মুসলমান-যুগের ভারতের ঐতিহাসিকগণ
তৃতীয় স্তবক
অষ্টাদশ শতাব্দীর ফার্সী ইতিহাসের বিশেষত্ব
মুঘল বাদশাহদের প্রাধান্যের সময় যে দুইটি বিশেষ শ্রেণীর ইতিহাস রচিত হয়, তাহার কথা দ্বিতীয় ব্যাখানে বলিয়াছি। প্রথমটি আকবর-নামার দৃষ্টান্তে রচিত বাদশাহের সরকারী ইতিহাস-গ্রন্থ; দ্বিতীয়টি ‘পত্র ও সংবাদ-পত্র’, যাহাকে ইংরাজীতে ডেস্প্যাচ এবং নিউস্-লেটার বলে, সেই শ্রেণীর উপাদান। কিন্তু ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে আওরংজীবের মৃত্যুর পর হইতে মুঘল বাদশাহদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হইয়া পড়িল, সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন ধরিল। তাঁহার পুত্র বাহাদুর শাহের পাঁচ বৎসর রাজত্ব (১৭০৭-১৭১২) পর্যন্ত রাজার ক্ষমতা ও ঠাট কোন রকমে বজায় ছিল, কিন্তু বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর হইতে যে অবিরত ঘরোয়া যুদ্ধ, মন্ত্রীদের আধিপত্য লইয়া বিবাদ ও পরস্পরের গলাকাটাকাটি, প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিদ্রোহ, সর্ব্বত্র লুঠতরাজ ডাকাতি ও খাজনা দেওয়া বন্ধ আরম্ভ হইল,– তাহা কিছুতেই নিবারিত হইল না। যা-ও বা একটু বাকী ছিল, তাহা নাদির শাহ ও আবদালীর আক্রমণ মারাঠাদের উত্তর-ভারতে ঘন ঘন অভিযান এবং প্রদেশ-দখল, এবং জাঠ ও শিখ অভ্যুত্থানের ফলে একেবারে শেষ হইয়া গেল। অর্থাৎ বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর ৭০ বৎসরের মধ্যেই হিন্দুস্থানের বাদশাহ দিল্লীর সিংহাসনে পুতুলের মতই নির্জীব হইয়া পড়িলেন; তাঁহার সাম্রাজ্য-সীমা কয়েকটি গ্রামে আসিয়া ঠেকিল; রাজকোষ শূন্য হইল, রাজসৈন্য লোপ পাইল, বাদশাহ বেগম নবাব সকলেই অনাহারে শুকাইতে লাগিলেন, দেশময় দৈন্য ও অশান্তি ছড়াইয়া পড়িল।
এরূপ অবস্থায় আকবর-শাহজাহানী যুগের ধরনের ইতিহাস রচিত হওয়া অসম্ভব। সুতরাং বাহাদুর শাহ যদিও একটা ‘বাহাদুর শাহ-নামা’ লিখাইতে আরম্ভ করিয়া দেন, (দানিশমন্দ খাঁ আলীর দ্বারা), দেড় বৎসরের ঘটনা বর্ণিত হইবার পর তাহার রচনা অর্থাভাবে বন্ধ হইয়া গেল। তাঁহার পরে আর কোন বাদশাহের যথার্থ “নামা” লেখা হয় নাই। সত্য বটে, সেই সব পরবর্তী বাদশাহের নামের সঙ্গে “নামা” এই শব্দ যোগ দেওয়া কতকগুলি ফার্সী ইতিহাস-গ্রন্থ পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলি আবুল-ফজলের ‘আকবর-নামা’র সহিত তুলনার অযোগ্য, তাহাদের রচনার সময় অতি অল্প পরিমাণেই সরকারী দলিলের সাহায্য পাওয়া গিয়াছিল এবং তাহাদের আকারও নিতান্ত ছোট। তথাপি, আগেকার সেই বিখ্যাত মুঘল বাদশাহদের গৌরবান্বিত যুগের ঐতিহাসিক ধারা রক্ষা করিবার জন্য অতি ক্ষুদ্র আকারের এই সব ক্ষুদ্র চেষ্টা আমাদের অবহেলার জিনিষ নহে; তবে আমরা এগুলিকে “নামা” শ্রেণীর লেখার মধ্যে গ্রহণ করিতে পারি না। তাকিয়ায় ঠেস দিয়া লক্ষ্ণৌর সুবাসিত তামাক গুড়গুড়ির দীর্ঘ নল দিয়া সেবন করা, আর পয়সায় পঁচিশটা বিড়ি কিনিয়া পথের ধারে দোকানের আগুনে তাহা জ্বালাইয়া ফুঁকিতে থাকা- এ দুটাই যেমন ধূমপান বটে, কিন্তু এদের মধ্যে পার্থক্য অনেক। ফলত: এই অষ্টাদশ শতাব্দীর ভণ্ড “নামা” গুলিতে আছে তারিখ ও কিছু কিছু ছোটখাট ঘটনা, যেমন বাজারে চলিত ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের সংক্ষিপ্তসারে দেখিতে পাই; নাই শুধু সেই আকবরী শাহজাহানী “নামা” গুলির চিন্তা, বর্ণনা এবং পূর্ণ অবয়ব। তথাপি এই সব অকুলীন নবীন “নামা” আমাদের পক্ষে অন্ধকারে ডিব্বীর আলো, ইহাদের ছাড়িলে কোন কোন রাজত্বকাল-বিষয়ে ঐতিহাসিক অনুসন্ধানকারী একেবারে নিঃসম্বল অসহায় হইয়া পড়িবেন।
আগেই বলিয়াছি যে, বাদশাহদের গৌরবের যুগে নানা স্থান হইতে সংবাদ ও সরকারী চিঠি তাঁহাদের দরবারে আসিয়া পৌঁছিত, অসংখ্য বিভাগ ও কারখানার হিসাবপত্র ও রিপোর্ট রাজধানীস্থ রেকর্ড অফিসে জমা হইত; এবং যখন বাদশাহ নিজ রাজত্বকালের ইতিহাস লিখিবার জন্য কোন বিখ্যাত ফার্সী লেখককে নিযুক্ত করিতেন, সেই লেখকের সম্মুখে এই সমস্ত দপ্তর খুলিয়া দেওয়া হইত, তিনি তাহা ঘাঁটিয়া তথ্য সংগ্রহ করিতেন, এবং দরকার-মত দেওয়ান বখ্শীদের জিজ্ঞাসা করিয়া আরও সংবাদ লইতেন। কিন্তু ১৭১২ খ্রিস্টাব্দ হইতেই অর্থের অভাবে, শান্তির অভাবে, লোকের অভাবে, এই সব শ্রেণীর সরকারী কাগজপত্র লেখা ও একত্র করা প্রায় বন্ধ হইয়া গেল, অতি সামান্য পরিমাণে অত্যাবশ্যক হিসাবপত্র মাত্র লেখা হইতে থাকিল। সুতরাং “নামা” গুলি এবং “নামা”র প্রধান উপকরণ একসঙ্গে লোপ পাইল।
কিন্তু তাহার পর আরও ১৮ বৎসর ধরিয়া বাদশাহী দরবারের রিপোর্ট-নাম ‘আখবারাৎ-ই-দরবার-ই-মুয়া’লা পূর্ণ জোরে লেখা হইতে লাগিল। এগুলি করদ রাজাদের জন্য তাঁহাদের ওয়াকেয়া-নবিসেরা বাদশাহী দরবার হইতে লিখিয়া পাঠাইত, এগুলি বাদশাহের গবর্ণমেন্টের সম্পত্তি নহে এবং সরকারী দপ্তরখানাতে রক্ষিত হইত না। কিন্তু করদ রাজাদের মধ্যে তখন হইতে সিপাহী-বিদ্রোহ পর্যন্ত এত বিপ্লব চলিয়া গিয়াছে যে, একমাত্র জয়পুর ভিন্ন আর সব রাজা নবাবদের রাজধানী হইতে এই আখ্ারাগুলি লোপ পাইয়াছে। এবং জয়পুরেও এগুলি একেবারে সম্পূর্ণ নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিক শ্রেণীতে নাই, তাহাদের মধ্যে অনেক মাস, এমন কি, বৎসর পর্যন্ত ফাঁক দেখা যাইতেছে। লক্ষ্ণৌ দিল্লী ঝঝর প্রভৃতি রাজধানী সিপাহী-বিদ্রোহের সময় ধ্বংস হয়।
নিজাম মাত্র ১৭২৪ সালে স্বাধীন হন, এবং তাহার পর প্রায় ২৫ বৎসর ধরিয়া তিনি নানা স্থানে যুদ্ধবিগ্রহে ব্যস্ত থাকেন, তাঁহার দপ্তরদারগণ প্রথমে আওরঙ্গাবাদে বাস করে, সেখানে তাঁহার অধিকাংশ রেকর্ড নষ্ট হইয়া গিয়াছে। আর ছোট ছোট সামন্তদের ত কথাই নাই। তাই আজ জয়পুর রাজদপ্তরই আমাদের একমাত্র সম্বল। সৌভাগ্যবশত: ১৯২৩ সাল হইতে অক্লান্ত চেষ্টার ফলে এগুলি গোছান, বাঁচান এবং ঐতিহাসিকের চোখের সামনে আনান হইয়াছে।
১৭৩০ সালে মালব প্রদেশ মারাঠাদের হাতে গেল, দক্ষিণ হইতে দিল্লী আগ্রা যাইবার পথ শত্রুর পক্ষে খোলা হইল, এবং মারাঠারা পঞ্জাব বাঙ্গলা পর্যন্ত লুঠ ও দখল করিতে আরম্ভ করিয়া দিল। প্রকৃত প্রস্তাবে মুঘল সাম্রাজ্য গেল, সুতরাং, এ সাম্রাজ্যের রীতিমত ইতিহাস রচনা একটি অর্থহীন ব্যঙ্গ মাত্র, অনাবশ্যক কাজ মাত্র হইয়া দাঁড়াইল। তবে প্রধান প্রধান ধাক্কার, বিপ্লবের খণ্ড ইতিহাস রচিত হইতে থাকিল; আমি তাহাদের “সত্য ঘটনামূলক ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত নাটক” বলিতে চাই। এই সময়ে একমাত্র সান্ত্বনার বিষয় এই যে, ১৭৩৬ হইতে অল্প অল্প এবং ১৭৫০ হইতে পূর্ণবেগে মারাঠাদের লিখিত সরকারী রেকর্ড হইতে উত্তর-ভারতের উপর ঐতিহাসিক আলোক পড়িতে থাকিল। অর্থাৎ এক দিকে জয়পুরের রাজদপ্তর, অপর দিকে পেশোয়াদের দপ্তর গবেষণাকারীর জ্ঞানপিপাসা পূর্ণ করিয়া দিতেছে।
ইংরাজদের পৃষ্ঠপোষকতা
তাহার পর চল্লিশ বৎসর কাটিয়া গেল, আন্দাজ ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ হইতে দেখা গেল যে, ইংরাজ উত্তর-পূর্ব্ব ভারতে স্বাধীন শক্তি হইয়া দাঁড়াইয়াছেন; নবাব শূজা-উদ্-দৌলার মৃত্যুর পর তাঁহারাই অযোধ্যা-রাজ্যের রক্ষকরূপে সেই সঙ্কীর্ণ মুঘল-সাম্রাজ্যের সীমানায়, দিল্লী-আগ্রার সামনে যমুনার পূৰ্ব্বপারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন; কানপুর ফরাক্কাবাদ এলাহাবাদে তাঁহাদের সৈন্য-ছাউনি। সুতরাং দিল্লী-সাম্রাজ্যের উপর অন্য দিক্ হইতে যে ঝড় আসিয়া পড়ে, তাহার ধাক্কা ইংরাজ কোম্পানীর গবর্ণমেণ্ট তৎক্ষণাৎ অনুভব করেন। আত্মরক্ষার্থে ইংরাজ সরকার এখন হইতে পশ্চিমের দক্ষিণের সব দেশী রাজ্যে সংবাদ-লেখক রাখিয়া দিলেন; তাহাদের রিপোর্ট এবং দেশী রাজাদের লিখিত কোম্পানীর নামে চিঠি– অধিকাংশই সাহায্যভিক্ষা-কলিকাতার রেকর্ড অফিসে জমিতে লাগিল। এগুলি সব ফার্সীতে লেখা, ইহাদের ইংরাজী সারসংগ্রহ এখন ছাপা হইয়াছে, ছয় ভলুমে ১৭৫৮ হইতে ১৭৮৫ পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে (তাহার মধ্যে প্রথম দশ বৎসর বড় ফাঁকা ফাঁকা এবং অকেজো)। এই গ্রন্থের নাম Calender of Persian Correspondence (Imperial Records, New Delhi.)
আর ১৭৬৫ হইতে এলাহাবাদে এবং ১৭৭৫ হইতে লক্ষ্ণৌ, ফরক্কাবাদে- সময়ে সময়ে আগ্রাতেও– সাহেব কর্মচারীরা অজস্র টাকা ও প্রতিপত্তির জোরে ঐতিহাসিক বা সুচিত্রিত সুলিখিত অন্যান্য ফার্সী হস্তলিপি সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের মনস্তুষ্টির জন্য ফার্সীনবিস উমেদারগণ ফার্সী ভাষায় ইতিহাস লিখিয়া (অথবা বাড়ী হইতে পূর্ব্বে রচিত পুঁথি সংগ্রহ করিয়া) তাঁহাদের উপহার দিয়া নিজের চাকরীর পথ সুগম করিয়া দিল। বিশেষত: ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের শেষার্দ্ধে পাঠান ঘুলাম কাদির কর্তৃক দিল্লী দখল, বাদশাহ শাহ্ আলমের চক্ষু উৎপাটন, রাজপরিবারে লুঠ ও রাজপরিজনের অবমাননার লোমহর্ষক কাহিনী ভারতে ও ভারতের বাহিরে সাহেব-মহলে অতীব চাঞ্চল্য ও কৌতূহল সৃষ্টি করিল। এ ধারে ঠিক পর-বৎসরেই বিলাতে ফরাসী রাষ্ট্রবিপ্লব আরম্ভ হইল। সেখানেও রাজপরিবার লাঞ্ছিত নিহত হইল, আমীর-ওমরা লুণ্ঠিত বন্দী নিহত বা নির্যাতিত হইল। এজন্য ভারতে ইংরাজ কর্ম্মচারীদের মধ্যে অনেকে তাঁহাদের মুনশীদিগকে ঐ মুঘল সম্রাটদের শেষ অবস্থার ইতিহাস লিখিতে আজ্ঞা দিলেন। এই বিদেশী উৎসাহে আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীর করুণ যুগের কয়েকখানি অমূল্য ইতিহাস পাইয়াছি। তাহার মধ্যে কয়েকটির নাম করিব-
(১) সম্রাট্ মুহম্মদ শাহের দুধ-ভাই (অর্থাৎ ধাত্রীপুত্র) মুহম্মদ বখ্শ (ছদ্মনাম
“আশোব্”)-কৃত ঐ সম্রাটের ইতিহাস, নাদির শাহের আক্রমণের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বিবরণ ইহাতে আছে। জগতে একমাত্র হস্তলিপি রক্ষা পাইয়াছে লণ্ডনের ইণ্ডিয়া অফিসে।
(২) ইউসূফ আলী-রচিত আলিবর্দী খাঁর কাহিনী।
(৩) ফকীর খয়ের-উদ্দীন-রচিত ইবরনামা–মাহাদজী সিন্ধিয়া, ঘুলাম কাদির, ডি বঁয়ে প্রভৃতি সম্বন্ধে সর্বপ্রধান ও অতুলনীয় উপাদান। হস্তলিপি।
(৪) ঘুলাম আলী-রচিত ইমাদ-উস্-সাদাৎ, প্রধানতঃ লক্ষ্ণৌয়ের নবাবদের লইয়া, কিন্তু দিল্লী, মারাঠা, জাঠ প্রভৃতি সম্বন্ধেও বহু সংবাদ আছে। লিখো হইয়াছে।
(৫) পাণিপথ-যুদ্ধ বিষয়ে কাশীরাজের ফার্সী বিবরণ, ফার্সীতে অমূল্য গ্রন্থ;
মারাঠী সরকারী কাগজপত্রে ইহার শতাংশ সংবাদও পাওয়া যায় না ৷
(৬) সুবিখ্যাত সিয়ার-উল-মুতাখ্ খরীণ, বঙ্গ বিহার সম্বন্ধে অমূল্য উপকরণ।
(৭) মালদহে উড্নী (Udney) সাহেবের জন্য লিখিত বাঙ্গলার সম্পূর্ণ ইতিহাস রিয়াজ-উস্-সালাতীন– যাহার ইংরাজী চুম্বক ষ্টুয়ার্ট-কৃত History of Bengal এত দিন পর্যন্ত আমাদের একমাত্র সম্বল ছিল।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরাজদের পোষ্যরূপে বাদশাহ শাহ্ আলম এলাহাবাদ- দুর্গে আশ্রয় লইলেন, এই দুর্গ ও শহর ইংরাজদের শাসনে ও রক্ষায় থাকিল। ১৭৭১ পর্যন্ত অর্থাৎ ছয় বৎসর বাদশাহ ওখানে থাকায় ভারতীয় রাজন্যগণের দৃষ্টি এলাহাবাদের দিকে নিবিষ্ট ছিল, কত দূত ও লেখক, পণ্ডিত ও সেনানী সেখানে আসিতে লাগিল। আবার ১৭৬৭ সাল অবধি প্রথমে নাদির শাহ্, পরে আবদালীর ঘন ঘন আক্রমণ ও লুণ্ঠনের ফলে দিল্লী আগ্রা অঞ্চল হইতে অনেক সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত লোক প্রাণ মান বাঁচাইবার জন্য ইংরাজ-আশ্রয়ে পাটনা শহরে পার হইয়া আসিলেন; কারণ, পাটনার ভাষা, খাদ্য, মুসলিম সভ্যতা ও জলবায়ুতে তাঁহারা আগ্রা হইতে বেশী পার্থক্য বুঝিতে পারিলেন না। এই কারণে অনেক সুন্দর হস্তলিপি ও মুঘল চিত্র পাটনায় স্থান পাইয়াছে। ঐতিহাসিক ঘুলাম হুসেন, মুনীর-উদ্-দৌলা (ভিখাপাহাড়ীর নবাব-বংশ) এবং শাকির (পাণিপথের আসারি-বংশজ) এই শ্রেণীর লোকের দৃষ্টান্ত।
ফার্সী ইতিহাস রচনা ও গ্রন্থসংগ্রহের পৃষ্ঠপোষক ইংরাজ কর্মচারীদের মধ্যে নাম করিব– ওয়ারেন হেষ্টিংস, ডো, জনসন, মেজর জেমস্ ব্রাউন, ষ্টুয়ার্ট, বেলী, স্কট, নীল্ বেঞ্জামিন এড্মনষ্ট, উড়ন, ভ্যাসিটার্ট, গ্লাড্উইন প্রভৃতি। ইঁহাদের সংগ্রহগুলি বিলাতে রক্ষা পাইয়াছে, আর ইঁহাদের মধ্যে অনেকে ফার্সীতে পণ্ডিত ছিলেন, অনুবাদ করিয়াছেন।
খণ্ড ইতিহাসের দৃষ্টান্ত
আওরংজীবের মৃত্যুর পরই তাঁহার ছেলেদের মধ্যে যে-সকল যুদ্ধ হইল, এবং তাহার পাঁচ বৎসর পরে তাঁহার পৌত্রগণের মধ্যে যে-সব যুদ্ধ চলিল, তাহার বর্ণনা করিয়া কতকগুলি সমসাময়িক এবং বিস্তৃত ফার্সী ইতিহাস রচিত হইয়াছে। তাহার পর, বাদশাহ ফরুশিয়র ও মুহম্মদ শাহের অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আছে, যদিও সেগুলি সরকারী কাগজপত্র দেখিয়া রচিত নহে। কিন্তু মুহম্মদ শাহের পরবর্তী দুইজন বাদশাহের (অর্থাৎ আহমদ শাহ্ এবং দ্বিতীয় আলমগীরের, ১৭৪৮-৫৪, ১৭৫৪-১৭৫৯) যে দুইখানি ইতিহাস পাওয়া যায়- দুইখানিই সর্ হেনরি এলিয়টের সংগ্রহ- সে দুইখানি “নামা” শ্রেণীর মতো সরকারী দপ্তরে রক্ষিত দিনলিপি অবলম্বনে রচিত, তবে তাহাতে আারাৎ ব্যবহৃত হয় নাই। শাহ্ আলম সম্বন্ধে মুনালাল এবং সৈয়দ রাজি খাঁ-লিখিত ইতিহাস তারিখ-অনুযায়ী সাজান হইলেও, এই দুখানি গ্রন্থ অকুলীন নবীন নামা অপেক্ষা অনেক নিকৃষ্ট; আমার মনে হয়, সেই শেষ যুগের রাষ্ট্র-বিপ্লবই এই অপকর্ষের কারণ। অতএব, বলিতে হইবে যে, তারিখ- ই-আলমগীর সানীই শেষ “নামা”।
“নামা”র অভাব আংশিক ভাবে পূরণ করে কয়েকখানি জীবনী। এই শ্রেণীর দুইখানি পুঁথি হইতে আমি অত্যন্ত উপকার পাইয়াছি, এবং তাহা ইংরাজীতে অনুবাদ করিয়াছি– প্রথম নজীব্-উল্-দৌলার জীবনী (সৈয়দ নুরুদ্দীন হুসেন-কৃত), দ্বিতীয় তাল্প খাঁ (ছদ্মনাম “মিসকিন”)-এর আত্মচরিত; এই দুটিই সত্য ঘটনায় পূর্ণ এবং নাটকের মতো মনোরঞ্জক। ‘ইনামা’ও অনেক স্থলে লেখক খয়ের-উদ্দীনের আত্মজীবনকাহিনি, সিয়র্-উল্-মুতাখ্ খরীণ। এই সব গ্রন্থে যুগের দেশের অবস্থা ও লোকদের জীবনযাত্রা যেন চোখের সামনে দেখিতে পাই।
প্রাদেশিক ইতিহাস
দিল্লীর সাম্রাজ্য ভাঙ্গিয়া পড়ায় বহু খণ্ডরাজ্যে দেশ ছাইয়া পড়িল। সুতরাং এখন হইতে আমরা খণ্ড-ইতিহাস বা প্রাদেশিক ইতিহাস অনেক পাই, ঠিক যেমন মুঘল-সাম্রাজ্য স্থাপিত হইবার পূর্ব্বে ভারত-ইতিহাসের অবস্থা ছিল। তবে ১৭৫০ সালের পরবর্তী এই সব খণ্ড ইতিহাস অতি তুচ্ছ, যেহেতু তাহাদের বর্ণিত রাজ্যগুলিও নগণ্য; কিন্তু ১৫২৬ সালের পূর্ব্বকালের প্রাদেশিক ইতিহাসগুলি অনেক স্থলে অমূল্য এবং শিক্ষাপ্রদ। এই খণ্ড-রাজ্যগুলির মধ্যে অযোধ্যা, নিজাম-রাজ্য, শিখ জাতি, এবং বাঙ্গলার মাত্র ফার্সী ইতিহাস পাওয়া যায়। জাঠ রাজপুত বুন্দেলা প্রভৃতির ঐ ভাষায় ইতিহাস রচিত হয় নাই।
ফার্সী ভিন্ন অপর ভাষায় লিখিত ইতিহাস
এ পর্যন্ত শুধু ফার্সী ভাষায় রচিত অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারত-ইতিহাসের কথাই বলিলাম। মারাঠী ভাষায় যে অমূল্য এবং সমুদ্র-প্রমাণ বৃহৎ উপাদান আছে, তাহার বর্ণনা “অধরচন্দ্র মুখোপাধ্যায়” বক্তৃতার প্রথম বর্ষে করিয়াছি; এবং তাহা এই ‘সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা’র ৪৩শ ভাগ ১-২২ পৃষ্ঠায় ছাপা হইয়াছে।
ফার্সী পর্তুগীজ ও ইংরাজী ভাষায় লিখিত ঐতিহাসিক উপাদান– ঐতিহাসিক সাহিত্য-গ্রন্থ নহে– এখানে বর্ণনা করা অসম্ভব; কিন্তু ১৭৭৫ সালের পর হইতে এই সব বিলাতী ভাষার দলিলগুলি ক্রমে প্রথম শ্রেণীতে স্থান অধিকার করিয়াছে।
[সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ৪৬ বর্ষ, সংখ্যা ২, ১৩৪৬।]