১০. ভালো থাক, সুখে থাক

এক চৈত্র মাসে বোতল ভূত এনেছিলাম— এখন আরেক চৈত্র মাস। দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেল। কত কাণ্ড হলো বোতল ভূত নিয়ে। সে হয়ে গেল আমাদের সুখদুঃখের বন্ধু। কোনো একটা সমস্যা হলেই বোতল ভূতের কাছে যাই। কাতর গলায় সমস্যার কথা বলি–

ও ভাই বোতল ভূত, লক্ষ্মী সোনা, চাঁদের কণা–ছয় প্রশ্নমালার তিন অংকটা পারছি না। একটু দেখবে, কিছু করা যায় কিনা?

ও ভাই বোতল ভূত, আজ ইংরেজি পড়া শেখা হয় নি। তুমি কি দয়া করে ইংরেজি স্যারের অসুখ বানিয়ে দেবে?

আজ মগদাপাড়ার বদমাশ ছেলেগুলির সাথে আমাদের একটা মারামারি আছে। তুমি কি দয়া করে আমাদের জিতিয়ে দেবে?

এই জাতীয় আবেদনে সব সময় যে কাজ হয় তা না, তবে বেশির ভাগ সময়েই হয়। সাধারণত খুব জটিল সমস্যায় বোতল ভূত আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। এই যেমন অরু আপার বিয়ে ভাঙার ব্যাপারটাই ধরা যাক না। কেমন চট করে ভেঙে গেল। বোতল ভূত হাতের কাছে ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।

আমি ঠিক করলাম এক বছর পার হলেই বোতল ভূতের জন্মদিন করা হবে। বন্ধুবান্ধব সবাইকে বলব। এক টাকা করে চাঁদা ধরা হবে। সারাদিন খুব হৈচৈ করা হবে। আমাদের ক্লাসের মর্টুকে বলা হবে এই উপলক্ষে একটা কবিতা লেখার জন্যে। মন্টু হচ্ছে আমাদের ক্লাসের কবি। সে এ পর্যন্ত তিনশ এগারটা কবিতা লিখেছে। এর মধ্যে কয়েকটা অতি বিখ্যাত। যেমন আমাদের অংক স্যারকে নিয়ে লেখা কবিতা–বিভীষিকা।

ঐ আসছে অংক স্যার
চক্ষে দেখছি অন্ধকার
হব আমরা পগারপার।

গায়কদের গান গাইতে বললে তারা সব সময় বলে–আজ আমার গলা ভেঙে গেছে, মুড নেই, ইচ্ছা করছে না ইত্যাদি। কবিদেব বেলায় ভিন্ন ব্যাপার। তাদের কবিতা লিখতে বললেই খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়ে। মন্টুও তাই করল। টিফিন টাইমের মধ্যে ছপাতার কবিতা লিখে ফেলল। কবিতার শিরোনাম–ওগো প্রিয় বন্ধু।

কবিতা শুনে আমরা মুগ্ধ। আমাদের ধারণা হলো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ছেলেবেলায় এত ভালো কবিতা লেখেন নি। আমরা মন্টুকে মহাকবি টাইটেল দিয়ে দিলাম। ঘোষণা করে দেয়া হলো এখন থেকে মন্টুকে শুধু মন্টু বললে কঠিন শাস্তি হবে। মন্টুকে ডাকতে হবে মহাকবি মন্টু।

বোতল ভূতের জন্মদিনের ব্যাপারেও সবার খুব আগ্রহ দেখা গেল। শুধু আমাদের ক্লাসেরই না, অন্য ক্লাসের ছেলেরাও চাঁদা নিয়ে উপস্থিত। তারাও জন্মদিন করতে চায়। ক্লাশ ফাইভের ছেলেরা এসে বলল, তারা বোতল ভূতকে একটা সংবর্ধনা দিতে চায়। ক্লাশ সিক্সের ছেলেরা এসে বলল, তারাও সংবর্ধনা দিতে চায়। শেষ পর্যন্ত ঠিক করা হলো স্কুলের তরফ থেকেই তাকে একটা সংবর্ধনা দেয়া হবে। সেই উপলক্ষে কমিটি তৈরি হলো। মানপত্র লেখা হলো। মানপত্র লিখলেন ক্লাশ টেনের আবু বকর ভাই। চমৎকার মানপত্র–হে ভূত, হে অশরীরী প্ৰাণ, হে বোতলবন্দি মুক্তহৃদয়, হে মহাপ্ৰাণ–এইসব লেখা। পড়লে রক্ত গরম হয়ে যায়।

আমরা ঠিক করলাম বোতল ভূতের সংবর্ধনায় যার কাছ থেকে ভূত পেয়েছি তাকেই সভাপতি করা হবে। ঐ যে রবি ঠাকুরের মতো দেখতে বুড়োকে। উনি হয়তো আসতে চাইবেন না।–না চাইলেও তাকে হাতে-পায়ে ধরে রাজি করাতেই হবে। একদিন বিকেলে দলবেঁধে গেলাম তার কাছে।

তার বাড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়াতে হলো। সব কেমন যেন অন্য রকম লাগছে। বাড়ি রঙ করা হয়েছে। শান্তিনিকেতন লেখা সাইনবোর্ডটি নেই। সুন্দর একটা বাগান করা হয়েছে বাড়ির সামনে।

ফর্সামতো একজন বৃদ্ধ গেঞ্জি গায়ে খুরপি হাতে বাগানে কাজ করছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, উনি কি আছেন?

বৃদ্ধ হাসি মুখে বললেন, উনিটা কে?

ঐ যে ববীন্দ্রনাথেব মতো দেখতে। লম্বা দাড়ি। লম্বা চুল।

বৃদ্ধ হেসে ফেললেন, আর তখনই বুঝলাম উনিই সেই লোক। দাড়ি কেটে ফেলেছেন। চুল ছোট কবে ফেলেছেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বৃদ্ধ বললেন–কী ব্যাপার বলো তো?

তাব আগে বলুন–আপনিই কি উনি?

হ্যাঁ, আমিই সেই মানুষ।

আমরা বোতল ভূতেব ব্যাপারটা তাকে বললাম। বোতল ভূত আমাদের জন্যে কী কী কলেছে তাও বললাম। তার বিস্মযেব সীমা বইল না। তাকে দেখে মনে হলো এমন অদ্ভুত কথা তিনি তার জীবনে শোনেন নি। হতভম্ব হয়ে যাওয়া স্বাবে তিনি বললেন, আমিই তোমাকে বোতল ভূত দিয়েছি!

জি।

কী সর্বনাশের কথা। আমি ভূত পাব কোথায় যে তোমাকে বোতলে ভাবে দেব?

এই তো দেখুন না। আমার সঙ্গেই আছে।

আমি শিশিটা তার হাতে দিলাম। তিনি গভীব আগ্রহে শিশি নেড়ে-চেড়ে দেখে বললেন, আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছে তোমাদের বলি। আমার মাথার ঠিক ছিল না। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলাম। চিকিৎসা চলছিল। এখন মনে হচ্ছে মাথা খারাপ অবস্থায় ওসব কবেছি।

আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম।

বৃদ্ধ বললেন, তোমরা যে সময়ে জন্মেছ তার অনেক আগেই চাঁদে মানুষ নেমে গেছে। মঙ্গল গ্রহে নেমেছে মেরিনাল-মহাশূন্যযান। আর তোমরা কিনা ভূত নিয়ে মাতামাতি কবছ। আমার না হয় মাথা খারাপ, কিন্তু তোমাদের তো আর মাথা খারাপ হয় নি? তোমরা কেন এসব বিশ্বাস করবে?

আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, বোতল ভূত আমাদের জন্যে অনেক কিছু করেছে।

কী করেছে?

আমরা একে একে ভূতের কাণ্ডকারখানা বললাম। বৃদ্ধ মিটমিটি হাসতে হাসতে বললেন, এইসব ঘটনা এম্নিতেও ঘটত। স্বাভাবিক নিয়মে এসব ঘটেছে, আর তোমরা ভেবেছ ভূত এসব করেছে।

আমাদের মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল।

বৃদ্ধ বললেন, মানুষের অসীম ক্ষমতা। অসাধ্য কাজের জন্যে মানুষের ভূতের দরকার হয় না। সে নিজেই পারে।

এই বৃদ্ধের কথা শুনে আমাদের এতই মন খারাপ হলো যে প্রায় চোখে পানি এসে পড়ার মতো অবস্থা। আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখেই হয়তোবা বৃদ্ধের মায়া হলো। তিনি বললেন, তোমরা ভূতের সংবর্ধনার আয়োজন করেছ–খুব ভালো কথা। কব। আমি সভাপতি হিসেবে সেখানে যাব। অবশ্যই যাব। কিন্তু কথা দিতে হবে, সভার শেষে বোতলটা আমাকে দিয়ে দেবে। কি, কথা দিচ্ছ?

আমরা চুপ করে রইলাম।

বৃদ্ধ বললেন, যাও বোতল নিয়ে বাড়ি যাও। সংবর্ধনাব শেষে আমাকে তা দিয়ে দেবে। কোথায় রাখলাম বোতলটিা?

আশ্চর্যের ব্যাপার, বোতলটা খুঁজে পাওয়া গেল না। বৃদ্ধ বিস্মিত হয়ে বললেন, এইখানেই তো ছিল। দেখ তো তোমরা কেউ পকেটে নিয়ে বেখেছি কি না।

আমাদের কারোরই পকেটে বোতল নেই। আমরা তন্ন-তন্ন করে খুঁজলাম। নেই নেই নেই। কোথাও নেই।

বৃদ্ধ গম্ভীর গলায় বললেন, ভালোই হলো। আপদ বিদেয় হয়েছে। যাও, এখন তোমবা বাড়ি যাও। এই জাতীয় বাজে বিষয় নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না। কেমন?

আমরা ফিরে এলাম। ফেরার পথে মনে হলো–আমরা ভূতকে বিশ্বাস কবি নি বলে বেচারা বোতল ভূত মনের দুঃখেই চলে গেছে। গভীর বেদনায় আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি মনে মনে বললাম, ভূত ভাই, তুমি সত্যি হও আর মিথ্যাই হও, আমি সাবা জীবন তোমাকে ভালোবেসে যাব। তুমি যেখানেই থাক–ভালো থাক, সুখে থাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *