লিল্লিহো!
আপনি আমাকে অ্যারেস্ট করছেন না কেন?
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার সত্যবান মণ্ডল লালবাজারে বসেন। দোতলায়। একতলায় একসারি হাজত ঘর পেরিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে, করিডোরের পর করিডোর পার হয়ে তার কাছে পৌঁছতে হয়। রাস্তা ধরে এগোলে ততক্ষণে রাধাবাজার এসে যেত।
সত্যসাধনবাবু অকৃতদার। বয়স চল্লিশে রেখেছেন। থাকেন বেকার রোডের পুলিস কোয়ার্টারে, নিঃসন্তান বিধবা বোনের সঙ্গে। (আসুন না একদিন রোববার দেখে। আড্ডা দেওয়া যাবে –সত্যবান)।
পুলিস বলতে এতদিন যা জেনে এসেছি, ভদ্রলোক গত বারো দিনে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তা ছিল পুরোটাই ভুল। অশিক্ষিত সে গ্রাম্য ধারণার তিনি মূর্তিমান প্রতিবাদ। ইউনিফর্ম নেই; কোমরে রিভলভার কখনও থাকে না; চোখে গোল্ড মেটালের চশমা; তীক্ষনাসা, ছিপছিপে ও ছ-ফিট কবি হিসেবেই তাকে মানাত ভাল, এত সহৃদয় ও এমন সজ্জন। ভদ্রলোকের গায়ের রঙ একদম বিলেতি। এত ফর্সা যে চোখ দুটি দেখে মনে হয়, নীল হলেই তারা যথাযথ হত। কথা বলেন যখন, পাখির ডিমের মতো গল-অস্থিটি ওঠানামা করে। মোট কথা, পুলিস অফিসার হিসেবে, দৃশ্যত, তিনি একেবারেই অবিশ্বাসযোগ্য।
খুব না বলে, বলা উচিত, তিনি মুহুর্মুহু সিগারেট খান।
যার-পর-নেই মৃদু ও মার্জিত ভাষায় যিনি আমাকে প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন, আপনি কনফেস করুন, আজ ১১ পেরিয়ে ১২ দিন হতে চলল, সেই তিনি আমাকে এখনও অ্যারেস্ট করেননি।
দীপ্তির মৃত্যুর পর ওর জন্যে শোক করা দূরে থাক, ওকে নিয়ে একটা মিনিটও ভাববার সময় পাইনি। আর ভাববই বা কী করে। ওকে নিয়ে একটা কিছু ধরে ভাবতে গেলেই এক শব্দহীন বিস্ফোরণ হয় মাথার মধ্যে। দুঃস্বপ্নে যেমন, একটা থেকে একটা থেকে আর একটা, অন্য থেকে অন্য থেকে অন্য ভাবনা-জগৎ তার মধ্যে ঢুকে পড়ে। পরমাণুর চারিদিকে দুর্ভাবনার ইলেকট্রন মেঘ যেন, যার মধ্যে রয়েছে পরম-পরমাণু অনির্ণেয় কোয়ার্ক এবং অ্যান্টিকোয়ার্কের মতো মাসহীন ভরশূন্য মৌলকণা, যারা, তত্ত্বের খাতিরে, মহাবিশ্বের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারে—যদি তার প্রান্ত থেকে থাকে। গত দশ বারো দিনে এই দুর্ভাবনার জগৎ আমার অভ্যস্ত ভাবনা-জগৎ থেকে অনেক, অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সুপরিচিত ইমেজ থেকে এখানে জেগে ওঠে স্বেচ্ছাচারী আবেগ, আবেগের স্বেচ্ছাচার থেকে জন্ম নেয় ইমেজের স্বাধীনতা। এরা আমাকে লুটিয়ে টেনে নিয়ে চলে। এ উন্মত্ততার মধ্যে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকার সাধ্য আমাদের অনেকেরই নেই।
এমনিতে ঠিক আছি, কিন্তু, দীপ্তিকে নিয়ে কোনও ভাবনার শুরু হলেই, এমনটা হয়। আজ ফেরার সময় এসপ্ল্যানেড স্টেশনে দরওয়াজা বন্ধ হো রহা হ্যায় শুনতে শুনতে মেট্রো রেলের উজ্জ্বল সন্ধ্যা কখন যে পরিণত হয়ে গেল কবেকার কোনও এক শীতের ভোরবেলায়…দীপ্তির গলায়, এই, তোমরা কে কে চা খাবে উঠে পড়, এর পর সাড়ে আটটার আগে আর চা হবেনা দিয়ে যে বিশ্বাসযোগ্য ভাবনার শুরু হল, মুহূর্ত পরে খেয়াল হতে দেখি, সেটাই আমার জীবনে সূর্যাস্ত তো দিনে একটা হয় না। অনেক সূর্যাস্ত হয় সারাদিনে। এই যেমন এখুনি একটা হল। সব অন্ধকার হয়ে গেল। কিন্তু এখন তো দুপুরবেলা …এই ভয়াবহ জলপ্রপাতের পরিণতিকামী খরস্রোত ধরে কুটোর মতো ভেসে চলেছে।
নাআ!
সহযাত্রীদের চমকে দিয়ে চিৎকার করে উঠে আমাকে তা থামাতে হয়। ট্রেন তখন আমার গন্তব্য ছাড়িয়ে পরবর্তী ও অন্তিম স্টেশন টালিগঞ্জ–এই ঘোষণার মধ্যে! ল্যাম্পপোস্টের দড়ির আগুনে সিগারেট ঠেকাতেই একদিন গানের স্কুল থেকে বেরিয়ে আসা আমার মেয়ের পা-দুটি জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ছি দেখি। তার হাতে স্বরলিপির খাতা। সেখান থেকে শুরু হয়। তারপর একটা থেকে একটা থেকে একটা। অন্য থেকে অন্য থেকে অন্য। স্বাধীন ইমেজ ও আবেগের অসহ্য স্বেচ্ছাচার।
নৃপেনের যোধপুর পার্কের বাড়িতে দীপ্তির শ্রাদ্ধ-শান্তি নমোনমো করে চুকে গেছে। আত্মীয়স্বজন যারা এসেছিল, সকলের, দৃষ্টিভঙ্গি দেখছি একটাই। যে, যে যাবার, সে গেছে। এখন যা আছে, তাকে বাঁচাও। অর্থাৎ, আমি আর চৈতি। নৃপেন তো এটাকে স্লোগান বানিয়ে ফেলেছে। তার শুধু একটাই জিজ্ঞাসা। খুন হল দুপুরে। আমি ফিরলাম রাত ৯টায়। অফিসে যাইনি। আমি তাহলে সারা দুপুর ছিলাম কোথায়?
প্রাইমারি স্টেজে মার্ডার কেস আমার কোর্টে অনেক এসেছে। স্ট্রং আলিবাই থাকলে মামলা কখনও হায়ার কোর্টে পাঠাইনি। নৃপেন বেশ কবার আমাকে জানিয়েছে।
দীপ্তি বসুরায় খুনের ঘটনায় কেউ এখনও অ্যারেস্টহয়নি। এ নিয়ে কাগজে খুব লেখালেখি হচ্ছে। নৃপেনের মুখে শুনলাম, সত্যবান মণ্ডলের ক্ষেত্রে এমনটা আগেও হয়েছে। এ তো সবে ১১ দিন, বাসনা সেন মার্ডার কেসে সে নাকি ছিল দেড় মাস চুপচাপ। তারপর একদিন খপ করে ওদের পুলিসেরই এক আই পি এস-কে ধরল। অকাট্য প্রমাণ হাতে আসার আগে। সত্যবান কখনও সাসপেক্টকে কাঠি দিয়েও ছোঁয় না-নৃপেন জানিয়েছে। তাকে ছেড়ে রাখে। ওয়াচ করে। আই জি ক্রাইমের অগাধ আস্থা ওর ওপর।
চৈতির অবস্থাও আমার মতো। মাতৃশোক ওকে এখনও স্পর্শ করেনি।
যখনই যা কথা হয়, টেলিফোন আসে, চৈতি পাশে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটি কথা শোনে। সিলেবেল ভাগ করে তীক্ষ্ণ স্বরে সে জানতে চাইল, কিন্তু। আমার। বাবা তো। খুন। করেনি।
তা তো করেইনি মামণি। নৃপেন সাদরে হাত ধরে ওকে কাছে টেনে আনে, সে তো আমি জানি। আর সেইজন্যেই তো তোমার বাবাকে এখনও ধরেনি।
এখনও? চৈতি মিস করলেও, আমি শব্দটির প্রয়োগ লক্ষ্য না করে পারি না।
রোজ সকালে সাড়ে ১১টার সময় লালবাজারে সত্যবান মণ্ডলের কাছে আমাকে একবার হাজিরা দিতে হয়। আমি রোজ ঘণ্টাখানেক বসে থাকি। উনি চা খাওয়ান। কোনওদিন লিমকা। আসল কথা একটাও হয় না।
শেষ সিগারেটটা আমাকে ধরিয়ে দিয়ে, দারওয়াজা বলে ডেকে একসঙ্গে পাঁচ প্যাকেট উইলস ফিল্টার আনতে দিয়ে, প্রথম দিনটা উনি কাটিয়ে দিলেন শুধু সিগারেট খাওয়ার অপকারিতা নিয়ে কথা বলে। প্রথম দিনেই নামটা ভুলে গেছেন এমন একজন ইটালিয়ান লেখকের একটা বই রেফার করলেন, জেমস জয়েস তাকে ইংরেজি শেখাতেন, বললেন, বইটার নাম দা কনফেশন অফ জেনো, ওঁর মনে পড়ল। প্রতি রাত্রে শেষ সিগারেট খেয়ে জেনো ডায়েরি তে লিখে রাখত, আর সিগারেট নয় এবং পরদিন ভোরে উঠেই দিনের প্রথমটি ধরাত। তার ডায়েরিতে প্রতিদিন, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর শুধু ওই একটা সেনটেন্স : নো মোর সিগারেট!
পুলিস অফিসারের মুখে জেমস জয়েস শুনে, সত্যি কথা বলতে কি, আমি প্রথম দিন ওঁকে চালবাজ ভেবেছিলাম। কিন্তু, পরে ধারণা পাল্টাতে হয়। আমি অটোমোবিল ক্লাবের মেম্বার। এক সময় ওখানে খুব আসতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর দলবল। রাত বাড়লে। সুনীলবাবু গান ধরতেন।
লালপাহাড়ির দেশে যা
রাঙামাটির দেশে যা
হেথায় তোরে মানাইছে না গ
ইক্কেবারে মানাইছে না গ…
আমাদের দলটা ছিল মূলত ব্যাঙ্কারদের। কিন্তু রাত বাড়লে বার-এব্রাহ্মণে-চণ্ডালে কোনও ভেদাভেদ থাকে না। আমরাও উঠে গিয়ে লাস্ট রাউন্ড হাতে ওঁদের সঙ্গে গলা মেলাতাম। তা, ওঁদের মুখেও তো কোনওদিন জেমস জয়েস শুনিনি।
কোনওদিন কথা হয় দেশের অবস্থা নিয়ে, কোনওদিন টিভি সিরিয়াল। ওঁর কথাবার্তার লেভেল নিঃসন্দেহে উঁচু মানের। রীতিমতো ইন্টেলেকচুয়াল। মহাভারত বিষয়ে ওঁর বক্তব্য হল–এই সিরিয়ালের আসল উদ্দেশ্য হল, হিন্দু ফান্ডামেন্টালিস্টদের একটা প্ল্যাটফর্মে এককাট্টা করা। সারা ছবি জুড়ে শুধু পিতাশ্রী, ভ্রাতাশ্রী, মাতাশ্রী মায় মামাশ্রী। আগাগোড়া চেস্ট তদ্ভব হিন্দি। বিজয়ী ভব আর চিরঞ্জীবী ভব–ভাঞ্জে, অতহ, অ্যান্ড পরন্তু! লক্ষ্য করেছে কি, একদম বলেই দেওয়া হয়েছে স্ক্রিপ্ট রাইটারকে, ডায়ালগে যেন, খবর্দার, একখানা মোচরমান শব্দও না থাকে!
দেশের অবস্থার কথা বলতে গিয়ে উনি যা বললেন, তার মর্মার্থ ভারতবর্ষের কপাল এখন, অবশেষে, সত্যি পুড়ছে এবং চচ্চড়িয়ে।
রাজা নবম চার্লসের সময়, বুঝলেন, সেই কোন সিক্সটিনথ সেঞ্চুরিতে, উনি সিগারেট ধরালেন, একবার অ্যান্টার্কটিক থেকে চারটে ক্যানিবালকে ধরে আনা হয়। শহরের জৌলুস। আর রাজকীয় জাঁকজমক দেখিয়ে ইন্টারপ্রেটার মারফত রাজা তাদের কাছে জানতে চাইলেন, সব তো দেখলে। এখন বল, কোনটা তোমাদের সবচেয়ে বেশি অবাক করল?
সভ্যতার সঙ্গে সেই তাদের প্রথম সংস্পর্শ! বোকাহাঁদা নরখাদকরা বলল, তারা তিনটে অবাক কাণ্ড দেখেছে। তারা কী বলেছিল জানেন? তৃতীয়টা, আমি ভুলে গেছি। কিছুতেই মনে পড়ে না। কোথায় যে পড়েছিলাম। বইটার নামও মনে নেই।
প্রথমটা কী ছিল?
তারা বলেছিল, দ্যাখো রাজা, আমরা প্রথমত অবাক হয়েছি তোমার মতো একটা পুঁচকে ছেলেকে এইসব সা-জোয়ান লোকগুলো (সশস্ত্র গার্ডদের দেখিয়ে)নতজানু হয়ে কুর্নিশ করছে কেন? তারা তোমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলে নিজেদের মধ্যে কারুকে সিংহাসনে বসাচ্ছে না কেন?
আমার এত বড় দুঃসময়েও একটু না হেসে আমি পারিনা, তারপর? রাজা নিশ্চয়ই দ্বিতীয় প্রশ্ন আর করেননি?
না-না। রাজা তো বাচ্চা ছেলে। দ্বিতীয়ত, তারা বলেছিল, শহর ঘুরে তারা দেখল, কিছু লোক প্রাসাদে থাকে আর বেশি লোক ফুটপাতে। কিছু লোক সেঁড়েমুসে খায়। বাকি লোক খেতে পায় না। কিছু লোক গাড়ির ওপর। কিছু লোক তাদের টানতে টানতে ধুকছে। কই, তাদের দেশে তো তারা এমনটা কোথাও দেখেনি।
সত্যবান আর-একটা সিগারেট ধরালেন।
আসলে কী, ওদের দেশে তো আমাদের মতো পুলিস নেই। বিচার নেই, আইন নেই, তাই জেলখানাও নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য কী তারা জানে না। তাদের ধনসম্পদ নেই, তাই দারিদ্রও নেই। প্রভু নেই, অতএব চাকরও নেই। এরা তো সব নন-স্টার্টার–হাঃ হাঃ–এদের খেলায় হারজিত নেই। এরা তো সব ন্যাংটা, হোঃ হোঃ, এখানে বাটপাড় কোথায়। লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, উচ্চাভিলাষ, দম্ভ, চরিত্রহনন—এই সব শব্দের যারা… যারা… যাদের প্রতিনিধি, কী বলবেন তাদের, এক কথায় স্বাস্থ্যবান নপুংসক বলা যাক? এই জিনিসটা–এই পুরুষত্বহীনতা–এ তো তাদের মধ্যে জন্মই নেয়নি।
সেদেশে বেশ্যা নেই। তারা রাজাকে বলেছিল। কারণ, নারীর পূর্ণ যৌন স্বাধীনতা সেখানে আছে। কুমারী মাতা সেখানে সন্তান হত্যা করে না–বাবু! বলা শেষ হয়েছে বলেই কি সত্যবান এখানে চুপ করলেন, নাকি এখানে শেষ করবেন বলেই আজকের টপিকটা শুরু করেছিলেন? (পরে বুঝেছি, উনি তখন মারি স্টোপস ক্লিনিকে ভ্রণ-হত্যার ব্যাপারটা জানতেন। জানবারই কথা।)
ক্যানিবালদের তৃতীয় উত্তরটা কী ছিল, সে সম্পর্কে অবগত হবার কৌতূহল অচরিতার্থ রেখে আমি উঠে পড়লাম। এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। আজকের মতো ছুটি। সেদিনও আসল কথা কিছুই বললেন না সত্যবানবাবু।
বেশ চলছিল। কিন্তু আজ, দ্বাদশ দিনে, উনি এমন একটা সাবজেক্ট নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করলেন যে হা-হুঁ করা দূরে থাক, শ্রুতিমাধ্যমে তাতে অংশগ্রহণ করাও আমার পক্ষে আর সম্ভব হল না।
আজ সত্যবান শুরু করলেন পুলিস-টর্চার নিয়ে।
ধরুন, ধোঁয়া ছেড়ে, কনফেশান আদায়ের এই যে পুলিসি মেথডলজিটা। অত্যাচার, টর্চার—এটা..এটা কি ইন ইটসেলফ সাব-হিউম্যান নয়? ধোঁয়া ছেড়ে, আপনি সহ্য করছেন, সহ্য করছে……করছেন, করছেন, করছেন, করছেন—ব্যস, তারপর আর পারলেন না।বলে ফেললেন! অনেক ক্ষেত্রে সলিটারি কনফাইনমেন্টও দেওয়া হয়। একদিন, সাতদিন, একমাস পরে আপনি বলবেন, আমাকে মুক্তি দাও এই নিঃসঙ্গতা থেকে। হ্যাঁ, আমি খুন করেছি।জানেন। কি, খুনের পর খুনিরা কখনও একা থাকে না? তারা মানুষের ভিড়ে মিশে থাকে? ধোঁয়া ছেড়ে, ক্রিমিনোলজিস্টরা বলবেন, এখানে খুনির বিবেক শেষ পর্যন্ত কথা বলল। তাই কি? ধোঁয়া ছেড়ে, আমি অনেক খুনিকে হ্যান্ডেল করেছি। আমি জানি, খুন করার পর খুনির পৃথিবী দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটায় থাকে সে, আর একটায় থাকে বাকি পৃথিবী। খুনির পৃথিবীতে ওসব বিবেক-ফিবেক থাকে না। বানের তোড়ের বিরুদ্ধে বিষধরের ফণা জেগে থাকা দেখেছেন কখনও, বাবু? ভেসে যেতে যেতে খুনির মধ্যেও ওভাবে জেগে থাকে একটাই চেতনা আর তা হল—রাইট টু লিভ। ধোঁয়া ছেড়ে, মৃত্যু পর্যন্ত দড়িতে ঝুলতে যাবার আগে প্রত্যেকটি খুনি সেই মানবতাবাদী ফাঁসুড়েদের অভিসম্পাত দিয়ে গেছে–আমরা যাদের গালভরা নাম দিয়েছি—বিচারপতি! সহ্যশক্তির তো একটা শেষ আছে। ব্রেকিং পয়েন্টে হ্যাঁ বলায় কত নিরাপরাধকে যে খুন করেছে ওই বিচারপতিরা, তার হিসেব কে রেখেছে?
তারপর ধরুন, ধোঁয়া ছেড়ে, আর একটা দিক। সহ্যশক্তির একটা সীমা আছে; আবার মানুষের ক্ষেত্রে, তা নেইও। জন্তুজানোয়ারদের মধ্যে মানুষই সবচেয়ে বড় জন্তু কিনা। মানুষের সহ্যশক্তি তো অসীম–অনন্ত! বিশেষত যে খুন করেনি, তার! ধোঁয়া ছেড়ে, বার্লিনে ঢুকে দ্বিতীয় দফার নিউ জেনারেশন সৈন্যরা কী করেছিল, রাশিয়া তো তা স্বীকার করেনি। রেড আর্মি কিছু করতে পারে না, যথা রেপ।ইটালিতে ঢুকে ভারতীয় সৈন্যরা রেপ করেনি। আমার বন্ধু অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর মত কি জানেন? মেম বলে ভরসা পায়নি। কিন্তু, আমেরিকানরা। করেছে। অনিচ্ছুক এনলিস্টেড জি আইরা ভিয়েতনামে কি করেছিল, তার অন্তত ছিটেফোটা ল্যান্সডেলের দ্য পেন্টাগন পেপার্সবইতে আছে। আমার কাছে আছে বইটা–পড়ে দেখবেন।
বীভৎস! মাই-লাইতে বাড়ি-বাড়ি ঢুকে জি আই-রা মেয়েদের ন্যাংটো করে সার্চ করত। তারপর বলত, একটুও বাড়িয়ে বলছিনা, এ-সবই সরকারি নথি, এবার তোমাদের ভ্যাজাইনা সার্চ হবে। বলে রেপ করত। ধোঁয়া ছেড়ে, একজন জি আই খুনের ব্যাপারে মা আর মেয়েকে উলঙ্গ করে ক্যাম্পে হাঁটিয়ে এনেছে : কনফেস করো কিন্তু মেয়েটা তো খুন করেনি। সে কিছু জানে না। একজন সৈন্যের হাতে জ্বলন্ত লাইটার তুলে দিয়ে লেফটেন্যান্ট বললেন, ওর পিউবিকহেয়ারগুলো জ্বালিয়ে দাও। মা মেয়েকে বলল, বল, খুন করেছি। কিন্তু মেয়েটা দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। কী বলবে। তার তো বলার কিছু নেই! তখন দিল জ্বালিয়ে।
কী হল, কাঁপছেন কেন আপনি? দারওয়াজা, এক গ্লাস পানি ল্যাও।
জল এলে এক চুমুকে আমি সবটা খেয়ে ফেললাম। বেশ খানিকটা উপচে পড়ল টেবিলে।
সেদিকে দৃকপাত না করে সত্যবান বলে চললেন, সেদিন সেল মিটিং-এ ঘটনাটা রেফার করে বললাম, তা একজন ইন্নোসেন্টের যদি এতখানি এনডিওরেন্স থাকে, একজন কালপ্রিটেরই বা থাকবে না কেন। সেও তো মানুষ। মেটাবলিজম একই। কাজেই ওসব টর্চার মেথড ফেথড একদম বাজে। অবসোলিট। ধোঁয়া ছেড়ে, আই জি ক্রাইম আমার বক্তব্য খুব অ্যাপ্রিসিয়েট করলেন। মুসৌরির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশানে ওঁকে লেকচার দিতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে দেখলাম, ওদের কাগজে যা বেরিয়েছে, উনি আমার লাইনেই বলছেন।
প্রকাণ্ড অ্যাশট্রেতে সিগারেট পিষতে পিষতে স্লিভ সরিয়ে সত্যবান কজিতে ঘড়ি দেখলেন।মনে হয়, একঘণ্টা বহুক্ষণ পেরিয়ে গেছে। সত্যবান হেসে জানতে চাইলেন, কী! আজ আপনি কিছু বললেন না যে!
পিউবিক হেয়ারে অগ্নিসংযোগের পর থেকে আমি আর কিছু শুনতে পাইনি। শুধু ওঁর গল-অস্থির ওঠানামা দেখে গেছি।
আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
এমন একটা ইশারার জন্যেই যেন এতক্ষণ গুটিয়ে চুপ করে শুয়ে ছিল আমার সকল স্নায়ু। উনি লিলিহহা! বলামাত্র নেড়ি কুকুরের মতন তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওঁর ওপর।
আপনি আমাকে কবে অ্যারেস্টকরছেন? ওঁর চোখে চোখ রেখে আমি জানতে চাইলাম।