শতক কাব্য
সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রগুলিতে শ্ৰব্য কাব্য বলতে প্রধানত মহাকাব্য ও চম্পু’র কথাই আছে; স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে খণ্ডকাব্যকে ধরা হয়নি; অথচ নানা শ্রেণির খণ্ডকাব্য সাহিত্যে আছে। কালিদাসের মেঘদূত-ই সম্ভবত প্রথম খণ্ডকাব্য, তার পরে আছে বেশ কিছু শতক কাব্য। মেঘদূতের অনুকরণে দীর্ঘকাল ধরে রচিত আরও অনেক দূতকাব্য এগুলির মধ্যে বিখ্যাত ধোয়ীর পবনদূত; এ ছাড়াও পিকদূত, কাকদূত, তুলসীদূত, চন্দ্ৰদূত, নেমিদূত, হংসদূত, মনোদূত, ভৃঙ্গদূত, প্রভৃতি) এবং নানা স্তোত্র সংকলন, যেগুলি একটি বিষয়ের দ্বারা গ্রথিত কিছু শ্লোকের সমাহার। এছাড়াও ষোলটি, দশটি, সাতটি এমন ছোট ছোট শ্লোক সংকলন (যেমন ঘটকর্পর কাব্য, দারিদ্রসপ্তক, কিছু কিছু অষ্টক ইত্যাদি) পাওয়া যায় এবং একেবারে অন্তিম পর্যায়ে পাই একক শ্লোকের সংকলন গ্রন্থগুলি, যেমন সুভাষিতাবলী, শাঙ্গধরপদ্ধতি সুভাষিতরত্নকোষ, সদুক্তিকর্ণামৃত, ইত্যাদি। তাহলে দেখা যাচ্ছে মহাকাব্যের পর ওই দৈর্ঘ্যের কাব্য ক্রমে অচলিত হয়ে আসতে থাকে— যদিও শতক ইত্যাদি রচনা কালেও এবং এই সেদিন পর্যন্ত কবিদের মহাকাব্য রচনার আগ্রহ কমেনি কবিদের। নৈষধচরিত-এর পরে রচিত কোনও মহাকাব্যই আর খ্যাতিলাভ করেনি, এর থেকে বোঝা যায় শক্তিমান কবিরা তখন আর মহাকাব্য রচনার জন্য লেখনী ধারণ করেননি, বরং খণ্ডকাব্য রচনার দিকেই তখন তাঁদের আগ্রহ বেশি। এই খণ্ডকাব্যগুলির মধ্যেও মেঘদূতও পবনদূত বাদ দিলে আর কোনও কাব্য তত বিখ্যাত হয়নি। যেমন হয়েছিল কয়েকটি শতককাব্য।
প্রায়ই দেখা যায় কোনও একটি সাহিত্যিক ভঙ্গি বা প্রকারভেদ তার চরম উৎকর্ষ লাভ করার পর অন্তত কিছুকালের জন্য তা পরিত্যক্ত হয়, তখন বিকল্প কোনও প্রকারভেদ দেখা দেয় সাহিত্যে। এই নিয়মেই মহাকাব্যের পরে এল খণ্ডকাব্য। খণ্ডকাব্যের মধ্যে দূতকাব্য ও বিচ্ছিন্ন শ্লোকের সংকলন বাদ দিলে যেটি প্রধানত উল্লেখযোগ্য তা হল শতককাব্য। বলা বাহুল্য, মহাকাব্য রচনার শেষ পর্যায়েই কবিদের প্রেরণা ক্ষীণ ও উদ্ভাবনী শক্তি দীন হয়ে আসছিল যার ফলে কাব্যগুলি ভঙ্গীসর্বস্ব হয়ে উঠছিল। দীর্ঘ কবিতায় এ দোষ যত প্রকট হয় খণ্ড খণ্ড শ্লোকে বা শ্লোকগুচ্ছে ততটা নয়। সম্ভবত সে-ও একটা কারণ যার জন্য শতককাব্য জনপ্রিয় হয়েছিল। এর পরিসর ছোট বলেই শ্রোতা বা পাঠকের প্রত্যাশাও এর কাছে কম, ছোট ছোট শ্লোক বা শ্লোকগুচ্ছে কোনও একটি ভাবের বিন্যাসই প্রত্যাশিত। চরিত্র, ঘটনা, দীর্ঘায়ত বর্ণনা, অঙ্গী ও অঙ্গরসের সঞ্চারের দ্বারা পরস্পরের পরিপূরণ ও সর্বোপরি কোনও প্রকার জীবনবোধ এখন আর কবিরা দিতে পারেন না, ফলে পাঠকও চায় না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই খণ্ডকাব্য ও তার অন্তর্গত শতককাব্যের বিচার হতে পারে। খণ্ডকাব্য লিরিক বা গীতিকাব্যধর্মী, শতককাব্যও তাই। ছোট কাব্যখণ্ডে কোনও রসের বা চিন্তার বর্ণনা বা বিস্তার, এই হল শতককাব্যের উপজীব্য। অলংকারশাস্ত্রে যে খণ্ডকাব্য বা শতককাব্যের আলোচনা নেই তার প্রধান কারণ মনে হয় এ কাব্যগুলি পাঠকচিত্তকে তেমন ভাবে নাড়া দিতে পারেনি, যেমনটা মহাকাব্য পেরেছিল। নইলে প্রখ্যাত অলংকারশাস্ত্রগুলি রচনার শেষ পর্যায়ে বেশ কিছুদিন ধরেই খণ্ডকাব্য রচনা চলছিল। মেঘদূত-এরও কোনও স্বতন্ত্র আলোচনা কোনও অলংকার গ্রন্থে নেই। মহাকাব্যই যে শুধু আলংকারিকদের আলোচনার কেন্দ্রস্থলে তারও একটি কারণ হয়তো মহাকাব্যের আলোচনাও নাটককে মনে রেখেই করা এবং ভরতের নাট্যশাস্ত্র-এর আলোচনাই অলংকার সাহিত্যে মহাকাব্য সম্বন্ধে আলোচনার গতি ও লক্ষ্য স্থির করে দেয়। তাই পরবর্তীকালে যখন মেঘদূত-এর মতো উৎকৃষ্ট খণ্ডকাব্য রচনা হল তখন ওই মহাকাব্যের ছাঁচের মধ্যে তাকে ধরানো গেল না বলে কোনও স্বতন্ত্র আলোচনায় তা স্থান পেল না। অথচ চম্পু’র মতো মোটামুটি দো-আঁশলা রচনারও আলোচনা হল, কারণ গদ্য, পদ্য ও গদ্যপদ্যমিশ্র এই ভঙ্গীগত জাতিভেদের মধ্যে চম্পুর একটা স্থান হয়। যাই হোক, খণ্ডকাব্য যে কাব্যখণ্ড নয় তা এর যে কোনও ধরনের রচনাই প্রমাণ করে, প্রথম প্রখ্যাত খণ্ডকাব্য মেঘদূত-এই তার স্বতন্ত্র ধর্ম প্রতিষ্ঠিত।
কালিদাসের পরে মহাকাব্যের ইতিহাস অবক্ষয়ের ইতিহাস, কারণ, পরবর্তীরা তাঁর মতো শক্তিমান শিল্পী ছিলেন না, তাঁদের প্রেরণাও ছিল দুর্বল। ধীরে ধীরে মহাকাব্য নিষ্প্রাণ ও ভঙ্গীসর্বস্ব হয়ে উঠল। তখন স্বাভাবিক নিয়মেই কবিরা অন্য পথে রচনায় প্রবৃত্ত হলেন; শতককাব্য সেই অন্য পথগুলির অন্যতম। প্রথম উল্লেখযোগ্য শতককাব্য বাণভট্টের চণ্ডীশতক। উপজীব্য এসেছে মহাভারত ও পুরাণ থেকে, ভঙ্গী হল অতিরঞ্জিত বর্ণনার। বিষয়: চণ্ডীর মহিষাসুরবধ— বাম চরণের ও শূলের একটিমাত্র আঘাতে দুর্জয় মহিষাসুরের জীবনাবসান। এ শতকের প্রত্যেকটি শ্লোকই আশীর্বাদ বহন করে: দেবী চণ্ডী তোমাদের মঙ্গল করুন। সরাসরি এই ভাবেই না হলেও বিজয়ের এক একটি প্রতীককে উল্লেখ করে বলা আছে সেটি তোমাদের মঙ্গল করুক। কখনও সেটি দেবীর বাম চরণ, কখনও ভ্রভঙ্গ, কখনও অস্ত্র, কখনও নূপুর, ইত্যাদি। মঙ্গলকামনাটির সঙ্গে যুক্ত অসুরবিনাশে দেবীর একটি বিশিষ্ট ভঙ্গী। কবির দৃষ্টির কেন্দ্রে কখনও দেবী স্বয়ং, কখনও তাঁর পুত্র, কখনও স্বামী কখনও-বা বন্ধুদেবতারা যাঁরা ছুটে এসেছেন এই দৃশ্য দেখতে। কখনও কবি দেবীর অসুরনিধন সরাসরি বর্ণনা না করে তির্যক ভঙ্গীতে করেছেন। যথা, চণ্ডীর পূর্বেই অন্যান্য দেবতারা একের পর এক মহিষাসুরকে বধ করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। তাঁদের ব্যর্থতা বর্ণনার মধ্যে দেবীর সার্থকতা রূপ পেয়েছে তির্যক অথচ সার্থক বর্ণনারীতিতে। কখনও-বা কবি বধ্য অসুরটিকেই স্বতন্ত্র ভাবে বর্ণনা করে দেখিয়েছেন সে কত ভয়াবহ ও শক্তিশালী; এ যেন প্রতিনায়কের প্রবলতার বর্ণনার দ্বারা নায়কের উৎকর্ষ প্রতিপাদন। অবশ্য গৌণ এক স্তরে প্রবল ও প্রতিষ্ঠিত পুরুষ দেবতাদের অসুরবিজয়ে অক্ষমতার বর্ণনাও এই উদ্দেশ্যেই।
প্রথম তিনটি শ্লোকে অসুরবধের সময়ে দেবীর যে পদাঘাত তারই বর্ণনা। প্রসঙ্গক্রমে যে বাম চরণের আঘাতে অসুর নিহত সেই চরণটিরও বর্ণনা: মহিষের পৃষ্ঠকে দেবীর ভ্রম হল তাঁর বাসভূমি বিন্ধ্যপর্বত বলে, মহিষের যে গর্জন সমুদ্রের তরঙ্গনিনাদকেও পরাস্ত করে তা সহসা ডুবে গেল মহিষের পৃষ্ঠে দেবীর পদাঘাতের সময়ে উত্থিত নূপুর-নিক্কণে। মহিষের পৃষ্ঠ হতে নির্গত রক্তধারা দেখে দেবীর ভ্রম হল এ বুঝি তাঁরই চরণের অলক্তরেখা। এমনই ভাবে সম্পূর্ণ অবহিত না হয়েই দেবী (অনায়াসে) অসুরকে বধ করেন; তাঁর সেই চরণ তোমাদের রক্ষা করুক। (চণ্ডীশতক ২) দেবীর চরণের অসম শক্তির বর্ণনাকেও আচ্ছন্ন করেছে দেবীর সম্পূর্ণ অনবধান; যে অসুরকে প্রাচীন প্রতিষ্ঠিত শক্তিমান বৈদিক দেবতারাও হত্যা করতে পারলেন না, দেবী সম্পূর্ণ হেলায় তা করলেন।
বহু শ্লোকে দেবতাদের অক্ষমতা, পরাভব ও বিমর্ষতার বর্ণনা পাই যেগুলির মধ্যে তাঁদের প্রতি অনুচ্চারিত একটা শ্লেষের পরিচয় আছে:
দেবী যিনি শত্রুকে বিনাশ করেছেন তিনি তোমাদের রক্ষা করুন। এর পর চণ্ডীর সঙ্গী জয়া হেসে দেবতাদের বললেন, ‘হরি ভয় পেলেন নাকি? অবশ্য ঘোড়ারা (হরির রথের বাহন) বরাবরই মহিষকে ভয় পায়। চন্দ্রে কি অতিরিক্ত একটা কলঙ্ক লাগল নাকি? সমুদ্র (ক্ষীণ) শশিকলা দেখেই ধৈর্য হারিয়েছে! বায়ু, তোমার নয় অন্য কারও শিহরিত হওয়ার কথা (বায়ুই সকলকে কম্পিত করে)। যম, তুমি তোমার বাহন মহিষটিকে এবারে সরিয়ে নাও (মহিষাসুরের মৃত্যুতে সে চঞ্চল হয়ে উঠতে পারে)।’ (১৫)
এই সুরে বেশ কয়েকটি শ্লোক আছে (১, ১৯, ২১, ২৩, ২৪, ২৯, ৩৩, ৩৪, ৩৬, ৩৮, ৪২, ৮০, ৯০] ও ৯৮) যে গুলির উদ্দেশ্য হল মুখ্য দেবতাদের অপ্রতিভ হওয়ার বর্ণনার মধ্যে দিয়ে চণ্ডীর মাহাত্ম্যকীর্তন। চণ্ডীর স্বামী স্বয়ং মহাদেব ও পুত্র দেবসেনাপতি কার্তিকেয়ও বাদ যাননি। এই সব পুরুষ দেবতারা প্রায় প্রত্যেকেই অসুরবিনাশের জন্যই যশস্বী, প্রত্যেকেই মহাবলী, অসমসাহসী ও অস্ত্রনিপুণ। এঁদের প্রতি শ্লেষের মধ্যে বাণভট্টের সমাজের একটা নতুন দিক প্রকাশিত হয়েছে, তা হল প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত দেবতাদের পাশাপাশি, কতকটা বা তাদেরই স্থানে মাতৃকার আবির্ভাব। নব্যব্রাহ্মণ্যধর্ম যা গুপ্তযুগে প্রথম লক্ষ্যগোচর হয় এবং পুরাণগুলিকে অবলম্বন করে যা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে বর্তমানে ‘হিন্দুধর্ম’ নামে পরিচিত, এ তার একটি প্রধান লক্ষণ। বাণ এ-ধর্মের প্রথম যুগের এক পুরোধা ও উদ্গাতা: যে প্রবল উল্লাসে তিনি পুরুষদেবতাদের পরাভব ও চণ্ডীর বিজয় বর্ণনা করছেন তাও এ যুগের, এ ধর্মের একটি লক্ষণ।
অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকেও এই প্রতিপাদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে— দেবপত্নীরাও চণ্ডীর সামনে নিষ্প্রভ:
‘তুমি কি পালিয়ে গেলে, ইন্দ্রাণী? কুবেরবধূ, তোমার সখী পার্বতীর বীরকীর্তি দেখ। শান্ত হও, স্বাহা, তোমার স্বামী (অগ্নি) এখনও অমৃত পান করেন। বৃথাই রোদন করছেন রোহিণী (চন্দ্রের পত্নী); লক্ষ্মী, তুমি তোমার স্বামীর শ্রীবৎসলাঞ্ছিত বক্ষে আবার হেলান দেবে।’
এই কথাগুলি বলে জয়া দেবীদের সান্ত্বনা দিলেন। চণ্ডী, যিনি এই কার্যে আলজ্জিতা, তিনি তোমাদের রক্ষা করুন। (৩৩)
দেবতারা মহিষাসুরবধে উদ্যোগী হয়ে, অস্ত্রের পর অস্ত্র নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অসুরের গায়ে আঁচড়ও লাগে না।
যে দেবী স্থির ছিলেন, যখন অসুরের দেহে শূল এসে পড়ল, যখন তীর এসে লাগল তখনও যার চোখে পলক পড়েনি, কণ্টকিত শর নিক্ষিপ্ত হতে যিনি হাস্য করেন, বজ্র নিক্ষিপ্ত হলেও যিনি বিচলিত হননি, বর্শা নিক্ষিপ্ত হলেও যাঁর চাঞ্চল্য ছিল না, চক্র নিক্ষেপের সময়ে তিনি অনবনতই ছিলেন, গদাক্ষেপের সময়েও স্থির ছিলেন, যিনি বাম চরণের স্পর্শে মহিষাসুর বধ করেন সেই দেবী তোমাদের শুচি করুন। (৫২)
মহিষাসুর যখন প্রখ্যাত দেবতার বাহুবল ও শস্ত্রবলের দ্বারা পরাভূত হল না তখন তাঁরা বিচলিত হলেন:
মহিষাসুর বলল, ‘প্রথমে বিষ্ণুর চক্র পুনরাবর্তিত হল, তারপর দেবসেনা পশ্চাৎপদ হল, ইন্দ্র ও শিবের ধনুর জ্যা শিথিল হয়ে চ্যুত হল, এই শিশু কার্তিকেয়ের শক্তি অস্ত্র আমাকে কী করে আঘাত করবে?’ যে পার্বতী এই শত্রুকে বধ করে সমস্ত দেবমণ্ডলীর শক্তিকে পরিহাস করেছেন, তিনি তোমাদের রক্ষা করুন। (৬৫)
দেবতাদের পরাভব ও অবমাননা নানা ভাবেই বর্ণিত হয়েছে: মহিষকে বধ করতে এসে তাঁরা সরাসরি পরাহত হয়েছেন এ বর্ণনায়, আবার তাঁদের প্রতি তাঁদের অস্ত্রের প্রতি ও তাঁদের পরাজয়কে উদ্দেশ করে দেবী বা তাঁর সঙ্গীর বিদ্রুপের মাধ্যমেও তাঁদের অবমাননা।
এই মহৎ শৌর্যের কথা শুনে মহাদেব দূর থেকে এলেন, দু’বাহু প্রসারিত করে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন, যাঁর গাঢ় প্রশ্বাসে নক্ষত্ররা শিহরিত হচ্ছিল। দেবতারা ভিড় করে এলেন, লজ্জানতা দেবী করসঞ্চালনে নিষেধ করলেন তাঁদের। এই যে দেবী যিনি পৃথিবীর আনন্দের অপহারক দৈত্যটিকে মৃত্যুমুখে প্রেরণ করেন, তিনি তোমাদের রক্ষা করুন। (৮৭)
এই ভাবেই কবিতাটি অগ্রসর হয় দেবীর কীর্তি, শক্তি, অস্ত্র, শৌর্য ও মহিমার স্তবের মধ্যে দিয়ে, এরই মধ্যে ধ্বনিত হতে থাকে প্রতিষ্ঠিত পুরুষ দেবতাদের পরাজয়ের গ্লানি। এই দেবীর মধ্যে বৈদিক, বেদোত্তর, মহাকাব্যিক ও পৌরাণিক দেবীর, শুভ ও অশুভ শক্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক মহিমাময়ী দেবীর অভ্যুত্থান। তাঁর পূর্ববর্তী সকল দেবতার গুণ ও কীর্তি তাঁর মধ্যে আশ্রয় পেয়েছে; এ কীর্তিগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল দানব-দলন। সেইটিকে তাই এত অতিরঞ্জন ও আড়ম্বরের মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। এই যুগ তন্ত্রশাস্ত্র রচনার যুগ; তন্ত্রে বর্ণিত দেবীর পূর্বগামিনী এই পৌরাণিক দেবী, বাণ তাঁর সূক্তকার। চণ্ডীশতক-এ তন্ত্রের ‘মহাশক্তি’ শাস্ত্রে নয়, অবতীর্ণা হলেন সাহিত্যে। বিদগ্ধ ভাষা, অপরিচিত প্রতিশব্দ, দূরান্বয়, অলংকারবাহুল্য জটিল শব্দবিন্যাস, অস্বচ্ছ ভাব, কষ্টকল্পনা, যমক ও অনুপ্রাসের ছড়াছড়ি— এ সবই বাণভট্টের শৈলীর চিহ্ন। কালিদাসের পরবর্তী আলংকারিকরা সাহিত্যে কৃত্রিমতার সমর্থন জুগিয়েছেন, পাঠকশ্রোতাও তখন কাব্যে বৈদগ্ধ্য ও ভঙ্গীভণিতিরই প্রত্যাশা করেন; এবং দুর্ভাগ্যক্রমে যশস্কাম কবিরাও তাঁদের এই বিকৃত বাসনা চরিতার্থ করে চলেন। কাব্য-স্বাচ্ছন্দ্য যেখানে প্রসাদগুণ ও প্রেরণার দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হল, সেখানে সে ক্ষতিপূরণ করতে চাইল এক গুরুভার অলংকৃত সমাসবহুল কৃত্রিম শৈলীতে। এই কৃত্রিমতার যুগে সম্ভবত বাণভট্টই একমাত্র কবি যাঁর মধ্যে সত্যকার কবিত্বের প্রেরণা ও শক্তি ছিল; তাঁর গদ্যকাব্যে মাঝেমাঝেই স্বতঃস্ফূর্ত কবিত্বের ঔজ্জ্বল্য পাঠককে চমকিত করে তোলে। কিন্তু ছন্দকাব্যে তাঁর দক্ষতা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর; সমালোচকরা বলেছেন: ‘যাদৃগ্ গদ্যবিধৌ বাণঃ পদ্যবন্ধে ন তাদৃশঃ— গদ্যরচনায় তাঁর যত কুশলতা পদ্যরচনায় তত নয়।’ নিজের শক্তির সীমা তিনি জানতেন বলেই প্রধান দুটি রচনা তিনি গদ্যেই করেন। যে ধরনের রচনায় যথার্থ কবিত্বের কোনও অবকাশ নেই, সেই জন্যে পাঠকের দাবি প্রেরণা ও স্বতঃস্ফূর্ততার কণ্ঠরোধ করল। ঠিক তেমনই যমকে, অনুপ্রাসে, সমাসে-দূরান্বয়ে, অলংকারে ও দুরূহ শব্দ প্রয়োগে কবিত্বের অভাবটা ঢাকা পড়ল না, শুধু রচনারীতি কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক হয়ে উঠল।
তাছাড়া, এই চণ্ডীশতক-এ যেখানে উপজীব্য হল চণ্ডীর মহিষাসুরবধ, সেখানে স্বতঃ স্ফূর্ত কবিত্বের অবকাশ অল্পই, যেটুকু আছে বাণ তা নিঃশেষে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই বিষয়বস্তুই তাঁকে প্রায় বাধ্য করেছে অতিশয়োক্তির দ্বারা তুচ্ছ অনুপুঙ্খগুলিকে অতিরঞ্জিত করতে এবং পূর্বের দেবতা ও দেবপত্নীদের লাঞ্ছনার দ্বারা চণ্ডীকে মহিমান্বিত করতে। এ তুচ্ছ কাজ একশোটি শ্লোকে করতে হলে স্বভাবতই পুনরুক্তি ও অত্যুক্তির আশ্রয় নিতে হয়, বাণও তা নিয়েছেন। ফল যা পাওয়া গেল তা যেমন কৃত্রিম তেমনই পুনরুক্তিবহুল। তাই পুরুষ দেবতাদের তুলনায় চণ্ডীর শ্রেষ্ঠত্ব কীর্তন করতে বাণকে ঊনিশটি শ্লোক রচনা করতে হয়েছে। (১৯, ২১, ২৩, ২৪, ২৯, ৩৩, ৩৬, ৩৮, ৪২, ৫৭, ৬০, ৬২, ৬৫, ৬৬, ৭৩, ৮০, ৯০, ৯২, ৯৮) এর দ্বারা সমস্ত উদ্যমটির আত্যন্তিক নিরর্থকতা এবং ভাবের সর্বস্বান্ততাই সূচিত হয়।
শ্লেষ ও দ্ব্যর্থবোধক রচনা সম্বন্ধে বাণের পক্ষপাতিত্ব মধ্যে মধ্যে কুরুচিপূর্ণ রচনায় পর্যবসিত হয়। ৭৫, ৭৬ ও ৭৭ সংখ্যক শ্লোকে এই শ্লেষ নিহত মহিষাসুর ও মহাদেব উভয়ের সম্বন্ধেই প্রযোজ্য হয়; এর দ্বারা হয়তো চণ্ডীর মহিমাবৃদ্ধি হয়, কিন্তু শ্লেষের মধ্যে মহাদেব ও মহিষাসুরের ব্যঞ্জনাগত সাদৃশ্যে সাহিত্যিক রুচির অতি নিম্নমান সূচিত হয়। তেমনই সংস্কৃত সাহিত্যের ঐতিহ্যে মাতৃকামূর্তির বর্ণনায় যথেষ্ট সংযম থাকার কথা। বাণভট্ট চণ্ডীর দেহ বর্ণনা এমন ভাবে করেছেন যে, তাতে তিনি তাঁকে সাধারণ কাব্যের নায়িকায় পরিণত হয়েছেন : নায়িকার দেহের বর্ণনায় যা সঙ্গত, কিন্তু জননীরূপে কল্পিত দেবীর বর্ণনায় অচল তেমন বহু উল্লেখ চণ্ডীশতক-এ পাওয়া যায় (লক্ষণীয় ৭১, ৭২, ৭৪, ৭৭, ৮১ ও ৮৫ সংখ্যক শ্লোক)। এর ফলে শুধু যে অশালীনতা প্রশ্রয় পেয়েছে তাই নয়, আরও গভীর স্তরে রুচিগত অপরাধ ঘটেছে, কারণ, রসের মধ্যে অনুচিত মিশ্রণ ঘটেছে: বর্ণনার ব্যঞ্জনায় শৃঙ্গাররসের আভাস আছে, অথচ কাব্যের উদ্দিষ্ট মূলসুর ভক্তির। সম্ভবত তৎকালীন মন্দির গাত্রের ভাস্কর্যে মাতৃকামূর্তির অবয়ব-সন্নিবেশের যে শাস্ত্রীয় নির্দেশ কার্যকরী ছিল তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই বাণভট্ট চণ্ডীর দেহবর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর ফলে সাহিত্যে যে বাঙ্ময়ী প্রতিমা নির্মিত হল তাতে রসবিরোধ ও রসসংকর ঘটল এবং পাঠকের চিত্তে বিভ্রান্তির উদয় হল; সেটা রচনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। চণ্ডীশতক-এর চণ্ডীর বর্ণনা বাণের গদ্যকাব্যের নায়িকার বর্ণনার মতোই; ফলে বাণের অভিষ্ট রসের হানি ঘটেছে এখানে।
বাণের শব্দপ্রয়োগ, তাঁর গদ্যকাব্যে সুবন্ধুর তুলনায় সরল হলেও কালিদাস বা ভারবির তুলনায় দুরূহ ও অপ্রচলিত। তাঁর বাক্যবিন্যাস বা বন্ধরীতি গদ্যে গৌড়ীয় অর্থাৎ সমাসবহুল। প্রথম যুগের আলংকারিক দণ্ডী সমাজবহুলতাকে ওজোগুণের বৈশিষ্ট্য বলেছেন এবং ওজোগুণবিশিষ্ট গৌড়ীয় রীতিকে গদ্যেরই প্রাণ বলেছেন— ‘ওজঃ সমাসভূয়স্তমেতদ্ গদ্যস্য জীবিতম্।’ (কাব্যাদর্শ-১:৮০) কাজেই কাদম্বরী ও হর্ষচরিত-এ গৌড়ী রীতি ঠিকই ছিল। মুশকিল হল চণ্ডীশতক-এ। এ তো কাব্য, এখানে ওই সমাসবহুল রীতি অস্থান-প্রযুক্ত, শ্রুতিকটু ও রসহানিকর। তার উপরে আছে দুরূহ বাগভঙ্গী: ভ্রমরের একটি প্রতিশব্দ ষট্পদ; বাণভট্ট চণ্ডীশতক-এ বললেন— ‘দ্বাদশার্ধাঙ্ঘ্রি (৯৫)। শ্রুতিকটুত্ব বাদ দিলেও এ প্রয়োগে কবিতায় মাধুর্যের গুরুতর অভাব ঘটে, প্রসাদগুণেরও। তাছাড়া এর হাস্যকর দিকও একটা আছে—ওই শ্রুতিকটু এবং তির্যক ভঙ্গি দিয়ে যা প্রকাশিত হল তা তো সাধারণ ভ্রমর ছাড়া কিছুই নয়। তেমনই ৯২ সংখ্যক শ্লোকে দু-তিনটি শ্লেষযুক্ত শব্দের ব্যবহারে আপাত যে দুরূহতা এসেছে তা শুধুমাত্র দ্ব্যর্থবোধক শব্দের থেকেই, ভাবে বা উপলব্ধিতে নয়; ফলে রসবিচারে এগুলি অপাঙ্ক্তেয়, সুস্থ রুচি ও রসবোধকে অকারণ আঘাত করে মাত্র
বাণের যুগেই শুরু হল সাহিত্যে সেই বিষক্রিয়া, যার ফলে কবিরা প্রেরণার স্থলে অভিষিক্ত করলেন ভঙ্গিকে। চণ্ডীশতকের পশ্চাতে কোনও আন্তর উপলব্ধি নেই, নতুন কোনও মননও নেই, এর বিষয়বস্তু যৎপরোনাস্তি অকিঞ্চিৎকর। তাকে অবলম্বন করে ছোট একটি স্তোত্র রচনা হতে পারত, একশোটি শ্লোকে রচনা করবার মতো মূলধন তাঁর ছিল না। অনিবার্য ভাবেই শতকের মধ্যে বাণভট্ট তাঁর পাণ্ডিত্য, আঙ্গিকসর্বস্ব, রচনাকুশলতা, দুরুহ শব্দ প্রয়োগের ক্ষমতা, অলংকার বহুলতা, বিশেষত রূপক ও শ্লেষের ব্যবহারে দক্ষতা এবং তির্যক বাগ্ভঙ্গিতে রচনার শক্তির প্রকাশ করেছেন। মহিষাসুরবধের মতো একটি ক্ষীণ বক্তব্যের ওপরে এত ওজন সয় না, ফলে রুচিমান পাঠকের কাছে অসহিষ্ণু লাগে আঙ্গিকের এই গুরুভার, এই কষ্টকল্পনার প্রাচুর্য। বৈদগ্ধ্য নিয়ে এর প্রহেলিকাগুলির সমাধান করলেও এমন কিছু পাওয়া যায় না, যা রসের বা বোধের দ্বারা ক্ষতিপূরণ করতে পারে। সত্যকার জটিলতা, যা কবির উপলব্ধির মধ্যেই নিহিত তার দ্বারা সৎকাব্য সৃষ্ট হতে পারে, তা-ও নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। ইংরেজিতে ডান বা তৎকালীন কবিদের রচনায় যে অন্তর্নিহিত উপলব্ধিগত দুরূহতা আঙ্গিকে কতকটা জটিলতার সৃষ্টি করেছে তার কথা মনে পড়ে এবং ক্ষোভ হয়। শুধু যদি ভঙ্গির ফুলঝুরির মোহ ত্যাগ করে উপলব্ধির গভীরে প্রবেশ করতে পারতেন তবে হয়তো স্থায়ী সম্পদ পেতাম তাঁর কাছে, যেমন পেয়েছি, খুব হলেও মাঝে মাঝে, তাঁর গদ্যকাব্য দুখানিতে। কিন্তু তার জন্যে বিষয়গৌরবও প্রয়োজন। চণ্ডীর মহিষাসুরবধ তেমন বিষয় নয়।
হয়তো বাণভট্ট যে যুগে জন্মেছিলেন তখন পাঠকের রুচি এমন ছিল যে গভীরতা, উপলব্ধির ঐশ্বর্য বা জীবনবোধ কবিতার কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। কলাকৌশলের জাদুতেই মুগ্ধ ছিল পাঠক; গভীরতর কিছু সৃষ্টি করতে গেলে বাণভট্টকেও হয়তো ভবভূতির মতোই নিরবধি কাল ও বিপুলা পৃথ্বীর দিকে চেয়ে আমরণ প্রতীক্ষা করতে হত, জীবৎকালে হয়তো স্বীকৃতিই মিলত না। তাই কি পাঠকের রুচিকে গড়ে তোলবার অপেক্ষাকৃত আয়াসসাধ্য ব্রত ত্যাগ করে আপাতযশের নগদবিদায়ের প্রত্যাশী হলেন কবি? না কি গদ্যে তাঁর যে অধিকার পদ্যে তা ছিল না, তাই এই রচনা? অথবা চণ্ডীশতক-এর বিষয়টির তুচ্ছতাই তাঁর সাধনা ও সিদ্ধি উভয়কেই সীমায়িত করেছে? কারণ যা-ই হোক, চণ্ডীশতক কবিতা হিসেবে সার্থক নয়, রসোত্তীর্ণ নয়। এর কতকটা ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্য ছিল, কিন্তু যেখানে এর অন্তিম বিচার সেই শিল্পবিচারে এর মূল্য নগণ্য কারণ আঙ্গিকের প্রচুর আড়ম্বর সত্ত্বেও কাব্যটি রসে পৌঁছয়নি।
ময়ূরভট্ট বাণভট্টের সমকালীন কবি, জনশ্রুতি, তাঁর কুটুম্ব। ইনি রচনা করেছিলেন সূর্যশতক। কিংবদন্তী হল, ময়ূরভট্ট কোনও একটি অশালীন কবিতা রচনার ফলে অভিশপ্ত হয়ে কুষ্ঠরোগাক্রান্ত হন, সূর্যের স্তবরচনা করার ফলে তাঁর রোগমুক্তি ঘটে, কারণ সূর্য আরোগ্যদাতা। (প্রচলিত শ্লোকে আছে, ‘আরোগ্যং ভাস্করাদিচ্ছেৎ— সূর্যের কাছে আরোগ্য চাইবে।) গল্পটি সম্ভবত সূর্যের আরোগ্যদাতারূপে প্রসিদ্ধি থেকেই তৈরি। সূর্যশতক-এ একশো একটি শ্লোক, সূর্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুসারে সেগুলি বিভক্ত। প্রথম স্তবকে তেতাল্লিশটি শ্লোকে সূর্যের দীপ্তির বর্ণনা, দ্বিতীয় স্তবকে ছ’টি শ্লোকে সূর্যের অশ্ব, তৃতীয় সূর্যসারথি অরুণ এগারোটি শ্লোকে, চতুর্থের এগারোটিতে সূর্যের রথ, পঞ্চমে আটটিতে সূর্যগোলক এবং শেষ কুড়িটিতে সাধারণ ভাবে সূর্যের বর্ণনা ও স্তব। শেষ শ্লোকটি কবির নিজের কথা এবং কাব্যপাঠের ফলশ্রুতি।
বাণের গদ্যে এবং কাব্যে সপ্তম যে পল্লবিত রচনার ভঙ্গি দেখি, ময়ুরের কাব্যেও ঠিক তেমনই বহু বিচিত্র অনুপুঙ্খের সমাবেশ। মূল বর্ণনীয় বস্তু হল সূর্য, যে সূর্য বেদের যুগ থেকেই দেবতা, সপ্ত-অশ্ব-বাহিত রথে সমারূঢ়, যাঁর সারথি ক্ষীণকায় অরুণ। এই সূর্য ময়ূরের বহুপূর্ব হতে জনমানসে বহু কাহিনি ও বর্ণনার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত আরোগ্যদাতারূপে। ময়ূরের মুখ্য বিবক্ষিত বস্তু সূর্যের ঔজ্জ্বল্য। ময়ূরের বর্ণনায় অলংকার ও অতিশয়োক্তি প্রচুর থাকলেও কাব্যের নিজস্ব জটিলতা বিশেষ কিছু নেই; সমাস অলংকার বুঝলে আর কোনও দুর্বোধ্যতা নেই। অর্থাৎ উপলব্ধি নিতান্ত সরল। দুরূহতা এসেছে শ্লেষ থেকে, যার উপর ময়ূরের বিশেষ পক্ষপাত। (শ্লেষের ছড়াছড়ি দেখি ৩, ৪, ৯, ১৮, ২১, ২৫, ৩১, ৪৭, ৫০, ৫১, ৫৩, ৫৬, ৬৪, ৯২] ও ৯৩] সংখ্যক শ্লোকে।) শ্লেষ ছাড়াও ময়ূরের দুর্বলতা অনুপ্রাস সম্বন্ধে; প্ৰতি শ্লোকে অনুপ্রাসের প্রাদুর্ভাব, এদিকে তাঁর এত পক্ষপাত যে, প্রসাদগুণ তাঁর কাব্য থেকে অন্তর্হিত; দুরূহ প্রতিশব্দ ও বাক্যবিন্যাস এসেছে অনুপ্রাসের খাতিরে। অতি সহজ ভাবের কাব্য দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে অপ্রচলিত শব্দের প্রয়োগে এবং ওই শব্দগুলি এসেছে অনুপ্রাসের প্রয়োজনে। দু-একটা উদাহরণে স্পষ্ট হবে :
ভূত্বা জন্তুস্য ভেত্তুঃ ককুভি পরিভবারম্ভভূঃ শুভ্ৰভানো—
বিভ্রাণা বহুভাবং প্রসভমভিনবা ম্ভোজম্ভাপ্রগল্ভাঃ।
ভূষা ভূয়িষ্ঠশোভা ত্রিভুবনভবনস্যাস্য বৈভাকরী প্রাগ্—
বিভ্রান্তি ভ্ৰাজমানা বিভবতু বিভবোদ্ভূতয়ে সা বিভা বঃ।। (৩৩)
যমকও মাঝে মাঝে দেখা দেয়, যেমন—
সানৌ সা নৌদয়ে নারুণিতদলপুনর্যৌবনানাং বনানা—
মালীমালীঢ়পূর্বা পরিহৃতকুহরোপান্তনিম্না তনিম্না।
ভা বোভাদৌপশান্তিং দিশতু দিনপতের্ভাসমানা সমানা
রাজী রাজীবরেণোঃ সমসময়মুদেতীব যস্যা বয়স্যা।। (৩৮)
এ-ধরনের রচনা কবিতা না ধাঁধাঁ তা নিয়ে সংশয় জাগে। এতে বাহাদুরি বিস্তর আছে কিন্তু কবিত্ব? তার কোনও অবকাশও নেই। আরও লক্ষণীয়, এত অনুপ্রাস ও যমক অর্থাৎ শব্দালংকারের এত আড়ম্বর সত্ত্বেও ওই বাহাদুরির লোভে মাধুর্য নেই ময়ূরের রচনায়। ওই বাহাদুরির লোভে শব্দালংকার তার প্রাথমিক দায়িত্বই পালন করেনি, যা বাণভট্টে প্রচুর পরিমাণে আছে। সূর্যশতক-এর রচনা গুরুভার অস্পষ্ট ও কৃত্রিম। ভাবে বা প্রকাশভঙ্গিতে যথার্থ কোনও গাম্ভীর্য নেই এ কাব্যে, যদিও তাঁর বিষয়বস্তুর মধ্যেই নিহিত ছিল গাম্ভীর্যের উপাদান। খুব মধ্যে মধ্যে একটুখানি ব্যতিক্রম আছে, যেমন ১৭ সংখ্যক শ্লোকে। বাংলায় এর অর্থ হল: ‘সূর্যকিরণ অবিলম্বে অন্ধকার ধ্বংস করে অসীম আকাশকে ও দশদিককে প্রকাশ করুক। সমুদ্রের অশান্ত তরঙ্গরা তটে এসে সবেগে লাগছে। বহু পর্বত, নগর, বৃক্ষ দৃশ্যমান হওয়াতে পৃথিবীকে বিপুলায়তন দেখাচ্ছে। এই সূর্যকিরণে পদ্ম প্রস্ফুটিত হচ্ছে; এই কিরণ দ্রুত তোমাদের সব অমঙ্গল দূর করুক।’ ৫৮ নং শ্লোকে সূর্যসারথি অরুণের বর্ণনা ঠিক বাণভট্টের ভঙ্গিতে; অর্থাৎ চণ্ডীশতক-এ যেমন মহিষাসুরকে অন্য কোনও দেবতা বধ করতে না পারায় চণ্ডীর সামনে সকলে নিষ্প্রভ হয়ে গেছেন, এই বর্ণনার মাধ্যমে চণ্ডীর মাহাত্ম্য ঘোষণা করা হয়েছে, তেমনই এখানেও অগ্নি, যম, বরুণ, পবন, কুবের, মহাদেব, ইত্যাদি সকলকে নিষ্প্রভ বর্ণনা করে সূর্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদিত হয়েছে। (এই কথাই প্রতিপাদিত হয়েছে ১৬, ৫৮, ৭১, ৭৬, ৮৮] ও ৯৯ নং শ্লোকে।) আরও ছ’টি শ্লোকেরই বক্তব্য এই কথা, ফলে কিছু ক্লান্তিকর হয়ে পড়ে একই কথার পুনরুক্তি, বৈশিষ্ট্য শুধু ভঙ্গিবৈচিত্র্যে।
বাণভট্টে যেমন মাতৃকা চণ্ডীর অভ্যুত্থানই চণ্ডীশতক-এর প্রেরণার উৎস, ময়ূরের সূর্যশতক-এর প্রেরণাও তেমনই সপ্তম শতকে নবপর্যায়ে সূর্যোপাসনার প্রবর্তনায়। হর্ষবর্ধন যে ধর্মসভা আহ্বান করেন সেখানে তিনটি দেবতা সর্বাধিক গৌরবের পদ পান— বুদ্ধ আদিত্য ও শিব। বর্ধন-রাজবংশের শিলালিপিগুলি থেকে বোঝা যায় এ তিনটি দেবতাই ওই রাজবংশের উপাস্য; বুদ্ধ শুধু হর্ষবর্ধনের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পরে আসেন এই দেবমণ্ডলীতে, বাকি দুজন পূর্ব হতেই ছিলেন। (স্মরণীয়, হর্ষবর্ধন যে নাম দেন— শীলাদিত্য— তাতেও সূর্যেরই স্বীকৃতি।) কিছুকালের জন্যে হর্ষের রাজত্বকালে হিন্দু ও বৌদ্ধ সমান মর্যাদা লাভ করে এবং যেহেতু তন্ত্রের মাধ্যমে শিব বৌদ্ধের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং বুদ্ধ ধীরে ধীরে দশাবতারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিলেন (এই যুগেই প্রথম তন্ত্রশাস্ত্রগুলি রচিত হয়); তাই দুটি সম্প্রদায়ই এমন তিনটি দেবতাকে পেলেন যাঁরা তাঁদের উভয়েরই আরাধ্য। (মিশরে টুটানখামেন এবং বহু পরবর্তীকালে ভারতে আকবর যখন সর্বজনগ্রাহ্য ধর্ম প্রবর্তনে উদ্যোগী হন তখন দুজনেই হর্ষবর্ধনের মতো সূর্যকে কেন্দ্রীয় উপাস্যরূপে উপস্থাপিত করেন, যাতে বহু ভিন্ন ভিন্ন দেবতার উপাসক সম্প্রদায়গুলি এক দেবতার ছত্রতলে মিলিত হতে পারেন।) হর্ষবর্ধনের এ-উদ্যোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, কিন্তু সূর্য-উপাসনার জন্যে একটি স্তব প্রয়োজন ছিল; ময়ূরের সূর্যশতক সেই অভাব মেটায়। কিন্তু এ শুধু বিদ্বৎসমাজেই গ্রাহ্য স্তব, সম্ভবত রাজসভাতেই কবি সমাদৃত হন সূর্যশতক-এর কবি রূপে এবং হয়তো তা-ই তাঁর অভীষ্ট ছিল। নতুবা এই দীর্ঘসমাসবদ্ধ, বহু-অলংকৃত, যমকে অনুপ্রাসে খচিত এ কাব্য যে কখনওই জনপ্রিয় হতে পারেনি সে বিষয়ে কোনও সংশয়ই নেই।
সূর্য ময়ূরকে কাব্য রচনার প্রেরণা দেয় কিন্তু কবিত্বশক্তি দিতে পারেনি, ফলে ময়ূর এমন কোনও কল্পকাহিনি সৃষ্টি করতে পারেননি যার দ্বারা সূর্যশতক পাঠককে মুগ্ধ করতে পারে। বাণভট্টের রচনায় আতিশয্য, কৃত্রিমতা, অলংকারবাহুল্য থাকা সত্ত্বেও চণ্ডীর একটা কাহিনি ছিল— মহিষাসুরবধ উপাখ্যানে, যাকে অবলম্বন করে বাণের কবিত্ব সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বেদেও সূর্য সম্বন্ধে তেমন কোনও কাহিনি গড়ে ওঠেনি আর মহাকাব্য দুটিতে তো সূর্য গৌণ দেবতা। অনেক পরের সাম্বপুরাণ-এর আগে সূর্য আর প্রাধান্য পায়নি। অসুরবধ বা শাপ অথবা বর দেওয়ার কোনও কাহিনির সঙ্গে সূর্য সম্পৃক্ত নন। তাই কল্পকাহিনির একটা বড় ফাঁক রয়ে গেছে, যা ভরে দেওয়ার মতো কবিত্বশক্তি ময়ূরের ছিল না। শুধু আরোগ্যদাতা সূর্যের বিষয়ে মহৎ কোনও সৃষ্টি করার সাধ্য তাঁর ছিল না। ফলে ময়ূরের সমস্ত ঝোঁকটা পড়েেেছ সূর্যের তেজ ও দীপ্তির উপর। কল্পকাহিনির ফাঁক ভরাতে ময়ূর এনেছেন সূর্যের রথ, সারথি, ঘোড়া, তার অবয়ব এবং সূর্যগোলকটির তেজ— বহু অলংকারে, আড়ম্বরে, সবিস্তারে, পুনরুক্তি দিয়ে এই সবই ময়ূর বর্ণনা করেছেন। তাঁর কাব্যবিন্যাস জটিল, অনুপ্রাসে ও যমকে বৈদগ্ধ্য যত আছে মাধুৰ্য তত নেই; অলংকারপ্রয়োগে আড়ম্বর যত, রুচির প্রমাণ তত নেই। কৃত্রিম অলংকারে কাব্যের ভার বেড়েছে, সৌন্দর্য আসেনি।
ময়ূরের একটাই সুবিধে ছিল: সূর্য স্বয়ং। মহাবিশ্বের অনন্ত বিস্তারের মধ্যে সূর্যের উজ্জ্বল প্রতাপ আপনিই মনে সম্ভ্রম জাগায়। এই উপাদান মহৎ কবির হাতে যা হয়ে উঠে পারত ময়ূরের হাতে তা অবশ্যই হয়নি; কিন্তু সপ্তম শতকের পাঠক কবির কাছে যা প্রত্যাশা করত— পাণ্ডিত্য— তা ময়ূরের যথেষ্টই ছিল। কখনো সখনো মাত্র দু-একবার ময়ূর যথার্থ কাব্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ৬৯ সংখ্যক শ্লোকে শুনি:
আকাশে সূর্যের রথ যখন ধাবমান, তখন দেবতারা সারি বেঁধে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁকে নমস্কার করতে। সারথি অসতর্ক নিষ্ঠুরতায় অগণ্য নক্ষত্রকে রথচক্রতলে পিষ্ট করে উজ্জ্বল চূর্ণে পরিণত করছেন। রথের অশ্বগুলির হ্রেষাধ্বনি, চক্রনেমির গুরুধ্বনি দূরের গুহায় গম্ভীর প্রতিধ্বনি জাগাচ্ছে। সূর্যের যে রথ এই ভাবে ছুটে চলেছে তা আমাদের রক্ষা করুক।
মনে হয় এই শ্লোকটির তির্যক প্রভাব পড়েছে ‘শেষের কবিতা’র শেষ কবিতাটির একটি পঙ্ক্তিতে— ‘চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দনে।’
খাঁটি স্তোত্রকাব্যের সুর লেগেছে ৭৩ সংখ্যক শ্লোকে: ‘যে (সূর্য) দিনের মহান বীজ, ক্লান্ত নেত্রের পক্ষে স্নিগ্ধ কজ্জল, মুক্তির তোরণ, সর্বজ্যোতির একক আধার, বর্ষাবারির উৎসস্থল, সমস্ত পৃথিবীর রসসুধার একমাত্র পানপাত্র,— সেই সূর্যমণ্ডল আমাদের মঙ্গল বিধান করুক।’ ভঙ্গির প্রতি এই অত্যধিক মনোযোগের ফলে বৈদগ্ধ্য ও জটিলতার জাল ভেদ করে পাঠক কতকটা প্রবঞ্চিত বোধ করেন, কারণ প্রায় কখনওই কাব্যটি রসে উত্তীর্ণ হয় না। আবেগ ও ব্যঞ্জনার একান্ত অভাব এতে, এমনকী মননের দিকেও নতুন কিছু মেলে না। ময়ূরের কণ্ঠে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের সুর লাগে খুবই কদাচিৎ, সূর্যশতক তাই সর্বপ্রকার কৃত্রিমতার উদাহরণস্বরূপ। দুরূহ প্রতিশব্দের ছড়াছড়ি, যমক, অনুপ্রাস, শ্লেষ, ইত্যাদি কৃত্রিম অলংকারের বহুল প্রয়োগ, দূরান্বয়, দীর্ঘসমাস, তির্ক বাগভঙ্গি, ইত্যাদির মধ্যে কাব্যটি যেন বহু-অলংকৃত একটি প্রতিমা, যাতে শেষ পর্যন্ত প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়নি।
সংস্কৃত শতককাব্যের ইতিহাসে ভর্তৃহরির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তাঁর তিনটি শতক— নীতি, বৈরাগ্য ও শৃঙ্গার; বিষয়বস্তুর দিক থেকে এ-তিনটি পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। কিংবদন্তীতে ভর্তৃহরি এক বিস্ময়কর মানুষ, থেকে থেকেই তাঁর মত ও পথ আমূল পালটে গেছে, ধর্ম ও দর্শনে তিনি শৈব, বৈদান্তিক ও বৌদ্ধ মত অবলম্বন করেছেন জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে; গৃহী ও সন্ন্যাসী জীবনে একাধিকবার আনাগোনা করেছিলেন এমন কথাও শোনা যায়। ভোগের ও ত্যাগের অভিজ্ঞতা যে ছিল তা অনুমান করা যায় তাঁর কাব্য থেকে, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন মেজাজের চিহ্ন আছে এবং তার অনেকগুলিতেই খাঁটি সুর লেগেছে।
নীতিশতক-এর বিষয়বস্তু নামেই প্রকাশ, এ কাব্যে কবিত্বের অবকাশ সবচেয়ে অল্প। তবু মাঝে মাঝে কবির আন্তরিকতা ও গভীরতা বিস্মিত করে পাঠককে। বিষয়বস্তু অনুসারে কাব্যটি বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিভক্ত এবং প্রত্যেকটি শ্লোকেই কবির বিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছে। নানা অলংকারের প্রয়োগে কবি দেখিয়েছেন সহজাত অজ্ঞতা কত দূরপনেয়: ‘কুমীরের দাঁত থেকে কেউ যদিও বা রত্ন উদ্ধার করতে পারে, বিষধর সাপকে ফুলের মতো মস্তকে ধারণ করতে পারে তবু মূর্খকে কেউ কখনও সন্তুষ্ট করতে পারে না।’ (৪ নং) তেমনই বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে পূর্ণ আনন্দ লাভ করার একমাত্র উপাদানই হল বুদ্ধি: ক্রুর নিয়তি হংসকে পদ্মবনে সঞ্চরণের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে পারে কিন্তু, দুধ ও জলের মধ্যে পার্থক্য বোঝবার (সহজাত) শক্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।’ (১৫ নং) যোগ্য ব্যক্তির গর্ব ছোট একটি শ্লোকে খুব স্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত: ‘প্রকৃত যোগ্য ও আত্মসম্মানবিশিষ্ট মানুষের স্থান পুষ্পেরই মতো যথার্থ ভাবে দুটি স্থানেই মাত্র হতে পারে— হয় তাঁরা অন্য মানুষের মস্তকে শোভা পাবেন, নতুবা অরণ্যে অনাদৃত হয়ে থাকবেন।’ (২৬ নং) মানুষের ভোগ্য সম্পদ পূর্ব হতেই ভাগ্য নির্ধারণ করে রাখে: ‘কূপে মগ্ন কলসের দিকে চেয়ে দেখ, তার যতটুকু সাধ্য মাত্র ততটুকু জলই সে ধারণ করতে পারে।’ (৪১ নং) ‘পণ্ডিত হলেও দুর্বৃত্তকে পরিহার করা উচিত। মস্তকে মণি ধারণ করলেও সর্প কি বিষধর থাকে না?’ ‘সজ্জনের চিত্ত সম্পদের দিনে পদ্মের মত কোমল, কিন্তু বিপদের দিনে প্রস্তরের মত কঠিন।’ ধৈর্যের গুণ সম্বন্ধে ভর্তৃহরির সুন্দর উক্তি ধীর ব্যক্তি নির্যাতিত হলেও ধৈর্য হারান না, অগ্নিকে নিচু করে ধরলেও তার শিখা কখনও নিম্নগামী হয় না।’ (৭৭ নং) দৈব যদিও সর্বশক্তিমান তবু মানুষের প্রধান গৌরব তার কর্তব্যপালনে; দেবতারাও আপন আপন কর্তব্যে অবিচল: ‘ব্ৰহ্মাও কুম্ভকারের মতো সৃষ্টিতে, নানা নির্মাণকার্যে ব্যাপৃত, বিষ্ণু দশটি অবতারের দুর্বিপাকে বদ্ধ, নরকপাল হাতে নিয়ে শিব ভিক্ষা করে বেড়ান। কর্মই এ সব নিয়ন্ত্রণ করে, কর্মকে নমস্কার। ‘ (৯৩ নং)। এ সব কাব্যে আছে জীবন সম্বন্ধে ভর্তৃহরির অভিজ্ঞতার ফল, এ শুধু তত্ত্ববাগীশের উপদেশ নয়, বুদ্ধিমান ও সহৃদয় ব্যক্তির প্রণিধান করে জীবনকে দেখা
বৈরাগ্যশতক-এর সঙ্গে নীতিশতক-এর বেশ কিছু মিল আছে, কারণ মোটের ওপর একই ধরনের জীবনবোধ থেকে এ-দুটির উদ্ভব। কিন্তু নীতিশতক-এর উক্তিগুলি সামাজিক মানুষের অভিজ্ঞতার প্রকাশ, বৈরাগ্যশতক-এর উদ্দিষ্ট মানুষ সংসারত্যাগী বা সংসারত্যাগে উদ্যত। হয়তো নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে কবির যখন জীবনে বিতৃষ্ণা জেগেছে, শান্তি পাওয়ার জন্যে যখন তিনি উৎসুক হয়ে উঠেছেন, তখনই বৈরাগ্যশতক-এর কবিতাগুলির সৃষ্টি। জীবনের ঘূর্ণাবর্তের বাইরে এসে তিনি শান্তির সন্ধান করেছেন, সেই সন্ধানেই এ কবিতগুলি জন্ম নিয়েছে। ‘আমি বহু দুর্গম প্রদেশে ঘুরে বেড়িয়েছি, বিনিময়ে কিছুই পাইনি। পরিবার ও বংশের যথার্থ গৌরব বর্জন করে (অযোগ্য) প্রভুর সেবা করেছি; বৃথাই কাকের মতো ভয়ে ভয়ে পরগৃহের অন্নে প্রাণধারণ করেছি। অয়ি তৃষ্ণা, মানুষকে নীচ ও হীন কর্মে প্রবৃত্তি দিয়ে থাক তুমি, এতেও কি তোমার তৃপ্তি হয়নি?’ (২ নং শ্লোক) ‘দিনে একবার মাত্র ভিক্ষার অন্ন আহার করি, ভূমি আমার শয্যা, নিজের দেহই আমার একমাত্র আত্মীয়, বসন হল জীর্ণ চীর; হায়, তবু তো তৃষ্ণা আমাকে ত্যাগ করে না।’(১৫ নং) এই বিতৃষ্ণার মনোভাবের কবিতাতেও মাঝে মাঝে খাঁটি সুরটি লাগে, সে সুর ঐকান্তিক বৈরাগ্যেরই: ‘সুখভোগ হল মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের ক্ষণিক চমকের মতো; বায়ুতে আন্দোলিত পদ্মপত্রে জলবিন্দুর মতোই তার পরমায়ু, এই কথা উপলব্ধি করে মানুষের সংযম অভ্যাস করা উচিত।’ (৩৫ নং) কিন্তু তবু তো মানুষ এ কথা উপলব্ধি করে না, বরং মাতালের মতো আচরণ করে: ‘পরমায়ু প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে সংকীর্ণ হয়ে আসছে, নানা কর্তব্য ও দায়িত্বের চাপে কালের গতি লক্ষিত হয় না। জন্ম, জরা, বিপদ ও মৃত্যু দেখেও মানুষের ভয় নেই। সংসার মদিরায় সে মত্ত, নেশার ঘোরে যেন উত্তাল।’ (৪৩ নং) ‘স্বল্পস্থায়ী শৈশবের পরে মানুষ পূর্ণ যৌবন লাভ করে— স্বল্পকালের জন্যেই। স্বল্পকালই সে দরিদ্র, ধনীও হয় স্বল্পকালের জন্যই। অবশেষে বলিচিহ্নিত জরায় জীর্ণ দেহ নিয়ে টলতে টলতে সে মৃত্যুর রাজ্যে প্রবেশ করে।’ (৫০ নং) মানুষের অন্তর্নিহিত ঐশী অতৃপ্তির পরিচয় একটি সুন্দর শ্লোকে; ‘যদি সব ঈপ্সিত বস্তু লাভ করে থাকো, যদি শত্রুদের মস্তকে চরণ স্থাপন করতে পেরে থাকো, যদি বিত্তের বিনিময়ে মিত্র অর্জন করতে পেরে থাকো, যদি দীর্ঘ যুগ ধরে জীবিত থাকতে পেরে থাকো, তাতেই বা কী, তাতেই বা কী?’ (৬৭ নং) এ শ্লোকের প্রতি চরণের শেষে আছে ‘ততঃ কিম্’— এই পুনরাবৃত্তির দ্বারা এ সব লাভেরই আত্যন্তিক অসারতা প্রতিপন্ন হয় কবিত্বপূর্ণ ব্যঞ্জনার দ্বারা। যে উন্নত ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মানুষ তৃষ্ণাকে প্রশ্ন করতে পারে, প্রতিটি সার্থকতাকে ওজন করে লঘুভার বলে প্রতিপন্ন করতে পারে, জগতের সমস্ত লাভ ও লব্ধব্যের প্রতি এই উদ্ধত ঔদাসীন্য এ-মনোভাবের এত সার্থক প্রকাশ কমই হয়েছে। ‘চন্দ্রকিরণ সুন্দর, বনভূমি রমণীয়, সজ্জনের সঙ্গ উপভোগ্য, সৎকাব্য চিত্তগ্রাহী, ক্রুদ্ধ প্রিয়ার অশ্রুপূর্ণ নেত্র সুন্দর— এ সবই সুন্দর ততক্ষণই যতক্ষণ না মানুষ উপলব্ধি করে যে জীবনই ভঙ্গুর।’ (৭৯ নং) নির্বেদ উপভোগ্য কবিতার উপজীব্য হয়ে উঠেছে: ‘পৃথিবী তার প্রসারিত শয্যা, বাহু দুটি তার আয়ত উপাধান, আকাশ তার চন্দ্রাতপ, স্নিগ্ধ বায়ু তাকে বীজন করে, শরতের চন্দ্র তার প্রদীপ, বধু বিতৃষ্ণার সঙ্গসুখে মুনি যেন অক্ষুণ্ণবিভব সম্রাটের মতোই সানন্দে শয়ন করে।’ (৯৪ নং) যে শান্তরসের রসত্বই বিসংবাদিত তাকে অবলম্বন করেও ভর্তৃহরি মোটের ওপরে সার্থক কিছু শ্লোক রচনা করেছেন।
নীতিশতকও বৈরাগ্যশতকমূলত কতকটা যেন একই মনোভাবের দুটি স্তরকে প্রতিফলিত করে। নীতিশতক-এ সংসারে থেকেই সংসারকে নিস্পৃহ ও নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখে যথাযথ আচরণ করবার নির্দেশ আর বৈরাগ্যশতক-এ কবির নিস্পৃহতা আরও উচ্চগ্রামে পৌঁছে তাঁকে সংসার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বীতস্পৃহ করে তুলেছে। দুটিতেই সংসারে আসক্ত মানুষের থেকে অনেকটা দূরত্বে কবির অবস্থান। নীতিশতক-এর আবেদন বুদ্ধির ও যুক্তির কাছে, উৎস ভূয়োদর্শিতা। বৈরাগ্যশতক-এর আবেদন আবেগের ভারসাম্যে স্থিত শান্তরসের উপলব্ধিতে, উৎস নির্বেদ। দুটি শতকেই প্রত্যেকটি শ্লোকেই স্বতন্ত্র একটি ভাব বা আবেগের রূপায়ণ— বিষয়ের সাম্যই এদের শতকরূপে গ্রথিত করেছে।
শৃঙ্গারশতক-এ কিন্তু শ্লোকের বিন্যাস অন্য রকম। এখানে শ্লোকগুলিতে শৃঙ্গার সম্পর্কে বিভিন্ন মনোভাবের অভিব্যক্তি; সাতটি গুচ্ছে শ্লোকগুলি বিভক্ত: স্ত্রীপ্রশংসা, সম্ভোগবর্ণন, পক্ষদ্বয়নিরূপণ (নারীসঙ্গ ভোগ ও ত্যাগের মধ্যে দোলায়মান মনোভাব), কামিনীগণ (নারীনিন্দা), সুবিরক্তপদ্ধতি (নারী সম্বন্ধে নিরাসক্তির উপায়), দুর্বিরক্তপদ্ধতি (নারী সম্বন্ধে নিরাসক্তির অসম্ভাব্যতা) ও ঋতুবর্ণন। বিষয়গুলির তালিকা থেকেই বোঝা যায় ভর্তৃহরির চিত্ত কত সংবেদনশীল ও অস্থির ছিল, কত বিভিন্ন ভাবে তাঁর চিত্তে সাড়া জাগত এবং নিরন্তর একটি আততির মধ্যে থাকার ফলে তাঁর চিত্তবৃত্তি কখনওই স্থায়ী স্থিতিলাভ করতে পারেনি। হয়তো চায়ওনি। নারী ও প্রেম সম্বন্ধে তাঁর মন কোনও একটি বিন্দুতে পৌঁছে বিরাম লাভ করেনি, সর্বদাই দোলাচল অবস্থায় পরস্পরবিরোধী দুটি কোটির মধ্যে আনাগোনা করেছে। ‘সূর্য, অগ্নি, নক্ষত্র ও চন্দ্র থাকা সত্ত্বেও সেই মৃগনয়ন দুটি না থাকলে আমার পৃথিবী অন্ধকারে।’ (১৪ নং) আবার নিরাসক্তির মেজাজে বলছেন, ‘এই মোহময়ীরা স্বভাবতই (সৌন্দর্য দিয়ে) মুগ্ধ করে; কেবলমাত্র মূর্খরাই তাদের হাবভাবে প্রভাবিত হয়। পদ্ম রক্তবর্ণ (নিজের গুণে নয়), প্রকৃতি তাকে রক্তবর্ণ করেছে বলেই, তবুও ভ্রমর তারই কাছে ঘোরাফেরা করে।’ (৪৭ নং) ‘মদন নারীকে ব্যবহার করেন পুরুষকে আকর্ষণ করবার জন্যে। জীবনের সমুদ্রে ধীবরের মতো মদন নারীকে বঁড়শির মতো নামিয়ে দিয়েছে, মৎস্যের মতোই পুরুষ তার ওষ্ঠাধরের টোপে আকৃষ্ট হয়ে উঠে এসে কামের অনলে দগ্ধ হয়।’ (৫২ নং) শ্লোকের পর শ্লোকে পুরুষকে সতর্ক করা হয়েছে যাতে সুন্দরীর আকর্ষণ ও ক্ষণিক প্রেমে সে দিগ্ভ্ৰান্ত না হয়। কবিতার বিচারে এগুলি উন্নত মানের নয়, কারণ এক হিসেবে এগুলিও নীতিশতক-এর শ্লোকের মতো উপদেশমূলক ও বেশ নীরস। এদের পিছনে অভিজ্ঞতা থাকতে পারে, কিন্তু হয় সে অভিজ্ঞতা কবির আবেগকে গভীরে স্পর্শ করেনি, নয়তো বিরুদ্ধ আবেগের উপলব্ধির সামনে এগুলি তাঁর নিজের কাছেই অপেক্ষাকৃত নিষ্প্রভ ও দুর্বল ঠেকেছে। যে কারণেই হোক এ কবিতাগুলি রসোত্তীর্ণ হয়নি।
কবির সংবেদনশীল মনের সবলতর, দৃঢ়তর অভিজ্ঞতার প্রকাশ অন্য ধরনের কবিতাগুলিতে। এগুলিতে কবি বলছেন, নারীই জীবনকে বহনীয়, সহনীয় করে তোলে। ঈষৎ তির্যক ভঙ্গিতে কবি স্বীকার করেছেন প্রেমের অভিজ্ঞতায় একমাত্র বেদনাই হল বিরহ : ‘নারীর বাইরে অমৃতও নেই, হলাহলও নেই; মিলনে সে-ই অমৃত, বিরূপ হলে সে-ই বিশুদ্ধ হলাহল।’ (৪৪ নং) কিংবা, ‘দৃষ্টিপথে থাকলে সে সুধা, দৃষ্টির বহির্ভূত হলে বিষের চেয়েও বিষম।’ (৪৩ নং) কখনও বা সুতীব্র তিক্ততা নিয়ে কবি নারীকে প্রলোভনের নাগপাশ ও নরকের দ্বার বলে অভিহিত করেছেন। (২৯, ৭৭ নং) কিন্তু এগুলিতে শৃঙ্গারশতক-এর কবির যথার্থ পরিচয় নেই, আছে সেই সব শ্লোকে যা নারীর নিন্দা বা প্রশংসার ঊর্ধ্বে; স্থায়ী কাব্যসুষমায় মণ্ডিত সেইসব ছোট ছোট শ্লোকগুলি যাতে প্রেমের দুর্জয় ও দুরধিগম্য আকর্ষণ ভাষা পেয়েছে। নারীনিন্দার শ্লোকগুলি অপেক্ষাকৃত অগভীর এবং অনান্তরিক, দেশের বাতাসে সঞ্চরণ করে যেসব গতানুগতিক নারীনিন্দা, পুরুষশাসিত সমাজের সাহিত্যে যা এক সনাতন উপজীব্য, নানা ভঙ্গিতে তারই উচ্চারণ। তেমনই নারীপ্রশংসার শ্লোকগুলিও অতিশয়োক্তিতে বিবর্ণ ও সাহিত্যবিচারে বেসুর ও ব্যর্থ। কিন্তু যে কটি শ্লোকে প্রেমের অপরাজেয় শক্তি স্নিগ্ধতা মাধুর্য ও সুধা রূপ পেয়েছে সে কটি সত্যিই অবিস্মরণীয়। ‘জীবন, তোমার এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে পরিক্রমা সত্যিই অসাধ্য হত, যদি না এই নারীরা না থাকত যাদের নয়নে ভরা মদিরা।’ (৩৩ নং) দুর্গম বিপৎসংকুল পথপরিক্রমার ক্লান্তি অপনোদন করতে যাত্রায় শ্রান্ত পথিক যেমন সুরাপানে শক্তি সঞ্চার করে নিজের দেহে, তেমনই নারীনয়নের মদিরায় জীবনপথিকেরও প্রাণে শক্তি সঞ্চারিত হয়। ‘সপ্তলোকের একটিমাত্র সত্য উচ্চারণ করি: নারীর মতো এমন মনোহারী আর কিছুই, এমন দুঃখহেতুও আর কিছু নেই।’ (৩৫ নং সবচেয়ে মর্মস্পর্শী শ্লোকটি বোধহয়: ‘এই অসার সংসারে জীবিকার জন্য কুনৃপতির ভবনদ্বারে সেবা করার কলঙ্ক ও গ্লানি আত্মসম্মানবিশিষ্ট মানুষ কেমন করে ধৈর্য ও স্থৈর্য অক্ষুণ্ণ রেখে সহ্য করতে পারত যদি না স্তনভরে আনতকটি বিকশিতমেখলা এই পদ্মনয়নারা চন্দ্রকিরণের দ্যুতি ধারণ করত?’
ভর্তৃহরির কাব্যে লক্ষ্য করি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণ। ক্লাসিক্যাল সাহিত্যে এটাই রীতি, উত্তমপুরুষে রচনা প্রায়ই থাকে না যদি না প্রসঙ্গটি উত্তমপুরুষের হয়, যেমন চৌরসুরতপঞ্চাশিকায়। তবু ভর্তৃহরির নৈর্ব্যক্তিকতার আড়ালটি খুবই সূক্ষ্ম, অন্তরালে কবিকে দেখা যায়। মুগ্ধ কবির নারীস্তুতি, প্রেমের উপলব্ধির গভীরে তাঁর নিমজ্জন, পরিতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস, বিরহের মর্মবিদারী দীর্ঘশ্বাস যেন স্পষ্ট শোনা যায়। কখনও বা স্পষ্ট হয়ে ওঠে নারীর প্রতি তাঁর গভীর কৃতজ্ঞতা, যে নারী জীবনের বহু দুঃখশোকে বন্ধুর মরুযাত্রাকে সহনীয় করে তোলে। এই শেষের কবিতাই নতুন সুর এনেছে সংস্কৃত কাব্যে। প্রকৃত বিচারে ভর্তৃহরি খুব উচ্চমানের কবি নন, মেঘদূত বাদে কোনও খণ্ডকাব্যই সেই অর্থে তেমন রসোত্তীর্ণ নয়। সার্বজনীন ও চিরন্তন সত্য বলার নেশায় পেয়ে বসেছিল কবিদের, এতে তত্ত্ব থাকে প্রচুর, কাব্য হয়ে ওঠে খুব কম শ্লোক।
অমরু সম্পূর্ণ ভিন্ন কোটির কবি। তাঁর রচিত শ্লোকসংকলনটি অমরুশতক নামে বিখ্যাত এতে প্রেমের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে। কতকটা যেন অলংকারশাস্ত্রের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই অমরু প্রেমের অবস্থাগুলি অবলম্বন করে শ্লোক রচনা করেছেন; তার মধ্যে পূর্বরাগ, উৎকণ্ঠা, মিলন, বিরহ, কোপ, ক্ষোভ, অভিমান সবই আছে। ডঃ সুশীলকুমার দে তাঁর সংশোধিত পাঠের সংস্করণে অমরুশতক-এর প্রচলিত একশো সাতাশটি শ্লোকের মধ্যে মাত্র বাহাত্তরটিকেই প্রামাণ্য বলে ধরেছেন, বাকিগুলি প্রক্ষিপ্ত। এই বাহাত্তরটির মধ্যেই প্রেমের নানা অবস্থাই প্রতিফলিত। তরুণীকে তার প্রেমিক বলছেন, ‘তোমার প্রেমপূর্ণ অর্ধমুকুলিত নেত্রের অলস দৃষ্টিপাত কখনও সরাসরি, কখনও বা তির্যক ভাবে প্রসারিত— যেন তোমার চিত্তে বিভিন্ন ভাবের আনাগোনা সূচিত করছে; বলত, প্রেয়সি, ওই দৃষ্টি তুমি কার উপরে নিক্ষেপ করছ?’ (৪ নং) অভিমানিনীর সখী, অপরাধী নায়ককে বলছে, ‘সখীকে তুমি একদা প্রেম দিয়েছিলে, দীর্ঘদিন তাকে আদর করেছ, সেই তুমিই আজ তাকে আঘাত করেছ, এই তার দুর্ভাগ্য। তার এই আঘাত ও অপমান শুধু তোমার মুখের কথায় যাওয়ার নয়। নিষ্ঠুর, দাও ওকে করুণ ভাবে, সরবে কাঁদতে দাও।’ (৬ নং) যে প্রেমিকা বধূটি কল্পনা করতে পারে না যে, স্বামী তাকে ছেড়ে বেশি দিন বাইরে থাকতে পারেন আর জানে না যে স্বামীর এবারের যাত্রা কয়েক মাসের জন্যে, সে যাত্রার পূর্বে স্বামীকে বলছে, তুমি ফিরবে কখন, এক প্রহর পরে? দ্বিপ্রহরে না আরও পরে? একেবারে কি দিনের শেষে?’ সাশ্রু নেত্রে বধূটি যখন এই প্রশ্ন করে তখন সে জানে না যে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতেই স্বামীর একশো দিনের বেশি লাগবে।’ (১২ নং)
দম্পতির জীবনের কতকগুলি চিত্র পাই অমরুর হাতে: তার মধ্যে অভিমান, ধীরে ধীরে পরস্পরের কাছ থেকে সরে যাওয়া, প্রেমের বিলোপ, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, পরুষ ভাষায় আলাপ ও ভর্ৎসনা আবার কখনও-বা সহসা আবেগভরে পুনর্মিলন। মানিনী বধূটি স্বামীর আচরণে গভীর ভাবে ক্ষুব্ধ কিন্তু মুখে প্রকাশ করবে না সে কথা। স্বামী তাকে বলছে : দূর থেকে স্মিত হেসে তুমি আমাকে অভ্যর্থনা কর, যখন তোমাকে কিছু করতে বলি, নতশিরে শোন তা, সম্ভোগের চূড়ান্ত মুহূর্তেও কিন্তু তোমার দৃষ্টি আর আচ্ছন্ন হয়ে আসে না; কঠিন হৃদয়ে, একটিই জিনিস আমাকে নিষ্ঠুরতম আঘাত হানে, এই সযত্নে তোমার কোপ গোপন করা।’ (১৩ নং)
সরলা বালিকাবধূর প্রথম বেদনার সুন্দর প্রকাশ: ‘স্বামীর প্রথম অপরাধে বালিকাবধূটি জানে না কেমন করে শয্যায় পার্শ্বপরিবর্তন করতে হয় অথবা নিষ্ঠুরভাষায় ভর্ৎসনা করতে হয়, কেউ তাকে এ সব শেখায়নি। তাই পদ্মনেত্র হতে স্থূল স্বচ্ছ অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ে তার চূর্ণকুন্তল সিক্ত করে তোলে। মেয়েটি (নীরবে) শুধু কেঁদেই চলে।’ (২৮ নং) সব সংকাব্যের মতো এ কবিতারও অনুবাদে অনেকটা সৌন্দর্যহানি ঘটেছে। দীর্ঘ স্বরবর্ণ ও তরল ব্যঞ্জনবর্ণগুলির বিন্যাসে আকম্প্র এর ধ্বনিতে, আর ওই অশ্রুসিক্তকুন্তলা নতনয়নার অবিরল নীরব ক্রন্দনের চিত্রটিতেই তীব্র বেদনার ব্যঞ্জনা রয়ে গেছে। বিপ্রলব্ধা নায়িকাকে স্বামী বলছে: ‘সুন্দরি তোমার মৌন ভঙ্গ করে তোমার পদানত এই আমার দিকে একবার চেয়ে দেখ। তোমার কোপ তো আগে এমন ছিল না। স্বামী এই কথা বলতে বলতেই বধূর দুনয়ন হতে অশ্রুর স্রোত নেমে এল।’(৩৬ নং) মানিনী স্বামীকে বলছে: ‘তবে তাই হোক্, বৃথা বাক্য থাক। তুমি যাও, প্রিয়তম, তোমার বিন্দুমাত্র দোষ নেই। ভাগ্য আমার প্রতি বিরূপ। তোমার সেই গভীর প্রেমেরই যদি আজ এই পরিণতি, তবে এই ভঙ্গুর জীবন আমাকে ত্যাগ করলে তা নিয়ে আর কি নালিশ থাকবে?’ (২৯ নং) অন্য একটিতে যাত্রায় উদ্যত স্বামীর সম্বন্ধে নায়িকা ‘তার বসনপ্রান্ত ও আকর্ষণ করল না, দুহাত দ্বারের দুপ্রান্তে রেখে তার যাত্রা রুদ্ধ করতেও প্রয়াসী হল না। আকাশে মেঘের ঘনঘটা কিন্তু নায়কের যাত্রায় বাধা পড়ল সেই তরুণীটির দুচোখ থেকে নেমে আসা অশ্রুনদীর ধারায়।’(৫৫ নং) সুন্দর একটি শ্লোকে দেখি, ‘প্রেমিক ভাল করেই জানে তার প্রেয়সীর মধ্যে বহু জনপদ, কতশত নদী, পর্বত ও অরণ্যের ব্যবধান; সে জানে যে, নায়িকা (তার) দৃষ্টিপথের অগোচরে, তবু পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে সে চোখ রগড়ে প্রিয়ার অভিমুখে বারে বারে তাকিয়ে দেখছে।’ (৭২ নং) মেঘদূতের যক্ষের কথা মনে পড়ে: যার আনন্দস্পর্শের লোভে অতি সহজ কথাও কানে কানে বলতাম আজ সে চোখের আড়ালে, শ্রবণের ওপারে। (উত্তরমেঘ ৪০) শুধু নায়কের কটি ভঙ্গি বর্ণনা করে বর্ণিত হয়েছে সেই বিরহের তীব্রতা যা বুদ্ধির প্রবোধ মানে না।
ক্রোধ, অভিমান, ক্ষোভ ইত্যাদি নানা ক্ষণিক মনোভাবের অন্তরালে গভীর স্থায়ী প্রেমের ব্যঞ্জনা অমরুর কাব্যে। ভ্রুকুটি করলেও নায়িকা সাগ্রহে নায়কের দিকে চেয়ে আছে, ক্রোধে বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছে না, তবু সহসা স্মিতহাস্যে উদ্ভাসিত হচ্ছে মুখমণ্ডল, হৃদয় কঠিন হয়ে উঠেছে তবু রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে তনুলতা, প্রেমিকের ওপরে তার যে ক্রোধ তা কেমন করে চরমে উঠবে যতক্ষণ সে নায়ককে চেয়ে দেখছে?’ (২৭ নং) আহতা নায়িকার মান যেতে চায় না, সে বলে: ‘চিত্ত দীর্ণ হোক, মদন শীর্ণ করে দিক এ দেহকে, ঐ চঞ্চলচিত্ত মানুষটির সঙ্গে আর কোনো সম্পর্কই থাকবে না আমার, সখি।’ মনের খেদে নায়িকা এ কথা বলল বটে কিন্তু উচ্চারণ শেষ না হতেই প্রিয়তমের পথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। (৬১ নং)
প্রচণ্ড ভুল বোঝার সময়েও, যখন গভীর ভাবে আহত নায়ক নায়িকা দুজনেই, তখনও প্রেম যে কি বিচিত্র অচিন্ত্যপূর্ব রূপে আত্মপ্রকাশ করে তা সত্যি বিস্ময়কর।
একই শয্যায় শুয়ে তারা দুজন পরস্পরের কথায় উত্তর দেয় না আর। মনে মনে যদিও দুজনেই অনুতপ্ত এবং পরস্পরের কথাই ভাবছে তবু মান ত্যাগ করছে না। ধীরে ধীরে পরস্পরের তির্যক দৃষ্টি এসে মিলল, দোষারোপের হিমানী গলল, একটি স্মিতহাসি দেখা দিল এবং সবটারই অবসান ঘটল একটি আলিঙ্গনে। (২২ নং)
স্বামী ভাবছে বধূটির প্রতিক্রিয়া কী হবে:
আমি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সে আমার দিকে ফেরে কিনা। সে-ও আহত হয়ে ভাবছে তার সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ করেছি আমি এতই নিষ্ঠুর। এমনই এক মুহূর্তে, যখন দুজনেই চোরাচাহনিতে পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে তখন আমার স্মিতহাস্য দেখেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ল, তাতে আমারও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। (২৩ নং)
দীর্ঘ বিরহের পর প্রেমিক প্রেমিকার মিলন; শাস্ত্রে যেমন লেখে তেমনটা কিন্তু ঘটল না, তখন তাদের নিজস্ব প্রতিক্রিয়াই দেখা দিল সে মুহূর্তে: ‘দীর্ঘ বিরহ ও সতৃষ্ণ প্রতীক্ষার অবসানে প্রেমিকপ্রেমিকার দেহ শিথিল হয়ে আসে। দীর্ঘদিন পরে তারা যখন পরস্পরকে অভিবাদন করে তখন পৃথিবীটাই তাদের চোখে নতুন হয়ে দেখা দেয়। (মিলনের প্রথম দীর্ঘ দিনটি কোনও মতে কাটে, রাত্রেও কামনা ততটা উদ্ৰিক্ত হয় না যতটা হয় অবিশ্রান্ত কথা বলে যাওয়ার বাসনা। (৪০ নং) ম্লান শীর্ণ নায়িকা নায়কের কাছে স্বীকার করবে না যে অদর্শনেই তার এই অবস্থা: ‘কেন তোমার এই শীর্ণতা এই বেপথু, কপোলে ও আননে এই ম্লানিমা?’ প্রেমিক এই প্রশ্ন করলে তন্বী নায়িকা জানায় এ সবই স্বাভাবিক আর মুখ ফিরিয়ে পক্ষ্মতলে সঞ্চিত অশ্রু ঝরিয়ে দেয়।’ (৪৬ নং)
আবার কখনও বা সত্যই প্রেমের মৃত্যু ঘটে, তখন বাকি থাকে নিষ্প্রতিকার বেদনা। অমরুর সংবেদনশীল লেখনীতে এ অবস্থার সার্থক প্রকাশ ঘটে:
যেখানে ভ্রুকুটিরচনাই ছিল কোপ, মৌন যেখানে ছিল নিগ্রহ, পরস্পরের অভিমুখে স্মিতহাস্য যেখানে ছিল অনুনয়, দৃষ্টিপাতই ছিল প্রসাদ, সেই প্রেমের কেমন মৃত্যু ঘটেছে দেখ, তুমি পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত, তবু, খল আমি, আমার ক্রোধ তো এখনও যায় না। (৩৫ নং) ‘প্রথমে আমাদের দেহ দুটি মিলিত হয়েছিল, তখন তুমি ছিলে প্রেমিক আর এই হতভাগিনী অমি তোমার প্রণয়িনী। এখন তুমি বর আমি বধূ, তবু আমি বজ্রের চেয়ে কঠিন এই জীবন বহন করে চলেছি, (অর্থাৎ তোমার প্রেমে বঞ্চিত হয়েও আমার মৃত্যু ঘটে না)।’ (৪৮ নং) ভর্তৃহরির শৃঙ্গারশতকে প্রেমের উপলব্ধি নিবৈশিষ্ট্য, সাধারণীকৃত, অমরুর কাব্য কিন্তু যেন সত্যকার প্রেমিক প্রেমিকাকে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ও মনোভাবে চোখে দেখা যায়, তারা যেন স্বতন্ত্র ও বাস্তব ব্যক্তি। এ কথা সত্যি যে অলংকারশাস্ত্রের নির্দেশ এ ধরনের বর্ণনার পশ্চাতে সক্রিয়, তবু শ্লোকগুলিতে খাঁটি সুরটি বেজেছে। ভর্তৃহরির শৃঙ্গারশতক-এরও অধিকাংশ শ্লোকেরই আবেদন বুদ্ধিবৃত্তির কাছে, অর্থাৎ তারা যেন দীপ্তিকাব্য’, সেখানে অমরুর মুখ্য আবেদন হৃদয়বৃত্তির কাছে, তাই তাঁর কাব্য ‘দ্রুতিকাব্য’, চিত্তকে দ্রব করে আনে। তাছাড়া স্থূল দেহবর্ণনায় অমরুর অরুচি, সম্ভোগশৃঙ্গার-এর বর্ণনায় বা নারীদেহের অনুপুঙ্খের বর্ণনা যা কালিদাসোত্তর কাব্যের মূলধন, তাতে অমরুর স্পষ্ট অনীহা। দেহ আছে, নারীদেহও আছে তার যৌবনের সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে, তবু অমরুতে সর্বদাই দেহের মন্দিরের বিগ্রহের মতো প্রতিষ্ঠিত একটি চিত্ত, যা নানা আবেগে নিয়তকম্প্র ও শিহরিত। তীব্র আবেগের রূপায়ণও যেমন সার্থক তাঁর লেখনীতে, তেমনই সার্থক সূক্ষ্ম সুকুমার আবেগগুলি। অমরুতে নরনারী উভয়েই প্রেমের জন্যে উন্মুখ, নারী অন্যত্র যেমন নিষ্ক্রিয় ভাবে চিত্রিত, অমরুতে তেমন নয়। অমরু প্রেম সম্বন্ধে কোনও তথ্য উপস্থাপিত করেননি যেমন করেছেন ভর্তৃহরি; প্রেমের কোনও মূল্যায়নও তাঁর উদ্দেশ্য নয়, তাঁর কাব্য প্রেমকে তার নানা তীব্র ও সূক্ষ্ম আবেগের অনুষঙ্গে সার্থক ভাবে চিত্রিত করেছে। সহজ একটি প্রেমের অবস্থাও অমরুর উপস্থাপনায় জটিল ভাবে রূপায়িত হয়েছে, কারণ নানা অঙ্গরস ওই স্বল্প পরিসরের মধ্যেই কখনও অন্তঃস্রোতে কখনও-বা দৃষ্টিগোচর ভাবেই আনাগোনা করেছে। নানা সূক্ষ্ম আভাস দেখা যায়— দ্বিধা, উভয়াবেশ, দুটি তিনটি ভাবের মধ্যে দোলাচলতা, প্রেমের মধ্যেই যেন অবচেতনে সন্নিহিত আছে, বিদ্বেষ, ক্রোধ, করুণা, মমতা ও ক্রুরতা। এ সবই যেন প্রেমের পটে দ্রুত দেখা দিয়ে সরে সরে যায়, যেমনটি ঘটে জীবনে। একটি মূল আবেগের সঙ্গেই এই পরিস্রিয়মাণ বৃত্তিগুলি যেন গৌণ ভাবে সম্পৃক্ত। এ ভাবে চিত্রণ অনেক বেশি বাস্তবানুগ, সরলরেখায় একটি মুখ্য রসকে চিত্রিত করার চেয়ে সংস্কৃত সাহিত্যে অধিকাংশ প্রেমের কাব্য যেখানে স্থূলরেখায় একটিমাত্র পরিচিত রসকে আঁকে সেখানে অমরুর কাব্যে আবেগের মুখ্য ও গৌণ অনুষঙ্গের জটিল মিশ্রণে কাব্য অনেক সমৃদ্ধতর হয়েছে।
অমরু পর্যন্ত শতককাব্যকাররাই এই কাব্যের ক্ষেত্রে প্রধান কবি। এর পরেও বেশ কয়েকজন অপেক্ষাকৃত অক্ষম কবি শতককাব্য রচনা করেছেন— নানা বিচিত্র বিষয়ে। রাজপুত ‘টাকা’ রাজবংশের রাজত্বকালে ধারা রাজ্যের এক নাগরাজ রচনা করলেন নিতান্ত নগণ্য এক ভাবশতক; এতে পাঠভেদে পঁচানব্বই থেকে একশো দু’টি পর্যন্ত শ্লোক পাওয়া যায়। নারীর দিক থেকে প্রেমের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাই এর বিষয়বস্তু। মোটামুটি নৈপুণ্য থাকলেও শতকটি সম্পূর্ণই প্রেরণাহীন। প্রেরণার অভাব তিনি পূরণ করতে চেয়েছেন প্রচণ্ড অতিশয়োক্তি, ভাবালুতা এবং কামশাস্ত্রের নির্দেশগুলির প্রতি অন্ধ আনুগত্য রেখে শ্লোক রচনা করে। শ্লোকগুলি বেশ কতকটা দুর্বোধ্য এবং ভাষ্যের শরণ না নিলে অস্পষ্ট থেকেই যায়; ভাষ্যকার সম্ভবত স্বয়ং কবিই; তিনি শ্লোকে যা প্রকাশ করতে পারেননি ভাষ্যের মাধ্যমে সেটি সম্পূরণ করেছেন। ‘বসন্তে কোনো পদ্মনয়না নায়িকা পুষ্পতরুর কাছে গিয়েও প্রশ্বাস রোধ করে থাকেন, মোচন করেন না।’ (৪ নং) টীকাকার জুড়ে দিচ্ছেন ‘পাছে মধুকররা তাঁর শ্বাসকে পুষ্পগন্ধ মনে করে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে পড়ে!’ এ-ধরনের রচনার অন্তর্নিহিত অসারতা আরও স্পষ্ট হয় যখন পড়ি: ‘সূর্য দূর সমুদ্রে তার তাপ নিমজ্জি করে তটের এক প্রাণীতে তা সঞ্চারিত করেন।’ ধাঁধাঁর মতো এই শ্লোকটির উপসংহার ভাষ্যকারের কথায়: চক্রবাক রাত্রে চক্রবাকী থেকে বিযুক্ত তারই বক্ষে সেই তাপ! এ জাতীয় উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। অক্ষম কবি তাঁর কাব্যগত দেউলে অবস্থা গোপন করবার জন্যে এই ধরনের কলাকৌশলের আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। নবম শতকের কোনও এক ভল্লট একটি শতককাব্য রচনা করেন, সেটি ভল্লটশতকবলেই পরিচিত। অলংকারশাস্ত্রগুলিতে মাঝে মাঝে এর থেকে শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। এতে ১০৮টি শ্লোক পাওয়া যায়, জীবনের নানা দিক এর বিষয়বস্তু। মনে হয় ভল্লটের রচিত বিক্ষিপ্ত শ্লোকগুলির সংকলনেই এর সৃষ্টি, বিষয়গত কোনও সংহতি এগুলিতে নেই। শ্লোকগুলি গুণগত দিক থেকেও সমান নয়। অধিকাংশ শ্লোকই জীবন সম্বন্ধে বহুপ্রচলিত সদুক্তি, নিতান্তই বৈশিষ্ট্যহীন। শুধু ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি অনাবশ্যক ভাবে জটিল। ‘বিষ, কে তোমার স্থান নিরূপণ করেছিল? প্রত্যেকটি স্থানই পূর্বটির থেকে গৌরবের: প্রথমে সমুদ্রের মধ্যে, তারপর মহাদেবের কণ্ঠে এবং তারপরে খলের বচনে?’ (৪ নং) ‘স্বর্ণকার, তোমাকে নমস্কার! সূক্ষ্ম ওজন নিরূপণ করার জন্যে একা তুমিই সুবর্ণের সঙ্গেই তুলায় শিলাখণ্ড চাপিয়ে দাও।’ (৭০ নং) ‘কপোল বেয়ে যে গন্ধগজের মদস্রাব হচ্ছে সে যদি তার কাছে আসা মৌমাছিদের তাড়িয়ে দেয় তবে ক্ষতি হাতিরই, কারণ তারই অলংকার চলে গেল (মৌমাছির গুঞ্জন হাতির মদস্রাবের বিজ্ঞাপন), কারণ মৌমাছিরা গিয়ে প্রস্ফুটিত পদ্মের চারিদিকে ঘুরবে।’ (১০৫ নং) ভল্লটের ভাবগুলি নেহাৎই সাধারণ, বৈশিষ্ট্যবর্জিত। একমাত্র ‘বৈশিষ্ট্য’ হল পাণ্ডিত্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত বা উল্লেখ, এই দিয়েই ভল্লট তাঁর প্রেরণার অভাব ঢাকতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর শতকটিও যে রক্ষা পেয়েছে এতে প্রমাণিত হয় সাধারণ পাঠক আর সংস্কৃত পড়েন না, যাঁরা পড়েন তাঁরা পণ্ডিত এবং পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেলেই তাঁরা খুশি, কাব্যের কাছে তাঁরা আর কবিত্ব আশা করেন না।
কালানুক্রমে মুখ্য শতককাব্যের ধারায় ওরই মধ্যে বিখ্যাত শেষতম রচয়িতা নীলকণ্ঠ দীক্ষিত, যাঁর সভারঞ্জনশতকটি সপ্তদশ শতকের রচনা, এতে ১০৫টি শ্লোক আছে; সব কটিই অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত। বিষয় অবশ্য বহুপ্রকার— কাব্য প্রশংসা, কবিকে দান করার প্ৰশংসা, শক্তি, দৈব, ধৈর্য, বিত্ত, সতী স্ত্রী ও সৎ রাজা। এ সব বিষয়ে নীলকণ্ঠ বিভিন্ন সময়ে যা কিছু রচনা করেছেন সব ক’টি সংকলন করে এ শতকটি নির্মিত। বিষয়গুলি মধ্যে মধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা, সেইটিই এর বৈচিত্র্য। শত সূর্য, শত চন্দ্ৰ উদিত হোক, মহিষীর বচন ব্যতিরেকে মনের তমিস্রা ঘোচে না।’ (৩ নং) ‘স্ত্রীর কাছে প্রেমিক স্বামী সুন্দর, গণিকার কাছে বিত্তবান সুন্দর।’ (৪৯ নং) শ্রুতি ও স্মৃতি ধনের নিন্দা করে কেন, যখন ধন ছাড়া তারা এক পা-ও এগোতে পারে না?’ (৫৯ নং) ‘দাম্পত্য প্রেম অক্ষুণ্ণ থাকলে কোনও কিছুরই সত্যিকার ক্ষতি হয় না।’ (৯৩ নং) এই শ্লোকগুলির বৈশিষ্ট্য দুটি; প্রথমত এরা কোনও অসামান্যতার দাবি করে না। সবচেয়ে সাধারণ ও বহুব্যবহৃত অনুষ্টুপ ছন্দে, অনাবশ্যক অলংকার, আড়ম্বর ও দুরূহতা বর্জন করে এরা সহজ ভাব স্বচ্ছন্দ সহজ ভাষায় ব্যক্ত করেছে। না আছে অপ্রচলিত প্রতিশব্দের ব্যবহার, না কৃত্রিম অলংকারের, না দীর্ঘ সমাসের ব্যবহার। ফলে এগুলি সুখপাঠ্য ও প্রসাদগুণে সহজবোধ্য। ভাবগুলি প্রায়ই অতি সাধারণ, যদিও মধ্যে মধ্যে যথার্থ ভুয়োদর্শিতার নিদর্শনও আছে। সহজ ভাষা আঙ্গিকে ব্যক্ত বলে এগুলি ভল্লট বা নাগরাজের রচনার মতো বিরক্তি উৎপাদন করে না।
আরও কয়েক শতাব্দী পূর্বে ভল্লটের সমকালেই আনন্দবর্ধন রচনা করেন তাঁর দেবীশতক, এতে একশোটি শ্লোকে দেবীর স্তুতি। এটি বিষয়ের দিকে স্তোত্রকাব্যেরই অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা, কিন্তু বিচ্ছিন্ন একশোটি শ্লোক থাকায় শতক বলেও বিবেচনা করা যায়। রচনার দিক থেকে দেবীশতক-এর কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। ভারতবর্ষে স্তোত্র সাহিত্য এত সমৃদ্ধ বলেই স্বভাবত অন্যান্য স্তোত্র শতকের (চণ্ডী বা চণ্ডীশতক-এর) সঙ্গে পাঠক মনে মনে তুলনা করেন ও লক্ষ্য করেন। দেবীশতক স্থানে স্থানে দুরূহ কিন্তু কাব্যের ভাবও জটিল নয় এবং দীপ্তিকাব্য বা দ্রুতিকাব্য হিসেবে কোনও গোত্রেই এর আবেগে বা মননে কোনও লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য নেই। স্রগ্ধরা ছন্দে শংকরাচার্যের রচনা বলে পরিচিত শতশ্লোক নামের একটি শতক, এতে মোট একশো একটি শ্লোক। শংকরাচার্যের নামের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটিই কারণ এর বৈদান্তিক বিষয়বস্তু। নিজগুণে এটিরও সহৃদয় পাঠকের চিত্তবৃত্তি বা বুদ্ধির কাছে কোনও দাবি নেই। আরও অনেক শতককাব্য গতানুগতিক বিষয়ে ও ভঙ্গিতে মধ্যে মধ্যেই রচিত হয়েছে। বিষয়ে, প্রেরণায় ও রসে তারা এমনই দীন ও অকিঞ্চিৎকর যে সাহিত্যের ইতিহাসে তারা উল্লেখের দাবি করতে পারে না। এগুলির মধ্যে পরবর্তী কালের রচনাই বেশি, যেমন পদ্মানন্দের বৈরাগ্যশতক, স্পষ্টই বোঝা যায় ভর্তৃহরিই এ-শতকের মূল, কিন্তু রচনা নিতান্তই দীন। তেমনই নরহরির শৃঙ্গারশতক। এরও মূল ভর্তৃহরির শৃঙ্গারশতক; জনার্দন ভট্টের শৃঙ্গারশতকও অমনই একটি অনুকৃতিবিশেষ। অজ্ঞাত কবির খশতক, বীরেশ্বরের অন্যোক্তিশতক রচনায় অত্যন্ত নিকৃষ্ট। শ্রীকৃষ্ণবল্লভের কাব্যভূষণশতক যমক ও অনুপ্রাসে উদাহরণ দেওয়ার জন্যই যেন রচিত। জৈনশতকও কয়েকটি আছে; জম্বুগুরুর জিনশতক একটি; ভূপালের জিনচতুর্বিংশতিকা-র একমাত্র সদ্গুণ হল এটিতে মোটে চব্বিশটি শ্লোক আছে। নাম ও পরিচয়েই বোঝা যায় ধীরে ধীরে এই নিতান্ত সাধারণ রচনাগোত্রটি কী ভাবে উত্তরোত্তর অবক্ষয়ের পথে নেমে যাচ্ছে।
ঠিক একশোটি না হলেও এমন কিছু সংকলন আছে যা এই জাতেরই, যেমন গোবর্ধনাচার্যের আর্যাসপ্তশতী, আর্যা ছন্দে সাতশোটি শ্লোকের সংকলন। এ শ্লোকগুলি শৃঙ্গাররসের। গোবর্ধনের উদ্দেশ্য ছিল শৃঙ্গাররসের নামে যে কুরুচিপূর্ণ রচনার প্রাদুর্ভাব ছিল তাঁর যুগে, তার থেকে সংস্কৃত সাহিত্যকে মুক্ত করা। অর্থাৎ এর রুচিগর্হিত দিকটিকে বর্জন করে শৃঙ্গাররসাশ্রিত কাব্য রচনা করা। গোবর্ধনাচার্যের কবিতা শক্তি রচনার মান এমন ছিল না যে, তিনি তাঁর কাব্য দিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেন; কিন্তু তৎকালীন কুরুচিকে তিনি নিজের কাব্যে স্থান দেননি এ কথা সত্য। তাঁর প্রভাবে কবি বিহারীলাল হিন্দিতে সৎসঈ (সপ্তশতী) রচনা করেন; এ কাব্যের ওপরে হয়তো প্রাকৃত ভাষায় রচিত সাতবাহন রাজা হালের গাহাসত্তসঈরও (গাথাসপ্তশতী) প্রভাব ছিল। বিহারীলালের প্রভাব পড়ে পরবর্তী কবি প্রেমানন্দের শৃঙ্গারসপ্তশতিকা-য় দেখা যাচ্ছে শৃঙ্গাররসকে আশ্রয় করে সাতশোটি শ্লোক রচনা জনপ্রিয় হয়েছিল, হয়তো হালের প্রাকৃত গাহাসত্তসঈ এর প্রবর্তক। কিন্তু হালের রচনার মতো কোনওটিই খ্যাতি পায়নি, কারণ উন্নতমানের কবিত্ব না থাকলে একই বিষয়বস্তুর একই রসের সাতশো’টি সার্থক শ্লোক রচনা করা সম্ভব নয়; সেই কারণে অন্য সপ্তশতীগুলিকে মানুষ বিস্মৃত হয়েছে। সপ্ত একটি পবিত্র সংখ্যা, সেই জন্য সপ্তশতীর এত প্রাদুর্ভাব।
একশো’র কম, অর্ধেক, শ্লোকে বিল্হণের রচিত চৌরসুরতপঞ্চাশিকা (স্বতন্ত্র প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)। এ-ও শৃঙ্গাররসের। এছাড়াও আছে সাম্বপঞ্চাশিকা (নামান্তরে, পরমাদিত্যস্তোত্র বা ব্রহ্মাদিত্যস্তোত্র)। এর রচয়িতা নাকি শ্রীকৃষ্ণ ও জাম্ববতীর পুত্র সাম্ব। সূর্যশতকের মতো সাম্বপঞ্চাশিকা-রও উপজীব্য সূর্যের মাহাত্ম্য। এর দ্বারা স্বল্পস্থায়ী এক সূর্য উপাসনার স্বতন্ত্র রীতি ও ধারা যে প্রবর্তিত হয়েছিল তা-ই প্রমাণিত হয়; সাম্বপুরাণ এই সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ। পঞ্চাশিকা যে শতকের ধারাতেই রচিত তা সহজেই বোঝা যায়; সম্ভবত চৌরসুরতপঞ্চাশিকা-য় বিল্হণ যে-খ্যাতি লাভ করেন তার দ্বারাই পরবর্তী পঞ্চাশিকা রচয়িতারা উদ্বুদ্ধ হন। সংখ্যার হিসেব খুব বড় কথা নয়, শতকের ‘শত’ শব্দ কোনও নির্দিষ্ট সংখ্যা ততটা সূচনা করে না যতটা করে সংখ্যা পূর্ণতাকে। মনে হয় যজুর্বেদ-এর শতরুদ্রিয়-ই এ দিকে পথিকৃৎ; সেখানেও সংখ্যা হিসেবে ‘শত’ নিরর্থক, পূর্ণ একটি স্তোত্রের পরিচয় বহন করে মাত্র। বৌদ্ধসাহিত্যেও দেখি একটি বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে পরস্পর অসংলগ্ন কয়েকটি গাথা গ্রথিত হয়ে স্তোত্রের আকার নিয়েছে, সুত্তনিপাত, থেরগাথা, থেরীগাথা ও ধম্মপদ-এ। রামায়ণ মহাভারত-এও এ রকম মূল আখ্যান থেকে কতকটা বিচ্ছিন্ন স্তোত্র অনেক আছে, পুরাণেও প্রচুর পরিমাণে আছে। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ উদাহরণ শ্রীমদ্ভগবদগীতার বিশ্বরূপদর্শন ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এ দেবীমাহাত্ম্য অংশে যা ‘চণ্ডী’ নামে প্রখ্যাত এবং যার প্রভাবে চণ্ডীশতক রচিত। ক্ৰমে ক্ৰমে অষ্টোত্তরশত নামে দেবতার আহ্বান ও স্তবের প্রচলন হয় এবং স্তোত্রসাহিত্যে বহু স্তব এই ধারাতেই রচিত।
শতককাব্য খণ্ডকাব্যের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম সার্থক খণ্ডকাব্য মেঘদূত-এর সঙ্গে এগুলির অনেক পার্থক্য; মেঘদূত-এ শ্লোকগুলির পারম্পর্য আছে যার প্রভাব বেশ কিছু দূতকাব্যে কিছুদিন পর্যন্ত পড়েছিল। কিন্তু শতককাব্যে বহু বিচ্ছিন্ন শ্লোক বিষয়গত শিথিল এক সংহতিকে অবলম্বন করে একত্র গ্রথিত। শতককাব্যের অধিকাংশেই শ্লোকগুলি নানা ছন্দে রচিত। বিষয় সাদৃশ্যও দৃঢ় নয়, রস বা ভাবের বন্ধনসূত্রটিও ক্ষীণ। ফলে শতক, সপ্তশতী ও পঞ্চাশিকা সবগুলিই কোনও কবির কবিজীবনে নানা বিষয়বস্তু অবলম্বনে রচিত বিচ্ছিন্ন শ্লোকের সংকলন। বোঝাই যায়, এ-জাতীয় সংকলনে সুভাষিতাবলী ধরনের গ্রন্থ রচিত হতে পারে, কিন্তু সংহত রচনার কাব্যপাঠে যে গাঢ়তা ও রস, ধ্বনি, ইত্যাদির ঐশ্বর্যে যে জাতীয় তৃপ্তি পাওয়া যায় শতককাব্যে বা তার অনুকারী কাব্যে তেমন কোনও অবকাশই নেই।
সপ্তম শতকে চিন ও ভারতবর্ষের মধ্যে বাণিজ্যসম্পর্ক খুব বেশি ছিল এবং বণিকের মুখেমুখে বা পণ্যদ্রব্যের সঙ্গে সঙ্গে কাব্যের সাহিত্যের আদানপ্রদান হওয়াও খুব স্বাভাবিক। ওই সময়ে চিনে তাবংশীয় রাজাদের কালে যে অপূর্ব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা রচনার ধারা প্রবর্তিত হয়, যার মধ্যে গভীর জীবনবোধ বিধৃত আছে তার প্রভাবও এসে থাকা সম্ভব। এ প্রভাব আসা সম্ভব হল কারণ মহাকাব্যের সুস্থ ধারাটির প্রেরণা তখন নিঃশেষিত; কবিদের এমন শক্তি নেই যা পূর্ণাঙ্গ সার্থক কাব্য রচনা করতে পারে; অথচ কিছু শক্তি আছে যাতে ছোট ছোট সার্থক শ্লোক রচনা করা যায়। বর্ধন রাজবংশের পতনের পরে আর্যাবর্তে রাষ্ট্রিক সংহতি কিছুকাল বিপর্যস্ত ছিল, আর রাজসভাই ছিল কবিদের আশ্রয়, পৃষ্ঠপোষক ও প্রেরণার অন্যতম উৎস। মহাকাব্যের মহাযুগ অবসিত তখন খণ্ডকাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হলেন অপেক্ষাকৃত হীন ক্ষমতার কিছু কবি। শতককাব্যে দায় সব চেয়ে কম; বিষয়গত বন্ধন এখানে শিথিল, ছন্দের সাম্যও আর অপেক্ষিত নয়। শতককাব্য যে ক্ষীণসূত্রে গ্রথিত তা-ও যখন শিথিল হয়ে এল তখন এল ‘সুভাষিতাবলী’ ধরনের সংকলন গ্রন্থ, যাতে বিভিন্ন কবির রচনা বিষয়সাদৃশ্য অনুসারে গ্রথিত।
ঋতুসংহার বা মেঘদূত-এর মধ্যে যে বিষয়সাম্য (ছন্দসাম্য ও) এবং পারম্পর্য আছে, সূর্যশতকও চণ্ডীশতকছাড়া অন্যান্য শতকে তা নেই। পরবর্তী শতককাব্যে প্রত্যেকটি শ্লোকই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা। কাব্যে কোনও অন্তর্নিহিত প্রেরণার সাম্য নেই, কোনও গতি নেই, রসের ঐক্য নেই, পারম্পর্য নেই, আদি, মধ্য ও অন্ত নেই, পরিণতি নেই। তাই যদিও ভর্তৃহরিতে এক একটি অনুচ্ছেদে বিষয়বস্তুর সাদৃশ্য আছে, যেমন শ্রীপ্রশংসা বা কামিনীগহণ— তবু সেই অনুচ্ছেদের মধ্যে প্রত্যেকটি শ্লোকই স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, পূর্ববর্তী বা পরবর্তী শ্লোকের সঙ্গে কোনও ভাবেই সম্পৃক্ত নয়; ফলে সমগ্র শতকটি কখনও একক কাব্য হয়ে ওঠে না। এই ধরনের খণ্ড খণ্ড ছবির মতো শ্লোক সপ্তম শতকেই প্রথম জনপ্রিয়তা অর্জন করে ও পরবর্তী তিন শতাব্দী ধরে জনপ্রিয় থাকে। এই তিন শতক ধরে এই কাব্যের ধারার কাছে পাঠকের প্রত্যাশা ছিল যে শিথিলবন্ধনে গ্রথিত একটি খণ্ডকাব্যের আকৃতি যেন তার থাকে, বন্ধনসূত্র শুধু বিষয়সাম্য। পরে এটুকু প্রত্যাশাও আর রইল না, তাই পরবর্তী শতক বা শতকধর্মী (অর্থাৎ সপ্তশতী বা পঞ্চাশিকা) কাব্যগুলি একই কবির বহু বিভিন্ন বিষয়ে ও বিভিন্ন যুগে রচিত শ্লোকের সংকলনে পর্যবসিত হল, যেমন ভল্লটশতকবা ভাবশতক। শতককাব্যের পূর্ণবিকাশের যুগেও একই বিষয়ে বিভিন্ন মনোভাবের প্রকাশ অনুমোদিত ছিল শুধু রচনাটি একই কবির হওয়া চাই; কিন্তু নবম শতকের পরে বিষয়ে বৈচিত্র এসে সংহতিকে আরও শিথিল করে দিল।
আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও এই বিকেন্দ্রিকতা লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী শতকগুলিতে কালিদাস, বাণ বা ময়ূরের মতো ভঙ্গি, রীতি ও ছন্দের ঐক্য নেই। প্রায় সব মহাকাব্যের একটি সর্গ জুড়ে একই ছন্দ থাকত, ব্যতিক্রম দেখা গেল অষ্টম-নবম শতকের পর থেকে। এই ছন্দসাম্যের নির্দেশ যেন কালিদাস, বাণ, ময়ূর তাঁদের খণ্ডকাব্যে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী শতককাব্যের রচয়িতারা দুই একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে, এ নির্দেশ অস্বীকার করলেন; তাঁরা প্রত্যেক শ্লোকের বিবক্ষিত অনুসারে সে-শ্লোকের উপযুক্ত ছন্দ নির্বাচন করলেন। ফলে, বিবক্ষিতে যত বৈচিত্র্য আঙ্গিকে তা-ই প্রতিফলিত হল। সপ্তদশ শতকে সভারঞ্জনশতক যে আগাগোড়া অনুষ্টুপে রচিত তাই স্পষ্টতই মহাকাব্য বা প্রথম যুগের খণ্ডকাব্যগুলির অনুকরণে।
শতককাব্যের ইতিহাসে একটা সূচনা, বিকাশ ও অবক্ষয়ের ইতিহাস দেখা যায়। প্রথম দুটি, সূর্যশতকও চণ্ডীশতক-এ বিষয় ও আঙ্গিকে অনেক বেশি সংহতি দেখা যায়, কারণ, মহাকাব্যের সুস্থ যুগের প্রভাব তখন সকল রচনার ওপরেই বিদ্যমান। ভর্তৃহরির নীতিশতক স্পষ্টতই মহাভারত-এর শান্তিপর্বের এবং অন্যত্রও যে সকল নীতিকথার অংশগুলি আছে তার দ্বারাই প্রভাবিত; সুভাষিত বা তত্ত্বাশ্রয়ী কাব্যের উদ্ভব বৌদ্ধ সাহিত্যে এবং মহাকাব্য দুটিতে নিহিত; অথবা বলা চলে, মুখে মুখে প্রচলিত গাথা-ও-সুভাষিতের একটি লোকায়ত ধারা ছিল যার থেকে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য উভয়েই বস্তু আহরণ করেছে। ভর্তৃহরির নীতিশতক ও বৈরাগ্যশতক এই ভ্রাম্যমাণ তত্ত্ব-সাহিত্যের কাছে বিশেষ ঋণী, যদিও বৈরাগ্যশতক-এর উপরে বেদান্ত ও সন্ন্যাস-সাহিত্যের প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়। অপর কোটিতে আছে ক্লাসিকাল সাহিত্য, যার মধ্যে শৃঙ্গাররসের প্রাবল্য। এদের উপরে কামশাস্ত্র, নাট্যশাস্ত্র ও অলংকারশাস্ত্র-এর (বিশেষত, উজ্জ্বলনীলমণি জাতীয় শাস্ত্রের) প্রভাব খুবই স্পষ্ট; শৃঙ্গারশতকও ভাবশতক এগুলির দ্বারা প্রভাবিত।
মহাকাব্যের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখি কালিদাসের পরে আড়াইশো বছরের মধ্যেই প্রধান মহাকাব্যগুলির অধিকাংশই রচিত হয়েছিল। কালিদাস খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকের; তার অর্ধশতাব্দীর কিছু পরে, ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি ভারবি তাঁর কিরাতার্জুনীয় রচনা করেন। দক্ষিণে সিংহলে ওই সময়েই কুমারদাস তাঁর জানকীহরণ রচনা করেন, (৫১৭-২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে)। ভর্তৃমেণ্ঠের নির্দিষ্ট যুগ ঠিক জানা যায় না, তবে মনে হয় এরই কিছু আগে বা পরে তিনি হয়গ্রীববধ রচনা করেন। ভট্টির যুগ ৬৪১ খ্রিস্টাব্দের পরে নয়, কাজেই এদের কিছু পরে তিনি তাঁর রাবণবধ রচনা করেন। রাজা বর্মলাতের রাজত্বকালে মাঘের বিকাশকাল; শেষ বর্মলাত ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি, কাজেই সপ্তম শতকের প্রথমার্ধেই মাঘ তাঁর শিশুপালবধ রচনা করেন। এই সব কবির মধ্যে যোগসূত্র একটিই; এঁরা সকলেই মহাকাব্যের মুখ্যধারার অন্তর্গত, অর্থাৎ প্রত্যেকেই নিজের নিজের শক্তি অনুসারে কালিদাসের বা তাঁর পরবর্তী ও নিজের পূর্ববর্তী কোনও মহাকবির অনুকরণ করেছে। এঁদের সিদ্ধি ও ব্যর্থতা নির্ভর করেছে তাঁদের প্রেরণা ও কলাকুশলতার উপরে, কিন্তু সকলেরই লক্ষ্য এক ছিল: রাজসভার কাব্যের যে মুখ্য ধারাটি তৎকালীন বিদ্বৎসমাজে প্রচলিত ছিল সেই ধারাতে রচনা করা।
এই শ’ দেড়েক বছরের অনুকরণের শেষ পর্যায়ে এটা প্রতিপন্ন হল যে মহাকাব্য রচনার জীবনীশক্তি কবিসম্প্রদায়ের মধ্যে নিঃশেষিত। সিদ্ধি নিতান্তই সীমিত হয়ে পড়ল, ফলে অনুকরণ স্পষ্টতর ভাবে প্রকট হয়ে উঠল। কবিরা উত্তরোত্তর অলংকার, দুরূহ প্রতিশব্দ ও আঙ্গিকবাহুল্য ও বাহ্য জটিলতার আশ্রয় নিতে লাগলেন, বিবিক্ষিতকে ভঙ্গীভণিতার দ্বারা আচ্ছন্ন করাই রীতি হয়ে উঠল। যে কোনও আঙ্গিকের কাব্য একবার প্রবর্তিত হলে তার থেকে সম্ভাব্য রসের শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত নিংড়ে নিয়ে তবে তাকে বর্জন করা হয়; অর্থাৎ ভঙ্গির বিকল্প উপস্থাপিত করে যথাসাধ্য তাকে সরল করে পরিবেশনার দুশ্চেষ্টা চলতে থাকে যতক্ষণ না কবি ও শ্রোতার কাছে তার নিঃশেষিত জীবনীশক্তি পীড়াদায়ক ভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ভাবে নানা আঙ্গিকের মকরধ্বজ ও মৃতসঞ্জীবনী সেবন করিয়ে দ্বাদশ শতকে শ্রীহর্ষের নৈষধচরিত পর্যন্ত চলল। কবির অভাবে কবিযশঃপ্রার্থীরা চেষ্টা করে গেছেন তার পরেও, কিন্তু সে চেষ্টা নিরতিশয় ব্যর্থ বলে আর তেমন স্বীকৃতি পায়নি বিদ্বৎসমাজে। কিন্তু মাঘের সময়েই মহাকাব্যের প্রাণরস বিশুষ্কপ্রায় এবং সহৃদয় পাঠক কাব্যরসের প্রত্যাশায় আর মহাকাব্যের দিকে তাকাননি। তখন কিছু কবিত্বশক্তি যাঁদের ছিল তাঁরা আঙ্গিক ও কাব্যধারার নূতন উদ্ভাবনে প্রবৃত্ত হলেন।
এই যুগসন্ধিক্ষণে বাণভট্ট দেখা দিলেন কাব্যদিগন্তে। বাণের পূর্বেও গদ্যসাহিত্য রচিত হত কিন্তু বাণের হাতে গদ্য এমন এক পূর্ণাঙ্গ বিকাশ লাভ করল যে সে ধারায় নতুন কিছু উদ্ভাবন করা আর যেন সম্ভব রইল না। বাণের পরবর্তীরা যেন গদ্যে আর নতুন কিছু পরিবেশন করার অবকাশই পেলেন না— বাণের হাতে গদ্য এত পরিপূর্ণ ও রসোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছিল বলে। বাণের গদ্যে যতই কৃত্রিমতা, দীর্ঘসমাস, দীর্ঘবন্ধ, দুরূহ প্রতিশব্দ ও অলংকারবাহুল্য থাক না কেন, তিনি যে এক নতুন ভঙ্গির পথিকৃৎ এবং তীর্থংকর তাতে কোনও সংশয় ছিল না। ফলে শক্তিমান কবিরা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন অন্য ভঙ্গি, ধারা ও আঙ্গিক উদ্ভাবনের জন্যে। এই সময় অলংকারশাস্ত্র-এর বিকাশেরও যুগ। আলংকারিকরা ক্রমশই গুরুভার অলংকৃত শৈলীর পক্ষপাতি হতে থাকেন। দণ্ডী, বামন, ভামহ, রুদ্রট— এঁরা পরপর আবির্ভূত হন এবং অলংকারের অসংখ্য বৈচিত্র্য ও প্রকারভেদ স্বীকৃত হতে থাকে। মহৎ কাব্যসৃষ্টির যুগ— হয়তো সম্ভাবনাও— যেন ক্রমে অন্তর্হিত হয়ে গেল। কাব্য অন্তরঙ্গ থেকে বহিরঙ্গে নিষ্ঠা দেখাল। অভিজ্ঞতা, জীবনবোধের চেয়ে সমাস ও অলংকৃত বাগভঙ্গি প্রাধান্য পেল। মুখ্য মহাকাব্য দুটির পরের কাব্যেও স্থানে স্থানে বৈশিষ্ট্য ও কাব্যগুণ দেখা দিয়েছিল; রোমান্টিক গদ্যও স্বল্পকালের জন্য পাঠককে চকিত করে অন্তর্হিত হল।
সপ্তম থেকে নবম শতকের মধ্যে শতককাব্যের উদ্ভব ও বিকাশ। প্রধান শতক কাব্যগুলির যুগ শেষ হলে কিছুকাল যেন নতুন কোনও ধারার সম্ভাবনা পর্যন্ত দেখা যায়নি; এই সময়ে চম্পু’র বিকাশ। চম্পুর তবু স্বীকৃতি ছিল অলংকারশাস্ত্রে; দণ্ডী বলছেন ‘গদ্যপদ্যময়ং কাব্যং চম্পূরিত্যভিধীয়তে— গদ্য ও পদ্যের সংমিশ্রণে যে বাক্য তাই চম্পু।’ দশম শতকে ত্রিবিক্রমভট্ট রচনা করেন নলচম্পু (৯১৫ খ্রিস্টাব্দ); সোমদেব রচনা করেন যশস্তিলকচম্পু (৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ)। এর পরেও কিছুকাল চম্পূ রচনা চলতে থাকে, কিন্তু সে সব রচনা সাধারণ, বৈশিষ্ট্যবর্জিত। চম্পু কিন্তু কোনও দিনই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, এর পরমায়ুও স্বল্পকালের; কিছুকাল পরেই চম্পূরচনা পরিত্যক্ত হয়। হয়তো এর গদ্যপদ্য সংমিশ্রণের মধ্যে অন্তর্নিহিত কোনও সাহিত্যিক যুক্তি ছিল না, ছিল শুধু প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যের অনুকরণ। কারণ যাই হোক, চম্পুর নিজস্ব কোনও জীবনীশক্তি ছিল না, কোনও শক্তিমান কবিই এ ভঙ্গিতে রচনায় প্রবৃত্ত হননি।
সপ্তম থেকে দশম শতকের মধ্যে নতুন গোত্রের (genre) রচনার উদ্ভাবনে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চলে; শতক, সপ্তশতী, পঞ্চাশিকা, চম্পূ এই সব তার ফসল। এগুলির সুস্থ সাহিত্য সৃষ্টির জীবনকাল হ্রস্ব; কিন্তু তার পরে বহুদিন ধরে চলে অনুকরণের যুগ— প্রেরণাহীন গতানুগতিক সৃষ্টি শুধু ভারাক্রান্ত করেছে সাহিত্যের ইতিহাসকে, সৎসাহিত্য দিতে পারেনি। কারণের সন্ধান করলে দেখি দশম-একাদশ শতকে, যখন থেকে নিষ্প্রাণ অনুকরণ চলতে থাকে— তখন থেকে কথ্যভাষায় সাহিত্যরচনার সূত্রপাত অপভ্রংশ ও কথ্যভাষার সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। কাজেই সংস্কৃত সাতিহ্য ধীরে ধীরে মজা নদীর খাতের মতো নীরস ও প্রাণহীন হয়ে গেল।
চম্পুর তুলনায় শতকের জীবনীশক্তি ও পরমায়ু দুই-ই বেশি ছিল। যে শতক ক’টি পাওয়া যায় সেগুলি পরস্পর থেকে ভিন্ন, কিন্তু কিছু কিছু সাধারণ চরিত্র সব ক’টিতেই আছে। মহাকাব্যের বিষয়বস্তু সম্ভবত নানা কারণে ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছিল, তাই খণ্ডকাব্যেই মনোনিয়োগ করলেন কবিরা। এগুলি মাঝে মাঝেই গীতধর্মী (লিরিক) ও রোমান্টিক। এ জাতীয় কবিতায় কবির ব্যক্তিগত আবেগ সহজে প্রকাশ পেতে পারে, যে-অবকাশ মহাকাব্যে ছিল না। শতক গোষ্ঠীর কাব্যই হোক বা সাধারণ স্তোত্র সাহিত্যই হোক, কবিরা প্রায়ই যেন উত্তমপুরুষে কথা বলেছেন, অন্তত বাণ ও ময়ূরের পর থেকেই। পুরাণের কাল থেকেই সাহিত্য ও সমাজে সাম্প্রদায়িক ও পারিবারিক দেবতার পূজা ও ব্যক্তিগত অর্থাৎ ইষ্টদেবতার বোধ ও পূজা দেখা দিয়েছিল; ফলে স্তোত্রসাহিত্যেও ব্যক্তিগত সুরটি লাগে— পুরাণ রচনার মধ্যযুগ থেকে অর্থাৎ অষ্টম শতক থেকেই। মাতৃকা, দেবী, সূর্য, ইত্যাদির উপাসনার প্রবর্তন হয়, পূজার ব্যাপক প্রচলন হয় ষষ্ঠ সপ্তম শতাব্দী থেকে: দেবতা ও ভক্তের সম্বন্ধের মধ্যে ভক্তি, ব্যক্তিগত আনুগত্য, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য মধুর ইত্যাদি ভাবের স্পর্শ লাগে। ফলে যজ্ঞ ও গোষ্ঠীগত উপাসনার স্থানে পূজা ও ব্যক্তিগত নিষ্ঠা প্রাধান্য পাওয়াতে বৈদিক সূক্তের অপেক্ষাকৃত নৈর্ব্যক্তিকতার স্থানে ব্যক্তিগত সংরাগ দেখা যায় স্তোত্রসাহিত্যে। বাণ ও ময়ূর মাতৃকা ও সূর্যপূজার এই নবপর্যায়ের প্রথম উদ্গাতা। এঁরা দুজনেই যে সমৃদ্ধিশালী বর্ধনসাম্রাজ্যে আবির্ভূত হন তা আকস্মিক নয়; এঁদের যুগই এঁদের প্রবর্তনা দেয় শতককাব্য রচনায়। ধীরে ধীরে বৃহৎ সাম্রাজ্যের ভগ্নদশায় নানা বিপর্যয় ও সামাজিক বিক্ষেপ এবং বিক্ষোভ দেখা দিল; বর্ধনপরবর্তী সাহিত্য তার চিহ্ন বহন করে, আর শতককাব্যও সে চিহ্ন বহন করে। অষ্টম শতকে অমরুতেই মনে হয় শতককাব্যের শ্রেষ্ঠ বিকাশ, তার পরেই শুরু হয়ে যায় ঊষর অনুকরণের যুগ। ছোট ছোট স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্লোকে এই মনোভাবের প্রকাশ, এ যেন সমাজের ব্যাপক সংহতির অভাবকেই প্রতিফলিত করে। বিষয়গাম্ভীর্য নেই, কাহিনির আন্তঃসংহতি নেই, অঙ্গীরসের সঙ্গে অঙ্গরসের পরিপূর্ণ-সম্পর্ক নেই, কাব্যব্যাপী একটি জীবনবোধ নেই, আছে শুধু বিচ্ছিন্ন একটি একটি উপলব্ধির চিত্রণ। পটও অপরিসর, সিদ্ধিও তেমনই। এই সময়ের মন্দির ভাস্কর্যের মতো মহৎ কোনও পরিকল্পনার স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বল্প-পরিসর চিত্র নিজ অপ্রশস্ত পরিসরে হয়তো সার্থক, কিন্তু সে এমন পরিসর যাতে মহৎ শিল্পের অবকাশ নেই।