রিকশা এসে থেমেছে নিরিবিলির সামনে। রিকশায় বসে আছে পাকুন্দিয়ার এমদাদ খোন্দকার। সঙ্গে তার নাতনী পুতুল। এমদাদ খোন্দকারের বয়স ষাটের উপরে। অতি ধুরন্ধর ব্যক্তি। মামলা মকদ্দমায় মিথ্যা সাক্ষী দেয়া তাঁর আজীবন পেশা। গ্রামের জমি জমা সংক্রান্ত মামলায় তিনি দুই পক্ষেই শলা পরামর্শ দেন। নিয়ম থাকলে দুপক্ষের হয়ে সাক্ষীও দিতেন, নিয়ম নেই বলে দিতে পারেন না। জাল দলিল তৈরির ব্যাপারেও তার প্রবাদ তুল্য খ্যাতি আছে।
পুতুলের বয়স পনেরো। এবার মেট্রিক পাস করেছে। ফাস্ট ডিভিশন এবং দুটো লেটার। রেজাল্ট বের হবার পর এমদাদ খোন্দকার খুব আফসোস করেছে–নাতনী যদি নকল করতে রাজি হত তাহলে ফাটাফাটি ব্যাপার হত, নকল ছাড়াই এই অবস্থা।
পুতুলকে নিয়ে এমদাদ খোন্দকার নিরিবিলিতে কেন এসেছে তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। পুতুলও কিছু জানে না। তাকে বলা হয়েছে ঢাকায় কয়েক দিনের জন্যে বেড়াতে যাচ্ছে, উঠবে সোবাহান সাহেবের বাড়ি। সোবাহান সাহেব তাদের কোন আত্মীয় না হলেও অপরিচিত নন। পাকুন্দিয়া গ্রামের কলেজটি তিনি নিজের টাকায় নিজের জমিতে করে দিয়েছেন। মেয়েদের একটি স্কুল দিয়েছে, মসজিদ বানিয়েছেন। সোবাহান সাহেব তাঁর যৌবনের রোজগারের একটি বড় অংশ এই গ্রামে ঢেলে দিয়েছেন, কাজেই গ্রামের মানুষদের কাছে তিনি অপরিচিত নন। পুতুল তাকে চেনে। তাঁর স্কুল থেকেই সে মেট্রিক পাস করেছে।
রিকশা থেকে নামতে নামতে পুতুল বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, কী বড় বাড়ি দেখছ দাদাজান?
এমদাদ মুখ বিকৃত করে বলল, পয়সার মা-বাপ নাই বাড়ি বড় হইব নাতো কি। চোরা পয়সা।
পুতুল দুঃখিত গলায় বলল, চোরা-পয়সা? কি যে তুমি কও দাদাজান। এমন একটা বালা মানুষ। কত টেকা পয়সা দিছে গোরামে…
টেকা পয়সা দিলেই মানুষ বালা হয়? এদের শইল্যে আছে বদ রক্ত। এরারে আমি চিনি না? হাড়ে গোশতে চিনি।
পুতুল কিছু বলল না। তার দাদাজানের চরিত্র সে জানে, মানুষের ভাল দিক তার চোখে পড়ে না। হয়ত কোনদিন পড়বেও না।
পুতুল।
জ্বি দাদাজান।
এমদাদ গলা নিচু করে বলল, সোবাহান সাহেবের দাদার বাপ ছিল বিখ্যাত চোর। এরা হইল চোর বংশ।
চুপ করতো দাদাজান।
আইচ্ছা চুপ করলাম।
এমদাদ নাতনীকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। সোবাহান সাহেব বারান্দায় বসে ছিলেন। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, চিনতে পারলাম নাতো। এমদাদ বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, আমি এমদাদ। পাকুন্দিয়ার এমদাদ খোন্দকার।
ও আচ্ছা আচ্ছা–আমি অবশ্যি এখনো চিনতে পারিনি।
চিনবার কথাও না–আমি হইলাম। জুতার ময়লা। আর আপনে হইলেন বটবৃক্ষ।
বটবৃক্ষ।
জ্বি বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষে কি হয়— রাজ্যের পাখি আশ্রয় নেয়। আপনে হইলেন। আমাদের আশ্রয়। বিপদে পড়ে আসছি। জনাব।
কি বিপদ?
বলব। সব বলব। আপনেরে বলবনাতো বলব কারে? পুতুল ইনারে সেলাম কর। ইনারা মহাপুরুষ মানুষ। দেখলেই পুণ্য হয়।
পুতুল এগিয়ে এল। সোবাহান সাহেব পুতুলের মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বললেন, যাও ভিতরে যাও। হত মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া কর। তারপর শুনব কি সমস্যা।
এমদাদ বলল, ভাইসােব আমারে একটু নামাযের জায়গা দিতে হয়। দুই ওক্ত নামায কাজ হয়েছে। নামায কাজ হইলে ভাইসােব আমার মাথা ঠিক থাকে না।
অজুর পানি লাগবে?
অজু লাগবে না, অজু আছে। আমার সব ভাঙ্গে অজু ভাঙ্গে না। হা হা হা।
সোবাহান সাহেব ভেতরে চলে গেলেন। আর তখন ঘরে ঢুকল ফরিদ। এমদাদ বলল, ভাইজান পশ্চিম কোন দিকে?
ফরিদ বিরক্ত গলায় বলল, পশ্চিম কোন দিকে আমি কি জানি? আমি কি কম্পাস না কি?
বাবাজীর পরিচয়?
বাবাজী ডাকবেন না।
রাগ করেন কেন ভাই সাহেব।
আপনি কে?
আমার নাম এমদাদ। এমদাদ খোন্দকার।
ও আচ্ছা।
ভাইসব ভাল আছেন?
ফরিদ বিরক্ত দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল। এমদাদ ধাঁধায় পড়ে গেল। এই মানুষটির চরিত্র সে ঠিক বুঝতে পারছে না। মানুষের চরিত্র পুরোপরি বুঝতে না পাড়া পর্যন্ত তার বড় অশান্তি লাগে।