দশম পরিচ্ছেদঃ মহর্রম উৎসব
১৭ই আষাঢ় মহর্রম উৎসব। সেকালের মহররম উৎসব এক বিরাট ব্যাপার, সমারোহকাণ্ড এবং চিত্ত-উন্মাদক বিষয় ছিল। মহর্রমের সে অসাধারণ আড়ম্বর, সে জাঁক-জমক, সে ক্রীড়া-কৌশল, সে লাঠি ও তলোয়ার খেলা, সে বাদ্যোদ্যম এবং যাবতীয় নর-নারীর মাতোয়ারা ভাবের উচ্ছ্বাস, সে বিরাট মিছিল, সে মর্সিয়া পাঠ, সে শোক প্রকাশ, সে দান খয়রাৎ, মহর্রমের দশদিন ব্যাপী সে সাত্ত্বিক ভাব, বর্তমানে কল্পনা ও অনুমানের বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সেকালের হিন্দু-মুসলমান, ধনী-দরিদ্র, আলেম-জাহেল, সকলেই মহর্রম উৎসবে যোগদান করিতেন। তখন বাঙ্গালা দেশে অদূরদর্শী কাটমোল্লার আবির্ভাব ছিল না; সুতরাং মহর্রম উৎসব তখন বেদাত বলিয়া অভিহিত হইত না। মহর্রমের দশ দিবস কেবল মুসলমান নহে, হিন্দুরা পর্যন্ত পরম পবিত্রভাবে যাপন করিতেন। মহর্রমের দশ দিবস চোর চুরি করিত না, ডাকাত ডাকাতি করিত না, লম্পট লাম্পট্য ত্যাগ করিত। ধনী ধনভাণ্ডার মুক্ত করিয়া গরীবের দুঃখ বিমোচন করিত। ক্ষুধার্ত অন্ন পাইত, তৃষ্ণার্ত সুমিষ্ট সরবৎ পাইত, বস্ত্রহীন বস্ত্র পাইত। ‘আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সমস্ত কার্য ফেলিয়া মহর্রম উৎসবে যোগদান করিতেন। বীরপুরুষ অস্রচালনায় নৈপুণ্য লাভ করিয়া বীরত্ব অর্জন করিবার, কারু ও শিল্পীগণ মহর্রমের তাজিয়া সংগঠনে আপনাদের সূক্ষ্ম কারুকার্যের সৌন্দর্য দেখাইবার জন্য মস্তিস্ক পরিচালনা করিবার, বালক-বালিকাগণ ‘কাসেদ’ সাজিয়া আনন্দ উপভোগ করিবার, ধনী দান-খয়রাতে লাভ করিবার, দেশবাসী গ্রামবাসী পরস্পরের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া বন্ধুত্ব লাভ করিবার, দলপতিগণ বিভিন্ন দলের পরিচালনা করিয়া নেতৃত্ব অর্জন করিবার এবং সর্বোপরি সকলেই এই দশ দিন নির্মল আনন্দ, বিপুল উৎসাহ, সামরিক উত্তেজনা,শত্রু-সংহারে উদ্দীপনা এবং মিত্রের প্রতি হিতৈষণা পোষণ করিবার সুবিধা পাইত।’ মহর্রমের দশ দিন সমারোহের দিন-উৎসাহের দিন এবং পুণ্যের দিন ছিল। সমগ্র দেশ বাদ্যোদ্যমে মুখরিত-শানাইয়ের করুণ-গীতিতে প্রাণ চতুর্দিকে উৎসাহ আনন্দে পরিপূর্ণ-মেদিনী কম্পিত-দিঙ্মণ্ডল চমকিত হইত! মিছিলের বিপুল আড়ম্বরে, তাজিয়া ও দুল্দুলের বিচিত্র সজ্জায়, কারুকার্যে, পতাকার উড্ডয়নে, অশ্বারোহীদিগের অশ্ব সঞ্চালনে কি চমৎকার দৃশ্যই না প্রতিভাত হইত! মর্সিয়ার করুণ তানে প্রাণের পর্দায় পর্দায় কি করুণ রসেরই সঞ্চার করিত! মহর্রমের দশ দিনে ইসলামের কি অতুল প্রভাবই প্রকাশ পাইত! মহাত্মা ইমাম হোসেনর অপূর্ণ আত্মোৎসর্গ ও অদম্য স্বাধীনতা-স্পৃহার উন্মাদনা গগণে গগণে পবনে নব জীবনের স্ফূর্তি ও আশায় ছড়াইত। রোগী রোগশয্যা হইতে উঠিয়া বসিত, ভীরু সাহস পাইত, হতাশ ব্যাক্তিও আশায় মাতিয়া উঠিত। উৎপীড়িত আত্মরক্ষার ভাগে অনুপ্রাণিত হইত, বীরের হৃদয় শৌর্যে পূর্ণ হইত। মহর্রমের দশ দিন দিগ্বিজয়ী বিরাট বিশাল মুসলমানজাতির জ্বলন্ত ও জীবন্ত প্রভাব প্রকাশ পাইত। মুসলমান এই দশ দিন বাহুতে শক্তি, মস্তিস্কে তেজঃ, হৃদয়ে উৎসাহ এবং মনে আনন্দ লাভ করিতেন। সমগ্র পৃথিবীতে মহর্রমের ন্যায় এমন শিক্ষাপ্রদ, এমন নির্দোষ, এমন উৎসাহজনক পর্ব আর নাই। অধম আমরা, মুর্খ আমরা, অদূরদর্শী আমরা, তাই মহর্রম-পর্ব দেশ হইতে উঠিয়া গেল। জীবন্ত ও বীরজাতির উৎসব কাপুরুষ, অলস, লক্ষ্যহীনদিগের নিকট আদৃত হইবে কেন? বীর-কূল-সূর্য অদম্যতেজা হযরত ইমাম হোসেনের অতুলনীয় আত্মোৎসর্গ ও স্বাধীনতাস্পৃহার জ্বলন্ত ও প্রাণপ্রদ অভিনয়, প্রাণহীন নীচচেতা স্বার্থন্ধদিগের ভালো লাগিবে কেন? পেচকের কাছে সূর্য, কাপুরুষের কাছে বীরত্ব বধিরের কাছে সঙ্গী, অলসের কাছে উৎসাহ করে সমাদর লাভ করে? যখন বাঙ্গালায় মুসলমান ছিল, মুসলমানের প্রাণ ছিল-বুদ্ধি ছিল-জ্ঞান ছিল-তেজঃ ছিল-বীর্য ছিল; তখন মহর্রম উৎসবও ছিল। যাহা হউক, উৎসবের কথা বলিতেছিলাম, তাহাই বলি।”
মহর্রমের ১০ তালিখ-বাঙ্গালায় পল্লীপ্রান্তর শহর বাজার কম্পিত করিয়া মুহুর্মুহু ইমাম হোসেনের জয়ধ্বনি উচ্চারিত হইতেছে। দ্বিপ্রহরের সঙ্গে সঙ্গেই সাদুল্লাপুর হইতে এক ক্রোশ পশ্চিমে কম্পিত কারবালার বিশাল মাঠে চতুর্দিক হইতে বিচিত্র পরিচ্ছদধারী সহস্র সহস্র লোক সমাগত হইতে লাগিল। নানাবর্ণের বিচিত্র সাজ-সজ্জায় শোভিত মনোহর কারুকার্যভূষিত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ তাবুত, অসংখ্য পতাকা, আসা-সোটা, ভাস্বর বর্শা, তরবারি, খব্ধর, গদা, তীর, ধনু, সড়কি, রায়বাশ, নানা শ্রেণীর লাঠি, খড়গ, ছুরি, বানুটি প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রে, স্বর্ণ-সজ্জা শোভিত দুলদুল, সহস্র সহস্র অশ্বারোহী ও শত শত হস্তি-শোভিত মিছিলের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ দল চতুর্দিক্ হইতে শ্রেণীবন্ধ সুশৃঙ্খল অবস্থায় কারবালার ময়দানের দিকে ধাবিত হইল। অসংখ্য বাদ্য নিনাদে জলস্থল কম্পিত এবং দিঙ্মণ্ডল মুখরিত হইয়া উঠিল। পিপীলিকাশ্রেণীর ন্যায় জনশ্রেণী জল ও স্থল আচ্ছন্ন করিয়া নানা পথে নৌকায় কারবালার ময়দানে ধাবিত হইল। জন-কোলাহল সাগর-কল্লোলবৎ প্রতীয়মান হইতে লাগিল। পঁচাত্তরটি ক্ষুদ্র ও বৃহৎ মিছিলের দশ শতাধিক তাবুতসহ বিভিন্ন গ্রাম হইতে বিভিন্ন পথে আসিয়া কারবালার ময়দানের বিভিন্ন প্রবেশপথ-মুখে অপেক্ষা করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে ঈসা খাঁ মস্নদ-ই আলীর মহর্রমের বিপুল মিছিল আড়ম্বর, প্রতাপ ও অসাধারণ জাঁকজমকের সহিত কারবালার নিকটবর্তী হইল। ঈসা খাঁর রৌপ্য-নির্মিত স্বর্ণ ও অসংখ্য মণি-মাণিক্য-খচিত সুচারু ছত্র, অসংখ্য কিঙ্কিণীজাল সমলঙ্কৃত পতাকা, দর্পণ এবং কৃত্রিম লতাপুস্প এবং নানা বিচিত্র কারুকার্য-শোভিত ত্রিশ হস্ত পরিমিত উচ্চ, বিশাল ও মনোহর তাবুত মিছিলের অগ্রভাগে একশত ভারবাহীর স্কন্ধে বাহিত হইল। ঈসা খাঁর তাবুত দেখিবামাত্রই সেই বিপুল জনতা সমুদ্র-গর্জনে “হায়! হোসেন! হায়! হোসেন!” রবে স্থাবর জঙ্গম চরাচর জগৎ যেন কম্পিত করিয়া তুলিল। মধ্যাহৃ ভাস্করের প্রখর কিরণে তাজিয়ার শোভা শতগুণে ঝলসিয়া উঠিল। তাজিয়ার পশ্চাতে দুই সহস্র অশ্বারোহী উর্দী পরিয়া বামহস্তে রক্তবর্ণ বিচিত্র পতাকা বিধূনন এবং দক্ষিণ করে উলঙ্গ কৃপাণ আস্ফালন করিয়া গমন করিল। তাহার পশ্চাতে পাঁচশত সুসজ্জিত স্বর্ণ-আন্তরণ-বিমণ্ডিত হস্তী তালে তালে সমতা রক্ষা করিয়া পৃষ্ঠে ভীষণ ভাস্বর বর্শাধারী দুই দুই জন বীরপুরুষকে বহন করতঃ উপস্থিত হইল। তৎপশ্চাৎ দুইশত বাদ্যকর ঢাক, ঢোল, ভেরী, শানাই, পটই, ডঙ্কা, তুরী, জগঝম্প, দফ্, শিঙ্গা প্রভৃতি নানাবিধ বাদ্যে ভূতল খতল কম্পিত করিয়া কারবালায় উপস্থিত হইল। তাহার পশ্চাতে শত শত খেলোয়াড় লাঠি তরবারি, বানুটি, সড়কির নানা প্রকার ক্রীড়া-কৌশল দেখাইতে দেখাইতে ভীমতেজে অগ্রসর হইল। তৎপর নানাজাতীয় পতাকা ও ঝাণ্ডা পুনরায় দেখা দিল। তৎপর কৃষ্ণবর্ণ অশ্বপৃষ্ঠে কৃষ্ণসজ্জায় শোভিত তেজঃপুঞ্জমূর্তি মহাবীর ঈসা খাঁ শত অশ্বারোহী-বেষ্টিত হইয়া অগ্রসর হইলেন। তৎপশ্চাতে শুভ্র পরিচ্ছদ-সমাবৃত দক্ষিণ হস্তে শ্বেত এবং বাম হস্তে কৃষ্ণ চামর-শোভিত সহস্র যুবক পদব্রজে বিলাপ এবং ব্যঞ্জন করিতে করিতে আগমন করিল। তৎপর বিপুল জনতা গৈরিক-প্রবাহের ন্যায় চতুর্দিক হইতে কারবালায় প্রবেশ করিল। ঈসা খাঁর তাবুত কারবালায় প্রবেশ করিলে, অন্যান্য মিছিলের দল নানা পথে উল্লাস ও আনন্দে ণ্ডঙ্কার করিয়া কারবালায় প্রবেশ করিল। সম্ভ্রান্ত মুসলমান-কুলমহিলাগণ তাঞ্জামে চড়িয়া সূক্ষ্ম যবনিকায় আবৃত হইয়া উৎসবক্ষেত্রের এক পার্শ্বে উপস্থিত হইলেন। অসংখ্য হিন্দু মহিলা লাল, সবুজ, বাসন্তী প্রভৃতি বর্ণের শাড়ী পরিয়া সিঁথিতে সিন্দুর মাখিয়া, নানাবিধ স্বর্ণ ও রৌপ্যালঙ্কারে বিভূষিত হইয়া, গুজরী মল, নূপুরের রুণু রুণু ঝুমু ঝুমু এবং ঝন্ ঝন্ কণ্ কণ্ শব্দে পল্লী ও প্রান্তরবে আনন্দনিক্কণ জাগাইয়া, রূপের ছাঁয় পথ আলোকিত করিয়া, কথার ঘটায় হাসির লহর তুলিয়া চঞ্চল শফরীর ন্যায় স্ত্রীলোকদিগের নির্দিষ্ট স্থানে জমায়েত হইল। মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে সহস্র সহস্র তরণী নানাবর্ণের উড়াইয়া দাঁড়ের আঘাতে জল কাটিয়া বাইচ দিতে লাগিল। অসংখ্য বালক-বালিকা এবং যুবক-যুবতীর উৎফুল্ল মুখকমলের আনন্দ-জ্যোতিঃতে মাথাভাঙ্গার জল-প্রবাহ আলোকিত এবং চঞ্চল হইয়া উঠিল। নদীর পারেই ঘোড়দৌড়ের বাঁধা রাস্তা; তাহাতে শত শত ঘোড়া প্রতিযোগীতা করিয়া ধাবিত হইতে লাগিল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মহর্রমের শির্নী স্বরূপ নানা শ্রেণীর মিষ্টান্ন পাইয়া আনন্দ করিতে লাগিল। খেলোয়াড়গণ শত শত দলে বিভক্ত হইয়া নানাপ্রকার ব্যায়াম, অস্ত্র-চালনা এবং ক্রীড়া-কৌশল প্রদর্শন করিতে লাগিল। বিশাল ময়দানে এক মহা সামরিক চিত্তোন্মাদকর দৃশ্য! অসণিত নরনারী সেই মহা উত্তেজনাকর ক্রীড়া-কৌশল দেখিয়া মুগ্ধ ও লুব্ধ হইতেছে। মহুর্মুহু সেই বিশাল জনতা “ইমাম হোসেন কি-ফতেহ্” বলিয়া গগন-ভুবন কম্পিত করিতেছে। শত শত বালক তাম্বুর চূড়ার ন্যায় লম্বা টুপী মাথায় পরিয়া ছুটাছুটি করিতেছে। থাকিয়া থাকিয়া “হায়! হোসেন! হায়! হোসেন!!” রবে প্রকৃতির বক্ষে শোকের দীর্ঘ লহরী তুলিতেছে। দরিদ্রেরা পয়সা ও কড়ি আগ্রহের সহিত কুড়াইয়া লইতেছে। কেহ কেহ রাশি রাশি বাতাসা বর্ষণ করিতেছে। বালকের দল সেই বাতাসার লোভে হুড়া-হুড়ি, পাড়াপাড়ি করিতেছে। বিশাল ময়দানের চতুর্দিকে তাবুত লইয়া মিছিলসমূহ শ্রেণীবন্ধভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আর মধ্যস্থলে অযুত লোক লাঠি তরবারি প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র লইয়া কৃত্রিম যুদ্ধ করিতেছে। গায়কগণ স্থানে স্থানে দল বাঁধিয়া করুণকণ্ঠে উচ্চৈঃস্বরে কারবালার দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী সঙ্গীতালাপে প্রকাশ করিতেছে। ধন্য ইমাম হোসেন! তুমি ধন্য! তোমার ন্যায় প্রাতঃস্মরণীয় এবং চিরজীবিত আর কে? ধন্য তোমার স্বার্থত্যাগ! ধন্য তোমার আত্মত্যাগ!! ধণ্য তোমার স্বাধীনতা-প্রিয়তা! শত ধন্য তোমার অদমনীয় সাহস ও শৌর্ষ! তোমার ন্যায় বীর আর কে? তোমার ন্যায় স্মরণীয়ই বা আর কে? প্রজাতন্ত্র-প্রথা রক্ষা করিবার জন্য, ধর্ম ও ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষা করিবার জন্য তোমার ন্যায় আর কে আত্মত্যাগ করিয়াছে? “মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন” এ প্রতিজ্ঞা তোমার দ্বারা পূর্ণ হইয়াছে। পুণ্যভূমি আরবের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, ইসলামের পবিত্রতম প্রজাতন্ত্র-প্রথা রক্ষা করিবার জন্য মৃত্যুর করাল গ্রাস এবং নির্যাতন ও অত্যাচারের ভীষণ নিষ্ঠুর যন্ত্রণাও তোমাকে বিচলিত করিতে পারে না। তুমি সবংশে ধ্বংস হইলে, তথাপি অন্যায়ের প্রভুত্বের নিকট মস্তক নত করিলে না। আজ অত্যাচারী এজিদের স্থান এবং তোমার স্থানের মধ্যে কি বিশাল ব্যবধান। তুমি আজ জগতের যাবতীয় নর-নারীর কণ্ঠে কীর্তিত, হৃদয়ে পূজিত। তুমি কারবালায় পরাজিত এবং নিহত হইয়াও আজ বিজয়ী এবং অমর।
মহর্রম উৎসব খুব জোরে চলিতে লাগিল। ক্রমে দিনমণি পশ্চিম-গগনপ্রান্তে দ্রুত নামিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে দিবসের শেষ-রশ্মি বৃরে অগ্রভাগে উত্থিত হইল। সন্ধ্যা সমাগমে দুই একটি তারকা নীলাকাশে ফুটিতে লাগিল। আর দেখিতে দেখিতে অমনি জলস্থল সহসা প্রদীপ্ত করিয়া সহস্র সহস্র মশাল কারবালা ক্ষেত্রে জ্বলিয়া উঠিল। নানা বর্ণের মাহতাব, তুবড়ী এবং হাওয়াই জ্বলিয়া জ্বলিয়া কারবালায় হত্যাকাণ্ডের দারুণ রোষানল উদগীর্ণ করিতে লাগিল। সহস্র সহস্র রোমের আওয়াজে আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িতে লাগিল। সহস্র সহস্র আগুনের বানুটি খেলোয়াড়দিগের হস্তে অদ্ভুত কৌশলে ঘূর্ণিত হইতে লাগিল। কি অপূর্ব দৃশ্য! প্রান্তরময় মনুষ্য! প্রান্তরময় অনল-ক্রীড়া! নদীগর্ভে অনল-ক্রীড়া! আকাশে অনল-ক্রীড়া! জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বত্র বিপুল উৎসাহ। বিপুল আনন্দ!! বিপুল কোলাহল!! বিপুল স্ফূর্তি!!
সাদুল্লাপুর মিত্রদের বাড়ী হইতেও বিপুল সমারোহে তাজিয়ার মিছিল বাহির হইয়া কারবালায় আসিয়াছিল। পাঠকগণ! অধুনা ইহা পাঠ করিয়া বিস্মিত হইবেন। কিন্তু যে-সময়ের কথা বর্ণিত হইতেছে, তখনকার ঘটনা ইহাই ছিল। বাদশার জাতি মুসলমানের সকল কার্যেই হিন্দুর শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতি ছিল। মুসলমানের মস্জিদ এবং পীরের দরগা দেখিলে সকল হিন্দুই মাথা নোয়াইত, মুসলমানের ঈদ পর্বেও হিন্দুরা মুসলমানদিগকে পান, আতর এবং মিষ্টান্ন উপহার দিত। মুসলমানের পোষাক পরিয়া হিন্দু তখন আত্মভিমান বোধ করিত। মহর্রম পর্ব-ত-হিন্দুরা প্রাণের সহিত বরণ করিয়া লইয়াছিল। আজিও বাংলার বাহিরে বিহার এবং হিন্দুস্থানের হিন্দুরা মহর্রম পর্বে মুসলমানের ন্যায়ই মাতিয়া উঠে। অনেক রাজ-রাজড়াদের বাড়ীতে দস্ত্তরমত তাবুত উঠে এবং মিছিল বাহির হয়। আজিও হিন্দুস্থানে মহর্রম পর্বে হিন্দু-মুসলমানে গভীর একপ্রাণতা পরিলক্ষিত হয়।”
সাদুল্লাপুর মিত্রদের বাড়ী হইতে স্থলপথে মিছিল আসিয়াছিল। আর জলপথে দুইখানি সুসজ্জিত পিনীসে বাড়ী গিন্নি ও বধূরা, অন্যখানিতে স্বর্ণময়ী, মালতী এবং অন্যান্য বালক-বালিকা। মাল্লারা নৌকা বাইচ দিতেছিল। বরকন্দাজেরা দাড়ি-গোঁফে তা দিয়া ঢাল-তলওয়ার লইয়া পাহারা দিতেছিল। হেমদাকান্ত এবং অন্যান্য যুবকেরা অশ্বারোহণে আসিয়াছিল।
কাপালিক ঠাকুর রক্তবর্ণ চেলি পরিয়া কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা কাটিয়া স্বর্ণময়ীদের নৌকায় চড়িয়া মহর্রমের উৎসব দেখিতেছিলেন। নদীগর্ভে একস্থানে ঈসা খাঁ কয়েকখানি রণতরী নৌযুদ্ধের অভিনয় করিতেছিল। স্বর্ণময়ী সেই অভিনয়ই সাভিনিবেশে পর্যবেক্ষণ করিতেছিল।
ঈসা খাঁ যে স্বর্ণময়ীর সহিত মহর্রম উৎসবের দিন দেখা করিতে চাহিয়াছিলেন, হেমদাকান্ত তাহা বিলক্ষণ অবগত ছিল। কারণ ইসা গোপানীয় বিষয় ছিল না। দুর্মতি হেমদাকান্ত এক্ষণে এই ছলে স্বর্ণকে হরণ করিবার জন্য একটা কৌশল বিস্তার করিল। হেমদা নৌকার পাহারাওয়াল বরকন্দাজগিদকে সহসা ডাকিয়া কয়েকটি ঘোড়া রক্ষা করিবার ভার তাহাদিগকে দিয়া, “আমি আসছি, তোমরা অপেক্ষা কর” বলিয়া সঙ্গের কয়েকটি কাশীনিবাসী আগন্তক বন্ধু লইয়া স্বর্ণের নৌকায় আসিয়া উপস্থিত হইল এবং অত্যন্ত ব্যস্ততা সহকারে মালতীকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “মালতী! তুই এবং অন্যান্য সকলে নেমে অন্য নৌকায় উঠ্, এ নৌকা তাজিয়া-ঘাটে নিয়ে যেতে হবে। তথায় নবাব সাহেব স্বর্ণকে দেখবার জন্য অপেক্ষা করছেন।” হেমদাকে বাটির ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত ভয় করিত। সুতরাং হেমদা বলিবা মাত্রই তাহারা অন্য নৌকায় তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল। অভিরাম স্বামী নৌকা হইতে নামিয়া ডাঙ্গায় উঠিল। মাঝি-মাল্লারা পিনীস তাড়াতাড়ি বাহিয়া তাজিয়াঘাটা পানে ছুটিল। হেমদার সঙ্গের ভদ্রবেশধারী কতিপয় ব্যক্তি নৌকায় উঠিয়া পড়িল। ‘ইহারা ঈসা খাঁর লোক, স্বর্ণকে লইতে আসিয়াছে,’ মাঝি-মাল্লারা ইহাই মনে করিল।
হেমদা এবং স্বামীজী দুইজন, জনতার মধ্যে মিশিয়া নানাস্থানে ক্রীড়া-কৌতুক এবং আতসবাজী দেখিতে লাগিল। অনেক বিলম্বে তাহারা বরকন্দাজদিগের নিকট উপস্থিত হইল। উপস্থিত হইয়াই তাড়াতাড়ি বলিল, “যাও, যাও, তোমলোগ্ জল্দি তাজিয়া-ঘাটামে কিস্তীকে হেফাজত মে যাও। ওঁহা নবাব সাহেবকা সাথে মোলাকাত করনেকে লিয়ে রাজকুঙারী তশ্রিফ লে গেয়ি হায়। জল্দি ওঁহা যানা।” বরকন্দাজেরা “হুজুর,” বলিয়া তাজিয়া-ঘাটের দিকে দৌড়াইল।
অভিরাম স্বামী পূর্বেই মাঝি এবং মাল্লাদিগকে একটি এমন ঔষধ পানের সহিত মিশাইয়া খাইতে দিয়াছিলেন যে, তাহারা তাজিয়া-ঘাটায় নৌকা লইয়া একটু বিশ্রাম করিতেই বেহুশ এবং সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িল। তখন সেই ছদ্মবেশী গুণ্ডার দল পাল তুলিয়া মাথাভাঙ্গা নদীর পশ্চিমগামী একটা ক্ষুদ্র শাখার দিকে নৌকা চালাইল। নৌকা ভরা-পালে উড়িয়া চলিল।