১০. রাণী মন খারাপ করে ঘুমুতে গেছে

রাণী মন খারাপ করে ঘুমুতে গেছে। ঘুমুতে যাবার আগে সবার সঙ্গে কিছুক্ষণ রাগারাগি করেছে। সবচে বেশি করেছে তার ভাবীর সঙ্গে। রাণীর একটা সুবিধা আছে যার সঙ্গে সে রাগারাগি করে সে সেটা বুঝতে পারে না। সে ভাবে নিতান্তই স্বাভাবিক ভাবে কিছু কথা বলা হল। কারণ ঝগড়া করার সময় রাণীর মুখ হাসিখুশি থাকে। এ রকম স্বভাব তার আগে ছিল না। আগে রাগারাগির সময় তার মুখ লাল হয়ে যেত। হাত পা কাঁপতে থাকত। কলেজে ভর্তি হবার পর হঠাৎ একদিন মনে হল, আচ্ছা রাগারাগি হাসিমুখে করা যায় না। কঠিন কঠিন কথা হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বললে কেমন হয়? সেই থেকে সে নতুন পদ্ধতি চেষ্টা করে যাচ্ছে। শুরুতে পদ্ধতিটা ঠিকমত প্রয়োগ করা যেত না। এখন যায়। রাণী নিজেই নিজের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়। আজও হয়েছে। জাহানারাকে সে হাসতে হাসতে কঠিন কিছু কথা বলেছে। এই কথাগুলিই না হেসে সে যদি শুধু স্বাভাবিক গলায় বলতো তা হলে জাহানারা নিশ্চয়ই কেঁদে ফেলত।

রাণী রাতের খাওয়া শেষ করে তার ঘরে গিয়েছে। দাঁত মাজবে। মুখে ফেস ক্রিম দিয়ে গল্পের বই নিয়ে বিছানায় যাবে। গল্পের বই পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পরবে। রাতে আবার যখন ঘুম ভাঙ্গবে তখন বাতি নেভাবে। এই হল পরিকল্পনা। তখন জাহানারা ঢুকল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, এই তোর কাছে রিলাক্সেন জাতীয় কোন ট্যাবলেট থাকলে দেতো।

ভাবটা এ রকম যেন ট্যাবলেট নিয়েই ভাবী চলে যাবে। তার এক মুহূর্ত দাঁড়াবার সময় নেই। অথচ রাণী খুব ভাল করে জানে জাহানারা কোন প্ল্যান নিয়ে এসেছে। এবং এসেছে দীর্ঘ সময় কাটাতে। রাণী ভাবীর সঙ্গে রাগারাগি করার জন্যে মনে মনে তৈরী হল। সে মুখটা হাসি হাসি করে ফেলল। এবং এক ফাঁকে দেখেও ফেলল তার হাসিমুখ আয়নায় কেমন দেখাচ্ছে। সুন্দর দেখাচ্ছে তবে ঠোটে লিপস্টিক থাকলে আরো সুন্দর দেখাতো। সে হাসতে হাসতে বলল, ভাবী এ জাতীয় কোন ট্যাবলেট আমার কাছে নেই! ভিটামিন ট্যাবলেট আছে অ্যারিস্টোভিট বি। ওটা দেব।

ভিটামিন ট্যাবলেট দিয়ে আমি কি করব?

খাবে। মানুষের শরীরে ভিটামিন দরকার আছে না। তোমারতো আরো অনেক বেশি দরকার। এত টেনশান নিয়ে বাস করছ।

আমার কিসের টেনশান?

রাণীর মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হল। সে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। তার পরিকল্পনা হচ্ছে কথা বলার এক ফাঁকে সে চট করে ঠোটে লিপস্টিক দিয়ে দেবে। এমন ভাবে দেবে যেন ভাবী হঠাৎ গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিকের হাসি দেখব। রাণী ড্রেসিং টেবিলের সামনের চেয়ারে বসেছে। সে বসেছে জাহানারাকে পেছনে রেখে। জাহানারা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল এখন বসল। তার অর্থ হচ্ছে জাহানারা বেশ কিছুক্ষণ থাকবে।

জাহানারা বলল, তোর কথা ক্লিয়ার কর। আমার কিসের টেনশান?

তোমার বড় ভাইয়ের বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে টেনশান।

আমি তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাইয়ার বিয়ের কি জটিলতা?

জাহানারা জবাব দিল না। আয়নায় তার লাল ঠোটের হাসি দেখে নিজেই মুগ্ধ হল।

তুই এই লিপস্টিক কখন দিলি।

রাণী খিলখিল করে হাসল। তার হাসি দেখে মনে হবার কোনই কারণ নেই যে এই মুহূর্তে রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।

হাসছিস কেন বল ভাইয়ার বিয়ের কি জটিলতা?

এক সময় আমি শুনলাম তাঁর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা প্রায় ফাইন্যাল। বিয়ের বাজার করতে তুমি কোলকাতা যাবে এবং আমাকেও নিয়ে যাবে এরকম কথাও হল। আমি খুব খুশি—তোমার ভাইয়া ভ্যাবদা ধরনের মানুষ। এরা বর হিসেবে ভাল হয়। ক্যাঙ্গারুর বাচ্চার মত সারাজীবন স্ত্রীর থলির ভেতর থাকে। মাঝে মধ্যে থলির ভেতর থেকে মাথাটা বের করে আবার সুড়ৎ করে ঢুকে পরে…।

কি ভ্যার ভ্যার করছিস। আসল কথা বল।

আসল কথা হচ্ছে আমি যখন বিয়ে নিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত। বাসর রাতে বরের সঙ্গে কি কথা টথা বলব সে সব নিয়ে রিহার্সেল দিচ্ছি তখন হঠাৎ শুনি তিনি অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করতে রওনা হয়েছেন। আকাশী না-কি ফাকাশী এই রকম নাম।

জাহানারা গম্ভীর গলায় বলল, তুই যেমন হঠাৎ করে ভাইয়ার বিয়ের কথা শুনেছিস। আমরাও হঠাৎ করে শুনেছি। বাসার কেউ জানত না। ভাইয়া কাউকে কিছু বলে নি। আসলে ওরা ট্রিকস করে অসুস্থ একটা মেয়েকে পার করতে চেয়েছিল। মেয়ের এক মামা মহাচালবাজ। ভাইয়া সহজ সাধারণ মানুষ, ঐ ধুরন্ধরের চাল কিছু বুঝতে পারে নি। ফাদে পড়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে। বিয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হলে সমস্যা হবে এই জন্যে ওরা এমন চাল চেলেছে যে ভাইয়া কাউকে জানায়ও নি। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বিয়ে ঠিকই ভেঙ্গেছে।

রাণী বলল, শুধু যে ভেঙ্গেছে তাই না। কনের এমন অসুখ সে যে কোনদিন বিয়ের শাড়ি পরবে সেই আশাও নেই। ঠিক না ভাবী?

ঠিকতো বটেই। মেয়ের ক্যানসার হয়েছে। বড়জোড় এক দু বছর।

রাণী হাসতে হাসতে বলল, তাহলে কি আমি এক দু বছর অপেক্ষা করব? এত দিন অপেক্ষা করাওতো মুশকিল ভাবী। দেখা যাবে অন্য কোন মেয়ের ধুরন্ধর মামা তোমার ভাইয়াকে ভজিয়ে ভাজিয়ে বিয়ে করাতে নিয়ে যাবে। সেই মেয়েও অসুস্থ–হাঁপানীর রোগী। অসুস্থ মেয়েকে ট্রিকস করে পার করে দেয়া।

তোর হয়েছে কি হঠাৎ এইসব কথা আমাকে বলছিস কেন?

রাণী কিছুক্ষণ খিলখিল করে হাসল। এমন হাসি যে তার প্রায় হেঁচকি উঠে গেল। হাসি থামিয়ে বলল—একটা কাজ করলে কেমন হয় ভাবী। চল আমরা আক্তারী বেগমকে বলি যেন উনি একটা স্পেশাল দোয়ার ব্যবস্থা করেন যাতে আকাশী ম্যাডামের যন্ত্রণার দ্রুত সমাপ্তি হয়। তিনি যেন মাস তিনেকের মধ্যে সিন থেকে বিদেয় হন। আর আমরা ধুমধাম করে বিয়েটা করতে পারি।

হঠাৎ করে আমাকে এইসব কথা বলার কারণ কি?

কারণ হচ্ছে তুমি এই লাইনে চিন্তা করছ।

মেয়েটা মরে যাক আমি এই চিন্তা করছি?

তুমি চিন্তা করছ যেন তোমার ভাইয়ার সঙ্গে আমার ভেঙ্গে যাওয়া বিয়েটা আবার জোড়া লাগে।

পাগলের মত এইসব কি বলছিস?

খুবই সত্যি কথা বলছি। তুমি নিজেও জান এটা সত্যি কথা। জান না?

না জানি না।

মাঐমা হঠাৎ করে আমাকে একটা শাড়ি উপহার দিয়েছেন।

আমার মা তোকে একটা শাড়ি দিতে পারেন না?

উনি বলেছেন ফরহাদ ভাই শাড়িটা আমার জন্যে কিনে এনেছেন।

মাতো আর বাজারে গিয়ে শাড়ি কিনবে না। তার যা কেনাকাটা তা ভাইয়াকে দিয়েই করাতে হয়।

আমি শাড়ির প্যাকেট খুলে দেখি—শাড়িটা তোমার ভাই তার হবু স্ত্রী আকাশীর জন্যে কিনেছে।

শাড়িতে বুঝি তার নাম লেখা ছিল?

রাণী হাসতে হাসতে বলল, নাম লেখা ছিল না। তবে একটা চিঠি ছিল। আবেগপূর্ণ চিঠিটা পড়বে?

জাহানারা তাকিয়ে আছে। রাণী বলল, ভাবী তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি—তোমার ভাইয়াকে আমার খুবই অপছন্দ। তোমরা যখন তার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা শুরু করলে তখনই রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। যেহেতু আমি খুবই শান্ত এবং টাইপ মেয়ে সেহেতু চুপ করে ছিলাম। মনে মনে ভেবেছি–কি আর করা। কপালে যা আছে হবে। সেই ব্যাপার তোমরা আবার শুরু করেছ। এখন আর রাগ লাগছে না। এখন মজা লাগছে।

জাহানারা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোর সঙ্গে এই নিয়ে পরে কথা হবে।

ভিটামিন ট্যাবলেট দেব ভাবী?।

জাহানারা গম্ভীর মুখে চলে গেল। রাণী ঠোটের লিপস্টিক মুছল। হাত মুখ ধুয়ে গল্পের বই নিয়ে বিছানায় চলে গেল। গল্পের বইয়ের ভেতরে ফরহাদ ভাইয়ের চিঠিটা আছে। গল্পের বই পড়া শুরু করার আগে চিঠিটা কি আরেকবার পড়বে? চিঠিতে এমন কিছু নেই কিন্তু পড়তে গেলে হঠাৎ করে কেন জানি মন খারাপ হয়–

আসমানী,

তোমাকে বিয়ের শাড়ি হিসেবে খুব সস্তা ধরনের শাড়ি দিচ্ছি। সস্তা শাড়ি কেনার একমাত্র কারণ অর্থনৈতিক। আমার ভয়ংকর দরিদ্র অবস্থা দেখে তুমি যে কত বড় ধাক্কা খাবে সেটা ভেবে খুব আতংকগ্রস্ত।

শাড়িটা সস্তা হলেও রঙটা খুব সুন্দর। তুমি হচ্ছ আসমানী। আমি অনেক খুঁজে খুঁজে আসমানী রঙের শাড়িটা বের করলাম। শাড়িটা যখন পড়বে তখন মনে হবে এক টুকরা আকাশ পৃথিবীতে নেমে এসেছে। আসমানী এখন বলতো একটা গাছে দশটা পাখি ছয়টা উড়ে গেল কটা থাকল?

রাণী চিঠি বইয়ের ভেতর রেখে চিঠির ধাঁধার রহস্য বের করার চেষ্টা করতে লাগল। এই ধাঁধার অর্থ কি? এটা ধাঁধা না কোড ল্যাংগুয়েজ? খুব ইচ্ছা করছে ফরহাদ ভাইকে জিজ্ঞেস করতে। সেটা সম্ভব না।

রাণীর মন খারাপ হওয়া শুরু হয়েছে। তার ভয় লাগছে। একবার তার মন খারাপ হওয়া শুরু করলে দ্রুত মন খারাপ হতে থাকে। এবং এক সময় এত বেশি মন খারাপ হয় যে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে একগাদা ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছাটা এত প্রবল যে ইচ্ছাটা চলে যাবার পরেও তার হাত পা কাঁপতে থাকে। শরীর ঘামতে থাকে। সে জানে এটা ভয়ংকর কোন অসুখ। এই অসুখ থেকে তার মুক্তি নেই।

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। ফরহাদ নামের একজন মানুষ তার ভেতরে এই অসুখটা তৈরী করে দিয়েছে। যে অসুখটা তৈরী করেছে সে কিন্তু কিছুই জানে না। তার জানার কোন কারণও নেই। এবং সে কোনদিনও জানবে না। কোন একদিন হয়ত সে খবর পাবে রাণী নামের একটা মেয়ে বাথরুমে মারা গেছে। বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে ডেড বডি বের করতে হয়েছে। মানুষটা হয়ত সৌজন্যবশত মরা বাড়িতে আসবে। দুএকটা সান্তনার কথা বলবে হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। সব মানুষকে একদিন মরতে হবে ইত্যাদি। মানুষটা জানবেও না রাণী নামের এত ভাল একটা মেয়ে কেন শুধু শুধু মরে গেল? কারণ সে কোন চিঠিপত্র লিখে যাবে না।

তবে চিঠি লিখতে পারলে সে খুব গুছিয়ে লিখে বলতে পারত কি করে ফরহাদ নামের খুবই সাধারণ একজন মানুষ তার ভেতরে এত বড় সমস্যার সৃষ্টি করল। চিঠিটা সে ফরহাদকেই লিখত। সুন্দর খামে ভরে রাখত। বাসর রাতে মিষ্টি মিষ্টি কথা না বলে গম্ভীর মুখে বরের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেয়া। বিয়েই হচ্ছে না। কিসের বাসর, কিসের চিঠি। ঘটনাটা এরকম—

রাণী যথারীতি কলেজে গিয়েছে। গাড়ি তাকে কলেজ গেটে নামিয়ে চলে গেছে। অন্য দিনের চেয়ে আজ তার সাজগোজ সামান্য বেশি। শাড়ি পরেছে, কপালে টিপ দিয়েছে। প্রিন্সিপ্যাল আপা বলে দিয়েছেন কলেজের মেয়েরা ঠোটে লিপস্টিক দিতে পারবে না। তারপরেও সে হালকা করে লিপস্টিক দিয়েছে। কারণ আজ তার অতিপ্রিয় বান্ধবী রীতার জন্মদিন। ক্লাসের শেষে তারা দলবেধে গুলশানে যাবে। গুলশানে একটা দোকানে সাউদার্ন ফ্রায়েড চিকেন খাওয়া হবে। তারপর রীতার বাসায় যাওয়া হবে। সেখানেও অনেক হৈ চৈ এর ব্যবস্থা। সেলিম চৌধুরী নামের এক গায়ককে খবর দেয়া হয়েছে। তিনি হাসন রাজার গান করবেন।

রাণী কলেজে ঢুকতে গিয়ে দেখে গেট বন্ধ। দারোয়ান বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, আপা তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান। শহরের অবস্থা ভাল না। গন্ডগোল হবে। বিরাট গন্ডগোল।

কিসের গন্ডগোল?

কিসের গন্ডগোল বলতে পারব না। বাসায় চলে যান।

রাণী কি করবে বুঝতে পারছে না। রীতার জন্যে কি অপেক্ষা করবে? ক্লাসের মেয়েরাও অবশ্যই আসবে। গন্ডগোলের কথা তারা নিশ্চয় জানে না, কলেজে এসে জানবে। রাণী আবারো গেটের কাছে ফিরে গেল। দারোয়ানকে বললে সে যদি ছোট গেটটা খুলে দেয়। তাহলে সে কলেজ কম্পাউন্ডের ভেতরে অপেক্ষা করতে পারবে। প্রিন্সিপাল আপার অফিস থেকে টেলিফোন করা যেতে পারে। বড় ভাইজানের অফিসে টেলিফোন করলে তিনি গাড়ি পাঠিয়ে দিবেন।

গেট পর্যন্ত যাবার আগেই হঠাৎ করে ভয়াবহ ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। নিউ মার্কেটের দিক থেকে চোখের নিমিষে একটা জঙ্গী মিছিল চলে এল। বিকট শব্দে কয়েকটা বোমা পড়ল। গাড়ির কাচ ভাঙ্গা-ভাঙ্গি শুরু হয়ে গেল। মিছিলের লোকজনের হাতে বড় বড় বাঁশ। অনেকের হাতে কেরোসিনের টিন। গাড়ি ভেঙ্গে গাড়িতে আগুন দেবার ব্যবস্থা। বাঁশ হাতে লোকগুলি এমন ভাবে ছোটাছুটি করছে যেন এরা মানুষ না। অতি হিংস্র ভয়ংকর কোন প্রাণী।

লোকজন যে যেদিকে পারছে ছুটছে। একটা লোক বাশ হাতে রাণীর দিকে আসছে। রাণীর মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। আর তখনি সে দেখে ফরহাদকে। অবাক হয়ে ফরহাদ ভাই জঙ্গী মিছিল দেখছেন। অবাক হয়ে দেখার মতই দৃশ্য। একটা বাস পুড়ছে। বাস ভর্তি লোকজন। বাস থেকে তারা লাফিয়ে নামার চেষ্টা করছে।

রাণী ছুটে এসে ফরহাদকে বলল, আপনি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিন। আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি।

ততক্ষণে উল্টো দিক থেকে আর একটা মিছিল আসতে শুরু করেছে। সেই মিছিলে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তারা আসছে ধীরে ধীরে তবে এই মিছিল মনে হচ্ছে আগেরটার চেয়েও ভয়াবহ। কারণ এদের কয়েক জনের হাতে খোলা বন্দুক। দিনের বেলায়ও হাতে মশাল।

ফরহাদ রাণীকে বলল, চলুন কোন একটা গলিতে ঢুকে পড়ি।

রাণী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলুন। আমি হাঁটতে পারছি না। আমার শরীর শক্ত হয়ে গেছে।

ফরহাদ তাকে নিয়ে প্রথমে একটা গলিতে ঢুকল। সেখান থেকে অন্য একটা গলি দিয়ে বড় রাস্তায়। সেই রাস্তায় কোন গন্ডগোল নেই, সব স্বাভাবিক। দোকান পাট খোলা। একটা দোকানে আবার হিন্দী গানও হচ্ছে। রিক্সা চলছে। ফরহাদ বলল, আপনার ভয় কি একটু কমেছে?

রাণী বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল। ফরহাদ ভাই আসলে তাকে এতক্ষণ চিনতে পারেন নি। তাকে অন্য কোন মেয়ে ভাবছেন বলেই আপনি আপনি করে বলছেন। ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে তার খুব বেশি দেখা হয় নি তার পরেও চিনতে না পারার তো কথা না। রাণী শাড়ি পরেছে বলে কি তাকে অন্য রকম লাগছে?

ফরহাদ বলল, আপনাকে এখন একটা রিক্সা করে দিলে আপনি বাসায় যেতে পারবেন না?

রাণী বলল, পারব না। আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। তার আগে আমি এক গ্লাস পানি খাব।

ফরহাদ বলল, আপনার বাসা কোন দিকে?

এই প্রশ্নে রাণী পুরোপুরি নিশ্চিত হল ফরহাদ ভাই তাকে মোটেই চিনতে পারেন নি। ব্যাপারটা খুবই মজার। এত পরিচিত একজন মানুষ তাকে চিনতে পারছে না। আশ্চর্যতো!

রাণী বলল, খালি পায়ে আমি বাসায় যেতেও পারব না। আমাকে আপনি দয়া করে কোন একটা জুতার দোকানে নিয়ে যান। আমি একজোড়া স্যান্ডেল কিনব।

আগের স্যান্ডেল কোথায়?

কে জানে কোথায়। আমি স্যান্ডেল ফেলেই দৌড় দিয়েছি।

আপনার ভয় কি কমেছে?

সামান্য কমেছে। পুরোপুরি কমেনি। খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। এক গ্লাস পানি খাব আর স্যান্ডেল কিনব।

স্যান্ডেল না কিনলে হয় না? যে কোন সময় গন্ডগোল শুরু হবে।

শুরু হলেও এখন আমার ভয় লাগবে না। আপনার কি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে কোন আপত্তি আছে?

একটা রিক্সা নিন, আমি খালি পায়ে হাঁটতে পারছি না। এখন পানি না খেলেও হবে। আমার পিপাসা মরে গেছে।

ফরহাদকে দেখে মনে হল সে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। রিক্সায় বসেছে খুব। সাবধানে যেন কিছুতেই গায়ের সঙ্গে গা লেগে না যায়। কেমন ব্ৰিত ভঙ্গিতে চারদিকে তাকাচ্ছে। মানুষটা মনে হয় কখনো কোন তরুণী মেয়েকে নিয়ে রিকশায় উঠে নি।

রাস্তায় আইসক্রীমওয়ালার এক ভ্যান গাড়ি দেখা গেল। রাণীকে অবাক করে দিয়ে ফরহাদ বলল, আইসক্রীম খাবেন?

রাণী আইসক্রীম কখনো খায় না। প্রথমত আইসক্রীম খেতে তার ভাল লাগে না। দ্বিতীয়ত তার টনসিলের সমস্যা আছে। ঠাণ্ডা কিছু খেলেই তার গলা ফুলে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে। তারপরেও সে স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যাঁ আইসক্রীম 3791

রাণী সেদিন বেশ কিছু কাণ্ড করল যেমন, স্যান্ডেল কেনার পর তার মনে হল, তার লেখার বল পয়েন্ট নেই। বল পয়েন্ট কিনতে হবে। সে ফরহাদকে নিয়ে বল পয়েন্ট কিনতে গেল। তারপর মনে হল রীতার জন্যে গিফট কেনা হয় নি। গিফট এবং ফুলের তোড়া কিনতে হবে। সে ফরহাদকে সঙ্গে নিয়ে গিফট কিনল। তারপর ফরহাদকে বলল তাকে রীতার বাসায় পৌঁছে দিতে।

রীতাদের বাসায় যাবার সারা পথটা রাণী গল্প করল। নানান গল্প–

আমি এখন যেখানে যাচ্ছি সেটা আমার বাসা না। আমার বন্ধুর বাসা। ওরা নাম রীতা। আজ রীতার জন্মদিন। রীতাদের বাসা থেকে আমি বড় ভাইজানকে টেলিফোন করব। তিনি গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাবেন। রীতার বাবাকে আমরা কি ডাকি জানেন? আমরা ডাকি ফুটবল কোচ। কেন ডাকি জানেন? কারণ রীতারা এগারো ভাই বোন। এই সময়ে কোন ভদ্রলোকের এগারো ছেলে-মেয়ের কথা কখনো শুনেছেন? রীতার বাবার দলে এগারো জন প্লেয়ার আছে বলেই ওনাকে আমরা ডাকি ফুটবল কোচ। নামটা ভাল হয়েছে না?

হুঁ।

আচ্ছা শুনুন। আপনিও চলুন না রীতাদের বাসায়?

আমি আমি কেন?

ওদের বাড়িতে অনেক মজা হবে। গানের আসর হবে। সেলিম চৌধুরী নামে একজন গায়ককে খবর দেয়া হয়েছে। উনি হাসন রাজার গান শুনাবেন। আপনি কি হাসন রাজার গান শুনেছেন।

একটা দুটা শুনেছি।

হাসন রাজার আসল নাম কিন্তু হাসন রেজা। রেজা নাম তার পছন্দ হল না। তিনি সবাইকে বলে দিলেন—আমাকে এখন থেকে কেউ রেজা ডাকবে না। আমাকে ডাকতে হবে রাজা। সেই থেকে তিনি রাজা।

ও।

রীতাদের বাসার সামনে বেবীটেক্সি থেকে নামার সময় একবার রাণীর ইচ্ছা হল নিজের পরিচয় দিতে। তারপরেই মনে হল —থাক কি দরকার। কোন এক সময় মানুষটাকে এই ঘটনা বলে চমকে দেয়া যাবে।

তার পরপরই রাণীর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। তার বড় ভাই আসগর সাহেব বোনের বিয়ের পাকা কথা দিয়ে ফেলেন। ছেলে ডাক্তার। ছেলের বাবা বড় ব্যবসায়ী। ব্যবসা সূত্রে ছেলের বাবার সঙ্গে আসগর সাহেবের পরিচয়।

ছেলে তার বন্ধু বান্ধব নিয়ে মেয়ে দেখে গেল। মেয়ে তাদের পছন্দ। যেদিন বিয়ের তারিখ ঠিক হবে সেদিন রাণী অসীম সাহসের পরিচয় দিল। একা একা তার বড় ভাইয়ের অফিসে উপস্থিত হল। আসগর সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কি ব্যাপার তুই এখানে কেন?

রাণী ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল, তার এই বিয়েতে মত নেই। এখানে বিয়ের তারিখ হলে সে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মরে যাবে।

আসগর সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, তোর কি পছন্দের কেউ আছে? চোখ মোছ। চোখ মুছে স্বাভাবিক গলায় কথা বল। আছে কেউ?

রাণী বলল, না।

এমন কোন ছেলে কি আছে যার সঙ্গে ভাব হয়েছে? টেলিফোনে কথা হয় বা চিঠি চালাচালি হয়?

না।

তাহলে এখানে বিয়ে হতে অসুবিধে কি? ছেলে দেখতে সুন্দর। ডাক্তার। টাকা পয়সা আছে। ফ্যামিলি ভাল।

রাণী চুপ করে রইল। আসগর সাহেব বললেন, পছন্দের কেউ না থাকলে যেখানে বিয়ে ঠিক করেছি সেখানেই বিয়ে হবে। চোখের পানি ফেলে লাভ হবে না। চোখের পানির দাম দশ নয়া পয়সা।

রাণী আবার ফুঁপাতে শুরু করল। ফুঁপানির মধ্যেই কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তার খুব পছন্দের একজন মানুষ আছে। মানুষটা হল জাহানারা ভাবীর ভাই। ফরহাদ ভাই।

আসগর সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, তার সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?

রাণী বলল, না।

টেলিফোনে কথা হয়?

কখনো কথা হয় নি।

চিঠি লেখালেখি?

না।

ফরহাদ সাহেব কি তোর পছন্দের ব্যাপার জানেন?

না।

সত্যি কথা বল।

সত্যি কথাই বলছি। উনি কিছুই জানেন না।

কথাবার্তা চলাকালিন সময়ে রাণী এক মুহূর্তের জন্যেও ফুঁপানি বন্ধ করল না। শাড়ির অর্ধেকটা সে চোখের পানিতে ভিজিয়ে ফেলল। আসগর সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, কান্না বন্ধ কর। আমি ব্যবস্থা করছি। তবে কেউ যেন জানতে না পারে যে ছেলে তোর নিজের পছন্দ। যদি জানে আমি টান দিয়ে তোর জিব ছিঁড়ে ফেলব। নিজেই ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেব। আমি বলব, ছেলে আমাদের নিজেদের পছন্দ। পারিবারিক ভাবে পছন্দ। এখন তুই আমার সামনে থেকে যা। তোর মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না।

রাণীর বড় ভাই তার কথা রেখেছিলেন। তাদের হিসাব মতে অতি অপদার্থ একজন ছেলের সঙ্গে বোনের বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টায় কোন লাভ যে হয় নি তা না। একটা লাভ হয়েছে—রাণীর ভয়ংকর এক অসুখ হয়েছে। অসুখের লক্ষণ হল তাকে হঠাৎ হঠাৎ বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে ইচ্ছা করে। অতি সামান্য একটা ব্যাপার থেকে এত বড় অসুখ কেন হল সে জানে না। কোনদিন হয়ত জানবেও না।

রাণী গল্পের বইটা খুলল। বইয়ের ভেতর থেকে চিঠিটা আবার বের হয়ে এসেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে—এমন একটা চিঠি যদি তার কাছে লেখা হত। কিংবা এমন যদি হত সে রাণী না, তার নাম আসমানী…

রাণীর চোখ ভিজে উঠছে। কিছুক্ষণ আগেই সে অনেক হাসাহাসি করেছে এখন চোখে পানি আসবেই। কিচ্ছু করার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *