১০. রাতের আকাশ

প্লেনে রাতের আকাশ দিয়ে ঢাকায় ফিরতে ফিরতে তার মনে পড়ল আজ দুপুরে পরপর সে কয়েকটা স্বপ্ন দেখেছে। কোনটা আগে কোনটা পরে এখন আর মনে নেই। খুঁটিনাটিও মনে পড়ছে না। কেবল কয়েকটা ছবি।

একটাতে তার বাবা ছাতা মাথায় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। গালের দাড়ি বেয়ে টপটপ করে ঝরছে বৃষ্টির ধারা। হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, ভিজে গেছে। বাবা ধুতি পরতেন। সে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল কিন্তু বাবা একটা কথাও বললেন না।

আরেকটাতে দেখেছে, তার গলা কেটে কারা যেন ফেলে রেখেছে। তার পাশে চুল খুলে কাদছে অচেনা একটা মেয়ে। পাশ দিয়ে শেখ মুজিব যাচ্ছিলেন। তার পা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কী যেন বলতে লাগল সে। শেখ একবার চোখের ওপর হাত রেখে নাবিকের ভঙ্গিতে আকাশ দেখলেন, তারপর ধীরপায়ে চলে গেলেন কুয়াশার মধ্যে।

একটা স্বপ্ন–তার গাড়ির কাচ ভাঙ্গা। একেবারে খোলা। হু হু করে। বাতাস আসছে ঠেলে। কিছুতেই গাড়ি চালানো যাচ্ছে না।

আরো অনেক কিছু দেখেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

হ্যাঁ, একটা মনে হয়েছে।

চিড়িয়াখানায় একটা রোগা সিংহ খুব ল্যাজ খাড়া করে খাঁচার মধ্যে এপাক ওপাক করছে। সিংহের চেহারাটা অবিকল কাজী সাহেবের মত। আর বাবর তাকে একটা মৰ্তমান কলা সাধছে খাবার জন্যে। কিন্তু সিংহ সেদিকে ভ্ৰক্ষেপ পর্যন্ত করছে না।

আরেকটা স্বপ্ন— বাবর ক্রমাগত এ-আকাশ ছেড়ে ও-আকাশে, আকাশের পর আকাশ উড়ে যাচ্ছে। আকাশটা মেঘহীন।

দয়া করে আপনাদের সিট বেল্টগুলো বেঁধে নিন।

কোমরে হাত দিয়ে বাবর দেখল সেই যে উঠার সময় বেঁধেছিল, আর খোলা হয়নি। সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলল সে। এক গ্লাশ পানি চেয়ে খেল।

নিচে ঢাকার আলো দেখা যাচ্ছে। ছেলেবেলার জোনাক জ্বলা বনের মত। মাগো, আমার কাজলা দিদি কই?

যাবার সময় এয়ারপোর্টে গাড়িটা রেখে গিয়েছিল। এখন রাত দশটায় একেবারে একাকী দাঁড়িয়ে আছে। অবিকল আমার মত–ভাবল বাবর। গাড়িটার হাতলে সস্নেহে হাত রাখল সে।

তারপর ইচ্ছে করে জাহেদাদের কলেজের সমুখ দিয়ে দুএকটা জানালায় জ্বলা বাতির দিকে তাকাতে তাকাতে বাড়ি ফিরল বাবর।

বাড়ি ফিরে নিজেকে বড় ক্লান্ত, ব্যয়িত কিন্তু ক্ষুব্ধ মনে হলো বাবরের। চোখের ভেতরে জ্বলজ্বল করতে লাগল ফিরতি পথে দেখা জাহেদার হোস্টেলের জানালায় তীব্ৰ আলোর আয়তক্ষেত্রগুলো।

কেন যেন মন খারাপ লাগছে খুব।

কেন?

কিছুতেই সে বুঝে পেল না। অসহায়ের মত টের পেতে লাগল সেই সব কিছু শূন্য করে তোলা অনুভূতিটা বৃহৎ থেকে কেবলি বৃহত্তর হচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠছে আত্মা। ভেতরটা ছটফট করছে। কী করলে যে শান্ত হবে তাও বোঝা যাচ্ছে না।

মান্নান এসে বলল, খাবার দেব?

না।

সে চলে গেলে বিছানায় চোখ বুঝে শুয়ে রইল বাবর। হাতে পুড়তে লাগল সিগারেট। কোথায় একটা বেড়াল অবিরাম ম্যাও ম্যাও করে চলছে। তার কী হয়েছে কে জানে?

ছেলেবেলায়, মাঝরাতে, বেড়াল ঐ রকম কাঁদলে মা তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতেন। বুকের শীতল কোমল মাংসে মশলা হলুদের ঝাঝের ভেতর মাথা ড়ুবিয়ে থাকতে থাকতে কেমন নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে আসত সব অনুভূতি। পৃথিবী গুটিয়ে আসত মায়ের বুকে। অর্ধশূন্য থলের মত মায়ের বুক হয়ে উঠত একমাত্র অবলম্বন।

বাবর বালিশে মুখ ড়ুবিয়ে রইল অনেকক্ষণ। ভেতর থেকে একটা কান্না পাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই বাইরে আসছে না। বাইরে আসছে না বলে ভীষণ ভয় করছে। ভয় করছে এই ভেবে যে স্মৃতিও বুঝি তার কাছে আর যথেষ্ট নয়।

বাবর উঠে দ্রুত হুইস্কির বোতল বার করে সরাসরি খানিকটা পান করল। তারপর গোলাশ খুঁজে খানিকটা ঢেলে বরফ দিয়ে ভরে নিল। বসল। মোড়ার ওপর। অন্যমনস্ক হাতে গোলাশটা ধীরে ধীরে ঘোরাতে লাগল ঘড়ির উল্টো দিকে; শীতল কাচ একবার চেপে ধরল গালে, চোখের গহবরে, কপালে, চিবুকের নিচে।

মাকে যেদিন কবর দেয়া হয় সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল।

বাবর পায়ের নিচে সিগারেটটা পিষে নিবিয়ে দিল।

হাসনু। তার ছোট বোন, বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট দুটি বিযুক্ত। যেন এই মাত্র কিছু বলেছে বা বলবে।

মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ বাবা?

আল্লার কাছে।

কেন?

আল্লার কাছে সবাইকে যেতে হয় যে, খোকা।

কেন যেতে হয়?

যেতে হয়, তাই।

কেন? আল্লা কে?

তিনি আমাদের সব। তিনি আমাদের তৈরি করে পাঠিয়েছেন। আবার তিনি আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তোমার মাকে তাই আজ নিয়ে গেলেন।

সেখানে বুঝি ঘুমিয়ে যেতে হয়।

হ্যাঁ খোকা, তাই।

হাঃ হাঃ হা।

বাবর চেষ্টা করল। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল তার। সে একটা দীর্ঘ চুমক দিল গেলাশে।

আজ বাবাকে প্লেনে আসতে আসতে স্বপ্নে দেখেছে সে। বৃষ্টিতে তার দাড়ি ভিজে টপটপ করে পানি পড়ছে। মাঠের ভেতর দিয়ে আসছিলেন তিনি। একটা কথাও বলেননি। বাবরের খুব কষ্ট হতে লাগল। বাবার কথা মন থেকে তাড়াবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে বার কয়েক পায়চারি করল সে। ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি দেখল। একটা পত্রিকার পাতা ওল্টাল। ওয়ার্ডরোব খুলে জামা কাপড়রে সুগন্ধ বুক ভরে নিল। গোলাশটা শেষ করে আবার কানায় কানায় সুরায় বরফে ভরে নিল বাবর। যা হাসনু যা। যা এখান থেকে। যা বলছি। হাসনু তো যাবেই না। বরং হাসনু ক্রমশ বড় হতে লাগল তার চোখের ভেতরে।

টেলিফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। জাহেদা? লতিফা? না, লতিফা হবে না। বাবলি?

হ্যালো।

খুব ভারি গলায় কে যেন জিগ্যেস কয়ল, রোজারিও সাহেব আছে?

রং নম্বর।

বসবার ঘরে এসে বসল বাবর। আবার টেলিফোনটা বেজে উঠল। আবার বোধহয় রোজারিওকে চাইছে। বাবর আর ধরল না। কিছুক্ষণ বেজে বেজে ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল টেলিফোন। নেমে এলো অখণ্ড নীরবতা।

হাসনু যা বলছি।

দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠিটি ছুঁড়ে মারল বাবর। ঘুরতে ঘুরতে শূন্যেই নিভে গিয়ে ঘরের কোণায় থুবড়ে মুখী পড়ে গেল।

হাসনুরে, কী চাস তুই?

হাসনুর দুটো দাঁত পোকা খাওয়া ছিল। হাসলে ভারি মিষ্টি লাগত। হাসনু হেসে ফেলল এখন। নিঃশব্দে, দীর্ঘক্ষণ ধরে, শ্লথগতি চলচ্চিত্রের মত।

এখান আরো এক লাগল বাবরের। রক্তের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক তাদের কথা মনে পড়তেই এই বোধটা বিরাট হয়ে উঠেছে যে এখন তার চারপাশে এ দেশে কেউ নেই। আপনি কাকে বলে সে তুলে গেছে বলেই যারা আপন তারা তাকে এমন একা করে যাচ্ছে। বহুদিন পর এ-রকম আবার হচ্ছে বাবরের।

সে ঢকঢক করে খানিকটা পান করল।

হাঃ হা। আমার কেউ নেই। কেউ নেই। কোনো কিছু আমার নয়। না মাটি, না মন, না। মানুষ। বর্ধমানে লেবু গাছটায় লেবু ধরেছে? কানা ফকিরটা বেঁচে আছে না মরে গেছে হাসনু?

দূর, তুই বলবি কী করে? তুই ও তো মরে গেছিস।

সত্যি?

না, বিশ্বাস হয় না, তুই হয়ত বেঁচে আছিস।

তোকে কত খুঁজলাম, পেলাম না।

ওরা তোকে কষ্ট দিয়েছে রে?

বাবর স্পষ্ট দেখতে পায় মাঠের ওপর থমথমে সন্ধে নেমে এসেছে। এতটুকু শব্দ নেই কোথাও। হাঁটতে গিয়ে পায়ে পায়ে আঁঠার মত জড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকার। হাসানুর হাত শক্তি করে ধরে সে তবু হাঁটছে। প্ৰাণপণে হাঁটছে। বাড়ি পৌঁছুতে হবে। রাতের আগেই পৌঁছুতে হবে যে।

কোথায় গিয়েছিল দুজন মনে নেই। মনে রাখার কোনো প্রয়োজনও নেই। যেন জন্মের পর থেকেই সে আর হাসনু অবিরাম দ্রুতপায়ে সেই অন্ধকার ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে চলেছে।

কে যেন পেছনে আসছে।

কই না।

আবার তাকিয়ে দেখল বাবর। কাউকে দেখল না, তবু মনে হলো কেউ তাদের অনুসরণ করছে। তার হাত ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ধরবার জন্যে। চট করে হাসনুকে টেনে সে পোলের পাশে ঝোঁপের মধ্যে লুকাল।

হাসনু প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠেছিল, দাদা।

চুপ।

হাসনুকে নিয়ে ঝোঁপের মধ্যে মুখগুঁজে পড়ে রইল বাবর। মশা কাটতে লাগল। যন্ত্রণা হতে লাগল। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল তারা। নিচে পোলোর থামে পানি আঘাত করছে, করতালির মত শব্দ উঠছে থেকে থেকে।

হঠাৎ দুটো মানুষের সাড়া পাওয়া গেল পোলের অপর দিকে, নিচে। সাড়া ঠিক নয়, নিঃশ্বাসের শব্দ। তার ভেতরে একজনের যেন হঠাৎ খুব শীত লেগেছে, দাঁতে দাঁতে শব্দ হচ্ছে তাই। আবার কখনো মনে হচ্ছে নিচু গলায় হি হি করে হাসছে।

কী করছে ওরা ওখানে?

বাবর কান খাড়া করল। অন্ধকারে হাসনু তার মুখের দিকে তাকাল। তারার আলোয়, নাকি ভয়ে, শাদা শাদা লাগছে হাসনুর মুখ।

দাদা।

চুপ।

হাসনুর মুখ চেপে ধরে বাবর কান পেতে রাখল ঐ শব্দের উৎসের দিকে। তার মেরুদণ্ড দিয়ে হঠাৎ ঠাণ্ডা তরল কী যেন নামছে অতি দ্রুত। তারপর হঠাৎ ঊরুর ভেতরটা ভিজে গোল উষ্ণতায়।

ঘড়ঘড় একটা শব্দ হলো সেই মুহূর্তে, ওপারে।

ফিসফিস গলায় কে যেন জিগ্যেস করল, বল শালা, হিন্দু না মুসলমান?

উত্তরে দ্বিতীয় লোকটা হি হি করে হেসে উঠল যেন।

বল।

চাপা গলায়। গর্জে উঠল প্ৰথম।

আঁ করে একটা শব্দ করল দ্বিতীয়।

তারপর শোনা গেল, হি হি মা, হি হি না, হি হি না না।

চুপ শালা।

বাড়িতে আমার বৌ আছে বাবা। না-আস্তে-না-না।

চিৎকারে ছিঁড়ে যাচ্ছিল অন্ধকারটা, কে যেন চেপে ধরে তা বন্ধ করল। সেই সঙ্গে ধানের বস্তা নামাবার সময় যেমন বুক থেকে শব্দ ওঠে কুঁলিদের সেই রকম একটা রুদ্ধশ্বাস ভারি শব্দ উঠল। আবার, আবার।

তারপর সব চুপ হয়ে গেল।

বাবর হাসনুকে টেনে তুলে দৌড় দিতে যাবে, একেবারে সামনে পড়ে গেল লোকটার। হাতে রক্তমাখা ছুরি। গলায় একটি মাদুলি চকচক করছে। আর কিছু চোখে পড়ল না তার।

আর কিছু মনে নেই বাবরের।

কেবল মনে আছে বাবর মাঠের ভেতর দিয়ে প্ৰাণপণে দৌড়ুচ্ছে।

আর পেছনে হাসানুর আর্তচিৎকার আকাশে বাতাসে হা হা করছে–দা—দা।

আরো খানিকটা হুইস্কি ঢালল বাবর।

হাসনুকে আর পাওয়া যায়নি।

কেন সে হাসনুকে ফেলে পালাল। কেন লড়াই করল না। কেন? কেন?

কোনটা স্বাভাবিক? পালিয়ে আসা? না, লড়াই করা? গল্পে উপন্যাসে মানুষের আদর্শে রুখে দাঁড়ানোটাই চিরকাল নন্দিত। সিনেমা হলে তালি পড়ে। বই পড়তে পড়তে প্ৰশংসায় পাঠকের মুখ লাল হয়ে ওঠে। কিন্তু সে নিজে, নিজের প্রাণ নিয়ে, পালিয়ে এসেছে। আমি কি ঘৃনিত বলে চিহ্নিত হবো?

নাকি আদর্শটাই ভুল।

মানুষ যা পারে না। তাই বড় করে দেখতে চায়, দেখানো হয়।

I know they do not know, but I
who have followed so many times
the road from the murderer to the murdered
from the murdered to the punishment
and from the punishment to the other murder, groping
the inexhaustible purple
that night of homecoming
when the Furies began to whistle
in the sparse grass–
I saw snakes crossed with vipers Entained on the Vile Generation
our destiny.

কতদিন পরে জর্জ সেফারিসের বইটা খুলল বাবর। পড়তে পড়তে চোখ ভরে এলো পানিতে। বইটা বন্ধ করে হাত বুলাতে লাগল নরম কভারে। ধুলা জমে আছে। ধুলোয় কিচ কিচ করছে মলাট। পকেট থেকে রুমাল দিয়ে সযত্নে মুছে আলমারিতে রেখে দিল বাবর। গোলাশটা শেষ করল।

হাসনু, আর কোনোদিন আসিস না। তুই যা।

হাসনু গেল না।

আলমারির ভেতরে খুঁজে দেখার ইচ্ছে হলো বাবরের। একবার কয়েকটা কবিতা অনুবাদ করবার চেষ্টা করেছিল সে। কাগজগুলো কই?

হাসনু তুই কি আমাকে মেরে ফেলবি?

এই তো কাগজগুলো। এই তো একটা অনুবাদ সম্পূর্ণ করেছিল সে। ঐ তো আরেকটার কয়েকটা লাইন। ঐ তো বাকিগুলো।

আমি পালিয়েছি বেশ করেছি। একশ বার পালাব। কার তাতে কী।

কাগজগুলো ভাঁজ করে একটা খামে পুরে রাখল বাবর।

সব শালাই পালায়। কিন্তু গল্প করার সময়, লেখার সময়, বক্তৃতায় উল্টোটা বলে। আমি সব জানি। সবাইকে আমার চেনা আছে।

হাসনুরে তুই যাবি না?

শূন্য গোলাশটা ছুঁড়ে মারল বাবর। দেয়ালে লেগে ঝনঝন করে ভেঙ্গে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে ঝিম ধরে উঠল মাথার ভেতরে। চমৎকার কাজ করতে শুরু করেছে। সুরা? বাবর দরোজা খুলে বেরুল বারান্দায়। এক ঝলক বাতাস তার মুখ ধুইয়ে দিয়ে গেল। হঠাৎ। হাত ঘড়ির দিকে তাকাল সে। কই, রাত তো বেশি হয়নি?

কাউকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কারো সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে ভাল হতো। কোথাও গেলে হতো। ঘরের ভেতরে গেলেই হাসনু আবার তার পোকা খাওয়া দাঁত নিয়ে হাসতে থাকবে। আর শোনা যাবে সেই আর্তচিৎকার। দা-দা!

বাবর গাড়ি স্টার্ট দিল।

সড়াৎ করে বেরিয়ে এল বড় রাস্তায়। একটানা চালিয়ে জাহেদার হোস্টেলের অদূরে গাড়ি রাখল সে। সিগারেট ধরিয়ে পেছনে মাথা হেলিয়ে পা লম্বা করে দেখতে লাগল হোস্টেলের জানালায় আলোর ছক।

দুপ দুপ করতে লাগল বুকের ভেতরে। সকাল হতে এখনো অনেক বাকি। সকালে জাহেদ আসবে।

জাহেদা

ভাল জাহেদা।

আমার ভাল জাহেদা।

এই আবৃত্তি ক্রমশ অমৃতের মত মনে হতে লাগল তার। প্রশান্ত হয়ে আসতে থাকল আত্মা।

হ্যাট।

ঐ দ্যাখা হ্যাট।

ঐ দ্যাখ কালো হ্যাট।

ঐ দ্যাখ জনের কালো হ্যাট।

ঐ দ্যাখ জনের কালো হ্যাট টেবিলে।

ঐ দ্যাখ জনের কালো হ্যাট টমের টেবিলে।

হাঃ।

এইভাবে শূন্য থেকে এক, এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন, তিন থেকে চার, এইভাবে, এইভাবে। শূন্যতা থেকে শুরু করা যায়। শূন্য থেকে আমি। আমি থেকে তুমি। আমি তুমি থেকে সে। আমি, তুমি, সে থেকে অনেকে।

অনেক কি আমরা হয়?

আমি বিশ্বাস করি না।

আমি বলছি, আমি বিশ্বাস করি না। জাহান্নামে যাও।

হাসনু যা। যা বলছি।

না, সুরা পানে কিছু হবে না। কাউকে দরকার। কোনো একটা জীবন্ত মানুষ। অনর্গল কথা কলতে হবে। নইলে আজ রাতে সে মারা যাবে। সেই রক্তাক্ত ছুরিটা সে চোখে দেখতে পাচ্ছে, বর্ধমানের অন্ধকারে, মাঠে, পোলের পাশে, ঝোঁপের ধারে।

দা–দা!

উদ্দাম গতিতে গাড়ি চালিয়ে দিল বাবর।

অনেকক্ষণ গাড়ি একভাবে চালাবার পর কান পাতল বাবর। না, চিৎকারটা আর তাড়া করছে না। তাকে। বাচা গেছে। তবু হাসনুর চেহারা একবার মনে করতে চেষ্টা করল সে, কিন্তু শত চেষ্টা করেও মনে করা গেল না। তখন স্বস্তিও হলো, আবার একটু দুঃখিতও হলো সে।

চারদিকে তাকিয়ে দেখল বাবর।

সমস্ত শহর ভারি অচেনা মনে হলো তার। পেট্রল পাম্পে এলো সে। ট্যাংক ভর্তি করে তেল নিল।

টেলিফোন আছে?

আছে স্যার।

লাফ দিয়ে নেমে কাচঘেরা ঘরের মধ্যে গেল বাবর। ডায়াল করল।

হ্যালো।

কে, হাসু?

জি।

ভাল আছ, হাসু?

হাসুর নামটা উচ্চারণ করতে ভারি মিষ্টি লাগে বাবরের।

ভাল। আপনি বাবার চাচা?

হ্যাঁ। তোমার বাবা কই, হাসু।

মাদারিপুরে।

মা?

আছেন। ডেকে দিই?

কী করছেন? ঘুমিয়ে? তা হলে থাক।

না, না। মা জেগেই আছেন। মা—আ।

টেলিফোনে ডাকটা শুনতে পেল বাবর। শুনতে পেল চটির শব্দ। শুনতে পেল মিসেস নফিসের খানখনে গলা।

হ্যালো।

আমি বাবর।

নিস্তব্ধতা।

আমি বাবর। হাসুব কাছে শুনলাম জেগে আছেন। কী করছেন?

কিছু না।

আমি আসছি।

দরকার আছে?

আছে।

টেলিফোন রাখল বাবর। মিসেস নাফিস সত্যি তার ওপর রাগ করেছেন। কেমন নিস্তাপ, নিম্পূহ করে রেখেছেন গলাটা। সেদিন সত্যি সত্যি কয়েকটা কড়া কথা বলা হয়ে গেছে। রসিকতা হয়ে গেছে বড় বেশি নির্মম। আজ পুষিয়ে দেবে।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, মিসেস নাফিসকে দেখলেই তার জিবে চুলবুল করে ওঠে। খোঁচাতে ইচ্ছা করে। কেন সে টেলিফোন করতে গেল তাকে? কী দরকার ছিল?

বোধহয় মনে মনে সে এখন এমন কাউকে খুঁজেছিল যার সঙ্গে বিরোধ পদে পদে। যাকে দেখলেই নখগুলো শানিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। যদি কোণঠাসা করে প্রতিশোধ নেবার প্রবৃত্তিটা শান্ত করা যায়।

কিন্তু প্ৰতিশোধ কেন? কার ওপর?

দরোজা খোলাই ছিল। বাবরের পায়ের শব্দে কাজের ছেলেটা বেরিয়ে এলো। নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকল সে।

সোফার ওপর সবুজ চটিতে পা পেতে বসে আছে মিসেস নাফিস। হাতে আজ সকালের বাসী কাগজ। বাবরের মনে হলো রঙ্গমঞ্চে পর্দা উঠেছে। সে তাই হাসল। সেই হাসিটাকেই দীর্ঘ করে চটুল কণ্ঠে বাবর বলল, ভাল তো?

মিসেস নাফিস তীক্ষ্ণ চোখে নিঃশব্দে মাথা ওঠানামা করলেন আস্তে আস্তে। নিঃশব্দ সেই বাতাঁর অর্থ হতে পারে, হ্যাঁ। অর্থ হতে পারে আমার চোখে আপনি এখন কাচের মত স্বচ্ছ। বাবর আবার বলল, আপনার কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। তাই। কারণ–। অবিশ্যি রাত বেশ হয়েছে–।

সুরা এত বেশি কাজ কবেছে যে বাক্যগুলি কিছুতেই শেষ করা যাচ্ছে না। বাবর একটা সিগারেট ধরাল অক্ষমতাকে ধামাচাপা দেবার জন্যে। জিগ্যেস করল, নসিফ সাহেব মাদারিপুরে কেন?

ওর মামাকে রেখে আসতে।

সেই মামা?

হ্যাঁ।

যার অপারেশন গল ব্লাডারে?

গল ব্লাডারে নয়, চোখে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, চোখে। চোখেই তো বলেছিলেন। এখন ভাল?

বোধহয়।

বোধহয় মানে?

জিগ্যেস করিনি।

ঠিক, ঠিক। বাইরে আপনার গাড়ি দেখলাম?

বাইরে যাচ্ছিলাম।

ও; কেন?

বলবেন না। একটু আগে হাসুকে নিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। রেস্তোরাঁয় চাবি ফেলে এসেছি। এখুনি না গেলে হয়ত আর পাওয়াই যাবে না।

মিসেস নাফিস উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে রইলেন। ভেতরেও গেলেন না, বাইরেও না। এক জোড়া তীক্ষ্ণ চোখ তার ক্রমশ ধার হারাতে লাগল।

বাবর বলল, কোন রেস্তোরাঁ?

কাফে আরাম।

বাবর হাসল। যেন চাবি ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছেন মিসেস নাফিস। সে উঠে দাঁড়াল। বাইরে বেরুল তারা এক সঙ্গে।

মিসেস নাফিস বললেন, দেখা হবে।

বলেই তিনি গাড়িতে সরব করলেন এঞ্জিন। বাবর হাত নেড়ে তারটায় বসল। যতক্ষণ না তার গাড়ি বেরুল বাবর চাবিতে পর্যন্ত হাত দিল না। মেয়েরা গাড়ি চালালে তাদের থেকে দূরে থাকাটা বুদ্ধিমত্তার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ মনে করে সে।

বাবর বেরিয়ে পেট্রল পাম্পে এলো তেল নিতে। কাল রংপুরে যাবার এই শেষ তৈরিটা বাকি আছে। চাবি খুলে ছেলেটাকে দিতে যাবে হঠাৎ তার চোখে পড়ল ট্যাঙ্কে তেল ভর্তি।

ওহো তাই তো। একটু আগেই না তেল নিয়েছে? হঠাৎ করে মাথাটা এমন শূন্য হয়ে গেল কেন?

হাঃ খেলে যা। ভাল করে খেলে যা। ব্রাভো খেলারাম।

ধন্যবাদ। হাঃ হাঃ হাঃ।

গাড়ি ছুটিয়ে দিল সে। পেট্রল পাম্পের ছেলেটা বিড়বিড় করে বলল, শালা মাতাল। তারপর তার মুখেও নিঃশব্দ এক টুকরো। হাসি ফুটে উঠল এবং অচিরেই হাসিটা হাইয়ে রূপান্তরিত হলো। তার ঘুম পাচ্ছে।

পুরনো পেন্টিংয়ে দেখেছে ইংল্যান্ডের জলাভূমিতে ঘোড়ায় চেপে শিকার করতে চলেছেন লর্ড। তার সমুখে শিকারী কুকুর। ঠিক তেমনি পেট সরু করে ছুটতে লাগল বাবর নির্জন অন্ধকার রাজপথ দিয়ে। তীব্ৰ গতিতে টায়ারে অবিরাম একটা হুইসিল বাজতে লাগল তার কানে।

অতিকায় একটা খেলনার মত দেখাচ্ছে ইন্টারকন্টিনেন্টালকে। কাচের দরোজার ওপারে মানুষকে মনে হচ্ছে রঙিন চলচ্চিত্রের চরিত্র। বাবর ভেতরে ঢুকলা চারদিকে দেখল, একবার ভাবল কাফে আরামে যায়, না থাক; সে ছিপ ফেলে একটা সোফায় বসল।

সবুজ শাড়িতে পুকুর ভরা শ্যাওলার মত মন্থর ঢেউ তুলে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন মিসেস নাফিস। বাবর তাকে ডাকল ও না, উঠেও দাঁড়াল না। নিঃশব্দে বিকশিত হাসিতে অপেক্ষা করে রইল।

মিসেস নাফিস কাঁধের চুল চলতে চলতে সরাতে গিয়ে বাবরকে দেখলেন এবং দুপায়ের মাথায় গিয়ে থামতে পারলেন।

বললেন, আপনি!

হ্যাঁ, আমি। বাবর কাছে উঠে এলো! আবার বলল, আমি। আপনি কি আমাকে এখানে আসতে বলেননি।

হ্যাঁ, আমি।

তাহলে ভুল শুনেছি।

কিন্তু–।

হ্যাঁ, আমিও তাই বলি। কিন্তু আপনি যেন বলেছিলেন, দেখা হবে। তাই চলে এলাম।

ও।

হঠাৎ নিঃশ্বাস ফেলে হেসে উঠলেন মিসেস নাফিস।

বাবর বলল, চলুন, কফি খেতে খেতে কথা বলি।

কফি?

হ্যাঁ, কফি।

আপনি তো হুইস্কি ছাড়া কিছু খান না শুনেছি।

কার কাছে?

কেন, আপনারই কাছে। সেদিন অত করে বললাম চা খেতে।

খেয়েছিলাম তো। পরে নিজেই চেয়ে খেলাম না?

সেটা আপনার ভদ্রতা।

দাঁড়িয়ে কথা ভাল দেখায় না। চলুন।

কোথায়? বারে না রেস্তোরাঁয়?

দুটোর কোনোটাতে নয়।

তবে? আমার এক বন্ধু থাকে ওপরে। তার সুইটে চলুন। যাবেন? আমার খুব ভাল বন্ধু। আপনি কি চিনবেন? জামাল?

জামাল? জামাল শেখ?

না, জামাল চৌধুরী। জামাল শেখ কে বলুন তো?

চিনবেন না। আছেন একজন।

বাবর লিফটের বোতাম টিপল। জ্বলে উঠল একটা তীর। যেন সূক্ষ্ম বিদ্রুপ করে কেউ হাসতে লাগল কোথাও।

মিসেস নাফিস নাভি ভেতরে টেনে চোখ গোল করে বলে উঠলেন, সত্যি সত্যি ওপরে নিয়ে যাচ্ছেন নাকি?

হ্যাঁ।

না, না, ভাল দেখাবে না।

ছোট্ট একটা মেয়ের মত খিন খিন করে উঠলেন মিসেস নাফিস। কথাটা প্রতিবাদ নয়, সিদ্ধান্ত নয়-কিছুই নয়। বলার জন্য বলা। তাই দেখে বাবর হেসে ফেলল।

হাসছেন কেন?

না, কিছু না।

সে মুহূর্তে দরোজা খুলে গেল লিফটের। ভেতরে পা দিলেন মিসেস নাফিসই প্রথমে। বাবর এসে বোতাম চাপ দিল। নয়ের বোতাম।

নাইনথ ফ্লোরে?

হ্যাঁ।

কিছু যদি মনে করেন?

কিছু মনে করবেন না। আপনাকে দেখলে খুশি হবে। আর আমিও খুশি হবো যদি আমার জন্যে আপনার একটি বন্ধু বৃদ্ধি হয়।

তার মানে তার কাঁধে চাপাতে চাইছেন? এই জন্যেই আমরা মেয়েরা বলি, পুরুষ মানুষকে যত শেখাও যত পড়াও ভদ্র হয় না, সভ্য হয় না।

বাবর হঠাৎ বলল, আপনার ছেলের নাম হাসু?

হ্যাঁ, কী হয়েছে?

মিসেস নাফিসকে ভারি উদ্বিগ্ন দেখাল।

না, কিছু না। ভারি মিষ্টি নাম। আমার এক বোন ছিল তার নাম হাসনু।

কই, কোনোদিন বলেননি তো!

কী?

আপনার বোন আছে।

বলিনি। বলার কী আছে? বোন থাকাটা বিশ্বের কোনো আশ্চর্য ঘটনা নয়। হাসনু তুই যা।

কী বললেন?

শেষ কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবার পর টের পেয়েছে বাবর। এক মুহূর্ত বোকার মত তাকিয়ে রইল সে মিসেস নফিসের দিকে। পরে হেসে ফেলল। বলল, কই কিছু বলিনি তো!

লিফট এসে থামল। দরোজা খুলে গেল, যেন স্বপ্নলোকের দিকে। বাবরের মনে হলো জনশূন্যযানে তারা এখন রয়েছে।

করিডোরে পা রেখে মিসেস নাফিস বললেন, আজ খেয়েছেন?

সুরার কথা বলেছেন? হ্যাঁ, না। অতটা খাইনি।

থমকে দাঁড়াল মিসেস নাফিস। দাঁড়াল বাবর। মিসেস নাফিস জানলেন হাসল বাবর। এক পা পিছুলেন।

বাবর বলল, হাসু! হাসনু!

বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিলেন মিসেস নাফিস। খসখসে ভয়ার্তা গলায় উচ্চারণ করলেন, আজ কী হয়েছে আপনার?

হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল বাবর।

মিসেস নফিসের মনে হলো এই লোকটিকে এর আগে কোনোদিন দেখেননি। তিনি। আরো দুপা পিছুলেন। তারপর দ্রুত ছুটে গিয়ে লিফটের বোতামে চাপ দিলেন তিনি।

বাবর কিছু বলল না।

বর্ধমানের সেই অন্ধকার। সেই চিৎকার। সেই পোল। তার চারদিকে চক্রের মত ঘুরছে, ফেটে পড়ছে। আচ্ছন্ন হয়ে আসছে তার দৃষ্টি। হঠাৎ সে দেখে মিসেস নাফিস নেই। কখন চলে গেছেন।

তখন ধীর পায়ে ফিরে যেতে লাগল সে, বাবর নিজেও। তার বুকের মধ্যে এক ধরনের কান্না পকিয়ে উঠতে থাকল, যার পরিণামে কোনো শব্দ হয় না, অশ্রু হয়।

বাবর এসে তার বিছানায় শুয়ে বিড়বিড় করে অবিরাম ডাকতে লাগল, হাসু হাসনু, হাসুরে। আর দুহাত শূন্যে তুলে শূন্যতার মধ্যে হাসনুর মুখ নির্মাণ করে আদর করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *