১০. মাত্র তিন রাত্রি

১০

মাত্র তিন রাত্রি পোয়াবার পরের সকালে, রুহিতন কুরমি বারো নম্বর ওয়ার্ডের এক পাশে থমকিয়ে দাঁড়াল। সকালের রোদ উঠেছে তখন। ওয়ার্ডের অনেকেই নীচে গিয়েছে। জানালা দিয়ে দেখা যায়, মাঠের সবুজ ঘাসে, পুকুরের জলে, আর দূরের বড় বটগাছটার পাতায় রোদ চিকচিক করছে। জগৎ সংসারের মতো, জেলখানাও জেগে উঠেছে। তার নিজের নিয়মে, নিজের মতো। নীচের ওয়ার্ডের ডবল গরাদে রাত্রি আটটায় তালা পড়ে। তার আগে বন্দিরা উঠোনের পাশের চালায় রাত্রের খাবার খেয়ে নেয়। তাদের ভিতরে ঢুকিয়ে ওয়ার্ডের গরাদ বন্ধ হয়। তারপরে সারা রাত্র কেবল বুটের খটখট, হুইসলের শব্দ, রাত পাহারার চিৎকারের ধ্বনি বিলম্বিত স্বরে, এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে জেলখানা জাগতে থাকে। ওয়ার্ডের আলো নিবে যায়। বন্দিদের রাত্রের প্রাকৃতিক কাজের জন্য, সাময়িক ব্যবস্থা ওয়ার্ডের ভিতরেই থাকে। সিঁড়ির রেলিং ছাদের সিলিং-এ ঠেকানো। সিড়ির মুখেও লোহার গরাদ। বন্দিদের দোতলায় তুলে দিয়ে, সিডির গরাদেও তালা পড়ে যায়। নীচের ওয়ার্ডে কেউ থাকে না, কেবল আলো জ্বলে। রাতের পাহারার তীক্ষ্ণ চোখ সেই শূন্য ওয়ার্ডেও প্রতি বারের টহলে উঁকি মেরে যায়। ভোরবেলা গরাদ খুলে দেওয়া হয়। বন্দিরা তখন বাইরের পাইখানা আর বাথরুমে যায়।

ভোরবেলা লোহার গরাদ খুলে দেবার পরে, বন্দিরা অনেকেই নীচে চলে গিয়েছে। রুহিতন কুরমি দেখল, দুজন কয়েদি তার লোহার খাটিয়াটা সরিয়ে, নীচে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে ওয়ার্ডের এক পাশে দাড়িয়েছিল। চার দিন আগে খাটিয়াটা এই ওয়ার্ডে তার জন্য, এই রকম দুজন কয়েদি তুলে দিয়ে গিয়েছিল। তার খাটিয়া সরিয়ে নেবার মুহূর্তেই, অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করেছিল। জবাব পেয়েছে, ‘হুকুম হয়েছে।’

খেলু চৌধুরীর সঙ্গে আরও কয়েকজন বন্দি অন্য এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। রুহিতন তার পুচ্ছহীন চোখের লাল দগদগে পাতা মেলে, তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দলের বন্ধুদের খাটিয়া সরিয়ে মাঝখান থেকে তার খাটিয়া তুলে নিয়ে যাচ্ছে। রুহিতন প্রতিবাদ করতে পারছে না। তার বন্ধুরাও প্রতিবাদ করছে না। সাত বছরের জেল জীবনে এমন ঘটনা এই প্রথম। সে অবাক হতে গিয়ে রেগে উঠছে। রাগ করতে গিয়ে এক ধরনের ত্ৰাসাচ্ছন্ন বিষাদ মনের মধ্যে ফিরে আসছে। সে দেখল, খেলু চৌধুরী আর অন্যরা দেখছে, কয়েদিরা খাটিয়াটাকে সিড়ির দিকে কেমন করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রুহিতনের যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তা-ই ব্যস্ত হয়ে কয়েদি দুজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’

একজন কয়েদি জবাব দিল, ‘নীচের ঘরে।’

রুহিতন আবার তাকাল খেলু চৌধুরী আর অন্যান্যদের দিকে। কী করবে রুহিতন? সে কি প্রতিবাদ করবে? ঝাঁপিয়ে পড়বে কয়েদি দুটোর (জেলের পরিভাষায় ‘ফালতু’) ওপর? একলা? একলা কি প্রতিবাদ করা যায়? বন্ধুরা যেখানে নিস্ক্রিয়, নিস্পৃহ, অনিচ্ছুক? রুহিতন কুরমির জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা! তার প্রতি সকলের দৃষ্টির ভঙ্গি বদলিয়ে গিয়েছে। সেই উষ্ণ অভিনন্দন, উচ্ছাসের উত্তেজনা আর নেই। বন্ধুদের চোখ-মুখ থেকে ঠিক কখন সেই হাসি মুছে গেল, রুহিতন মনে করতে পারছে না। কিন্তু সে খেয়াল করতে পারছে, কখন এক সময় থেকে যেন বন্ধুদের চোখ মুখ বদলিয়ে যাচ্ছিল।

এই ওয়ার্ডের প্রথম দিনের সকালেই কি? রুহিতন যখন বুকের ওপর দু হাত চেপে, নিচু আর্তস্বরে বলে উঠেছিল, ‘অই ওহে দিবাবাবু’…সে কঁদেনি, চোখ থেকে জল পড়েনি। কিন্তু প্রাণটা হাহাকার করে উঠেছিল। জীবনে আর কখনও কারও জন্য এমন হাহাকার করে ওঠেনি। সে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারেনি। সে কোনও কথা বলবার আগে, খেলু চৌধুরী কেমন যেন নির্বিকার স্বরে বলেছিল, ‘দিবা বাগচির জন্য দুঃখ করে আর কী হবে?’

‘দুঃখ মনে আসে খেলুবাবু। করতে লাগে না।’ রুহিতন বলেছিল।

খেলু চৌধুরী কেমন রাগ রাগ গলায় বলেছিল, ‘অমন দুঃখেই বা লাভ কী রুহিতন ভাই? দিবা বাগচি ছিল দীনু বাগচির ছেলে, তুমি জানতে।’

রুহিতন অবুঝ অবাক চোখে তাকিয়েছিল। খেলু চৌধুরীর চোখে যেন রাগ দপদপ করছিল। আরও অনেক জোড়া চোখের দৃষ্টিও সেই রকম, তার দিকে তাকিয়ে ছিল। রুহিতনের মনে সন্দেহ জেগেছিল, তার বহুকালের জগৎটার কোথায় কী সব অদল বদল হয়ে গিয়েছে। না হলে, দিবাবাবু দীনু বাগচির ছেলে, এ সম্পর্কের কথা নতুন করে শুনতে হবে কেন? দিবাবাবুর নাম মুখে নিতে, খেলুবাবুর গলায় এমন গরগরানি! দুই জনে না বড় বন্ধু ছিল? দিবাবাবু নেতা ছিল না?

খেলু চৌধুরীর বদলে, অন্য একজন বলে উঠেছিল, ‘কমরেড রুহিতন কুরমি, দিবাকর বাগচি ছিল একজন জঘন্য জোতদারের ছেলে। তার ছেলেমেয়ে বউ বিস্তর টাকার মালিক, তারা সুখেই আছে। দিবাকর বাগচি সর্বহারাদের নেতৃত্ব করত। এখন বলুন তো, আপনার ছেলেমেয়েরা কোন সুখে আছে? তারা কোন জোতদারের ধনে আছে?’

এমন কথা শুনেও রুহিতনের মন বিরূপ হয়নি। তার বিস্ময়ও ঘোচেনি। বলেছিল, ‘কিন্তু ভাই সাথীরা, দিবাবাবু যে মস্ত বড় জোতের মালিকের ব্যাটা, সেই কথা তো তাবৎ সংসার জানত। কিন্তু বাপের জোতের তাবৎ জমিন তো সে কোরফা রায়ত আর আধিয়ারদের বিলি বাঁটোয়ারা করে দিছিল! দ্যায় নাই?’

‘কার জমি জোত, কে বিলি বাঁটোয়ারা করেছে?’ একজন তরুণ বিদ্রুপ করে বলে উঠেছিল, ‘জোত জমি দীনু বাগচির। দিবাবাবু কি আধিয়ারদের লেখাপড়া করে দিয়ে গেছলো? তার বাপ তাকে সে হক করে দিয়েছিল? মুখের কথায় অমন সারা পৃথিবীটাই সর্বহারাদের দান করা যায়।’

রুহিতন অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কমরেড, লেখাপড়া করে বিলি বাঁটোয়ারা কেমন করে হয়? দিবাবু মুখে বলছিল, ত তার বাপের জোত তো লড়াই করে দখল নিছিল আধিয়াররা!’

তরুণ বন্দি রেগে উঠে বলেছিল, ‘আর যেমনি লড়াইয়ে হেরে সরে পড়তে হল, অমনি আবার জোঁতের মালিক জোতদার। আধিয়ারদের পিটিয়ে মারা হয়েছে, আর দীনু বাগচি সুখে আছে।’

‘সে দোষ কি দিবাবুর ?’ রুহিতন বলেছিল, ‘মরার পরে এখন তার বিচার করেন কেন?’

খেলু চৌধুরী বলেছিল, ‘তখন বিচারের কথা ওঠেনি, তাই বিচার হয়নি। আমাদের দলের ধর্ম এই, মরার পরেও কেউ রেহাই পায় না।’

রুহিতনের তথাপি হতভম্ব ভাব কাটেনি। বলেছিল, ‘খেলুবাবু, দিবাবাবুকে তুমি নেতা মেনেছিলে।’

‘মেনেছিলাম।’ খেলু চৌধুরী যেন কেঁজে বলেছিল, ‘এখন আর মানি না। সে নিজে ছিল শ্রেণীশত্রু, তাই শেষ পর্যন্ত সে পার্টিকে ভুল পথে চালিয়েছিল।’

রুহিতন মনে মনে বিভ্রান্ত হলেও স্থির বুঝেছিল তাদের সেই জগতের নানান জায়গায় ভাঙচুর ফাটল ধরেছে। নিজেদের মধ্যে ঘৃণা আর রাগ, সেই প্রথম জানতে পেরেছিল। বড় যন্ত্রণা বোধ হয়েছিল তার। শ্রেণীশত্রু কাকে বলে ? কাদের ? খেলুবাবুর বাবার তো অনেক চা-বাগানের মোটা শেয়ার আছে। এই সব তরুণ কমরেডদের কার কী আছে, সে জানে না। পার্টিকে ভুল পথে চালানো ? আগে কেউ বুঝতে পারেনি? নাকি দিবাবাবুর নেতৃত্ব সফল হয়নি বলে, আজ তার মড়া নিয়ে টানাটানি? কিন্তু প্রাণ থাকতে সে দিবা বাগচিকে শ্রেণীশত্রু ভাবতে পারবে না। সে তার ফ্যাসফেসে করুণ স্বরে বলেছিল, ‘কিন্তু খেলুবাবু, দিবাবাবু, আমাদের নেতা ছিল। তার জন্য আমার মন চিরকাল পুড়বে হে, মিথ্যা বলব না।’

খেলু চৌধুরী এক মুহুর্ত চুপ করে ছিল। সকলের দিকে তাকিয়েছিল। একটু হেসে বলেছিল, ‘তোমাকে দোষ দেব না রুহিতন ভাই, তোমার দোষ নেই। আস্তে আস্তে তুমি বুঝতে পারবে। সময়ে সবই বুঝতে পারবে।’

খেলু চৌধুরীর সব কথা রুহিতনের কানে যায়নি। দিবা বাগচির মুখই তার চোখের সামনে ভাসছিল। দিবা বাগচির ধরা পড়া আর মৃত্যু-সংবাদ আর সব কিছুই তার মন থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকেই কি তার প্রতি সকলের চোখমুখের ভাবভঙ্গি বদলিয়ে যাচ্ছিল?

রুহিতন প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, ‘কিন্তু আমি কোথায় যাব? কোনও সংবাদ তো পাই নাই?’

খেলু চৌধুরী রুহিতনের দিকে তাকিয়ে এইবার মুখ খুলল, ‘তুমি নীচের ওয়ার্ডে থাকবে এখন থেকে। ডাক্তার বলেছে, তোমার আলাদা থাকা দরকার।’

‘একলা?’ রুহিতনের স্বরে ক্ষুব্ধতার মধ্যেও একটা ব্যাকুল বিষন্নতার সুর বেজে উঠল।

খেলু চৌধুরী বলল, ‘হ্যাঁ, একলা।’

‘কেন?’ রুহিতন এক রকম স্বরেই জিজ্ঞাসা করল।

খেল চৌধুরীর ঠোঁট ছুরির মতো বেঁকে উঠল। বলল, ‘তুমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ না নাকি? তোমার হাত পায়ের গোড়ায়, মুখে লাল চাকা চাকা দাগ কীসের? নিজের নাক মুখ দেখে বোঝ না? কিন্তু এর জন্য আমি তোমার দোষ দিই না।’

দোষ? রুহিতন মনে মনে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে। তার হাতে, পায়ে মুখে শুকনো ঘায়ের কথা সে জানে। তার লাল দগদগে চোখের পাতা, নাকের ডগা ফুলে ওঠা, মাঝখানটা বসে যাওয়া, মুখের চামড়া আস্তে আস্তে মোটা হয়ে ওঠার কথা সে জানে। হাত পায়ের আঙুলের ডগাগুলোও কেমন লাল আর ক্ষয় ক্ষয়া। যে-জেল থেকে তাকে এই জেলে আনা হয়েছে, সেই জেলের ডাক্তার তেলের মতো যে মলম দিয়েছিল, তা-ই সে ব্যবহার করে। সে জানে, শরীর তার ভাল নেই। প্রায়ই গা গরম হয়। গলার স্বর বসে গিয়েছে। কানে ভাল শুনতে পায় না। নাক দিয়ে প্রায়ই অজান্তে সর্দি গড়িয়ে পড়ে। হাতের আঙুলগুলো সহজে সোজা হতে চায় না, বাঁকতেও চায় না ।কেবল ডগাগুলো বেঁকে শক্ত হয়ে থাকে। ভাল্লুকের লোম ওঠা থাবার মতো দেখায়। কিন্তু দোষ কীসের? বন্ধুদের কাছ থেকে চলেই বা যেতে হবে কেন? এই জেলের ডাক্তার তাকে দেখেনি, কিছু বলেওনি।

রুহিতন অবাক স্বরে বলল, ‘খেলুবাবু, আমি কোনও দোষ করি নাই। দোষ দেবেই বা কেন?’

‘তুমি তো আর চিরকাল এই রুহিতন কুরমি ছিলে না। সেইজন্য তোমাকে দোষ দিই না।’ খেলু চৌধুরী বলল, ‘বাপ ঠাকুর্দার রোগ পেয়েছ, না নিজেই বাধিয়েছ, তা তুমিই জানো। মোহন ছেত্রীর ছেলে বড়কা ছেত্রীর সঙ্গে এক সময়ে অনেক মজা ফুর্তি করেছ! মেলায় মেলায় রং পাঁচালি মানপাঁচালি গান শুনেছ, জুয়া খেলেছ। খেল নাই?’

‘খেলেছি।’ রুহিতন খলিত অবাক স্বরে স্বীকার করে।

খেলু চৌধুরী হেসে বলল, ‘মনে করে দেখ, তখন আরও কী কী ফুর্তি করেছ। মদ পচুই হাঁড়িয়া গিলেছ, আর বড়কা ছেত্রীর টাকায় লুবু খাঁকড়ির (নরম বা মেয়ে কাঁকড়া) সঙ্গ করেছ। এখন সেই খাঁকড়িরা সব রক্তে ফুটে উঠেছে।’

‘অই খেলুবাবু, তুমি কাকে কী বলো হে?’ রুহিতনের স্বরে চিৎকার নেই, গর্জন নেই। বুকের ওপর দায়ের কোপ লেগে সে যেন আর্তনাদ করে ওঠে, ‘আমি তাদের দাগ?’ বলে দু হাত নিজের চোখের সামনে মেলে ধরল। মনে হল, এ সবই যেন তার প্রাক্তন জীবনের বোঙার অলৌকিকতা! খেলুবাবুর এই সব কথা। তার শরীরের এই ব্যাধি। তার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল টেঁপড়ির মুখ। চুনীলাল মৌজার এক মাঝারি জোতের মালিক শুকু গোঙানির মেয়ে চেঁপড়ি। তার ষোলো বছর বয়সের বন্ধুনী ছিল।

কেন টেঁপড়ি তার বন্ধুনী হয়েছিল? মনে নেই। তার ষোলো বছর বয়সে শুক পোঙানির জমি চাষ করত রুহিতন। তেঁপড়ির বয়স তখন কত ? রুহিতনের সমবয়সি, অথবা কিছু কম। তেঁপড়ির তখন বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। সেই বয়সে না হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। টেঁপড়ি কেন চোখের তারা ঘোরাত, ঠোঁট মচকিয়ে হাসত, মাজা দুলিয়ে ফান ফান চলে যেত রুহিতনের গায়ে বাতাস লাগিয়ে, বুঝে উঠতে পারত না। বুঝে উঠতে পারলেও সাহসে কুলাত না। জোতের মালিকের বেটি! অথচ ভাল লাগত। শরীরে রক্ত টগবগিয়ে ফুটত। টেঁপড়ির বুকের দোলায় তার বুকে বাঁধা শাড়ির বন্ধন খুলে যেত। রুহিতনের বুকের ধনুক টান টান হয়ে উঠত। টেঁপড়ির সব ভাল ছিল। চলন বলন দলদলি, মিষ্টি হাসি। কিন্তু গায়ে দাদের ঘা ছিল। না থাকবার কোনও কারণ ছিল না। শুকু পোঙানির ঘরের সকলের গায়ে দাদ ছিল। তার বলদের গায়েও ঘাও ছিল। বোধ হয় দাদেরই ঘা।

রুহিতন নিজের হাতের দিকে তাকাল। লাল ডুমো ডুমো দাগ কনুই থেকে এখানে সেখানে। হাতের পাঞ্জা লোম ওঠা ভাল্লুকের থাবার মতো, ডগাগুলো ক্ষয়া ক্ষয়া। এ সব কি টেঁপড়ির দাদের ঘায়ের দাগ? হ্যাঁ, টেঁপড়ির সঙ্গে সে জঙ্গলে গিয়ে শুয়েছিল। বড় সুখ হয়েছিল। দাদের ঘায়ের কথা মনে ছিল না। টেপড়ির গা থেকে, তার সারা গায়েও দাদ হয়েছিল। দাদের ঘা নেই, এমন ঘর কটা ছিল? মেলায় খাবারের থেকে দাদের মলম কম বিক্রি হত না। রুহিতন বেরুবাড়ির মেলা থেকেই দাদের মলম কিনেছিল। কিন্তু কেঁপড়ি টাকায় কেনা লুবু খাঁকড়ি ছিল না। বড়কা ছেত্রীর সঙ্গে মেলায় বাজারে ঘুরে, লুবু খাঁকড়িদের সঙ্গে শুয়ে তার এই ঘা হয়েছে?

খেলু চৌধুরী আবার বলল, ‘কিন্তু আমি তোমাকে দোষ দিই না রুহিতন। তোমার বাপ ঠাকুর্দা ছিল চা বাগানের কুলি। তুমি একজন ভুমিহীন—।’

‘চুপ! চুপ করো হে তুমি।’ রুহিতন তার বিকৃত স্বরে, দোতলার ওয়ার্ড ফাটিয়ে গর্জন করে উঠল। তার দগদগে চোখের পাতা টকটকে লাল। তার সারা গায়ে লালের আভা দপদপ করে উঠল।

খেলু চৌধুরী আর অন্যান্য বন্দিরা হতবাক স্তব্ধ। অপ্রত্যাশিত গর্জনে, তাদের চোখে বিস্মিত ত্রাস ও জিজ্ঞাসা। রুহিতন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল। কিন্তু তার দগদগে রক্তাভ দৃষ্টি এখন সিঁড়ির দিকে। তথাপি খেলু চৌধুরী এবং অন্যান্য বন্দিরা যেন আক্রমণের আশঙ্কায় শক্ত হয়ে উঠল।

রুহিতন এগিয়ে আসতে আসতে ঘরের মাঝখানে এক বার দাঁড়াল। এক বার তাকাল খেলু চৌধুরীর দিকে। তারপরে আবার সিড়ির দিকে। কয়েদিরা ইতিমধ্যে তার লোহার খাটিয়া সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছে। রুহিতন এগিয়ে গেল সিঁড়ির মুখে। ডান হাত দেওয়ালে স্পর্শ করে, মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে নীচে নামতে লাগল। ছেলেবেলায় শোনা মায়ের একটা গান বারে বারে মনে পড়তে লাগল। মায়ের গানের কলি সে নিজের মনে আওড়াতে লাগল;

উত্তরে উনাইল ম্যাঘ

পচ্ছিমে বরষিল গ!

ভিজি গেল গাবানি কাপড়।

এই রকম কি জীবন? উত্তরে মেঘ ঘনায়। অথচ বর্ষায় পশ্চিমে ? আর শখের রঙিন কাপড় ভিজে যায় ? আগুন জ্বলছে তার বুকের মধ্যে। রাগের থেকে এ আগুনে বুকের পোড়ানি বেশি। এই আগুনে বুকের ঝোরায় জল ঝরে। তার নাক থেকে গাঢ় রস গড়িয়ে পড়ে। সে হাতের পিঠ দিয়ে মুছে নিল। সিঁড়ির নীচে থমকিয়ে দাঁড়াল।

নীচের ওয়ার্ডে মাঠের দিকে একটা জানালা বরাবর তার খাটিয়া পাতা হয়েছে। একজন ওয়ার্ডার তার খাটিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। কয়েদি দুজন দাঁড়িয়েছিল কাছেই। সবাই রুহিতনের দিকে তাকাল। রুহিতন এখনও তার মায়ের মুখ দেখতে পাচ্ছে। মায়ের গলায় সেই গান শুনতে পাচ্ছে ‘উত্তরে উনাইল ম্যাঘ, পচ্ছিমে বরষিল গ!’…

১১

‘ওপর থেকে এর বাকসোটা এনে খাটের কাছে রাখো।’ ওয়ার্ডার কয়েদিদের হুকুম করল।

কয়েদিরা সিঁড়ির দিকে তাকাল, সিঁড়ির নীচে তখনও রুহিতন দাঁড়িয়ে। কয়েদিরা ভয় ভয় অবাক চোখে তার দিকে তাকাল। রুহিতন এক বার ওপরের দিকে তাকাতে গিয়েও ঘাড় তুলল না। সিঁড়ির নীচে অনেকগুলো ছায়া পড়তে দেখেই সে বুঝতে পেরেছে, খেলুবাবুরা সবাই রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে তাকে দেখছে।

লুবু খাঁকড়ি! বড়কা ছেত্রীর টাকায় ? মেলায় বাজারে ফুর্তি! কথাগুলো আবার রুহিতনের মনে পড়ল। টেপড়ির পরে মঙ্গলা। বাবা নিজে মঙ্গলার বাপকে পণ দিয়ে রুহিতনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের পরে মঙ্গলাকেও তেঁপড়ির কথা বলেছিল। এমনি কি আর বলেছিল? অনেকখানি ডেয়ং খেয়ে তার সুখের কথা বলেছিল। খোয়ারি কাটবার পরে মঙ্গলার কোপ টের পেয়েছিল। মঙ্গলাকে ছাড়া আর কোন মেয়েকে আগে জানত সে? হ্যাঁ, টেপড়িকে কখনও ভোলেনি। মঙ্গলার সঙ্গে তার বিয়ের পর থেকেই টেঁপড়িকে আর দেখেনি। টেঁপড়ি ছিল রাজবংশিদের মেয়ে। মাহাতো কুরমি সাঁওতালদের সঙ্গে তাদের বিয়ে হতে পারে না। কিন্তু ও যদি মাহাতো বা সাঁওতালদের মেয়ে হত, তা হলেও রুহিতনের সঙ্গে বিয়ে হতে পারত। সে বিয়ে হত বাহা সাম্হা। বিধবা অথবা বিবাহিতা মেয়ে স্বামী ছেড়ে এসে আবার একজনকে বিয়ে করলে, সেই বিয়েকে বাহা সাম্হা বলে। রুহিতন তার মায়ের কাছে শুনেছে।

রাজবংশি ক্ষত্রিয়দের বিয়ের নিয়মকানুন জানত না সে। টেঁপড়ি কখনও তাকে বিয়ের কথা বলেনি। কেবল ফান ফান দৌড় দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে যেতে চাইত। তা ছাড়া ওর বাবা ছিল একজন ছোট জোতদার। রুহিতন ছিল তার কৃষি মজুর। কিন্তু টেঁপড়ি যদি মাহাতো কুরমি সাঁওতালদের মেয়ে হত, তার যদি বিয়ে না হত?

গভীর জঙ্গলের নিবিড় ছায়ায়, উদাস হাওয়ায় টেঁপড়ির পাশে শুয়ে যদি সে জিজ্ঞেস করত কেন ও শ্বশুর বাড়ি যেতে চায় না, তা হলে ও একটি গান গুনগুনিয়ে উঠত:

‘শোন বাহে দেওয়ানীর ছাওয়া।

মুই কমবকতি কপাল পোড়া ॥

শ্বশুর হয়্যা মাইর খাওয়াইলেন মোকে।

শ্বশুর হয়্যা দিলেন কন্যা

মাইরলে গোলাম দুপুরবেলা

মাইরলে গোলাম মাটিত ফ্যালেয়া ॥

সেই গুনগুনানি শুনলে মনে হত, টেঁপড়ি বনের বাতাসে গলা মিলিয়ে কাঁদছে।

রুহিতন কোনও দিকে না তাকিয়ে ওয়ার্ডের বাইরে এসে দাঁড়াল। যে সব বন্দিরা ইতিমধ্যেই নেমে এসেছিল, তারা তার দিকে তাকাল। রুহিতন কারোর দিকে তাকাল না। সে গাছের ছায়ার দিকে এগিয়ে গেল। এই মুহুর্তে সে স্থান-কাল-পাত্র বিস্মৃত। ভাবল, টেঁপড়ির সঙ্গে তা হলে তার নির বোলোক বাল্লা হত। এ সবই তার মায়ের কাছে শোনা। নির বোলোক বাল্লা বলে সেই বিয়েকে, যে বিয়েতে মেয়ে নিজেই বরের বাড়িতে জোর করে এসে পড়ে। টেঁপড়ি তো সেই রকম ছিল, যে ছেলের ওপর জোর খাটাবে। সেই জোরের মধ্যে টেপড়ির প্রাণের মধু ছিল। কিন্ত পোশ্পত করমি তখনও বেঁচে ছিল। শুকু পোঙানির জোতে দু দিন গিয়ে, টেঁপড়িকে দেখে ব্যাটার মতিগতি বুঝেছিল। বছর না ঘুরতেই রুহিতনের বিয়ে দিয়েছিল। কিরিন বাহা বাপ্লা। সোজাসুজি বিয়ে। দেখে শুনে মানানসই মেয়ে এনেছিল। মেয়ের বাপকে ধার করে পণ দিয়েছিল। আর রুহিতনকে শুকু পোঙানির জোতের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল।

রুহিতন কি তবু টেঁপড়িকে ভুলতে পেরেছিল? কিছুদিনের জন্য একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। এইরকম মানুষের মন। মঙ্গলাকে পেয়ে সব ভুলেছিল। টেঁপড়ি এক রকম। মঙ্গলা আর এক রকম। মঙ্গলার বয়সও কিছু কম ছিল। সাদাসিধে সরল মাহাতো মেয়ে। শরীরে সেই সবে মাত্র বেড়ে ওঠার লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছিল। টেঁপড়ির মতো তার চোখের তারা ঘুরত না। মন ভোলানো হাসি শেখেনি। রুহিতন হাত ধরে টানলে ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যেত। গায়ে দাদের গা ছিল না। বরং কালো । রংটি যেন তেল চুকচুকে ছিল, এমন মিহি। চাঁদমণি মায়ের কুণ্ডের গভীর কালো জলের মতো ছিল চোখ দুটি।

হ্যাঁ, ঝোরার জলের ধারা যেখানে গভীর কূপের মতো কুণ্ডকে ভরিয়ে তোলে, তখন তার নাম হয়ে যায় মণি। সেই কুণ্ড তখন হয়ে ওঠে মাতৃকূপের প্রতীক। আর সেই প্রতীককে মানুষ পূজা করে। জলের প্রাচুর্যের প্রার্থনায়। আসলে, তরাইয়ের পানীয় জলের একটি প্রাকৃতিক আধার। গভীর জল সেখানে বারো মাস। মণি তো স্ত্রী ইন্দ্রিয়ের আর এক নাম। রুহিতনের মনে হত মঙ্গলার সেই কুণ্ডের গভীর কালো জলের মতো চোখে তার সতেরো বছরের জীবনটা ডুবে গিয়েছে। কিন্তু ডুবে কি যায়? এক বছর পরে তবে সে কেন আবার কেঁপড়ির খোঁজে গিয়েছিল? বাঘের ফেলে আসা শিকারের মতো নাকি? বাঘ যে-শিকারের কাছে আবার না গিয়ে পারে না?

না, রুহিতন টেঁপড়ির দেখা আর পায়নি। তারপরের বাকি জীবনটা শুধুই মঙ্গলা। একটা বউ। এক আধারেই সে কত রকম। একের মধ্যেই অনেক। শুধু টেঁপড়ি কেন। এক মঙ্গলার মধ্যে সংসারের যাবৎ স্ত্রীলোকের দেখা মিলেছিল। সেটাও জীবনের এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু লুবু খাকড়ি? মেলায় বাজারে ঘুরে বড়কা ছেত্রীর পয়সায় বেশ্যার সঙ্গ করে এই রোগ সে শরীরে এনেছে? ভাবতে ভাবতেই দু হাত সে চোখের সামনে তুলে ধরল। তারপরেই ঘা দগদগে লাল টকটকে চোখে পিছন ফিরে দোতলার ওয়ার্ডের দিকে তাকাল। দাঁতে দাঁত পিষে তার চোয়াল কেঁপে উঠল। খেলু চৌধুরীকে সে দোতলার ওয়ার্ডের জানলায় দেখতে পেল না।

রুহিতনের প্রাণে রাগের থেকেও যন্ত্রণা বেশি। এত কালের পুরনো লোকটা, একটা নেতা লোক, এমন করে দাগা দেয়? এত কালের চেনা সব মিথ্যা? লুবু খাঁকড়ি? বড়কা ছেত্রীর পয়সায় ? হা ! অই মা, তোর কথাই ঠিক! উত্তরে উনাইল ম্যাঘ, পচ্ছিমে ববলি গ..।

সে একটা গাছের গায়ে পিঠের ভার চেপে দাঁড়াল। তার সামনে এখন কেউ নেই। একটা ভারী মোটর গাড়ির গর্জন যেন তার খুব কাছ দিয়ে শব্দ করে চলে যাচ্ছে। সে চোখ বুজল। আর তবু চোখের সামনে ভেসে উঠল রক্তহীন কাঁচা মাংসের রং। তার ওপরে নড়ে চড়ে উঠল সেই মন্থরগতি মেটে রঙের সাপটা, যার গায়ে লাল চাকা চাকা দাগ।

রুহিতন চমকিয়ে উঠে চোখ মেলে তাকাল। মনে হল সেই সাপটাই যেন তার শরীরের ভিতরে নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। এইজন্যই কি আজকাল চোখ বুজলে সে সেই কুৎসিত সাপটাকে দেখতে পায় ? তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বন্দুক হাতে বড়কার মূর্তি।

‘আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?’ দড়ি বাঁধা লাঠি হাতে ঝুলিয়ে একজন বাঙালি ওয়ার্ডার এসে সামনে দাঁড়াল। লোকটার চোখের দৃষ্টিতে কেমন গায়ে কাঁটা দেওয়া ভাব। কিন্তু মুখে হাসি! বলল, এখানে গান্ধীজি প্রার্থনা করতেন, যখন এই জেলে ছিলেন।

এইটা সেই জায়গা। কিন্তু সেই মানুষটির মতো কোনও প্রার্থনা রুহিতনের জানা নেই। প্রার্থনা করলে কী হয়। পরাধীনরা স্বাধীন হয়? ভূমিহীনে ভূমি পায়? জন- মজুরে রাজ্য চালায়? প্রাণের এই যে যন্ত্রণা, দুঃখে তাপমানে পুড়ে যাচ্ছে, এর কি উপশম হয়? রুহিতন ওয়ার্ডারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে, পশ্চিমের দেওয়ালের ধারে, ছায়া ঘেরা জমির দিকে পা বাড়াল। ওয়ার্ডার বলে উঠল, ‘আসুন, আপনাকে আমি ডাকতে এসেছি। ডাক্তারবাবু আপনাকে দেখতে এসেছেন, নীচের ওয়ার্ডে বসে আছেন।’

রুহিতন থমকে দাঁড়াল। পিছন ফিরে ওয়ার্ডারের মুখের দিকে দেখে ওয়ার্ডের দিকে এগিয়ে গেল। খেলু চৌধুরীরাই তা হলে ডাক্তার পাঠাতে বলেছে?

১২

রুহিতন ওয়ার্ডের ভিতরে পা দিয়ে দেখল, শার্ট-প্যান্টপরা অল্পবয়সি একটি কালো ছোটখাটো লোক, জানালার সামনে মাঠের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। লোহার খাটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন কয়েদি। হাসপাতালের বয়, হাতে একটা ব্যাগ। সে রুহিতনের দিকে এক বার দেখেই খাটের কাছ থেকে সরে গিয়ে জানালার সামনে লোকটির দিকে তাকাল। পিছন থেকে বাঙালি ওয়ার্ডার বলে উঠল, ‘স্যার, এই যে ডেকে এনেছি।’

জানালার সামনে শার্ট-প্যান্টপরা লোকটি তাড়াতাড়ি ফিরে দাঁড়াল। প্রথমেই রুহিতনের দিকে তাকাল। দু পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম রুহিতন কুরমি?’

রুহিতন মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল। স্পষ্ট শুনতে না পেলেও সে লোকটির ঠোঁট নড়া দেখেই বুঝে নিয়েছিল। লোকটির অল্পবয়সি চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক খেলে গেল। শুধু বিস্ময় না, যেন এক ধরনের সন্ত্র বা আর কিছু তার চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ল। ওর কথার স্বরেও যেন সেই ভাব, বলল, ‘আমি এখানকার ডাক্তার। আপনাকে দেখতে এসেছি।’

এই জেলে প্রথম দিন সকালে জেল সুপারের সঙ্গে যে ডাক্তার রুহিতনকে দেখতে এসেছিল এ সে ডাক্তার না। এর বয়স অনেক কম। আকারেও ছোটখাটো বলে খুব ছেলেমানুষ দেখাচ্ছে। ডাক্তার বলে মনেই হয় না। ও আবার বলল, ‘আসুন, এই জানালার দিকে এগিয়ে এসে খাটে বসুন। এদিকে আলো বেশি আছে। দেখতে সুবিধা হবে।’

রুহিতন তার বাঁয়ে সিঁড়ির দিকে এক বার দেখল। তারপর খাটের সামনে জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে বসল। ডাক্তার তার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। চোখের নজর বেশ চোখা করে খুব মনোযোগ দিয়ে রুহিতনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। কয়েক মিনিট কোনও কথা না বলে ও শুধু রুহিতনের সমস্ত শরীরটা যেন চোখ দিয়ে মেপে মেপে দেখতে লাগল। কখনও ওর ভুরু কুঁচকে উঠল। কখনও বা মুখের চামড়া টান টান হয়ে খুব গম্ভীর দেখাল! এমনকী জুতোর গোড়ালিতে ডিঙি দিয়ে রুহিতনের মাথাও দেখল।

রুহিতনের মনটা শক্ত হয়ে উঠল। এই ছোকরা ডাক্তারও নিশ্চয় খেলু চৌধুরীর মতো লুবু খাঁকড়ির কথা বলবে?

‘রোগ তো বেশ পুরনো। অনেক দিন ধরেই ভুগছেন, না?’ ডাক্তার জিজ্ঞেস করল। রুহিতন ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘আশ্চর্য! ডাক্তার বলল, ‘এর আগে যে জেলে ছিলেন, সেখানকার ডাক্তার আপনাকে দেখেনি?’

রুহিতন খানিকটা নির্বিকার স্বরে বলল, ‘দেখেছিল। এই তো হাতে পায়ে সেই ডাক্তারের দেওয়া মলম লাগিয়েছি।’

ডাক্তারের তরুণ মুখ যেন রাগে আর বিরক্তিতে ভরে উঠল। ও হাত তুলে আঙুলের ইশারায় কয়েদি হসপিটাল বয়কে ডাকল। সে কাছে আসতে ওর হাত থেকে ব্যাগ নিল। ব্যাগের মুখ খুলে ভিতর থেকে বের করল লম্বা পেরেকের মতো ঝকঝকে এক টুকরো লোহা আর তুলো। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার শরীর থেকে রক্ত নিয়ে কখনও পরীক্ষা করা হয়েছে?’

রুহিতন ঘাড় নেড়ে জানাল, ‘না।’

‘আপনার এই হাতের আঙুলগুলো এ রকম ক্ষয়ে যাচ্ছে কত দিন আগে থেকে?’ ডাক্তার জিজ্ঞেস করল।

রুহিতন লোমহীন ভুরু কুঁচকে মনে করবার চেষ্টা করল। মনে করতে না পেরে অন্যমনস্ক হয়ে উঠল। ডাক্তার সেই ছুঁচের চেয়ে মোটা আর লম্বা লোহার টুকরো দিয়ে রুহিতনের হাতের তালু আর আঙুলে স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করল, ‘আঙুলগুলো এ রকম বেঁকেই বা যাচ্ছে কবে থেকে, মনে করতে পারেন?’

রুহিতন ঘাড় নেড়ে জানাল ‘না।’

‘আশ্চর্য। ডাক্তার ছেলেটি বলে উঠল, ‘কোনও কষ্ট বা জ্বালা যন্ত্রণা কিছু হয় না?’

রুহিতন ঘাড় নেড়ে বলল, ‘জালা যন্ত্রণা তেমন তো বুঝি না। মাঝে মাঝে জ্বরের মতো লাগে।’

‘জ্বরের মতো লাগে? জ্বর না?’ ডাক্তার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

রুহিন বলল, ‘হতে পারে।’

‘জ্বর তো আপনার এখনও রয়েছে।’ বলে ডাক্তার তার পায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর পায়ে এ রকম দু-তিনটে নখ উড়ে গেছে, ব্যথা লাগে না?’

রুহিতন মাথা নেড়ে বলল,’না।’

ডাক্তার যেন কয়েক মুহুর্ত অবাক স্তব্ধ হয়ে রইল। রুহিতন নির্বিকারভাবে বলল, কী করে কখন হোঁচট খেয়ে নখগুলান উঠে গেছে, টেরই পাইনি।’

‘টেরই পান নি?’ ডাক্তার সেই লোহার টুকরো দিয়ে হাতের আঙুলে টোকা মেরে জিজ্ঞেস করল, ‘টের পাচ্ছেন?’

রুহিতন যেন কিছুটা অবাক স্বরে বলল ‘আগুন গরম ভাতে হাত দিয়েই কিছু টের পাই না, এতে আর আমার কী হবে?’

ডাক্তার যেন বিস্ময়ে চমকিয়ে উঠে বলল, ‘আগুন গরম ভাত আঙুলে টের পান না?।ঠাণ্ডা জলে হাত দিলে টের পান?’

রুহিতন মাথা নেড়ে জানল ‘না।’

‘ওহ তা হলে তো ব্যাপার অনেক দূর গড়িয়েছে।’ ডাক্তার বলল। হাতের লোহার ডগা দিয়ে, রুহিতনের হাতের আঙুলে জোরে বিঁধিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘টের পাচ্ছেন?

রুহিতন মাথা নাড়ল, পাচ্ছে না। ডাক্তার বলল, ‘চোখ বুজে থাকুন একটু। আর আমি যা জিজ্ঞেস করব, তার জবাব দিন।’

রুহিতন সন্দিগ্ধ চোখে এক বার ডাক্তারের দিকে দেখল। তারপরে চোখ বুজল। ডাক্তার লোহার ডগা দিয়ে তার হাতে আর মুখের লাল চাকা চাকা ডুমো অংশে খোঁচা দিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথাও লাগছে? কিছু টের পাচ্ছেন?’

রুহিতন মাথা নেড়ে জানাল, ‘না।’

‘ফুল অ্যানেসথেসিয়া!’ ডাক্তার বিড়বিড় করে বলল।

রুহিতন চোখ মেলে তাকাল। ডাক্তার তার দিকেই তাকিয়েছিল। জিজ্ঞেস করল, এই যে আপনার নাক থেকে শিক্নি গড়াচ্ছে, টের পাচ্ছেন না?’

রুহিন বলল, ‘সবসময় পাই না।’ সে হাতের পিছন দিয়ে নাক মুছতে উদ্যত হল।

ডাক্তার তার আগেই তুলো দিয়ে নাকের গড়ানো রস মুছে নিল। ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে, তার মধ্যে তুলোটুকু জড়িয়ে রেখে দিল। রুহিতন অবাক জিজ্ঞাসু চোখে ঘটনাটা দেখল। আর ডাক্তার ছেলেটি যেন বিচলিত মুখে, বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, ‘কোনও সন্দেহ নেই, আর কোনও সন্দেহ নেই।‘

এই সময়ে এক জন কয়েদি খাটের কাছে এসে দাঁড়াল। তার এক হাতে অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে মুড়ি ছোলা আর কলা। অন্য হাতে এক গেলাস চা। ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, ‘কী চাই?’

কয়েদি রুহিতনকে দেখিয়ে হিন্দিতে বলল, ‘নাস্তা লে আয়া হোজোর।’

রুহিতন ফিরে তাকাল। ডাক্তার বলল, ‘নিন, আপনার জলখাবার এসেছে, খেয়ে নিন।’

রুহিতন হাত বাড়িয়ে বাটি আর গেলাস নিল। খোলা দরজা দিয়ে তার চোখে পড়ল, উঠোনের ওপারে রান্নার চালার ভিতরে খেলু চৌধুরীর মুখ। খেলু চৌধুরী আর অন্যান্য বন্দিরা, সকলেই চালার ভিতর থেকে এ দিকেই তাকিয়ে আছে। রুহিতন মুখ ফিরিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকাল। খাটের অদূরেই একটা পুরনো টেবিল রয়েছে। রুহিতন সরে গিয়ে বাটি গেলাস সেই টেবিলের ওপরে রাখল।

ডাক্তার বলল, ‘আপনার অসুখটা বেশ বেড়ে উঠেছে। কেন যে এত দিন আপনাকে দেখা হয়নি, জানি না। অনেক অনেক আগেই আপনাকে দেখা দরকার ছিল। ওষুধ দেওয়া দরকার ছিল। আপনার বাড়িতে এ অসুখ কারোর দেখেছেন? ছিল নাকি?’

রুহিতন জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘কখনও দেখি নাই।’

ডাক্তার আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার ঠাকুর্দা ঠাকুমা বাবা মা বউ বা আর কারোর?’

রুহিতন আবার জোরে মাথা নেড়ে গলা চড়িয়ে বলল, ‘না না।’

ডাক্তার কিছুটা হতবাক হয়ে থমকিয়ে গেল। রুহিতনের মুখের দিকে তাকাল, আস্তে বলল, ‘আপনি জলখাবার খেয়ে নিন।’

রুহিতন এক গাল মুড়ি পুরে চায়ের গেলাসে চুমুক দিল। ডাক্তার ব্যাগটা হসপিটাল বয় কয়েদির হাতে তুলে দিল। তাকে গম্ভীর আর বিচলিত দেখাচ্ছে। রুহিতন ফ্যাসফেসে স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কি খুব খারাপ ব্যামো?’

ডাক্তার একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, ‘রোগ ব্যামো সবই খারাপ। আবার ঠিকমতো চিকিৎসা করলেই ভাল হয়ে যায়। আপনার বেশ দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আপনাকে ওষুধ দেওয়া দরকার।’

‘কেন হয় এই ব্যামোটা?’ কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে রুহিতনের নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এল। তার চোখ দুটো বড় হয়ে উঠল। আর তার অজান্তেই মুড়ি চিবোতে চিবোতে মুখের দু পাশ থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

ডাক্তার বলল, ‘অনেক কারণেই হতে পারে। রোগটা তেমন মারাত্মক ছোঁয়াচে না। ছেলেমানুষদেরই বেশি ছোঁয়াচ লাগে। সেইজন্যেই আপনাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, আপনার বাবা মায়ের কারোর এই অসুখ ছিল কি না। ঠাকুর্দা ঠাকুরমার থাকলেও নাতির হতে পারে।’

‘কিন্তু আমার বাপ ঠাকুর্দার কারোর এ ব্যামো ছিল না।’ রুহিতন প্রায় ভাঙা ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল। এখনও গোরুর জাবর কাটার মতোই তার চোয়াল নড়ছে, আর চবিত মুড়ি তার দু ঠোঁটের কষ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে। সে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘খারাপ লোকেদের এই ব্যামো হয় নাকি?’

ডাক্তার অবাক অনুসন্ধিৎসু চোখে রুহিতনের দিকে দেখল। বলল, ‘খারাপ লোকেদের? কেন? না না, অনেক নিরীহ ভাল মানুষদেরই এ রোগ হয়।’

রুহিতনের আরক্ত অপলক চোখের দৃষ্টি ডাক্তারের ওপর। সে আবার মুখে মুড়ি পুরে দিল, আর চোয়াল নাড়তে লাগল। অনেকটা গোঙানো স্বরে ‘লুবু খাঁকড়ি-হুঁ-বাজারের বেশ্যাদের সঙ্গ করলে এই ব্যামো হয়?’

ডাক্তারের ভুরু কুঁচকে উঠল, তারপরেই হঠাৎ হেসে উঠল। বলল, ‘ওহ্, না না, আপনি যে অসুখের কথা বলছেন, এটা তা নয়। বুঝেছি, আপনি সেইজন্যই খারাপ লোকদের কথা বলছিলেন। না না, এটা সে রকমের কোনও অসুখ নয়। এটা চামড়ার ওপরের অসুখ, তবে শরীরের হাড় অবধি ঢুকে যায়, আর অসাড় করে দেয়। যে কোনও লোকেরই এ অসুখ করতে পারে। আর ছোঁয়াচে বলে ছোটদেরই তাড়াতাড়ি ধরে। বড়রা সাবধান হলে চট করে কিছু হয় না।’

‘কী ব্যামো এটা? রুহিতন যেন ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে জিজ্ঞেস করল। তার চোয়াল নড়া মুখ আর আরক্ত চোখ দুটো অনেক বড় দেখাচ্ছে।

ডাক্তার একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। রুহিতনের পা থেকে মাথা অবধি এক বার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে ঠিক, কিন্তু আপনি ভাল হয়ে যাবেন। এই অসুখটাকে বলে লেপ্রসি—মানে, কুষ্ঠ।’

রুহিতনের চোয়াল নড়া বন্ধ হয়ে গেল। তার মোটা ফাটা ফাটা চামড়ার মুখটা অনেকটা প্রাচীন রক্তবর্ণ মাকড়া পাথরের মতো দেখাচ্ছে। উচ্চারণ করল, ‘কুট!’

‘হ্যাঁ কুষ্ঠ।’ ডাক্তার বলল, ‘অসুখটাকে লোকে যত ভয় পায়, তেমন কিছু না। তবু লোকে ভয় পায়। আর আপনার দেরিও হয়ে গেছে। আপনাকে এখানে আর রাখা হবে না। বোধ হয় এ বেলাই অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে।’

রুহিতন যেন চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘অন্য জায়গায় ?’

‘হ্যাঁ জেলের মধ্যেই আলাদা জায়গায়।’ ডাক্তার বলল, ‘আর একটুও দেরি না করে আপনার চিকিৎসা শুরু করা দরকার। আমি গিয়ে ব্যবস্থা করছি। আপনি জলখাবার খেয়ে নিন। আমি চলি।’

তরুণ ডাক্তারের দৃষ্টিতে এবং গলার স্বরে এখনও এক ধরনের সম্ভ্রমের সুর। এখন কিছুটা করণ। সে হসপিটাল বয় কয়েদিকে ইশারা করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। রুহিতন ওর দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, ডাক্তার বাইরে যাওয়া মাত্রই খেলু চৌধুরী আর অন্যান্যরা ওকে ঘিরে ধরল। রুহিতন মুখ ফিরিয়ে নিল। জানালার বাইরে তার চোখের সামনে মাঠ। কিন্তু সে কিছুই দেখছে না। তার আরক্ত অপলক দুই চোখে এক অপরিসীম আহত বিস্মিত জিজ্ঞাসা। হাত দুটো সে সামনে তুলে ধরল। তার ঠোঁট নড়ে উঠল, আর নিঃশব্দে উচ্চারণ করল, ‘কুট কুট ! আমার।’…

১৩

বন্দি কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তদের বিচ্ছিন্ন জায়গায় রুহিতনের জন্য একটা আলাদা সেল নির্দিষ্ট ছিল। সেখানে স্থানান্তরিত করে তার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। বন্দি কুষ্ঠ রুগিদের সীমানার মধ্যে রুহিতনও চলাফেরা করে। কিন্তু কারোর সঙ্গে সে কথা বলতে পারে না। অন্যান্য কুষ্ঠ রুগি বন্দিরা সকলেই এমন জগতের লোক রুহিতন তাদের সঙ্গে বলবার মতো কথা খুঁজে পায় না। কিন্তু তারা কেউ কেউ তাকে বিদ্রুপ করে, পিছনে লাগে, নানা রকম কথা বলে ক্ষেপিয়ে তোলবার চেষ্টা করে। এমন সব কটু নোংরা কথাবার্তা বলে, শুনে রুহিতনের ভিতরে ফুসতে থাকে। একটাই মাত্র রক্ষা, সকলে এক রকম না। ভিন্ন জগতের মানুষ হয়েও তারা কেউ কেউ রুহিতনকে রীতিমতো খাতির করে। সম্মান দেখায়। ফলে তাদের নিজেদের মধ্যে দলাদলি আর বিরোধ লেগে যায়। এমনকী চিৎকার চেঁচামেচি করে মারামারি লাগিয়ে দেয়। তার জন্য পাগলা ঘণ্টি বেজে ওঠে না। ওয়ার্ডার আর মেট তাদের হাতের লাঠি আর কোমরের বেল্ট নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। উভয়পক্ষের গায়েই কিছু এলোপাথাড়ি প্রহারের পরে আবার সব থেমে যায়।

অবিশ্যি সময় এক আশ্চর্য বিধি। বাইরের সংসার বা এই জেলের মধ্যেও কোনও কিছুই এক রকম থাকে না। বদলায়। বদলিয়ে যেতে থাকে। রুহিতন তা ভালই জানে। এখানকার এক শ্রেণীর বন্দি, যারা তাকে প্রথম কয়েক মাস নানাভাবে ক্ষেপিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছে তাদের সেই ইচ্ছা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। তাকে বিরক্ত বা বিদ্রুপ করার মধ্যে ওরা তেমন উত্তেজনা আর খুঁজে পায় না।

সেই ডাক্তার ছেলেটিকে তার ভাল লাগে। জেলের ডাক্তার হলেও ওর কথাবার্তা ব্যবহার একটু অন্য রকমের। ও যেন নিতান্ত দায়ে পড়ে রুহিতনের চিকিৎসা করে না। অথবা শুধুই একটা কর্তব্য মানা, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সে রকম ঠিক না। ও যখন রুহিতনের দিকে তাকায়, তখন সবসময়েই ওর চোখে অগাধ কৌতুহল আর জিজ্ঞাসা যেন জেগে থাকে। আর সেই একটা সম্রমের ভাব। অথচ ও কখনও পদ আর গণ্ডির বাইরে একটা কথাও জিজ্ঞেস করে না। বলেও না। ও যখন বুঝতে পেরেছে রোগটা নিয়ে রুহিতনের মনে আর কোনও ভয় নেই তখন পরিষ্কার করেই বলে দিয়েছে, তার অসাড় হয়ে যাওয়া নাক কানের অংশ, হাত পায়ের আঙুলের কিছু অংশ আর কখনও ফিরে পাওয়া যাবে না। কপালে গালে চিবুকে পায়ের গোড়ালিতে আর হাতের কনুইয়ে কতগুলো চিরস্থায়ী দাগ থেকে যাবে। কিন্তু ও রুহিতনের মনে একটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এ বারে বারেই বলে, ‘আপনি মনে করে দেখুন, ছেলেবেলায় কোনও কুষ্ঠ রুগির কাছে আপনার যাতায়াত ছিল কি না। যে আপনাকে আদর করত, কোলে নিত, আর তখন হয়তো আপনার নাক দিয়ে সিনি গড়াত। ছেলেমানষের সিক্নি গড়ালে খেয়াল থাকে না। কুষ্ঠ রোগের জীবাণু সিকনির সঙ্গে একজনের শরীরে যেতে পারে। গায়ে ঘা পাচড়া থাকলে পোকায় কামড়ানো ক্ষতের মধ্যে জীবাণু ঢুকে যায়। আপনি মনে করে দেখুন, কখনও না কখনও আপনি নিশ্চয়ই কোনও কুষ্ঠ রুগির কাছাকাছি ছিলেন। আর তখন হয় তো আপনার গায়ে ঘা পাচড়া কিছু ছিল।

রুহিতনের অবিশ্বাসী নন, এক দিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই ব্যামোর বিষ হয়তো আমাকে জেলেই ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছে।’

তরুণ ডাক্তার হা হা করে হেসে মাথা নেড়ে বলেছে, ‘না না, একেবারেই সে রকম কিছু ঘটেনি। এটা চামড়ার রোগ, খাইয়ে কিছু করা যায় না। আর তা-ই যদি হত, আপনাকে আরও মারাত্মক বিষই দেওয়া যেত। তা ছাড়া, খাওয়ালে আপনাকে একাই বা কেন? আপনাদের দলের সবাইকেই তো খাওয়ানো যেত। এ রকম ভেবে কোনও লাভ নেই।’

রুহিতন ডাক্তারের কথা মনে মনে মেনে নিয়েছিল। প্রথমত ওকে অবিশ্বাস করা খুবই শক্ত। তা ছাড়া, যারা তাকে যে কোনও মুহূর্তে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিতে পারে, তারা এক জনের জন্য এ রকম একটা রাস্তা কেনই বা নেবে? জেল-জীবনে এই প্রথম সে বন্ধুদের কাছ থেকে একেবারে আলাদা। প্রথম দিকে, জিজ্ঞাসাবাদের সময়গুলো ছাড়া, আলাদা হলেও কাছাকাছিই থেকেছে। কয়েক বছর পরে, মোটামুটি এক দলের দলীদের একসঙ্গেই থাকতে দিয়েছে। তার জন্য অবিশ্যি অনশন ধর্মঘট করতে হয়েছে।

রুহিতন তার পিছনের জীবনটাকে ওলট পালট করে দেখার চেষ্টা করেছে। ঝরঝরে শুকনো ধানে মরা ধান খোঁজার মতো খুঁজেছে। কিন্তু কিছুতেই একটি কুষ্ঠ রুগিকে খুঁজে পায়নি। এখন এই দলের বন্ধুহীন বিচ্ছিন্ন একাকী জীবন অনেকটা ঘনায়মান সন্ধ্যার মতো ঝাপসা। পিছনের জীবনটাই সবসময়ে আলোয় ফট ফট করে। বিশেষ করে সেই সময়টা যখন গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আর তারই অঙ্গ হিসেবে যখন নিজেদের একটা শত্রুমুক্ত স্বাধীন অঞ্চল গড়ে তোলা শুরু হয়েছিল। একটা রীতিমতো যুদ্ধ বলা যায়।

জোতদার আর মহাজনরা গরিব আর ভূমিহীনদের স্পর্ধায় খুবই ক্ষেপে উঠেছিল। এত ক্ষেপে উঠেছিল, ওরা নিজেরাই লোক বেছে বেছে মারতে আরম্ভ করেছিল। মোহন ছেত্রী, রুকনুদ্দিন আহমদ শনিলাল, এমনকী শুকু পোঙানিও একটা বন্দুক ঘাড়ে নিয়ে বেড়াতে আরম্ভ করেছিল। তারও একটা বন্দুকের লাইসেন্স ছিল। সব ছোট বড় জোতদার আর মহাজনেরই বন্দুক ছিল। তাদের বন্দুক দেওয়া হত, ডাকাত ঠেকাবার জন্য। হেমন্তে আর শীতে নেপালের সীমানা থেকে দুর্ধর্ষ মুরাং উপজাতির লোকেরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত। তারাও বন্দুক আর কুকরি আর বড় বড় ঘাস-কাটা দা ব্যবহার করত। কিন্তু সে আক্রমণ ছিল, বছরের বিশেষ সময়ে এক-আধ বার। সেইজন্য বারো মাসই বর্ডার পুলিশ তার সেনাবাহিনী অধিকারী থেকে নকশালবাড়ি রানিগঞ্জ, পানিঘাট মিরিক টাংলু বরাবর ছাউনি করে থাকে। আসলে জোতদার মহাজনদের বন্দুকের দাপট বেশি গরিব আধিয়ার আর খাতকদের ওপর। তা ছাড়া, খাস মহল আর সংরক্ষিত জঙ্গলে বেআইনি চোরা শিকার তো আছেই।

রুহিতনরা ওদের একটি বন্দুকও হাতছাড়া করেনি। পুব-দক্ষিণে টুকরিয়াঝাড়, উত্তরে মেচি আর পশ্চিমে ডালকাঝাড় জঙ্গলকে কেন্দ্র করে, বিশাল এক এলাকার সমস্ত জোতদার মহাজনদের বন্দুক তারা ছিনিয়ে নিয়েছিল।

আর বড়কা ছেত্রী। বিরাট জোতদার মোহন ছেত্রীর ডাকসাইটে ছেলে বড়কা। হ্যাঁ, রুহিতনের বিয়ের অনেক দিন পরে পর্যন্তও তার বন্ধু ছিল। ভাবলে বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে কি? না, একটুও না। সেই দুর্দান্ত দুর্মদ খুনিকে সে শুধু ঘুষি মারতে মারতেই রক্তাক্ত করেছিল, মেরে ফেলেছিল। কিন্তু সত্যি, বড়কা তার ছেলেবেলার বন্ধু ছিল। রুহিতনের হাতে থাকত তীর-ধনুক। ওর হাতে থাকত বন্দুক। ওর থেকে বোধ হয় বন্দুকটার ওজনই বেশি ছিল। তবুও সেটা অনায়াসে দুহাতে তুলে নিয়ে কাঁধের নীচে বাঁট দিয়ে ঠেকিয়ে ঘোড়া টিপত। কী টিপ! এক চুল এদিক ওদিক হত না ।রুহিতনের নিজেরও তীর-ধনুকের টিপ খারাপ ছিল না। জীবনে ওরা বড় শিকার কিছু করেনি। বাঘ হরিণ অজগর মেরেছে। আর ময়ুর মোরগ খরগোশের তো কথাই নেই। ময়ূর তরাইয়ের জঙ্গলে খুব কম দেখা যায়। উড়ন্ত বন্য মোরগকে রুহিতন অনেক বার, বড়কার বন্দুকের গুলির থেকেও, ঝটিতি তীর-ধনুক দিয়ে বিঁধেছে। আর সেই সোনালি চিতা বিড়ালটা? রুহিতন সেটাকে গায়ে তীর বিধিয়ে জ্যান্ত ধরেছিল। বড়কা পোষবার জন্য বিড়ালটাকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই সুন্দর জানোয়ারটিকে বড়কা বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। দুজনে একসঙ্গে যেত মেচি নদীতে মহাশোল মাছ মারতে। কখনও বালাসনে, এমনকী দূরের পশ্চিমে, তিস্তায়। তা ছাড়া পাহাড়ি ঝোরাগুলো থেকে প্রবাহিত স্রোতস্বিনী-ধারায়, কখনও বা মণিকুণ্ডে মাছধরা তো ছিলই। তার সঙ্গে মাছখেকো বন্যবিড়ালও।

সেই সময়টায়, রুহিতনের অল্পবয়সে, বন-বিভাগের শিকারে তেমন কড়াকড়ি ছিল না। তা ছাড়া, জোতদারদের সঙ্গে বন বিভাগের বাবু সাহেবদের মুখ শোঁকাশুঁকি ছিল সব সময়েই। চা বাগিচার সাহেবরা দাপটেই শিকার করত।

বড়কার কথা মনে হলেই খেলুবাবুর কথাগুলোও মনে পড়ে যায়। হঁ হুঁ, ঠিক বলেছ হে খেলুবাবু, বড়কা ছেত্রী আমার বন্ধু ছিল। আমরা দুজনে একসঙ্গে মেলায় যেতাম। রংপাঁচালি মানপাঁচালি গান শুনতাম। হঁ, জুয়াও খেলতাম। আমার বিয়ে হল। তার কিছু দিন পরে ওর বিয়ে হল। খাস নেপাল থেকে মেয়ে এনে বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছিল ওর বাবা। ওরও বউয়ের নাম ছিল মায়া। আমার মঙ্গলা, ওর মায়া। দুজনে বউদের নিয়েও মেলায় চলে যেতাম। গান শুনতাম, মেলায় বায়স্কোপ দেখতাম, জুয়া খেলতাম, মদ পচুইও খেতাম। আর বউয়েরা আমাদের তাড়া দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেত। অল্প বয়সে বড় সুখের দিন ছিল বটে। হঁ, বড়কার ঘরে ভাতের হাঁড়ি ভরা। আমার থাকত না। রাত্রের অন্ধকারে দুজনে শিকারে বেরিয়েছে। সামনে হাতির দল পড়ে, কি মাথার ওপর থেকে চিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে, একবারও মনে আসত না। ওর পেট ভরা থাকত। আমার হয়তো থাকত না। বড়কা জানতে পেলে কোনও দিন ঘর থেকে কিছু নিয়ে আসত। কিন্তু লুবু খাঁকড়ি? বড়কার টাকায়? খেলুবাবু, আমি কুরমি মাহাতো। সাঁওতাল কুরমি ওঁরাও মুণ্ডা, অনেক তো চা বাগানে, জোতে দেখেছ। টাকা দিয়ে মেয়েমানুষের সঙ্গ, আমরা জানি না। তোমার হিসাব নেই, আমাদের দুঃখী মেয়েগুলোকে কারা কিনতে চায়?

১৪

কিন্তু বড়কা ছিল মোহন ছেত্রীর ছেলে বড়কা ছেত্রী। যখন থেকে বুঝেছিল, রুহিতন অন্য জগতের লোক, তখন থেকেই ও আর তার বন্ধু ছিল না। মেলামেশা করত না। বরং শাসাতে আরম্ভ করেছিল। রুহিতনদের কার্যকলাপে সন্দেহ করে, সবসময়েই বন্দুক হাতে করে বেড়াত। আর তার সামনেই এক দিন গোবরা সাঁওতালকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে মারতে আরম্ভ করেছিল। গোবরা ছিল বড়কাদেরই জোতের মজুর, বাড়ির চাকর। বড়কার সন্দেহ হয়েছিল, গোবরা জোতদার মারার দলে ভিড়েছে। কথা আদায়ের জন্য পেটাচ্ছিল। পেটানো? ওটাকে পেটানো বলে না। খুন করার জন্যই মারা। বড়কার হাতে রক্ত আগেও লেগেছিল। শত্রু মনে হলেই তাকে মারতে ওর হাত কাঁপত না।

দিবাবাবু নিজে ডেকে বলেনি রুহিতনকে, বড়কাকে মারতে। রুহিতন বড়কার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। হঁ, এটা ঠিক, বড়কা খুব অবাক হয়েছিল। রুহিতন ওকে মারবে, আশা করেনি। তারপরেই ভীষণ ক্ষেপে উঠে বন্দুক বাগিয়ে গুলি করবার চেষ্টা করেছিল। রুহিতন তা হতে দেয়নি। সে জানত, বড়কা এক বার বন্দুক ধরতে পারলে, রেহাই নেই। তা-ই, প্রাণপণ চেষ্টায় আগে ও বন্দুকটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। গোরা সাঁওতাল বন্দুকটা তুলে নিয়েছিল। রুহিতন বড়কাকে মারতে আরম্ভ করেছিল। মারতে মারতে…। না, বুকে ছাঁৎ করে উঠছে না। সেই মারামারির সময়েই গোবরা সাঁওতাল একদল লোক নিয়ে মোহন ছেত্রীর কাঠ আর টিনের চালার দোতলা জোতবাড়ি আক্রমণ করেছিল। বৃদ্ধ মোহন ছেত্রী, আর তার দুই ছেলেও মরেছিল। শত্রুমুক্ত স্বাধীন এলাকার কাজ তার আগেই কিছু কিছু শুরু হয়েছিল। বড়কা বন্ধু ছিল? হ্যাঁ বন্ধু ছিল। তারপরে শত্রু। জীবন তো এই রকমই। সকল জীবে যদি নিজের ধর্ম থাকে, তবে ভূমিহীন কৃষক রুহিতন কুরমিরও একটা ধর্ম আছে। সেই ধর্মের কাছে শত্রুর একটাই মাত্র বিচার। মরো, না হয় মারো।

প্রধানত জোতদার হল বর্ণহিন্দু বাঙালি, কিছু বিহারি মুসলমান, সামান্য দু-চারটি নেপালি। মহাজনরা অধিকাংশই মারোয়াড়ি। বড় বড় দোকান, আড়ত আর তেজারতি সুদখোরি কারবার তাদেরই। ক্রমে ক্রমে চা বাগানগুলোর মালিক তারাই হয়ে উঠছে। তাদের থাবা চা বাগান থেকে তরাইয়ের অরণ্য আর শস্য সম্পদের সর্বত্র। মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার প্রথম আক্রমণের লক্ষ্য ছিল, সেই সব মহাজন জোতদাররা। অনেকেই শিলিগুড়িতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছিল। বড়কার মতো যারা লড়তে চেয়েছিল, তাদের লড়বার শখ মেটানো হয়েছিল। বর্ডার পুলিশ আর সেনাবাহিনী, সেই আকস্মিক সশস্ত্র উত্থানের জন্য প্রস্তুত ছিল না। স্বভাবতই তারা প্রথম দিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। পরে পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিমে ঘিরে দক্ষিণের সমতলে শিলিগুড়ি, বিহারের সীমানা থেকে, প্রতি-আক্রমণের প্রস্তুতিপর্ব দ্রুত শুরু করেছিল।

কিন্তু উত্থানের যোদ্ধারা শহরের মাস্তান গুণ্ডা শকুনগুলোকে ঠিকমতো রুখতে পারেনি। গোরু মরলে যেমন মাছিরা গিয়ে আকাশে শকুনিদের খবর দেয়, আর তারা ঝাঁপিয়ে এসে মড়ার ওপর পড়ে, সেই ভাবে এসে ঝাপিয়ে পড়েছিল। উত্থানের সুযোগ নিয়ে, ওরা ট্রাক আর লরি করে, লক্ষ লক্ষ টাকার মাল লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিল। উত্থানের আগেই, ঠিক পরের মুহুর্তের চেহারা কী দাঁড়াতে পারে, সে বিষয়ে সকলের সম্যক কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। আর সেই সব গুণ্ডা মাস্তানরা, যাদের অনেকের দলীয় রাজনীতির ছদ্মবেশও ছিল, ওরা যে কোনও অবস্থার সুযোগ নেবার জন্য প্রস্তুত থাকে।

রুহিতন ভুলতে পারে না, সেই সময় তরাইয়ের জঙ্গলে গ্রামে গ্রামে মানুষদের কী আশ্চর্য উৎসাহ আর সাহস। সে নিজে সব গ্রাম বা বিভিন্ন আস্তানায় ঘুরে ঘুরে দেখেছে। ছেলেবুড়ো, মেয়েম, সকলের চোখমুখের চেহারা বদলিয়ে গিয়েছিল। সত্যি কি তারা একটা নতুন জীবন পেয়েছিল? এমনকী অনেকে হাঁড়িয়া খাওয়া, বউ পেটানো বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেকের মতো মনের জ্বালায় বউ পেটানোর ঝোঁক রুহিতনের ছিল না। তা বলে কি দু-এক বার কখনও পেটায়নি? তবে হ্যা, সে নিজেও দু-এক বার মঙ্গলার পিটুনি খেয়েছে। এমন কুরমি মাহাতোর বাচ্চা জগতে কে আছে, গুরুতর অপরাধ করে বউয়ের কিল ঘুষি খায়নি? নিদেন নেশা ভাঙের খোয়ারি কাটাতে? বিশেষ করে সেই নেশা যদি হয়, ঘরের সকলের মুখের অন্ন চুরি করে নিয়ে গিয়ে, বদলিতে একটা হাঁড়িয়া খাওয়া? কিন্তু সেও যখন ডেয়ং (হাঁড়িয়া) খাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন তার মা বলেছিল, তা আবার কী করে হয়? সাঁওতাল কুরমি মুণ্ডা মাহাতোরা ডেয়ং খাবে না, এ হয় না। এটা অধর্ম। এখনও আমরা করম পূজা করি, মারাংবুরুর কৃপা চাই, ডেয়ং তাঁরই তৈরি। এখনও রাজবংশিদের শিরুয়া কিসুয়া উৎসবে (কাদামাখা, শিকার করতে যাওয়া) আমরা যাই।

মা এই রকম বলত। মঙ্গলারও তাতেই সায় ছিল। কিন্তু রুহিতনদের মুক্ত অঞ্চলে তখন একটা ভিন্ন হাওয়া বইছিল। ডেয়ং খাওয়ার বিষয়ে বা আরও কোনও কোনও বিষয়ে কোনও নির্দেশ বা নিষেধ ছিল না। মুক্ত অঞ্চল গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সকলের মধ্যেই একটা পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছিল। সকলেই কেমন সচেতন আর কঠোর হয়ে উঠেছিল। কঠোরতা এই কারণে, সকলেই নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্য পালন করতে চেয়েছিল। মুক্ত এলাকাকে সবাই অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দিত।

মঙ্গলা কী করেছিল? তার বউ? মনে প্রাণে মাহাতোদের মেয়ে হয়েও মুক্তাঞ্চলের মধ্যে এক ডাইনি পোড়াবার ঘটনায় ভীষণ ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল। দাঁড়াবার কথা না। করম পূজা, আর মারাংবুরুর মতোই ডাইনি পোড়ানোতে ওর বিশ্বাস ছিল। থাকবারই কথা। এ নিয়ে রুহিতনের সঙ্গে আগে ওর অনেক বাকবিতণ্ডা ঝগড়া বিবাদ হত। ঘরের ভিতর থেকে ফুকা ঝেড়ে যে গ্রামের গোরুর দুধের বাঁট শুষে নিতে পারে, মায়ের কোলে কচি শিশুর বুকের রক্ত খেয়ে ফেলতে পারে, জ্বালিয়ে দিতে পারে ফলন্ত শস্য, তাকে এক বার ধরতে পারলে না পুড়িয়ে রেহাই দেওয়া যায়? যায়। মঙ্গলা নিজেই তার নেতৃত্ব করেছিল। আর এই একটা ঘটনা থেকেই মঙ্গলাকেও সবাই চিনে নিয়েছিল। হ, লড়িয়ে নেতা রুহিতন কুরমির বউ না মঙ্গলা? বলেছিল, ঝাড়ফুঁক গুনিন ওঝা ভাগো। সব বুজরুকি।

কী করবে রুহিতন? এই সব কথাই এখন তার বারে বারে মনে পড়ে। অসুস্থ বিচ্ছিন্ন এই জেল-জীবনে এ সব কথা মনে হলেই আরও কিছু কিছু ইচ্ছা তার বুকের মধ্যে তোলপাড় করে ওঠে। শিশু যেমন মায়ের গায়ের গন্ধে সচকিত হয়ে ওঠে, মঙ্গলার গায়ের গন্ধে তারও সে রকম হত। এতগুলো বছর পার হয়ে গিয়েছে, তবু সেই গন্ধটা চিনে উঠতে ভুল হয় না। এখন রুহিতন কুরমির জীবনে এটা কি দুর্বলতা না? বুধুয়া করমা দুধিকে দেখার ইচ্ছায় বুকটা টনটনিয়ে ওঠে। হঠাৎ হঠাৎ প্রাণটা উদ্বেগে চমকিয়ে ওঠে, অন্ধ মা ঝোরার কাছে গিয়ে আলগা পাথরের ওপর পা দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে না তো?

তরাইয়ের চুনীলাল মৌজার রুহিতন কুরমি সে। তার কেন এ সব কথা মনে পড়বে? তাদের চিন্তায় উদ্বিগ্ন হওয়া কি তার উচিত? পচা ডালপালা খসে যাওয়ার মতো, তার শরীরের কোনও কোনও অংশ খসে যাচ্ছে। বাকি অংশে নতুন করে অনুভূতি নিয়ে আসছে। সাড় ফিরে আসছে। সে টের পায়, সে আরোগ্য হয়ে উঠছে। স্নায়ু আর হাড়ের দুর্বলতা কেটে যাচ্ছে। কিন্তু তার জীবনের সাফল্য তো অন্যখানে। এখনও সে জেলে, এবং বিচ্ছিন্ন অসুস্থ একা। বউ ছেলে মেয়ে মা কেমন আছে, কোথায় আছে, কীভাবে আছে, এই উৎকণ্ঠায় থেকে থেকে কেন তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে? কেন বা ডাক্তারের সেই কথাটা প্রায়ই মনে পড়ে যায়, ‘আপনি ভাববেন না আপনার জীবনটা এই অসুখে শেষ হয়ে গেছে। আপনি ভাল হয়ে উঠবেন। তারপরেও আপনার আবার ছেলে মেয়ে হতে পারবে, যখন আপনি আপনার স্ত্রীর কাছে ফিরে যাবেন। হ্যাঁ, আগের মতোই নীরোগ সুস্থ ছেলেমেয়ে হবে আপনার। কোনও বাজে চিন্তা করবেন না।’

সত্যি? সত্যি! কিন্তু কেন ডাক্তার তাকে এ সব কথা বলে? ‘মঙলি, তুই তো বুঝতে পারিস, এ সব কথা শোনার অর্থ কী? এ সব কথা প্রাণের ভিতরে কোথায় চলে যায়? আর যেখানে যায় সেখানে গিয়ে কোথাকার প্রাণটাকে কোথায় ছুটিয়ে নিয়ে যায়? কিন্তু আমি যে রুহিতন কুরমি। রুহিতন কুরমি।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে পড়ে যায়, তবু সে একজনের ‘ফানলা’ ভূমিকা, সাঁওতাল মুণ্ডা মেয়েরা এক জনকেই ‘ফানলা’ বলে। কপটাচারী প্রেমিক অথবা দাগাবাজ, কথাটার এমনি একটা মানে করা যায়। মঙ্গলা রুহিতনকে কখনও কখনও এই নামে ডেকে উঠত। আসলে এটাও একটা সোহাগের ডাক। কিন্তু রুহিতন এ সব কথা মনে করতে চায় না। সে অবাক আর অসহায় হয়ে জিজ্ঞেস করতে চায় না, এই ব্যাধি কেন তার শরীরে? কারণ তাও যে এক অকারণ দুর্বলতা। সে তার ফেলে আসা জীবনের সমস্ত মানুষকে মনে মনে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেছে। ডাক্তারের কথামতো কে সেই লোক যার কাছ থেকে তার শরীরে এই ব্যাধি এসেছে?

যত দিন চলে যেতে থাকে, তত এই জিজ্ঞাসাটা মন থেকে সরে যেতে থাকে। আর কী লাভ, যদি বা মনে পড়ে সে কে? বরং তার মনে মাঝে মাঝেই তীব্র কৌতুহল আর ব্যগ্র জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে, সেই মুক্ত এলাকার চেহারা এখন কী রকম? জেলের মধ্যে অনেকের কাছে অনেক রকম কথা শুনেছে সে। সত্যি মিথ্যা জানে না, তবে সব খবরই আশাহীন ব্যর্থতায় ভরা। শুনতে ইচ্ছা করে না। উদ্বেগ জাগে সেখানকার মানুষরা কেমন আছে? হত্যা জখম লুট, ক্ষেত্রবিশেষে আগুন লাগানো, আর অস্ত্রাগার তৈরি, সবই সত্যি। মিথ্যা না। এ সবই ঘটেছিল, আর একটা নতুন জগৎ তৈরি করার জন্য। রুহিতন অস্বীকার করে না। কিন্তু এই এলাকার মানুষরা ছিল শুধু খুনি ডাকাত অপরাধী, নিজেদের সম্পর্কে এ কথা সে কোনও দিন শুনতে চাইবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *