দশম অধ্যায়
শহীদ তিতুমীর
শহীদ তিতুমীর সমসাময়িক একজন অতীব মজলুম ব্যক্তি। তিনিও হাজী শরীয়তুল্লাহর মতো অধঃপতিত মুসলমান সমাজে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর এ নিছক ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনে হিন্দু জমিদারগণ শুধু প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করেনি, ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমান জাতির প্রতি তাদের অন্ধ বিদ্বেষ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অতীব পরিতাপের বিষয় সমসাময়িক ইতিহাসে তিতুমীরের চরিত্র অত্যন্ত বিকৃত করে দেখানো হয়েছে। তার কারণও অতি সুস্পষ্ট। বিদ্বেষপুষ্ট যেসব মন্তব্য করেছেন, তা বিকৃত, কল্পনাপ্রসূত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিতুমীরের ন্যায় একজন নির্মল চরিত্রের খোদাপ্রেমিক মনীষীকে একজন দুশ্চরিত্র, দুর্বৃত্ত ও ডাকাত বলে অভিহিত করা হয়েছে। ডাঃ এ আর মল্লিক তাঁর
British Policy & the Muslims in Bengal গ্রন্থের ৭৬ পৃষ্ঠায় Calcutta Review, Boards Collections, 54222, p-401, Colvin to Barwell, 8 March 1832 para 6, Magistrate of Banaset to Commissioner of Ciccuit, 18 Div.28 November, 1831, para 35 প্রভৃতির বরাত দিয়ে বিকৃত তথ্য পরিবেশন করেছেন। বলা হয়েছে যে, তিতুমীর কোন উল্লেখযোগ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেননি, তবে মুন্সি আমীর নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত জোতদারের পরিবারে বিয়ে করেন। আরও বলা হয়েছে যে, তিতুমীর একজন দুশ্চরিত্র দুর্বৃত্ত বলে পরিচিত ছিলেন এবং নদিয়ার জনৈক হিন্দু জমিদারের অধীনে ভাড়াটিয়া গুন্ডা হিসাবে চাকুরী করেন। এ উক্তিগুলি সম্পূর্ণ সত্যের অপলাপ ব্যতীত কিচু নয়। এসব বিবরণ থেকে অথবা ইসলাম বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে হান্টার সাহেবও মন্তব্য করেন , “এ সময় কোলকাতায় ধর্মীয় নেতার যেসব শিষ্য-শাগরেদ ও অনুসারী ছিল, তাদের মধ্যে পেশাদার কুস্তিগীর ও গুন্ডা প্রকৃতির একটা লোক ছিল তিতুমির নামে। এই ব্যক্তি সম্ভ্রান্ত কৃষকের পুত্র হিসাবে জীবন আরম্ভ করলেও জমিদারের ঘরে বিয়ে করে নিজের অবস্থার উন্নতি করেছিল। কিন্তু উগ্র ও দুর্দান্ত চরিত্রের দরুন তার সে অবস্থা বহাল থাকেনি
”। (W.W. Hunter The Indian Mussalmans. B. D. First Edition, 1975, pp.34-35)।
ইংরেজ খৃষ্টান হান্টার সাহেব মুসলিম জগতের চিরস্মরণীয় ও বরেন্য মনীষী সাইয়েদ আহমদ শহীদ সম্পর্কেও জানা উক্তি করেছেন। যথাস্থানে তার আলোচনা করা হবে। যতোটা নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি শহীদ তিতুমীর সম্পর্কে জানা গেছে, তারই ভিত্তিতেই তাঁর আন্দোলন ও কার্যতৎপরতার আলোচনা আমরা করব। তার ফলে আশা করি, এটাই প্রমাণিত হবে যে, তাঁর শিক্ষা, চরিত্র, খোদাপ্রেম, অসত্য ও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রামী মনোভাবের সাথে উপরের কল্পিত বর্ণনার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই।
পলাশী যুদ্ধের পঁচিশ বছর পর এবং উনবিংশ শতকের পঞ্চম দশকের সমগ্র ভারতব্যাপী আযাদী সংগ্রামের (১৮৫৭) পঁচাত্তর বছর পূর্বে ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে সাইয়েন নিসার আলী ওরফে তিতুমীর পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মীর (সাইয়েদ) হাসান আলী এবং মাতার নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন। (শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ১)।
ইংরেজ ইতিহাস লেখকগণ অবজ্ঞাভরে এবং তিতুমীরকে ছোটো করে দেখাবার জন্যে তাঁকে এক অনুল্লেখযোগ্য কৃষক পরিবার সদ্ভুত বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রখ্যাত সাইয়েদ বংশে জন্মলাভ করেন। প্রাচীনকালে যে সকল অলী-দরবেশ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় আগমন করেন তাঁদের মধ্যে সাইয়েদ শাহ হাসান রাজী ও সাইয়েদ শাহ জালাল রাজীর নাম পুরাতন দলীল দস্তাবেজে পাওয়া যায়। দুই সহোদর ভাই সাইয়েদ আব্বাস আলী ও সাইয়েদ শাহ শাহাদত আলী যথাক্রমে সাইয়েদ শাহ জালাল রাজী ও সাইয়েদ শাহ হাশমত আলীর ত্রিংশ অধস্তন পুরুষে জন্মগ্রহণ করেন মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর। (শহীদ তিতুমীর, আব্দুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ৩-৪)।
তিমুমীর বিয়ে করেন তৎকালীন খ্যাতনামা দরবেশ শাহ সুফী মুহাম্মদ আসমতউল্লা সিদ্দিকীর পৌত্রী এবং শাহ সুফী মুহাম্মদ রহীমুল্লাহ সিদ্দিকীর কন্যা মায়মুনা খাতুন সিদ্দিকাকে। (শহীদ তিতুমীর, আব্দুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ১৬)।
আবু জাফর বলেন, মীর নিসার আলীর পিতার নাম মীর হাসান আলী এবং মাতার নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন। তিতুমীর বিয়ে করেন হযরত শাহ সুফী মোহাম্মদ রহীমুল্লা সিদ্দিকীর কন্যা মায়মুনা সিদ্দিকাকে। বিয়ের চৌদ্দ দিন পরে তাঁর ছোটো দাদা সাইয়েদ ওমর দারাজ রাজী প্রাণত্যাগ করেন। এর ছয় মাস পর তাঁর পিতা মীর হাসান আলীর মৃত্যু হয়। (স্বাধীন সংগ্রামের ইতিহাস, আবু জাফর, পৃঃ ১১৭-১৮)। নিসার আলীর জন্মের আগেই তাঁর আপন দাদা সাইয়েদ শাহ কদমরসুল দেহত্যাগ করেন। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শাহ ওমর দরাজ রাজীর হাতেই মুরীদ হন নিসার আলীর পিতা মীর হাসান আলী।
এসব তথ্য থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে
, সাইয়েদ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর এক অতি উচ্চ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তারপর ও তাঁকে একজন উচ্ছৃংখল দুষ্টপ্রকৃতির যুবক এবং জনৈক হিন্দু জমিদারের গুন্ডাবাহিনীর বেতনভুক্ত সদস্য বলে চিত্রিত করা হয়েছে। তাঁর শিক্ষাদীক্ষা ও চরিত্রগঠন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনায় তাঁর সম্পর্খে উপরের মন্তব্য ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হবে।
তৎকালীন মুসলিম সমাজের সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নিসার আলীর বয়স যখন চার বছর চার মাস চার দিন
, তখন তাঁর পিতামাতা পুত্রের উস্তাদ মুন্সী লালমিয়াকে নিসার আলীর আরবী, ফার্সী ও উর্দুভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্যে নিযুক্ত করা হয়। মাতৃভাষা শিক্ষার প্রতিও তাঁর পিতামাতা উদাসীন ছিলেন না মোটেই। সেজন্যে পার্শ্ববর্তী শেরপুর গ্রামের পন্ডিত রারকমল ভট্টাচার্যকে বাংলা, ধারাপাত, অংক ইত্যাদি শিক্ষার জন্যে নিযুক্ত করা হয়। এ সময়ে বিহার শরীফ থেকে হাফেজ নিয়ামতুল্লা নামে জনৈক পারদর্শী শিক্ষাবিদ চাঁদপুর গ্রামে আগমন করলে, গ্রামের অভিভাবকগণ তাঁকে প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত করেন এবং তিনি কোরআনের হাফেজ হন। উপরন্তু আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্র, ফারায়েজ শাস্ত্র, হাদীস ও দর্শনশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, তাসাউফ, এবং আরবী-ফার্সী কাব্য ও সাহিত্যে বিশেষ পান্ডিত্য লাভ করেন। তিনি আরবী, ফার্সী ও বাংলা ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন।
যে যুগে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন, বাংলার কিশোর ও যুবকরা তখন নিয়মিত শরীরচর্চা করতো। চাঁদপুর ও হায়দারপুর গ্রামের মধ্যস্থলে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা প্রাঙ্গনটি ছিল শরীরচর্চার আখড়া। হায়দারপুর নিবাসী শেখ মুহাম্মদ হানিফ শরীরচর্চা শিক্ষা দিতেন। এ শরীরচচার আখড়ায় শিক্ষা দেয়া হতো ডনকুস্তী
, হাডুডু খেলা, লাঠি খেলা, ঢালশড়কী খেলা, তরবারী ভাঁজা, তীর গুলতী, বাঁশের বন্দুক চালনা প্রভৃতি। হাফিজ নিয়ামত উল্লাহ শুধু আরবী-ফার্সী অথবা কোরআন সকরতও শিক্ষা দিতে থাকেন। প্রত্যহ বৈঠকে ও সন্ধ্যারাত্রিতে তিনি শরীরচর্চার ও অস্ত্রচালনার নানা প্রকার কৌশল শিক্ষা দিতে থাকেন। এ আখড়ার সর্দার ছাত্র হলেন দু’জন –শেখ মুহাম্মদ হানিফ ও সাইয়েদ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর।
সম্ভবতঃ বিংশ শতকের প্রথম দশকেই তাঁর বিয়ে হয়। তার বছর দেড়েক পর তিনি উস্তাদ হাফিজ নিয়ামত উল্লাহর সাথে কোলকাতা এবং তালিবটোলায় (বর্তমান নাম তালতলা) হাফেজ মুহাম্মদ ইসরাইলের বাসায় অবস্থান করতে থাকেন। হাফেজ ইসরাইলও ছিলেন বিহার শরীফের অধিবাসী। তিনি তালতলা জামে মসজিদের পেশ ইমাম নিযুক্ত হন
–এখানেই বিয়ে করে কোলকাতাবাসী হয়ে যান।তালিবটোলা বা তালতলার একটি অংশকে তখন মিসরীগঞ্জ বলা হতো। এখানে কুস্তী প্রতিযোগিতার একটি আখড়া বা কেন্দ্র ছিল যার সভাপতি ছিলেন জামালউদ্দীন আফেন্দী। সে যুগে পেশাদারী কুস্তী প্রতিযোগিতার প্রচলন হয়নি। ধনবান ব্যক্তিগণ শারীরিক শক্তি ও বীরত্ব অর্জনে প্রেরণা দানের জন্যে বিজয়ী ব্যক্তিকে পুরস্কার ও কেলাৎ দান করতেন এবং পরাজিত ব্যক্তিকে শুধু পুরস্কার দিতেন। কুস্তীগিরি করে ধনউপার্জন করতে হবে, এ ধরনের মনোভাব তখন পালোয়ানদের মনে স্থান পায় নি।
তিতুমিরের কলকাতা অবস্থানকালে মিসরীগঞ্জ আখড়ায় কুস্তী প্রতিযোগিতা হতো এবং বিজয়ী পালোয়ানকে প্রচুর এনাম দেয়া হতো। এখানে কুস্তী প্রতিযোগিতায় তিতুমীর বেশ সুনাম অর্জন করেন। হাফিজ নিয়ামতউল্লাহ ও হাফিজ মুহাম্মদ ইসরাইল কুস্তী প্রতিযোগিতার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন।
কুস্তীকেলার আর একজন বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তিনি হলেন মীর্জা গোলাম আম্বিয়া। তাঁর কিঞ্চিৎ পরিচয় দান এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তিনি ছিলেন শাহী খান্দানের লোক এবং ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি ছিলেন জমিদার এবং নিঃসন্তান ছিলেন বলে জমিদারীর যা আয় হতো তার অধিকাংশই সৎকাজে ব্যয় করতেন।
কোলকাতা শহরের ভারত বিভাগপূর্ব কালের মীর্জাপুর আহহার্স্ট স্ট্রীট অঞ্চলে তাঁর জমিদার বাড়ী অবস্থিত ছিল। তাঁর বাড়ীর নাম ছিল মীর্জা মঞ্জিল। তাঁর নামানুসারে মীর্জাপুর স্ট্র্রীট নামকরণ করা হয়। মীর্জা মঞ্জিলের দক্ষিণে ছিল মীর্জা তালাব ও মীর্জাবাগ। এই মীর্জাবাগ পরে মীর্জাপুর পার্ক নামে অভিহিত হয়। যেখানে তাঁর বৈঠকখানা অবস্থিত ছিল, সেটাকে পরে বৈঠকখানা রোড নাম দেওয়া হয়। মীর্জা সাহেব সর্বদা এবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতেন। তিনি বৃদ্ধ বয়সে মীর্জাপুর ও বৈঠকখানা রোডের জমি, মীর্জা তালাব, মীর্জাবাগ প্রভৃতি কোলকাতা মিডিনিসিপালটিকে দান করে এবং বাড়ীঘর ও অন্যান্য বিষয়সম্পত্তি বিক্রী করে মক্কায় হিজরত করেন। যে মীর্জা তালাব ও মীর্জাবাগ ব্রিটিশ রাজত্বের প্রায় শেষ অবধি মীর্জাপুর পার্ক নামে অভিহিত ও সুপরিচিত চিল, বিংশতি শতাব্দীর তিনের দশকে তার নাম দেয়া হয় স্বামী শ্রদ্ধানন্দ পার্ক। এ অধিকার ন্যায়তঃ মিউনিসিপালিটি ছিল না। মীর্জাপুর পার্কে বিশ-পঁচিশ হাজার বিক্ষুব্ধ মুসলমান সমবেত হয়ে এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
উক্ত মীর্জা গোলাম আম্বিয়ার সান্নিধ্যে আসার পর মীর নিসার আলীর একজন কামেল মুর্শিদের হাতে বয়আন করার প্রবল আগ্রহ জাগে। অতঃপর জাকী শাহ নামক জনৈক দরবেশ কোলকাতার তালিবটোলায় আগমন করলে নিসার আলী তাঁর দরবারে হাজির হয়ে মুরীদ হওয়ার বাসনা প্রকাশ করেন। শাহ সাহেত তাঁর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, “বায়তুল্লাহ শরীফের জিয়ারত না করলে তুমি নিযুক্ত পীরের সন্ধান পাবে না”।
প্রকৃত মুর্শিদ প্রাপ্তির আশায় অবশেষে মীর নিসার আলী মক্কা গমন করেন এবং সেখানেই সাইয়েদ আদমদ বেরেলভীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। একানেই মীর নিসার আলী তাঁর হাতে বয়আন করে মুরীদ হন।
হজ্জ্ব ও অন্যান্য ক্রিয়াদি সমাপনান্তে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী তাঁর খলিফা মওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসমাইল ও মওলানা ইসহাককে নিম্নরূপ নির্দেশ দেনঃ-
“তোমরা আপন আপন বাড়ী পৌঁছে দিন পনেরো বিশ্রাম নিবে। তারপর তোমরা বেরেলী পৌঁছুলে তোমাদের নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থান সফর করব। পাটনায় কয়েকদিন বিশ্রামের পর কোলকাতা যাব।
বাংলাদেশের খলিফাগণের প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল নিম্নরূপঃ-
আমি পাটনায় পৌঁছে মওলানা আদুল বারী খাঁ (মওলানা আকরাম খাঁর পিতা), মওলানা মুহাম্মদ হোসেন, মওলানা হাজী শরীয়তুল্লাহ, মওলানা সাইয়েদ নিসার আলী (তিতুমীর), মওলানা সুফী খোদাদাদ সিদ্দিকী ও মওলানা কারামত আলীকে খবর দিব। আমার কোলকাতা পৌঁছার দিন তারিখ তোমরা তাদের কাছে জানতে পারবে। কোলকাতায় আমাদের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে তাতে আমাদের চূড়ান্ত কর্মসূচী গৃহীত হবে।
অতঃপর সকলে মক্কা থেকে স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে নির্দিষ্ট সময়ে তাঁরা কোলকাতার শানসুন্নিসা খানমের বাগানবাড়ীতে সমবেত হন। আলোচনার পর স্থিরীকৃত হয় যে পাটনা মুজাহিদগণের কেন্দ্রীয় রাজধানী হবে এবং প্রত্যেক প্রদেশে হবে প্রাদেশিক রাজধানী। প্রাদেশিক রাজধানী থেকে কেন্দ্রে জিহাদ পরিচালনার অর্থ প্রেরণ করা হবে।
এসব সিদ্ধান্তের পর মওলানা সাইয়েদ নিসার আলী (তিতুমীর) উক্ত বৈঠকে যে ভাষণ দান করেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন-
বাংলাদেশের মুসলমানদের ঈমান খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদেরকে খাঁটি মুসলমান না করা পর্যন্ত তাদেরকে জেহাদে পাঠানো বিপজ্জনক হবে। আমি তাদের মধ্যে ইসলামী দাওয়াত পৌঁছাবার দায়িত্ব নিচ্ছি। শুধু তাই নয়, আমি মনে করি, নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরাও আমাদের সংগ্রামে যোগদান করতে পারে।….কারণ ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, ক্ষত্রিয় ও কায়স্থ জাতির উপর নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা সন্তুষ্ট নয়। আমরা যদি মুসলমানদেরকে পাকা মুসলমান বানিয়ে নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি তাহলে
…কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে কেন্দ্রকে সাহায্য করা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হবে না।
পরামর্শ সভায় অতঃপর স্থির হলো, বাংলা কেন্দ্রকে অপর সকল বিষয়ে গোপনে সাহায্য করবে। কিন্তু প্রকাশ্যভাবে জেহাদে অংশগ্রহণ করবে না। তবে যাঁরা কেন্দ্রের সাথে যোগদান করার ইচ্ছা করবে, তাদেরকে বাধা দেয়া হবে না।
(শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ২২-৩৭)।
তারপর সাইয়েদ নিসার আলী তাঁর কর্মতৎপরতা শুরু করেন যারা বিস্তারিত আলোচনা আমাদের নিম্নে করতে চাই। তাঁর শিক্ষাজীবন থেকে আরম্ভ করে কোলকাতার জীবন, পীরের সন্ধানে ভ্রমণ, হজ্জপালন, সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর শিষ্যত্ব লাভ প্রভৃতি কার্যক্রমের বিবরণ উপরে দেয়া হলো। তিনি যে কখনো কোন হিন্দু জমিদারের গুন্ডাবাহিনীতে ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল হিসাবে কাজ করেছেন, এ কথা একেবারে অমূলক ও ভিত্তিহীন। তাঁর মহান আদর্শ
, চরিত্র ও মহত্বকে বিকৃত করে তাঁকে লোকচক্ষে হেয় ও ঘৃণিত করবার এ এক পরিকল্পিত অপপ্রয়াস।
তিতুমীর তাঁর উপরোক্ত ভাষণে বলেছিলেন, “বাংলাদেশের মুসলমানদের ঈমান বড়োই দুর্বল হয়ে পড়েছে”। তাঁর আন্দোলন তৎপরতা আলোচনার পূর্বে আমাদের জানা দরকার মুসলমানদের ঈমান কতখানি দুর্বল ছিল এবং কি পরিবেশে তিনি তাঁর ইসলামী দাওয়াতের কাজ শুরু করেছিলেন। বাংলার হিন্দুজাতি ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করে এবং আপন মাতৃভূমির প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে মুসলমানদেরকে শুদু রাজ্যচ্যুতই করেনি, জীবিকা অর্জনের সকল পথ রুদ্ধ করেছে এবং একজন মুসলমানের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্বল ঈমানটুকুও নষ্ট করতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। মুসলমানদেরকে নামে মাত্র মুসলমান রেখে ঈমান, ইসলামী জীবন পদ্ধতি ও সংস্কৃতি থেকে দূরে নিক্ষেপ করে নিম্নশ্রেণীর হিন্দু অপেক্ষাও এক নিকৃষ্ট জীবে পরিণত করে তাদেরকে দাসানুদাসে পরিণত করতে চেয়েছিল।
মুসলমান জাতি অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে কতখানি অধঃপতনে নেমে গিয়েছিল তার আলোচনা আমরা পূর্ববর্তী ‘মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজকি ও সাংস্কৃতিক অবস্থা’ শীর্ষক অধ্যায়ে করেছি। তিতুমীরের সময়ে সে অবস্থার কতখানি অবনতি ঘটেছিল, তারও কিঞ্চিৎ আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি।
বাংলার নতুন হিন্দু জমিদারগণ হয়ে পড়েছিল ইংরেজদের বড়োই প্রিয়পাত্র। একদিকে তাদেরকে সকল দিক দিয়ে তুষ্ট রাখা এবং মুসলমানদিগকে দাবিয়ে রাখার উপরেই এ দেশে তাদের কায়েমী শাসন সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। সুতরাং সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানদের উপর হিন্দু জমিদারগণ ন্যায় অন্যায় আদেশ জারী করার সাহস পেতো।
নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদেরকে যেমন ব্রাহ্মণেরা ধর্মকর্মে স্বাধীনতা ও মন্দিরে প্রবেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছিল, অনুরূপভাবে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমাদের মধ্যেও একদল লোককে মুসলমান ব্রাহ্মণরূপে দাঁড় করিয়ে মুসলমান জনসাধারণকে ইসলামের আরোক থেকে বঞ্চিত করলো।
আবদুল গফুর সিদ্দিকী তাঁর গ্রন্থে বলেনঃ-
পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু জমিদার ও উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিরক্ষর মুসলমানদেরকে বুঝাইলঃ তোরা গরীব। কৃষিকার্য ও দিনমজুরী না করলে তোদের সংসার চলে না। এমতাবস্তায় তোদের প্রাত্যহিক, সাপ্তাহিক ও বার্ষিক নামাজ এবং রোজ, হজ্জ, জাকাত, জানাজা, প্রার্থনা, মৃতদেহ স্নান করানো প্রভৃতি ধর্মকর্ম করিবার সময় কোথায়? আর ঐ সকল কার্য করিয়া তোর অর্থোপার্জন করিবার সময় পাইবি কখন এবং সংসার –যাত্রাই বা করিবি কি প্রকারে? সুতরাং তোরাও ধর্মকার্যগুলি করিয়া দিবে, তোদেরও সময় নষ্ট হইবেনা।
দ্বীন ইসলামের শিক্ষা হইতে বঞ্চিত পশ্চিবঙ্গের কৃষক ও কৃষিমজুর শ্রেণীর মুসলমানেরা বাবুদিদের এই পরামর্শ আন্তরিকতার সহিত গ্রহণ করিল। ক্রমে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজেও এই ব্যাধি ছড়াইয়া পড়িল। এই সঙ্গে আজাজিল শয়তান এবং নফস আম্মারা তাহাদিগকে প্ররোচনা দান করিল। তাহারা বাবুদিগের কথার জবাবে বলিলঃ
বাবু আপনি ঠিকই বলিয়াছেন। এতদিন আমাদিগকে এই প্রকার হিতোপদেশ আর কেহ দেন নাই। আমরা নির্বোধ, কিছু বুঝি না। আপনি আমাদের যাহা বিবেচনা করেন তাহা করুন।
(শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ৫-৬)।
বলাবাহুল্য, মুসলমানেরদ ব্রাহ্মণ সাজবার লোকেরও অভাব হলো না। প্রাচীনকালে মুসলমানদের শাহী দরবারে এক শ্রেণীর মুসলমানকে তাদের যোগ্যতার পুরস্কার স্বরূপ ভালো ভালো উপাধিতে ভূষিত করা হতো, উপরন্তু তাদের ভরণপোষণের জন্যে আয়মা, লাখেরাজ ও বিভিন্ন প্রকারের ভূসম্পত্তি দান করা হতো। ইংরেজদের আগমনের পর তাদের এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। তারা হয়ে পড়ে নিঃস্ব –বিত্তহীন। শারীরিক পরিশ্রমে অভ্যস্ত ছিল না বলে তাদের জীবিকার পথও বন্ধ হয়ে গেল। বিদ্যা শিক্ষা করার ক্ষমতাও তাদের ছিল না।
বলতে গেলে তারা সম্ভ্রান্ত ভিখারীর দলে পরিণত হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিল কিছুসংখ্যক শেখ, সৈয়দ, মীর, কাজী প্রভৃতি নামধারী লোক। তারা ছিল প্রাচীন বুনিয়াদী ঘরের সন্তান। কিন্তু অভাবের তাড়নায় তাদেরকে এখন কৃষক, শ্রমিক মজুরদের দ্বারস্থ হতে হয়। তাদের এই অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দুগণ তাদেরকে সহানুভূতির সুরে বলতে লাগলোঃ
চাষী মজুর প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর মুসলমান এখন আর আপনাদেরকে পূর্বের ন্যায় মানে না, মানতে চায় না। ভক্তিশ্রদ্ধাও করেনা। তাদের এরূপ ব্যবহারে আমরাও হৃদয়ে খুব বেদনা অনুভব করে থাকি। কি আর করা যাবে –কলিকাল। আরা চাই যে তাদের ধর্ম কাজগুলি করে দেবার দায়িত্ব আপনাদের উপর ন্যস্ত করে আপনাদেরকে সাহায্য করব। আপনারা মুসলমান সমাজের আখঞ্জী, মোল্লা, উস্তাদজী, মুনশী, কাজী প্রভৃতি পদ গ্রহণ করে তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করুন। তাহলে আপনাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। তারাও আপনাদের অনুগত থাকবে। ধনহারা, মূর্খ, অর্ধমূর্খ, শরাফতীর দাবীদার শেখ
, সৈয়দ, মীর ও কাজীর দল হিন্দু ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য বাবুদিগের কথায় ভুল্লো। তারা আখঞ্জী, মোল্লা, উস্তাদজী ও মুন্সীর পদ গ্রহণ করে মুসলমান জাতির ব্রাহ্মণ সেজে বসলো। মুসলিম জনগোষ্ঠীর জাতীয় সর্বনাশের পথ উন্মুক্ত করল। হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণের আদর্শে মুসলমান সমাজেও ব্রাহ্মণের পদ সৃষ্ট হলো। সাধারণ মুসলমানরা আপাতঃ মধুর ভাবে বিভোর হয়ে ইসলাম ও ইসলামী শরিয়তের পথ থেকে বহুদূরে বিচ্যুত হয়ে পড়লো। হিন্দু ব্রাহ্মণজাতির রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফলে তারা আত্মহত্যা করলো। (শহীদ তিতুমীর –আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ৭ দ্রঃ)।
মুসলমানদের জাতীয় ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বিরান হয়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে হিন্দু পন্ডিতদের গ্রাম্য পাঠশালা স্থাপিত হয়েছে। সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানকেরকে এসব পাঠশালার গুরুমশায়, কুমার, ধোপা, নাপিত, গণকঠাকুর প্রবৃতির সাথেই মিলামিশা করতে হতো। এরা সকলে মিলে মুসলমান ব্রাহ্মণদের ক্ষ্রেত প্রস্তুত করে দিল।
মুসলমানদের মধ্যে যাদের সামর্থ ছিল তারা তাদের সন্তানদেরকে এসব পাঠশালায় প্রেরণ করতো। এখানে হ্নিদু ছাত্রমের সাথে মুসলমান ছাত্রদেরকেও নানা দেবদেবীর স্তবস্তুতি, বিশেষ করে সরস্বতীর বন্দনা মুখস্ত করতে হতো।
পাঠ্যপুস্তকগুলি হিন্দুধর্মের মহিমা কীর্তন, দেবদেবীর বন্দনা ও স্তবস্তুতিতে পরিপূর্ণ ছিল। মুসলমান ছাত্রের রুচি –কোমল হৃদয়ে হিন্দুধর্মের ছাপ অংকিত হয়ে যেতো। স্কুলে পড়াশেষে নিম্নের ছড়া আবৃত্তি করে গুরু মশায়কে নমস্কার করে বাড়ী যেতে হতো-
সরস্বতী ভগবতী
, মোরে দাও বর,
চল ভাই পড়ে সব
, মোরা যাই ঘর।
ঝিকি মিকি ঝিকিরে সুবর্ণের চক
,
পাত-দোত নিয়ে চল
, জয় গুরুদেব।
তার পর রইলো নৈতিক দিক। ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্যের দ্বারা বৈষ্ণব ধর্মমত প্রবর্তিত হওয়ার ফলে হিন্দুজাতির চরম নৈতিক অধঃপতন ঘটেছিল। শ্রীকৃষ্নের প্রেমলীলা, ধর্মের নামে নেড়া-নেড়ী তথা মুন্ডিত কেশ বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের যে জঘন্য যৌন অনাচারের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল তা শুধু হিন্দু সমাজের একটা বৃহত্তর অংশকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি, অশিক্ষিত সাধারণ মুসলমানদেরকেও এ অনাচারের দিকে আকৃষ্ট করেছিল। বামাচারী তান্ত্রিকদের যৌন অনাচারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলমানদের মধ্যেও একশ্রেণীর ভন্ড যৌনাচারীর আবির্ভাব ঘটে এবং তারা সাধারণ মুসলমানকেরকে ধর্মের নামে যৌন উচ্ছৃংখলতার (SEXUAL ANARCHY)পংকিল গর্তে নিমজ্জিত করে। তদুপরি পীরপূজা ও কবরপূজার ব্যাপক প্রচলন মুসলমানদেরকে পৌত্তলিক হিন্দুসম্প্রদায়ের সমপর্যায়ে পৌছিয়ে দিয়েছিল।
তারপর মুসলমানদের নামকরণের ব্যাপারেও হিন্দুরা অন্যায় হস্তক্ষেপ করা থেকেও ক্ষান্ত হয়নি। বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার নামে তারাম মুসলমানদেরকে বিপথে টেনে নিয়ে গেছে। হিন্দু ঠাকুর মশায়রা বলা শুরু করলোঃ
অতএব ঠাকুর মশায়ের ব্যবস্থা অনুসারে মুসলমানদের নাম রাখা হতে লাগলো গোপাল, নেপাল, গোবর্ধন, নবাই, কুশাই, পদ্ম, চিনি, চাঁপা, বাদল, পটল, মুক্তা প্রভৃতি। ছোটবেলা গ্রামঞ্চলের বুহ মুসলমানের এ ধরনের নামের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম।
অতঃপর ঠাকুর মশায়দের হিতোপদেশে বিভ্রান্ত হয়ে মুসলমানরা তহবন্দ ছেড়ে ধূতি পরিধান করা শুরু করলো, দাড়ি কামিয়ে গোঁফ রাখা ধরলো। বলতে গেলে মুসলমানকে মুসলমান বলে চিনবার কোন উপায়ই ছিল না।
মুসরমানদের এ চরম ধর্মীয় ও নৈতিক অধঃপতনের সময় সাইয়েদ নিসার আলী ওরফে তিতুমীরের আবির্ভাব হয়েছিল। তিনি তাঁর মহান কাজ পরিপূর্ণ করে যেতে পারেননি বটে, কিন্তু যে ধর্মীয় ও নৈতিক অনাচার এবং হিন্দু জমিদাদের অন্যায় উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তা পরবর্তীকালে মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় আজাদীর পথে আলোকবর্তিকার কাজ করেছে।
তিতুমীর কোলকাতায় সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর পরামর্শ সভা সমাপ্তের পর নিজ গ্রাম চাঁদপুরে ফিরে এসে কিছুদিন বিশ্রাম গ্রহণের পর তাঁর ইসলামী দাওয়াতেরক কাজ শুরু করেন।
তিতুমীরের দাওয়াতের মূলকথা ছিল ইসলামে পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন এবং প্রত্যেকটি কাজেকর্মে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ পালন। হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার উৎপীড়নকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই বলেন যে, কৃষক সম্প্রদায়ের হিন্দুদের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সারফরাজপুর নামক গ্রামবাসীর অনুরোধে তিনি তথাকার শাহী আমলের ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রচারের জন্যে তাঁর একটি খানকাহ স্থাপন করেন। এখানে জুমার নামাজের পর তিনি সমবেত হিন্দু-মুসলমানকে আহবান করে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেনঃ
ইসলাম শান্তির ধর্ম। যারা মুসলমান নয় তাদের সাথে শুধু ধর্মের দিক দিয়ে পৃথক বলে, বিবাদ বিসম্বাদ করা আল্লাহ ও তাঁর রসূল কিছুতেই পছন্দ করেন না। তবে ইসলাম এ কথা বলে যে, যদি কোন প্রবল শক্তিশালী অমুসলমান কোন দুর্বল মুসলমানের উপর অন্যায় উৎপীড়ন করে, তাহলে মুসলমানরা সেই দুর্বলকে সাহায্য করতে বাধ্য।
তিনি আরও বলেন, মুসলমানদেরকে কথাবার্তায়, আবচার-আচরণে প্রকৃত মুসলমান হতে হবে। তারা যদি অমুসলমানের আচার-আচরণ, চাল-চলন ও কাজকর্ম পছন্দ করে তাহলে শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাদেরকে অমুসলমানদের সাথে স্থান দিবেন। তিতুমীর বলেন, ইসলামী শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মা’রফাৎ -এ চার মিলিয়ে মুসলমানদের পূর্ণাংগ জীবন এবং এর মধ্যেই রয়েছে তাদের ইহকাল পরকালের মুক্তি। এর প্রতি কেউ উপেক্ষা প্রদর্শন করলে আল্লাহ তাকে কঠোর শাস্তি দিবেন। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাঁটা মুসলমানদের অবম্য পালনীয় কর্তব্য। যারা অমুসলমানদের আদর্শে এসব পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিবেন।
এ ছিল তাঁর প্রাথমিক দাওয়াতের মূলকথা। তিনি অনর্গল হৃদয়গ্রাহী বাষায় বক্তৃতা করতে পারতেন এবং তাঁর বক্তৃতা ও প্রচারকার্য বিপথগামী ও সুপ্ত মুসলমানদের মধ্যে এক অভাবিতপূর্ব জাগরণ এনে দিল।
তিতুমীর যে কাজ শুরু করলেত তার মধ্যে অন্যায়েল কিছু ছিল না। বরঞ্চ মুসলমান হিসাবে এ ছিল তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু বর্ণহিন্দুগণ তা সহ্য করবে কেন? মুসলমান জাতিকে নির্মূল করার গভীল ষড়যন্ত্র তাদের নস্যাৎ হয়ে গেল, তারা অগ্নিশর্মা হয়ে পড়লো তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের প্রতি। তাদেরকে নির্মূল করার জন্যে এক নতুন চক্রান্ত শুরু হলো।
সরফরাজপুরের ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পুনঃসংস্কার, আবার জামায়াতে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা, নামাজান্তে সমবেত লোকদের সামনে তিতুমীরের জ্বালাময়ী ভাষণ –পুঁড়ার জমিদার কৃষ্নদেব রায়কে সন্ত্রস্ত ও চঞ্চল করে তুল্লো। তিতুমীরের গতিবিধি ও প্রচার-প্রাচারণা সংবাদাদি সংগ্রহের ভার জমিদারের অনুগত ও বিশ্বস্ত মুসলমান পাইক মতির উপর অর্পিত হলো। জমিদার মতিকে বল্লো-
তিতু ওহাবী ধর্মাবলস্বী। ওহাবীরা তোমাদের হযরত মুহাম্মদের ধর্মমতের পরম শত্রু। কিন্তু তারা এমন চালাক যে, কথার মধ্যে তাদেরকে ওহাবী বলে ধরা যাবে না। সুতরাং আমার মুসলমান প্রজাদেরকে বিপথগামী হতে দিতে পারি না। আজ থেকে তিতুর গতিবিধির দিকে নজর রাখবে এবং সব কথা আমাকে জানাবে।
অতঃপর কৃষ্ণদেব রায় গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় এবং গোবরডাঙার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তিতুমীরের বিরুদ্ধে শাস্তিভংগের নালিশ করার জন্যে কিছু প্রজাকে বাধ্য করল। তারপর জমিদারের আদেশে মতিউল্লাহ, তার চাচা গোপাল, জ্ঞাতিভাই নেপাল ও গোবর্ধনকে দনিয়ে জমিদারের কাচারীতে উপস্থিত হয়ে নালিশ পেশ করলো। তার সারমর্ম নিম্নরূপ-
চাঁদপুর নিবাসী তিতুমীর তার ওহাবী ধর্ম প্রচারের জন্যে আমাদের সর্পরাজপুর (মুসলমানী নাম সরফরাজপুর) গ্রামে এসে আখড়া গেড়েছে এবং আমাদেরকে ওহাবী ধর্মমতে দীক্ষিত করার জন্যে নানারূপ জুলুম জবরস্তি করছে। আমরা বংশানুক্রমে যেভাবে বাপদাদার ধর্ম পালন করে আসছি, তিতুমীর তাদে বাধা দান করছে। তিতুমীর ও তার দলের লোকেরা যাতে সর্পরাজপুরের জনগণের উপর কোন প্রকার অত্যাচার করে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করতে না পারে, জোর করে আমাদের দাড়ি রাখতে, গোঁফ ছাঁটতে, গোহত্যা করতে, আরব দেশের নাম রাখতে বাধ্য করতে না পারে, হিন্দু-মুসলমানে দাংরগা বাধানে না পারে, হুজুরের দরবারে তার বিহিত ব্যবস্থার জন্যে আমাদের নালিশ। হুজুর আমাদের মনিব। হুজুর আমাদের বাপ-মা।
গোপাল, নেপাল, গোবর্ধনের টিপসইযুক্ত উক্ত দরখাস্ত পাওয়ার পর জমিদার কৃষ্ণদেব রায় হুকুম জারী করলো।
১। যারা তিতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ওহাবী হবে, দাড়ি রাখবে, গোঁফ ছাঁটবে তাদেরকে ফি দাড়ির জন্যে আড়াই টাকা ও ফি গোঁফের জন্যে পাঁচ সিকা করে খাজনা দিতে হবে।
২। মসজিদ তৈরী করলে প্রথ্যেক কাঁচা মসজিদের জন্যে পাঁচশ’ টাকা এবং প্রতি পাকা মসজিদের জন্যে এক হাজার টাকা করে জমিদার সরকারে নজন দিতে হবে।
৩। বাপদাদা সন্তানদের যে নাম রাখবে তা পরিবর্তন করে ওহাবী মতে আরবী নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্যে খারিজানা ফিস পঞ্চাম টাকা জমিদার সরকারে জমা দিতে হবে।
৪। গোহত্যা করলে তার ডান হাত কেটে দেয়া হবে –যাতে আর কোনদিন গোহত্যা করতে না পারে।
৫। যে ওহাবী তিতুমীরকে বাড়ীতে স্থান দিবে তাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
(শহীদ তিতুমীর –আবদুল গফুর সিদ্দিকী পৃঃ ৪৮, ৪৯; স্বাধীনতা সংগ্রাসের ইতিহাস, আবু জাফর পৃঃ ১১৯; Bengal Criminal Judicial Consultation, 3 April 1832, No. 5 and 6)।
মুসলমান প্রজাদের উপরে উপরোক্ত ধরনের জরিমানা ও উৎপীড়নের ব্যাপারে তারাগুনিয়ার জমিদার রাম নারায়ণ, কুরগাছির জমিদারের নায়েব নাগরপুর নিবাসী গৌড় প্রসাদ চৌধুরী এবং পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের নাম পাওয়া যায় –Bengal Criminal Judicial Consultancy, 3 April 1832, No.5 রেকর্ডে। (Dr. AR Mallick, British Policy & the Muslims in Bengal, p.76)।
বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে জমিদার রাম নারায়ণের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল যাতে জনৈক সাক্ষী একথা বলে যে –উক্ত জমিদার দাড়ি রাখার জন্যে তার পঁচিশ টাকা জরিমানা করে এবং দাড়ি উপড়ে ফেলার আদেশ দেয়। Bengal Criminal Judicial Consultancy, 3 April 1832, No.5; (Dr. AR Mallick, British Policy & the Muslims in Bengal, p.76)।
তিতুমীর কৃষ্ণদেব রায়কে একখানা পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, তিনি কোন অন্যায় কাজ করেননি, মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ করছেন। এ কাজে হস্তক্ষেপ করা কোনক্রমেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাঁটা প্রভৃতি মুসলমানের জন্যে ধর্মীয় নির্দেশ। এ কাজে বাধা দান করা অপর ধর্মে হস্তক্ষেপেরই শামিল।
তিতুমীরের জনৈক পত্রবাহক কৃষ্ণদেব রায়ের হাতে পত্রখানা দেয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল তাও পাঠক সমাজের জেনে রাখা প্রয়োজন আছে –তা এখানে উল্লেখ করছি।
পত্রখানা কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করলে পত্রবাহক চাঁদপুরের তিতুমীর সাহেবের নাম করে। তিতুমীরের নাম শুনতেই জমিদার মশাইয়ের গায়ে আগুন লাগে। রাগে গর গর করতে করতে সে বল্লো, কে সেই ওহাবী তিতু? আর তুই ব্যাটা কে?
নিকটে জনৈ মুচিরাম ভান্ডারী উপস্থিত ছিল। সে বল্লো, ওর নাম আমন মন্ডল। বাপের নাম কামন মন্ডল। ও হুজুরের প্রজা। আগে দাড়ি কামাতো, আর এখন দাড়ি রেখেছে বলে হুজুর চিনতে পারছেন না।
পত্রবাহক বল্লো, হুজুর আমার নাম আমিনুল্লাহ, বাপের নাম কামালউদ্দীন, লোকে আমাদেরকে আমন-কামন বলে ডাকে। আর দাড়ি রাখা আমাদের ধর্মের আদেশ। তাই পালন করেছি।
কৃষ্ণদেব রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ব্যাটা দাড়ির খাজান দিয়েছিস, নাম বদলের খাজনা দিয়েছিস? আচ্ছা, দেখাচ্ছি মজা। ব্যাটা আমার সাথে তর্ক করিস, এত বড়ো তোর স্পর্ধা? এই বলে মুচিরামের উপর আদেশ হলো তাকে গারদে বন্ধ করে উচিত শাস্তির। বলা বাহুল্য, অমানুষিক অত্যাচার ও প্রহারের ফলে তিতুমীরের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ হলো আমিনুল্লাহ। সংবাদটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মুসলমানরা মর্মাহত হলো, কিন্তু সাক্ষী প্রমাণের অভাবে প্রবল শক্তিশালী জমিদারের বিরুদ্ধে কিছুই করতে না পেরে তারা নীরব রইলো।
কোলকাতায় জমিদারদের ষড়যন্ত্র সভা
তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের দমন করার উদ্দেশ্যে কোলকাতায় জনৈক লাটু বাবুর বাড়ীতে এ সভায় নিম্নলিখিত ব্যক্তিগত হাজির হলেনঃ লাটু বাবু (কোলকাতা), গোবরডাঙার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যয়, গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়, নূরনগরের জমিদারের ম্যানেজার, টাকীর জমিদারের সদর নায়েব, রানাঘাটের জমিদারের ম্যানেজার, পুঁড়ার কৃষ্ণদেব রায়, বশীরহাট থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তী, যদুর আটির দুর্গাচরণ চক্রবর্তী প্রভৃতি।
সভায় স্থিরীকৃত হলো যে, যেহেতু তিতুমীরকে দমন করতে না পারলে হিন্দুজাতির পতন অনিবার্য, সেজন্যে যে কোন প্রকারেই হোক তাদে শায়েস্তা করতে হবে এবং এ ব্যাপারে সকল জমিদারগণ সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করবেন। ইংরেজ নীলকরদেরও সাহায্য গ্রহণ করা হবে বলে স্থির হলো। তাদেরকে বুঝানো হবে যে, তিতুমীর ইংরেজদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম শুরু করেছেন। হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে এ কথা প্রচার করতে হবে যে তিতু গো-মাংস গুঁজে দিয়ে জাতি নাশ করেছেন। বশীরহাটের দারোগা চক্রবর্তীকে এ ব্যাপারে সর্বপ্রকার সাহায্য করার অনুরোধ জানানো হলো। কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যয় দারোগাকে বল্লেন, আপনি ব্রাহ্মণ, আমরাও ব্রাহ্মণ। তাছাড়া আপনি আমাদের আত্মীয়। আমাদের এ বিপদে আপনাকে সব দিক দিয়ে সাহায্য করতে হবে। দারোগা বল্লো, আমি আমার প্রাণ দিয়েও সাহায্য করব এবং তিতুমীরকে রাজদ্রোহী প্রমান করব।
কোলকাতার ষড়যন্ত্র সভার পর সরফরাজপুরের লোকদের নিকট থেকে দাড়ি-গোঁফের খাজনা এবং আরবী নামকরণের খারিজানা ফিস আদায়ের জন্যে কৃষ্ণদেব রায় লোক পাঠালো। কিন্তু তারা খাজনা দিতে অস্বীকৃতি জানালে জমিদারের কর্মচারী ফিরে এসে জমিদারকে এ বিষয়ে অবহিত করে। অতঃপর তিতুমীরকে ধরে আনার জন্যে বারোজন সশস্ত্র বরকন্দাজ পাঠানো হয়। কিন্তু তারা ধরে আনতে সাহস করেনি।
অতঃপর কৃষ্ণদেব নিম্নের ব্যক্তিগণকে পরামর্শের জন্যে বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেঃ
১। অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যয়কে গোবরডাঙায়,
২। খড়েশ্বর মুখোপাধ্যয়কে গোবরা-গোবিন্দপুরে,
৩। লাল বিহারী চট্টোপাধ্যয়কে সেরপুর নীলকুঠির মিঃ বেজামিনের কাছে,
৪। বনমালী মুখোপাধ্যয়কে হুগলী নীলকুঠিতে,
৫। লোকনাথচক্রবর্তীকে বশীরহাট থানায়।
উল্লেখযোগ্য যে, লোকনাথ চক্রবর্তী বশীলহাটের দারোগা রামরাম চক্রবর্তীর ভগ্নিপতি।
অতঃপর বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষ্ণদেবের সাহায্যার্থে সহস্রাধিক লাঠিয়াল, সড়কীওয়ালা ও ঢাল-তলোয়ারধারী বীর যোদ্ধা কৃষ্ণদেবের বাড়ী পুঁড়ায় পৌঁছে গেল। পরদিন শুক্রবার সরফরাজপুরে তিতুমীর ও তাঁর লোকজনদেরকে আক্রমণ করার আদেশ হলো।
পরদিন শুক্রবার সর্বাগ্রে অশ্বপৃষ্ঠে কৃষ্ণদেব রায় এবং তার পিছনে সশস্ত্র বাহিনী যখন সরফরাজপুর পৌঁছে, তখন জুমার খুৎবা শেষে মুসল্লীগণ নামাজে দাঁড়িয়েছে। কৃষ্ণদেবের সৈন্যরা বিভিন্ন মুসলিম বিরোধী ধ্বনি সহকারে মসজিদ ঘিরে ফেলে আগুন লাগিয়ে দিল। অল্প বিস্তর অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তিতুমীর এবং মুসল্লীগণ মসজিদের বাইরে এলে তাদেরকে আক্রমণ করা হলো। দু’জন সড়কীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলো এবং বহু আহত হলো।
অতঃপর মুসলমানগণ কলিঙ্গার পুলিশ ফাঁড়িতে কৃষ্ণদেব রায় ও তার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে খুনজখম মারপিট প্রভৃতির মামলা দায়ের করলো। পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ইজাহার গ্রহণ করলো বটে। কিন্তু ঘটনাস্থলে উপস্থিত না হয়েই লাশ দাঠন করার নির্দেশ দিল।
J.R. Colvin-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, জমিদারের কর্মচারীগণ সরফরাজপুরে দাড়ি-গোঁফ ইত্যাদির খাজনা আদায় করতে গেলে তাদেরকে মারপিট করা হয় এবং একজনকে আটক করা হয়। তারপর কৃষ্ণদেব রায় সশস্ত্র বাহিনীসহ তাদেরকে আক্রমণ করে এবং মসজিদ জ্বালিয়ে দেয়।
(Board’s Collection 54222, p 405-6, Colvin’s Report-para 9, Dr. AR Mallick: British Policy & the Muslims in Bengal, p. 79)।
উক্ত ঘটনার আঠার দিন পর কৃষ্ণদেব রায় তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে এই বলে মামলা দায়ের করে যে, তারা তার লোকজনকে মারপিট করেছে এবং তাকে ফাঁসাবার জন্যে তারা নিজেরাই মসজিদ জ্বালিয়ে দিয়েছে। (Bengal Criminal Judicial Consulations, 3 April 1832, No.6)।
কৃষ্ণদেব রায় তার ইজাহারে আরও অভিযোগ করে যে, ‘নীলচাষদ্রোহী জমিদারদ্রোহী ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীদ্রোহী তিতুমীল নামক ভীষণ প্রকৃতির এক ওহাবী মুসলমান এবং তার সহস্রাধিক শিষ্য পুঁড়ার জমিদার শ্রীযুক্ত কৃষ্ণদেব রায় মহাশয়ের দু’জন বরকন্দাজ ও একজন গোমস্তাকে অন্যায় ও বেআইনীভাবে কয়েধ করিয়া গুম করিয়াছে। বহু অনুসন্ধানেও আমরা তাহাদের পাইতেছিনা। আমাদের উক্ত পাইক ও গোমস্তা সরফরাজপুর মহলের প্রজাদের নিকট খাজান আদায়ের জন্য মহলে গিয়াছিল। খাজনার টাকা লেনদেন ও ওয়াশীল সম্বন্ধে প্রজাদের সহিত বচসা হওয়ায় তিতুমীরের হুকুম মতে তাহার দলের লোকেরা আমাদের গোমস্তা পাইকদিগকে জবরদস্তি করিয়া কোথায় কয়েধ করিয়াছে তাহা জানা যাইতেছে না। তিতুমীর দম্ভভরে প্রচার করিতেছে যে, সে এদেশের রাজা। সুতরাং খাজনা আর জমিদারকে দিতে হইবেনা’।
(শহীদ তিতুমীর –আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ৬০)।
কিভাবে মিথ্যা মামলা সাজাতে হয় তা রামরাম চক্রবর্তীর অন্ততঃপক্ষে বালো করে জানা ছিল। কারণ সে তিতুমীরকে রাজদ্রোহী প্রমাণ করার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যাহোক, ঘটনার আঠারদিন পর জমিদারের ইজহার যে, বিশ্বাসযোগ্য নয়, তা না বল্লেও চলে। এ শুধু গা বাঁচাবার জন্যে করা হয়েছিল। তবু উভয় মামলার তদন্ত শুরু হয়।
মামলার প্রাথমিক তদন্ত শুরু করে কলিঙ্গা ফাঁড়ির জামাদার। তার রিপোর্টে বলা হয় যে, উভয় পক্ষের অভিযোগ অত্যন্ত সংগীন। সে আরও বলে, আমি মুসলমানদের অভিযোগের বহু আলামত দেখেছি। জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের নায়েব তিতুমীর ও তার দলের বিরুদ্ধে যে মোকাদ্দমা দায়ের করেছে সে সম্পর্কে তদন্ত করে জানা গেল যে, যেসব কর্মচারীর অপহরণের অভিযোগ করা হয়েছে তারা সকলেই নায়েবের সঙ্গেই আছে। নায়েবের জবাব এই যে, সে মফঃস্বলে যাওয়ার পর তিতুর লোকেরা তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে। আমার মতে এ জটিল মামলা দুটির তদন্ত ও ফাইনাল রিপোর্টের ভার বশীরহাটের অভিজ্ঞ দারোগা রামরাম চক্রবর্তীর উপর অর্পণ করা হোক।
ওদিকে বারসতের জয়েন্ট ম্যাজিষ্ট্রেট কৃষ্ণদেব রায়কে কোর্টে তলব করে জামিন দেন এবং রামরাম চক্রবর্তীকে তদন্ত করে চূড়ান্ত রিপোর্টি দেয়ার আদেশ দেন।
রামরাম চক্রবর্তী তদন্তের নাম করে সরফরাজপুর আগমন করে তিতুমীর ও গ্রামবাসীকে অকথ্যভাষায় গালাগালি ও মারপিট করে জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ীতে কয়েকদিন জামাই আদরে কাটিয়ে যে রিপোর্ট দেয় তা নিম্নরূপঃ-
১। জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের গোমস্তা ও পাইকারদেরকে তিতু ও তার লোকেরা বেআইনীভাবে কয়েদ করে রেখেছিল। পরে তারা কৌশলে পলায়ন করে আত্মগোপন করেছিল। পুলিশের আগমনের পর তারা আত্মপ্রকাশ করে। সুতরাং এ মামলা অচল ও বরখাস্তের যোগ্য।
২। তিতুমীর ও তার লাঠিয়ালেরা জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ও তার পাইক বরকন্দাজদের বিরুদ্ধে খুনজখম, লুট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির মিথ্যা অভিযোগ এনেছে।
৩। তিতু ও তার লোকেরা নিজেরাই নামাজঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। অতএব এ মামলা চলতে পারে না।
দারোগার রিপোর্ট সম্পূর্ণ মনগড়া এবং তার বিদ্বেষাত্মক মনের অভিব্যক্তি মাত্র। মুসলমানদের শত দোষ থাক কিনউত মসজিদ ভস্মিভূত করার মতো পাপ কাজ করতে সাহস তাদের কখনোই হবে না।
পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, অবৈধ খাজনা আদায়ের বিষয়টি হাকিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি যা ছিল দাংগার মূল কারণ। তার ফলে জমিদার শুধু মামলায় জয়লাভই করেনি, বরঞ্চ তার অবৈধ খাজনা আদায়ের কাজকে বৈধ করে দেয়া হলো। বিভাগীয় কমিশনার বলেন, জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট যে রায় দিলেন তার মধ্যে একদিকে জমিদারদের অবৈধ ও উৎপীড়নমূলক খাজনা বন্ধ করার উদ্দেশ্য ছিলনা, অপরদিকে প্রতিপক্ষের উত্তেজনাকর মনোভাব লাঘব করারও কিছু ছিল না। (Bengal Criminal Judicial Consultations, 3 April 1832, No.3; Commissioner to Deputy Secretary; 28 Nov. 1831. para 3)।
ম্যাজিস্ট্রেটের এ অবিচারমূলক রায়ের ফলে জমিদার প্রতারণামূলক ও উৎপীড়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সাহসী হলো। ১৭৯৯ সালের ৭ নং রেগুলেশন অনুযায়ী বকেয়া খাজনার নাম করে প্রজাদেরকে ধরে এতে আটক করার ক্ষমতা লাভ করলো। এমনকি যারা জমিদারের প্রজা নয় অথচ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে তাদেরকে মিছিমিছি ৩৮ টাকা বকেয়া দেখিয়ে ধরে এনে আটক করা হলো এবং তাদেরকে নানাভাবে শারীরিক শাস্তি দেয়া হলো। অতঃপর বকেয়ার একাংশ আদায় করে বাকী অংশ দিবার প্রতিশ্রুতিতে তাদের কাছে মুচলেকা রিখে নেয়া হলো যাতে করে কোর্টের আশ্রয় নিতে না পারে। (Board’s Collection, 54222, Enclosure No 4, the Colvin’s Report; Also in Bengal Criminal Judicial Consultations, 3 April 1832 No.6)।
১৮৩১ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর মামলার রায়ের নকলসহ মুসলমান কমিশনারের কোর্টে আপিল করার জন্যে কোলকাতা গেল। কিন্তু কমিশনারের অনুপস্থিতির দরুন তাদের আপিল দাখিল করা সম্ভব হলো না বলে ভগ্নহৃদয়ের প্রত্যাবর্তন করলো।
সরফরাজপুর গ্রামের মসজিদ ধ্বংস হলো, বহু লোক হতাহত হলো, হাবিবুল্লাহ, হাফিজুল্লাহ, গোলাম নবী, রমজান আলী ও রহমান বখশের বাড়ীঘর ভক্ষস্তূপে পরিণত করা হলো, বহু ধনসম্পদ ভস্মিভূত ও লুন্ঠিত হলো, কিন্তু ইংরেজ সরকারত তার কোনই প্রতিকার করলো না। সরফরাজপুর গ্রামবাসীর এবং বিশেষ করে সাইয়েদ নিসার আলীর জীভন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল বলে সকলের পরামর্শে সাইয়েদ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর উপরোক্ত পাঁচজন গৃহহারাসহ সরফরাজপুর থেকে ১৭ই অক্টোবরে নারকেলবাড়িয়া গ্রামে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্থানাস্তরিত হলেন। ২৯ শে অক্টোবর (১৮৩১) কৃষ্ণদেব রায় সহস্রাধিক লাঠিয়াল ও বিভিন্ন অস্ত্রধারী গুন্ডাবাহিনীসহ নারিকেলবাড়িয়া গ্রাম আক্রমণ করে বহু নর-নারীকে মারমিট ও জখম করে। ৩০শে অক্টোবর পুলিশ ফাঁড়িতে ইজাহার হলো। কিন্তু কোনই ফল হলো না। কোন প্রকার তদন্তের জন্যেও পুলিশ এলো না।
উপযুপরি জমিদার বাহিনীর আক্রমণে মুসলমানগণ দিশেহারা হয়ে পড়লো। তখন বাধ্য হয়ে তাদেরকে আত্মরক্ষার জন্যে প্রস্তুত হতে হলো। ৬ই নভেম্বর পুনরায় কৃষ্ণদেব রায় তার বাহিনীসহ মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রচন্ড সংঘর্স হয় এবং উভয়পক্ষে বহু লোক হতাহত হয়। এরপর কৃষ্ণদেব রায় চারদিকে হিন্দু সমাজে প্রচার করে দেয় যে, মুসলমানরা অকারণে হিন্দুদের রায় চারদিকে হিন্দু সমাজে প্রচার করে দেয় যে, মুসলমানরা অকারণে হিন্দুদের উপরে নির্যাতন চালাচ্ছে। তার এ ধরনের প্রচারণায় হিন্দুদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং গোবরডাঙ্গার নীলকর জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যয় মোল্লাআটি নীলকুঠির ম্যানেজার মিঃ ডেভিসকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে। ডেভিস প্রায় চার
’শ হাবশী যোদ্ধা ও বিভিন্ন মারণাস্ত্রসহ নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে। এবারও উভয় পক্ষে বহু হতাহত হয়। ডেভিস পলায়ন করে। মুসলমানরা তার বজরা ধ্বংস করে দেয়। উক্ত ঘটনার কিছুদিন পরে গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় এক বিরাট বাহিনীসহ নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে। প্রচন্ড যুদ্ধে দেবনাথ রায় সড়কীর আঘাতে নিহত হয়্
উপরোক্ত ঘটনার পর চতুনার জমিদার মনোহর রায় পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের নিকট যে পত্র লিখেন তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেনঃ
নীলচাষের মোহ আপনাদেরকে পেয়ে বসেছে। তার ফলেই আজ আমরা দেবনাথ রায়ের ন্যায় একজন বীর পুরুষকে হারালাম। এখনো সময় আছে। আর বাড়াবাড়ি না করে তিতুমীরকে তার কাজ করতে দিন আর আপনারা আপনাদের কাজ করুন। তিতুমীর তার ধর্ম প্রচার করছে, তাতে আপনারা জোট পাকিয়ে বাধা দিচ্ছেন কেন? নীলচাষের মোহে আপনারা ইংরেজ নীলকরদের সাথে এবং পাদ্রীদের সাথে একতাবদ্ধ হয় দেশবাসী ও কৃষক সম্প্রদায়ের যে সর্বনাশ করছেন তা তারা ভুলবে কি করে? আপনারা যদি এভাবে দেশবাসীর উপর গায়ে পড়ে অত্যাচার চালাতে থাকেন তাহলে বাধ্য হয়ে আমি তিতুমীরের সাহায্যের জন্যে অগ্রসর হবো। আমি পুনরায় বলছি নীলচাষের জন্যে আপনারা দেশবাসীর অভিসম্পাত কুড়াবেন না।
-শ্রীমনোহর রায় ভূষণ (শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দীকী পৃঃ ৭৯)।
মনোহর রায়ের সদুপদেশ গ্রহণ করলে ইতিহাসের এতবড়ো একটা বিয়েঅগান্ত নাটকের অভিনয় হতো না। কিন্তু কৃষ্ণদেব রায়ের একদিকে সীমাহীন ধনলিপ্সা এবং অপরদিকে চরম বিদ্বেষ তাদের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে ফেলেছিল। তাই সে তার পৈশাচিত তৎপরতা থেকে ক্ষান্ত হতে পারেনি।
বশীরহাটের দারোগা রামরাম চক্রবর্তী তিতুমীর ও তার দলের লোকদের বিরুদ্ধে যেসব কাল্পনিক, বিকৃত ও উদ্দেশ্যমূলক রিপোর্ট সরকারের নিকটে পেশ করেছিল এবং হিন্দু জমিদারগণও যেসব পত্র কালেক্টর ও জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট তিতুমীরকে দমন করার জন্যে গভর্ণরকে অনুরোধ জানায়। গভর্ণর আবার উপরোক্ত রিপোর্টসহ নদিয়ার কালেক্টর ও আলীপুরের জজকে নির্দেশ দেন।এদিকে গভর্ণরের আদেশ পাওয়া মাত্র নদিয়ার কালেক্টর কৃষ্ণদেব রায়কে যথাশ্রঘ্র সম্ভব তাঁর সাথে দেখা করতে বলেন। আলীপুরের জজ সে সময় নদিয়াতেই অবস্থান করছিলেন। কৃষ্ণদেব রায় যখাসময়ে উপস্থিত হলে কালেক্টর নদিয়াতেই অবস্থান করছিলেন। কৃষ্ণদেব রায় যথাসময়ে উপস্থিত হলে কালেক্টর ও জজ সাহেবের বজরায় পথপ্রদর্শক হিসাবে নারিকেলবাড়িয়ার দিকে রওয়ানা হয়।
এদিকে স্বার্থান্বেষী মহল থেকে সংবাদ রটনা করা হলো যে শেরপুর নীলকুঠির ম্যানেজার মিঃ বেনজামিন বহু লাঠিয়াল ও সড়কিওয়ালাসহ নারিকেলবাড়িয়অ আক্রমণের জণ্যে যাত্রা করেছে। এ সংবাদ পাওয়ার পর তাদেরকে বাধাদানের উদ্দেশ্যে গোলাম মাসুম তিতুমীর দলের লোকজনসহ সম্মুখে অগ্রসর হলো এবং বারগরিয়া গ্রামের জঙ্গল ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে রইলো। বজরা এসে বারঘরিয়ার ঘাটে ভিড়লে পরে তিতুমীরের লোকেরা দেখতে পেলো যে, বজরায় দু’জন ইংরেজ এবং তাদের সাথে তাদের পরমশত্রু কৃষ্ণদেব রয়েছে। ইংরেজ দুজনকে তারা ডেবিস এবং বেনজামিন বলে ধারণা করে আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত হলো। কৃষ্ণদেব বল্লো, হুজুর ঐ দেখুন। তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি গোলাম মাসুম বজরা আক্রমণ করার জন্যে এতদূর পর্যনআত এসেছে। সাহেব তখন গুলি চালাবার আদেশ দিলেন। অপরপক্ষও তীর সড়কি চালাতে শুরু করলো। উভয়পক্ষের কয়েকজন হতাহত হওয়ার পর কালেক্টর যুদ্ধ স্থগিত রেখে নদীর মাঝখানে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন।
তিতুমীরের দলকে স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যা সংবাদ দিয়ে প্রতারিক করলো। তারা ডেভিস ও বেনজামিন মনে করে বজরা আক্রমণ করলো। স্বার্থান্বেষী মহল চেয়েছিল এভাতে তিতুমীরের দলের প্রতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকারকে ক্ষিপ্ত করে তুলতে। তাদের উদ্দেশ্য সফল হলো। প্রকৃত ঘটনা অবগত হলে তারা এভাবে বজরা আক্রমণ করতে আসতোনা। বিশেষ করে কৃষ্ণদেব রায়কে বজরায় দেখে তারা তাদেরকে শত্রুই মনে করেছিল।
মজার ব্যাপার এই যে, বারঘরিয়ার ঘাট থেকে তাড়াতাড়ি বজরায় উঠে নদীর মাঝখানে আত্মরক্ষার সময় কৃষ্ণদেব উঠতে পারেনি। ফলে তার ভাগ্যে যা হবার তা হলো। তবে মুসলমানরা তাকে হত্যা করেনি। নদীতে ডুবে তার অপমৃত্যু ঘটলো।
ইস্ট ইন্ডিয়া সরকারের বিরুদ্ধে তিতুমীরের সংঘর্ষের কোন বাসনা ছিলনা। ঘটনাপ্রবাহ, কতকগুলি অমূলক গুজব এবং এক বিশেষ স্বাথান্বেষী মহল তিতুমীর ও সরকারের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয়। কতিপয় পাদ্রী
, দেশী বিদেশী নীলকর এবং হিন্দ জমিদারদের পক্ষ থেকে বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ আলেকজান্ডারের কাছে তিতুমীরের বিরুদ্ধে অনবরত উত্তেজনাকর রিপোর্ট। এর ফলে তিতুমীর ও তার দল সম্পর্কে মিঃ আলেকজান্ডারের যে ধারণা জন্মে হাতে তিতুমীর ও তার দল সম্পর্কে মিঃ আলেকজান্ডারের যে ধারণা জন্মে তাতে তিতুমীরকে দমনের জণ্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। সম্ভবতঃ রামরাম চক্রবর্তী সংঘর্ষে নিহত হওয়ার পর বশীরহাট থানায় নতুন দারোগা নিযুক্ত হয়। তার প্রতি নির্দেশ দেয়া হয় যে, সে যেন কতিপয় সিপাই জমাদার নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ো গিয়ে তিতুমীরকে সাববধান করে দেয়। অতঃপর যা যা ঘটে তার রিপোর্ট যেন দেয়। দারোগা সম্ভবতঃ নারিকেলবাড়িয়ে না গিয়ে থানায় বসেই রিপোর্ট দেয় যে, তিতুর লোকজেরন আক্রমণে প্রাণ নিয়ে কোনমতে পালিয়ে এসেছে। ফলে আলেকজান্ডারকে কর্তৃপক্ষের কাছে তিতুমীর সম্পর্কে কড়া রিপোর্ট দিতে হয়।
১৮৩১ সালের ১৪ই নভেম্বর মিঃ আলেকজান্ডার একজন হাবিলদার, একজন জমাদার এবং পঞ্চাশজন বন্দুক ও তরবারিধারী সিপাহী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ার তিনক্রোশ দূরে বাদুড়িয়া পৌছেন। বশিরহাটের দারোগা সিপাই-জমাদারসহ বাদুড়িয়ায় আলেকজান্ডারের সাথে মিলিত হয়। উভলের মোট সন্য সংখ্যা ছিল একশ’ বিশজন। অতঃপর যে প্রচন্দ সংঘর্স হয় তাতে উভয়পক্ষের লোক হতাহত হয়, গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে মুসলমানদের বীরত্ব দেখে আলেকজান্ডার বিস্মিত হন এবং দারোগা ও একজন জমাদার মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। বেগতিক দেখে আলেকজান্ডার প্রাণরক্ষার্থে পলায়ন করেন।
আলেকজান্ডারের রিপোর্ট ও তার প্রতিক্রিয়া
জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ আলেকজান্ডার বারাসাত প্রত্যাবর্তন করে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকটে তিতুমীরকে শায়েস্তা করার আবেদন জানিয়ে রিপোর্ট পেশ করেন। কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকার কর্ণেল স্টুয়ার্টকে সেনাপতি পদে নিযুক্ত করে তার অধীনে একশত ঘোড়-সওয়ার গোর সৈন্য, তিনশত পদাতিক দেশীয় সৈন্য, দু’টি কামানসহ নারিকেলবাড়িয়ো অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। ১৩ই নভেম্বর রাত্রে কোম্পানী সৈন্য নারিকেলবাড়িয়া পৌঁছে গ্রাম অবরোধ করে রাখলো।
শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে তিতুমীর ও তাঁর লোকেরা তিতুমীরের হুজরাকে কেন্দ্র করে চারদিকে মোটা মোটা ও মজবুত বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘিরে ফেলেছিলেন যা ইতিহাসে “তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা” বলে অভিহিত আছে।
আবদুল গফুর সিদ্দিকী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বের কিছু ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, কর্ণেল স্টুয়ার্ট তিতুমীরের হুজরা ঘরের সম্মুখস্থ প্রধান প্রবেশদ্বারের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে দেখলেন এক ব্যক্তি সাদা পিরহান ও সাদা পাগড়িতে অংগ শোভা বর্ধন করতঃ তসবিহ হাতে আল্লাহর দ্যানে নিমগ্ন। স্টুয়ার্ট মুগ্ধ ও বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পথপ্রদর্শক রামচন্দ্র বন্দোপাধ্যয়কে জিজ্ঞাসা করলেন, এই ব্যক্তিই তিতুমীর? একে তা বিদ্রোহী বলে মনে হয় না?
রামচন্দ্র বল্লো, এই ব্যক্তিই তিতুমীর। নিজেকে তিতু বাদশাহ বলে পরিচয় দেয়। আজ আপনাদের আগমনীতে ভংগী পরিবর্তণ করে সাধু সেজেছে।
অতঃপর স্টুয়ার্ট রামচন্দ্রকে বল্লেন, তিতুকে বলুন আমি বড়োলাট লর্ড বেন্টিংক-এর পক্ষ থেকে সেনাপতি হিসাবে এসেছি। তিতুমীর যেন আত্মসমর্পণ করে। অথবা তিনি যা বলেন হুবহু আমাকে বলবেন।
রামচন্দ্র তিতুমীরকে বল্লো, আপনি কোম্পানী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এখন জপমারা ধারণ করেছেন, আসুন তরবারি ধারন করে বাদশাহর যোগ্য পরিচয় দিন।
তিতুমীর বলেন, আমি কোম্পানী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি। হিন্দুদের ন্যায় আমরাও কোম্পানী সরকারের প্রজা। জমিদার নীলকরদের অত্যাচার দমনের জন্যে এবং মুসলমান নামধারীদেরকে প্রকৃত মুসলমান বানাবার জন্যে সামান্য চেষ্টা করেছি মাত্র।
তিতুমীরের জবাব শুনার পর রামচন্দ্র স্টুয়ার্টকে দোভাষী হিসাবে বল্লো, বিদ্রোহী তিতুমীর বলছে আত্মসমর্পণ করবে না, যুদ্ধ করবে। সে বলে যে, সে তোপ ও গোলাগুলির তোয়াক্কা করেনা। সে বলে যে, সে তার ক্ষমতা বলে সবাইকে টপ টপ করে গিলে খাবে। সেই এ দেশের বাদশাহ, কোম্পানী আবার কে? (শহিদ তিতুমীরঃ আবদুল গফুর সিদ্দিকী
, পৃঃ ৯৫-৯৬)।
রামচন্দ্র দোভাষীর কাজ করতে গিয়ে কোন আগুন জ্বালিয়ে দিল, তা পাঠকমাত্রের বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়।
তারপর যে যুদ্ধ হলো, তার ফলাফল কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সুশিক্ষিত ইংরেজ সৈণ্য এবং তাদের ভারি কামানের গোলাগুলির সামনে লাঠি ও তীর সড়কি কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে। তথাটি সাইয়েদ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর, গোলাম মাসুম ও তাদের দলীয় লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে অথবা প্রতিপক্ষের কাছে আনুগত্যের মস্তক অবনত না করে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ধীরস্থির হয়ে যেভাবে শত্রুর মুকাবিলা করে শাহাদাতের অমৃত পান করেছেন তা একদিকে যেমন ইতিহাসের অক্ষয় কীর্তিরূপে চির বিরাজমান থাকবে, অপরদিকে অসত্য ও অন্যায় উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রাণপণ সংগ্রামের প্রেরণা ও চেতনা জাগ্রত রাখবে ভবিষ্যতের মানবগোষ্ঠীর জন্যে।
উক্ত ঘটনার চল্লিশ বৎসর পরে Calcutta Review তে একটি বেনামী নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে তিতুমীরের সমসাময়িক কোম্পানী সরকারের এই বলে সমালোচনা করা হয় যে, তিতুমীরের রাজদ্রোহীতামূলক কর্মতৎপরতার প্রতি সরকার উদাসীন ছিলেন। এ নিবন্ধকারের মতে তিতুমীর রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের অভিলাষী ছিলেন। অতএব সরকারের পূর্বাহ্নে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত ছিল। তিনি আরও বলেন যে, তিতুমীর এবং তাঁর মতাবলম্বী কোম্পানী শাসনের অবসান দাবী করে এবং ইংরেজদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত মুসলমানদেরকে সার্বভৌম ক্ষমতার উত্তরাধিকারী বলে দাবী করে। হান্টারও এরূপ মন্তব্য করেন। (Calcutta Review No. Cl. P. 36)।
হান্পার সাহেব হিন্দু জমিদার, নীলকর ও কতিপয় পাদ্যীর অমূলক ও উদ্দেশ্যমূলক অভিযোগগুলিই অন্ধভাবে বিশ্বাস করে তার গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। সাইয়েদ আহমদ শহীদ সম্পর্কেও হান্টার অত্যন্ত জঘন্য ও অশালীন মন্তব্য করেছেন। যথাস্থানে তা আলোচনা করা হবে।
বারাসতের অধীন নরিকেলবাড়িয়ার হাংগামার কারণ ও প্রকৃতি নির্ণয়ের জন্যে J.R Colvin কে নিযুক্ত করা হয়েছিল।তিনি প্রামান্যসূত্রে গৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে যে রিপোর্ট পেশ করেন তা এখানে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি নিশ্চয়তার সাথে বলেন যে, হাংগামাটি ছিল একটি সম্পূর্ণ স্থানীয় ব্যাপার এবং যে সমস্ত অধিবাসী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সাথে জড়িত ছিল তারা কোন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক ছিলনা। দুই একজন ব্যতীত তারা সকলে ছিল বারাসতের উত্তরাঞ্চলের লোক। তারা ছিল সকলে প্রজা (রায়াত), তাঁতী ও সাধারণ শ্রেণীর মুসলমান। (Board’s Collection, 54222, p.400; Colvin to Barwell, 8 March 1832, para 4; A R Mallick: British Policy & the Muslims in Bengal, p.87)।
কলভিনের উক্ত রিপোর্টের পরে সরকার বিষয়টির প্রতি তেমন কোন গুরুত্ব আরোপ করেননি। ডক্টর এ আর মল্লিক Board’s Collection এবং Bengal Criminal Judicial Consultations-এর বরাত দিয়ে বলেন যে, কোম্পানীর সৈন্য পরিচালনা করেন মেজর স্কট। তিতুমীরসহ প্রায় পঞ্চাশজন নিহত হন এবং ২৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। মৃতদেহগুলি জ্বালিয়ে ফেলা হয়। তিতুমীরের দলের লোকদের বাড়ীঘর লুণ্ঠন করা হয় এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদেরকেও গ্রেফতার করা হয়। (Dr. A.R. Mallick British Policy & the Muslims in Bengal, p.86)।
সর্বমোট ১৯৭ জনের বিচার হয়। তন্মধ্যে গোলাম মাসুমের প্রাণদণ্ড, ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং ১২৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড হয়।
বিচারকালে চারজনের মৃত্যু হয়। ৫৩ জন খালাস পায়।
তিতুমীরের জ্যেষ্ঠপুত্র সাইয়েদ গওহর আলীর দক্ষিণ বাহু গোলার আঘাতে উড়ে যায় বলে তাকে কারাদন্ড থেকে মুক্তি দেয়া হয়। অন্যপুত্র তোরাব আলী অল্পবয়ষ্ক ছিল বলে তার দু’বৎসর সশ্রম কারাদন্ড হয়। তৎকালীন সরকার পরে নিজেরেদ ভ্রম বুঝতে পেরে তিতুমীরের তিনপুত্রের জন্যে ভাতার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু হিন্দুলীরৈগ চেষ্টায় পরে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। (শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ১০০)।
উপরের আলোচনায় এ কথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃত ঘটনা সরকারের জানা থাকলে হয়তো ব্যাপার এতদূর গড়াতোনা। জমিদারদের মুসলিম বিদ্বেষ, মিথ্যা প্রচারণা, দরিদ্র প্রজাবৃন্দের উপর তাদের অসীম প্রভাব এবং তদুপরি দারোগা রামরাম চক্রবর্তীর একতরফা এবং একদেশদর্শী মনগড়া রিপোর্ট কর্তৃপক্ষকে প্রকৃত ঘটনা থেকে দূরে রেখেছে। অপরদিকে জমিদার নীলকরদের সীমাহীন অমানুষিক অন্যায় অত্যাচার এবং সরকারের নিকটে বিচার প্রার্থনা করে ব্যর্থ মনোরথ হওয়ার প্রতিপক্ষকে চরমপন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল। এছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিলনা। কলতিনের রিপোর্টেও এ কথাই বলা হয়েছে। প্রজাবৃন্দের উপর যে কোন উপায়ে অত্যাচার, উৎপীড়ন করার সীমাহীন ক্ষমতা চিল জমিদারদের। কলভিন এটাকেই হাংগামার মূল কারণ বলে বর্ণনা করেন। তিনি আরও বলেন যে এমতাবস্থায়, যেখানে দোষী ব্যক্তি প্রভূত সম্পদের মালিক, সেখানে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। (A.R. Mallick: British Policy & the Muslims in Bengal, p. 88; Board’s Collection, 54222, Colvin’s Report, para 36)।