১০. ভূমিকম্প আসলে কী?

দশম অধ্যায় – ভূমিকম্প আসলে কী? 

কল্পনা করুন, আপনি আপনার ঘরে চুপচাপ বসে আছেন, হয়তো কোনো বই পড়ছেন বা টেলিভিশন দেখছেন অথবা কম্পিউটারে গেমস খেলছেন। হঠাৎ করে ভীতিকর গুড় গুড় একটি শব্দ শুনতে পেলেন, এরপর পুরো ঘরটাই কাঁপতে শুরু করল। ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা বাতিগুলো উন্মত্তভাবে দুলতে শুরু করেছে, শো-কেসের তাকে সাজিয়ে রাখা জিনিসপত্রগুলো ছিটকে মাটিতে পড়ছে, ভয়ঙ্কর কম্পন ঘরের আসবাবপত্রগুলোকে ঝাঁকিয়ে মেঝের উপর ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে, আপনিও চেয়ার থেকে ছিটকে পড়লেন। দুই মিনিট বা আরো কিছু সময় পর সবকিছু আবার শান্ত হয়ে আসে এবং চারিদিকে শুধু নীরবতা; আতঙ্কিত কোনো শিশুর কান্নার আওয়াজ কিংবা কুকুরের ডাকে যে নীরবতা ভাঙে। আপনি নিজেকে মাটি থেকে ওঠালেন এবং ভাবলেন, আপনি কত ভাগ্যবান, পুরো বাড়িটাই ধসে পড়েনি আপনার উপর। খুব বড় কোনো ভূমিকম্পে সম্ভবত সেটাই হতে পারত। 

যখন আমি এই বইটি লিখতে শুরু করেছিলাম, ক্যারিবীয় দ্বীপ হাইতিতে আঘাত হেনেছিল ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী একটি ভূমিকম্প এবং এর রাজধানী, পোর্ট অ প্রিন্স শহরটি প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়েছিল। ধারণা করা হয় প্রায় দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল এই দুর্যোগে এবং বহু মানুষ, দরিদ্র অনাথ শিশুসহ, গৃহহীন হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে অথবা অস্থায়ী তাঁবুতে বাস করেছে। 

পরে যখন আমি বইটি সম্পাদনা করছিলাম, আরো একটি ভূমিকম্প, এমনকি আগেরটার চেয়েও শক্তিশালী, আঘাত হেনেছিল জাপানের উত্তর পূর্বাঞ্চলে সমুদ্রের নিচে। এটি দানবীয় আকারের ঢেউ সৃষ্টি করেছিল, একটি ‘সুনামি’, যা অকল্পনীয় ধ্বংসলীলার কারণ হয়েছিল যখন এটি জাপানের ভূখণ্ডে আঘাত হেনেছিল, হাজার মানুষকে হত আর লক্ষ মানুষকে গৃহহীন করে পুরো একটি শহর এটি ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ভয়ানক বিস্ফোরণেরও কারণ হয়েছিল, সুনামি-পূর্ব ভূমিকম্পের কারণে ইতোমধ্যে যা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। 

ভূমিকম্পগুলো এবং তাদের কারণে সৃষ্ট সুনামি, জাপানে প্রায়শই ঘটে [‘সুনামি’ শব্দটাই জাপানি ভাষা থেকে এসেছে], কিন্তু স্মরণকালের অতীতে দেশটি এমন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করেনি। দেশটির প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটির জন্য সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা হিসেবে এটি বর্ণনা করেছিলেন, পারমাণবিক বোমা যখন হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহর দুটি ধ্বংস করেছিল। সত্যি, ভূমিকম্প প্রায়শই ঘটে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, নিউজিল্যান্ডের শহর ক্রাইস্টচার্চকে ব্যাপক ধ্বংস আর প্রাণহানি সহ্য করতে হয়েছে একটি ভূমিকম্পের কারণে, যেটি ঘটেছিল জাপানের ভূমিকম্পটির মাত্র এক মাস আগে। এই তথাকথিত ‘রিং অব ফায়ার’ বা আগুনের বলয় নামে পরিচিত এলাকার মধ্যে পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যালিফোর্নিয়ার অধিকাংশ এলাকাও অন্তর্ভুক্ত, যেখানে ১৯০৬ সালে সান ফ্রান্সিসকো শহরের কুখ্যাত সেই ভূমিকম্পটি ঘটেছিল। অপেক্ষাকৃত বড় শহর লস এঞ্জেলেসও ঝুঁকির মধ্যে, কারণ এটিও কুখ্যাত সান আন্ড্রিয়াস ফল্টের উপর অবস্থিত। 

কোনো একটি ভূমিকম্পে, পুরো ভূখণ্ডটি আচরণ করে এমনভাবে যেন মনে হয় এটি তরল কিছু। এটি দেখতে সমুদ্রের মতো মনে হয়, যার উপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যায়। কোনো সমুদ্রের উপর যেমন ঢেউ বয়ে যায়, ভূমিকম্পে শক্ত আর শুষ্ক মাটির উপর দিয়ে তেমনি ঢেউ বয়ে যায়। সেটাই ভূমিকম্প। আপনি যদি মাটিতে শুয়ে থাকেন, আপনি সেই ঢেউগুলো দেখতে পাবেন না কারণ আপনি তার খুব কাছে অবস্থান করছেন, তাদের তুলনায় আপনি খুব ক্ষুদ্র। আপনি শুধু পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে ও নড়ে উঠতে দেখবেন। 

কিছুক্ষণের মধ্যে ভূমিকম্প আসলে কী এবং একটি ফল্ট লাইন বলতে আমরা কী বুঝি, যেমন—সান আন্ড্রিয়াস ফল্ট এবং পৃথিবীর অন্য জায়গায় একই ধরনের ফল্টগুলো আসলে কী, সেটি আমি ব্যাখ্যা করব, কিন্তু প্ৰথমে ভূমিকম্প সংক্রান্ত কিছু পুরাণের দিকে তাকানো যাক। 

ভূমিকম্প পুরাণ 

আমরা শুরু করব একজোড়া পুরাণ-কাহিনি দিয়ে যা হয়তো বিশেষ কোনো ভূমিকম্প ঘিরে গড়ে উঠেছিল, যে ভূমিকম্পগুলো আসলেই ঘটেছিল ইতিহাসের কোনো একটি মুহূর্তে। 

ইহুদি একটি কিংবদন্তিতে, সডোম ও গোমোরাহ নামের দুটি শহরের বিবরণ আছে, যে শহর দুটি ধ্বংস করেছিল হিব্রু ঈশ্বর, কারণ সেই শহরগুলোয় যে মানুষগুলো বাস করত তারা খুবই খারাপ প্রকৃতির ছিল। এই দুটি শহরেই একজনই মাত্র ভালো মানুষ ছিলেন, যাঁর নাম ছিল লট। ঈশ্বর লটকে সতর্ক করতে দুজন দেবদূতকে পাঠিয়েছিলেন একটি নির্দেশ দিয়ে, যত দ্রুত তাঁর পক্ষে সম্ভব যেন তাঁর পরিবারসহ সডোম শহর ত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে যান। লট ও তাঁর পরিবার পাহাড়ের উদ্দেশ্যে শহর ছেড়ে বের হয়ে যান, ঠিক তারপর ঈশ্বর সেখানে আগুনের আর জ্বলন্ত পাথরের বৃষ্টিপাতের সূচনা করেন। লট ও তাঁর পরিবারের সব সদস্যদের বিশেষভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তাঁরা যেন পিছু না তাকান, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে লটের স্ত্রী ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করেছিলেন। তিনি পেছন ফিরে তাকিয়ে একপলক দেখতে চেয়েছিলেন। সুতরাং ঈশ্বর তাঁকে দ্রুত লবণের একটি স্তম্ভে পরিণত করেছিলেন, কিছু মানুষ এখনো দাবি করেন যে চাইলে আপনি সেখানে এটি আজও দেখতে পারবেন। 

কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদ দাবি করেছিলেন যে তাঁরা প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন একটি বিশাল ভূমিকম্প সেই এলাকাটিকে ধ্বংস করেছিল, প্রায় ৪০00 বছর আগে যেখানে সডোম ও গোমোরাহ অবস্থিত ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। যদি তাই সত্যি হয়ে থাকে তাহলে শহর দুটি ধ্বংস হবার কাহিনি হয়তো আমাদের ভূমিকম্প পুরাণের তালিকার অন্তর্ভুক্ত। 

বাইবেলে বর্ণিত আরেকটি পুরাণ-কাহিনি যা হয়তো শুরু হয়েছিল একটি সুনির্দিষ্ট ভূমিকম্প দিয়ে, সেটি হচ্ছে জেরিকো শহরটি কিভাবে ধ্বংস হয়েছিল। জেরিকো শহরটি ইসরায়েলের ডেড সি-এর খানিকটা উত্তরে অবস্থিত, এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি। এমনকি সাম্প্রতিক সময়েও এটি ভূমিকম্পের শিকার হয়েছে : ১৯২৭ সালে এটি ভূমিকম্পের কেন্দ্রের খুব কাছেই ছিল যখন সেই ভূমিকম্পটি পুরো এলাকায় আঘাত হেনেছিল। প্রায় ২৫ কিলোমিটার [প্রায় ১৫ মাইল] দূরে জেরুজালেমেও এই ভূমিকম্পটি বহু শত মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছিল। 

জশুয়া নামের একজন কিংবদন্তির নায়কের কাহিনি আছে প্রাচীন হিব্রু গল্পে, যিনি সেই মানুষগুলোকে জয় করতে চেয়েছিলেন যারা জেরিকো শহরে বহু হাজার বছর আগে থেকেই বসবাস করত। জেরিকো শহরটিকে ঘিরে ছিল প্রশস্ত, মজবুত একটি দেয়াল এবং শহরবাসীরা সেই দেয়ালের ভিতরে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছিল, যেন বাইরে থেকে তাদের শহরে আক্রমণ করা না যায়। জশুয়া’র সৈন্যরা সেই দেয়াল ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছিল, সুতরাং তিনি তাঁর যাজকদের জোরে জোরে পুরুষ মেষের শিং দিয়ে বানানো শিঙ্গা বাজাতে নির্দেশ দেন এবং তাঁর অনুসারীদের সবাইকে উচ্চস্বরে চিৎকার করার নির্দেশ দেন। 

সেই চিৎকার এতই তীব্র ছিল যে দেয়াল কাঁপতে শুরু করেছিল এবং দ্রুত সেই দেয়ালটি পুরোপুরিভাবে ধসে পড়েছিল। তারপর জশুয়া’র সেনারা দ্রুত শহরে ঢুকে নারী ও শিশুসহ সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এমনকি এই হত্যাযজ্ঞ থেকে শহরের গরু, গাধা ও ভেড়ারাও নিস্তার পায়নি। এছাড়াও তারা সবকিছুই পুড়িয়ে দিয়েছিল, শুধুমাত্র সোনা ও রুপা ছাড়া, যা তারা তাদের ঈশ্বরকে উৎসর্গ করেছিল, যেভাবে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। যেভাবে এই পুরাণটি বর্ণিত হয়েছে যেন এটাই ভালো একটি কাজ : জশুয়া ও তাঁর অনুসারীদের জন্যে ঈশ্বর এটাই হোক চেয়েছিলেন, যেন তাঁর নির্বাচিত মানুষগুলো পুরোপুরিভাবে সেই ভূখণ্ড দখল করতে পারে যা এর আগে জেরিকোর জনগণের বাসভূমি ছিল। 

যেহেতু জেরিকো এমনই ভূমিকম্পপ্রবণ একটি এলাকা, ইদানীং গবেষকরা প্রস্তাব করছেন যে জশুয়া আর জেরিকোর পুরাণ-কাহিনিটা হয়তো শুরু হয়েছিল একটি প্রাচীন ভূমিকম্প দিয়ে, যা শহরটিকে এমনভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছিল যে এর দেয়াল ভেঙে পড়েছিল। আপনি খুব সহজেই কল্পনা করতে পারবেন যে একটি ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের প্রাচীন লোকস্মৃতিকে অতিরঞ্জিত ও বিকৃত করা যেতে পারে যখন এটি প্রজন্মান্তরে মৌখিকভাবে হস্তান্তরিত হয়েছিল সেই মানুষগুলোর মাধ্যেমে, যারা লিখতে ও পড়তে পারত না এবং অবশেষে এটি মহান গোত্রীয় বীর যোদ্ধা জশুয়া আর সেইসাথে ওইসব চিৎকার আর শিঙ্গার আওয়াজ কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। 

যে দুটি পুরাণ এইমাত্র বর্ণিত হল সেগুলো হয়তো শুরু হয়েছিল ইতিহাসের একটি বিশেষ ভূমিকম্প দিয়ে। সারা পৃথিবী জুড়ে আরো অনেক পুরাণ-কাহিনি আছে, সেগুলো সৃষ্টি হয়েছে কারণ সাধারণভাবে ভূমিকম্প আসলে কী মানুষ সেটি বুঝতে চেষ্টা করেছিল। 

জাপানের যেহেতু ভূমিকম্পের বহু অভিজ্ঞতা আছে, খুব বিস্ময়কর নয়, ভূমিকম্প নিয়ে বেশকিছু বর্ণিল জাপানি পুরাণ আছে। তাদের একটি যেমন বলছে, নামাজু নামের একটি দানবীয় ক্যাটফিশের উপর পৃথিবীর পুরো স্থলভূমি ভাসছে, যখন নামাজু তার লেজ ঝাপটা দেয়, পৃথিবীও কেঁপে ওঠে। 

বহু হাজার মাইল দক্ষিণে, নিউজিল্যান্ডের মাওরি আদিবাসীরা, ইউরোপীয় নাবিকদের সেই দেশে পৌঁছাবার বেশ কয়েক শতাব্দী আগে যারা ছোট নৌকায় ভেসে সেখানে এসে বসতি গড়েছিল, তাদের একটি পুরাণ বলছে, মা পৃথিবী গর্ভবতী তার শিশুদেবতা রুকে নিয়ে। যখন শিশু রু মায়ের জরায়ুতে লাথি দেয় বা আড়মোড়া ভাঙে, তখনই ভূমিকম্প হয়। উত্তরে ফিরে আসি আবার, সাইবেরীয় কিছু গোত্রের সদস্যদের বিশ্বাস যে একটি স্লেজ গাড়ির উপর পুরো পৃথিবী আছে বসে আছে, যা টানছে একদল কুকুর আর সেটি চালাচ্ছেন টুল বলে একজন দেবতা, কিন্তু বেচারা কুকুরদের গায়ে ফ্লি পোকারা বাসা বেঁধেছে, যখনই তারা গা চুলকায়, তখনই পৃথিবী কেঁপে ওঠে । 

পশ্চিম আফ্রিকার একটি পুরাণে পৃথিবীকে একটি চাকতির মতো মনে করা হয়, যার এক পাশ উঁচু করে ধরে রেখেছে একটি বিশাল পর্বত আর অন্য দিকে আছে একটি বিশাল দানব, যার স্ত্রী উঁচু করে ধরে রেখেছে আকাশটাকে। মাঝে মাঝে যখন সেই দানব ও তার স্ত্রী পরস্পরকে আলিঙ্গন করে, তখন, আপনি নিশ্চয়ই কল্পনা করতে পারছেন, ভূমিকম্প হয়। 

পশ্চিম আফ্রিকার অন্য একটি গোত্রের সদস্যরা বিশ্বাস করে যে, একটি দানবের মাথার উপর তারা বাস করে। জঙ্গল হচ্ছে তার চুল, মানুষ আর সব প্রাণীরা ফ্লি পোকার মতো তার মাথার যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভূমিকম্প হয় যখন সেই দানবটি হাঁচি দেয়। অন্ততপক্ষে তাদের সেটাই বিশ্বাস করার কথা যদিও আমার বরং সন্দেহ আছে আসলেই তারা সেটি করে কি না। 

ভূমিকম্প আসলেই কী এখন আমরা খুব ভালো করেই জানি, সুতরাং এইসব পুরাণ-কাহিনিগুলো সরিয়ে রেখে সত্যটিকে দেখার সময় এখন 

ভূমিকম্প আসলেই কী? 

প্রথমে, প্লেট টেকটনিকের অসাধারণ গল্পটি আমাদের শোনা প্রয়োজন। পৃথিবীর মানচিত্র দেখতে কেমন সেটি প্রত্যেকেই জানেন। আমরা আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকা, এই দুটি মহাদেশের আকার কেমন সেটি জানি, এছাড়াও জানি যে, এই দুটি মহাদেশকে পরস্পর থেকে পৃথক করে রেখেছে প্রশস্ত আটলান্টিক মহাসাগর। আমরা সবাই অস্ট্রেলিয়াকে শনাক্ত করতে পারি এবং আমরা জানি যে নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। আমরা জানি যে ইতালি দেখতে বুট জুতার মতো, ‘সিসিলি’ ফুটবলকে লাথি মারতে উদ্যত, কেউ কেউ মনে করেন পাপুয়া নিউ গিনি দেখতে পাখির মতো। আমরা খুব সহজে ইউরোপের সীমারেখাকে চিহ্নিত করতে পারি, যদি এর আভ্যন্তরীণ সীমান্তরেখাগুলো প্রায়শই পরিবর্তিত হয়েছে। সাম্রাজ্য এসেছে আর চলে গেছে, ইতিহাস জুড়েই দেশের সীমানা পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু মহাদেশের সীমারেখা অপরিবর্তিত রয়েছে, তাই না? বেশ, না, তারা অপরিবর্তিত থাকেনি, আর সেটাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। 

তারা নড়ছে, যদিও স্বীকার করতেই হবে খুবই ধীরে এবং একইভাবে পর্বতমালাগুলোর অবস্থানও পরিবর্তন হচ্ছে : আল্পস, হিমালয়, আন্দিজ, রকিস। নিশ্চিতভাবে, অবশ্যই এই উল্লেখযোগ্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলো মানব-ইতিহাসের সময়কালের মানদণ্ডে স্থির, কিন্তু পৃথিবী নিজে—যদি এটি নিজে চিন্তা করতে পারত—সেই সময়কালকে কোনো সময় হিসেবেই বিবেচনা করত না। লিখিত ইতিহাস মাত্র প্রায় ৫০০০ বছরের প্রাচীন 1 আরো এক মিলিয়ন অতীতে যান [লিপিবদ্ধ ইতিহাস যতদূর বিস্তৃত এটি তার প্রায় ২০০ গুণ বেশি] এবং যতদূর আমাদের চোখের লক্ষ করার ক্ষমতা আছে, সব মহাদেশগুলোর আকার মোটামুটি আজকের মতো একই রকম ছিল, কিন্তু ১০০ মিলিয়ন বছর আগে যান; কী দেখবেন আপনি? 

দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর আজকের তুলনায় বেশ সংকীর্ণ একটি চ্যানেল ছিল মাত্র এবং দেখে মনে হতে পারে আপনি আসলেই সাঁতার কেটে আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা চলে যেতে পারবেন। উত্তর ইউরোপ গ্রিনল্যান্ডকে প্রায় ছুঁয়ে ছিল, যা কানাডাকে প্রায় স্পর্শ করে ছিল। আর ভারত আদৌ এশিয়ার কোনো অংশ ছিল না, ঠিক মাদাগাস্কারের পাশে এটি একপাশে কাত হয়ে ছিল, আজ যেমন এটিকে সোজা অবস্থানে দেখি, তার তুলনায় আফ্রিকা একইভাবে একপাশে কাত হয়েছিল। 

আরেকটি বিষয়, আপনি কি কখনো লক্ষ করেছেন আধুনিক মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে, দক্ষিণ আমেরিকার পূর্বাঞ্চল সন্দেহজনকভাবে আফ্রিকার পশ্চিম দিকের মতো, যেন তারা একই সাথে ‘খাপ’ খেতে চাইছে, জিগস পাজলের দুটি টুকরোর মতো? দেখা গেছে যে আমরা যদি সময়ে আরো অতীতে ফিরে যাই [বেশ আরো ৫০ মিলিয়ন বছর আগে, সুবিশাল আর ধীর ভূতাত্ত্বিক সময়ের মাপকাঠিতে যা খুব সামান্য পরিমাণ সময় মাত্র], আমরা তাহলে দেখতে পাব আসলেই তারা একই সাথে খাপ খেয়েছিল। 

একশ পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর আগে, আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকা পুরোপুরিভাবে সংযুক্ত ছিল, পরস্পরের সাথেই শুধু নয়, মাদাগাস্কার, ভারত আর অ্যান্টার্কটিকার সাথেও এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সাথে যা যুক্ত ছিল অ্যান্টার্কটিকার অন্য পাশে। একসাথে এই ভূখণ্ডগুলো সুবিশাল একটি বিশাল ভূখণ্ড বা সুপার-মহাদেশ তৈরি করেছিল, যার নাম দেয়া হয়েছে গন্ডওয়ানা, যা পরে বহু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, একের পর একটি কন্যা-মহাদেশ তৈরি করার মাধ্যমে। 

শুনতে বেশ আজব একটি কাহিনি মনে হয়, তাই-না? আমি বলতে চাইছি, বেশ হাস্যকর শোনায় যে মহাদেশের মতো এত বিশাল আকারের কোনোকিছু বহু হাজার মাইল তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে— কিন্তু আমরা জানি এটাই ঘটেছিল এবং আরো যেটা জানি সেটি হচ্ছে আমরা বুঝতে পেরেছি কিভাবে এটি ঘটেছিল। 

কিভাবে পৃথিবী তার স্থান পরিবর্তন করে 

আমরা আরো জানি যে মহাদেশগুলো শুধু পরস্পর থেকে দূরে সরেই যায়নি। কখনো কখনো তারা পরস্পরের সাথে ধাক্কাও খেয়েছিল এবং যখন সেটি ঘটেছিল ঊর্ধ্বমুখী সুবিশাল আর সুউচ্চ পর্বতমালার সৃষ্টি হয়েছিল। ঠিক এভাবে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়েছিল : যখন ভারত এসে এশিয়ার সাথে ধাক্কা খেয়েছিল। আসলে, এশিয়ার সাথে ভারত এসে ধাক্কা খেয়েছিল কথা সম্পূর্ণ সত্য নয়। আর খুব শীঘ্রই আমরা দেখব, এশিয়ার সাথে যা ধাক্কা খেয়েছিল সেটি আরো অনেক বড় একটি জিনিস, যাকে বলা হয় ‘প্লেট’, যার বেশিরভাগ অংশ পানির নিচে নিমজ্জিত, যার উপর ভারত বসে। সব মহাদেশই এইসব ‘প্লেটের’ উপর বসে আছে। আমরা সেগুলো নিয়ে পরে কথা বলব, কিন্তু প্রথমে একটু ভাবা যাক এইসব ‘সংঘর্ষ’ এবং মহাদেশগুলো বিষয়ে দূরে সরে যাওয়া প্রসঙ্গে। 

যখন ‘সংঘর্ষ’ বা ‘ধাক্কা’ লাগে শব্দগুলো শোনেন, আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যেন হঠাৎ কোনো সংঘর্ষ, যেমন যখন কোনো গাড়ির সাথে একটি ট্রাকের ধাক্কা লাগে, কিন্তু সেভাবে এটি ঘটে না বা আবার ঘটেও। মহাদেশের অবস্থান পরিবর্তন বা নড়ার বিষয়টি ভয়ানকভাবে ধীর একটি প্রক্রিয়া। কেউ একবার বলেছিলেন যে, আঙুলের নখ যত দ্রুত বৃদ্ধি পায় এটি তত দ্রুত ঘটে। যদি আপনি আপনার আঙুলের নখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, আপনি তাদের বাড়তে দেখবেন না, কিন্তু যদি কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করেন, আপনি দেখতে পারবেন নখ কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আপনাকে নখ কাটতে হবে। একইভাবে আপনি দেখতে পারবেন না যে আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকার সরে যাবার ক্রিয়াটিকে, কিন্তু আপনি যদি ৫০ মিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে পারেন, আপনি লক্ষ করবেন দুটি মহাদেশই পরস্পর থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। 

‘নখ যে গতিতে বাড়ে’ হচ্ছে গড় গতি, যে গতিতে মহাদেশগুলো তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে, কিন্তু নখ বেশ স্থির নির্দিষ্ট একটি গতিতে বাড়ে, আর মহাদেশগুলো তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে : প্রথমে একটি ঝাঁকুনি তারপর একশ বছরের একটি বিরতি অথবা সেকরম কোনো একটি সময়, যখন স্থান পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় চাপ ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, তারপর আবার ঝাঁকুনি দিয়ে নড়া এবং এভাবেই চলতে থাকে। 

হয়তো এখন আপনি অনুমান করতে শুরু করেছেন ভূমিকম্পগুলো আসলেই কী? হ্যাঁ ঠিক : ভূমিকম্প হচ্ছে আমরা যা অনুভব করি যখন ওই ঝাঁকুনিগুলো ঘটে। 

আমি আপনাদের এসব বলছি একটি জ্ঞাত বাস্তব তথ্য হিসেবে, কিন্তু কিভাবে আমরা সেটি জেনেছি? এবং প্রথম কখন আমরা এটি আবিষ্কার করেছিলাম? সেটি খুবই চমৎকার একটি গল্প, যা আমার এখন বলতে হবে। 

দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশ যে অনেকটা ‘জিগস’ পাজলের টুকরোর মতো খাপ খায়, সেটি মানচিত্র দেখে অতীতে অনেকেই লক্ষ করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। প্রায় ১০০ বছর আগে একজন জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড ভেইগানার সাহসী একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এতই সাহসী যে অধিকাংশ মানুষই তাঁকে খানিকটা উন্মাদ ভেবেছিল। ভেইগানার প্রস্তাব দিয়েছিলেন দানবীয় বিশাল আকারের জাহাজের মতো মহাদেশগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণের অন্যান্য ভূখণ্ডগুলো, ভেইগানারের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, একসময় পরস্পরের সাথে সংযুক্ত ছিল। তারপর পরস্পরের থেকে তারা ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমুদ্রে ভাসতে শুরু করেছিল তাদের পৃথক পৃথক দিকে। সেটাই ভেইগানার ভেবেছিলেন এবং, মানুষ এর জন্য তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টাও করেছিল, কিন্তু এখন আমরা জানি যে তিনিই সঠিক ছিলেন, বেশ, প্রায় ঠিক এবং অবশ্যই বেশি সঠিক ছিলেন সেই মানুষগুলোর চেয়ে যারা তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা করেছিল। 

প্লেট টেকটোনিক আধুনিক তত্ত্বটি, যা সমর্থন করছে বিশাল পরিমাণ প্রমাণ, সেটি পুরোপুরিভাবে ভেইগানারের ধারণার মতো একই নয়। ভেইগানার অবশ্যই ঠিক বলেছিলেন, আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকা, ভারত, মাদাগাস্কার, আন্টার্কটিকা আর অস্ট্রেলিয়া কোনো একসময় সব একসাথে যুক্ত ছিল, পরবর্তীতে যা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু প্লেট টেকটোনিক তত্ত্ব অনুযায়ী সেটি যেভাবে ঘটেছিল, ভেইগানার যেভাবে বিষয়টি ঘটে বলে ভেবেছিলেন, তার থেকে খানিকটা ভিন্ন। তিনি ভেবেছিলেন মহাদেশগুলো সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, তবে পানিতে নয়, বরং নরম, গলিত অথবা অর্ধ-গলিত ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে। প্লেট টেকটোনিকের আধুনিক তত্ত্ব বলছে যে, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠটি, সমুদ্র তলদেশসহ, পরস্পরের সাথে যুক্ত পুরোপুরি এক সেট প্লেটের মাধ্যমে [এই প্লেট মানে সেই প্লেট নয় যার উপরে কিছু রেখে আপনি খান, এটি বর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয় যেমন ধাতব প্লেট, সেই প্লেটের মতো কিছু সুতরাং শুধুমাত্র মহাদেশগুলোই তাদের স্থান পরিবর্তন করছে না, এগুলো যে প্লেটের উপর বসে আসে সেই প্লেটগুলো নড়ছে। আর পৃথিবীপৃষ্ঠের এমন কোনো অংশ নেই যা কিনা প্লেটের অংশ নয়। 

অধিকাংশ প্লেটের বেশিরভাগ অংশই সমুদ্রের নিচে অবস্থান করে। যে ভূখণ্ডগুলোকে আমরা মহাদেশ হিসেবে চিনি সেগুলো হচ্ছে প্লেটের উঁচু অংশ, যে অংশটি পানির উপর ভেসে থাকে। আফ্রিকা যেমন আরো অনেক বিশাল ‘আফ্রিকান’ প্লেটের উপর অবস্থিত, যা বিস্তৃত দক্ষিণ আটলান্টিক সাগরের অর্ধেক অবধি। অন্য প্লেটগুলো, যেমন—’ইন্ডিয়ান’ ও ‘অস্ট্রেলীয়’ প্লেট, ‘ইউরেশিয়ান’ প্লেট, যার মধ্যে আছে ভারত ছাড়া পুরো ইউরোপ ও এশিয়ার ভূখণ্ড। ‘আরব’ প্লেট, সেটি বেশ ছোট, ইউরেশিয়ান ও আফ্রিকার প্লেটের মধ্যবর্তী এলাকায় যার অবস্থান। আর ‘উত্তর আমেরিকা’ প্লেট, যার মধ্যে আছে গ্রিনল্যান্ড ও উত্তর আমেরিকা, যা বিস্তৃত উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশের অর্ধেক অবধি। এছাড়াও কিছু প্লেট আছে যাদের উপর কোনো শুষ্ক ভূখণ্ড নেই, যেমন বিশাল ‘প্যাসিফিক’ প্লেট। 

দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা প্লেটের মধ্যে বিভাজনরেখাটি বয়ে গেছে দক্ষিণ আটলান্টিকের ঠিক মাঝ বরাবর, দুই মহাদেশ থেকেই যা বহু মাইল দূরে। মনে রাখতে হবে যে সমুদ্রের তলদেশও এই প্লেটের অন্তর্ভুক্ত, আর যার মানে কঠিন শিলা। তাহলে কিভাবে দক্ষিণ আমেরিকা আর আফ্রিকা ১৫০ মিলিয়ন বছর আগে একসাথে যুক্ত ছিল? এটি ব্যাখ্যা করতে ভেইগানারের কোনো সমস্যায় পড়তে হত না কারণ তিনি ভেবেছিলেন মহাদেশগুলো নিজেরাই ভেসে দূরে সরে যেতে পারে, কিন্তু যদি দক্ষিণ আমেরিকা আর আফ্রিকা কোনো সময় একসাথে যুক্ত থাকে, তাহলে প্লেট টেকটোনিক কিভাবে ব্যাখ্যা করবে পানির নিচে সেই কঠিন শিলার বিস্তৃত এলাকাকে যা বর্তমানে তাদের পৃথক করে রেখেছে? তাহলে কি সমুদ্রের নিচে পাথুরে প্লেটটি কোনো-না-কোনো উপায়ে বৃদ্ধি পেয়েছে? 

সমুদ্র তলদেশের প্রসারণ 

হ্যাঁ, এর উত্তর আছে সেই বিষয়টির মধ্যে, যাকে বলা হয় ‘সি-ফ্লোর- স্প্রেডিং’ বা সমুদ্র তলদেশের প্রসারণ বা বিস্তৃতি। আপনি নিশ্চয়ই বড় বিমানবন্দরগুলোর চলন্ত ওয়াকওয়েগুলো দেখেছেন, যা মানুষকে তাদের লাগেজ নিয়ে দীর্ঘ পথ হাঁটতে সাহায্য করে, যেমন ধরুন বিমানবন্দরের প্রবেশপথ থেকে ডিপারচার লাউঞ্জের মধ্যবর্তী দূরত্ব। পুরোটা পথ না হাঁটার বদলে, তাঁরা একটি চলমান বেল্টের উপর উঠে দাঁড়াতে পারেন, কিছুটা পথ সেই বেল্টটি তাঁদের বহন করে নিয়ে যায়, যেখান থেকে তাঁদের আবার হাঁটা শুরু করতে হবে। আর চলমান হাঁটার পথটিতে শুধুমাত্র দুইজন মানুষ পাশাপাশি দাঁড়াতে পারে এমন প্রশস্ত, কিন্তু এবার কল্পনা করুন একটি চলমান ওয়াকওয়ে যা কয়েক হাজার মাইল প্রশস্ত, যা বিস্তৃত আর্কটিক থেকে অ্যান্টার্কটিক পর্যন্ত এবং কল্পনা করুন, হাঁটার গতিতে এটি নড়ছে না, এটি নড়ছে সেই গতিতে যে গতিতে আমাদের হাতের নখ বৃদ্ধি পায়। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, দক্ষিণ আমেরিকা এবং পুরো দক্ষিণ আমেরিকার প্লেটটি আফ্রিকা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং আফ্রিকা প্লেটটি, সেটি চলমান ওয়াকওয়ের মতো কোনোকিছুর উপর যা অবস্থান করছে সমুদ্র তলদেশের গভীর ভিতরে এবং সেটি বিস্তৃত অনেক দূরের উত্তর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের অনেক দক্ষিণ পর্যন্ত, যা খুব ধীরে নড়ছে। 

তাহলে আফ্রিকা? কেন আফ্রিকার প্লেটটিও একই দিক বরাবর নড়ছে না, কেন তাহলে সেটি দক্ষিণ আমেরিকা প্লেটের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না? 

উত্তর হচ্ছে আফ্রিকা অবস্থান করছে ভিন্ন একটি চলমান ওয়াকওয়ের উপর, যা সরে যাচ্ছে বিপরীত দিক বরাবর। আফ্রিকার সেই চলমান ওয়াকওয়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পূর্বে, আর দক্ষিণ আমেরিকার চলমান সেই পথ সরে যাচ্ছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। বেশ, তাহলে এদের ঠিক মাঝখানে কী হচ্ছে? এরপর যখন আপনি কোনো একটি বড় বিমানবন্দরে নামবেন, চলমান ওয়াকওয়ের উপর পা দেয়ার ঠিক আগে একটু থামবেন এবং ভালো করে এটি দেখবেন। মেঝের একটি ফাটল বা ছিদ্র দিয়ে এটি বেরিয়ে আসে এবং তারপর আপনার দিক থেকে এটি দূরে সরে যায়। এটি একটি বেল্ট, যা ঘুরছে আর ঘুরছে, মেঝের নিচ থেকে বের হয়ে আপনার সামনের দিকে এগিয়ে আবার এটি মেঝের নিচ দিয়ে প্রবেশ করে আপনার দিকে ফিরে আসছে। এবার আরেকটি বেল্টের কথা কল্পনা করুন, যা একই ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসছে কিন্তু এটি ঠিক বিপরীত দিকে যাচ্ছে। আপনি যদি একটি পা এক বেল্টের উপর এবং অন্য পা আরেকটি বেল্টের উপর রাখেন, দুই পা দুই দিকে ছড়িয়ে মাটিতে বসে পড়তে বাধ্য হতে হবে আপনাকে। 

আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে বিমানবন্দরের মেঝের সেই ছিদ্রটির সমতুল্য ফাটলটি গভীর সমুদ্র তলদেশে উত্তরে বহু দূর থেকে দক্ষিণে বহু দূর অবধি বিস্তৃত। এটাকেই বলে মিড-আটলান্টিক রিজ বা খাঁজ। মিড-আটলান্টিক রিজ থেকে দুটি ‘বেল্ট’ বের হয়ে আসে এবং তারা বিপরীত দিকে অগ্রসর হতে থাকে, একটি দক্ষিণ আমেরিকাকে পশ্চিম দিক বরাবর নিয়ে যায়, আর অন্যটি আফ্রিকাকে নিয়ে যায় পূর্বদিকে এবং, বিমানবন্দরের বেল্টগুলোর মতো, এই বিশাল বেল্টগুলো টেকটোনিক প্লেটগুলোকে আবার ঘুরিয়ে পৃথিবীর গভীরে নিয়ে যায়। 

পরের বার আপনি কোনো এয়ারপোর্টে যখন এ রকম চলমান ওয়াকওয়েতে উঠবেন এবং আপনার নিজেকে বহন করতে দেবেন এটিকে, তখন ভাববেন যে আপনি আফ্রিকা [অথবা দক্ষিণ আমেরিকা, যদি আপনি চান]। যখন আপনি ওয়াকওয়ের অন্য প্রান্তে এসে পৌঁছাবেন এবং সেখান থেকে নেমে দাঁড়াবেন, লক্ষ করবেন যে বেল্টটি মাটির নিচে ডুব দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে এবং এভাবেই সেটি পুরোটা পথ ঘুরে এসে সেখানে আবার উঠে আসে যেখান থেকে কেবলই আপনি এসেছেন। 

এয়ারপোর্টের চলমান ওয়াকওয়ের বেল্টটি পরিচালিত করে বৈদ্যুতিক মটর। পৃথিবীর বিশাল প্লেটগুলোকে পরিচালিত করছে কী, যে তারা চলমান বেল্টের উপর মহাদেশ বহন নিয়ে যায়? পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের নিচে গভীরে কনভেকশন [একাংশ থেকে অন্য অংশে তাপের সঞ্চালন, পরিচলন] কারেন্ট বলে একটি জিনিস আছে; এই কনভেকশন কারেন্টটি কী? হয়তো আপনার বাসায় একটি বৈদ্যুতিক কনভেকটর হিটার আছে আর একটি ঘরকে উষ্ণ করার জন্যে সেটি এভাবে কাজ করে : এটি বাতাসকে তাপ দিয়ে উষ্ণ করে, গরম বাতাস ভেসে উপরে উঠে আসে, কারণ ঠাণ্ডা বাতাসের চেয়ে এটি অপেক্ষাকৃত কম ঘনত্বপূর্ণ [সে-কারণেই হট এয়ার বেলুন কাজ করে] এবং হালকা। গরম বাতাস উপরে উঠতে থাকে যতক্ষণ-না এটি ছাদ স্পর্শ করে। সেখান থেকে সেটি আর উপরে উঠতে পারে না, সুতরাং তাদেরকে জোর করে দুই পাশে সরিয়ে দেয় নিচ থেকে আসা নতুন গরম বাতাস, যখন আগের গরম বাতাসগুলো দুই পাশে সরে যেতে থাকে, তারা শীতল হতে শুরু করে, আর শীতল হবার কারণে এদের ঘনত্ব বাড়ে এবং এটি নিচে নেমে আসে, যখন এটি মেঝে স্পৰ্শ করে, আবারো এটি পাশের দিকে সরে যেতে থাকে, মেঝের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যতক্ষণ-না এটি আবার হিটারের কাছে আসে আবার উষ্ণ হয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। ব্যাখ্যাটা খানিকটা বেশি সরল হয়ে গেল, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে মূল ধারণাটি : আদর্শ পরিস্থিতিতে একটি কনভেকটর হিটার বাতাসকে ক্রমাগতভাবে ঘোরাতে থাকে সঞ্চালনের মাধ্যমে। এই ধরনের সঞ্চালনকে বলা হয় কনভেকশন কারেন্ট। 

একই ঘটনা ঘটে পানির সাথেও। বাস্তবিকভাবে যে-কোনো তরল বা গ্যাসের সাথে এটি ঘটতে পারে, কিন্তু ভূপৃষ্ঠের নিচে কিভাবে কনভেকশন কারেন্ট থাকতে পারে? নিচে সেখানে তো কিছু তরল নয়, 

নাকি তরল? বেশ, হ্যাঁ, এক ধরনের তরল। পানির মতো তরল নয়, তবে খানিকটা অর্ধতরল ঘন মধু বা তরল গুড়ের মতো। এর কারণ এটির তাপমাত্রা এত বেশি যে সবকিছু গলিত। আর এই তাপটি আসছে পৃথিবীর গভীর থেকে। পৃথিবীর কেন্দ্র আসলেই অনেক বেশি উত্তপ্ত এবং তাপমাত্র খুবই বেশি থাকে যতক্ষণ-না ভূপৃষ্ঠের বেশ কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। মাঝে মাঝে সেই তাপটি বিস্ফোরণের মতো হয়ে আসে বাইরে কিছু জায়গায়, যাদের আমরা বলি আগ্নেয়গিরি। 

তাপ দ্বারা পরিচালিত 

প্লেটগুলো কঠিন পাথর দিয়ে তৈরি এবং যেমন আমরা দেখেছি, বেশিরভাগ অংশই থাকে সমুদ্রের নিচে। প্রতিটি প্লেটই বেশ কয়েক মাইল পুরু। যুদ্ধবর্মের ধাতব পাতের মতো পুরু স্তরটিকে বলা হয় লিথোস্ফিয়ার, আক্ষরিকভাবে যার অর্থ ‘পাথরের বলয়’। পাথরের স্তরের নিচে আরো পুরু একটি স্তর আছে, যদি আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, এটিকে আসলেই গুড়ের স্তর বলা হয় না কিন্তু সম্ভবত সেটাই বলাই উচিত [এটি আসলে ‘আপার ম্যান্টল’]। পাথরের স্তরের কঠিন পাথরের প্লেটগুলোকে বলা যেতে পারে তারা গুড়ের স্তরের উপর ‘ভাসছে’। গুড়সদৃশ তরলের স্তরটির নিচে ও ভিতরের তীব্র তাপ সেই স্তরের মধ্যে খুবই ধীর তবে শক্তিশালী কনভেকশন কারেন্ট তৈরি করে, এই কনভেকশন কারেন্টগুলো এর উপরে ভাসতে থাকা পাথরের প্লেটগুলো বহন করে নিয়ে যায়। 

কনভেকশন কারেন্ট খুবই জটিল পথ অনুসরণ করে। বিভিন্ন সমুদ্রস্রোতগুলোর কথা শুধুমাত্র চিন্তা করে দেখুন এমনকি বাতাস, যেগুলো এক ধরনের উচ্চ গতিসম্পন্ন কনভেকশন কারেন্ট। সুতরাং বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই যে পৃথিবীর পৃষ্ঠের নানা প্লেটগুলোকে কোনো একই দিকে বার বার মেরি-গো-রাউন্ডের মতো না ঘুরিয়ে বরং এটি নানা দিকে বহন করে নিয়ে যায়। আর সেই একই কারণে প্লেটগুলো পরস্পরের সাথে ধাক্কা খায়, পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে সরে যায়, পরস্পরের নিচে ডুব দিয়ে প্রবেশ করে অথবা পাশাপাশি পারস্পরিক ঘর্ষণের কারণ হয়। আর অবাক হবারও কোনো কারণ নেই যে আমরা সেই দানবীয় প্রবল শক্তিকে অনুভব করতে পারি—ঘর্ষণ, চাপ, গর্জন কিংবা আঁচড়ানোর শক্তি—ভূমিকম্প হিসেবে। ভূমিকম্প এমনিতেই খুবই ভয়াবহ মাত্রার হতে পারে, কিন্তু বিস্ময়টি হচ্ছে তারা কেন আরো ভয়ঙ্কর মাত্রায় ঘটে না। 

কখনো একটি চলমান প্লেট পার্শ্ববর্তী আরেকটি প্লেটের নিচে পিছলে ঢুকে যেতে পারে। এটিকে বলে ‘সাবডাকশন’, আফ্রিকা প্লেটের একটি অংশ, যেমন—ইউরেশিয়া প্লেটের নিচে প্রবিষ্ট হয়ে আছে। এটি একটি কারণ কেন ইতালিতে এত বেশি ভূমিকম্প হয় এবং এটাই একটি কারণ কেন মাউন্ট ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল প্রাচীন রোমের সময়ে, পম্পেই আর হারকিউলেনিয়াম শহর যা ধ্বংস করেছিল [কারণ টেকটোনিক প্লেটের প্রান্তে আগ্নেয়গিরিগুলো সাধারণত গজিয়ে ওঠে]। হিমালয় পর্বতমালা, মাউন্ট এভারেস্টসহ, তীব্র শক্তির কারণে এতটা উচ্চতায় উঠেছে, যখন ভারত প্লেটটি ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ধীরে নিয়মিতভাবে প্রবেশ করেছিল। 

আমরা শুরু করেছিলাম সান আন্দ্রিয়াস ফল্ট দিয়ে, সুতরাং সেখানেই আমরা শেষ করি। সান আন্দ্রিয়াস ফল্ট প্যাসিফিক আর উত্তর আমেরিকার প্লেটের মাঝখানে দীর্ঘ আর অনেকটাই ঋজু একটি ‘স্লিপেজ লাইন’, একটি প্লেট যেখানে আরেকটার নিচে ঢুকে আছে। দুটো প্লেটই উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছে, কিন্তু প্যাসিফিক প্লেটটি আরো দ্রুত গতিতে সরে যাচ্ছে। লস এঞ্জেলেস শহরটি আছে প্যাসিফিক প্লেটের উপর, উত্তর আমেরিকার প্লেটের উপর নয় এবং ধীরে ধীরে সেটি সান ফ্রান্সিসকো শহরের উপর একটি বেয়ে উঠছে, যার বেশিরভাগই উত্তর আমেরিকা প্লেটে অবস্থিত। ভূমিকম্প এই পুরো এলাকায় সারাক্ষণই প্রত্যাশিত এবং বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে আগামী দশ বছর বা আর কিছু সময়ের মধ্যে একটি বড় ভূমিকম্প হবে। সৌভাগ্যজনকভাবে, ক্যালিফোর্নিয়া, হাইতি’র ব্যতিক্রম, ভূমিকম্পের শিকার মানুষদের ভয়ঙ্কর দুর্দশা মোকাবেলা করতে যথেষ্ট পরিমাণে প্ৰস্তুত। 

একদিন, লস এঞ্জেলেসের কিছু অংশ হয়তো সান ফ্রান্সিসকোর অংশ হয়ে যাবে, কিন্তু সেটি ঘটবে আরো অনেক দিন পর, আমরা কেউ সেদিন থাকব না সেটি দেখার জন্য। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *