॥ ১০ ॥
মিটার গেজের প্যাসেঞ্জার গাড়ি। কামরাগুলো তাই খুবই ছোট। যাত্রীও বেশি নেই, তাই একটা খালি ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াতে খুব একটা অবাক লাগল না।
কামরা অন্ধকার; হাতড়িয়ে সুইচ বার করে টিপে কোনও ফল হল না। লালমোহনবাবু বললেন, ‘সভ্য দেশেই রেলের বাল্ব লোপাট হয়ে যায়, ডাকাতের দেশে তো ওটা আশা করাই ভুল।’
ফেলুদা বলল, ‘তোরা দু’জন দু’ দিকের বেঞ্চিতে শুয়ে পড়। আমি মাঝখানের মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে ম্যানেজ করছি। ঝাড়া ছ’ ঘণ্টা সময় আছে হাতে, দিব্যি গড়িয়ে নেওয়া যাবে।’
লালমোহনবাবু একবার একটু আপত্তি করেছিলেন—‘আপনি আবার ফ্লোরে কেন মশাই, আমাকে দিন না’—কিন্তু ফেলুদা একটু কড়া করে ‘মোটেই না’ বলাতে ভদ্রলোক বোধহয় গাঁটের ব্যথার কথা ভেবেই বেঞ্চিতে হোল্ড-অল খুলে পেতে নিলেন।
গাড়ি ছেড়ে প্ল্যাটফর্ম পেরোনোর এক মিনিটের মধ্যেই কে একজন আমাদের দরজার পা-দানিতে লাফিয়ে উঠল। লালমোহনবাবু হেসে বলে উঠলেন, ‘আরে বাবা, গাড়ি রিজার্ভ হ্যায়। জেনানা কাম্রা হ্যায়!’
এবারে ঝড়াক্ করে আমাদের দরজাটা খুলে গেল, আরেকটা উজ্জ্বল টর্চের আলো জ্বলে উঠে কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল।
সেই আলোতেই দেখলাম, একটা হাত আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছে, আর সে হাতে চকচক করছে একটা লোহার নলওয়ালা জিনিস।
আমাদের তিনজনেরই হাত মাথার উপর উঠে গেল।
‘এবার উঠুন তো বাবুরা! দরজা খোলা আছে, একে একে নেমে পড়ুন তো বাইরে!’
এ যে মন্দার বোসের গলা!
‘গাড়ি যে চলছে!’—কাঁপা গলায় বলে উঠলেন লালমোহনবাবু।
‘শাট্ আপ!’ মন্দার বোস গর্জন করে দু’ পা এগিয়ে এলেন। টর্চের আলোটা অনবরত আমাদের তিনজনের উপর ঘোরাফেরা করছে। ‘ন্যাকামো হচ্ছে! কলকাতায় চলন্ত ট্রাম-বাস থেকে ওঠানামা করা হয় না? উঠুন উঠুন—’
কথাটা শেষ হতে না হতে এমন একটা ব্যাপার ঘটে গেল, যেটা আমি জীবনে কোনওদিন ভুলব না। ফেলুদার ডান হাতটা একটা বিদ্যুতের শিখার মতো নেমে এসে তার নিজের শতরঞ্চির সামনের দিকে খাম্চে ধরে মারল একটা প্রচণ্ড হ্যাঁচকা টান—আর তার ফলে মন্দার বোসের পা দুটো সামনের দিকে হড়কে ছটকে শূন্যে উঠে গিয়ে উপরের শরীরটা এক ঝটকায় চিতিয়ে দড়াম করে লাগল কামরার দেয়ালে। আর সেই সঙ্গে তার ডান হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে পড়ল লালমোহনবাবুর বেঞ্চিতে আর বাঁ হাত থেকে জ্বলন্ত টর্চটা ফসকে গিয়ে পড়ল মেঝেতে।
মন্দার বোসের পুরো শরীরটা মাটিতে পড়বার আগেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ফেলুদা—তার হাতে কোটের ভিতর থেকে বার করা তার নিজের রিভলভার।
‘গেট আপ!’ ফেলুদা মন্দার বোসকে উদ্দেশ করে গর্জিয়ে উঠল।
মিটার গেজের গাড়ি, প্রচণ্ড শব্দ করে দুলে দুলে এগিয়ে চলেছে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে। লালমোহনবাবু ইতিমধ্যে মন্দারবাবুর রিভলভারটা তার জাপান এয়ার লাইনস্-এর ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
‘উঠুন বলছি!’ ফেলুদা আবার গর্জিয়ে উঠল।
টর্চটা মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে, অথচ বুঝতে পারছি সেটা মন্দার বোসের উপর ফেলা উচিত—নইলে লোকটা অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে একটা গোলমাল করতে পারে। এই কথাটা ভেবে টর্চটা তুলতে গিয়েই হয়ে গেল সর্বনাশ; আর সেটা এমনই সর্বনাশ যে সেটার কথা ভাবতে এখনও আমার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মন্দার বোসের শরীরের উপর দিকটা ছিল আমার বেঞ্চির দিকে। আমি যেই টর্চটা তুলতে নিচু হয়েছি, ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ একটা আচমকা ঝাঁপ দিয়ে আমাকে জাপটে ধরে আমাকে সুদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন। তার ফলে মন্দার বোস আর ফেলুদার মাঝখানে পড়ে গেলাম আমি। এই চরম বিপদের সময়েও মনে মনে লোকটার শয়তানি বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না। বুঝতে পারলাম, ফেলুদা প্রথম রাউন্ডে আশ্চর্য ভাবে জিতলেও, দ্বিতীয় রাউন্ডে বেকায়দায় পড়ে গেছে। এটাও বুঝলাম যে এই অবস্থাটার জন্য দায়ী একমাত্র আমি।
মন্দার বোস আমাকে পিছন থেকে আঁকড়ে ধরে সামনের দিকে রেখে খোলা দরজাটার দিকে পিছোতে লাগলেন। কাঁধের কাছটায় কী যেন একটা ফুটছে। বুঝলাম সেটা মন্দার বোসের হাতের একটা নখ। নীলুর হাতের যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে গেল।
ক্রমে বুঝলাম দরজার খুব কাছে এসে গেছি। কারণ বাইরে থেকে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে আমার বাঁ কাঁধটায় লাগছে।
আরও এক পা পিছোলেন মন্দার বোস। ফেলুদা রিভলভার উঁচিয়ে রয়েছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। জ্বলন্ত টর্চটা এখনও ট্রেনের দোলার সঙ্গে সঙ্গে মেঝের এদিকে-ওদিকে গড়াচ্ছে।
হঠাৎ পিছন থেকে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে আমি ফেলুদার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আর তার পরেই একটা শব্দ পেলাম যাতে বুঝলাম যে, মন্দার বোস চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়েছেন। তিনি বাঁচলেন কি মরলেন, সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই।
ফেলুদা দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখে ফিরে এল। তারপর যথাস্থানে রিভলভারটাকে চালান দিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়ে বলল, ‘দু’-একটা হাড়গোড় অন্তত না ভাঙলে খুব আক্ষেপের কারণ হবে।’
লালমোহনবাবু যেন একটু অতিরিক্ত জোরেই হেসে উঠে বললেন, ‘বলেছিলাম না মশাই, লোকটা সাস্পিশাস্।’
আমি এর মধ্যে ফ্লাস্ক থেকে খানিকটা জল খেয়ে নিয়েছি। বুকের ধড়ফড়ানিটা আস্তে আস্তে কমছিল, নিশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। কী ভীষণ একটা ঘটনা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল, সেটা যেন এখনও ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না।
ফেলুদা বলল, ‘শ্রীমান তপেশ ছিলেন বলে লোকটা এ-যাত্রা পার পেয়ে গেল, নইলে বন্দুকটা নাকের সামনে ধরে ওর পেট থেকে সব বার করে নিতাম। অবিশ্যি—’
ফেলুদা থামল। তারপর বলল, ‘খুব বড় বিপদের সামনে পড়লেই দেখেছি আমার মাথাটা বিশেষ রকম পরিষ্কার হয়ে যায়। ওই সংকেতের মানেটা এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি।’
‘বলেন কী!’ বললেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদা বলল, ‘আসলে খুবই সহজ। আই হচ্ছে আমি, পি হচ্ছে পোকরান, ইউ হচ্ছে তুমি, আর এম্ হচ্ছে মিত্তির—প্রদোষ মিত্তির।’
‘আর প্লাস-মাইনাস?’
‘আই পি ১৬২৫ + ইউ। অর্থাৎ আমি পোকরান পৌঁচচ্ছি বিকেল চারটে পঁচিশে, তুমি আমার সঙ্গে এসে যোগ দিয়ো।’
‘আর ইউ মাইনাস এম?’
‘আরও সহজ—তুমি মিত্তিরকে কাটাও।’
‘কাটাও!’ ধরা গলায় বললেন লালমোহনবাবু। ‘তার মানে মাইনাস হচ্ছে মার্ডার?’
‘মার্ডারের প্রয়োজন কী? মাঝপথে চলন্ত ট্রেন থেকে নামিয়ে দিলে এক তো জখম হবার সম্ভাবনা ছিলই, তার উপর চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হত পরের ট্রেনের জন্য। তার মধ্যে ওদের কার্যসিদ্ধি হয়ে যেত। দরকারটা ছিল আমাদের জয়সলমীর থেকে মাইনাস করা। সেই জন্যেই তো রাস্তায় এত পেরেকের ছড়াছড়ি। সেটায় কাজ হয়নি বুঝতে পেরে শেষটায় ট্রেন থেকে নামানোর চেষ্টা।’
এতক্ষণে হঠাৎ একটা জিনিস খেয়াল করলাম। ফেলুদাকে বললাম, ‘চুরুটের গন্ধ পাচ্ছি ফেলুদা।’
ফেলুদা বলল, ‘সেটা লোকটা কামরায় ঢোকামাত্র পেয়েছি। সার্কিট হাউসেও কোনও ব্যক্তি যে চুরুট খাচ্ছেন সেটা আগেই বুঝেছি। মুকুলের হাতের সেই রাংতাটা চুরুটেই জড়ানো থাকে।’
‘আর ভদ্রলোকের একটা নখ ভীষণ বড়। আমার কাঁধটা বোধহয় নীলুর হাতের মতোই ছড়ে গেছে।’
‘কিন্তু যিনি ইন্স্ট্রাকশন দিচ্ছেন সেই আই-টি কিনি?’ জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদা গম্ভীর গলায় বলল, ‘সার্কিট হাউসে পাওয়া ইংরিজিতে লেখা হুমকি-চিঠির সঙ্গে এই সংকেতের লেখা মিলিয়ে তো একটা লোকের কথাই মনে হয়।’
‘কে?’ আমরা দু’জনে এক সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম।
‘ডক্টর হেমাঙ্গমোহন হাজরা।’
রাত্রে সবসুদ্ধ বোধহয় ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়েছি। যখন ঘুম ভাঙল তখন বাইরে রোদ। ফেলুদাকে দেখলাম মেঝে থেকে উঠে আমার বেঞ্চির এক কোণে বসে বাইরের দিকে চেয়ে রয়েছে। তার কোলে রয়েছে সেই নীল খাতা, আর হাতে রয়েছে দু’খানা চিঠি—একটা সেই ইংরিজিতে হুমকি আর অন্যটা ডক্টর হাজরার লেখা চিঠি। ঘড়িতে দেখি পৌনে সাতটা। লালমোহনবাবু এখনও দিব্যি ঘুমোচ্ছেন। খিদে পাচ্ছিল ভীষণ, কিন্তু গজা খেতে আর মন চাইছিল না। জয়সলমীর পৌঁছবে প্রায় ন’টায়। বুঝলাম এই দু’ ঘণ্টা সময় খিদেটাকে কোনওরকমে চেপে রাখতে হবে।
বাইরের দৃশ্য অদ্ভুত। মাইলের পর মাইল অল্প ঢেউ-খেলানো জমি দেখা যাচ্ছে দু’ দিকে—তার মধ্যে একটা বাড়ি নেই, একটা লোক নেই, একটা গাছ পর্যন্ত নেই। অথচ মরুভূমি বলা যায় না, কারণ, বালি মাঝে মাঝে থাকলেও, বেশির ভাগটাই শুকনো সাদা ঘাস, লালচে মাটি আর লাল-কালো পাথরের কুচি। এর পরেও যে আবার একটা শহর থাকতে পারে সেটা ভাবলে বিশ্বাস হতে চায় না।
একটা স্টেশন এল—জেঠা চন্দন। আমি ব্র্যাড্শ খুলে দেখলাম এটার পর থাইয়ৎ হামিরা, আর তার পরেই জয়সলমীর। স্টেশনে দোকান-টোকান নেই, লোজন নেই, কুলি নেই, ফেরিওয়ালা নেই। সব মিলিয়ে মনে হয় যেন পৃথিবীর কোনও একটা অনাবিষ্কৃত জায়গায় এই ট্রেনটা কেমন করে জানি এসে পড়েছে—ঠিক যেমনি করে রকেট গিয়ে হাজির হয় চাঁদে।
এবার গাড়ি ছাড়ার মিনিটখানেক পরেই লালমোহনবাবু উঠে পড়ে বিরাট একটা হাই তুলে বললেন, ‘ফ্যান্ট্যাস্টিক স্বপ্ন দেখলুম মশাই। একদল ডাকাত, তাদের গোঁফগুলো সব ভেড়ার শিঙের মতো প্যাঁচানো—তাদের আমি হিপ্নোটাইজ করে নিয়ে চলেছি একটা কেল্লার ভিতর দিয়ে। সেই কেল্লায় একটা সুড়ঙ্গ। তাই দিয়ে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বারে পৌঁছলুম। জানি সেখানে গুপ্তধন আছে, কিন্তু গিয়ে দেখি একটা উট মেঝেতে বসে জিভেগজা খাচ্ছে।’
‘গজা খাচ্ছে সেটা জানলেন কী করে?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। ‘হাঁ করে দেখাল?’
‘আরে না মশাই। স্পষ্ট দেখলুম আমার দালদার টিনটা খোলা পড়ে আছে উটের ঠিক সামনে।’
থাইয়ৎ হামিরা স্টেশন পেরোনোর কিছুক্ষণ পরেই দূরে আবছা একটা পাহাড় চোখে পড়ল। এ-ও সেই রাজস্থানি চ্যাপটা টেব্ল মাউন্টেন। আমাদের ট্রেনটা মনে হল সেই পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে।
আটটা নাগাত মনে হল পাহাড়টার উপর একটা কিছু রয়েছে।
ক্রমে বুঝতে পারলাম, সেটা একটা কেল্লা। সমস্ত পাহাড়ের উপরটা জুড়ে মুকুটের মতো বসে আছে কেল্লাটা—তার উপর সোজা গিয়ে পড়েছে ঝকঝকে পরিষ্কার সকালের ঝলমলে রোদ। আমার মুখ থেকে একটা কথা আপনা থেকেই বেরিয়ে পড়ল—
‘সোনার কেল্লা!’
ফেলুদা বলল, ‘ঠিক বলেছিস। এটাই হল রাজস্থানের একমাত্র সোনার কেল্লা। বাটিটা দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। তারপর গাইডবুক দেখে কন্ফার্মড হলাম। বাটিটা যে পাথরের তৈরি, কেল্লাও সেই পাথরেরই তৈরি—ইয়েলো স্যান্ডস্টোন। মুকুল যদি সত্যি করেই জাতিস্মর হয়ে থাকে, আর পূর্বজন্ম বলে যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে, তা হলে মনে হয় ও এখানেই জন্মেছিল।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু ডক্টর হাজরা কি সেটা জানেন?’
ফেলুদা এ কথার কোনও উত্তর না দিয়ে একদৃষ্টে কেল্লার দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘জানিস তোপ্সে—অদ্ভুত এই সোনালি আলো। মাকড়সার জালের নকশাটা চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এই আলোয়।’