শান্তিনিকেতনে যাওয়া একেবারে ঠিকঠাক, তবু বাতিল হয়ে গেল শেষ মুহূর্তে। ফণিভূষণ বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির দর্শন ও সংস্কৃতের অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছেন, থাকতে হবে সেই ক্যামপাসে, বাড়ি বদলের ঝক্কি ঝামেলা কি কম!
রাণুর খুবই মন খারাপ, আবার নতুন বাড়িতে যাবার কিছুটা উত্তেজনাও আছে। নতুন করে জিনিসপত্র গুছোনো, বাড়ি সাজানো। ব্ৰহ্মকুণ্ডের গলির তুলনায় এখানে অনেকটা খোলামেলা আকাশ। গাছপালাও প্রচুর, কিছুটা যেন শান্তিনিকেতনের কথা মনে পড়ে যায়।
এর মধ্যেই গরম পড়ে গেছে বেশ, কিন্তু রাণু আর খালি গায়ে থাকে না। মা বকে বকে তার স্বভাব শুধরেছেন। তার অবশ্য এখনও লজ্জার নম্রতার বদলে চাঞ্চল্যই বেশি। শরীরে যৌবন আসি আসি করছে, কিন্তু রাণু তা টের পায়নি। সে সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে নামে, রাস্তায় কোনও ফেরিওয়ালাকে ডাকার জন্য খালি পায়ে দৌড়ে যায়।
বড় দুই দিদিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে হস্টেলে, রাণু ভর্তি হয়েছে কাছাকাছি ইস্কুলে। পড়াশুনোর চেয়ে সে এস্রাজ নিয়েই সময় কাটায় বেশি। তার গান গাইতেও ইচ্ছে করে, মাঝে মাঝে সে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে আপনমনে গান গেয়ে যায়, জলের কল খোলা থাকলে বাইরে থেকে শোনা যায় না।
হঠাৎ একদিন অ্যান্ড্রুজ সাহেব এই নতুন বাড়িতে এসে উপস্থিত। এই সাহেবটিকে রাণুর বেশ মজার লাগে। কথা বলার সময় মুণ্ডুটা এদিক ওদিক নাড়েন আর দাড়িতে হাত বুলোন। বাংলা উচ্চারণ একেবারে পারেন না, তবু মাঝে মাঝে বাংলা বলা চাই। গুরুদেবকে বলেন গুঢুডেব!
অ্যান্ড্রুজ যে প্রস্তাব দিলেন, তা শুনে রাণু আনন্দে নেচে উঠল।
এই গ্রীষ্মে এদের সবারই শান্তিনিকেতন যাবার কথা ছিল, তাই গুরুদেব ঠিক করে রেখেছিলেন যে রাণুকে দিয়ে তাঁর একটি নাটকে অভিনয় করাবেন। অধিকারী মশাই নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, যেতে পারছেন না, গুরুদেব তা জেনেছেন ও বুঝেছেন যে এখনই আপনাদের পক্ষে যাওয়া অসুবিধেজনক। তবে অধিকারী মশাই যদি রাজি থাকেন, তা হলে শুধু রাণুকে অ্যান্ড্রুজ শান্তিনিকেতন নিয়ে যেতে পারেন, আবার কেউ ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। অ্যাজ শুধু এই জন্যই। কাশীতে আসেননি, লক্ষ্ণৌতে তাঁর অন্য কাজ ছিল, গুরুদেব বলে দিয়েছিলেন, ফেরার পথে কাশীতে নেমে এই কথাটা জানাতে।
রাণুর বাবা রাজি হলেন না। এর আগে রাণু কখনও বাড়ি ছেড়ে একা কোথাও থাকেনি, তাকে অতদূরে পাঠাতে তাঁর মত নেই। কন্যাসন্তান একটু বড় হয়ে উঠলে তার ওপর বিশেষ নজর তো রাখতেই হয়।
রাণু গিয়ে কেঁদে পড়ল তার মায়ের কাছে।
সরযুবালার আপত্তি নেই। একবার শান্তিনিকেতন দেখার পর তাঁর নিজেরই বারবার সেখানে যেতে ইচ্ছে করে। গুরুদেবের সান্নিধ্য পাওয়াই তো বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। কত নতুন নতুন গান শোনা যায়। সন্ধেবেলা ছাদের ওপর সাহিত্য বাসর হয়। এখানে তো সে সব কিছুই নেই।
স্বামীর আশঙ্কা উড়িয়ে দেবার জন্য সরযূবালা বললেন, গুরুদেব রাণুকে এত স্নেহ করেন, রাণু তাঁর কাছে থাকবে, এতে চিন্তার কী আছে?
ফণিভূষণ বললেন, গুরুদেব রাণুকে বিশেষ স্নেহ করেন, তা জানি। কিন্তু তিনি ব্যস্ত মানুষ, তিনি কি সর্বক্ষণ এই দুরন্ত মেয়েকে সামলে রাখতে পারবেন? ওখানে আরও মানুষজন নেই?
সরযূবালা বললেন, শান্তিনিকেতনের সবাই কাশীর লোকদের চেয়ে অনেক ভাল! এখানে কি মেয়েদের একা রাস্তায় বেরোবার উপায় আছে? প্রায়ই তো গুণ্ডাদের উপদ্রবের কথা শোনা যায়। শান্তিনিকেতনে তিনি মহিলাদের সন্ধের পরেও নিঃশঙ্ক চিত্তে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন।
তা ছাড়া গুরুদেব নিজে অনুরোধ করে পাঠিয়েছেন, তা কি প্রত্যাখ্যান করা সমীচীন?
এর পর আর কথা নেই। ফণিভূষণকে সম্মতি জানাতেই হল।
ট্রেনে অ্যান্ড্রুজ সাহেব একগাদা কাগজপত্র ছড়িয়ে সেগুলি পড়াশুনোতেই ব্যস্ত রইলেন। কথাবার্তা বিশেষ বলেন না। রাণুও ‘গল্পগুচ্ছ’ আর ‘বউ ঠাকুরানির হাট’ নিয়ে এসেছে, আগে পড়া গল্পগুলিই আবার পড়ে, বারবার পড়তে তার ভাল লাগে, এক এক সময় বই থেকে চোখ তুলে তলিয়ে থাকে চলন্ত প্রকৃতির দিকে। হ্যাঁ, মনে হয় ট্রেনটা থেমে আছে আর বাইরের মানুষজন, এমনকী গাছপালাগুলোও ছুটছে উলটো দিকে।
টিফিন কেরিয়ার ভর্তি খাবার সঙ্গে দিয়েছেন মা। লুচি, আলুর দম, বোঁদে, গাজা, মালাই। কবির জন্য আলাদা সন্দেশের বাক্স। অ্যাজ সাহেব এ সব কিছুই খাবেন না, রাণু দিতে গেলে তিনি যেন ভয় পেয়ে গিয়ে বলে ওঠেন, ওইসব বস্তু খাইলে পেটের ব্যায়াম হয়।
লুচি খেলে পেটের অসুখ হবে, রাণু এমন কখনও শোনেনি।
ট্রেনের চাকার যে আওয়াজ, তার যেন একটা ভাষা আছে। সমস্ত রেলগাড়িটা যেন ছুটতে ছুটতে বলছে, আর কত দূর, আর কত দূর! রাণুর মনও যেন বলছে সেই কথা, আর কত দূর, আর কত দেরি হবে, কখন দেখা হবে ভানুদাদার সঙ্গে?
একসময় অ্যাজ পড়া থামিয়ে বললেন, শোনো বালিকা, তোমাকে একটা কথা বলা উচিত মনে করি। তুমি গুরুদেবের কাছে যাইতেছ, কিন্তু তাঁহাকে বেশি বিরক্ত করিও না। তাঁহার সময় নষ্ট করিও না। তিনি কত বড় মানুষ, তুমি জানো?
রাণু বলল, হ্যাঁ জানি। পৃথিবীর সব মানুষের চেয়ে তিনি বড়।
রাণুর কথার কৌতুকের সুরটি তিনি ধরতে পারলেন না। তিনি কৌতুকের ধার ধারেন না। গম্ভীর মুখে বললেন, হাঁ, তা বলিতেও পারো। তিনি অতিশয় ব্যস্ত। আমি যখনই তাঁহার নিকটে যাই, দেখি যে তুমি তাঁহার পাশে বসিয়া আছ। তাঁহার সহিত কথা বলিতেছ।
রাণু বলল, তাতে আপনার হিংসে হয় বুঝি?
অ্যান্ড্রুজ বললেন, আমার অনেক কাজের কথা থাকে। সে সব হয় না। তুমি কথা বলিয়া সময় নষ্ট করো।
রাণু বলল, বেশ করব। আমি আমার কবির সঙ্গে কথা বলব।
অ্যান্ড্রুজ চোখ বড় বড় করে তাকাতেই রাণু খিল খিল করে হেসে উঠল।
কামরার অন্য লোকেরা অবাক ভাবে তাকিয়ে থাকে। এক সাহেবের সঙ্গে চলেছে একটি ফুটফুটে কিশোরী মেয়ে। সাহেব দেখলে অনেকেরই সভয় সম্ভ্রম হয়, মেয়েটি কিন্তু মাঝে মাঝেই মজা করছে সাহেবটিকে নিয়ে।
উত্তর প্রদেশ ছাড়িয়ে বিহার, তারপর বাংলায় প্রবেশ করল ট্রেন। এত পুকুর, নদী, খাল বিল দেখলেই বাংলাদেশ চেনা যায়। স্টেশনের নামও বাংলায় লেখা। মুমফালি এখন বাদাম হয়ে গেছে, সীতাফল হয়ে গেছে আতা।
হাওড়া স্টেশনে নেমে অ্যান্ড্রুজ বললেন, গুরুদেব এখন শান্তিনিকেতনে রহিয়াছেন। কিন্তু আমার কিছু কার্য আছে, তাই দুই দিন কলিকাতায় থাকিয়া তারপর সেখানে যাইব।
রাণু বলল, কবি শান্তিনিকেতনে? তা হলে আমার একদিনও কলকাতায় থাকার ইচ্ছে নেই।
অ্যান্ড্রুজ বললেন, বলিলাম যে আমার কিছু প্রয়োজন সারিতে হইবে।
রাণু বলল, আপনার প্রয়োজন আপনি সারুন গে। আমাকে রেল গাড়িতে চাপিয়ে দিন, আমি একাই যেতে পারব।
তা তো আর হয় না। অগত্যা অ্যান্ড্রুজকেও কাজ ফেলে চেপে বসতে হল পরের ট্রেনে।
বোলপুর থেকে ঘোড়ার গাড়িতে শান্তিনিকেতন। সন্ধে হয়ে এসেছে, পশ্চিম আকাশে শেষ সূর্যের রক্তিম ছটা। সঙ্গীত ভবনে ছাত্ররা গান ধরেছে সমস্বরে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ফিরে আসছে। নিজেদের কুলায়।
গাড়িটা প্রার্থনা ভবনের সামনে থামতেই রাণু লাফিয়ে নেমে পড়ল, তারপর ছুট লাগাল মাঠের মধ্য দিয়ে।
একদিকে একটা বেশ বড় বাড়ি তৈরি হচ্ছে, এখন অর্ধসমাপ্ত অবস্থা। প্রথমেই একটা ব্যাপার নতুন লাগল, বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে! আগে সন্ধের সময় ঘরে ঘরে লণ্ঠন জ্বলতে দেখে গেছে রাণু।
সাধুচরণের কাছে জেনে নিল, কোথায় আছেন কবি। তিনি ঘন ঘন বাসস্থান বদল করেন।
একটি একতলা বাড়ির ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে রাণু। দেখল, একটা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কবি, গান গাইছেন নিচু গলায়, সম্ভবত সুর দিচ্ছেন নতুন গানে।
রাণু নিঃশব্দে এগিয়ে পেছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, কে বলুন তো?
গান থামিয়ে কবি বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, ভেবে বলছি।
রাণুর হাত দুটি ধরে বললেন, এমন শুভ্র কমলকলিকার মতো দুটি মুঠি কার হতে পারে? নিভৃত ঝর্নার মতো কণ্ঠস্বর যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। পারিজাত ফুলের সুগন্ধ পাচ্ছি, ঘরের বাতাসও বদলে গেছে, এ যেন বারাণুসীর জাহ্নবীর বাতাস …
ঘুরে দাঁড়িয়ে সবিস্ময়ে তিনি বললেন, এ কী, এর মধ্যে এত বড় হয়ে গেছ?
ফুলকাটা ঘটিহাতা ব্লাউজ পরেছে রাণু, চম্পক বর্ণের শাড়ি, এর মধ্যে যথেষ্ট দীঘল হয়েছে তার বরতনু, মাথার চুল পিঠ ছাড়িয়ে গেছে। দীর্ঘ ট্রেনযাত্রার ক্লান্তির সামান্যতম চিহ্নও নেই মুখে, প্রসাধনও নেই কিছু, যেন সদ্য বৃষ্টি-ধোওয়া প্রকৃতি।
রাণু বলল, বাঃ, বড় হব না?
কবি অস্ফুট স্বরে বললেন, ওহে সুন্দর মরি মরি, তোমায় কী দিয়ে বরণ করি—
রাণু বলল, ও গানটা আমি শুনেছি। এখন কী গান গাইছিলেন, সেটা করুন।
কবি সুর ছাড়াই বলতে লাগলেন, আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় বারে বারে/ ডাক দিয়ে যায় নতুন পাতার দ্বারে দ্বারে।
রাণু তার করমচা রঙের হাতের পাঞ্জা কবির মুখে চাপা দিয়ে বলল, না, এটা শুনব না। জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় আবার কী? না, না, এরকম বলা চলবে না।
কবি হেসে বললেন, বাকিটা শোনো! তাই তো আমার এই জীবনের বনচ্ছায়ে/ফাগুন আসে ফিরে ফিরে দখিন-বায়ে,/নতুন সুরে গান উড়ে যায় আকাশ-পারে,/নতুন রঙে ফুল ফুটে তাই ভারে ভারে—
রাণুর কাঁধে স্নেহময় হাত রেখে তিনি আবার বললেন, ওগো আমার নিত্যনূতন, দাঁড়াও হেসে।/ চলব তোমার নিমন্ত্রণে নবীন বেশে–
রাণু বলল, আপনার কিন্তু এর মধ্যে একটুও বয়েস বাড়েনি।
কবি বললেন, বাড়েনি কী বলছ, বরং যেন কমছে। কাল কী হল শুনবে? কাল আমার পঞ্চম বর্গের ছেলেরা দুপুরবেলা এসে ধরল, তাদের খাওয়াতে হবে। সমরেশ সিংহ নামে একটি ছেলে ওদের সর্দার। সে-ই আমার কাছে এসে দরখাস্ত করলে। আমি বল্লম, আচ্ছা বেশ। তাই সন্ধেবেলা আমার ও বাড়ির নীচের দক্ষিণের বারান্দায় বসে ওদের ভোজ হয়ে গেছে। ওদের ফরমাশ ছিল লুচির। লুচি ডাল ধোকা চাটনি যেমনি পাতে পড়া অমনি কোথায় যে অদৃশ্য হতে লাগল তার ঠিকানা পাওয়া গেল না। তার ওপর আম ছিল, রসগোল্লা ছিল—
রাণু বলল, শুনেই আমার জিভে জল আসছে!
কবি বললেন, তারপর কী হল, ভাগ্যিস বৃষ্টি এসে পড়ল হঠাৎ, নইলে ওদের খাওয়া ফুরোত না, অথচ আমার খাবার ফুরিয়ে যেত। এই লোভী বাঁদরগুলোকে আমি খুব ভালবাসি। ওরা ক্লাসে কী রকম চেঁচায় দেখেছ তো, এখনও সেইরকম চেঁচামেচি করে, সমস্ত শান্তিনিকেতন অশান্ত হয়ে ওঠে—আমার ক্লাসে ওরা মনে করে খেলা—এ তো পড়া নয়, আমি যেন ওদের খেলার সর্দার। সত্যিই আমি তাই—মনের ভিতর দিকে আমার আর বয়েস হল না–তুমি সাতাশ বলেছ, আমি যেন সাতাশের চেয়েও কম—আমি জানি, তাই তোমার ইচ্ছে করে আমাকে ছোট ছেলের মতন সাজাতে, এবং যত্ন করতে, আদর করতে।
রাণু চোখ পাকিয়ে বলল, ভানুদাদা, আপনি আজও চুল আঁচড়াননি।
কবি বললেন, আমার চিরুনি রানিটি যে কোথায় পলাতকা হয়ে যায়। সে বুঝি শুধু তোমার হাতে ধরা দেবে বলেই লুকিয়ে বসে থাকে।
চিরুনি ঠিক খুঁজে বার করল রাণু।
রাণু যে গাল টিপে ধরে চুল আঁচড়ে দেয়, এই ভঙ্গিটা খুব উপভোগ করেন কবি।
তিনি মৃদু সুর করে বললেন:
বঁধুয়া, হিয়া ‘পর আও রে,
মিঠি মিঠি হাসয়ি, মৃদু মৃদু ভাষয়ি,
হমার মুখ পর চাও রে!
রাণু একটু চমকে উঠেই বলল, এ আবার কী? হিন্দি নাকি? এ আবার কী ছাই হিন্দি? এর চেয়ে আমি হিন্দি অনেক ভালো জানি।
কবি বললেন, হিন্দি আমিও খারাপ জানি না। এক সময় মেজদাদা আর মেজ বউঠানের সঙ্গে উত্তর ভারতের মতো জায়গায় গিয়ে থেকেছি। কিন্তু এটা হিন্দি নয়। এটা বাংলাও নয়। এটা নতুন ভাষা, ভানু সিংহের ভাষা। এখন থেকে আমি মাঝে মাঝে তোমার সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলব।
রাণু বলল, আর একটু বলুন! আর একটু!
কবি বললেন:
সজনি সজনি রাধিকা লে
দেখ অবহুঁ চাহিয়া
মৃদুলগমন শ্যাম আওয়ে
মৃদুল গান গাহিয়া
একটু থেমে, কপালটা চেপে ধরে কবি বলতে লাগলেন, তারপর, তারপর…মনে আসছে না, মনে আসছে না, কতকাল আগেকার লেখা…তবে শেষটা শোনো
মল্লিকা চামেলী বেলী
কুসুম তুলহ বালিকা,
গাঁথ বৃথি, গাঁথ জাতি
গাঁথ বকুল মালিকা।
তৃষিত নয়ন ভানুসিংহ
কুঞ্জপথম চাহিয়া
মৃদুল গান শ্যাম-আওয়ে
মৃদুল গান গাহিয়া।
রাণু বলল, আবার করুন তো, আবার করুন তো! আমি মুখস্ত করে নেব।
কবি বললেন, পর পর কি গাওয়া যায়। পরে আবার হবে।
রাণু জিজ্ঞেস করল, এটা কবে লিখেছিলেন?
কবি বললেন, তা প্রায় তোমার বয়েসে!
পরদিন ‘বিসর্জন’ নাটকের রিহার্সালের সময় রাণু দেখল, কবির বয়েসের ব্যাপারটা বাইরের দিক থেকেও কত সত্য।
আগে ঠিক ছিল, ‘বিসর্জন’ নাটকে কবি সাজবেন রঘুপতি। হঠাৎ নিজেই তা বদলে দিলেন, রাণু হবে অপর্ণা, আর তিনি জয়সিংহ। যুবক জয়সিংহের ভূমিকায় তাঁর কী সাবলীল পদক্ষেপ, অভিমানের কী দৃপ্ত ভঙ্গি, কে বলবে তাঁর বয়েস সাতাশের বেশি!
প্রথম কয়েকদিন পার্ট শেখাতে গিয়ে হিমসিম খেতে হল কবিকে।
অন্য সময় রাণু কত চঞ্চল, কত স্বাভাবিক, কিন্তু নাটকের মুখস্ত করা পার্ট বলতে গিয়ে সে দারুণ আড়ষ্ট হয়ে যায়। অপর্ণা হিসেবে তাকে মানিয়েছে চমৎকার, কিন্তু ঠিক ঠিক কথাগুলো বলতে হবে তো!
কবি অবশ্য হাল ছাড়লেন না। তবে, বিসর্জনের মঞ্চস্থ হবার তারিখটি পিছিয়ে গেল অনেক। কারণ, কবিকে এর মধ্যে গুজরাত যেতে হবে কয়েকটি বক্তৃতা দিতে।
নাটকের রিহার্সাল ও গান রচনা বন্ধ করে কবি বক্তৃতা লিখতে বসলেন।
রাণুর তা পছন্দ নয়। কেন কবিকে এত বক্তৃতা দিতে হয়?
রাণু বলল, আমি অতদূর থেকে এলাম, আর আপনি গুজরাতে চলে যাবেন?
কবি বললেন, তা কি কখনও সম্ভব? হয় তুমিও আমার সঙ্গে গুজরাতে যাবে, কিংবা যতদিন তুমি এখানে থাকবে, ততদিন আমি গুজরাত কেন অমরাবতী, অলকাতেও যাব না।
তারপর তিনি বুঝিয়ে বললেন যে, শান্তিনিকেতনের কর্মকাণ্ড চালাবার জন্য তাঁকে অনবরত অর্থচিন্তা করতে হয়। ভিক্ষাপাত্র নিয়ে যেতে হয় দেশে দেশে। অনেকে এমনি এমনি ভিক্ষে দিতে চায় না, তাই বক্তৃতা দিতে হয়। যে কোনও কারণেই হোক, সম্প্রতি বেশ কিছু গুজরাতি ছাত্র এখানে এসে ভর্তি হয়েছে। গুজরাতের বড় বড় ব্যবসায়ীরা টাকা তুলে দেবার আশ্বাস দিয়ে আয়োজন করেছে কয়েকটি বক্তৃতাসভার।
রাণু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আপনাকে বক্তৃতা দিতে হবে না, আমি আপনাকে টাকা দেব!
কবি সকৌতুকে বললেন, তোমার বুঝি অনেক টাকা আছে? অধ্যাপক কন্যা সন্ধান পেয়েছে কোনও গুপ্তধনের? কিংবা যক্ষ অধিপতি স্বয়ং কুবের তোমার ভক্ত হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন মণিমাণিক্য?
রাণু কাঁধের ছোট্ট ঝোলা ব্যাগটি খুলতে খুলতে বলল, আমি পরীক্ষায় ফাস্ট হয়ে তিরিশ টাকা জলপানি পেয়েছি। এই সব টাকা আপনার।
কবি বললেন, শুধু পরীক্ষায় কেন, তুমি অনেক বিষয়েই ফাস্ট। কিন্তু জলপানির সব টাকা দিয়ে দেবে?
রাণু বলল, আমি টাকা নিয়ে কী করব? আপনাকে দেব বলেই তো এনেছি।
কবি বেশ কয়েক মুহূর্ত অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলেন কিশোরীটির দিকে।
তারপর আস্তে আস্তে বললেন, আমি অনেক রাজা-মহারাজের কাছ থেকেও দান পেয়েছি, কিন্তু তোমার এই দানের তুলনা হয় না। দাতাদের মধ্যে তুমি সর্বকনিষ্ঠ শুধু নও, তোমার মতো আর কেউ সর্বস্ব দান করেনি! দাও, আমি মাথা পেতে নিচ্ছি।
টাকাটা হাতে নিয়ে তিনি আবার বললেন, অনেক দিন ধরেই ভাবছি, শান্তিনিকেতনে একটা ঘন্টাঘর বানাতে হবে। তোমার টাকাতেই শুরু হবে সেই কাজ। দাঁড়াও, এখুনি সুরেনকে ডেকে বলছি। এর পর যখন তুমি আসবে, দেখতে পাবে ঘণ্টা তৈরি হয়ে গেছে। যখনই সেই ঘণ্টা বাজবে, আর কেউ না শুনুক, আমি ঠিক শুনতে পাব, তাতে ধ্বনিত হচ্ছে রাণুর নাম। রাণু, রাণু, রাণু, রাণু, ঢং ঢং ঢং ঢং।
তিনদিন পরেই সরযূবালার আগ্রহাতিশয্যে ফণিভূষণ অন্য মেয়েদের নিয়ে পৌঁছলেন শান্তিনিকেতনে। তাঁদের জন্য দেওয়া হল একটি পৃথক বাড়ি, কবির গুজরাট সফরের তারিখ পিছিয়ে গেল।
রাণু অধিকাংশ সময় কবির সঙ্গেই কাটাবে। এটা সবাই ধরে নিয়েছে, তাতে কবির মন ভাল থাকে। তাঁর নতুন করে লেখারও জোয়ার এসেছে।
রাণু কবির কাছে নতুন গল্পের জন্য আবদার করেছিল। কবি তাকে একটি নতুন লেখা শোনালেন, সেটা ঠিক গল্পও নয়, কবিতাও নয়। কিংবা সেটা গল্পও হতে পারে। কবিতাও হতে পারে। সব গল্পেই যে জমজমাট কাহিনী থাকতে হবে, তার কোনও মানে নেই। আবার অনেক কবিতাতেও কাহিনীর আভাস থাকে। ইংরেজ-ফরাসিরা তো ছন্দ-মিল ছাড়াও কবিতা লিখছে।
কবি শোনাতে লাগলেন : এখানে নামলো সন্ধ্যা। সূর্যদেব, কোন দেশে কোন সমুদ্র পারে তোমার প্রভাত হল!
অন্ধকারে এখানে কেঁপে উঠছে রজনীগন্ধা, বাসরঘরের দ্বারের কাছে অবগুণ্ঠিত নববধূর মতো; কোত্থানে ফুটল ভোরবেলাকার কনকচাঁপা।
জাগল কে। নিবিয়ে দিল সন্ধ্যায়-জ্বালানো দীপ, ফেলে দিল রাত্রে-গাঁথা সেউতির মালা।
এখানে একে একে দরজায় আগল পড়ল, সেখানে জানলা খুলে গেল। এখানে নৌকো ঘাটে বাঁধা, মাঝি ঘুমিয়ে; সেখানে পালে লেগেছে হাওয়া…
সূর্যদেব, তোমার বামে এই সন্ধ্যা, তোমার দক্ষিণে ওই প্রভাত, এদের তুমি মিলিয়ে দাও। এর ছায়া ওর আলোটিকে একবার কোলে তুলে নিয়ে চুম্বন করুক, এর পূরবী ওর বিভাসকে আশীর্বাদ করে চলে যাক।
শুনতে শুনতে আবিষ্ট হয়ে গিয়ে রাণু জিজ্ঞেস করল, এটা কবে লিখেছেন?
কবি বললেন, তোমাকে একদিন চিঠি লিখতে লিখতেই এই লেখাটা মনে এসে গেল। কিংবা বলতে পারো, লেখাটাই যেন আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল।
রাণু জিজ্ঞেস করল, এই লেখাটার নাম কী?
কবি বললেন, এটার নাম ‘সন্ধ্যা ও প্রভাত’। এরকম আরও লিখছি, সব মিলিয়ে নাম দেব ভেবেছি ‘লিপিকা’।
রাণু বলল, আমাকে সবগুলোই শোনাতে হবে কিন্তু।
শান্তিনিকেতনের বারোয়ারি রান্না ফণিভূষণের সহ্য হয় না, তিনি আলাদা রাঁধুনি নিযুক্ত করেছেন। সে জন্য রাণু যেখানেই থাকুক, সন্ধের পর এসে বাবা-মায়েদের সঙ্গে খেতে বসতে হয়। এখানে সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে, রাণুর ঘুম আসে না। এক একদিন খাওয়ার পরেও সে আবার চলে যায় কবির কাছে। কিংবা কবিই ডেকে পাঠান তাকে।
কবির পাশটিতে ঘেঁষে বসে, কখনও শিশুর মতন গলা জড়িয়ে ধরে সে লিপিকার লেখাগুলি শোনে। কখনও কখনও দু’বার করে শুনতে চায়। শব্দগুলির ঝংকারে সে শিহরন বোধ করে। এরই মধ্যে কোনও কাজের কথা নিয়ে উপস্থিত হন অ্যান্ড্রুজ। রাণুকে দেখে তিনি স্পষ্ট বিরক্ত হন, তারপর দুজনের মধ্যে যেন নিঃশব্দ প্রতিযোগিতা চলে, কে বেশি আকৃষ্ট করতে পারবে কবির মনোযোগঅধিকাংশ দিনই অ্যান্ড্রুজকেই আগে প্রস্থান করতে হয়।
একদিন বেশি বেশি রাত হয়ে গেল। কবি ও রাণু কথায় কথায়, গল্পে গল্পে এমন বিভোর হয়ে ছিলেন যে সময় টের পাননি। গোটা শান্তিনিকেতন এখন ঘুমন্ত, শুধু জেগে আছে সারমেয়কুল। মাঝে মাঝে তাদের ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। মেঘমুক্ত আকাশ ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়, গাছগুলি সেই জ্যোৎস্নার আদর খাচ্ছে।
কবি নিজে রাণুকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন।
রাণু কারুকে না জানিয়ে, পা টিপে টিপে এসে শুয়ে পড়ল বোনদের পাশে।
পাশের ঘরে ফণিভূষণ এখনও জেগে আছেন। রাণুর ফিরে আসা টের পেয়ে তিনি টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখলেন, কিছু বললেন না।
পরদিন প্রাতরাশের সময় রাণু বলল, বাবা, আমার শান্তিনিকেতন থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করে না। আমি এখানেই পড়তে পারি না?
ফণিভূষণ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না।
সরযূবালা বললেন, কথাটা তো ও মন্দ বলেনি। ওর যখন শান্তিনিকেতন এত ভাল লাগে, ও এখানেই পড়াশুনো করুক না। গুরুদেব ওঁকে এত স্নেহ করেন, তাঁর কাছে থাকলে ও কতকিছু শিখবে। এরকম সৌভাগ্য ক’জনের হয়!
ফণিভূষণ বললেন, গুরুদেবের কাছে বেশি প্রশ্রয় পেয়ে ওর মাথা বিগড়ে যেতে পারে। এখানে থাকলে ওর পড়াশুনো হবে না।
সরযুবালা বললেন, যদি অন্যদের মতন হস্টেলে থাকে? এখানে তো মেয়েদেরও হস্টেল হচ্ছে শুনছি।
ফণিভূষণ বললেন, হস্টেলের খাওয়া তোমার মেয়ের সহ্য হবে?
রাণু বলল, হ্যাঁ বাবা, আমার কোনও অসুবিধে হবে না। আমি ঠিক পারব। আরও তো মেয়েরা থাকবে।
ফণিভূষণ কঠোরভাবে বললেন, রাণু আমি না বলে দিয়েছি, তুমি আমাদের সঙ্গে কাশী ফিরে যাবে। আর কোনও কথা নয়।
কয়েকদিন বাদে বিদায় নেবার সময় স্বয়ং কবি ফণিভূষণকে অনুরোধ করলেন, রাণুকে তিনি নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে শান্তিনিকেতনে পড়াতে চান।
ফণিভূষণ আগেই মনস্থির করে ফেলেছেন। তিনি রাজি হলেন না।