এবার রবীন্দ্রনাথের মেয়েদের কথায় আসা যাক। ঠাকুরবাড়ির অন্য মেয়েরা যথেষ্ট বড় হয়েছেন এমন সময় একে একে এলেন তিন কন্যা—মাধুরী, রেণুকা, অতসী। যেন তিনটি পদ্ম ফুলের কুঁড়ি। বড় মেয়ের নাম মাধুরীলতা, কবির বড় আদরের বেলা, বেলি বা বেলুবুড়ি। ফরসা রঙ, অপরূপ সুন্দর মুখ। ছাব্বিশ বহরের পিতা রবীন্দ্রনাথের মনের আয়নায় ধরা পড়েছে তার বিচিত্র অভিব্যক্তি। কিছু চিঠিপত্র ও স্মৃতিকথা ছাড়াও বেলার এই বয়সটা চিরকালের মতো ধরা আছে কাবুলিওয়ালা গল্পের মিনির মধ্যে।
ঠাকুরবাড়ির মেয়ে হয়েও মাধুরীলতা মানুষ হয়েছেন স্বতন্ত্র ধরনে। তা স্বতন্ত্র বৈকি। সত্যেন্দ্র বা হেমেন্দ্রর মেয়েদের মতো ধরাবাঁধা বিলিতি স্কুল লরেটোতে পড়েননি তিনি। এমনকি দেশী স্কুল বেথুনেও না। পড়েছেন বাড়িতে। তিনজন ইংরেজ শিক্ষয়িত্রী, লরেন্স সাহেব ও হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে শিখতেন লেখাপড়া। এছাড়া পড়তেন বাবার কাছে। স্কুলে পাঠাননি বলে কবি যে মাধুরীকে কিছু শেখাতে বাকি রেখেছিলেন তা নয়। দেশী-বিলিতি গান, সাহিত্য, এমন কি নার্সিং পর্যন্ত শিখিয়েছিলেন।
মাত্র একত্রিশ বছর বেঁচেছিলেন মাধুরীলতা। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনের ইতিবৃত্ত সকলেরি জানা কারণ তিনি রবীন্দ্র-দুহিত। পিতা রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপলব্ধি বেলাকে কোলে নিয়েই। তাই তাকে নিয়ে তার কত আশা কত আশঙ্কা! কত স্বপ্ন কত সাধ! পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে বেলা কবির সবচেয়ে প্রিয়। বাবার মন বলে বড় হয়ে বেলি খুব লক্ষ্মী মেয়ে হবে। হয়েছিলেনও তাই। একটু বড় হতেই মাধুরী বুঝেছিলেন, আমি যা করব আমার ভাইবোনেরা তাই দেখে আমার দৃষ্টান্ত অবলম্বন করবে। আমি যদি ভাল না হই, তবে ওদের পক্ষে, আমার পক্ষেও মন্দ! মাধুরী জানতেন তিনি দিদিদের মতো বিশেষ করে ইন্দিরার মতো গুণবতী নন। কিন্তু তার চেষ্টা যদ্দুর পারি ভাল হব।
শিলাইদহের একঘেয়েমিতে মৃণালিনীর মতোই হাঁপিয়ে উঠতেন মাধুরী। দিন যেন কাটে না। অভিযোগ ঝরে পড়ে বাবার বিরুদ্ধে। রবীন্দ্রনাথকে সরাসরিভাবে তাক্রমণ করার সাহস কারুর নেই। কিন্তু মাধুরীলতা তারই মেয়ে। তাই বাবাকে চিঠি লেখেন :
তোমার একলা মনে হয় না, কেননা তুমি ঢের বড় বড় জিনিষ ভাবতে, আলোচনা করতে, সেগুলোকে নিয়ে একরকম বেশ কাঁটাও। আমরা সামান্য মানুষ, আমাদের একটু গল্পগুজব মানুষজন নিয়ে থাকতে এক একসময় একটু আধটু ইচ্ছে করে। আর যদি তুমি এখানে এসে আর নড়তে না চাও তবে তুমি যে যে মহৎ বিষয় নিয়ে থাকে। তাই সব আমাদের একটু একটু দাও।
ভাবতে অবাক লাগে, মাধুরী যখন এ চিঠি লিখছেন তখন তার বয়স চোদ্দও পুরো হয়নি। তখন থেকেই তিনি পিতার দার্শনিক চিন্তার শরিক হতে চেয়েছেন।
মাধুরীর চোদ্দ বছর বয়স হতেই তার বিয়ের জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। মনের মতো ছেলে পাওয়া কি এতই সোজা? তার ওপর মোটা বরপণ আছে। বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের ওপর পড়ল পাত্র খোঁজার ভার। যখন কথাবার্তা। ফলপ্রসূ হয় না তখন বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে লেখেন, বৃথা চেষ্টায় নিজেকে ক্ষুব্ধ কোরো না। আবার লেখেন, নদী যেমন চলতে চলতে একসময়ে সাগরে গিয়ে পড়েই, সেইরকম বেলা যথাসময়ে তার স্বামীকুলে গিয়ে উপনীত হবে। কিন্তু এ তো সান্ত্বনা। এভাবে বসে থাকলে তো মেয়ের বিয়ে হয় না। অবশেষে সুপাত্রের সন্ধান মিলল। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর পুত্র শরৎ-কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র। দর্শনে অনার্স নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে। পেয়েছেন কেশব সেন স্বর্ণপদক। তারপর মেন্টাল এ্যাণ্ড মর্যাল সায়েন্সে এম. এ., তাতেও প্রথম। এখন ওকালতী পাশ করে মজঃফরপুরে প্র্যাকটিস করছেন। সব দিক থেকেই মনোমত পাত্র। কবি বিহারীলালের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণ প্রথম জীবন থেকে সেই তিন তলার ছাদ, ফুলের বাগান, জ্যোতিদাদার সাহিত্য মজলিশ, বৌঠানের প্রিয় কবি বিহারীলালের উদাত্ত, হাসি, সাধের আসন—সব যেন মনে পড়ে। এখন বিহারীলাল নেই, তার ছেলে। কি তার মতোই স্বভাব পাবে না?
শরতের মা মোটা বরপণ দাবি করলেন। বিয়ে হবে ব্রাহ্ম মতে। কবি তখনও সংস্কারক হননি। মেয়ের সুখের জন্য ক্ষুব্ধ অভিমানে বরপণের দাবিও মেনে নিলেন। সম্মত হলেন দশ হাজার টাকা দিতে। গুরুজনদের প্রতি কোনরকম বিরুদ্ধাচরণ করে শরৎ এ বিয়েতে মত দিতে চাননি, কবিও না, তাই পণের টাকা নিয়ে কোন পক্ষই কিছু ভাবেননি। এর আগে বলেছি, মহর্ষি মেয়েদের বিয়েতে যৌতুক দিতেন তিন হাজার টাকা, এবারে দিলেন পাঁচ হাজার। বাকিটা দিলেন কবি। পণের টাকা দেওয়া নিয়েও বিস্তর লেখালেখি হল। বিয়ের কথা পাকা হবার পরেও বাধা এসেছিল, কারণ শরৎত্রা যে শ্রেণীর ব্রাহ্মণ, তার সঙ্গে মাধুরীর বিয়ে কুটুম্বদের মনঃপূত হয়নি। অবশ্য এসব আপত্তি কবি গায়ে মাখলেন না।
বিয়ের পর মাধুরী স্বামীর প্র করতে গেলেন মজঃফরপুরে। সেখানে ওরকম যৌতুক নিয়ে ঘরবসত করতে কেউ আসেনি। অপর্যাপ্ত শাড়ি, গয়না, অসামান্য রূপ। তার ওপর মাধুরীর মধুর ব্যবহারে সমস্ত মজঃফরপুরবাসী বাঙালী বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এর ওপর অতিথিরূপে এসেছেন মাধুরীর কবিপিতা। লোক সমাগমের যেন শেষ নেই। এত ঝঞ্চাটের মধ্যেও কবি খুশি হয়েছিলেন জামাই হিসেবে শরৎকে পেয়ে স্ত্রীকে লিখলেন, এমন সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য জামাই তুমি হাজার খুঁজলেও পেতে না। অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন মেয়েকে; মাধুরী উত্তরে লিখেছেন, এ বাড়ির মেয়ে বলে উনি আমাতে অনেক সদগুণ আশা করেন, তাতে যাতে না নিরাশ হন আমি সেই চেষ্টা করব।
মাধুরীর চেষ্টা সফল হয়েছিল। সতেরো বছরের দাম্পত্য জীবনে সুখী হয়েছিলেন শরৎ ও মাধুরী। মজঃফরপুরের জীবনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে নিশ্চয় কষ্ট হয়েছিল মাধুরীর। লেখিকা অনুরূপা দেবীর সঙ্গে এ সময় মাধুরীর আলাপ হয়। দুজনের স্বামীরা ছিলেন দুই বন্ধু। সেই সূত্রে বন্ধুত্ব। বিয়ের সময় অনুরূপা মজঃফরপুরে ছিলেন না। ফিরে এসে মাধুরীকে দেখলেন এক স্নিগ্ধোজ্জল চৈত্র অপরাহ্নে। দেবকন্যার মতোই অপরূপা। সকলেই তার গুণে মুগ্ধ। মাধুরীর গৃহিণীপণার গল্প আর করব না। কবির চিঠিতে তার উল্লেখ আছে। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা, শুধু ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা কেন, বাঙালী মেয়েরা গৃহিণীপণায় খুব পটু। সুতরাং অন্য প্রসঙ্গে আসি।
বিহারে তখন প্রচণ্ড পর্দার যুগ চলছে। সেই পর্দা ভেদ করে মেয়েদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছয় না। এইরকম জায়গায় এসে মাধুরী কি শুধু আপন সংসারটিকে নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকতে পারেন? না পারা সম্ভব? বিশেষ করে মাধুরী সেই ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, যে মেয়ের জ্ঞানের আলো জ্বালাতে বারবার এসে দাঁড়িয়েছেন পুরুষের পাশে। মজঃফরপুরে যদিও শরৎকে কোন সমাজ-সংস্কারের কাজে মগ্ন হতে দেখা যায়নি তবে স্ত্রীর ইচ্ছেয় তিনি বাধাও দেননি। তাই মাধুরী কাজ শুরু করে দিলেন অনুরূপাকে সঙ্গে নিয়ে। কলকাতায় তিনি দেখে এসেছেন নারী শিক্ষা প্রসারের চেষ্টা, দেখেছেন তার দিদিরা কেমন মেতে উঠেছেন জনসেবার কাজে। এখানেও রয়েছে অনেক কাজ। মেয়েরা একেবারে অশিক্ষিত, ঘোর পর্দার আড়ালে তাদের জীবনের সবটাই প্রায় ঢাকা। এমন উপযুক্ত পরিবেশে শিক্ষার বীজ বপন করতেই হবে। সখী অনুরূপাকে নিয়ে মাধুরী সেখানে গড়ে তুললেন লেডিজ কমিটি, যুগ্ম সম্পাদিকা হলেন দুজনেই। তারপর প্রতিষ্ঠা করলেন একটা গালস স্কুল, চ্যাপম্যান বালিকা বিদ্যালয়। স্কুল তো হল, ছাত্রী কই?
মজঃফরপুরে ছাত্রী জোগাড় করা সহজ নয়। বাংলার তুলনায় বিহারের মেয়েরা তখনও পেছনে পড়ে আছেন। মাধুরীর সমসাময়িককালেই বিহারের মেয়েদের কথা আরো অনেক বেশি ভেবেছিলেন অঘোরকামিনী রায়। তার অক্লান্ত চেষ্টায় বাঁকিপুরের মেয়েদের অবস্থা কিছু বদলেছে। তিনি নিজের কাছে মেয়েদের রেখে তাদের একটু একটু করে শিখিয়েছেন। এভাবেই প্রথম পনেরোজন শিক্ষিত হয়ে ওঠে। অঘোরকামিনীর সঙ্গে সঙ্গে কাজ করতেন। তার মেয়েরাও। বিহারের মেয়েরা থাকত পর্দার আড়ালে। পর্দা প্রথা দূর করবার জন্যে অঘোরকামিনী ব্ৰহ্মসঙ্গীত গাইতে গাইতে মেয়েদেব নিয়ে পথে বেরোতেন। সে এক দৃশ্য! তাদের সমবেত সঙ্গীত সাহস জোগাত অন্যদের, একটু একটু করে খুলে যেত বন্ধ দুয়ার। অবশ্য অঘোরকামিনীর মতো সমাজ সেবিকার সঙ্গে মাধুরীর কোন তুলনা হয় না। কতই বা বয়স তার? কদিনই বা ছিলেন মজঃফরপুরে? এসময় আরো একজন মহিলা ভাগলপুরের মেয়েদের দুরবস্থা দূর করতে এগিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু পারেননি। তাঁর নাম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনিও বাংলারই মেয়ে। বিয়ে হয়েছিল ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। বিদুষী স্ত্রীকে তিনি লেখাপড়া ও বইলেখার কাজে উৎসাহ দিতেন। মৃত্যুকালে একটা মেয়েদের স্কুল স্থাপন করে স্ত্রীকে তার ভার দিয়ে যান। মাত্র পাঁচটি মেয়ে ও একজন শিক্ষিকা নিয়ে স্কুলের কাজ শুরু করেন রোকেয়া। কিন্তু সেখানে বিশেষ করে মুসলমান সমাজের অবস্থা তখন অবর্ণনীয়। বোরখার অন্ধকারে হাঁফিয়ে উঠে কত মেয়ে যে ছটফট করত কে তার হিসেব রাখে! বিয়ে-সাদী স্থির হলে মেয়েকে ছয় কি সাত মাস রাখা হত অন্ধকার ঘরে। দিন-রাত আটক থাকতে থাকতে কেউ হারাত স্বাস্থ্য, কেউ হারাত জীবন, কেউ হারাত দৃষ্টিশক্তি, তবু পর্দা এতটুকু ফাঁক হত না। এদের ভাল করার সাধ্য একা রোকেয়ার ছিল না। স্বামীর স্মৃতি রক্ষার জন্যে তাকে স্কুলটি তুলে নিয়ে চলে আসতে হয় কলকাতায়। তবে ভাগলপুরে মেয়েদের জন্যে কিছু কাজ করতে পেরেছিলেন। দীপনারায়ণ সিং-এর স্ত্রী লিলিয়ান বা লীল। ভাগলপুরের পাশেই তো মজঃফরপুর। সেখানে দুটি সংসার-অনভিজ্ঞা কিশোরী বধূ কি করে স্কুল চালাবেন!
অনুরূপা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিতে চান কিন্তু মাধুরীর ধৈর্য অসাধারণ। সখীকে টেনে নিয়ে ঢাকা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে মাধুরী বাড়ি বাড়ি ঘুরতে শুরু করলেন। মেয়েরা তখনও অসূর্যম্পশ্যা। তাদের মনে বিশ্বাস উৎপাদন করবার জন্যে মাধুরীদের লুকোতে হত আড়ালে। গাড়ি থেকে নামার সময় দুদিকে চাদর ধরে আড়াল করা পথ দিয়ে তাঁরা গৃহস্থবাড়ীতে ঢুকতেন। কেন এই প্রয়াস? তারা তোত অসূর্যম্পশ্যা নন। তবু বিশ্বাস আনতে হবে তো। খণ্ডন করতে হবে বিবিয়ানার অপবাদ। আপনজনের সামনেই তো খুলবে মনের বদ্ধ দুয়ার, তাই ছোট শহরের সামাজিক রীতিকে উপেক্ষা করলেন না মাধুরী। একটু একটু করে সত্যিই দরজা খুলতে লাগল। মজঃফরপুরে বেশিদিন থাকলে মাধুরীও নিশ্চয় সমাজসেবিকা হিসেবে নাম করতেন! কিন্তু স্ফুলিঙ্গ দাবানলে পরিণত হবার আগেই পট পরিবর্তন হল! মাধুরী ফিরে এলেন কলকাতায়।
মাধুরীর লেখাপড়ার দিকে নজর ছিল রবীন্দ্রনাথের। তাই বোধহয় লেখার হাত খুলেছিল প্রথম থেকেই। চিঠিগুলোই তার প্রমাণ। এছাড়াও তার আটটা রচনার খোঁজ পাওয়া গেছে। মনে হয় এ সময়েই কবি মৃণালিনীর অসমাপ্ত রামায়ণটা মেয়ের হাতে তুলে দেন। শরৎ ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেতে গেছেন। অবসর সময়ে মাধুরী শান্তিনিকেতনে বাচ্চাদের পড়াতেন। গল্প লেখার শুরুও এখানে অনুবাদ ছাড়া তিনটে গল্পে নতুনত্ব এবং শক্তির পরিচয়। পাওয়া যায়। আত্মপ্রকাশে কুণ্ঠিত মাধুরীকে লিখতে বলতেন অনুরূপাও। তারপর বাবার উৎসাহে লিখে ফেললেন সুয়ো, মাতশত্রু, সৎপাত্র, অনাদৃতা, চোর প্রভৃতি গল্প। ছাপা হয়েছিল ভারতী, প্রবাসী ও সবুজপত্রে। অবশ্য সে আরো পরের কথা। তখন মাধুরী আছেন জোড়াসাকোতে, শরৎ বিলেতে। স্ত্রী, রেণুকা আর শমীন্দ্রকে হারিয়ে কবি অবশিষ্ট সন্তানদের আরো আপন করে নিতে চাইলেন। এই সময়ই মকসো চলত গল্পের। খসড়া দেখে দিতেন মাধুরীর বাবা। কবি প্রশান্ত মহলানবিশকে বলেছিলেন, ওর ক্ষমতা ছিল, কিন্তু লিখত না। মাতশত্রু বা সৎপাত্র পড়লেই এ কথা বোঝা যাবে। তবে এসব গল্পে রবীন্দ্রনাথ কতখানি কলম চালিয়েছিলেন বলা শক্ত। হয়ত শুধু কাঠামোটাই ছিল মাধুরীর। গল্প গুচ্ছের প্রথম মুদ্রণে সংপাত্র তো রবীন্দ্রনাথের রচনা হিসেবেই ছাপা হয়। পরে কবি জানান সেটি তার কন্যার লেখা। এ গল্পে নারীমাংসলোলুপ সাধুচরণের শ্বাপদবৃত্তির যে ছবি আঁকা হয়েছে তা যেমন তীব্র তেমনি ভয়াবহ। গল্পের শেষে একটি মাত্র মন্তব্য স্ত্রীর হিসাবে সাধুচরণের যত্র আর তত্র ব্যয়। এই গল্প এবং শেষের মন্তব্যটির অনির্বাচ্য ব্যঞ্জনায় মাধুরীর চেয়ে বিশ্ববিখ্যাত বাবার হাতই যে বেশি ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। মাতশত্রুও বেশ নতুন ধরনের গল্প। এক হতভাগিনী মায়ের দুর্জয় লোভ ও তার পরিণতি নিয়ে লেখা। শরৎকুমারীর সোনার ঝিনুকের সঙ্গে এর আশ্চর্য মিল রয়েছে। হয়তো মূল গল্পটি কবিই দুজনকে বলেছিলেন, দুটো গল্পই অবিশ্বাস্য অথচ বিশ্বাসযোগ্য করে তোল হয়েছে। মাধুরীর বন্ধু অনুরূপার সঙ্গে কবির দেখা হয়েছিল একবার। কবি অনুরূপাকে বলেছিলেন, তোমার দেখাদেখি ইদানীং গল্প লিখতে আরম্ভ করেছিল। বেঁচে থাকলে হয়ত তোমার মতো লিখতে পারত।
নিতান্ত অকালে-হারানো মাধুরীলতার জীবন যেভাবে শুরু হয়েছিল সেভাবে শেষ হল না। ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত জোড়াসাঁকোতে কাটলেও তারপর শুরু হয়েছিল ঘোর অশান্তি। কারণটা ঠিক জানা যায়নি। কবি ছিলেন বিদেশে। জোড়াসাঁকোর বাড়ি তদারকির ভার ছিল ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথের হাতে। শোনা যায়, ঐ সময়ে শরতের ওপর নানারকম অবিচার করা হয়। দোষ ছিল না তার। তবু ফিরে আসার পর মাধুরীর মুখে সব কথা শুনেও কবি যখন কোন ব্যবস্থা না করেই শান্তিনিকেতনে ফিরে গেলেন তখন ক্ষুব্ধ অভিমানে শরৎ ও মাধুরী চলে গেলেন ডিহি শ্রীরামপুরের বাড়িতে। এরপর আর কোনদিন শরতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। আর মাধুরীলতা?
মৃত্যুসংবাদ ছাড়া তার সম্বন্ধে আর কি কিছুই জানা যাবে না? দেবতুল্য বিশ্ববন্দিত পিতার সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটল, সে সময় কে রইল পাশে? কে দিল সান্ত্বনা? এ সময় থেকেই তিনি ধীরে ধীরে রোগশয্যা নিলেন। বছরখানেক পরে একটু সুস্থ হয়ে অনুরূপাকে লিখেছিলেন, বন্ধুহার মম অগ্ধ ঘরে, থাকি বসে অবসন্ন মনে। রোগশয্যায় শুয়ে মাধুরী অনুভব করেছেন :
একটা আবরণ সরে গেছে, মানুষকে যেন নতুন করে দেখতে শিখেছি। এরকম কঠিন ভাবে মনটা নাড়া না পেলে হয়ত কখনো ক্ষাগত না।
মাধুরী উপলব্ধি করেছেন, তার জীবনে এতদিন আত্মার সঙ্গে মনের পরিচয় হবার সুযোগ হয়নি, হয়েছে সুদীর্ঘ বোগশয্যায়, জীবনমৃত্যুর মাঝখানে। এই নতুন উপলব্ধি নিয়ে মাধুরী আর সংসারে ফিরে আসতে পারেননি। সম্প্রতি জানা গেছে, অনুরূপা ছাড়াও আর এক বান্ধবীর সঙ্গে এসময় পত্রালাপ করেছিলেন মাধুরী, তার নাম ইন্দুপ্রভা। ইন্দুপ্রভাকে লেখা চিঠিতে অবশ্য নেই তার নতুন উপলব্ধির কথা কি কোন বিষণ্ণতার আভাস। তবে কি মাধুরী তখন সবই ভুলে যেতে চাইছিলেন? তাই চিঠিতে লিখেছেন, মেয়েমানুষকে যখন বি, এ ছাড়া অন্য পাশ দিতে হয় না তখন অত লম্বা স্মরণশক্তি রেখে কি ফল? এসময় একবার হাজারিবাগে ইন্দুপ্রভার বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। মাধুরীর, মনে হয় যাওয়া হয়নি। কবিকেও বারবার যেতে হয়েছে বিদেশে। এণ্ডজের মুখে বাবার বিজয়বার্তা শোনেন মাধুরী। প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে মেয়ের পাণ্ডুর মুখ। তারপর শোনা গেল ডাক এসেছে মাধুরীর। যে রোগে মারা গেছেন ছোট বোন রেণুকা, সেই রাজাই বাসা বেঁধেছে স্বর্গীয় মাধুরীমাখা বেলার শরীরে। এ তো বেলার অসুখ নয়। এ যে মহাকালের পরীক্ষা! কবি রথীন্দ্রকে লিখলেন, জানি বেলার যাবার সময় হয়েছে। আমি গিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে পারি এমন শক্তি আমার নেই।
সময় যখন সত্যিই ঘনিয়ে এল, তখন কবিকে এসে বসতেই হল মেয়ের পাশে। বিছানায় মিশে থাকা, তিল তিল করে ক্ষয়ে যাওয়া রুগণ শরীর, দুখানি শীর্ণ সাদা হাত বাড়িয়ে মাধুরী ছেলেবেলার মতো আবদার করেন, বাবা গল্প বলো।
বাবার বুকে শেলাঘাত হয়। এই তো সেদিন, কদিন আর হবে, তার অবুঝ চঞ্চল মেজ মেয়ে রাণীও বেলার মতোই শীর্ণ হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিল তাকে, বলেছিল বাবা গল্প বলো। আবার? এত শীঘ্র গল্প শোনাতে হবে আরেক জনকে, কথাকোবিদ পিতার গল্পের ঝুলিও বুঝি শেষ হয়ে যেতে চায়। রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠ। তবু বলেন। রেণুকা শুনেছিল ছোট ছেলের গল্প—শিশুর কবিতা —সে নিজেও যে শৈশবের সীমানা পার হয়নি। বেলা বুঝি শোনেন পলাতকার বিনুর গল্প, মুক্তি, হারিয়ে যাওয়া বামির কথা! এই গল্প শোনাও একদিন ফুরল।
মাধুরীলতার মৃত্যুসংক্রান্ত কিছু তথ্যঘটিত ভ্রান্তি রয়েছে। বেশির ভাগটাই শরৎকে নিয়ে। আমরা ঠিক না জানলেও একথা সত্য যে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যে অপ্রীতিকর অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল মাধুরীর মৃত্যুর মতো বিশাল ঘটনাতেও তার জের মেটেনি। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, কবির সঙ্গে আর শরতের সাক্ষাৎ হয়নি। বেলা যখন মৃত্যুশয্যায় তখন কবি কন্যাকে দেখতে যেতেন দুপুরে—যখন জামাতা আদালতে। অপর দিকে হেমলতার উক্তি তুলে ধরেছেন মৈত্রেয়ী দেবী। তাতে দেখা যাবে হেমলতা বলেছেন, অত আদরের মেয়ে বেলা তার মৃত্যুশয্যায়, সব অপমান চেপে তিনি দেখা করতে যেতেন। শরৎ তখন টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেত। পা নামাত না পর্যন্ত—এমনি করে অপমান করত। উনি সব বুকের মধ্যে চেপে মেয়ের পাশে বসতেন, মেয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকত।
দুটি উক্তিই আমাদের মনে সংশয় জাগিয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এবং প্রশান্ত মহলানবিশ দুজনেই বলেছেন তারা মাধুরীকে দেখতে যেতেন সকাল বেলা। প্রশান্ত তাকে নিয়ে যেতেন গাড়ি করে, তাই তার ভুল হবার সম্ভাবনা কম। অপর দিকে রবীন্দ্রজীবনীকার বলেছেন দুপুরবেলা। অবশ্য এই সময়টা বেলা দশটার পর হলে, বোধহয় কোনো সংশয় থাকে না। অপর দিকে হেমলতার কথাকেও বিনা দ্বিধায় মেনে নেওয়া গেল না, কারণ কবি নিজে বলেছেন মেয়ে তাকে বলতেন বাবা গল্প বলে। বেলার মৃত্যুর পরে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লেখা চিঠিতেও দেখা যাচ্ছে, কবি লিখেছেন তিনি তার মেয়ের রোগযন্ত্রণা কিছুই লাঘব করতে পারেননি, পারা সম্ভবও ছিল না অথচ পিতার উপর শেষ পর্যন্ত তাহার নির্ভর ছিল। তাই মেয়ের মুখ ফিরিয়ে থাকার মধ্যে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। শরতের চাপা অভিমানী স্বভাবের সঙ্গেও যেন এই ব্যবহার খাপ খায় না। বরং তার সঙ্গে কবির দেখা না হবার সম্ভাবনাই বেশি। যেদিন দেখা হতে পারত অর্থাৎ বেলার মৃত্যুর সময়, সেদিন কবি ফিরে গিয়েছিলেন সিঁড়ি থেকেই। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে শরৎ চলে গিয়েছিলেন মজঃফরপুরে, একটা পুরনো নীলকুঠি কিনে সেখানে গাছপালা ফুলের বাগান করে নিরালায় বাস করতেন। অনেকের মতে মাধুরীলতার বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তার ব্যর্থ-বিড়ম্বিত জীবন থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন হৈমন্তী গল্পের বীজ। হৈমন্তীর সঙ্গে মাধুরীর সাদৃশ্য আছে ঠিকই তবে শরৎ ও মাধুরীর বিবাহিত জীবন ব্যর্থ হয়েছিল মনে হয় না। ইন্দিরা লিখেছেন, শরং তাদের স্বল্পকালস্থায়ী বিবাহিত জীবনে বেলার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। তবে ক্ষুব্ধ অভিমানের দুস্তর সেতু কবি বা শরৎ কেউই কোনদিন পার হতে পারেননি।