রেসের মাঠে অবশ্য চেনা লোককেও চেনা দেওয়ার নিয়ম নেই। এই সত্যটা মিস্টার বোসের সঙ্গে রেসের মাঠে এসে এসে বুঝেছে দীপনাথ। তাই সে শ্রীনাথকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এবং আড়চোখে দেখে, শ্রীনাথও অন্য দিকে চলে যাচ্ছে।
এইভাবেই তারা দুই ভাই দুই দিকে আলাদা হয়ে চলে যেতে পারত এবং দীর্ঘকাল আর তাদের হয়তো দেখা হত না। কিন্তু পরের রেসে টিকিট কাটতে গিয়ে দীপনাথ আর শ্রীনাথ একেবারে আগুপিছু পড়ে গেল। বস্তুত দীপনাথের শাস শ্রীনাথের ঘাড়ে পড়ছে।
তবু কথা বলছিল না দীপ। অন্য দিকে চেয়ে ছিল। টিকিট কেটে বেরিয়ে আসার পর হঠাৎ শ্রীনাথই মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করল, কত নম্বরে ধরলি?
দুই।–খুব লজ্জার সঙ্গে দীপনাথ বলে।
গাধা।–শ্রীনাথের উত্তর।
একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দীপনাথ বলে, বাজে ঘোড়া নাকি?
ঘোড়াই নয়। বললাম তো, গাধা। এসব না বুঝেসুঝে পয়সা নষ্ট করতে আসিস বুঝি?
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, আমি আসি না। বসের সঙ্গে আসতে হয়।
পরেরগুলো অমন আনতাবড়ি খেলিস না। টিপস দিচ্ছি, টুকে নে।
দীপনাথ দ্বিধা করতে থাকে। তার এমন অনেক টাকা নেই যে নষ্ট করবে। টিপস নেওয়াই হয়তো ভাল। শ্রীনাথ এসব হয়তো তার চেয়ে বেশিই বোঝে। সে বলল, টুকতে হবে না। বলল, আমার মনে থাকবে।
শ্রীনাথ সে কথায় কান না দিয়ে একটা বাতিল টিকিটের পিছনে ডটপেন দিয়ে কয়েকটা নম্বর লিখে তার হাতে দেয়। বলে, বিলুদের খবর কী? প্রীতমের নাকি অসুখ! তোর বউদি বলছিল।
খুব অসুখ। হয়তো বাঁচবে না।
কথাটা শুনে শ্রীনাথ একটু কেমন হয়ে যায় যেন। বলে, কী অসুখ? ক্যানসার নাকি?
না। হাড়ের ভিতরে আর নার্ভে ইনফেকশন। ডাক্তার কিছু ধরতে পারছে না।
চিকিৎসার কী হচ্ছে?
যা হওয়ার সবরকম হচ্ছে। আকুপাংচারও।
পরের রেসটা শুরু এবং শেষ হল। তুমুল হট্টগোলেও দুই ভাই তেমন উত্তেজিত হল না। কিন্তু বোর্ডে নম্বর উঠলে দু’জনেই পুতুলের মতো টিকিটের নম্বর মিলিয়ে নিল। দীপ জেতেনি। কিন্তু শ্রীনাথের মুখে সামান্য হাসির ফুসকুড়ি গলে যাওয়ায় দীপ বুঝল, মেজদা জিতেছে। সে বলল, প্রীতমকে কোথাও একটু চেঞ্জে নিয়ে যাওয়া দরকার। কাছেপিঠে হলেই ভাল হয়।
এতক্ষণ আড়চোখে দীপনাথের হাতের সুটকেসটা বারবার দেখছিল শ্রীনাথ। হঠাৎ বলল, কোথাও যাচ্ছিস নাকি? হাতে সুটকেস কেন?
না, এটা সারানো হল।
শ্রীনাথকে একটু অন্যমনস্ক লাগছিল দীপনাথের। কোনও দিকেই যেন ঠিক মন নেই অথবা বহু দিকেই মন দিতে হচ্ছে। কথা বলতে বলতে ভিড়ের মধ্যে কার দিকে চেয়ে যেন একটু চোখের ইশারাও দিল।
দীপনাথের মনে হয়, শ্রীনাথের কোথাও একটা গূঢ় পরিবর্তন ঘটেছে। চালচলতির মধ্যেই একটা উড়ুউড় ভাব।
শ্রীনাথ আনমনে কী একটু ভেবে হঠাৎ বলল, ওদের টাকা-পয়সা কীরকম?
সেটা এখনও কোনও দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। অফিস থেকে প্রীতম বেশ কিছু টাকা পেয়েছে।
শ্রীনাথ ভ্রু কুঁচকে বলল, গত বছরই তো ভাইফোঁটা নিয়ে এলাম। বিলু সেবার মস্ত মস্ত গলদা চিংড়ি আনিয়েছিল, চল্লিশ না পঞ্চাশ টাকা কেজি। তখনও খারাপ কিছু দেখিনি প্রীতমের।
গত বছর! ভুল বলছ। গত বছর নয়, তার আগের বার।
তাই নাকি? হতে পারে। বিলুর সদ্য একটা মেয়ে হয়েছিল তখন। সেটা তখনও খুব ছোট। আর কিছু হয়েছে তার পরে?
না। তুমি বহুকাল যাও না বিলুর বাসায়।
এবার একদিন যাব।
দীপ একটু রাগ করে বলল, রেসের মাঠ পর্যন্ত আসতে পারলে। বিলুর বাসা আর কত দূর! এখান থেকে ভবানীপুর তো হেঁটেই যাওয়া যায়।
শ্রীনাথ একটু হাসল। একসময়ে সে সুপুরুষ ছিল। বয়েসকালে আবার চেহারাটা জেল্লা দিচ্ছে। তবে বড়ই নরম পৌরুষহীন চেহারা। কিন্তু হাসলে চেহারার জেল্লা ভেদ করে একটা বিষণ্ণতা যেন ফুটে বেরোতে চায়। বলল, এই পথটুকু পার হওয়া যে কত শক্ত!
পুতুলের মতোই নিজেদের অজান্তে পরের রেসটার জন্য টিকিট কাটতে কাউন্টারে এসে দুই ভাই দাঁড়ায়। দীপনাথ বলে, ওটা কোনও কাজের কথা নয়। একটা লোক মরতে চলেছে, তাকে এই বেলা একবার শেষ দেখাও তো দেখে আসতে হয় মেজদা। নইলে কথা থাকবে।
যেতেই হবে!–দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রীনাথ বলে।
দীপনাথ শ্রীনাথকে নিশ্চিন্ত করার জন্য খুব সাবধানে বলল, ওদের টাকা-পয়সার বা অন্য কোনওরকম হেলপ দরকার নেই। জাস্ট মাঝে মাঝে গিয়ে একটু মনোবল বাড়িয়ে আসা আর কী! প্রীতমটা বেঁচে থাকার জন্য কত যে আকুলি-বিকুলি করে।
শ্রীনাথ আবার একটু হাসে। বলে, টাকাপয়সার দরকার হলে দিতে ভয় পাব নাকি?
আমি সেভাবে বলিনি।
দূর বোকা! আমিও সেভাবে বলছি না। আসলে আমার যেটুকু আছে তা নিতান্তই আমার। সে অবশ্য সামান্যই। দাদার টাকা তো আর আমার নয়। তোর বউদির। আমারটুকু আমি দিতে পারি।
এই একটা রহস্য থেকে গেল চিরকাল। কেন যে বড়দা মল্লিনাথ তার যাবতীয় বিষয়-আশয় ভাইয়ের বউকে লিখে দিয়ে গেল তা কে বলবে! দীপনাথের কোনও লোভ নেই বটে, কিন্তু ব্যাপারটা মনে পড়লে তার খুব ধাঁধা লাগে। কিছু কুকথাও শুনেছে সে মল্লিনাথ আর বউদিকে নিয়ে। কথাগুলো সুখশ্রাব্য নয়। গায়ে জ্বালা ধরে যায়।
দীপনাথ বলল, বলছি তো, ওদের টান্সার দরকারটা আদপেই প্রধান নয়। ওদের যেটা নেই সেটা হল আপনজন।
কথাটা শ্রীনাথের বোধহয় মনোমত হল। ওপর নীচে বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলল, ওইটেই তো সবচেয়ে বড় সমস্যা। আপনজন পাওয়াই সবচেয়ে কঠিন। জন থাকলেও তারা আপন হতে চায় না। তুই নম্বর দেখে টিকিট কাট।
তাই কাটে দীপনাথ।
বাইরে এসে শ্রীনাথ জিজ্ঞেস করে, এখন কী করছিস?
একটা গুজরাটি কোম্পানির ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের সেক্রেটারি।
কত দিচ্ছে-থুচ্ছে?
দেয় একরকম। চলে যায়।
ওটা কোনও কাজের কথা নয়। পে স্কেল আছে তো?
না। চাকরিতে সদ্য ঢুকেছি, ওসব এখনও ঠিক হয়নি।
বিয়ে করে বসিসনি তো?
না।
করিস না। ও ঝামেলায় না যাওয়াই ভাল।’
শ্রীনাথের মুখে এ কথা শুনবে বলে আশা করেনি দীপনাথ। বউদির সঙ্গে কি তা হলে ওর বনিবনা হচ্ছে না!
শ্রীনাথ নিজেই রহস্য পরিষ্কার করে দিয়ে বলল, চারদিকে এত থিকথিকে মানুষজন দেখে আমার বিয়ের ওপর বিতৃষ্ণা এসে গেছে। আর লোক বাড়িয়ে লাভ কী? তা ছাড়া আজকালকার মেয়েরা যত্নআত্তিও জানে না। ঘাড়ে চেপে বসে বসে খায় আর রক্ত শোষে।
কথাগুলো নীরবে শুনল দীপ। মনে মনে হাসল। দীপনাথের ভালমন্দ ভেবে এত কথা বলেনি মেজদা। ও নিজের কথা ভেবে বলছে। দুনিয়ার সব মানুষই আজকাল নিজের নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে আর পাঁচটা লোকের ভালমন্দ বিচার করে।
শ্রীনাথ আর দীপনাথ দু’জনেই এই রেসটায় মার খেল। শ্রীনাথের টিপস মেলেনি। তবে দীপ অন্যমনস্কতার মধ্যেও চমকে উঠে দেখল, এই রেসে বাজি মেরেছে দু’নম্বর ঘোড়া। তারও আজ আগাগোড়া দু’নম্বরে বাজি ধরারই সংকল্প ছিল। ধরলে ঠকতে হত না।
শ্রীনাথ নিজের টিকিটটা দুমড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, তোর মেসের ঠিকানাটা দিয়ে রাখিস তো। একবার দিয়েছিলি, সেটা বোধ হয় হারিয়ে গেছে।
দীপ বলে, হারিয়ে ভালই হয়েছে। সেই বোর্ডিং-এ আমি আর থাকি না। এখনকার ঠিকানা আলাদা। অনেকদিন আমার কোনও খোঁজ রাখো না মেজদা!
তুই নিজেই কি রাখিস!
রতনপুরে সবাই ভাল আছে?
আছে ভালই। সবজি, ডিম, মাছ সব বাড়িতে বা জমিতে হচ্ছে। খাঁটি সব জিনিস পাচ্ছে, ভাল থাকার কী?
সজল কত বড় হল?
এঁচড়ে পাকা।
অনেকদিন আগে ওকে চিড়িয়াখানা দেখাব বলে কথা দিয়েছিলাম। সেটা আর হয়নি।
চিড়িয়াখানা বহুবার দেখেছে। চিন্তা নেই। তা ছাড়া নিজেদের বাড়িতেই তো চিড়িয়াখানা। কত পাগল, ছাগল, সাধু, বদমাশের আনাগোনা।
শ্রীনাথের কথার ভিতর একটা ভয়ংকর বিদ্বেষ আর ঘৃণা ফুটে বেরোচ্ছে। ঠিক অনুধাবন করতে পারছে না দীপনাথ। তবে আঁচটা গায়ে লাগছে। শ্রীনাথ কখনও বোধহয় কাউকে সুখী করেনি, সুখী সে নিজেও হয়নি।
পরের রেসগুলিতে একের পর এক দু’নম্বর ঘোডা বাজিমাত করে গেল। শ্রীনাথের একটা টিপসও মিলল না। সেজন্য শ্রীনাথকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। স্বধর্মে মরাও যে ভাল এই আপ্তবাক্যটা যে মনে রাখেনি দীপ! নিজের সংকল্পে অচল থাকলে সে আজ বহু টাকা জিততে পারত।
শ্রীনাথ দাঁড়াল না। রেস শেষ হতেই বলল, চলি রে।
ভিড়ের ভিতর দুর থেকে মেজদাকে লক্ষ করছিল দীপনাথ। তার কেন যেন মনে হচ্ছিল, রেসের মাঠে মেজদা একা আসেনি। দীপনাথের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে ভিড়ের মধ্যে কাকে যেন চোখের ইশারা দিচ্ছিল।
দীপনাথের অনুমান মিথ্যে নয়। শ্রীনাথ পেমেন্ট কাউন্টারের কাছ বরাবর পৌঁছলে একটা কালো মতো বদমাশ চেহারার লোক আর ফর্সা মতো একটা মেয়ে তার সঙ্গ নিল।
গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড থেকে বোস নেমে আসে। সঙ্গে তার সমপর্যায়ের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এবং তাদের দু’জনের দু’রকম সুন্দরী দুটি স্ত্রী। সবাই খুব হাসছে। প্রায় সবাইকেই চেনে দীপ।
ক্লাইন ওয়ালকটের পি আর ও দত্ত দীপকে দেখে বলে উঠল, হ্যাল্লো! হাউ ইজ লাইফ?
দত্তর মুখটা রক্তাভ। আলগা একটা চকচকে ভাব তার চোখে। অঢেল বিয়ারের প্রভাব। দীপ মৃদু হেসে বলল, টেরিফিক।
তার হাতের সুটকেসটা সবাই দেখছে, তবে ভদ্রতাবশে কেউ জিজ্ঞেস করছে না কিছু। সবাই ফটকের দিকে হাঁটছে। দীপ বুঝতে পারছে না উইনিং টিকিটের পেমেন্টগুলো কে নেবে! সে জানে, বোস নিজে পেমেন্ট নিতে ভালবাসে। আজও নিজেই নেবে কি? সুটকেস নিয়ে দলের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে এই ছোট সমস্যাটা আবার ভাবিয়ে তুলল তাকে। কোনও ব্যাপারেই সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলে দ্বিধাগ্রস্ত ও সমস্যাপীড়িত মন নিয়ে সে মহিলা দু’জনের সৌন্দর্যও ভাল করে উপভোগ করতে পারছে না।
ফটকের কাছাকাছি এসে অবশ্য বোস তাকে সমস্যা থেকে মুক্তি দিয়ে বলল, দীপবাবু, আপনি বরং পেমেন্টটা নিয়ে আসুন। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি।
সুটকেস দুলিয়ে দীপ দৌড়ল। বোস প্রায় হাজার দুয়েক টাকা জিতেছে। টাকায় টাকা আনে। বেশি টাকা না খেললে এ টাকাটা উসুল করতে পারত না বোস। দীপ নিজে একটির বেশি দুটি টিকিট কাটার সাহস পায়নি। সামনের লাইনে দু-চারজনের মুখে খুব ফ্যাকফেকে হাসি। একজন চেঁচিয়ে বলছে, আজ ছিল দুইয়ের দিন।
দীপ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মেজদার সঙ্গে দেখা না হলে সে আজ দুই নম্বর ঘোড়াগুলোর ওপর খেলত। কিছু অন্তত জিতেও যেত। কিন্তু এই অনিশ্চয়তার নামই তো ঘোড়দৌড়।
পেমেন্ট নিয়ে দীপ বাইরে এসে দেখে, বোসের গাড়িতে বসার জায়গা নেই। বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রীরা জায়গা জুড়ে বসে আছে। বোস দীপকে বলল, সুটকেসটা লাগেজবুকে দিয়ে দিন।
টাকাটা?–দীপ জানালায় ঝুঁকে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে।
আপনার কাছে থাক। একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে চলে আসুন।
গাড়ি ছেড়ে দেয়।
দীপ তার প্যান্টের গুপ্ত পকেটে টাকার বান্ডিলটা অনুভব করতে করতে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে বসের কোনও সন্দেহ নেই, তা সে জানে। কিন্তু ভয় কলকাতার চাল পকেটমারদের। টাকাটা মার গেলে শশাধ করার সাধ্য তার নেই।
রেসের মাঠ থেকে শেয়ারের ট্যাক্সি ছাড়া গতি নেই।
রেসে হারা চারজন গোমড়ামুখো লোকের সঙ্গে একটা ট্যাক্সিতে জায়গা পেল দীপ। সামনের সিটে ড্রাইভার আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং আর-একজন যাত্রীর মাঝখানে খুবই ঠাসাঠাসি করে বসতে হয়েছে তাকে। শীতকাল বলে অতটা কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু ভারী আড়ষ্ট লাগছে। পিছনে হেরে রেসুড়েরা বলছে, কে জানত লাইটনিং জিতবে? পুরো গট আপ কেস।… আমি নিজে দেখেছি টপ স্কোরারকে বাঁকের মুখে ইচ্ছে করে জকি টেনে রাখছিল।… মন্দাকিনী বোধ হয় জীবনে এই প্রথম জিতল।… স্টেটসম্যান ওটাকে ফ্লকে রেখেছিল….
দীপ অত্যন্ত সজাগ হয়ে বসে আছে। তার সমস্ত মনপ্রাণ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে গুপ্ত পকেটের দু’হাজার টাকার ওপর। হাত দিয়ে ছুঁয়ে টাকাটা আছে কি না দেখতে ইচ্ছে করছিল তার। কিন্তু সেটা ভারী বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। লোকে জেনে যাবে, টাকা আছে।
তারাতলায় নেমে আর বাস-টাস ধরল না দীপ। সোজা হাঁটা দিল। নিউ আলিপুরের ও ব্লক অনেকটা দূর। তবু হাঁটাই ভাল।
শীতের অন্ধকার দেখতে না দেখতে নেমে আসে। দীপের ঘেমো শরীরে উত্তরের হাওয়া লেগে শিরশির করতে থাকে। তবু একটু রোমাঞ্চও আছে কোথাও। মনের গভীরে কি সত্যিকারের পাপ আছে তার? তবে কেন বোস সাহেবের ফ্ল্যাটে যেতে তার একরকম তীব্র সুখের অনুভূতি হচ্ছে? এখনও সেই কাটা চেকটা তার বুক পকেটে। স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জির নামটা সে একটুও ভুলে যায়নি।
বোসের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দীপ দেখল, বোস এখনও আসেনি। সাদা উর্দিপরা একজন বেয়ারা দরজা খুলে দিয়ে ড্রয়িং কাম ডাইনিংয়ের মাঝখানে প্ল্যাস্টিকের ফুলছাপ পরদাটা টেনে দিল। ড্রয়িংরুমের ফাঁকা নির্জনতায় বসে দীপ টের পাচ্ছিল ডাইনিং হলে আজ কোনও ভোজর আয়োজন হচ্ছে। অন্তত দু-তিনজন বেয়ারা নিচু স্বরে কথা বলতে বলতে টেবিল সাজাচ্ছে। প্লেট আর চামচের শব্দ হচ্ছে টুং টাং।
বড়লোকদের ড্রয়িংরুম যেরকম হয় বোসেরটাও তাই। ভাল সোফাসেট, পেতলের ছাইদানি, মেঝেয় কার্পেট, কাচের স্ল্যাব বসানো সেন্টার টেবিল, ঘোমটা দেওয়া স্ট্যান্ডের আলো, টি ভি সেট এবং অপরিহার্য বুক-কেস।
মিসেস বোস বা মণিদীপার কোনও সাড়াশব্দই পেল না দীপ। ভদ্রমহিলা আদৌ বাড়িতে আছেন কি না তাও বুঝতে পারছে না। এ বাড়িতে তার যাতায়াত বেশ কিছু দিনের। কিন্তু এখনও সে ড্রয়িংরুমের সীমানা পার হতে পারেনি।
খবর না দিলে মণিদীপা হয়তো খবর পাবেন না ভেবে দীপ উঠে গিয়ে পরদা সরিয়ে একজন বেয়ারাকে বলল, মেমসাহেব বাড়িতে নেই?
আছেন। ড্রেস করছেন।
তাঁকে একটু সেলাম দেবে? বলো, দীপনাথবাবু এসেছেন।
বেয়ারা তেমন গা করল না যেন। তবে মাথা নাড়ল।
দীপ আবার এসে সোফায় বসে এবং একটি ইংরেজি ফ্যাশনের পত্রিকা তুলে নিয়ে ছবি দেখতে থাকে।
মণিদীপা নিঃশব্দে এলেন না। এলেন চাকরবাকর বা বেয়ারাদের কাউকে অনুচ্চস্বরে বকতে বকতে। কারও কোনও দোষ হয়ে থাকবে।
ড্রয়িংরুমের পরদা সরিয়ে ভিতরে এসে চুপ করে দাঁড়ালেন মণিদীপা। ‘কী খবর’ বা ‘এই যে, কখন এলেন’ গোছের কোনও প্রশ্ন করলেন না। দাঁড়িয়ে খুব খরচোখে দীপকে দেখছিলেন। পরনে একটা কাপতান। জাপানি কিমোনো ধরনের ভারী ঝলমলে পোশাক। মুখে রূপটান মাখা শেষ হয়েছে। মস্ত মৌচাকের মতো করে বাঁধা খোঁপা। দীপের যতদূর মনে পড়ে, ওঁর মাথার চুল বব করা। তবু খোঁপাটা কী করে সম্ভব হল তা ভেবে পায় না সে। মণিদীপার গা থেকে ভারী মোহময় একটা সুবাসও আসছিল। সম্ভবত ফরাসি সেন্ট।
দীপ মুখ তুলে বলল, সকালে সেই চেকটা দেওয়ার কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
মণিদীপা একটু যেন বিরক্ত হয়ে বললেন, এটা নিয়ে আপনি অত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? খুব ইমপর্ট্যান্ট কিছু নয়।
দীপ বুকপকেটে চেকটা খুঁজতে খুঁজতে বলে, আপনার কাছে না হলেও আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। আপনিও চেয়েছিলেন।
বুকপকেট থেকে রেসের বাতিল টিকিট, ঠিকানা লেখা কাগজ এবং ভাউচার ইত্যাদি একগাদা কাগজ বেরোল বটে, কিন্তু চেকটা নেই। নেই তো নেই-ই। পোশাকে যে ক’টা পকেট ছিল সবই হাঁটকে ফেলল দীপ। মুখ লাল হয়ে উঠছে তার, কান মাথা ঝা ঝা করছে। চেকটা তার সঙ্গে হঠকারিতাই করে বসেছে শেষ পর্যন্ত।
মিসেস বোস নিঃশব্দে ব্যাপারটা লক্ষ করছিলেন। মুখে মৃদু জ্বালাভরা হাসি। দীপের খোঁজা এবং পাওয়ার পালা শেষ হলে বললেন, খামোখা ব্যস্ত হচ্ছেন। আমিই তো বলছি চেকটার কোনও দাম নেই।
দীপ নিভে গিয়ে বলে, আমি কিন্তু পকেটেই রেখেছিলাম। রেসের মাঠে হয়তো–
আপনি নিশ্চিন্তে বসুন। ওটা কেউ পেয়ে থাকলেও ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমাকে ব্ল্যাকমেল করা অত সহজ নয়।
দীপ শিউরে ওঠে। আজ সকালে সেও ব্ল্যাকমেলের কথাই ভেবেছিল না কি? সে তাড়াতাড়ি বলল, না, ব্ল্যাকমেলের কথা নয়।
তবে আর কিসের ভয়? চেকটা এমনভাবে কাটা হয়েছে যে ওটা আর ক্যাশ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ব্যাংকে আমার অত টাকাও নেই। স্নিগ্ধ বেচারা খামোখা ব্যাংকে গিয়ে হয়রান হয়েছিল।
দীপ চুপ করে বসে থাকে। ভারী লজ্জা করছে চেকটা হারিয়ে ফেলায়। উনি হয়তো ভাবছেন, চেকটা সে-ই রেখে দিয়েছে। প্রয়োজনমতো কাজে লাগাবে।
মণিদীপা অতিরিক্ত স্নেহের সঙ্গে বললেন, মিস্টার বোস বোধ হয় রেসের পর কোথাও বসে বিয়ার-টিয়ার খাচ্ছেন। আপনাকে বসতে হবে। একটু চা বলে দিই?
চা!–বলে দীপ একটু ভাবে, তারপর মাথা নেড়ে বলে, দরকার নেই। আমি বরং উঠে পড়ি। উইনিং টিকিটের টাকাটা যদি আপনি রেখে দেন—
বলতে বলতে দীপ উঠে প্যান্টের গুপ্ত পকেটের দিকে হাত বাড়ায় এবং ভাবে, হায় ভগবান! চেকটার মতো টাকাগুলোও যদি এতক্ষণে ম্যাজিকের মতো গায়েব হয়ে গিয়ে থাকে।
মণিদীপা মাথা নেড়ে বললেন, আমাকে বোস সাহেব অত বিশ্বাস করেন না দীপনাথবাবু। আমি বিশ্বস্তও নই। টাকাটা আমার হাতে এলে আমি নিশ্চয়ই খরচ করে ফেলব। তখন আপনি খুব মুশকিলে পড়বেন। বরং একটু বসুন, মিস্টার বোস এসে যাবেন।
দীপ সুতরাং বসে পড়ে। বলে, টাকাটা যে আপনার হাতে দেওয়া যাবে না এমন কথা কিন্তু মিস্টার বোস আমাকে বলেননি।
মণিদীপা হেসে বলেন, ও কখনও বলবে না। কিন্তু এইসব ছোটখাটো ঘটনার ভিতর দিয়ে আপনার বুদ্ধিকে ও পরীক্ষা করবে। নাড়ুগোপালের মতো চেহারা দেখে ওকে বোকা ভাববেন না। ও শেয়ালের মতো চালাক। পরীক্ষায় আপনি পাশ করলেই যে ও আপনাকে কোনও চান্স দেবে তাও ভাববেন না। মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করাটা ওর হবি। আমাকেও অনবরত পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।
বলে মণিদীপা ইংগিতপূর্ণভাবে চুপ করে থাকেন।
দীপ বোঝে, এটাও একটা পরীক্ষা। মণিদীপা দেখছেন, সে ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে কোনও আগ্রহ প্রকাশ করে কি না। সে ইদানীং চালাক হয়েছে, তাই ওসব কথার ধার দিয়েই গেল না। বলল, টাকাগুলো যতক্ষণ সঙ্গে থাকবে ততক্ষণই অস্বস্তি।
টাকার কিছু হ্যাজার্ডস তো আছেই।–বলে মণিদীপা একটু হাসলেন। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবাব পাশের কৌচে বসে বললেন, কত টাকা জিতেছে ও?
প্রায় দু’হাজার।
মণিদীপা ভ্রু কুঁচকে একটু ভেবে বললেন, টাকা আয় করা কারও কারও কাছে কত সোজা!
তা ঠিক। মণিদীপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আপনিও রেস খেললেন নাকি?
আমার ভাগ্যটা একদম কানা। চল্লিশ টাকার মতো হেরে গেছি।
কোনও দিন জিতেছেন?
না।
তা হলে আপনাকে ভাগ্যবানই বলতে হয়।
কেন?
জিতলে রেসের মাঠের নেশা আপনাকে ভূতের মতো পেয়ে বসত। আমিও প্রথম প্রথম ওর সঙ্গে খুব যেতাম। কিন্তু প্রত্যেকবার হেরে হেরে বিরক্তি ধরে যাওয়ায় আর যাই না। কিন্তু টের পেতাম যারা এক-আধবার জেতে তারা আর নেশাটা কিছুতেই ছাড়তে পারে না।
দীপ একটু হেসে বলল, আমার প্রবলেমটা তা নয়। আমি যে-কোনও নেশাই ছাড়তে পারি।
মণিদীপা মাথা নেড়ে বলেন, ইউ আর নট একসেপশন।
দীপ হঠাৎ টের পায় তার নামের সঙ্গে মণিদীপার নামের একটা আশ্চর্য মিল আছে। সে দীপনাথ, আর মিসেস বোস মণিদীপা। এতক্ষণে এ মিলটা তার মনে পড়েনি তো! আশ্চর্য!
দীপ বলল, আসলে আমি কোনও কিছুতেই তেমন ইন্টারেস্ট পাই না। আমার আগ্রহ শুধু কোনওক্রমে বেঁচে থাকার।
মণিদীপা উদাসভাবে বললেন, আমারও কি তাই নয়? সকলেরই তাই। তবু মানুষের ইন্টারেস্টেরও তো শেষ নেই। রেসের মাঠে আমি আমার স্কুলের একজন পুরোনো মাস্টারমশাইকে দেখতে পেয়েছিলাম, যাকে সবাই সাধুসন্ত বলে মনে করত।
মণিদীপা চায়ের কথা বলেননি, কিন্তু তবু চা এল। ট্রে ভরতি চায়ের পট, দুধের পাত্র, চিনির বোল, একটা মস্ত প্লেটে নিউ মার্কেটের ভাল কেকের একটা বড় টুকরো, দুটো বড় সন্দেশ আর একটা কাটলেট গোছের জিনিস। এ বাড়িতে দীপ কদাচিৎ আপ্যায়িত হয়েছে। এতটা তো কোনওদিনই নয়। সে বলল, এত?
আমার বাপের বাড়িতে লোক এলে চা আর খাবার দেওয়ার নিয়ম। গরিবদের বাড়িতেই ওসব নিয়ম থাকে। বড়লোকরা খুব কাঠ-কাঠ ডিসিপ্লিনে চলে, তাই অতিথি আপ্যায়ন না করলেও বলার কিছু নেই। তবে মাঝে মাঝে গার্টি দিতে হয়। আজ যেমন।
দীপ চুপ করে রইল। চুপ করে থাকার চেয়ে বড় কূটনীতি তার জানা নেই। অল্পস্বল্প খাচ্ছিলও সে। তবে খুব সংকোচের সঙ্গে।
মণিদীপা হঠাৎ খুব হেসে উঠে বললেন, সত্যিই আপনার কোনও ব্যাপারে ইন্টারেস্ট নেই দেখছি!
দীপ কৌতূহলে মুখ তুলে বলে, কেন?
একবারও তো জিজ্ঞেস করলেন না স্নিগ্ধদেব লোকটা কে!
দীপ গম্ভীর হয়ে বলে, আমার জানার দরকার তো নেই।
দরকার নেই, সে তো ঠিকই। কিন্তু কৌতূহলও কি হয় না?
দীপ কেকটার তেমন স্বাদ পাচ্ছিল না, ভালই হওয়ার কথা। বলল, কেউ একজন হবেন। হয়তো আপনার ভাই-টাই।
কী বুদ্ধি! আমি বোসের বউ হলে আমার ভাই চ্যাটার্জি হয় কী করে?
অসবর্ণ তো হতে পারে!
মোটেই না। আমার বাপের বাড়ি মিত্র।
ও। তা হলে বন্ধু?
মণিদীপা মস্ত এক শ্বাস ছেড়ে বললেন, শুনলে হাসবেন। স্নিগ্ধদেবের বয়স চল্লিশের ওপর। রং কালো, চেহারা রোগা এবং দেখতে মোটেই ভাল নয়। মাথার চুল পাতলা হয়ে টাক পড়ে এল প্রায়। তার স্ত্রী এবং দুই ছেলেমেয়ে আছে। স্কুলমাস্টার এবং বেশ গরিব।
গরিবকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন?
না। টাকাটা ওকে দিচ্ছিলাম, ও পার্টি-ফান্ডে জমা দেবে বলে।
রাজনীতির লোক নাকি?
ভীষণ। এবং এত গাটসওয়ালা লোক এ দেশে দুটো নেই। আপনি যদি ওর সঙ্গে দশ মিনিট কথা বলেন তা হলেই আপনার লাইফ-ফিলজফি পালটে যাবে।
দীপ খুব চালাকের মতো বলে, তা হলে দেখা না করাই ভাল।
আসলে দীপ ব্যক্তিপূজা ভালবাসে না। এলেমদার যে-কোনও লোককে বিগ্রহের আসনে বসাতে সে রাজি নয়।
মণিদীপা বললেন, আপনি ওকে চেনেন না।
দীপ লক্ষ করে মণিদীপার চোখে হঠাৎ স্বপ্নের সুদূর ফুটে উঠল।