১০.
শেফালি জিজ্ঞেস করলেন,— কী রে, এবার তা হলে তোদের লুচিটা ভাজি?
মাধবীলতা চোখ পাকাল,— ছটফট করছ কেন? চুপটি করে বোসো। এখন মোটেই তোমাকে গ্যাসের সামনে যেতে হবে না।
হ্যাঁ, খিদে পেলে আমরা বলব। দোলা তালে তাল দিল,— ঝুমা আজ বাড়িতে, ঝুমা ভেজে দেবে।
কেন? ঝুমা কেন? শেফালি রীতিমতো অপ্রসন্ন,— আমি কি অথর্ব হয়ে গেছি? ময়দা তো মাখাই আছে, ক’টা লুচি বেলে ভাজতে পারব না?
মাধবীলতা হাত উলটে দিল। দোলাও হাসছে। মাকে নিয়ে এই হয়েছে ফ্যাসাদ, কাজ করতে না দিলেই খেপে যাবে। বিশেষ করে রান্নাবান্নাটা। পঁচাত্তর বছর বয়স হল, চোখে ভাল দেখছে না ইদানীং, শরীর স্বাস্থ্যও সুবিধের নয়, কিন্তু হাতাখুন্তি ছাড়তে ঘোর আপত্তি। জোর করে ঝুমা সম্প্রতি এক রাঁধুনি রেখেছে, পুত্রবধূর ওপর তাই রেগে টং। ফোনে সে-দিনও গজগজ করছিল, সংসারে তো আমার সবই গেছে, ওই একটা জায়গা ছিল, ঝুমা তাও কেড়ে নিল! কে বোঝাবে, বন্দোবস্তটা মা’র ভালর জন্যই!
ক’দিন ধরেই ডাকাডাকি করছিল ভাইয়া। মা নাকি রাতে একেবারেই ঘুমোচ্ছে না, সারাদিন ঝিমোচ্ছে, টলে যাচ্ছে হাঁটতে গিয়ে…। দুপুরে দোলা যখন দিদির সঙ্গে এল, তখনও মা বিছানায়। কিন্তু মেয়েদের দর্শন পেয়েই হঠাৎ তিনি চনমনে। গুটগুট হেঁটে বেড়াচ্ছেন, বকবক চলছে অবিরাম।
শয্যাশায়ী নয়, মাকে এই অবস্থায় দেখতেই ভাল লাগে দোলার। আবার একটু একটু খারাপও লাগে যেন। সংসারে এক সময়ের দাপুটে অধিকর্ত্রীর কী হাল! মাত্র আট ফুট বাই পাঁচ ফুট একটা ঘরের দখলদারির জন্যই কী আকুলতা এখন! অবশ্য দোলার নিজের দশাই বা কী এমন আলাদা? শেফালির তো তাও বয়স হয়েছে, শরীর ভেঙেছে, দোলা তো শক্তসমর্থ অবস্থাতেই…! দিনভর শুধু কী রান্না হবে, আর কে কী খাবে! তার পরেও ছেলে মেয়ে বর, কেউ কি তাকে পোঁছে?
মেয়েদের বারণকে তোয়াক্কা না করে শেফালি চলে গেছেন স্বস্থানে। ছ্যাঁকছোঁক শব্দ আসছে লুচি ভাজার। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে লাভ নেই, শেফালি হাউমাউ চেল্লাবেন, অতএব দুই বোন এখন ঠুঁটো জগন্নাথ। বাবলিকে পাড়ার নাচের স্কুলে দিতে গিয়েছিল ঝুমা, ফিরে ঘরে কী যেন করছিল, বেরিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে ফিক করে হাসল,— কী গো, তোমরা আটকাতে পারলে?
মাধবীলতা হেসে বলল,— থাক না, করুক না… শুধু একটু নজর রাখিস।
সে নয় যতক্ষণ বাড়ি আছি, চোখে চোখে রাখলাম। কিন্তু যখন নেই?
হুম্। দোলা মাথা নাড়ল,— একটা রাতদিনের লোক রাখলে বোধহয়…
কোনও লাভ হবে না ছোড়দি। চেঁচামিচি করে মা দু’দিনে তাকে ভাগাবেন।
গভীর সমস্যা। তা ঘুমটুমের ব্যাপারে ডাক্তার কী বলল?
ওষুধের ডোজ বাড়িয়েছে। কিন্তু তোমাদের ভাই তো দিতে সাহস পাচ্ছে না। এমনিতেই টলছেন, কখন কোথায় পড়ে গিয়ে বিচ্ছিরি কিছু ঘটে যাবে…। বলতে বলতে ঝুমা চলে গেছে রান্নাঘরে, সেখান থেকেই গলা ওঠাল,— জানো তো, গাঙ্গুলিবাড়ির শরৎবাবু চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে এখন নার্সিংহোমে। ফিমার বোন নাকি দু’টুকরো।
ওমা, সে কী? শরৎজেঠুর পা ভেঙেছে কবে?
পরশু সন্ধেবেলা। কী আতান্তর বলো তো? বাকি জীবনটা হয়তো বিছানাতেই থাকতে হবে।
বটেই তো। বুড়ো বয়সে ওই হাড় আর জোড়া লেগেছে!
নিজেরও কষ্ট। বাড়ির লোকেরও ভোগান্তি। যত দিন বাঁচবেন, পার্মানেন্ট গৃহবন্দি।
শেফালিকে সফলভাবে রান্নাঘর থেকে হঠিয়ে দিয়েছে ঝুমা। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন শেফালি। রাগ রাগ গলায় বললেন,— অত আহা-উহুর কী আছে? এ হল গিয়ে কর্মফল। ওই লোক সুধাদিকে সারা জীবন দগ্ধে মেরেছে! নিজে উনি ট্যাঙোস ট্যাঙোস চরকি মারছেন, ওদিকে সুধাদির ঘরের বাইরে বেরোনো মানা! পরপুরুষের নজর লাগলে বউয়ের নাকি চরিত্তির যাবে! এবার নিজে শুয়ে থেকে দ্যাখো চার দেওয়ালে আটকে থাকা কেমন লাগে!
এটা অবশ্যি ঠিক বলেছে মা। মাধবীলতা সায় দিল,— শরৎজেঠু সুধাজেঠিমার সঙ্গে যে আচরণটা করেছেন, সে তো অত্যাচার। বউ সুন্দরী বলে একসময়ে তো তাকে ঘরে তালাবন্ধ করে অফিস যেতেন।
পাষণ্ড। শেফালি মোড়া টেনে বসলেন,— বাড়িতে অত বাহারি গোলবারান্দা, জম্মে কখনও সেখানে বউকে দাঁড়াতে দিল না গো। আটকে থেকে থেকে এমন অভ্যেস হয়েছে, সুধাদি এখনও বারান্দায় দাঁড়াতে পারে না। অসোয়াস্তি হয়।
বারান্দা তো একটা দোলাও পেয়েছিল। সুধাজেঠিমার থেকে এক প্রজন্ম পরে জন্মেও। সে কি পারল দাঁড়াতে? অংশুদা যতই ডাকুক, সৃষ্টিতে যেতে আর কি তার পা উঠবে?
লুচির প্লেট হাতে ঝুমা এসেছে। টেবিলে রাখতে যাচ্ছিল, মাধবীলতা হা হা করে উঠল,— করছিস কী? দাঁড়া, আগে ছবিগুলো সরাই।
বাবানের পাঠানো একগাদা ফটো এনেছিল মাধবীলতা। এসেই ছড়িয়ে দিয়েছিল টেবিলে। বাবানের বাড়ির অন্দরের ছবি, বাইরের ছবি, বাবান আর অলির একসঙ্গে ছবি, আলাদা আলাদা ছবি…। গোছা করে তুলছে এখন। খামে ভরতে ভরতে দোলাকে বলল,— ও হ্যাঁ, দরকারি কথাটা বলতে ভুলে যাচ্ছি। তিয়ার কোনও রিসেন্ট ছবি আছে? একটু সেজেগুজে তোলা?
দোলা লুচি ছিঁড়তে গিয়ে থমকাল,— দেখতে হবে। কেন বলো তো?
অলি একটা ভাল সম্বন্ধর কথা বলছিল। যদি লেগে যায়, আমাদের তিয়াও চলে যাবে মেলবোর্নে।
শেফালি আগ্রহভরে বলে উঠলেন—, তিয়ার জন্য পাত্র? মেলবোর্নের? বাঙালি তো?
হ্যাঁ গো। খড়্গপুর আই-আই-টির ইঞ্জিনিয়ার। বাবানদেরই বন্ধু।
লাগিয়ে দে, লাগিয়ে দে। শেফালি উল্লাসে ফুটছেন,— মেয়েটা বড্ড উড়ছে। আমার কাছে আসারও সময় পায় না। দে বেটির ডানা ছেঁটে।
ছাড়ো তো দিদির কথা। দোলা পলকাভাবে বলল,— অত ভাল ছেলে তিয়াকে থোড়াই পছন্দ করবে!
কেন করবে না শুনি? তিয়া আমাদের কীসে কম? দেখতে সুন্দর, লেখাপড়া জানে, ফটাফট ইংরিজি বলতে পারে…
ঠিকই তো। মাধবীলতা মাথা দোলাল,— ওখানকার ছেলেদের জন্য তিয়া পারফেক্ট ম্যাচ। ফ্যামিলিটাও ভাল। বাবা মা দু’জনেই প্রফেসার, বেহালায় নিজেদের বাড়ি। কাস্টও খাপে খাপে মেলে। বসু। সৌকালীন গোত্র।
ওফ দিদি, এ যুগেও তুই জাতগোত্রে পড়ে আছিস?
তুত্ আমি ওসব মানি নাকি? তবু সম্বন্ধ করার সময়ে একটু দেখতে হয়। সবাই দ্যাখে।
বটেই তো। শেফালি বললেন,— ছেলের বাপ মায়ের সঙ্গেও যোগাযোগ কর। দেরি করিস না, ভাল পাত্র বেশি দিন ফাঁকা থাকে না।
দোলা তবু উৎসাহ পাচ্ছিল না। মেয়ের ধাত তো সে জানে। একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল,— থাক রে দিদি। জানিসই তো, সম্বন্ধ করা বিয়েতে তিয়া রাজি হবে না।
ছাড় তো। ছেলের বায়োডাটা শুনলে আপ্সে গলে যাবে।
তবু…
তুই ছেলেমেয়ের ভয়ে এত কাঁপিস কেন বল তো? তুই না মা?
ঝুমা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎই নাক গলিয়েছে,— আমি একটা কথা বলব বড়দি? তিয়া নিজে কাউকে পছন্দ করেছে কিনা সেটা আগে জেনে নিলে হয় না?
মাধবীলতা দোলার দিকে ফিরল,— কী রে, তেমন আছে নাকি কেউ?
দোলা আমতা আমতা করল,— না মানে… আমার সঙ্গে তো ঠিক কথা হয় না… সারাক্ষণ এমন ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে থাকে…
আমি কিন্তু তিয়াকে একটা ছেলের সঙ্গে দেখেছি। ঝুমা ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে চোখ ঘোরাল,— দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম। মোটরসাইকেল আছে ছেলেটার।
সে বোধহয় ওর কোনও এমনি বন্ধুটন্ধু…
তা আমি জানি না। তবে যেভাবে দু’জনে হাত ধরাধরি করে রাস্তা পার হয়ে বাইকে উঠল…
অ। মাধবীলতা যেন হতাশ,— তবে আগে জান ব্যাপারটা। আমাকে আর তা হলে কষ্ট করে এগোতে হয় না।
ঝুমার দেওয়া খবরটা বিশ্বাস করতে পারছিল না দোলা। আবার পুরোপুরি ঝেড়েও ফেলতে পারছে না। প্রেমে পড়লে মেয়েদের একটু পরিবর্তন তো হয়ই, তিয়ার মধ্যে তেমন কিছু লক্ষ করেছে কি? চালচলনে? হাবভাবে? অবশ্য চাঁদ-তারা-ফুলের যুগ চলে গেছে, এখনকার ভাবভালবাসা হয়তো এরকমই হয়! চাকরির মতো! ব্যাবসার মতো! তবে এও ঠিক, তিয়া ঢুলুঢুলু চোখে ফোঁস ফোঁস শ্বাস ফেলছে, বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, এ-দৃশ্যও তো অকল্পনীয়।
মা’র কাছে আরও খানিকক্ষণ বসে পাতিপুকুর থেকে বেরিয়ে পড়ল দুই বোন। ফিরছে মাধবীলতার গাড়িতে। বাইরে একটা ফুরিয়ে আসা বিকেল। ম্লান সন্ধ্যা নামছে মন্থর পায়ে। আকাশে অল্প অল্প মেঘ। বর্ষা আসি আসি করেও আসছে না, তবে প্রায় রোজই বৃষ্টি হচ্ছে একটু-আধটু। ভি-আই-পি রোডের দু’ধারে গাছগাছালির সবুজ ভাব বেড়েছে খানিকটা। বাতাসে বাষ্প নেই তেমন, এখনও হাওয়া কেমন শুকনো শুকনো।
বাইপাসে এসে মাধবীলতা বলল,— তুই এখন বাড়ি ফিরবি তো?
তিয়ার কথাই ফের ভাবছিল দোলা। আনমনে বলল,— হুঁ।
তবে চল না আমার ওখানে।
কেন রে?
এমনি। যাসনি তো অনেক দিন। তোর আশিসদা বোধহয় আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে, একটু নয় গপ্পোটপ্পো করে আসবি।
সামান্য চিন্তা করে দোলা বলল,— না রে, আজ থাক। তিতানটার পরীক্ষা চলছে…
ওমা, এখনও শেষ হয়নি?
আর একটা বাকি। মঙ্গলবার লাস্ট। পরিবেশ বিজ্ঞান না কী একটা যেন আছে।
পরীক্ষা ভাল হচ্ছে তো?
দোলা মনে মনে বলল, যে পড়াশুনোই করে না, পরীক্ষা তার ভাল হবে কোথ্থেকে। মুখে বলল,— মোটামুটি দিচ্ছে আর কী।
বেশ, তবে মঙ্গলবারের পরেই নয় আসিস। মাধবীলতাকে ঈষৎ উদাস দেখাল,— আসলে কী জানিস, একা একা আর ভাল্লাগে না।
একা কোথায় রে? আশিসদা জলজ্যান্ত মজুত…?
তবু তো ওই একাই। দু’জনে মিলে একা। আমি ওর মুখ দেখি, ও আমার মুখ দেখে, কাঁহাতক ভাল লাগে, বল? কীভাবে যে দিন কাটে!
বাবানের জন্য খুব মন কেমন করে বুঝি? তা অষ্ট্রেলিয়া থেকে ক’দিন ঘুরে আয় না দু’জনে।
সে নয় গেলাম। মাসখানেক নয় হইহই করে এলাম। কিন্তু তারপর? মাধবীলতা একখানা দীর্ঘশ্বাস ফেলল,— ওরা বোধহয় আর ফিরবে না, বুঝলি।
কেন? ওকে তো মাত্র পাঁচ বছরের জন্য পাঠিয়েছে?
সেরকমই তো জানতাম। কিন্তু এখন তো অন্য রকম শুনছি। কোম্পানি বাবানের থাকাটা এক্সটেন্ড করতে চাইছে। বাবানও তাতে খুব হ্যাপি। তাই মনে হচ্ছে…
সে আর কী করবি বল দিদি? ওদের জীবন, ওদের জীবন। আমরা চাইলেই বা আমাদের ইচ্ছেমতো ওরা লাইফ কাটাবে কেন?
তা বটে। মাধবীলতা আবার লম্বা শ্বাস ফেলল,— একটা কথা ভাবছিলাম, বুঝলি। আমি আর তোর আশিসদা বেলুড় মঠে গিয়ে দীক্ষাটা নিয়ে নিই। মনের উচাটন হয়তো কমবে।
মানুষ খুব অসহায় বোধ করলেই না কোনও একটা আশ্রয় খোঁজে! দিদির জন্য মায়া হচ্ছিল দোলার। ছেলে নিয়ে ভারী গর্ব ছিল দিদির, সেই গরিমা ক্রমশ বিষাদে গড়িয়ে যাচ্ছে। এ কি সন্তান নিয়ে বেশি সম্পৃক্ত থাকার পরিণাম? হবেও বা। হয়তো এইজন্যই একটা নিজস্ব জগতের প্রয়োজন হয় মানুষের। দোলাকে অবশ্য এ কষ্ট পেতে হবে না নতুন করে। সে তো একাই, বহু কাল ধরেই একা।
দোলা আলতোভাবে বলল,— দ্যাখ, যা ভাল বুঝিস।
মাধবীলতা শুনতে পেল কিনা কে জানে, তার চোখ বাইরে, বাইপাসের ধারে এক প্রকাণ্ড জলাশয়ে। দেখছে কি কিছু? পড়ন্ত বিকেলের আলোয়? বিম্বিত হচ্ছে কি কোনও স্মৃতি? নাকি এ শুধুই তাকিয়ে থাকা? হঠাৎই ঘুরে বলল,— তুহিনের কী খবর রে?
প্রশ্নটার আকস্মিকতায় দোলা সামান্য চমকেছে। পরক্ষণে হেসে বলল,— ঠিকই আছে। অফিস নিয়ে যেমন থাকে।
ওর সেই প্রোমোশনের কদ্দূর?
হবে বোধহয় শিগগির। খুব টেনশন করে তো দেখি।
ড্রিঙ্ক করাও নিশ্চয়ই বেড়েছে?
তার আর বাড়া কমা!
চিন্তা হয় রে। বয়সটা তো ভাল নয়… সারাক্ষণ টেনশন, বাইরে বাইরে ঘোরা…! উফ, বেচারা এই বয়সেও এখনও কী দৌড়োদৌড়িটাই না করে!
দিদি ভুল বলেনি। বয়সের তুলনায় বড্ড বেশি ধকল যায় তুহিনের। কিন্তু তাকে বেচারা বলা যায় কি? এই দুনিয়ায় কে যে প্রকৃত বেচারা, টের পাওয়া কি অতই সহজ? দেহের ধকল, শরীরপাত, এগুলো তাও দেখা যায়, মনের ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া কে দেখে! দোলার তো কারও কাছে অভিযোগ জানানোরও উপায় নেই। কী বলবে? আপাতদৃষ্টিতে অল্পস্বল্প বদমেজাজ আর একটু বেশি মাত্রায় মদ্যপান ছাড়া দোলার বর তো খুঁতহীন মানুষ, সংসারের জন্য যে নিরলস খেটে মরছে। ছেলেও এমন কিছু গুন্ডাবদমাশ, বয়ে-যাওয়া নয়। মেয়েকেও সময়ের নিরিখে সেভাবে উচ্ছৃঙ্খল বলা যায় না। তবু তাদের ঘিরে এক গভীর অতৃপ্তি যে দোলাকে কুরে কুরে খায়, এও তো সত্যি। আর এই অবয়বহীন সুখহীনতা কারওকে দেখাতে পারে না বলেই দোলার বেচারাত্ব বহু গুণ বেড়ে যায় না কি?
একটু ভার মনেই বাড়ি ফিরল দোলা। দেখল তিতান এসে গেছে, আলুপরোটা বানানো ছিল, খাচ্ছে আয়েশ করে।
প্রশ্ন করা নিরর্থক, তবু সংসারের নিয়ম মেনে দোলা জিজ্ঞেস করল,— কেমন হল আজ পরীক্ষা?
হল একরকম। তিতানের নির্বিকার জবাব।
রোজই তো শুনি একরকম। একদিন কি অন্য কিছু বলতে পারিস না?
আর কী বলব?
ভাল। খারাপ। কিংবা খুব একটা ভাল নয়…
পরীক্ষার ভাল খারাপ নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাই না। ওসব আমার আসে না।
পাশ করবি তো?
উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করল না তিতান। ঠোঁটের কোণে ফুটেছে এক চিলতে বিদ্রূপ। উপেক্ষা। খাওয়া সেরে হেলেদুলে ঘরে। চেঁচিয়ে বলল,— এক কাপ কফি বানাও তো।
আগের মতো আবদার নয়, এ যেন নির্দেশ। নাকি আদেশ? ভঙ্গিটা তুহিনের, তবে স্বরের দাপট তুহিনকেও ছাপিয়ে যায়।
রাগতে গিয়েও রাগল না দোলা। গরম কফি নিঃশব্দে রেখে এল ছেলের টেবিলে। এবং তখনই স্থির করে ফেলল, অনেক হয়েছে, আর নয়, ছেলে মেয়ে বর কারও ব্যাপারে সে কৌতূহল দেখাবে না।
তা এমন শপথ তো জীবনে হাজার বার হল, কতক্ষণ টেকে ওই প্রতিজ্ঞা। সংসার থেকে দোলা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে কই! তিয়া ফিরতে সেই তো পায়ে পায়ে ঢুকেছে মেয়ের ঘরে!
এসেই বিছানায় চিতপাত তিয়া। পোশাক বদলানোর বালাই নেই, জিন্স-টিশার্টেই লম্বা হয়েছে। কানে নতুন আইপড, গানের তালে তালে দুলছে পা।
দোলা খাটের কোনায় বসল। মুখে হাসি টেনে জিজ্ঞেস করল,— কী রে, খুব টায়ার্ড নাকি?
তিয়া হেডফোন নামিয়েছে। চোখ কুঁচকে বলল,— কিছু বলছ?
এসেই শুয়ে পড়লি যে বড়? খাটুনি গেছে বুঝি আজ?
সেইজন্যই তো রিল্যাক্স করছি।
বলেই আবার হেডফোন চড়াচ্ছিল তিয়া, দোলা তাড়াতাড়ি বলে উঠল,— তোর সঙ্গে একটা কথা ছিল।
বলে ফ্যালো।
ছেলেটা কে রে?
কোন ছেলেটা?
ওই যে… যার সঙ্গে তুই মোটরসাইকেলে…?
কে বলল? তিতান?
তার এখন কথা বলার সময় কোথায়! এই তো, বাড়ি ঢুকেই বেরিয়ে গেল। আমি অন্য একজনের মুখে শুনলাম।
ও, গার্গীদি? যে এখন তোমার খুব প্যাল হয়েছে?
নাম জেনে তোর কী হবে? বল না কে?
অন্য দিন হলে এ প্রশ্নে খিঁচিয়ে উঠত মেয়ে। কিন্তু আজ কেন যেন খানিকটা সদয়। স্বাভাবিক স্বরেই বলল,— ও তো সূর্য। আমার বিজনেস পার্টনার। ও আর আমি মিলেই তো এখন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট করি।
দোলার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,— শুধুই বিজনেস পার্টনার।
পলকে তিয়ার চোখ সরু,— মানে?
সঙ্গে সঙ্গে দোলা ঢোঁক গিলেছে,— না… একসঙ্গে কাজে নেমেছিস যখন… নিশ্চয়ই তোর অনেক দিনের চেনা…?
খুব বেশি দিন নয় মা। কলেজ ছাড়ার পরে আলাপ।
ও। ছেলেটা থাকে কোথায়?
সল্টলেক। গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারে। বাবা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের অফিসার, মা স্কুলটিচার। নো ভাইবোন। এক বিধবা পিসি আছে, সঙ্গেই থাকে…। হয়েছে? তোমার নলেজ ব্যাঙ্ক ফুল?
দোলা ভ্রূকুটি করল। আত্মরক্ষার সুরে বলল,— আহা, আমি কি অত খবর চেয়েছি?
কৌতূহল তো পেটে বুড়বুড়ি কাটছে। তবে তুমি যা ধরে নিচ্ছ…। তিয়া ঝুপ করে থেমে গেছে। তীক্ষ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছে দোলার মুখমণ্ডল। সময় নিয়ে আড়মোড়া ভাঙল একটা। ছড়ানো হাত তুলে রেখেই হঠাৎ মুখ টিপে হাসি। দোলাকে অবাক করে বলল,— তোমার গেসিংটা রাইট। আমরা বিয়ে করতে পারি।
ওমা, তাই? খবরটা দিব্যি চেপে রেখেছিস?
অত পুলকিত হওয়ার কিছু নেই মা। এক্ষুনি এক্ষুনি কিছু হচ্ছে না। আগে আমরা একটু সলিড ফুটিং পাই…
একদিন নিয়ে আয় না ছেলেটাকে।
দেখি। তিয়া বাবু হয়ে বসল,— শোনো, যা বললাম তা কিন্তু বিটুইন ইউ অ্যান্ড মি। চারদিকে ড্রাম পিটিয়ে বেড়িয়ো না। ঠিক?
দোলা ঢক করে ঘাড় নাড়ল। হঠাৎই যেন একটা সুন্দর বাতাস ঢুকে পড়েছে ঘরে। হাত বোলাচ্ছে দোলার গায়ে, মাথায়। এই যে কথাগুলো মেয়ে তার ঝাঁপিতে তুলে দিল, এইটুকুই তো সে চায়। টুকরো-টাকরা এই মুহূর্তগুলোই কি সুখ? এক অসহ্য সংসারকে সহনীয় মেনে হেঁটে চলার পাথেয়? হয়তো বা।
.
১১.
এবছর বর্ষা এল বেশ দেরিতেই। তবে বৃষ্টির ঘাটতি হয়নি, পুষিয়ে দিয়েছে পুরো মাত্রায়। আষাঢ়ের মাঝামাঝি টানা তিন-চার দিন তো সূর্যদেবের দেখাই মিলল না। সারাক্ষণ শুধু ঝরছে আর ঝরছে। কলকাতাও ওমনি সুযোগ পেয়ে ফিরে গেছে স্বমহিমায়। খানাখন্দ, রাস্তাঘাট জলে টইটুম্বুর, দোকানবাজার ভাসছে, ট্রামবাস প্রায় বন্ধ, ট্রেন চলাচলের ঠিক নেই— সব মিলিয়ে এক কেচ্ছাকেলেঙ্কারি দশা। গণমাধ্যম আর জনসাধারণের গুঁতো খেয়ে ঘুমন্ত পুরসভা পর্যন্ত নেমে পড়েছে ত্রাণকাজে। আমহার্স্ট স্ট্রিটে নৌকো বাইছে পুলিশ— ছোট্ট মোদের পানসি তরী, সঙ্গে কে কে যাবি আয়…!
তিয়াদেরও ক’দিন কাজকর্মের বারোটা। অফিস যাবে কী, তাদের কানেক্টিভিটির সামনে এক কোমর জল। কোথ্থাও নড়ার উপায় নেই, জোরজার করে বেরোলেও অর্ধেক লোকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না…। এক মোবাইল ফোনই যা ভরসা। এর মধ্যে একদিন বীরত্ব দেখাতে গিয়ে বিশ্রীভাবে ভিজল তিয়ার সূর্যদেব, তারপর জ্বরে কাবু, চার দিন বিছানায়। শুয়ে শুয়ে সমানে তিয়াকে মেসেজ পাঠাচ্ছে। কাজের। অকাজের। আর কখনও কি দেখা হবে! তানেজাকে মিট কোরো কিন্তু! শালা মনসুনটা এমন ভিলেনি করল কেন বলো তো! চুমু পাঠালাম, ডিলিট কোরো না! ইভিটার ফাইনাল পেমেন্টের জন্য একবার যাও না প্লিজ! সূর্যর পাম্প-খেয়ে তিয়াও ঘুরেছিল জলে জলে। ব্যস, ওমনি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ সর্দি, ঘঙঘঙ কাশি। শয্যা নিতে হয়নি, এই যা বাঁচোয়া।
তা আকাশ এখন খানিক শুধরেছে। তেড়েফুঁড়ে হানা দিচ্ছে বটে হঠাৎ হঠাৎ, আবার মেঘ হঠিয়ে রোদ্দুরও লাফাচ্ছে ঝিকঝিক। শহরের পথঘাট মাড়ি বের করে হাসছে।
আজ একটু সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিল তিয়া। একের পর এক অফিসে ঢুঁ মারতে। আজকাল যে পণ্যই বাজারে আসুক, গোড়াতেই একটু ফোকাস চায়। সে ফিল্ম হোক, কি গানের ডিস্ক, কিংবা বিস্কুট, গুঁড়োমশলা। নতুন কোনও ঘ্যামচ্যাক দোকান খুললেও এখন একই রেওয়াজ, শুরুর আগে ট্রাম্পেট বাজানোর জন্য একটা জম্পেশ অনুষ্ঠান দরকার। রংদার। জেল্লাদার। মিডিয়ার যাতে চোখ টানে। এ ছাড়া অফিস কনফারেন্স, সেমিনার, ওয়ার্কশপ তো লেগেই থাকে হরবখত। আর এইসব কাজ উতরে দিতেই তো কানেক্টিভিটিদের উদ্ভব। যত নিখুঁত করবে, তত নাম ছড়াবে। তবে কাজটা আগে পেতে হবে তো। তার জন্য দোরে দোরে ঘোরাটাও কাজ। তিয়াই এখন এদিকটা সামলাচ্ছে বেশি। প্রথমে আজ গেল এক অ্যাড এজেন্সিতে, সেখান থেকে একটা বুটিক, তারপর মদের কোম্পানি। কোথাও স্রেফ ছুঁয়ে যাওয়া, আর সেই ফিকিরে নতুন কাজের অনুসন্ধান এবং যোগাযোগের পরিধি বাড়ানো। কোথাও বা অর্ডারের জন্য বডি ফেলে রাখা। সুরা নির্মাতা অবশ্য কাজ দেবে না কানেক্টিভিটিকে। তাদের হাইফাই ব্যাপার, সামাল দেওয়ার মতো রেস্তোও নেই তিয়াদের। তবে ঘুরপথে অল্পস্বল্প কাজ আসে বই কী। খোলাখুলি মদের বিজ্ঞাপন আইনে নিষিদ্ধ, তাই কোনও অছিলায় নামটুকু দেখাতে তারা অজস্র প্রোগ্রামে টাকা ঢালে। ওই সব প্রোগ্রামের লিস্ট বাগাতে পারলে, অনুষ্ঠানগুলোর জন্যও তো তিয়ারা দৌড়ঝাঁপ করতে পারে।
তিন জায়গায় সফর সারতে দুপুর গড়িয়ে গেল। অফিসে ফেরার আগে একবার মালহোত্রা অটোমোবাইলসে এল তিয়া। কবে চাকরি ছেড়েছে, তিন মাস হয়ে গেল, এখনও একটা ইনসেনটিভের টাকা বাকি। কত বার ফোন করল, প্রতি বারই এক বুলি, এখনও বিল হয়নি! অবশেষে কাল বাবুদের দয়া হয়েছে, ফোন করে নিজেরাই বলল নিয়ে যেতে।
চেকটা হাতে পেয়ে তিয়ার মেজাজ ভারী শরিফ হয়ে গেল। আঠাশশো টাকা, মন্দ কী! পুরনো সহকর্মীদের হাই হ্যালো করে তিয়া প্রজাপতির মতো উড়ে বাইরে। খিদে পাচ্ছিল একটু একটু। অফিসে ফিরে সূর্যর সঙ্গে লাঞ্চ সারবে? নাকি এখনই? সূর্যর জন্য একটা বারগার নিয়ে গেলেও হয়।
কাছের কফি-বারটায় ঢুকে পড়ল তিয়া। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কফি স্যান্ডুইচের অর্ডার দিচ্ছে। তখনই নজরে পড়ল সোনালিকে। কোল্ড ড্রিঙ্ক আর পিৎজা নিয়ে বসে আছে। আনমনে। একা।
তিয়া খাবারের ট্রে হাতে টেবিলটায় গেল। বসতে বসতে রগুড়ে গলায় বলল,— কী খপর, সোনালি মেমসাব?
আরে, তুই? হোয়াট আ সারপ্রাইজ! সোনালির চোখ উজ্জ্বল হয়েছে,— কেমন চলছে তোদের বিজনেস?
দৌড়ে, হেঁটে, হামাগুড়ি দিয়ে… ঠিকই আছে।
মানে তুই হ্যাপি? চাকরিটা ছেড়ে?
বলতে পারিস। রোকড়া কী আসছে বড় কথা নয়, তবে জবটা চ্যালেঞ্জিং। ভ্যারাইটি আছে।
দ্যাটস গুড। প্রেজেন্টলি কেমন পাচ্ছিস?
পাওয়া-পাওয়ির কিছু নেই, এটা তো আমারও ব্যাবসা। তোকে তো বলেই ছিলাম, আমি আর সূর্য ফিফটি ফিফটি। উইদাউট এনি ইনভেস্টমেন্ট ফ্রম মাই সাইড।
সোনালি একটুক্ষণ চোখ গেঁথে রাখল তিয়ায়। কপালে নেমে আসা চুল আঙুলে সরিয়ে বলল,— ডিড করেছিস?
তুত্, সূর্যর সঙ্গে আবার কীসের ডিড! জাস্ট ভারবাল এগ্রিমেন্ট।
মানছে তো? পয়সাকড়ি মিলছে তো ঠিকঠাক? নাকি প্রেমের জাদুকাঠি নেড়ে তোকে ব্যাপক খাটিয়ে নিচ্ছে?
তিয়ার শুনতে ভাল লাগল না মোটেই। স্যান্ডুইচে কামড় দিয়ে বলল,— যাহ্, সূর্যও কি কম খাটে!… আমি তো কাজ ধরা, মিডিয়া হ্যান্ডলিং, সেলিব্রেটি অ্যাপ্রোচ মেনলি এসব সামলাই। সূর্য বাকি কাজগুলো করে। আর প্রোগ্রামে তো দু’জনকেই একসঙ্গে থাকতে হয়।
ট্রু লাইফ পার্টনার, অ্যাঁ? জীবনসাথী! সোনালির কণ্ঠে কটাক্ষ। চোখ টিপে বলল,— আসলি বাতটা কিন্তু চেপে গেলি!
কী?
তোর মেটিরিয়াল বেনিফিট কত হল?
আপাতত পনেরো নিচ্ছি। সূর্য বলছিল, পুজোর আগে অ্যামাউন্টটা হয়তো বাড়বে।
সূর্য বলছিল মানে? স্টিয়ারিং তা হলে সূর্যর হাতে? তুই গাড়ি ঠেলছিস?
বড্ড আলফাল বকে তো সোনালি! কানেক্টিভিটি সূৰ্যর ব্রেন চাইল্ড, দেড়-দু’বছর ধরে চালাচ্ছে, স্টিয়ারিং তার হাতে থাকাই তো স্বাভাবিক। হ্যাঁ, এটা ঠিক, মান্থলি পনেরো হাজার এক বারে তিয়ার হাতে আসে না। খেপে খেপে দেয় সূর্য। কখনও বা তিয়াকে চাইতেও হয়। তো কী আর করা, পেমেন্ট আসার ব্যাপারটাও তো ভাবতে হবে। বেচারা সূর্যকেও তো পার্টির চেকের অপেক্ষায় থাকতে হয়, নয় কি? কানেক্টিভিটির লাখ লাখ ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স হয়নি এখনও। মার্কেটে ক্রেডিট পড়ে, নতুন কাজ ধরলে আগাম গাঁটের কড়ি ঢালতে হয়, এ ছাড়া অফিসে বিজয়, নীলেশের মাইনে…। সব দিক ব্যালেন্স করে চলার দায়িত্বটা মাত্র তিন মাসেই তিয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে সূর্য?
তিয়া ঠোঁট উলটে বলল,— তুই কিন্তু খুব সিনিক হয়ে গেছিস।
এমনি এমনি হইনি ইয়ার। সোনালি কাঁধ ঝাঁকাল,— পুরুষমানুষ তো লাইফে কম দেখলাম না! ওরা কী চিজ, আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।
বেশি পুরুষ ঘেঁটেই তোর মাথাটা বিগড়েছে। কথাটা টুপুস ছুড়ে দিল তিয়া। হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে বলল,— যাক গে, তোর খবর বল। ব্যালেরিনাটা গছাতে পেরেছিলি শেষ পর্যন্ত?
পেরেছি। সোনালি কোল্ড ড্রিঙ্কের স্ট্রয়ে ঠোঁট ছোঁয়াল, কিন্তু চুমুক দিল না। মুখ সরিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়েছে। কাচের ওপারে দৃষ্টি মেলে বলল,— আমি ভাল নেই রে তিয়াসা।
একেবারে অচেনা স্বর। সোনালির গলা এমনটা কখনও শোনেনি তিয়া। ভুরু কুঁচকে বলল,— কেন? কী হয়েছে?
সেম কোয়েশ্চেন তো আমিও করছি নিজেকে। কী হল? কেন ফালতু ফালতু জড়িয়ে গেলাম?
কীসে জড়ালি?
ওই যে … মহেশ … মহেশ শ্রীবাস্তব।
বি-কে ইন্ডাস্ট্রিজের জোনাল ম্যানেজার? যাকে তুই ব্যালেরিনাটা…?
হুম্। কী যে হয়ে গেল… একটু ইন্টিমেট হওয়ার পর মনে হল, ও খুব আনহ্যাপি। আমিও কেমন গ্র্যাজুয়ালি … মহেশের বউ আছে, বড় বড় ছেলেমেয়ে …, কিছুই আর মাথায় রইল না। আই অ্যাম ইন লাভ তিয়াসা, কী যে করি!
তিয়া হেসে ফেলল,— তুই? তুই প্রেমে পড়েছিস?
সোনালি ক্ষুন্ন স্বরে বলল,— আমি কি ভালবাসতে পারি না? আমার কি মন নেই?
কিন্তু … একটা ম্যারেড, এজেড লোকের সঙ্গে…?
মহেশ বুড়ো নয় রে তিয়াসা। হার্ডলি ফরটি ফাইভ।
মে বি। তবে তোর চাইতে না হোক বিশ বছরের বড়!
অত বড়, ছোট, মেপেজুপে কি ভালবাসা হয় রে!
ও কে। ও কে। মহেশকে তা হলে ডিভোর্স নিতে বল।
পারবে না রে। ফ্যামিলিতে ভীষণ জড়িয়ে আছে। মাঝখান থেকে বউটা সব জেনে গিয়ে বাড়িতে হেভি অশান্তি। মহেশ তো এখন আমাকে মিট করতে ভয় পাচ্ছে।
তোর মহেশ ব্লাফ মারছে না তো? মে বি তোকে কাটাতে চায়…
না রে তিয়াসা। মহেশ ওই টাইপই নয়। তুই ওকে দেখলে বুঝতিস।
সব বুঝেছে তিয়া। সোনালির থেকে যেটুকু নেওয়ার উশুল করে মহেশ শ্রীবাস্তব মানে মানে ভাগতে চায় এখন। আশ্চর্য, পুরুষদের হাড়হদ্দ জানা সোনালির মতো চালু মেয়েও শেষে বোকা বনে গেল? নাহ, প্রেমের পাওয়ার আছে। দৃষ্টিমানকেও দিব্যি অন্ধ করে দেয়।
তিয়া সোনালির হাতে হাত রাখল,— ফরগেট ইয়ার। লাইফমে কভি কভি অ্যাইসা ভি হোতা হ্যায়। ভুলতেও হয়।
আই কান্ট। পারছি না রে।
খুব পারবি। একটা ঠিকঠাক ছেলে দেখে এবার সেটল্ করে যা তো।
হুম্। সোনালি নাক টানল,— নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে, জানিস। মা’র একটা অ্যাফেয়ার ছিল বলে… ছিল কেন, এখনও আছে… আই হেট মাই মম। সেই আমিই কিনা মার মতো একটা ম্যারেড লোকের সঙ্গে…! ঠাস ঠাস চড়াতে ইচ্ছে করছে নিজেকে।
তিয়া মনে মনে বলল, এ দাওয়াইটা খারাপ নয়। মুখে বলল,— কাম অন ইয়ার। অনেক প্রিন্স চার্মিং তোর জন্য ওয়েট করছে। গো অ্যান্ড ফাইন্ড দেম।
সোনালি আর কিছু বলল না। নখ খুঁটছে।
অফিসে ফিরে সোনালির গল্পটা সূর্যকে শোনাবে ভেবেছিল তিয়া। সুযোগ পেল না। সূর্য বেজায় সিরিয়াস মুখে স্ন্যাকসের লিস্ট বানাচ্ছে। সামনের সপ্তাহে অর্থোপেডিক ডাক্তারদের একটা সেমিনার আছে কলকাতায়, কানেক্টিভিটি বরাতটা পেয়েছে, পরিকল্পনার শেষ ধাপ চলছে এখন। লিস্ট ধরে টুকটুক করে খাবারের নাম বলছে সূর্য, কম্পিউটারে ঢুকিয়ে নিচ্ছে নীলেশ।
সূর্যর জন্য বারগার এনেছিল তিয়া। ধরিয়ে দিয়ে বলল,— আগে খেয়ে নাও।
হাতে নিল সূর্য, তবে মোড়ক খুলল না। চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করল,— কোন বিস্কিটটা বেটার হবে? ক্রিম? না বাটার?
বাটারই দাও। একটু নোনতার দিকে। আসবে তো বেশির ভাগই ফরটি প্লাস, মিষ্টি কেউ প্রেফার করবে না।
কারেক্ট। এইজন্যই তো টিমে একটা মেয়ে দরকার। সূর্যর দু’আঙুলে প্রশংসার মুদ্রা,— ভেজ আইটেম কী কী থাকছে শুনে নাও। ধোকলা, পনির চপ, ভেজ কাটলেট।
আর নন-ভেজে?
চিকেন পকোড়া, ফিস টিক্কা।
এই স্ন্যাকস্ ওরা অ্যাপ্রুভ করেছে?
বলেছে, ওটা আপনাদের লিবার্টি। শুধু কোয়ালিটি যেন ফ্রেশ থাকে। তবে লাঞ্চ ওদের লিস্ট মতো দিতে হবে। আজই রুপোলি কেটারারকে ধরিয়ে দেব।
হোটেল বুকিংয়ের ব্যাপারটা ফাইনাল হল?
ইয়েস। বুকিং আমরা করব, পেমেন্ট ওরা। ডাইরেক্ট। গাড়ি নিয়েও কথা হয়ে গেছে। আগের দিন চারটে, প্রোগ্রামের দিন বারোটা, পরের দিন দুটো। লাস্ট দুটো গাড়ি তিন দিন ধরেই থাকবে। ফ্রম মর্নিং এইট টু এনি টাইম দে লাইক। … ওহ্ হো, গোটা পনেরো ছেলেমেয়েও তো লাগবে।
অত? আর একটু কম নিলে হয় না? ডাক্তার তো আসবে হার্ডলি সিক্সটি ফাইভ টু সেভেনটি!
না না, কমানো যাবে না। দু’জনকে এয়ারপোর্ট পাঠাতে হবে। কনফারেন্স হলে প্রেজেন্ট থাকবে অ্যাট লিস্ট ছ’জন। প্লাস রিসেপশন। প্লাস ফুড অ্যান্ড বেভারেজের দিকটা দেখা। হোটেলে যারা উঠবে, তাদের জন্যও তো…। সূর্য মৃদু হাসল,— এটা আমাদের লাভের কাজ নয় তিয়াসা। জাস্ট বর্ষাকালটা পার করার জব। অ্যান্ড মাইন্ড ইট, এভরি ডক্টর ইজ আ গুড সোর্স।
হুঁ। তিয়া ঘুরনচেয়ারে বসল,— এবার আমার ইনফর্মেশানগুলো শোনাই? অ্যাকর্ডিং টু ক্রিয়েশান পাবলিসিটি, এই ডিসেম্বরেই সানশাইন একটা নতুন হেয়ার অয়েল বাজারে ছাড়বে।
পরে হচ্ছে। সূর্য হাত তুলে থামাল,— আগে হাতের কাজটা সেরে নিই। টেবিলে ডাক্তারদের লিস্টটা তোলো, পর পর ফোন মেরে যাও। কেউ যদি আনসার্টেন থাকে, নামের পাশে স্টার দিয়ে রাখো। একদমই না এলে, ক্রস।
ব্যস, টেলিফোনের খেল শুরু। চলছে মোবাইলও। কথা, শুধু কথা বলে যাওয়া। নরম ভঙ্গিতে। মিষ্টি গলায়। সূর্যরও ঘাড় ঘোরানোর ফুরসত নেই। হিসেব কষছে, কম্পিউটারে বসছে, টেলিফোন ধরছে, টেলিফোন করছে, ক্রমাগত নির্দেশ দিয়ে চলেছে নীলেশকে। কার রেন্টালের লোকটা এল, তাকে পেমেন্ট নিয়ে খেলাল একটু, তারপর ছোটখাটো চেকও ধরিয়ে দিল একটা। বিজয়কে পাঠাল কেটারারের কাছে। বারগার পড়েই আছে, পড়েই আছে। কখন যে সে ঠান্ডা হয়ে গেল!
দুপুর হেলেছে বিকেলের দিকে। এবার বুঝি ক্ষণিকের অবসর। শুকনো বারগার কচকচ চিবোচ্ছিল সূর্য। মিনারেল ওয়াটারের বোতল খুলে জল খেল। কাগজরুমালে মুখ মুছে বলল,— এবার অফিসে একটা মাইক্রো ওভেন রাখতে হবে।
সেমিনার রুম সাজানোর নকশা তৈরি করছিল তিয়া। হালকাভাবে বলল,— তারপর ফ্রিজ, তারপর গ্যাস… পুরো সংসার পেতে নিলেই হয়।
টু স্টার্ট উইথ … খারাপ কী? এমন একটা ওয়ানরুম ফ্ল্যাট… বালিগঞ্জ ফাঁড়ির মতো জায়গা … কোয়াইট গুড লোকালিটি। বলেই সূর্যর চোখ নীলেশে। কম্পিউটারের কি-বোর্ডে নীলেশের আঙুল নিথর, সূর্য-তিয়ার সংলাপ গিলছে। বুঝি তাদের সম্পর্কটা আন্দাজ করেছে মনে মনে। ভুরুতে ছোট্ট ভাঁজ ফেলে কথার মোড় ঘোরাল সূর্য,— তুমি লাঞ্চ করেছ?
ইয়েস স্যার। আমাদের কফি বারে। ওখানে সোনালির সঙ্গে দেখা।
কী বলে?
বেশ মনমরা। জোর ফেঁসেছে।
ও তো আমার আগেই ফোরকাস্ট করা ছিল। সূর্য শোনার আগ্রহই দেখাল না। চেয়ারে পিঠ টান করে বলল,— বুটিকে আজ কতটা এগোলে?
কাজটা হয়ে যাবে। তবে বায়নাক্কা আছে। ফিল্ম হিরোইনকে দিয়ে ওপেন করাতে চায়
হিরোইনদের রেট বলেছ?
ওই নিয়েই একটু কিন্তু-মিন্তু করছে। তবে পটে যাবে। মিডিয়া কভারেজের ব্যাপারেও ভীষণ লোভ। নিউজ পেপার আর টিভিতে বিষ্ণুপ্রিয়া বুটিকের ছবি চাইই চাই। এবং অবশ্যই বিষ্ণুপ্রিয়া মজুমদারেরও। … আমিও বলে দিয়েছি, পপুলার পারসোনালিটি এলে তবেই কিন্তু মিডিয়ার দর্শন মিলবে।
কাজটা কিন্তু ছাড়া নেই। তানেজাটা বহুত ঝুল দিল, এসব খুচখাচ করে করেই এখন টানতে হবে।
তানেজারটাও পাব। প্রোব্যাবলি পিছিয়ে ডিসেম্বরে হচ্ছে। আমি তো উসকে এসেছি, সেমিনারটা সি-সাইডে করুন, দারুণ ইন্টারেস্টিং হবে। আর কাছাকাছি করতে চাইলে রায়চক। পসিবলি, আইডিয়াটা খেয়েছে।
দ্যাখো চিঁড়ে ভেজে কিনা। ব্যাটা কানেক্টিভিটির পয়সায় আরও হুইস্কি ধসাবে মনে হয়। সূর্য কপালে আঙুল ঘষছে। হঠাৎ ঘড়ি দেখে বলল,— এই, তুমি আর দেরি কোরো না, বেরিয়ে পড়ো। তোমার সাড়ে চারটেয় অ্যাপয়েন্টমেন্ট না?
পাঁচটায়।
ওই হল। ট্রেনে সোনারপুর যাবে, কতক্ষণ টাইম লাগে, না লাগে…।
তুমি যাবে নাকি সঙ্গে?
আমাকে তো ইভিটায় যেতে হবে। রান্নার ওয়ার্কশপটার রেট ফাইনাল করব না?
হিহি। তিয়া হেসে ফেলল,— কী কাণ্ড বলো তো? কুকিংয়েরও ওয়ার্কশপ?
করুক বাবা করুক। রান্না, ঘর সাজানো, জামাকাপড় কাচা, ইস্ত্রি করা, যা খুশির ওয়ার্কশপ করুক। অর্ডারটা আমরা পেলেই হল। সূর্য উঠে পড়ল,— চলো তোমাকে বালিগঞ্জ স্টেশন অবধি লিফট দিয়ে দিই।
ট্রেনে ঠাসাঠাসি ভিড়। সোনারপুরে নামল যখন, তিয়ার গলদঘর্ম দশা। এখানে কাজটা ছোট, তবে উপেক্ষা করার জো নেই। এ রাজ্যেরই এক মাঝারি গুঁড়োমশলা নির্মাতা সরষের তেল বানানো শুরু করেছে সম্প্রতি। বিভিন্ন জেলার বাজারে সংস্থাটি একটু প্রচার দিয়ে ঢুকতে চায়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় ‘রুচি’ গুঁড়োমশলার মূল মজুতদার সোনারপুরের। তারই ঠিক করা জায়গায় ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রুচি সরষের তেল জাহির করবে তার আগমন বার্তা। অনুষ্ঠানটা তোলার কাজ তিয়াই জোগাড় করেছে ঘুরে ঘুরে। অতএব স্টকিস্টের সঙ্গে আলোচনা করে গোটা জেলার ডিলার আর বড় বড় দোকানদারদের জড়ো করার প্রাথমিক দায়িত্বটাও তিয়ার।
দেখা হল মধ্যবয়সি লোকটার সঙ্গে। আলাপ আলোচনাও। নেমন্তন্নর একটা লম্বা ফিরিস্তি ধরাল লোকটা। ডিলারদের কী ধরনের উপহার পছন্দ, তা নিয়েও মতামত জানাল। স্পষ্ট ভাষায় বলে দিল, কলকাতার মতো কেক-পেস্ট্রির বাক্স এখানে অচল, মফস্সলের মানুষগুলোকে মাংস-ভাত খাওয়াতেই হবে। আর মূল অনুষ্ঠানে একটা গায়ক-টায়ক ছাড়তে পারলে আমন্ত্রিতরা নাকি ভারী অভিভূত হয়।
মনে মনে হিসেব কষতে কষতে স্টকিস্টের ঘর থেকে বেরোল তিয়া। মোটামুটি চলনসই একজন গায়ক বা গায়িকা কত নিতে পারে? পনেরো? কুড়ি? গিফট… দেওয়াল ঘড়ি। কোয়ার্টজ্ ক্লক লটে রাধাবাজার থেকে কিনলে পার পিস একশোর বেশি পড়বে না। লোক আসবে শ’খানেক, অর্থাৎ খাওয়া-দাওয়াতে দশ। উঁহুঁ, আর একটু বেশি। নয় পনেরোই হল। এ ছাড়া আরও বিশ-পঁচিশ হাজার তো আছেই…। অর্থাৎ রুচিকে রেটটা দিতে হবে পঁচাশি থেকে নব্বইয়ের মধ্যে। কিংবা এক লাখ। তারপর টানামানি। আহা, কম লাভই সই, অন্য ডিস্ট্রিক্টের কাজগুলো তো জুটতে পারে।
কী ম্যাডাম, আপনি আমাদের পাড়ায়?
চমকে তাকাল তিয়া। ইন্দ্রজিৎ!
পরনে সেই পোশাক, মুখে সেই হাসি।
ভুরু নাচিয়ে তিয়া বলল,— সোনারপুর কবে থেকে নরেন্দ্রপুরে ঢুকে পড়ল? … আমি কাজে এসেছিলাম…
আমিও। বাজারে কটা লাউ-লঙ্কা-কুমড়ো দিয়ে গেলাম। বৃষ্টিতে যা সব্বোনাশটা হল, বাব্বা!
খুব ক্ষতি হয়েছে বুঝি?
সময় আছে? চলুন না, স্বচক্ষে দেখবেন।
নাকমুখ কুঁচকে তিয়া ভাবল একটু। পৌনে ছ’টা বাজে, অফিস ফিরে লাভ নেই, সূর্য আর আসবে না। এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকেই বা করবে কী? আজ একবার ঘুরে গেলে হয়। সেই ভারী বর্ষার আগে এসেছিল আর একবার। তাও প্রায় দিন পনেরো-কুড়ি হল। কমল-গণেশরা খুব খুশি হয়েছিল সেদিন। হাতের ইঙ্গিতে আবার যেতে বলেছিল।
ভাবছেন কী? তাড়া আছে খুব?
না, চলুন। এদিক ওদিক তাকাল তিয়া,— আপনার রথ কোথায়?
ওই তো। দূরে আঙুল দেখাল ইন্দ্রজিৎ,— এই ভিড়ে কি গাড়ি রাখা যায়?
মারুতি অবধি পৌঁছে তিয়া অবাক। নয়ন গাড়িতে বসে। চকচক করছে চোখ দুটো।
সামনের সিটে বসে তিয়া বলল,— ওমা, এ সঙ্গে আছে বলেননি তো?
ওই তো আমায় দেখাল। ইন্দ্রজিৎ গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। সদ্য নির্মিত উড়ালপুল পেরোতে পেরোতে বলল,— কী জাদু যে করেছেন আপনি! প্রায়ই আমাকে খোঁচায়, দিদিকে ডাকো! দিদি যে কত ব্যস্ত মানুষ, সে তো ওদের মগজে ঢুকবে না!
সত্যি, বড্ড চাপ। তিয়া ঘাড় ঘোরাল। কেটে কেটে নয়নকে জিজ্ঞেস করল,— লুউউডোও খেএলছও?
ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে প্রশ্নটা পড়তে পেরেছে নয়ন। ঘাড় এক দিকে ঝুলে গেল।
ইন্দ্রজিৎ বলল,— শুধু খেলছে না, খেলতে খেলতে ঝগড়াও চলছে। চারখানা সেট দিয়েছিলেন, তার মধ্যে দুটো বোর্ড ভেঙে টুকরো।
এক্সেলেন্ট। এবার ওদের জন্য একটা লুডোর টুর্নামেন্ট চালু করে দিন।
উদ্বোধনটা আপনি করবেন তো? সেদিন হোল ডে থাকবেন, বেশ খাওয়াদাওয়া হবে। চড়ুইভাতির মতো।
ইচ্ছে তো করে। কিন্তু হয়ে যে উঠবে না, তাও তিয়া বিলক্ষণ জানে।
ফাঁপা আশ্বাসবাণী শোনাল না তিয়া। তবে কথা বলছে দুলকি চালে। গাড়ি কামরাবাদের রাস্তা দিয়ে যেরকম নাচতে নাচতে চলেছে, অনেকটা সেই রকম। পথের ঘোরপ্যাঁচ পেরিয়ে তিয়া যখন হ্যাপি হোমে পৌঁছোল, সূর্য প্রায় ডুবুডুবু।
ভেতরে ঢুকে সবজি খেতের দিকে যাচ্ছিল তিয়া, ইন্দ্রজিৎ হা হা করে উঠেছে,— উঁহুঁ, ওখানে এখন সাপখোপ ঘুরছে ম্যাডাম। দূর থেকে দেখুন।
সাপ? তিয়া ত্রস্ত,— পয়জনাস্?
ছোবল খেয়ে তো দেখিনি ম্যাডাম। ইন্দ্রজিৎ হো হো হাসল,— আমি ভিতু মানুষ, প্রয়োজন না হলে বর্ষাকালে ওদিকে ঘেঁষি না। তাও হাতে লাঠি থাকে, ঠুকতে ঠুকতে যাই।
কথার মাঝেই ছেলেরা সদলবল হাজির। নয়ন বুঝি ছুট্টে গিয়ে খবর দিয়েছিল। হাত-চোখ-মুখ নেড়ে উল্লাস দেখাচ্ছে সবাই। লুডো খেলায় কে কত পারদর্শী, জানাচ্ছে সগর্বে। ডাকছে ওদের ঘরে যাওয়ার জন্যে।
অজানা এক অনুভূতি জাগছিল তিয়ার হৃদয়ে। কী এমন মহামূল্যবান বস্তু দিয়েছে সে, তাতেই এত কৃতজ্ঞতা? এখনও এমন তুচ্ছ জিনিসে আনন্দিত হতে পারে মানুষ? অথচ ওই একই দুনিয়ায় তিয়ারাও তো আছে। যাদের শুধু চাই চাই … চাহিদার কোনও সীমা পরিসীমা নেই। কী আশ্চর্য, তৃপ্তিও নেই যেন। গত মাসেই তো শ’তিনেক টাকার একটা লিপস্টিক কিনল তিয়া, বড়জোর চার-পাঁচ দিন মেখেছে, চোখে একটু চড়া লাগছে বলে প্রায় বাতিল, হয়তো আর ছুঁয়েও দেখবে না কোনওদিন। বিউটি পারলারে পাক্কা ন’শো টাকা গুনে চুলে অবার্ন কালার করাল, পছন্দ হল না, এক মাস পরে ফের ন’শো, ফের বারগেন্ডি। এক অদৃশ্য তাড়না যেন ছোটাচ্ছে, ছোটাচ্ছে… চটকদার বিজ্ঞাপন ডাকছে হাতছানি দিয়ে! ওই সব প্রলোভনের বাইরে থাকে বলেই কি বোবা-কালা ছেলেগুলো এত অল্পে তুষ্ট?
জল-ডোবা খেতে চোখ বোলানোর পর নয়ন-কমলদের আস্তানায় মজায় কাটল খানিকক্ষণ। সেখান থেকে তিয়া যাচ্ছিল অফিসঘরে। বিকেল ফুরিয়ে এল, সন্ধে ডানা মেলছে। মেঘ ঘনাচ্ছে আকাশে, হাওয়া নেই। কেমন গুমোট গুমোট লাগে।
অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তিয়া বলল,— দিব্যি আছেন কিন্তু আপনারা।
ইন্দ্রজিৎ ঘাড় বেঁকাল,— কেন? আপনারা কি মন্দ আছেন?
কী জানি। বুঝতেই পারি না। সারাক্ষণ দৌড় দৌড় …
সে তো আপনাদের বেছে নেওয়া জীবন। … আপনাদের সঙ্গে আমাদের বড় তফাতটা হল, আপনাদের পছন্দ-অপছন্দকে ঠিক করে দিচ্ছে বাজার। ইউ আর গাইডেড বাই দা মার্কেট। আর আমরা চেষ্টা করছি যথাসম্ভব তার বাইরে থাকতে। বলেই ইন্দ্রজিৎ ফের জোরে জোরে হাসছে,— নাহ্, এসব বলারও কোনও মানে হয় না। আমরাও তো ওই বাজারের ওপরই ডিপেন্ডেন্ট। যাদের মাল বেচি, তারাও বাজার। যারা আর্থিক সাহায্য দেয়, তারাও বাজার।
হুম্ম্।
তা আমার সেই স্পনসরদের কাছে যাওয়ার কী হল? চলুন না, এবার একদিন নক্ করে আসি।
উত্তর দেওয়ার আগেই মোবাইলে সুর। বিশেষ গান, বিশেষ লোক।
ফোন কানে লাগিয়ে তিয়া বলল,— হ্যাঁ সূর্য, কাজ হয়েছে। রেটও বানিয়ে ফেলেছি মোটামুটি।
গুড। … এখন কোথায় তুমি?
নরেন্দ্রপুর। হ্যাপি হোমে।
হোয়াট? সোনারপুর থেকে ওখানে চলে গেছ?
হ্যাঁ। হঠাৎ ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে দেখা …
ওমনি তুমি নাচতে নাচতে…! স্ট্রেঞ্জ, একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলে না? এসব কী ধরনের আহ্লাদিপনা, অ্যাঁ? অফিসের একটা ডেকোরাম আছে, ফিরে এসে ডিটেল রিপোর্ট দেবে…
এ তো অবিকল মালহোত্রা অটোমোবাইলসের সেল্স ম্যানেজারের কণ্ঠ! তিয়া ক্ষুব্ধ গলায় বলল,— তুমি তো বলে যাওনি আবার অফিসে আসবে!
কী বললাম, না বললাম, সেটা বড় কথা নয়। তোমায় রেসপন্সিবিলিটি দেওয়া হয়েছে, সো ইউ শুড কনট্যাক্ট মি, অ্যান্ড রিপোর্ট। একটা কল পর্যন্ত করলে না? কোথাকার এক হ্যাগার্ডের সঙ্গে এখন প্রেমসে ফুর্তি মারছ?
ইন্দ্রজিৎ এগিয়ে গেছে। তাকে একবার দেখে নিয়ে তিয়া চাপা স্বরে বলল,— বিহেভ ইয়োরসেলফ্। কী যা তা বলছ!
কিচ্ছু বাজে বলিনি। আমি এসব লাইক করি না। সূর্যর গলা সামান্য নামল,— কাজের সময়ে আগে কাজ। তারপর অন্য কিছু।
ঠিক আছে। কাল কথা হবে। ছাড়ছি।
ব্যাগে ফোন রেখে তিয়া স্থির দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। কান ঝাঁ ঝাঁ। এ কী টোনে কথা বলে সূর্য? তিয়া কি সূর্যর কর্মচারী? হুকুম চালায় কোন সাহসে? এমনিই তো সর্বক্ষণ বস্ বস্ এয়ার নিয়ে চলে। যেভাবে বলবে, সেভাবেই চলতে হবে তিয়াকে! নাহ্, কাল অফিসে গিয়ে একটা হেস্তনেস্ত চাই। কষে ঝাড় দেবে, তা হলে যদি সূর্য সিধে হয়! এত চটার কী আছে? উঁহুঁ, অফিসে ফেরার ব্যাপারটা স্রেফ ঢপ। তিয়া নরেন্দ্রপুরে এসেছে বলেই…। সূর্য কি হিংসে করছে ইন্দ্রজিৎকে? না না, এ মোটেই ভাল লক্ষণ নয়। সন্দেহের পোকা ব্রেনে ঢুকলে সম্পর্ক চিড় খেয়ে যায়। নিজের বাবা মাকে দেখছে না তিয়া? মা নাটকের গ্রুপে ছুটছিল, বাবা ওমনি অংশু রায়কে হিংসে করে পুড়তে লাগল। আর কি জুড়ল সম্পর্কটা? না, খ্যাপাটাকে ঠিকঠাক সমঝাতে হবে, কীসের টানে হ্যাপি হোমে আসছে তিয়া। জোর করে এখানে একবার ধরে আনলে হয় সূর্যকে। দেখেশুনে নিজেই বুঝুক। বেসিক্যালি তো সূর্য ছেলে খারাপ নয়। তিয়াকে ভালবাসে…
ইন্দ্রজিৎ দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞেস করল,— কী ম্যাডাম, চা বসাব নাকি?
তিয়া অন্যমনস্ক মুখে বলল,— নাহ্, আজ যাই।
আরজেন্ট ডাক এল বুঝি?
তিয়া উত্তর করল না। হাসার চেষ্টা করল শুধু।
ইন্দ্রজিৎ কাছে এল,— অল রাইট, তা হলে আর আটকাব না। … আমার স্পনসরের কেসটা কী করছেন? পারবেন তো যেতে?
সূর্যর স্বর কানে বেজে উঠল, আমি এসব লাইক করি না…! তিয়ার চোয়াল শক্ত সহসা। সে কি সূর্যর কেনা বাঁদি? তার লাইক, ডিজলাইকই মানতে হবে সর্বদা? তিয়ার নিজের ভাল লাগা, না লাগা নেই?
তিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,— না পারার কী আছে? নেক্সট্ উইকে ফোন করবেন, ডেট বলে দেব।
ঝিরঝির বৃষ্টি নেমেছে। তিয়া ছাতা খুলল।
.
১২.
কলেজের নোটিশবোর্ডের সামনে থিকথিকে ভিড়। একটু আগে রেজাল্ট টাঙিয়েছে, তারপর থেকে চলছে ছেলেমেয়েদের ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি। পাশ ফেলের তালিকা দেখে সরে আসার পর কারও চোখ জ্বলজ্বল, কারও বা মুখ তোলো হাঁড়ি।
বোর্ডে সাঁটা কাগজটায় অস্থির ভাবে চোখ ঘুরছিল তিতানের। একবার নয়, দু’বার নয়, বারবার। খানিক উদ্ভ্রান্ত ভাবে বেরিয়ে এল জটলা থেকে। বুকটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেছে। হাত পায়ে যেন জোর নেই। হাঁটু কাঁপছে ঠকঠক।
শ্রেয়া রাজ্যশ্রীরা তফাতে দাঁড়িয়ে কলকল করছিল। তুরতুরে পায়ে দৌড়ে এল শ্রেয়া। চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল,— কী হল রে সায়র? সব ঠিকঠাক তো?
না বলতে জিভ আটকে গেল তিতানের। ঠোঁট চেপে জোরে জোরে মাথা নাড়ল দু’দিকে।
নাম নেই?
দেখছি না তো।
ও নো! কী হবে এখন?
কী যে হবে, তা কি তিতানও জানে? সে কি আগে ফেল করেছে কখনও? লেখাপড়ায় যেমনই হোক, পাশ তো করে যায় বরাবর। ইউনিভার্সিটির প্রথম পরীক্ষাতেই কিনা দুর্ঘটনা ঘটে গেল?
শ্রেয়ার চোখ ছলছল করছে,— কোনও মানে হয়?
তিতান ভারী গলায় বলল,— দেখছি তো হয়।
তুই তো বলেছিলি, পরীক্ষা খারাপ দিসনি…?
তিতানেরও তো সেইরকমই অনুমান ছিল। আনসারগুলো হয়তো গুছিয়ে লিখতে পারেনি, একটু আধাখেঁচড়া মতন হয়েছিল, তা বলে একেবারে পাশ না করানোটা কি উচিত কাজ হল? মাস্টারদের এ কী ধরনের শয়তানি? ফেল করিয়ে কী আনন্দ পায়?
শ্রেয়া তিতানের হাত ধরে টানল,— মন খারাপ করিস না। আয়, কোথাও বসি।
কোথায় বসব? ভাল্লাগছে না।
ওরকম করে না, আয়। প্লিজ।
করিডর পেরিয়ে লাইব্রেরির সামনের ধাপিটায় বসেছে দু’জনে। শ্রেয়া নরম গলায় বলল,— এত ভেঙে পড়ছিস কেন? ইউনিভার্সিটির রেজাটের শিটে হয়তো ভুলভাল আছে। মার্কস এলে দেখবি হয়তো পাশ করে গেছিস।
সত্যি সত্যি ভেঙে পড়েছে বলেই বোধহয় দপ্ করে জ্বলে উঠল তিতান। শ্রেয়া কি মলম লাগাচ্ছে?
তিতান বিরক্ত গলায় বলল,— কানের কাছে ফ্যাচফ্যাচ করিস না তো। বললাম না, আমার ভাল লাগছে না।
যাহ্ বাবা, আমাকে বকছিস কেন? বিলিভ মি, আমিও খুব শকড্।
তা হলে মুখে ফেবিকল সেঁটে বসে থাক।
গত দু’-তিন মাসে শ্রেয়ার সঙ্গে তিতানের সম্পর্কটা ঘন হয়েছে আরও। পরীক্ষার পরও দেখাসাক্ষাৎ চলেছে নিয়মিত। কখনও ঢাকুরিয়া লেক, কখনও সিনেমাহল কিংবা স্রেফ রাস্তায় ট্যাঙোশ ট্যাঙোশ। কে জানে কেন, বাড়িতে আর ডাকেনি শ্রেয়া। ভয় পেয়েছে কি? তিতানও অবশ্য যেচে যেতে চায়নি। কেন চাইবে? সে সায়র মিত্র, কোনও ভুক্কার পার্টি নয়। তা ছাড়া লেক-টেকই বা মন্দ কী, দুঃসাহসী হয়ে উঠতে তো বাধা নেই। এক নিরালা দুপুরের জেরে শ্রেয়ার তুলতুলে শরীরটার ওপর সায়র মিত্রর যে একটা অধিকার জন্মে গেছে, এ ব্যাপারে তিতান পুরো মাত্রায় সচেতন। এবং এখন সে শ্রেয়াকে দাবড়াতেও পারে। অনায়াসে।
তা শ্রেয়া কি চুপচাপ বসে থাকার পাত্রী? বকুনি খেয়েও উশখুশ করছে। একবার বর্ষাশেষের নীল নীল আকাশটা দেখল, পরক্ষণে চোখ নেমেছে ঘড়িতে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
তিতান গোমড়া মুখে বলল,— কী হল? এত ছটফটানি কীসের?
পলা রাজ্যশ্রী বোধহয় খুঁজছে আমাকে। একবার ঘুরে আসি? পাঁচ মিনিট।
কোথ্থাও যাওয়ার দরকার নেই। গেলে আর আসতে হবে না।
শ্রেয়া পালাতে পারল না। তবে বিচিত্র সব মুখভঙ্গি করেই চলেছে। আর আড়ে আড়ে দেখছে তিতানকে। তার এই আটকে যাওয়াটা, এমন বিচ্ছিরি মুহূর্তেও, বেশ লাগল তিতানের। পরীক্ষার ফল তার ভার কমিয়ে দেয়নি তা হলে!
কলেজের এই দিকটা ছেড়ে তিতানের উঠতে ইচ্ছে করছিল না। সামনেটায় যাওয়া মানে অজস্র ড্যাবডেবে চোখ, কলেজময় নির্ঘাত এতক্ষণে চাউর হয়ে গেছে তিতান গাড্ডু, ঠিকরে ঠিকরে আসবে সমবেদনা, বিস্ময় … নাহ্, সহ্য হবে না সায়র মিত্রের।
কিন্তু এখানেই বা শান্তি কোথায়? হঠাৎ কোথ্থেকে পল্লব এসে হাজির, প্রায় মাটি ফুঁড়ে। ধপ করে বসল পাশে। পিঠে হাত রেখে বলল,— কাম অন সায়র, বি স্টেডি। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
শ্রেয়া আদুরে গলায় বলল,— দ্যাখ না, আমি তো ওকে সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি। পরীক্ষাতে তো এমন হয়েই যায়, তাই না?
চোপ। তিতান মৃদু ধমক দিল। ঘুরে পল্লবকে বলল,— তোর তো ডান্স করা উচিত।
কেন?
তুই তো চেয়েইছিলি সায়রটা ফেল করুক।
আমার সম্পর্কে এরকম ভাবতে পারলি? পল্লব রীতিমতো আহত,— তোকে আমি পরীক্ষার আগে বলিনি, যদি প্রিপারেশানে গলতি থাকে তো এবারটা ড্রপ মেরে দে?
কথাটা বর্ণে বর্ণে সত্যি। তবু একটুও সান্ত্বনা পেল না তিতান। মনে হল, এটাও এক ধরনের হ্যাটা। পল্লব যেন পরীক্ষার আগেই বুঝে ফেলেছিল এবার কোনও ভাবেই টপকানোর সাধ্য নেই তিতানের!
তিতান নয়, সায়র তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল,— ছাড় তো। আমি আর রেজাল্ট ফেজাল্ট নিয়ে ভাবছি না। বাইগন্স আর বাইগন্স।
বাচ্চাদের মতো করিস না। আমরা কি বুঝছি না, তুই কতটা হার্ট হয়েছিস? বাবা বলে…
পরীক্ষায় ফেল নিয়েও তোর বাবার কোনও গপ্পো আছে বুঝি?
পল্লব রাগল না। শান্তভাবেই বলল,— শোন, তুই তো আর রেগুলার স্টুডেন্ট থাকছিস না, একটা বছর কলেজে আসা কমিয়ে দে। পার্টি-ফার্টি হঠা, তেড়ে খাট, তোর সায়েন্সের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, নেক্সট ইয়ার এক দাঁড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবি।
ঝাং করে তেতে গেল সায়র মিত্র। ভেংচে বলল,— অ্যাই, কপচাস না তো। পাশ করেছিস, বাড়িতে খিল এঁটে পড় গে যা। ফের যদি তোকে ইউনিয়ন-রুমে দেখেছি…
পল্লব একটা শ্বাস ফেলে হাত উলটোল। শ্রেয়াকে একবার আড়চোখে দেখে চলে যাচ্ছে ধীর পায়ে।
শ্রেয়া মিনমিন করে বলল,— পল্লব তোকে খারাপ কিছু তো বলেনি!
ভাল খারাপের তুই কী বুঝিস? পল্লবটা বহুত দু’নম্বরি। আউট অ্যান্ড আউট ধান্দাবাজ। শালা পার্টিকে ইউজ করছে…
আহা, সে তো তুইও করিস।
নো। সায়র মিত্র পার্টিকে ইউজ করে না। সে নিজেই পার্টি… আই মিন, পার্টিরই একজন।
আমি বাবা অত মারপ্যাঁচ বুঝি না। পল্লব যেমনই হোক, তোর না পড়াশুনো করার কী আছে?
ট্যাকট্যাক করিস না তো। বসতে ইচ্ছে না ভুলে যা ভাগ, কেটে পড়। রাজ্যশ্রীদের গলা জড়িয়ে হিহি কর।
নতুন ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে। এক ঝাঁক এসে এমন কিচিরমিচির শুরু করল, লাইব্রেরির সামনে আর তিষ্ঠোনো যাচ্ছে না। এরই মধ্যে বাড়ি থেকে ফোন। মা।
কী রে? কী খবর?
গলা ভারিক্কি করে তিতান বলল,— গিয়ে বলব।
পাশ করেছিস তো?
বললাম তো, গিয়ে বলব।
কখন আসছিস?
বলতে পারছি না।
কট্ করে ফোনটা কেটে দিল তিতান। বিস্বাদ মেজাজ এখন নিমতেতো। মাকে বড় কায়দা মেরে বলেছিল, পাশ ফেল নিয়ে ভাবতে হবে না… ফিরে কী বলবে এখন?
চিন্তিত মুখে উঠল তিতান। করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টের পেল মাঝপথে শ্রেয়া ভিড়ে গেল একটা দলে। তিতান যেন দেখেও দেখল না। সোজা চলে গেছে কলেজের অফিসরুমে। হ্যাঁ, উৎপলবাবুর টেবিলে পৌঁছে গেছে মার্কশিট। সামনে যতীনবাবুকে বসিয়ে দু’জনে মিলে মার্কস তুলছে জাবদা খাতায়।
উৎপলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল তিতান। বলল,— কাইন্ডলি আমার মার্কগুলো একটু দেখব?
এখন না, এখন না। দু’হাত নেড়ে উৎপল বলল,— শান্তিতে কাজটা ফিনিশ করতে দাও।
একটা মার্কশিট বার করতে কী এমন অসুবিধে? তিতান পলকে সায়র মিত্র। কোমরে হাত রেখে বলল,— প্রিন্সিপালের অর্ডার আনতে হবে নাকি?
উফ্, কী যে করো না…! উৎপল এক ডোজেই নরম। রোল নাম্বার ঘেঁটে বার করেছে কাগজটা। বলল,— চটপট দেখে দাও।
দেখার অবশ্য বিশেষ কিছু নেই। নম্বরগুলোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। দশ, বারো, ষোলো…। শুধু কম্পালসারি গ্রুপটাই চলনসই। পরিবেশবিদ্যায় মাত্র তেরো!
তিতান দুর্বল পায়ে বেরিয়ে এল। বুকে বুঝি ক্ষীণ আশা ছিল একটা, তাও ভেঙে চুরমার। দমাদ্দম হাতুড়ির ঘা পড়ছে মাথায়। এতক্ষণে বুঝি যেন তার ফেল করাটা সম্পূর্ণ হল। এবার কী করবে? কোথায় যাবে? বাড়ি? নাকি একবার পার্টি অফিসে…? পল্টুদা না বলেছিল…! কিছু একটা নিশ্চয়ই করতে পারবে পল্টুদা। কিন্তু এখন, এই সাড়ে তিনটে-চারটের সময়ে, ব্যস্ত মানুষটাকে কি পাওয়া যাবে?
প্রযুক্তির কল্যাণে যোগাযোগ এখন হাতের মুঠোয়। নম্বরও রয়েছে পল্টু বিশ্বাসের।
হ্যালো, পল্টুদা? সায়র বলছি।
আরে, কী খবর? তোমায় ক’দিন দেখছি না কেন?
এই তো, আজ যাব ভাবছি। আপনি থাকবেন? আপনার সঙ্গে একটা জরুরি দরকার ছিল।
চলে এসো। ঘণ্টাখানেক পর।
একটা ঘণ্টা যে এত লম্বা হয় তিতানের জানা ছিল না। ঘড়ির কাঁটা যেন লেংচে লেংচে চলছে। এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে বার দু’-তিন দেখতে পেল শ্রেয়াকে, অমিত-শ্রীমন্তদের সঙ্গেও মোলাকাত হল বেশ কয়েক বার, তিতান কথাও বলল দাঁড়িয়ে, কিন্তু সময় আর এগোয় না। শেষে ধুস্ বলে বেরিয়েই পড়ল কলেজ ছেড়ে। হাঁটছে। দুলে দুলে।
ভাদ্রের আকাশ বিচ্ছিরি রকমের নীল। রোদ এখনও গা জ্বালাচ্ছে। পাছে সূর্যকে ঢাকা দিতে হয়, মেঘেরা তাই বেবাক উধাও। এক রত্তি হাওয়া নেই। পচা গুমোটে গেঞ্জি জামা ঘামে জবজব। তিতানের অন্যমনস্ক পা ঠোক্কর খেল রাস্তায়। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কোনওক্রমে সামলেছে।
পল্টু বিশ্বাস আজ অফিসে একা। সাদা ফুলস্কেপ কাগজে কী যেন লিখছিল। তিতানকে বসতে বলে শেষ করল কাজটা। তারপর চোখ তুলেছে,— বলো কী ব্যাপার।
যা বলার বলল তিতান। শুধ নম্বরগুলো উচ্চারণ করল না। লজ্জা করল।
চোখ থেকে চশমা খুলে রুমালে মুছল পল্টু। ফের পরে নিয়ে বলল,— হুম, খুব দুর্ভাগ্যজনক। দেবাশিস কি ভাল নোট-ফোট দেয়নি?
টিউটোরিয়ালে আর যেতে পেরেছি কোথায়! প্রায় রোজই তো পার্টির কাজে…
আমি কিন্তু তোমায় আগাগোড়াই বলে আসছি, পড়াশুনোটা মাস্ট। টিউটোরিয়ালের ওপরও ডিপেন্ড করতে তোমায় মানা করেছিলাম। ঠিক?
অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। আপনাআপনি তিতানের ঘাড় ঝুলে গেল।
চেয়ারে হেলান দিয়েছে পল্টু,— এনি ওয়ে, আপসেট হোয়ো না। একটা পরীক্ষায় পাশ-ফেল এমন কোনও হাতিঘোড়া ব্যাপার নয়। ইনফ্যাক্ট, এক-আধটায় ফেল করাই ভাল। ব্যর্থতার আগুনই মানুষকে পুড়িয়ে সাচ্চা করে। আর আমরা সাচ্চা কমরেডই চাই।
কিন্তু আপনি যে বলেছিলেন… পরীক্ষার ব্যাপারটা… দেখবেন…
তুমি কী আশা করছ সায়র? পার্টি তোমার মার্কস বাড়িয়ে দেবে? এমন একটা অনৈতিক কাজ কি আমরা করতে পারি?
তিতান বলে ফেলল,— তা হলে আর কীভাবে সাহায্য করবেন?
শোনো সায়র, ইংরিজিতে একটা প্রবাদ আছে, গড হেলপ দোজ, হু হেলপ দেমসে্ভস্। আমরা তো ঈশ্বর মানি না, তাই আমরা বলি, পার্টি হেলপ দোজ, হু হেলপ দেমসেল্ভস্। তুমি কিন্তু নিজের কাজটা করোনি। এখন পার্টিকে দুষলে চলবে কেন?
এই নিশ্ছিদ্র যুক্তিজালের সামনে তিতানের কী বলার থাকে?
পল্টু কোমল গলায় বলল,— যাক গে, লং টার্ম গোলের কথা ভাবলে তোমার হয়তো আল্টিমেটলি উপকারই হল। ছাত্রফ্রন্টে তুমি একটা বছর বেশি কাজ করতে পারবে। … তুমি ভবিষ্যতের যোদ্ধা, এত অল্পে তোমার ভেঙে পড়লে চলবে?
বাক্যের কী অপরূপ মহিমা! মিইয়ে যাওয়া তিতান চাঙ্গা হচ্ছিল ক্রমশ। গলা ঝেড়ে বলল,— তা হলে পড়াশুনো স্টার্ট করি…
এ কি বলার অপেক্ষা রাখে নাকি? আরে, পাশ-টাশগুলো তো তোমাকে করতে হবে। তারপর তো আমরা আছি। সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেকে তো প্রফেসর করে দেওয়া যায় না! তাকে অন্তত এম এ-র গণ্ডিটা পার হতে হয়, ইউ-জি-সির ফ্যাকড়াগুলো সামলাতে হয়…। অর্থাৎ আমাদের ‘পিক অ্যান্ড চুজের’ জায়গাটায় তোমাকেই পৌঁছোতে হবে। তুমি যদি ভাবো স্কুলের চাকরির পরীক্ষায় পার্টি তোমার হয়ে লিখে দিয়ে আসবে, সেটা কি বাড়াবাড়ি নয়? আমরা নীতি মেনে চলি সায়র, ইন্টারভিউতে এলে তোমায় ঠিক তুলে নেব। বাট এই সব অ্যাশিওরেন্স তখনই খাটবে, যখন তুমি পার্টির মেশিনারির সঙ্গে খাপে খাপে মিশে যাবে। বুঝেছ কী বলতে চাইছি?
হ্যাঁ। আমি তো সাধ্যমতো করছি পল্টুদা।
জানি তো। তাই তো তোমায় এত স্নেহ করি। … যাক গে, একটা খবর দিই। শুনে আনন্দ পাবে। আমি ডিস্ট্রিক্ট কমিটিতে নমিনেটেড হয়েছি।
তাই? কনগ্রাচুলেশন্স পল্টুদা।
বুঝতেই পারছ, আমার দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। …আর কী, মনটা এবার ভাল করো। একটু চা-কফি খাও।
আরও যে কত কথা হল পল্টু বিশ্বাসের সঙ্গে। এ যেন ভীষ্মের পায়ের কাছে বসে যুধিষ্ঠিরের রাজনীতির শিক্ষা নেওয়া। শুধু পল্টু শরশয্যায় নেই, পার্টিতে এক ধাপ উঠেছে, এটুকুই যা তফাত। নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছিল তিতানের। পল্লব যা বলেছিল, এ যদি খাঁচাও হয়, তার জন্য দুঃখ কীসের? মানে মানে পাশটুকু করতে পারলে জলটা ছোলাটার তো অভাব হবে না। একই সঙ্গে ছাত্রফ্রন্ট আর পার্টি, দু’জায়গাতেই তার পা রইল।
সন্ধেবেলা তিতান যখন বাড়ি ফিরল, মনে গ্লানির ছিটেফোঁটাও নেই। বরং অবাক হয়েছে বেশ। হের্ পপ্ এসে গেছে জলদি জলদি! এবং বোতল খোলেনি এখনও! নিউজ দেখছে টিভিতে! পাশে মা! স্নায়ু টানটান রেখে নিঃশব্দে নিজের ঘরে যাচ্ছিল তিতান, বাবার গলার শব্দে দাঁড়িয়ে গেল,— ডাকছ?
তুহিনের কপালে ভাঁজ,— তোমার মার্কশিট পেয়েছ?
তিতান থমকাল। ঠিক এই প্রশ্নটির জন্য বুঝি প্রস্তুত ছিল না মগজ। একটু সময় নিয়ে বলল,—না। পরশু ইস্যু করবে।
হাতে এলে একবার দেখিও। আফটার অল, আমরা তো তোমার বাবা মা।
তুহিনের স্বর অদ্ভুত রকমের তাপহীন। জোর একটা ধাক্কা খেল তিতান। সে ধরেই নিয়েছিল, বাবা জোর হল্লাগুল্লা জুড়বে, পাত্তা না দিয়ে পালটা জবাব দিয়ে যাবে সে, নিজের ওজনটা বুঝিয়ে দিয়ে চুপ করিয়ে দেবে সকলকে। কিন্তু যারা নিজেরাই চুপ মেরে যায়, জেরা চোটপাটের ধার দিয়েই হাঁটে না, তাদের জন্য তো তিতানের স্নায়ু তৈরি নেই। তুহিনের দৃষ্টি ফের টিভিতে, কিন্তু তিতান যেন আর নড়তে পারছিল না। পা জোড়া বুঝি গেঁথে গেল মোজাইক মেঝেতে। প্রশ্নহীনতার চাপই যেন ক্ষণপূর্বের সায়র মিত্রকে বদলে দিচ্ছে তিতানে।
আশ্চর্য, নিজের অজান্তে হাত কচলাচ্ছে তিতান! অপরাধীর সুরে বলল,— এবার রেজাল্টটা খারাপ হয়ে গেল।
তুহিন ভারী স্বরে বলল,— হুঁ।
আমি এরকমটা এক্সপেক্ট করিনি।
হুঁ।
সামনের বছর ঠিক বেরিয়ে যাব। দেখে নিয়ে।
ভাল।
আর টিউটোরিয়ালের দরকার নেই।
তুহিন আর দোলার চোখ একযোগে ঘুরেছে তিতানে। বিস্ময়ে? বিরক্তিতে? হতাশায়? তিতান মা বাবাকে ঠিকঠাক পড়তে পারল না যেন। মাথা নামিয়ে বলল,— আমি নিজে নিজেই পড়ব।
যা তোমার ইচ্ছে। তুহিনের স্বরে ওঠাপড়া নেই,— কিছুই বলব না আর।
তিতান আস্তে আস্তে ঘরে চলে গেল। বিছানায় বসে শুনতে পাচ্ছিল, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মা। চাপা স্বরে বাবা কী যেন বলল, মা’র কান্না বাড়ল আরও। হঠাৎ দুটো গলাই থেমে গেছে। ও-ঘরে গ্লাস-বোতল সাজিয়ে বসল নাকি বাবা? পরিচিত ঝাঁঝালো গন্ধটা আসে না কেন?
খাওয়া-দাওয়া চুকে গেছে অনেকক্ষণ। কম্পিউটারে খুটখাট করছিল তিয়া, কখন সেও শুয়ে পড়েছে। গোটা ফ্ল্যাট নিস্তব্ধ, পাড়া নিঝুম, হঠাৎ হঠাৎ কুকুরের কোরাস ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই কোথ্থাও। আচমকা এক ট্যাক্সি এসে থামল আবাসনের গেটে। মিটারের টুং টাং ধ্বনি। ইঞ্জিনে কর্কশ আওয়াজ বাজিয়ে চলেও গেল গাড়িটা। রাত বাড়ছিল।
তিতানের ঘুম আসছিল না। বিচিত্র এক চাপান উতোর চলছে অন্তরে। গমগমে গলায় উপদেশ দিচ্ছে সায়র মিত্র, তাকে প্রাণপণে নস্যাৎ করতে চাইছে তিতান। সায়র ধমক দিচ্ছে, তিতান প্রতিবাদ জুড়ছে। কখনও সায়র জেতে, তো কখনও তিতান।
নাহ্, এ লড়াই বুঝি থামার নয়। অন্তত এক্ষুনি এক্ষুনি।
.
১৩.
অনেক দিন ধরেই খবরটা ভাসছিল বাতাসে। অবশেষে অর্ডারটা বেরোল। ভেনাস রবারের চিফ সেল্স ম্যানেজার পদে উন্নীত হয়েছে তুহিন মিত্র। আগামী সোমবার থেকে তাকে কাঁধে তুলে নিতে হবে দায়িত্বভার।
সঙ্গে সঙ্গে অফিসময় রটে গেছে বার্তা। অভিনন্দনের বন্যা বইছে। কেউ চেম্বারে এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেল, কেউ বা মোবাইলে।
কিন্তু অভিনন্দন কুড়িয়ে সময় কাটালে তো চলবে না তুহিনের, তাকে কাজও করে যেতে হচ্ছে সমানে। প্রথমেই সেল্স অফিসারদের নিয়ে একটা মিটিং সারল। শেষ হতে না হতেই ছুটল জি-এমের ঘরে। আবার মিটিং। সেখান থেকে এক রাশ ফরমান নিয়ে চেয়ারে ফিরতে না ফিরতেই স্থানীয় এক স্টিল কোম্পানির পারচেজ অফিসার উপস্থিত। আগামী লটের মালের দাম নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করল খানিকক্ষণ। সে উঠতে না উঠতে এম-ডির চেম্বারে ডাক। এখানে কী হচ্ছে, সেখানে কী হল, ওখানে সেটা হয়নি কেন…!
সওয়া দুটো নাগাদ একটু হাঁপ জিরোনোর সময় পেল তুহিন। গেছে ক্যান্টিনে। লাঞ্চ সারতে। অনাড়ম্বর আহার। টোস্ট, স্টু, স্যালাড, টক দই।
সবে চিকেন স্টুতে চামচ ডুবিয়েছে, টেবিলে অ্যাকাউন্টসের দিলীপ দত্ত। হাত বাড়িয়ে বলল,— কনগ্র্যাটস্। মেরে দিলেন তা হলে?
প্রায় সমবয়সি দিলীপের সঙ্গে কিঞ্চিৎ খাতির আছে তুহিনের। লোকটা তেমন কুচুক্কুরে নয়, কথাবার্তায় চালবাজিও কম।
তুহিন মৃদু হেসে বলল,— হ্যাঁ, শিকেটা শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ল।
রায়চৌধুরী তো শুনলাম খুব ফ্যাবুলাস অফার পেয়ে কোম্পানি ছাড়ল?
গুজব তো সেই রকমই। তবে টেক্-হোম শেষ পর্যন্ত কত পাবে, তা তো জানার উপায় নেই। অবশ্য স্টক অপশনও বোধহয় আছে কিছু।
আপনারও তো লিফ্ট ভালই হল।
এখনও ডিটেল হিসেব করিনি। মনে হয় ফিফটিন টু টোয়েন্টি হাইক হবে। অফকোর্স ট্যাক্স বাদ না দিয়ে।
ট্যাক্স ধরলেও দশের কম তো নয়। আমাদের জমিয়ে একটা ট্রিট দিন। ফাইভ স্টার-ফার চাই না, যেখানে ঘ্যাম করে মাংস-টাংস রাঁধে, সেরকম কোনও জায়গায়। আর এবার চোখকান বুজে একটা গাড়ি কিনে ফেলুন।
এমন এক বাসনা তুহিনের মাথাতেও ঘুরছে বটে। কিন্তু কেনা তো সমস্যা নয়, মেনটেন করাটাই ঝামেলার। নিজে গাড়ি চালানো শেখেনি, এই বয়সে আর হবেও না, ড্রাইভারই তো খেয়ে নেবে হাজার তিনেক। ফ্ল্যাটের লোন ছ’বছর টানতে হবে এখনও। সঙ্গে আরও একটা দেনা যোগ করবে কিনা দশবার ভাবা দরকার। তাও স্রেফ অফিসে আসা-যাওয়ার জন্যে। ছুটির দিনে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রমোদভ্রমণে যাবে, এমন সৌভাগ্য তো করে আসেনি তুহিন! তবু কেনার ইচ্ছেটা জাগে। নিজের গাড়িতে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে তুহিন, এ দৃশ্য কল্পচোখে দেখতেও তো আরাম। সেই তুহিন, কীটপতঙ্গের মতো বেঁচে থাকা এক কেরানির ছেলে তুহিন…!
মুখে অবশ্য তুহিন বলল,— কী হবে দত্ত, এঁড়ে গরু কিনে?
কেন কিনবেন না? এবার তো তেলের পয়সা পেয়ে যাবেন!
ক’টাকা দেবে? এ তো মাল্টিন্যাশনালের চাকরি নয় রে ভাই, সিলিং বাঁধা।
আহা, একটু হিসেব-টিসেব রেখে চালাবেন। দিলীপ হাসছে,— গাড়িও তো আপনি ভাল ডিসকাউন্টে পেয়ে যাবেন। আপনার মেয়ে আছে না?
ছিল। লেফ্ট। শি ইজ ইন বিজনেস নাউ।
ওইটুকু মেয়ে ব্যাবসা করছে? কী ব্যাবসা?
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট।
বাহ্, দারুণ লাইন। আজকাল তো সার্ভিস সেক্টরেই পয়সা। হাওয়ায় হাওয়ায় টাকা আসে। আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের মতো বাজার নিয়ে কাঁটা হয়ে থাকতে হয় না। জাপানে রিসেশন, আমরা কাঁপছি। আমেরিকা যুদ্ধে নামল, আমাদের তালু শুকিয়ে গেল। দিলীপের সামনে মশালা বোসা। ভেতরের পুরটা চামচে দিয়ে খুঁটতে খুঁটতে বলল,— যাই হোক, আপনার কন্যাটি তার মানে বেশ চইয়ে-বইয়ে হয়েছে!
তারিফটা শুনতে ভাল লাগল তুহিনের। আবার কোথায় যেন একটা চিনচিনে কষ্টও হল। মেয়ের এই চালাকচতুর হওয়ার পিছনে তার কোনও ভূমিকা আছে কি? চিরকাল শুনে এসেছে, বাবা-মেয়ের নাকি একটা আলাদা ভালবাসার সম্পর্ক থাকে, তিয়ার সঙ্গে তেমনটা তার হল কই? একটু যেন তফাতে তফাতেই রইল মেয়ে, মনপ্রাণের কথা বলে না তুহিনকে তিয়ার কোনও ইচ্ছেতেই সে কখনও বাধা দেয়নি, কিন্তু মেয়ে তাকে আদৌ আপন ভাবে কি? ভাবলে মুখের ওপর টাকাগুলো ফেলে দেয়? বাবাকে দেনা শোধ করতে মরিয়া, এ কেমন মেয়ে?
তুহিন আলগা হাসল,— ওই আর কী। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
প্রার্থনা করুন, যেন দাঁড়িয়ে যায়। মেয়েরা রোজগেরে হলে বাপ-মা’র মঙ্গল। মেয়েদেরই মনে একটু মায়াদয়া আছে, শেষ জীবনটা হয়তো বুড়োবুড়িকে দেখবে। ছেলেরা তো ফার্স্ট চান্সেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হাওয়া।
হায় রে, সে সম্ভাবনাও যদি থাকত! হাওয়া তো হবেই না তিতান, ঘাড়ে বসেই খাবে। বরং বাপ-মাকেই না শেষমেশ ঘেঁটি ধরে আউট করে দেয়! সেদিন তো অন্য দাওয়াই দিয়েও দেখল তুহিন। তখনকার মতো সুবোধ বালক হয়ে প্রতিশ্রুতি দিল, এবার থেকে মন দিয়ে পড়বে, অথচ তার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? পার্টি স্বর্গ, পার্টি ধর্ম, পার্টি হি পরমতপঃ, জপ করতে করতে নেচে বেড়াচ্ছে। পার্টি যে ওই মাথামোটা ছেলেকে ছিবড়ে করে ফেলে দেবে, এটুকু বোঝার বুদ্ধি ঘটে থাকলে তো। ভাবছে পার্টি ওর মই। ওদের মতো গাড়োলদের কাঁধেই যে মইটা চাপানো থাকে, এ বোধ যে ছেলের কবে গজাবে?
খাওয়া সেরে উঠে পড়েছে দিলীপ দত্ত। বেসিনে মুখ ধুতে ধুতে চেঁচাল,— এখন কি আবার মিটিং?
আর কী, এখন তো অফিস মানেই মিটিং। অবিরাম মিটিং। ঘনঘন মিটিং। তুহিন জোর করে হাসল,— এই তো, এক্ষুনি মহেশতলায় ছুটব। কয়েকটা ডেলিভারি শিডিউল নিয়ে ওয়ার্কস ম্যানেজারের সঙ্গে বসতে হবে।
দৌড়োন তা হলে।… খ্যাটনটার কথা কিন্তু ভুলবেন না। কবজি ডুবিয়ে মাংস…
তুহিনও টেবিল ছাড়ল। চেম্বারে ফিরে জিরোল না আর, ব্রিফকেস গুছিয়ে সোজা কারখানা। অফিস ফিরতে প্রায় সন্ধে। জি-এম দেখা করে যেতে বলেছিল, এসেই দৌড়েছে তার গুহায়।
বছর পঁয়তাল্লিশের ব্যাকব্রাশ চুল, ঝাঁটাগোঁফ, সুরেশ গুলাটি আজ বেশ খোশমেজাজে। আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছিল কফিতে। জিজ্ঞেস করল,— চলবে?
তুহিন হাত তুলল,— নো, থ্যাঙ্কস।
তারপর বোলুন, কেমোন ফিল করছেন অর্ডারটা পাওয়ার পর? অফকোর্স ইটস নট এ সারপ্রাইজ ফর ইউ?
সত্যি বলতে কী, তুহিনের তো তেমন কোনও প্রতিক্রিয়াই হয়নি। হয়তো বা মস্তিষ্কে প্রতিক্রিয়া জাগানোর কোষগুলোই অকেজো হয়ে গেছে তার। এখন তো প্রোমোশন মানে স্রেফ ঘর বদল, নয় কি? তবু সৌজন্য দেখিয়ে বলল,— ভালই তো লাগছে।
ম্যাডামকে গুড নিউজটা শুনিয়েছেন?
দোলাকে আদৌ বলবে কিনা তাও জানে না তুহিন। তবে এবারও অবলীলায় ডাহা মিথ্যে ঝেড়ে দিল,— শিয়োর। শি ইজ হ্যাপি।
কফি শেষ করে সুরেশ হঠাৎ টানটান,— নাউ লেটস টক শপ। সকালে আমি ডিসকাস করিনি, লাস্ট বোর্ড মিটিংয়ের দুটো ডিসিশন আপনাকে জানানো বহুত জরুরি। ফার্স্টলি, আমাদের হাফ ইয়ার্লি টারগেটের থেকে আমরা কিন্তু পিছিয়ে আছি। শর্টফল নিয়ে বোর্ড মেম্বারস আর ওয়ারিড। সেকেন্ডলি, সেল্সের স্টাফ প্যাটার্নটাকে রিস্ট্রাকচারিং করতে হোবে।
ও। তুহিনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল,— ছাঁটাই-ফাঁটাই…?
ওয়েল, ইট মে বি ভি-আর অলসো। নট ইয়েট ডিসাইডেড। মিনিমাম যা না রাখলে নয়, তার বেশি ভেনাস রবার রাখতে চাইছে না। কে কে না থাকলেও চলে, তার একটা লিস্ট বানান। অফকোর্স, নতুন পোস্টে জয়েন কোরার পর। মেক এ লিস্ট অব টেন উইথ দেয়ার পারফরমেন্স রিপোর্ট। তারপর দেখি কী কোরা যায়।
কী শুরু! তুহিন একটা শ্বাস চাপল। নতুন চেয়ারে বসেই হাতে রক্তের ছিটে! তবু বাধ্য জল্লাদের মতো ঘাড় নাড়ল তুহিন,— হয়ে যাবে।
উইদিন নেক্সট উইক দিয়ে দিন। সুরেশ গদিমোড়া চেয়ারে হেলান দিয়েছে। মুচকি হেসে বলল,— আপনার আর একটা কাজ আছে। রাউরকেল্লার ডি-কে স্টিল ইন্ডাস্ট্রির জি-এম কামিং উইকে কলকাতা আসছেন।
মিস্টার সাহু?
হাঁ। আমি থাকব না, চেন্নাই যাচ্ছি… আপনি প্লিজ ওঁকে অ্যাটেন্ড করবেন। সুরেশ চোখ টিপল, জানেন নিশ্চয়ই, হি ইজ উইডোয়ার?
জানি। বছর দুয়েক আগে ওঁর স্ত্রী ক্যান্সারে মারা গেছেন।
ঠিক।… সো প্লিজ লুক আফটার এভরিথিং।
সুরেশের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আপন মনে একটু হাসল তুহিন। গুলাটির ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধে নেই। তবে বউ মরেছে বলেই যে সাহু কলকাতায় এসে মেয়েমানুষের জন্য ছোঁকছোঁক করবে, তা তো নয়। ঘরে সুন্দরী বউ থাকা সত্ত্বেও এই হোমরা-চোমরাগুলো অধিকাংশই নারীমাংসভোজী। দেখে দেখে চোখ পচে গেল তুহিনের। এক সময়ে অবশ্য গা কিশকিশ করত, এখন আর তাপউত্তাপ জাগে না। সেই প্রথম বারের ঘটনাটা মনে পড়লে তো হাসি পায়। ধানবাদের সেই মাইনসের পারচেজের বড়কর্তা পদধূলি দিয়েছেন কলকাতায়, মুখ ফুটে বলেও ফেলেছেন সন্ধেবেলা তাঁর কী চাই। তুহিন তখন রবার ইন্ডিয়ায়, বয়স বড়জোর বছর তিরিশ, সবে তিয়া হয়েছে…। এমন একটা দাবি শুনে তার মাথায় বজ্রাঘাত। কী করবে, কোথায় খুঁজবে, কোথ্থেকে জোগাড় করবে, ভেবে ভেবে দিশেহারা। মরিয়া হয়ে দু’-চারজনকে ফোন করল, তারা এই মারে তো সেই মারে। শেষে অফিসের ঘোষ সুলুকসন্ধান দিয়ে তাকে উদ্ধার করল। তারপর তো আর এক গাড্ডায়। মেয়েটার হোটেলে আসার কথা সাতটায়, তুহিন কর্তাটিকে হুইস্কি খাইয়েই যাচ্ছে, খাইয়েই যাচ্ছে… আটটা বাজল, ন’টা… সে পাখি আর আসেই না! কর্তার রোষ এড়াতে শেষে হোটেলের গেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুহিন, ফুটপাথে কোনও মেয়ে দেখলেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে…। অবশেষে যখন চিড়িয়াটি এল, তুহিন প্রায় তার হাত চেপে ধরে, বাঁচালে মা! পরে অবশ্য সবই অভ্যেস হয়ে গেল। এখন তো কোনও সমস্যাই নেই। হাজারো এজেন্সি রয়েছে। নিজেও ফোন লাগাতে পারো, সেল্সের কাউকে টিপে দিলেও চলবে, ঠিক সময়ে, ঠিক জায়গায় চাহিদা মাফিক মাল পৌঁছে যাবে। কলেজগার্ল, গৃহবধূ, যা চাইবে তাই। অভাব-অনটন আজকাল আর বড় কথা নয়, এখন তো এটা স্রেফ উপরি রোজগারের রাস্তা। দিনে দিনে শহরটা কী যে হয়ে গেল।
তা এই আক্ষেপ কি তুহিনের সাজে? শহর তো শুধু ইট-কাঠ-পাথর-মল্- ফ্লাইওভার নয়, শহর তো মানুষ। সেই মানুষই যদি বদলে যায়…! তুহিন নিজেও কি সেই নিস্পাপ তরুণ আছে এখনও?
টুকটাক চিন্তাগুলো মাথায় নিয়ে শেষ মুহূর্তের কাজ সারছিল তুহিন। ডেলিভারি শিডিউল ফ্যাক্স করার বন্দোবস্ত করল, চেক করল মেল, একটা টেকনো-কমার্শিয়াল টেন্ডারের বয়ানে চোখ বুলিয়ে নিল। একটু ভাল করে দেখবে বলে ফাইলটা পুরেই নিল ব্রিফকেসে।
মোবাইল বাজছে। বিশ্রী ধাতব ঝংকারটা থামানোর আগে তুহিন নম্বরটা দেখল। সুজয়।
কী রে, অফিসে? না বেরিয়ে পড়েছিস?
এই তো, বেরোব বেরোব করছি।
জানি, তুই শালা এখনও চেয়ারে সেঁটে। প্রেস থেকে ফিরছি, তোকে তুলে নেব?
নিয়ে?
একটু বসি কোথাও। কত দিন গপ্পোআচ্ছা হয় না।
স্কুলের তিন-চারজন সহপাঠীর সঙ্গে এখনও অল্পস্বল্প যোগাযোগ আছে তুহিনের। তাদের মধ্যে সুজয়ই ফোন করে ঘনঘন। কলেজ স্ট্রিটে সুজয়দের বিশাল ছাপাখানা। পারিবারিক ব্যাবসা। রমরমিয়ে চলছে। মাঝে বিশ-তিরিশ বছর তুহিনের খুব একটা খোঁজখবর রাখত না সুজয়। গত অঘ্রানে একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কৈশোরের বন্ধুত্বটাকে আবার চাগিয়ে তুলছে। প্রায়ই ডাকাডাকি করে পুরনো ইয়ার দোস্তদের। গল্পগাছা করে সুখ পায়।
দু’-এক পল ভাবল তুহিন। এখন বাড়ি ফিরেই বা তার কী কাজ? নিরানন্দ গৃহে ঢোকা মানেই তো দম আটকে আসা। মেয়ে নেই, ছেলে নেই, থাকলেও তারা এসে দুটো কথা বলবে কিনা সন্দেহ। আর বউ? সে তো এক নিষ্প্রাণ অস্তিত্ব মাত্র।
পাল্কা গলায় তুহিন বলল,— চলে আয় তা হলে। আমি অফিসের সামনেটায় আছি।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তুহিন ফুটপাথে। আলোয় আলোয় বাহার খুলেছে শহরটার। বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল, ভিজে পিচরাস্তা থেকে দ্যুতি ঠিকরোচ্ছে। খানিক তফাতে এক শপিংমলের চোখ ঝলসানো রোশনাই। এ দিকের বাসস্টপটা একটু যেন অন্ধকার। দাঁড়িয়ে আছে অফিসফেরতা লোকজন। তিন-চারটে সুবেশা মেয়েও। ওরা কি এ-পাশ ও-পাশের অফিস থেকে…? নাও হতে পারে অবশ্য। শহরটাই এখন মেয়েছেলের বাজার। কে ভদ্র, কে ধান্দেওয়ালি, ঠাহর করা দায়। সোনাগাছি, হাড়কাটা গলি যে কদ্দূর ছড়িয়েছে।
তুত্, যত্ত সব নোংরা চিন্তা। হলটা কী তুহিনের? দুনিয়ার কোনও ভালই কি তার চোখে পড়ে না? আজকালকার মেয়েরা কত স্বচ্ছন্দ হয়ে গেছে, কঠোর পরিশ্রম করছে, তিয়ার মতোই…! মেয়ের কথা স্মরণে আসতেই তুহিন ঈষৎ মেদুর। দোলা সেদিন বলছিল, তিয়া নাকি একজনকে পছন্দ করেছে, হয়তো বিয়ে করবে…। তিয়ার দাম্পত্য জীবন নিশ্চয়ই তুহিনদের মতো হবে না! বড্ড হেডস্ট্রং মেয়ে, মানিয়ে-গুনিয়ে চলতে পারবে তো?
সুজয়ের বড় গাড়ি হর্ন বাজাচ্ছে। উঠে নরম সিটে শরীর ছেড়ে দিল তুহিন। ডাইভার স্টার্ট দিতেই জিজ্ঞেস করল,— যাবি কোথায় এখন?
আমাদের ক্লাবে চল। উইক-ডে তো, ক্লাবটাই নিরিবিলি।
রেনবো ক্লাব দক্ষিণ কলকাতায়। এক বহুতল অট্টালিকার একতলা, দোতলা জুড়ে। ব্যাঙের ছাতার মতো সদ্য গজিয়ে ওঠা আর পাঁচটা ক্লাবের মতো, আভিজাত্য বা ঐতিহ্য না থাক, ঠাটঠমক আছে দিব্যি। হালফ্যাশনের ঝাড়বাতি, কাচ বসানো থাম, বিদেশি কেতার আধুনিক আসবাব, শরীর জুড়োনো শীতলতা…। ইনডোর গেমস, জিমন্যাশিয়াম, লাইব্রেরি, সবই আছে মাপ মতো।
তুহিনকে নিয়ে দোতলার টেরেস্টায় বসল সুজয়। মনোরম পরিবেশ। গাছ-টাছ দিয়ে সুন্দর সাজানো জায়গা।
শৌখিন গার্ডেন-চেয়ারে হেলান দিয়ে তুহিন প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলল,— এরকম একটা ক্লাব-ফাবের মেম্বারশিপ নিলে হয়।
নে না। আমি তো আগের দিনই তোকে বললাম। সেক্রেটারির সঙ্গে আমার ভাল খাতির, এখন লাখের কমে নিচ্ছে না, তুই পঁচাত্তরে এনট্রি পেয়ে যাবি।
ওরে বাবা, সে তো অনেক টাকা!
টাকা টাকা করেই গেলি। কী হবে যখের মতো আগলে রেখে? উড়িয়ে পুড়িয়ে সাফ করে দে।
এমন দর্শন সুজয় আওড়াতেই পারে। একে তার টাকায় ছাতা পড়ছে, তার ওপর মেয়ের বিয়ে দিয়ে সে এখন ঝাড়া-হাত-পা। কিন্তু তুহিনের দায়দায়িত্ব তো চিতেয় ওঠা পর্যন্ত ফুরোবে না। সন্ধেবেলা এইসব জায়গায় খানিকটা সময় কাটালে ভালই লাগে, তবে এই বিলাসিতা তুহিনের জন্য নয়। টাকাটা অপচয় ভেবে সারাক্ষণ গা কুটকুট করবে যে।
তুহিন হেসে বলল,— তুই ওড়া। আমি তোর পাশে আছি।
কিপটের হদ্দ!… যাক গে, কী নিবি বল?
যা খুশি। তুহিন কাঁধ ঝাঁকাল। পলকের জন্য ভাবল প্রোমোশনের কথাটা সুজয়কে বলে, উৎসাহ পেল না। আলগা ভাবে বলল,— বিয়ার নিতে পারিস। ঠান্ডা ঠান্ডা।
ভাল আইডিয়া। ভাদুরে গরমটা বড় জ্বালাচ্ছে।
বেয়ারাকে ডেকে দু’বোতল বিয়ারের অর্ডার দিল সুজয়। সঙ্গে কাবাব। সিগারেটের প্যাকেট বার করে রাখল টেবিলে। তুলে একটা ধরিয়ে প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়েছে বন্ধুকে।
তুহিন বলল,— থাক না। আমি তো খাই না বড় একটা।
আমিও কি বেশি খাই? তোল, তোল। সিগারেট খাওয়াটা তুইই আমায় শিখিয়েছিলি, মনে আছে?
নেই আবার! স্কুলের টিফিনটাইমে বাথরুমে গিয়ে…। তখন তো এইট, তাই না?
উঁহুঁ নাইন। তুই ব্যাটা চিরকাল কিপটের যাশু… কোথ্থেকে একটা সস্তার সিগারেট… ভয়ংকর কড়া… টান দিতে গিয়ে শালা আমার বল দুটো টাকে উঠে গেছিল মাইরি!
তুই শালা পুরো ভোম মেরে গিয়েছিলি। মুখ লাল-টাল করে…
তুহিন গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল। বহুকাল পর। একমাত্র স্কুলের বন্ধুদের সান্নিধ্যেই বুঝি এমন হাসি আসে। চুয়ান্ন বছর বয়সেও। হাসতে হাসতেই তুহিন দেখছিল নীচের সুইমিং পুলটা। থলথলে বপু নিয়ে দুটো লোক দাপাদাপি করছে নীল জলে। দু’খানা বাচ্চা হাতির মতো। দৃশ্যটা ইশারায় দেখাল সুজয়কে। দুই বন্ধু আরও জোরে হেসে উঠেছে।
বিয়ারের বোতল হাজির। সন্তর্পণে দু’গ্লাস ভরতি করে ঢালল সুজয়। গ্লাস উঁচু করে বলল,— চিয়ার্স।
তুহিনের মেজাজ আশ্চর্য রকমের ফুরফুরে হয়ে গেছে। গ্লাসে গ্লাস ঠুকে বলল,— চিয়ার্স টু আওয়ার চাইল্ডহুড।
বড় একটা চুমুক দিয়ে সুজয় বলল,— স্কুলের খবর কিছু রাখিস?
কী হয়েছে?
এ-বছর প্ল্যাটিনাম জুবিলি। একটা গালা কিছু করতে হবে। তুই তো শালা অ্যালাম্নির মেম্বারও হোসনি।
হয়ে যাব।
স্কুলের দশা দেখেছিস? বিল্ডিংটা তো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। কত ভাল ভাল স্টুডেন্ট ছিল আমাদের সময়ে!… বাংলা মিডিয়াম স্কুল তো, এখন ঝি-চাকরের ছেলে ছাড়া কেউ পড়তে যায় না। স্ট্যান্ডার্ড একদম ফল করে গেছে।
তো?
তো মানে? উই মাস্ট ডু সামথিং।… লাস্ট অ্যালাম্নি মিটিংয়ে আমরা ঠিক করেছি, মোটা টাকা ডোনেট করব স্কুলে। বিল্ডিংটাও রিপেয়ার হবে, কয়েকটা কম্পিউটার কিনে দেব…। তুই দু’হাজার দিবি।
হাজার।
শালা সেল্সে চাকরি করে দর করাটা স্বভাব হয়ে গেছে, না? নো আরগুমেন্ট। মিটার তা হলে আরও চড়ে যাবে কিন্তু।
আচ্ছা আচ্ছা, হবেখ’ন। তুহিন অনাবিল হাসছে,— আর কী প্ল্যান?
একটা বড় ফাংশন করব। লিডিং আর্টিস্ট-ফাটিস্ট এনে। প্লাস, একটা স্যুভেনির। আমি তো অ্যাড দিচ্ছি, তুইও কয়েকটা জোগাড় কর। বলতে বলতে সুজয়ের প্রবল আবেগ এসে গেছে,— আয় না, সবাই মিলে একটু খাটি। আমি অন্তত পুরনো একশো জনের সঙ্গে কনট্যাক্ট করেছি। অনেকেই খুব আগ্রহ দেখিয়েছে…
সুজয়ের আবেগ যেন তুহিনকেও গ্রাস করছে ক্রমে ক্রমে। হয়তো কালই কথাগুলো হাস্যকর মনে হবে, তবু এই মুহূর্তে তারও উচ্ছ্বাসে কোনও কৃত্রিমতা নেই। টেবিলে হাত ঠুকে বলল,— আছি, আমিও আছি সঙ্গে। এখন আমি ভেনাস রবারের চিফ সেল্স ম্যানেজার, দ্যাখ না বিজ্ঞাপনে কেমন ফ্লাড করে দিই।
তুই চিফ হয়েছিস? কবে?
আজই।
হোয়াট আ গ্রেট নিউজ!… তা হলে বিয়ার তো আর চলে না রে, শ্যাম্পেন খুলতে হয়।
মুখ ফসকে সংবাদটা বেরিয়ে যেতেই একটু সংকুচিত হয়ে পড়েছে তুহিন। লজ্জা লজ্জা মুখে বলল,— ধ্যাত, সিন ক্রিয়েট করিস না। বরং হুইস্কি বল।
বিয়ারের পর হুইস্কি? বাহ্, জমে যাবে।
শুধু হুকুমের অপেক্ষা, মদিরা এসে গেল টেবিলে। চলছে পান, চলছে কথা। কখনও বা স্মৃতি রোমন্থন। কখনও লঘু আলাপন।
হঠাৎই সুজয় বলল,— রোববার কী করছিস? চলে আয় না আমার বাড়ি।
কেন?
একটু খাই-দাই করব। অঞ্জন দীপকদেরও ডাকছি। সবাই মিলে বউ-টউ নিয়ে… দুপুর দুপুর আমার গাড়িটায় সদলবল…
দোলা কি আসবে? সংশয় আছে তুহিনের।
তবু তুহিন আগ্রহভরেই জিজ্ঞেস করল,— কোথায় যাবি?
আছে, আছে। সুজয় চোখ নাচাল,— সাসপেন্স।
হেঁয়ালি ছাড় তো। ঝেড়ে কাশ।
ফার্স্ট সোজা ডায়মন্ড হারবার। ওখানে শর্ট ব্রেক, চা-ফা খেয়ে আবার এগোনো। কুলপির কাছে গিয়ে আমরা ঘুরব ডাইনে। ওখানে আমি একটা ফ্যান্টাস্টিক স্পট আবিষ্কার করেছি। একদম গঙ্গার ধারে।
তারপর?
তোরা জায়গাটা দেখবি। ওখানে জমি কিনছি আমি। তিন-চার বিঘে মতন। সুজয় ঠোঁট ছুঁচোলো করল,— মাথায় একটা আইডিয়া ঘুরছে, বুঝলি। ওখানে যদি ছোট ছোট কয়েকটা কটেজ বানাতে পারি… ধর একটা বৃদ্ধাবাস মতন…
তার জন্য কুলপি কেন বাছা? কলকাতা কী দোষ করল? অদ্দূরে, ধ্যাধধেড়ে গ্রামে…
উঁহুঁ। বল, নিরালায়। নির্জনে। আমি তো সোশাল সার্ভিস করছি না? নিজেদের জন্য বানাতে চাইছি। আই মিন, আমি আর বীথি, তুই, তোর বউ, দীপক অঞ্জনরাও উইথ ওয়াইফ…
কী করব সেখানে? খোল-করতাল বাজাব?
আরে ব্যাটা, সবাই মিলে বুড়ো বয়সে একসঙ্গে থাকব। সুজয়ের স্বর সহসা উদাস,— আমার আর বীথির তো বন্ধন চুকেই গেছে, পাঁচ-সাত বছর পর তোদেরও একই হাল হবে… মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে, ছেলে ছেলের মতো সংসারী… আমরা বাপ-মা তো সেখানে বাড়তি। তখন জীবনের বাকি ক’টা দিন নিজেদের মতো করে থাকা, আনন্দ করা…। ইচ্ছে হল বাগান করলাম, নয়তো গঙ্গার ধারে চুপচাপ বসে রইলাম…। জায়গাটা তো দেখিসনি তোরা, সে যে কী সুন্দর! সূর্য যখন ডাবে, নদী লাল হয়ে যায়, আর সারাদিন জলের ছলাতছল শব্দ…।
তুহিনের নেশা নেশা চোখে এক প্রশান্ত ছবি। দীর্ঘ ম্যারাথন দৌড়ের পর ঠিক যেমন একটা বিরামভূমিতে পৌঁছোতে সাধ যায় মানুষের। কিন্তু দোলা তখন তুহিনের পাশে থাকবে কি? অংশু রায়ের স্মৃতি ছেড়ে আর কি কখনও ধরবে তুহিনের হাত? অবশ্য তুহিনের হাতও তো এখন ময়লা। দুগ্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, চামেলি, কামিনী… কত যে শরীর…! তার মতো পাপিষ্ঠের পাশে বসবে কি দোলা? গঙ্গার ধারে… কলকল বয়ে যাচ্ছে নদী… মৃদুমন্দ বাতাস বইছে… দোলার চুল উড়ছে হাওয়ায়…!
তুহিনের কান্না পাচ্ছিল। হবে না…। হবে না…।
.
১৪.
শরতের সন্ধ্যা গাঢ় হয়েছে অনেকক্ষণ। আলো ঝলমল হস্তশিল্প মেলাপ্রাঙ্গণের একটু ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল তিয়া। খানিক তফাতে সূর্য, কানে মোবাইল, হাতে হেলমেট। দু’জনেরই চেহারা বিধ্বস্ত, রণক্লান্ত সৈনিকের মতো। একটাই যা সান্ত্বনা, আজকের মতো সাঙ্গ হয়েছে কাজ। এবার পাততাড়ি গুটিয়ে বেরোনোর পালা।
মোটামুটি বড় একটা কাজের বরাত ছিল আজ। ইভিটা পত্রিকার উদ্যোগে রান্নার ওয়ার্কশপ, যুগ্ম প্রায়োজক অনুরাগ বাদাম তেল। শুরু হয়েছিল আড়াইটেয়, চলল পাক্কা সাড়ে তিন ঘণ্টা। দারুণ জমেছিল আজ অনুষ্ঠান। মেলার ছোট্ট অডিটোরিয়াম প্রায় টইটম্বুর, না হোক শ’দেড়েক মহিলা তো এসেছিলই। যে সে ব্যাপার তো নয়, সাত তারা হোটেলের প্রধান পাচক রাহুল শেনয় স্বহস্তে তিন তিনখানা পদ বেঁধে দেখাল। ইয়াখানি পোলাও। ফিশ রেশমি কাবাব। কড়াই চিকেন। চমৎকার বাক্চাতুর্য আয়ত্ত করেছে রাহুল, রসবোধও আছে দুর্দান্ত, রান্নার ফাঁকে ফাঁকে কত যে মজার গল্প শোনাল। হাত খুনতি নাড়ছে, মুখ চুটকি ছাড়ছে, আর নানান বয়সের মহিলা গড়িয়ে পড়ছে হাসিতে। প্রোগ্রামের চটক বাড়ানোর জন্য টিভিতারকা রিমা রায়কেও আনা হয়েছিল, রাহুল সমানে খুনসুটি করে গেল তার সঙ্গে। রন্ধন, আর অভিনয়, দুই শিল্পের যুগলবন্দিতে করতালি বাজল মুহুর্মুহু। দর্শক আর শিল্পীর মাঝে যোগাযোগ রক্ষা করতে তিয়া আর সূর্যকেও ছুটে বেড়াতে হল গোটা অডিটোরিয়াম। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ, শিল্পীদের কাছে তাদের প্রশ্ন পৌঁছে দেওয়া, এসবও তো কানেক্টিভিটির কাজের অঙ্গ।
মূল অনুষ্ঠানের পর রিমা আর রাহুল দু’হাতে অটোগ্রাফ বিলোল খানিকক্ষণ। নারীবাহিনীর হাত থেকে তাদের উদ্ধার করে গাড়িতে তুলে দিয়ে এল তিয়া। উপহার আর প্রায়োজকদের রকমারি গিফ্ট ভাউচার সমেত। এবং অবশ্যই নগদানগদি টাকা, উপস্থিতির সম্মানদক্ষিণা। এরপর ডেকরেটর ইলেকট্রিশিয়ানদের মাল বুঝিয়ে দাও রে; অনুরাগ তেল কোম্পানির অফিসাররা সন্তুষ্ট হল কিনা তার খোঁজখবর নাও রে, এজেন্সি থেকে আনা ছেলেমেয়েদের ছাড়ো রে… ঝঞ্ঝাটের অন্ত নেই। সেই সকাল ন’টা থেকে দৌড়ঝাঁপ শুরু, এখন সাড়ে সাতটা, তিয়ারা যে শ্রান্ত হবে, এ আর বিচিত্র কী!
ফোন শেষ করে শরীরটাকে একটু ঝাঁকাল সূর্য। বোধহয় হাড়গোড়গুলোকে স্বস্থানে ফেরাল। তিয়া কফি খাচ্ছে দেখে বলল,— আমার জন্য নিলে না?
খাবে তুমি?
দিনটাই তো কফির ওপর চলছে। হোক আর এক কাপ।
পাশের স্টল থেকে উষ্ণ পানীয় নিয়ে এল তিয়া। সূর্যকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,— কার সঙ্গে কথা বলছিলে? ইভিটা?
আর কে! একটা ভারবাল রিপোর্ট দিয়ে দিলাম। সঙ্গে তাগাদাটাও সেরে রাখলাম।
পুজোর আগে কি ছাড়বে পেমেন্ট? মেলার গেটের দিকে এগোতে এগোতে তিয়া বলল,— মনে তো হয় না।
দেখা যাক। বলল তো, কাল লাস্ট আওয়ারে গিয়ে রিপোর্ট-টিপোর্ট জমা দিতে। সঙ্গে বিলও। সূর্য টেরিয়ে একবার দেখল তিয়াকে,— আমি কিন্তু জমা দিয়েই খালাস। পেমেন্টের তাগাদা তুমি করবে। চান্স পেলেই শোনাবে ফিনানশিয়াল ম্যাটার আমি একা কন্ট্রোল করি, ওটি আর হচ্ছে না। নিজে যাও, হাইহিলের সুখতলা ক্ষয়াও।
তিয়া মুচকি হেসে বলল,— দেখুন স্যার, আমি কিন্তু আজ হিলস পরিনি। স্নিকারস।
মোল্ডেড রাবার-সোলেরই বারোটা বাজাও দৌড়ে দৌড়ে। আমি অফিসে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকব, আর শুধু ফোন করে যাব। ও কে?
খিলখিল হেসে উঠল তিয়া। পরপর কয়েক দিন তিয়ার দাবড়ানি খেয়ে বাবুর বুঝি একটু গোঁসা হয়েছে! চান্স পেলেই এরকম পিন ফোটাচ্ছে পুটপাট। তবে সিধে হয়েছে অনেকটা, দুমদাম আর হুকুম ঝাড়ে না। তিয়ার পরামর্শও শুনছে মন দিয়ে। এক দিক দিয়ে এটা তো ভালই, নিজের নিজের পজিশনটা ক্লিয়ার থাকলে, পরে অনেক অশান্তি এড়ানো যায়। মুখে বলবে আধাআধি বখরা, অথচ সম্পর্ক হবে মনিব-চাকরের, এটা তো চলতে পারে না।
হাসতে হাসতেই তিয়া বলল,— বুঝেছি, বুঝেছি, তোমার খুব খিদে পেয়েছে।
উঁহুঁ, পেয়েছিল। পাস্ট টেন্স। এখন মরে গেছে।
সত্যি, ঝড় গেল বটে। এক দিকে সেলিব্রিটির নখরা সামলান, অন্য দিকে অডিয়েন্সকে গুড হিউমারে রাখা… লাইফ হেল হয়ে যাওয়ার জোগাড়।
বকবক করতে করতেই গেটের বাইরে দু’জনে। সূর্য জিজ্ঞেস করল,— এখন কী প্ল্যান?
তিয়া সূর্যর পিঠে হাত রাখল,— চলো আগে ভাল করে ফুয়েল নিই।
কী খাবে?
আমাকে চয়েস দিলে তো চাইনিজ। রাসবিহারী কানেক্টারে একটা গলতা খুলেছে, শুনছিলাম বেশ কোজি, ফুডটাও ভাল, এখনও তেমন ভিড়ভাট্টা নেই…
সূর্য ভাবল একটু। তারপর বলল,— সেই ভাল, একটু ফাঁকাতেই যাই। এখন আর লোকজন ভাল লাগছে না।
মোটরসাইকেলের সাইডবক্সে রাখাই থাকে তিয়ার হেলমেট। মাথায় চড়িয়ে চেপে বসতেই গতিময় হয়েছে দ্বিচক্রযান। ছুটছে মহানগরীর বাইপাস ধরে। দুর্গাপুজোর আর দেরি নেই, পরশু মহালয়া। এবার পুজো আশ্বিনের মাঝামাঝি, ভাদ্রের পচা গুমোট সরে বাতাসে সামান্য শিরশিরে ভাব। বুঝি বা ছুটি ছুটি গন্ধও। হাওয়াটায় আরাম হচ্ছিল তিয়ার, মুছে যাচ্ছিল ক্লান্তি।
নতুন চিনা রেস্তোরাঁটি ছোট, তবে বেশ ছিমছাম সাজানো। দেওয়ালে চৈনিক পেন্টিং, মৃদু বাতির ঢাকনিতে চিনা কারুকাজ, গোটা পাঁচেক টেবিলে বড়জোর জনা কুড়ির সংকুলান। কাস্টমারের মনোরঞ্জনের জন্য রঙিন টিভির ব্যবস্থাও আছে একখানা। চলছে হিন্দি নাচাগানা। নিচুগ্রামে।
হেলমেট রেখে বসতে বসতে সূর্য বলল,— যাহ্ বাবা, এ যে একেবারে জনশূন্য!
কোথায়! ওই তো একটা কাপ্ল। তিয়া চোখের তারা ঘুরিয়ে কোণের টেবিলটা দেখাল। তাদেরই মতো এক জোড়া জিন্স-টিশার্ট টেবিলে প্রায় ঝুঁকে পড়ে কথা চালাচ্ছে নিবিষ্ট মনে। রেস্তোরাঁয় আর কারও উপস্থিতিকে যেন গ্রাহ্যই নেই। তিয়াদের থেকে খানিক ছোটই হবে জুটিটা। গলা নামিয়ে তিয়া বলল,— ওরাও বোধহয় আমাদের মতো ক্রাউড অ্যাভয়েড করতে চায়।
হুম্। মাথার ওপর হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল সূর্য। চেয়ারে ঠেসান দিয়ে বলল,— তা হলে ম্যাডাম, লক্ষ্মীপুজো অবধি আমরা এখন বেকার।
কী আর করা। তিয়া ঠোঁট উলটোল,— একটাও শারদ-সম্মান তো ধরা গেল না।
নিরাশ হয়ো না বেবি। ওতে অনেক বেশি লোকবল লাগে। আমাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার আরও মজবুত করতে হবে। সামনের বার জান লড়িয়ে দেব।
টেবিলে ওয়েটার। খুদে চোখ, চ্যাপটা নাক, পাহাড়ি তরুণ। তিয়া মেনু-কার্ড উলটোতে উলটোতে বলল,— স্টার্টার কিছু নেবে? স্যুপ-টুপ?
যা বলবে, তাই খাব।
চিকেন অ্যাসপারাগাস স্যুপ বলি তা হলে? খেতে খেতে মেন কোর্সটা…
ওটাও এখনই বলে দাও না। পেটে স্যুপ পড়লেই খিদেটা ঝটাকসে বেড়ে যাবে।
ছেলেমানুষ না ছেলেমানুষ! তিয়া হাসল মুখ টিপে। খাচ্ছে না তো খাচ্ছে না… কাজে ডুবে থাকলে খাওয়ার কথাই বেমালুম ভুলে যায়। কিন্তু একটু রিল্যাক্সড হয়ে খেতে বসলে সূর্যকে থামানো মুশকিল। সেই বুঝে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্ডার দিল তিয়া। প্রন, চিকেন, মাশরুম, সব মিলিয়ে-জুলিয়ে।
নির্দেশ ছুড়ে তিয়া গুছিয়ে বসেছে। টিভিতে শাহরুখ-সুস্মিতার নাচ চলছে জোর। ম্যায় হুঁ না। সে-দিকে আলগা চোখ রেখে ফের কাজের কথায় এল,— শারদ সম্মানের কাজটা কিন্তু খুব চ্যালেঞ্জিং। একটা তুলতে পারলে কানেক্টিভিটির হেব্বি পাবলিসিটি হবে।
যাক গে যাক, দুগ্গা তো হল না, দেখি যদি সরস্বতীটাকে ধরতে পারি।
পুজোগুলোও আমাদের ওপর ছাড়ে না কেন বলো তো? তিয়া আহ্লাদি গলায় বলল,— ধরো যদি ম্যাডক্স স্কোয়্যার বা মহম্মদ আলি পার্কটা কানেক্টিভিটিকে দিয়ে দেয়…।
হব্বে, হব্বে। সব মোরগাই ফাঁসবে। আর দুটো বছর দ্যাখো, সব বড় বড় পুজো মাল্লু-টাল্লু কামিয়ে লোডটা আমাদের ট্রান্সফার করে দেবে।
আহা, তাই যেন হয়। তিরিশ-চল্লিশ লাখ টাকার পুজোর দশ পারসেন্টও যদি আসে… উফ, আমি ভাবতে পারছি না! তখন কিন্তু আমরা একটা ঝক্কাস অফিস নেব। ভাল কোম্পানিকে দিয়ে ইন্টিরিয়ার ডেকরেশন করাব। ফুললি এসি… অল দা ফারনিচার উইল বি স্লিক অ্যান্ড মডার্ন… ওই যে একটা ইটালিয়ান কোম্পানি আছে না, ওদের কাছ থেকে কিনব। তখন তোমার ওই টু-হুইলার বাতিল। তোমার একটা গাড়ি থাকবে, আমারও একটা…
হয়েছে, হয়েছে। স্বপ্নে এবার ব্রেক মারো। সূর্য হাসছে,— কাজের কথাটা শোনো। রুচির চেক আজকালের মধ্যে ক্লিয়ার হয়ে যাবে, মহালয়ার পর দিন তুমি পঁচিশ হাজার ড্র করে নিয়ো। বিজয় নীলেশের পুজোর পয়সাকড়িও সেদিন মেটাতে হবে।
আর তোমারটা?
আমিও নেব।… বিজয় নীলেশের কিন্তু এটা বোনাস নয়। এখন থোক একটা অ্যামাউন্ট পাবে, ফিনানশিয়াল ইয়ার কমপ্লিট হলে বোনাসের ব্যাপারটা সেটল করব।
হুম্।
তিয়া আনমনে মাথা দোলাল। পঁচিশ হাজার শুনতে বেশ লাগছে বটে, অন্য মাসের চেয়ে পরিমাণটাও বেশি, তবে দেওয়া-থোওয়াও তো কম নেই। গত বছর হাত ফাঁকা ছিল, পড়াটা চালাচ্ছিল তখন, কিন্তু এ-বছরটা তো অন্য রকম। এই পুজোতেই না সে প্রথম স্বাবলম্বী হল! মুখে না প্রকাশ করুক, সবাই নিশ্চয়ই মনে মনে আশা করবে। মা’র জন্য একটা দামি শাড়ি কিনবে। বাবাকে পাজামা-পাঞ্জাবির সেট। তিতানটাকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে না, বড্ড বেশি রং দেখায়… তবু ওর জন্য একটা জিন্স…। আর হ্যাপি হোমে এক ডজন শার্ট। একদম সস্তার নয়, তবে দেখতে হবে লটে কোথায় কমে পাওয়া যায়…। দিদাকেও শাড়ি দেবে? না ভাল দেখে বেডকভার? আর বাবলিটাকে কেপ্রি? নাকি স্কার্ট-ব্লাউজ? সব মিলিয়ে আট-দশ হাজার টাকার বাজেট তো আছেই। সূর্যকে কি দেওয়া যায়? সেদিন একটা মলে গিয়ে খুব রিস্টওয়াচ দেখছিল…
এত কী ভাবনা শুরু হল ম্যাডাম?
কিছু না। তিয়া নরম হাসল,— তোমার পুজোর কেনাকাটা নেই?
সূর্য চোখ নাচাল,— কী চাই তোমার? বলে ফ্যালো।
আমারটা ছাড়ো।… তোমার বাড়ির কথা বলছি।
ওসব ঝামেলায় সূর্য চ্যাটার্জি নেই। মা’র হাতে মাল ধরিয়ে দেব, যাও চরে খাও, যা খুশি শপিং করো। মা ভি হ্যাপি, ছেলে লায়েক হয়েছে।
যাহ্, হাতে টাকা দেওয়াটা মোটেই ভাল দেখায় না। বরং কিছু কিনে দিলে মা-টারা বেশি খুশি হয়।
তার জন্য দোকানে ঘুরে ঘুরে মা’র শাড়ি কিনব? কিংবা ড্যাডের ট্রাউজারস? পোষাবে না ডার্লিং।
আমি কিনে দেব। বাড়ির জন্য তো শপিং করবই, তুমিও থেকো সঙ্গে।
স্যুপ এসে গেল। গরম ধোঁয়া উঠছে। সূর্য অল্প টম্যাটো সস মেশাল, তিয়া চিলি। পোর্সিলিনের চামচে সামান্য স্যুপ তুলে ফুঁ দিতে দিতে তিয়া বলল,— অফিস কি লক্ষ্মীপুজো অবধি বন্ধ থাকছে?
এবার থাকুক। তবে ষষ্ঠীর দিন পর্যন্ত কিন্তু আমাদের যেতে হবে রোজ।
পুজোর আগে কি আর কোনও অর্ডার হবে?
চান্স নিতে হবে। খুচখাচ যদি এসে যায়… দোকান-টোকান ওপেনিং…। প্লাস, পেমেন্ট কালেকশন…।
ইভিটারটা মিলবে কি? হোপ দিল কিছু?
পুজোর সময়ে তো… পসিবিলিটি একটু আছেই। এখন তোমার ক্যালি।
আর কানেক্টিভিটির লাক।
হাসি-গল্পের মাঝেই এক পরিবার ঢুকেছে রেস্তোরাঁয়। বাবা, মা আর দুটো বাচ্চা। অবিকল একরকম দেখতে বাচ্চা দুটো। সম্ভবত যমজ। দুষ্টুমিতে দুটো ছেলেই সমান ওস্তাদ, এ-টেবিল ও-টেবিল দৌড়ে বেড়াচ্ছে। জিন্স জুটি কোল্ড-ড্রিঙ্ক নিল। একই বোতলে দু’খানা স্ট্র। ফুড়ুক ফুড়ুক টানছে, আর ফিকফিক হাসছে দু’জনে। কাউন্টারের বাঙালি ম্যানেজার, মালিকও হতে পারে, চ্যানেল ঘুরিয়ে দিল। টিভিতে এখন ক্রিকেট। পুরনো ম্যাচ। ইন্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া।
সচিন বোল্ড। দ্রাবিড় নামছে। তিয়া টিভি থেকে চোখ সরিয়ে নিল। স্যুপ শেষ করে মুখ মুছছে ন্যাপকিনে।
সূর্যর পাত্র আগেই সাফ। একদৃষ্টে তিয়ার খাওয়া দেখছিল সূর্য। হঠাৎ বলল,— এবার আমাদের কাজের কথাটা হোক?
কী?
পুজোয় আমরা কী করছি?
তিয়া চোখ রাখল সূর্ষর চোখে। তারপর আচমকাই ফিক করে হেসে ফেলেছে,— ডায়মন্ড হারবার কিন্তু যাচ্ছি না।
কেন? কী হয় গেলে?
ত্যাত্, ওরকম দু’-চার ঘণ্টার জন্য হোটেলে…
ও কে। দু’-চার দিনের জন্যই চলো কোথাও। দিঘা… কিংবা ঝাড়গ্রামের কাছে একটা এক্সেলেন্ট রিসর্ট আছে… জঙ্গল জঙ্গল, পাহাড় পাহাড়… কলেজে পড়ার সময়ে একবার গেছিলাম।
তিয়ার মন পলকের জন্য দুলে উঠল। পরক্ষণে ছদ্ম গাম্ভীর্যে চোখ পাকিয়েছে,— ইস রে, যাব বললেই যাওয়া যায় নাকি?
মুশকিল কেয়া হ্যায়?
বাড়িতে কী বলে যাব?
দিঘাতে সেবার যা বলে গেছিলে। কোনও বন্ধু-টন্ধুর নাম করে দেবে!
তিয়া ঈষৎ দূরমনা আবার। সৌরভ স্ট্রেট ড্রাইভে চার মারল, দেখেও দেখল না। বাড়িতে মিথ্যে বলবে? গত বছর অষ্টমীর দিন সকালে বেরিয়ে সন্ধেয় ফিরেছিল, মা কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি, কৈফিয়ত দেওয়ারও প্রয়োজন ছিল না। তা বলে তিন-চার দিন…? যাদের নাম করে যাবে, তারা যদি কোনও কারণে বাড়িতে ফোন করে… টুপি তখন একটা দেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু তিয়া কি নিজের কাছে ছোট হয়ে যাবে না?
দু’দিকে ঘাড় নেড়ে তিয়া বলল,— নাহ্, তা হয় না।
কিউ?
গুল মেরে যাওয়াটা আমার কেমন কেমন লাগে।
ও কে, দেন স্পিক আউট দা ট্রুথ। স্ট্রেট বলো, আমার সঙ্গে যাচ্ছ। দুটো অ্যাডাল্ট ছেলেমেয়ে… দোজ হু আর এনগেজড… যেতেই পারে একসঙ্গে।
খুউব, অ্যাঁ? তিয়া চোখ পাকাল। বুড়ো আঙুল নেড়ে বলল,— ছাঁদনাতলায় বসার আগে আর ওসব হচ্ছে না স্যার।
প্লিজ তিয়াস। সূর্য হাতে হাত রেখেছে। মৃদু চাপ দিয়ে বলল,— চলো না।
খাবার হাজির। প্লেট, চামচ, কাঁটা, সাজিয়ে দিল ওয়েটার। সূর্যর প্লেটে মিক্সড চাউমিন তুলে দিল তিয়া। খানিকটা গার্লিক প্রনও। নিজেও নিয়েছে।
কাঁটায় একটা চিংড়ি গেঁথে মুখে পুরল সূর্য। উৎসুক মুখে তিয়া জিজ্ঞেস করল,— কেমন বানিয়েছে?
চলতা হ্যায়। তবে আমার জন্য রসুনটা একটু বেশি।
আমার কিন্তু রসুনের স্মেল দারুণ লাগে। ইনফ্যাক্ট, আমি তো মাঝে মাঝে কাঁচা রসুন খাই।
কই, গন্ধ পাইনি তো?
আমি একই দিনে চুমু আর রসুন খাই না।
সূর্য হা হা হেসে উঠল। ও-পাশের টেবিলের পরিবারটি জুলজুল চোখে দেখছে। তিয়া চোখে ধমক এঁকে তাকাতেই সূর্য গপ করে গিলে নিয়েছে হাসিটা। একবারে অনেকটা চাউমিন মুখে ভরে বলল,— তা হলে কী ঠিক হল? আমরা যাচ্ছি তো?
দাঁড়াও, দাঁড়াও। তুমি যে জাস্ট নাউ কায়দা মেরে বললে, দোজ হু আর এনগেজড…! তিয়া ভ্রূভঙ্গি করল,— আমাদের এনগেজমেন্টটা হল কবে?
হয়নি, না? সূর্য খিকখিক হাসল,— চলো তা হলে সেরে ফেলি। পুজোয় তোমায় একটা ডায়মন্ড রিং কিনে দিই।
ব্যস, তাতেই বুঝি হয়ে যায়? আর কোনও ফরম্যালিটি নেই?
বলো কী আছে?
অনেক অনেক কিছু। তোমার বাবা-মা আমায় দেখেননি, আমার বাবা-মাও তোমাকে মিট করেনি, আমিও তোমার বাবা-মাকে দেখিনি, তুমিও আমার বাবা-মাকে চেনো না…।
উরেব্বাস, এ তো সিরিজ অব ইভেন্ট!
এটুকু তো লাগবেই সোনা। আমরা তো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করব না। রেজিষ্ট্রি করি, কি সোশাল ম্যারেজ… দু’বাড়ির কনসেন্ট নিয়েই করব। অবশ্য অসম্মতির তো কোনও কারণ দেখি না। তবে হ্যাঁ, ফার্স্ট স্টেপটা তোমাকেই নিতে হবে।
কী রকম?
অনেক দিন ধরে তো বলছি, মা তোমায় দেখতে চেয়েছে। চলো একদিন।
সে তো আমার মাও কবে থেকে বলছে…
উঁহুঁ। নিয়ম এখন উলটো। আগে মেয়ের বাড়ির লোক ছেলেকে দেখবে, তারপর মেয়ে গিয়ে দর্শন দেবে।
ওয়েল…। সূর্যর চোখে কপট উদ্বেগ,— অ্যাকর্ডিং টু ইউ, তোমার মা তো ললিতা পাওয়ার টাইপ নন!
গেলেই টের পাবে।
তোমার বাবাও কি প্রেজেন্ট থাকবেন?
থাকতেই পারে। আগে থেকে বলব কেন?
না মানে… ইন্টারভিউয়ের জন্য তো সেভাবে প্রিপেয়ার্ড হতে হবে। সূর্যের ঠোঁটে হাসি, কপালে ভাঁজ,— আচ্ছা, উনি কি ভীষণ কড়া?
তিয়া এককথায় উত্তর দিতে পারল না। বাবাকে কঠিন, নরম, কোনও ধাঁচেই ফেলা যায় কি? মা’র সঙ্গে বাবার ব্যবহার, আর রাতবিরেতে তিয়া যখন কম্পিউটারে, তখন হঠাৎ হঠাৎ এসে তার মাথায় হাত রেখে বাবার নরম কথা বলা— দুটো কি এক? বাবার কোন রূপটা সত্যি, তাও তো তিয়ার বোধগম্য হল না এখনও।
সূর্যর চোখে কৌতুক চিকচিক। তিয়ার দৃষ্টি সূর্য থেকে সরে গেছে। সৌরভ মিড-উইকেটে ক্যাচ তুলে আউট, কাউন্টারের লোকটা দুম করে বদলে দিল চ্যানেল। রিমোট টিপে পর পর প্রোগ্রাম ঘুরছে। দু’-চার সেকেন্ডের বেশি স্থির হচ্ছে না কোথাও।
আচমকা পরদায় এক চেনা মুখ! পলকের জন্য! পলকে সরেও গেছে!
তিয়া অস্ফুটে বলে উঠল,— আরে, ইন্দ্রজিৎ না?
সূর্য চোখ কুঁচকোল,— কে ইন্দ্রজিৎ?
আরে, হ্যাপি হোমের সেই ভদ্রলোক! তিয়া গলা উঠিয়ে কাউন্টারের লোকটাকে বলল,— দাদা, আগের চ্যানেলটা একটু দেবেন?
কোনটা?
ঘোরান, ঘোরান।… হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো। এখানে।
হ্যাঁ, ইন্দ্রজিৎই। তিয়া স্তম্ভিত চোখে দেখল, দু’জন পুলিশ থানায় ঢোকাচ্ছে ইন্দ্রজিৎকে। রুমালে মুখ ঢাকার চেষ্টা করছে ইন্দ্রজিৎ, তবে তাকে চিনতে কোনও অসুবিধে হয় না। পরনে সেই জিন্স-পাঞ্জাবি!
সূর্য ঘুরে বসেছে। চেঁচিয়ে বলল,— বাড়ান তো, বাড়ান তো সাউন্ডটা।
সংবাদ পাঠিকার গলা বেজে উঠল,— আজ সকালেই নরেন্দ্রপুরের আশ্রম থেকে এই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগ, ইন্দ্রজিৎ রায় এক প্রথম শ্রেণির ধূর্ত প্রতারক। মূকবধিরদের নিয়ে হ্যাপি হোম বলে যে এন-জি-ও-টি সে চালাচ্ছিল, তার কাগজপত্র সবই জাল। যে সব মানুষের নাম এন-জি-ওর সদস্য হিসেবে দেখানো আছে, সেগুলোও ভুয়ো। হ্যাপি হোম দেখিয়ে নানান সংস্থা থেকে অর্থ সংগ্রহই ছিল ইন্দ্রজিতের মূল পেশা। শুধু তাই নয়, সম্পূর্ণ জাল হিসেবপত্র পাঠিয়ে বিদেশ থেকেও সে বিস্তর টাকা পেয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, এই ইন্দ্রজিৎ রায়ের অতীতও অতি বর্ণময়। দশ বছর আগে একটি প্রাইভেট কোম্পানির তহবিল তছরুপ করে তার প্রতারণার জীবন শুরু। তখনই সে গ্রেফতার হয়েছিল, কিন্তু প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। মিথ্যে পরিচয় দিয়ে সে একটি বিয়েও করেছিল, তার স্বরূপ জানতে পেরে তার স্ত্রী বছর পাঁচেক আগে তাকে ত্যাগ করে। লোক ঠকানো বিপুল অর্থ ডিসকো, নাইটক্লাবে গিয়ে দু’হাতে ওড়াত ইন্দ্রজিৎ। সম্প্রতি তাকে নাইটক্লাবে দেখে হ্যাপি হোমকে সাহায্যকারী এক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের মনে সন্দেহ জাগে। তাঁরই অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়েছে। লেক গার্ডেন্সে ইন্দ্রজিতের একটি ফ্ল্যাটেরও সন্ধান পেয়েছে পুলিশ এবং সেখান থেকে আরও চাঞ্চল্যকর সব নথিপত্র মিলেছে…
শ্রবণেন্দ্রিয় যেন অসাড় হয়ে আসছিল তিয়ার। যা শুনছে, তা কি সত্যি? হ্যালুসিনেশন নয় তো? এই তো দিন দশেক আগেও তিয়া হোমে গিয়েছিল, লোকটা তখন বলল, পুজোয় ছেলেদের নিয়ে কলকাতায় ঠাকুর দেখতে আসবে…! সে-দিনও খুব অনুনয় করছিল, একটা-দুটো কোম্পানিতে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্যে… সব মিথ্যে? সব?
তিয়ার গোটা শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। একটা বমি উঠে আসছিল গলায়। তখনই সূর্যর স্বর, বিকৃত উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল,— দেখেছ তো, দেখেছ তো, তোমার ইন্দ্রজিৎ কী মাল? শিক্ষা হল তো?
তিয়া কপাল টিপে ধরল,— চুপ করো। ভাল লাগছে না। আমার কষ্ট হচ্ছে।
এখন কষ্ট হলেই হল? কেন চুপ করব? বারবার তোমায় মানা করেছি লোকটাকে নিয়ে নাচানাচি করতে। চারদিকে এখন এরকম বহুত ফ্রড বেরোচ্ছে। লোকটা তোমায় পাকড়াও করে সেন্টু দিল, তুমিও তার পিছনে ছুটতে লাগলে!
অসহায় চোখে সূর্যকে দেখছিল তিয়া। সবই তো বুঝছে সে, কিন্তু সুর্য কেন তাকে অনুভব করার চেষ্টা করছে না? তার কেজো জগতের বাইরে অন্য এক ভুবনের সন্ধান পেয়েছিল তিয়া, সেই পৃথিবী নিমেষে চুরচুর, এ কি কম যন্ত্রণার? এ যন্ত্রণা ইন্দ্রজিৎ নামের জোচ্চরটার কাছে ঠকে যাওয়ার কষ্টের চেয়ে ঢের ঢের বেশি। অন্তত এই মুহূর্তে কি সূর্য একটু নরম করে তার সঙ্গে কথা বলতে পারে না?
ক্ষণিকের জন্য তিয়ার চোখে হ্যাপি হোম ভেসে উঠল। একটা সবুজ খেত… নয়ন-কমল-গণেশদের মুখ… সরল উজ্জ্বল চোখ… শব্দহীন হাসি…! প্রাণপণে কান্না চেপে তিয়া বলল,— ছেলেগুলোর এবার কী হবে?
সূর্য বিদ্রূপের স্বরে বলল,— গন টু মায়ের ভোগ। চিটিংবাজের পোঁ ধরে ছিলি, এবার ঠ্যালা বোঝ!
কিন্তু ওদের এখন চলবে কী করে? ওরা তো কোনও দোষ করেনি?
ওসব তোমার না ভাবলেও চলবে। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সূর্য বলল,— ওরা এখন গভর্নমেন্টের হেডেক। থাউজ্যান্ড অ্যান্ড ওয়ান হোম আছে, কোথাও একটা ঠিক পুশ করে দেবে।
তিয়ার স্বর ভিজে এল,— তুমি জানো না সূর্য, ছেলেগুলো বড্ড ধাক্কা খাবে।
ওদের কপাল।
আমাকেও ওরা ভীষণ ভালবাসে সূর্য।
অ্যাই, স্টপ দিস ননসেন্স। ঢংয়ের কথাগুলো বোলো না তো। কোথায় কোন এক চিটিংবাজের আখড়ায় গিয়ে পড়েছিলে, মানে মানে বেরিয়ে আসতে পেরেছ, পুলিশ-ফুলিশের গাড্ডায় ফঁসতে হল না, এটাই তো এনাফ। সূর্য গলা ঝাড়ল,— একটা কথা শুনে রাখো, তিয়াস। এবার থেকে দুমদাম উলটোপালটা জায়গায় আর ভিড়বে না। নিজেকে বেশি ওস্তাদ ভাবার দরকার কী, অ্যাঁ? আমি মানুষ চিনি, আমার কথা একটু শুনে চোলো।… ঢুকল মাথায়?
সূর্যর স্বর হঠাৎ বাবাকে মনে পড়িয়ে দেয় কেন? অবিকল এই ভঙ্গিতেই না মাকে দাবড়ায় বাবা? তিয়া টের পেল, বুকটা তার আচমকা শুনশান হয়ে গেছে। নাকি এ এক দুঃসহ ভার? যা অবশ করে দেয় হৃৎপিণ্ড?
টেবিলে ভর দিয়ে তিয়া উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। পারছে না। পা দুটো যেন জেলির মতো তলতলে সহসা।
সূর্যর নজরে পড়েছে। অবাক মুখে বলল,— কী হল তোমার? যাচ্ছ কোথায় এখন?
তিয়া ক্ষীণ গলায় বলল,— বাড়ি।
কেনওও? খাও, খাওয়াটা শেষ করো। এত কিছু নিলে…
ইচ্ছে করছে না সূর্য। বিশ্বাস করো।
কী ব্যাপার বলো তো? ফ্রডটাকে খিস্তি মারলাম বলে চটে গেলে নাকি? সূর্য হ্যা হ্যা হাসছে। গলায় ফের ব্যঙ্গ হেনে বলল,— এখনও হারামিটার ওপর থেকে তোমার উইকনেস যায়নি, অ্যাঁ?
এই হৃদয়হীন, বোধবুদ্ধিবিহীন, অনুভূতিশূন্য সূর্যর সঙ্গে একটা গোটা জীবন পাড়ি দেবে তিয়া?
মাথা ঘুরছে বনবন। দুলছে পৃথিবী। কোনওরকমে টলতে টলতে বেসিন অবধি গিয়ে তিয়া হড়হড় বমি করে ফেলল। যাক, নাড়িভুঁড়ি সুদ্ধু বেরিয়ে যাক।