয়ে গেলেও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারি নি। বিশুদার কথা তো! বৈঠকে একটা কিছু রুদ্ধশ্বাস গল্প ফেঁদে আসর গরম করায় ওঁর জুড়ি মেলে না।
আমাদের মুখের ভাবসাব দেখে বিশুদা বললেন–কথাটা বিশ্বাস করলেন না তো? ধৰ্ম্মত বুকে হাত দিয়ে বলছি, ঘটনা সত্যি। আমার কালিঘাট পাড়ার একটি ছেলে ওই অফিসে কাজ করে, সে-ই দুপুরে টেলিফোনে খবরটা দিল। সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে টেলিফোনে বার তিনেক ধরবার চেষ্টা করেছি, এনেগেজড। তাই সশরীরে এসে খবরটা দিলাম।
বিশুদা বললে আমার কিন্তু দুশ্চিন্তা আপনাকে নিয়ে। প্রভাতদার যণ্ডামার্কা চেহারা—ওদিকে ঘেষবে না। তা ছাড়া জানেন তো প্রভাতদা হচ্ছে ভবানীপুরের পুরনো পলিটিক্যাল মস্তান। ওঁর গায়ে হাত দেয় এরকম বুকের পাটা কজনের আছে। তবে হ্যাঁ, আপনি ওঁর গল্প ছেপেছেন। আপনাকে কি রেহাই দেবে?
এ আবার কী কথা। গল্প ছেপে শেষকালে মারধোর খেতে হবে? প্রথমেই বলেছিলাম, পূজা-সংখ্যা বাজারে বেরুলে হাজার ঝামেলা। কিন্তু এরকম মারপিটের ঝামেলায় পড়তে হবে আমি তা কস্মিনকালেও কল্পনা করি নি।