শওকত সাহেব সারাদিন কোথায় কোথায় যেন ঘুরে বেড়ান। বাসার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই হয়। নাশতা খেয়েই বেরিয়ে পড়েন, ফেরেন সন্ধ্যা মেলাবার পর। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় ক্যাম্পখাটে শুয়ে থাকেন। বকুল ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে–চা দেব?
তিনি হ্যাঁ-না কিছুই বলেন না। তবে চা এনে দিলে নিঃশব্দে খান। আগের মত চিনি কম হয়েছে, লিকার পাতলা হয়েছে বলে চেঁচামেটি করেন না। বকুল যদি বলে চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে? মুড়ি মেখে দেব? তিনি মৃদু স্বরে বলেন না লাগবে না।
রাত বাড়তে থাকে। তিনি বারান্দার বাতি জ্বালান না। অস্পষ্ট আলোতে পত্রিকার একটা পাতা চোখের সামনে ধরে রাখেন। বকুলের বড় মন খারাপ লাগে। খুব ইচ্ছা করে বাবার পাশে এসে বসতে, কিন্তু সাহসে কুলোয় না।
আজও তিনি অন্য দিনের মত ক্যাম্পাখাটে বসে আছেন। খালি গা। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। এবার শীত পড়ে গেছে আগেভাগে। শীতে একেকবার তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন, বকুল একটা পাঞ্জাবি তাকে এনে দিল। তিনি যন্ত্রের মত পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন। বকুল ভয়ে ভয়ে বলল বাবা তোমার কী শরীর খারাপ? তিনি কিছুক্ষণ থেমে বললেন শরীর ঠিক আছে রে মা; বকুলের চোখ ভিজে গৈল। গলা ব্যথা ব্যথা করতে লাগল। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে সে হয়ত কেঁদেই ফেলবে। সে মাথা নিচু করে তার মার ঘরে ঢুকে পড়ল।
লতিফা বললেন তোর বাবা কী করছে?
বসে আছেন।
মুন? মুনা এখনো আসেনি?
এসেছে। শুয়ে আছে। মাথা ধরেছে।
ওকে একটু ডেকে আন।
বললাম না মাথা ধরেছে। এখন ডাকলে যোগ করবে।
লতিফা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর অসুখ খুবই বেড়েছে। নতুন একটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে। শ্বাস কষ্ট। এত বাতাস চারদিকে অথচ প্রাযই নিঃশ্বাস নেবার মত বাতাসের টান পড়ছে তার। সারারাত এ ঘরের সব ক’টি জানালা খোলা থাকে, ফ্যান চলে ফুল স্পিডে। তবু তিনি বাতাস পান না।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে শ্বাস কষ্ট শুরু হলেই শওকত সাহেব তাঁর পাশে এসে বসেন। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, তবু তিনি একটা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করেন। লতিফার লজ্জা লাগে। আবার ভালও লাগে।
শওকত সাহেব অনেক’দিন পর এ ঘরে ঘুমুতে এলেন; মিনামিন করে একটা অজুহাত ও দিলেন বিছানায় পিঁপড়া উঠেছে। লাজুক ভঙ্গি। বিয়ের প্রথম ক’দিন এ রকম হয়েছিল। দীর্ঘদিন পর যেন বিয়ের প্রথম দিকের রাত ফিরে এল। পৃথিবীতে কিছুই বোধ হয় শেষ হয় না। পুরনো ঘটনা আবার ঘুরেফিরে আসে। অর্থহীন কথাবার্তাও তাদের মধ্যে হল। লতিফা বললেন, বকুলের বিয়ে সত্যি সত্যি হলে মন্দ হয় না, কী বল? তিনি বললেন, ভালই হয়।
এ রকম ছেলে পাওয়া ভাগ্যের কথা ঠিক না?
হুঁ।
তবে বড় বেশি বড়লোক। এত বড়লোকের সঙ্গে সম্পর্ক করতে ভয় ভয় লাগে।
ভয়ের কী?
শওকত সাহেব অন্ধকারে একটা সিগারেট ধরান; বড় মায়া লগে লতিফার। ইচ্ছা করে একটা হাত গায়ের ওপর উঠিয়ে দিতে কিন্তু লজ্জার জন্যে পারেন না।
যৌবনের কথা অস্পষ্ট ভাবে তার মনে পড়ে; কত রহস্যময় বাত গিয়েছে। গল্প করতে করতেই কতবার ভোর হল। পাখ-পাখালি ডাকতে লাগল। কতবার আফসোস করেছেন রাতগুলি এত ছোট কেন?
মানুষের সব কিছুই ছোট ছোট। জীবন ছোট। ভালবাসাবাসির দিন ছোট শুধু দুঃখের কাল দীর্ঘ। ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তে ফুঁপিয়ে ওঠেন। শওকত সাহেব ব্যস্ত হয়ে বলেন কী হয়েছে?
কিছু হয়নি।
শ্বাসের কষ্ট?
হুঁ।
পানি খাবে? পানি এনে দেই?
না, কিছু আনতে হবে না। তুমি ঘুমোও।
লতিফা তার রোগজীৰ্ণ শ্ৰীহীন হাত বাড়িয়ে দেন। গত রাতটা তারা দু’জন জেগেই কাটিয়েছেন। আজও কী সে রকম হবে?
বকুল কেমন রাগী রাগী মুখ করে বসে আছে বিছানার পাশে। এমন বিরক্ত তার মুখের ভাব যে কিছু বলতেই ভরসা হয় না। তবু লতিফা ক্ষীণ স্বরে বললেন তোর বাবা কী করছে?
একবার তো বলেছি মা; কিছু করছেন। ক্যাম্পখাটে বসে আছে।
ডেকে নিয়ে আয় না।
কী জন্যে?
এমনি। তোকে ডাকতে বলছি ডাক।
বকুল চলে যায়। লতিফা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন। কেউ আসে না। এই ঘরে। বকুল নিশ্চয়ই বলেনি কিছু। বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েদেব যোগাযোগ খুব কম! সবাই কেন তাকে এত ভয় পায়? ভয় পাওয়ার মত কী আছে এই মানুষটার?
রাত নটার দিকে ঝমঝম কবে বৃষ্টি পড়তে লাগল। মুনা ঘুম ঘুম চোখে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দুটো প্যারাসিটামল খেয়েও তার মাথাধরা সারেনি। কেমন যেন বমি বমি ভাব হচ্ছে এখন। হাত ধড়িয়ে সে বৃষ্টির ফোঁটা ধরতে চেষ্টা করল। তার কিছুই ভাল লাগছে না। তবু সে ফুর্তির আগলা একটা ভাব এনে উঁচু গলায় বলল। এই বাবু, বৃষ্টিতে ভিজবি? বাবু কিছুই বলল না। বকুল ও রাজি হল না।
এক একই উঠোনে নামল মুনা। বৃষ্টিা ফোঁটাগুলি অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা! গা কোপে কেঁপে উঠছে। তবুও ভালই লাগছে। বাবু বাবান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে। মুন! আবার ডাকল এই বাবু আয় না। বারু কোনো জবাব দিল না। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়তে লাগল।