১০. মতির কথা

মতির কথা গোড়া হইতে বলি।

রাজপুত্র প্রবীরকে স্বামী হিসাবে পাইয়া মতির সুখের সীমা নাই। গ্রাম ছাড়িতে চোখে জল আসে, অজানা ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়া একটা রহস্যময় ভীতি বুক চাপিয়া ধরে, তবু আহ্বাদে মেয়েটা মনে মনে যেন গলিয়া গেল। এইটুকু বয়সে এমন উপভোগ্য মনকেমন-করা! স্টিমার ছাড়িলে জেটিতে দাঁড়ানো পরাণকে ঘোমটার ফাঁকে দেখিতে দেখিতে ভিতরটা যখন তোলপাড় করিতে লাগিল আর চোখের জল সব ঝাপসা হইয়া গেল, রাজপুত্র প্রবীর পাশে বসিয়া আছে অনুভব করার মধ্যেই তখন কী উত্তেজনা, কী আশ্বাস!

কলিকাতায় পৌঁছিয়া আগে সে যে এবার কুমুদের খোজেই কলিকাতা আসিয়াছিল, মতি সে বিষয়ে কিছুই বলিল না। প্রথম এই শহরটা দেখাইয়া কুমুদ তাহাকে থ বানাইয়া দিতে চায় বুঝিয়া মতি যথোচিত থ-ই বনিয়া গেল। একটু বোকার মতো কথা বলিতে লাগিল মতি, এটা কী ওটা কী জিজ্ঞাসা করিয়া কুমুদকে অস্থির ও আনন্দিত করিয়া তুলিল-কী অনিন্দ মতির বানানো উচ্ছ্বাস!

কোথায় উঠব আমরা?

হোটেলে উঠব। কদিন হোটেলে থেকে, তোমায় সব দেখিয়ে শুনিয়া বাসা-টাসা যদি করি তো করব, নয় তো বেড়াতে চলে যাব কোথাও। কেমন?

তাই হোক। যা-খুশি ব্যবস্থা করুক কুমুদ, মতির কোনো আপত্তি নাই! নতুন বউ সে, স্বামী এখন যেমন রাখিবে তেমনি থাকিবে, তারপর সংসার পাতিয়া দিলে তখন শুরু হইবে গৃহিণীপনা। এখন তাহার কিসের দায়িত্ব, কিসের ভাবনা? নিজের সৌভাগ্যে মতি পুলকিত হইয়া থাকে। গায়ের কোন মেয়ে তার মতো এমন ভাগ্যবতী মনের মতো বরের সঙ্গে তো বিবাহ হয়ই না, শ্বশুরবাড়ি গিয়া প্রথমে ঘোমটা দিয়া ঘরের কোণে বসিয়া থাকে, তারপর বাসন মাজে, ঘর লেপে, রান্না করে আর গালাগালি খায়! কত ভয়, কত ভাবনা, কত তারা পরাধীন। আর তার নিজের পছন্দ-করা বর, বিবাহের পরেই এমন স্ফূর্তি করিয়া বেড়ানো, সব বিষয়ে স্বাধীনতা। হোটেলের ঘরখানা মতির পছন্দই হইল। রাস্তার দিকে দুটি জানালা আছে, ঝুঁকিলে দুদিকে অনেক দূর অবধি দেখা যায়। ঠিক সামনে একটা ছোট গলি সোজা গিয়া পড়িয়াছে ওদিকের বড় রাস্তায়! সেখানে ট্রাম চলে। কুমুদের সাহায্যে বিছানা পাতিয়া মতি ঘর গুছাইয়া ফেলিল! হোটেলের চাকরদের দিয়া দুটি একটি দরকারি জিনিস আনানো হইল। তারপর মতি সাবান মাখিয়া স্নান করিয়া আসিল, স্নানের ঘরের বন্ধ দরজার সামনে কুমুদের প্রহরী হইয়া দাঁড়াইয়া থাকা কী মজার ব্যাপার! হোটেলের বুড়ো উড়িয়া বামুন,–বেঁটে লিকলিকে বাদামি রঙের মানুষ সে, কিন্তু কথায় কাজে চটপটে ঘরে ভাত দিয়া গেল। নিজের থালায় ভাতের পরিমাণ দেখিয়া মতি বলিল, মাগো, কত ভাত দিয়েছে দ্যাখো আমাকে আমার মতো সাতটার কুলিয়ে যাবে যে!

মেসে হোটেলে এমনি দেয়।

নষ্ট হবে তো? ডেকে বলো না তুলে নিয়ে যাক?

হোক না নষ্ট, আমাদের কী?

তবু মতির মন খুঁতখুঁত করিতে লাগিল। আহা, ভাত যে লক্ষ্মী, ভাত কি নষ্ট করতে আছে। খাইতে খাইতে আবার সে আপসোস করিল। কুমুদ বলিল, তুমি তো আচ্ছা মেয়ে দেখছি। একটা তুচ্ছ কথা নিয়ে এত ভাবছ? খাত নষ্ট হবে তাও হোটেলের ভাত, এ আবার মানুষের মনে আসে?

খাওয়াদাওয়ার পর সিগারেট টানিতে টানিতে কুমুদ ঘুমাইয়া পড়িল। জ্বলন্ত সিগারেটটা তার প্রসারিত হাত হইতে মেঝেতে খসিয়া পড়িলে মতি সেটা কুড়াইয়া নিভাইয়া তুলিয়া রাখিল। অর্ধেকও পোড়ে নাই সিগারেটটা, ঘুম হইতে উঠিয়া কুমুদ আবার খাইতে পরিবে। তারপর গাড়ির কষ্টে মতিরও ঘুম আসিতে লাগিল। চৌকিতে কুমুদ এমনভাবে গা এলাইয়া শুইয়াছে যে পাশে জায়গা খুব কম। নতুন বউ সে, বরের পাশে শোয়াই তো নিয়ম, না? নিয়ম বজায় রাখিতে না পারিয়া মতি দুঃখিত মনে মেঝেতে একটা কম্বল বিছাইয়া শুইয়া পড়িল। তিনটার সময় ঘুম ভাঙল কুমুদের। মুখহাত ধুইয়া জামা-কাপড় পরিয়া সে মতিকে ডাকিয়া তুলিল। বলিল, দরজা দিয়ে বসো, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। কটা জিনিস কিনেই ফিরে আসব।

কুমুদ বাহির হইয়া গেলে মতি দরজায় খিল বন্ধ করিল। মিনিট পনেরো পরেই দরজায় ঘা পড়িতে খিল খুলিয়া সে বলিল, এর মধ্যে ফিরে এলে?

কিন্তু ও তো কুমুদ নয় কুড়ি-বাইশ বছরের চশমা-পরা একটা ছেলে মতিকে দেখিয়া সেও যেন অবাক হইয়া গেল। ঘরের ভিতর একবার চোখ বুলাইয়া আনিয়া বলিল, এঘরে আমার একজন বন্ধু থাকত। ঘর ছেড়ে চলে গেছে জানতাম না।

মতি কিছু বলিতে পারিল না।

পরশু দিন দেখে গেলাম আছে, এর মধ্যে সে গেল কোথায়?

কেমন যেন চোখ ছেলেটার, কেমন তাকানোর ভঙ্গি। মতির ইচ্ছা হইতেছিল দরজাটা দড়াম করিয়া বন্ধ করিয়া দেয়। কিন্তু ওর বন্ধু যদি এ-ঘর থেকে উধাও হইয়া গিয়া থাকে, দু-চারটে কথা জিজ্ঞাসা করিবার অধিকার হয়তো ওর আছে। মতির ভয় করিতেছিল, জড়ানো গলায় সে বলিল, আমরা মোটে আজ সকালে এসেছি।

এমন সময়ে হাঠাত ম্যানেজার আসিয়া হাজির। বোধ হয় পাশেই কোন মেম্বারের ঘরে ছিল।

কাকে খোঁজেন? এদিকে আসুন মশায়, সরে আসুন।

মতি দরজাটা এবার বন্ধ করিল। শুনিল ছেলেটা বলিতেছে, শ্যামলবাবুকে খুঁজছি।

শ্যামলবাবুকে? শ্যামলবাবু তেতলায় গেছেন একুশ লম্বরে। তার ঘরেই তো দেখলাম মশায় আপনাকে এতক্ষণ? ব্যাপারখানা কী বলুন দেখি সারা দুপুরটা শ্যামলবাবুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এখানে তাকে খুঁজতে এসেছেন?

মতি বুঝিতে পারিল, আশেপাশের ঘর হইতে দু-চারজন লোক বাহির হইয়া আসিয়াছে। একটা গোলমাল আরম্ভ হইয়া গেল। রুদ্ধ ঘরের ভিতরে মতি লজ্জায় ভয়ে কাঠ হইয়া রহিল। কোন দেশী ব্যাপার এসব? কী মতলব ছিল ছেলেটার? এ কেমন জায়গায় কুমুদ তাহাকে একা ফেলিয়া রাখিয়া গেল?

একটু পরে গোলমালটা দূরে সরিয়া গিয়া অস্পষ্ট হইয়া আসিল, তারপর একেবারে থামিয়া গেল। ঘন্টাখানেক পরে দরজায় আবার ঘা পড়িতে মতির বুকটা ধড়াস করিয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিল, কে? হোটেলের চাকর জানিতে আসিয়াছে কিছু দরকার আছে কি-না। মতি বলেল, না কোনো দরকার নেই!

কুমুদ ফিরিয়া আসিল সন্ধ্যার পর।

কুমুদকে ব্যাপারটা বলিবার সময় মতির ভয় করিতে লাগিল যে, শুনিয়া হয়তো সে রাগিয়া অনর্থ করবে, খুন করিয়াই ফেলিতে চাহিবে সেই দুৰ্বত্ত ছেলেটাকে। কুমুদ কিন্তু শুধু একটু হাসিল। বলিল, ছেলেটা তো চালাক কম নয়!

চালাক পাজি নয়, শয়তান, নয়, লক্ষ্মীছাড়া নয়, শুধু চালাক?

এমন ভয় করছিল আমার! মতি বলিল।

কুমুদ বলিল, কিসের ভয়? খেয়ে তো ফেলত না। এত লোক রয়েছে চারিদিকে, ছল করে তোমার সঙ্গে কথা বলে যাওয়ার বেশি সাহস কী আর হত ছোড়ার। হয়তো কার সঙ্গে বাজি-টাজি রেখেছিল, তোমার সঙ্গে কথা বলবে। অল্পবয়সের পাগলামি ওসব।

হয়তো তাই, তবু কুমুদ কেন তাহা বরদাস্ত করিবে? মনে মনে মতি বড় ক্ষুন্ন হইয়া গেল। শশী হইলে হয়তো এরকম হাসিয়া উড়াইয়া দিত না ব্যাপারটা, ছড়ি হাতে ছোঁড়াটাকে ঘা-কতক বসাইয়া দিয়া আসিত। মতির হঠাৎ মনে হয় কুমুদের এ যেন ভীরুতা। ব্যাপারটা সে হালকা করিয়া চাপা দিতে চায়, তার কারণ আর কিছুই নয়, যদি গুরুতর হইয়া ওঠে, যদি তার কোনো অসুবিধা বা ক্ষতি হয়, কুমুদের এই আশঙ্কা আছে। ছোট ছোট অপমান কি কুমুদ তবে হাঙ্গামার ভয়ে গ্রাহ্য করে না? এ বিষয়ে সে কি গাওদিয়ার কীর্তি নিয়োগীর মতো?

মতির জন্য কুমুদ একজোড়া জুতা কিনিয়া আনিয়াছিল। বিবাহের পর মতিকে এই তার প্রথম উপহার।

একে একে এই হোটেলেই সাতদিন কাটিয়া গেল! এর মধ্যে মতিকে কুমুদ একদিন দেখাইল সিনেমা আর একদিন লইয়া গেল গঙ্গাতীরে বেড়াইতে। কত কী সে বলিয়াছিল। ঘুরিয়া ঘুরিয়া শহর দেখাইবে, আজ সিনেমা, কাল থিয়েটার করিয়া বেড়াইবে, গৃহকোণে মুখোমুখি বসিয়া থাকিবে কপোত-কপোতীর মতো। সেসব সংকল্প কোথায় গেল কুমুদের? তার অপরিমেয় আলস্যপ্রিয়তায় মতি অবাক হইয়া থাকে। কোথাও লইয়া যাওয়া দূরে থাক, মতির সঙ্গে খেলা করিতেও তার যেন পরিশ্রম হয়, অমন কোমল হালকা দেহ মতির, তবু কুমুদের বুকে তার এতটুকু ক্ষণস্থায়ী আশ্রয়! শুইয়া বসিয়া হাই তুলিয়া বই পড়ে কুমুদ, আলস্যের মধুর আরামে দিনে একটিন সিগারেট খায়, বা করিয়া মতিকে খানিক আদর করিয়া জানালা দিয়া পুরা দশ মিনিট চাহিয়া থাকে বাহিরে, অন্যমনে শিস দেয়। বলে, চা করো মতি।

মতি বলে, কোথাও নিয়ে যাবে না আমাকে আজ?

কুমুদ বলে, কোথায় যাবে? কী আর দেখবার আছে কলকাতায়? একদিন থিয়েটার দেখো, ব্যস, তাতেই অরুচি। তারপর চলো না একদিন বেরিয়ে পড়ি, পুরী ওয়ালটেয়ার সব বেড়িয়ে আসি? এখানে অদ্রলোক থাকে? কলকাতা কি শহর, এ তো একটা বাজার রাস্তায় বেরুলে মাথা ঘোরে।

কবে যাবে পুরী-টুরীর দিকে?

যাব যাব, ব্যস্ত কী। কুমুদ হাসে, আচল ধরিয়া বিব্রত মতিকে কাছে টানিয়া বলে, একটা ঘরে শুধু আমরা দুজনে কেমন আছি! ভালো লাগে না মতি?

হুঁ, লাগে।

তারপর ভয়ে ভয়ে–যা বই পড় সারাদিন।

তুমিও পড়বে মতি, তুমিও পড়বে।

ব্যস, তারপর এক পেয়ালা চা খাইয়া কুমুদ আবার চিত। আবেগ-মূৰ্ছনায় একটা সম্পূর্ণতা মতির কখনও পাইবার উপায় নাই। খানিক অন্যমনস্ক চিন্তা, এক পরিচ্ছেদ বই, দশ মিনিট মতি-এ যেন পালা করা খেলা কুমুদের, বৈচিত্র্য সৃষ্টি!

ভালোবাসার এত ক্রমশ মতির ভালো লাগে না। তবে ছোট-বড় সেবার সুযোগ মতিকে কুমুদ অফুরন্তই দিয়াছে। মতি চা করে, খাবার দেয়, তৃষ্ণার জল যোগায়। দাড়ি কামানোর আয়োজন করে, ক্ষুর ধুইয়া সরঞ্জাম গুছাইয়া রাখে, কুমুদের টেরিও মতিই কাটে, দিয়াশলাই সিগারেট প্রভৃতি যোগান দেয়। আরও কত কী মতি করে।

একদিন কুমুদ বলিয়াছিল, পা-টা কামড়াচ্ছে বউ।

কেন?

এমনি কামড়াচ্ছে। কেউ যদি একটু টিপে দিত।

মতি আরক্ত মুখে বলিয়াছিল, চাকরকে ডেকে বলো না?

হোটেলের চাকর পা টিপবে? তবেই হয়েছে। দাও না, তুমিই একটু দাও না আস্তে আস্তে!

সেই হইতে দুপুরবেলা কুমুদের ঘুম পাইলে মতি তার পাও টিপিয়া দেয়। শহরের শব্দে তখন স্থানীয় একটু স্তব্ধতার চাপ পড়ে। এ সময়টা মতির মন ভারি খারাপ হইয়া যায়। কলের মতো এক হাতে কুমুদের পা টিপিতে টিপিতে অন্য হাতে তাহাকে চোখ মুছিয়া ফেলিতে হয়। নিজেকে কেমন বন্দিনী মনে হয় মতির। মনে হয়, কুমুদ তাকে চিরকাল এই ছোট ঘরটিতে পা-টেপানোর জন্য আটকাইয়া রাখিবে, তার খেলার সাথি কেহ থাকিবে না, আপনার কেহ থাকিবে না, মাঠ ও আকাশ আর জীবনে পড়িবে না চোখে, বালিমাটির নরম গেঁয়ো পথে আর সে পরিবে না হাঁটিতে।

সাত দিন। মোটে সাত দিন যে এখানে কাটিয়াছে মতির!

তারপর একটি দুটি করিয়া কুমুদের বন্ধুরা আসিতে আরম্ভ করে। প্রতিদিন ইহাদের সংখ্যা বাড়িতে থাকে। আশ্চর্য সব বন্ধু কুমুদের। এরকম লোক মতি জন্মে কখনও দ্যাখে নাই। আসিয়া দরজায় ঘা দেয়। কুমুদ বলে, কে?

আমি।

কুমুদ বলে, দরজা খুলে দাও মতি।

দরজা খুলিয়া মতি ঘরের কোণে সরিয়া যায়। সরাসরি ঘরে ঢুকিয়া কুমুদের বন্ধু বিছানায় বসে। প্রথমবার আসিয়া থাকিলে মতির দিকে চোখ পড়ায় খানিকক্ষণ তাকাইয়া থাকে।

কোথায় পেলি?

বন্ধু শুইয়া থাকিয়াই জবাব দেয়, বউ!

কুমুদু হাসে। ফস করিয়া দিয়াশলাই জ্বলিয়া সিগারেট ধরায়।

আর এক দফা মতিকে দেখিয়া বলে, চা করো দিকি বউদি। চিনি কম, কড়া লিকার।

এবং পরক্ষণেই কুমুদের সঙ্গে গল্পে মশগুল হইয়া যায়। মতি গায়ের মেয়ে, বন্ধু যে লোক ভালো নয় সে তা বুঝিতে পারে। তবু আর যে সে একবারও তার দিকে ভালো করিয়া চাহিয়া দ্যাখে না, মতি তাতে আশ্চর্য হইয়া যায়। ভাবে, কুমুদের বন্ধু লোক যেমন হোক ভদ্রতা জানে। এমন ভাব দেখাইতে পারে যেন এঘরে শুধু বন্ধু আছে, বন্ধুর বউ নাই!

সকলে এরকম নয়। মতির সঙ্গে আলাপ করিবার চেষ্টাও কেউ কেউ করে। কেউ ঘরে ঢুকিয়াই একেবারে বহুদিনের পরিচিত হইয়া উঠিতে চায়, কেউ ধীরে ধীরে পরিচয় গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করে,-কারো কথাবার্ত হয় কৃত্রিম, কারো সহজ ও সরল। বইটই দু-একটা উপহারও মতি পায়। এইসব বন্ধুদের মধ্যে একজনেক মতির বড় ভালো লাগিল, মোটা জোরালো চেহারা আর শক্ত কালো একঝাড় গোপ থাকা সত্ত্বেও। তার নাম বনবিহারী।

জাকিয়া বসিয়া প্রথমেই সে ঠাট্টা করিয়া বলিল, খুকি বলব, না বউদি বলব?

মতি বলিল, খুকি কেন বলবেন?

বনবিহারী যেন অবাক হইয়া গেল। কুমুদকে বলিল, কই রে, তেমন গেঁয়ো তো নয়। কথা বলার জন্যে সাধাসাধি করতে হল কই?

কুমুদ বলিল, লজ্জা একটু ভেঙেছে।

আরও কত কী ভাঙবে।—বলিয়া বনবিহারী হাসিল। মতিকে বলিল, অনেক দিনের বন্ধু আমি কুমুদের। বয়সের হিসাব ধরলে আমি তোমার ভাসুর হব, কিন্তু বয়সের কথাটা মনে রাখতে বউ আমাকে বারণ করেছে।

মতির লজ্জাও করে, হাসিও আসে।

বনবিহারী বলিল, তোমাকে হোটেলে এনে তুলেছে শুনে মাথাটা কাটিয়ে দিতে এসেছিলাম। আমার স্ত্রীও এই ইচ্ছা অনুমোদন করেছেন। এখন তোমার অনুমতি পেলেই কাজটা করে ফেলতে পারি। দেব নাকি মাথাটা ফাটিয়ে?

কৌতুকে মতির চোখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। বনবিহারী বলিল, বিজ্ঞাপনের ছবি একে পেট চালাই, বাড়ি বলতে একটা ঘর আর একফোঁটা একটু বারান্দা। তবু সেটা বাড়ি, হোটেল তো নয়। এ রাস্কেলের তাও খেয়াল থাকে না।

অসময়ে আসিয়া বনবিহারী অনেকক্ষণ বসিয়া গেল। আগাগোড়া কত হাসির কথাই যে সে বলিল! শেষের দিকে চাপিয়া রাখিতে না পারিয়া মতি মাঝে মাঝে শব্দ করিয়াই হাসিয়া উঠিতে লাগিল। কুমুদকে একদিন সন্ত্রীক তার বাড়িতে যাওয়ার হুকুম দিয়া বনবিহার সেদিন বিদায় হইল।

কুমুদ বলিল, হালকা লোক, ফাঁপা। পয়সার জন্য আর্টকে জবাই করছে। ছবি আঁকার অদ্ভুত প্রতিভা ছিল, নাম হওয়া পর্যন্ত লড়াই করিতে পারল না। মাসিকের পট বিজ্ঞাপনের ছবি একে দিন কাটায়। সেজন্য আপসোসও নেই, এমন অপদার্থ।

বনবিহারীর অপরাধটা মতি বুঝিতে পারে না। বুঝিতে ইচ্ছা হয় না। কথার অন্তরালে স্নেহ ছিল বনবিহারীর, সমবেদনা ছিল। গ্রাম ছাড়িয়া আত্মীয়পরিজনের সঙ্গ ছাড়িয়া ছেলেমানুষ সে যে একটা অপরিচিত অদ্ভুত জগতে আসিয়া পড়িয়ছে, বনবিহারী ছাড়া কুমুদের আর কোনো বন্ধু বোধহয় তাহার খেয়ালও করে নাই। দুদিন পরে সকালবেলা বনবিহারী আবার আসিল। না-যাওয়ার অন্য অনেক অনুযোগ দিয়া বলিল, চলো কুমুদ, এখুনি যাই আজ, ওখানেই খাওয়াদাওয়া করবি।

কুমুদ হাই তুলিয়া বলিল, যাব যাব, এত ব্যস্ত কেন?

বনবিহারীর মুখখানা এবার একটু গম্ভীর দেখাইল। সুর ভারী করিয়া সে বলিল, তোর ব্যাপারটা কী বল তো কুমুদ? আমাদের ওদিকে যাস না আজ ছ মাস, যেতে বলায় আজ হাই উঠছে? সাতদিন তোর দেখা না পেলে আগে আমাদের ভাবনা হত। হঠাৎ যে ত্যাগ করলি আমাদের?

ত্যাগ? ত্যাগের স্বভাব আমার নেই। এমনি হাই উঠছে–শ্রান্তিতে।

সারাদিন শুয়ে থেকে শ্রান্তি! আর যেতে বলব না কুমুদ।

কী দরকার? কাল-পরশুর মধ্যে একদিন হশ করে হাজির হব দেখিস।

বনবিহার এবার হাসিল, হয়তো তার আগেই জয়া হশ কওে এসে হাজির হবে এখানে। কী শাস্তিটা তখন যে তোকে দেবে ভেবে পাচ্ছি না। খুকিকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে একমাস হয়তো লুকিয়ে রেখে দেবে।

বনবিহারীর মুখে খুকি শব্দটা মতির ভালোই লাগে। তবু সে আবদার করিয়া বলিল, আবার খুকি কেন?

বনবিহারী চলিয়া গেলে কুমুদকে বলিল, চলো না যাই একদিন? অমন করে বলছেন!

কুমুদ মৃদু হাসিয়া বলিল, উনি কি আর বলছেন মতি, ওর মুখ দিয়া আর একজন বলাচ্ছেন তার নাম জয়া, উনার তিনি পত্নী।–যাব, ইতিমধ্যে একদিন যাব।

এদিকে ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যাবেলা কুমুদের সমাগত বন্ধুর সংখ্যা বাড়িতে থাকে, রীতিমতো আড্ডা বসে। চৌকিতে কুলায় না। চৌকি কাত করিয়া রাখিয়া মেঝেতে বিছানা ও চাদর বিছাইয়া সকলে বসে। কেহ অনর্গল কথা বলে, কেহ থাকিয়া থাকিয়া প্রবল শব্দ করিয়া হাসে, কেহ গুনগুন করিয়া ভাঁজে গানের সুর। দেয়ালে ঠেস দিযা শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত কেহ শুধু ঝিমায়। বিড়ি, সিগারেট আর চুরুটের ধোঁয়ায় ঘরের বাতাস ভারী হইয়া ওঠে।

তাস খেলা হয়। টাকা পয়সার আদান-প্রদান দেখিয়া মতি বুঝিতে পারে জুয়া খেলা হইতেছে।

মতির কান্না আসে। সহজভাবে সে নিশ্বাস ফেলিতে পারে না। লজ্জা করিতে কুমুদ তাহাকে বারণ করিয়াছে, কুমুদের বন্ধুরা একজন দুজন করিয়া আসিলে মতির বেশি লজ্জা করেও না। এ তো তা নয়। যে ঘর ছাড়িয়া এক মিনিটের জন্য তাহার বাহিরে যাওয়ার উপায় নাই, একপাল বন্ধু জুটাইয়া সে ঘরে কুমুদ সন্ধ্যা হইতে রাত এগারোটা পর্যন্ত আড্ডা দেয়, হাজার লজ্জা না করিলেও যে চলে না।

মতি চা যোগায়। বিকালে স্টোভ ধরায়, রাত বারোটার আগে সে স্টোভ ঠাণ্ড হইবার সময় পায় না। বোধহয় কুমুদের বলা আছে, সন্ধ্যার বন্ধুরা মতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, চা পান প্রভৃতির প্রয়োজন পর্যন্ত কুমুদকে জানায়। চা করিয়া, পান সাজিয়াই মতির কর্তব্য শেষ, বিতরণ করিতে হয় না। এদিকের জানালায় গিয়া সে বসিয়া থাকে সমস্তক্ষণ। জানালার পাটগুলি ঘরের ভিতরে খোলে, তারই আড়ালে মতি একটু অন্তরাল পায়। ওইখানে মাঝে মাঝে মতির রোমাঞ্চ হয়। ভয়ে সে কাঁদিতেও পারে না, ঘরে এতগুলি মানুষ। রাগে দুঃখে অভিমানে পাখি হইয়া মতির গাওদিয়া উড়িয়া যাইতে সাধ হয়। ক্রমে রাত্রি বাড়ে। রাস্তার লোক চলাচল কমিয়া আসে, সরু গলিটার ওমাথায় ক্ষণিকের জন্য আলোকিত ট্রামগুলিকে আর যাইতে দেখা যায় না, তীব্র আলো নিভাইয়া পথের ও পাশের মনোহারি দোকানটি বন্ধ করা হয় ন আর দোকানটির ঠিক উপরের ঘরে মতিরই সমবয়সি একটি মেয়ে টেবিল চেয়ারে পড়া সাঙ্গ করিয়া শয়নের আয়োজন করে। দেখিয়া মতিরও ঘুম আসে।

বন্ধুরা চলিয়া গেলে কুমুদ বলে, আগে বিছানা পাতবে? নামিয়ে দেব চৌকিটা? না, খেয়ে নেবে আগে?

মতি সাড়া দেয় না! উঠিয়া কাছে যাইবে তাতেও কুমুদের আলস্য। বলে, শোনো, শুনে যাও। রাগ হল নাকি? আহা, শোনোই না।

বেশিক্ষণ অবাধ্য হওয়ার সাহস মতির হয় না। কাছে গিয়া কাঁদিতে থাকে, বলে, এত লোক ঘরে এলে আমি কেমন করে থাকি?

কুমুদ তাকে আদর করিয়া বলে, বন্ধুরা এলে কি তাড়িয়ে দিতে পারি মতি? ওরা তো জ্বালাতন করে না তোমাকে?

তখন মতি বলে যে কুমুদ তবে আর একটা ঘর ভাড়া নিক। কুমুদ বলে, ঘরের ভাড়া কি সহজ, অত টাকা কোথায়? মতি তখন জবাব দেয় টাকার যখন এমন অভাব, খুব সস্তায় ছোটখাটো একটা বাড়ি ভাড়া নিলেই হয়। এখানে আর ভালো লাগিতেছে না মতির। আর তাও যদি না হয় বন্ধুদের কারো বাড়ি গিয়া কুমুদ আড্ডা বসাক।

এত রাত পর্যন্ত তোমায় একা রেখে যাব? ভয় করবে না তোমার?

না ভয় করবে না। ঘরে খিল দিয়ে থাকব।

এবার আর কুমুদ এমন যুক্তি দেখায় না মতি যা খণ্ডন করিতে পারে। প্রথমেই মতিকে এমন সোহাগ করে যে সে অবশ, মন্ত্ৰমুগ্ধ হইয়া আসে। তারপর সে মতিকে বোঝায় বলে, ভেঙেচুরে গড়ে নেব বলিনি তোমাকে? বলিনি ঘর সংসার পেতে বসবার আশা কোরো না? সে তো সবাই করে, রাস্তায় মুটে থেকে মহারাজ পর্যন্ত। আমি তো সেইরকম নই মতি। নিয়ম মেনে চলতে হলে দুদিনে আমি মুষড়ে মরে যাব। ভেসে ভেসে বেড়াই, কাল কী হবে ভাবি না, যা ভালো লাগে তাই করি। আমার সঙ্গে থাকতে হলে কনেবউটি সেজে থাকলে চলবে কেন তোমার? বউ-মানুষ আমি, আমি এমন করে থাকব অমন করে থাকব,-এ ভাব যদি তোমার মনের মধ্যে থাকে, আমার সঙ্গে তোমার তবে বনবে না। আমি রোজগার করে আনব আর ঘরের কোণে বসে তুমি রাধবে, বাড়বে, ছেলেমেয়ে মানুষ করবে,-কবে তো বলেছি তোমাকে, তা হবার নয়। বউ তুমি নও, তুমি সাথি। অন্তত তাই তোমাকে হতে হবে। তোমার সম্বন্ধে সব বিষয়ে আমার যদি দায়িত্ব নিতে হয়, তুমি যদি ভার হয়ে থাকো আমার, তোমাকে না হলে আমার একটুও ভালো লাগবে না মতি। তোমার জন্য যদি আমাকে বদলে যেতে হয়, যেভাবে দিন কাটাতে চাই তা না পারি, কী করে তোমাকে তাহলে রাখব আমার সঙ্গে?

মতি সভয়ে বলে, ত্যাগ করবে আমাকে?

কুমুদ হাসিয়া তাহার গায়ে মাথায় হাত বুলায়, বলে, ভয় পেয়ো না, সব ঠিক হয়ে যাবে মতি। ভাবনার কী আছে? এক বচ্ছর আমার সঙ্গে থাকলে এমন বদলে যাবে যে, আমাকে আর বলে দিতে হবে না, যেখানে যে অবস্থাতে থাকো তাতেই মজা পাবে। অভ্যাস নেই কি না, তাই প্রথমটা অসুবিধা হচ্ছে। দুদিন পরে আর গ্রাহ্যও করবে না। তখন কী করব জানো? ওদের আসতে বারণ করে দেব।

কেন?

বেশিদিন আমার কিছু ভালো লাগে না মতি। অনেকদিন পরে কলকাতা এলাম, তাই একটু আড্ডা দিচ্ছি বিতৃষ্ণা জন্মাল বলে।

 

দিনদুই পরে বনবিহার একেবারে সস্ত্রীক আসিয়া হাজির হইল। জয়া একটু মোটা, তবে সুন্দরী। টকটকে রঙ, মুখখানা গোল, জমকালো চেহারা। চোখদুটি ঝকঝকে, ধারালো দৃষ্টি।

তুমি তো গেলে না, আমি ভাই তোমাকে তাই দেখতে এলাম। তোমার ব্যাপারটা কী কুমুদ? বিয়ে করে বউকে লুকিয়ে রাখলে? ওকে তো অন্তত পাঠালাম সাতবার, তবু কি একবার মনে পড়ল না জয়া বলে একটা জীব কৌতুহলে ফেটে পড়ছে? গা থেকে বউ এনেছ শুনে অবধি অবাক মেনেছি।

ধারালো চোখে জয়া মতিকে দেখিতে থাকে। বলে, কচি বলে কচি, এ যে ধাঁধা লাগানো কুমুদ আমার মেয়ে হলে ওকে যে ফ্রক পরিয়ে রাখতাম!–তাকায় দ্যাখো কেমন করে। এসো তো ভাই খুকি এদিকে, নেড়েচেড়ে দেখি।

বাজিয়ে দেখবে না? বনবিহারী বলিল।

কুমুদ বলিল, স্পিড একটু কমাও জয়া, ভড়কে যাবে। পুতুল তো নয়।

জয়া হাসিল, মায়া নাকি? শেষে মায়া করতেও শিখলে মতির দিকে চাহিয়া বলিল, এসো এদিকে, এখানে বোসো। প্রেজেন্ট কিন্তু আনিনি ভাই তোমার জন্যে, টাকায় কুলোল না। পরে কিনে দেব। খালি হাতেই ভাব করে যাই আজ।

সাধারণ একখানা শাড়ি পরনে, যেন দাসীর বেশ জয়ার বেশভূষা, কথাবার্তা ভাবভঙ্গি মতির কাছে অদ্ভুত ঠেকিতে লাগিল। কুমুদের নাম ধরিয়া ডাকে গুরুজনের মতো, অথচ কথা ফাজলামি করিয়া, এ কোনো-দেশী মেয়েমানুষ? প্রথম দেখাতেই জয়ার সম্বন্ধে মতির মনে একটা বিরুদ্ধভাবের সৃষ্টি হইয়া রহিল। কেমন একটা অদ্ভুত অনুকম্পার ভাব জয়ার, মতিকে দেখিয়া তার যেন হাস্যকর মনে হইতেছিল! ঘণ্টাখানেক বসিয়া জয়া চলিয়া গেল।

মতির মনে হইল, ঘরে যেন একঘণ্টা ধরিয়া ম্যাজিক হইতেছিল,–ভোজবাজি কী বলিল জয়া, কেন হাসিল, অর্ধেক সময় মতি তা বুঝিতেই পারে নাই, শুধু কুমুদ ও জয়ার মধ্যে যে নিবিড় অন্তরঙ্গতা আছে এটা টের পাইয়া বোধ করিয়াছে ঈর্ষা।

নাম ধরে ডাকলে যে তোমায়?

মতির প্রশ্নে কুমুদ কৌতুক বোধ করিলা আমার বন্ধু যে মতি, অনেক দিনের বন্ধু।

মতি অবাক। মেয়েমানুষ বন্ধু। খানিকক্ষণ স্তন্ধ থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, ও যে তোমার সঙ্গে ওরকম করছিল, ওর স্বামী রাগ করবে না?

কীরকম করছিল? কুমুদ জিজ্ঞাসা করিল।

মতি কথা বলিল না।

কুমুদ বলিল, তোমার মন তো বড় ছোট মতি।

একটু পরে মতির চোখ দিয়া জল পড়িতেছে দেখিয়া হঠাৎ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়া কুমুদ বাহির হইয়া গেল। বলিয়া গেল, ছিঁচকাদুনেও নও কম।

কুমুদের কছে এমন কঠিন কথা মতি আর শোনে নাই। স্বামীর প্রথম ভর্ৎসনায় মতির চোখের জল শুকাইয়া গেল।

 

ম্যানেজার একদিন টাকা চাহিয়া গেল।

মতি কুমুদের বাগ ও বাক্স প্যাটরা হাতড়াইয়া দেখিয়া বলিল, মোটে সাত টাকা আছে। টাকা বুঝি লুকিয়ে রেখেছ?

কুমুদ বলিল, আর টাকা কোথায় যে লুকিয়ে রাখব?

আর নেই? মতির মুখ শুকাইয়া গেল।

কুমুদ হাসিয়া বলিল, সাত টাকা বুঝি কম হল মতি?

কী হবে তবে? কোথায় পাবে টাকা? হোটেলে টাকা দেবে কী করে? ভীত চোখে চাহিয়া থাকে মতি, বলে, রোজ তুমি জুয়া খেলে টাকা হেরে যাও, কেন খ্যালো?

তাহার দুর্ভাবনার পরিণাম দেখিয়া কুমুদের যেন মজা লাগিল। পাশে বসাইয়া বলিল, আমার বউ হয়ে তুমি তুচ্ছ টাকার জন্য ভাবছ মতি? আজ সাত টাকা আছে, আজ তো চলে যাক, কালের ভাবনা কাল ভাবব। ব্যবস্থা একটা কিছু হয়ে যাবেই মতি, টাকার জন্য কখনও মানুষের বেঁচে থাকা আটকায় না।

উতলা মতি বলল, সাত টাকায় কী করে চলবে?

দিব্যি চলবে। দ্যাখোই না কী করে চলে? চিরকাল এমনি করে চালিয়ে এলাম, আমি জানি না? তুমি কেন ভাবছ? টাকার চিন্তা করার কথা তো তোমার নয়!

মতি তবু বলিল, হোটেলের টাকা দেবে কী করে? কাল যে দেবে বললে?

আবার ভাবে ওকথা। ঘ্যানঘ্যান করার স্বভাব গড়ে তুলো না মতি, গিনির মতো মুখ কোরো না। কাল যা দেব বলেছি কাল তার ভাবনা ভাবব, আজ কেন তুমি উতলা হয়ে উঠলে?

রাত্রে বন্ধুরা ফিরিয়া গেলে একমুঠা টাকাপয়সা কুমুদ বিছানায় ছড়াইয়া দিল। বলিল, দেখলে কোথা থেকে টাকা আসে? ভেবে তো তুমি মরে যাচ্ছিলে।

মতি বিষণ্ণভাবে বলিল, কালকে হেরে যাবে আবার। কী-ই-বাহবে এ একটা টাকায়!

সিগারেট ধরাইয়া কুমুদ কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে মতির দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে বলিল, এত অল্পবয়সে তোমার এত হিসাব হয়েছে আমি তা ভাবতে পারিনি মতি। টাকার দরকার তোমার তো এমন করে বুঝবার কথা নয়! ছেলেমানুষ তুমি, নিজের ফুর্তিতে থাকবে, কিসে কী হবে না হবে সে ভাবনা ভাবতে তোমার হবে বিরক্তি। তা নয়, টাকা কম পড়েছে বলে সারাদিন মুখ কালি হয়ে রইল। এত কচি ছিলে গাওদিয়ায়, এত পাকলে কখন? কিছুই যে সেখানে তুমি বুঝতে না মতি, যা বলতাম শিশুর মতো মেনে নিতে আর হা করে তাকিয়ে থাকতে মুখের দিকে? ঠকিয়েছিলে নাকি আমায়, ছেলেমানুষির ভান করে?

মতি জবাব দিতে পারে না, কুমুদের অভিযোগ ভালো করিয়া বুঝিতেও পারে না, তার শুধু কান্না আসে। ছেলেমানুষির ভান করিত? সে কি এখনো ছেলেমানুষ নয়? টাকা নাই তাই টাকার কথা ভাবিয়াছে, তাতেই কি মানুষের ছেলেমানুষি ঘুচিয়া যায়? পরদিন টাকা চাহিতে আসিয়া ম্যানেজার খালি হাতে ঘুরিয়া গেল। টাকা থাকিতেও কুমুদ তাকে টাকা দিল না কেন মতি বুঝিতে পারিল না, ভয়ে কিছু বলিল না।

দিন সাতেক পরে সকালবেলায় কুমুদ একটা অল্পদামি টিনের তোরঙ্গ কিনিয়া আনিল। মতিকে বলিল, জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও মতি, বাড়ি ঠিক করে এলাম, খেয়েদেয়ে বাড়িতে গিয়ে উঠব। এ শালার হোটেলে আর মন টিকছে না।

সদ্য-ক্রীত টিনের তোরঙ্গটিতে কিছুই ভরা হইল না। কুমুদ বলিল, ওটা খালি থাক মতি। বাকি জিনিস সমস্ত বাঁধিয়া-ছাদিয়া গুছাইয়া নেওয়া হইল। কেবল একটি ফরসা চাদর পাতা রহিল চৌকির উপরে, একটা বালিশও রহিল। আলনায় ঝুলানো রহিল ছেড়া একটা পাঞ্জাবি, একখানা পুরোনো কাপড় ও একটা গেঞ্জি। তারপর কুমুদ চাকরকে পাঠাইয়া দিল গাড়ি ডাকিতে।

খবর পাইয়া ম্যানেজার ছুটিয়া আসিল। বলিল, চললেন নাকি কুমুদবাবু?

কুমুদ বলিল, স্ত্রীকে রেখে আসতে যাচ্ছি বাপের বাড়ি, কাল ফিরব বিকেলের দিকে। জিনিসপত্র রইল, একটু নজর রাখবেন ঘরটার দিকে।

ম্যানেজার বলিল, টাকা দেবেন বলেছিলেন আজ?

কাল দেব। কাল নিশ্চয় পাবেন।

আশেপাশেই রহিল ম্যানেজার। গাড়ি আসিলে এবং জিনিসপত্র তোলা হইলে কুমুদ ঘরে তালা বন্ধ করিল। ঘরের মধ্যে নতুন তোরঙ্গ, চৌকির বিছানা ও আলনার জামাকাপড় দেখিয়া ম্যানেজার একটু আশ্বস্ত হইল।

গাড়িতে উঠিয়া মতির মুখে কথা সরে না। কুমুদ মৃদু হাসে। বলে, ভাবছ ম্যানেজারকে ঠকালাম? টাকা দিয়ে যাব মতি।

কাল আসবে?

কাল কি আর আসব, হাতে টাকা হলেই আসব। মিছামিছি গোলমাল করত টাকার জন্যে, তাই একটু কৌশল করলাম, নইলে কাউকে আমি ঠকাই না মতি, দু-চার মাসের মধ্যে টাকাটা একদিন ঠিক দিয়ে যাব।

ঘরঘর শব্দে গাড়ি চলে। কোথায় যাইতেছে তারা? আকাশ-পাতাল ভাবে মতি, কুমুদের কাছে থাকিয়া তার যেন বিপদের ভয় হয়, কুমুদ যেন ভয়ানক মানুষ। অনেকক্ষণ চলিয়া সরু একটা গলির মধ্যে ছোট একতলা একটা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াইল। একটু পরেই দরজা খুলিল বনবিহারী, জয়াও আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, মঙ্গলঘট স্থাপনের সময় পাইনি, বাড়িতে শাঁখ নেই, উলু দিতেও জানি না,-মাপ কোরো কুমুদ।

ছোট বাড়ি, পাশাপাশি দুখানা শয়নঘর, সামনে একরত্তি একটু রোয়াক ও ছোট উঠান, একপাশে রান্নাঘর এবং তার লাগাও পায়রার খোপের মতো একটি বাড়তি ঘর। উঠানে দাঁড়াইয়া মতিকে এদিক-ওদিক চাহিতে দেখিয়া জয়া বলিল, বাড়ি বুবি তোমার পছন্দ হচ্ছে না?

মতি দ্বিধাভাবে বলিল, মন্দ কী?

জয়া বলিল, যে তাড়াহুড়ো করে এলাম কাল বিকেলে ঘরদের এখনো সাফ পর্যন্ত করা হয়নি। যাক, দুজনে হাত চালালে সব ঠিক করে নিতেই আর কতক্ষণ। আমি এ ঘরখানা নিয়েছি, এ ঘরে জানালা বেশি আছে একটা, মোটা মানুষ একটু আলো-বাতাস নইলে হাপিয়ে উঠি। তোমার ঘরখানা একটু ছোট হল। তা হোক! তুমি মানুষটাও ছোট, নতুন সংসারে জিনিসপত্রও তোমার কম, এতেই তোমার কুলিয়ে যাবে।

বাড়িঘর সাফ হয় নাই বটে, নিজের ঘরখানা জয়া কিন্তু ইতিমধ্যে গুছাইয়া ফেলিয়াছে। জিনিসপত্র নেহাত কম নয় জয়ার, তবে সবই প্রায় কমদামি। জিনিসের চেয়ে ঘরের ছবিগুলিই মতির দৃষ্টি আকর্ষণ করিল বেশি। সব ছবি হাতে আঁকা, ছোট-বড়, বাধাআবাধা, ওয়াটার কালার, অয়েল পেন্টিংপ্রভৃতি রঙবেরঙের অসংখ্য ছবিতে চারিটা দেয়াল একরকম ঢাকিয়া গিয়াছে। খুব বড় একটা ছবি দেখিয়া মতি হঠাৎ লজ্জা পায়।

জয়া খিলখিল করিয়া হাসে, বলে আমার উর্বশী-সতিন ভাই। আকাশ থেকে নামছেন কি-না, বাতাসে তাই শাড়িখানা উড়ে দিয়া পেছনের মেঘ হয়েছে। একজন সাতশো টাকা দর দিয়েছে, ও হাকে হাজার। আমি বলি দিয়ে দাও না সাতশয়েই, সাতশো টাকা কি কম, আপদ বিদেয় হোক! আসলে ওর বেচবার ইচ্ছেই নেই!

মতি বলিল, মুখখানা আপনার মতো।

তাই তো হাজার টাকা দর হাঁকে!-জয়া হাসিল।

জয়ার সাহায্যে মতি ঘর গুছাইয়া ফেলিল। সামান্য জিনিস, জয়ার ঘরের সঙ্গে তুলনা করিয়া নিজের ঘরখানা মতির খালি খালি মনে হইতে লাগিল, খেলাঘরের মতো ঠেকিতে লাগিল। কিন্তু সেই দিন বিকালেই জিনিস আসিল। কোথা হইতে টাকা পাইল কুমুদ সেই জানে, হোটেলের পাওনা ফাকি দিক, কৃপণ সে নয়। টেবিল, চেয়ার, আলনা, বড় একটা তক্তপোশ আনিয়া সে ঘর বোঝাই করিয়া ফেলিল, নীল-শেড়-দেওয়া সুন্দর একটি টেবিলল্যাম্প ও মতির জন্য ভালো একখানা শাড়িও কিনিয়া আনিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *