১০. রচয়তি সৌদাসঃ
তাহার সহিত দেখা হইয়াছিল আচম্বিতে। কোনো প্রস্তুতি ছিল না। বাল্যাবধি মাতুলালয়ে মানুষ হইয়াছিলাম, গোপীনাথপুরে মধ্যে মধ্যে যাইতাম। আমি সৌদাস—তখন সদ্য কৈশোর অতিক্রম করিয়া যৌবনে উপনীত হইয়াছি। চতুষ্পাঠীর পাঠ শেষ করিয়াছি সবে, অন্য কোনোরূপ কর্মে আত্মনিয়োগ তখনও করি নাই। আপন খেয়ালে ভূর্জপত্রে গাথা রচনা করিয়া থাকি, তাহা কতদূর কাব্য হইয়া উঠে জানি না, যদিও সতীর্থমহলে ইতোমধ্যেই কবিখ্যাতি ঠিকই জুটিয়াছে।
আমার এই সময়কার কাব্যে আয়োজনের অভাব ছিল না, কেবল প্রকৃতির পটে যে-সকল নিসর্গদৃশ্য ফুটিয়া উঠে, তদতিরিক্ত অন্য কোনো বিষয় লইয়া কাব্য রচনা করিবার তখন প্রয়োজন অনুভব করি নাই। পদ্মের মৃণাল, সূর্যের কিরণ, নদীর কলতান, নৈশাকাশের নক্ষত্রবীথি—এ সকলই তখন আমার কাব্যোপাদান হইয়া উঠিয়াছে। এ পৃথিবীতে যে মানুষ বসবাস করে, তাহাদের হৃদয়ের ভিতর যে অহোরাত্র সুখ দুঃখের, হর্ষ বিষাদের তরঙ্গ উঠিতেছে, পড়িতেছে—তাহা লইয়া কাব্যপ্রেরণা তখনও অনুভব করি নাই।
আশ্রম হইতে স্নাতক হইয়া স্বগ্রামে ফিরিলাম; একদিন বৈকালে নৈরঞ্জনার তীরে বসিয়া আছি। নদীর পরপারে উরুবিল্ব বন আপনাতে আপনি জড়ামড়ি করিয়া ঘনকৃষ্ণ বিরাটাকার মেঘের মতন ধরিত্রীর উপর পড়িয়া আছে, এ পারে তিন্তিড়ি, অশ্বত্থ, নিম্ব, রসাল প্রভৃতি ছায়াঘন বৃক্ষরাজি নদীর বাতাসে মৃদু মৃদু দুলিতেছে। সূর্য অস্ত গিয়াছে, নৈরঞ্জনার উপর আকাশে অস্তরাগ সিন্দুরের ন্যায় রাঙা করিয়া রাখিয়াছে, তাহারই ছায়া বুকে লইয়া নদীও গৈরিক হইয়া উঠিতেছে… এইসব দেখিতে দেখিতে মনের ভিতর কতগুলা ছন্দোবদ্ধ পদ নড়িয়া-চড়িয়া উঠিতে লাগিল। সে আজিকালিকার কবিতা নহে, আড়াই হাজার বৎসর পূর্বের পদ; তাহার ছন্দ, শব্দবন্ধ, অলংকার, আঙ্গিক সকলই ভিন্ন। কিন্তু ভাবটি চিরকাল একই ছিল, আজিও তাহার ভাব পুরানো হইয়া যায় নাই।
মাটির প্রদীপটি অন্ধকারকে কহিল, আমাকে গ্রাস করিয়া লইবার জন্যই তোমার এত আয়োজন, আমাকে তোমার এত কেন ঘৃণা? অন্ধকার বলিতেছে, ইহাকে ঘৃণা বলে বুঝি? আমি না থাকিলে তোমাকে চিনিত কে? তোমাকে যে আমি বুকে ধরিয়া আছি।
আমার সে গ্রাম্য কবিতার এইরূপ ভাব, পদটি লইয়া মনে মনে নাড়াচাড়া করিতেছি। নদীর তীরে হাঁটিতে হাঁটিতে উহা নিজ মনেই একবার আবৃত্তি করিলাম, তৃপ্তি হইল না। অতৃপ্তির ঝোঁকে একবার মাথা নাড়িলাম, তাহার পর সামান্য সংশোধন করিয়া পদটি পুনরায় আবৃত্তি করিতেছি, এমন সময় বৃক্ষের অন্তরাল হইতে সোল্লাসে কৌতুকে কে যেন হাসিতে ফাটিয়া পড়িল, আমার মনঃসংযোগে বিঘ্ন হওয়াতে বিরক্ত হইয়া ঘাড় ঘুরাইয়া দেখিলাম। কে এক কিশোরী আমার উন্মনা ভাব দেখিয়া আপনমনে খিলখিল করিয়া হাসিতেছে। হাসিতে হাসিতে তাহার কেশপাশ খুলিয়া পড়িয়াছে; কেশের বন্যায় আর হাস্যের গমকে মিলিয়া মিশিয়া একেবারে একাকার!
মুহূর্তে আমার চিত্তের মুদিত কমলকলিকা যেন তাহাকে দেখিয়া খুলিয়া গেল। সে আশ্চর্য ভ্রুভঙ্গি, মরাল গ্রীবার লালিত্য, কালো দুইটি চক্ষুর বিদ্যুৎচাঞ্চল্য, বেপথুমান দেহলতার লাবণ্য, উচ্চহাস্যের কলতান—সেইসব আমাকে এক মুহূর্তে সম্মোহিত করিয়া ফেলিল। আমি তাহাকে অবাক হইয়া দেখিতেছিলাম। মুহূর্ত পরেই সে সম্বিৎ ফিরিয়া পাইয়া লজ্জায় চকিতা হরিণীর ন্যায় সেই যে পলাইয়া গেল, তাহাকে আর দেখিতে পাইলাম না।
কে মেয়েটি, কাহার কন্যা, মনের ভিতর এসব প্রশ্ন উঠিতেছিল। জানিতে অধিক বিলম্ব হইল না। অচিরেই জানিলাম—গ্রামমুখ্য সুদত্তের কন্যা সুজাতা। গোপবালিকা।
তাহার পর কয়দিন হইল, তাহাকে আর দেখি নাই। মনকে অনেক বুঝাইবার পরেও মন বুঝিতে চায় না। তখন মধুমাস—আমার নয়ন চলিতে ফিরিতে তাহাকেই কেন যে খুঁজিয়া মরে!
ইহারই সহিত মনের ভিতর একটা অন্য প্রকার গোপন হাহাকার উঠিয়া আসিতে লাগিল। এতদিন ধরিয়া কী ছাই কাব্যরচনা করিয়াছি? আমার কবিতাকুঞ্জে এ পুষ্প তো কখনও ফুটে নাই। সেখানে শুধু জড়া প্রকৃতির বর্ণনাই স্থান করিয়া লইয়াছে। কিন্তু সেইদিন চকিতে যে চিন্ময় রূপসমুদ্র দর্শন করিলাম, তাহার কণামাত্র আমার কবিতায় ধরা পড়ে নাই। আমি যেন একটা অজ্ঞাত রাজ্যের সম্মুখে স্তব্ধ বিস্ময়ে দাঁড়াইয়াছিলাম।
কিন্তু তখনও জানিতে পারি নাই, যাহা লইয়া আমার মন তরঙ্গচঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে, তাহা একেবারে বাহ্য বিষয়। উহা শুধু রমণীর বাহ্যরূপ। পরে জানিয়াছিলাম, রমণীর অন্তরে যে-সৌন্দর্যের কলানিধি বসত করিতেছে, সেই মুগ্ধতা, সেই প্রীতি, সেই সংকোচ, সেই ত্রাস, সেই লজ্জা, সেই ভয়, সেই অভিমান এবং সেই আশ্চর্য আত্মসম্মান—ইহাই পুরুষচিত্তে বিজয়িনী হইয়া বিরাজ করে। তখন সেসব কথা ভালো বুঝিতে পারি নাই। সুজাতা তাহার এক হাস্যেই অনঙ্গবিজয় করিয়া লইয়াছিল, তাহার মূল্য বুঝিতে আমার আরও কিছুকাল লাগিয়াছিল। সেই বন্ধুত্বের আনন্দ যখন প্রাণে প্রাণে বুঝিলাম, তখন আমি তাহারই পার্শ্বে নদীর ঘাটে বসিয়া আছি, তাহার স্কন্ধদেশ আমার স্কন্ধে বিলগ্ন হইয়া আছে, তাহার কবরীর অর্ধাংশ আমার পৃষ্ঠের উপর ভাঙিয়া পড়িয়াছে, তাহার ও আমার করতল লীলাচঞ্চলা হংসমিথুনের ন্যায় খেলা করিতেছে… মাথার উপর দিয়া অপরাহ্ণের আকাশ বাহিয়া সন্ধ্যার কুলায় প্রত্যাশী পাখি গৃহে ফিরিতেছে…
এমনই একদিন ছায়াপরাহ্ণের প্রান্তদেশে বসিয়া আছি, সন্ধ্যার তরল অন্ধকার নদীজলের সহিত মিশিয়া অনন্তের উদ্দেশে ধাবমান, সুজাতা আমার ক্রোড়ের উপর ন্যস্ত করতলে তাহার ভালদেশ রাখিয়া গ্রীবা কাত করিয়া নদীস্রোতের দিকে মুগ্ধনেত্রে চাহিয়াছিল। ছলছল কলকল শব্দে নদী কত কথা যেন বলিতেছে, সেসব অস্ফুট শব্দ অন্ধকার আকাশে সন্ধ্যাসংগীতের ন্যায় উঠিয়া মিলাইয়া যাইতেছে। সেই শ্রুতিপারের অগম দেশ হইতে নামিয়া আসিয়া সুজাতার কণ্ঠস্বর এক মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হইয়া উঠিল। শ্বাসের গভীরে ডুবিয়া গিয়া সে বলিল :
‘বলো, কখনও ভুলিবে না!’
বলিলাম, ‘এ জন্মে নহে।
সে বলিল, ‘অন্য কোনো জন্মে? ভুলিয়া যাইবে?’
‘ভুলিব না, ভুলিব না, ভুলিব না!’
‘কোনো জন্মে আমাকে ভুলিও না, সৌদাস। আমি শুধু তোমারই আর কাহারও নহি।’
আর কোনো কথা শুনা গেল না। রাত্রি ঘন হইয়া আসিয়াছে।
ধীরে ধীরে প্রকৃতিকে আমি ভিন্ন চক্ষে দেখিতে লাগিলাম। বেনুবনের কম্পন সুজাতারই প্রাণের স্পন্দন মনে হইতে লাগিল। বর্ষার বারিধারা তাহারই অশ্রুসজল চক্ষুর একটি মিনতির মতন লাগিল। মধ্যাহ্নের দাবদাহ সুজাতার স্ফুরিত নয়নেরই একটি কটাক্ষ, রাত্রিচরা পাখিদের ডাক তাহারই কৌতুক-নির্গলিত হাস্যের স্রোত….. এমনই প্রকৃতির নানা গতিবিধি, বিবিধ ভঙ্গিমা প্রেমাস্পদা সুজাতারই এক-একটি অভিব্যক্তি হইয়া আমার হৃদয়কে অধিকার করিতে লাগিল। বুঝিলাম, এতদিন প্রকৃতি আমার নিকট মূক ছিল, তাহার ভাষা বুঝিতে শিখি নাই। সুজাতা আসিয়া এই দৃশ্যমানা প্রকৃতিকে শ্রুতিসুখাবহা বাঙ্ময়ী করিয়া তুলিয়াছে।
কিন্তু আমাদের এই যে-একান্ত দেখাশোনা, প্রণয়বিহ্বল আলাপ ধীরে ধীরে তাহা কেবল আমাদেরই ব্যক্তিগত হইয়া রহিল না। ইহা লইয়া গ্রামে নানা কথা হইতে লাগিল। সে-সকল কথা আমার পিতৃদেবের কর্ণেও প্রবেশ করিল। সুজাতার পিতাও কিছু কিছু জানিলেন। অবশেষে আমার পিতা সুজাতার পিতার নিকট আমার ও সুজাতার বিবাহের সম্বন্ধ প্রেরণ করিলেন।
আমরা ব্রাহ্মণ, সুজাতা গোপকন্যা—তাহাতে আপত্তি ছিল না। অন্যান্য বিষয়ে সেসময় জাতপাতের বন্ধন দৃঢ় ছিল সত্য, কিন্তু পাত্রের বর্ণ যে-স্থলে পাত্রীর বর্ণ অপেক্ষা উচ্চতর, সে-স্থলে বিবাহ অনুমোদিত ছিল। আমি অবশ্য এ সমস্ত বিষয়ে আগ্রহী ছিলাম না, আমি কেবল সুজাতাময় হইয়াই ছিলাম, সেই প্রেম জগতের সকল বিধিনিষেধের অতীত ছিল। যাহাই হউক, সুজাতার পিতা এ-প্রস্তাবে সানন্দে সম্মত হইলেন এবং শুভদিনে এক গোধূলিলগ্নে আমাদের চারি হাত এক হইয়া গেল। বিবাহ উপলক্ষ্যে গ্রামে সবিশেষ উৎসব আনন্দের আয়োজন করা হইয়াছিল, মনে পড়ে।
গ্রামের প্রান্তদেশে আমাদের গৃহ, সুজাতা সেখানে আসিয়া সংসারকে যেন নূতন আয়োজনে ভরিয়া তুলিল। আমার জননী আমার অতি শৈশবে লোকান্তরিতা হইয়াছিলেন। ফলত, আমাদিগের আবাস দীর্ঘকাল নারীস্পর্শবঞ্চিত, রুক্ষ, লাবণ্যহীন ছিল। ধুলামলিন সেই নিষ্প্রদীপ ঘরে সুজাতা আসিয়া প্রথম প্রীতিস্নিগ্ধ সেবার প্রদীপটিকে মাজিয়া ঘষিয়া জ্বালিল, তাহারই অমল জ্যোতিতে আমার এতাবৎকালাবধি উদাসীন জীবন ও আরব্ধ কাব্যপ্রয়াস নূতন মাত্ৰা পাইল।
আমি সুজাতার ভিতর একেবারে ডুবিয়াছিলাম। বাল্যকাল হইতে ভালোবাসা পাই নাই, আমার প্রেমবুভুক্ষু হৃদয় সুজাতাকে পাইয়া যেন ভরিয়া উঠিল। অবিরত তাহাকে লইয়াই থাকিতাম, তাহার প্রতিটি নড়াচড়া, প্রতিটি উচ্চারণ, প্রতিটি কর্মপ্রচেষ্টা আমার নিকট অভিনব ঠেকিত। আমার কাব্যের নায়িকারা সকলেই সুজাতারই অবিকল প্রতিমূৰ্তি হইয়া উঠিতে লাগিল। সুজাতাও আমার হৃদয়বেদিতে তাহার প্রত্যহের প্রেমপুষ্প দিয়া গাঁথা ফুলহার নিবেদন করিয়া নিজেকে চরিতার্থ জ্ঞান করিত। আমরা দুজন কুলায়নিবাসী পারাবত- পারাবতপ্রিয়ার ন্যায়, কবিতার দুইটি সমিল চরণের ন্যায় এই নীলাভ অপরাজিতা আকাশের নিম্নে নিত্য স্তবমন্ত্রমুগ্ধ তন্ময় উচ্চারণে উচ্চারিত হইতে লাগিলাম।
একদিন প্রভাতবেলায় আমার এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হইল। আমাদের মাটির দাওয়ায় আসন বিছাইয়া উৎপীঠিকার উপর পুথি খুলিয়া দুই একটি পদ রচনা করিতেছি, সুজাতা গৃহকর্মে ব্যাপৃত আছে, পিতা কর্মব্যপদেশে অন্যত্র গমন করিয়াছেন, এমন সময় আমাদের গৃহের সম্মুখে মাধবীবিতানের ছায়ায় এক ভিক্ষু আসিয়া দাঁড়াইলেন। আমি নয়ন তুলিয়া সেই অনিকেত পরিব্রাজকের পানে তাকাইয়া একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেলাম। তাঁহার মুণ্ডিত শিরোদেশ, প্রস্ফুট কমলের ন্যায় উন্মুক্ত চরণ, মুখমণ্ডলে কী এক আশ্চৰ্য প্ৰশান্তি!
আয়ত নয়নে করুণাকিরণ ঝরিয়া পড়িতেছে, জগতের সকল দুঃখ যেন তাঁহার হৃদয়ের উত্তপ্ত কটাহে পাক হইয়া দুঃখোপশমের ঔষধ প্রস্তুত হইতেছে, গৈরিক কাষায় কী যেন কী শান্তি বিকীর্ণ করিতেছে, কোমল পদবিক্ষেপে পথের একটি ধূলিকণাও যেন স্থানচ্যুত হইতেছে না… আমি একেবারে অবাক হইয়া গেলাম! এতদিন সুন্দর কী তাহারই অনুসন্ধান করিয়া ফিরিয়াছিলাম, সুন্দরকে পাইয়াছিলাম আমার সুজাতারূপে। কিন্তু এ ভিক্ষু যে সুন্দর নয়, এ যে অপার্থিব! সেই অভয়, অসঙ্গ ও আনন্দের মূর্তি আমার হৃদয়কে এককালে হরণ করিয়া লইল। আমার অন্তর হইতে ধ্বনি উঠিল, এই অপার্থিব শান্তিই আমার চাই। আসন হইতে শশব্যস্তে উঠিয়া তরুণ ভিক্ষুকে ভিক্ষা দিলাম, তাহার পর তাঁহার চরণপ্রান্তে নতজানু হইয়া প্রার্থনা করিলাম, ‘হে শ্রমণ! আপনার হৃদয়ে যে অপার্থিব শান্তি রহিয়াছে, তাহার এক কণা আপনি আমাকে প্রদান করুন। আমার হৃদয় আপনার প্রশান্তিতে ভরিয়া উঠুক!’ তিনি মৃদু হাসিয়া দক্ষিণ কর উত্তানমুদ্রায় আশীর্বাদের ভঙ্গিমায় উত্তোলন করিয়া বলিলেন, ‘স্বস্তি!’ তাহার পর স্মিতাননে পথ বাহিয়া চলিয়া গেলেন।
সেইদিন হইতে, সেই মুহূর্ত হইতে আমার এক আচম্বিত পরিবর্তন সূচীত হইল। আমি যেদিকে তাকাই, সেইদিকেই সেই তরুণ শ্রমণের মূর্তি প্রতিভাত হইতে লাগিল। আহার-বিহার-গৃহকর্ম-কাব্যরচনা কিছুই করিতে ইচ্ছা করে না, কেবল বসিয়া বসিয়া তাঁহারই কথা ভাবিতে ইচ্ছা করে। যে-সুজাতা আমার প্রাণাপেক্ষাও প্রিয়তরা সহচরী ছিল, এখন তাহার সহিত দুই-একটার বেশি কথা কহিতে ইচ্ছা হয় না। সংসার-সমাজের কাহারও সহিত আমার যেন কোনো সম্বন্ধ নাই। নদীতীরে ঘাটের উপর বসিয়া থাকি, চক্ষু নিজ হইতেই মুদিয়া আসে, মনের ভিতর তলাইয়া জীবনপ্রশ্নের মুখামুখি হইতে হয়। মনে হয়, এ পৃথিবীর সমস্তই ক্ষণিক, দুঃখাবহ। এই দুঃখপূর্ণ জগৎটা যেন একটা চিতাগ্নি, নিয়ত শোক ও দুঃখের আগুনে গনগন করিয়া জ্বলিতেছে। ইহার পরপারে শান্তি কোথায় আছে, তাহারই জন্য হৃদয় তৃষার্ত হইয়া উঠিল।
আমার এ অবস্থা দেখিয়া সুজাতা চিন্তায় নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িল। বারবার সে প্রশ্ন করিত, ‘তোমার কী হইয়াছে? শরীর ভাল বোধ করিতেছ না? আমাকে কি আর ভালোবাস না?’ এই শেষ প্রশ্নটি লইয়া তাহার বিষম অভিমান হইত। সে উপর্যুপরি অতীতের নানা কথা পাড়িত। সে বলিত, ‘সেই যে আমরা নদীতীরে ঘাটের রানায় বসিয়া থাকিতাম… সেই যে বনমধ্যে দেখা হইয়াছিল… সেই যে একদিন আমাকে দেখিবার জন্য তুমি কাতর হইয়াছিলে… সেসব কি আর কিছুই তোমার মনে নাই? সব অতীত হইয়া গিয়াছে?’ আমি তাহাকে কী করিয়া বুঝাই, আমি তাহাকে পূর্বেরই ন্যায় ভালোবাসি, অতীতের সব প্রণয়ছবি আমার সকলই মনে আছে, কিন্তু আমার মনটা এখন আর ‘আমার’ নাই? এ মন সেই তরুণ ভিক্ষু হরণ করিয়া লইয়া গিয়াছেন; আমি দিনে দিনে যেন আর-একজন মানুষ হইয়া পড়িতেছি….
কয়দিন পর এক প্রভাতে নদীতীরে বসিয়া থাকিতে থাকিতে সহসা মনে হইল, আমার চক্ষুর সম্মুখ হইতে এই গাছপালা, এই নদীস্রোত, এই আকাশ, নিসর্গ, এই দৃশ্যমান চরাচর যেন একদিক হইতে অন্যদিকে সকলই মুছিয়া যাইতেছে… যেন একটা পুথির পৃষ্ঠার উপর লিখিত রচনাকে কে যেন এক দিক হইতে আর- একদিকে ঘষিয়া মুছিয়া ফেলিতেছে… আমার বড়ো ভয় হইল… এই জগৎটা ছায়াছবির ন্যায় মিলাইয়া যাইবে নাকি? এ কী ভোজবাজি হইতেছে? মনের ভিতর কেমন একটা বিষাদের বোধ উঠিয়া আসিতেছে! কিছুক্ষণ এইরূপ হইবার পর পুনরায় সকল কিছু স্বস্থানে ফিরিয়া আসিতে লাগিল। কী যে তখন দেখিতেছিলাম, বুঝাইতে পারি না।
কখনও দেহবোধ বিলুপ্ত হইবার জোগাড়, শরীরে যেন কোনো সাড় নাই, শরীরই নাই। কখনও আবার শরীরবোধ ফিরিয়া আসিয়া প্রবল ক্ষুধা পায়। একজনে তিনজনের আহার করিয়া ফেলি… কী যে আমার হইয়াছে! ক্রমশ এ অবস্থা অসহ্য হইয়া উঠিল। সুজাতার নিকট আর যাই না; তাহার সহিত একটাও কথা কহি না। দিনের পর দিন না ঘুমাইয়া থাকি। ক্লান্তিবোধ কিছুমাত্র হয় না!
গ্রামে ঘরে আমাকে লইয়া কথা উঠিতেছে, আমাদের কয়েক বৎসর বিবাহ হইয়াছে, কিন্তু আমাদের কোনো সন্তান হইল না। সুজাতা কি বন্ধ্যা? সে তাহার স্বামীর মন ভুলাইতে পারে না? আমি দিন দিন সংসারের বাহির হইয়া পড়িতেছি। গ্রামের লোক সকলে মিলিয়া জল্পনা করিল, এ বৎসর শ্রেষ্ঠীরা গ্রামে ফিরিয়া আসে নাই, তাহাদের অনুদানের অভাবে ইন্দ্রপূজা সম্যকরূপে পালিত হয় নাই, তাই ইন্দ্রের রোষে মোড়লের মেয়ে সুজাতা বন্ধ্যা হইয়া রহিয়াছে… উরাইল বনের বৃক্ষদেবতার নিকট মানসিক করিলে তবে এ বিপত্তি কাটিবে ইত্যাকার কত কথা…
কেহ জানে না, আমার কী হইয়াছে, আমি সুজাতার নিকট যাই না, তাহার সহিত পূর্বেকার সম্পর্কই নাই, কেমন করিয়া আমাদের সন্তান আসিবে? ইহাতে ইন্দ্রের রোষজনিত কোনো কারণই নাই, ইহা স্ত্রী-পুরুষ সংসর্গের অভাব। গ্রামের লোক কিছু বুঝে না, নানা কুসংস্কারে পরিপূর্ণ মন… কেবল আমিই জানি আমাদের নিঃসন্তান থাকিবার কারণ কী… সন্তানকামনা আমার মনে কদাপি উঠে না, উহা যেন বন্ধনের উপর নূতন একটা বন্ধন…
আমার মন সেই সন্ন্যাসীর ভাবে ভরিয়া উঠিতেছে, ঘরে প্রায় যাইই না, বেলা পড়িয়া আসে। নদীর ধারের বৃহৎ বনস্পতিগুলিকে দেখিলে ধ্যানস্থ ঋষি বলিয়া মনে হয়। আকাশ দিয়া পাখি উড়িয়া গেল, উহাদের ন্যায় অনিকেত, গগনাবলম্বী হইবার ইচ্ছা হয়। নদীর চরে কিংবা ঘাটের রানায় পড়িয়া থাকি, রাত হইয়া গেলে সুজাতা জোর করিয়া আমাকে ধরিয়া ধরিয়া গৃহে লইয়া যায়। দুই এক গ্রাস জোর করিয়া খাওয়াইয়া শয্যায় তাহারই পার্শ্বে শোয়াইয়া দেয়, কিন্তু আমার ঘুম আসে না। শয্যায় পড়িয়া থাকি, অধিক রাত্রে যেন মনে হয় জগতের সকল- বেদনা অন্ধকারে পুঞ্জ পুঞ্জ জোনাকির ন্যায় আমার বুকের ভিতর জমিয়া উঠিতেছে, আমি এ জীবনসমস্যার কোনো উত্তর খুঁজিয়া পাইতেছি না… কণ্ঠ শুকাইয়া কাঠ হইয়া যায়, বারংবার ঘটিটি মুখের কাছে তুলিয়া জলপান করি… কী প্রচণ্ড শিরঃপীড়া—আমি কি উন্মাদ হইয়া যাইতেছি?
উন্মাদ হইবার এই ভয় আমার বুকের উপর ক্রমে ক্রমে চাপিয়া বসিতেছে। আমি কি আর কখনও স্বাভাবিক হইব না? আর কোনোদিন সুজাতাকে ভালোবাসিতে পারিব না? আমি কি ইন্দ্রের অতুল ঐশ্বর্য পাইয়াও হারাইলাম? আর যে এ ভাব আমি সহ্য করিতে পারিতেছি না! কেউ কি নাই, আমার এ অসুখ সারাইয়া দেয়, আমাকে এই ভাবের জ্বর হইতে মুক্ত করিতে পারে?
এইসব প্রাণান্তকর চিন্তা অবিরত ভাবিয়া চলিতেছিলাম। নিষ্ক্রান্তির কোনো উপায় দেখিতে পাইতেছিলাম না। এমন সময় একদিন প্রভাতকালে আমি আবার সেই সন্ন্যাসীর দেখা পাইলাম। তরুণ তাপস পূর্বেরই ন্যায় আমাদিগের গৃহে ভিক্ষার্থে আসিয়াছিলেন। আমি অতি সত্বর তাঁহার নিকটে আসিয়া চরণতলে পতিত হইলাম। সুজাতা তাঁহাকে ভিক্ষা দিয়াছিল। আমি ধীরে ধীরে ভূমি হইতে উঠিয়া দরবিগলিত ধারায় কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলাম, ‘ভো শ্রমণ! ভো অনাথনাথ! আমি আপনার চরণপ্রান্তে প্রপন্ন, আমাকে উপায় বলিয়া দিন। আর যে আমি আপনার এ ভাব সহ্য করিতে পারিতেছি না। আপনার এ ভাব আপনি ফিরাইয়া নিন!’
তিনি দক্ষিণ কর উত্তোলিত করিয়া স্মিত হাসিয়া পূর্বেরই ন্যায় মৃদুল কণ্ঠে কহিলেন ‘স্বস্তি!’ এই বলিয়াই তিনি চলিতে আরম্ভ করিলেন।
এক লহমায় আমার সে-যন্ত্রণার অবসান হইয়া গেল। শিরঃপীড়া থামিল, বক্ষের ভিতর যে-দাবাগ্নিটা জ্বলিতেছিল, তাহা এক মুহূর্তে নিভিয়া গেল। চারিপাশে তাকাইয়া দেখিলাম, সবই তো ঠিক আছে! সবই তো ঠিক চলিতেছে!
সেই দিন যথাসময়ে আমি আহার করিয়া দ্বিপ্রহরে গভীর স্বস্তিকর নিদ্রায় ডুবিয়া গেলাম। ঘুম যখন ভাঙিল, তখন বেলা পড়িয়া আসিয়াছে, নিকটস্থ শিংশপা বৃক্ষে একটা দধিরাল পক্ষী ক্বীচ্ ক্বীচ্ করিয়া ডাকিতেছে।
অভ্যাসবশত সেইদিনও নদীর ঘাটে আসিয়া বসিতেই আর-একটা অন্য প্রকার বেদনা ধীর লয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারের মতো হৃদয়ে জাগিয়া উঠিতে লাগিল। কী একটা গাঢ় অভিমান! নিজের উপর কী একটা নিষ্ফল ক্ষোভ! হায়, কী করিলাম! ভিক্ষুর সেই ভাব প্রশমিত হইয়া গেল! উহা যেন কী অমূল্য পদার্থ ছিল, যাহা আমি হেলায় হারাইলাম! আর একটু হইলেই আমি জীবনকে যেন কৃতকৃত্য করিতে পারিতাম, সে মহনীয় ভাব আমাকে ছাড়িয়া গেল। কী আর হইত? না হয় বাহ্যদৃষ্টিতে উন্মাদ হইতাম, কিন্তু জীবনটার সারনিষ্কর্ষ তো বুঝিয়া পাইতাম। হায়, কেন আমি তাঁহার নিকট ‘ভাব সরাইয়া লও’ বলিয়া প্রার্থনা করিতে গেলাম? কেন আমার আর একটু সাহস হইল না।!
সেই আত্মক্ষোভ ভরা অভিমান বুকে লইয়াই ঘরে ফিরিলাম। রাত্রি হইল। বুকের ভিতর হাহাকার উঠিয়া আসিতে লাগিল। শয্যায় শুইয়া আছি। দুই চক্ষু হইতে অশ্রুপাত হইতেছে। সুজাতা পার্শ্বে শুইয়া সমস্ত দিনের গৃহকর্মে ক্লান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। ভাবিতেছিলাম, এখন হইতে আবার স্বাভাবিক জীবন শুরু হইল! হায়, স্বাভাবিক জীবন! ইহাকে লোকে স্বাভাবিক জীবন বলে, আর যাহা আমাদিগের প্রকৃত স্বভাব, তাহা আবিষ্কার করিবার যে-উত্তেজনাপূর্ণ অভিযাত্রা, তাহাকে অস্বাভাবিক বলিয়া থাকে? হায় রে মানুষ! হায় রে মানুষের বোধের দৈন্য!
শয্যার উপর উঠিয়া বসিলাম। এই একাকিত্ব বড়ো অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। চকিতে সুজাতার নিদ্রিত দেহলতা দুই বাহুতে তুলিয়া ধরিলাম। সে প্রথমে চমকিতা হইয়া উঠিল। তাহার পর ঘুমের ঘোর ভাঙিয়া আমার এই অকস্মাৎ আচরণ দেখিয়া নিতান্ত অবাক হইয়া গেল। আমি তাহাকে অন্ধের যষ্ঠির ন্যায় জড়াইয়া ধরিলাম।
উন্মুক্ত বাতায়নপথে নদীর বাতাস কক্ষে প্রবেশ করিতেছে। চাঁদের কিরণ বাঁকাভাবে শয্যার উপর আসিয়া পড়িতেছে। চারিদিক নিঃশব্দ। মধ্যরাত।
সেই নিভৃত নিশীথে সুজাতাকে আমি প্রথম পূর্ণভাবে গ্রহণ করিলাম।