১০. মহা বিপর্যয়

১০. মহা বিপর্যয়

ভেবেছিলাম পরের দিন মামীকে বুঝিয়ে রাজী করিয়ে আবার সুর্কেল করতে নিয়ে যাব কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না কারণ একেবারে খুব ভোর বেলা অনেক রকম শব্দ করে জাহাজের ইঞ্জিন চালু হয়ে সেটা আবার রওনা দিয়ে দিল। গাড়ী কিংবা ট্রেনে গেলে প্রতি মুহূর্তে চারপাশের দৃশ্য পালটে যায়, দেখতে ভালো লাগে। জাহাজে সেরকম কিছু নাই, সামনেও পানি, পিছনেও পানি, আগেও পানি পরেও পানি। যদি খুব কপাল ভালো থাকে তাহলে একটা সামুদ্রিক কাছিম, একটা ডলফিন কিংবা কিছু উড়ন্ত মাছ দেখা যায়। আগে পেছন পেছন অনেকগুলো সিগাল থাকত এখন কোনো সিগালও নেই।

তবে মামী একদিন তার ফোনে বাসার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। আব্বু আম্মুর সাথে কথা হলো। আপুকেও দেখলাম, টেবিলে তার প্লাস্টার। করা পা তুলে রেখে বই পড়ছে। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কী টুলু, মজা হচ্ছে?”

“হ্যাঁ আপু। তুমি থাকলে আরও মজা হতো।”

“আমি থাকলে তো আর তুই থাকতে পারতি না।”

“তা ঠিক।”

“মামীকে জ্বালাতন করছিস না তো?”

“নাহ্।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার পায়ের কী অবস্থা?”

“ভালো। শুধু একটা ঝামেলা–”

“কী ঝামেলা?”

“ভেতরে চুলকায়।”

“সাবধানে থেকো। ভেতরে তেলাপোকা না ঢুকে যায়।”

আপু ধমক দিল, “চুপ কর পাজী। দেব একটা থাবড়া।”

আমি হি হি করে হাসলাম।

.

মিতির সাথে আমার সময়টা ভালোই কেটে যাচ্ছিল। সে খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। আমার জন্য সে সামুদ্রিক কাছিমের ছবি এঁকে দিল। আমি তখন তাকে বললাম, সামুদ্রিক কাছিমের পিঠে আমাকে বসিয়ে দিতে। শুনে মিতি হি হি করে হাসল কিন্তু আমাকে কাছিমের পিঠে বসিয়ে দিল। চেহারাটা মোটামুটি খারাপ হয় নাই কিন্তু বুকের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল–খালি গা হলে আমাকে মনে হয় এইরকমই দেখায়।

আমি আর মিতি সময়টা ভালো কাটালেও জহিরের খুবই খারাপ অবস্থা। একা একা মুখ ভোঁতা করে বসে থাকে। এবার জাহাজে দুলুনী কম তাই বমি শুরু হয় নাই কিন্তু সারাক্ষণই সেটা নিয়ে টেনশনে আছে। আমার কথা শুনে এবার বন্ধ ঘরে না থেকে দূরে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কোন দুঃখে যে এসেছিলাম। কবে যে ফেরত যাব।”

আমি উপদেশ দিলাম, “বই পড়ো। আমার কাছে ভালো বই আছে।”

জহির মুখ খিঁচিয়ে বলল, “বইয়ের খেতাপুড়ি।” তারপর একটা কুৎসিত গালি দিল, পিচিক করে থুতু ফেলল, তারপর বলল, “এতদিন হয়ে গেল,

একবেলা ভালো করে খেতে পর্যন্ত পারলাম না।”

আমি বললাম, “কেন? জাহাজে তো খাবার যথেষ্ট ভালো।”

“ভালো?” জহির মুখটা কুঁচকে নাক দিয়ে বিদঘুঁটে শব্দ করল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কী খেতে চাও?”

“তুই শুনে কী করবি?”

“দেখি পছন্দ হয় কিনা তাহলে ব্যবস্থা করব।”

জহির একেবারে আলজিভ বের করে হা হা করে হাসল, তারপর বলল, “তুই ব্যবস্থা করবি? তোর নাক টিপলে দুধ বের হয় আর তুই ব্যবস্থা করবি? তুই কী জাহাজের ক্যাপ্টেন?”

“বলেই দেখো।”

জহির হাসি থামাল, বলল, “মনে কর বার্গার। ভেতরে মেয়োনিজ আর পেঁয়াজের স্লাইস। ওপরে মাস্টার্ড আর কেচ আপ। সাথে মুচমুচে ফ্রেঞ্চফ্রাই। তার সাথে ঠান্ডা কোক। আ হা হা চিন্তা করেই জিভে পানি এসে যাচ্ছে।”

জহির সেটা চিন্তা করতে করতে তার মাথার চুল ঠিক করতে লাগল, সেগুলো আবার মোটামুটি খাড়া হয়েছে। এখন আর নেতিয়ে নাই। এরকম চুল মনে হয় খারাপ না, তার অবস্থা কীরকম জিজ্ঞেস করতে হয় না। চুল দেখলেই বোঝা যায়।

আমি তখন মিতিকে নিয়ে নিচে জাহাজের কিচেনে গেলাম। বাবুর্চি তার কেবিনেটের নিচ থেকে কী একটা জিনিস বের করে মুখ কুঁচকে সেটার দিতে তাকিয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “চাচা, কী দেখেন?”

“ইন্দুর আটকা পড়েছে কিনা দেখছি।”

“ইন্দুর?”

“হ্যাঁ এটা হচ্ছে ইন্দুর ধরার আঠা, খুবই ডেঞ্জারাস। একবার ইন্দুর এখানে পা দিলে আর উপায় নাই, আটকে যায়।”

“আটকায় নাই?”

“নাহ। মনে হয় সবগুলো ধরা পড়ে গেছে। ফ্যামিলি ফিনিশ। তারপরেও দিয়া রাখি।”

বাবুর্চি আঠা লাগানো কাঠের টুকরাটা কেবিনেটের নিচে রেখে উঠে দাঁড়াল। বলল, “মারাত্মক আঠা। সেদিন ভুলে পা দিয়ে দিয়েছিলাম, পরে স্যান্ডেল আর পরিষ্কারই করতে পারলাম না। স্যান্ডেলটাই ফেলে দিতে হলো। সদরঘাট থেকে আশি টাকা দিয়ে কিনেছিলাম।” বাবুর্চি তার স্যান্ডেলের দুঃখে জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করল।

আমি বললাম, “মনে হয় ইন্দুরের ফ্যামিলির বদদোয়া।”

বাবুর্চি হা হা করে হাসল, বলল, “ঠিকই বলেছ।” তারপর একবার মিতির দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “তুমি কী খেতে চাও সেটা বলবা না?”

আমি বললাম, “সেইটাই বলতে এসেছি।”

বাবুর্চি হাসি হাসি মুখ করে বলল, “বলল, দেখি তোমার জন্য রান্না করতে পারি কিনা।”

“আপনি কি বার্গার বানাতে পারবেন? সাথে ফ্রেঞ্চফ্রাই?”

“পারব না কেন? কিমা বেশী নাই। তোমরা কয়জন?”

“তিনজন।”

“কুনো সমস্যা নাই। আজ দুপুরে তিনজনের জন্য ইসপিশাল বার্গার।”

“সাথে কেচ আপ। আর কোক।” বার্গারের সাথে কেচ আপ কোক তো থাকতেই হবে।”

“ওপরে পেঁয়াজের স্লাইস।”

“আর কিছু?”

“বেশী করে মেয়োনিজ।”

“ঠিক আছে। সব পাবে।”

“থ্যাংক ইউ চাচা।”

“একশবার।” তারপর বাবুর্চি আমার সাথে আর মিতির সাথে হ্যান্ডশেক করে ফেলল।

.

দুপুরবেলা আমাদের তিনজনকে আলাদা বসিয়ে বাবুর্চি বার্গার নিয়ে এলো। জহির ভুল বলে নাই, দেখেই আমার মুখে পানি এসে গেল। অন্য টেবিলে বড়ো মানুষেরা বসে ছিল তাদের একজন কান্নার ভঙ্গী করে বলল, “ব্যাপারটা কী? আমরা বড়ো হয়ে গেছি দেখে জাংক ফুড পাব না? শুধু বাচ্চাদের জন্য জাংক ফুড?”

বাবুর্চি হাসল, বলল, “আজকে বাচ্চাদের স্পেশাল। আপনারা চাইলে আপনাদের জন্যও বানাতে পারি।”

কয়েকজন বলল, “চাই! চাই! জাংক ফুড চাই।”

কমবয়সী একটা মেয়ে বলল, “চাইলেও লাভ নাই। আমাদের জন্য শুধুমাত্র বিস্বাদ ইকো ফ্রেন্ডলি হেলদি ডায়েট!”

অনেকেই সেটা শুনে শব্দ করে হাসল।

আমি ভেবেছিলাম জহির তার প্রিয় খাবার খেয়ে খুশী হবে, কিন্তু উলটো ফল হলো। কেমন জানি রাগ রাগ চোখে বলল, “তুই কেমন করে এটা ম্যানেজ করলি? তুই কে?”

আমি বললাম, “বাবুর্চি চাচাকে বললাম, বাবুর্চি চাচা বানিয়ে দিল।”

“বাবুর্চি চাচা? এই বাবুর্চি তোর চাচা?”

আমার রাগ উঠে গেল, কিন্তু কিছু না বলে চোখ লাল করে তাকালাম। জহির বলল, “খালি এই বাবুর্চি তোর চাচা নাকি তোদের বাবুর্চির ফ্যামিলি? বাপ চাচা সবাই বাবুর্চি?”

আমার ইচ্ছা হলো বাগারটা তার মুখে ছুঁড়ে মারি কিন্তু কিছু করলাম না, এখানে কিছু করা সম্ভব না।

জহির বার্গার কামড় দিয়ে বলল, “এই বয়সে দুই নম্বুরি কাজ করতে শিখেছিস? সন্ত্রাসীর ট্রেনিং নিচ্ছিস। বড়ো হয়ে কী হবি? কালা জাহাঙ্গীর? হ্যাঁ?”

আমি তখন আমার প্লেট নিয়ে সরে অন্য জায়গায় বসলাম। মিতিও আমার সাথে সাথে চলে এলো। আমার অনেকক্ষণ লাগল শান্ত হতে। এই জহির ছেলেটার সমস্যা কী? তাকে সাইজ করার সময় মনে হয় হয়ে গেছে।

.

দুপুরের দিকে জাহাজটা থামল। অনেক রকম শব্দ করে নোঙর ফেলা হলো। আমি তখন দৌড়ে মামীকে খুঁজে বের করলাম, খুবই কাচুমাচু মুখ করে বললাম, “মামী, জাহাজ থেমেছে!”

মামী হাসলেন, বললেন, “হ্যাঁ। দেখেছি।”

“আমাদের স্নার্কেল করতে নিয়ে যাবে? প্লিজ মামী প্লিজ!”

মামী চোখে কপালে তুললেন, বললেন, “তোর কী ধারণা আমরা এই গহীন সমুদ্রে শুধু মজা করতে এসেছি? আমাদের কোনো কাজকর্ম নাই?”

“কাজ তো আছেই। কাজের ফাঁকে একটু সময়।”

মামী মুখ গম্ভীর করে বললেন, “না টুলু। আজকে আর কালকে আমার একদম সময় নেই। শুধু তাই না আমাদের বোট ব্যস্ত। তোদের অপেক্ষা করতে হবে।”

আমি অনেক বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ঠিক তখন দুপুর বেলা যে মানুষটা জাংক ফুডের জন্য হাহুতাশ করছিল সে হেঁটে যাচ্ছিল, আমাদের দেখে থেমে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হলো ইয়ংম্যান? এত মন খারাপ কেন?”

আমি বললাম, “না, না, মন খারাপ না।”

মামী বললেন, “নতুন স্নর্কেল শিখেছে তাই আবার স্নর্কেল করতে চাইছে। আমার ফিল্ড ওয়ার্ক সময় নাই সেজন্য মন

মানুষটা বলল, “তোমরা ডাটা নিয়ে ফেরত না আসা পর্যন্ত আমার কোনো কাজ নাই। আমি নিয়ে যেতে পারি।”

আমি চোখ বড়ো বড়ো করে বললাম, “আপনি স্নর্কেল জানেন?”

মামী শব্দ করে হাসলেন, বললেন, “কাকে কী বলিস? তুই জানিস ইমতিয়াজ হচ্ছে এই দেশের সবচেয়ে বড়ো ডিপ সি ডাইভার? পানির নিচে মনে হয় ঘুমাতেও পারে। তারপর ইমতিয়াজ নামের মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “থ্যাংক ইউ ইমতিয়াজ। কিন্তু আজকে কোনো বোট ফ্রী নাই। আমরা বোটগুলোকে নিয়ে সাউথে যাব।”

ইমতিয়াজ নামের মানুষটা হাসার ভঙ্গী করে বলল, “কোনো সমস্যা নাই। একটা লাইফবোট নামিয়ে ফেলব। বোটা ছোটো কিন্তু আমরা মানুষও তো দুই তিনজন। ইঞ্জিন নাই কিন্তু বৈঠা আছে। আমরা তো আর সমুদ্র পাড়ি দিব না, ধারে কাছে যাব।”

মামী বললেন, “তুমি যদি এদের সাথে থাকো তাহলে সমুদ্র পাড়ি দিলেও আমার কোনো চিন্তা নাই!”

আমি একবার মামীর দিকে আরেকবার ইমতিয়াজ নামের মানুষটার দিকে তাকালাম তারপর উত্তেজিত হয়ে বললাম, “তাহলে আমরা স্নর্কেল করতে যাব?”

মামী বললেন, “তাই তো মনে হচ্ছে।”

আমি তখন আনন্দে এত জোরে চিৎকার দিলাম যে আশেপাশে যারা ছিল সবাই চমকে উঠল।

আমি মিতিকে খবর দিলাম তখন মিতিও আনন্দে হাততালি দিল। তারপর দুজন আমাদের ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। আগের বার যখন মামীর সাথে গিয়েছি তখন কী কী নিতে হবে জেনে গেছি। আমরা ব্যাগ রেডি করে ইমতিয়াজ নামের বিখ্যাত ডাইভারের কাছে গিয়ে বললাম, “আমরা রেডি, আপনি কখন যেতে চান বলবেন, ইমতিয়াজ চাচা।”

“ঠিক আছে। আমাকে ঘণ্টাখানেক সময় দাও।”

আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। দেখলাম স্পীডবোটে অনেকে উঠেছে, কেউ ডাইভারের পোশাকে, কেউ এমনি। অনেক যন্ত্রপাতি তোলা হয়েছে। মামীও উঠেছেন। তারপর স্পীডবোটটা গর্জন করে পানি ছিটিয়ে চলে গেল,

আমি আর মিতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়লাম।

ঘণ্টাখানেক পর ইমতিয়াজ চাচা বললেন, “চলো যাই। তোমাদের জন্য সময় হচ্ছে এক ঘণ্টা তিরিশ মিনিট। হবে না?”

আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, “হবে।”

ইমতিয়াজ চাচা জাহাজের পেছনে টানিয়ে রাখা ছোটো একটা বোট কীভাবে কীভাবে জানি খুলে পানিতে নামিয়ে ফেললেন। কোথা থেকে জানি দুটি বৈঠা রাখলেন, তারপর বোটের সামনে রাখা দড়িটা ধরে নৌকাটাকে জাহাজের কাছে রেখে আমাদের বললেন, “নাও ওঠো।”

আমরা সাবধানে নৌকায় উঠলাম। ইমতিয়াজ চাচাও উঠলেন পেছনে বসে বৈঠা দুটো হাতে নিয়ে বললেন, “সবকিছু নিয়েছ? ডাইভিং গগলস? স্নর্কেল?”

আমি বললাম, “নিয়েছি।”

ইমতিয়াজ চাচা বললেন, “গুড।” তারপর বৈঠা বাইতে শুরু করলেন। না বাইলেও ক্ষতি নেই, কারণ সমুদ্রের পানিতে একটা স্রোত আছে। সেই স্রোতেই বোটটা যেতে পারে। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম ইমতিয়াজ চাচা স্রোতের উলটো দিকে বোটটা নিতে চাইছেন যেন ফিরে আসাটা সোজা হয়।

একটুক্ষণ যাওয়ার পরই হঠাৎ ইমতিয়াজ চাচা বৈঠা থামিয়ে বললেন, “উপস।”

আমি বললাম, “কী হয়েছে?”

“একটা জিনিস ভুলে গেছি।”

“কী জিনিস?”

“আমাদের সার্ভারের আইপিএস চার্জে দেওয়ার কথা। জেনারেটরটা চালিয়ে রাখার কথা ছিল। পাঁচ মিনিটের জন্যে জাহাজে নামতে হবে।”

“ঠিক আছে।”

ইমতিয়াজ চাচা বোটটাকে জাহাজের কাছে নিয়ে গেলেন, তারপর জাহাজে উঠে বোটের দড়িটা রেলিংয়ে একবার প্যাচিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “ধরে রাখো। আমি আসছি।”

আমি দাঁড়িয়ে দড়িটা ধরে রাখলাম। বোর্টটা হালকা ঢেউয়ে একটু একটু দুলছে। আকাশটা আজকে অসম্ভব নীল, এত সুন্দর নীল আকাশ মনে হয় আমি কখনো দেখি নাই। পানিটাও নীল। কক্সবাজারে সমুদ্রের পানি কখনো এত নীল হয় না।

হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে কীভাবে যেন দড়িটা আমার হাত থেকে ছুটে গেল। আমি চমকে উঠে তাকিয়ে দেখি জহির রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে টান দিয়ে দড়িটা আমার হাত থেকে ছুটিয়ে নিয়েছে।

আমি বললাম, “কী করছ? কী করছ?”

জহির দাঁত বের করে হাসল যেন খুব একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। তারপর দড়িটা আস্তে আস্তে ঢিলে করতে লাগল যেন নৌকাটা জাহাজ থেকে সরে যায়।

আমি আবার চিৎকার করলাম, “কী করছ? কী করছ তুমি?”

জহির দড়িটা ঢিলে করে শেষ মাথা পর্যন্ত গেল, তারপর হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টান দিল। তখন আমি বুঝতে পারলাম সে কী করতে চাইছে–বোটটাকে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে নাড়াতে চাইছে যেন আমি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাই। কিন্তু বোটকে পানির মাঝে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নাড়ানো এত সোজা না, জহিরের দুবলা শরীরে সেটা কঠিন একটা ব্যাপার তাই বোটটাকে খুব বেশী নড়াতে পারল না কিন্তু সর্বনাশ যেটা হওয়ার কথা সেটা হয়ে গেল। তার হাত থেকে দড়িটা ছুটে গেল এবং সেটা পানিতে পড়ে গেল। জহির দড়িটা ধরার হাস্যকর একটা চেষ্টা করল। সে যেভাবে শূন্যে হাত নেড়ে দড়িটা ধরতে চেষ্টা করল যে মনে হলো সে আশা করছে এভাবে হাত নাড়লেই পানি থেকে দড়িটা লাফ দিয়ে তার হাতে উঠে আসবে।

জহির কেমন জানি বোকার মতো তাকিয়ে রইল, প্রথমে বেকুবের মতো একটু হাসল তারপর ফিচলে ভঙ্গীতে হাসল যেন সে খুবই মজার একটা দৃশ্য দেখছে।

আমার আর মিতির বুঝতে একটুও দেরী হলো না যে আমরা খুব বড়ো বিপদে পড়ে গেছি। স্রোতে বোটটা সরে যাচ্ছে এবং দেখতে দেখতে সেটা এতদূরে চলে যাবে যে আমাদেরকে কেউ আর খুঁজে পাবে না। কী করব বুঝতে না পেরে আমি বৈঠা হাতে নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম বোটটাকে জাহাজের কাছে নিতে। কাজটা খুব কঠিন, বোটটা একটুও সামনে গেল না বরং সেখানেই সেটা ঘুরে গেল। মিতিও ততক্ষণে আরেকটা বৈঠা হাতে নিয়ে বৈঠা বাওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করেছে কিন্তু বোট এক জায়গাতেই ডানে বামে নড়তে লাগল এবং আমরা দেখলাম বোটটা আস্তে আস্তে জাহাজ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে।

ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে গেল। আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম, “ইমতিয়াজ চাচা, ইমতিয়াজ চাচা।”

আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম, “ইমতিয়াজ চাচা, ইমতিয়াজ চাচা।”

কিন্তু জাহাজে জেনারেটর চালু করা হয়েছে, তার শব্দে আমার গলা বেশী দূর গেল না। যদি কোনো জাদুমন্ত্রের কারণে ইমতিয়াজ চাচা এই মুহূর্তে বের না হয়ে আসেন তাহলে আমাদের কেউ রক্ষা করতে পারবেন না। আমি অবাক হয়ে দেখলাম জহির বেশ শান্তভাবে আমাদের দেখছে। যেন একটা নাটক দেখছে। শুধু তাই না, মনে হলো নাটকটা সে বেশ ভালোই উপভোগ করছে। একসময় হাত দিয়ে তার চুলগুলো ঠিক করে পকেটে হাত দিয়ে ডেকের দিকে চলে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম সে ডেক চেয়ারে বেশ আরাম করে বসেছে। সেই মুহূর্তে আমি তার গলার রগ ছিঁড়ে ফেলতে পারতাম।

আমি আরও অনেকবার “ইমতিয়াজ চাচা, ইমতিয়াজ চাচা” করে চিৎকার করলাম কিন্তু কেউ আমার চিৎকার শুনল না। বরং আমার চিৎকারটা আমার নিজের কানেই কেমন জানি অসহায় আর্তনাদের মতো শোনালো। আমি মিতির দিকে তাকালাম, সে ফ্যাকাশে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখে অবিশ্বাস্য একধরনের আতঙ্ক।

আমরা দেখলাম জাহাজটা আমাদের চোখের সামনে ছোটো হতে শুরু করছে। ছোটো হতে হতে একসময় জাহাজটা একটা বিন্দুর মতো হয়ে গেল এবং তারপর আর সেটাকে দেখতে পেলাম না। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি, উপরে নীল আকাশ। তার মাঝে ছোটো একটা বোটে আমরা দুজন ভেসে বেড়াচ্ছি। আমরা এখন আর জানিও না জাহাজটা কোন দিকে, আমরা কোথায় কতদূরে।

আমি মিতির দিকে তাকিয়ে বললাম, “ভয় পেয়ো না। যখন টের পাবে তখন আমাদের উদ্ধার করতে আসবে।”

মিতি কিছু বলল না। আমি জানি বলার কিছু নাই। নিশ্চয়ই আমাদের উদ্ধার করতে আসবে কিন্তু এরকম ভয়ংকর বিপদের মাঝে পড়ে সবাইকে ব্যস্ত করার জন্য কেউ নিশ্চয়ই খুশী হবে না। আমি মামীর সামনে মুখ দেখাব কেমন করে? দোষ তো আমাদের না, দোষ যে জহিরের সেটা তো কেউ শুনতে চাইবে না। পৃথিবীতে যত কুৎসিত গালি আছে আমি মনে মনে জহিরকে সেই গালিগুলো দিতে লাগলাম।

আমি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিশাল একটা সমুদ্রে আমি আর মিতি হারিয়ে গেছি, ইচ্ছা হলো ডাক ছেড়ে কাঁদি।

আমরা কতক্ষণ এভাবে ভেসে গেছি জানি না। প্রথম প্রথম বৈঠা দিয়ে নৌকাটাকে এদিকে সেদিকে নিতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই বিশাল সমুদ্রে কোনো দিকেই কোনো পার্থক্য নেই তাই এদিক সেদিক যাওয়ার চেষ্টা করার কোনো অর্থ আছে কিনা আমি জানি না। শেষ পর্যন্ত আর কোনো চেষ্টা না করে চুপচাপ বসে রইলাম ।

ধীরে ধীরে সূর্য হেলে পড়তে লাগল এবং তখন আমার ভেতরে নতুন একটা আতঙ্ক এসে ভর করতে লাগল। দিনের আলো থাকতে থাকতে যদি আমাদের উদ্ধার করতে না পারে তখন কী হবে? তখন অন্ধকারে তারা আমাদের খুঁজে পাবে কেমন করে? আমাদের কি সারা রাত অন্ধকারে এই নৌকায় একা একা বসে থাকতে হবে?

এত অসহায় লাগছিল যে নিজেদের ভেতর কথাও বলতে ইচ্ছা করছিল না। আমরা দুজন বোটের দুই মাথায় বসে আছি। পানির দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করছিল না। মনে হচ্ছিল সমুদ্রের এই পানিটাই বুঝি আমাদের সর্বনাশের মূল।

আমি একসময় পানির নিচে তাকালাম এবং কেমন জানি চমকে উঠলাম। মনে হলো পানির নিচে কিছু একটা নড়ে উঠেছে। আমি ভালো করে তাকালাম এবং আমাকে দেখে মিতিও তাকাল এবং আমরা দুজন একসাথে চমকে উঠলাম। নিচে বিশাল একটা কোরাল বাগান। কোরালের গুঁড়গুলো কিলবিল করে নড়ছে। শুধু তাই না তার ভেতরে রঙিন মাছ। মামীর ল্যাপটপে আমি হুবহু এই রকম কোরাল রিফের ছবি দেখেছি। তাহলে কি আমরা সেই কোরাল রিফটা খুঁজে পেয়েছি, যেটা মামীদের টিম বহুদিন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?

আমার বুকে রক্ত ছলাৎ করে উঠল, আমি মিতির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, “কোরাল রিফ!”

মিতি মাথা নাড়ল। সে তার বুক থেকে নোট বইটা বের করে কুট কুট করে লিখল, যেটা সবাই খুঁজছে?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সেটা।”

এতক্ষণ খুবই মনমরা হয়েছিলাম হঠাৎ করে আমাদের মন ভালো হয়ে গেল। শরীরে জোর ফিরে পেলাম। আমি একটা বৈঠা নিয়ে কোরাল রিফের ভেতর দিয়ে আমাদের বোটটাকে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। এই কোরাল রিফটা কত বড়ো আমি দেখতে চাই।

আমি আর মিতি বোটটা প্রথমে চালাতে পারছিলাম না, এটা ডানে বামে ঘুরে যাচ্ছিল কিন্তু কিছুক্ষণের ভেতরেই আমরা মোটামুটি সোজা সামনের দিকে নিয়ে যেতে শিখে গেলাম। আমরা বোট চালাতে থাকি এবং যেতে থাকি কিন্তু কোরাল রিফ আর শেষ হয় না, কিছুক্ষণের মাঝে বুঝে গেলাম এটা বিশাল বড়ো। মনে হয় এর বুঝি শেষ নেই।

আমরা উপর থেকে দেখছি, যদি মুখে ডাইভারস গগলসটা পরে নিচে সুর্কেল করতে পারতাম তাহলে ঠিক করে দেখতে পারতাম। কিন্তু সাথে বড়ো মানুষ নাই, পানিতে নামার পর হঠাৎ যদি বোট থেকে আলাদা হয়ে যাই, আর ফিরে আসতে না পারি তাহলে আরও বড়ো বিপদ হয়ে যাবে। কাজেই মনে হচ্ছে পানির ওপর থেকেই আবছা আবছাভাবে কোরাল রিফটা দেখে খুশী থাকতে হবে।

কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের কপাল খুলে গেল, ক্যাচ করে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বোটটা কোথায় জানি আটকে গেল। আমরা বোটটা একটু নাড়াচাড়া করে দেখলাম, বোটটা নড়ল না। আমি মাথা নিচু করে তাকালাম, মনে হলো আবছা সাদা রঙের একটা ঢিবির মাঝে আটকে গেছে। এটা নিশ্চয়ই কোরাল স্কেলিটন। কোরালের শক্ত অংশ দিয়ে তৈরি, যেটা দিয়ে আস্ত দ্বীপ তৈরি হয়ে যায়।

যখন বুঝতে পারলাম বোটটা সহজে নড়বে না তখন আমি আমার ডাইভারস গগলস আর সুর্কেল মুখে লাগিয়ে সাবধানে পানিতে নামলাম, বোটের দড়িটা আমি হাতে ধরে রাখলাম যেন হঠাৎ করে বোটটা ছুটে গিয়ে আমাকে ফেলে রেখে মিতিকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে না যায়! পানিতে নামার পর আমি কোরাল রিফটা দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম, আমার সারা শরীরে আমি রীতিমতো শিহরন টের পেলাম! এত সুন্দর কিছু হতে পারে?

মিতিকে দেখাতে হবে তাই আমি বোটটা যেখানে আটকেছে সেটা পরীক্ষা করলাম, জায়গাটা একটা উইয়ের ঢিবির মতো আমি অবশ্য জীবনেও উইয়ের ঢিবি দেখি নাই, অনুমান করছি এরকম হবে। বোটটা যেখানে লেগেছে সেখানে খানিকটা জায়গা ভেঙে গুড়ো হয়ে গেছে, কোরাল স্কেলিটন খুব শক্ত না, সহজেই ভেঙে যায়। আমি ঘুরে দেখলাম, বোটের দড়িটা যথেষ্ট লম্বা, এই কোরাল স্কেলিটনের ঢিবিটার সাথে বোটটা বেঁধে রাখা যাবে, তাহলে এটা হঠাৎ করে ভেসে চলে যাবে না।

আমি বোটটা বেঁধে ফেললাম, তারপর উঠে মিতিকে বললাম, “মিতি, নিচে চললা, দেখবে।”

মিতি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করল, দুজনেই? আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “বোট বেঁধে দিয়েছি। ভেসে চলে যাবে না।”

আমি এবারে পায়ে ফিন দুটোও লাগিয়ে নিলাম, মিতিও আমার দেখাদেখি ডাইভারস গগলস, সর্কেলের সাথে পায়ে ফিন লাগিয়ে নিল। তারপর দুজন বোটের দুই পাশ থেকে পানিতে নামলাম। মিতি কিছুক্ষণ একেবারে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল, তারপর সাঁতরে আমার কাছে এসে আনন্দে আমাকে জাপটে ধরল। তারপর নিজেই একটু লজ্জা পেয়ে আমাকে ছেড়ে দিল!

কোরাল রিফটায় ছোটো বড়ো অসংখ্য মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের রংগুলো কী আশ্চর্য! তাদের মাঝে আমি আর মিতিও বড়ো বড়ো দুটি মাছের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। একটু পরে পরে মাথা ঘুরিয়ে দেখছিলাম, আমরা আবার আমাদের বোট থেকে বেশী দূরে চলে না যাই। কতক্ষণ পানির নিচে ছিলাম জানি না, একসময় মনে হলো একটু একটু শীত করছে, শুধু তাই আলোও কমে আসছে। আমরা তখন বোটে উঠে পড়লাম। টাওয়েল দিয়ে শরীর মুছে ভেজা কাপড় পালটে শুকনো কাপড় পরে নিলাম। তারপর ফ্লাস্ক থেকে গরম হট চকলেট বের করে দুজনে খেয়ে শরীরটা একটু গরম করে নিলাম।

ব্যাগের ভেতর চিপসের প্যাকেট আর বিস্কুট ছিল, প্রায় রাক্ষসের মতো খিদে পেয়েছে, সেগুলো খেয়ে পেটটা একটু শান্ত হলো। সূর্য অনেক নিচে নেমে এসেছে, কিছুক্ষণের ভেতর সূর্য ডুবে যাবে। চারিদিক তখন অন্ধকার হয়ে যাবে। এখনো কেউ আমাদের খুঁজতে আসে নাই। যদি কেউ কখনো আমাদের খুঁজে না পায় তখন কী হবে?

আমি আর মিতি পাশাপাশি বসে অপেক্ষা করতে থাকি। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজে বের করবে। নিশ্চয়ই বের করবে।

.

শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে যখন খুঁজে পেল তখন বেশ রাত। স্পীড বোটটা আমাদের ছোটো বোটটার পাশে থেমেছে, একটা খুব তীব্র আলোতে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। স্পীডবোটে কারা আছে দেখতে পাচ্ছি না, সেখান থেকে আমি মামীর গলা শুনতে পেলাম। একেবারে বরফের মতো ঠান্ডা গলায় বললেন, “টুলু, মিতিকে নিয়ে উঠে আয়।”

আমি মিতিকে আগে উঠতে দিলাম। আমি তার পিছু পিছু উঠে এলাম। আমি মামীর গলা শুনতে পেলাম, এবারে আগের থেকেও শীতল এবং আগের থেকেও ভয়ংকর! মামী হিংস্র গলায় বললেন, “টুলু, আমি অসম্ভব বিরক্ত হয়েছি তোদের এরকম দায়িত্বহীন কাজের জন্য। শুধু তোদের জন্য এই জাহাজের প্রত্যেকটা মানুষের অনেক বড়ো ধকল সহ্য করতে হয়েছে।”

আমি দুর্বল গলায় বললাম, “মামী–”

মামী প্রচণ্ড জোরে ধমক দিলেন, “চুপ কর। কথা বলবি না।”

আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মামী আমাদের অসংখ্যবার বকুনী দিয়েছেন, সেই বকুনীগুলো ছিল আদর করে, ঠাট্টা করে, কিন্তু জীবনেও এরকম গলায় কথা বলেন নাই। আমার মনে হলো আমার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসবে। আমি অনেক কষ্টে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখলাম।

“একজন নরম গলায় বলল, “থাক নীরা। এখন থাক–”

মামী কঠিন গলায় বললেন, “না থাকবে না। আমি বাচ্চাদের আনতে চেয়েছি বলে আমাদের টিম পারমিশন দিয়েছে। সেই বাচ্চার যদি এতটুকু দায়িত্বজ্ঞান না থাকে যে পুরো টিমের সবাইকে সব কাজ ফেলে পাগলের মতো পুরো রাত তাদের সমুদ্রে খুঁজে বেড়াতে হয় তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি সেটা গ্রহণ করতে পারি না। এটা আমার ব্যর্থতা—”

মামী কখনো এরকম কঠিন কঠিন ভাষায় কথা বলেন না, অসম্ভব রেগে আছেন বলে এই ভাষায় কথা বলছেন। প্রচণ্ড একধরনের কষ্টে আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল। আমি আরেকবার চেষ্টা করলাম, বললাম, “মামী। কী হয়েছে শুনো–”

“না। আমি শুনব না। কী কারণে একটা অঘটন ঘটেছে সেটার ব্যাখ্যা শুনে কোনো লাভ নাই। অঘটন না ঘটলে অনেক লাভ।”

হঠাৎ করে আমার বুকের ভেতর এত কষ্ট হলো যে আমার মনে হলো কিছুতেই বুঝি আর কিছু আসে যায় না। মনে হতে লাগল আমার বুঝি বেঁচে থাকারও কোনো দরকার নেই। আমাদের এতটুকু দোষ নেই কিন্তু পুরো দোষটুকু আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে। কেউ জানতেও চাইল না আসলে কী হয়েছে। তীব্র অভিমানে আমার বুকটা ভেঙে গেল।

সবাই মিলে যে কোরাল রিফটা খুঁজে বেড়াচ্ছে আমরা যে সেটা খুঁজে পেয়েছি সেটাও আমি আর বলতে উৎসাহ পেলাম না। স্পীডবোটের এক কোনায় মাথা নিচু করে বসে রইলাম।

স্পীডবোটের সামনে হঠাৎ একজন চিৎকার করে বলল, “এই মেয়েটি কী লিখেছে কাগজে?”

আমি বুঝলাম মিতি তার নোট বইয়ে কিছু লিখেছে।

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কী লিখেছে?”

“লিখেছে লিখেছে–” মানুষটা তার কথা শেষ করতে পারল না, প্রায় আর্তনাদের মতো করে বলল, “লিখেছে এরা দুজন কোরাল রিফটা খুঁজে পেয়েছে–এটাই সেই কোরাল রিফ”

মনে হলো স্পীডবোটের ভেতর বুঝি একটা বজ্রপাত হলো–সবাই পাথরের মতো নিঃশব্দ হয়ে গেল।

মামী আমার কাছে এগিয়ে এলেন, আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “সত্যি? টুলু সত্যি?”

আমি কোনো কথা বললাম না, আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি বের হয়ে এলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *