১০. মূল্যায়ন

মূল্যায়ন

ব্রিটেনের অর্থনৈতিক ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হয়েছে। ১৬০০ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে ভারতের ইতিহাসে কোম্পানির তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে তুলনায় অনেক কম। বইয়ের শেষ অধ্যায়ে এই বিষয়টা নিয়ে চর্চা করা যাক।

বিষয়টাকে তিনটে আলাদা প্রসঙ্গে ভাগ করে নিলে আলোচনার সুবিধা হবে। এগুলি হল, ভারতের ব্যাবসাপাতির সাংগঠনিক-প্রাতিষ্ঠানিক দিকগুলির উপরে কোম্পানির প্রভাব, ভারতের অর্থনৈতিক বিবর্তনে কোম্পানির বাণিজ্যের প্রভাব ও ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা অধঃপতনের পিছনে কোম্পানি সরকারের অবদান।

ব্যবসায়িক ইতিহাস

ভারতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে কোম্পানির বিশেষ ভূমিকা কী তা নিয়ে গবেষণামূলক কাজ হয়নি। তা হলেও দুটো মতবাদ চিহ্নিত করা যেতে পারে। একটা মত অনুযায়ী যৌথ উদ্যোগে তৈরি ইউরোপের কোম্পানিগুলি আধুনিক সংস্থা। ভারতীয়দের রক্ষণশীল পারিবারিক সংস্থাগুলির সঙ্গে তুলনায় বা পর্তুগিজদের আক্রমণাত্মক নীতির সঙ্গে তুলনায় এরা অনেক আধুনিক, তাই অনেক বেশি কার্যকর। এইভাবে কোম্পানিগুলির কাজকর্মের মধ্য দিয়ে ভারতে বাণিজ্যবিপ্লব ঘটেছে। অন্যদিকে, এই মতবাদের সমালোচকরা বলবেন, ইউরোপিয়ানরা ভারতীয়দের উপরে এত বেশি নির্ভরশীল ছিল এবং সেই কারণে এখানে আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত নিয়ম বা ঐতিহ্যের ব্যবহারও তাদের এত বেশি করতে হয় যে ভারতীয়দের অবদানের উল্লেখ না করে কোম্পানির সাফল্যের কারণ বোঝা সম্ভব নয়। অর্থাৎ কোম্পানির ইতিহাস বুঝতে হলে ভারতের ব্যাবসার ইতিহাস আগে জানা দরকার।

এই দুটো মতবাদ নিয়েই আপত্তি তোলা যায়। ভারতে ব্যাবসা করতে এসে কোম্পানিকে যত সমস্যা বা বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে এবং তার জন্য যতরকম সমঝোতা করতে হয়েছে, প্রথম মতবাদ মানলে সেগুলিকে একটু খাটো করে দেখা হয়। আর দ্বিতীয় মতবাদ অনুসরণ করলে ভারতে বাণিজ্যিক সংগঠনের উপর কোম্পানির প্রভাব কী সেই প্রশ্নটাই উড়ে যায়। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তো প্রথম থেকেই যথেষ্ট ভাল, তাদের আবার নতুন করে কে কী শেখাবে?

আসলে ইউরোপীয় ও ভারতীয় ব্যাবসার জগৎ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং দুই জগৎই পারস্পরিক যোগাযোগের কারণে অল্পবিস্তর বদলেছে। এই যোগাযোগের কারণে একটা জগৎ আর একটাকে গিলে ফেলেছে এমন বলা যাবে না। বরং বলা যায় এর ফলে একেবারে নতুন ধরনের কতগুলি রীতিনীতি ও নতুন ঐতিহ্যের জন্ম হয়। এই নতুন রীতিনীতির ব্যবহারে ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসা সাফল্য পেয়েছে সেটা ঠিক, আবার এটাও ঠিক যে এর ফলে অনেক রকম বিবাদ-সংঘাতেরও সৃষ্টি হয়েছে, যা নজিরবিহীন।

কোম্পানির ব্যাবসা আর ভারতীয় ব্যাবসার মধ্যে প্রধান তফাত দক্ষতা বা এফিশিয়েন্সির মাপকাঠিতে বোঝা যাবে না, দুইয়ের মধ্যে প্রধান তফাত আয়তনের। ব্যক্তিগত ব্যাবসার সাফল্য দেখিয়ে দেয় যে অষ্টাদশ শতকে একচেটিয়া কারবার খুব একটা কার্যকরী মডেল ছিল না। তা হলেও, যৌথ উদ্যোগ ও একচেটিয়া অধিকারের কারণে ভারতের ব্যবসায়িক জগতে এমন এক প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ ঘটে যার পরিধি সেকালের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানগুলির তুলনায় বহুগুণ বড়। ভারতে এর আগে কোনও সংস্থাই এত বড় স্কেলে এত বিশাল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাবসা করেনি।

ব্যাবসার পরিধি বিশাল হওয়ার কারণে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বা কন্ট্রাক্টের ব্যবহার বেড়ে যায়। এইটাই সাংগনিক দিকে কোম্পানি ব্যাবসার প্রধান নতুনত্ব। চুক্তিবদ্ধ কেনাবেচা ভারতে এর আগে একেবারেই হয়নি এমন নয়। কিছু কাপড়ের ব্যাবসায় চুক্তির ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়, যদিও এসব চুক্তির শর্তাবলি সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ও মুসলমানদের সামাজিক নিয়মবিধির যেসব আকরগ্রন্থ পাওয়া যায় তাতেও ব্যবসায়িক চুক্তির উল্লেখ আছে এবং এই উদাহরণগুলি ব্যবহার করে কোম্পানি শাসনের প্রথম যুগের বুদ্ধিজীবীরা, যথা টমাস কোলব্রুক, আদালতে দেশি আইন প্রবর্তনের চেষ্টা করেন।

কিন্তু ব্রিটিশ আমলের আদালতে লেনদেন বা কেনাবেচা সংক্রান্ত মামলায় এইসব ধর্মীয় তথা সামাজিক নিয়মের বহুল ব্যবহার হয়নি। বরং জজদের মন্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে আসামি-ফরিয়াদি কেউ-ই কারবার সংক্রান্ত, বিশেষ করে চুক্তিভঙ্গ সংক্রান্ত মামলায় হিন্দু বা মুসলমানি নিয়মের ধার ধারেনি, যদিও তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ধৰ্মীয়-সামাজিক নিয়মের ব্যাপারে মামলাকারীদের ঔদাসীন্য স্বাভাবিক। এইসব নিয়ম সাম্প্রদায়িক। যেখানে ব্যাবসা ক্রমেই সাম্প্রদায়িক গণ্ডি অতিক্রম করে বেড়ে চলেছে— যেমন হয়েছে সমস্ত বড় শহরে, বিশেষ করে বম্বে ও কলকাতায়— সেখানে সাম্প্রদায়িক নিয়মের চাহিদা বাড়তে যাবে কেন? সামান্য দু’-একটা ক্ষেত্র (তার একটা ঋণের মামলা) বাদ দিলে সাম্প্রদায়িক নিয়ম চুক্তির বিষয়ে ব্যবহার হয়নি ব্রিটিশদের চেষ্টা সত্ত্বেও।

প্রথম দিকে কোম্পানির কর্মচারীরা বাজার থেকে কাপড় বা মরিচ সংগ্রহ করত, অর্থাৎ চুক্তিমূলক কেনাবেচার তুলনায় অন-দি-স্পট বা নিলামে জিনিসপত্র কেনাবেচার দিকেই ঝোঁক বেশি ছিল। এই ধরনের বিক্রিবাটায় ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে পরিচয় বা যোগাযোগ থাকার দরকার পড়ে না। ক্রমশ দালাল, এজেন্ট, সর্দার, ঠিকাদার ইত্যাদি নিয়োগ করা হল এবং এদের মাধ্যমে কাপড় কেনা চলতে থাকল। এরা কোম্পানির কর্মচারীদের চেনা লোক, তাই এদের সঙ্গে বা এদের চেনা তাঁতিদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করলে টাকা মার যাবার ভয় কম।

ক্রমে হাজার হাজার তাঁতিদের সঙ্গে এক বছর পর্যন্ত মেয়াদে লক্ষ লক্ষ টাকা নগদ বায়না দিয়ে চুক্তি লেখা হতে থাকল। এই চুক্তি ছিল স্ট্যাম্প কাগজের মতো বা কারখানার হিসেব-বইয়ের একটা পাতা। সেই কাগজে ক্রেতা ও বিক্রেতা সাক্ষী রেখে সই করত, আগাম টাকার পরিমাণ, মাল ডেলিভারির তারিখ ও কাপড়ের গুণমান, নকশা, দাম ইত্যাদি বিস্তারিত ভাবে লেখা থাকত। বলাবাহুল্য, ফ্যাশনেবল কাপড়ের ক্ষেত্রে গুণমান যথাযথ রক্ষা করা খুব জরুরি বিষয় ছিল। যে হারে কোম্পানি ও ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা চুক্তির ব্যবহার করেছে তার কাছাকাছি কোনও নজির ভারতে কোম্পানি যুগের আগে ছিল বলে জানা নেই।

সব চুক্তি বিশ্বাসের ভিত্তিতে কাজ করে। বিশ্বাসভঙ্গ হলে আইন- আদালতের দরকার। একজন অন্যকে ঋণ দিল, অন্যজন আবার কিছু দ্রব্য বা পরিষেবা জোগান দেওয়ার অঙ্গীকার করল। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে-কোনও ব্যাবসার মতোই এই ব্যাবসাতেও অঙ্গীকার অনেক সময়ে রক্ষা হত না। কিন্তু চুক্তি স্বীকার করা হবে এমন আইন-আদালতও ছিল না। প্রতিশ্রুতিভঙ্গ হলে ঋণদাতার সামনে রাস্তা কী? এই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন যাতে না হতে হয় তাই ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসের অর্থাৎ জমিজমা, ব্যাবসার গোপন তথ্য, বা বড় আকারের ঋণ আদানপ্রদান আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করত। যাতে বিশ্বাসভঙ্গ হলে শুধু ঋণদাতা নয়, সমস্ত সমাজ দেনাদারকে শাস্তি দিতে পারে।

কিন্তু ইউরোপিয়ানদের সামনে এই রাস্তা খোলা ছিল না। কাজেই সমস্ত রকম চুক্তিই সমস্যাজর্জরিত হয়ে উঠেছিল। তাঁতিরা টাকা আগাম নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেত, বা ডেলিভারির মালে নানারকম কারচুপি করত। দালালরা দুই তরফ থেকেই ঘুষ নিত। দালালরা ডাচ ও ইংরেজদের মধ্যে কিংবা নবাব ও কোম্পানির মধ্যে গোলমাল বাধাবার চেষ্টা করত। এই ধরনের বিশৃঙ্খলা কোম্পানির কাজকর্ম সংক্রান্ত নথিপত্রে নিয়মিত আলোচনার একটা বিষয় ছিল। এই বিশৃঙ্খলাজনিত তিক্ততাই বেরিয়ে আসত ‘বানিয়া’-র উপরে মন্তব্যে (প্রথম অধ্যায়ে দু’-একটা উল্লেখ করেছি), যদিও বানিয়াকে বাদ দিয়ে ইউরোপীয় ব্যাবসা এক-পাও চলত না।

চুক্তিভঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা সমস্ত দালাল সম্প্রদায়ের জন্যে দুঃসংবাদ ছিল না, বরং বলা যায় এই সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি মাত্রায় ছিল বলেই যে এজেন্ট বা পার্টনারদের বিশ্বস্ত মনে করা হত তাদের প্রচুর সুযোগসুবিধা দিতে কোম্পানি প্রস্তুত ছিল। শুধু টাকাপয়সা দিয়ে নয়, নিজেদের এলাকায় নানারকম ভাবে অতিরিক্ত ক্ষমতা ও সম্মান দিয়ে। ১৭৫০ নাগাদ যে তিনটে শহরে কোম্পানির নিজের আইন বলবৎ ছিল, সেখানে এই এজেন্টরা কম-বেশি রাজনৈতিক সুবিধা পেত, চুক্তির ক্ষেত্রে আইন-আদালতের ব্যবহার হত, আর তাঁতিদের শহরে এসে বসবাস করার জন্যে উৎসাহ দেওয়া হত।

ফলে এই তিনটে শহরে যে ধরনের ব্যাবসা বেড়ে ওঠে তার ধারাটা ছিল সনাতন ভারতীয় ব্যাবসার থেকে অনেকটাই আলাদা। এখানে বিভিন্ন জাতির মধ্যে পার্টনারশিপ সংস্থা তৈরি করা সহজ হয়ে উঠেছিল। এই তিনটে শহর বহির্বিশ্বের বাজার ভারতীয়দের আরও কাছে এনে দিয়েছিল। ব্যাবসার এলাকায় জাতি-ধর্মের গুরুত্ব কমে গিয়েছিল এখানে। ভারতীয়রা অনেক স্বচ্ছন্দে ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে বা পরস্পরের সঙ্গে মিলে আমদানি-রপ্তানির ব্যাবসা শুরু করত। একই কারণে যাদের পূর্বপুরুষরা কোনওদিন আমদানি- রপ্তানির ব্যাবসা করেনি, যেমন পার্সিরা বা বাঙালি কায়স্থরা, দিব্যি ব্যাবসা করে পয়সা করেছে। বম্বে, কলকাতা ও মাদ্রাজে জাতপাতের গণ্ডির বাইরে একটা অর্থনৈতিক সমাজের ভিত গড়ে ওঠে। এই সমাজ অভ্যন্তরীণ ভারতের সমাজের সঙ্গে তুলনায় অনেক অসাম্প্রদায়িক, অনেক বেশি স্বাধীন ও পরীক্ষামূলক, অর্থাৎ আধুনিকতার নিদর্শন।

বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন

যদিও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বড়, ভারতের বাণিজ্য জগতের পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানি ঠিক কত বড় প্রতিষ্ঠান?

ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরী দেখিয়েছেন যে স্থলপথে যে ব্যাবসা হত তার গুরুত্ব সামুদ্রিক বাণিজ্যের থেকে কিছু কম নয়। আরও এগিয়ে বলা যায় যে ভারতের অর্থনীতির পটভূমিতে সব ইউরোপীয় কোম্পানি একসঙ্গে জড়ো করলেও তাদের পরিধি এতই সামান্য থাকবে যে এদের পক্ষে ভালমন্দ কোনওরকম পরিবর্তন আনাই সম্ভব ছিল বলে মনে হবে না। সুতির কাপড়ের সম্ভাব্য উৎপাদনের উপর বিদেশে রপ্তানি করা কাপড়ের অনুপাত নানাভাবে মাপা হয়েছে। সবথেকে বিশ্বাসযোগ্য পরিমাপ হল ১০ শতাংশ (বাংলা, ১৭৫০, ওম প্রকাশের হিসেব)। আমার হিসেব অনুযায়ী ১৭৯৫ সালে সমগ্র ভারতের রপ্তানিকৃত সুতির কাপড়ের পরিমাণ ছিল উৎপাদনের ১-২ শতাংশ। কাপড়ের উৎপাদন হয়তো সমস্ত উৎপাদনের ১০ শতাংশের বেশি কোথাওই ছিল না। অর্থাৎ আমরা এমন একটি ব্যাবসার আলোচনা করছি যার পরিমাণ সমগ্র অর্থনীতির এক হাজার ভাগের এক ভাগ। তার মধ্যেও আবার ইংরেজদের কোম্পানির অংশ খুব বেশি হলে দুই-তৃতীয়াংশ।

রপ্তানি ব্যাবসার পরিমাণ আনুপাতিক হিসেবে কত সামান্য, প্রায় তুচ্ছ, সেটা মনে রাখলে অনাবশ্যক তর্কে জড়িয়ে গিয়ে সময় নষ্ট করার ভয় থাকে না। যেমন, কিছু ঐতিহাসিক আলোচনা করেছেন বৈদেশিক বাণিজ্যের সুবাদে ‘বিশাল’ পরিমাণ রুপো ভারতে আমদানি হলেও তার প্রভাব জিনিসপত্রের দামের উপর পড়েনি কেন, যেমন পড়েছিল সমসাময়িক ইউরোপে। এঁদের একাংশ আবার রুপোর নিষ্ক্রিয়তার ব্যাখ্যা করেছেন ভারতীয়রা সোনা-রুপো গলিয়ে গয়না করে ফেলত, এই মত ব্যবহার করে। সোনা-রুপোর আমদানির পরিমাণ কত সামান্য ছিল সেটা মেনে নিলে এসব আলোচনা নিরর্থক মনে হবে।

ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসা যে ঐতিহাসিকদের কাছে একটা বিরাট গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে তার কারণ এই নয় যে ভারতের অর্থনীতিতে এই ব্যাবসার আপেক্ষিক গুরুত্ব খুব বেশি ছিল। শতকরা মাপে গুরুত্ব যৎসামান্য। তার পিছনে আসল কারণ দেশে ও বিদেশে মহাফেজখানায় এই ব্যাবসা নিয়ে যা তথ্য পাওয়া যায় তার পরিমাণ বিপুল, বিশেষ করে দেশীয় ব্যাবসার উপরে উপলব্ধ তথ্যের সঙ্গে তুলনায়। ইতিহাসের ছাত্রদের জন্যে কোম্পানির কর্মচারীরা নথির পাহাড় রেখে গিয়েছে। তাদের এত কাগজপত্র তৈরি করতে হয়েছিল কারণ তারা যৌথ সংস্থার কর্মী। কোম্পানির ডিরেক্টর, মালিক, পরের দিকে পার্লামেন্ট, এমনকী রাজাকেও ঠিকঠাক তথ্য দেওয়ার দায় ছিল। অন্যদিকে, হাজার হাজার ভারতীয় পারিবারিক সংস্থা যেসব নথি তৈরি করেছে তা কেবলমাত্র পরিবারের সদস্যদের পড়ার জন্যে। তার ভাষা দুর্বোধ্য। অনেক সময়ে ইচ্ছে করে সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার হয়েছে। আর পুরুষানুক্রমে সেই নথি পরিবারের গোপন অস্থাবর সম্পত্তির সঙ্গে সিন্দুকে বন্দি হয়ে আছে।

ব্যাবসার ইতিহাস নিয়ে যেসব ছাত্রছাত্রী গবেষণা করে ডক্টরেট পাওয়ার চেষ্টা করছে তাদের পরিতাপের বিষয়, ভারতীয় ব্যাবসার নথি পাওয়া যায় না। নথিপত্র যে কিছু নেই তা নয়। ইউরোপীয় ব্যাবসার সঙ্গে তফাতটা এখানেই যে, ভারতীয় ব্যাবসার নথি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে ধরা হত, এখনও হয়। ইউরোপীয় ব্যাবসার নথি পড়ার লোক ছিল অনেক এবং তাদের সকলেই কর্মচারীদের সঙ্গে পেশাগত ভাবে যুক্ত। পারিবারিক সম্পর্ক দিয়ে যুক্ত নয়।

পরিসংখ্যানে ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসার গুরুত্ব সামান্য হলেও অন্য দুটো বিচারে এর তাৎপর্য অপরিসীম। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসার পরিধি অপেক্ষাকৃত ছোট হলেও ক্রমবর্ধমান, আর দেশীয় বা স্থলপথের ব্যাবসার পরিধি আরও বড় হলেও সেই পরিধি মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পরে ও যুদ্ধবিগ্রহের কারণে দ্রুত কমে আসছে। তা ছাড়াও, প্রাতিষ্ঠানিক দিক দিয়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাবসার সংগঠনে সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রভাব দেশীয় ব্যাবসার তুলনায় অনেক গভীর, অনেক আধুনিক ও অনেক সুদূরপ্রসারী।

রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রসঙ্গই ধরা যাক। ভারতে ইংরেজদের রাজ্যদখল ও উপনিবেশ স্থাপন কোনও বিশুদ্ধ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দিয়েও বোঝা যাবে না, আবার কোম্পানির বিশালত্ব দিয়েও বোঝা যাবে না। সেই ঘটনা বুঝতে হলে একটা জরুরি সূত্র হল বিদেশি বণিক ও তাদের পার্টনারদের কাছে ব্যবসায়িক চুক্তি বলবৎ করা কত সহজ বা কত কঠিন ছিল এ দেশে। আমি বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে এই কাজ দেশের আইন-আদালত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠছিল। অন্যভাবে বললে, আমার মতে কন্ট্রাক্ট বা চুক্তির বহুল ব্যবহার ও তার জেরে সাংগঠনিক এমনকী রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতের ইতিহাসে কোম্পানির ব্যাবসার প্রধান ফলাফল।

আরও অনেক সাদামাটা অর্থে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ব্যাবসা অবশ্য‍ই যুগান্তকারী। এই ব্যাবসার হাত ধরেই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শুরু হয়।

কোম্পানিরাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন

ব্যাবসার জগতের উপরে কোম্পানির প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়নি। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপরে কোম্পানিরাজের প্রভাব নিয়ে এত বেশি আলোচনা হয়েছে ও তার বেশিটাই এত আইডিয়োলজিক্যাল বা রাজনৈতিক- মতাদর্শ-প্রণোদিত যে এ বিষয়ে নিরাবেগ আলোচনা করাই এখন মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাতীয়তাবাদী নেতা-লেখকরা একশো বছরের বেশি সময় ধরে ভারতীয়দের সমষ্টিগত চেতনার দেওয়ালে একটা গল্প সযত্নে খোদাই করে দিয়ে গিয়েছেন। সেই গল্প অনুসারে কোম্পানিরাজের আগে ভারতবর্ষ ছিল এক সমৃদ্ধ ক্ষমতাশালী শিক্ষিত দেশ। সেখানকার রাজা ও নবাবরা নিজেদের এলাকায় জনকল্যাণ ও উদ্যোগ বাড়ানোর জন্যে সবসময়ে সচেষ্ট। কোম্পানি ভারতের অপর্যাপ্ত ধনসম্পদ লুটেপুটে ব্রিটেনে পাঠাবে ঠিক করে প্রতারণার সাহায্যে এইসব ভাল রাজাদের হারিয়ে নিজেরাই রাজত্ব শুরু করে। ভারতের সম্পদ লুটে নেবার পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। কিছুটা পলাশির পরে, আরও বেশি বক্সারের পরে চাষিদের দেয় রাজকর কোম্পানির পদস্থ কর্মচারীরা হয় সরাসরি বিদেশে পাঠিয়েছে, নয় সেই টাকা ব্যবহার করে রপ্তানির পণ্য কিনেছে। সরকারি খাতে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে, ‘ড্রেন’ বা শোষণ চালিয়ে ব্রিটিশরা ভারতে দারিদ্র সৃষ্টি করেছে, এ দেশে আগে এত বেশি গরিব লোক ছিল না। এই হল ‘ড্রেন থিয়োরি’-র মোদ্দা কথা। ড্রেন থিয়োরি দীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাস আলোচনায় একটা মৌলিক তত্ত্ব। তত্ত্ব বললে হয়তো ভুল হবে, প্ৰায় ধর্মীয় সংস্কারের মতো হয়ে রয়েছে। এটা নিয়ে অন্যরকম প্রশ্ন তোলা সরকারি ঐতিহাসিকদের চোখে মহাপাপ

নিঃসন্দেহে কোম্পানির রাজস্ব নীতি প্রথম দিকে দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল এবং সেই রাজস্বব্যবস্থা চালাত যারা তাদের মধ্যে অনেক অসাধু লোক ছিল। কিন্তু এই দুর্নীতির বিরুদ্ধতা ও এটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা সেই ১৭৭০-এর দশক থেকেই শুরু হয়ে গেছে। এটা মনে রাখা দরকার যে কোম্পানির সমালোচক ও বিরুদ্ধ দল বরাবরই শক্তিশালী ছিল। ফলে নিশ্চিন্তে জনশ্রুতি এড়িয়ে দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার মতো সময় ও সুযোগ কোম্পানির অসৎ অফিসারদের পক্ষে পাওয়া সম্ভব ছিল না। সেরকম সুযোগ কোম্পানির কর্মচারীরা দশ-বারো বছরের বেশি পায়নি। ১৭৭০-এর দশক থেকেই ইংল্যান্ডে কোম্পানি শাসনের উপরে পার্লামেন্টারি নিয়ন্ত্রণের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে। এই বিতর্ক— যাতে এডমান্ড বার্ক ও অ্যাডাম স্মিথ মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন— সেটাও এতই আইডিয়োলজিক্যাল যে সঠিক মূল্যায়ন না করে এইসব অভিযোগের উল্লেখ করা অনুচিত হবে।

প্রথম কয়েক বছরের দুর্নীতির জের টেনে সমগ্র ভারতে কী করে দারিদ্র সৃষ্টি হল তাই নিয়ে একটা গোটা ‘তত্ত্ব’ পেশ করা একটু বাড়াবাড়ি হবে। রবার্ট ক্লাইভ ও তাঁর সঙ্গে ‘ন্যাবোব’রা যে অর্থ ভারত থেকে ব্রিটেনে পাচার করেন তার প্রায় পুরোটাই এসেছিল নবাবের তোষাখানা থেকে। ১৭০০ সালের শেষে এক আমেরিকান বণিক দেশি নবাবদের বলেছিল ‘জীবন্ত গয়নার দোকান’। এই নবাবরা সাধারণের কল্যাণে যত অর্থ ব্যয় করত তার বহুগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করত হিরে আর মুক্তোর মালা কিনে। কোম্পানি যদি করদাতা অর্থাৎ সাধারণ চাষিদের দেওয়া টাকা নবাবের পকেট থেকে সরিয়ে নিজের পকেটে নিয়ে আসে তা হলে নবাবদের হিরে-মুক্তো কেনা কমে যেতে পারে, কিছু জহুরি দেউলে হয়ে যেতে পারে, হারেমের বাসিন্দাদের ভাগে গয়নাগাটির পরিমাণ কমে যেতে পারে, কিন্তু সাধারণ চাষিদের অবস্থার ইতরবিশেষ হবে না।

চাষিদের দেয় কর দিয়ে রপ্তানির পণ্য কেনার ব্যবস্থা এত কম সময়ে ও এত ছোট পরিধিতে ঘটেছে যে তার উপরে ভিত্তি করে কোটি কোটি লোকের গরিব হয়ে যাওয়ার গল্প রূপকথার পর্যায়ে পড়ে। বক্সারের যুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতে যুদ্ধবিগ্রহ চালাতে কোম্পানিকে ব্যাবসা কমিয়ে রাজস্বের অনেকটা ভারতেই খরচ করতে হয়। ভারত তথা বাংলার সাধারণ লোকজন কোম্পানির অভ্যুত্থানের অনেক আগে থেকেই গরিব হয়ে ছিল, কোম্পানির অফিসাররা চেষ্টা করলেও তাদের শোষণ করে বিশেষ কিছু পেত না।

‘ড্রেন থিয়োরি’ নাম দিয়ে দারিদ্রের যে তত্ত্ব জাতীয়তাবাদী লেখকরা প্রচার করেন সেটা অবশ্য শুধু ১৭৭০-এর দশকেই প্রযোজ্য ছিল না। সেই সময় থেকে শুরু করে ১৯৩০-এর বিশ্বব্যাপী মন্দার সময় পর্যন্ত প্রায় দেড়শো বছর ভারতের বৈদেশিক লেনদেন একটা বিশেষ নিয়মে চলতে থাকে। এই নিয়মের সূত্রপাত কোম্পানির কাজেকর্মে ও কোম্পানির আমলে। এই নিয়মে ভারত প্রচুর পরিমাণে পরিষেবা কেনে বিদেশ থেকে, বিশেষ করে ব্রিটেন থেকে, আর তার বিনিময়মূল্য আসে জিনিসপত্র, প্রধানত কৃষিপণ্য, বিক্রি করে। অর্থাৎ বৈদেশিক পণ্য ব্যাবসার হিসেবের খাতে ভারতের উদ্বৃত্ত থাকত, আর সেই উদ্বৃত্ত খরচ হত পরিষেবা কিনতে। মোটামুটি ১৭০০ সালের শেষ থেকে বা ১৮০০ সালের প্রথম থেকে এই প্যাটার্নের শুরু হয় এবং আগেই বলেছি, এটা অক্ষুণ্ণ থাকে ১৯৩০ পর্যন্ত।

জাতীয়তাবাদী লেখকরা এই দীর্ঘস্থায়ী পরিষেবা ক্রয়ের ব্যাপারটাকেও শোষণ বা ড্রেন বলে চালাবার চেষ্টা করেছেন। ফলে কোম্পানির প্রথম দিকের বিবেকবর্জিত লুঠপাটের রাজত্ব ও অব্যবহিত পরেই যে অর্থনৈতিক পরিবর্তন শুরু হল ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বে, এই দুটো ব্যাপার মিলেমিশে খিচুড়ি হয়ে গেছে। জাতীয়তাবাদীদের বক্তব্য এই পরিষেবা ক্রয় রাজনৈতিক কারণে বা রাজনৈতিক চাপে ঘটেছে। এটা বশ্যতার নিদর্শন। ভারতের ঔপনিবেশিক অর্থনীতির নিদর্শন। এক প্রজন্ম আগে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ঘন ঘন তর্ক হত ড্রেনের পরিমাণ কতটা আর তার কারণে ভারতের অর্থনীতি কতটা মার খেয়েছে। মার যে খেয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না।

১৯৭০-এর দশকে বামপন্থী মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকরা ড্রেনের উপর ভিত্তি করে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির কতগুলি সাধারণ তত্ত্ব খাড়া করলেন। তাঁদের মতে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদ ছিল পৃথিবীর গরিব দেশগুলি থেকে এখন যারা ধনী সেইসব দেশে সঞ্চয় স্থানান্তরণের মাধ্যম। ভারতে কোম্পানি সরকারের প্রবর্তিত ড্রেন এই শোষণ ও শোষণের কারণে উত্তরোত্তর গরিব হয়ে যাওয়ার ভাল উদাহরণ। এই ব্যাখ্যা অতিমাত্রায় সরলীকৃত এবং আজকের দিনে মোটামুটি বাতিল হয়ে গেছে। সাম্রাজ্যব্যবস্থা কখনও কখনও লুঠপাট চালিয়েছে, প্রায় কখনই স্থানীয় বাসিন্দাদের কল্যাণের কথা ভেবে রাজ্যশাসন করেনি এবং উনিশ শতকে সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থার বৈষম্য বেড়েছে— এ সব কথাই কমবেশি ঠিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বৈষম্য বেড়েছে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের কারণে, বা সঞ্চয়ের স্থানান্তরণের কারণে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অনেকগুলি নতুন ধরনের বাণিজ্যিক-সাংগঠনিক আদানপ্রদানের উপায় সৃষ্টি করে দেয়। এই আদানপ্রদানের জন্যে পরিষেবা কেনার দরকার হয়েছিল। কোন পরিষেবা শোষণমূলক আর কোনটা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করেছে সে বিচার করার সহজ কোনও উপায় নেই। মার্ক্সবাদীরা সে আলোচনার ধার দিয়েও যাননি।

বরং ড্রেনের পরিমাপ অত্যন্ত ঘোরালো এবং অবিশ্বাসনীয় পদ্ধতিতে করা হয়েছে। যেমন, অনেকে ধরেই নিয়েছেন যে পণ্য আমদানি-রপ্তানির মোট মূল্যের পার্থক্য বা ব্যালেন্স অফ ট্রেড পুরোটাই ড্রেন বা লুঠের মাল হিসেবে ধরা উচিত। ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের এই জাতীয় ব্যাখ্যা অর্থহীন। অত্যন্ত সরলচিত্ত না হলে কোনও অর্থনীতিবিদ বিদেশে পাঠানো যে-কোনও রকম পেমেন্টকেই ড্রেন বলে ধরবেন না। সমস্ত ‘ব্যালেন্স অফ ট্রেড’কে ড্রেন বলে ধরে নিলে উনিশ শতকের অর্থনৈতিক পরিবর্তন বুঝতে আমাদের গোড়ায় বড় রকমের ভুল হবে।

উনিশ শতকের ভারত দরিদ্র দেশ তাতে সন্দেহ নেই, আশ্চর্যেরও কিছু নেই। নদীর অববাহিকা, বদ্বীপ ও উপকূলবর্তী কিছু অঞ্চল বাদ দিলে প্রায় গোটা উপমহাদেশে চাষের জমি অনুর্বর ও জলের অভাবে চাষের মরশুম অত্যন্ত সীমিত, কোথাও কোথাও বছরে তিন-চার মাসের বেশি চাষ করা সম্ভব নয়। তাতে প্রাণ রক্ষা হতে পারে, বড়লোক হওয়া যায় না। এই ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কোনও প্রযুক্তি সবুজবিপ্লবের আগে জানা ছিল না। সবুজবিপ্লবের পরেও অনেক অঞ্চলে রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

যা সত্যিই আশ্চর্যের কথা তা হল, ক্রান্তীয় অঞ্চলের দরিদ্র কৃষিপ্ৰধান দেশগুলির মধ্যে একমাত্র ভারতেই আধুনিক অর্থনীতির একটা কাঠামো গড়ে উঠেছিল। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক এশিয়া বা আফ্রিকার সঙ্গে তুলনায় একমাত্র ভারতেই শিল্পায়ন হয়েছে। কারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ১৮৬০ সালে ছিল মুষ্টিমেয়, ১৯৪০ সালে তা দশ লক্ষ ছাড়িয়েছে! পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক ও অন্যতম টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও গড়ে উঠেছে তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে সবথেকে বড় ও আধুনিক ব্যাঙ্ক, ইউনিভার্সিটি, বন্দর ও হাসপাতাল। এবং এই পরিকাঠামোর অনেকটাই তৈরি ভারতীয়দের টাকায়, সেইসব ভারতীয় যারা কোম্পানির শহরগুলিতে ব্যাবসা করে বড়লোক হয়েছে।

উন্নয়নশীল বিশ্বের মান দিয়ে মাপলে, ভারতের এই পরিবর্তন ছিল পুরোপুরি ব্যতিক্রমী। উনিশ শতকে ভারতে বিদেশের বাজারে বিক্রির জন্যে প্রচুর কৃষিপণ্য পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু শিল্পায়নের জন্যে বা ব্যাঙ্ক-ট্রেন- টেলিগ্রাফ-ইউনিভার্সিটি চালাবার জন্যে জরুরি দক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী-অধ্যাপক পাওয়া যাবে না। সুদের হার ইউরোপের তুলনায় দ্বিগুণ-তিন গুণ। এই পরিবেশে শিল্পায়নের মতো অসম্ভব যে সম্ভব হল তার কারণ ব্রিটেন থেকে টাকা ও দক্ষতা দুটোই সহজে আমদানি করা যেত। বম্বের কার্পাসের ব্যাপারীরা ম্যানচেস্টারে কার্পাস বিক্রি করে যে পয়সা করলেন তাই দিয়ে ম্যানচেস্টার থেকেই মেশিন এবং ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে এসে বম্বেতে মিল তৈরি করলেন। বিশ শতকের গোড়ায় শিল্পপতিরা ব্রিটেনের উপর নির্ভরতা অনেকটা কমিয়ে ফেলেছেন, তার একটা কারণ ভারতেই ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাশিক্ষার চর্চা বেড়েছে। কিন্তু সেইসব প্রতিষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবার লোক পাওয়া যাবে কোত্থেকে? অবশ্যই ব্রিটেন থেকে! এই ভাবে, উনিশ শতকের ভারতে আধুনিক অর্থাৎ শিল্পভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের গোড়াপত্তন হয়। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই পণ্য বিক্রির টাকা দিয়ে দরকারি ক্যাপিটাল ও পরিষেবা কেনা হয় যা ভারতে পাওয়া যেত না। পরিষেবা অনেকটা কেনা হয়েছিল সরকারি খাতে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আবার অনেকটা হয়েছিল বৈদেশিক বাণিজ্য, দেশি ব্যাবসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের এলাকায়

এই বিশাল পরিবর্তনের পিছনে যে অর্থনীতির নিয়ম কাজ করেছে তাকে ড্রেন বা পরাধীনতার পরিচায়ক বলে উড়িয়ে দেওয়াটা দেশপ্রেমের নিদর্শন হতে পারে, কিন্তু সঠিক ঐতিহাসিক মূল্যায়ন হবে না। নোবেলজয়ী বৈজ্ঞানিক ও ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের কর্মী রোনাল্ড রসের মাইনে আসত যে সরকারি টাকা থেকে তাকে আমরা ড্রেন বলব? কয়েক লক্ষ শ্রমিকের চাকরি হয়েছে যে পাট বা কাপড়ের কলে, তার বিদেশি মালিক যে ডিভিডেন্ড ব্রিটেনে পাঠাত সেটা ড্রেন? সরকারি খাতে ধারের উপর যে সুদ বিদেশে পাঠানো হত সেই সুদ জাতীয়তাবাদী লেখকদের কাছে ড্রেনের একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ। উনিশ শতকের শেষে পৃথিবীর প্রায় সব বড় দেশের সরকার বিদেশের বাজারে টাকা ধার করে রেলপথ গড়ে ট্রেন চালিয়েছে। সেই নীতির ভালমন্দ নির্ভর করে কোন বাজারে ধার করা হয়েছে, সেখানে টাকার দাম কী রকম তার উপরে। সেই হিসেবে দেখলে সারা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বড় টাকার বাজার লন্ডনে নেওয়া ধার ছিল সবচেয়ে লাভজনক। সমসাময়িক ভারতে দেশি ব্যাঙ্কারদের কাছ থেকে ধার নিয়ে ট্রেন চালালে করদাতাদের উপর অবিচার করা হত।

আর একটু ছড়িয়ে দেখলে, ব্রিটিশ ভারত যে টাকা ব্রিটেনকে পাঠাত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মিলিটারি অফিসার বা অধ্যাপকদের মাইনে বাবদ, সেটা ছিল ভারতে নানারকম দক্ষতা তৈরি করার মূল্য। সেই দক্ষতা ব্যবহার করেই অনেক পরের যুগে জওহরলাল নেহরুর ভারত স্বনির্ভর নীতি অবলম্বন করে উন্নয়নের চেষ্টা করেছে, আরও পরের যুগে সারা পৃথিবীতে সস্তায় তথ্যপ্রযুক্তি সহ ভারতীয়রা অনেক রকম পরিষেবা বিক্রি করেছে। এই পরের যুগের প্রবাহগুলির ব্যাখ্যা করা যাবে না যদি না আমরা ঔপনিবেশিক ভারতে যে উলটো প্ৰবাহ ঘটেছিল সেটাও হিসেবের মধ্যে ধরি।

এই সব পরিবর্তনের অনেকটাই কোম্পানি-পরবর্তী যুগের ব্যাপার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিবর্তনের একটা নিয়ম তৈরি করে দিয়ে যায়, যার মূল মন্ত্র ব্রিটেনের অর্থনীতির সঙ্গে ভারতের অর্থনীতির নিবিড় যোগসাধন। উনিশ শতকের প্রথমে ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্বায়নের সংজ্ঞাই ছিল ব্রিটেনায়ন। কেবল ঔপনিবেশিক ভারতে নয়, পৃথিবীর সব দেশে। বলাবাহুল্য, ব্রিটেনায়নের বাইরে কোম্পানির অফিসার বা সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে কোনও সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। ১৮৩০ সাল পর্যন্ত উন্নয়নের কোনও নির্দিষ্ট আলোচনাই শুরু হয়নি। কিন্তু ব্রিটেনায়নের জন্যেই একধরনের বাজারভিত্তিক পরিবর্তনের জোরালো হাওয়া বইতে থাকে। সেই হাওয়া বম্বে-কলকাতা-মাদ্রাজের বাইরে বেশি দূর যায়নি। কিন্তু এই তিনটে শহরে অসাম্প্রদায়িক ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে জড়িত যে ব্যাবসার প্রবাহ তৈরি হল তা কোম্পানিরই পরোক্ষ অবদান।

এসব কথা বলবার অর্থ এই নয় যে কোম্পানি শাসন কল্যাণকর শাসন ছিল। সরকার হিসেবে কোম্পানিরাজ আরও অনেক কিছুই করতে পারত যা করেনি বা হয়নি। ১৭৭০ ও ১৭৮০-র দশকে স্মিথ এবং বার্ক ন্যায্য প্রশ্ন তুলেছিলেন, ব্যবসায়ীদের দিয়ে সরকার চললে দুর্নীতি অবশ্যম্ভাবী, ব্যাবসাও লাটে উঠবে। সেই সময়ের অনেক ব্রিটেনবাসীর চোখে কোম্পানিরাজ ভারতীয়দের দুর্ভাগ্যের চিহ্ন। তার কারণ এই শাসনের প্রথম কয়েক বছর জনস্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থ একাকার হয়ে গিয়েছে। আজকের যুগের ভারতীয়রা নিজেদের দেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝবে জনস্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থ গুলিয়ে গেলে কী অনাচারের সৃষ্টি হতে পারে। যদিও এই সংমিশ্রণ সব সময়ে ব্যাবসার ক্ষতি করেছে এমন হয়তো বলা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *