মনোয়ারার গাল ফুলে একটা বিশ্ৰী কাণ্ড হয়েছে।
সারা দিন কিছুই মুখে দেন নি। ব্যথায় ছটফট করেছেন। ব্যথা কমানোর কোনো ওষুধ কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না।
সবচে মুশকিল হয়েছে হোসেন সাহেবের। তাঁকে দেখামাত্র মনোয়ারার রাগ চড়ে যাচ্ছে। যা মনে আসছে, তাই বলছেন। হোসেন সাহেব অনেকক্ষণ সহ্য করলেন। কিন্তু এক সময় স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁর ধৈর্য্যচ্যুতি হল। তিনি থমথমে মুখে বললেন, আমার উপর রাগ করছ, কেন? তোমার দাঁতব্যথা তো আমি তৈরি করিনি। সে-রকম কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
মনোয়ারা চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, আমার সামনে থেকে যাও তো। শুধু শুধু ভ্যাজভ্যাজ করবে না।
যাবিটা কোথায়?
যেখানে ইচ্ছা যাও। শুধু চোখের সামনে থাকবে না।
আই সি। .
কী, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
যাচ্ছি, শেষে আফসোস করবে কিন্তু।
হোসেন সাহেব কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। নীলু কাপড় ইন্ত্রি করছিল, তাকে গিয়ে বললেন, চললাম মা। নীলু আশ্চর্য হয়ে বলল, কোথায় চললেন? তিনি তার জবাব দিলেন না। অনেক সময় নিয়ে হ্যাণ্ডব্যাগ গোছালেন এবং এক সময় সত্যি সত্যি বেরিয়ে গেলেন।
নীলু খুব একটা বিচলিত হল না। হোসেন সাহেব প্রায়ই এ রকম গৃহত্যাগ করেন, ঘণ্টা দু-এক রাস্তায় ঘোরাঘুরি করেন এবং এক সময় বাড়ি ফিরে আসেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, হোসেন সাহেবের গৃহত্যাগের কিছুক্ষণের ভেতরই মনোয়ারার দাঁতের ব্যথার আরাম হল। তিনি এক কাপ লেবু-চা এবং দু স্নাইস রুটি খেলেন। রাতের বেলা কী রান্না হচ্ছে খোঁজ নিলেন, তারপর শাহানার সঙ্গে ছোটখাটো একটা ঝগড়া বাধিয়ে বসলেন। ঝগড়া বাধানোর ইচ্ছা তাঁর ছিল না। তিনি বেশ স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোদের রেজাল্ট বেরুতে এত দেরি হচ্ছে কেন?
শাহানা গম্ভীর গলায় বলল, আমি কী করে বলব। এত দেরি হচ্ছে কেন।
মনোয়ারা অবাক হয়ে বললেন, তুই এমন ক্যাটক্যাট করে কথা বলছিস কেন? একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম, আর ছ্যাৎ করে উঠলি? তোর সঙ্গে কি কথাও বলা যাবে না?
শাহানা থমথমে মুখে তাকাল। তিনি তীক্ষ্ণ কষ্ঠে বললেন, তোর তেল বেশি হয়েছে। কাজকর্ম নেই তো, শুধু বসে বসে খাওয়া। বসে-বসে খেলে এমন তেল হয়ে যায়।
এ-রকম বাজে করে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে না, মা।
বাজে করে কথা বলব না?
না।
কেন? তুই কি রানী ভিকটোরিয়া?
হ্যাঁ, আমি রানী ভিকটোরিয়া।
চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। মুখে-মুখে কথা।
শাহানা নিঃশব্দে উঠে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল, এবং দরজা বন্ধ করে দিল। শাহানার দরজা বন্ধ করা একটা ভয়াবহ ব্যাপার, সহজে এ দরজা সে খুলবে না। ক্রমাগত দুদিন দু রাত দরজা বন্ধ রাখার রেকর্ড তার আছে। এ দরজা কবে খুলবে কে জানে।
মনোয়ারা কিছুক্ষণ কাঁদলেন, তারপর নিজের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লেন।
নীলু বড়ো অস্বস্তির মধ্যে পড়ল। এ বাড়ির সবার এখন মেজাজ খারাপ যাচ্ছে। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে রাগোরাগি। নীলুর নিজের মন-মেজাজও ভালো না। এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে তার ভালো লাগে না। কিন্তু মাথা ঘামাতে হয়, এক-এক করে সবার রাগ ভাঙাতে হয়। ভালো লাগে না।
সংসারে অভাব-অনটন বাড়ছে। অনেক চেষ্টা করেও কিছু করা যাচ্ছে না। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের লোনের টাকা কাটতে শুরু করেছে। বাড়িভাড়া বেড়েছে এক শ টাকা। নীলুর ধারণা ছিল, খুব সহজেই রফিকের চাকরি হয়ে যাবে। ধারণা ঠিক হয় নি। রফিকের কিছুই হচ্ছে না। সপ্তাহে দু-তিনটা করে ইন্টারভ্যু দিয়ে হাসিমুখে ঘরে ফিরছে, ভাবী, একেবারে মেরেকেটে দিয়েছি।
তাই নাকি?
ইয়েস। স্মার্টলি সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম! যেখানে হাসার দরকার সেখানে মৃদু হাসলাম। যেখানে গভীর হওয়ার দরকার সেখানে গম্ভীর হলাম।
পেরেছ সবকিছু?
এইট্টি পারসেন্ট পেরেছি। যেগুলি পারিনি, সেগুলি পারার কথা নয়।
চাকরি হবে বলছ?
এক জনের হলেও আমার হবে।
বল কি!
দ্যাটস রাইট। এখন চট করে চা-সিগ্রেট খাওয়াও। আমাকে খুশি রাখার চেষ্টা কর। ভবিষ্যতে লাভ হবে। বেতনের দিন ভালোমন্দ কিছু পেয়েও যেতে পার।
শেষ পর্যন্ত অবশ্যি কিছুই হয় না। রফিক নতুন কোনো ইন্টারভুর জন্যে তৈরি হয়। নীলুর বড়ো মায়া লাগে। মনোয়ারা রাগারগি করেন, দুনিয়াসুদ্ধ লোকের চাকরি হয়, তোর হয় না কেন?
হবে। আমারো হবে।
কবে সেটা?
ভেরি সুন। কোনো এক সুপ্রভাতে দেখবে রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠি এসে হাজির?
আমি আর দেখে যেতে পারব না।
এখনো তো পাঁচ মাস হয় নি। পাশ করেছি, এর মধ্যে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন?
যারা হয় না পাঁচ মাসে, তার হয় না পাঁচ বছরে।
চিঠি অবশ্যি একটা আসে রফিকের। রেজিস্ট্রি ডাকে নয়-সাধারণ ডাকে। মনসুর আলি কলেজের প্রিন্সিপ্যালের চিঠি। ইতিহাসের প্রভাষক পদে নিয়োগপত্র। যেতে হবে বরিশালের কোনো এক গ্রামে।
নীলু জিজ্ঞেস করল, যাবে নাকি?
যাব না মানে? অফ কোর্স যাব।
থাকতে পারবে গ্রামে?
খুব পারব। গ্রামের ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বিসিএস-এর জন্য সিরিয়াস এপ্রিপারেশন নিয়ে নেব। দেখবে ফার্স্ট-সেকেন্ড কিছু একটা হয়ে বসে আছি।
রফিক মহা উৎসাহে বরিশাল চলে গেল। এবং এক সপ্তাহের মধ্যে মুখ অন্ধকার করে ফিরে এল। শফিক অবাক হয়ে বলল, চলে এলি কেন? রফিক বিরক্ত হয়ে বলল, আরে দূর, যত ফালতু ব্যাপার! অলরেডি সেখানে একটা ভালো কলেজ আছে। রেষারেষি করে আরেকটা কলেজ দিয়েছে। না। আছে মাস্টার, না আছে ছাত্র। এগার জন টীচার আছে, এরা গত পাঁচ মাস ধরে বেতন পাচ্ছে না।
বলিস কি।
আমি যাওয়ামাত্র প্রিন্সিপ্যাল আমার জন্যে একটা জায়গীরের ব্যবস্থা করে ফেলল। নাইনে পড়ে এক মেয়ে, তাকে পড়াতে হবে। তার বিনিময়ে থাকা-খাওয়া। চিন্তা কর অবস্থা।
শফিক কিছু বলল না। রফিক শুকনো মুখে বলল, বুলে থাকতাম সেখানেই, কিন্তু মেয়ের বাবার কথাবার্তা যেন কেমন-কেমন।
কেমন–কেমন মানে?
ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় মেয়ে বিয়ে দিতে চায় আমার কাছে।
বলিস কি!
হ্যাঁ। ভদ্রলোক প্রথম প্রথম আমাকে ভাই বলত, তারপর বলা শুরু করল-আপনি আমার ছেলের মতো।
নীলু বলল, মেয়েটি দেখতে কেমন?
দেখতে ভালোই। বরিশালের মেয়েরা খুব সুন্দর হয়। হাসছ কেন তুমি ভাবী? এর মধ্যে হাসির কিছু নেই। এটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার।
বিয়ের ভয়েই পালিয়ে এসেছ?
সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা ভালো লাগে না।
তুমি ওদের বলে এসেছি তো, নাকি না-বলে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এসেছে?
রফিক কোনো উত্তর দিল না। পরবর্তী বেশ কিছুদিন কাটাল গম্ভীর হয়ে। নীলু ঠাট্টা-টাট্টা করবার চেষ্টা করল, কী রফিক, বরিশাল-কন্যার জন্যে মন খারাপ নাকি?
একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে কী সব ঠাট্টা কর, ভালো লাগে না।
মেয়েটির দিকে দরদ একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছে।
স্টপ ইট ভাবী। প্লীজ।
বিসিএস পরীক্ষাও রফিকের ভালো হল না। ইংরেজি এবং ইতিহাস দুটার কোনোটাতেই নাকি পাশ মার্ক থাকবে না। রফিকের ধারণা, এগজামিনররা খাতা দেখে হাসাহাসি করবে। হোসেন সাহেব বললেন, এতটা খারাপ হল কেন?
বোগাস সব কোশ্চেন করেছে, খারাপ হবে না?
বিসিএস-এ বোগাস প্রশ্ন করবে। কেন?
করলে তুমি কী করবে বল? সব মাথা-খারাপের দল। ইতিহাসের প্রশ্ন পড়লে মনে হয় জিওগ্রাফির কোশ্চেন।
বলিস কি?
বিশ্বাস না হলে তুমি পড়ে দেখ।
পরীক্ষা খারাপ দিয়ে রফিক খুবই মুষড়ে পড়ল। সে ধরেই নিয়েছিল, ভালো করবে। বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কও কমে গেল নাশতা খেয়ে বেরিয়ে যায়, রাত দশটা—এগারটায় ফেরে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই রেগে যায়। কথাবার্তা যা হয় নীলুর সঙ্গেই। তাও সব দিন নয়, যেদিন মেজাজ ভালো থাকে সেদিন।
নীলু বুঝতে পারে, রফিক হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করেছে। এটা কাটিয়ে তোলার জন্যে তার কিছু করা উচিত, কিন্তু সে কী করবে বুঝতে পারে না। আগে মাসের মধ্যে বেশ কয়েক বার রফিক টাকা চাইত। এখন আর চাচ্ছে না। চাইতে লজ্জা পাচ্ছে বোধহয়! দিন দশেক আগে হঠাৎ করে চাইল, ভাবী, তোমার গোপন সঞ্চয় থেকে কিছু দিতে পারবে?
কত?
সামান্য কিছু, ধর পঞ্চাশ।
নীলু এক শ টাকা এনে দিল।
গোটাটা দিলে নাকি ভাবী?
হুঁ, দিলাম।
থ্যাংকস। মেনি থ্যাংকস।
আমাকে থ্যাংকস্ কেন? তোমার ভাইকে দাও। আমি তো তার ধনেই পোদারি করছি।
ভাইয়াকেও থ্যাংকস। আমি ভাবী, সব লিখে রাখছি। ভেরি সুন তোমাদের সব পয়সা ফেরত দেব, উইথ ইন্টারেস্ট।
ঠিক আছে, দিও।
মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই একটা কিছু হবে।
তাই নাকি?
সেভেন্টি পারসেন্ট পসিবিলিটি। জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সে বলেছে।–আপনার মত ইয়াং এ্যাকটিভ ম্যানদেরই এখন দরকার। নিউ ব্লাড। নিউ আইডিয়া।
বেতন কেমন?
ফ্যানটাস্টিক বেতন। বিদেশী কোম্পানি।
তোমার ভাইয়েরটাও তো বিদেশী কোম্পানি। বেতন তো এমন কিছু না।
কোম্পানিতে কোম্পানিতে বেশিকম আছে ভাবী।
তোমাদেরটা খুব রমরমা কোম্পানি বুঝি?
খুবই রমরমা। গাড়ি এসে দিয়ে যাবে, নিয়ে যাবে।
বল কি!
কোম্পানির নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে। গ্ৰী বেড রুম। দেখলে মাথা ঘুরে যাবে।
ফ্ল্যাট দেখে এসেছ?
না, আমি দেখি নি। ঐ অফিসের অন্য অফিসারদের সঙ্গে আলাপ হল। সবাই বেশ মাইডিয়ার।
তাই নাকি?
হুঁ। বেশ কয়েক জন মহিলা আছেন। বড়ো বড়ো পোস্টে! বুঝলে ভাবী, মেয়েদের জন্যে আজকাল চাকরির খুব সুবিধা। তুমি যদি চেষ্টা কর, উইদিন টুমানথাস একটা কিছু জুটিয়ে ফেলতে পারবে।
সত্যি।
ইউ বেট। বি. এ. পাশ আছ। দেখতে–শুনতেও মোটামুটি খারাপ না! চলে যাও।
চলে যায় মানে?
ডানাকাটা পরী তুমি নও ভাবী। এ-রকম কোনো মিসকলো পসন থাকা উচি৩ না। তবে দেখতে খারাপও না।
নীলু হেসে ফেলল। রফিক সিগারেট ধরিয়ে উৎসাহের সঙ্গে বলল, আমার কথা শোন ভাবী, চাকরির চেষ্টা কর। এই যুগে একার রোজগারে কিছু হয় না। দু জনে মিলে হাল ধরা।
তোমার ভাই পছন্দ করবে না।
এর মধ্যে পছন্দ-অপছন্দের কিছু নেই। কোশ্চেন অব সারভাইভেল।
চাকরির ব্যাপার নিয়ে অনেক দিন থেকেই নীলু ভাবছে। বন্যা গত মাসে এসেছিল। তাকে এক সময় বলেই ফেলেছে, তুই বলেছিলি আমার জন্যে একটা ব্যবস্থা করে দিবি। চাকরি জুটিয়ে দিবি। মনে আছে?
মনে থাকবে না কেন? করতে চাস?
হুঁ। কী রকম চাকরি?
মোটামুটি ধরনের একটা কিছু, তোকে তো আর ফস করে ক্লাস ওয়ান অফিসার বানিয়ে ফেলবে না।
কেরানির চাকরি?
অসুবিধা আছে? দেড়-দু হাজার টাকা পাবি সব মিলিয়ে। এই বাজারে এটাই-বা মন্দ কী? কারবি? তাহলে আগামী সোমবার আয় আমার অফিসে। আমি কথা বলে রাখব।
কার সঙ্গে কথা বলবি?
লোক আছে। তুই আয় তো।
নীলু সোমবারে যেতে পারেনি। বুধবারে সত্যি সত্যি গিয়ে উপস্থিত। বন্যা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিল। হাসিমুখে বলল, তোর এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে হাতে দেবার ব্যবস্থা করতে না পারলে আমার নাম বন্যা নয়।
বলিস কি তুই!
মামাকে তোর কথা বলে রেখেছি। সার্টিফিকেটগুলি এনেছিস?
না।
বললাম না। সার্টিফিকেটগুলি সব আনতে?
এখন গিয়ে নিয়ে আসব?
আচ্ছা থাক, পরে হলেও চলবে।
মতিঝিলের এমন একটি অফিসে তারা ঢুকল যে, নীলুর বুক কাঁপতে শুরু করল। রিসিপশনে উগ্র ধরনের সাজ-করা ভারি সুন্দরী একটি মেয়ে। ঝক ঝক তকতক করছে চারদিক।
এইটাই নাকি অফিস?
হুঁ, কেন, পছন্দ হচ্ছে না?
নীলু কিছু বলল না। বন্যা বলল, চল, মামার সঙ্গে তোকে পরিচয় করিয়ে দিই। মুখ এমন শুকনো করে রেখেছিস কেন?
নীলু ফিসফিস করে বলল, এখানে আমার চাকরি হবে না।
বুঝলি কী করে হবে না?
আমার মন বলছে হবে না। কিছু কিছু জিনিস। আমি টের পাই। সিক্সথ সেন্স।
রাখি তোর সিক্সথ সেন্স।
বন্যার মামা তেমন কোনো উৎসাহ দেখালেন না। দুএকটা ছোটখাট প্রশ্ন করলেন–কিবে পাস করেছেন? এর আগে কোথাও চাকরি করেছেন? টাইপিং জানা আছে কিংবা শর্টহ্যাণ্ড? বাসা কোথায়? এমন কিছু জটিল প্রশ্ন নয়, কিন্তু উত্তর দিতে গিয়ে নীলুর কথা জড়িয়ে যেতে লাগল এবং এক বান্ন মনে হল, না এলেই ভালো ছিল।
ভদ্রলোক তাদের কফি খেতে বললেন। প্রাইভেট ব্যবসার নানা সমস্যার কথা বললেন এবং এক সময় টেলিফোন নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দুটি মেয়ে বসে আছে তাঁর সামনে, এটা তাঁর মনেই রইল না। নীলু ফিস-ফিস করে বন্যাকে বলল, আমরা কি চলে যাব? বন্যা ইশারায় তাকে বসতে বলল। সবচে যে জিনিসটি নীলুর কাছে আশ্চর্যজনক মনে হল, তা হচ্ছে-বিন্যার সঙ্গে এই ভদ্রলোকের তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। বন্যা নিজেও কেমন যেন মিইয়ে আছে। নীলু লক্ষ করল, তাদের দু জনের মধ্যে কথাবার্তা প্রায় কিছুই হয় নি। এমন এক জন অল্প পরিচিত মানুষের কাছে বন্যা তাকে এতটা ভরসা দিয়ে কেন নিয়ে এসেছে, কে জানে! নীলুর বেশ মন খারাপ হল।
টেলিফোনে ভদ্রলোক প্রায় এক ঘণ্টা কথা বললেন। খুব জরুরি টেলিফোন বোধহয়। কারণ কথা শেষ করেই তিনি বললেন, আমি আজ একটু ব্যস্ত। অর্থাৎ উঠতে বলা হচ্ছে। বন্যা শুকনো মুখে বলল, একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেন মামা। চাকরির ওর খুব দরকার। রাগ হবার মতো কথা। নীলুর চাকরির এমন কিছু দরকার নেই। কিন্তু বন্যা এমনভাবে কথাটা বলল, যেন নীলু ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে আছে।
ভদ্রলোক নিরাসক্ত গলায় বললেন, আমাদের এখানে কোনো ওপেনিং নেই। ভবিষ্যতে হবে, এ-রকম আশাও নেই। তবে আমার কাছে পাটিকুলার্স রেখে যান, আমি দু-এক জনকে বলে দেখব।
ও কিন্তু মামা অত্যন্ত ভালো মেয়ে।
ভালো মেয়েদের অফিসে দরকার নেই, অফিসে দরকার এফিশিয়েন্ট মেয়ে।
ও খুব এফিশিয়েন্ট।
বুঝলে কী করে? উনি তো এর আগে অফিসে কোনো কাজ করেন নি।
মামা, আপনি একটু দেখবেন।
নিশ্চয়ই দেখব। নাম-ঠিকানা এবং একটা বায়োড়াটা আপনি আমার সেক্রেটারির কাছে দিয়ে যান।
নীলুর এসব করার কিছুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বন্যা এমন আগ্রহ নিয়ে এসেছে, তাকে না বলতে খারাপ লাগল। সে এমন ভাব করছে যেন বায়োডাটা লিখে দিলেই তার চাকরি হয়ে যাবে। এমন ছেলেমানুষও থাকে এই যুগে!
নীলু বাড়ি ফিরল খুব মন খারাপ করে। এতটা মন খারাপ হবে সে নিজে বুঝতে পারে নি। সে বোধহয় ধরেই নিয়েছিল চাকরিটা হবে। নানা রকম পরিকল্পনাও তার ছিল। প্রতি মাসে মাকে কিছু টাকা পাঠাবে। বেতন পাবার সঙ্গে সঙ্গেই সে মানি অর্ডার করবে। যত দিন মা বেচে থাকবেন তত দিনই পাঠানো হবে। এ বাড়ির কারোর কিছু বলার থাকবে না। তার নিজের টাকা। দু একটা শখের জিনিস কিনবে। একটা টিভি। একটা ফ্রিজ। একটা হারমোনিয়াম। গানের দিকে তার খুব ঝোঁক ছিল। তার বাবারও ছিল। বাবাই দু, মেয়েকে গান শিখিয়েছিলেন। বাবা মারা যাবার পর কোথায় সব ভেসে গেল!
কী চমৎকার গানের গলা ছিল বিলু আপার! বাবা সব সময় বলতেন, আমার এই মেয়ে গান গেয়ে পাগল করে দেবে সবাইকে। কোথায় গেল গান, কোথায় কি!
নীলু তার বোনের কথা কখনো ভাবতে চায় না। ওটা যেন একটা দুঃস্বপ্ন। কোনোকালে তারা যেন কোনো বোন ছিল না। বিলু নামের কাউকে সে চেনে না। কিন্তু তবু একেক সময় এমন পরিষ্কারভাবে বিলু আপার মুখ মনে আসে।–আদুরে, স্নিগ্ধ একটা মুখ! যেন সে বলছে, কিরে নীলু, রোদে ঘুরে তোর মুখটা রাঙা হয়ে আছে। দেখি, বস তো আমার পাশে। নীলু প্রায়ই ভাবে, এত মায়াবতী একটি মানুষ কী করে হয়! কী দুঃখী মেয়েই না ছিল আপা, অথচ কী সুখী—সুখী চেহারা! গভীর দুঃখের কিছুমাত্র ছাপ ছিল না বিলু আপার চোখে। আনন্দ উজ্জ্বল হাসি-হাসি দুটি চোখ।
শফিক সাধারণত রাত আটটার মধ্যে এসে পড়ে। সাড়ে আটটা বাজছে, এখনো তার ফেরার নাম নেই। হোসেন সাহেবও ফেরেন নি। কোথায় ঘুরছেন কে জানে। এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাঁর রাগ থাকে না। আজ আছে। রাগ পড়ে নি শাহানারও। এখনো তার ঘরের দরজা বন্ধ। মনোয়ার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করেছেন, লাভ হয় নি।
নীলু। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দিন খারাপ করেছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভালোই হবে। গুমোট হয়ে আছে। নীলু আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
টুনী জেগে উঠেছে। তার হাসি শোনা যাচ্ছে। অদ্ভুত স্বভাব হয়েছে মেয়েটার, ঘুম ভেঙে হাসতে শুরু করে। পৃথিবীর সব বাচ্চারাই জেগে উঠে কাঁদে। শুধু টুনীই বোধহয় হাসে। দূর থেকে টুনীর হাসি শুনতে এমন মজা লাগছে।
বৌমা।
নীলু চমকে তাকাল। মনোয়ারা টুনীকে কোলে নিয়ে বারান্দায় চলে ५q6अCछ्न्म।
একটু হলেই তো সর্বনাশ হত! কী যে কাণ্ড কর তুমি!
কী হয়েছে মা?
খাটের কিনারে শুইয়ে রেখেছি। নিজে নিজে উঠে বসেছে, একটু হলেই পড়ত। এত অসাবধান হলে চলে?
নীলু কিছু বলল না।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছ কেন?
দিন খারাপ করেছে মা।
ঘরে আস। দরজা-জানালা বন্ধ করা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার দরকারটা কী?
জানালা বন্ধ করবার আগেই হঠাৎ করে প্রচণ্ড বাতাস বইতে শুরু করল। রীতিমতো ঝড়। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। মনোয়ারা টুনীকে কোলে নিয়ে অকারণেই ছোটাছুটি করতে লাগলেন। মোমবাতি খুঁজে পাওয়া গেল না। হারিকেনে তেল নেই। প্রচণ্ড শব্দে বাথরুমের জানালার একটা কাঁচ ভাঙল। মনোয়ারা আকাশ ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, বৌমা, তোমার কি কোনো কালেও বুদ্ধিসুদ্ধি হবে না। ঝড়-বাদলার দিনে হাতের কাছে হারিকেন রাখবে ঠিকঠাক করে–এক ফোঁটা তেল নেই হারিকেনে। এসব কী?
টুনীও ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। নীলু বলল, ওকে আমার কাছে দিন মা।
মনোয়ারা রেগে গেলেন, অন্ধকারে হাত থেকে ফেলবে। ও থাকুক আমার কাছে। তুমি তোমার কাজ কর।
করার মতো কোনো কাজ নেই। নীলু তার ঘরে চলে গেল। ঝামািঝম শব্দে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। গাঢ় অন্ধকার চারদিকে। এক-এক বার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর আলো হয়ে উঠছে চারদিক। পরীক্ষণেই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ছে। মনে হয় এই কাছেই কোথাও যেন পড়ল। চুপচাপ বসে থাকতে ভালোই
লাগছে নীলুর।
ভাবী।
নীলু। তাকাল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে শাহানা এগিয়ে আসছে। নীলু হাসিমুখে বলল, রাগ কমেছে নাকি শাহানা?
শাহানা জবাব দিল না। নীলু হালকা গলায় বলল, ওদের কী অবস্থা, কে জানে!
কাদের?
বাবা আর রফিক।
তোমার বরের কথা তো কিছু বল নি। নাকি ভাইয়াকে নিয়ে তুমি ভাব না?
শাহানা উঠে এল খাটের উপর। মৃদুস্বরে বলল, হঠাৎ করে এমন দিন খারাপ হল কীভাবে? যা ভয় লাগছে।
ভয়ের কী আছে?
টুনী কাঁদছে। মনোয়ারা তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করছেন। কোনো লাভ হচ্ছে না। শাহানা বলল, ভাবী, তুমি টুনীকে নিয়ে এস তো।
তুমি নিয়ে এস, আমার কাছে দেবেন না।
আমি যাচ্ছিটাচ্ছি না।
নীলু হালকা গলায় বলল, এত ছোট ব্যাপার নিয়ে এ-রকম রাগ করেচ কেউ? জীবনে রাগ করার মতো অনেক বড়ো বড়ো ব্যাপার ঘটবে।
শাহানা মৃদুস্বরে বলল, হঠাৎ করে আমার কেমন যেন রাগ ধরে যায়। আর এ-রকম করব না।
মোমবাতি কোথায় আছে জান?
জানি। আমার টেবিলের ড্রয়ারে।
একটা মোমবাতি মার ঘরে দিয়ে আস না। টুনী অন্ধকার দেখে কাঁদছে।
আমি পারব না ভাবী। তুমি যাও!
নীলু। মোমবাতি জ্বলিয়ে মনোয়ারার ঘরে রেখে এল। টুনীর কান্না থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। হাত-পা ছুঁড়ে খেলা জুড়ে দিল। নীলুর ইচ্ছা হল বলে, ওকে আমার কাছে একটু দিন না মা। কিন্তু সে কিছু বলল না। মনোয়ারা দেবে না।
বৌমা, কটা বাজল?
নটা পঁচিশ।
এ তো মহাচিন্তায় পড়লাম। কোথায় আটকা পড়ল। ওরা কে জানে?
এসে পড়বে মা। আপনার দাঁতব্যথা কমেছে?
কমেছে।
কিছু খাবেন আপনি? দুপুরে তো কিছু খান নি।
না, কিছু খাব না। তুমি দেখ, শাহানার রাগ ভাঙাতে পার। কিনা। যন্ত্রণা হয়েছে একটা!
ওর রাগ তেঙেছে মা। আমার ঘরে বসে আছে।
মনোয়ারা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
দরজায় ধাক্কা পড়ছে। নীলু দরজা খুলে দেখল, আনিস দাঁড়িয়ে আছে। কাকভেজা হয়ে গেছে সে।
ব্যাপার কী আনিস?
অবস্থা কাহিল ভাবী। চা খাওয়াতে পারবেন?
তা পারব। শুকনো কাপড় কিছু পরে আস।
শুকনো কাপড় আমার কিছু নেই ভাবী। ঘর ভেসে গেছে। একটা গামছা-টামছা কিছু দিন।
এস ভেতরে। শাহানাকে বলছি, কাপড় দেবে তোমাকে!
নীলু চা বানিয়ে বসার ঘরে ঢুকে দেখল, অন্ধকারে আনিস এবং শাহানা পাশাপাশি বসে আছে। ওদের বসার ভঙ্গিটার মধ্যেই কিছু একটা ছিল যা দেখে হঠাৎ নীলু একটু চমকাল। ভালোবাসাবাসির কোনো ব্যাপার নেই তো? শাহানার বয়স খুবই কম। এই সময়ে মন তরল থাকে। সবাইকেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
দরজায় আবার ধাক্কা পড়ছে। হোসেন সাহেবের গলা পাওয়া যাচ্ছে–ও বৌমা, বৌমা।
রাত দশটার মধ্যে ভিজতে ভিজতে সবাই এসে উপস্থিত হল। তুমুল বর্ষণ হল সারা রাত। আনিস থেকে গেল এ বাড়িতে। সোফার উপর বিছানা হল তার, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইল সে।
জেগে রইল শাহানাও। সমস্ত রাত তার মন কেমন করতে লাগল।
আজ প্রথম বারের মতো সে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছে। আনিস ভাই যখন গামছায় তার মাথার ভেজা চুল মুছছে, তখন হঠাৎ তার ইচ্ছা করছিল গামছাটা তার কাছ থেকে নিয়ে নিতে। তার বলতে ইচ্ছা করছিল, আনিস ভাই, মাথাটা নিচু করুন, আমি মুছিয়ে দিচ্ছি। কেন এ-রকম মনে হল? এ-রকম মনে হওয়া নিশ্চয়ই খুব খারাপ। খুব খারাপ মেয়েদেরই নিশ্চয়ই এ-রকম মনে হয়। কিন্তু সে খারাপ মেয়ে হতে চায় না। সে খুব একটা ভালো মেয়ে হতে চায়।
শাহানা চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে কাঁদতে শুরু করল। সে অন্ধকারে একা ঘুমুতে ভয় পাবে বলেই মনোয়ারা আজ তার সঙ্গে ঘুমিয়েছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, কী হয়েছে রে শাহানা, কাঁদছিস কেন? শাহানা ধরা গলায় বলল, জানি না কেন।
অদ্ভুত এক ধরনের কষ্ট হচ্ছে শাহানার। এ ধরনের কষ্ট পৃথিবীতে আছে, তা তার জানা ছিল না। মনোয়ারা শাহানার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলেন। তিনি কি কিছু বুঝতে পারছেন? মায়েরা অনেক কিছু বুঝে ফেলে।
শাহানা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে মা।