১০
লক্ষ্মীদির চিঠিগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে একজনকে দিয়ে আসার মধ্যে কোথায় যেন একটা নিষিদ্ধ রোমাঞ্চ ছিল। লক্ষ্মীদির নাচ, লক্ষ্মীদির লেখাপড়া, লক্ষ্মীদির আদর, সব কিছুই। দীপঙ্কর ভেবেছিল, লক্ষ্মীদি যেন দীপঙ্করকে এক নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছে। তার ইস্কুল, কলেজ, লেখাপড়া, দেখাশোনা, ভাবা সমস্ত কিছুর মধ্যে যেন এক নতুন উন্মাদনা এনে দিয়েছিল লক্ষ্মীদি। এতদিন জীবনকে যেন এদিক থেকে আস্বাদ করা হয়নি। কোন এক অজ্ঞাতকুলশীল লোককে চিঠি দিয়ে আসার মধ্যে দীপঙ্করের কিসের স্বার্থ কে জানে! কিন্তু তবু সে-কাজেও কত যেন উৎসাহ তার। বৃষ্টি মাথায় করে চিঠি দিয়ে আসার মধ্যে যেন কোনও স্বার্থসিদ্ধি আছে দীপঙ্করের। যেন চিঠিটা না দিয়ে আসতে পারলে তার মহা লোকসান হয়ে যাবে একেবারে।
আর তারপর একদিন সতী এল।
কিন্তু কী মর্মান্তিক তার আবির্ভাব! সেই সতী যদি এলই তার জীবনে, তবে প্রথম সাক্ষাতের দিনই কেন অমন করে আঘাত দিলে সে! সে-আঘাতের কথা অনেকদিন ভুলতে পারেনি দীপঙ্কর। অনেকদিন ভেবেছে দীপঙ্কর, আর লক্ষ্মীদির কথা ভাববে না। কিরণ কতবার বলেছে–কী রে, ওদের মেম্বার করেছিস?
–কাদের?
–ওই তোদের বাড়ির ভাড়াটেদের মেয়েদের? যাদের সঙ্গে তোর অত রগড়া রগড়ি?
কথাটা সেদিনই ভালো লাগেনি দীপঙ্করের। কিরণের কথাটার মধ্যে ইঙ্গিতটাও ঠিক মুখরোচক নয়।
বললে–ওদের সঙ্গে আর আমার ভাব নেই—
কিরণ জিজ্ঞেস করেছে-কেন রে, কী হলো আবার?
দীপঙ্কর বলেছিল–না, ওরা বড়লোক–
আসলে বড়লোক হওয়াটা ওদের বড় অপরাধ নয়। দীপঙ্করের মনে হতো, সে তো ওদের কাছে তার কলেজের মাইনে, বই কেনার টাকা চাইতে যাচ্ছে না। যাবেও না কোনওদিন। তাদের টাকা নিয়ে তারাই থাকুক। যতদিন প্রাণমথবাবু আছেন, ততদিন তিনিই দিয়ে যাবেন। কিন্তু যারা তাকে ছোট মনে করে তাদের সঙ্গে কী করে মিশতে পারে সে। সে তো সব বিষয়ে ছোট, সব বিষয়ে। শুধু অর্থের দিক দিয়েই নয়। সামর্থ্যের দিকেও বটে। আর শুধু সামর্থ্যের দিকেও নয়, অন্তরের দিক থেকেও। অর্থমূল্য দিয়ে যারা সব কিছুর বিচার করে, তাদের কাছে দীপঙ্করের কতটুকু মূল্য! ওরাও তো অঘোরদাদুর সমগোত্রীয়। দীপঙ্করকে ওরা করুণা করে দীপঙ্কর গরীব বলেই ওরা সহানুভূতি দেখায় দীপঙ্করকে হয়তো মানুষ বলেও মনে করে না। দীপঙ্করকে যদি মানুষ বলেই মনে করতো তাহলে তার হাত দিয়ে কি লক্ষ্মীদি চিঠি পাঠাতো! লক্ষ্মীদি তাকে যে বিশ্বাস করে, তার কারণ বিশ্বাসঘাতকতা করবার ক্ষমতাই যে নেই দীপঙ্করের।
কিরণ বলেছিল–বড়লোক বলেই তো বলছি রেভজুদা বলেছে বড়লোকদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে, পটিয়ে-পাটিয়ে টাকা নিতে দোষ নেই–তুই একবার যা না, দেখ না কী বলে–
সেদিন অনেকবার ভাববার পর দীপঙ্কর গিয়েছিল। বলতে গেলে কিরণই পাঠিয়েছিল জোর করে–
সতী তখন ছিল না বাড়িতে। দীপঙ্কর জানতো সে সময়ে সতী থাকে না। বৃহস্পতিবার ছোট মেয়েটা আসে দেরি করে। লক্ষ্মীদির কলেজের গাড়িটা গলির মোড়ে এসেই একবার হর্ন বাজায়। দীপঙ্কর তৈরিই ছিল। লক্ষ্মীদি বাড়িতে ঢুকছিল, দীপঙ্কর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।
ডাকলে—লক্ষ্মীদি—
লক্ষ্মীদি ডাক শুনেই পেছন ফিরেছে। বললে–দীপু? কী রে?
–তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে লক্ষ্মীদি!
–কথা আছে তো ভেতরে আয় না!
দীপঙ্কর বললে–তোমাকে একলা বলবো-কারোর সামনে বলতে চাই না। লক্ষ্মীদি হাসল! বললে–কেন রে! খুব গোপন কথা বুঝি?
–না, তোমার বোনের সামনে বলতে চাই না–কেন? সতী কী করলে তোর?
–তোমার ছোট বোন আমাকে দেখতে পারে না।
–কী করে বুঝলি তোকে দেখতে পারে না?
–কী জানি! তোমার সঙ্গে বেশি কথা বলি বলে হয়তো। কিন্তু আমি তাকে কিছুই বলিনি কোনওদিন, অথচ আমাকে দেখলেই গম্ভীর হয়ে যায়। সেই জন্যে তো আগেকার মতোন তোমাদের বাড়িতেও আসি না। অথচ তোমার কাছে শুনেছিলাম, তোমার বোন খুব ভালো–
–তা আমি বুঝি সতীর চেয়েও ভালো?
দীপঙ্কর হাসলো শুধু। কিছু বলতে পারলে না মুখ ফুটে। তারপরে
লক্ষ্মীদি বললে–আয়, ভেতরে আয়, সতী এখন নেই বাড়িতে–কী কথা আছে তোর শুনবো–
ওপরে লক্ষ্মীদি পড়ার ঘরে গিয়ে বইগুলো রাখলে। জানালাটা খুলে দিলে। দীপঙ্কর ভাবছিল, কেমন করে লাইব্রেরীর চাঁদার কথাটা পাড়বে। একখানা রসিদ-বই দিয়ে দিয়েছিল কিরণ। ‘দি কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরী’র রসিদ বই। রবার স্ট্যাম্প লাগানো। কথাটা পাড়তে কেমন দ্বিধা হচ্ছিল। দু টাকা চাঁদা চাইতেও কেমন লজ্জা হচ্ছিল। দু টাকা কি সোজা কথা! দু টাকা না হলে এক টাকা। কিরণ বলে দিয়েছিল–আর যদি এক টাকা না দিতে চায় তো আট আনা, আট আনাই সই-আট আনা দিতে চাইলেও ছাড়বি না-দুখানা করে বই পাবে দিনে–ভালো করে বুঝিয়ে বলতে পারবি তো, না হাঁদার মতন কেবল সুন্দর মুখের দিকে চেয়ে সব ভুলে যাবি?
লক্ষ্মীদি একটা শাড়ি আর শেমিজ নিয়ে বাইরে গেল। বললে–তুই বোস্ আমি আসছি
কিরণ বলেছিল–যে-কোনও রকমে মেম্বার ওদের করতেই হবে বুঝলি–আর তুই যদি না পারিস তো আমাকে নিয়ে যাস্ সঙ্গে করে, আমি ঠিক মেম্বার করে নেব ওদের-সব্বাইকে মেম্বার করলাম আমি! রাখাল, নির্মল পালিত, সব্বাইকে তো আমিই মেম্বার করলুম-তাহলে তোকে প্রেসিডেন্ট করে লাভটা কী আমার–
লক্ষ্মীদি ঘরে এল। বললে–চা খাবি?
চা? দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। সত্যিই লক্ষ্মীদিকে বেশ দেখাচ্ছে। শাড়িটা বদলে পরেছে। পরে আয়নার সামনে গিয়ে পাউডার ঘষছে মুখে। চুলের খোঁপাটা ঠিক করে নিচ্ছে। না, হঠাৎ সামলে নিলে দীপঙ্কর। কিরণের কথাটা মনে পড়লো। সুন্দর মুখের দিকে চেয়ে সব ভুলে যাবে না সে। বড়লোক যারা, তাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে পটিয়ে-পাটিয়ে কাজ আদায় করতে হবে। কিরণকে ভজুদা বলেছে।
দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ খাবো।
রঘু এক কাপ চা এনে দিয়েছিল। লক্ষ্মীদি সেদিকে ঘাড় ফিরিয়ে বললে–আর এক কাপ নিয়ে আয় রে রঘু–দীপুও চা খাবে আজ–
রঘুও অবাক হয়ে গেছে। বললে–দীপুবাবু, চা খাও তুমি?
দীপঙ্কর বললে–খাই না, শুধু আজ খাবো—
লক্ষ্মীদি বললে–আমার কথায় চা খাচ্ছে ও–
রঘু আবার চা দিয়ে গেল। কিরণ বলেছিল চা মানে কুলির রক্ত! কিন্তু হোক কুলির রক্ত। হয়তো কিরণ শুনলে রাগ করবে। দি কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরী’র প্রেসিডেন্ট হয়ে কেন সে চা খেলে? কিন্তু সেদিন লক্ষ্মীদির সঙ্গে এক টেবিলে পাশাপাশি বসে চা খেতে তার ভালোই যে লেগেছিল! পরে জীবনে অনেকবার এই তার প্রথম চা খাওয়ার কথাটা মনে পড়েছে। চা খাওয়ার জন্যে নয়–কিন্তু লক্ষ্মীদির আদরের জন্যেই চা খাওয়াটা তার স্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু পরে মনে হয়েছিল, সেদিন সে চা খায়নি, বিষ খেয়েছিল। সক্রেটিসের মতন হেমূলক খেয়েছিল দীপঙ্কর, কিন্তু সক্রেটিসের মতন সে বলতে anca-Be hopeful then, gentlemen of the jury, as to death; and this one thing hold fast, that to a good man, whether alive or dead, no evil can happen, nor are the gods indifferent to his well-being.
লক্ষ্মীদি হঠাৎ বললে–চা কেমন লাগলো রে তোর দীপু?
দীপঙ্কর বললে–খুব ভালো লক্ষ্মীদি–
–তবে? তবে যে চা খাস না তুই?
দীপঙ্কর বললে–তোমার সঙ্গে বসে খাচ্ছি বলে বোধহয় ভালো লাগছে এত–অন্য কারুর সঙ্গে খেলে হয়তো এত ভালো লাগবে না
লক্ষ্মীদি হো-হো হেসে উঠলো। বললে–তুই তো বেশ কথা বলতে শিখেছিস 693175-when my Daisy sits by me, I need no sugar in my tea—কী বল?
একদিন চকোলেট দিয়েছিল লক্ষ্মীদি, সে অনেকদিন আগেকার কথা, সেদিন সে চকোলেট দীপঙ্কর খেতে পারেনি। সেদিন সন্দেহ হয়েছিল তার। তারপর অনেকবার দেখেছে লক্ষ্মীদিকে অনেকভাবে মিশেছে-এখন আর সন্দেহ হয় না। দীপঙ্কর চায়ের শেষ ফোঁটাটুকু পর্যন্ত গলায় ঢেলে নিঃশেষ করে দিলে।
তারপর বললে–তোমার ছোট বোন এখুনি এসে পড়বে না তো?
–কেন রে? সতীকে তোর অত ভয় কেন বল তো?
দীপঙ্কর বললে–ভয় নয়; কেমন যেন আমাকে পছন্দ করে না মনে হয়
–কেন? তোকে কিছু বলেছে?
দীপঙ্কর বললে–বলেনি কিন্তু আমার দিকে অমন করে চায় কেন? সেদিন ব্যারিস্টার পালিতের বাড়িতে দেখে তাই মনে হলো
লক্ষ্মীদি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বললে–বুঝেছি, সে আমার জন্যে
–তোমার জন্যে? কেন? তোমার জন্যে আমাকে অপছন্দ করবে কেন?
লক্ষ্মীদির মুখের দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। মুখটা যেন হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। লক্ষ্মীদি যেন হঠাৎ বড় গম্ভীর হয়ে গেল। লক্ষ্মীদি চোখ নিচু করে কী যেন ভাবতে লাগলো। দীপঙ্কর সেই দিকে চেয়ে কিছু বুঝতে পারলে না। হঠাৎ কী এমন ঘটল, যার জন্যে অমন গম্ভীর হয়ে গেল লক্ষ্মীদি!
দীপঙ্কর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে কী হলো তোমার লক্ষ্মীদি?
–সে তুই বুঝবি না ভাই–বড় হলে বুঝতে পারবি
দীপঙ্কর বললে–তুমি বলো না, আমি বুঝতে পারবো ঠিক–আমি তো এখন বড় হয়েছি–
–না রে, তুই বুঝবি না সব
বলে লক্ষ্মীদি আবার দীপঙ্করের মুখোমুখি চাইলে। বললে–জানিস কেউ আমায় বুঝতে পারে না, আমার বাবাও আমাকে বোঝে না সতীও আমাকে বোঝে না-মা বেঁচে থাকলে হয়তো বুঝতে–
বলে লক্ষ্মীদি টেবিলে মাথাটা ঠেকিয়ে মুখ ঢেকে ফেললে। তারপর লক্ষ্মীদির শরীরটা মাঝে মাঝে ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো। দীপঙ্কর কী করবে, বুঝে উঠতে পারলে না। লক্ষ্মীদি কি কাঁদছে নাকি! কেমন অস্বস্তি লাগলো দীপঙ্করের। লক্ষ্মীদির এমন পরিচয় তো কখনও পায়নি দীপঙ্কর। লক্ষ্মীদি তাকে মেরেছে, লক্ষ্মীদি তাকে আদর করেছে, লক্ষ্মীদি তাকে চকোলেট দিয়েছে, কিন্তু লক্ষ্মীদি তো কখনও কাঁদেনি তাঁর সামনে বসে।
দীপঙ্কর ডাকলে–লক্ষ্মীদি–
লক্ষ্মীদি তবু মুখ তুললো না। তখনও ফুলে ফুলে উঠছে শরীরটা। তাহলে লক্ষ্মীদিরাও কাঁদে! এতদিন দীপঙ্করের ধারণা ছিল, কাঁদবার জন্যে পৃথিবীতে বুঝি অন্য মানুষ আছে। মা আছে। চন্নুনী, দীপঙ্কর নিজেও আছে। কিন্তু লক্ষ্মীদিরা যে অন্য জাতের মানুষ। এই এত টাকা, এত গুণ, এত নাচ-এরাও কাঁদে নাকি!
দীপঙ্কর আবার ডাকলে–লক্ষ্মীদি, আমি আসি তাহলে–
লক্ষ্মীদি এবার মুখ তুললো। তাড়াতাড়ি চোখ দুটো মুছে নিলে আঁচল দিয়ে। একবার হাসবার চেষ্টা করলে। কিন্তু বড় ফ্যাকাশে দেখাল সে-হাসিটা। বললে–যাক গে, কিছু মনে করিস না ভাই-যা বলেছি ভুলে যা তুই–
লক্ষ্মীদি বলে কি! ভুলে যাবে দীপঙ্কর! তার সেদিনের জীবনের এত বড় ঘটনাটা সে ভুলে যাবে! তাহলে কেন সে দীপঙ্কর হয়ে জন্মেছে? কেন সে ছোটবেলা থেকে এত দুঃখ পেয়েছে? কেন তার জন্মের পর তার মাকে বিধবা হতে হয়েছে? বিধবা হয়ে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের অঘোরদাদুর বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে? কেন মানুষের আর প্রকৃতির কাছে সে এত ঋণী হয়ে রয়েছে? সকাল বেলায় রোদ, দুপুর বেলায় চিলের ডাক, আমড়া গাছের ডালের কাক, হাজি কাশিমের ভাঙা বাগান, আগুনখাকীর পুকুর আর পুকুরের ওধারের ধানক্ষেত কেন তাকে এতদিন আকর্ষণ করে এসেছে। হয়তো দীপঙ্করের ঈশ্বরের তা ইচ্ছা নয়। হয়তো সেই জন্যেই মানুষের কাছে এত আঘাত পেয়েছে। হয়তো সেই জন্যেই মানুষের কাছে এত ভালোবাসাও পেয়েছে। আঘাত আর ভালোবাসা, ঘৃণা আর আদর, অপমান আর সম্মান-এই সমস্ত দিয়েই তো সে দীপঙ্কর হয়ে উঠেছে। কে তার নাম রেখেছিল, কে জানে! তার নামের সঙ্গে তার এই স্বভাবের দিক কি তিনি দেখতে পেয়েছিলেন?
একদিন বড় হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল–আমার নাম কে রেখেছিল মা?
মা বলেছিল–কে আবার রাখবে, আমি!
–তা এত নাম থাকতে দীপঙ্কর নাম রাখতে গেলে কেন তুমি?
মা বলেছিল–বাটরার ছোটতরফের মল্লিকবাবুর নাতি হলো, তারা তার নাম রাখলে দীপঙ্কর-তা মানে তো বুঝিনি, তুই হলে তোর নামও রাখলুম দীপঙ্কর–
ছোট সংক্ষিপ্ত তার নামের ইতিহাস। কিন্তু সেদিন, সেই নাম দেবার সময় মা হয়তো ভাবতেও পারেনি যে তার দীপঙ্কর সারাজীবন তার নামের বাণীবাহ হয়ে থাকবে। সে শুধু আলো জ্বালিয়েই যাবে, নিজের অন্ধকার ঘোচাবার জন্যে আলো জ্বালাবার কেউ ই থাকবে না তার।
সেদিন লক্ষ্মীদির কাছ থেকে চলেই আসছিল দীপঙ্কর, কিন্তু হঠাৎ লক্ষ্মীদি আবার ডাকলে। বললে–শোন–
দীপঙ্কর বললে–কী?
–কাউকে বলিসনি যেন, বুঝলি? তোকে ভালোবাসি বলেই সব বলে ফেললাম, সতী যেন না জানতে পারে।
–কিন্তু তুমি তো আমাকে কিছুই বলোনি লক্ষ্মীদি!
লক্ষ্মীদি বললে–তোকে বলতে পারলেই ভালো হতো, হয়তো খানিকটা শান্তি পেতাম, জানিস–তুই না থাকলে আমি বাঁচতাম না এখানে এমন করে
–কিন্তু কী তোমার কষ্ট লক্ষ্মীদি? লক্ষ্মীদি হঠাৎ সোজা হয়ে গুছিয়ে বসলো। বললেশম্ভুকে তো তুই দেখেছিস
–শম্ভু? শম্ভু কে লক্ষ্মীদি?
–ওই যে, তার সঙ্গে তো শম্ভুর দেখা হয়েছে খিদিরপুরে, শম্ভু বলছিল যে আমাকে–
–মিস্টার দাতার?
–হ্যাঁ, যাকে তুই আমার চিঠি দিয়ে আসিস, জানিস আমার জন্যে ও সব করতে পারে, আমি বিষ খেতে বললে ও বিষ পর্যন্ত খেতে পারে, আমার জন্যে ও কী-ই না করেছে! নিজের সংসার নিজের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, নিজের ব্যবসা-ট্যাবসা সব ছেড়ে দিয়েছে। আমি কলকাতায় এসেছি, ও-ও বর্মা থেকে সব ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে এসেছে—অথচ–
–অথচ?
লক্ষ্মীদি বললে–অথচ আমার কী-ই বা আছে ব! ওর ওখানে কত বড় ব্যবসা, কত নাম, আমার জন্যেই ও সব ছাড়লো, আর আমি? আমি ওর তুলনায় কী? ওর তুলনায় আমি কতটুকু? আমি ওর জন্যে কতটুকু করতে পেরেছি? একদিন আমার খবর না পেলে ও কাঁদে জানিস–ওর ঘুম হয় না রাত্রে–
–কিন্তু….
বলতে গিয়েও দীপঙ্কর কিছু বলতে পারল না। একটু দ্বিধা হলো। লক্ষ্মীদির চোখ তখনও জলে ছলছল করছে।
লক্ষ্মীদি আবার বলতে লাগলো–কত লোক ওকে কত বুঝিয়েছে, বলেছে-তুমি এক জাতের, লক্ষ্মী আর এক জাতের, তোমাদের মিল হয় না, হতে নেই। আমিও কত বোঝাই ওকে, কত বলি–কিন্তু কিছুতেই আমাকে ভুলতে পারে না। সেই সেখান থেকে ছুটে এসেছে-যেই খবর পেয়েছে, আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে, ও-ও পালিয়ে এসেছে এখানে
দীপঙ্কর কী উত্তর দেবে বুঝতে পারলে না। লক্ষ্মীদির দিকে চেয়ে শুধু চুপ করে রইল বোবার মতো।
তারপর বললে–তাহলে কী হবে এখন?
লক্ষ্মীদি বললে–আমিও তো ওকে তাই বলি–এখন কী হবে? আর আমারও এমন হয়েছে, ওকে না দেখলে থাকতে পারি না-একদিন খবর না পেলে খারাপ লাগে–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু কাকাবাবু যদি জানতে পারে এসব?
লক্ষ্মীদি বললে–কাকাবাবু যে সব জেনে গেছে
–জেনে গেছে? আর কাকীমা?
–সবাই জেনে গেছে, সতীও জেনেছে, আমার বাবাও জেনে গেছে, তাই তো কাকাবাবুর সঙ্গে আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ভেবেছে দূরে গেলে হয়তো সব ভুলে যাবো-তাই তো এত জায়গা থাকতে এই কালীঘাটে গলির মধ্যে এসে বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে
দীপঙ্কর স্তম্ভিত হয়ে গেল কথাটা শুনে। লক্ষ্মীদির যেন হঠাৎ আর এক রূপ ভেসে উঠলো চোখের সামনে।
লক্ষ্মীদি বললে–এই দেখ না, কাল দেখা হবার কথা ছিল কলেজের সামনে কিন্তু কলেজ আগে ছুটি হয়ে গেল, বাস-এ করে বাড়ি চলে এলাম, আর কথা হলো না–সারা রাত আমার ঘুম হয়নি, আমি জানি, তারও ঘুম হয়নি রাত্রে
দীপঙ্কর বললে–কী করে জানলে ঘুম হয়নি তার?
লক্ষ্মীদি বললে–সে তুই বুঝবি না–জানা যায়–
দীপঙ্কর কিছুক্ষণ ভেবে বললে–কিন্তু এটা কি ভালো কাজ করছো তুমি মনে করো লক্ষ্মীদি!
লক্ষ্মীদি বললে–এটা ভালো কাজ তা কি আমি বলেছি? আমি তো জানি এটা খারাপ–সেই জন্যেই তো লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে চিঠি পাঠাই, লুকিয়ে লুকিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করি–
দীপঙ্কর বললে–তুমি আর চিঠি দিও না তাহলে–মিছিমিছি কী হবে সকলের মনে কষ্ট দিয়ে, তোমার বাবাও কষ্ট পাবেন শুনলে, কাকাবাবু কাকীমা সবাই কষ্ট পাবে। তুমিও মনে সুখ পাবে না, দেখোতোমার কষ্ট দেখলে আমারও কষ্ট হবে।
লক্ষ্মীদি উদাস হয়ে উঠলো। বললে–না রে, চিঠি না দিলে, দেখা না করতে পারলে আমি একদিনও বাঁচবো না–
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল লক্ষ্মীদির কথা শুনে। কিছুতেই বুঝতে পারলে না এ কেমন জিনিস!
বললে–এই যে বাবার সঙ্গে তোমার এতদিন দেখা হয়নি–সে জন্যে তোমার কষ্ট হয় না?
লক্ষ্মীদি বললে–দূর, তুই সে বুঝবি নে, বাবার সঙ্গে দেখা না হলে কষ্ট হবে কেন?
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমার মা’র জন্যে খুব কষ্ট হয় সত্যি, মনে হয়, মাকে একদিন না দেখতে পেলে বোধহয় মরে যাবো–
লক্ষ্মীদি বললে–সে অন্যরকম কষ্ট, আর এ অন্যরকম–এর কষ্টের মধ্যে আনন্দও আছে যে-এ-আনন্দ মেশানো একরকম কষ্ট–
আনন্দ মেশানো কষ্ট! দীপঙ্কর কিছুই বুঝতে পারলে না। অদ্ভুত লাগলো কথাটা!
লক্ষ্মীদি বললে–তা এখন তুই য দিপু, হয়তো সতী এখনি এসে পড়বে দীপঙ্কর যাবার জন্যে মুখ ফিরিয়েছিল।
লক্ষ্মীদি বললে–আজ তোকে অনেক কথা বললুম-কাউকে যেন বলিসনি, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে আমার-বলবি না তো?
দীপঙ্করের কানে লক্ষ্মীদির কথাটা যেন ঢুকলো না। বললে–আচ্ছা লক্ষ্মীদি, চিঠিতে তোমরা এত কথা কী লেখো?
লক্ষ্মীদি বললে–কেন, তুই পড়িস নাকি?
–না, আমি পড়তে যাবো কেন?
–না, খবরদার পড়িস না যেন। তোকে আমি বিশ্বাস করি বলেই তোর হাত দিয়ে চিঠি পাঠাই, তোকে ছাড়া এ-বাড়িতে আর কাউকে আমি বিশ্বাস করতে পারি না। বলবি না তো কাউকে?
এ কথাটাও যেন দীপঙ্করের কানে গেল না।
হঠাৎ বললে–আচ্ছা লক্ষ্মীদি, তোমরা যখন দুজনে থাকো, তখন কী কথা বলো?
লক্ষ্মীদি বললে–ওমা, আমি যে-কথা বললুম, সে-কথা তোর কানে গেল না-যত অন্য কথা জিজ্ঞেস করছিস–
দীপঙ্কর বললে–না বলবো না, কাউকে বলবো না—
–হ্যাঁ, বলিস নি–বলতে নেই–
দীপঙ্কর চলেই আসছিল। হঠাৎ লক্ষ্মীদি বললে– হ্যাঁ রে, তুই যে কী কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবি বলেছিলি? বললি আমাকে গোপনে বলবি?
সত্যিই তো! কী যেন একটা কথা বলবার ছিল! খুব জরুরী কথা! কিন্তু কিছুতেই মনে পড়লো না। কোন কথা বলতে এসেছিল সে? কী সে কথা, যা সকলের সামনে বলা যায় না?
লক্ষ্মীদি বললে–শম্ভুর সঙ্গে তোর দেখা হয়েছিল শুনলুম-তা খিদিরপুরে গিয়েছিলি তুই কী করতে?
দীপঙ্কর বললে–কিরণ যে পৈতে বিক্রি করতে যায়–কিরণকে তুমি চিনবে–আমার বন্ধু-কিন্তু মিস্টার দাতার সেদিন আমাদের খুব খাইয়েছে লক্ষ্মীদি, একেবারে পেট ভরে খাইয়েছে আমাদের দুজনকে–সন্দেশ রসগোল্লা রাজভোগ–
লক্ষ্মীদি বললেও ওইরকম–আমাকেও খাওয়ায় আমার সঙ্গে তোর খুব চেনা আছে কিনা, তাই তোকেও খাইয়েছে–
–সে আমি বুঝতে পেরেছি, দেখেছে তো যে আমি কতদিন চিঠি দিয়েছি, রোদ নেই, বৃষ্টি নেই, ঘুম থেকে উঠেই গেছি চিঠি দিতে–তাই খাওয়ালে আর কি-মিস্টার দাতার খুব ভালো, জানো লক্ষ্মীদি-অনেক কথা বললে আমাদের বললে গরীব বলে ভয় পাবার কিছু নেই, মিস্টার দাতারও একদিন নাকি খুব গরীব ছিল–
লক্ষ্মীদি বললে–তুই আর কতটুকু দেখেছিস ওর–আমি জানি ও কত ভালো–
–কিন্তু ওকে আসতে বলো না কেন এ বাড়িতে! লুকিয়ে মেশো বলেই তো সবাই পছন্দ করে না–
তা হয় না রে, অনেকবার অনেক চেষ্টা করেছে ও, আমার বাবাকে তো চিনিস তুই–
কথাটা বলতে বলতে হঠাৎ লক্ষ্মীদি থেমে গেছে। বাইরের দিকে চেয়ে কী যেন দেখলে একবার।
দীপঙ্কর বললে–থামলে কেন, বলো–
লক্ষ্মীদি বললে–বোধহয় সতী এল মনে হচ্ছে–
লক্ষ্মীদি উঠে বাইরে দেখতে গেল সতী সত্যিই এসেছে কিনা। খানিক পরে এসে আবার চেয়ারে বসলো। বললে–না, আসেনি।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তুমিও সতীকে ভয় করো বুঝি লক্ষ্মীদি
–ভয় করবো কেন, কিন্তু ও জ্ঞানে কিনা সব, সেই জন্যেই তো ওকে বাবা পাঠিয়েছে এখানে
দীপঙ্কর বললে–তাহলে আমি আর আসবো না তোমাদের বাড়িতে লক্ষ্মীদি, তাহলে সতী আমাকেও সন্দেহ করবে
–না, তোকে সন্দেহ করতে পারবে না, তুই ওর সঙ্গে খুব ভাব করিস, তাহলে তোকে কিছুতেই আর সন্দেহ করতে পারবে না।
–কিন্তু যদি জানতে পারে যে, আমি তোমার চিঠি নিয়ে দিয়ে আসি ওকে?
–জানবে কী করে? তুই না বললে সতী জানবে কী করে?
–যদি আমায় জিজ্ঞেস করে, তাহলে?
–তুই বলবি তুই জানিস না!
–কিন্তু তাহলে যে মিথ্যে কথা বলা হয়!
লক্ষ্মীদি বললে–বলবি। মিথ্যে কথা বলবি! আমার জন্যে তুই একটা মিথ্যে কথাও বলতে পারবি না?
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু মিথ্যে কি বলা উচিত, তুমিই বলো
লক্ষ্মীদি বললে–তাহলে এই তুই আমাকে ভালোবাসিস? এই তোর ভালোবাসা? দেখ না মিস্টার দাতার আমার জন্যে সব ত্যাগ করেছে
–কিন্তু মিথ্যে কথা যে আমি বলবো না প্রতিজ্ঞা করেছি!
–মিথ্যে কথা বললে ক্ষতি কী? কেউ তো জানতে পারছে না!
–কিন্তু চোদ্দ বছর মিথ্যে কথা না বললে শেষে যে অনেক লাভ–যা বলবো, তাই যে ফলে যাবে
লক্ষ্মীদি বললে–যত সব বাজে কথা! ছোটবেলায় তোদের ইস্কুলের মাস্টার ভুল শুনিয়েছে–এখন বড় হয়েছিস, এখন ওসব ভুলে যা–একদিন তোকেও তো সংসার করতে হবে, কত রকম লোকের সঙ্গে মিশতে হবে, কত রকম লোক কত কী বলবে–মিথ্যে কথা না বলে বাঁচতে পারবি?
পরে অনেকদিন যখনই সেই দিনের ঘটনার কথাটা মনে পড়েছে দীপঙ্করের, তখনই মনে হয়েছে লক্ষ্মীদি সেদিন যে তাকে আদর করে জীবনে প্রথম চা খাইয়েছে, সে চা নয়, সে বিষ। সক্রেটিস-এর হেমলক নয়, খাঁটি বিষ। সেই বোধহয় প্রথম লক্ষ্মীদিকেই সে ভালো করে ভালোবেসেছিল-আর ভালোবেসেছিল বলেই সেই বিষ খেতে পেরেছিল অমন করে! সে যে কী দ্বন্দ্ব! একদিকে তার জীবনের প্রতিজ্ঞা, আর একদিকে লক্ষ্মীদি!
লক্ষ্মীদি বলেছিল–তুই যদি সব বলে দিস, তাহলে কিন্তু আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে দীপু
–তুমি আমায় মিথ্যে কথা বলতে বোল না লক্ষ্মীদি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি!
–তাহলে তোর প্রতিজ্ঞাটাই বড় হলো? আর আমি কিছু নই, আমি কেউ নই তোর?
–অমন করে আমাকে বোলো না তুমি লক্ষ্মীদি, আমার কষ্ট হয়!
–তাহলে আমি যদি মরে যাই, তোর খুব সুখ হবে তো?
–ছিঃ, ও-কথা বলতে আছে? তুমি যেন কী লক্ষ্মীদি! তোমার মুখে কিছু আটকায় না।
লক্ষ্মীদি চেয়ার থেকে উঠে আস্তে আস্তে কাছে সরে এল। দীপঙ্করও লক্ষ্মীদিকে কাছে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল। দীপঙ্করের মুখের দিকে সোজাসুজি চোখ রেখে
লক্ষ্মীদি বললে–তুই যদি বলে দিস দীপু, তাহলে আমার মরা ছাড়া আর কোনও গতি থাকবে না
দীপঙ্কর বললে–তাহলে তুমি বলে দাও, আমি কী করবো!
লক্ষ্মীদি দীপঙ্করের হাতটা ধরলে। বললে–তুই বুঝতে পারিস না যে, একথা বলতে নেই?
দীপঙ্কর ঘাড় নাড়ালে। বললে–পারি।
–তাহলে?
দীপঙ্কর এবার চোখ নামালো। মনে হলো লক্ষ্মীদি যেন আরো কাছে সরে এল তার। একেবারে গায়ের কাছাকাছি। তারপর সেই আগেকার মতন তার মাথায় হাত রাখলো। নিজের হাত দিয়ে তার চুলগুলো গুছিয়ে দিতে লাগলো।
বললে–তুই জানিস্ না দীপু, তোকে আমি কত ভালোবাসি—
তারপর একটু থেমে বললে–এ কি তুই কাঁদছিস?
হয়তো দীপঙ্করের চোখ একটু সজল হয়ে এসেছিল কিন্তু লক্ষ্মীদির কথায় আর তা বাধা মানলো না। একেবারে ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো তার দু’গাল বেয়ে। লক্ষ্মীদি তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিলে।
বললে–কাঁদে না, ছিঃ–আমি মরে যাবো বলেছি বলে কাঁদতে আছে? বলছি বলে কি আর সত্যি সত্যিই মরবো? কাঁদিসনি, তুই দেখছি ঠিক আমার মতোই সেন্টিমেন্টাল–এত সেন্টিমেন্টাল হলে চলে?
তারপর দুই হাতে দীপঙ্করকে বুকের মধ্যে রেখে সান্ত্বনা দিতে লাগলো-জীবনে এখন আরো কত জিনিস দেখতে হবে তোকে, সারা জীবনটাই পড়ে রয়েছে তোর, কত দেখবি, কত ঠকবি, কত শিখবি! দেখা-শেখার কত বাকি রয়েছে তোর–এখনই এত ভেঙে পড়লে চলবে কেন-কাঁদিস নি–
বলে লক্ষ্মীদি আঁচল দিয়ে দীপঙ্করের চোখ দুটো মুছিয়ে দিলে।
বলতে লাগলো-লক্ষ্মীটি আমার, কাঁদে না, তোকে বিশ্বাস করি বলেই তোর হাত দিয়ে চিঠি পাঠাতুম, সব কথা বলতুম তোকে, তোর কাছে আমার কোনও লজ্জা নেই, চুপ কর, কাঁদিসনি লক্ষ্মী ভাইটি আমার–
তারপর ভালো করে মুখটা আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে বললে–তুই তো জানিস না আমার জীবনে আমি কত কষ্ট পেয়েছি। নিজের মা নেই যে তার কাছে মনের কথা বলবো, ছোটবেলা থেকেই ফাঁকার মধ্যে মানুষ, বাবা থেকেও নেই আমার, বাবা সারাদিন ব্যবসা নিয়ে মেতে আছে–এক পেয়েছিলাম ওকে–কিন্তু ওকেও আমার কাছ থেকে সবাই কেড়ে নেবে বলে ঠিক করেছে! জানিস কতবার আত্মহত্যা করবার কথা ভেবেছি, মরতে সত্যিই আমার কষ্ট হবে না, কিন্তু ওর কথা ভেবেই আমার মরা হয় না, ওর বড় কষ্ট হবেও বাঁচবে না তাহলে–
দীপঙ্কর ততক্ষণে একটু শান্ত হয়েছিল।
লক্ষ্মীদি বললে–কেমন, কথা রাখবি তো আমার? কাউকে বলবি না তো?
দীপঙ্কর বললে–না–
–এই তো লক্ষ্মী ছেলের মতো কথা। বলে লক্ষ্মীদি তার গালে আঙুল দিয়ে খুচরো আদর করলে একটু বললে–সতী জিজ্ঞেস করলেও মিথ্যে কথা বলতে পারবি তো?
দীপঙ্কর বললো—হ্যাঁ–
দীপঙ্কর আস্তে আস্তে চলে আসছিল। দীপঙ্করের মনে হচ্ছিল তার যেন নেশা হয়েছে। দুর্গাপুজোর সময় সিদ্ধি খেলে যেমন হয় ঠিক তেমনি। মনে হলো যেন টলছে সে। অথচ কেন তার এমন হলো, কিছু তো তার হয়নি! কিছুই তো সে খায়নি! শুধু চা খেয়েছিল সে এক কাপ চায়ে কিছু ছিল নাকি! কিছু নেশার জিনিস! চা খেলে মানুষ বুঝি এমন করে টলে!
লক্ষ্মীদি তাকে বিষ খাইয়ে দিয়েছে আদর করে। হেমলক নয়, সত্যিকারের খাঁটি বিষ। প্রাণমথবাবু যা কিছু ক্লাসে শিখিয়েছিলেন সব যেন সে ভুলে গেছে, এক মুহূর্তের জন্যেও তা আর তার মনে পড়বে না।
লক্ষ্মীদি কাছে এসে কাঁধটা ধরলে। বললে–কী হলো রে তোর?
লক্ষ্মীদির ঝাঁকুনি খেয়ে কথাটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। বললে—লক্ষ্মীদি–
–বল্ না কী বলবি বল?
–আচ্ছা, কাকাবাবু কোথায় কাজ করে?
–কাকাবাবু? কেন? হঠাৎ ও-কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
দীপঙ্কর বললে–সবাই যে আমাকে জিজ্ঞেস করে! দুনিকাকা, ছোনেদা, পঞ্চাদা, মধুসূদনের বড়দা-টড়দা পাড়ার যত লোক সব্বাই জিজ্ঞেস করে কি না–
–তা এই কথা জিজ্ঞেস করবার জন্যেই বুঝি তুই এসেছিলি?
দীপঙ্করের তখন মনে নেই কী করতে এসেছিল লক্ষ্মীদির কাছে। তাড়াতাড়ি বললো, এই কথা জিজ্ঞেস করতেই এসেছিলাম আমি
–তা সেটা তো কাকাবাবুকেই জিজ্ঞেস করতে পারিস।
হ্যাঁ, তাও তো বটে। কাকাবাবুকেই তো সে-কথা জিজ্ঞেস করতে পারে দীপঙ্কর। আশ্চর্য, এই সামান্য কথাটা জিজ্ঞেস করতেই সে এসেছির নাকি! এই সামান্য কথাটার জন্যে একলা লক্ষ্মীদির ঘরে আসার তার কিসের দরকার ছিল? আসলে কী করতে সে এসেছিল, তাই-ই তো তার মনে নেই আর। আসলে লক্ষ্মীদির কাছে আসতে বোধহয় ভালো লাগতো তার। আসলে সতীকে এড়িয়ে লক্ষ্মীদিকেই সে চাইতো হয়তো।
বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতেই নজরে পড়লো ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন-এ বেলা পড়ে এসেছে। ডালপুরী, ঘুগনিদানাওয়ালা হাতে মস্ত একটা পুঁটলি ঝুলিয়ে হাঁকতে আঁকতে চলেছে গলি দিয়ে। বাইরে পইঠের ওপর দাঁড়িয়ে দীপঙ্করের মনে হলো এতদিনে যেন সে নিজেকে আবিষ্কার করলো। এতদিনে যেন সে নিজেকে চিনতে পারলো। লক্ষ্মীদি যেন তাকে চিনিয়ে দিলে। আর মনে পড়লো তাদের কলেজের প্রফেসরের কথাটা। লাইফ অফ সক্রেটিস্।
Be hopeful then, gentleman of the jury, as to death; and this one things hold fast, that to a good man, whether alive or dead, no evil can happen, nor are the Gods indifferent to his well-being.
দীপঙ্কর সত্যিই সেদিন চা খায়নি, বিষই খেয়েছিল!
১১
কিরণ ঘুরঘুর করছিল গলির ওপারে। দীপঙ্করকে দেখেই দৌড়ে এল। বললে–কত দিলে রে? এক টাকা না আট আনা-?
দীপঙ্কর হতভম্বের মতো চেয়ে রইল কিরণের দিকে। কিরণ যে তার জন্যে অপেক্ষা করছে সে-কথা ভুলেই গিয়েছিল দীপঙ্কর।
কিরণ বললে–কী রে? কী ভাবছিস? আমি দু’ ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি তোর জন্যে।
ভাবছিলাম বোধহয় পাঁচ টাকা আদায় করবি। তা বলেছিস তো যে দুখানা করে বই পাবে পড়তে?
দীপঙ্কর বললে–বলিনি।
–বলিসনি? তাহলে কত টাকা চাঁদা দিলে? রসিদ-বইটা দেখি?
এতক্ষণে রসিদ-বইটার কথা মনে পড়লো দীপঙ্করের। পকেট থেকে বার করতেই কিরণ পাতা ওল্টা লাগলো। একটা পাতায় এসে বললে–এ কী রে? কিচ্ছু দেয়নি?
দীপঙ্কর বললে–আমি বলিনি ভাই, চাঁদার কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলুম।
–যাঃ চলে! চাঁদার জন্যে গেলি মেয়েটার পেছন-পেছন আর আসল কাজটাই ভুলে গেলি? তাহলে এতক্ষণ এই দু’ঘণ্টা ধরে কী করছিলি? রগড়া-রগড়ি?
দীপঙ্করের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে চেয়ে কিরণ বললে–না, দেখছি তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না, তোকে প্রেসিডেন্ট করবো না-এবার ইলেশন করে আমি প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি দুই-ই হবে–একটা সামান্য কাজ তোকে দিয়ে হবে না। আমি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে চাঁদা আদায় করে করে লাইব্রেরী দাঁড় করাবো আর তুমি নামকো ওয়াস্তে প্রেসিডেন্ট হয়ে বসে থাকবে, সে-সব চলবে না
তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে বললে–তাহলে এতক্ষণ তোদের কী কথা হচ্ছিল, বল? ব আমাকে
দীপঙ্কর বললে–সেসব অন্য কথা!
অন্য কথা মানে? অন্য কথা মানে কী? ও-মেয়েটার সঙ্গে তোর কিসের অন্য কথা থাকতে পারে? ওরা বড়লোক আমরা গরীব-গরীবদের সঙ্গে বড়লোকের মেয়েদের কী কথা থাকতে পারে শুনি?
দীপঙ্কর বললে–না রে লক্ষ্মীদি খুব ভালো মেয়ে, বড়লোকদের মতো নয়
–বড়লোক আবার বড়লোকদের মতো নয় মানে কী? সব বড়লোক এক জাতের। ও আমার দেখা আছে। ভজুদা বলে, ইংরেজরা যা বড়লোকরাও তাই-ইংরেজরা যখন এখানে আসে তখন থেকে বরাবর বড়লোকদের শিখণ্ডি করে গরীবদের মাথায় হাত বুলিয়ে আসছে। ভজুদা তো মিথ্যে কথা বলবে না, ভজুদার মতন লার্নেড় লোক মিথ্যে কথা বলতে পারে না, সব মুখস্থ, ইংরেজী, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, নেপালী, বার্মিজ সব ভাষা একেবারে গুলে খেয়েছে ভজুদা
দীপঙ্করের যেন সে-সব কথা কানেও গেল না।
বললে–না রে, তুই জানিস না, লক্ষ্মীদির খুব কষ্ট–
–কষ্ট? কিসের কষ্ট? অত টাকা তবু কষ্ট?
–হ্যাঁ ভাই, ভীষণ কষ্ট, লক্ষ্মীদির কষ্ট দেখে আমারও কেমন মায়া হচ্ছিল।
কিরণ বললে-–ছাই কষ্ট, আমাকেই দেখ না, আমার চেয়ে আর কার কষ্ট বেশি হতে পারে!
দীপঙ্কর বললে–আগে তাই-ই ভাবতুম ভাই, কিন্তু লক্ষ্মীদির জীবন আমাদের চেয়েও কষ্টের, বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝায় যায় না। বাইরে থেকে তো বেশ রঙিন শাড়ি পরে থাকে, বাস্-এ করে কলেজে যায়, হাসে, গল্প করে, অনেক বড়লোক, লেখাপড়া শিখেছে, নাচ শিখেছে, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে খুব দুঃখ কষ্ট আছে লক্ষ্মীদির জানিস–
–কী করে জানলি তুই?
দীপঙ্কর বললে–আমাকে বললে যে লক্ষ্মীদি–
–কী কষ্ট গুনিই না!
–ভাই, সে বলা যায় না—
কিরণ বললে বলা যায় না মানে? কষ্টের একটা মানে থাকবে তো? যেমন খেতে পায় না, কিংবা লেখা-পড়ার টাকা নেই, কিংবা বাড়িতে কেউ দেখতে পারে না
দীপঙ্কর বললো ঠিক তাই
–তা দেখতে পারে না কেন? কী দোষ করেছে তোর লক্ষ্মীদি?
দীপঙ্কর বললে–দোষ কিছুই করেনি, বলতে পারিস ভাগ্যের দোষ, ভাগ্যের জন্যে : খুব কষ্ট পাচ্ছে, তা ছাড়া মা নেই কিনা
–তা মা কি সকলের চিরকাল থাকে? একদিন-না-একদিন মা তো মারা যাবেই! আসলে তোকে ওই সব বলে বুঝিয়েছে। নারীচরিত্র বোঝা বড় শক্ত-ভজুদা বলে…যাক তোকে এসব বলে কোনও লাভ নেই-মেয়েমানুষ তো, ওরা ও-রকম বলে ভোলাবার জন্যে! ওই বলে তোকে ভুলিয়ে দিয়েছে। আর তুইও যেমন বোকা, তুইও ওই কথায় ভুলে চাঁদা চাইতে ভুলে গেলি
দীপঙ্কর বললে–সেদিন যে সেই লোকটা তোকে পাঁচটা টাকা দিয়েছিল, সেটা কী করলি?
–সেই এস্ এ দাতার? সেটা রেখে দিয়েছি, একটা আলমারি কিনবো ও-টাকাটা দিয়ে, লুকিয়ে রেখে দিয়েছি, নইলে মা দেখতে পেলে হয়তো ওই টাকা দিয়ে বাবার ওষুধ কিনে ফেলবে, মা’র হাতে একটা পয়সাও নেই ক’দিন ধরে, জানিস–
রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে অনেকদূর চলে গিয়েছিল। কালীঘাটে তখন সন্ধ্যের অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। অফিস-ফেরত লোকজন বাড়ির দিকে আসছে সবাই। এই সময়ে বন্ধুর দোকানে তেলে-ভাজার ভিড় জমে। এই সময়েই এ-পাড়ায় কুলপি বরফওয়ালারা আসে, পাঁঠার ঘুগনিওয়ালারা আর একবার ঘুরে যায়। এই সময়ে চণ্ডীবাবুদের মন্দিরে আরতির ঘণ্টা বাজে।
দীপঙ্কর বললে–কোথায় যাবি তুই এখন?
কিরণ বললে–কোথাও যাবো না এখন, এখন রাস্তায় ঘুরলে ক্ষিদে পাবে, তার চেয়ে লাইব্রেরীতে গিয়ে বসি গিয়ে চল–তুই প্রেসিডেন্ট অথচ তুই মোটে যাস না, মেম্বাররা সবাই জিজ্ঞেস করে আমাকে–
কিরণ লাইব্রেরীটাকে বেশ সাজিয়েছিল। খড়-কুটো দিয়ে বেশ একটা চালাঘর মতন করে নিয়েছিল। ছেঁড়া মাদুর একটা পেতে দিয়েছিল মেঝেতে। বইগুলো থাক থা করে সাজিয়েছিল। কালীঘাটে বই-এর দোকান ছিল না। বই কিনতে যেতে হতো অনেকদূরে। সেই পূর্ণ থিয়েটারের সামনে চাউলপটিতে। রায়চৌধুরী কোম্পানীর দোকান থেকে বই কিনতে হতো। নতুন বই আর কটাই বা। তবু কিরেছিল কিরণ দু’একটা। বিনয় সরকারের বর্তমান জগৎ’, বুকার টি ওয়াশিংটনের জীবনী’, নিগ্রো জাতির কর্মবীর’, জোনাথন সুইফটের ‘গালিভার্স ট্রাভেলস্’। তারপর ছিল রবিনসন ক্রুসো’, Fem utspattet nog ‘India In World Politics’, J. T. Sanderland-এর ‘India In Bondage’, একগাদা টাইমটেবিল, হোয়াইটওয়ে লেড়-ল’র ক্যাটালগ। আরো কত নাম-না-জানা বই। যেখানে যা কিছু পেয়েছিল সব যোগাড় করে এনেছিল কিরণ। অনেকদিন লাইব্রেরীর মধ্যে মাদুরের ওপর চিৎপাত হয়ে শুয়ে শুয়ে কিরণ কত স্বপ্ন দেখেছে। বলেছে-বুঝলি দীপু, ভজুদা বলেছে, বই পড়লে খুব নলেজ হয়-যত বই পড়বি তত নলেজ হবে–
কিরণ কত বই পড়তে আর গল্প করতো তখন। আয়াল্যান্ড, ইটালী আর রাশিয়ার ইতিহাস। ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস। বই পড়ে ভালো লাগলেই দৌড়ে আসতো দীপঙ্করের কাছে।
একেবারে লাফাতে লাফাতে আসতো কিরণ।
দীপঙ্কর অবাক হয়ে যেত কিরণকে দেখে। বলতো-কী রে, হঠাৎ এত আনন্দ, কী হলো তোর?
কিরণের বাবা ভালো হয়ে গেছে কি? কিরণদের বাড়ি হয়েছে কি? কিরণের চাকরি হয়েছে কি? না, সে সব কিছুই না।
বলতো–না রে, মাইরি, ওঃ এমন একটা বই পড়ছি না, পড়লে তুইও চমকে যাবি
–কী বই?
বইটা দেখালে কিরণ বললে–ভজুদা দিয়েছে আমাকে পড়তে-এই দেখ–
কী বই, কী নাম, কার লেখা তা আজ আর মনে নেই দীপঙ্করের। কোন ফরাসী লেখক। তারই জীবনী। যতদূর মনে পড়ে Babeuf-এর জীবনী! কিরণের ভজুদা কোথা থেকে সব অদ্ভুত বই দিত পড়তে। সেসব বই আজকাল আর চোখেও পড়ে না।
কিরণ বললে–এইখানটা পড়ে দেখু-কী চমৎকার লিখেছে–
সে কবেকার কোন যুগের কথা। ১৭৮৯ সালের একদিন ফরাসী দেশেও ঠিক এমনি অবস্থা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর পৃথিবীতে একদিন যন্ত্রসভ্যতার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ফরাসী দেশে আর এক নতুন সভ্যতার সূত্রপাত হলো। সেদিন সেখানকার অবস্থাও ছিল ঠিক এখনকার মতো। সেখানকার অঘোরদাদুরাও ঠিক এমনি করে দেবতার নৈবেদ্য চুরি করে যজমান ঠকাতো। সেখানকার চন্নুনীরাও লেখাপড়া শিখতে না পেরে, কুশিক্ষা আর অশিক্ষার অন্ধকারে কুৎসিত গালাগালি দিয়ে জীবন কাটাতো। সেখানেও ছিল দুনিকাকা, সেখানেও ছিল পঞ্চাদা, ছোনেদা, মধুসূদনের বড়দা। সেখানকার পাড়ার রোয়াকে বসে তারও ঠিক এমনি করে আড্ডা দিত আর ফোড়ন কাটতো। সেখানেও সেই ফরাসী দেশেও ছিল কালীঘাটের মতো ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন, সেখানকার ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনেও রোদ ঢুকতো না, শিক্ষা ঢুকতো না, সভ্যতা ঢুকতো না সেদিন। সি আর দাশ মারা যাবার দিন সেখানেও কোনও পরিবর্তন হতো না–সবই ঠিক এমনি করেই নির্বিকার হয়ে থাকতো। হুজুগের সময় চরকা কাটতো আবার হুজুগ চলে গেলে চরকা ফেলে দিত। সেখানও লক্ষ্মীদির মতো মেয়েরা লুকিয়ে লুকিয়ে ছোট ছেলেকে চকোলেট দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে শম্ভুদের কাছে চিঠি পাঠাতো। সেখানেও কিরণরা রাস্তায় রাস্তায় পৈতে বিক্রি করতো–আর দীপঙ্করের মায়েরা পরের বাড়িতে রান্না করতো আর ছেলে মানুষ করার স্বপ্ন দেখতো। আর সেখানেও যারা বড়লোক, যারা ব্যারিস্টার পালিতের মতো বড়লোক, যারা অঘোরদাদুর যজমানদের মতো বড়লোক, সেই লখার মাঠের একাদশী বাড়জ্জে আর চাউলপটির শশধর চাটুজ্জের দল কড়ি দিয়ে সব কিনে ফেলতো–পাপ কিনতো, পুণ্য কিনতো, ধর্ম কিনতো, অধর্ম কিনতো; সেই সঙ্গে সম্মান, প্রতিষ্ঠা, যশ, কীর্তি, অমরত্ব সব কিনে ফেলতো!
কিরণ বললে–একেবারে হুবহু আমাদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ঠিক বল
সত্যিই মিলে যাচ্ছিল। সেখানেও চৌরঙ্গীপাড়ায় থাকতো বড়লোকরা। আলিপুরের বড় বড় বাড়িতে থাকতো সাহেবরা। বেলভেডিয়ারের বড়লাটের বিরাট বাড়িটা সারা বছর খালি পড়ে থাকতো বছরে একবার ব্যবহারের জন্যে। সেই কদিনের ব্যবহারের জন্যে সারা বছর হাজারটা চাকর, হাজারটা মালি বসে বসে ঘর-বাগান পরিষ্কার রাখতো আর ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের নর্দমার ধারে ময়লা উপচে পড়তে পাহাড় হয়ে, সে পরিষ্কার করবার লোক থাকতো না একটা। সেখানকার রাজাও থাকতো কোথাকার কোন প্রাসাদে। রাজার ছিল পনের হাজার চাকর আর রানীর পাঁচশো–
কিরণ বললে–দেখেছিস, ঠিক আমাদের বড়লাটের মতন মাইরি–একেবারে হুবহু–
দীপঙ্কর আরো পড়তে লাগলো। অদ্ভুত ঘটনা সব ঘটেছে সেখানেও। সেখানেও খেতে পেত না মানুষ ঠিক এখানকার মতো। সেখানেও কিরণরা নর্দমার ডাব কুড়িয়ে পেট ভরিয়েছে আর সেখানকার অঘোরদাদুরা সন্দেশ এনে ঘরে পুরে পচিয়েছে। কিংবা ডালার দোকানে বেচেছে।
–তারপর আরো আছে, আরো পড়ে দেখ–
ছোটবেলার পড়া সেই ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস পরে পড়েছে দীপঙ্কর, কিন্তু সেদিন কিরণই প্রথম পড়িয়েছিল দীপঙ্করকে। কিরণই দেখিয়েছিল পথ। সেই ফরাসী বিপ্লব থেকে শুরু করে যুদ্ধ পর্যন্ত সে এক বিচিত্র ইতিহাস। নেপোলিয়ন থেকে বিসমার্ক পর্যন্ত সে এক বিচিত্র উপন্যাস।
একটা লাইন দাগ দেওয়া ছিল। লাল পেন্সিলের দাগ।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–এখানে দাগ দিয়েছে কে রে?
কিরণ বললে–ভজুদা–পড়ে দেখ–
দীপঙ্কর পড়তে লাগলো। Babeuf বলছে–
When I see the poor without the clothing and without the shoes which they themselves are engaged in making, and contemplate the small minority who do not work any yet want for nothing. I am convinced that Government is still the old conspiracy of the few against the many, only it takes a new form–
–চমৎকার, কী বল?
তারপর একটু ভেবে জিজ্ঞেস করলে-conspiracy মানে কী রে?
দীপঙ্কর বললে–ষড়যন্ত্র!
কিরণ বললে–ঠিক বলেছে, আসলে বাইরে বাইরে সব বক্তৃতা করে আর লোক-দেখানি, বুঝলি–আসলে সব বড়লোকরা একজাতের, সব শেয়ালের এক রা–
দীপঙ্কর বলতো-কিন্তু লক্ষ্মীদিরা অন্যরকম ভাই
কিরণ বলতোদর, সব ষড়যন্ত্র ওদের–এই লক্ষ্মীদিরাও যা, তোর ওই পালিতরাও তাই। তুই ফরসা মুখ দেখে ভুলে গেছিস-দেখবি তোর কাকাবাবু চাঁদা দেবে না, কিছুতেই চাঁদা দেবে না–
কিন্তু না, সেদিন হঠাৎ পাড়াতেই কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা। সন্ধ্যেবেলা ঠিক সময়ে অফিস থেকে আসছেন। সেদিন কিন্তু বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিচ্ছদ। কোট প্যান্ট পরেছেন, মাথায় সোলার টুপি। বললেন–এই যে দীপুবাবু–
দীপঙ্কর এগিয়ে গেল কাছে, বললে–আপনি এত সকাল-সকাল আসছেন আজ
–তা আসবো না, কাজ না থাকলে বাড়ি আসবো না–
একবার মনে হলো জিজ্ঞেস করে কাকাবাবু কী কাজ করেন, কোন অফিসে চাকরি করেন। কিন্তু তারপরেই মনে পড়লো চাঁদার কথাটা। বললে–কাকাবাবু আমাদের চাঁদা দেবেন?
–চাদা? কীসের চাঁদা?
–আমাদের লইব্রেরীর–
–লাইব্রেরী করেছ নাকি তোমরা? বেশ বেশ, ভালো কথা–
কাকাবাবু খুব উৎসাহ দিলেন। কথাগুলো বলছিল দীপঙ্কর আর কিরণ এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কাকাবাবুর উৎসাহ পেয়ে কিরণ আর থাকতে পারলে না। বললে কাকাবাবু আমি হচ্ছি লাইব্রেরীর সেক্রেটারী আর দীপু প্রেসিডেন্ট–
–তাই নাকি? বাঃ, খুব ভালো কথা তো, কোথায় লাইব্রেরী করেছ তোমাদের?
অনেক খবর নিলেন কাকাবাবু। বই পড়া খুব ভালো জিনিস। কত ভালো-ভালো বই আছে পৃথিবীতে তার ইয়ত্তা নেই। সংসারে মানুষ হতে গেলে বই পড়া দরকার।
কাকাবাবু বললেন–তোমাদের লাইব্রেরীটা আমি দেখবো একবার দীপুবাবু কিরণ বললে–এখনি চলুন না
দীপঙ্কর বললে–আমাদের পাঁচশো বই হয়ে গেছে, আরো বই কিনবো–আপনাকে চাঁদা দিতে হবে কিন্তু কাকাবাবু
কাকাবাবু বললেন–তা দেব চাঁদা–কত দিতে হবে?
দীপঙ্কর হঠাৎ এ-কথার উত্তর দিতে পারলে না। যত টাকা দেবে ততই তো ভালো। এক টাকা চাইবে, না দশ টাকা চাইবে তাই ভাবতে লাগলো দীপঙ্কর। কিরণ বাঁচিয়ে দিলে। বললে–আপনি দু টাকা করে দেবেন কাকাবাবু
কাকাবাবু বললেন–তা তাই দেব—
কিরণ বললে আপনাকে দু’খানা করে বই দেব–
কাকাবাবু বললেন–তা তাই দিও
কিরণ বললে–এখুনি চলুন না আমাদের লাইব্রেরীতে, একটু দেখবেন, আপনার উৎসাহ পেলে আমরা আরো বড় করতে পারবো লাইব্রেরীকে–আপনাদের সাহায্যের ওপরেই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে–আপনি চলুন না, একটু দেখবেন–
কাকাবাবু সেই অফিস-ফেরত অবস্থাতেই গেলেন লাইব্রেরীতে। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন দিয়ে ঢুকে নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটের গলির মধ্যে একেবারে বস্তির কাছে। দু’পাশে কাঁচা নমা। অন্ধকার চারিদিকে। কিছু দেখা যায় না। অনেক দূরে গ্যাসের আলোর একটু রেখা এসে পড়েছে এখানে-ওখানে। তখনকার দিনের কালীঘাটের বস্তি। ভাঙা পাচিল, নোনাধরা ইট আর কাঁচা নর্দমা পেরিয়ে কাকাবাবুকে নিয়ে যেতে কেমন লজ্জা করছিল দীপঙ্করের!
কিরণ বললে–একটু টাকা হলেই আমরা অন্য জায়গায় ঘর ভাড়া নেব, এখন প্রথম স্টার্ট করেছি তাই…
কাকাবাবুর কিন্তু কিছুতেই বিকার ছিল না। বললেন–তাতে কী হয়েছে, ছোট থেকেই তো সবাই বড় হয়
তারপর কিরণদের বাড়ির সামনে এসে খড়-কুটো-দেওয়া চালাঘরটা দেখে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন–এই বুঝি তোমাদের লাইব্রেরী?
সামনে সাইনবোর্ডটা ঝুলছিল।–বড় বড় হরফে লেখা ‘দি কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরী’।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন-ভেতরে যাওয়া যায় না?
কিরণ বললে–আমি আগে হারিকেনটা জ্বালি–আপনি মাথাটা নিচু করে আসবেন–
এতদিন পরে সেদিনকার সেই ঘটনাটা মনে পড়লো দীপঙ্করের। লজ্জাও হয়, হাসিও পায়। আবার দুঃখও হয়। কিন্তু তখন তো জানতো না দীপঙ্কর কেন অত আগ্রহ নিয়ে কাকাবাবু তাদের লাইব্রেরী দেখতে গিয়েছিলেন! কেন অফিস থেকে পরিশ্রম করে কান্ত হয়ে এসেও সেই নোংরা বস্তির মধ্যে ঢুকেছিলেন! কতদিন আগের কথা। তখন কে জানতো একদিন এই কিরণের লাইব্রেরী দেখানোই কাল হবে। ওই লাইব্রেরীই একদিন কিরণের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনবে।
কাকাবাবু বললেন–বাঃ, বেশ লাইব্রেরী, তুমিই বুঝি এই লাইব্রেরী করেছ?
কিরণ তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, আমিই হলাম সেক্রেটারি আর দীপু হলো প্রেসিডেন্ট
হারিকেনের আলোয় দাঁড়িয়ে কাকাবাবু এক-একটা বই তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। মেঝের ওপর ছেঁড়া মাদুর পাতা। মাটির দেয়াল আর নর্দমার গন্ধ। সেদিন, সেই নোংরা আবহাওয়া আর ভাঙা হারিকেনের ঝাপসা আলোয় দীপঙ্কর আর কিরণ কাকাবাবুর উৎসাহ দেখে অবাক হয়ে গেল। অনেকেই চাঁদা দিয়েছে, অনেকেই মৌখিক সহানুভূতি জানিয়েছে। রাস্তায় ঘাটে অনেকে যেমন নিরুৎসাহ করেছে, তেমনি অনেকেই তো আবার উৎসাহও দিয়েছে। কিন্তু কাকাবাবুর মতো উৎসাহ কেউ-ই দেয়নি। নিজে লাইব্রেরীতে এসে পায়ের ধুলো দিয়েছেন। কিরণ একেবারে বিগলিত হয়ে গেল কৃতজ্ঞতায়।
কিরণ বললে–কাকাবাবু, আপনি আমাদের প্রেসিডেন্ট হোন। আপনি প্রেসিডেন্ট হলে অনেক সুবিধে হবে আমাদের–
কাকাবাবু বললেন–এখানে কারা মেম্বার?
কিরণ বললে–সবাইকে মেম্বার করেছি কাকাবাবু, দুনিকাকা, পঞ্চাদা, ছোনেদা, আমাদের ক্লাসফ্রেন্ডদের করেছি, ব্যারিস্টার পালিতের ছেলে নির্মল পালিত, চণ্ডীবাবুর নাতি রাখাল–
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন–অঘোর ভট্টাচার্য মশাই?
দীপঙ্কর বললে–উনি চোখে দেখতে পান না
কিরণ বললে–আমি অঘোরদাদুকে বলতে গিয়েছিলাম–তা লাঠি নিয়ে তেড়ে মারতে এলেন
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন-সব মেম্বাররা আসে এখানে?
কিরণ বললে–কেউ আসে না কাকাবাবু আমি একলা এইখানে আলো জ্বেলে বসে থাকি–কেউ আসে না, দীপু আসে না
কাকাবাবু বললেন–ঠিক আছে, আমি আসবো এবার থেকে–
–আপনি প্রেসিডেন্ট হবেন?
কাকাবাবু বললেন–প্রেসিডেন্ট দীপুবাবুই থাক, আমি এমনি আসবো এখানে মাঝে মাঝে আর চাঁদা দেব-মেম্বার
কিরণ বললে–আপনি এলে অনেক উৎসাহ পাব আমরা, জানেন কাকাবাবু, ভালো ভালো বই সব পাওয়া যায়, কিন্তু পয়সার জন্যে কিনতে পারি না!
তারপর চাপা গলায় বললেন, একজনের কাছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবি’ আছে জানেন! পাঁচ টাকা দিলে আমাদের দেবে বলেছে–তার কাছে আরও অনেক বই আছে কাকাবাবু-টাকা হলে সব যোগাড় করতে পারতুম–
কাকাবাবুর উৎসাহ পেয়ে কিরণ গড় গড় করে আরো অনেক কথা বলে গেল। অনেক প্রাণের কথা সব কিরণের। কিরণ যেন একটা আপনার লোক পেয়ে গেছে হঠাৎ। যে-সব বই পড়তে পায় না সেই বই-এর সন্ধানও বলে গেল কিরণ। ক্ষুদিরামের ফাঁসি, আন্দামানে বিশ বছর, বিপ্লবী বাঙলা–এমনি সব অনেক বই-এর নাম করে গেল কিরণ। ভারতবর্ষের পরাধীনতার যত ইতিহাস লেখা হয়েছে তার নিখুঁত তালিকা কিরণের মুখস্থ। ছিল। কোথা থেকে এত বই-এর নাম সে যোগাড় করেছিল কে জানে! দীপঙ্করও অবাক হয়ে গেল কিরণের জ্ঞান দেখে। এত জানে কিরণ! কিরণ ম্যাট্রিক ফেল, তবু দীপঙ্করের চেয়েও জানে বেশি। সেদিন সেই লাইব্রেরী-ঘরে দাঁড়িয়ে কিরণের কথাবার্তা শুনে দীপঙ্কর যেন হঠাৎ বড় ছোট হয়ে গেল। বড় ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। আবার একটু গর্বও হলো কিরণের জন্যে। কাকাবাবুর মুখ দেখে বোঝা গেল কিরণের জ্ঞান দেখে কাকাবাবুও যেন অবাক হয়ে গেছেন। শুধু স্বদেশী বই-ই নয়, সরকারের বর্তমান জগৎটা পুরো মুখস্থ করে ফেলেছোঁকরণ, নিগ্রো জাতির কমবার বহটার গল্প গড়গড় করে সমস্ত বলে গেল কিরণ।
কাকাবাবু অবাক হয়ে শুনছিলেন। বললেন–তুমি এত পড়ো?
কিরণ বললে–পড়তে আমার খুব ভালো লাগে–
দীপঙ্কর বললে–জানেন কাকাবাবু, ওকে সারাদিন ভিক্ষে করতে হয় বলে ও ফেল করেছে, নইলে ও ফাস্ট ডিভিশনে পাস করতে পারতো–ওরা খুব গরীব তাই ওর লেখাপড়া হলো না–
কাকাবাবু যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন–হুঁ, বুঝতে পেরেছি–
দীপঙ্কর তখন খুব উৎসাহ পেয়ে গেছে। বললে–কিরণের সঙ্গেই আমার বেশি ভাব, ও আর আমি, আমরা দুজনে মিলেই এই লাইব্রেরী করেছি–
কিরণও চুপ করে থাকতে পারলো না। বললে–আমাদের দেশে মাত্র শতকরা সাড়ে পাঁচজন লোক নাম সই করতে পারে, লেখাপড়া জানে না কেউ, তাই দেশে দেশে পাড়ায় পাড়ায় যত লাইব্রেরী হয় ততই তো ভালো। সেইজন্যেই আমরা এইটে করেছি–
কাকাবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন–এসব কথা তোমায় কে শেখালে।
কিরণ বললে–শেখাবে কেন কাকাবাবু, সবাই তো জানে, আজকাল একথা সবাই জেনে গেছে, ইংরেজরাই তো আমাদের শত্রু, এই যে সেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগে এত লোক খুন হয়ে গেল, বারীন ঘোষের দ্বীপান্তর হয়েছে, কত সব ছেলে জেল খাটছে, এ কিসের জন্যে বলুন, এও তো ইংরেজদের জন্যে? লাইব্রেরী করে সকলের মধ্যে এইটে বুঝিয়ে দিলে….
দীপঙ্কর বললে–এসব শিখিয়েছে ওর ভজুদা–
–ভজুদা কে?
কাকাবাবু আরো একটু কৌতূহলী হয়ে উঠলেন, বললেন–কে ভজুদা! খুব লার্নেড লোক মনে হচ্ছে!
দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ, খুব লার্নেড়, আমার সঙ্গে এখনও আলাপ হয়নি, কিরণ চেনে, কিরণের সঙ্গে আলাপ আছে তার।
কাকাবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন–বেশ বেশ, খুব ভালো কথা, তোমাদের লাইব্রেরী দেখে খুব খুশী হলুম আমি–
মনে আছে কাকাবাবুর উৎসাহ দেখে দীপঙ্করেরও সেদিন খুব উৎসাহ এসেছিল। যে-কিরণকে সবাই তাচ্ছিল্য করে, যে-কিরণকে সবাই এত অবহেলা অবজ্ঞা করে, সেই কিরণকে বুঝতে পেরেছেন কাকাবাবু। সংসারে সবাই যা চায়, টাকা, সম্মান, চাকরি, সে-সব কিছুই চায়নি কিরণ। কিরণ চেয়েছিল শুধু লাইব্রেরী গড়ে তুলতে। চেয়েছিল একদিন তার কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরীর নাম ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত কলকাতায়। একদিন মহাত্মা গান্ধী, জে এম সেনগুপ্ত কি তেমনি আর কেউ এসে উদ্বোধন করবেন তার লাইব্রেরী। কালীঘাটের নাম ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে, নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রীটের নাম ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে। সবাই বই পড়তে আসবে তার লাইব্রেরীতে–আর তারপর একদিন স্বরাজ আসবে। স্বরাজ শুধু কলকাতার নয়, স্বরাজ শুধু কালীঘাটের নয়, স্বরাজ আসবে সমস্ত মানুষের। বড়লোক, গরীবলোক, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান সকলের স্বরাজ।
দেরি হয়ে গিয়েছিল। কাকাবাবু বললেন–আমি এখন যাই, কেমন? কিরণ বললে–আবার আসবেন কাকাবাবু!
–নিশ্চয়ই আসবো–
তারপর পকেট থেকে দুটো টাকা বার করে দিলেন কিরণের হাতে। কিরণ টাকাটা নিয়েও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। এত সহজে কাকাবাবু এমন করে তাদের উৎসাহ দেবেন এ যেন তার কল্পনারও অতীত। কিরণের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। পেট ভরে খেতে পেলেও যেন কিরণ এত খুশী হতো না। কিরণ কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে-যেন আনন্দে হতবাক হয়ে গেছে। তার চোখ দুটো আনন্দে সজল হয়ে এসেছে যেন–
যাবার সময় কাকাবাবু বললেন–আমার সঙ্গে একবার দেখা কোর দীপু–
–কবে কাকাবাবু?
কাকাবাবু বললেন–আজই, একটু পরে–
কাকাবাবু চলে গেলেন। কিরণ হারিকেনটা নিয়ে নর্দমা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে এল। তারপর ফিরে এসে কিরণ হঠাৎ যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর বলা নেই কওয়া নেই সেই লাইব্রেরী-ঘরের মাদুরের ওপর হঠাৎ নাচতে শুরু করলো। ধেই ধেই করে নাচতে লাগলো। চণ্ডীবাবুদের বাড়ি জন্মাষ্টমীর দিন যেমন করে সংকীর্তনের সময় সবাই নাচে তেমনি করে নাচতে লাগলো। হাত দুটো ওপরে তুলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচতে লাগলো। দীপঙ্করেরও আনন্দ হয়েছিল খুব–কিন্তু কিরণের আনন্দের তুলনায় সে কিছুই নয়। কিরণের তখন কোনও দিকে খেয়াল নেই। সে ঘরের মধ্যে উত্তাল উদ্দাম হয়ে নাচছে। খানিকক্ষণ দেখার পর দীপঙ্করের হাসি পেল। বললে—কিরণ–
কিরণের সেদিকে খেয়াল নেই। তখনও নাচছে। দীপঙ্করের মনে হলো, নাচতে নাচতে কিরণ যেন ভাঙা হারিকেনটার ওপরই হুমড়ি খেয়ে পড়বে। দীপঙ্কর কিরণকে ধরতে গেল।
বললে–কিরণ থাম, থাম রে–
কিরণ দীপঙ্করকে দুই হাতে জাপটে ধরলো। কিরণ আনন্দের চোটে কী যে করবে তা যেন বুঝতে পারছে না।
–থাম্ কিরণ, ছাড় ছাড় আমাকে দীপঙ্কর আবার বললে–লোকে পাগল বলবে, থাম্ তুই—
কিরণ বললে–কী করা যায় বল তো–কাউকে মারতে ইচ্ছে করছে–
–কেন রে?
কিরণের চোখে মুখে যেন একটা পাগলের দৃষ্টি। বললে–আমার এত আনন্দ হচ্ছে ভাই, আমি কী করবো বল্ তো
দীপঙ্কর বললে–থাম তুই কিরণ, তোর মা দেখতে পেলে পাগল ভাববে তোকে–
–ভাবুক গে, আমি আজ খাবো না, আমি ঘুমোব না, আমি সমস্ত রাত নাচবো-তোর কাকাবাবু এত ভালো লোক ভাই? আগে বলিসনি কেন তুই? আমি মিছিমিছি ওদের বড়লোক বলে গালাগালি দিয়েছি।
কিরণের মুখের দিকে চেয়ে দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। মানুষ লটারিতে এক লাখ টাকা পেলেও এমন করে অধীর হয়ে ওঠে না। দীপঙ্কর জোর করে কিরণকে ধরে লাখলো। বললে–চুপ কর, চুপ কর তুই–
মনে আছে সেদিন কিরণের আনন্দ দেখে দীপঙ্করও যেন নিজেকে বেশিক্ষণ সামলাতে পারেনি। কিন্তু সেদিন দীপঙ্করও জানতো না আর কিরণও জানতো না মানুষ সম্বন্ধে অত সহজে রায় দেওয়া উচিত নয়। অত সহজে রায় দিলে মানুষকেই হয়তো অবিচার করা হয়। কত লোকই তো চাঁদা দিয়েছে! সেই শম্ভু দাতার, খিদিরপুরের রাস্ত Tয় দেখা হয়েছিল তাদের সঙ্গে। পাঁচটা টাকা চাঁদা দিয়ে দিয়েছিল এক কথায়, দোকানে নিয়ে গিয়ে সন্দেশ রসগোল্লা রাজভোগ খাইয়েছিল। কিন্তু সেদিন তো কিরণ এমন উচ্ছ্বসিত উল্লসিত হয়ে ওঠেনি। আর যারা কিছুই দেয়নি, পুলিসে ধরিয়ে দেবে বলে ভয় দেখিয়েছিল তারা কি সবাই খারাপ লোক? কী দিয়ে বিচার হবে কে ভালো, কে খারাপ? টাকা দিয়ে? টাকা দিয়ে বিচার হবে মানুষের মনুষ্যত্বের? অঘোরদাদু যদি পাঁচ টাকা চাঁদা দিয়ে দিত তো হঠাৎ কিরণের চোখে এক মুহূর্তে ভালো লোকে রূপান্তরিত হয়ে যেত কি? পরে অনেকবার অনেকরকম ভাবে ভেবেছে দীপঙ্কর-এর কোনও সদুত্তর পায়নি। মনে হয়েছে, কী সে মাপকাঠি, যা দিয়ে সে বিচার করবে মানুষকে!
কিরণ বললে–এবার ‘পথের দাবি’টা কিনবো ভাই–
–যদি পুলিসে ধরে?
-–টের পাবে কী করে? আমি বিছানার তলায় লুকিয়ে রাখবো, আর লুকিয়ে লুকিয়ে পড়াবো সবাইকে
দীপঙ্কর বললে–তুই খে গে যা এখন। আমি বাড়ি যাই–
তখন অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে বাইরে। কিরণ একাই বসে রইল লাইব্রেরীর মধ্যে। হয়তো আনন্দের আতিশয্যে কিরণ খাবেই না, হয়তো ঘুমোবেই না। সত্যিই তো, কে ভাবতে পেরেছিল কাকাবাবু এমন করে তাদের লাইব্রেরীকে সাহায্য করবেন। এমন করে লাইব্রেরীতে এসে তাদের উৎসাহ দিয়ে যাবেন। আর কাকাবাবু যখন মেম্বার হয়েছেন, লক্ষ্মীদিও হবে, আর সতীও হবে। সবাই হবে। তাহলে আর তাদের ভাবনা নেই। এবার টাকার ভাবনা নেই আর। টাকা হলে আরো আলমারি কিনবে তারা, আরো বই কিনবে। আরো নতুন করে বাড়ি হবে লাইব্রেরীর। এক হাজার টাকা দিয়ে একটা নতুন বাড়ি হবে–সেই বাড়ির সামনে বড় বড় করে লেখা থাকবে–”দি কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরী”। বহুদিন পরে, বহু বছর পরে একশো দুশো হাজার বছর পরে কেউ যদি জানতে চায় কে প্রতিষ্ঠা করেছিল এই লাইব্রেরীর? তখন দুজনের নাম করবে সবাই। প্রথম কিরণকুমার চ্যাটার্জি আর দুই দীপঙ্কর সেন। সেই হাজার বছর পরে কালীঘাট আর এরকম কালীঘাট থাকবে না, কলকাতা আর এরকম কলকাতা থাকবে না। নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীট, ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনও আর এ-রকম থাকবে না। শুধু থাকবে তাদের দি কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরী। রি থাকবে তাদের দুজনের নাম। একজন লাইব্রেরীর প্রেসিডেন্ট আর একজন সেক্রেটারি। দীপঙ্কর সেন আর কিরণকুমার চট্টোপাধ্যায়।
এই ঘটনার কথা আর একদিন দীপঙ্করের মনে পড়েছিল।
প্রাণমথবাবুর বাড়িতে বসে বাল্মীকির রামায়ণখানা পড়তে পড়তে দীপঙ্কর এক জায়গায় থম্কে গিয়েছিল।
একদিন তপোধন বাল্মীকি মুনিবর নারদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন–ভগবান, এ সংসারে এ সময় এমন কে আছেন যিনি বীর্যবান, গুণবান, চরিত্রবান, কান্তিমান, বিদ্বান, ধর্মজ্ঞ, কৃতজ্ঞ, সত্যবাদী, দৃঢ়ব্রত, প্রিয়দর্শন, ইন্দ্রিয়জয়ী, ক্রোধজয়ী, সর্বহিতকারী, পরোন্নতি-সহনশীল এবং লৌকিক ব্যবহারে দক্ষ?
মহাকবির এ-প্রশ্ন দীপঙ্করও ভেবেছে। কবেকার সেই যুগ। কবে সেই আড়াই হাজার তিন হাজার বছর আগেকার কথা। কেউ জানে না সে কোন্ যুগ। সেদিন সেই পৃথিবীর আদি যুগে ঋষিকবির মনে উদয় হয়েছিল এই প্রশ্নের। আশ্রমের বৃক্ষছায়ার তলায় বসে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন নারদকে। তখনও রামায়ণ লেখা হয়নি। তারপর ইক্ষাকু বংশে রাম জন্মগ্রহণ করেছেন। একের পর এক যুগ এসেছে গেছে। কত লোক জন্মেছে, কত রাজা মহারাজা ম্রাট জন্মেছে, কত মহাপুরুষ কত মহাকবি জন্মেছে। তারপর এসেছে পাঠান, মোগল, ইংরেজ। সুতানুটি থেকে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন পর্যন্ত অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। রবিনসন সাহেব এসেছে, ঘোষাল সাহেব এসেছে। মোটর গাড়ি এসেছে, এরোপ্লেন এসেছে, রেডিও এসেছে। মানুষের ভিড়ে ভরে গেছে পৃথিবী। সেই সুতানুটি থেকে গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং পর্যন্ত এতটুকু তিল ধারণের আর জায়গা নেই। দীপঙ্কর সেই একই প্রশ্ন করেছে। একই প্রশ্নের ভারে দীপঙ্কর কতদিন ম্রিয়মাণ হয়ে উঠেছে। তার সে প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারেনি।
প্রাণমথবাবু বলেছিলেন–বাল্মীকির ওই-ই হলো আদর্শ, আদর্শ পুরুষের কথাই বলেছেন ওখানে মহাকবি
কলেজের প্রফেসর অমলবাবু বলেছিলেন–ওটা হলো utopia—
কিন্তু তবু দীপঙ্করের কৌতূহল মেটেনি। এই মাটির পৃথিবীতে আদর্শ মানুষের সন্ধান পাওয়া কি এতই শক্ত? কোটি কোটি মানুষের মধ্যে একজনও কি সে আদর্শ পূরণ করতে পারবে না? তাহলে এত উপদেশ, এত ব্রত, এত ত্যাগ, এত তিতিক্ষা কেন? কিন্তু তারও বহুদিন পরে যখন সনাতন-বাবুকে প্রথম দেখলে দীপঙ্কর, মনে হয়েছিল সনাতনবাবুই হয়তো সেই আদর্শ পুরুষ। সনাতনবাবুকেও সেই একই প্রশ্ন করেছিল দীপঙ্কর। সনাতনবাবু বলেছিলেন–আমি?
একটু হেসে বলেছিলেন–আমাকে আপনি কতটুকু জানেন?
সত্যিই দীপঙ্কর কতটুকুই বা জেনেছিল প্রথমে! শুধু চেহারাটাই যা দেখেছিল দীপঙ্কর। চমৎকার সোজা স্বাস্থ্যবান উন্নত শরীর। সতীর পাশে সনাতনবাবুকে দেখে দীপঙ্কর সেদিন বড় আনন্দ পেয়েছিল। আনন্দও পেয়েছিল, দুঃখও পেয়েছিল। একেই তো বলে পুরুষ, বাল্মীকির বর্ণনার আদর্শ পুরুষ! সামনা-সামনি সনাতনবাবুকে দেখে তার কাছে পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে যেন ছোট মনে হয়েছিল সেদিন।
তিনি বলেছিলেন–ওতে অহঙ্কার হয়, অহঙ্কার তো মানুষকে বড় করে না!
কিন্তু সেদিন নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটের সেই লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে দীপঙ্করের মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে যদি আদর্শ পুরুষ কেউ থাকে তো সে কাকাবাবু। শুধু দীপঙ্করের নয়, কিরণেরও তাই মনে হয়েছিল। অন্ধকার গলি দিয়ে উনিশের একের বি-তে এসে দীপঙ্কর দেখলে, সদর দরজাটা তখনও খোলা রয়েছে। দীপঙ্কর ভেতরে ঢুকলো। রঘু রোজকার মতো রান্নাঘরের সামনে কী যেন করছে–
–কে?
–আমি কাকীমা, আমি দীপু—
–এখন যে হঠাৎ?
দীপঙ্কর বললে–কাকাবাবু আমাকে ডেকেছেন একবার–
–যাও ওপরে যাও, লক্ষ্মী সতী ওরাও আছে-বলে কাকীমা আবার কাজ করতে লাগলেন। সংসারের কাজ কাকীমা না করলেও চলে। তবু কাজ করতে যেন ভালো লাগে কাকীমার। একলা চুপ করে বসে থাকতে পারেন না।
দীপঙ্কর বললে–জানেন কাকীমা, কাকাবাবু আমাদের লাইব্রেরী দেখে খুব খুশী হয়েছেন
–তাই নাকি? বেশ তো—
–লাইব্রেরীর মেম্বারও হয়েছেন।
কাকাবাবুর মেম্বার হওয়ার কথাটা যেন সবাইকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল দীপঙ্করের। মনে হচ্ছিল লক্ষ্মীদি, সতী, পাড়ার সমস্ত লোক, এমন কি মা, অঘোরদাদুকেও বলে আসে সে।
দোতলায় লক্ষ্মীদির ঘরের ভেতর আলো জ্বলছিল। বোধ হয় সতীও আছে ভেতরে। এতক্ষণে সতীও নিশ্চয়ই এসেছে। এসে পড়তে বসেছে। একটু আগেই বিকেলবেলা লক্ষ্মীদি চা খেতে খেতে যে কথাগুলো বলেছে সে কথাগুলোও মনে পড়লো দীপঙ্করের। সত্যিই লক্ষ্মীদির বড় কষ্ট। বাইরে থেকে কষ্টটা কেউ দেখতে পায় না–কিন্তু দীপঙ্কর তো জানে কত কষ্ট। সবাই মিলে মিছিমিছি লক্ষ্মীদিকে দোষ দেয়। হয়তো সতীও দোষ দেয়। তাকে দেখতে পেলে সতীও হয়তো একদিন জিজ্ঞেস করবে। জিজ্ঞেস করবে–কেন সে এত ঘন ঘন লক্ষ্মীদির কাছে আসে।
টিপি টিপি পায়ে দীপঙ্কর তেতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
পাশের ঘরে লক্ষ্মীদি তার টেবিলে পড়ছে। কিন্তু সতী নেই। সতী কি তাহলে এখনও আসেনি।
দীপঙ্কর ডাকলে—লক্ষ্মীদি–
লক্ষ্মীদি বই থেকে মুখ তুলে দীপঙ্করকে দেখে অবাক হয়ে গেছে। বললে–কী রে, আবার কী করতে?
দীপঙ্কর বললে–জানো লক্ষ্মীদি, কাকাবাবু আমাদের লাইব্রেরীর মেম্বার হয়েছেন আমাকে ডেকেছেন এখন–
লক্ষ্মীদি চমকে উঠলো। যেন ভয় পেয়ে গেছে। বললে–কাকাবাবু ডেকেছে? কেন রে?
দীপঙ্কর বললে–তা জানি না–
লক্ষ্মীদি বললে–সতীর সঙ্গে তোর দেখা হয়নি? সতী যে তোদের বাড়ি গেছে!
–আমাদের বাড়ি? এই এখনও? কী করতে?
–সতী বললে তোর মা’র সঙ্গে আলাপ করে আসবে–
দীপঙ্কর কেমন অবাক হয়ে চেয়ে রইল লক্ষ্মীদির মুখের দিকে। তাদের বাড়িতে গেছে সতী-তার মা’র সঙ্গে আলাপ করতে!
দীপঙ্কর বললে–আমি কাকাবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করে এখুনি বাড়ি যাচ্ছি–
লক্ষ্মীদি বললে–আমি যা বলেছিলুম মনে আছে তো তোর?
–মনে আছে লক্ষ্মীদি–
লক্ষ্মীদি মনে করিয়ে দিলে আবার। বললে–যদি জিজ্ঞেস করে তুই আমার সম্বন্ধে কিছু জানিস কিনা, তুই বলবি তুই কিছু জানিস না,–বুঝেছি তো? দেখিস, ভুলিসনি যেন?
–না, ভুলবো না।
–মিথ্যে কথা বলবি, বুঝলি?
ততক্ষণে দীপঙ্কর সোজা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেছে। তেতলায় কাকাবাবুর ঘরে কাকাবাবু তখন জামা-কাপড় বদলে চেয়ারে বসে আপিসের কাজ করছিলেন বোধ হয়। দীপঙ্করের পায়ের আওয়াজ পেয়েই হাতের ফাইলটা সরিয়ে ফেললেন। তারপর সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বললেন—বোসো–
দীপঙ্কর চেয়ারে বসলো। কিন্তু কাকাবাবুর মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। কাকাবাবুর মুখটা যেন অন্য দিনের মতো নয়। গম্ভীর। বললেন–তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে বলেই তোমাকে ডেকেছিলাম–
দীপঙ্কর বললে–আপনি চলে আসার পর কিরণ খুব নাচছিল–
–কেন?
–খুব আনন্দ হয়েছে ওর, আমারও আনন্দ হয়েছে কাকাবাবু খুব। আমাদের অনেক কষ্টের লাইব্রেরী, বিশেষ করে কিরণের। ও খুব ভালো ছেলে কাকাবাবু, নিজে না খেয়ে ওই লাইব্রেরী করেছে, লাইব্রেরী ওর ধ্যান জ্ঞান সব, ও রাত্রে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও লাইব্রেরীর স্বপ্ন দেখে–
কাকাবাবু সব কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন–তোমাকে কী বলবো বলে ডেকেছি জানো–ওর সঙ্গে তুমি মিশো না–
হঠাৎ দীপঙ্করের সামনে বাজ পড়লো। যেন বিশ্বাস হলো না কাকাবাবুর কথাগুলো।
বললে–কেন, কাকাবাবু?
কাকাবাবু বললেন–হ্যাঁ, আমি বলছি ওর সঙ্গে তুমি মিশো না–
–কিন্তু ও তো খুব ভালো ছেলে কাকাবাবু!
কাকাবাবু এবার আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। দীপঙ্করের ভয় করতে লাগলো কাকাবাবুর চেহারা দেখে। এত গম্ভীর হতে দীপঙ্কর কখনও দেখেনি কাকাবাবুকে।
কিন্তু কিরণ তো কোনও দোষ করেনি কাকাবাবু! জানেন, কত দুঃখ কষ্টের মধ্যে মানুষ ও! ওদের কত অভাব, এক-একদিন ভাতও জোটে না ওদের, ওর বাবা আজ আট বছর অসুখে ভুগছে। ওর মা পৈতে তৈরি করে, সেই পৈতে বিক্রি করে ওদের সংসার চলে, তবু চাঁদার একটা আধলা সংসার-খরচের জন্যে দেয় না–ওর মতন সৎ ছেলে…
–থামো!
কাকাবাবুর গলাটা বড় রুক্ষ কঠিন কর্কশ শোনালো।
বললেন–তোমার বয়েস কত দীপুবাবু? সেদিনের ছেলে তুমি। পৃথিবীর কতটুকু জানো? কতটুকু দেখেছ তুমি?
দীপঙ্কর কাকাবাবুর কথার কোনও জবাব দিতে পারলে না। তার সমস্ত মন যেন শিথিল হয়ে এল কাকাবাবুর কথায়।
কাকাবাবু আবার বলতে লাগলেন-মানুষের সবটা দেখা যায় না। বাইরে থেকে যা দেখা যায় সেটা আসল রূপ নয়। তোমার চেয়ে আমার অনেক বয়েস হয়েছে। অনেক ভালো জিনিস দেখেছি অনেক মন্দ জিনিস দেখেছি তোমার ভালোর জন্যেই বলছি, ওর সঙ্গে তুমি মিশো না
কথাগুলো বলে কাকাবাবু চুপ করলেন। এবার প্রতিবাদ করবার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত যেন নিঃশেষ হয়ে গেল দীপঙ্করের। কাকাবাবুর মুখের দিকে চেয়ে নির্বাক হয়ে রইল শুধু।
কাকাবাবু বললেন–তোমার মা রয়েছেন, তাঁর কত কষ্ট দেখছো তো তুমি! কত কষ্ট করে পরের বাড়ি দাসীবৃত্তি করে তোমাকে মানুষ করে তুলছেন–সে কি কিরণের সঙ্গে মেশবার জন্যে? একদিন তোমাকেও দশজনের একজন হতে হবে না? চিরকাল এমনি পরের অন্নদাস হয়ে থাকলেই জীবন সার্থক হবে?
এবারও দীপঙ্করের মুখে প্রতিবাদের ভাষা যোগাল না।
কাকাবাবু বললেন–আজ কিরণকে ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে, একদিন এর চেয়েও আরো প্রিয় জিনিস তোমাকে ছাড়তে হবে, নিজের উন্নতির জন্যে দরকার হলে তোমাকে সব ছাড়তে হবে-সংসার আর লাইব্রেরী এক জিনিস নয়, পৃথিবীও সেই আর আগেকার পৃথিবী নেই-বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভালো লাগারও রকমফের হবে, সেদিন বুঝবে আমার কথাই ঠিক, আমি যা বলছি অন্যায় বলিনি
তারপর অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন–এবার যাও
দীপঙ্করের সাহস হলো না আর একটুও বসে থাকতে। আস্তে আস্তে উঠে সিঁড়ি দিয়ে দীপঙ্কর নামতে লাগলো নিচেয়। মনে হলো এ কী হলো তার! কিরণকে ছাড়তে হবে! কিরণ কী দোষ করেছে! কিরণের মতো বন্ধু হয় নাকি! কিরণ যে তার প্রাণের বন্ধু! প্রাণের বন্ধুর চেয়েও বড়। একদিন কিরণকে না দেখলে যে তার খারাপ লাগে! সেই ইনফ্যান্ট ক্লাস থেকে একসঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে এসেছে, তারপর পাশাপাশি বড় হয়েছে, কত সুখদুঃখের সঙ্গী সে। তার মা পর্যন্ত তাকে কিরণের সঙ্গে মেশা বন্ধ করতে পারেনি। সেই কিরণকে ছাড়বে দীপঙ্কর! কিরণ দোষটা কী করলে? গরীব হওয়া কি দোষ? গরীব হওয়া কি অপরাধ? কিরণই তো বলেছিল মানুষ যে গরীব হয় তা মানুষই করে। মানুষই মানুষকে গরীব করে, বড়লোক করে। তবে কেন কাকাবাবু কিরণের সঙ্গে মিশতে বারণ করলেন তাকে! কিরণের সঙ্গে যদি না মেশে দীপঙ্কর তো কার সঙ্গে মিশবে! বড়লোকরা কেন মিশবে দীপঙ্করের সঙ্গে নির্মল পালিত কি মিশবে তার সঙ্গে তার বাবা ব্যারিস্টার পালিত সাহেব কি ছেলেকে মিশতে দেবেন তার সঙ্গে! রাখালকেও তো চণ্ডীবাবু তাদের সঙ্গে মিশতে দেন না। যেটুকু মেশে তাও লুকিয়ে লুকিয়ে। তাহলে? তাহলে কী করবে সে?
দীপঙ্করের মনে হলো তার পায়ের তলার মাটিটা যেন হঠাৎ সরে যাচ্ছে। সমস্ত আকর্ষণের মূলটা যেন হঠাৎ শিথিল হয়ে গেল। তার পায়ের তলার ভিত্তি মাথার ওপরের আশ্রয়, চারপাশের অবলম্বনগুলো যেন তার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর সে যেন তলিয়ে গেল অতল সীমাশূন্যতার মধ্যে। কেউ তার নেই, কেউ নেই তার! অথচ দুদিন আগেও যেন এই সমস্ত কিছুকে সে নিজের বলে অনুভব করেছে। এই কাকাবাবু, এই লক্ষ্মীদি, এই কালীঘাট, এই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল স্কুল, এই কালীঘাটের রাস্তাঘাট সমস্ত কিছু যেন তার নিজস্ব ছিল। আকাশের মেঘটাও ছিল তার নিজস্ব, আকাশের সূর্যটাও ছিল তার নিজস্ব। আমড়া গাছের ডালের কাকটাও ছিল তার নিজস্ব, আবার নিজস্ব ছিল রাস্তার ঘেয়ো কুকুরটাও। কাউকে ভালোবাসা বা ঘৃণা করার প্রশ্ন নয়, কাউকে দুঃখ দেওয়া বা কারোর কাছ থেকে দুঃখ পাওয়ার প্রশ্নও নয়–এখানকার যা কিছু ভালো, এখানকার যা কিছু মন্দ, এই সংসারের যা কিছু ছোট, যা কিছু বড় সবাইকে নিয়েই তো দীপঙ্কর হয়ে উঠেছিল, সবাই-এর সঙ্গেই দীপঙ্কর তো একাত্ম হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আজ কাকাবাবুর কথায় যেন সেই অবিশ্রান্ত প্রবাহধারায় এক ছেদ পড়লো হঠাৎ। দীপঙ্করের মনে হলো, সে যেন আর নেই। আর সব কিছু আছে। এই অঘোরদাদু, এই লক্ষ্মীদি, এই কালীমন্দির, এই ছিটে ফোঁটা সবাই-ই আছে, শুধু সে-ই হারিয়ে গেছে, তার এই ভুবন থেকে শুধু সে-ই যেন হারিয়ে গেছে। তাকে যেন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। চেষ্টাও করলেও কেউ তার সন্ধান পাবে না।
–দীপু!
দোতলার বারান্দায় আসতেই লক্ষ্মীদি দেখতে পেয়েছে। ঘরের দরজার বাইরে এসে এতক্ষণ দীপঙ্করের জন্যেই হয়তো অপেক্ষা করছিল। কাছে এসে গলা নিচু করে বললে–এতক্ষণ কী কথা হচ্ছিল রে কাকাবাবুর সঙ্গে?
দীপঙ্করের চোখের দৃষ্টি যেন কেমন-কেমন। লক্ষ্মীদি কাঁধে হাত দিলে তার। বললে–কী হলো রে তোর?
দীপঙ্কর বললে–লক্ষ্মীদি, আমি এখন বাড়ি যাই।
–কেন, কী হলো তোর? কাকাবাবু এতক্ষণ কী বলছিল?
–আমি পরে বলবো তোমাকে সব লক্ষ্মীদি, আমি এখন বাড়ি যাই—
লক্ষ্মীদি কেমন অবাক হয়ে গেল। কিছু বুঝতে পারলে না।
দীপঙ্কর বললে–তুমি কিছু মনে কোর না লক্ষ্মীদি, আমার কিছু ভালো লাগছে না, আমি বাড়ি যাই এখন
বলে লক্ষ্মীদির হাত ছাড়িয়ে দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নামতে লাগলো। আজ যেন দীপঙ্করের চোখে এ-বাড়িটা অচেনা ঠেকছে। একদিন এ-বাড়িটার সঙ্গে তার সমস্ত অন্তরাত্মা ক্রমে ক্রমে ঘনিষ্ঠ হতে আরম্ভ করেছিল, আর আজ যেন মনে হলো তার সব বন্ধন সব আকর্ষণ এক নিমেষে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এখানে এ-বাড়িতেই শুধু নয়, এই সংসারে, এই পৃথিবীতেও যেন তার আর কোনও অধিকার নেই।
.
দরজাটা খোলাই ছিল। দীপঙ্কর সোজা রাস্তায় গিয়ে নামলো। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন এ-সময়ে নির্জন। অন্ধকারের মধ্যে নেমে দীপঙ্কর যেন এতক্ষণে সব স্পষ্ট দেখতে পেলে। স্পষ্ট দেখতে পেলে নিজেকে। এতক্ষণ কাকাবাবুর বাড়ির ভেতরে আলোর মধ্যে সব যেন অস্পষ্ট ঠেকছিল।
–কী আশ্চর্য! আরে, তুমি এখানে! আর তোমার মা যে ওদিকে খোঁজাখুঁজি করছে!
সামনে সতী দাঁড়িয়ে। সতীও যেন বাড়ির মধ্যে ঢুকছিল। দীপঙ্করকে সতীই প্রথমে দেখতে পেয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে দীপঙ্করের কোনও দিকে খেয়াল ছিল না। সতীর মাথার কোঁকড়ানো চুলগুলো মাথায় কেঁপে রয়েছে। দীপঙ্কর একদৃষ্টে অন্যমনস্কের মতো সেইদিকে চেয়ে ছিল। হঠাৎ যেন তার হুশ হলো। বললেও,
বলেই নিজের বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। মনে হলো, না, সে নেই। সে কোথায়ও নেই। সে হারিয়ে গেছে। এই পৃথিবী থেকে সে নিঃশেষে হারিয়ে গেছে। কেউ তাকে খুঁজে পাবে না, কেউ তার সন্ধান পাবে না।
–এই, শোন
সতীর গলার আওয়াজ পেয়ে দীপঙ্কর পেছন ফিরলে। তখনও সতী দাঁড়িয়ে আছে পৈঠের ওপর। সেই আঁকড়া ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল মাথার ওপর ফুলে রয়েছে।
–এই, শোন একটু।
দীপঙ্কর মেশিনের মতো আস্তে আস্তে সতীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বললে আমাকে ডাকছো?
–হ্যাঁ, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? কার সঙ্গে কথা বলছিলে?
দীপঙ্কর যেন বুঝতে পারলে না। সতীর কথাগুলো যেন অন্য কাউকে লক্ষ্য করে বলা হচ্ছিল। বললে–আমি? আমাকে বলছো?
সতী বললো, তোমাকে বলছি না তো কাকে বলছি আবার? আর কে আছে এখানে?
বলে হাসলো সতী খিল খিল করে। আবার বললে–তোমাকেই তো বলছি এতক্ষণ আমাদের বাড়িতে কী করছিলে?
–বা রে, কেন, তোমাদের বাড়িতে যেতে নেই?
দীপঙ্কর যেন আরো হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কাকাবাবুর বাড়িতে তার যাওয়া-আসা নিয়ে এতদিন তো কেউ কোনও প্রশ্নই করেনি। কেউ তো তার অধিকারবোধ নিয়ে
কোনও দিন তর্ক তোলেনি এমন করে। কাকাবাবুরা কি তার পর?
আবার বললে–কেন, ওকথা জিজ্ঞেস করছো কেন?
সতী বললে–বলো না, এতক্ষণ কী করছিলে আমাদের বাড়িতে? কার সঙ্গে কথা বলছিলে?
দীপঙ্কর চুপ করে রইল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল লক্ষ্মীদির কথা। লক্ষ্মীদির কষ্টের কথা। লক্ষ্মীদির জীবনের কথা।
–বলো, কার সঙ্গে কথা বলছিলে? আমার দিদির সঙ্গে?
দীপঙ্কর সোজাসুজি সতীর চোখের দিকে চোখ রাখলো। অন্ধকারের মধ্যে সতীর চোখের লেখা পড়তে চেষ্টা করলে দীপঙ্কর। সতী কি তাকে সন্দেহ করছে? ভালো করে লেখাগুলো পড়া যায় না। তবু দীপঙ্কর অনেকক্ষণ ধরে সেদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো। অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে আরো। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের এখানটা এখন আরো নির্জন হয়ে আসছে। খোলা দরজার দিকে পিঠ করে সতী দাঁড়িয়েছিল আর দীপঙ্কর রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে দেখছে। ভেতরের বারান্দার আলোটা এসে পড়েছে সতীর পিঠে, মাথার চুলে, আর শাড়ির আঁচলে।
–বলো, না, চুপ করে রইলে কেন? আমার দিদির সঙ্গে কথা বলছিলে?
দীপঙ্কর মাথা নাড়লে। বললে–না
–তবে কার সঙ্গে?
দীপঙ্কর বললে–কাকাবাবুর সঙ্গে–
কথাটা শুনে সতী যেন একটু নিশ্চিন্ত হলো মনে হলো। বললে–তা এতক্ষণ বাড়ির বাইরে রয়েছ আর তোমার মা যে এদিকে তোমার জন্যে ভাবছে বসে বসে, বাড়ি যাও শিগগির
বলে সতী হয়তো বাড়ির ভেতরে চলে যেত। কিন্তু দীপঙ্কর হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে বসলো।
বললে–কেন, লক্ষ্মীদির সঙ্গে যদি গল্প করেই থাকি, তাতে কি দোষ হয়েছে?
সতী মুখ ফেরাল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে–আমি কি বলেছি দোষ হয়েছে? লক্ষ্মীদির সঙ্গে যত ইচ্ছে গল্প করো না তাতে আমার কি? তবে ওরও তো লেখাপড়া আছে, তোমারও লেখাপড়া আছে, অত গল্প করা কি ভালো? তোমার মা বলছিল তুমি নাকি একদম লেখাপড়া কর না
হঠাৎ যেন সতী অন্যরকম হয়ে গেল। সে-সতী নয় আর।
দীপঙ্কর বললে–আমি তো লেখাপড়া করি!
–ছাই করো, আমি সব শুনে এলাম তোমার মার কাছে। পাড়ার একটা কে ছোঁড়া আছে, ফেল-করা ছেলে, কেবল তার সঙ্গে দিনরাত মেশো, আমি সব শুনে এসেছি
দীপঙ্কর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–তা তুমি যে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল হঠাৎ?
–কেন, যেতে নেই?
দীপঙ্কর বললে–না, তা বলছি না, হঠাৎ আমাদের বাড়িতেই বা গেলে কেন, তাই জিজ্ঞেস করছি!
সতী এবার কথাটা শুনে একটু হাসলো। বললে–লক্ষ্মীদি ঠিকই বলেছে দেখছি
–লক্ষ্মীদি? লক্ষ্মীদি কি বলেছে আমার সম্বন্ধে শুনি?
–বলেছে, দীপুকে বাইরে থেকে যা ভাবিস, ও তা নয়। ও খুব চালাক আছে–। তাই তো তোমার সঙ্গে ভাব করতেই তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলুম–
দীপঙ্কর বললে–আমার সঙ্গে ভাব করার তো খুব গরজ দেখছি তোমার!
সে-কথার উত্তর না দিয়ে সতী বললে–সেদিনকার কথাটা বললাম তোমার মাকে তোমার ঘাড়ে মাল বইয়ে নিয়ে এসেছিলুম, শুনে খুব হাসলেন তোমার মা-বললেন–ওই ছেলেকে নিয়েই হয়েছে আমার জ্বালা…তুমি নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলো?
বলে আবার হাসতে লাগলো সতী। বিকেল বেলা লক্ষ্মীদির কাছে সতীর সম্বন্ধে শোনা কথাগুলো আবার মনে পড়তে লাগলো দীপঙ্করের।
হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা সত্যি বলো তো তুমি কেন আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলে?
–এমনি। কেন, যেতে নেই!
–না, সত্যি করে বলল, এতদিন এসেছে, এর আগে তো কোনওদিন যাওনি, হঠাৎ এতদিন থাকতে আজই-বা গিয়েছিলে কেন?
সতী বললে–কেন, তুমি চাও না, আমি যাই?
–না, সেকথা বলছি না, নিশ্চয় তোমার কোনও উদ্দেশ্য ছিল। কই, লক্ষ্মীদি তো যায়নি কখনও, কাকীমা তো যায়নি, কাকাবাবুও তো যাননি–হঠাৎ তুমি কেন গিয়েছিলে?
–ওমা, তা আর কেউ না গেলে কি আমার যেতে নেই? আমি হয়তো ওদের মতো নয়–ওদের থেকে আলাদা
দীপঙ্কর মাথা নাড়লো। বললে–না, সেকথা বললে শুনবো না, তুমি মোটেই আলাদা নও।
সতী তো অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রইল কথাটা শুনে। একটা কথাও তার মুখ দিয়ে বেরোল না।
দীপঙ্কর বললে–আসল কথা তা নয়, আসল কথাটা আমি জানি
–আসল কথা কী?
দীপঙ্কর বললে–তুমি কী জন্যে আমাদের বাড়ি গিয়েছিলে, তা আমি জানি, তুমি না বললেও বুঝতে পারি
সতী আরো অবাক। বললে–কী জানো তুমি শুনি? কী জন্যে আমি তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম বলো তো দেখি?
দীপঙ্কর বললে–সে আমি তোমায় বলবো না—
সতী আরো এগিয়ে সিঁড়ির দুটো ধাপ নেমে এল। বললে–শুনিই না, কী জানো তুমি?
দীপঙ্কর বললে–না, সে আমি কিছুতেই বলবো না তোমাকে–
দীপঙ্করের মনে হলো সতী যেন তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখছে। যেন তার মনের কথাগুলো দেখতে চেষ্টা করছে। অনেক কাছে সরে এসেছে সতী, ঠিক সেই কারণেই বুঝি দীপঙ্কর আরো পেছিয়ে দাঁড়াল।
বললে–তোমরা ভাবোবা, আমি কিছু বুঝতে পারি না, না?
সতী বললে–বেশ তো, কে বলেছে আমরা ওই কথা ভাবি?
দীপঙ্কর বললে তোমরা সবাই সেই কথা ভাবো! তুমি ভাবো, তোমার কাকাবাবু ভাবেন, কাকীমাও ভাবেন তাই। কিন্তু এটা জেনে রেখো আমার কাছ থেকে কোনও কথা আদায় করতে পারবে না। তোমরা আমার বাড়িতে গিয়ে আমার মার সঙ্গে যতই ভাব করো, আর যতই বন্ধুত্ব করো, আমি কিছু বলবো না
হঠাৎ দীপঙ্করের এই কথা শুনে সতী কী বলবে ভেবে পেলে না। বললে তার মানে?
দীপঙ্কর বললে–না, তার মানেও আমি বলবো না, তোমরা সকলকে কষ্ট দাও, সকলকে দুঃখ দাও কেবল–অথচ দুঃখ দিলে লোকে কত কষ্ট পায়, তা জানো না?
সতী কিছুই বুঝতে পারছিল না। বললে–কার কথা বলছো?
দীপঙ্কর বললে–আমি কার কথা বলছি তা-ও বলবো না, কেন বলতে যাবো তোমাকে? তুমি কে? তুমি তো কেবল সন্দেহ করো
–সন্দেহ করি? কাকে? কাকে সন্দেহ করি?
দীপঙ্কর বললে–যেন জানো না কাকে সন্দেহ করো, আবার মুখ ফুটে তোমাকে বলে দিতে হবে?
সতী যেন কী ভাবলো এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর বললে–কার কথা বলছো বলো তো?
কে এসব কথা বলেছে তোমাকে? লক্ষ্মীদি?
দীপঙ্কর বললো আমি বলে দিই, আর তুমি সকলকে সব কথা বলে দাও আমি কিছু বলবো না–
সতী একটু থেমে বললে–কিন্তু আমি সন্দেহ করি কাকে তা বললে না তো?
–কাকে আবার? আমাকে! আমাকেই তুমি সন্দেহ করো। আমি জানি না মনে করো?
–তোমাকে সন্দেহ করি? তোমাকে সন্দেহ করতে যাবো কেন? কিসের জন্যে তোমাকে সন্দেহ করবো? কী করেছ তুমি?
–সে আমি বলবো না-বলে দীপঙ্কর সোজা নিজেদের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো। আর দীপঙ্করের মনে হলো আর-একটু দাঁড়ালেই যেন সতী তার কাছ থেকে সমস্ত কথা আদায় করে ফেলতো—
১২
রাত্রে খেতে বসে মা বললে–কাল যেন কোথাও আড্ডা দিতে বেরিয়ো না, আমার সঙ্গে যেতে হবে এক জায়গায়–
তাকে নিয়ে মা’র সেই দুর্ভাবনার দিনগুলোর কথা এখনও আজো মনে আছে দীপঙ্করের। কী দিনই গেছে সেসব। ফরসা কাপড় সাবান দিয়ে কেচে, ছেঁড়া, জামাটা সেলাই করে দিয়েছে, কোথাও নিয়ে যাবার আগে। শার্ট পরিয়ে, জুতো পরিয়ে, চুল আঁচড়িয়ে দিয়ে নিয়ে গেছে বাড়ি বাড়ি। কোথায় কার সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে আলাপ হয়েছে। নিজের দুঃখের কথা গল্প করেছে। ছেলের কথা বলেছে। ছেলের কথা বলতে বলতে মা’র মুখ ব্যথা হয়ে গেছে কতবার। কোথায় কোন হরিশবাবু চাকরি করেন সওদাগরী আপিসে। তার বউ-এর সঙ্গে ভাব করে মা নিয়ে গেছে তাঁদের বাড়ি। হরিশবাবু, হরিশচন্দ্র গাঙ্গুলী। কোথাকার কোন মার্চেন্ট আপিসের বড়বাবু।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে অন্দরমহলে মা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। শিখিয়ে দিত-পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে; যেন বলতে না হয়–
হরিশবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন–চাকরি?
আড়াল থেকে মা বলতো-আপনি একটু চেষ্টা করলেই করে দিতে পারেন, কত লোকের উপকার করেছেন আপনি, বিধবার একটা উপকার করলে আজীবন মনে করে রাখবো
হরিশবাবু বলেছিলেন–তা দিও একখানা দরখাস্ত আমার হাতে, দেখি কী করতে পারি–
শুধু হরিশবাবুই নয়, কোথা থেকে সব কত নতুন নতুন লোকের সন্ধান আনতো মা। নতুন নতুন মুখ, নতুন নতুন পাড়া। সব জায়গাতেই মা’র হাত ধরে যেত দীপঙ্কর। সবাই ওই একই কথা বলতো–আচ্ছা, দিও একখানা দরখাস্ত দেখি কী করতে পারি–
শুধু দরখাস্ত দিয়ে আসাই নয়, তারপর মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিয়েও আসতে হতো। চুপি চুপি করুণ মুখ করে দাঁড়াত গিয়ে দীপঙ্কর।
তারা জিজ্ঞেস করতেন–কী চাই?
দীপঙ্কর বলতো-আজ্ঞে, সেই দরখাস্ত একখানা দিয়ে গিয়েছিলাম আপনার কাছে–
তারা রেগে যেতেন অনেকেই। বলতেন–তা দরখাস্ত দিয়ে গেলেই চাকরি হয়ে যাবে ওমনি! দিনকালটা কি-রকম পড়েছে বুঝতে পারছো না? ছ’ টাকা চালের মণ, আট আনা সের সরষের তেল, চাকরি কোত্থেকে আসবে? চাকরি কি গজাবে?
–আপনি যে মনে করিয়ে দিতে বলেছিলেন?
–মনে করিয়ে দিলেই চাকরি হয়ে যাবে ওনি! চাকরি কি গাছের ফল!
কারো কারো বাড়িতে মা গিয়ে মুড়ি ভেজে দিয়ে আসতো, বড়ি দিয়ে আসতো। বলতো–আমার ছেলের চাকরির কথাটা একবার কর্তাকে মনে করিয়ে দিও দিদি সময়মতো
এমনি করে মাসের পর মাস চলে যেত কিন্তু দরখাস্তের জবাবও আর আসতো না। দীপঙ্করের মা খাইয়ে-দাইয়ে ফরসা জামা-কাপড় পরিয়ে পাঠিয়ে দিত বার বার। দীপঙ্কর যেত। কিন্তু চাকরি আর হতো না। শেষে নৃপেনবাবুর খবর পাওয়া গেল। গঙ্গার ঘাটেই একজন কে বুঝি বলেছিল নৃপেনবাবুর কথা। সেখাইে নিয়ে গেল মা।
নৃপেনবাবু অনেক লোককে চাকরি করে দিয়েছেন। প্রথম দিনেই নৃপেনবাবু বলেছিলেন–চাকরি হওয়াটা তো শক্ত নয় দীপুর মা, মুশকিল হয়েছে সাহেবদের নিয়ে–
মা বলেছিল–আপনি পরোপকারী লোক, আপনি অনেকের চাকরি করে দিয়েছেন
নৃপেনবাবু বলেছিলেন–দিনকাল বড় খারাপ দীপুর মা, যে দিনকাল পড়েছে, এখন চাকরি করে দেওয়া বড় শক্ত। এককালে কত লোককে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তখনকার সব সাহেব ছিল অন্যরকম, তারা পরের দুঃখ বুঝতো–এখন যে কী দিনকাল পড়লো, সরষের তেল বলে আট আনা সের, চালের দাম দেখ না, বাঁকতুলসী চাল ছ’টাকা মণ কী খাবে লোকে?
প্রথম প্রথম এমনি অনেক কথা বলতেন। বার বার ঘোরাতেন। মা বাড়ির ভেতরে গিয়ে নৃপেনবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতো। বলতো-তুমি একটু বলে দিও দিদি কর্তাকে, আর পারছি না আমি, আমার শরীরে আর বইছে না–
শেষে একদিন খোলাখুলিই বলে ফেললেন নৃপেনবাবু।
বললেন–তোমাকে খুলেই বলি দীপুর মা, এ তো আর মার্চেন্ট আপিস নয় তোমার, এ হলো গিয়ে সাহেবদের আপিস, এখানে একবার ঢুকতে পারলে আর চাকরি যায় না সারাজীবনে, তারপর কত সুবিধে, তুমি বিধবা মানুষ, ছেলের পাস নিয়ে কাশী, বৃন্দাবন, গয়া, শ্রীক্ষেত্র কত জায়গায় ঘুরতে পারবে, একটা পয়সা লাগবে না-কম সুবিধে!
–সেই সুবিধের জন্যেই তো আপনার কাছে আসা দাদা।
–তা দাদার তো আর আপিস নয় দীপুর মা। আমার যদি আপিস হতো তো আমি আজই হুকুম দিয়ে দিতাম এই এখখুনি দীপঙ্করকে চাকরি দিয়ে দাও-খাতায় নাম উঠে যেত সঙ্গে সঙ্গে আর মাসে মাসে তেত্রিশ টাকা মাইনে হয়ে যেত-তারপর পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে আয়েস করো না। তাই তো বলছিলুম মুশকিল হয়েছে সাহেবদের নিয়ে
মা বলতো-আপনি বললে আবার মুশকিল কী হবে দাদা?
–আরে না, তুমি বোঝ না, সবাই তো আর তোমার-আমার মতো সাধুপুরুষ নয়! তারা এসেছে সাতসমুদ্র তের নদী পেরিয়ে এখানে কি শুধু মুখ দেখাতে? তারা হলো ঠাকুরের বাড়া-ঠাকুরকে যেমন নৈবিদ্যি দিতে হয়, সাহেবদেরও তেমনি ভেট দিতে হয়
–ভেট! কত টাকার ভেট দাদা?
নৃপেনবাবু বলেছিলেন–তা কম করেও পঁচিশ টাকার ভেট না দিলে সাহেবঠাকুরের পেট ভরবে কেন? এই ধরো দুটো মুরগী, কিছু ফল-ফুলুরী, একটা গিনি, নতুন-গুড়ের সন্দেশ, এক বোতল বিলিতী মদ-তারপর আছে বাবুদের চাপরাশীদের বখশিশ–সব মিলিয়ে টাকা পঁচিশেক পড়বে–
পঁচিশ টাকার কথা সেই-ই প্রথম বলেছিলেন নৃপেনবাবু। মা-ও কথা দিয়েছিল যেমন করে পারে যোগাড় করবে পঁচিশটা টাকা। পঁচিশটা টাকা হলেই একেবারে হাতে স্বর্গ পেয়ে যাবে দীপঙ্কর। তারপর সারাজীবন যত পারো আয়েস করো। রেলের পাস নিয়ে হিল্লী-দিল্লী ঘুরে বেড়াও, তীর্থ-ধর্ম করো। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। কারো বাবার সাধ্য নেই তোমার চাকরি খায়। সরকারী চাকরির ওই তো মজা। তারপর বছর বছর তিন টাকা করে ইনক্রিমেন্ট। কত বাবুয়ানি করবে করো না, কত লবাবি করবে করো না! কাজের মধ্যে সকাল দশটায় হাজরে দেওয়া, আর বিকেল পাঁচটায় আপিস থেকে মুক্তি। দুপুরবেলা আধ ঘণ্টা টিফিন-টাইম। তা তোমার ছেলের সঙ্গে একটা টিফিন-কৌটো দিয়ে দিও। একটা বেগুন ভাজা আর দুটো পরোটা দিয়ে দিও পুরে। আর চা খাওয়র বদ্ নেশা যদি থাকে তো দু-পয়সায় একবাটি চা, তারও ব্যবস্থা আছে সেখানে
–না, দীপু আমার চা খায় না দাদা
–তা না খাক। সে তো পরের কথা। আগে চাকরি তো হোক। হলে মন্দিরে পুজো দিয়ে আসবে মা। ওই ষষ্ঠী, গণেশ, ভুবনেশ্বরী, নকুলেশ্বরতলা, সব জায়গায় মানত করা আছে। সব দেব-দেবীকে কামনা জানানো আছে। কামনা পূরণ হলেই মা পুজো দেবে। এ যে মা’র কতদিনের সাধ। মা’র যে কতদিনের বাসনা! কিন্তু পঁচিশটা টাকা কেমন করে কোথা থেকে যোগাড় হয়!
বাইরে রাস্তায় এসে দীপঙ্কর বললে–ও চাকরি আমি করবো না মা–
–কেন করবি নে তুই?
–না মা, ঘুষ দিয়ে আমি চাকরি করবো না।
–ঘুষের কথা তো উনি বললেন না, সাহেবকে ভেট দিতে হবে! ঘুষ বলছিস কেন?
দীপঙ্কর বললেও একই কথা, ওর নামই ঘুষ!
মা বিরক্ত হলো। বললে–তবে তুই নিজে যাহোক করে একটা চাকরি যোগাড় করে নে, আমাকে যেন তাহলে কষ্ট করতে হয় না আর। আমি তাহলে আর তোমার চাকরির মধ্যে থাকবো না, আমার তো ভালোই, কিন্তু আমি আর সকাল-নেই, বিকাল-নেই, এই রাধা-বাড়া করতে পারবো না বাপু-সেও বলে রাখছি
দীপঙ্করও কিছু কথা বললে না আর। মা যেন রেগে গিয়ে আগে আগে চলতে লাগলো। কালীঘাট মন্দিরের কাছে আসতেই দীপঙ্কর বললে—মা–
মা কিছু কথা বললে না। যেমন চলছিল, তেমনি চলতে লাগলো।
দীপঙ্কর আবার ডাকলো—মা–
–কী বল?
–তুমি আমার ওপর রাগ করলে?
মা বললে–রাগ-ফাগ বুঝি নে বাপু, আমি জ্বলছি নিজের জ্বালায়, আর ছেলের এখন মান-অভিমান জ্ঞান হয়েছে! বলি অত মান-অসম্মান জ্ঞান যদি তোর, তো মরতে আমার পেটে জন্ম নিলি কেন তুই? বড়লোকের বাড়িতে জন্মাতে পারলি না, যেখানে ফেলে-ছড়িয়ে দু-দশটা মানুষ হলেও কারু গায়ে লাগে না–
গজ গজ করতে লাগলো মা। বলতে লাগলো-অঘোরদাদু আর ক’দিন? বুড়ো মানুষ যদ্দিন আছে, তদ্দিন তবু খেতে পরতে পাচ্ছিস, তারপর? তারপর কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে, কে খেতে দেবে তোমাকে? ওই বুড়ো মানুষ গালাগালিই দিক আর যা-ই করুক, কে করবে অমন করে? উনি গেলে কী করে বাঁচবে, সেটা ভেবেছ একবার?
সারা রাস্তা-ই এমনি করে উপদেশ দিতে দিতে চললো মা। কথাগুলো বলতে বলতে মা’র গলা যেন বুজে আসছিল। বাড়িতে আসতেই দীপঙ্করের যেন কেমন অনুতাপ হলো।
বললে—মা–
মা রেগে বললে–কী? আবার ক্ষিদে পেয়েছে? আমার কাছে ক্ষিদের কথা আর বোল না তুমি, আমি আর খেতে দিতে পারবো না–! যেখানে থেকে পারো তুমি এবার নিজে যোগাড় করে নাও-আমি খেতে দিতে পারবো না-এই বলে রাখলুম
দীপঙ্করের যেন কান্না পেল। চোখ ফেটে জল আসতে লাগলো। হঠাৎ দুই হাতে মাকে জড়িয়ে ধরল। বললে–মা, তুমি রাগ করো না, তুমি রাগ করলে আমার যে ভালো লাগে না মোটে
–ভালো লাগে না তো না লাগুক, আমি তার কী জানি! আমি তার কী করবো, আমার যেমন কপাল, আমার মরণ হলেই বাঁচি-ছাড় আমাকে, ছাড় তুই, আমার কাজ আছে–ছাড়
দীপঙ্কর কিছুতেই ছাড়বে না। তার মনে হলো যেন মা’কে ছাড়লেই তার মা আর থাকবে না। তার মাকে হারালে সে বাঁচবে কী করে? কোথায় থাকবে? মা-ই তো তার সব।
বললে–মা তুমি মুখ গম্ভীর করে আছো কেন?
–তা গম্ভীর করবো না তো কি হাসবো! আমার হাসারই কপাল বটে!
–না, তুমি একবার হাসো, না হাসলে তোমাকে ছাড়বো না আমি, তুমি হাসো একবার, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি হাসো মা
মা দীপঙ্করকে ছাড়াতেও পারে না, দীপঙ্করও মাকে ছাড়বে না।
মা বললে–তোর লজ্জা করে না কথা বলতে দীপু! আমার দুঃখু তুই যদি বুঝতিস, তাহলে কি আমার এই হাল হয়! আমি তোর জন্যে দোরে দোরে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছি, আর তুই কিনা আমাকে হাসতে বলছিস? পোড়া মুখে হাসি আসে? হাসবার মুখ তুই রেখেছিস?
মা’র মুখটা ধরে দীপঙ্কর সোজা তার দিকে টেনে নিয়ে বললে–তবু তুমি হাসো মা একবার, আমি দেখি–
দীপঙ্কর দেখতে লাগলো-মা যেন একবার হাসবার চেষ্টা করলে। কিন্তু হাসতে গিয়ে হঠাৎ মা যেন কান্নায় ভেঙে পড়লো একেবারে, হঠাৎ দীপঙ্করকে বুকে জড়িয়ে ধরে একেবারে হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেললে। ছেলের মাথাটা বুকের মধ্যে নিয়ে বলতে লাগলো-তুই কিনা আমায় হাসতে বলিস দীপু! হাসতে কি আমি চাই না রে! হাসতে যে আমার কত সাধ! আজ কত বছর ধরে একদিন হাসতে পারবো বলে মা’কে ডাকছি, সেই আমাকেই তুই হাসতে বলিস দীপু? আমার মতো এমন করে সংসারে কেউ আর হাসতে চায় না যে দীপু–
বলতে বলতে মার চোখের জলগুলো টপ টপ করে দীপঙ্করের মাথার ওপর ঝরে পড়তে লাগলো। আর মা’র বুকের মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে দীপঙ্করের মনে হলো, না থাক তার চাকরি, না থাক তার টাকা, কিছুই না থাক, তার তো মা আছে। মা মানেই তো সব, মা মানেই তো সব কিছু। সংসারে মা থাকলে আর কী চাই? যার মা আছে, তার আর কিসের দরকার? মা মানেই তো সংসার, সংসার মানেই তো মা। মা থাকা মানেই তো সব থাকা।
দীপঙ্কর বললে–আমি আর তোমাকে কষ্ট দেব না মা-তুমি চুপ করো–
এমনি করে কতদিন যে মা-ছেলেতে ঝগড়া হতো আর কতদিন যে ভাব হতো তার ইয়ত্তা নেই। দীপঙ্করের মনে হতো, অঘোরদাদু যতই তাকে ভালোবাসুক, প্রাণমথবাবু যতই তাকে বিপদে সাহায্য করুন, কিরণ যতই প্রাণের বন্ধু হোক মা’র মতন তো কেউ নয়। মা না থাকলে কোথায় সে আশ্রয় পেত? মা না থাকলে এই বিরাট পৃথিবীতে সে কী করতো?
১৩
সেদিন বাড়িতে যেতেই দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-মা, ওদের বাড়ির একটা মেয়ে এসেছিল বুঝি?
মা বললে–হ্যাঁ, রে, তুই যে ওদের বাড়িতে অত যাস তা তো বলিস নি?
দীপঙ্কর বললে–ওরা খুব বড়লোক মা, কাকাবাবু খুব বড় চাকরি করে–
মা বললে–তা তুই এত যা, একটা কাজের কাজ তো করতে পারিস না, একবার শুধু মুখের কথা বললেই তোর একটা চাকরি হয়ে যায় শুনলাম–
–কেন? কে বললে তোমাকে? সতী বলেছে বুঝি?
অনেক দিন অনেক জায়গায় অনেক মানুষকে খোশামোদ করে করে মা যেন আশা ছেড়েই দিয়েছিল। একেবারে হতাশ হয়ে গিয়েছিল। অনেক দুঃখের বোঝা বয়ে বয়ে মা যেন একেবারে ভেঙে পড়ছিল। মা এতদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তারই নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় যে চাকরি এসে হাজির হবে তা হঠাৎ বিশ্বাস করতে হয়তো সাহস হয়নি মার।
মা বললে–কালকেই একবার বলিস, বুঝলি?
–আমি বলতে পারবো না মা।
–তা পারবে কেন, তা-ও আমাকেই করতে হবে, পারবে কেবল কিরণের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ঘুরে বেড়াতে! ও ফেল করেছে, ওর সঙ্গে তোমার এত বেড়াবার দরকার কী?…কাল একবার যাবি, বুঝলি?
–তা সতী এসেছিল তোমার কাছে কী করতে মা?
মা বললে–তোর কথাই তো জিজ্ঞেস করছিল বার-বার। আমি বললাম-বাপ মরা ছেলে, তোমরা তোমার কাকাবাবুকে বলে যদি একটা চাকরি-বাকরি করে দাও ওর তো গরীবের একটা উপকার হয়।
দীপঙ্কর তবু যেন খুশী হলো না শুনে। বললে–কিন্তু কী করতে এসেছিল কিছু বললে না?
–কী আবার করতে আসবে, পাশের বাড়িতে লোক বেড়াতে আসে না?
–কেন, ওর কাকীমা তো আসে না, লক্ষ্মীদি তো আসে না, সতীই বা একলা কেন এল?
–তা সবাই কি এক-রকম হয়? এ-মেয়েটা হয়তো আলাদা ধরনের, একটু মিশুকে স্বভাব!…এক-একজনের একটু মিশুকে স্বভাব তো থাকে, তেমনি এসেছিল
দীপঙ্কর বললে–না মা, তা নয়, আসলে অন্য উদ্দেশ্য ছিল, তুমি বুঝতে পারোনি!
–ওমা, লোকের বাড়িতে লোকে বেড়াতে আসবে, তার আবার উদ্দেশ্য কী থাকবে! আর ওরা হলো বড়লোকের মেয়ে, বাপের টাকা আছে, আমাদের মতো গরীব লোকের বাড়িতে বেড়াতে এসে ওদের কীই বা লাভ! এমনি সময় কাটাতে এসেছিল আর কি!
দীপঙ্কর হাসলো। বললে–না মা, তুমি ভালো মানুষ তো, সরল প্রকৃতির লোক, ধরতে পারোনি-আসলে একটা উদ্দেশ্য ছিল মেয়েটার, আমি জানি–
–উদ্দেশ্য আবার কী থাকতে পারে?
দীপঙ্কর বলেছিল একটা উদ্দেশ্য! তুমি সেসব বুঝতে পারবে না। ওরা খুব চালাক মেয়ে তো! তোমার কাছে তাই খুলে কিছু বলেনি
–কিন্তু খুলে বলবার আছে কি তাই বল?
দীপঙ্কর বললে–ওরা বর্মার মেয়ে, তা জানো তো! বর্মার মেয়েরা এখানকার মেয়েদের মতো নয়, জানো! খুব চালাক, আর ওদের পেটে-পেটে বুদ্ধি-ওরা লোককে খুব কষ্ট দেয়। ধরো যদি জানতে পারে যে, তোমার একটা খুব ভালো হচ্ছে তো কিছুতেই তোমার ভালো হতে দেবে না–কেবল চাইবে কিসে তোমার খারাপ হয়! এই রকম ওরা। আর পেছনে পেছনে নজর রাখবে যেন কেউ তোমার ভালো না করতে পারে। আর কেবল সন্দেহ করবে সকলকে।
দীপঙ্করের মা ছেলের কথা কিছু বুঝতে পারলে না। বললে–তার মানে?
–তার মানে ওরা লোক ভালো নয়! বুঝতে পেরেছ?
–লোক ভালো নয়, কিসে বুঝলি তুই?
দীপঙ্কর বললে–আমি যে দেখেছি ওদের বাড়ি গিয়ে।
–তুই ওদের বাড়ি গিয়ে বুঝি কেবল এই সব দেখিস? লেখাপড়া নেই, একটা কাজের কাজ নেই, কেবল এই সব দেখিস তুই ওদের বাড়ি গিয়ে?
–তা দেখবো না! কে কী রকম লোক, তা আমি বুঝতে পারি না ভাবছো! আমাকে সন্দেহ করবে, আর আমি বললেই দোষ হয়ে যাবে? সেই জন্যেই তো এসেছিল আমাদের বাড়িতে–তা বুঝি জানো না
–তোকে সন্দেহ করবে? তোকে সন্দেহ করতে যাবে কেন মিছিমিছি? কী করেছিস তুই?
দীপঙ্করের মা যেন আকাশ থেকে পড়লো। ছেলে বলে কী!
–তোকে কেন সন্দেহ করতে যাবে শুনি? আমি তো এতক্ষণ গল্প করলাম মেয়েটার সঙ্গে, সেসব তো কিছু মনে হলো না! এসব কথা তোকে কে বুঝিয়েছে? কে মাথায় ঢুকিয়েছে তোর এসব?
এতক্ষণ দরজার চৌকাঠের ওপর বসে বসে বিন্তিদি সব কথা শুনছিল। হঠাৎ বললে—দিদি–
মা বললে–কী মা, কী বলছো মা বিন্তি—
বিন্তিদি বললে–মেয়েটা খুব সুন্দর, না দিদি–
মা বললে–কার কথা বলছো মা?
বিন্তিদি বললে–ওই যে বিকেল বেলা এসেছিল–?
মা বললে–তুমিও তো সুন্দর মা, তুমি কি সুন্দর নও? তুমিও সুন্দর–
–না দিদি ও আমার চেয়েও সুন্দর
মা বললে–সাজলে-গুজলে তোমাকে ওর চেয়ে আরো সুন্দর দেখাবে, দেখো তোমাকে সাবান ঘষে মুখে পাউডার মাখালে আরো ভালো দেখাবে-তখন সবাই তোমাকে সুন্দর বলবে
–কিন্তু কেউ তো আমাকে সুন্দর বলে না!
–বলবে, বলবে, এই তো আমি বলছি তোমাকে-আর তাছাড়া সুন্দর বলবার লোক যখন আসবে তোমার, তখন বলবে
বিন্তি কথাটা শুনে যেন খানিকটা লজ্জা পেলে। কিছুক্ষণ কিছু কথা বেরোল না মুখ দিয়ে—
.
দীপঙ্কর বললে–আচ্ছা মা, লক্ষ্মীদি বেশি সুন্দর, না সতী বেশি সুন্দর?
–বড় বোনকে তো দেখিনি, যেদিন যাবো ওদের বাড়িতে সেদিন দেখবো, সতী বলেছে, ওর কাকাবাবুর কাছে আমায় নিয়ে যাবে।
বিন্তি বললে–ভগবান টাকাও দিয়েছে, রূপও দিয়েছে ওদের, না দিদি?
মা বললে–তা তোমাকেও টাকা দিয়েছে ভগবান, তোমার দাদুর অনেক টাকা আছে, ওদের চেয়েও অনেক টাকা, তোমার বিয়ের সময় নাত-জামাইকে অঘোরদাদু অনেক টাকা দেবে–তাই তো সিন্দুকের মধ্যে দাদু টাকা জমাচ্ছে অত–
বিন্তি আবার চুপ করে গেল।
দীপঙ্কর হঠাৎ বললে–মা, তার চেয়ে তুমি ওদের বাড়ি যেও না!
–কেন রে, ওদের বাড়িতে গেলে দোষ কী?
–না, ওরা হয়তো তোমাকে আমার সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞেস করবে, তুমি হয়তো কী বলতে কী বলে ফেলবে, শেষকালে তখন মুশকিল হয়ে যাবে।
–কেন? কী জিজ্ঞেস করবে আবার?
দীপঙ্কর বললে–এই ধরো যদি জিজ্ঞেস করে ভোর বেলা উঠে মন্দিরে ফুল দিতে যাই কি না, ফুল দিতে যাবার সময় কারো সঙ্গে কথা বলি কি না, কারো জন্যে কিছু নিয়ে যাই কি না, এই সব নানান কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে!
বললে–তা ফুল দিতে যাবার সময় তুই আবার কার সঙ্গে কথা বলিস? কার জন্যে কী নিয়ে যাস? কী বলছিস মাথামুণ্ডু তুই?
–না, মাথামুণ্ডু কথাই তো ওরা জিজ্ঞেস করবে কি না!
–কে জিজ্ঞেস করবে?
দীপঙ্কর বললে–ওই মেয়েটাও জিজ্ঞেস করতে পারে। ওই সতী মেয়েটা। তাছাড়া কাকীমাও জিজ্ঞেস করতে পারে। আর কাকাবাবু তো আছেই। আসলে সবাই ওরা এক রকম, জানো-শুধু লক্ষ্মীদিই যা আলাদা–এত ভালো মেয়ে, তোমাকে কী বলবো মা! আর ভালো হলে যা হয়, তাই হয়েছে
মা ছেলের কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারছিল না।
বললে–ভালো হলে কী হয়?
–ভালো হলেই সংসারে সবাই তাকে কষ্ট দেয়!
মা চাইল ছেলের মুখের দিকে। বললে–তোকে একথা কে শেখালে?
দীপঙ্কর বললে–একথা আবার কাউকে শেখাতে হয় নাকি! তুমি কি ভাবো, আমি কিছু জানি না? যে যত ভালো লোক, সংসারে সে-ই বেশি কষ্ট পায়, এ তো জানা কথা! এই তোমার কথাই ধরো না, তুমি ভালো মানুষ বলেই তো এত কষ্ট পাচ্ছে।-না? সত্যি কিনা বলো?
মা বলে–তা তো পাচ্ছি-কী কষ্ট যে পাচ্ছি, তা ভগবানই জানেন
–তবে? লক্ষ্মীদিও ঠিক তোমার মতো মা। লক্ষ্মীদিকে দেখলেই আমার ভোমার কথা মনে পড়ে। তোমারও যত কষ্ট, লক্ষ্মীদিরও তত কষ্ট। দুজনেই ঠিক একরকম
মা কিছু বুঝতে পারলে না ছেলের কথা।
দীপঙ্কর বললে–অথচ তোমাকে দেখেও যেমন তোমার কষ্টটা কেউ বুঝতে পারে না, লক্ষ্মীদিকেও বাইরে থেকে দেখলে কিছু বোঝা যায় না–অথচ কী কষ্ট যে লক্ষ্মীদির মা, কী বলবো।
মা বললে–তা কষ্টটা কিসের ওর?
দীপঙ্কর বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর বললে–সে তুমি বুঝবে না মা, নিজের ছোট বোন, নিজের বাবাই ওকে বুঝতে পারে না–তা তুমি-আমি তো পর! আমরা কী বুঝবো বল! আর তাছাড়া ভালোমানুষ হয়ে জন্মেছে যখন তখন কষ্ট তো পেতেই হবে! সে-কষ্ট কে খণ্ডাবে বলো?
মা চুপ করে শুনছিল। সারাদিন খাটুনির পর মা’র চোখে বুঝি ঘুম জড়িয়ে আসছিল। অনেকক্ষণ কথা বলার পর দীপঙ্করের কেমন সন্দেহ হলো। ডাকলে–মা
মা’র সাড়া নেই।
দীপঙ্কর আবার ডাকলে–মা–
মা’র তন্দ্রা ভেঙে গিয়েছিল। বললে–তুই বল্ না, আমি শুনছি–তারপর কী হলো?
দীপঙ্কর বললে–আমি বলছিলাম সংসারে ভালো লোকদের কথা। জানো মা, আমাদের বইতে আছে সক্রেটিস বলে একজন লোক ছিল গ্রীস দেশে–সে-ও ওই রকম খুব ভালো লোক ছিল, কিন্তু শেষকালে ভালো লোকদের যা দুর্দশা হয় তাই হলো।
–কি হলো?
–কী আবার হবে? কেউ তাকে দেখতে পারতো না। শেষে তাকে ধরে দেশের রাজা বিষ খাইয়ে দিলে।
–তারপর?
–এত ভালো লোক সেই সক্রেটিস, জানো মা, সেই বিষ তিনি নিজেই মুখে তুলে খেয়ে ফেললেন। আর মারা গেলেন। অথচ দেখ মা, সেই সক্রেটিস কী লিখে গেছেন জানো, লিখে গেছেন–ইংরিজীটা বললে তুমি বুঝতে পারবে না, লিখেছেন–যারা ভালো তাদের মৃত্যুই হোক আর তারা বেঁচেই থাকুক, ভগবান তাদের সব সময় সহায় হন–!
তারপর দীপঙ্কর আবার ডাকলে–মা
কোনও সাড়াশব্দ নেই মা’র। সারা দিন পরিশ্রম করে মা ক্লান্ত হয়ে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। দীপঙ্কর আর ডাকলে না। তখনও তার ঘুম আসছে না। দীপঙ্কর সেই অন্ধকারের মধ্যেই চোখ চেয়ে জেগে রইল। ওপরে দোতলার একটা ঘরে অঘোরদাদু তখন হয়তো অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। ছিটে-ফোঁটা রাত্রে খেয়ে আবার বেরিয়ে গেছে। কখন আসবে ঠিক নেই। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের সেই ঘেয়ো কুকুরটা মাঝে মাঝে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠছে। আর কেওড়াতলার শ্মশান থেকে মাঝে মাঝে বিকট আর্তনাদ কানে আসছে–বল হরি হরি বোল্–।
দীপঙ্কর তখনও জেগে ছিল। আস্তে আস্তে কাকাবাবুদের বাড়ির ছোটখাটো শব্দও ক্রমে বাতাসে মিলিয়ে গেল। তারপর শুধু নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে আর কিছু দেখা গেল না। কবে কতদিন কত যুগ আগের কথা। যীশুখ্রিস্ট জন্মাবার চারশো ঊনসত্তর বছর আগের কথা। একদিন এথেন্স শহরে এক গরীবের ঘরে দীপঙ্করের মতই একটি ছেলে হলো। বাপ তার নাম রাখলে সক্রেটিস। ব্যাটরার ছোট তরফের বাবুদের বাড়িতে নাতির নামও রাখা হয়েছিল দীপঙ্কর। সে দীপঙ্করের কী হলো কেউ জানে না। কিন্তু আর এক দীপঙ্কর একদিন এসে হাজির হলো বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে এই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে, উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে। সেদিন সেই আড়াই হাজার বছর আগেকার সেই ছেলেটি একদিন বড় হলো। মানুষ হলো। কিন্তু সে এক বিচিত্র মানুষ। তিনি বললেন–‘know thyself; তিনি বললেন, ‘নিজেকে জানো’। তিনি বললেন, ‘It is not the gods but we ourselves who shape our destiny’; তিনি বললেন, ঈশ্বর নয়, আমরাই আমাদের নিজেদের ভাগ্যবিধাতা।’
তিনি বললেন, ‘To a good man, whether alive or dead, no evil can hap pen, nor are the gods indifferent to his well-being’ বললেন,–’যে ভালো ঈশ্বরই তার সহায়’।
তারপর কত মহাপুরুষ এসেছেন আমাদের সংসারে। বুদ্ধদেব এসেছেন, যীশুখ্রিস্ট এসেছেন, মহম্মদ এসেছেন, চৈতন্যদেব, শঙ্করাচার্য, পরমহংসদেব, বিবেকানন্দ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। উপনিষদ থেকে শুরু করে গীতাঞ্জলি পর্যন্ত লেখা হয়েছে। হাজার হাজার বছর আর কোটি কোটি মানুষ এসেছে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য, কেউ কি একবারও ভেবেছিল ব্যাঁটরা গ্রামের দীপঙ্কর সেন সেই একই প্রশ্নের একই জিজ্ঞাসার সমস্যা নিয়ে উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের অঘোর ভট্টাচার্যির ভাঙা বাড়ির ছাদের তলায় শুয়ে শুয়ে একদিন বিনিদ্র রাত কাটাবে? আর সেদিনের সক্রেটিস? তিনিই কি ভেবেছিলেন তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরে সাউথ সাবার্বান কলেজের একটি ছাত্র প্রফেসারের বক্তৃতা শুনে এসে তার রাত্রে ঘুমের ব্যাঘাত করবে তাঁকেই স্মরণ করে! কেন সংসারে ভালো লোকরাই কষ্ট পাবে! ভালো লোকদের ওপরেই বিধাতাপুরুষের এ পক্ষপাতিত্ব কেন? কেমন করে নিজেকে জানবে সে। নিজেকে জানবার সে-মন্ত্র সে কোথায় পাবে! মানুষ যদি নিজের ভাগ্যবিধাতা, তবে ঈশ্বরের দরকার কী! আর ঈশ্বর যদি না থাকে তো কেন সে রোজ ফুল দিয়ে আসে মন্দিরে গিয়ে? পুজো করে সে কোন্ দেবতাকে? মা-কালী, সিদ্ধেশ্বরী, ষষ্ঠী, গণেশ, নকুলেশ্বর–ওরা তবে কে? সে ঈশ্বর কোথায় যে ইহকালেও রক্ষা করবে, পরকালেও রক্ষা করবে!–তার মা’র ভালোর জন্যে কোন্ দেবতার কাছে সে প্রার্থনা করবে? লক্ষ্মীদির মঙ্গলের জন্যে সে কোন্ ঈশ্বরকে ধ্যান করবে?
হঠাৎ দীপঙ্করের মনে হলো ঘরের মধ্যে যেন কিসের শব্দ হলো।
অন্ধকারের মধ্যেই দীপঙ্কর তার দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলে। না, হয়তো কিছু নয়। তার মনের ভুল। কেউ কোথাও নেই। তার ঘুম-না-আসা মনের হয়তো বিচিত্র বিলাস। এমন হয় মাঝে মাঝে। নিস্তব্ধতারও একটা শব্দ থাকে। এও বোধ হয় সেই রকম। আবার পাশ ফিরে ঘুমোবার চেষ্টা করলে দীপঙ্কর।
আবার যেন খস খস করে কী-রকম শব্দ হলো একটা। মনে হলো মাকে ডাকবে নাকি? কিন্তু সারাদিন পরিশ্রম করে মা ঘুমোচ্ছে। কেমন মায়া হলো দীপঙ্করের ডাকতে। হয়তো ছিটে ফিরলো বাড়িতে। কিম্বা ফোঁটা। হয়তো সেই গরাদ-ভাঙা জানালাটা দিয়ে বাড়ির ভেতরে এসে ঢুকলো। এসে ঘুমোবে, তারপর সারা রাত ঘুমিয়ে সকালবেলা অঘোরদাদুকে লুকিয়ে আবার বেরিয়ে যাবে বাইরে।
দীপঙ্কর আবার ঘুমোবার চেষ্টা করলে।
শেষবারের মতো পাশবালিশটা আঁকড়ে ধরে মনে মনে বলতে লাগলো দীপঙ্কর : অঘোরদাদু তোমাকে যতই ঠকাক ঠাকুর, যতই নৈবিদ্যি চুরি করুক, তুমি যেন অঘোরদাদুর কোনও খারাপ করো না। আর কাকাবাবু যতই বলুক–কিরণ খারাপ ছেলে নয় তুমি তো তা জানো ঠাকুর–তারও কোনও খারাপ কোরো না। আর মা? মা তেমাদের ফুল না দিয়ে তোমাদের পুজো না করে জলগ্রহণ করে না–তারও কল্যাণ কোরো তুমি ঠাকুর। আর সকলের শেষে লক্ষ্মীদি! লক্ষ্মীদিকে আমি খুব ভালোবাসি। লক্ষ্মীদিরও খুব কষ্ট, কেউ তাকে দেখতে পারে না-তাকেও তুমি দেখো ঠাকুর–তাকেও তুমি দেখো—
১৪
চন্নুনীর আর আগেকার সে ক্ষমতা নেই। তেমন গালাগালির গলাও যেন থেমে এসেছে। উঠোনের কোণের দিকে একটা চালার ভেতর শুয়ে শুয়ে চেঁচায়, বলে–হাড়হাভাতে মাগী, তোদের মুখে খ্যাংরা মারি, তোদের মুড়োয় আগুন জ্বালি, তোদের পিণ্ডি চটকে গয়ায় গিয়ে আমি তোদের…
তারপর হঠাৎ মাঝখানে থেমে গিয়ে বলে–দিদি, ও দিদি—
দীপঙ্করের মা ডাক শুনে কাছে যায়। বলে–কী হলো চন্নুনী, কী হলো তোর?
–গা-গতরে বড় ব্যথা দিদি, ব্যথায় গতর নাড়তে পারছি নে দিদি–
–তা এতক্ষণ যে গলা শুনছিলুম!
–কই, কখন আবার চেঁচালুম! আমার কথাই বেরোচ্ছে না গলা দিয়ে, আমি আবার চেঁচাব–আ আমার পোড়া কপাল–
কখন অভ্যাসবশে গালাগালি দিয়ে ফেলে চন্নুনী, তার নিজেরও খেয়াল থাকে না মাঝে মাঝে। হঠাৎ ঘুমের ঘোরেও গালাগালি দিয়ে ফেলে। সেদিন উঠোন ঝাঁট দেওয়াও হয় না, সেদিন গোবর ছড়াও দেওয়া হয় না তার। সেদিন দীপঙ্করের মা’র কপাল ভাঙে। সেদিন একহাতে রান্নাও করতে হয়, আর এক-হাতে ঝাঁটাও ধরতে হয়। আবার উনুন নিকোনো বাসন মাজা সবই করতে হয় মা’কে। আর দীপঙ্করকে করতে হয় বাজার। বাজারে গিয়ে মাছ, আলু, পটল, বেগুন, লাউ, কুমড়ো সবই কিনে আনতে হয়।
প্রথম প্রথম মা’র ভয় করতো। কখনও বাজার করেনি ছেলে, পারবে কিনা কে জানে! বাজার থেকে এলে হিসেব নিতে বসে।
বলে– পয়সার হিসেবটা দে–
হিসেবে মা খুব পাকা। হিসেব করে প্রত্যেকটি পাইপয়সা পর্যন্ত। তারপর বাকি পয়সাগুলো আঁচলে বেঁধে রাখে। পরের পয়সা। পরের পয়সার বড় জ্বালা। নিজের পয়সা হলে যেমন তেমন করে খরচ করলে চলে। কিন্তু বুড়ো মানুষ পয়সা-অন্ত প্রাণ একটা পয়সা প্রাণ ধরে কাউকে দিতে পারেন না। ছোট বেলায় পয়সার মুখ দেখেন নি। একটা পয়সার অভাবে গঙ্গার জল খেয়ে কাটাতে হয়েছে, গঙ্গার জল আঁজলা ভরে খেয়ে পেট ভরাতে হয়েছে। সেই মানুষের আজ পয়সা হয়েছে। সেই মানুষের পয়সা, টাকা, মোহর, গয়না সব সিন্দুকে বোঝাই করে তার ঘরে রাখা হয়েছে। রাত্রে ঘুমিয়েও যেন শান্তি থাকে না, বাইরে গিয়েও ভাবনা ঘোচে না। বার বার ঘরের তালাটা টেনে দেখে মা। ঠিক আছে তো!
মা বলে–এই বেগুন দু পয়সা সের? বলিস কি তুই দীপু–এ যে দিনে ডাকাতি মা–
দীপঙ্কর বললে–কত করে বললুম, এক পয়সা সের করে দিতে, কিছুতেই দিলে না, আমি কী করবো
অঘোরদাদু অবশ্য দর-দাম নিয়ে মাথা ঘামায় না। বরাদ্দ পয়সায় চলে গেলেই হলো! তা হলে কিছু বলবে না মুখে। খড়ম পায়ে দিয়ে নিচে নেমে গপ্ গপ্ করে ভাতগুলো মুখে পুরে দেয়। ছাই খাচ্ছে, না ভস্ম খাচ্ছে তাও দেখবার দরকার নেই তার।
–ওমা, মাছটা মুখে দিলেন না বাবা, মাছটা আবার কা’র জন্যে রেখে দিলেন? অঘোরদাদু চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলো। বললে–মুখপোড়া মেয়ে মাছ দিয়েছে আমাকে? মুখপোড়া আমার পয়সা দেখেছ? পয়সা সস্তা হয়েছে আমার?
অঘোরদাদু তখন থালা ছেড়ে হাত তুলেছে। বলে– খাবো না মুখপোড়া আমি, যে খাবে, সে মুখপোড়া, সে হারামজাদা–
তখন মাকে শান্ত করতে হবে। বলবে–বাবা, ঘাট হয়েছে আমার, আমিই মাছ আনিয়েছি, চন্নুনীর তো অসুখ, তাই দীপুকে বাজারে পাঠিয়েছিলুম, দীপু মাছ এনেছে–
–মুখপোড়াটা আমার পয়সা দেখেছে বুঝি? কোথায় গেল সে মুখপোড়াটা? কোথায় গেল সে শুনি?
–দীপু তো খেয়ে কলেজ গেছে এখন, এলে পাঠিয়ে দেব।
তখন আবার ঠাণ্ডা হয় বুড়ো মানুষ। মাছটা খেয়ে যেন ভালো লাগে। চেটে চেটে রসিয়ে রসিয়ে খায় মাছটা।
বলে–মুখপোড়াকে এ-মাছ খেতে দিয়েছ? মুখপোড়াটা খেয়েছে?
মা বললে–না দিইনি, দেব’খন ওবেলা–তার মাছ ঢাকা আছে–
অঘোরদাদু বলে–তা দেবে কেন, সব দেবে আমাকে, আমি মাছ খেয়ে মরি, আর তোমরা আমার পয়সাগুলো নিয়ে হরির লুট খাও–এই বলে রাখলুম মেয়ে, আমি কোনও মুখপোড়াকে টাকা দিয়ে যাবো না, আমি টাকা নিয়ে গঙ্গায় ফেলে দেব, রাস্তায় ছড়াবো, ভিখিরিদের দিয়ে দেব, তবু তোমাদের দেব না একটা আধলা–
বলতে বলতে রেগে মেগে হাত ধুয়ে, মুখ ধুয়ে আবার খড়ম খট্ খট্ করতে করতে ওপরে গিয়ে ওঠে। তারপর ওপরে উঠেও গড়্গগজানির শেষ হয় না। এক ঘণ্টা দু’ঘণ্টা ধরে সেই গজগজানি নিচে থেকে শোনা যায়। তারপর ছিটে এক সময় খেতে আসে, ফোঁটা এক সময়ে খেতে আসে। চন্নুনীর খাবারটা তার ঘরে দিয়ে আসতে হয়। তারপর দীপঙ্করের মা যখন খেতে বসে তখন হয়তো দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। ভাড়াটে বাড়ির ছায়াটা সরে সরে একেবারে এক চিলতে হয়ে যায়। আমড়া গাছটার ডালে একটা কাক তখন হাঁ করে রান্নাঘরের দিকে চেয়ে বসে থাকে। এঁটো কাঁটাগুলো যখন মা আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তখন সে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকে। আর তখন আসে ঠঙ ঠঙ বাজনা বাজাতে বাজাতে বাসনওয়ালারা, তখন কলের মুখে একটা সোঁ সোঁ আওয়াজ শুরু হয়, আর তার একটু পরেই কলে জল আসে!
বাজার থেকে এসেই দীপু বললে–মা, আজকে কাকাবাবুদের বাড়ি যাচ্ছি–এখনই
আসব।
–-কলেজ যাবি না?
-–যাবো, এই যাবো আর আসবো–
–চাকরির কথাটা বলতে বুঝি? একটু বলিস ভালো করে–
মা তখন রান্না করছিল। কড়ায় তেল চড়িয়েছিল। তেলের ওপরে আলুগুলো ছাড়তেই কেমন একটা কল্ কল্ শব্দ হলো। আর কিছু শোনা গেল না। দীপঙ্কর বাজারের ঝুলিটা রেখেই আঁশের হাতটা ধুয়ে নিলে। তারপর চটিটা পায়ে দিয়ে লক্ষ্মীদির বাড়ির দিকে গেল। কেমন যেন একটু তার ভয় করতে লাগলো মনে। অথচ সকাল বেলাও কিছু জানতো না। সকাল বেলা যথানিয়মে মন্দিরে মন্দিরে ফুল দিয়ে এসেছিল তারপর এসে পড়তে বসবার কথা। হিস্ট্রি আছে, সিভিক্স আছে, ইংরিজী আছে! কিন্তু চন্নুনীর অসুখ আজও কমেনি। বাজারে যেতে হয়েছিল দীপঙ্করের সেদিনও। বাজারে হঠাৎ রঘুর সঙ্গে দেখা দেখা। রঘুও বাজার করছে।
রঘু বললে—দীপুবাবু–
দীপু বললে–রঘু, বাজার করছো বুঝি?
তারপর আবার জিজ্ঞেস করলে-লক্ষ্মীদি কী করছে!
রঘু বললে–কাল খুব ঝগড়া হয়ে গেছে দীপুবাবু–
–ঝগড়া? কার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে, কে ঝগড়া করেছে?
–দুই বোনে। বড়দিমণি আর ছোড়দিমণিতে–
-–কেন?
–তা জানিনে, বড়দিমণি রাগ করে খায়নি। কাকাবাবু খুব সাধাসাধি করলে, তবু খেলে না, কাকীমা সাধলে তবু খেলে না।
-–কেন, ঝগড়াটা হলো কী নিয়ে? তা শোননি!
রঘু বললে–ও দু বোনের ঝগড়া তো নতুন নয়, ও সেখানেও ছিল, এখানেও হয়েছে।
দীপঙ্কর বললে–তা দুটি তো মাত্র বোন, তা দুটিতেও ভাব নেই?
রঘু বললে—নাঃ–
–কিন্তু এক-এক সময় যে খুব ভাব দেখেছি, খুব হাসে দুজনে। আমি বাড়ি বসে পড়তে পড়তে শুনতে পাই।
রঘু বললে–তা ভাব হয, কিন্তু ঝগড়াই হয় বেশি, ছোটবেলা থেকে তো আমি দেখে আসছি–
–কার দোষটা বেশি? লক্ষ্মীদির না সতীর? দুজনের মধ্যে কে ভালো বলো তো রঘু?
–ভালো দুজনেই।
দীপঙ্কর বললে–দুজনেই ভালো?
–হ্যাঁ, দুজনেই ভালো।
–তবু তারই মধ্যে লক্ষ্মীদি বোধহয় একটু বেশি ভালো, না?
রঘু বললে–না, দুজনেই বেশি ভালো।
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু সতী, তোমার ছোড়দিমণি একটু সন্দেহ করে যে, লক্ষ্মীদিকে যারই ভালো লাগবে, তাকেই যে সন্দেহ করে?
–কিসের সন্দেহ করবে?
দীপঙ্কর আর সেসব নিয়ে বেশি আলোচনা করলে না রঘুর সঙ্গে। ওসব কথা ওর সঙ্গে আর বেশি আলোচনা না করাই ভালো। বাড়ির চাকর তো। হয়তো সব কথা জানে না। হয়তো বাইরের থেকে যা দেখেছে, তা-ই জানে। লক্ষ্মীদির মনের কষ্টটা জানবে কী করে। লক্ষ্মীদি তো তাকে ছাড়া আর কাউকে বলেনি। লক্ষ্মীদির মনের কষ্টের কথা একমাত্র দীপঙ্করই জানে। লক্ষ্মীদি তো বাড়িতে আর কাউকে বিশ্বাস করে না।
–আচ্ছা, তুমি বাজার করো রঘু, আমি যাই–
বাড়িতে ঢোকবার মুখেও কেমন একটু ভয় ভয় করছিল। তবে কি জানাজানি হয়ে গেছে? তবে কি সবাই জেনে গেছে? সতী হয়তো সব বলেছে লক্ষ্মীদিকে। দীপঙ্করের মনে হলো আজ যেন সে অপরাধীর মতো ঢুকছে এ-বাড়িতে। এতদিন যেন সে সত্যিই অন্যায় করে এসেছে। জানা নেই, শোনা নেই, কোথাকার কে একজন, তাকে সে লক্ষ্মীদির চিঠিগুলো দিয়ে এসেছে লুকিয়ে লুকিয়ে। লুকিয়ে লুকিয়ে কোনও কাজ করাই তা অন্যায়। আসলে তো দীপঙ্করেরই দোষ! সেই কতদিন থেকে এ-কাজ করে আসছে সে। অবশ্য লক্ষ্মীদির ভালোর জন্যেই করে এসেছে। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, গ্ৰীষ্ম, নেই, বর্ষা নেই, প্রতিদিন সে চিঠি দিয়ে এসেছে। এতদিন নিজের স্কুলের পড়ার ক্ষতি করে দিয়েছে, অপেক্ষা করেছে, বৃষ্টিতে ভিজেছে রাত্রে শুয়ে শুয়ে, যখন মা ঘুমিয়ে পড়েছে, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন লক্ষ্মীদির কথাই ভেবেছে।
মা বলে দিয়েছিল–একটু বুঝিয়ে-সুজিয়ে বলবি, জানিস, বলবি নিজের দুঃখের কথা–না বললে লোকে বুঝবে কেন? তারপর আমি একদিন বলবো গিয়ে–
–মা তো জানতো না, মা তো কল্পনাও করতে পারতো না এ-সব ৷
মা বলেছিল–নিজের কথা নিজে না বললে কি কেউ চাকরি দেয়? আমি ঘরে বসে থাকবো আর একজন হাতে তুলে দেবে চাকরি তা তো হয় না–
–কাকীমা, লক্ষ্মীদি কোথায়?
কাকীমা যেন অন্য দিনের চেয়ে একটু গম্ভীর-গম্ভীর।
বললে–আছে ওপরে, যাও–
রঘু তখনও বাজার থেকে আসেনি। সকালবেলা সংসারে সবাই ব্যস্ত। কাকাবাবু আপিস যাবেন। রান্নাবান্না হচ্ছে। ঠাকুর উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে রান্না করছে। একতলার রোয়াক ধোয়া মোছা হয়ে গেছে। সিমেন্টের রোয়াকের ওপর দিয়ে যেতে যেতে দীপঙ্করের পা যেন আটকে যেতে লাগলো। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে এক মুহূর্তের দ্বিধা হলো। যদি লক্ষ্মীদির ঘরে সতী থাকে এ-সময়ে! সতী যদি লক্ষ্মীদির সঙ্গে তাকে কথা বলতে না দেয়! সতী যেরকম মেয়ে, হয়তো কথাই বলতে দেবে না। অত কথা কী, হয়তো ঘরেই ঢুকতে দেবে না! হযতো বলবে–এখন এসেছ কেন? পড়াশোনা নেই আমাদের?
দীপঙ্কর খানিকক্ষণ দাঁড়িয়েই আবার ফিরলো।
কিন্তু এতদূর এসে ফিরে যাবে নাকি! লক্ষ্মীদি তো তাকে ভালোবাসে! লক্ষ্মীদির কাছে সে যাবে, তাতে কার কী বলবার আছে। লক্ষ্মীদি তো বড় বোন। বড় বোনের কথার কোনও দাম নেই! বড় যে হয়, তার কথাই তো ছোট শোনে!
কাকীমা বোধহয় রোয়াক দিয়ে ভাঁড়ার ঘরে যাচ্ছিলেন।
বললেন–কে, দীপু? ওখানে দাঁড়িয়ে আছ যে ওপরে গেলে না?
দীপঙ্কর হঠাৎ যেন জ্ঞান ফিরে পেলে।
বললে–আচ্ছা কাকীমা, একটা কথা বলবো?
–কী কথা, বল না!
দীপঙ্কর বললে–আপনি তো জানেন আমাদের কথা!
–তা তো জানিই।
–আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। আপনি তো জানেন, আমার বাবাকে ডাকাতে খুন করে ফেলেছিল। আমার মা কত কষ্ট করে আমাকে মানুষ করেছে। পরের বাড়িতে মা’কে রান্না করতে হচ্ছে, তারপরে বলত গেলে ভিক্ষে করেই এক রকম চলছে আমার…
কাকীমা বললেন–হ্যাঁ, তা তো জানিই–তা কী বলবে বলো না?
–সেই কথাই বলতে এসেছিলাম। এ অবস্থায় আমার একটা চাকরি যদি হয় তো খুব উপকার হয় আমাদের, মানে তাহলে আর মা’কে পরের বাড়ি রান্না করতে হয় না–
কাকীমা বললেন–তা তো বটেই, তা কাকে কী বলতে এসেছিলে?
দীপঙ্কর বললে–কাকাবাবু আমাকে একটা চাকরি করে দিতে পারেন না? কাকাবাবু তো বড় চাকরি করেন। কাকাবাবু যদি নিজের আপিসে ঢুকিয়ে দেন আমাকে তো খুব ভালো হয় আর কি–
কাকীমা বললেন–তা কাকাবাবু তো রয়েছেন ওপরে, কাকাবাবুকে গিয়ে বলে দেখ না!
–আমি নিজে যাব? কাকাবাবু রাগ করবেন না?
-–না, রাগের কী আছে! তোমার চাকরির দরকার, তুমি বলবে, তাতে রাগ করবেন কেন?
দীপঙ্কর বললে–মা-ও আসবে বলতে, মা নিজেই কাকাবাবুকে বলবে, তার আগে আমি তবু একবার বলতে এসেছি আর কি
–তা চলে যাও ওপরে, যাও না, গিয়ে বলগে–আমাকে যে কথাগুলো বললে, এই কথাগুলোই গিয়ে বলো গে!
–কাকাবাবু রাগ করবেন না?
তারপর একটু থেমে বললে–আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না কাকীমা!
–কী কাজ?
–আপনি এখন খুব ব্যস্ত আছেন, নইলে আপনাকে আমি সব বুঝিয়ে বলতাম, আর তারপর আপনি সমস্ত বলতেন কাকাবাবুকে!
কাকীমা বললেন–তা কখনও হয়? নিজের কথা নিজে বলাই ভালো–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু চাকরির কথা বলতে আমার বড় লজ্জা করে কাকীমা, আপনাকে সব বলতে পারি, কিন্তু কাকাবাবুকে বলতে গেলে বড় লজ্জা হয় কাকীমা–
কাকীমা বললেন–লজ্জা করলে তো চলবে না তোমার, আর লজ্জা করলে কে তোমাকে চাকরি দেবে? তোমার তো কেউ নেই সংসারে যে, তোমাকে ডেকে চাকরিতে বসিয়ে দেবে! যাদের কেউ থাকে না, তাদের নিজেদেরই বলতে হয়–
-–আচ্ছা, লক্ষ্মীদি কোথায়?
কাকীমা হাসলেন। বললেন–তা লক্ষ্মীকে দিয়েও বলাতে পারো–বলে দেখ না–যাও–লক্ষ্মী তো আছে ওপরে
বলে কাকীমা ভাঁড়ার ঘরে চলে গেলেন। দীপঙ্কর আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো। ওপরে উঠেই লম্বা বারান্দা। বারান্দাটা খালি। কেউ নেই তখন ওখানে। বারান্দা পেরিয়ে তেতলার সিঁড়ি দিয়ে কাকাবাবুর কাছে যেতে হবে। আস্তে আস্তে বারান্দা দিয়ে যেতে গিয়েই দীপঙ্কর দেখলে লক্ষ্মীদির ঘরে আর কেউ নেই। একলা লক্ষ্মীদি দরজার দিকে পেছন ফিরে একমনে কী যেন পড়ছে।
দীপঙ্কর দরজার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে ডাকলে–লক্ষ্মীদি–
লক্ষ্মীদি পেছন ফিরলো।
পেছন ফিরতেই দীপঙ্করের মুখখানা সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তখন আর ঘরের ভেতরে ঢোকবার সাহসও নেই।
সতী দীপঙ্করকে দেখেই বললে–এসো, ভেতরে এসো না–
দীপঙ্কর ভয় পেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ঘর থেকে চলে যেতে পারলে যেন সে বাঁচে। বললে–আমি এমনি এসেছিলাম
–ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো–
দীপঙ্কর আস্তে আস্তে ঘরের ভেতরে যেতে যেতে বললে–আমি ভেবেছিলাম লক্ষ্মীদি বুঝি–
সতী বললে–বোসো এই চেয়ারটায়–
দীপঙ্কর ভয়ে ভয়ে বসলো। পা দুটো কাঁপছিল তার। বললে–আমার এখুনি কলেজে যেতে হবে, আমি বরং যাই–
সতী বললে–লক্ষ্মীদির সঙ্গে তোমার কী দরকার ছিল?
–দরকার কিছু ছিল না, এমনি–
সতী বললে–দরকার না থাকলেও বুঝি তুমি আসো?
দীপঙ্কর বললে– হ্যাঁ, লক্ষ্মীদিই আমাকে আসতে বলে, লক্ষ্মীদি আমাকে আসতে বলে বলেই এসেছি–লক্ষ্মীদি বলে, কাকাবাবু বলেন, কাকীমা বলেন–সবাই আমাকে আসতে বলেছে, দরকার না থাকলেও আসতে বলেছে। এখন আর তোমাদের বাড়িটা পরের বাড়ি বলে মনে হয় না আমার–
তারপর একটু থেমে বললে–তুমি আসার আগে পর্যন্ত খুব ঘন-ঘন আসতাম, তুমি আসার পর থেকে আসা একটু কমিয়ে দিয়েছি–
–কেন?
দীপঙ্কর একটু ভেবে নিয়ে উত্তর দিলে। বললে–এখন আমারও কাজ বেড়েছে, এখন লেখাপড়া বেড়েছে, এখন চাকরির খোঁজে চারদিকে যেতে হয়–তারপর সকালবেলা থেকে আমার অনেক কাজ–তোমাদের মতন সারাদিন বইতে মুখ দিয়ে বসে থাকলে তো আমার চলে না। আমার বাজার করতে হয়, ভোর বেলা উঠেই আমাকে আবার মন্দিরে মন্দিরে ফুল দিয়ে আসতে হয়
অনেকগুগুলো কাজের ফিরিস্তি দিতে পেরে দীপঙ্করের জড়তাটুকু যেন কেটে গেল–
সতী বললে–কাজ করা তো ভালোই
দীপঙ্কর উৎসাহ পেয়ে গেল সতীর কথায়। বললে–আমার মা আমার চেয়েও বেশি কাজ করে। কাজ করতে করতে একেবারে ঘেমে নেয়ে ওঠে, বাড়িসুদ্ধ সকলের রান্না করতে হয়–তাছাড়া বাবা নেই তো আমার, আমার জন্যেও মা’র অনেক ভাবনা, সেই দু মাস বয়েস থেকে আমাকে মানুষ করে আসছে। মনে করে দেখ, আমি যখন শিশু আর কি, কথাও বলতে পারি না তখন থেকেই মা বিধবা! সে যে কী কষ্ট, সে কেউ বুঝবে না। মার কাছে শুনেছি এক-একদিন ভাত খেতে পায়নি, শুধু মুড়ি খেয়ে মা কাটিয়েছে
বলতে বলতে হঠাৎ বোধহয় খেয়াল হলো দীপঙ্করের। এসব কথা কাকে বলছে সে। বললে–যাকগে, এসব কথা তোমরা ঠিক বুঝবে না–
সতী বললে–না-না, বেশ লাগছে, বলো না–
দীপঙ্কর বললে–তোমরা এসব কল্পনাও করতে পারবে না, মানে, মা বলে, এক একদিন ঘরে একটা কণাও চাল নেই, ওদিকে আমি ভাত খাবো বলে কাঁদছি–বলতে বলতে মা-ই অনেক সময় কেঁদে ফেলেছে–আর বলবে কি–
হঠাৎ থেমে গিয়ে দীপঙ্কর বললে–আচ্ছা, একটা কথা তোমায় জিজ্ঞেস করবো?
-–কি কথা!
–আগে বলো, আমার কথার ঠিক-ঠিক উত্তর দেবে?
সতী বললে–কেন, আমাকে কি তোমার সন্দেহ হয়?
দীপঙ্কর হাসলো। বললে–সন্দেহ তো তুমিই আমাকে করো–
–কেন, আমি তোমাকে সন্দেহ করতে যাবো কেন? আশ্চর্য তো–
দীপঙ্কর বললে–দেখ, তুমি নতুন এসেছ কলকাতায়, এখনও ভালো করে চেনো না আমাকে, লক্ষ্মীদিকে তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো, লক্ষ্মীদি জানে, আমি কাউকে কোনদিন কষ্ট দিইনি জীবনে, কাউকে কষ্ট দিতে আমার খুব দুঃখ হয়–কাউকে কষ্ট দিয়ে লাভটা কী? একে তো সব মানুষের হাজার-হাজার রকমের কষ্ট আছে, দুঃখকষ্টের শেষ নেই পৃথিবীতে। তার ওপর মানুষের দেওয়া কষ্ট কতখানি মর্মান্তিক বলো তো!
সতী বললে–তা তো বটেই–
দীপঙ্কর বললে–এই ধরো না আমাদের কথা, আমার বাবাকে ডাকাতে খুন করে ফেলেছিল। কেন? না আমার জেঠামশাইয়ের সঙ্গে বাবার জমি-জমা নিয়ে মামলা চলছিল–
–সেসব তোমার মা’র কাছে শুনেছি
দীপঙ্কর বললে–মা বলেছে বুঝি তোমাকে? তাহলেই ভেবে দেখ, আমার বাবা যদি খুন না হতো আজ আমাদের ভাবনা! তাহলে আমিও তোমাদের মতো এইরকম বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতাম, এই রকম টেবিল-চেয়ার-খাট নিয়ে থাকতাম, বাড়িতে তোমাদের মতো ঠাকুর, চাকর, ঝি সব থাকতো–সারাদিন আমার কাজ করতে হতো না–কেবল তোমাদের মতো বসে বসে পড়তুম
সতী বললে–তুমি কি মনে করো আমাদের কোনও কষ্ট নেই? একা শুধু তোমাদেরই কষ্ট?
দীপঙ্কর বললে–তা তোমার আবার কিসের কষ্ট! বেশ খাচ্ছো, দাচ্ছো, লেখাপড়া করছো–
সতী বললে–কত রকম কষ্ট আছে আমার! সব কি সকলকে বলা যায়?
–কিন্তু আমার কষ্ট তো সব বললুম তোমাকে। আমার কষ্ট, আমার মা’র কষ্ট, আমাদের কষ্ট তো সব বললুম তোমাকে। আমি আমার সব কথা সকলকে বলতে পারি-লক্ষ্মীদিকেও আমি আমার সব কষ্টের কথা বলেছি, লক্ষ্মীদিও বলেছে তার সমস্ত কথা–
–লক্ষ্মীদি! লক্ষ্মীদির কিসের কষ্ট?
সতী যেন হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠলো। যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে লাগলো সতী দীপঙ্করের দিকে। বললে–লক্ষ্মীদি কোন্ কষ্টের কথা তোমায় বলেছে?
দীপঙ্কর হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল ৷
সতী বললে–উঠো না, বোস, লক্ষ্মীদি তোমায় কোন্ কষ্টের কথা বলেছে, বলো। আমি কিছু বলবো না
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু তার জন্যে তুমিও দায়ী!
–আমি? আমি দায়ী?
দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ, তুমিও দায়ী।
–আমি কিসে দায়ী বললে, বা রে, কে বলেছে এসব কথা? লক্ষ্মীদি বুঝি?
দীপঙ্কর বললে–কে বলেছে না বলেছে সে কথা থাক, কিন্তু তুমি তো ঝগড়া করেছ! বড় বোনের সঙ্গে তোমার ঝগড়া করা কি উচিত হয়েছে? লক্ষ্মীদি না তোমার বড় বোন হয়?
সতী একটু গম্ভীর হয়ে গেল কথাটা শুনে। একটু পরে বললে–আমাদের ঝগড়া হলে তোমার কানে কী করে যায়?
দীপঙ্কর বললে–আমি জানি, আমি সব জানতে পারি–
–কি করে তুমি জানতে পারো, তাই আমি জিজ্ঞেস করছি। লক্ষ্মীদি বলেছে? দীপঙ্কর হাসলো। বললে–ঝগড়া করে লক্ষ্মীদি যে খায়নি কাল রাত্রে, তাতে তোমার কষ্ট হয় না?
সতী অনেক কিছু ভাবতে লাগলো। দীপঙ্করের মনে হলো সতী যেন ভাবছে–এ ছেলেটা কেমন করে সব জানতে পারলে?
সতী জিজ্ঞেস করলে–কিন্তু আমাদের বাড়িতে ঝগড়া হলে–তোমার কানে কী করে যায়, তাই শুনি?
দীপঙ্কর বললে–তোমরা ঝগড়া করলে তাতে দোষ হল না, আর আমার কানে যেতেই দোষ?
সতী আরো গম্ভীর হয়ে গেল। বললে–বুঝেছি–
–কি বুঝেছ?
সতী সে-কথার উত্তর দিলে না। বললে–আচ্ছা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি আমি, ঠিক-ঠিক বলবে
–বলো–
সতী একবার পেছন দিকে দেখে নিলে। বললে–লক্ষ্মীদি চান করতে গেছে, এখুনি হয়তো এসে পড়বে–তোমার বয়েস কত?
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে–কেন, আমার বয়েস জেনে তোমার কী হবে? তোমার বয়েস কত?
সতী বললে–বয়েসের কথা জিজ্ঞেস করেছি বলে বুঝি তোমার রাগ হয়ে গেল? পুরুষরা বেশি বয়েস পর্যন্ত ছেলেমানুষ থাকে বলেই তোমার বয়েস জিজ্ঞেস করেছি–
দীপঙ্কর বললে–না, তুমি যা ভাবছো আমি তা নই!
–কী নও?
–আমি আর ছেলেমানুষ নই। আমি সব বুঝতে পারি। আমি লক্ষ্মীদির কী কষ্ট,
তা লক্ষ্মীদির মুখ দেখেই বুঝতে পারি, আর তোমাকেও আমি বুঝতে পারি। বলবো? কেন আমাকে দেখে তোমার রাগ হয়, তা-ও বুঝতে পারি। বাইরে থেকে মনে হয় আমি কিছুই বুঝতে পারি না, আমি বোকা কিন্তু আমি খুব চালাক
সতী বললে–তুমি যদি সবই বোঝ তাহলে তোমাকে একটা কথা বলি–
–বল।
সতী বললে–আমাদের সংসারে এক মা না-থাকা ছাড়া আর কোনও দুঃখকষ্ট নেই। তা মা তো সকলের থাকে না। আমার বাবা অনেক টাকা উপায় করেছেন নিজে মেহনত করে। বিরাট বাড়ি করেছেন, সম্পত্তি করেছেন–সব আমাদের দু বোনের। আমাদের কোনও ভাই নেই। আমরা ছেলের মতোন মানুষ হয়েছি, কলেজে পড়েছি–
দীপঙ্কর চুপ করে শুনতে লাগলো।
সতী আবার বলতে লাগলো–যেখানেই মানুষ হয়েছি, সেখানেই লেখাপড়া করেছি, হয়তো সেখানেই সারাজীবন কাটিয়ে দিতাম–কিন্তু একটা মুশকিল হলো–। সে মুশকিলটা না হলে দিদিও কলকাতায় আসতো না, আর দিদি না এলে আমাকেও আসতে হতো না–এসে এই–দাঁড়াও আমার কথাটা আগে শেষ হোক–এসে এই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতে ভেতর থাকতে হতো না–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কী মুশকিল? মুশকিলটা কী?
-–বলছি, আমার বাবা জীবনে কোনও পাপ করেননি। একটা মিথ্যে কথা পর্যন্ত বলেননি কখনও। কারোর কোনও ক্ষতি জ্ঞানত করেননি, নিজে সৎপথে থেকে সারাজীবন চলে এসেছেন। যখন গিয়েছিলেন সেখানে, তখন একেবারে নিঃসম্বল অবস্থা, তারপর নিজের চেষ্টায় পয়সা উপার্জন করেছেন। বাবাকে না দেখলে ঠিক বাবাকে বোঝানো যাবে না। আমাদের চেহারা দেখে বাবার চেহারাটাও আন্দাজ করা যাবে না। আমরা আর কীই-বা ফরসা! বাবার মতো গায়ের রঙ আমরা কেউই পাইনি। রোজ সকাল বেলা উঠে বাবা এক ঘণ্টা ধরে এখনও গীতা পড়েন, আহ্নিক করেন, জপ করেন–তারপর জলগ্রহণ করেন–
বাবার কথা বলতে বলতে সতীর মুখ চোখ যেন লাল টকটকে হয়ে এল।
দীপঙ্কর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–তুমি বুঝি বাবাকে খুব ভালোবাসো?
সতী হাসলো। বললে–বাবাকে কে না ভালোবাসে? সেইজন্যেই তো তোমার বাবা নেই যখন শুনলুম, তখন খুব দুঃখ হলো আমার। এই যে এখানে আছি, বাবার চিঠি না পেলে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। আমাদের তো মা নেই, বাবাই সব–
দীপঙ্কর একমনে শুনছিল। বললে–আমার উল্টো–আমার মা’ই সব–
–তোমার মা’র কাছে তাই বলছিলাম, আমার বাবার চেহারা দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। এত ভালো আমার বাবা। কিন্তু সেই বাবার কাছেও থাকতে পারলাম না, এমনি কপাল আমাদের–
–কেন?
সতী বললে–সেই কথাই তো বলছি, শেষ জীবনে বাবা মনে বড় কষ্ট পেলেন। মা মারা যাওয়াতেও বাবা এত কষ্ট পাননি–বাবার সে-কষ্ট চোখে দেখা যায় না।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কী কষ্ট? কষ্টটা কী?
সতী একটু থেমে এল। গলাটা তার যেন বুজে এল। তারপর একটু থেমে বললে– ওই আমার লক্ষ্মীদি–লক্ষ্মীদির জন্যে–
–লক্ষ্মীদির জন্যে?
সতী হঠাৎ মুখটা সামনে নিয়ে এল। গলাটা হঠাৎ নিচু করে বললে–তোমায় একটা কথা বলবো?
–কী কথা?
–এই কথা বলবার জন্যেই তোমার সঙ্গে কদিন ধরে দেখা করতে চাইছি। কলকাতায় আমি সে জন্যেই এসেছি, তোমাদের বাড়িতেও আমি সেইজন্যেই গিয়েছিলুম…তুমি তো লক্ষ্মীদিকে খুব ভালোবাসো?
দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ, খুব ভালোবাসি। লক্ষ্মীদিও আমাকে খুব ভালোবাসে—
সতী বললে–হ্যাঁ, লক্ষ্মীদির চিঠিতেও আমি তাই বুঝতে পেরেছিলাম, তোমার কথা অনেক লিখতো আমাকে। তুমি কী রকম করে উঁকি দিয়ে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলে, মারলেও তুমি রাগ করতে না–
দীপঙ্কর বললে–তখন আসলে আমি সত্যিই ছোট ছিলুম, কিছু বুঝতুম না
–আচ্ছা, এখন তো সব বোঝ, এখন তো তুমি বড় হয়েছ, এখন তো আর তুমি ছেলেমানুষ নও!
–না!
–তাহলে একটা কথা তোমায় বলবো, তুমি শুনবে?
দীপঙ্কর বললে–কী কথা?
–আগে বলো আমি যা বলবো, তা কাউকে বলবে না?
দীপঙ্কর আবার জিজ্ঞেস করলে–তবু কী কথাটা তুমি বলো না–
সতী আর একবার পেছন দিকটা দেখে নিলে। বললে–কাউকে বলবে না বলো? দীপঙ্কর যেন ভাবনায় পড়লো। সবাই তাকে সব কথা গোপন করতে বলে। সংসারে সবাই-ই কি সবাইকে অবিশ্বাস করে! লক্ষ্মীদি অবিশ্বাস করে সতীকে, সতী অবিশ্বাস করে লক্ষ্মীদিকে! কাকাবাবুও কি অবিশ্বাস করে কাকীমাকে? তার বাবাও কি মাকে অবিশ্বাস করতো? আর কিরণ? কিরণও কি অবিশ্বাস করে দীপঙ্করকে? ছিটে, ফোঁটা, চন্নুনী, বিন্তিদি সবাই? আর অঘোরদাদু? অঘোরদাদুও যেমন অবিশ্বাস করে ঠাকুরকে, ঠাকুরও কি অবিশ্বাস করে এই সব মানুষকে?
একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। সতীর কথায় আবার জ্ঞান ফিরে এল।
সতী বললে–বলো, কাউকে বলবে না?
–লক্ষ্মীদিকেও বলবো না?
–না, কাউকে বলতে পারবে না।
দীপঙ্কর বললে–কী কথা, বলো?
সতী এবার যেন আরো সতর্ক হলো। আরো কাছে সরে এল। একেবারে মুখোমুখি–
বললে–আমার বাবার মুখ চেয়ে আমি বলছি, অনেক সহ্য করেছেন বাবা, কিন্তু এবার যদি কিছু ঘটে তো আর বাবাকে হয়তো বাঁচানো যাবে না। অন্তত বাবার কথাটা ভেবেও তুমি নিশ্চয়ই সাহায্য করবে আমাদের
দীপঙ্কর এবার সত্যিই অবাক হয়ে গেল। বললে–আমি সাহায্য করবো?
–হ্যাঁ, আমাদের সংসারের শান্তি, আমাদের বংশের সুনাম, সব কিছু খানিকটা তুমি বাঁচাতে পারো–
এমন অদ্ভুত কথা দীপঙ্কর জীবনে কখনও শোনেনি এর আগে। সামান্য মানুষ সে। অখ্যাত, অবজ্ঞাত একজন ানুষ। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের একটা বাড়িতে পরের আশ্রয়ে মানুষ। তার এত মতা! তার ওপর লক্ষ্মীদির সম্মান, সুনাম সব নির্ভর করছে! অন্তত খানিকটাও নির্ভর করছে। এ কেমন কথা!
সতী বললে–হ্যাঁ, তুমি পারো, আমি শুনেছি তুমি লক্ষ্মীদির কাজ করে দাও—
দীপঙ্করের মনে হলো সে যেন হঠাৎ এক মুহূর্তে বড় সাবালক হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সব সংসারের কাছে এতদিন সে ছোট বলেই প্রতিপন্ন হয়ে এসেছে কেবল। লক্ষ্মীদি এতদিন তাকে যে বিশ্বাস করে সব কথা বলেছে, তা-ও কেবল সে ছোট বলেই। এতদিন ছোট বলেই সবাই তাকে অগ্রাহ্য করে এসেছে। ছোট ছেলে বলেই এতদিন সবাই তাকে অনাদর করেছে, আবার কেউ কেউ ছোট বলে তাকে স্নেহও করেছে। অঘোরদাদুর স্নেহ যে সে পেয়েছিল সে তো ছোট বলেই। বড় হলে সে আর তো তা পাবে না। ছিটে ফোঁটা বিন্তিদির মতন বয়েস হলে তাকেও অঘোরদাদু বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। তখন তাকেও একদিন তার মা’র হাত ধরে আবার নতুন আশ্রয়ের সন্ধান করতে হবে। ছোট হওয়ার অসুবিধেও ছিল, কিন্তু সুবিধেও ছিল সামান্য। কিন্তু আজ মনে হলো বড় হওয়ার আর একটা দিকও আছে–এতদিনের অজানা দিক। মনে হলো–বড় হওয়া যেন বেশ ভালো। যেন বড় হলে বড়রা বড় বিশ্বাস করে, বড় ভালোবাসে,বড় কাছে টানে।
সতী বললে–আমি জানি লক্ষ্মীদি তোমাকে খুব বিশ্বাস করে–করে না?
দীপঙ্কর বললে–করে–
সতী হঠাৎ বললে–তোমার হাত দিয়ে কারোর কাছে যদি কোনও চিঠিপত্র…
–দীপু!!!
হঠাৎ যেন বাজ পড়লো। দীপঙ্কর চমকে উঠেছে। সতীও যেন চমকে উঠলো এক নিমেষে! আর সামনেই লক্ষ্মীদি ঘরে ঢুকলো।
লক্ষ্মীদি চীৎকার করে উঠলো–আবার এসেছিস তুই?
দীপঙ্কর হাঁ করে চেয়ে রইল লক্ষ্মীদির দিকে। এখনি স্নান করে এসেছে লক্ষ্মীদি। ভিজে চুলগুলো পিঠে এলিয়ে পড়েছে। তখনও দু’একটা জলের ফোঁটা আটকে আছে কপালে, মুখে, চোখের পাতায়। লক্ষ্মীদির চেহারা দেখে দীপঙ্কর যেন ভয় পেয়ে গেল। এমন চেহারা তো কখনো দেখেনি লক্ষ্মীদির। এমন কেন হলো?
লক্ষ্মীদি যেন ফেটে পড়লো। বললে–কেন এসছিস এখন, বল্?
দীপঙ্কর জড়োসড়ো হয়ে ভয়ে কুঁকড়ে এল যেন। বললে–কেন লক্ষ্মীদি? আমি কী করেছি?
–আবার কথা বলছিস্? কেন এসেছিস এখানে? কী করতে?
দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না লক্ষ্মীদির কথাগুলো। কী অপরাধ করেছে সে এখানে এসে? কার কী ক্ষতি করেছে?
বললে–আমি কাকাবাবুর কাছে এসেছিলুম লক্ষ্মীদি–
–কাকাবাবুর কাছে, তা এখানে কেন? এ-ঘরে কেন?
–সতীকে পেছন থেকে দেখে আমি ভেবেছিলুম বুঝি তুমি….
–আবার মিথ্যে কথা! যা, বেরিয়ে যা বলছি, বেরিয়ে যা এখান থেকে, বেরো, যেখানে খুশি সেখানে যা, এখানে আসবি নে–
দীপঙ্কর কথাগুলো শুনতে শুনতে স্তম্ভিত হয়ে গেল। লক্ষ্মীদি! শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মীদির মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনতে হলো তাকে? চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইল তার। আর একবার সে লক্ষ্মীদির মুখের দিকে চাইলে, তারপর সতীর মুখের দিকে ও চাইলে একবার। আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিল কে জানে!
দীপঙ্কর আর একবার তবু জিজ্ঞেস করলে–আমি বেরিয়ে যাবো?
লক্ষ্মীদি বললে– হ্যাঁ, হ্যাঁ-কতবার বলবো তোকে!
–আর কখনও আসবো না?
–না–
দীপঙ্কর শেষ পর্যন্ত ঘাড় নিচু করে দরজার দিকে পা বাড়াচ্ছিল, হঠাৎ সতী তার হাতটা ধরে ফেললে। বললে–না, ও যাবে না।
দীপঙ্কর ফিরে দেখলে, সতী লক্ষ্মীদির দিকে চেয়ে বললে–না, ও যাবে না, কেন যেতে বলছো তুমি ওকে?
লক্ষ্মীদি বললে–হ্যাঁ যাবে, ওর হাত ছেড়ে দে তুই–কেন আসে ও এখানে? এত আসার কিসের দরকার?
দীপঙ্করের হয়েই সতী বললে–বেশ করে, ও আসে! ও এসেছে বলে তোমার এত রাগ কেন?
লক্ষ্মীদি আরো রেগে গেল। বললে–আমি আবার বলছি সতী ওর হাত ছেড়ে দে তুই–
সতী বললে–না, ছাড়বো না ওর–
বলে দীপঙ্করকে বললে–দীপঙ্কর, তুমি থাকো তো এখানে, দেখি দিদি কী করে
–ছাড়বি না?
বলে লক্ষ্মীদি এবার সামনে এগিয়ে এসে দীপঙ্করের অন্য হাতটা ধরে টানতে লাগলো। বললে–বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা বলছি–
একদিকে লক্ষ্মীদি টানতে লাগলো, আর একদিকে সতী টানতে লাগলো। দুজনের টানাটানির মধ্যে দীপঙ্কর কেমন অসহায় হয়ে দুজনেরই মুখের দিকে চাইলে। এ কী হলো! এ কী কাণ্ড তাদের দুজনের!
লক্ষ্মীদি বললে–ওকে ছেড়ে দে বলছি সতী–
সতী বলছে–ছাড়বো না, ও যাবে না–
–হ্যাঁ যাবে, ওর ঘাড় যাবে–
বলে লক্ষ্মীদি দুই হাতে দীপঙ্করকে টানতে লাগলো। আর সতীও তার গায়ে যত শক্তি আছে তত জোরে তাকে টেনে ধরে রইল।
দীপঙ্কর শেষে সতীকে বললে–আমি যাই এবার–আমারও কাজ আছে–
সতী বললে–না, তুমি যাবে না, কেন যাবে। যেতে পাবে না! কেন, লক্ষ্মীদি যা খুশি তাই করবে, লক্ষ্মীদির খুশিমত চলতে হবে নাকি আমাদের? লক্ষ্মীদিই সব, আমি কেউ না? আমি যদি তোমার সঙ্গে কথাই বলে থাকি, তাতে লক্ষ্মীদির কেন রাগ হয়? কিসের ভয়? কাকে ভয়?
দীপঙ্কর বললে–তা হোক, আমি এখন যাই, আমার মা হয়তো ভাবছে খুব, আমার কলেজও রয়েছে–
সতী বললে–তাহলে বলো আবার আসবে তুমি?
দীপঙ্কর ভয়ে ভয়ে চাইল লক্ষ্মীদির মুখের দিকে।
লক্ষ্মীদি বললে–না, ও আসবে না! ওর সঙ্গে তোর কিসের দরকার অত শুনি? ওর সঙ্গে তোর কিসের অত ভাব? ওর মুখ থেকে তুই কী কথা আদায় করতে চাস? ও তোর মতো নয়, ও কিছু জানলেও তোকে বলবে না, ওকে মেরে ফেললেও বলবে না ও–ওকে তুই চিনিস না–
হঠাৎ সতীর হাতটা একটু আলগা হতেই দীপঙ্কর ছাড়া পেয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। তখনও দুজনের ঝগড়া চলছে। তারপর ভাবলে একবার কোথায় যাবে! এতক্ষণ যেন সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। খেয়াল ছিল না কে সে, কেন সে এসেছিল এ-বাড়িতে। হঠাৎ মনে পড়লো কাকাবাবুর কথা। কিন্তু বাড়ির এই অবস্থার মধ্যে কাকাবাবুকে কি সে বুঝিয়ে বলতে পারবে! তার চেয়ে পরে বললেই হবে!
নিচে আসতেই কাকীমার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল।
কাকীমা জিজ্ঞেস করলেন–কী রে? কী বললেন?
দীপঙ্কররের যেন তখনও ভালো করে মানসিক ঘোর কাটেনি। কাকীমার মুখের দিকে চেয়ে কিছু বুঝতে পারলে না।
কাকীমা আবার জিজ্ঞেস করলেন–কী রে, অমন করছিস কেন? কাকাবাবুকে বলেছিলি?
–না ৷
–কেন? বলতে লজ্জা হলো?
দীপঙ্কর বললে–না–
–তা এতক্ষণ ওপরে কী করছিলি তবে? লক্ষ্মী বুঝি আবার ঝগড়া করছে সতীর সঙ্গে? সেই শুনছিলি?
দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ, কাকীমা–
বলে দরজা খুলে বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। দীপঙ্করের মনে হলো সমস্ত পৃথিবীটা যেন তার চোখের সামনে ঘুরছে। একবার ভালো করে চোখ চেয়ে দেখলে চারিদিকে। মনে হলো কিছুই যেন সে চিনতে পারছে না। সেই চেনা ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনটাও যেন তার কাছে হঠাৎ বড় অচেনা ঠেকলো। আস্তে আস্তে সে নিজের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো—