১০. মিলি সেজেগুজে বেরুচ্ছিল

মিলি সেজেগুজে বেরুচ্ছিল। তার শাশুড়ি, সুরমা তাকে ডাকলেন। সুরমাব বয়স প্রায় পঞ্চাশ, কিন্তু এখনো তার মাথার চুল পাকেনি। চামড়ায় ভঁাজ পড়েনি। ভদ্রমহিলা ছোটখাটো। কথা বলেন নিচু গলায় কিন্তু যা বলেন খুব স্পষ্ট করে বলেন। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায যে তিনি এ সংসারের সর্বময় কত্রী। এবং আরো দীর্ঘদিন তার কর্তৃত্ব থাকবে।

মিলি শাশুড়িকে দেখেই থমকে দাঁড়াল। সে সুরমাকে বেশ ভয্য কবে। সুরমা ঠাণ্ডা গলায় বলল, কোথায় যাচ্ছ মা?

এই একটু বাইরে যাচ্ছি, এসে পড়ব।

যখন তখন হুঁটহাট করে বাইরে যাওয়া ঠিক না।

মিলি কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। সুরমার মনের ভাব ঠিক ধরা যাচ্ছে না। তিনি কথা বলছেন মিষ্টি গলায়। আদর করার ভঙ্গিতে।

তুমি মা একা একা বেড়াও। এই শহর কী একা একা ঘুরে বেড়ানোর শহর? এখন যাচ্ছ কোথায়?

বাবার কাছে যাব। তার শরীরটা ভাল না। খুব জ্বর।

সুরমা তাকিয়ে রইলেন, কিছু বললেন না। মিলি হড়বড় করে বলল, একশ চার পর্যন্ত উঠেছিল। মাথায় পানি-টানি ঢেলে রক্ষা। এই বয়সে এ জুরি ওঠা খুব খারাপ।

কিন্তু কাল তো কিছু বলনি। কাল গিয়েছিলে না তার ওখানে?

মিলি আমতা আমতা করে বলল, কাল বলতে মনে ছিল না।

সুরমা শীতল কণ্ঠ বের করলেন। কিন্তু শীতল হলেও গলার স্বরের অদূরে ভঙ্গিটি নষ্ট হল না।

ঠিক আছে মা, যাও বাবাকে দেখে আস। ছেলেমেয়ে বাবাকে না দেখলে কে দেখবে?

তা তো ঠিকই। তাছাড়া বাবা একা মানুষ। সব সময় চিন্তা-ভাবনা করেন। আমাদের নিয়ে তার খুব চিন্তা।

সুরমা গম্ভীর হয়ে বললেন, এটা তো মা ঠিক বললে না। বেয়াই সাহেব চিন্তা-ভাবনা নিশ্চয়ই করে। কিন্তু তোমাকে নিয়ে না। যতদিন বিয়ে হয়েছে একদিন এসেছেন তোমাকে দেখতে? নাতনী হবার খবর পেয়েও তো আসেননি।

বাবার গাড়িটা মা নষ্ট। তিনি একে বারে অচল।

যাদের গাড়ি নেই তারা বুঝি চলাফেরা করে না?

মিলি এর কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। সুরমা হাসি মুখে বললেন, তোমার বাবা যেমন তোমার লেখক ভাইও সে রকম। সেও তো আসে না। তারও বুঝি গাড়ি নষ্ট?

ভাইয়ার তো গাড়ি নেই মা। ও রিকশাতেই ঘোরাফেরা করে। খুব অসামাজিক তো, তাই কোথাও যায় না। লেখক মানুষ, নিজের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে থাকে। ভাইযার কোনো দোষ ধরা ঠিক না মা। সে তো আর আমাদের মত সাধারণ মানুষ না।

তা তো ঠিকই। সাধারণ কেন হবে। ঠিক আছে মা যাও ঘুরে আসা। তোমার দেরি করিয়ে দিলাম।

মিলির মনটাই খারাপ হয়ে গেল। একবার ভাবলা যাবে না কোথাও। ঘরে শুয়ে থাকবে। কিন্তু দুপুরে সে ঘুমুতে পারে না। বিছানায় গড়াগড়ি করতে খুব খারাপ লাগে। কারো সঙ্গে গল্প করে সময় কাটানোরও উপায় নেই। ননদ গিয়েছে ইউনিভার্সিটিতে। আগে সে দুপুর নাগাদ ফিরে আসত। এখন ফিরছে না। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় আসছে। তার হাবভাবে কিছু একটা গোপন করার চেষ্টা। মিলির ধারণা তার এই বোরকাওয়ালির কোনো একটা ছেলের সঙ্গে ভাব-টাব হয়েছে। হয়ত লাইব্রেরির ধারন্দায় বসে আডিডা দেয়। তখনো বোরকা থাকে কী না এটা মিলির দেখার সখ। কিন্তু ভর দুপুরে ইউনিভার্সিটি এলাকায় যেতে ভয় ভয় লাগে বলে যাওয়া হয় না।

আজ সে রিকশা নিয়ে শাহবাগ চলে গেল! একটা স্ন্যাকবারে ঢুকে ঠাণ্ডা পেপসি খেল, যদিও তার মোটেও তৃষ্ণা হয়নি। সেখান থেকেই দেখল ছেলেমেয়ে নিয়ে দু’টা ফ্যামিলি ঢুকছে মিউজিয়ামে। মিলি এখনো এই মিউজিয়াম দেখেনি, কাজেই সে মিউজিয়াম দেখতে গেল; দোতলায় রাজামহারাজাদের পালঙ্ক দেখে সে মুদ্ধ হয়ে গেল। দীর্ঘ সময় সে ঘুরঘুর করল পালঙ্কের আশপাশে। এক বিদেশিনী পালঙ্কের ছবি তুলছিল। মিলির ইচ্ছা হল বলে দয়া করে আমারও একটা ছবি তুলে দেন না। ইংরেজিতে এটা কিভাবে বলতে হবে বুঝতে না পারার জন্যে শেষ পর্যন্ত বলতে পারল না। তবে সে ঘুরতে লাগল বিদেশিনীর সঙ্গে সঙ্গে।

মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আসবার মুখে রিসিপশনের মেয়েটিকে বলল, আমার একটা টেলিফোন করা খুব জরুরি কোথেকে করতে পারি বলতে পারেন? এখন একটা টেলিফোন করতে না পারলে বিরাট বিপদ হয়ে যাবে।

মিলি তার মুখ এতই করুণ করে ফেলল যে তার নিজেরই কান্না পেয়ে যেতে লাগল। এবং এক সময় সত্যি সত্যি চোখে পানি এসে গেল। রিসিপশনিস্ট মেয়েটি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে তাকে টেলিফোন জোগাড় করে দিল। সে ডায়াল ঘুরিয়ে হাসি মুখে বলল, কেমন আছ ভাইয়া? ঘুমুচ্ছিলে নাকি? না? তাহলে কী লিখছিলে? বলত কোথেকে ফোন করছি? একশ টাকা বাজি, বলতে পারবে না। যে জায়গা থেকে করছি তার প্রথম অক্ষর হচ্ছে মা। কী আন্দাজ করতে পারছ?

রিসিপশনিস্ট মেয়েটি অবাক হয়ে মিলির কথাবার্তা শুনতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *