দুজন পাঠানো হলো রক্তে রঞ্জিত হয়ে একজন ফিরে এলো
হিন্দুদের জন্য মুহাম্মদ বিন কাসিম এক জীবন্ত আতঙ্কে পরিণত হলেন। এক ইংরেজ ঐতিহাসিক লিখেছেন, সাপ যখন কোন ইদুরকে পাকড়াও করতে উদ্যত হয় তখন ভয়ে আতঙ্কে ইঁদুর পালানোর শক্তিও হারিয়ে ফেলে। বিন কাসিমের একেরপর এক বিজয়ে হিন্দুদের মধ্যেও এমন আতঙ্ক দেখা দিলো। রণাঙ্গন থেকে যেসব হিন্দুসেনা পালিয়ে গিয়েছিল এরা পুনর্বার আক্রমণের আর সাহস পাচ্ছিল না। যখনই খবর পৌছত বিন কাসিম কোন দুর্গ অবরোধ করতে আসছেন, তখন সেই দুর্গের হিন্দু সৈন্যরা প্রতিরোধ কৌশল ভুলে যেত। দুর্গশাসকরা দুর্গের বাইরে বিন কাসিমকে প্রতিরোধ করার কোন কৌশলের কথাই ভাবতে পারতো না। সৈন্যরা ভয় আতঙ্কে জড়সড় হয়ে পড়ত। আর সাধারণ হিন্দুদের অবস্থা হতো আরো শোচনীয়।
বিন কাসিম যখন সিন্ধু নদীর পূর্বপাড়ের প্রায় সব দুর্গ একেরপর এক কব্জা করে নিলেন, তখন থেকেই হিন্দুদের মধ্যে বিন কাসিমের ভয় স্থায়ী হয়ে গেল। কিন্তু বাস্তবে বিন কাসিম যখন বিজয়ী বেশে কোন দুর্গে প্রবেশ করতেন তখন সেখানকার অধিবাসীদের মন থেকে বিন কাসিমের আতঙ্ক দূর হয়ে যেতো। তারা বুঝতে পারতো অমুসলিম রাজা মহারাজাদের মতো সামরিক বেসামরিক নির্বিশেষে সকল প্রতিপক্ষের লোকদের নির্বিচারে হত্যা করতেন না বিন কাসিম। তিনি কোথাও জনগণের সহায় সম্পদ লুট করতেন না।
বিজিত এলাকায় প্রবেশ করার সাথে সাথে সেখানকার সাধারণ অধিবাসীদের জীবন সম্পদ ও মানসম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধান করতেন তিনি। তার কোন সৈনিকের পক্ষে সাহস হতো না বিজিত অঞ্চলের কোন অবলা নারী বা তরুণির গায়ে হাত দেয়ার।
হিন্দু ঐতিহাসিকরা অভিযোগ করেছেন যে, বিন কাসিম ছিলেন খুবই নির্মম তিনি কাউকে ক্ষমা করতেন না। কথাটি আংশিক সত্য। তিনি চিহ্নিত অপরাধী, কুচক্রি, বিনা কারণে রক্তপাত ও সংঘর্ষকারীদের ক্ষমা করতেন না। যেসব হিন্দু শাসক ও সৈন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উস্কানী দিতো, যেসব হিন্দু ঠাকুর পুরোহিত ও পণ্ডিত সাধারণ নাগরিকদেরকে মুসলমানদের ব্যাপারে কুৎসা রটনা করে ভয় দেখাতো, লড়াইয়ের জন্য প্ররোচিত করত কিংবা বিদ্রোহ করত এদের তিনি ক্ষমা করতেন না। চক্রান্তকারী ও জিঘাংসাপরায়ণদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতেন। শত্রুপক্ষের নেতাদের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর কিন্তু সাধারণ অধিবাসী, কৃষক, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীদের প্রতি তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতেন। সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতেন জননিরাপত্তা। অবশ্য এটা শুধু বিন কাসিমের অনুসৃত নীতিই ছিল না। নিরপরাধ নাগরিকদের জানমাল ইজ্জত সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধান ইসলামের সকল মুসলিম বিজয়ীরাই করতেন।
এটা মুসলিম বিজয়ীদের জন্য অলিখিত আইনে পরিণত হয়েছিল। নিরপরাধ মানুষকে শান্তি ও নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টিকে তারা আল্লাহর নির্দেশ হিসাবে গণ্য করতেন।
বিন কাসিমের প্রজা হিতৈষী নীতির ফলে হিন্দুস্তানের পরিস্থিতি এই হলো যে, যখনই তিনি কোন দুর্গে দু’চার দিন কাটাতেন দলে দলে হিন্দু লোকেরা এসে তাঁর কাছে ইসলামে দীক্ষা নিতো।
রাজা দাহিরের মরদেহ থেকে মাথা ছিন্ন করে বিন কাসিম যখন রাওয়া দুর্গে প্রবেশ করলেন, তখন পূর্ব থেকেই এই দুর্গে নিয়োজিত তার গোয়েন্দারা তাকে জানাল, এখানে দাহিরের কয়েকজন উচ্চ পদস্থ সেনাকর্মকর্তা রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে আসা সৈন্যদেরকে পুনর্বার আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করছে। এদের কয়েকজন হিন্দু নাগরিকদের প্ররোচনা দিচ্ছে, তারা যেন আরবদের মোকাবেলায় তাদের সাথে যোগ দেয়। এদের মধ্যে দু’জন সেনাপতি এমন রয়েছে, যারা এখানে পালিয়ে আসা জয়সেনাকে এখানে না থেকে ব্রাহ্মণাবাদ গিয়ে পুনর্বার প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। ব্রাহ্মণাবাদ থেকে কয়েকজন ঠাকুরও এ লক্ষেই এখানে এসেছে। বিন কাসিমের গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফী অভিযুক্ত হিন্দু সেনাকর্মকর্তা, ঠাকুর, পুরোহিত ও পণ্ডিতদের ধরে এনে এক জায়গা জড়ো
করলেন। তিনি দুর্গের অধিবাসীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে যারা বিদ্রোহ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সাধারণ নাগরিকদের প্ররোচনা দিচ্ছিল তাদের সবাইকে গ্রেফতার করলেন। লোকদের তথ্যে কিছু সংখ্যক বেসামরিক হিন্দু লোকও ধরা পড়ল। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলো বিন কাসিম এদের সবাইকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, ইতিহাসের ক্ষণজন্মা অল্প বয়স্ক সেনাপতি বেসামরিক পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের ওপর কোন ধরনের আক্রমণ করতেন না। কারণ সমাজের স্বাভাবিকতা এরাই বজায় রাখত। কৃষক, মজুর, জেলে, তাঁতী ব্যবসায়ীদের চলার গতি স্বাভাবিক না থাকলে সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন বাধাগ্রস্ত হবে, ভেঙে পড়বে সমাজের স্থিতিশীলতা। ফলে পেশাজীবী হত্যা না করার ব্যাপারে তাঁর কঠোর নির্দেশ ছিল। প্রমাণিত কোন অপরাধ ছাড়া তিনি কোন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতেন না।
রাজা দাহিরের নিহত হওয়ার ফলে ব্রাহ্মণাবাদ পর্যন্ত বিন কাসিমের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। দাহির পুত্র জয়সেনা দাহির বাহিনীর কয়েকজন উর্ধতন সেনা কর্মকর্তা, কয়েকজন রাজ দরবারী আর কিছুসংখ্যক বনেদী ঠাকুর রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণাবাদ আশ্রয় নিলো। জীবিতাবস্থায় রাজা দাহির তার ছেলে জয়সেনাকে গর্ব করে বলতো বাঘ। কিন্তু দাহিরের সেই বাঘ তার বাবার মৃতদেহ রণাঙ্গনে ফেলে শিয়ালের মতো রণাঙ্গন থেকে ব্রাহ্মণাবাদ পালিয়ে গেল। রাজা দাহিরের রাজকীয় সৈন্যরা দেখতে পেল, দাহিরের ব্যাঘপুত্রধন বাবার মরদেহ ফেলে রেখে রণাঙ্গন থেকে জীবন নিয়ে পালিয়েছে। এতে তাদের মধ্যে মুসলমানদের আতঙ্ক আরো গভীর হলো।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, শোচনীয় পরাজয় ও বাহাদুর পিতার করুণ মৃত্যুতে জয়সেনার মাথা ঠিক ছিল না। ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গে পৌছার পর সে সর্বাগ্রে সেখানকার প্রধান মন্দিরে হাজির হলো। সেখানে গিয়ে মন্দিরে তাদের পূজনীয় প্রধান পুরোহিতকে দেখে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতেই পুরোহিত তার প্রতি দু’হাত প্রসারিত করে এগিয়ে এলো।
জয়সেনা পুরোহিতদের উদ্দেশ্যে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, তোমরা না মহারাজকে আক্রমণের শুভলগ্ন বলেছিলে? বলেছিলে মহারাজের বিজয় নিশ্চিত?
হা, রাজকুমার; আমরা তাই বলেছিলাম।
কোথায় গেল তোমাদের ভবিষ্যত বাণী? তোমরা কি শোননি, মহারাজ শুধু পরাজিত হননি, তিনি নিহত হয়েছেন! তোমরা এই আশা করতে পারো এর পরও আমি তোমাদের জীবিত ছেড়ে দেবো?
রাজকুমারের যদি এটাই নির্দেশ হয়ে থাকে তবে আমাদের মরণে আপত্তি নেই। তবে আমাদের মাথা তরবারীর আঘাতে দ্বিখণ্ডিত করার আগে শুনে নিন, মহারাজের ওপর দেবদেবীদের অভিশাপ পড়েছিল। এই অভিশাপ আমাদের সবার ওপর পড়বে। আমাদের মন্দিরগুলো মুসলমানদের আস্তাবলে পরিণত হবে।
কি সেই অভিশাপ? কেন মহারাজের ওপর দেবদেবীদের অভিশাপ পড়ল?
একই মায়ের উদরে জন্মগ্রহণকারী নারী আর পুরুষে কখনো বিয়ে হতে পারে না, রাজকুমার! মহারাজ আপন সহোদরা বোনকে বিয়ে করে বিবি বানিয়ে রেখেছিলেন, বলল প্রধান পুরোহিত। কিন্তু তিনি তো বোনের সাথে ঘর সংসার করতেন না? পুরোহিত কিছু বলার আগেই আড়াল থেকে ভেসে এলো নারীকণ্ঠ। “হ্যাঁ, আমরা কখনো স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করিনি। সবাই নারীকন্ঠের দিকে উৎসুক হয়ে তাকানোর আগেই দৃশ্যপটে এসে দাঁড়ালো মায়ারাণী। আড়াল থেকে মায়াই বলেছিল একথা। আমরা কখনো স্বামী-স্ত্রীর মতো ঘরসংসার করিনি। আবারো স্বগতোক্তি করল রাণী। তবে আমার ভাই আমার জীবন যৌবন আশা আকাঙ্ক্ষাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। আমার ভাই এজন্য আমাকে স্ত্রী বানিয়ে রেখেছিল, আমার যদি আর কারো সাথে বিয়ে হয় তাহলে সে ক্ষমতা দখল করে নেবে আর তাকে বনবাসে যেতে হবে।
তোমাদের মতো ঠাকুর পণ্ডিতরাই তার মধ্যে এই সংশয় জন্ম দিয়েছিল। এর চেয়ে কি আমাকে বলী দিয়ে দেয়া বেশি ভালো ছিল না? মন্দিরে আমাকে বলী দিয়ে আমার রক্ত দিয়ে কৃষ্ণ মাতার চরণ ধুয়ে দেয়া কি বেশি ভালো হতো না? তা না করে আমার ভাই বিনা ছুরি বল্পমে আমার যৌবনের সব আশা আকাংখা স্বপ্ন-সাধ, চাওয়া-পাওয়া তিলে তিলে হত্যা করেছে। আর তোমাদের মতো ধর্মের ঠিকাদাররা এমন কাজ থেকে মহারাজকে বিরত রাখার কোন চেষ্টাই করনি। মহারাজ তার রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আমার যৌবনকে বলী দিয়েছেন, কিন্তু তাতেও তো তার রাজত্ব টিকল না। হ্যাঁ, একথাই আমরা রাজকুমারকে বলতে চাচ্ছিলাম, যে কথা রাণী বলল, এটা দেবতার অভিশাপে হয়েছে, এই অভিশাপে মহারাজের রাজত্ব ধ্বংস হয়ে গেছে।
এখন তাহলে কি হবে? আমাদের কি এর পরিণতিতে কোন বলীদান করতে হবে? পুরোহিতের কাছে জানতে চাইলো রাজকুমার জয়সেনা। “না, এসবই মিথ্যা, এরই মধ্যে কয়েকজন নিরপরাধ কুমারীকে বলী দেয়া হয়েছে।” আর কোন কুমারী বলী দেয়া হবে না। চিকার করে বলল রাণী।
রাণী! রাণীকে একদিকে ঠেলে দিয়ে মহারাজের মতো গর্জে উঠল জয়সেনা। মরা এবং মারা আমাদের কাজ। তুমি তো একজন অবলা নারী মাত্র, এখানে তোমার কোন হুকুম মানা হবে না।
এখন আর কারোরই হুকুম মানা হবে না। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল রাণী। মহারাজের মৃত্যুর পর আমিই রাণী, আমিই তার স্থলাভিষিক্ত। আমার তরবারী তোমার মাথা বিচ্ছিন্ন করার আগে এখান থেকে চলে যাও রাণী! নির্দেশের স্বরে বলল জয়সেনা। তার দেহরক্ষীদের বলল, এখান থেকে ওকে সরিয়ে নাও, এ পাগল হয়ে গেছে। দু’তিন জন লোক ঝাপটে ধরে রাণীকে টেনে হেঁচড়ে মন্দিরের বাইরে নিয়ে গেল, আর তার চিৎকার শোনা গেল।
জয়সেনা যখন মায়ারাণীর মাথা ছিন্ন করার হুমকি দিচ্ছিল, বিন কাসিম তখন রাওয়া দুর্গে মালে গনীমত পর্যবেক্ষণ করছিলেন। রাওয়া দুর্গে বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিন কাসিমের হস্তগত হলো। তন্মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল রাজা দাহিরের এক তরুণী ভাগ্নি, আর রাজার ছিন্ন মস্তক। বিন কাসিমের নির্দেশে মালে গণীমতের এক পঞ্চমাংশ আলাদা করা হলো খেলাফতের জন্য। বিপুল পরিমাণ সোনাদানাসহ রাজা দাহিরের ছিন্নমস্তক ও রাজার ভাগ্নিকেও খেলাফতের অংশে রাখা হলো। খেলাফতের গোটা অংশ বিন কাসিম আলাদা করে কাব বিন মুখারিকের কাছে সোপর্দ করলেন।
ইবনে মুখারিক! খেলাফতের বদলে এই সম্পদ হাজ্জাজ বিন ইউসুফের হাতে সোপর্দ করবে এবং তাকে আমার এই পয়গাম দেবে। বিন কাসিম রাজা দাহিরকে পরাজয়ের পর হাজ্জাজের কাছে যে ঐতিহাসিক পয়গাম দিয়েছিলেন তা ছিল এই ও
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম খাদেমুল ইসলাম মুহাম্মদ বিন কাসিমের পক্ষ থেকে ইরাকের শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নামে
আসসালামু আলাইকুম
আল্লাহ তাআলার রহমত মদদ এবং আপনার দিক নির্দেশনায় সিন্ধু অঞ্চলের কেউটে সাপের মাথা কেটে দেয়া হয়েছে, ইসলামের জঘন্যতম শত্রু আরব জাহানকে পদানত করে কাবা ঘরে মূর্তি স্থাপনের স্বপ্নে বিভোর রাজা দাহিরের ছিন্ন মস্তক আপনার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো এবং দাহিরের এক ভাগ্নি যে হিন্দুস্তানের রূপ সৌন্দর্যের প্রতীক আপনার কাছে পেশ করা হলো। এটি সেই জালেম রাজার মাথা যে আমাদের নিরপরাধ নারী-শিশু ও হজ্জযাত্রীদেরকে ডাভেলের বন্দিশালায় আটকে রেখেছিল…।
আপনি যেসব আয়াত পাঠের কথা বার বার বলতেন, আমি আপনার নির্দেশ মতো সবসময়ই ঐগুলো পাঠ করি। আমরা সব সময় আল্লাহর রহমতের জন্য মোনাজাত করি, আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। আল্লাহর রহমতেই আমরা রাজা দাহিরকে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করেছি। দাহিরের ছেলে জয়সেনা রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে গেছে। … এ মুহূর্তে আমি রাওয়া দুর্গে অবস্থান করছি। এখানকার সাধারণ লোকদের আমরা ক্ষমা ঘোষণা করেছি। কিন্তু যারা বিদ্রোহের পায়তারা করছিল তাদেরকে চিরদিনের জন্যে খতম করে দিয়েছি। ব্রাহ্মণবাদের দিকে অভিযান চালানোর জন্য আপনার অনুমতি চাচ্ছি। কারণ দাহিরের ছেলে জয়সেনা সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। সে আমাদের মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ব্রাহ্মণাবাদ যাওয়ার পথে আরো দুটি দুর্গ রয়েছে। এগুলোতে হিন্দু সৈন্য রয়েছে ওরা পিছন দিক থেকে আক্রমণ করতে পারে এজন্য এগুলো দখল করে নিতে হবে।
আপনি এই বিজয়ের সুসংবাদ যাদের জানাবেন, তাদেরকে আমার সালাম জানাবেন এবং আমাদের অব্যাহত বিজয়ের জন্য দোয়া করতে বলবেন।
৯৩ হিজরী মোতাবেক ৭১২ খ্রিস্টাব্দের শাওয়াল মাসে বিন কাসিম হাজ্জাজের কাছে এই পয়গাম ও গণীমতের সম্পদ পাঠিয়েছিলেন।
এদিকে যখন আল্লাহর মদদ ও নুসরতের জন্য আবেদন করা হচ্ছিল ওদিকে জয়সেনা তখন হিন্দুস্তানের রাজা মহারাজাদের কাছে সহযোগিতা ও সাহায্যের জন্য দূত পাঠাচ্ছিল। দাহিরপুত্র জয়সেনা হিন্দুস্তানের সব রাজা মহারাজার কাছে তার সাহায্যের জন্য দূত পাঠাল। সবাইকে জয়সেনা লিখল, তার পিতা ইসলামের অগ্রাভিযান রুখতে জীবন উৎসর্গ করেছে। জানা গেছে, আরব বাহিনীর সেনাপতি তার মাথা কেটে আরব পাঠিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, আরব সেনাপতি স্বর্গবাসী রাজার এক কুমারী ভাগ্নিকেও আরব পাঠিয়ে দিয়েছে। সে কয়েকজন পুরোহিতকেও হত্যা করেছে। এখনও যদি এই তুফান রুখে দিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ না হই তাহলে আপনাদের সবার মাথাও আরব পৌছবে। সেই সাথে আপনাদের কুমারী কন্যারাও আরবদের দাসী হবে। আর আবহমান কাল থেকে চলে আসা আমাদের দেবদেবীদের সত্য ধর্মের পূজা অর্চনা চিরদিনের জন্য ভারতের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
জয়সেনার পয়গাম ছিল খুবই উত্তেজনা ও প্ররোচনাদায়ক। অন্যান্য রাজাদের কাছে পয়গাম পাঠানোর পাশাপাশি সে তার জ্ঞাতি ভাই গোপীর কাছেও পয়গাম পাঠাল। গোপী ছিল রাওয়া দুর্গের শাসক। দুর্গ মুসলিম বাহিনীর কব্জায় চলে যাওয়ার পর গোপীও সেখান থেকে অন্যত্র পালিয়ে যায়। জয়সেনা তার এক ভাতিজা বীরসেনাকেও পয়গাম পাঠাল। বীরসেনা ছিল বাটিয়া দুর্গের শাসক। আপন ও আত্মীয় সম্পর্ক যাদের সাথে ছিল জয়সেনা সকল শাসকদের কাছে পয়গাম পাঠাল। আপন আত্মীয়রা তার ডাকে সাড়া দিলেও অনাত্মীয় অনেক শাসক জয়সেনার ডাকে সাড়া না দিয়ে তার সহযোগিতায় না এসে বরং রাওয়া দুর্গে গিয়ে বিন কাসিমের কাছে আত্মসমর্পণ করল। বাহরার ও দাহলিলা দুর্গের শাসকরা একসাথে মিলিত হয়ে জয়সেনার পরাজয়ের জবাবে লিখল, আরব বাহিনী আমাদের খুব কাছে পৌঁছে গেছে। এমতাবস্থায় দুর্গ খালি রেখে সেনাবাহিনী নিয়ে আপনার সাহায্যে বাইরে যাওয়া যৌক্তিক মনে হয় না। এরচেয়ে আমরা দুর্গের ভিতরে থেকে অবরোধ দীর্ঘায়িত এবং দুর্গের বাইরে আরব বাহিনীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করব। সেই সাথে আমরা ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে আরব বাহিনীর জনবল হ্রাসের চেষ্টা করব যাতে ব্রাহ্মণাবাদ পৌছার আগে আরব বাহিনীর জনবল কমে যায়।
গনীমতের সম্পদ এবং যুদ্ধবন্দীদেরকে নিয়ে বিন কাসিমের পাঠানো কাফেলার প্রধান কাব বিন মুখারিক যখন কুফায় প্রবেশ করলেন, তখন মানুষ মুখে মুখে সিন্ধু বিজয়ের খবর শুনে দৌড়ে রাস্তায় নেমে এলো। সিন্ধু বিজয়ের জন্য বিজয়ী বাহিনীকে মোবারকবাদ এবং তাকবীর ধ্বনী দিতে লাগল। ফিরে আসা আরব সৈন্যদের কাছে দৌড়ে এলো নারীরাও।
তারা পরম আনন্দে তাদের আপনজনদের খোঁজখবর জিজ্ঞেস করছিল গণীমতের কাফেলায় ফিরে আসা যোদ্ধাদের কাছে। হাজ্জাজ তখন কুফায় অবস্থান করছিলেন। গনীমতের সম্পদ রাজধানী দামেশক পাঠানোর রীতি থাকলেও এগুলো হাজ্জাজের কাছেই আগে পৌছানোর নির্দেশ ছিল। কারণ সিন্ধু অভিযান ছিল হাজ্জাজের একান্ত উদ্যোগের ফসল। কেন্দ্রীয় খলিফা এই অভিযানে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু হাজ্জাজের দৃঢ়তার মুখে কেন্দ্রীয় খলিফার তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল না। বাইরে অসংখ্য মানুষের শোরগোল শুনে দ্বাররক্ষীর কাছে হাজ্জাজ শোরগোলের কারণ জানতে চাইলে দ্বাররক্ষী জানালো, সিন্ধু থেকে গণীমতের সম্পদ ও বিপুল যুদ্ধবন্দি নিয়ে বিশাল কাফেলা এসেছে। একথা শোনামাত্র হাজ্জাজ দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন এবং একটি ঘোড়ায় চেপে কাফেলাকে অভ্যর্থনা জানাতে নিজেই এগিয়ে গেলেন। আবেগের আতিশয্যে তিনি কাফেলার নেতা কাব বিন মুখারিককে জড়িয়ে ধরলেন।
কাফেলা শহরে প্রবেশ করতেই তিনি সারা শহর জুড়ে ঘোষণা করিয়ে দিলেন, সকল মানুষকে কেন্দ্রীয় মসজিদে জমায়েত হতে বলল। নামাযের পর সবাইকে সিন্ধু বিজয়ের বিস্তারিত খবর জানানো হবে।
তখন যোহরের ওয়াক্ত ছিল। কুফার ছোট বড় সকল লোক জামে মসজিদে জমায়েত হলো। নামায শেষে হাজ্জাজের নির্দেশে রাজা দাহিরের ছিন্নমস্তক একটি বল্পমে বিদ্ধ করে তার হাতে দেয়া হলো। হাজ্জাজ নিজে বল্লম উঁচু করে রাজা দাহিরের ছিন্নমস্তক উপস্থিত সবাইকে দেখালেন। হাজ্জাজ সমবেত জনতার উদ্দেশে বললেন, হে কুফাবাসী! এই ছিন্নমস্তক সেই দাম্ভিক ও অপরাধী বেঈমানের, যে আমাদের নারী শিশু ও হজযাত্রীদেরকে ধরে নিয়ে ডাভেলের কারাগারে বন্দি করে রেখেছিল। সে এতোটাই হিংস্র ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, আমাদের কোন কথাই সে শুনতে রাজি ছিল না। সে নাকি মুসলমানদের নিঃশ্চিহ্ন করে কাবা শরীফকেও মূর্তীর মন্দিরে পরিণত করার স্বপ্নে বিভোর ছিল। আজ এই দাম্ভিকের ছিন্ন মাথা তোমরা দেখো। হে
কুফাবাসী! মুহাম্মদ বিন কাসিম ও মুজাহিদীনের জন্য দোয়া করতে থাকো। এই বিজয় তোমাদের দোয়া ও ত্যাগের ফসল। হে কুফার নওজোয়ানরা! তোমরা কি জানো, আমাদের যোদ্ধাদের অভিযান চূড়ান্ত করতে তাদের আরো সহযোগিতার প্রয়োজন। তোমরা কি তাদের সহযোগিতা করতে আগ্রহী নও? আমরা যদি সময়মতো তাদের সহযোগিতায় সাড়া না দেই, তাহলে এই বিজয়ের পরও তাদের মন ভেঙে যাবে। আমার বিশ্বাস, বিশাল বিজয়ের পর শুধু সহযোগিতার অভাবে চুড়ান্ত বিজয়ের পথে তারা ব্যর্থ হয়ে যাক তা কোন মানুষই ভাবতে পারে না। তোমরা জানো একাধারে যুদ্ধ করতে করতে তাদের লোকবলও অনেক কমে গেছে এবং অনেকেই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছে।
হাজ্জাজ তার মুখের কথা শেষ করতে পারলেন না, সমবেত জনতা চিল্কার করে বলতে শুরু করল, লাব্বাইকা লাব্বাইক! ইয়া হাজ্জাজ। লাব্বাইক! শত শত লোক দাঁড়িয়ে লাব্বাইক বলে চিৎকার করতে লাগল। বিন কাসিমকে সহযোগিতার জন্য সিন্ধু অভিযানে শরীক হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল। হাজ্জাজ তার সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন, সক্ষম তরুণদের তালিকা তৈরি করে তাদের সামরিক ট্রেনিং শুরু করে দেয়া হোক। এরপর গণীমতের সম্পদ থেকে কানাকড়িও না রেখে পুরোটাই হাজ্জাজ দামেস্কে কেন্দ্রীয় খলিফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালেকের কাছে পৌছানোর নির্দেশ দিলেন। গণীমতের সম্পদের সাথে বিশেষভাবে প্রেরিত দাহিরের ভাগ্নী হিন্দাকেও তিনি খলিফার উদ্দেশ্যে পাঠালেন। গণীমতের সম্পদের সাথে হাজ্জাজ খলিফা ওয়ালীদ বিন মালিকের নামে একটি পয়গামও পাঠালেন। হাজ্জাজ লিখলেন- “আমি জানি সিন্ধু অভিযানে আপনার ইচ্ছা ছিল না।
কিন্তু আমি আপনাকে এই অভিযানে সম্মত করিয়ে নিয়েছিলাম। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সিন্ধু অভিযানের সম্পূর্ণ খরচের ব্যবস্থা আমি করবো এবং আপনাকে এই খরচের চেয়ে অনেক বেশি উপঢৌকন দেবো। আপনি ইতোমধ্যেই দেখেছেন, সিন্ধু থেকে এ পর্যন্ত কততবার গণীমতের সম্পদ এসেছে এবং একেকবার কি পরিমাণ সম্পদ ও সোনাদানা এসেছে। এ তো গেল ধন-সম্পদের কথা। এই ধনসম্পদ তো শুধু জাগতিক জাকজমক বজায় রাখে। কিন্তু আখেরাতের কথা চিন্তা করুন, সেখানে সোনাদানা, দিনার দিরহাম সৈন্য সামন্ত হাতি ঘোড়া কোন কাজে আসবে না। আমার কিশোর ভাতিজা ইসলামের অন্যতম দুশমন রাজা দাহিরকে শুধু পরাজিতই করেনি, মাখা ছিন্ন করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এটি
সেই অহংকারী মুশরিকের মাথা যে শুধু আল্লাহর একত্ববাদ ও রাসূল সাঃ-এর রিসালতকেই অস্বীকার করেনি, ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের অপচেষ্টা করেছে। পরিশেষে হাজ্জাজ তার পয়গামে বিন কাসিমের একেরপর এক বিজয়ের কাহিনী বিস্তারিত লিখলেন। তিনি এও লিখলেন, সামনে বিন কাসিমের পরিকল্পনা কি এবং সে কোন্ দিকে অগ্রসর হবে।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, গণীমতের বিপুল সম্পদসহ বহু যুদ্ধবন্দিকে নিয়ে বিশাল কাফেলা যখন কুফা থেকে দামেশকে প্রবেশ করল, তখন কুফার মতো দামেশকের লোকজনও কাফেলাকে দেখার জন্যে রাস্তায় নেমে এলো। তারা বিজয়ের আনন্দে তাকবীর ধনী দেয়ার সাথে সাথে যুদ্ধবন্দীদের প্রতি তিরস্কার কটুক্তি করছিল। দামেশকের পথে পথে একই আওয়াজ ধ্বনীত হতে লাগল মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু রাজা দাহিরকে হত্যা করে বিজয়ী হয়েছে। সর্বক্ষেত্রে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল বিন কাসিমের নাম। সবাই বিন কাসিমের অভাবনীয় সাফল্যে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
এই বিজয়বার্তা দামেশকের অধিবাসীদের এতোটাই আবেগাপ্লুত ও উৎফুল্ল। করল যে, আনন্দিত লোকজন বিজয় উৎসবে মেতে উঠল। অনেকেই ডাক পেটাতে শুরু করল।
কিন্তু দামেশক জুড়ে এতো আনন্দ উচ্ছাসের মধ্যেও একজনের মনে এই বিজয় কোন প্রভাব সৃষ্টি করল না। উচ্ছ্বাসের বদলে তার চেহারা ছিল গম্ভীর। তার গাম্ভীর্য কখনো বিমর্ষতার রূপ ধারণ করছিল।
তার চেহারা দেখে যে কারো পক্ষে বলে দেয়া সম্ভব ছিল, বিন কাসিমের এই অভাবনীয় বিজয়ে যেন তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, বরং এই বিজয় তার জন্যে পীড়াদায়ক। বিমর্ষ এই লোকটি ছিল তৎকালীন খলিফার ভাই সুলায়মান বিন আব্দুল মালেক। সে কাফেলার যাত্রা পথে অনিহামাখা বিমর্ষ মনে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। কা’ব বিন মুখারিক খলিফা ওয়ালীদ বিন মালেকের দরবারে উপস্থিত হলেন। দরবারে খালীফা ছাড়াও তার অন্যান্য আমত্যবর্গ উপস্থিত ছিলেন। কা’ব প্রথমেই খলিফার কাছে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের লিখিত পয়গাম পেশ করলেন। খলিফা কাবের হাত থেকে সেটি নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। হাজ্জাজের পয়গাম যতোই পড়ছিলেন, তার চেহারা সন্তুষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছিল। তিনি পয়গাম পড়ে কাবকে বললেন, বিস্তারিত আমি তোমার মুখে
পড়ে শুনবো। অতঃপর দরবার কক্ষ থেকে তিনি বাইরে বেরিয়ে এসে গনিমতের ধনসম্পদ ও যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যক্ষ করে গোটা ধনসম্পদ স্তরে স্তরে ভাগ করার নির্দেশ দিলেন। সবশেষে কাবকে বললেন, রাজা দাহিরের। ভাগ্নী কোথায়? তাকে হাজির করো। দাহিরের ভাগ্নীকে যখন খলিফা ওয়ালীদের সামনে হাজির করা হলো, দীর্ঘক্ষণ তিনি অপলক দৃষ্টিতে তরুণির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার চেহারায় এক ধরনের উৎফুল্লভাব ফুটে উঠল। খলিফার দৃষ্টি দেখে তরুণির দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
খলিফা দুভাষীর মাধ্যমে তরুণির উদ্দেশ্যে বললেন, হে তরুণী! তোমার সৌভাগ্যকে তুমি এখনো অনুধাবন করতে পারোনি। যার ফলে তোমার চেহারায় এর কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। তুমি যদি সিন্ধুতেই রয়ে যেতে তাহলে তোমার পরিণতি খুবই ভয়ানক হতো।
আমার এই বন্দিত্বের মধ্যে সৌভাগ্যের কি আছে মহারাজ? এটা কি কোন সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো? এখানে আমি যে কারো রক্ষিতা হয়ে থাকবো। নারীর জীবনে এর চেয়ে অবমানোকর আর কী আছে? আমি তো মুসলমানদের ব্যাপারে ভিন্নরকম গল্প শুনেছি। কিন্তু আপনি অসহায় এক ভাগ্য বিড়ম্বিতা মেয়ের দুর্ভাগ্য দেখে আনন্দবোধ করছেন? তুমি ভুল বুঝেছো তরুণী! তোমার মামা দাহির যেভাবে আমাদের অসহায় নারী শিশুদেরকে কয়েদখানায় বন্দী করে রেখেছিল, আমি তোমাকে সেভাবে বন্দী করে রাখবো না।
তাদের প্রতিশোধ কি আমার ওপরে নেয়া হবে?
প্রতিশোধ যার ওপর নেয়ার দরকার ছিল তার ওপর নেয়া হয়েছে। তোমার ওপর কোন প্রতিশোধ নেয়া হবে না এবং তোমাকে যে কারো রক্ষিতা হয়ে থাকতে হবে না, বরং তুমি সসম্মানে মর্যাদাপূর্ণ মানুষের বেগম হয়ে থাকবে। তুমি যদি সিন্ধুতে থাকতে তাহলে লড়াইরত অবস্থায় জীবন বাঁচাতে গিয়ে না জানি কার হাত থেকে কার হাতে গিয়ে পড়তে। তখন হয়তো তোমাকে গণহারে ব্যবহার করা হতো, কিন্তু আমাদের যেসব যোদ্ধা সিন্ধুতে যুদ্ধ করছে, তাদের কারো বেলায় এমন একটা উদাহরণ কি দিতে পারবে যে, তারা বিজিত কোন এলাকার কোন একজন নাগরিকের ইজ্জত সম্ভ্রম দূরে থাক সহায় সম্পদ ও বাড়ি-ঘরে হামলা করেছে? তুমি কি শোননি, মুসলিম বিজয়ী সৈন্যরা নারীর সম্ভ্রমকে খুব বেশি মূল্য দিয়ে থাকে। তুমি কি আমাদের
তরুণ সেনাপতি বিন কাসিমকে দেখোনি। সে ইচ্ছা করলেই তো তাঁর রক্ষিতা হিসেবে তোমাকে রাখতে পারতো।
হ্যাঁ, তা সেই সেনাপতি করতে পারত বটে। কিন্তু এরপরও আমি ভয় পাচ্ছি, কে আমাকে বিয়ে করবে?
আমিও করতে পারি? কিন্তু এজন্য তোমাকে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে কায়মনে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে এবং মনে প্রাণে আমাকে গ্রহণ করতে হবে।
উপস্থিত এক লোক হঠাৎ বলে উঠল, খলিফাতুল মুসলিমীন! এই তরুণীকে বিয়ে করার আমার সাধ কি তাহলে পূরণ হবে না? একে আমি নিজের জন্যেই পছন্দ করেছিলাম কিন্তু তোমাকে বিমুখ করতে চাই না আমি। ঠিক আছে, তোমার সাথেই ওর বিয়ে হবে, বললেন খলিফা।
ইতিহাসে সেই ব্যক্তিকে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মালেক লেখা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস একথাটি পরিষ্কার করেনি কেন এই লোকটি এই তরুণীকে বিয়ে করতে আগ্রহী ছিল এবং কি ছিল তার পদবী ও পরিচয়। তাছাড়া খলিফাই বা কেন সেই লোকের সাধকে তার নিজের আকাক্ষার ওপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দাহিরের ভাগ্নী ইসলাম গ্রহণ করলে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের সাথে বিয়ে হয়। দীর্ঘ দিন সে আব্দুল্লাহর সংসারে ছিল কিন্তু এর গর্ভজাত কোন সন্তানাদি হয়নি। এরপর খলিফা আব্দুল মালেকের মনোভাব সম্পূর্ণ বদলে গেল। তিনি সিন্ধু অভিযানের সার্বিক খোজ খবর নেন এবং সাহায্য সহযোগিতা করতে শুরু করেন। তিনি এই অস্বাভাবিক বিজয়ের জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে মোবারকবাদ পাঠিয়ে বলেন, আমার এই বার্তা বিন কাসিমকেও পৌছে দেবেন।
এদিকে দামেশকে রাজা দাহিরের ছিন্নমস্তকটি একটি বল্পমে বিদ্ধ করে সারা শহরে প্রদক্ষিণ করিয়ে আনা হলো। প্রদর্শন করানো হলো শহর জুড়ে।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কাব বিন মুখারিকের মাধ্যমে পুনরায় বিন কাসিমের কাছে পয়গাম পাঠালেন। পয়গামের শুরুতে তিনি বিন কাসিম কিভাবে অগ্রসর হবেন এজন্য তাঁকে দিক নির্দেশনা এবং উজ্জীবনীমূলক উপদেশ দিলেন। সেই সাথে পূর্বের মতোই তিনি বিন কাসিমকে তেলাওয়াত যিকির ও
ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থেকে আল্লাহর মদদ ও নুসরতের জন্যে কায়মনো বাক্যে প্রার্থনা করার উপদেশ দিলেন।
বিন কাসিম ততো দিনে রাওয়া দুর্গে প্রশাসক নিয়োগ করে সেখানকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন কাজ সম্পন্ন করেছেন। এদিকে দুর্গের স্থাপত্য কাঠামো ও দুর্বলতা পর্যবেক্ষণ করার জন্য গোয়েন্দা প্রধান তার বেশ বদল করে দুর্গের চারপাশ ঘুরে দেখতে বের হলেন। শা’বান ছাকাফী স্থানীয় বহু লোককে গোয়েন্দা কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তাদের ঘুরে বেড়ানোতে কোন জটিলতা ছিল না। এরা স্থানীয় আশ্রয়প্রার্থী হিসাবে সারা দুর্গের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতো। আবার সময় সময় দুর্গের বাইরেও চলে যেত। স্থানীয় অধিবাসী হওয়ায় তাদের কেউ সন্দেহের চোখে দেখার অবকাশ ছিল না।
উরুঢ় থেকে কিছু দুরে বাহ্মণবাদের পথে বাহরু নামের একটি দুর্গ ছিল। গোয়েন্দারা বিন কাসিমকে খবর দিলো, সেই দুর্গে প্রায় ষোল হাজার হিন্দু সৈন্য জমায়েত হয়েছে। বিন কাসিমের পরবর্তী টার্গেট ছিল ব্রাহ্মণাবাদ। তিনি এ দুর্গ এড়িয়ে ঘোর পথে ব্রাহ্মণাবাদ আক্রমণ করতে পারতেন কিন্তু এতো বিপুল বাহিনীর সমাগমকে এড়িয়ে যাওয়া ছিল সামরিক বিবেচেনায় মারাত্মক ভুল। ফলে এই দুর্গের সৈন্যদের পরাস্ত করা জরুরী হয়ে পড়ল। ৯৩ হিজরী সনের শাওয়াল মাসের শেষ সপ্তাহে বিন কাসিম রাওয়া দুর্গ থেকে রওয়ানা হলেন। বিন কাসিম ভেবে ছিলেন পূর্বের মতো তিনি হয়তো শত্রুবাহিনীর অজ্ঞাতে বাহরু পৌছে যাবেন। কিন্তু তার এই ধারণা ছিল ভুল। কারণ বাহরু দুর্গ অবরোধের সাথে সাথে সেখানকার নওজোয়ান সৈন্যরা তাঁর বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড তীর বৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শুরু করে।
মুসলমানরা যখন অবরোধে লিপ্ত ঠিক সেই সময় অভাবনীয় ভাবে শত্রু বাহিনীর পক্ষ থেকে তীর বৃষ্টি শুরু হয়। দৃশ্যত দুর্গপ্রাচীরে অবস্থান নেয়া সৈন্যদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা আতঙ্কিত ভীত। আর দুর্গের ভিতরে লোকজনের অবস্থান আছে। বলেও মনে হচ্ছিল না। দুর্গপ্রাচীরের সৈন্যদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তারা মুসলিম সৈন্যদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করতে ভয় পাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে মুসলিম সৈন্যরা দুর্গপ্রাচীরের একেবারে কাছে চলে গিয়ে ছিল। এই সুযোগে শত্রুসেনারা তাদের ওপর তীরের তুফান বয়ে দিল। ফলে বহু সংখ্যক মুসলিম যোদ্ধা তীরবিদ্ধ হয়ে পড়ল এবং অবরোধ চেষ্টা ভেঙে পড়ল। মুসলমানদের মধ্যে দেখা দিল বিশৃঙ্খলা। এই সুযোগে শত্রু সৈন্যরা দুর্গের প্রধান ফটক ও আরো একটি ফটক খুলে বিদ্যুৎ বেগে মুসলিম সৈন্যদের ওপর হামলে পড়ল।
হিন্দু সৈন্যদের আক্রমণ ছিল তীব্র এবং সুশৃঙ্খল। আকষ্মিক আক্রমণে মুসলমানরা কাবু হয়ে গেল। প্রতিরোধের আয়োজন করার আগেই ওরা তাদের লক্ষ্য পূর্ণ করে দুর্গে ফিরে যেতে শুরু করল।
এই আকস্মিক আক্রমণের ফলে বিন কাসিমকে তার রণকৌশল এবং চিন্তা-ভাবনাকে ঢেলে সাজাতে হলো। তিনি সকল সৈন্যকে পিছনে সরিয়ে আনলেন। তখন পর্যন্ত হিন্দুদের আক্রমণে শাহাদাত বরণকারী যোদ্ধাদের লাশ তাদের সামনে পড়ে রয়েছে এবং যেসব যোদ্ধা মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে ওঠার মতো শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল তারা ময়দানে পড়ে পড়ে কষ্টযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। দিন শেষে রাতের বেলায় নিহত ও আহত সহযোদ্ধাদের উঠিয়ে আনা হলো। পরদিন বিন কাসিম কোন ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নিলেন না। আহত ও নিহতদের সেবা শুশ্রুষা দাফন কাফনেই দিন চলে গেল। দিন শেষে সকল সেনাপতি ও কমান্ডারদের ডেকে বিন কাসিম তাদের সাথে পরামর্শ করে নতুন সমরকৌশল গ্রহণ করলেন। সকল মুসলিম কমান্ডারই বুঝতে পেরেছিল, এই দুর্গ জয় করার ব্যাপারটি সহজসাধ্য হবে না।
তৃতীয় দিন বিন কাসিম তীরন্দাজ ও দুর্গ ভেদকারী সৈন্যদের এক জায়গায় জমা করলেন। বিন কাসিম তীরন্দাজকে নির্দেশ দিলেন, ডানে বামে এবং দেয়ালের ওপরে এ ভাবে তীর নিক্ষেপ করবে যাতে দেয়ালের ওপরের কোন শত্রু সৈন্য মাথা ওপরে উঠাতে না পারে? তীরন্দাজরা তীর বর্ষণ শুরু করতেই বিন কাসিম প্রশিক্ষিত দেয়াল ছিদ্রকারীদের দৌড়ালেন। তারা দেয়ালে গাত্রে আঘাত করতে শুরু করল। কয়েক আঘাত করার পরই দেখা গেল দেয়াল খুব শক্ত নয়, পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি। আঘাত করতেই পাথর দেয়াল গাত্র থেকে খসে পড়তে শুরু করল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল দুর্গপ্রাচীরটিকে যতোটা নরম ভাবা হয়েছিল আসলে ততোটা নরম নয়। দেয়ালের গড়ন প্যাছানো বাকানো। তাছাড়া দেয়ালটির নীচের অংশ খুবই পুরু। তাতে ভাঙন ধরানো মানে রীতিমতো পাহাড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করা।
দুর্গপ্রাচীর ভাঙার কাজে যে পরিমাণ আরব যোদ্ধা অংশ গ্রহণ করেছিল, তারা নির্বিঘ্নে কাজ করলে তাদের পক্ষে দুর্গপ্রাচীরে গর্ত সৃষ্টি করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু প্রাচীরের কোণায় পাহারারত প্রহরীদের প্রতি তীর নিক্ষেপ না করতে পারায় তারা মুসলিম যোদ্ধাদের দেয়াল ভাঙার অভিযান দেখে ফেলল। তারা দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে বড় বড় পাথর ও গাছের কাণ্ড নীচে ফেলার ব্যবস্থা করল। সেই সাথে জ্বলন্ত কাঠের টুকরো নীচে গড়িয়ে দিল।
মুহুর্তের মধ্যে দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে নীচের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বড় বড় পাথর গাছের কাণ্ড ও জ্বলন্ত কাঠ ফেলতে শুরু করলে দেয়াল গাত্রে ধাক্কা খেয়ে পাথর কাঠ নীচে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল।
হিন্দু সৈন্যদের এই ব্যবস্থা মুসলমানদের জন্যে মুসীবত বয়ে আনল। ওপর থেকে পতিত পাথর ও জ্বলন্ত কাঠে বেশ কজন মুসলিম সৈন্য ঝলসে গেল এবং শরীর থেতলে গেল। কয়েকজন সৈন্য মারাত্মক ভাবে পাথর চাপা পড়ে আহত হলো। মোট কথা, কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসাবে হিন্দুসৈন্যদের এই উদ্যোগ সফল হলো। অবশ্য হিন্দুদের এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে গিয়ে তাদের বেশ কয়েকজন সৈন্য তীর বিদ্ধ হয়ে নিহত হলো। কিন্তু তাতেও প্রতিরোধ ব্যবস্থায় কোন ধরনের শৈথিল্য দেখা গেল না।
অবশেষে বিন কাসিমের দুর্গপ্রাচীর ভাঙ্গার কৌশলও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। ফলে এটা ত্যাগ করে বিন কাসিম দুর্গফটক ভাণ্ডার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু হিন্দু তীরন্দাজরা আরব সৈন্যদেরকে দুর্গফটকের ধারে কাছে ভীড়তেই দিচ্ছিল না। কয়েক ধরনের কৌশল অবলম্বন করলেন বিন কাসিম। কিন্তু কোন কৌশলই দুর্গফটক ভাঙার কাজে সফল হলো না। অপর দিকে হিন্দু সৈন্যরা দুর্গফটক দিয়ে হঠাৎ বের হয়ে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে আবার দুর্গে ফিরে যাওয়ার কৌশলও অব্যাহত রাখল। অবশেষে বিন কাসিম বুঝতে পারলেন, আমরা যেমন রাতের বেলায় ঝটিকা আক্রমণ করে পালিয়ে যাই হিন্দু সৈন্যরাও অবরোধ ভাঙার জন্য এই ঝটিকা ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে।
শত্রুদের এই ব্যবস্থা ব্যর্থ করার জন্য বিন কাসিম চিন্তা করলেন, হিন্দু সৈন্যরা যখন দুর্গ থেকে বের হয়ে ঝটিকা আক্রমণে অগ্রসর হবে তখন আমরা ওদেরকে ঘেরাও এর মধ্যে ফেলে কুপকাত করব।
এই চিন্তার তিন দিন পর পুনরায় হিন্দু সৈন্যরা দুর্গ থেকে বেরিয়ে মুসলিম সৈন্যদের উপর আক্রমণে অগ্রসর হলো। তখন মুসলিম সৈন্যরা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ডানে-বামে অগ্রসর হয়ে হিন্দু সৈন্যদেরকে ঘেরাও করে ফেলল। এই ঘেরাও করতে গিয়ে মুসলিম যোদ্ধারা দুর্গফটক ও প্রাচীরের একেবারে কাছে চলে গিয়েছিল, ফলে তাদের দিকে দুর্গপ্রাচীর থেকে তীর বৃষ্টির
পাশাপাশি পাথর নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করল। এমতাবস্থায় হিন্দু অশ্বারোহীরা অশ্বহাঁকিয়ে মুসলিম যোদ্ধাদের মাড়িয়েই আবার দুর্গে ঢুকে পড়ল। এবার বিন কাসিম বিরাট ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি নিলেন। তিনি কয়েকজন জীবন ত্যাগী যোদ্ধাকে দুর্গফটকের কাছাকাছি অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিলেন। এবার দুদিন পর হিন্দু সৈন্যরা দুর্গ থেকে বের হলো। এদিকে ওদের বের হতে দেখেই মুসলিম যোদ্ধারা ঘোড়া হাঁকাল। এবার উভয় দলের মধ্য শুরু হলো মুখোমুখি সংঘর্ষ। মুসলিম যোদ্ধারা পূর্ব থেকে তরবারী ও বল্লম নিয়ে প্রস্তুত ছিল ফলে হিন্দু সৈন্যরা বের হতেই ওদের ওপর মুসলিম যোদ্ধারা হামলে পড়ল। যেহেতু মুসলিম সৈন্যরা ছিল দুর্গের বাইরে এজন্য তারা ডানে-বামে ইচ্ছামতো মোড় নিতে পারছিল কিন্তু হিন্দুদের সেই সুযোগ ছিল না, কারণ তারা এদিক সেদিক হতে চাইলেই প্রতিপক্ষের সহজ আক্রমনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে এবার আরব সৈন্যরা ওদের কাবু করে রীতিমতো কচুকাটা করতে লাগল।
দৃশ্যত পরিস্থিতি এমন মনে হচ্ছিল যে, মুসলিম সৈন্যরা এবার ওদের কচুকাটা করে দুর্গে প্রবেশ করবে। বিন কাসিম সহযোদ্ধাদের উৎসাহিত করতে একেবারে কাছে চলে গিয়েছিলেন। এমন সময় হঠাৎ একটি তীর এসে বিন কাসিমের ঘোড়ার জিনে বিদ্ধ হলো। অবস্থা এমন যে তার জীবন মৃত্যুর মাঝে মাত্র কয়েক চুল ব্যবধান ছিল। এই অবস্থা মুসলিম শিবিরের এক অশ্বারোহী দেখে ফেলল। বিন কাসিম তার দিকে ছোড়া তীরটি জিন থেকে তুলে ফেলে দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। তিনি একে কোন গুরুত্বই দিলেন না। তিনি বরং বিপুল উৎসাহে সহযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করার জন্যে চিৎকার করে তাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন।
যে আরব যোদ্ধা বিন কাসিমের জিনে তীর বিদ্ধ হতে দেখেছিল, কাল বিলম্ব না করে সে বিন কাসিমের দিকে ঘোড়া হাঁকাল। সে এসে বলল, সম্মানিত প্রধান সেনাপতি! আপনি এখান থেকে চলে যান। আল্লাহ না করুন, আপনি না থাকলে আমাদের সবকিছুই নাই হয়ে যাবে।
যাও এখান থেকে, নিজের জায়গায় চলে যাও। সেই যোদ্ধাকে ধমক লাগালেন বিন কাসিম। কিন্তু সেই আরব যোদ্ধা প্রধান সেনাপতির ধমকি হুমকিকে কোন পরওয়া না করে, থাবা দিয়ে বিন কাসিমের ঘোড়ার লাগাম ধরে তাঁর ঘোড়া দৌড়িয়ে দিল। বিন কাসিম চিৎকার করলেন কিন্তু সেই
সহযোদ্ধা তার চিৎকারে থামল না। তাঁর ঘোড়াকে টেনে অনেকটা দূরে নিয়ে গেল যেখানে তীর বিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা নেই।
ইবনে কাসিম! আপনার মূল্য অনেক। আমার মতো হাজারো আরব মারা গেলে কিছু হবে না। এই অশ্বারোহী বিন কাসিমকে পুনর্বার কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই লড়াইয়ের দিকে অশ্ব হাকাল। ঠিক সেই সময় একটি তীর এসে তার পাজরের নীচে বিদ্ধ হলো। যোদ্ধাটি তীর বিদ্ধ হয়ে ঘোড়া থেকে এক পাশে ঝুকে পড়তে শুরু করল, বিন কাসিম তা দেখে বিজলীর মতো গিয়ে তাকে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করলেন এবং তার ঘোড়াটিকেও বিন কাসিম নিজের ঘোড়ার পিছনে আটকে ফেললেন।
আপনি জীবিত থাকুন বিন কাসিম! আপনি বেঁচে থাকলে বিজয় আমাদের অনিবার্য। একথা বলতেই যোদ্ধার মাথা বিন কাসিমের ঘাড়ে নেতিয়ে পড়ল। বিন কাসিম তাকে ধরাধরি করে ঘোড়া থেকে নামানোর জন্য আর দু’জনকে ডাক দিলেন। অপর দিকে হিন্দু বাহিনীর চোখের সামনে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। তাদের মনে হচ্ছিল এবার আর রক্ষা নেই, মুসলিম বাহিনী দুর্গে ঢুকে পড়বে। ভয় পেয়ে বিপুল সংখ্যক হিন্দুযোদ্ধাকে দুর্গের বাইর রেখেই তারা দুর্গফটক বন্ধ করে ফেলল। দুর্গে ফেরার পথ বন্ধ হতে দেখে হিন্দু সৈন্যদের মন ভেঙে গেল। আর এই সুযোগে আরব যোদ্ধারা ওদেরকে কচুকাটা করল।
বিন কাসিমকে তার কোন এক সেনাপতি পরামর্শ দিলেন, লড়াই না করে অবরোধ দীর্ঘায়িত করা হোক যাতে কষ্ট যাতনায় অতীষ্ট হয়ে দুর্গবাসীরা সৈন্যদেরকে অস্ত্র সমর্পনে বাধ্য করে। সেই যুগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাসের পর মাস দুর্গ অবরোধ করে রেখে শত্রুদের আত্মসমর্পনে বাধ্য করা হতো। এমন ছিল যে, টানা দু’বছর পর্যন্তও অবরোধ ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত দুর্গপতি আত্মসমর্পন করে প্রথমেই বলতো, যা আছে আমাদের আগে কিছু খাবার দাও। না, তা হতে পারে না, প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন বিন কাসিম। আমার হাতে এতো সময় নেই। আমাদের লক্ষ্য বহু দূর। অথচ জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া আমি শত্রুদের এ ধারণা করার সুযোগ দিতে চাই না
যে, আমরা তাদের শক্তিকে ভয় পেয়ে দূরে বসে আছি। এখন থেকে রাতেও লড়াই অব্যাহত থাকবে।
সকল সেনাপতি ডেপুটি সেনাপতি ও কমান্ডারদেরকে ডাকলেন বিন কাসিম। তিনি গোটা বাহিনী ও অফিসারদের দু’ভাগে ভাগ করলেন। নির্দেশ দিলেন, এক অংশ দিনের কার্যক্রম চালু রাখবে এবং অপর অংশ রাতের বেলায় অগ্ৰিতীর ও মিনজানিক চালাবে। পর দিন থেকে নতুন নিয়মে লড়াই শুরু হল। দিনের বেলায় উভয় দিক থেকে তীর নিক্ষিপ্ত হতো, দেয়াল ভাঙার ইউনিট দেয়াল গাত্রে ছিদ্র করার চেষ্টা চালাতো, আবার কখনো শত্রুপক্ষের কোন ইউনিট বেরিয়ে এসে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে আবার দুর্গে চলে যেত। এটা ছিল গতানুগতিক রীতি। কিন্তু একরাতে হঠাৎ দুর্গের ওপর থেকে আগুন পড়তে শুরু করল আর দুর্গের। ভিতরে ভারী পাথর আঘাত হানতে শুরু করল। অগ্নিতীর নিক্ষেপের প্রথম রাতেই এই সাফল্য দেখা গেল যে দুর্গের ভিতর থেকে আগুনের কুণ্ডলী উঠতে দেখা গেল। তাতে বুঝা গেল ঘরবাড়ি জ্বলছে। একপর্যায়ে বিন কাসিম অগ্নিতীর ও পাথর নিক্ষেপ বন্ধ করিয়ে দিলেন, কারণ জ্বালানী ও পাথর তাকে খুবই কার্যকর ভাবে ব্যবহার করতে হবে। কারণ সিন্ধু অঞ্চলের এ জায়গাটা বালুময় এখানে কোন পাথর নেই।
জ্বালানী সংকটও তীব্র। অতএব পাথর ও জ্বালানীর ব্যবহার সঠিক ভাবে করা হলে তার বাহিনীকেই জরুরী এই দুটি পণ্যের জন্যে বিপদে পড়তে হবে। পরদিন সকল বেলায় সৈনিকদের পালা বদল হলো। দিনের ডিউটি করার জন্য সৈন্যরা রাতের সৈন্যদের স্থলাভিষিক হল। গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফী সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, আজ যদি শত্রুবাহিনী ঝটিকা অভিযান চালায় তবে ওদের দু’চারজনকে জীবিত পাকড়াও করার চেষ্টা করবে।
সেদিনের দ্বিপ্রহরের পর একটির বদলে একসাথে দুর্গের তিনটি ফটক খুলে গেল। এসব ফটকের একটি দিয়ে পদাতিক এবং অপর দুটি দিয়ে অশ্বারোহী সৈন্যরা দ্রুত বেরিয়ে জোরদার ঝটিকা আক্রমণ চালালো কিন্তু মুসলমানরা যেহেতু পূর্ব থেকেই জীবিত শত্রুসেনা পাকড়াও করতে প্রস্তুত ছিল, তাই তারা পূর্ণ সতর্কতায় এ ভাবে মোকাবেলা করল যে, তিন শত্রু সৈন্যকে তারা পাকড়াও করে ফেলল এবং কয়েকজন আহত সৈন্যকে ফেলে রেখেই বাকীরা দুর্গে ফিরে গেল।
জীবিত ও আহত শত্রু সেনাদেরকে গোয়েন্দা প্রধানের কাছে নেয়া হলো। তিনি শত্রুসেনাদের প্রত্যেককেই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে জিজ্ঞেস করলেন। গতরাতে দুর্গের ভিতরে কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং এই আক্রমণ সম্পর্কে দুর্গবাসীরা কি বলাবলি করছে? মৃত্যুভয়ে শত্রুসৈন্যদের অনেকেই দুর্গের প্রকৃত অবস্থা বলে দিল। পাথর বর্ষণে কয়েকটি দালান বাড়ির ছাদ ধসে গিয়েছিল। ফৌজী আস্তাবলে পাথর পতিত হওয়ায় ডজন খানিক ঘোড়ার মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বেশি আশাপ্রদ ঘটনা ছিল দুর্গবন্দি শহরবাসী পাথর ও অগ্নিবাহী তীর নিক্ষেপে মারাত্মকভাবে ভয় পেয়ে গেছে। ভয়ে লোকজন ঘরের বাইরে খোলা আকাশের নীচে রাত্রি যাপন করতে শুরু করে। সাধারণ লোকজনের মধ্যে মারাত্মক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সৈন্যও অগ্নিতীর এবং পাথর নিক্ষেপে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী তাদের জিজ্ঞেস করলেন, সেনাদের রসদপত্র ও সাজসরঞ্জাম কোথায় রাখা হয়েছে? তারা কয়েকটি সেনা ছাউনীর কথা বলল। এও জানালো, কোথায় সৈন্যদের রসদপত্র রাখা হয় এবং দুর্গপ্রাচীরে থেকে এগুলোর দূরত্বের কথাও তারা জানিয়ে দিলো ওদের কাছ থেকে রিপোর্ট নিয়ে গোয়েন্দা প্রধান বিন কাসিমকে জানালেন, আজ রাতে এসব স্থানে পাথর ও অগ্নিতীর নিক্ষেপ করতে হবে।
সূর্য ডুবে গেল। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল রাত। রুটিন মতো মুসলমান তীরন্দাজ ও মিনজানিক ইউনিট দুর্গপ্রাচীরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। হিন্দু বন্দীদের থেকে উদ্ধারকৃত তথ্য মতে লক্ষ বস্তুতে আঘাত হানতে মিনজানিকগুলো তীরন্দাজদের সুবিধা মতো জায়গায় দাঁড় করানো হলো। দুর্গের অধিবাসীরা যাতে নিরাপদ মনে করে ঘরে ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে এজন্য তীর ও পাথর নিক্ষেপ অর্ধরাতের পর করার সিদ্ধান্ত হলো। ঘুমন্ত অবস্থায় নিক্ষিপ্ত পাথর ও অগ্নিতীরে আতঙ্কিত মানুষ ঘাবড়ে গিয়ে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি শুরু করে দেবে এবং প্রতিরোধের কথা চিন্তা করার অবকাশ পাবে না। এ ধরনের হুলস্থুল কাণ্ড মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়, পরিস্থিতি বেশামাল হয়ে পড়ে। মাঝরাতের পর সবগুলো মিনজানিক থেকে একই সাথে পাথর নিক্ষিপ্ত হলো, সেই সাথে অগ্নিবাহী তীরগুলো শুরু করল অগ্নিবর্ষণ। কিছুক্ষণ পর
দ্বিতীয় বার একই সাথে মিনজানিকগুলো পাথর নিক্ষেপ করল। এবার দুর্গের ভিতরকার লোকজনের চিৎকার চেচামেচি হই হুল্লোড় এতোটাই প্রকট শোনা গেল যেন দুর্গের সব লোক দুর্গপ্রাচীরের ওপরে উঠে চিৎকার করছে। দুর্গের এপাশ থেকেও দেখা গেল নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে বাড়িঘর ধ্বসে পড়ার শব্দ। বিন কাসিম এদিক থেকে ঠিকই অনুমান করলেন এ মুহূর্তে শহরে কোন পর্যায়ে হই হুল্লোড় শুরু হয়েছে। প্রাচীরের এ পাশ থেকে দেখা গেল বিশাল কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। আগুনের শিখা এতোটাই ওপড়ে উঠে গেল যে, দুর্গের সবটাই আলোকিত হয়ে গেল। দুর্গের আগুনের আলো দুর্গের বাইরেও আলোকিত করে ফেলল। এই অগ্নিকাণ্ড ঘটলো দুর্গপ্রাচীরের কাছেই সৈন্যদের ঘোড়ার খাবার হিসাবে সংরক্ষিত ঘাসের স্তুপে অগ্নি সংযোগের কারণে। মুসলিম তীরন্দাজদের ছোড়া অগ্নিতীর হিন্দু সৈন্যদের সংরক্ষিত পশু খাদ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে জ্বলে ওঠে আগুন। গোটা এলাকা গ্রাস করে ফেলে আগুনের কুণ্ডলী। এসময় দুর্গপ্রাচীরের ওপরে দাঁড়ানো হিন্দু প্রহরীদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন একেকটি জীবন্ত ভূত।
ইবনে কাসিম! এরা আগুন নেভাতে গিয়ে দুর্গের গোটা পানিই খরচ করে ফেলবে। দেখবেন পানির অভাবে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে ওরা আগামীকালের মধ্যে আত্মসমর্পন করতে দুর্গের ফটক খুলে দেবে, বিন কাসিমের কাছে এসে বললেন, এক জ্যৈষ্ঠ সেনাপতি। হু, দুর্গে আপনার মতো এমন বুদ্ধিমান সেনাপতির অভাব নেই। আমরা। এতোদূর পর্যন্ত এসে অনায়াসে দুর্গেরপর দুর্গ জয় করেছি কিন্তু এই দুর্গটি দখলে নিতে কঠিন বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। আপনি কি দেখেননি, এরা কতো শক্তিশালী মোকাবেলা করছে? বললেন বিন কাসিম। আপনি ভেবেছেন, এখানে পানি স্বল্পতা দেখা দেবে কিন্তু এটা ভাবতে পারেননি, এরা আগুন। নেভাতে পানির বদলে বালু ব্যবহার করবে। কারণ এখানে বালুর কোন অভাব নেই। আগুন নেভাতে পানির চেয়ে বালু আরো বেশি কার্যকর।
তবুও দেখবেন আগামী সন্ধ্যার মধ্যে আমরা দুর্গে প্রবেশ করবো, বললেন সেনাপতি। বলুন এখুনি দুর্গে প্রবেশ করবো আমি। আগামীকাল পর্যন্ত বেচে থাকার কোন নিশ্চয়তা কি আপনার কাছে আছে? তিনি একান্ত এক সংবাদবাহককে বললেন, প্রাচীর গর্তকারী ইউনিটকে এখুনি আসতে বল।
বিন কাসিম দেখতে পাচ্ছিলেন, দুর্গের ভিতরে মারাত্মক হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে। দুর্গপ্রাচীরের ওপর কোন সৈন্যকেই আর দেখা যাচ্ছে না। প্রাচীর ছিদ্রকারী ইউনিট এলে বিন কাসিম নিজে তাদেরকে নিয়ে দুর্গপ্রাচীরের কাছে চলে গেলেন। প্রাচীর গাত্রে হাত রেখে একটি জায়গা দেখিয়ে বললেন, এই জায়গায় ছিদ্র করার চেষ্টা কর। এতটুকু ছিদ্র করবে, যাতে দু’জন পদাতিক সৈন্য নির্বিঘ্নে ঢুকতে পারে।
সৈন্যরা প্রাণপণে দুর্গপ্রাচীর ভাংতে শুরু করল। বিন কাসিম দুর্গপ্রাচীর থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং সেনাপতিদের ডেকে বললেন, আমার কিছুসংখ্যক জীবন ত্যাগী পদাতিক দরকার, ভেতরের ভয়াবহ হৈ হুল্লোড়ের সুযোগে যারা দুর্গপ্রাচীরের ছিদ্র দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করবে। এ দিকে সৈন্যরা বিপুল উদ্যোমে প্রাচীর ভাংতে শুরু করল। সূর্য ওঠার আগেই দুর্গপ্রাচীরে এমন ছিদ্র করে ফেলল, যা দিয়ে দু’জন বিশালদেহী মানুষও অনায়াসে আসা-যাওয়া করতে পারবে। প্রাচীর ভেদ করে দুর্গে প্রবেশের জন্যে নির্বাচিত সৈন্যরা নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। তন্মধ্যে সবার অগ্রগামী ছিল বসরার অধিবাসী হারুন বিন জাফর, আর দ্বিতীয়জনের নাম আবুল কাসেম। এই দুজনের পরেই যারা দুর্গেরপ্রবেশ করলো এদের মধ্যে কয়েকজন ছিল মুকুর সৈন্য। আগেই বলা হয়েছে, রাওয়া যুদ্ধ থেকেই মুকু তার দলবল নিয়ে বিন কাসিমের সাথেই ছিল এবং সমতালে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছিল। এবার দুর্গে প্রবেশের জন্য মুকুর সৈন্যদল থেকে কয়েকজনকে নির্বাচন করা হলো।
অস্বাভাবিক অগ্নিকাণ্ড দুর্গবাসীদেরকে কোন দিকে তাকানোর অবকাশ দিলো না। সাধারণ লোকদের সাথে সৈন্যরাও আগুন নেভাতেই ব্যস্তছিল। লোকজন নিজেদের জরুরী আসবাবপত্র টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এমতাবস্থায় মুসলিম সৈন্যরা হামলে পড়ল। মুসলিম যোদ্ধারা ঢুকে কয়েকজন সবচেয়ে কাছের ফটকের দিকে দৌড়ে গেল। সেখানে মাত্র কয়েকজন হিন্দু সেনা ফটক পাহারায় লিপ্ত ছিল। তারা মুসলিম যোদ্ধাদের কিছুতেই মোকাবেলা করতে পারল না। কারণ তারা যখন দেখল দুর্গের ভেতর থেকে মুসলিম সৈন্যরা তাদের ওপর আক্রমণ করছে, তখন তারা ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। প্রধান ফটক খুলে দেয়াটাই যথেষ্ট ছিল। এর মধ্যে ভোরের আলো বিকশিত হওয়ার আগেই হাজার হাজার সৈন্য দুর্গে প্রবেশ করল। বিন কাসিম
নিজেও তখন সৈন্যদের সাথে দুর্গে প্রবেশ করলেন। তিনি তার একান্ত বার্তাবাহকদের নির্দেশ দিলেন, সবাইকে বলে দাও কোন বেসামরিক নাগরিকের ওপর যেন আক্রমণ না করা হয়। সেই সাথে তিনি নির্দেশ দেন, কোন নারী ও শিশুর ওপর যেন হাত উঠানো না হয়। তাদেরকে যেন পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হয়।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, দুর্গের সৈন্যরা ছিল সত্যিকার অর্থেই লড়াকু, তারা বিপদ আসন্ন দেখে মৃত্যুপণ করে মোকাবেলা করল। কিন্তু সকল মুসলিম সৈন্য তখন দুর্গে প্রবেশ করে প্রবল বিক্রমে হিন্দুদের ওপর হামলে পড়েছে। ফলে অল্পক্ষণের মধ্যে ষোল হাজার হিন্দু সৈন্যের মধ্যে মাত্র কিছু সংখ্যককে পাকড়াও করা গেল, আর বাকীরা নিহত হলো। কিছুসংখ্যক সৈন্য পালিয়ে যেতেও সক্ষম হলো।
দুর্গ জয় হলো বটে কিন্তু বিন কাসিম ও মুসলিম সৈন্যদের অবস্থা এমন হলো যে, ক্লান্তি ও অবসন্নতায় তাদের আর চলার শক্তি ছিল না। প্রায় দু’মাস চলে গিয়েছিল এই দুর্গের নিয়ন্ত্রণ কব্জা করতে, এতো কষ্টকর দুর্গজয়ের পরও বিন কাসিমের পক্ষে দীর্ঘ বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ ছিল না। কারণ তখনো তার সামনে অজেয় দাহলিলা ও ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গ। যেখানে শত্রুবাহিনী শক্তি সঞ্চয় করছিল বলে তাঁর কাছে খবর পৌছে গিয়েছিল। বিন কাসিম আশঙ্কা করছিলেন এই দুর্গ থেকে পালিয়ে যাওয়া হিন্দু সৈন্যরা দাহলিলা দুর্গের শক্তি বৃদ্ধি করবে। নয়তো দাহলিলা দুর্গকে খালি করে সকল হিন্দু ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গে গিয়ে জড় হয়ে বিশাল শক্তিসঞ্চয় করবে। এই আশঙ্কা বোধ করে সৈন্যদেরকে দীর্ঘ বিশ্রামের অবকাশ না দিয়ে বিন কাসিম দাহলিলা দুর্গের দিকে অগ্রাভিযানের নির্দেশ দিলেন, যাতে ওখানে গিয়ে সৈন্যরা প্রস্তুতি নেয়ার আগেই তিনি দুর্গ কব্জা করতে পারেন। অবশ্য অগ্রাভিযানের অর্থ এই ছিল না যে, পরদিনই তিনি রাওয়া দুর্গ ত্যাগ করেছিলেন। এখানকার প্রশাসনিক অবস্থা পুনর্বহাল করতে তার কয়েক দিন লেগে গেল। প্রায় সপ্তাহখানিক সময় তাঁর এই দুর্গের পরিস্থিতি সামলাতেই চলে গেল। রাওয়া দুর্গ থেকে রওয়ানা হতেই দুই গোয়েন্দা এসে বিন কাসিমকে খবর দিলো, দাহলিলা দুর্গে তেমন কোন বেসামরিক লোক নেই। ভয়ে সব
বেসামরিক লোক চলে গেছে নয়তো সৈন্যরাই তাদেরকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখানে শুধু সৈন্যরা অবস্থান করছে। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া লোকেরা ওখানে গিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। ওরা বলেছে, বাঁচতে চাইলে দুর্গ ছেড়ে পালাও মুসলিম বাহিনী আসছে। দুর্গে থাকলে পুড়ে মরতে হবে। এখানে অগ্নিতীর ও মিনজানিক থেকে ছুড়া পাথরের আতঙ্ক এরা এমনভাবে ছড়িয়েছে যে, বেসামরিক লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে লোকজন নিয়ে দুর্গ থেকে চলে গেছে। এখান থেকে যেসব সৈন্য পালিয়ে গেছে, ওরা কি দাহলিলা দুর্গে উঠেছে? গোয়েন্দাদের কাছে জানতে চাইলেন বিন কাসিম। ওরা পরস্পর কি বলাবলি করে? তোমরা কি ওদের কথাবার্তা শুনতে পেরেছ? এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া সৈন্যরা বেসামরিক লোকদের চেয়ে বেশি আতঙ্কিত, বলল গোয়েন্দা। কিন্তু সৈনিক হওয়ার কারণে ওরা পাল্টা লড়াই করতেই ওখানে থেকে গেছে। কিন্তু আমাদের ধারণা, ওরা দাহলিলা থেকেই সবার আগে পালানোর চেষ্টা করবে। ওরা যে ভাষায় এই দুর্গের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিয়েছে, তাতে সৈন্যদের মধ্যেও যে আতঙ্ক ভর করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গোয়েন্দাদের কথা থেকে বোঝা যাচ্ছিল, দাহলিলার সৈন্যরা অনেকটাই। ভীতু কিন্তু বিন কাসিম দাহলিলা দুর্গ অবরোধের পর বুঝতে পারলেন আসলে যতটা ভীতু মনে করা হয়েছিল, এখানকার সৈন্যরা ঠিক ততোটা ভীতু নয়। দুর্গ আমাদের কব্জায় দিয়ে দাও; তোমরা তো রাওয়া দুর্গের অবস্থা জানো’ ঘোষক দিয়ে প্রচার করালেন বিন কাসিম।
যারা পালিয়ে যাওয়ার তারা এখান থেকে চলে গেছে। পাথর ফেলো, আগুন লাগাও, দুর্গ জ্বালিয়ে দাও। কিন্তু দুর্গফটক খোলা হবে না। জবাব আসলো দুর্গপ্রাচীর থেকে।
আমরা যদি দুর্গ জয় করি, তাহলে কিন্তু কারো জীবন রক্ষা পাবে না? হুমকি দিলেন বিন কাসিম। আমাদের একটি সৈন্য জীবিত থাকতেও তোমরা দুর্গের দখল নিতে পারবে না, জবাব এলো দুর্গপ্রাচীর থেকে। বিন কাসিম চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করে দুর্গপ্রাচীর নিরীক্ষণ করলেন, সেই সাথে তার নিজের সৈন্যদের অবস্থানও দেখে নিলেন, তারা ঠিকমতো যথাস্থানে অবস্থান নিতে পেরেছে কি-না।
বিন কাসিম যখন দুর্গপ্রাচীরের চতুর্দিক দেখছিলেন, তখন তার দিকে তাক করে শত্রুরা একটি তীর ছুড়লো। তীরটি বিন কাসিমের অবস্থান থেকে খানিকটা দূরে এসে মাটিতে পড়ল।
শত্রুবাহিনীর তীর দেখে মুসলিম সৈন্যরাও তীর ছুড়তে শুরু করল। শুরু হলো উভয় দিক থেকে তীরবৃষ্টি। এখানকার সৈন্যরাও রাওয়ার সৈন্যদের কৌশল অবলম্বল করল। হঠাৎ দুর্গফটক খুলে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে আবার দুর্গে ফিরে গেল।
এই দুর্গের ভিতরে পাথর নিক্ষেপ ও অগ্নিতীর কোন ফল বয়ে আনার সম্ভাবনা ছিল না। কারণ এখানকার বসবাসকারী সাধারণ লোকজন দুর্গ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। দৃশ্যত দুর্গ ছিল লোকশুন্য। প্রশিক্ষিত সৈন্য ছাড়া আর লোকজন তেমন ছিল না। তাছাড়া রাওয়া দুর্গের ক্ষয়ক্ষতির কথা শুনে এখানকার সৈন্যরা তাদের সব সামরিক সরঞ্জাম দুর্গপ্রাচীর থেকে দূরে রেখেছিল। বিন কাসিম পূর্বেকার সবকৌশলই পরীক্ষা করলেন কিন্তু কোনটিই তেমন ফলোদয় হলো না। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, শত্রুবাহিনী যখন ঝটিকা আক্রমণে বের হবে তখন এদেরকে ঘেরাও করে হত্যা করতে হবে। এই পদ্ধতিতে কিছুটা কাজ হলো। শত্রু বাহিনীর জনবল কমতে শুরু করল। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকল। একপর্যায়ে তিনি দুর্গফটকের ওপর পাথর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। এতেও কিছুটা কাজ হলো।
ফটক খুবই মজবুত ছিল, পাথর নিক্ষেপে তা ভাঙ্গা সম্ভব ছিল না কিন্তু হিন্দু সৈন্যরা তাতে ভীত বিহ্বল হতে লাগল। কারণ তাদের মনোবল এমনিতেই ভঙ্গুর ছিল। শত্রু সৈন্যদের বিপর্যয় ঘটানোর জন্য বিন কাসিম নতুন কৌশল গ্রহণ করলেন। তিনি তার সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, এখন থেকে তীরন্দাজ ইউনিট দুর্গফটকের অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি অবস্থান করবে, শত্রু সৈন্যরা যখনই দুর্গফটক খুলে বের হবে তখনই ওদের ওপর তুমুল তীরবৃষ্টি শুরু করবে। বিন কাসিমের এই কৌশলও কিছুটা কার্যকর প্রমাণিত হলো। কিন্তু সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করার পরও দু’মাস পর্যন্ত অবরোধ বহাল রাখতে হলো। দু’মাসের টানা অবরোধে শত্রু সৈন্যরা জনবল হারিয়ে যেমন দুর্বল হয়ে পড়েছিল তদরূপ সরঞ্জামাদির সাপ্লাই না থাকায় তারা নানা দুর্ভোগের শিকার হয়েছিল। অবশেষে একদিন দুর্গফটক খুলে একটি মৌনমিছিল বের হতে দেখা গেল। মিছিলের সবার পরনে সাদা পোশাক এবং সবাই পদব্রজে
আরব-কন্যার আর্তনাদ অস্ত্রহীন। সবার শরীর থেকে আতরের ঘ্রাণ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। মিছিলটি গুণগুণিয়ে কি যেন জপমালা পাঠ করতে করতে মুসলিম সৈন্যদের অতিক্রম করে এগিয়ে গেল। একটু পরেই দেখা গেল দুর্গফটক খালি, দুর্গপ্রাচীরের কোথাও কোন সৈন্য নেই। দুর্গের সৈন্যরা যখন দেখল মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা করার মতো কোন শক্তি আর তাদের অবশিষ্ট নেই, তখন তারা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে শোক মিছিল সহকারে নিরস্ত্র অবস্থায় দুর্গ ত্যাগ করে চলে গেল। করল নীরব আত্মসমর্পণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। তারা কোন লোকালয় বা দুর্গের দিকে না গিয়ে বিজন মরুভূমির পথে চলে গেল। বিন কাসিম তাঁর সৈন্যদের নিয়ে দুর্গে প্রবেশ করলেন। তারা শত্রুসৈন্যদের রেখে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র একত্রিত করলেন। দুর্গের ভিতরে কিছুসংখ্যক বেসামরিক লোক ছিল। তাদের বলা হলো, তোমরা তোমাদের আত্মীয় স্বজনদের দুর্গে ফিরে আসার জন্য খবর দাও। নাবাহ বিন হারুনকে বিন কাসিম দাহলিলা দুর্গের প্রশাসক নিযুক্ত করলেন এবং এখানেই অবস্থান নিলেন।
বিন কাসিম দাহলিলা দুর্গ থেকে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন রাজা মহারাজাদের কাছে পয়গাম পাঠালেন। পয়গামে তিনি হিন্দু রাজা মহারাজাদেরকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলেন। এই দাওয়াত ছিল সৌজন্যমূলক। তাতে কোন ধরনের হুমকি ছিল না। পয়গামে তিনি ইসলামের আদর্শিক সৌন্দর্যের কথা লিখলেন এবং ইসলামের মৌলিক ভিত্তিগুলোর বর্ণনা দিলেন। তিনি আরো লিখলেন, এপর্যন্ত যেসব এলাকা আমরা জয় করেছি, সেগুলোর অধিবাসীদের খোঁজ নিয়ে দেখুন, তারাই ইসলামের সৌন্দর্যের কথা বলতে পারবে। দাহলিলা দুর্গে চারজন অপরিচিত ব্যক্তি এসে বিন কাসিমের সাথে সাক্ষাত করার আগ্রহ প্রকাশ করল। তাদেরকে বিন কাসিমের কাছে সরাসরি না
নিয়ে আগে গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফীর কাছে উপস্থিত করা হলো। এটা ছিল গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীর নির্দেশ। যেকোন অজ্ঞাত পরিচয় লোক এলে যাতে বিন কাসিমের কাছে সরাসরি যেতে দেয়া না হয়। কারণ তাতে তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। কোন শত্রুর চর তার ওপর অতর্কিতে আত্মঘাতি আক্রমণ করে বসতে পারে। বিন কাসিমের নিরাপত্তার
প্রশ্নে প্রহরীদের প্রতি এমর্মে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন গোয়েন্দা প্রধান। লোক চারজন এসে বিন কাসিমকে জানালো, তারা রাজা দাহিরের এক মন্ত্রী সিয়াকর এর পক্ষ থেকে এসেছে। সিয়াকর একান্তই বিন কাসিমের বশ্যতা স্বীকার করে তার সংস্পর্শে থাকতে আগ্রহী। তবে ইসলাম গ্রহণ করা না করার ব্যাপারে সে স্বাধীন থাকতে চায়।
সিয়াকর ছিল রাজা দাহিরের মন্ত্রী সভার মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য ও জ্ঞানী উজির। শাবান ছাকাফীও বিন কাসিমকে সিয়াকরের জ্ঞান বুদ্ধি সম্পর্কে আগেই অবহিত করেছিল। সিয়াকরের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়ার সংবাদে উভয়েই খুব খুশি হলেন। বিন কাসিম আগত চার দূতকে ক্ষমামূলক পয়গাম দিয়ে তাদের বিদায় করলেন। ওদের চলে যাওয়ার কয়েক দিন পর সিয়াকর নিজে বিন কাসিমের দরবারে হাজির হলেন।
কোন কোন ঐতিহাসিক লিখেছেন, ডাভেল দুর্গ জয়ের পর দাহিরের হাতে যেসব আরব বন্দি ছিল সবাইকে মুক্ত করে বিন কাসিম তাৎক্ষণিক ভাবে আরব পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু সব বন্দি ডাভেল দুর্গে ছিল না। কিছু বন্দি উরুটে মন্ত্রী সিয়াকরের তত্ত্বাবধানে ছিল। যাদের সম্পর্কে এর আগে বিন কাসিমের কাছে কোন তথ্য ছিল না। সিয়াকর তার বিশ্বস্ততা জোরদার করার জন্যে তার আওতাধীন আরব বন্দীদের সাথে নিয়ে এলো এবং বিন কাসিমের উদ্দেশে বলল, মহান সেনাপতি! আমার বিশ্বস্ততার প্রমাণ হিসাবে আমি এদেরকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছি। এরাও সেই আরবদের সাথেই বন্দি হয়েছিল কিন্তু ডাভেল দুর্গে না রেখে এদেরকে উরুঢ়ে রাখা হয়েছিল। সিয়াকরের নিয়ে আসা বন্দীদের সবাই ছিল নারী। কিন্তু এরা সবাই ছিল বয়স্কা এবং পরিশ্রমী। দেখেই মনে হলো এরা আরব বংশোদ্ভূত নয়। প্রকৃতপক্ষে যেসব মুসলমান শ্রীলংকা থেকে হজ করার উদ্দেশে আরব রওয়ানা হয়েছিল এসব নারী ছিল তাদের সেবিকা। এরা আরব বনিকদের সেবাদাসী ছিল। আরবদের সংস্পর্শে গিয়ে এরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। বিন কাসিম এদেরকে পরখ করার জন্য আরবীতে নানা কথা জিজ্ঞেস করলে তারা আরবীতে জবাব দিলো। বিন কাসিম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের সাথে বন্দি অবস্থায় ওরা কেমন আচরণ করেছে। তারা জানালো, আমরা আগের মালিকের যে সব কাজ করতাম এদের কাছে গেলে তারাও আমাদের দিয়ে অনুরূপ কাজ করিয়েছে। আমরা ঘরদোর ঝাড়ু দিতাম, কাপড়
পরিষ্কার করতাম। ওদের বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো আমাদের খেতে হতো। আলাদা ভাবে আমাদেরকে তেমন কোন খাবার দেয়া হতো না।
বিন কাসিম এদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলেন, এরা বংশানুক্রমে দাস গোষ্ঠীজাত, বন্দিত্বে এদের মালিক বদল হয়েছে মাত্র। মূলত তাদের জীবনের খুব একটা ছন্দপতন ঘটেনি। এরা শুধু অতটুকুই বুঝতে পেরেছিল, তাদের আগের মালিকরা ছিল মুসলমান, আর এরা হিন্দু।
অবশেষে বিন কাসিম সিয়াকরকে জিজ্ঞেস করলেন, কি কারণে তোমার মধ্যে আমাদের আনুগত্য করার বাসনা জাগলো?
এখন আমি স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছি। এর আগে আমি রাজার উজির ছিলাম বটে কিন্তু পুরো পরিবার পরিজনসহ রাজার বন্দিত্বে ছিলাম। আমি রাজাকে পরামর্শ দিতাম বটে কিন্তু তখন আমাকে ভাবতে হতে কোন ধরনের কথা রাজা প্রছন্দ করবে। রাজা দাহির যখন মুসলমানদের জাহাজ লুট ও তাদের বন্দি করার চিন্তা করল, তখন আমি বলেছিলাম, এমনিতেই সিন্ধুর প্রতি আরবদের দৃষ্টি রয়েছে। তাছাড়া মাকরানের একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ আরবদের হাতে। এমতাবস্থায় কোনভাবেই আরবদের ক্ষিপ্ত করা ঠিক হবেনা। কিন্তু রাজা আমার পরামর্শ মানল না। এরপর যখন একাধারে দুজন আরব সেনাপতিকে হত্যা করে আরব বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করল, তাতে তার দেমাগ আরো বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং নিরঙ্কুশ করার জন্য সে অপর এক প্রভাবশালী উজির বুদ্ধিমানের পরামর্শে নিজের আপন বোনকে পর্যন্ত স্ত্রী করে রাখল।
তোমাদের ধর্মীয় গুরুরা কি রাজাকে সতর্ক করেনি যে, কোন ধর্মেই আপন বোনকে ভাই স্ত্রী করে রাখতে পারে না? সিয়াকরকে জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম। ধর্মীয় গুরুজন! রহস্যজনক অবজ্ঞাময় হাসি দিয়ে বলল সিয়াকর। ধর্মীয় গুরুরা তো রাজার সন্তুষ্টি লাভকেই ধর্ম মনে করে। আর রাজার নিজের কাছে ধর্মের চেয়ে ক্ষমতা ও রাজপাট বেশি প্রিয় ছিল। পুরোহিত যখন রাজাকে বলল, মহারাজ। আপনার ভবিষ্যত ভগ্নিপতি আপনার কাছ থেকে রাজ্যপাট ছিনিয়ে নেবে। তখন উজির বুদ্ধিমান পরামর্শ দিলো, মহারাজ! আপনিই বোনকে স্ত্রী বানিয়ে ফেলুন, তা হলে আর ভগ্নিপতি অস্তিত্বেই আসবে না। পরিহাসের ব্যাপার হলো, যেসব পুরোহিত রাজাকে তার আপন বোন বিয়ে করতে প্ররোচিত করেছিল, তারাই আমাকে বলেছিল,
জানি না রাজার এই পাপের অভিশাপ রাজদরবার ও প্রজাদেরও ভোগ করতে হয় কি না। আসলে এই পাপের অভিশাপ সবাইকে ঠিকই ভোগ করতে হলো। আমার দুর্ভাগ্য হলো, আমি সেই অভিশপ্ত রাজার উজির হয়ে রইলাম। কিন্তু মনে মনে আমি আশঙ্কা বোধ করছিলাম এই পাপের শাস্তি আমাকেও না হয় ভোগ করতে হবে। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি আপনার কাছে এসেছি। আপনি যদি আমাকে গ্রহণ করেন, তাহলে আমি আপনার সাথেই থাকবো।
এক আরব সর্দার হারেস আলাফীও তো রাজার দরবারে থাকত। সে এখন দাহিরের ছেলে জয়সেনার সাথে রয়েছে, বলল সিয়াকর।
সে কেমন লোক? সিয়াকরকে জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম। কার প্রতি সে মনেপ্রাণে অনুগত?
সে আসলে দুমুখো। আমি জানি, সে আপনাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে, কিন্তু রাজা দাহিরের প্রতিও সে ঠিক ততোটাই বিশ্বস্ত। অবশ্য আমি একথা নিদ্বিধায় বলতে পারি, সে আরব শাসকদের প্রতি বিদ্রোহী কিন্তু ইসলামের প্রতি অনুগত। রাজা দাহির তাকে বহু ধরনের লোভ দেখিয়েছে, কিন্তু সে প্রকান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছে আরবদের বিরুদ্ধে কিছুতেই অস্ত্র ধারণ করবে না সে। একপর্যায়ে রাজা দাহির তাকে হুমকি দিলো, রাজা ইচ্ছা করলে তাদেরকে তার এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে। এর জবাবে সে রাজা দাহিরেকে বলেছিল, মাকরানে আশ্রয় প্রাপ্ত আরবদেরকে যদি রাজা এখান থেকে চলে যেতে বলে তাহলে এরা আরব বাহিনীর শক্তিশালী সহযোগীতে পরিণত হবে। তখন তারা রাজধানীর জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে ওঠবে। বিন কাসিম এতোটা আনাড়ি ও অদূরদর্শী ছিলেন না যে, শত্রুবাহিনীর এক উজিরের কথায় তাকে আপন কোলে আশ্রয় দিয়ে দেবেন। তিনি দৃশ্যত সিয়াকরকে গ্রহণ করলেন এবং প্রকাশ্যে নির্দেশ দিলেন, তাকে রাজদরবারে যে মর্যাদা দেয়া হতো এখানেও সেই ধরনের মর্যাদায় রাখা হোক। আপরদিকে গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীকে বললেন, এর ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার, যাতে এর আসল উদ্দেশ্য আন্দাজ করা যায়।
বিন কাসিম দাহলিলা থেকে রওয়ানা হয়ে একটি খরস্রোতা নদী পার হয়ে অপর পাড়ে তাঁবু ফেললেন। বিন কাসিম ওখানে অবস্থান নিয়ে জয়সেনাকে একটি লিখিত পয়গাম পাঠালেন। পয়গামে তিনি লিখলেন, তুমি তোমার বাবার পরিণতি স্বচোখে দেখেছো। সিন্ধের কর্তৃত্ব তোমাদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে। এখন আর কতোদিন তুমি এভাবে পালিয়ে বেড়াবে, আর কোথায় পালিয়ে যাৰে? যে ব্রাহ্মণাবাদে তুমি আশ্রয় নিয়েছ, সেটিকেও অস্থায়ী মনে করো। রণ তোমাদের সৈন্যবাহিনী ও তোমাদের শক্তিশালী হস্তি এবং অশ্ববাহিনী আমাদের হাত থেকে নিজেদেরই রক্ষা করতে পারেনি। আমাদের মোকাবেলায় কোন রণাঙ্গনে দাঁড়াতেই পারেনি। তোমার জন্য সবচেয়ে উত্তম হবে তুমি ইসলাম গ্রহণ করো তাহলে সসম্মানে জীবনযাপন করতে পারবে। তা যদি ইচ্ছা না করে তাহলে অন্তত আমাদের বশ্যতা স্বীকার করে নাও, তাহলেও তোমাকে আমরা বন্দি করব না। আমরা তোমাকে গোলাম বানাতে চাই না। এই অবস্থায়ও তুমি স্বপদে সসম্মানে বহাল থাকবে। তাতেও যদি রাজি না হও, তাহলে এমন এক লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকো, যে লড়াইয়ে তোমার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। কারণ আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করি, তিনি অবশ্যই আমাদের বিজয়ী করবেন।
বিন কাসিমের প্রেরিত দূত পয়গাম নিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলো। এসে সে বিন কাসিমকে জানালো, দুর্গফটকেই তার পথ রোধ করে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, কেন এসেছে সে? সে জানালো, রাজকুমার জয়সেনার জন্যে সিন্ধু শাসক মুসলিম সেনাপতি বিন কাসিমের পয়গাম নিয়ে এসেছি। তখন তাকে দুর্গশাসকের কাছে নিয়ে গেল। এই পয়গাম কি রাজকুমার ছাড়া আর কাউকে দিতে পারো? দূতকে জিজ্ঞেস করল দুর্গপতি। কারণ রাজকুমার এখানে নেই।
কারণ রাজা দাহিরের পর সেই তো তার একমাত্র স্থলাভিষিক্ত যে একটা সিদ্ধান্ত দিতে পারে।
জয়সেনাতো এখানে আসেনি। তবে আমি জানি তোমরা কি পয়গাম নিয়ে এসেছো? এর জবাব আমিই দেবো’ আমাকে পয়গামটি পড়ে শোনাও।
দূত ছিল সিন্ধু অঞ্চলের লোক। সে ছিল এক নওমুসলিম, স্থানীয় ভাষায় সে যখন পয়গামের বক্তব্য বলল, তখন দুর্গপতি একটা অট্ট হাসি দিয়ে বলল, আমি জানতাম তোমার সেনাপতি এটাই লিখবে। তোমাদের সেনাপতির দেমাগ নষ্ট হয়ে গেছে। শুনেছি, ও নাকি একেবারেই বাচ্চা মানুষ। ওর বোঝা
দরকার, রাজা দাহির মারা গেলেও আমরা সবাই মরে যাইনি। শুধু জয়সেনাই লড়াই করবে না। জয়সেনা যদি মুসলমানও হয়ে যায় তবে তাকে আর ঠেকাবে কে? কিন্ত ওর কথায় তো আর সবাই মুসলমান হয়ে যাবে না। জয়সেনা এখন পলাতক। তোমার সেনাপতিকে গিয়ে বললো, তার খুব ইচ্ছে হলে সে যেন আসে এবং দুর্গ দখল করে নেয়। আমাদের সেনাপতি তো আসবেনই। তবে তোমাদের মনে রাখা উচিত, সাধারণ সৈনিকদের গণহত্যার দায় দায়িত্ব তোমাকেই বহণ করতে হবে। দূত যখন বিন কাসিমকে দুর্গশাসকের ভাষায় তার জবাব শোনাচ্ছিল, ঠিক তখনই ব্রাহ্মণাবাদ থেকে বিন কাসিমের এক গোয়েন্দা এসে জানাল, জয়সেনা কয়েক দিন ব্রাহ্মণাবাদে ছিল। সেখানে থেকে সে সেনাবাহিনীকে নতুন করে তৈরী করল। পালিয়ে আসা বিচ্ছিন্ন সৈন্যদেরকে নতুন ভাবে সংগঠিত করে ব্রাহ্মণাবাদ ত্যাগ করে চেনসারের দিকে চলে গেছে। ওহ্, সে সহযোগীদের একত্রিত করছে? বললেন বিন কাসিম। আমরা আর ওকে পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করবো না।
ব্রাহ্মণাবাদে প্রায় ৪০ হাজার হিন্দু সৈন্য ছিল। তাদেরকে জঠিল প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অদম্য করে তোলা হয় এবং কঠিন যুদ্ধের মোকাবেলায় বিজয় ছিনিয়ে আনার মতো মনোবলের অধিকারী করা হয়। বিন কাসিম সবকিছু বুঝে শুনে বাহ্মণাবাদ যুদ্ধের জন্য তার রণকৌশলে পরিবর্তন আনলেন। তিনি দুর্গ অবরোধের পরিবর্তে দুর্গের কাছাকাছি গিয়ে তাবু ফেলে তারুর চারপাশে খাল খনন করলেন এবং দুজন সৈন্যকে দুর্গ ফটকের কাছে গিয়ে ঘোষণা করার নির্দেশ দিলেন ‘দুর্গ আমাদের হাতে ছেড়ে দাও, অন্যথায় আমরা যদি লড়াই করে দুর্গ দখল করি, তাহলে কাউকে প্রাণভিক্ষা দেয়া হবে না।’
ঘোষণাকারীরা দুর্গফটকের কাছাকাছি গিয়ে কয়েকবার ঘোষণা করল কিন্তু তাদের জবাবে কারো কণ্ঠ শোনা গেল না, বরং তাদের প্রতি কয়েকটি তীর ছুটে এলো। ফলে কোন মৌখিক জবাব না পেয়ে ঘোষণাকারীরা ফিরে এলো।
সেদিনটি ছিল ৯৪ হিজরী মোতাবেক ৭১৩ খ্রিস্টাব্দের পহেলা রজব, সোমবার। হঠাৎ দুর্গফটক খুলে গেল। বাধভাঙা পানির মতো হিন্দু সৈন্যরা দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলো। সেনাবাহিনীর অগ্রভাগে ছিল দশবারো জনের
একটি বাদক দল। তারা প্রশিক্ষিত সৈন্যদের মতোই শৃঙ্খলা বজায় রেখে দ্রুতগতিতে এসে মুসলিম যোদ্ধাদের ওপর হামলে পড়ল। আক্রমণ ছিল খুবই তীব্র। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত তীব্র আক্রমণে মুসলিম বাহিনীর রক্ষণভাগ ভেঙে পড়ল। ব্রাহ্মণাবাদে এতোটা তীব্র আক্রমণের মুখোমুখি হবে এটা মোটেও ভাবেনি মুসলিম বাহিনী।
বিন কাসিম এই আক্রমণ সামলে নিলেন বটে তবে ততোক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। লড়াই চলাকালে সারাক্ষণই হিন্দুবাহিনীর বাদক দল বিরামহীনভাবে ঢোল পেটাচ্ছিল আর তাতে হিন্দু সৈন্যদের রণ-উদ্দীপনা যেন আরো উজ্জীবিত হচ্ছিল। সন্ধ্যা নেমে আসার সাথে সাথে হিন্দুবাহিনী দুর্গে ফিরে গেল। তাদের ফিরে যাওয়াও ছিল বেশ কৌশলী। ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে তারা দুর্গের ভিতরে চলে গেল। মুসলমানরা যখন হিন্দু সৈন্যদের তাড়া করে অগ্রসর হলো, তখন দুর্গের কাছাকাছি যেতেই দুর্গপ্রাচীরে থেকে মুসলমান যোদ্ধাদের প্রতি তীব্র তীরবৃষ্টি ধেয়ে এলো। ফলে আর অগ্রসর না হয়ে মুসলিম যোদ্ধারা তাদের তাঁবুতে ফিরে এলো।
রাতের বেলায় বিন কাসিম সকল সেনাপতি ও কমান্ডারদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। তিনি হিন্দু সৈন্যদের আকষ্মিক তীব্র আক্রমণ ও ফিরে যাওয়ার কৌশল নিয়ে সবার সাথে মতবিনিময় করলেন। শত্রুদের শক্তি ও সামর্থ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হলো। অনেকেই অনেক ধরনের মতামত ব্যক্ত করলেন।
সবার মতামত শোনার পর বিন কাসিম বললেন, হিন্দু সৈন্যরা চেষ্টা করছে আমরা যাতে দুর্গ অবরোধ করতে না পারি। ওরা ময়দানে আমাদের লড়াইয়ে লিপ্ত রাখতে চায়। আমরা তাদের এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করবো। তবে দুর্গকে পশ্চাদভূমি হিসাবে ব্যবহার করার মতো সুবিধা তাদের আছে, আমরা ইচ্ছা করলেও তাদের তাড়া করতে পারব না। তিনি সেনাপতিদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা সবাই আমার চেয়ে বয়স্ক ও অভিজ্ঞ। আমি আপনাদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, আমাদের যোদ্ধারা ক্লান্ত। তাদের আবেগ যদিও ক্লান্ত নয় তবে রক্ত গোশতের শরীর অব্যাহত পরিশ্রমে একসময় চুরচুর হয়ে যায়। দ্বিতীয় কথাটি হলো, দুর্গ অবশ্যই আমাদের অবরুদ্ধ রাখতে হবে। আমরা যদি অবরোধ না করি, তাহলে শত্রুদের সরবরাহ পথ উন্মুক্ত রাখা হবে। আপনারা জয়সেনার কথা
শুনেছেন, সে দুর্গে নেই। জয়সেনা আশপাশের রাজা মহারাজাদের সাহায্যের জন্যে বেরিয়েছে। ওর পথ রুদ্ধ করতে হবে। কারণ সে যখন এদিকে ফিরে আসবে তখন সে একা আসবে না, বহু সৈন্য সাথে নিয়ে আসবে। আপনারা দেখেছেন হিন্দু সৈন্যরা খুবই উজ্জীবিত আবেগাপ্লুত।
“বিন কাসিম! বেশি আবেগ ঠাণ্ডা হতে সময় লাগে না,” বললেন বিন কাসিমের পিতৃবয়সী এক সেনাপতি। আপনি যদি ওদের এই আক্রমণে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে থাকেন, তাহলে এই দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিন। আপনাকে আল্লাহ খুব উঁচুমাপের বিবেক বুদ্ধি দিয়েছেন। আপনার চিন্তাশক্তি আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। আপনি আল্লাহর দেয়া বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগান। আমরা আপনার সাথে আছি। আমরা আল্লাহকে ভুলিনি। সবসময় নামায তেলাওয়াত দোয়া দরূদে আল্লাহর মদদ ও সাহায্য প্রার্থনা করছি। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের মদদ করবেন।
রাতের বেলায় মিনজানিক ও অগ্নিতীর ব্যবহার করাই সঠিক কাজ হবে, বললেন অপর এক সেনাপতি।
বিন কাসিম তার মতামতের জবাবে বললেন, না, এক্ষেত্রে মিনজানিক ও অগ্নিতীর ব্যবহার করা ঠিক হবে না। ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গ একটি জনবহুল দুর্গ। মিনজানিক ও অগ্নিতীর ব্যবহার করলে শিশু ও বেসামরিক লোকেরা হতাহত হবে। আমি সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চাই না। তাছাড়া আরো ক’দিন দেখি না, শত্রুরা তাদের রণকৌশলে কতোটা দৃঢ় থাকে।
পরদিন ব্রাহ্মণবাদের সৈন্যরা আগের দিনের মতো দুর্গ থেকে বেরিয়ে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করল। আগের রাতে বিন কাসিম সেনাপতি ও কমান্ডাদের বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, সেনাপতিরা তাদের নিজ নিজ ইউনিটকে দিনের শুরুতেই তাঁবু থেকে বের করে জায়গা মতো দাঁড় করলেন। অশ্বারোহী সৈন্যদের দু’প্রান্তে রেখে পদাতিক সৈন্যদের মাঝখানে দাঁড় করানো হলো।
গত দিনের আক্রমণে হিন্দুরা দুর্গপ্রাচীরের কাছাকাছি থেকে লড়াইয়ের চেষ্টা করতে দেখা গেছে। বিন কাসিম পরিকল্পনা মতো পদাতিক সৈন্যদেরকে অগ্রসর করে দিলেন। পদাতিক সেনাকমান্ডারদেরকে কি করতে হবে তা তাদের জানা ছিল। সংঘর্ষ যখন তীব্র আকার ধারণ করলো, তখন তারা
এমনভাবে পিছু হটতে শুরু করে যেনো তারা শত্রুদের আক্রমণে বিপর্যস্ত। মুসলিম সৈন্যদের পিছু হটতে দেখে হিন্দু সৈন্যরা বিপুল উদ্যমে সামনে অগ্রসর হলো।
এমতাবস্থায় হিন্দু সৈন্যদের খেয়াল ছিল না, তারা দুর্গপ্রাচীর থেকে বহুদূরে চলে এসেছে। ঠিক এমন সময় বিন কাসিম দু’প্রান্তের অশ্বারোহীদের ইশারা করলেন। অশ্বারোহীরা ইশারা পাওয়া মাত্র উর্ধশ্বাসে ঘোড়া দৌড়াল। চোখের পলকে অশ্বারোহীরা হিন্দু সৈন্যদের পিছন ও দু’পাশ থেকে আক্রমণ করল। এই আক্রমণে হিন্দু সৈন্যরা বিন কাসিমের পাতা ফাঁদে আটকে গেল। মুসলিম অশ্বারোহীদের তরবারীর আঘাতে ধরাশায়ী হতে লাগল হিন্দু সৈন্যরা। তাদের পিছু হটার পথ আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হিন্দু কমান্ডারও ছিল বুদ্ধিমান। সে দুর্গ থেকে একটি অশ্বারোহী ইউনিটকে তড়িৎ মুসলিম বাহিনীর পিছন ভাগে আঘাত করার জন্য পাঠাল। এরা এসে আঘাত করায় মুসলমানদের ঘেরাও ভেঙে গেল এবং হিন্দু সৈন্যরা বেরিয়ে গেল। কিন্তু তাদেরকে ফেলে যেতে হয়েছে অসংখ্য সহযোদ্ধার মরদেহ। ততোক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বেলা ডুবার আগেই মুসলিম যোদ্ধারা তাদের মৃত ও আহত সহযোদ্ধাদের রণাঙ্গন থেকে তুলে আনল।
পরবর্তী রাতে বিন কাসিম তাঁবু থেকে কিছু সৈন্যকে বের করে দুর্গের চারপাশে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে একপ্রকার অবরোধ আরোপ করলেন, যাতে দুর্গবাসীরা বাইরের কোন সরবরাহ না পায়। পরদিনও হিন্দু সৈন্যরা যখন দুর্গ থেকে বের হলো, তখন দু’পাশ থেকে তাদের ঘেরাও করে আক্রমণ করা হলো। হিন্দু সৈন্যরা দ্রুত দুর্গে ফিরে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু হুড়োহুড়ি করে প্রবেশ করতে গিয়ে ওরা দুর্গফটকে হজবরল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটালো। ভীড়ে চাপা পড়ে বহু পদাতিক সৈন্য হতাহত হলো।
একই পদ্ধতিতে টানা কয়েকদিন এ ধরণের আক্রমণ প্রতি আক্রমণ চলল। কিন্তু কিছু দিন পর হিন্দুদের আক্রমণের মাত্রা হ্রাস পেতে শুরু করল। দুতিন দিন চলে গেল তারা দুর্গ থেকে বের হয়ে কোন আক্রমণ করল না। তাতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল হিন্দুদের জনবলে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
৯৪ হিজরী সনের যিলহজ্জ মাসে মুসলমানদের একটি সরবরাহ কাফেলা আসার কথা ছিল। কিন্তু তারিখ পেরিয়ে গেলেও সরবরাহ কাফেলার হদিস পাওয়া গেল না। হঠাৎ এক রাতে অবরোধকারী সৈন্য দলের ওপর গুপ্ত আক্রমণ হলো। অনুসন্ধান করে জানা গেল, গুপ্ত আক্রমণকারীরা দুর্গ থেকে আসেনি ওরা বাইরের। গুপ্ত আক্রমণে মুসলিম সৈন্যরা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। পরের রাতে আবারো আক্রমণ হলো।
দীর্ঘ যুদ্ধে এমনিতেই মুসলিম সৈন্যদের জনবলের ওপর চাপ পড়েছিল। এরপর এই গুপ্ত আক্রমণ সেই চাপ আরো বাড়িয়ে দিলো। অপর দিকে সরবরাহ আসার নিশ্চিত সংবাদ আসার পরও কোন ধরনের সরবরাহই পৌছেনি। এমতাবস্থায় দাহলিলা ও বাহরাওয়াতে সরবরাহ না পৌছার কারণ অনুসন্ধানে লোক পাঠানো হলো। কিন্তু সংবাদবাহকরাও তিন দিনের মধ্যে ফিরে এলো না। অথচ উভয় দুর্গের দূরত্ব ছিল কম। ইচ্ছা করলে একদিনেই উভয় দুর্গের খবর নিয়ে ফিরে আসা যায়। কোন খবর না পেয়ে চতুর্থ দিন সকালবেলায় আরো দু’জনকে পাঠানো হলো। দিন শেষে বিকেলবেলায় এদের একজন আহত রক্তমাখা অবস্থায় ফিরে এলো। সে জানালো, দাহলিলা দুর্গের অনতি দূরে তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায় চার অশ্বারোহী। তাতে তার সাথী মারা যায়। সে কোন মতে প্রাণ বাঁচিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এই আক্রমণ থেকে বিন কাসিম বুঝে নিলেন, সরবরাহ কোন না কোনভাবে পথিমধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
বিন কাসিম সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, যারা অবরোধে নিযুক্ত, তারা যেন রাতের বেলায় সজাগ থাকে এবং রাতের আক্রমণকারীদের অন্তত দু’চার জনকে জীবন্ত পাকড়াও করার চেষ্টা করে।
সেই দিনগুলোতে প্রতিরাতেই গুপ্ত আক্রমণ হতো। কয়েক দিন পর একরাতে আক্রমণকারীদের দুজনকে পাকড়াও করা হলো। পাকড়াও করে শত্রু সেনা দুজনকে বিন কাসিমের কাছে উপস্থিত করা হলো। বিন কাসিম বহু চেষ্টা করেও ধৃতদের মুখ খুলতে পারেন নি। অবশেষে তিনি নির্দেশ দিলেন, ওদেরকে ঘোড়ার পিছনে বেধে ঘোড়া দৌড়িয়ে দাও। এমতাবস্থায় মৃত্যু ভয়ে শত্রুসেনারা কথা বলতে শুরু করল। অবশেষে ওরা রহস্য উন্মোচন করে দিলো। শত্রু সেনারা বলল, জয়সেনা বিমল রাজার কাছ থেকে সৈন্য নিয়ে ব্রাহ্মণাবাদ আসতে চাচ্ছিল। যখন সে খবর পেল, ব্রাহ্মণাবাদ অবরুদ্ধ, তখন সে দূরের একটি জায়গায় তাবু ফেলে গুপ্তহামলা চালাতে শুরু করে।
বিন কাসিম সেনাপতিদের ডেকে বললেন, সব সেনাপতি যেন নিজ নিজ ইউনিট থেকে কিছুসংখ্যক অভিজ্ঞ যোদ্ধাকে বাছাই করে দেয়। যারা সম্মিলিতভাবে একটি দলভুক্ত হয়ে জয়সেনাকে তাড়া করবে। সেনাপতিগণ, নির্দেশ পেয়ে কিছুসংখ্যক যোদ্ধাকে বাছাই করলেন। এদেরকে একটি ইউনিটে রূপান্তরিত করে মুকু, নাবাতা বিন হানযালা, আতিয়া প্রমূখকেও অন্তর্ভুক্ত করলেন। এই সেনাদলের কমান্ডার নিযুক্ত করলেন মুকু ও খুরায়েম বিন আমের মাদানীকে। মুকু তখনও পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেনি। কিন্তু বিন কাসিমের প্রতি সে বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। তাছাড়া স্থানীয় লোক হওয়ায় এই অঞ্চলের সব পথঘাট ছিল তার নখদর্পনে।
এদিকে শত্রুপক্ষের রাতের গুপ্তহামলা অব্যাহত থাকল এবং একরাতে মুসলিম যোদ্ধাদের হাতে আরো তিন হামলাকারী গ্রেফতার হলো। এরা জিজ্ঞাসাবাদের মুখে জানিয়ে দিলো, জয়সেনা কোন এলাকায় আস্তানা গেড়েছে। জয়সেনার অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ায় সেই রাতেই মুকু ও মাদানীর নেতৃত্বে বিশেষ বাহিনী রওয়ানা হয়ে গেল। তাদের সাথে দেয়া হলো গ্রেফতার হওয়া তিন শত্রুসেনাকে, ওদের দেয়া তথ্য ভুল প্রমাণিত হলে ওদের হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হলো। এই বিশেষ বাহিনী ব্রাহ্মণাবাদ থেকে কয়েক মাইল অগ্রসর হলে হঠাৎ দ’জন অশ্বারোহী উধ্বশ্বাসে ঘোড়া হাঁকাল, এরা রাস্তায় কোন আড়ালে উৎপেতে ছিল। মুকু সাথে সাথে তার চার যোদ্ধাকে ওদের ধাওয়া করতে নির্দেশ দিল। কিন্তু তারা শত্রুসেনাদের নাগাল পেল না। ধাওয়াকারীদের বলে দেয়া হয়েছিল তারা যেন আয়ত্তের বাইরে না যায়। শক্ত সেনারা নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় ধাওয়াকারীরা ফিরে এলো। এই ঘটনা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল এরা নিশ্চয়ই জয়সেনার চর।
জয়সেনাকে ধরার জন্য মুকু ও মাদানীর কাফেলার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়া হলো। কিন্তু জয়সেনার অবস্থান ছিল যথেষ্ট দূরে। সকাল পর্যন্ত ইন্দিত স্থানে পৌছে যাওয়ার আশা ছিল। কিন্তু রাতের অন্ধকারে মুসলিম সৈন্যদেরপক্ষে খুব বেশি দ্রুত ঘোড়া দৌড়ানো সম্ভব ছিল না। সারারাত চলার পর সকালবেলায় তারা এমন জায়গায় পৌছাল, যেখানে চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কোন সেনাবাহিনীর অবস্থানের চিহ্ন। স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করে মুকু জানতে পারল, রাজা দাহিরের পুত্র জয়সেনার নেতৃত্বে এখানে কিছুদিন একটি সেনা ইউনিট অবস্থান করেছিল। কিন্তু
গতরাতের শেষপ্রহরে তারা এখান থেকে চলে গেছে। ওদের যাওয়ার সময় হিসাব করে দেখা গেল। পিছু ধাওয়া করা অর্থহীন।
জয়সেনা নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় মুকু ও মাদানীসহ অন্যান্য উর্ধতন সেনাকমান্ডারগণ পরামর্শ করলেন, এলাকাটি শত্রুমুক্ত করার জন্য দাহলিলা ও রাওয়া দুর্গ পর্যন্ত গোটা এলাকা চক্কর দেয়া দরকার। সারারাতের ভ্রমণের ক্লান্তি সৈন্য ও ঘোড়ার বিশ্রামের জন্য এক জায়গায় তাঁবু ফেলা হলো। বিশ্রামের পর আবার চলতে শুরু করল কাফেলা।
চলন্ত কাফেলা হঠাৎ দুই উষ্ট্রারোহীকে দেখতে পেল। মুসলিম কাফেলাকে দেখে আরোহী দু’জন পথ বদল করে ফেলল। ওদের প্রতি সন্দেহ হওয়ায় পাঁচজন অশ্বারোহীকে নির্দেশ দেয়া হলো ওদের পাকড়াও করতে। পাঁচ অশ্বারোহীকে আসতে দেখে ওরা চলার গতি বাড়িয়ে দিয়ে সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দিল। কিন্তু পাঁচ অশ্বারোহী উর্ধশ্বাসে ঘোড়া হাঁকিয়ে ঘেরাও করে দুই উষ্ট্ৰারোহীকে পাকড়াও করল। ধরাপড়ে ওরা প্রথমে সাধারণ পথিক হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করতে চেষ্টা করল। কিন্তু মুসলিম যোদ্ধারা যখন বর্শার ফলা ওদের বুকের ওপর রাখল তখন স্বীকার করল, তারা জয়সেনার সৈন্য। সেই সাথে তারা জানাল, জয়সেনা তাদের মাধ্যমে এই এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জয়সেনার গোয়েন্দাদের খবর দিয়ে দিয়েছে, তারা যদি জয়সেনার সাথে থাকতে চায়, তাহলে যেন চারু দুর্গে পৌছে, নয়তো নিজেদের বাড়িতে ফিরে যায়। বিন কাসিমের বিশেষ এই ইউনিট দুই তিন দিন গোটা এলাকা চক্কর দিয়ে ব্রাহ্মণাবাদ ফিরে এলো। এর দু’দিনপর সরবরাহ কাফেলাও ব্রাহ্মণাবাদ পৌছে গেল।
দেখতে দেখতে ব্রাহ্মাণাবাদ দুর্গের অবরোধ ছয় মাস পেরিয়ে গেল। কিন্তু দু’মাস পর দুর্গ থেকে হিন্দু সৈন্যরা বেরিয়ে মুসলমানদের ওপর আঘাত করা ছেড়ে দিয়েছিল। এই সুযোগে বিন কাসিম তার সৈন্যদেরকে তবু থেকে বের করে দুর্গ অবরোধ মজবুত করলেন এবং দুর্গপ্রাচীর ভাঙা বা ডিঙানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। দুর্গের অধিবাসীদের নিরাপদ রাখতে তিনি পাথর ও অগ্নিতীর নিক্ষেপ থেকে বিরত রইলেন।
এক পর্যায়ে স্থানীয়ভাষায় অনেকগুলো পয়গাম লিখে রাতের বেলায় দুর্গপ্রাচীরের কাছাকাছি গিয়ে তীরে বেঁধে এগুলোকে এমনভাবে নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন, যাতে এগুলো গিয়ে লোকালয়ে পড়ে।
সব পয়গামে একই বক্তব্য ছিল। পয়গামে লেখা হলো, দুর্গের বেসামরিক অধিবাসীরা যেন দুর্গফটক খুলে দিতে সৈন্যদের বাধ্য করে। নয়তো আমরা অচিরেই দুর্গে পাথর ও আগুন বর্ষণ করতে শুরু করব। তখন আর কাউকেই ক্ষমা করা হবে না। পক্ষান্তরে দুর্গবাসী যদি সৈন্যদের ফটক খুলে দিতে বাধ্য করে তাহলে বেসামরিক সব নাগরিককে ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং তাদের জানমাল ইজ্জত আব্রু সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। তীরে বাঁধা নিক্ষিপ্ত পয়গামে কাজ হলো। দু’তিন দিন পর রাতের বেলায় দুর্গ থেকে একটি ছোট্ট দরজা দিয়ে দু’জন লোক বেরিয়ে মুসলিম শিবিরের দিকে এগিয়ে এলো। তাদের হাতে ছিল সাদা পতাকা। এরা মুসলিম শিবিরের দিকে অগ্রসর হলে কয়েকজন সৈন্য এদের ধরে বিন কাসিমের কাছে নিয়ে এলো। তারা জানাল, তীরে বাঁধা পয়গামের খবর দুর্গের অধিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
এই পয়গাম পাওয়ার পর দুর্গের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী ও মন্দিরের প্রধান পুরোহিত সৈন্যদের সাথে আলোচনা করল, তোমরা দুর্গের কর্তৃত্ব ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ কর। সৈন্যরা বলল, তা সম্ভব নয়। অন্য কোন ব্যবস্থা করা যেতে পারে যাতে আমরা দুর্গ ত্যাগ করে চলে যেতে পারি। এর পর সিদ্ধান্ত হলো, তাদেরকে দুর্গ ত্যাগের সুযোগ করে দিলে তারা দুর্গের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেবে। অত:পর দুর্গফটকের প্রহরীদের এই কথা বলা হলো, তোমাদের একটি সেনাদল ছোট্ট একটি দরজা খুলে মুসলিম সৈন্যদের আক্রমণ করবে, ওরা পাল্টা আক্রমণ করলে তোমরা প্রধান ফটক দিয়ে দুর্গে প্রবেশ করবে কিন্তু দুর্গফটক খোলা থাকবে। খোলা দরজা দিয়ে মুসলিম। সৈন্যরা প্রবেশ করবে আর অপর দরজা দিয়ে তোমরা পালিয়ে যাবে। এ দুই সংবাদবাহক বিন কাসিমকে জানাল, দুর্গের অধিবাসীরা অনেক দিন থেকে দিনে একবেলা আহার করছে। সেই সাথে দুর্গের ভিতরে সুপেয় পানির তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় দুর্গের অধিবাসীরা সৈন্যদের ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করেছে আত্মসমর্পণ করতে। কিন্তু জীবন ও মান রক্ষায় সৈন্যরা আত্মসমর্পনে রাজী হচ্ছিল না। তাছাড়া তাদের অর্ধেক সৈন্যই মারা গেছে। এমতাবস্থায় তাদেরকে পালানোর সুযোগ দিলে তারা দুর্গ ত্যাগ করে চলে যাবে। তিনদিন পর ছোট্ট একটি ফটক দিয়ে কিছুসংখ্যক হিন্দু সৈন্য বেরিয়ে মুসলিম যোদ্ধাদের ওপর আঘাত করল। বিন কাসিম আগে থেকেই প্রস্তুত
ছিলেন, তিনি একটি ইউনিটকে ওদের ধাওয়া করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানরা ধাওয়া করতেই ওরা প্রধান ফটক দিয়ে দুর্গে ঢুকে পড়ল। কিন্তু দুর্গফটক খোলা রইলো, বিন কাসিমের সেই ইউনিট খোলা ফটক দিয়ে দুর্গে প্রবেশ করল। সেই সাথে মুহূর্তের মধ্যেই গোটা মুসলিম বাহিনী দুর্গের ভিতরে চলে এলো। আর হিন্দু সৈন্যরা অপর দিকের ফটক খুলে পালিয়ে গেল। বিন কাসিম ওদের পিছু ধাওয়া করতে নিষেধ করেলেন।