দশম পরিচ্ছেদ – ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস ও পরবর্তী পর্যায়
১. মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে রণনীতি ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয় সেগুলি ভারত ও পাকিস্তান উভয় অংশেই কমিউনিস্ট পার্টির পরবর্তী ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সেই হিসাবে এই কংগ্রেসের তাৎপর্য পাক-ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসেও খুব উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু দ্বিতীয় কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তসমূহ এবং তার পরবর্তী পর্যায়ের কমিউনিস্ট কার্যকলাপের চরিত্র সম্পর্কে কোন সুষ্ঠু আলোচনা উপমহাদেশের তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মহলের পর্যালোচনাকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। এর প্রধান কারণ দ্বিতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্তসমূহ একদিকে দেশীয় রাজনীতিতে পরিবর্তন এবং অন্যদিকে আন্তর্জাতিক, বিশেষতঃ সোভিয়েট ও যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্রদের রচনা এবং বক্তব্য এই উভয়ের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছিলো।
৩রা জুন, ১৯৪৭, মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ ঘোষিত হওয়ার পর জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি বোম্বাইয়ে একটি বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ, ভারতীয় বুর্জোয়া, নেহরু ইত্যাদি প্রশ্ন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর তাঁরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদের সমালোচনা প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন যে সত্য অর্থে তা ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তিকে টিকিয়ে রাখারই এক নিশ্চিত চক্রান্ত।[১] সেই হিসাবে সমগ্র পরিকল্পনাটি ভারতীয় জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। এই কারণে মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্যে তাঁরা নেহরু সরকারের সমালোচনাও করেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তাঁরা একই প্রস্তাবে আবার একথাও বলেন যে সব দোষ ত্রুটি সত্ত্বেও পরিকল্পনাটি ভারতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পদক্ষেপ। এই বিবেচনা অনুসারে তাঁরা নেহরু সরকারকে তাঁদের সমর্থন জ্ঞাপনের সিদ্ধান্ত নেন।[২]
ভারতীয় সামন্ত স্বার্থ এবং বৃহৎ ব্যবসার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে বৃটিশ সরকার কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীদের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে একথা স্বীকার করা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁদের প্রস্তাবে বলেন যে এই দক্ষিণপন্থীরা আসলে কংগ্রেসের মধ্যে তুলনায় অনেকখানি দুর্বল। কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলির মধ্যেও তারা তেমন প্রভাবশালী নয়। কাজেই কংগ্রেসের বামপন্থীদের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে তাঁরা তাদের গণতান্ত্রিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সহায়তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটি একটি প্রস্তাবে বলেন :
গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রকে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি সগর্বে জাতীয় নেতৃত্বের সাথে পুরোপুরি সহযোগিতার মাধ্যমে ভারতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করবে।[৩]
কমিউনিস্ট পার্টি একথাও মনে করে যে ভারতবর্ষে কোন গণতান্ত্রিক কর্মসূচীকে কার্যকরী করতে হলে কংগ্রেস লীগের অন্তর্গত বামপন্থী এবং অন্যান্য প্রগতিশীল শক্তিসমূহের ঐক্যজোটের মাধ্যমেই তা সম্ভব।[৪]
ঐক্যের উপর এই গুরুত্ব আরোপের ফলে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি বস্তুতপক্ষে বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রতি তাঁদের পূর্ব গুরুত্বকে অনেকখানি খর্ব করেন। কিন্তু তৎকালীন সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে অবশ্য তাঁদের এই ঐক্য প্রস্তাবের তাৎপর্য কিছুটা বোঝা যাবে।
সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতির ফলে হিন্দু-মুসলমান এবং অন্যান্য সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর পারস্পরিক ঐক্য সে সময়ে যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে হয়ে দাঁড়ায় অপরিহার্য। পার্টির নেতা ও কর্মীদের চিন্তা এই পরিস্থিতির দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। দ্বিতীয় কংগ্রেসে পার্টির নীতির একটি আত্মসমালোচনামূলক পর্যালোচনায় ভালচন্দ্র ত্রিম্বক রণদীভেও একথা স্বীকার করেন।[৫]
মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ এবং নেহরু ও কংগ্রেসের সহযোগিতার প্রশ্নে বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির রজনীপাম দত্তও একটি প্রবন্ধে৬ কেন্দ্রীয় কমিটির বক্তব্যের অনুরূপ মত প্ৰকাশ করেন। তিনিও যথারীতি উপরোক্ত রোয়েদাদের সমালোচনা করার পর তাকে গণতন্ত্রের পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ হিসাবে বর্ণনা করে তৎকালীন অবস্থায় কংগ্রেসের সাথে সহযোগিতার পরামর্শ দেন। শুধু তাই নয়, মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্যে নেহরু সরকারকে দোষারোপ করা থেকে পর্যন্ত তিনি বিরত থাকেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে পূর্ববর্তী পর্যায়ের তীক্ষ্ণ বিরোধের পরিবর্তে তখন কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টি উভয়ের মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে একত্রে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ অনুভূত হচ্ছিলো। সর্ব ভারতের গণতান্ত্রিক ঐক্য, আর্থিক ও সামাজিক দাবীসমূহ পূরণ, ভূমি সংস্কার, শিল্প জাতীয়করণ ও পরিকল্পিত শিল্পোন্নয়ন ইত্যাদি একমাত্র সেই যৌথ এবং ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার দ্বারাই সম্ভব বলেও তিনি প্রবন্ধটিতে তাঁর মত প্রকাশ করেন। মোটামুটিভাবে বলা চলে যে রজনী পাম দত্ত আলোচ্য প্রবন্ধটিতে যা কিছু বলেন তার মধ্যে নেহরু সরকারকে একটি প্রগতিশীল সরকার হিসাবে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা খুবই স্পষ্ট।
রজনী পাম দত্তের এই প্রবন্ধের মধ্যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্গত সংস্কারপন্থীরা নিজেদের বক্তব্যের স্বপক্ষে সমর্থন লাভ করেন এবং তাঁদের পথ যে নির্ভুল একথা চিন্তা করে নিশ্চিত হন। সোভিয়েট অথবা অন্য কোন দেশী পার্টির সুস্পষ্ট নির্দেশ অথবা বক্তব্যের অভাবে নিজেদের অনুসৃত নীতির প্রতি তাঁদের আস্থাও স্বভাবতঃই বৃদ্ধি পায়।
কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেস লীগের সাথে একত্রে স্বাধীনতা দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং ১৫ই অগাষ্টকে ‘জাতীয় উৎসবের দিন হিসাবে ঘোষণা করে কংগ্রেস লীগভুক্ত এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক কর্মীদের সাথে এ ব্যাপারে সহযোগিতার নির্দেশ দেয়।[৭] নবগঠিত কংগ্রেস-লীগ সরকারের প্রতি সমর্থন অবশ্য তৎকালীন জরুরী অবস্থায় কোন কোন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার প্রাক্কালেই পাঞ্জাবে বিস্তৃত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাকে আয়ত্তে আনার জন্যে কংগ্রেস লীগ এবং প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠানসমূহের সহযোগিতা হয় অপরিহার্য। কমিউনিস্ট পার্টি সেই দাঙ্গাকে নেহরু সরকারের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ এবং তার অনুচরদের চক্রান্ত বলে বর্ণনা করে।[৮] এবং বলে যে সেই চক্রান্তকে দ্রুত নিশ্চিহ্ন করতে হলে তা প্রগতিশীল শক্তিসমূহের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই সম্ভব।[৯]
এ প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির তদানীন্তন সম্পাদক পূরণচন্দ্র যোশী অক্টোবর ১৯৪৭ এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলেন:
জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় ১৫ই আগস্ট দেশ জুড়ে আনন্দের বান ডেকেছিলো – ১৫ই আগষ্ট আমাদের দেশের জনগণের সম্মুখে এক নতুন স্বাধীন জীবনের সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। কিন্তু ১৫ই আগস্টের পর ঠিক দুই সপ্তাহের মধ্যেই আবার পাঞ্জাবের আকাশে যে কালো ভয়ংকর মেঘ দেখা দিয়েছে তাতে করে সমস্ত জাতিই আতংকিত হয়ে উঠেছে।[১০]…
কারা এই আগুন জ্বালিয়েছে? কারা আমাদের দেশের মানুষের মন বিষিয়ে তুলেছে আমাদের সকলের সেকথা জানা দরকার। পাঞ্জাব আজ আমাদের সমস্ত জাতির পক্ষে মর্মন্তুদ অভিশাপ। এ অভিশাপ থেকে আমাদের সকলের শিক্ষা নিতে হবে।[১১] পাঞ্জাবের দাঙ্গার ভিত্তি স্থাপন করেছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা এবং তাদেরই অনুচরেরা আগুন জ্বালিয়েছে। আজ এর সুযোগে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে পাকিস্তান ও ভারতীয় ইউনিয়ন উভয় রাষ্ট্রেই। এখন দুটি রাষ্ট্রকে অপদস্ত ও চ্যালেঞ্জ করে চলেছে তারা; দুটি রাষ্ট্রকেই প্রতিক্রিয়াশীল করে গড়ে তুলতে চাইছে।[১২]
ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রকেই অপদস্থ করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ পাঞ্জাবের দাঙ্গাকে ব্যবহার করতে চায়। দেখাতে চায় শাসনব্যবস্থা চালাবার যোগ্যতা আমাদের নেই।[১৩]
সর্বশেষে যোশী ভারত এবং পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রে প্রগতিশীল দল ও কর্মীদের উদ্দেশ্যে দাঙ্গার বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিকদের ঐক্য জোট গঠন এবং সাধারণভাবে ‘জাতীয় সরকার’কে সক্রিয় সমর্থন জ্ঞাপনের আহ্বান জানান :
ভারতীয় ইউনিয়নের ভিতর আমরা যারা দেশকে ভালোবাসি, প্রগতির জন্য দাঁড়াই, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আমাদের সকলের কর্তব্য হলো সাম্প্রদায়িকতার প্রেতশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে, পাঞ্জাবের রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ এবং আকালী বাহিনীর বিরুদ্ধে, অন্যান্য প্রদেশে যে সমস্ত শক্তি প্রতিহিংসার আগুন জালাতে চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের জনগণকে জাগিয়ে তোলা।
পাকিস্তানের ভিতর প্রগতিশীল লীগপন্থীদের ওপর আমরা আস্থা রেখেছি, তাঁরা সমস্ত জনপ্রিয় শক্তিগুলির সহযোগিতায় ন্যূনপন্থীদের সাথে মোকাবেলা করবেন, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডকে নিরস্ত্র করবেন, এবং ধর্মের অসৎ জিগীরের বিরুদ্ধে পীরদের সতর্ক করবেন।…
পাঞ্জাবের ঘটনায় আমাদের এখনি হুশিয়ার হয়ে যাওয়া দরকার। প্রদেশের বাইরে প্রত্যেকটি জনপ্রিয় সংগঠনের কর্তব্য – জাতীয় সরকারকে পূর্ণভাবে সমর্থন করা, পাঞ্জাবকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ সাহায্য পাঠানো এবং নিজেদের এলাকায় শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মিলিত প্রচেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়োগ করা।
এই শিক্ষাই আমাদের পাঞ্জাবের ঘটনা থেকে নিতে হবে-এই সংকল্পই ঘোষণা করতে হবে নোতুন করে।[১৪]
পাক-ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে দাঙ্গা রোধ করার জন্যে যে ঐক্যের প্রয়োজন দেখা দেয় তার ফলেই যোশী এবং অপরাপর সংস্কারপন্থী কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষে কংগ্রেস লীগ সরকারকে সাধারণভাবে সমর্থনের আহ্বান জানানো সহজ হয় এবং সেই প্রয়োজনের তাগিদে কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্গত বামপন্থীরাও স্বাধীনতা উত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতীয় এবং পাকিস্তানী ‘জাতীয়’ সরকারের সাথে নিজেদের সম্পর্ক যথাযথভাবে নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতেই যোশীর পক্ষে সম্ভব হয় ‘জাতীয় সরকারকে পূর্ণভাবে সমর্থনের’ কর্মসূচীর সপক্ষে পার্টির নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। দ্বিতীয় কংগ্রেসে রণদীভে পার্টি নীতির পর্যালোচনাকালে একথা উল্লেখ করেন।[১৫]
কংগ্রেস লীগ সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঠিক পরবর্তী পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত অনুসৃত তাদের সমস্ত কর্মসূচীকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দেয়। বাঙলাদেশে তেভাগা আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদের এই ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৬ সাল থেকেই দুই-তৃতীয়াংশ ফসলের দাবীতে বর্গাদারেরা বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষতঃ দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, যশোর, খুলনা, অর্থাৎ প্রধানত উত্তর বাঙলায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এক শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলে। ফসল ভাগের এই সংগ্রাম জোতদার ও সরকারের প্রতিরোধকে অতিক্রম করে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছিলো এক বৈপ্লবিক কৃষক আন্দোলনের। কিন্তু সেই আন্দোলনকে ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে কমিউনিস্ট পার্টি প্রত্যাহার করে নিলো। বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ভবানী সেন তাই কৃষকদের প্রতি আবেদন জানিয়ে নভেম্বর মাসে বললেন যে ‘গত বছরের মতো এ বছরে তাঁরা যেন কোন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথে না যান।’ কারণ নোতুন সরকারকে ‘আইনের মাধ্যমে তার প্রতিশ্রুতি পালনের একটা সুযোগ দেওয়া দরকার’।[১৬]
এর পূর্বে সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ এ, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির পক্ষে মধু ব্যানার্জী কর্তৃক ১৫ নং কোর্ট হাউস স্ট্রীট থেকে প্রকাশিত ‘পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ’ নামে একটি পুস্তিকাতে ভবানী সেন অবশ্য বলেন :
গত বৎসর লীগ মন্ত্রীমণ্ডলী নির্মম অত্যাচার দ্বারা ৬০ লক্ষ ভাগ চাষীর তেভাগা আন্দোলন দমন করিয়াছেন।
সরকারী সশস্ত্র বাহিনী যে ধান জোর করিয়া বর্গাদারের বাড়ী হইতে লইয়া জোতদারের গোলায় তুলিয়া দিয়াছে সেই ধান এখন চোরাবাজারে। সরকারী সরবরাহ বিভাগের গুদামও শূন্য। অথচ এখন আর সরকারী সশস্ত্র বাহিনী জোতদারের গোলা হইতে সে ধান সরকারী সরবরাহ বিভাগের গুদামে আনিতেছে না, আর ঠিক সেই জন্যই পূর্ব বঙ্গের জেলায় জেলায় দুর্ভিক্ষের দ্রুত পদধ্বনি শোনা যাইতেছে।
পাকিস্তান যদি এমনিভাবে জমিদার জোতদারের পক্ষপুটে আবদ্ধ থাকে তাহা হইলে উহাকে গোরস্থানে পরিণত করিতে দেরী লাগিবে না। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণকে বাঁচিতে হইবে এবং স্বাধীন মানুষের মতোই বাঁচিতে হইবে। এরূপভাবে বাঁচা সম্ভব যদি হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণ ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তানকে জমিদার জোতদারের পক্ষপুট হইতে মুক্ত করিয়া জনগণের স্বাধীন পাকিস্তানে পরিণত করেন।[১৭]
পণ্ডিত নেহরুর প্রতি মোহগ্রস্ত হওয়ার ফলেই কমিউনিস্ট পার্টির সংস্কারপন্থী নেতৃত্ব জাতীয় সরকার’ এবং কংগ্রেস লীগ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও নানা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য উপস্থিত করেন। তাঁরা বস্তুতঃপক্ষে নেহরু এবং ভারতীয় বুর্জোয়ার মধ্যে একটি গুণগত পার্থক্য কল্পনা করে নেহরুর প্রগতিশীল হাতকে জোরদার করার উদ্দেশ্যে নিজেদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে উদ্যোগী হন। এজন্যে নেহরুকে তাঁরা ‘জনতার কণ্ঠ’ আখ্যায় ভূষিত করেন[১৮] এবং ‘পণ্ডিত নেহেরু থেকে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট পর্যন্ত যুক্ত ফ্রন্ট’ গঠনের প্রস্তাব দেন।[১৯] যোশীর নেতৃত্বে এই পর্যায়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি মনে করেছিলেন যে নেহরুর সাথে ‘বামপন্থী’ ঐক্যজোটের মাধমে তাঁরা ভারতে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের যথার্থ অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হবেন। এখানেও রজনী পাম দত্তের তত্ত্বগত বক্তব্য এবং পরামর্শ তাঁদের চিন্তাকে অনেকাংশে গঠন করে।
কিন্তু এক্ষেত্রে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এবং তাদের উপদেষ্টা বৃটিশ পার্টির রজনী পাম দত্ত যখন নেহরু এবং তাঁর সরকারকে সমর্থনের মাধ্যমে ভারতে গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে জোরদার করার চিন্তা করছিলেন তার কয়েক মাস পূর্বে সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি নেহরুকে ‘ধনী ব্যক্তি’ এবং তাঁর সরকারকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ আখ্যা দিয়ে তৎকালীন অবস্থায় ভারতীয় বুর্জোয়ার ভূমিকা সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল। শুধু সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টিই নয়, যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিনফর্মের নেতারাও উপনীত হয়েছিলেন অনুরূপ সিদ্ধান্তে।
অধিকতর বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে উপরোক্ত সিদ্ধান্তের খবর অনেকদিন পর্যন্ত ভারতীয়দের কাছে ছিলো সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।
২. সোভিয়েট এবং যুগোস্লাভ পার্টির মুখপাত্রদের বক্তব্য
মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ ঘোষিত হওয়ার পর দিয়াকভ ‘নিউ টাইম্স্’-এ প্রকাশিত ‘ভারতে নূতন বৃটিশ পরিকল্পনা’ নামে একটি প্রবন্ধে সমগ্র পরিকল্পনাটির কঠোর সমালোচনা করেন।[২০] সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবটি আসলে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখারই একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। সেই চক্রান্তের কাছে নতি স্বীকার করে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ বস্তুতঃপক্ষে সাম্রাজ্যবাদের সাথে একটা আপোষ রফায় উপনীত হয়েছেন এবং ভারতীয় বৃহৎ ব্যবসাই তাঁদেরকে এই আপোষের দিকে পা বাড়াতে বাধ্য করেছে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ এবং উপমহাদেশের বৃহৎ ব্যবসা দেশীয় বাজারকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বিপ্লবকে বানচাল করতে উদ্যোগী হয়েছে।[২১]
কংগ্রেস লীগের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র সম্পর্কে প্রবন্ধটিতে স্পষ্ট অভিমত সত্ত্বেও দিয়াকভ কিন্তু ভারতীয় পার্টিকে সরাসরিভাবে মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদের বিরুদ্ধে কোন আশু কর্মপন্থা নির্ণয়ের পরামর্শ দেওয়া থেকে বিরত হন। সেদিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে যে এই পর্যায়ে সোভিয়েট মতামত ছিলো অনেকাংশে দোদুল্যমান, তার মধ্যে নির্দেশজ্ঞাপক অথবা নিশ্চিত সিদ্ধান্তসূচক কোন বক্তব্য ছিলো না।
কিন্তু এর পর জুলাই মাসে এশিয়া সম্পর্কে সোভিয়েট বিশেষজ্ঞ ই জুকভ ‘ভারতীয় পরিস্থিতি প্রসঙ্গে’ নামে এক প্রবন্ধে নেহেরু সরকারের চরিত্র সম্পর্কে আরও স্পষ্টভাবে সোভিয়েট পার্টির অভিমত ব্যক্ত করেন।[২২] তাতে সোজাসুজি বলা হয় যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতীয় বৃহৎ বুর্জোয়া অর্থাৎ একচেটিয়া পুঁজির প্রতিনিধি ছাড়া আর কিছুই নয় এবং মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদকে স্বীকার করে কংগ্রেস প্রকৃতপক্ষে প্রতিক্রিয়াশীলদেরই দলভুক্ত হয়েছে। জুকভ তাঁর প্রবন্ধে আরও বলেন যে বৃহৎ বুর্জোয়ারা বৃটিশের থেকে জনগণকেই বেশী ভয় করে। সেজন্যে তারা পূর্ণ স্বাধীনতার পরিবর্তে পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে একটি মাঝামাঝি ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন।
জুকভ অবশ্য একথাও বলেন যে কংগ্রেস লীগ উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই কিছু কিছু গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল কর্মী আছেন যাঁরা বৃহৎ বুর্জোয়া নিয়ন্ত্রিত সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে প্রস্তুত হবেন। পাকিস্তান প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব এবং মুসলিম জনগণের কাছে পাকিস্তানের অর্থ এক নয়। সাধারণ মুসলমানেরা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হিসাবেই পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছে।
জুকভ শ্রমিক শ্রেণীর উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন যে তৎকালীন ভারতীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারাই সব থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তাদের তুলনায় কৃষকেরা অনেক বেশী অনগ্রসর। কারণ অশিক্ষা, বর্ণপ্রথা এবং সামন্তবাদের অবশেষসমূহের চাপে তাদের মধ্যে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মোটামুটিভাবে বলা চলে যে জুকভ তাঁর প্রবন্ধে সাম্রাজ্যবাদ এবং তার সহযোগী সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে একটা নির্দিষ্ট রণনীতি গ্রহণের প্রস্তাব করেন। এবং সেই রণনীতি অনুসারে ভারতে নেহেরু সরকার এবং পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকারের উপর আক্রমণ হয়ে দাঁড়ায় অবধারিত।
নেহেরুকে বৃহৎ বুর্জোয়ার প্রতিনিধি হিসাবে চিহ্নিত করে সোভিয়েট মুখপাত্রেরা সকলেই নেহেরু এবং তাঁর সরকার সম্পর্কে একটি সাধারণ কর্মপন্থা নির্দেশ করতে সমর্থ হলেও সামগ্রিকভাবে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর সম্পর্কে তাঁরা কোন সুস্পষ্ট নীতি তখনো পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারেননি। কিন্তু প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তার সমাধান ব্যতীত নেহেরু সরকারের বিরুদ্ধে বাস্তবক্ষেত্রে কর্মসূচী প্রণয়ন ও তাকে সঠিকভাবে কার্যকর করা সম্ভব ছিলো না।
এই অসুবিধা দূর করার জন্যে ইতিপূর্বে সোভিয়েট বিশেষজ্ঞরা ১৯৪৭-এর জুন মাসে বিজ্ঞান একাডেমীর এক বিশেষ অধিবেশনে ভারতীয় পরিস্থিতি পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে মিলিত হন।[২৩] মূল আলোচনার সূত্রপাত করে সেখানেও জুকভ তাঁর উপরোক্ত বক্তব্য উপস্থিত করেন। দিয়াকভ ও ব্যালাবুশেভিচ দুজনেই সেই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বক্তৃতা দেন। তাঁরা দুজনেই বলেন যে নেহেরু সরকার শুধুমাত্র বৃহৎ বুর্জোয়ারই প্রতিনিধিত্ব করে তাই নয়, তারা মাঝারি বুর্জোয়াদেরও প্রতিনিধি। এই মাঝারি বুর্জোয়াদেরকেও তাঁরা প্রতিক্রিয়াশীল হিসাবে চিহ্নিত করেন।
ব্যালাবুশেভিচ বলেন যে ভারত বিভাগ ভারতীয় বুর্জোয়া ও জমিদারদের সাথে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের একটা বোঝাপড়ারই প্রত্যক্ষ ফল। যে ভারতীয় বুর্জোয়ারা কংগ্রেসের নেতৃস্থানে থেকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো তারাই অবশেষে সমগ্র ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীকে নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্রাজ্যবাদের শিবিরে চলে গেছে। দিয়াকভ ও ব্যালাবুশেভিচ উভয়েই বলেন যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কংগ্রেস লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাতকেই জোরদার করে এবং তার ফলে নানাদিক দিয়ে তারা সাম্রাজ্যবাদীদের অনেক সুবিধা করে দেয়। কিন্তু পরস্পরের এই মতানৈক্য থাকলেও জুকভের মতো ব্যালাবুশেভিচও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর উপর গুরুত্ব আরোপ সত্ত্বেও কৃষকের ভূমিকাকে খুব ছোট করে দেখেন। তিনি বলেন যে একমাত্র সেই সমস্ত ক্ষেত্রেই কৃষকেরা সব থেকে বেশী সক্রিয় যেখানে তাদের সাথে শহরের শ্রমিকদের একটা প্রত্যক্ষ যোগ আছে। কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে ব্যালাবুশেভিচের এই বক্তব্য যে তেলেঙ্গানা এবং উত্তর বাঙলার শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে মোটেই প্রযোজ্য নয় সেকথা বলাই বাহুল্য। শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত ভারতীয় পরিস্থিতির এই পর্যালোচনা সভায় দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা এবং উত্তর বাঙলার কৃষক আন্দোলনের কোন উল্লেখই তাঁরা প্রয়োজন মনে করেননি।
ব্যালারুশেভিচ তাঁর বক্তৃতার শেষে ঘোষণা করেন:
ভারতের মেহনতী জনগণ ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণী এবং তাদের পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পূর্ণ স্বাধীনতা, সামন্তবাদের অবশেষসমূহ নিশ্চিহ্ন এবং জনগণতন্ত্রের জন্যে সাম্রাজ্যবাদ, বুর্জোয়া শ্রেণী এবং ভূমি মালিকদের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় সংগ্রাম পরিচালনা করছেন।
পর্যালোচনা ক্ষেত্রে জুকভের সাথে মত পার্থক্যের ফলে দিয়াকভ ও ব্যালাবুশেভিচের নির্দেশিত রণনীতির মধ্যেও অনেক পার্থক্য দেখা দেয়। সেই অনুসারে জুকভের তুলনায় তাঁরা নেহেরু সরকারের বিরুদ্ধে অধিকতর চরমপন্থী কর্মসূচীর পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ভারতীয় পরিস্থিতি আলোচনার ক্ষেত্রে চীনের অভিজ্ঞতা অথবা মাও সেতুঙ এর চিন্তাধারার উপর কোন গুরুত্ব আরোপ তো দূরের কথা তার কোন উল্লেখ পর্যন্ত তাঁরা কেউ করেননি। ভারতীয় কমিউনিজমের পরবর্তী লক্ষ্য ভারতে জনগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা একথা সোভিয়েট বিশেষজ্ঞরা ঘোষণা করলেও জনগণতন্ত্রের চরিত্র সম্পর্কে তাঁদের মধ্যেও যথেষ্ট মতবিরোধ ছিলো। অন্যান্য দেশীয় কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যুগোস্লাভ পার্টি অবশ্য সরাসরিভাবে জনগণতন্ত্রের বিরোধিতা করে[২৪] এবং সেজন্যে কৃষি বিপ্লবের রণনীতিকে তারা মনে করে সর্বাংশে ভ্রান্ত।
ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে প্রতিষ্ঠিত জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রণনীতি অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ বিদেশী পুঁজি এবং তার সহযোগী দেশীয় বৃহৎ বুর্জোয়া এবং বৃহৎ সামন্ত শক্তির বিরুদ্ধেই সেখানে গৃহীত হয় ব্যাপক রাজনৈতিক কর্মসূচী। সেই হিসাবে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বুর্জোয়া অথবা সমাজতান্ত্রিক নয়, সে দুইয়ের মধ্যবর্তী এক পরিবর্তনশীল পর্যায়।
১৯৪৭ সাল থেকেই যুগোস্লাভ পার্টির মুখপাত্রেরা জনগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁদের বক্তব্য উপস্থিত করেন। তাতে তাঁরা বলেন যে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে একটি মধ্যবর্তী অবস্থা হিসেবে না দেখে আরও জঙ্গী কর্মসূচীর মাধ্যমে বুর্জোয়া ও সামাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে একই সূত্রে গ্রথিত করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে হবে। কাজেই যুগোস্লাভ তাত্ত্বিকেরা শুধুমাত্র একচেটিয়া পুঁজি এবং সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কর্মসূচীকে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে একটি চরম সংগ্রামের পথে চালনা করতে বলেন। সেজন্যে তাঁরা বুর্জোয়া শ্রেণীর সমস্ত প্রতিষ্ঠা ও সংগঠনকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে এক সর্বাত্মক বৈপ্লবিক কর্মসূচী নির্ধারণের পরামর্শ দেন।
জনগণতন্ত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে যুগোস্লাভ মুখপাত্রেরা কেবলমাত্র পূর্ব ইউরোপের জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রেই তাঁদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখেননি। কমিনফর্মের বৈঠকে তাঁরা এ বিষয়ে ফরাসী ও ইটালিয়ান উভয় পার্টিকেই আক্রমণ করেন। জানুয়ারী ১৯৪৭ এ যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্রে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে এডওয়ার্ড কাজে ঘোষণা করেন যে উপনিবেশগুলিতে ‘জাতীয় বুর্জোয়া’ সর্বক্ষেত্রেই প্রতিক্রিয়াশীল, বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের মুৎসুদ্দী, কাজেই উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সফল করতে হলে অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির সাথে বুর্জোয়া শ্রেণীকেও সম্পূর্ণভাবে পরাজিত না করে তা সম্ভব নয়। এবং এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন শুধুমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের পথেই সম্ভব।
তত্ত্বগত দিক থেকে কার্পেজের এই বক্তব্য এবং ১৯৪৭ এর জুন মাসে অনুষ্ঠিত সোভিয়েট বিশেষজ্ঞদের সভায় ব্যালাবুশেভিচ ও দিয়াকভের বক্তব্যের কোন মৌলিক প্রভেদ নেই। সে প্রভেদ তাঁদের ক্ষেত্রে দেখা দেয় রণনীতি ও পদ্ধতির প্রশ্নে। কাজে যেখানে সরাসরিভাবে সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলেন সোভিয়েট বিশেষজ্ঞেরা সেখানে প্রশ্নটিকে রেখে দেন অনেকাংশে অমীমাংসিত।
৩. নেহেরু সম্পর্কে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নোতুন সিদ্ধান্ত
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার ফলে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির চরমপন্থীরা অল্প সময়ের জন্যে যোশীর আপোষপন্থী সংস্কারবাদী নেতৃত্বের কাছে নতি স্বীকার করলেও সে অবস্থার অবসান ঘটতে বিলম্ব হয়নি। যোশীর আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব সত্ত্বেও বামপন্থীদের বক্তব্য প্রথম দিকেও পার্টির মধ্যে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে। স্বাধীনতা উৎসবের মধ্যেও তাই রণদীভে পার্টি মুখপত্র ‘পিপল্স্ এজ’-এর পাতায় নেহেরু সরকারের দক্ষিণপন্থী ও আপোষমুখী চরিত্র সম্পর্কে সকলকে হুশিয়ার করে দিয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করেন।[২৫] শুধু তাই নয়, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্র ‘কমিউনিস্ট’ এর পাতায় অগাস্ট মাস থেকেই যগোস্লাভ পার্টি নেতাদের প্রবন্ধও প্রকাশিত হতে শুরু করে।[২৬] ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে ‘আন্তর্জাতিক উন্নয়নের সমস্যাবলী: একটি মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণ’ এই নামে এডওয়ার্ড কার্পেজের একটি লেখা তাঁরা পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেন।[২৭] বুর্জোয়া শ্রেণী সামগ্রিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরভুক্ত হয়েছে প্রবন্ধটিতে কার্পেজের এই বক্তব্য ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বামপন্থীদের জঙ্গী মনোভাবকে অধিকতর জোরদার করে। এর ফলে তাঁরা নেহেরু সরকারের প্রতি আনুগত্যের নীতি পরিহারের জন্যে ক্রমশ আভ্যন্তরীণ চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।
কিন্তু শুধু আন্তর্জাতিক বক্তব্যই যে কমিউনিস্ট পার্টির বামপন্থীদের নোতুন রণনীতি গ্রহণ ও সাংগঠনিক রদবদলের প্রেরণা যুগিয়েছিলো তা নয়। আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির পরিবর্তন এক্ষেত্রে ছিলো অধিকতর প্রভাবশালী। যোশীর ‘আনুগত্যে’র নীতিকে প্রথম থেকেই পার্টির অসংখ্য সদস্য স্বীকার করে নিতে পারেননি। বহুদিনের সংগ্রামী প্রস্তুতি এবং তেলেঙ্গানা ইত্যাদির অভিজ্ঞতার পর তাঁরা যে সময় নোতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের চিন্তা করছিলেন সে সময় তাঁদের কাছে আপোষের রাজনীতি প্রথম থেকেই মনে হয়েছিলো ঘটনাপ্রবাহের সাথে সামঞ্জস্যহীন।
ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতি ক্ষেত্রে কংগ্রেসের তৎপরতার ফলে এই অবস্থা বেশ প্রকট হয়ে ওঠে। তারা কমিউনিস্ট প্রভাবিত নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রভাবকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস নামে একটি নোতুন সংস্থা খাড়া করে এবং তার ফলে পার্টির কর্মীরা ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে ভয়ানক অসুবিধার সম্মুখীন হন। সেখানে কংগ্রেসের প্রভাবকে ঠেকিয়ে রাখার জন্যে অধিকতর জঙ্গী কর্মসূচীর প্রয়োজন অনুভূত হয়, কিন্তু পার্টির আপোষ ও আনুগত্যের নীতি হয়ে দাঁড়ায় সেদিক দিয়ে মস্ত বাধাস্বরূপ। সেই বাধাকে অতিক্রম করার জন্যে পার্টির মধ্যে আভ্যন্তরীণ চাপ ক্রমশঃ দারুণভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ভারতীয় রাজনীতিতে নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের যে প্রগতিশীল ভূমিকার কথা যোশী বিবৃত করেছিলেন কংগ্রেস বস্তুতঃ সে ভূমিকা পালনে প্রথম থেকেই ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদের সাথে ভারত সরকারের একটা আঁতাতের প্রস্তুতিও চলতে থাকে প্রথম থেকেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে যোশীর বিরুদ্ধে পার্টির অভ্যন্তরে বিক্ষোভ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তাঁকে ‘পেটি বুর্জোয়া সংস্কারবাদী’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করে সম্পাদকের দায়িত্বশীল পদ থেকে অপসারণের জন্যে সাধারণভাবে দাবী ওঠে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে রণদীভে এবং অন্যান্য চরমপন্থীরা অবস্থার এই পরিবর্তনকে রণনীতি ও সাংগঠনিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হন।
১৯৪৭ এর সেপ্টেম্বর মাসে পোল্যান্ডে কমিনফর্মের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে জাদনভ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। সাম্রাজ্যবাদের তৎকালীন ভূমিকা বর্ণনা প্রসঙ্গে উপনিবেশগুলিতে তারা যে সংকট সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করে চলেছেন তিনি তার উল্লেখ করেন। ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদীরা ধ্বংস করার চেষ্টায় কিভাবে লিপ্ত হয়েছে তিনি তাঁর ভাষণে তারও বর্ণনা দেন। জাদনভ আরও বলেন যে ‘ভারত ও চীনকে সাম্রাজ্যবাদের আওতাভুক্ত এবং নিরবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে সাম্রাজ্যবাদ তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিজের শক্তিকে খাটো করে এবং শত্রুর শক্তিকে বড়ো করে দেখা শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে একটা বিপজ্জনক ব্যাপার বলে তিনি উপনিবেশ অঞ্চলের শ্রমিক শ্রেণীর পার্টিগুলিকে সাবধান করে দেন এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটা দৃঢ় প্রতিরোধ আন্দোলন গঠন ও পরিচালনার জন্যে সংশ্লিষ্ট কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের প্রতি আহ্বান জানান।[২৮]
কিন্তু এসব সত্ত্বেও জাদনভ তাঁর বক্তৃতায় উপনিবেশগুলিতে বুর্জোয়া শ্রেণীকে সামগ্রিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হিসাবে বর্ণনা করে তার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কথা সরাসরিভাবে উল্লেখ না করে কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘গণতান্ত্রিক’ সাম্যবাদী লক্ষ্য অনুসরণের পরামর্শ দেন। কমিনফর্মের এই অধিবেশনে কাজে তাঁর ভাষণে ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে একই সূত্রে গ্রথিত করে এমন এক অখণ্ড রণনীতি নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন যা বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে পরিচালিত হবে। কার্পেজের এই ভাষণ এবং তার সাথে যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে মার্শাল টিটোর মূল রিপোর্টটিও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্র ‘কমিউনিষ্ট’ এ প্রকাশিত হয়।
একদিকে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কংগ্রেসের আক্রমণাত্মক ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং অন্যদিকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের জঙ্গী বক্তব্যসমূহের প্রভাবে যোশীর নেতৃত্ব এক দারুণ সংকটের সম্মুখীন হয়। নেহেরু সরকারের ‘অনুগত বিরোধিতার’ পরিবর্তে তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির এক প্রভাবশালী অংশ রণদীভের নেতৃত্বে নোতুনভাবে পার্টির মধ্যে নিজেদেরকে সংহত করতে সচেষ্ট হন।
এই সময় কমিউনিস্ট পরিচালিত নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের নেতা শ্রীপত অমৃত ডাঙ্গে ওয়ার্লড্ ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়নস-এর অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে প্রাগ্ যান এবং সেখান থেকে পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েট ইউনিয়ন সফরের পর ভারতে ফিরে আসেন। সফরকালে ভারতীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর সাথে কমিনফর্ম ও সোভিয়েট পার্টির নেতাদের আলাপ-আলোচনা হয়। এবং সম্ভবতঃ তাঁরা ভারতে টিটোপন্থী নীতি অনুসরণকে পরোক্ষ অনুমোদন দান করেন। এ সম্পর্কে সঠিক ও নিশ্চিতভাবে কিছু জানা না গেলেও রজনীপাম দত্ত এই প্রসঙ্গে ডাঙ্গেকে ভারতে ‘টিটোপন্থী প্রভাবের অন্যতম প্ৰধান ধারক’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন।[২৯]
১৯৪৭ সালে ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বোম্বাইয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এক অধিবেশন বসে। তার ঠিক এক সপ্তাহ পূর্বে বোম্বাই প্রদেশের কংগ্রেসী সরকার পার্টির মুখপত্র ‘পিপল্স এজ’-এর উপর অনেক রকম নিষেধাজ্ঞা জারী করেন।[৩০] এর ফলে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনাকালে চরমপন্থীদের আরও সুবিধা হয় এবং তাঁরা রণদীভের নেতৃত্বে যোশীর ‘অনুগত বিরোধিতার’ নীতি ও কর্মসূচীকে দারুণভাবে আক্রমণ করেন। অধিবেশনে যোশীর আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব বজায় থাকলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে পার্টি কর্মসূচীর মধ্যে আমূল পরিবর্তনের স্বপক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলেন যে সারা দুনিয়া দুটি পরস্পর বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়েছে এবং নেহেরু সরকার বৃহৎ বুর্জোয়া প্রভাবে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের তাঁবেদার ব্যতীত আর কিছুই নয়। সেই হিসাবে যোশী এবং রজনীপাম দত্তের সমালোচনা প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন যে কংগ্রেসের মধ্যে প্রগতিশীল দলগুলির কাজকর্ম এবং গণচাপের মাধ্যমে নেহরু সরকারকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতি অনুসরণে বাধ্য করার নীতি সুবিধাবাদেরই নামান্তর। কাজেই সেই সরকার এবং তার মূল ভিত্তি ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সামগ্রিক সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যে তাঁরা পার্টির সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান।
নেহেরু এবং বৃহৎ বুর্জোয়াকে ভারতীয় জনগণের শত্রু হিসাবে নির্দেশ করা সত্ত্বেও এই পর্যায়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একমাত্র যুগোস্লাভ পার্টি ব্যতীত অন্য কোন পার্টি ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের পরামর্শ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
৪. ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস
কেন্দ্রীয় কমিটির উপরোক্ত বোম্বাই অধিবেশনে নেহেরু এবং ভারতীয় বুর্জোয়া পাটি সম্পর্কে একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয় ও সামগ্রিক ধনতন্ত্রবিরোধী রণনীতির অনুমোদন এবং প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে একটি কংগ্রেস আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয়। এই কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই রণদীভে এবং অন্যান্য চরমপন্থীরা কেন্দ্ৰীয় কমিটিতে প্রাধান্য লাভ করেন এবং পার্টির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে যোশী সমর্থকদেরকে অপসারণ করতে তৎপর হন। ডিসেম্বর মাসের অধিবেশনে কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টি সভ্যদের জন্যে একটি রাজনৈতিক রিপোর্টের খসড়া তৈরীর উদ্দেশ্যে একটি সাব-কমিটি গঠন করেন। এ ছাড়া কংগ্রেসের সামনে পেশ করার জন্যে কেন্দ্রীয় কমিটি নোতুন সদস্যদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন।
রাজনৈতিক রিপোর্টটির উপর আলোচনা এবং কংগ্রেসের প্রতিনিধি নির্বাচনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক প্রাদেশিক কমিটি নিজেদের সম্মেলন আহ্বান করেন। রাজনৈতিক রিপোর্টের খসড়া রচনা থেকে প্রাদেশিক সম্মেলন পর্যন্ত সবকিছুই অতি অল্পকালের মধ্যেই দ্রুতভাবে সম্পন্ন হয় এবং ডিসেম্বর মাসের কেন্দ্রীয় কমিটির অধিবেশনের মাত্র আড়াই মাস পরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস ২৮শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮, কলকাতাতে মিলিত হয়।[৩১]
‘পিপলস্ এজ’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ৯১৯ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে ৬৩২ জন কংগ্রেসে উপস্থিত হন। এঁদের মধ্যে ৫৬৫ জন ছিলেন সার্বক্ষণিক কর্মী অর্থাৎ প্রধানত পাৰ্টি সংগঠক। তেলেঙ্গানা থেকে ৭৫ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেও শেষ পর্যন্ত উপস্থিত হতে পারেন মাত্র চার পাঁচজন। অস্ট্রেলিয়া, বার্মা, সিংহল এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধিরাও এই কংগ্রেসে উপস্থিত থাকেন। বৃটিশ অথবা সোভিয়েট পার্টি দ্বিতীয় কংগ্রেসে কোন প্রতিনিধি পাঠাননি।[৩২]
কংগ্রেসে অস্ট্রেলিয়া, বার্মা এবং সিংহলের প্রতিনিধিরা মোটামুটিভাবে নীরব দর্শকের ভূমিকা অবলম্বন করলেও যুগোস্লাভ পার্টির প্রতিনিধি ভ্লাদিমির দেদিয়ের এবং রাদোভের হকোভিক উভয়েরই ভূমিকা সেখানে ছিলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধনতন্ত্রবিরোধী রণনীতির অধীনে সমসূত্রে প্রথিত গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে নিজেদের বক্তব্য তাঁরা কংগ্রেসে এত বলিষ্ঠভাবে উত্থাপন ও আলোচনা করেন যাতে করে সকলের মনে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে তাঁরা কমিনফর্মের পূর্ণ অনুমোদনক্রমে তা করছেন। অস্ট্রেলীয় পার্টির প্রতিনিধি শার্কী যুগোস্লাভদের এই পরামর্শ সম্পর্কে কোন আপত্তি করেননি এবং কোন দিক থেকে সেই বক্তব্যের কোন বিরোধিতা না হওয়ায় ভারতীয় পার্টির মধ্যে টিটোপন্থী রণনীতি অপ্রতিহত প্রাধান্য লাভ করে। এখানে সব থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, মাও সেতুঙ এর তত্ত্বগত চিন্তা অথবা চিনের কমিউনিস্ট পার্টির অনুসৃত রণনীতির কোন উল্লেখই সেখানে কেউ প্রয়োজন মনে করেননি।[৩৩]
যুগোস্লাভদের তাত্ত্বিক বক্তব্যের সাথে রণদীভের পূর্ব পরিচয় ছিলো এবং প্রধানতঃ তার উপর ভিত্তি করেই তিনি নিজের ব্যক্তব্যকে দাঁড় করিয়েছিলেন। কংগ্রেস যুগোস্লাভ প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ও সক্রিয় ভূমিকা রণদীভের হাতকে অনেকখানি বেশী শক্তিশালী করে এবং প্রথম থেকেই তিনি কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হন।
খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবের উপর রণদীভে যে রিপোর্ট পেশ করেন সেটাই কংগ্রেসের পরবর্তী আলোচনার দিক নির্ণয় করে। আলোচ্য রিপোর্টটিতে তিনি বলেন যে ভারতীয় বুর্জোয়ারা ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে একজোট হওয়ার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক শিবিরের সাথে তারা এক অখণ্ড দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। কাজেই জনগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের রণনীতিকে একই সঙ্গে গ্রথিত করে পার্টিকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করে যেতে হবে। তার জন্যে প্রয়োজন হবে সামগ্রিকভাবে ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপুল জনগোষ্ঠিকে সংগঠিত ও পরিচালনা করা। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে রণদীভে শ্রমিক কৃষক পেটি বুর্জোয়া এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে এক জনগণতান্ত্রিক মোর্চা গঠনের প্রস্তাব করেন।[৩৪]
তেলেঙ্গানার অভিজ্ঞতাকে যোশী তাঁর চিন্তার মধ্যে গ্রাধান্য দেওয়া তো দূরের কথা নিজের সংস্কারবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে সে বিষয়ে তিনি ছিলেন উদাসীন। রণদীভে কিন্তু তাঁর রিপোর্টে তেলেঙ্গানার অভিজ্ঞতার উপর জোর দিয়ে বলেন যে ভারতীয় রাজনীতিক্ষেত্রে তা একটা ‘গুণগত’ পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আজ তেলেঙ্গানার অর্থ কমিউনিস্ট এবং কমিউনিষ্টের অর্থ তেলেঙ্গানা।’[৩৫]
কংগ্রেসের বক্তাদের মধ্যে রণদীভের পরই ভবানী সেনের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে কংগ্রেস-লীগ সরকারের সাথে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে তিনি বাঙলাদেশে তেভাগা আন্দোলন স্থগিত রাখার পরামর্শ[৩৬] দেওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারী-মার্চে তিনি হয়ে দাঁড়ান চরমপন্থী রাজনীতির অন্যতম মুখপাত্র।
রণদীভের বক্তব্যকে আরও বিশদভাবে বর্ণনা করে তিনি কংগ্রেসে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। তাতে ১৯৪২ থেকে ৪৮ পর্যন্ত পার্টি অনুসৃত ‘জাতীয়তার নীতিকে’ বর্জন করে বলা হয় যে তৎকালীন অবস্থায় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার কোন একটি বিশেষ জাতির সমগ্র জনগণের দ্বারা অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়; সত্যিকার আত্মনিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে হলে শ্রমিক শ্রেণী ও তার মিত্রদের বৈপ্লবিক সংগ্রামের মাধ্যমেই তা সম্ভব। কাশ্মীর সম্পর্কে তাঁদের পূর্ব অনুসৃত নীতির সমালোচনাকালে তিনি বলেন যে, কাশ্মীরের ভারতভুক্তি সমর্থন করে পার্টি এক মস্ত ভুল করেছিলো। ভবানী সেনও এই প্রসঙ্গে তেলেঙ্গানার উল্লেখ করে বলেন যে আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে সংগ্রামের সত্যিকার পথ হচ্ছে তেলেঙ্গানার পথ।[৩৭]
এ ছাড়া সমগ্র পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন:
এ প্রশ্নের সত্যিকার সমাধান যুদ্ধক্ষেত্রে। তেলেঙ্গানার বীর জনগণ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের মহান উদাহরণের দ্বারা শুধুমাত্র দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে কি ঘটবে তাই দেখায় না, ভারত ও পাকিস্তানের সত্যিকার ভবিষ্যতের কি হবে সেটাও দেখিয়ে দেয়। সেই পথেই বিজয়ী জনগণকে স্বাধীনতা ও সত্যিকার গণতন্ত্র অর্জনের জন্যে এগিয়ে যেতে হবে।[৩৮]
রণদীভে, ভবানী সেন প্রভৃতির বক্তৃতার পর তেলেঙ্গানা আন্দোলনের স্বপক্ষে কংগ্রেসের মনোভাব এত প্রবল হয়ে ওঠে যে তাঁরা সেই আন্দোলনের সমর্থনে একটি পৃথক প্রস্তাব গ্রহণ করেন।[৩৯] মূল রিপোর্টগুলি পঠিত হওয়ার পর যোশী এক আত্ম-সমালোচনামূলক বক্তৃতায় নিজের সমস্ত দোষ ত্রুটি স্বীকার করে বলেন যে তিনি ‘কাপুরুষতা’, ‘পেটি বুর্জোয়া দোদুল্যমানতা’, ‘আমলাতান্ত্রিক মনোভাব’ এবং ‘দক্ষিণ সংস্কারবাদী’ চিন্তার দ্বারা নানা প্রকার বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে প্রকৃতপক্ষে পার্টির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছেন।[৪০]
বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি নোতুন কমিটি নির্বাচনের জন্যে যে মনোনয়ন দেন তাতে পুরাতন কমিটির বহু সদস্যের সাথে যোশীর নামও ছিলো। কিন্তু যোশীর কার্যকলাপের সমালোচনা এবং তাঁর নিজের আত্মসমালোচনামূলক বক্তৃতা তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের মনে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলো যে কেন্দ্রীয় কমিটির মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে একমাত্র যোশীই নির্বাচনে পরাজিত হন। এর পরই নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটি রণদীভেকে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত করে নোতুন রাজনীতিকে কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক নেতৃত্ব স্থাপন করেন।[৪১]
কংগ্রেসের অধিবেশনে নোতুন নেতৃত্ব একটি ‘রাজনৈতিক থিসিস’ পেশ করেন এবং সেই থিসিসের উপর এক দীর্ঘ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ববর্তী খসড়া সম্পর্কে পার্টির অভ্যন্তরে নানা আলোচনার সময় সেটিকে অনেকাংশে পরিবর্তিত করলেও কংগ্রেসে তার উপর আরও অনেক মুলতুবী প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। রাজনৈতিক থিসিসটির উপর আলোচনা শেষ হওয়ার পর সেটিকে অপরিবর্তিত অবস্থায় গ্রহণ করার জন্যে রণদীভে কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানান এবং তাঁদের আলোচনার আলোকে সেটিকে সংশোধন করার জন্যে কেন্দ্ৰীয় কমিটিকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তাঁর সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।[৪২] এই রাজনৈতিক থিসিসটিতেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নোতুন রণনীতি ও কর্মসূচী ঘোষিত হয়। বৈপ্লবিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা প্রসঙ্গে তাতে বলা হয় যে ভারত সশস্ত্র বিপ্লবের পর্যায়ে আছে এবং সেই বিপ্লবকে সফল করার জন্যে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া প্রয়োজন। এই বৈপ্লবিক সংগ্রামের মাধ্যমেই ভারতে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ একই সাথে সাধিত হবে। তার জন্যে পার্টিকে শ্রমিক, কৃষক, পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীকে ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত ও পরিচালনা করা প্রয়োজন। নেহরু সরকার প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় বুর্জোয়ারই প্রতিনিধি, কাজেই সংগ্রামী জনগণের গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের মাধ্যমে সেই সরকারকে আক্রমণ করতে হবে। কংগ্রেসের অধিবেশন চলাকালে কেন্দ্রীয় কমিটি নিজেদের একটি পৃথক প্রস্তাবে কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এর পরই সেখানে সরাসরিভাবে বলেন যে ‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের’ অর্থ সর্বহারার একনায়কত্ব ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। কাজেই নেহেরু সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের বৈপ্লবিক সংগ্রাম অত্যাসন্ন।[৪৩] যুগোস্লাভ পার্টির পরামর্শ শুধু যে ভারতীয় পার্টিকেই গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সমসূত্রে গ্রথিত করার টিটোবাদী নীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো তাই নয়। পরবর্তী অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে বার্মা, মালয়, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশেও সেই একই নীতির অনুসরণে এক সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধ প্রায় ঐ সময় থেকেই শুরু হয়। বার্মা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক থাকিন থান টুন ব্যক্তিগতভাবে দ্বিতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কংগ্রেসে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বার্মায় আসন্ন বিপ্লবের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন যে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা যদি গৃহযুদ্ধ বাধাতে চায় তাহলে তাদেরকে গৃহযুদ্ধেরই সম্মুখীন হতে হবে। এর পর তিনি বলেন, ‘কমরেডগণ, মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে ১৯৪৮ একটি চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরেই দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে মুক্তি আন্দোলনের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।’[৪৪]
দ্বিতীয় কংগ্রেসের ঠিক পূর্বেই কলকাতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই সম্মেলনে ভারত, পাকিস্তান, বার্মা, মালয়, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং উত্তর দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। সোভিয়েট প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসাবে উপস্থিত থাকেন। এ ছাড়া দ্বিতীয় কংগ্রেসে যোগদানের জন্যে আগত যুগোস্লাভ প্রতিনিধিরাও সেই সময় কলকাতাতে সমবেত হন। অনেকে মনে করেন দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ায় বিপ্লবের পতাকা তোলার সত্যিকার নির্দেশ মস্কো থেকেই এসেছিলো এবং এই যুব সম্মেলনেই সেই নির্দেশ সংশ্লিষ্ট পার্টিসমূহের কাছে তাঁরা পৌঁছে দিয়েছিলেন। যোশী অবশ্য পরবর্তীকালে প্রকাশিত তাঁর একটি বিবৃতিতে বলেন যে দ্বিতীয় কংগ্রেসে যুগোস্লাভ প্রতিনিধিরা ব্যক্তিগতভাবে যে রণকৌশলের পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই অনুসারেই কেন্দ্রীয় কমিটি তেলেঙ্গানায় কৃষক বিপ্লব পরিচালনা করে।[৪৫]
৫. পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগসহ কোন প্রতিষ্ঠানই আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টিরও তখন পর্যন্ত কোন পূর্ব পাকিস্তান কমিটি ছিলো না।
সেপ্টেম্বর মাসে ভবানী সেন, আবদুল্লাহ রসুল এবং মনসুর হাবিব ঢাকা আসেন এবং করোনেশন পার্কে একটি জনসভায় বক্তৃতা দেন। এই সফরের সময়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন তাঁদের তিনজনকেই সাক্ষাতের জন্যে আমন্ত্রণ জানান এবং সরকারের সাথে তাঁরা সহযোগিতা করে যাবেন বলে আলোচনাকালে নাজিমুদ্দীন আশা প্রকাশ করেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান সরকারের সাথে সহযোগিতার নীতিই তাঁরা অনুসরণ করে চলেছিলেন। সেই হিসাবে নাজিমুদ্দীনের সাথে ভবানী সেন প্রভৃতির আলাপ মোটামুটি সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়েছিলো।[৪৬]
দ্বিতীয় কংগ্রেসের পূর্বে আবদুল্লাহ রসুল এবং মনসুর হাবিব আবার ঢাকা আসেন। আবদুল্লাহ রসুল সে সময় ঢাকাতে মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে বাসাও ঠিক করেছিলেন। মুজফ্ফর আহমদও এইা সময় ঢাকাতে আসেন এবং রথখোলায় ন্যাশন্যাল বুক এজেন্সীর দোকান ও অফিস ঘর উদ্বোধন করেন।[৪৭]
দেশভাগের পর সরকারী কর্মচারীদেরকে নিজেদের চাকরীর এলাকা বেছে নেওয়ার যে সুযোগ দেওয়া হয় তার ফলে পার্টির অনেক অসুবিধা হয়ে পড়ে। পূর্ব-বাঙলায় বিপুল অধিকাংশ পার্টি সভ্য ছিলেন ‘হিন্দু’। তাঁদের মধ্যে অনেকেই নানা পারিবারিক অসুবিধার জন্যে পশ্চিম বাঙলায় যেতে বাধ্য হন। কিন্তু পার্টির পক্ষে আসল অসুবিধা দেখা দেয় অন্য দিক থেকে। পূর্ব-বাঙলার অধিকাংশ লোকই মুসলমান এবং পার্টি সভ্যদের অধিকাংশ ‘হিন্দু’ হওয়ার ফলে খোলাখুলি কাজের ক্ষেত্রে তাঁরা বহু অসুবিধার সম্মুখীন হন। সেই অসুবিধার আংশিকভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে, কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ‘মুসলমান’ পার্টি সভ্যের পশ্চিম-বাঙলা থেকে পূর্ব-বাঙলায় আসার প্রয়োজন দেখা দেয়।[৪৮] আবদুল্লাহ রসুল এবং মনসুর হাবিব পূর্ব-বাঙলায় কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আবদুল্লাহ রসুল অল্প কিছুদিন থাকার পরই আবার কলকাতা ফিরে যান।
দ্বিতীয় কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি একটি পৃথক সংগঠন হিসাবে কাজ করে যাবে। পুরাতন পার্টি নেতৃত্বের মধ্যে যাঁরা পাকিস্তান অংশের মধ্যে পড়লেন তাঁরা কলকাতাতেই বসে সাজ্জাদ জাহীরকে সম্পাদক করে একটি কমিটি গঠন করেন। এছাড়া বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটিকে ভেঙ্গে দিয়ে তার স্থানে পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার জন্যে পৃথক কমিটিও গঠিত হয়।[৪৯]
কার্যক্ষেত্রে নিখিল পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান পার্টির তেমন কোন সাংগঠনিক সম্পর্ক ছিলো না। তার মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে কিছুটা যোগাযোগ রক্ষা হতো মাত্র।[৫০]
যদিও ১৯৫৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে বেআইনী ঘোষিত হয়নি, তবু দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর স্থির হয় যে অল্প কিছু সংখ্যক কর্মী ও নেতা প্রকাশ্যে কাজ করলেও অধিকাংশই গোপন কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। সেই হিসাবে এর পর থেকে পার্টির অধিকাংশ কর্মী আত্মগোপন করে থাকেন। এঁদের মধ্যে দুই একজন ব্যতীত কেন্দ্ৰীয় কমিটির প্রায় সব সদস্যই ছিলেন।[৫১]
১৯৪৮-এর মার্চ মাসে কোর্ট হাউজ স্ট্রীট এবং কাপ্তেন বাজারে* যথাক্রমে পার্টির শহর ও কেন্দ্রীয় অফিস খোলা হয়। প্রকাশ্য কাজের যতটুকু সুযোগ-সুবিধা ছিলো সেটা ব্যবহারের জন্যেই উপরোক্ত অফিস দুটি চালু রাখা হয়। কাপ্তেন বাজারে পার্টি অফিসের পাশেই পূর্ব পাকিস্তান রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের অফিসও স্থাপিত হয়। এই ইউনিয়নটি তখন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন ছিলো।[৫২]
[* ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এখানেই ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টির প্রাদেশিক অফিস ছিলো।]
১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ১২ই মার্চ মুসলিম লীগের গুণ্ডারা কাপ্তেন বাজার এবং কোর্ট হাউজ স্ট্রীটে অবস্থিত পার্টির প্রাদেশিক ও শহর অফিস আক্রমণ করে। কিছু বইপত্র ব্যতীত অন্য কোন কাগজপত্র সেখানে না থাকায় আসবাবপত্র এবং বইগুলি তছনছ করে তারা চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়।[৫৩] ১৩ই মার্চ রণেশ দাশগুপ্ত এবং ধরনী রায়কে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু ভাষা আন্দোলনে অন্যান্য বন্দীদের সাথে তাঁরা দুজনেও ১৫ই তারিখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। এর পর ঢাকা শহরে পার্টির দুটি অফিসই আবার চালু করা হয়।[৫৪]
জুন মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কার্যসূচী নির্ধারিত হয় এবং সেই কার্যসূচীকে প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করার উদ্দেশ্যে ৩০শে জুন তাঁরা করোনেশন পার্কে একটি জনসভার সিদ্ধান্ত নেন। এই সভার পূর্বে সাত দিন পথ সভা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচারকার্য চালিয়ে যাওয়া হয়। অন্যান্যদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম প্রভৃতি চোঙ্গা নিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় বক্তৃতা এবং স্লোগান দিয়ে ৩০শের সভাকে সাফল্যমণ্ডিত করার উদ্দেশ্যে প্রচারকার্য চালান।[৫৫]
৩০শে জুন করোনেশন পার্কে যে সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন মুনীর চৌধুরী। রণেশ দাশগুপ্ত এবং সরদার ফজলুল করিম এই দুই জনের বক্তৃতা দেওয়ার কথা স্থির হয়।[৫৬ আরও স্থির হয় যে সরদার ফজলুল করিম সাধারণ কার্যসূচী আলোচনা প্রসঙ্গে স্থানীয় সমস্যার উপর বিস্তৃত আলোচনা করবেন এবং রণেশ দাশগুপ্ত বলবেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা সম্পর্কে।[৫৭]
প্রায় এক হাজার লোকের উপস্থিতিতে সভা আরম্ভ হয়। এই সময় শাহ আজিজুর রহমানও তাঁর দলবল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। শুরু থেকেই গণ্ডগোলের আশংকায় সভার মধ্যে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকে। প্রথম বক্তা সরদার ফজলুল করিম তাঁর বক্তৃতা আরম্ভ করার অল্প কিছুক্ষণ পর থেকেই শাহ আজিজের দল সভাপতির কাছে একের পর এক চিরকুট পাঠিয়ে নানারকম প্রশ্নের উত্তর দাবী করতে থাকেন এবং মাঝে মাঝে চীৎকার করে বাধা দানের চেষ্টাও করেন। রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আলোচনা ছাড়া পাকিস্তানের কমনওয়েল্থ্ ত্যাগের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন।[৫৮] পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির ম্যানিফেষ্টোটি সভাতে সরাসরি পাঠ করা হয়নি। কিন্তু সেই কার্যসূচীকে দুজন বক্তাই নিজেদের বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করে সকলকে বোঝান। কথা ছিলো তাঁদের দুজনের পর মুনীর চৌধুরী বক্তৃতা করবেন। কিন্তু সভায় শাহ আজিজুর রহমানদের কার্যকলাপের ফলে পরিস্থিতি বেশ আশংকাজনক মনে হওয়ায় তাঁরা এর পর তাড়াতাড়ি সভা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন। কাজেই মুনীর চৌধুরী সভাপতি হিসাবে দুই এক কথা সাধারণভাবে বলার পর সেদিনকার মতো তাঁর সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।[৫৯]
এই ঘোষণার পরই শাহ আজিজেরা চীৎকার করে সভা ভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁদের বক্তব্য পেশ করার দাবী করেন এবং তার পরই কিছু ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। এই গণ্ডগোলের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা সভাস্থল পরিত্যাগ করে তাঁদের অফিসের দিকে চলে যান, কারণ মুসলিম লীগ গুণ্ডপাদের দ্বারা তাঁদের অফিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। তাঁরা সভাস্থল ত্যাগ করার পর শাহ আজিজেরা ময়দান দখল করে কিছুক্ষণ কমিউনিস্ট পার্টিকে নানা গালাগালির পর নিজেদের সভা শেষ করেন।[৬০]
৩০শে জুন করোনেশন পার্কের সভার পর সন্ধ্যার দিকে প্রায় এক হাজার লোক কোর্ট হাউজ ষ্ট্রীটের পার্টি অফিস ঘেরাও করে আক্রমণ চালায় এবং তাদের সাথে অফিসের লোকদের প্রায় আধঘণ্টাব্যাপী তুমুল খণ্ডযুদ্ধ হয়। বিনয় বসু, অমূল্য সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম ছাড়াও প্রায় জনকুড়ি যুবক তখন অফিসের মধ্যে ছিলেন।[৬১] এই মারামারি ও গণ্ডগোলের সময় প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে দুইজন পুলিশ পাঠিয়ে দেন।[৬২] পার্টি সভ্যেরা বেশ কিছুক্ষণ সেই আক্রমণ প্রতিহত করার পর গুণ্ডারা স্থান ত্যাগ করে এবং সেবারের মতো পার্টি অফিসের ভেতরে প্রবেশ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।[৬৩]
এই পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনী ঘোষণা করার কোন পরিকল্পনা সরকারের ছিলো না। কিন্তু অন্যান্য উপায়ে এবং নির্যাতনের মাধ্যমে পার্টির কাজে সর্বতোভাবে বাধা প্রদানের সিদ্ধান্ত তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন ও সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করতে তাঁদের চেষ্টা এবং উদ্যোগের ত্রুটি ছিলো না।
৭ই জুলাই রণেশ দাশগুপ্ত এবং ধরনী রায়কে গ্রেফতার করা হয়। এর পরই মোটামুটিভাবে সকলে খোলাখুলি কাজ বন্ধ করে গোপনীয়তা রক্ষা করে চলার সিদ্ধান্ত নেন।[৬৪]
দ্বিতীয় কংগ্রেসের সময় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য সংখ্যা ছিলো প্রায় দশ বারো হাজার। কিন্তু এই সংখ্যা মার্চের পর থেকেই দ্রুত কমে আসতে থাকে।[৬৫] পূর্বে ঢাকা শহরে এবং পার্টির বিভিন্ন জেলা অফিসগুলিতে ছাত্র এবং কর্মীদের যে ভীড় দেখা যেতো পরবর্তী পর্যায়ে তাও পাতলা হয়ে আসে এবং অল্প দিনের মধ্যেই তাঁদের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় নগণ্য।[৬৬]
এর কারণ দ্বিতীয় কংগ্রেসে গৃহীত নোতুন রণনীতি এবং পরবর্তী রণকৌশলের ভিত্তিতে পার্টি যে কার্যসূচী গ্রহণ করেছিলো তাকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে পার্টি সভ্য এবং দরদীদের উপর যে দায়িত্ব বাস্তবতঃ অর্পিত হয় অথবা অর্পিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তা পালনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও মনোবলের অভাব। বহুদিন যাবৎ সংসদীয় আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার ফলে পার্টি সভ্যেরা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্যে উচিতমতোভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। এই অবস্থা আরও ঘোরতর আকার ধারণ করে তাঁদের অধিকাংশের শ্রেণীগত দুর্বলতার জন্যে। পেটিবুর্জোয়া আধিপত্যের ফলে সভ্য হওয়াও তখন তেমন কঠিন ছিলো না এবং সেই সুযোগে এমন অনেকে পার্টির মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে সমর্থ হন যাঁদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন বৈপ্লবিক সম্ভাবনাই ছিলো না। প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত থেকে পেটি বুর্জোয়া আত্মপ্রসাদ এবং জনপ্রিয়তার জন্যেই তাঁরা পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। কাজেই সত্যকার সংগ্রাম এবং সশস্ত্র বিপ্লবের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো অবস্থা তাঁদের ছিলো না। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই প্রথম দিকে উধাও হন এবং অনেকে কোন প্রকারে মুখ রক্ষা করে পার্টির সাথে সম্পর্ক ছেদের উপায় অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকেন।[৬৭]
৬. জননিরাপত্তা আইন ও সরকারী দমননীতি
শুধু কমিউনিস্ট পার্টি নয়, সামগ্রিকভাবে সমস্ত বিরোধীদলকে দমনের উদ্দেশ্যে সরকার জননিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য বহু নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এই নির্যাতন অবশ্য প্রধানত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়।
সরকারের এই দমননীতির বিরুদ্ধে অন্যান্য মহল তো দূরের কথা এমনকি সরকারের অনুগত সংবাদপত্র দৈনিক আজাদ পর্যন্ত প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়। ১১ই মার্চ ১৯৪৯ তারিখের দৈনিক আজাদ-এর এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়:
আমাদের কর্তৃপক্ষকে জানাইয়া দিতে চাই যে, আতংকগ্রস্ততা ও দমননীতির উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল না হইয়া তাঁরা দেশ হইতে দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও সামাজিক ভেদবৈষম্য দূর করিবার কাজকে ত্বরান্বিত করুন। ইহা করিতে পারিলেই পাকিস্তানে কমিউনিজমের প্রবেশের দূরতম এবং ক্ষীণতম সম্ভাবনাও চিরদিনের জন্য দূর হইয়া যাইবে।
কেবলমাত্র সরকারই নয়, প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা-ভাবনায় অভ্যস্ত কিছু সংখ্যক ব্যক্তিও দমনমূলক ব্যবস্থার পক্ষে খোলাখুলিভাবে তাঁদের মত প্রকাশ করেন। এ সম্পর্কে নওবেলালের ১৭ই মার্চ, ১৯৪৯ তারিখের একটি সম্পাদকীয়তে বলা হয়:
আজ জনসাধারণের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক যাহারা কঠোর দমননীতি চালাইয়া যাইবার জন্য সরকারকে চাপ দিতেছেন তাহারা প্রকৃতপক্ষে কমিউনিজমের কাজ আগাইয়া দিতেছেন। তাহারা হারা যদি সত্য সত্যই কমিউনিজম বিরোধী হইয়া থাকেন তাহা হইলে তাহাদের উচিত দেশের প্রধান প্রধান সমস্যা যথা – শিক্ষা সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, মানুষ মানুষের মতো বাঁচিয়া থাকিবার সমস্যা ইত্যাদির আশু এবং উপযুক্ত সমাধান করিবার জন্য সরকারকে বাধ্য করা।
১৯৪৯ এর মে মাসে পূর্ব-বাঙলা সরকার চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান-এর নিকট থেকে ৩০০০ টাকা জামানত তলব এবং ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উত্তেজনামূলক সম্পাদকীয় ও সংবাদ প্রকাশের’ ওপর সেন্সরশীপ জারী করেন।[৬৮] এ ছাড়া ঐ একই মাসে ঢাকায় ইংরেজী সাপ্তাহিক ইস্টার্ণ স্টার-এর ওপরও তাঁরা ১৯৪৬ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বলে সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশের পূর্বে সেগুলি সরকারকে দেখানোর জন্যে তাঁদের ওপর এক নির্দেশ জারী করেন।[৬৯]
এই দুই পত্রিকার ওপরই উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা জারীর পর অনেক প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার সেই নিষেধাজ্ঞাগুলিকে প্রত্যাহার করার কোন ব্যবস্থা না করে সেগুলিকে বহাল রাখেন। এই সরকারী মনোভাব ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নওবেলাল ১৯৪৯ এর ২রা জুন সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন:
সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সকল স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানই প্রতিবাদ জানাইয়া অবিলম্বে এই আদেশ প্রত্যাহার করিবার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানাইয়াছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকার তাহাদের আদেশ বলবৎ রাখিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদপত্রের সংখ্যা পাকিস্তানের অন্য প্রদেশের তুলনায় খুবই অল্প। এই প্রদেশে শক্তিশালী সংবাদপত্র যাহাতে ত্বরিত গড়িয়া ওঠে সরকারের উচিত ছিল সে ব্যবস্থা করা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সরকার তার বিপরীত পন্থাই অবলম্বন করিতেছেন। দেশের জাগ্রত জনমত তাহা কোনমতেই অনুমোদন করিতে পারে না এবং করেও নাই। জনমতের প্রতিধ্বনি করিয়া আমরা সরকারকে আরও একবার অনুরোধ করিব আপনাদের আদেশ প্রত্যাহার করুন।
২রা জুন, ১৯৪৯, এর নওবেলাল-এ প্রকাশিত একটি খবরে জানা যায় যে, চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান-এর সম্পাদক জনাব আবদুস সালাম তাঁর পত্রিকার বিরুদ্ধে সরকারী দমননীতির প্রতিবাদে ১লা জুন থেকে অনশন শুরু করেন। শুধু পূর্ব পাকিস্তানেই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানেও পশ্চিম পাকিস্তান জন-নিরাপত্তা আইন ও পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে এবং সেই প্রতিবাদে মুসলিম লীগের নেতারা পর্যন্ত শরীক হন। ১৯৪৯-এর অক্টোবর মাসে পশ্চিম পাঞ্জাব প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলের পরবর্তী অধিবেশনে প্রাদেশিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ ইকবাল চীমা পশ্চিম পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইন এবং পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স রহিত করার জন্যে এক প্রস্তাবের নোটিশ দেন।[৭০]
সে সময় পশ্চিম পাঞ্জাব প্রাদেশিক লীগের কাউন্সিল সদস্য মোহাম্মদ আবদুল্লাহ খানকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধেও চীমা ও লাহোর মুসলিম লীগের সভাপতি জাফরুল্লাহ পৃথক পৃথক বিবৃতিতে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন
পশ্চিম পাঞ্জাব সাংবাদিক সংঘের কার্যকরী কমিটিও জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স এর তীব্র নিন্দা করে এক প্রস্তাব নেন এবং তাতে তাঁরা ঐ অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার জন্যে পাকিস্তানের সাংবাদিকদের কাছে আবেদন জানান।[৭২]
এ ছাড়া ১০ই অক্টোবর, ১৯৪৯, তারিখে লাহোরে এক বিরাট জনসভায় পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে এক প্রস্তাব পাশ করা হয়। সেই প্রস্তাবে বেগম শাহ নওয়াজ, মালিক ফিরোজ খান নুন, খান ইফতেখার হোসেন খান (মামদোত), মিয়া মমতাজ দৌলতানা, মিয়া ইফতেখার উদ্দীন, সর্দার শওকত হায়াত খান, শেখ কেরামত আলী প্রভৃতি পাকিস্তান বিধান সভার সদস্য এবং মুসলিম লীগের পাণ্ডা ব্যক্তিরাও স্বাক্ষর দান করেন। এই প্রস্তাবটিতে তাঁরা বলেন:
দেশের মধ্যে এমন কোন অবস্থার সৃষ্টি হয় নাই যাহার জন্য এই যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা আবার নতুন করিয়া গ্রহণ করিবার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে। স্বাধীনতা অর্জনে দেশবাসী আশা করিয়াছিল যে নাগরিক অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকিবে। কিন্তু সরকার দেশবাসীর আশা ভঙ্গ করিয়া এই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা আবার নতুন করিয়া দেশের উপর চাপাইয়া দিতেছেন।[৭৩] জননিরাপত্তা আইনের বলে সরকার সংবাদপত্র সম্পাদক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মী পর্যন্ত সকলকে ব্যাপকভাবে ধরপাকড় শুরু করে। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহও এই সরকারী হামলার শিকারে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রগতি লেখক সংঘকে সরকার একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে নানা প্রকার দমন ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। এ সম্পর্কে ১৩ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫০, করাচীর লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ছাত্র, যুবক ও কৃষকদের এক সভায়৪ প্রগতি লেখক সংঘকে সরকার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে যে ঘোষণা করেছিলেন তা বাতিল করার দাবী জানানো হয়। উক্ত সভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবে তাঁরা সরকারের এই ঘোষণাকে শুধু সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক কার্যাবলীর উপর আক্রমণ নয়, নাগরিক অধিকারের উপর আক্রমণ বলে অভিহিত করেন।
৭ই এপ্রিল, ১৯৫০, করাচীতে পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদকদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।[৭৫] সেই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের কোন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেননি। সম্মেলনে পাকিস্তান সরকারের জননিরাপত্তা আইন সম্পর্কে সভ্যদের মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা চলে এবং সেখানে সরকার কর্তৃক জননিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ সংবাদপত্রের উপর যাতে না হয় সে বিষয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। কিন্তু সম্মেলন সেই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের সাতজন সম্পাদক অধিবেশন গৃহ পরিত্যাগ করেন। এ প্রসঙ্গে ২৭শে এপ্রিল নওবেলাল ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে বলেন:
সম্প্রতি করাচীতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদক সম্মেলনের অধিবেশন হইতে লাহোরের কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিক সম্মেলনের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া বাহির হইয়া আসিয়াছেন। পাকিস্তান সরকারের জননিরাপত্তা আইনের কবল হইতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদিগকে অব্যাহতি দিবার জন্য যে প্রস্তাব করা হইয়াছিল তাহা সম্মেলনে অগ্রাহ্য হইয়া যাওয়ায় তাহারা এই পন্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছেন। এই আইন অনুযায়ী সরকার কোন কারণ না দর্শাইয়াই যে কোন সময়ে যে কোন সংবাদপত্র বন্ধ করিয়া দিতে বা যে কোন সংবাদপত্র সম্পাদককে কারা প্রাচীরের অন্তরালে নিক্ষেপ করিতে পারেন। দেশে জরুরী অবস্থাধীনে এই ধরনের আইনের প্রয়োজনীয়তা থাকিতে পারে কিন্তু সাধারণ অবস্থায় এইরূপ বিশেষ ক্ষমতার ব্যবস্থাকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের নামান্তর ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।
করাচীর সংবাদপত্র সম্পাদক সম্মেলনে সাতজন সম্পাদক যে প্রস্তাব আনেন তাতে জননিরাপত্তা আইন বাতিলের কোন দাবী ছিলো না। আইনটি যাতে সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয় এই ছিলো তার সুপারিশ। কিন্তু এই সুপারিশও সম্পাদকদের নিজেদের দ্বারাই অগ্রাহ্য হয়।
পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন জননিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যক্ষেত্রে তা পালন করা হয় নাই। ঐ সম্পর্কে ঢাকার অন্যতম ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার মন্তব্য করে:
এই ধরনের প্রতিশ্রুতির কোন অর্থই হয় না। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কাইয়ুম মন্ত্রীসভা, মন্ত্রীসভার রদবদল সম্পর্কে এক সংবাদ প্রকাশ করার জন্য ‘সরহদ’ পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তানেও এইরূপ বা ইহার চেয়েও নগণ্য কারণে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন। সমগ্র পাকিস্তান জুড়িয়া এবং বিশেষ করিয়া উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পূর্ব পাকিস্তানে বিশিষ্ট মুসলিম লীগ পন্থীদের পর্যন্ত এই আইনের আওতায় ফেলিয়া বিনা বিচারে আটক রাখা হইয়াছে এবং হইতেছে।[৭৬]
পূর্ব-বাঙলার কথা উল্লেখ করে ঢাকার কুখ্যাত ইংরেজী দৈনিক মর্নিং নিউজ পর্যন্ত ১৮ই এপ্রিল, ১৯৫০, এক সম্পাদকয়ীতে লেখে:
এখানে কর্তৃপক্ষ জনকল্যাণমূলক সমালোচনা সহ্য করিতেও প্রস্তুত নহেন। প্রাদেশিক প্রেস কনসালটেটিভ কমিটির ১১ জন সদস্যের মধ্যে চারিজনই সরকারী কর্মচারী। এই কমিটিকে জিজ্ঞাসা না করিয়াই সম্পাদকদেরকে গ্রেফতার করা হইতেছে। জামানত তলব দেওয়া হইতেছে এবং সংবাদপত্র বন্ধ করা হইতেছে।[৭৭]
সরকার জননিরাপত্তা আইনের বলে একের পর এক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং পত্রিকা সম্পাদকের বিরুদ্ধে হামলা চালায়। সরকারের সাথে সামান্য মতবিরোধ পর্যন্ত তারা দমন করতে বদ্ধপরিকর হয়ে নির্বিচারে তাদের দমননীতি প্রয়োগ করে। শুধু ঢাকা, লাহোর এবং অন্যান্য বড়ো শহর থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র পত্রিকার উপরই তাদের এই হামলা সীমাবদ্ধ ছিলো না। মফস্বলের সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলির মধ্যে বহুসংখ্যক পত্রিকাই সরকারের জননিরাপত্তা আইনের কবলে পড়ে। ফেনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংগ্রাম সম্পাদক ফয়েজ আহমদ এই আইনে গ্রেফতার হওয়ার পর ২রা নভেম্বর, ১৯৫০, ‘দুর্ভাগা সাংবাদিক’ নামে একটি সম্পাদকীয়তে নওবেলাল বলেন:
জনাব আহমদ ‘নিরাপত্তা আইনের’ কবলে পড়িয়াছেন। আমরা প্রকাশ্য আদালতে তাহার সুবিচার চাই। যদি সরকার জনমতের ধার ধারিয়া থাকেন – দোষী হইলে নিশ্চয়ই আহমদ সাহেব শান্তি বরণ করিয়া নিবেন – নির্দোষী হইলে তাহার মুক্তি চাই। – ‘পূর্ব পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদক সংঘ’ একবার সরকারকে জিজ্ঞাসা করুন সরকার কি তাহার অলঙ্ঘনীয় দোষের কথা তাহাদিগকে অবহিত করাইবেন? ‘নিখিল পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদক সংঘের’ ষ্ট্যান্ডিং কমিটির রীতি অনুযায়ী সংগ্রাম সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করিয়া দেখুন। কোথায় সম্পাদক সাহেব রাষ্ট্রদ্রোহিতা করিয়াছেন? বৃটিশ আমলের তৈরী একজন কর্মচারীর খেয়ালের বলেই কি এমনিভাবে সাংবাদিকেরা জননিরাপত্তার নামে কারীর প্রাচীরের অন্তরালে থাকিবেন? – আমরা সত্যকারের বিচার চাই। – নির্দোষীদের মুক্তি চাই।
কমিউনিস্ট পার্টিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেআইনী ঘোষণা না করলেও জননিরাপত্তা আইনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের দ্বারা সরকার পাইকারী হারে কমিউনিস্টদেরকে গ্রেফতার করে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এর ফলে বহু পার্টি সদস্য আত্মগোপন করেন এবং অনেকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিশ্চিত জীবন গঠনে নিযুক্ত হন।
৭. জেল নির্যাতন ও অনশন ধর্মঘট
বৃটিশ আমলে রাজবন্দীদের জন্যে ১৯৪০ সালের যে Securty Prisoners Rules ছিলো ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর Bengal Special Powers Ordinance পাস করার সময় সেটাকে বাতিল করা হয়।[৭৮ এর পর থেকে রাজবন্দীদেরকে পূর্বের মতো মর্যাদা না দিলে জেলা শাসক ইচ্ছেমতো তাদেরকে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত করে রেখে যখন যা খেয়াল সেই অনুসারে তাদের সাথে ব্যবহার করতেন। এই ক্ষমতা জেলা শাসকদেরকে আইনগতভাবেই দেওয়া ছিলো। একথা ১৯৪৭ এর ৫ই এপ্রিল পূর্ব-বাঙলা পরিষদে রাজবন্দীদের অনশন সম্পর্কে একটি বিতর্ক চলাকালে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মুফিজউদ্দীন আহমদের পক্ষ থেকে কাজী আবুল মাসুদ স্বীকার করে বলেন যে, রাজবন্দীদের মধ্যে কাকে দ্বিতীয় শ্রেণী এবং কাকে তৃতীয় শ্রেণী দেওয়া হবে সেটা সম্পূর্ণভাবে জেলা শাসকের হাতেই ন্যস্ত আছে।[৭৯]
এই একই বিতর্কের সময় মন্ত্রী মুফিজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর বন্দীদের মধ্যে আসলে তেমন কিছুই তফাত নেই। প্রথম শ্রেণীর বন্দীরা অন্যদের থেকে সাক্ষাৎকারের এবং চিঠিপত্র লেখালেখির সুযোগ বেশী পান। কিন্তু খাদ্য এবং অন্যান্য ব্যাপারে এ দুই শ্রেণীর মধ্যে কোন তফাৎ নেই।[৮০] অন্যদিকে মন্ত্রী আবার একথাও স্বীকার করেন যে Securty Prisoners Rules বাতিল হওয়ার পর রাজবন্দীদেরকে সুযোগ- সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে কোন বাঁধা ধরা নিয়ম ছিলো না। তাঁরা সেক্ষেত্রে পূর্বোক্ত বাতিলকৃত Securty Prisoners Rules-কে অনেকাংশে অনুসরণ করেই বিশেষ বিশেষ অবস্থায় নিজেদের করণীয় স্থির করতেন। কিন্তু পূর্বের Rules সমূহ এ ব্যাপারে পুরোপুরি অনুসরণ করা হতো না।[৮১]
Jail Code অনুসারেই তাদের সুযোগ-সুবিধা মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত হতো এবং সেখানে রাজবন্দীদের কোন পৃথক ব্যবস্থার কথা যে ছিলো না একথাও মুফিজউদ্দীন স্বীকার করেন।[৮২]
মন্ত্রী মুফিজউদ্দীনের এই বিতর্ককালীন উক্তিগুলো থেকেই একথা প্রমাণিত হয় যে রাজবন্দীদেরকে কি ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে এবং তাঁদের সাথে কি ধরনের ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে কোন আইন নির্দিষ্ট ব্যবস্থা ছিলো না। এর অনেকখানি তাই জেলা শাসকের খামখেয়ালী এবং ইচ্ছে অনিচ্ছের ওপরই নির্ভর করতো। আইনের অবর্তমানে জেলা শাসক ছাড়া জেলার, জেল সুপারিনটেন্ডেন্ট এবং জেলের অন্যান্য কর্মকর্তারাও অনেক সময় ইচ্ছামতোভাবে রাজবন্দীদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করতো না।
তৎকালীন রাজবন্দীদের থেকে জানা যায় যে সে সময় রাজবন্দীদের কোন মর্যাদাই দেওয়া হতো না। প্রথম দিকে জেল ভাতা, পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি, খবরের কাগজ ইত্যাদির কোন ব্যবস্থা ছিলো না। আইনত তৃতীয় শ্রেণির কয়েদী না হলেও পরের দিকে তাঁদেরকে তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদীদের খাদ্য দেওয়া হতো, নিজেদের কাপড়ের পরিবর্তে জেলের কুর্তা পরতে হতো এবং সন্ধ্যের পর তাঁদের ঘরে বাতি দেওয়া হতো না।
জেলের অভ্যন্তরে এই নির্যাতন ছাড়াও ১৯৪৯-৫০ সালে রাজবন্দীদের অনশনের আর একটি প্রধান কারণ এই অনশন ধর্মঘট সম্পর্কে তৎকালীন পার্টির সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী। এর সাথে প্রথম দিকে রণদীভে থিসিসের কোন প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ সে সময় অনশনকে বৈপ্লবিক সংগ্রামের একটি পদ্ধতি হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিলো যে জেলের মধ্যে নিজেদের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম শুরু করলে জেলের বাইরে যাঁরা আছেন তাঁরা এর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হবেন এবং তার ফলে দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সামগ্রিকভাবে অনেকখানি এগিয়ে যাবে। রণদীভে থিসিস পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করার নির্দেশ আসার পর এই লাইনকে আরও জোরালোভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তখন জেলখানার কয়েকদীদেরকেও অনশনের দিকে টেনে এনে তাদেরকেও বিপ্লবের দিকে চালনা করার চেষ্টা চলতে থাকে।
এ সময় সাধারণ কয়েদীদেরকে এইভাবে অনশনের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করার নীতির বিরুদ্ধে অনেকে জেলের মধ্যেই বক্তব্য পেশ করেন। তাঁরা বলেন যে এই কয়েদীরা প্রধানতঃ লুমপেন প্রলেটারিয়েট।* এই লুমপেন প্রলেটারিয়েটদেরকে দিয়ে কোন বিপ্লব হতে পারে না, বিশেষ করে জেলের মধ্যে এই বক্তব্য যাঁরা দেন তাঁদেরকে সংস্কারপন্থী আখ্যা দিয়ে তাঁদের সমালোচনা অগ্রাহ্য করা হয়।[৮৩]
[* লুমপেন প্রলেটারিয়েট : ভবঘুরে সর্বহারা]
পূর্ব-বাঙলায় জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয় তখন ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষত পশ্চিম বাঙলাতেও, জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। সেখানেও অনশন ধর্মঘটকে সংগ্রামের একটা পদ্ধতি হিসাবে স্বীকার করে নিয়ে তার দ্বারা ব্যাপক জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। সেই হিসাবে দমদম, আলীপুর ইত্যাদি কেন্দ্রীয় কারাগারগুলিতে অনশন ধর্মঘটকে তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর জবাবে পশ্চিম বাঙলা সরকার কর্তৃক দমদম এবং আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে এই সময় রাজবন্দীদের ওপর অকথ্য এবং নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।
১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকেই সর্বপ্রথম অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং পূর্ব বাঙলার সমস্ত জেলে একই সময় সেই ধর্মঘট শুরু করার জন্যে বিভিন্ন জেলের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চলতে থাকে। এই যোগাযোগ প্রধানত বদলীকৃত কয়েদীদের মাধ্যমেই স্থাপিত হতো।
যোগাযোগ মোটামুটিভাবে স্থাপিত হওয়ার পর ঢাকা এবং রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারসহ পূর্ব বাঙলার সমস্ত জেলে কমিউনিস্ট রাজবন্দীরা ১১ই মার্চ, ১৯৪৯ থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন।
ঢাকা জেলে সে সময় প্রায় ১০০ জন রাজবন্দী ছিলেন। তাঁদের পক্ষ থেকে রণেশ দাশগুপ্ত জেল কর্তৃপক্ষকে ধর্মঘটের নোটিশ দেন।[৮৪ এই সময় এক পাঞ্জাবী IMS (ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস) ছিলো ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্স। সে প্রথমে রণেশ দাশগুপ্তের নোটিশের জবাবে তাঁদেরকে পাল্টা নোটিশ পাঠিয়ে জানায় যে তাঁদের অনশন ধর্মঘট সম্পূর্ণ বেআইনী।
নোটিশ যখন রণেশ দাসগুপ্তের কাছে সার্ভ করতে আসে তখন অন্যান্য সকলে তাঁকে ঘিরে ধরেন এবং নোটিশটা না নেওয়াই স্থির করেন। এর পর নোটিশ সার্ভ করবার জন্য তারা রণেশ দাশগুপ্তকে জেল গেটে নিয়ে যায়। সেখানেও তিনি সেটি নিতে অস্বীকার করায় তারা জোর করে তার হাতে নোটিশটি দিয়ে দেয়।[৮৫]
এর পর উপরোক্ত আইডি প্রিজন্স নিজে জেলখানায় এসে রাজবন্দীদের সাথে দেখা করে তাঁদের বলে যে, তাঁরা দেশদ্রোহী, দেশপ্রেমিক নন। তাঁরা এখন আর ইংরেজদের কারাগারে নেই। কাজেই কোন রকম বিবেচনা তাঁদের প্রতি করা হবে না।[৮৬] এর পর সে উপস্থিত রাজবন্দীদের জিজ্ঞেস করলো তাঁরা তাঁদের অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে রাজি আছেন কিনা। এর জবাবে সকলেই না, না, বলে চীৎকার করে আইজিকে তাঁদের অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।[৮৭]
ঢাকা জেলে ১১ মার্চ, ১৯৪৯ সকাল থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু হলে ৪৯ জন সেই ধর্মঘটে শরিক হন। সেই দিন সন্ধ্যাবেলাতেই এঁদের মধ্যে ৪ জন অনশন ত্যাগ করেন। ১২ই মার্চ আরও ৩ জন এবং তারপর আরো ৩ জন অনশন ত্যাগ করেন।[৮৮]
এই সময় জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারী লোকজন ঘন ঘন অনশন ধর্মঘটীদের সাথে আলাপ- আলোচনা করতে আসতেন এবং তাঁদের দাবী মেনে নেওয়া হবে ইত্যাদি মৌখিক আশ্বাস দিয়ে তাঁদেরকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিতে বলতেন। ধর্মঘটীদের মধ্যেও কেউ কেউ এই সময় অনেকখানি দুর্বল হয়ে পড়েন এবং কর্তৃপক্ষের এইসব আশ্বাসের ওপর আস্থা রেখে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়ার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেন। এই অবস্থা ছাড়াও তিন চার দিনের মধ্যে দশজন ধর্মঘটী ইতিমধ্যেই নিজেদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনশন ত্যাগ করায় ধর্মঘট পরিস্থিতির অনেকখানি অবনতি ঘটে। কাজেই শেষ পর্যন্ত ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।[৮৯] এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৫ই মার্চ বাকী ৩৯ জন অনশন ধর্মঘটী তাঁদের অনশন ত্যাগ করেন।[৯০]
অনশন ধর্মঘটের সময় জেলের মধ্যে গিয়ে জেল কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য সরকারী কর্মচারী ধর্মঘটীদের দাবী-দাওয়া মেনে নেওয়া সম্পর্কে যে সমস্ত আশ্বাস দিয়েছিলেন সেগুলির কোনটিই কার্যকর করা হয়নি। উপরন্তু এ প্রসঙ্গে পূর্ব-বাঙলা বিধান পরিষদে এক বিতর্ককালে ৫ই এপ্রিল মন্ত্রী মুফিজউদ্দীন ঘোষণা করেন যে ঢাকা জেলের অনশন ধর্মঘটীদেরকে কোন রকম আশ্বাসই দেওয়া হয়নি এবং তাঁরা বিনাশর্তে তাঁদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন।[৯১]
মৌখিক আশ্বাস যতই দেওয়া হোক আইনত এবং লিখিত কোন বোঝাপড়া দুইপক্ষে হয়নি, কাজেই মন্ত্রীর এই উক্তি। অনশন ধর্মঘটীরা যে বিনাশর্তে তাঁদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছিলেন তা সত্যি। সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে তাদের থেকে অধিকার আদায় করার মতো মনোবল এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা তাঁরা ধর্মঘটীদের নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারেনি। কাজেই ঢাকা জেলে প্রথম ধর্মঘটটি ১১ই মার্চ থেকে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত মাত্র ৪ দিন স্থায়ী হয়।
সরকার রাজবন্দীদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মঘটের ঠিক পরেই তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। পূর্বে যেটুকু অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা তাদের ছিলো সেগুলি প্রায় সবই এর পর তারা হরণ করে। প্রথমেই তারা ব্যবস্থা করে রাজবন্দীদের একত্রে রাখার পরিবর্তে তাঁদের পৃথক সেলে রাখার। তারা ঘোষণা করলো যে এর পর থেকে তাদেরকে আর রাজবন্দীদের মর্যাদা কোনক্রমেই দেওয়া হবে না। সেই অনুসারে রাজবন্দীদের থেকে তাঁদের জামা কাপড় কেড়ে নিয়ে তারা তাঁদেরকে সাধারণ কয়েদীদের জন্যে বরাদ্দকৃত ডুরেকাটা কয়েদীর পোশাক পরাতেও চেষ্টা করলো। এ ছাড়া চৌকি, মশারী ইত্যাদি ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্রও তাঁদের থেকে কেড়ে নেওয়া হলো।[৯২]
ঢাকা জেলে এই ধর্মঘট মাত্র ৪ দিন স্থায়ী হলেও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথম ধর্মঘট আরও অনেক বেশীদিন স্থায়ী হয়। কিন্তু প্রায় ৩৮ দিন ধর্মঘটের পর সেখানেও অবশেষে কর্তৃপক্ষের সাথে কোন বোঝাপড়া ব্যতীতই ধর্মঘট ভেঙে পড়ে। ধর্মঘট ভেঙে পড়ার পর সেখানেও রাজবন্দীদের থেকে ঢাকা জেলার অনুকরণে সমস্ত অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেওয়া হয়।[৯৩]
কেন্দ্রীয় কারাগার দুটি ব্যতীত অন্যান্য জেলগুলিতেও প্রথম অনশন ধর্মঘটের পরিণতি মোটামুটি একই রকম হয়। ঢাকার তুলনায় অন্যান্য জেলে ধর্মঘট কিছুটা বেশীদিন স্থায়ী হয়।
রংপুর জেলে ধর্মঘট চলার সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার জেল পরিদর্শন করে রাজবন্দীদের সাথে দেখা করেন। তিনি তাঁদেরকে বলেন যে নিজের ব্যক্তিগত দায়িত্বেই তিনি আলাপ করতে এসেছেন এবং ঢাকা গিয়ে অন্যান্য মন্ত্রীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে তিনি তারযোগে তাঁদেরকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। ইতিমধ্যে তিনি রাজবন্দীদেরকে অনশন প্রত্যাহার করতে অনুরোধ জানান। ধর্মঘটীরা তাঁকে বলেন যে, তাঁদের অন্তত ডিভিশন প্রিজনার হিসাবে গণ্য করতে হবে এবং দশ দিনের মধ্যে সেই সিদ্ধান্ত তাঁদেরকে জানিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় দশদিন পর তাঁরা ধর্মঘট আবার শুরু করবেন।[৯৪] হাবিবুল্লাহ বাহারের সাথে উপরোক্ত আলাপ-আলোচনা এবং দশ দিনের মধ্যে মন্ত্রী কর্তৃক নিজেদের সিদ্ধান্ত রাজবন্দীদেরকে জানানোর শর্তে রংপুর জেলের অনশন ধর্মঘটীরা ১৫ দিন ধর্মঘটের পর তাঁদের অনশন ত্যাগ করেন।[৯৫]
কিন্তু হাবিবুল্লাহ বাহারের প্রতিশ্রুত টেলিগ্রাম রাজবন্দীদের কাছে এলো না। নয় দিন কেটে- যাওয়ার পর আবার অনশন ধর্মঘটের প্রস্তুতি শুরু হলো। কিন্তু সে ধর্মঘট আর সম্ভব হলো না। কারণ দশম দিন সকালে অনেককে রংপুর জেল থেকে অন্যত্র বদলী করে দেওয়া হলো। এর মধ্যে অমূল্য লাহিড়ী ও সুধীন ধরকে যেতে হলো রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং মারুফ হোসেন ও মুখলেসুর রহমানসহ আরো কয়েকজনকে যেতে হলো ঢাকা কেন্দ্ৰীয় কারাগারে।[৯৬]
প্রথম অনশন ধর্মঘট এইভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৪৯ এর মে মাসে দ্বিতীয় দফা ধর্মঘট শুরু হয়।[৯৭] এবার শৃঙ্খলার ব্যাপারে আগের থেকে অনেক বেশী কড়াকড়ি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। সকলকে বলে দেওয়া হয় যে পার্টি সিদ্ধান্ত ছাড়াই কেউ যদি অনশন ভঙ্গ করেন তাহলে তাঁকে তৎক্ষণাৎ পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হবে। কাজেই সমস্ত জায়গায় খবর দেওয়া হলো যে মরে গেলেও কেউ নিজের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে অনশন ভঙ্গ করতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না কর্তৃপক্ষ দাবি-দাওয়া মেনে নিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত অনশন ধর্মঘটে সকলকে অটল থাকতে হবে।[৯৮]
ঢাকা জেলে দশ দিন পর্যন্ত কাউকে নাক দিয়ে খাওয়াতে চেষ্টা করেনি। কিন্তু দশদিন পর প্রত্যেকেই খুব দুর্বল হয়ে পড়ার জন্য কেউই আর উঠতে পারতো না। সেই অবস্থায় জেল কর্তৃপক্ষ নাক দিয়ে তাদেরকে খাওয়াতে শুরু করে।
এই অনশন ধর্মঘট চলাকালে ১লা জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা সরকারী জুলুমের প্রতিবাদে এবং ধর্মঘটীদের সমর্থনে একটি সভার অনুষ্ঠান করেন।[৯৯]
২৪ দিন এইভাবে অনশন ধর্মঘট চলার পর মন্ত্রী মুফিজউদ্দীন আহমদ এবং ফকির আবদুল মান্নান ও মনোরঞ্জন ধর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দীদের সাথে দেখা করে তাঁদেরকে আশ্বাস দেন যে তাদের সমস্ত দাবী-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তাঁরা অনশন ধর্মঘটীদেরকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্যেও অনুরোধ করেন। এবং আবার এই আশ্বাস এবং অনুরোধের ওপর ভিত্তি করে ঢাকা জেলের ধর্মঘটীরা তাঁদের অনশন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।[১০০]
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে দ্বিতীয় ধর্মঘট স্থায়ী হয় ৪১ দিন। সেখানে এই ধর্মঘটের সময় অনশন ধর্মঘটীদের প্রত্যেককে আত্মহত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে জেল কর্তৃপক্ষ এক বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড দেন। এর ফলে তাঁদের সকলকে ঘানি, তাঁত ইত্যাদিতে তারা সাধারণ কয়েদীদের মতো কাজে লাগিয়ে দেয়। এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ফলে নূরুল আমীন সরকারের আমলে রাজবন্দীরা বিভিন্ন চাকীতে কাজ করতে থাকেন।[১০১]
ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং অন্যান্য জেলা কারাগারগুলিতে দ্বিতীয় অনশন ধর্মঘট চলার সময় অনশন ধর্মঘটরত রাজনৈতিক নিরাপত্তা বন্দীদের সম্পর্কে পূর্ব-বাঙলা সরকার এক প্রেস নোটে বলেন:
ভারত বিভক্ত হওয়ার পূর্বে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের হাত হইতে দেশকে রক্ষা করিবার জন্য তৎকালীন রাজবন্দীগণ আত্মত্যাগ করিতেন বলিয়া তাঁহাদিগকে দেশসেবক ও আত্মত্যাগী হিসাবে পরিগণিত করা হইত এবং সেই জন্যই তাঁহাদিগকে জেলে পদ-মর্যাদা ইত্যাদি দেওয়া হইত। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজনৈতিক পঞ্চম বাহিনীর দল নবলব্ধ পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ধ্বংস করিবার মানসে তৎপর হইয়া উঠিয়াছে। সুতরাং তাঁহাদিগকে সরকার রাষ্ট্রদোহী বলিয়া বিবেচনা করেন। অতএব সরকারের মতে বর্তমানে রাজনৈতিক বন্দীরা কোন পদমর্যাদা বা অন্য প্রকার সুবিধা লাভ করিতে পারেন না।[১০২]
এই সরকারী প্রেস নোটের সমালোচনা প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক নওবেলাল মন্তব্য করেন:
রাষ্ট্রদ্রোহীদের ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলানই উচিত এবং কে রাষ্ট্রদোহী আর কে রাষ্ট্রদোহী নয় উপযুক্ত কোর্টই তাহা বিচার করিবার অধিকারী – সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগ নিশ্চয়ই নহে। আর সাম্রাজ্যবাদী আমলের যে যুক্তি দেখানো হইয়াছে তাহা একটু চিন্তা করিয়া দেখিলে সরকার নিজেই দেখাইতেন না বলিয়াই আমরা বিশ্বাস করি। সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস করিবার জন্য যাহারা সংগ্রাম করিয়া রাজবন্দী হইয়াছিলেন তাঁহাদিগকে আদর করিয়া সাম্রাজ্যবাদী সরকার বন্দীশালায় পদমর্যাদা দান করিত তাহা সত্যই এক হাস্যাস্পদ ব্যাপার।[১০৩] কিন্তু শুধু মে মাসের দ্বিতীয় অনশন ধর্মঘটের সময় উপরোক্ত সরকারী প্রেস নোটই নয়,
পরবর্তী অনশন ধর্মঘটের সময় পূর্ব-বাঙলা বিধান পরিষদে এক বিতর্ককালে প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন বলেন:
আমি একথা জানাতে চাই যে স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে নিরাপত্তা বন্দীদের কাজকে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা হতো। এখানে তখন একটা বিদেশী শাসন ছিলো এবং যারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতো তাদেরকে দেশপ্রেমিক হিসাবে বিবেচনা করা হতো। আমরা এখন পাকিস্তান অর্জন করেছি, আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কাজেই এখন যারা আমাদের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে চেষ্টা করে এবং যারা দেশে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে তাদেরকে দেশপ্রেমিক হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। তাদেরকে বিবেচনা করা হয় রাষ্ট্রের দুশমন হিসাবে। কাজেই বৈদেশিক শাসনের থেকে তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা যে সুযোগ-সুবিধা পেতো এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যখন দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তখন সেগুলি তারা-আর পাওয়ার আশা করতে পারে না।[১০৪]
উপরোল্লিখিত প্রেস নোট এবং ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্র পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গীয় মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য পাকিস্তানের সমগ্র রাষ্ট্রীয় কাঠামোর চরম প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র এবং জনগণ ও রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর তাদের নির্যাতনের মাত্রাকে নগ্নভাবেই চিত্রিত করে।
দ্বিতীয় ধর্মঘট শেষ হওয়ার পর ঢাকা জেলে দেবপ্রসাদ এবং নাদেরা বেগম বাইরে থেকে রাজবন্দী হিসাবে আসেন। তাঁদের মাধ্যমে নোতুন রণদীভে লাইন বাস্তবায়ন সম্পর্কে জেলের ভেতরকার কমিউনিস্ট রাজবন্দীরা কিছুটা অবহিত হন এবং তার পর জেলকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ গঠন করার সিদ্ধান্ত আবার নোতুনভাবে নেওয়া হয়। এর পরই তাঁরা শুরু করেন তৃতীয় পর্যায়ের অনশন ধর্মঘট।[১০৫]
এই সময় সাধারণ কয়েদীদের দাবী-দাওয়া নিয়ে কিছুটা আন্দোলনেরও সিদ্ধান্ত হয় এবং সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁরা জেলের মধ্যে মারামারি করার সিদ্ধান্তও নেন। এই সিদ্ধান্ত অবশ্য শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।[১০৬]
তৃতীয় অনশন ধর্মঘট ঢাকায় শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে এবং তা ৪০ দিন স্থায়ী হয়। এই ধর্মঘটও কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের পর শেষ হয় এবং এবার রাজবন্দীরা নিজেদের পৃথক পৃথক সেল থেকে পূর্বের মতো আবার একত্রে থাকার জন্য ওয়ার্ডে ফিরে আসেন।[১০৭] রাজশাহীতে এই তৃতীয় ধর্মঘট স্থায়ী হয় ৪৫ দিন।[১০৮]
তৃতীয় ধর্মঘটের পর জেলের নিয়ম ভঙ্গ করার জন্যে ঢাকা জেলে দেবেশ ভট্টাচার্য ও নারায়ণ বিশ্বাসসহ কয়েকজনের বিচার হয়। রাজবন্দীরা এর পর নিজেদের উকিলের পরামর্শমতো হাজিরা দিতে অপারগ বলে জেল কর্তৃপক্ষকে জানান। এর ফলে রণেশ দাশগুপ্তসহ কয়েকজনকে হাজিরা দিতে হলো না এবং সেজন্যে তাঁরা কোন মেয়াদী সাজাও পেলেন না।[১০৯]
কিন্তু নাদেরা বেগমের বিরুদ্ধে জেল নিয়ম ভঙ্গ করা ইত্যাদি অভিযোগ আনার পর ৩০শে নভেম্বর জেল গেটে একজন সাব-ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে বিচারের জন্যে তাঁকে হাজির করা হলো। এই বিচারের সময় নাদেরা বেগম কোন প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করে বিচারক সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্টেটকে নিজের জুতো ছুঁড়ে মারেন। এই ঘটনার পর নাদেরা বেগমের চুলের মুঠি ধরে তাঁকে মারতে মারতে জেল গেট থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।[১১০] নাদেরা বেগমকে এইভাবে মহিলা ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার সময় ওয়ার্ডের ভেতরে অন্যান্য মহিলা কয়েদীরা বোতল, কাচের গ্লাস ইত্যাদি ছুঁড়ে জেলের ওয়ার্ডারদের মারতে শুরু করেন। মারপিট ছাড়াও এর অন্য কারণও ছিলে।। মহিলা ওয়ার্ডে মেয়ে ওয়ার্ডার ছাড়া কেবলমাত্র জমাদার ও জেলার ব্যতীত অন্য কোন পুরুষের ঢোকার নিয়ম ছিলো না। কাজেই পুরুষ ওয়ার্ডাররা যখন নাদেরাকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ভেতরে ঢোকালো তখন তাঁরা খুব বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওয়ার্ডারদেরকে আক্রমণ করলেন। এই আক্রমণের সাথে সাথে তাঁরা স্লোগানও দিতে থাকলেন।[১১১]
এই ঘটনা যখন ঘটে তখন রাজবন্দীরা জেলখানার মধ্যে ভলি খেলছিলেন।[১১২] মহিলা ওয়ার্ডের স্লোগান এবং আর্ত চীৎকারে তৎক্ষণাৎ খেলা পরিত্যাগ করে তাঁরাও স্লোগান দিতে শুরু করলেন। এরপর পুলিশ খেলার মাঠেই রাজবন্দীদের ওপর লাঠি চার্জ শুরু করে তাঁদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ওয়ার্ডের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। ইতিপূর্বে পাগলা ঘণ্টা দিয়ে জেল কর্তৃপক্ষ অনেক পুলিশ হাজির করে ফেলেছিলো। তারা বললো রাজবন্দীরা এর পর বেশী গণ্ডগোলের চেষ্টা করলে তারা তাঁদের ওপর গুলি চালাবে।[১১৩]
এই পরিস্থিতিতে জোর করে একটা কিছু করতে অর্থাৎ পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে কেউ রাজী ছিলো না। তাছাড়া পাগলা ঘণ্টা দিয়ে ওয়ার্ড ঘিরে ফেললেও অতিরিক্ত জেলার মাখলুকুর রহমানের প্রচেষ্টার ফলে পুলিশ শেষ পর্যন্ত গুলি না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।[১১৪]
এর পরদিন রাজবন্দীদের পক্ষ থেকে সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে অনশন ধর্মঘটের নোটিশ দেওয়া হয়। অনেকেই এবার বললেন যে বারবার অনশন করে কোন লাভ হচ্ছে না, উপরন্তু ক্ষতিই নানাভাবে বাড়ছে। তার চেয়ে এবার শেষবার শেষ পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়া দরকার।[১১৫] সিদ্ধান্তও এবার সেই অনুসারে নেওয়া হলো। রাজবন্দীদের দাবী-দাওয়া কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়ে বললেন যে তাঁদের প্রত্যেকটি দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তাঁরা কোনমতেই অনশন ত্যাগ করবেন না।[১১৬]
এই অনশন ধর্মঘটের দাবীগুলি মুখ্য মন্ত্রী নূরুল আমীন পূর্ব-বাঙলা বিধান পরিষদের সামনে ১৯৪৯-এর ১৭ই ডিসেম্বর উল্লেখ করেন। তাঁর উল্লিখিত দাবীগুলি হলো:
১. সকল নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বন্দীদেরকে বিনাশর্তে এবং তৎক্ষণাৎ মুক্তি দান।
২. অন্যথায় ব্যবস্থা করতে হবে:
ক. খাদ্যের জন্যে প্রতিদিন ৩-৪ টাকার
খ. খাট, তোষক, হাঁড়িবাসন এবং আসবাবপত্র ছাড়াও ২৫০ টাকা প্রাথমিক ভাতা
গ. মাসে ৫০ টাকা ব্যক্তিগত ভাতা
ঘ. বিচার না হওয়া পর্যন্ত গ্রেফতারের তারিখ থেকে প্রত্যেক নিরাপত্তা বন্দীর ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদেরকে প্রতি মাসে ১০০ টাকা হারে পারিবারিক ভাতা দিতে হবে।
ঙ. প্রত্যেক সপ্তাহে চারটি চিঠি বাইরে পাঠানো, দুই সপ্তাহ অন্তর সাক্ষাৎকার, উপযুক্ত থাকার জায়গা, খেলাধুলার ব্যবস্থা ইত্যাদি সুবিধা।
চ. হাজং এবং অন্যান্য বিচারাধীন রাজনৈতিক বন্দীদেরকে প্রথম ডিভিশনের নীচে না রাখা।
ছ. অন্য সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য দ্বিতীয় ডিভিশনের মর্যাদা।
জ. উন্নত খাদ্যব্যবস্থা, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, দৈনিক খবরের কাগজ, পারিশ্রমিক ব্যবস্থা চালু, উন্নততর জীবনযাপন, সরকারী খরচায় ধূমপানের ব্যবস্থা, ওয়ার্ডে রেডিও বসানো এবং নির্দেশিত সমস্ত খবরের কাগজ ও পত্র-পত্রিকায় সেন্সর না করে দেওয়া এবং সেলে রেডিও বসানো।[১১৭]
এই দাবীগুলি পরিষদে পড়ে শোনানোর সময়েই নূরুল আমীন পরিষদকে জানান যে তাঁদের মতে অনশনরত রাজবন্দীরা রাষ্ট্রের শত্রু, কাজেই তাঁদের এই সব দাবী স্বীকার করে নেওয়া তাঁর সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে জেলের নিয়মকানুনসমূহ তাঁরা আবার পুনর্বিবেচনা করে দেখবেন এই সম্পর্কে কতদূর কি করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব।
২রা ডিসেম্বর অনশন ধর্মঘট শুরু হলে রাজবন্দীরা জেল কর্তৃপক্ষকে জানান যে তাঁরা কোনমতেই এবার ওয়ার্ড ছেড়ে সেলে যাবেন না। কিন্তু পর পর কয়েকবার দীর্ঘ অনশনের পর তাঁদের সকলেরই স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিলো এবং সে কারণে ধর্মঘটের পঞ্চম দিনেই তাঁরা সকলে খুবই কাহিল হয়ে পড়েন। এই দুর্বল অবস্থায় তাঁদেরকে জোর করে সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অ্যান্টি সেল নামে কথিত ছয়টি সেল খুবই খারাপ ছিলো। এই বিশেষ সেলগুলিতে মারুফ হোসেন, সত্য মৈত্র, সিরাজুর রহমান এবং শিবেন রায়কে রাখা হয়।[১১৮] সেলের মধ্যে এই সময় রাজবন্দীদেরকে দাঁতের মাজন, বিছানাপত্র ইত্যাদি ব্যক্তিগত ব্যবহার্য কোন জিনিসই নিতে দেওয়া হয় না।[১১৯]
অনশনের ষষ্ঠ দিনে অর্থাৎ সেলে পাঠানোর পরই পাঞ্জাবী ওয়ার্ডার দিয়ে রাজবন্দীদেরকে জোর করে খাওয়ানো শুরু হলো। যে সমস্ত বাঙালী ওয়ার্ডাররা তাঁদেরকে খাওয়াতে আসতো তারাও ছিলো ভয়ানক বদমাশ। এই খাওয়ানোর সময় তারা বুকের ওপর চড়ে নাকের মধ্যে দিয়ে জোর করে খাবার চুকিয়ে দিতো।[১২০]
৮ই ডিসেম্বর এইভাবে জোর করে বুকের ওপর চড়ে খাওয়াতে যাওয়ার সময়েই ফুসফুস ছিদ্র হয়ে রাজবন্দী শিবেন রায় শহীদ হন। জোর করে তাঁর নাকের মধ্যে রড ঢুকিয়ে দেওয়াতে রডটি শিবেন রায়ের ফুসফুস ভেদ করে যায় এবং তিনি রক্ত বমি করতে থাকেন। সে সময় জেলের এক সেলের সাথে অন্য সেলের যোগাযোগের কোন উপায় ছিলো না। তাছাড়া ফুসফুস ছিদ্র হয়ে গিয়ে দারুণভাবে অসুস্থ এবং অজ্ঞান হয়ে পড়ায় চীৎকার করে কাউকে ডাকাডাকি করাও শিবেন রায়ের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায় সেলের মধ্যে রাত্রিকালে তাঁর মৃত্যু ঘটে।[১২১]
৯ই ডিসেম্বর খুব সকালে জেলের লোকজন এসে শিবেন রায়ের মৃতদেহ যখন সরিয়ে নিয়ে যায় তখন সে দৃশ্য দেখে মারুফ হোসেন, সত্য মৈত্র, সিরাজুর রহমান প্রভৃতি চীৎকার করে স্লোগান দিতে থাকেন। এই স্লোগানের শব্দে অন্য সকলে জেগে ওঠেন এবং ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে তাঁরা দারুণভাবে উত্তেজিত হন।[১২২]
অনশনরত রাজবন্দীদের এই উত্তেজনা দেখে ৯ই ডিসেম্বর সারা দিন জেলখানার কোন লোক তাঁদের সেলগুলোর ভেতরে আসতে সাহস করেনি। সেদিন দারুণ শীত পড়েছিলো। সেজন্যে তারা কয়েদীদেরকে দিয়ে তোষক, কম্বল ইত্যাদি সেলের দরজার সামনে পাঠিয়ে দিলো।[১২৩]
শিবেন রায়ের মৃত্যু সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন প্রাদেশিক পরিষদে ১৭ই ডিসেম্বর নিম্নলিখিত বিবৃতি দেন:
কুষ্টিয়া সাব-জেলে আটকবন্দী জনৈক শিবেন মোহন রায়কে ১৬ই নভেম্বর, ১৯৪৯, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলী করা হয়। তিনি ১৯৪৯-এর ২রা ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অনশন ধর্মঘটে যোগদান করেন এবং ৯ই ডিসেম্বর, ১৯৪৯, রাত্রিকালে মারা যান। যেদিন থেকে উক্ত রাজবন্দী অনশন ধর্মঘটে যোগ দেন সেদিন থেকেই তিনি চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করেন এবং তাঁকে জোর জবরদস্তি করে খাওয়াতে হয়। পোস্ট মর্টেম পরীক্ষার পর ডাক্তারের মত হচ্ছে ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়া ঘটিত স্বাভাবিক কারণেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। এর পরদিন যথারীতি স্থানীয় হিন্দু সৎকার সমিতির দ্বারা উক্ত নিরাপত্তা বন্দীর মৃতদেহের সৎকার করা হয় এবং তারযোগে বন্দীর পিতাকেও খবর দেওয়া হয়।[১২৪]
নূরুল আমীনের এই বিবৃতির পর বিরোধীদলের নেতা বসন্তকুমরার দাস মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চান যে মৃত্যুর পূর্বে শিবেন রায়ের ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়া ধরা পড়লো না কেন? অনশন শুরু হয়েছিলো ২রা ডিসেম্বর এবং তিনি মারা গিয়েছিলেন ৯ই ডিসেম্বর। এজন্যে ব্রঙ্কো- নিউমোনিয়ার ব্যাপারটিকে ‘খুবই অদ্ভুত’ বলে বর্ণনা করে যে পরিস্থিতিতে শিবেন রায়ের মৃত্যু ঘটেছে তার ওপর বসন্ত দাস একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন।[১২৫] বসন্তু কুমার দাসের প্রশ্ন ও দাবীর জবাবে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন বলেন:
এই ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়া পূর্বে কেন ধরা পড়েনি এ সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যে বিরোধী দলের নেতা আমাকে বলছেন। এখন প্রশ্ন হলো এই যে প্রত্যেককেই এটা বুঝতে হবে যে এই সমস্ত ব্যক্তিরা এত উচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া যে কোন ডাক্তারকে তারা নিজেদের দেহ স্পর্শ করতে দেয় না, তাদের কি অসুখ হয়েছে সেটা বের করার জন্যে কোন স্টেথসকোপ ব্যবহার করতেও তারা দিতে চায় না। এই ব্যক্তিদেরকে জোর করে খাওয়াতে হয় এবং ওষুধপত্রও তাদেরকে দিতে হয় জোর করেই। কাজেই তারা যদি নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা উপলব্ধি না করে, যদি তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় না হয়, তাহলে তাদের মধ্যে হিতাহিত জ্ঞান আনা এবং তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করার অন্য কোন উপায় আমি দেখি না। সরকার তাদেরকে সব সময়েই খাদ্য এবং প্রয়োজনমত ঔষধপত্র দিতে ইচ্ছুক কিন্তু এই সমস্ত ব্যক্তিরা সহযোগিতা করতে রাজী নয়। সুতরাং আমি আশা করি তাদের প্রতি যাদের দরদ আছে তারা যেন বাইরে থেকে এই ব্যক্তিদেরকে উপদেশ দেন যাতে তারা ঔষধ অথবা খাদ্য গ্রহণ করতে অস্বীকার না করে।[১২৬]
শিবেন রায়ের ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়া সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের এই মিথ্যা তথ্যের ভিত্তি, অন্তত তাঁর নিজের কথামতো, জেল ডাক্তারের পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট। কিন্তু এই রিপোর্টের ব্যাপারটিও কতদূর সত্য সে বিষয়েও কোন নিশ্চিত প্রমাণ নূরুল আমীন দাখিল করতে পারেননি।
অন্যদিকে ঢাকা জেলের অন্যান্য অনশনরত রাজবন্দীরা, যাঁদের সাথে দুদিন আগে পর্যন্ত শিবেন রায় একই ওয়ার্ডে একত্রে ছিলেন, তাঁরা কেউই তার ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়া হওয়ার কথা বলেন না। অন্যদের মতো শিবেন রায়ও সেদিক দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থই ছিলেন। ৭ই ডিসেম্বর তাঁদের সকলকে পৃথক পৃথক সেলে বদলী করে দেওয়ার পর তাঁদের প্রত্যেককেই জোর করে খাওয়াতে চেষ্টা করা হয় এবং সেই সময়েই নাকের মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া রডে ফুসফুস ছিদ্র হয়ে যাওয়ার ফলেই শিবেন রায়ের মৃত্যু ঘটে।
এ সত্য ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্যে নূরুল আমীনকে এক ঝুড়ি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অনেক বানানো কথা পরিষদের সামনে বলতে হয়। কিন্তু তৎকালীন পরিষদের বিতর্ক এবং পরবর্তীকালে তৎকালীন অনশন ধর্মঘটীদের জবানীতে জানা যায় যে, শিবেন রায়ের মৃত্যু সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের উপরোক্ত বক্তব্যকে কেউই বিশ্বাস করেননি। তাকে তার যোগ্য মর্যাদাই সকলে দিয়েছিলেন।
আর একটি ঘটনা এক্ষেত্রে খুবই উল্লেখযোগ্য এবং এর মাধ্যমেই তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের শয়তানী ও ভাঁওতাবাজীর পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যাবে।
৭ই জানুয়ারী, ১৯৫০ কলকাতার পত্রিকা দৈনিক সত্যযুগ এই অনশন সম্পর্কে একটি সংবাদ প্রকাশ করে তাতে বলে যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘটীদের মধ্যে ৬ই জানুয়ারী দুই জনের মৃত্যু ঘটেছে।
এই সংবাদের প্রতিবাদে পূর্ব-বাঙলা সরকারের জেল মন্ত্রী মুফিজউদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে নিম্নলিখিত বিবৃতি দেন
৬ই জানুয়ারী চট্টগ্রাম হইতে প্রেরিত বলিয়া ৭ই জানুয়ারী কলিকাতার বাংলা দৈনিক সত্যযুগে প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হইয়াছে। এই সংবাদে বলা হইয়াছে যে, ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলে অনশন ধর্মঘটীদের মধ্যে দুইজন ৬ই জানুয়ারী তারিখে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। এই সংবাদ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।[১২৭]
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘটীদের মধ্যে ৯ই ডিসেম্বর একজনের মৃত্যু ঘটে। কাজেই মৃতের সংখ্যা এবং মৃত্যুর তারিখ এই দুই বিষয়েই সত্যযুগ-এ সংবাদের মধ্যে ভুল ছিলো। কিন্তু তার থেকে আরও বেশী লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে কুখ্যাত জেলমন্ত্রী ‘এই সংবাদ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ বলে যেভাবে সংবাদপত্রে উপরোক্ত বিবৃতিটি দেন তাতে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারে কারো মৃত্যু আদৌ ঘটেছে তা মনে হয় না। এই বিবৃতির মাধ্যমে শিবেন রায়ের মৃত্যুর ঘটনাকে সম্পূর্ণভাবে ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে তৎকালীন ধোঁকাবাজ মুসলিম লীগ সরকারের সত্যিকার চরিত্র ভালোভাবেই ধরা পড়ে।
শিবেন রায়ের মৃত্যুর পর সিভিল সার্জেন মহম্মদ হোসেন নিজে এসে রাজবন্দীদেরকে বলেন যে তখন থেকে তিনি নিজে সব কিছুর তদারক করবেন এবং কোন গোলযোগ যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, জোর করে অনশন ধর্মঘটীদেরকে খাওয়ানোর সময় সেলগুলিতে কোন ডাক্তার উপস্থিত থাকতো না, ওয়ার্ডারদের সহায়তায় জেল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই সে কাজ করতো।[১২৮] অথচ এ ব্যাপারে ইতিপূর্বে ডাক্তারের উপস্থিতিকে একটি নিয়ম হিসাবে মেনে চলা হতো।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এই অনশন ধর্মঘট ৫৮ দিন স্থায়ী হয়। এর পূর্বে সরকারের পক্ষ থেকে ফকির আবদুল মান্নান এবং অন্যান্য কর্মচারীরা এসে আবার আলাপ আলোচনা শুরু করে।[১২৯] নূরুল আমীন ইতিমধ্যে কিছুটা দুর্বল হয়ে এসেছিলো কাজেই বাধ্য হয়ে তিনি রাজবন্দীদের কিছু কিছু দাবী-দাওয়া স্বীকার করে নিতে রাজী হলেন।
কিন্তু সেক্ষেত্রে একটি প্রধান অসুবিধা হলো এই যে রাজবন্দীদেরকে মোটামুটি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হলো। যারা কৃষক শ্রমিক শ্রেণীভুক্ত তাঁদেরকে দেওয়া হলো ‘খ’ বিভাগ এবং যাঁরা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত তাঁদেরকে দেওয়া হলো ‘ক’ বিভাগ। এই শ্রেণী বিভাগের ফলে অসুবিধা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকে এই শর্ত স্বীকার করে নিতে হয়। অন্যথায় ৫৮ দিন অনশনের পর কারো আর বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। কাজেই সেই পর্যায়ে বিভিন্ন সেল থেকে এসে সকলে একত্রিত হয়ে অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন।[১৩০] পুরুষ রাজবন্দীদের এই সিদ্ধান্ত প্রথম দিকে মহিলারা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তাঁরা উপরোক্ত শর্তে অনশন প্রত্যাহার করতে রাজী ছিলেন না। কিন্তু মহিলাদের এই আপত্তি অগ্রাহ্য করে পুরুষরা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে পুরুষরা যখন ধীরে ধীরে দুধ পান করতে থাকেন তখনো মহিলারা নিজেদের ওয়ার্ডে এ ব্যাপারে অটল থাকেন। পরে পুরুষদের সমবেতভাবে অনশন ভঙ্গ করার খবর তাঁদের ওয়ার্ডে পৌঁছলে তাঁরাও নিজেদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে দুধ পান করেন।[১৩৩] রাজশাহীতে এই চতুর্থ অনশন ধর্মঘট স্থায়ী হয় ৬১ দিন।[১৩২]
ধর্মঘটের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রায় ২৫ জন রাজবন্দীকে প্রদেশের অন্যান্য জেলে বদলী করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ফনি গুহও ছিলেন। তিনি গ্রেফতার হন ১৯৪৯ সালে। চতুর্থ অনশন ধর্মঘটের ফলে ফনি গুহের নাড়ী ছিদ্র হয়ে যায় এবং ময়মনসিংহে বদলী হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই সেখানে তাঁর মৃত্যু ঘটে।[১৩৩]
খুলনা জেলে বিষ্ণু বৈরাগীকে ১৯৫০ সালে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। এ সময় জেল কর্তৃপক্ষ পাগলা ঘন্টী বাজিয়ে একটা জরুরী পরিস্থিতির মহড়া দিয়ে আসল ঘটনাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।[১৩৪]
ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং অন্যান্য কারাগারে বিভিন্ন পর্যায়ে যাঁরা অনশন ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন তাঁদের নাম : অমূল্য লাহিড়ী, বাবর আলী, গারীসউল্লাহ সরকার, নিবেন ভট্টাচার্য্য, খবিরুদ্দীন, পি. রায়, আমিনুল ইসলাম, অজয় ভট্টাচার্য্য, শীতাংশু মৈত্র, ভূজেন পালিত, বিজন সেন, ডোমারাম সিংহ, কম্পরাম সিংহ, সুখেন ভট্টাচাৰ্য্য, হানিফ শেখ, দেলোয়ার হোসেন, আবদুল হক, আনোয়ার হোসেন, সুধীর ধর, মনসুর হাবিব, হাজী দানেশ, নূরুন্নবী চৌধুরী, শফিউদ্দীন আহমদ, আবদুশ শহীদ, শিবেন রায়, কমনীয় দাশগুপ্ত, নগেন সরকার, তকিউল্লাহ, জ্ঞান চক্রবর্তী, ফনি গুহ, সরদার ফজলুল করিম, নাসিম আহমদ, নাদেরা বেগম, নলিনী দাশ, মারুফ হোসেন, আনন্দ দেব, কালীপদ সরকার, আশুতোষ ভট্টাচার্য্য, অজিত নন্দী, সত্য মৈত্র, সিরাজুর রহমান, লুৎফর রহমান, দিলীপ সেন, হীরেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সুধীর মুখার্জী, গণেন্দ্রনাথ সরকার, কৃষ্ণবিনোদ রায়, মহম্মদ রশিদউদ্দীন, সুধীর সান্ন্যাল, সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য্য, আরোরাম সিংহ, প্রিয়বৃত দাস, শ্যামাপদ সেন, ফটিক রায়, সদানন্দ ঘোষ, প্রসাদ রায়, নাসিরুদ্দীন আহমদ, লালু পাণ্ডে, খবির শেখ, সতীন্দ্রনাথ সরকার, নূরুন্নবী, অনিমেষ ভট্টাচার্য্য, নির্মল সেন, প্রফুল্ল রায়।*
[* অনশন ধর্মঘটীদের পূর্ণ তালিকা দেওয়া এখানে সম্ভব হলো না।]
৮. রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলিবর্ষণ ও রাজবন্দী হত্যা
১৯৪৯ সালের মে-জুন মাসে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে দ্বিতীয় অনশন ধর্মঘটের পর ‘আত্মহত্যার’ অভিযোগে অনশনকারীদেরকে এক বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সে সময় রাজবন্দীদেরকে বিভিন্ন চাকীতে সাধারণ কয়েদীদের সাথে কাজ করতে হতো। এই কাজের মাধ্যমে তাদের সাথে রাজবন্দীদের যোগাযোগ বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।[১৪৬]
সাধারণ কয়েদীদেরকে তখন বৃটিশ আমলের বন্দোবস্তু অনুসারেই নানারকম অতিরিক্ত নির্যাতন সহ্য করতে হতো। জেল কর্তৃপক্ষও তাদেরকে পশু হিসেবেই গণ্য করতো এবং গরুর পরিবর্তে তাদেরকেই সরষে মাড়া ঘানিতে জুড়ে খাটিয়ে নিতো। উপযুক্ত সহানুভূতি এবং সহযোগিতার অভাবে তারা এসবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করতো এবং কোন ব্যাপারেই প্রতিবাদের সাহস পেত না।[১৪৭]
রাজবন্দীদেরও যখন তাদের সাথে ঘানি ইত্যাদি বিভিন্ন চাকীতে জুড়ে দেয়া হলো তখন তাঁদের সহানুভূতি এবং সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ এবং প্রতিবাদ ও প্রতিকারের আকাঙ্ক্ষা অনেকখানি জাগ্রত হলো। তারা ধীরে ধীরে এসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে থাকলো এবং প্রশ্ন তুললো পাকিস্তান হওয়ার পরও জেলের মধ্যে মানুষ দিয়ে ঘানি টানাবে কেন? এতো মারপিট হবে কেন? খাওয়া-দাওয়ার এতো অসুবিধা থাকবে কেন? তামাক খাওয়া বেআইনী থাকবে কেন? ইত্যাদি।[১৪৮
এই সব আলাপ-আলোচনা অনেকখানি অগ্রসর হওয়ার পর এবং রাজবন্দীদের সক্রিয় সহযোগিতার ফলে সাধারণ কয়েদীরা কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের দাবী পেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। মনসুর হাবিব এবং আরো দুই একজন মিলে তাদের দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে একটি মেমোরান্ডামের খসড়া তৈরি করেন এবং সেটি সাধারণ কয়েদীদের পক্ষ থেকে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হয়। জেল কর্তৃপক্ষ তাদের এই মেমোরান্ডামে কর্ণপাত না করায় তারা ৫ই এপ্রিল, ১৯৫০ থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করে। তাদের অনশনের সমর্থনে রাজবন্দীরাও ৭ই এপ্রিল থেকে অনশন ধর্মঘটে শরীক হন।[১৪৯]
অনশন শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর কয়েদীদের মধ্যে অনেকে ধর্মঘট ছেড়ে দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় এক হাজার কয়েদী ধর্মঘটে অটল থাকে।[১৫০]
ধর্মঘটের পঞ্চম দিন অর্থাৎ ৯ই এপ্রিল ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্স আমীর হোসেন রাজশাহী জেল পরিদর্শন করতে আসে এবং ধর্মঘটী কয়েদীদের সাথে দেখা করে তাদেরকে অনশন পরিত্যাগ করতে বলে কিন্তু ধর্মঘটীরা দাবী না মেনে নেওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে রাজী হয় না।[১৫১]
এরপর আমীর হোসেন এগারো বারো তারিখের দিকে রাজবন্দীদের সাথে দেখা করে তাদেরকে বলে যে সাধারণ কয়েদীদের ধর্মঘট তাঁদের জন্যেই সম্ভব হচ্ছে কাজেই তাঁরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেই অন্যান্য কয়েদীরা তাদের ধর্মঘটও প্রত্যাহার করে নিবে। সেই বিবেচনায় ইন্সপেক্টর জেনারেল রাজবন্দীদেরকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে অনুরোধ জানায়। কিন্তু রাজবন্দীদের পক্ষ থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের কোন প্রশ্নই ছিলো না, কাজেই তাঁরা আমীর হোসেনকে পরিষ্কারভাবে নিজেদের অনশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।[১৫২] সুতরাং রাজবন্দীসহ সাধারণ কয়েদীদের অনশন ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। এই সময় ইন্সপেক্টর জেনারেল আমীর হোসেন জেল সুপারিনটেন্ডেন্টকে নির্দেশ দেয় রাজবন্দীদের মধ্যে পনেরো ষোলো জনকে বিচ্ছিন্ন করে অন্যত্র অর্থাৎ ১৪ নং কনডেম্ সেলে সরিয়ে দিতে।[১৫৩] এই ১৪ নং ছিলো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সেল।
আমীর হোসেনের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে রাজবন্দীদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দেয়। তাঁরা কেউই খাপরা ওয়ার্ড থেকে সরে গিয়ে উপরোক্ত কুখ্যাত সেলে বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে রাজী ছিলেন না। কাজেই তাঁরা নিজেদের মধ্যে তখন আলোচনা করে স্থির করেন যে তারা ঐ সেলে কিছুতেই যাবেন না।[১৫৪]
মাত্র একজন রাজবন্দী, নগেন সরকার এই সিদ্ধান্ত খোলাখুলিভাবে পুনর্বিবেচনা করার কথা বলেছিলেন। যশোরের ফরওয়ার্ড ব্লক মার্ক্সিস্ট পার্টির সদস্য হীরেন সেন বিরোধিতা না করলেও সকলকে সাবধান করে বলেছিলেন যে, সেই সিদ্ধান্তের পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।[১৫৫] এই মারাত্মক পরিণতি’ বলতে তিনি লাঠিচার্জ পর্যন্তই আশংকা করেছিলেন।[১৫৬ ১৪ই এপ্রিল ইন্সপেক্টর জেনারেল আমীর হোসেন রাজবন্দীদের সকলকে এবং সাধারণ কয়েদীদের বেশ কয়েকজন প্রতিনিধিকে জেল গেটে হাজির করে। সেখানে সে কয়েদীদেরকে অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে বলায় তারা জবাব দেয়: আগে দাবী মেনে নাও, পরে ধর্মঘট প্রত্যাহার।[১৫৭]
১৫ই এপ্রিল তারা আবার সকলকে জেল গেটে উপস্থিত করল এবং ধর্মঘটীদের দাবী মোটামুটিভাবে মেনে নেওয়ার কথা জানিয়ে বললো: মানুষ দিয়ে আর ঘানি টানানো হবে না। সরকারী পয়সায় তামাক দেওয়া সম্ভব হবে না, তবে যারা নিজের পয়সায় তামাক জোগাড় করতে পারবে তাদেরকে তামাক খাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। এ ছাড়া মারপিট ইত্যাদিও বন্ধ করা হবে।[১৫৮]
রাজশাহী জেলের ফুটবল মাঠের মধ্যেই সেদিনই বিকেল বেলা ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্স আমীর হোসেন জেলের প্রায় ২৫০০ কয়েদীকে হাজির করে তাদের সামনে এক বক্তৃতা দিয়ে বললো তারা যেন কমিউনিস্টদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে।[১৫৯]
ফুটবল মাঠের এই মিটিং শেষ হওয়ার আগেই খাপরা ওয়ার্ডে রাজবন্দীদের লকআপ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সন্ধ্যার পর আমীর হোসেন তালা খুলে ওয়ার্ডের ভেতরে এসে রাজবন্দীদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো: বাইরে আপনারা বিপ্লব করছেন। জেলের ভেতরেও এই সব কাণ্ড করলেন। এর প্রতিফল আপনাদেরকে পেতে হবে।[১৬০]
১৫ই এপ্রিলের পর এলো ২৪ এপ্রিল। ঐ দিন সকাল ৯টার দিকে জেলা সুপার বিল তার সাপ্তাহিক পরিদর্শনের জন্যে আসে। সুপারিনটেন্ডেন্ট বিলের সাথে জেলের ডাক্তার, জেলার মান্নান, দুজন ডেপুটি জেলার, হেড ওয়ার্ডার প্রভৃতি আরও কয়েকজন ছিলো।[১৬১] এর পূর্বেই খাপরা ওয়ার্ডে রাজবন্দীদের চা খাওয়া শেষ হয়েছিলো এবং ১৪ নম্বর সেলে বদলী ইত্যাদি নিয়ে হানিফ শেখ, মনসুর হাবিব, আবদুল হক প্রভৃতি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন।[১৬২]
সুপার বিল খাপড়া ওয়ার্ডের বারান্দায় দাঁড়িয়েই রাজবন্দীদের সাথে আলাপ শুরু করে। সে সময় জেল ইউনিটের সেক্রেটারী আবদুল হক তাঁদের পক্ষ থেকে তাকে বলেন যে তাঁরা প্রতিদিন দুবেলা একইভাবেই কুমড়োর ঘ্যাট আর খেতে পারবেন না। কাজেই জেলা কর্তৃপক্ষকে তাঁদের খাদ্যতালিকা পরিবর্তন করতে হবে।[১৬৩]
এর উত্তরে বিল তাঁদেরকে বলে যে তাঁরা হচ্ছেন ক্রিমিন্যাল, কাজেই যা তাঁদেরকে দেওয়া হচ্ছিলো তাই যথেষ্ট। তার বেশী তাঁদেরকে আর কিছু দেওয়া সম্ভব নয়। কনডেড সেলে যাওয়ার ব্যাপারেও সুপার বিলকে তাঁরা বলেন যে, সেখানে যেতে তাঁদের আপত্তি আছে।[১৬৪] এইভাবে কথা কাটাকাটি হতে হতে এক পর্যায়ে বিল তার হাতের ছড়ি তুলে বন্দীদের মধ্যে একজনকে মারতে ওঠে। সে সময় তাঁদের মধ্যে একজন তার ছড়িসমেত হাত ধরে ফেলেন এবং টেনে তাকে বারান্দা থেকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন। এই সময় সাধারণভাবে আলাপরত অবস্থায় দুজন ডেপুটি জেলারও ঘরের মধ্যে ছিলেন। যাই হোক জেল সুপার বিলকে ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বারান্দায় দাঁড়ানো জেলার মান্নান হুইসেল বাজিয়ে দেয়। ঘরের মধ্যে এই সময় একটা ধস্তাধস্তি শুরু হয় এবং বন্দীদের হাত ছাড়িয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই বিল এবং অন্যেরা দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। দুজন ডেপুটি জেলার অবশ্য ভিতরেই আটকে পড়েন। এর পরই তারা পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় এবং তাদের সেপাইরা জানালার ফাঁক দিয়ে বন্দুক গলিয়ে ঘরের মধ্যে অবস্থিত রাজবন্দীদের উপর ৬০ রাউণ্ড গুলি ক্রমাগত বর্ষণ করে।[১৬৫]
বিল ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এবং হুইসেল ও পাগলা ঘণ্টা বাজানোর সাথে সাথেই রাজবন্দীরা চৌকি, নারকেলের ছোবড়ার গদি ইত্যাদি খাড়া করে নিজেদের ঘরের দরজা যথাসাধ্য বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু গুলির ধাক্কায় প্রায় তৎক্ষণাৎ তাঁরা প্রত্যেকেই এধার-ওধার ছিটকে পড়েন এবং নিজের নিজের আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ঘরের মধ্যে কোন আশ্রয়ই নিরাপদ ছিলো না কাজেই তাঁরা প্রত্যেকেই গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘরের মেঝে তাঁদের রক্তে ভিজে লাল হয়ে ওঠে।[১৬৬] একমাত্র শফিউদ্দীন আহমদই প্রস্রাবের জন্য রাখা একটি ড্রাম উল্টে তার মধ্যে আশ্রয় নেওয়ায় তাঁর শরীরেই সরাসরিভাবে গুলির কোন আঘাত লাগেনি।[১৬৭] খাপরা ওয়ার্ডের মধ্যে যে দুজন ডেপুটি জেলার আটকা পড়েছিলেন তাঁদের মধ্যেও একজন গুলিতে আহত হন।[১৬৮]
গুলিতে প্রথমেই মারা যান হানিফ শেখ। তার পর আনোয়ার হোসেন। মাথায় গুলি লেগে তাঁর মাথাটা সম্পূর্ণভাবে চুরমার হয়ে যায়।[১৬৯] তার পর ঘরের মধ্যে একের পর এক মারা যান সুখেন ভট্টাচার্য, দেলওয়ার এবং সুধীর ধর। সুধীর ধর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও তাঁর সহজ ভাব পরিত্যাগ করেনি। গণ্ডগোল শুরু হওয়ার সময়েই তিনি তাড়াতাড়ি একটি বিড়ি ধরিয়ে বলেন, ‘সবাই আজ লম্বা বিড়ি ধরাও। আজ আর কারো রক্ষে নেই। এর অল্পক্ষণ পরেই গুলিতে তিনি নিহত হন।[১৭০]
গুলি বর্ষণ শেষ হওয়ার পর পুলিশেরা ঘরের মধ্যে ঢুকে দুইবার লাঠি চার্জ করে। একজন রাজবন্দী তৃষ্ণার চোটে অস্থির হয়ে পানি পানি বলে চীৎকার করলে জেলার মান্নান একজন সেপাইকে দিয়ে তার মুখে প্রস্রাব করিয়ে দেয়। এই অবস্থায় তাঁরা পড়ে থাকার সময় রাজশাহীর পুলিশ সুপার একদল সশস্ত্র পুলিশ সাথে নিয়ে খাপরা ওয়ার্ডে হাজির হন।[১৭১] এর পূর্বে পাগলা ঘণ্টা দেওয়ার পর জেলার মান্নান ও বিল তাঁকে টেলিফোনে জানায় যে, রাজবন্দীরা খাপরা ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণ কয়েদীদেরকে সঙ্গে নিয়ে জেল গেট ভেঙে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। কাজেই তারা তাঁকে যত শীঘ্র সম্ভব সশস্ত্র দল নিয়ে জেলখানায় উপস্থিত হতে বলে। জেলখানায় উপস্থিত হয়ে পুলিশ সুপার কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। যে দৃশ্য তিনি খাপরা ওয়ার্ডে এসে দেখেন তা তিনি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি। নিহত এবং আহত রাজবন্দীদেরকে রক্ত গঙ্গার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখে এবং জেল সুপার ও জেলারের মিথ্যা রিপোর্ট দেওয়ার জন্যে তিনি তাদের দুজনকেই দারুণ গালাগালি করেন এবং গ্রেফতার করতে চান। পরে অবশ্য তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়নি।[১৭২]
সেই পুলিশ সুপারের বাড়ী ছিলো হায়দ্রাবাদ (দক্ষিণ)। তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি রাজবন্দীদের ওপর এই নির্যাতন ও নৃশংস গুলি বর্ষণ দেখে ঘটনাস্থলেই বলেছিলেন যে যুদ্ধের সময় তিনি অনেক মৃত্যু দেখেছিলেন কিন্তু অসহায় লোকদেরকে ঘরের মধ্যে এভাবে গুলি করে মারার কোন নজির তাঁর জানা নেই।[১৭৩] গুলি বর্ষণ বন্ধের পর যাঁরা আহত অবস্থায় রক্তগঙ্গা মেঝেতে পড়ে থাকলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কম্পরাম সিংহ, বিজন সেন, মনসুর হাবিব, নূরুন্নবী চৌধুরী, আবদুল হক, ভূজেন পালিত, অমূল্য লাহিড়ী, বাবর আলী, আবদুস শহীদ, আমিনুল ইসলাম প্রভৃ তি ৩১ জন রাজবন্দী। এঁদের মধ্যে কম্পরাম সিংহ এবং বিজন সেনের অবস্থা ছিলো সব থেকে সংকটাপন্ন।[১৭৪]
কিন্তু অবস্থা যতই সংকটাপন্ন হোক আহতদের চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা না করে তাঁদেরকে তারা প্রায় সারাদিন খাপরা ওয়ার্ডের মধ্যে ফেলে রাখলো। বহু ঘণ্টা পরে আহতদেরকে চিকিৎসার নাম করে একবার জেল গেটে তারা নিয়ে গেলো। সে সময় জেল কর্তৃপক্ষ তাঁদেরকে রাজশাহী সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার একটা চিন্তা করছিলো কিন্তু পরে ‘নিরাপত্তা’ ব্যবস্থার অসুবিধাঘটিত কারণে জেল গেট থেকেই ঐ অবস্থায় তাঁদেরকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে জেল হাসপাতালেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সেই রাত্রেই বিনা চিকিৎসায় জেলের মধ্যে বিজন সেন এবং কম্পরাম সিংহের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পূর্বে দিনাজপুর তেভাগা আন্দোলনের বীর যোদ্ধা কম্পরাম সিংহ আহত কমরেডদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘যারা বেঁচে থাকবে তাদেরকে বোলো লাল ঝাণ্ডার সম্মান রেখেই আমরা মারা গেলাম।[১৭৫]
খাপরা ওয়ার্ডে গুলি বর্ষণের ফলে যে সাতজন শহীদ হন তাঁদের প্রত্যেকেরই লাশ পুলিশ গোপনে সরিয়ে ফেলে এবং আত্মীয়স্বজনকে এ ব্যাপারে কোন খবর না দিয়ে সেগুলো গুম করে দেয়।[১৭৬]
বিনা চিকিৎসায় বহুক্ষণ পড়ে থাকায় এবং পরবর্তী সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে আহতদের সকলেরই অতিরিক্ত নানা উপসর্গ দেখা দেয়। এর মধ্যে নূরুন্নবী চৌধুরীর পায়ে গ্যাংগ্রীন হয়ে যাওয়ার ফলে তাঁর একটি পা কেটে বাদ দিতে হয়।[১৭৭]
জেল হাসপাতালের চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ প্রায় আড়াই বছর এই রাজবন্দীদেরকে পূর্বোল্লিখিত ১৪নং কনডেম্ড সেলেই তারকাঁটার বেড়ার মধ্যে আটকে রেখে[১৭৮] নিজেদের জেদ এবং ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘ইসলামী’ ন্যায়নীতিকে বজায় রেখেছিলো।
৯. ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ওপর মাও সেতুঙ ও চীনা লাইনের প্রভাব ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নোতুন পার্টি সম্পাদক রণদীভের সাথে অন্ধ্র পার্টি সেক্রেটারিয়েটের আভ্যন্তরীণ মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব অনেকখানি সুস্পষ্ট আকার ধারণ করে। অন্ধ্র ছাড়াও ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ, বিশেষত এসএ ডাঙ্গেও এই সময় রণদীভে লাইনের বিরোধিতা শুরু করেন।[১৭৯]
ছয় মাসের মধ্যে ভারতের বিপ্লব আসন্ন এই বক্তব্য এবং ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুসৃত রণকৌশলের বিরুদ্ধে অজয় ঘোষ জেল থেকে দুটি চিঠি পাঠিয়ে প্রতিবাদ জানানোর জন্য রণদীভে এই সময়ে তাঁকে বহিষ্কারের হুমকি দেখান।[১৮০]
কিন্তু ডাঙ্গে, অজয় ঘোষ প্রভৃতির সমালোচনার তুলনায় অন্ধ্র পার্টির বক্তব্য ও সমালোচনা ছিলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং তেলেঙ্গানায় সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনের অগ্রগতির ফলে তাদের বক্তব্যকে হুমকি দিয়ে বাতিল করার ক্ষমতাও প্রকৃতপক্ষে রণদীভের ছিলো না। এই সময় তেলেঙ্গানার পার্টির সাথে অন্ধ্র পার্টির খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো এবং অন্ধ্র পার্টির নেতা রাজেশ্বর রাওই ছিলেন তেলেঙ্গানা কৃষক সংগ্রামের সর্বপ্রধান প্রবক্তা।
হায়দ্রাবাদের নলগোণ্ডা ও ওয়ারাঙ্গল এই দুটি জেলাতে কমিউনিস্টরা নিজেদের সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন করে সমগ্র এলাকাটিকে মুক্ত এলাকা হিসেবে গঠন করতে থাকেন। গ্রামের পর গ্রাম তাঁরা গ্রাম্য ‘সোভিয়েট’ স্থাপন করে পুরাতন জমিদার জোতদারদের তাড়িয়ে দিয়ে ও হত্যা করে সে সব জায়গায় নোতুন জমি বন্দোবস্ত করেন। নিজামের কর্মচারীদের তাড়িয়ে দিয়ে পার্টির নেতৃত্বে তাঁরা নিজেদের এলাকার আর্থিক জীবন এবং রক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্ৰণ করতে থাকেন। ঠিক এই সময়েই অর্থাৎ ১৯৪৮ এর গোড়ার দিকে তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রে মাও সেতুঙ-এর প্রভাব বিস্তৃত হতে শুরু করে এবং অন্ধ্র সেক্রেটারিয়েট তাঁদের নোতুন বক্তব্য বিবেচনার জন্যে তা পার্টির সামনে উত্থাপন করেন।[১৮১]
১৯৪৮-এর জুন মাসে অন্ধ্র পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে একটি চিঠিতে ঘোষণা করেন যে মাও সেতুঙ-এর ‘নয়া গণতন্ত্র’কে ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। এ সম্পর্কে তাঁরা যে রণনীতির প্রস্তাব করেন তাতে সমগ্র কৃষক সম্প্রদায়কে (গ্রামীণ বুর্জোয়া ও ধনী কৃষকসহ) শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে একতাবদ্ধ করে তাদেরকে চীনা লাইন অনুসারে গেরিলা যুদ্ধে নিয়োজিত করার কথা বলা হয়।[১৮২]
অন্ধ্র সেক্রেটারিয়েট সে সময়ে কেবলমাত্র বৃহৎ বুর্জোয়া ও বৃহৎ জমিদারকেই সত্যিকার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসাবে মনে করেন। মধ্য কৃষকদেরকে তাঁরা মনে করেন বিপ্লবের দৃঢ় মিত্র এবং ধনী কৃষকদেরকে মনে করেন নিরপেক্ষ ও ক্ষেত্রবিশেষে বিপ্লবের দোদুল্যমান মিত্র।[১৮৩]
এই শ্রেণী বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে তাঁরা নিজেদের মতামতের সংক্ষিপ্ত সারাংশ দিতে গিয়ে বলেন:
ক্ল্যাসিকাল রুশ বিপ্লবের সাথে আমাদের বিপ্লবের অনেক দিক দিয়ে তফাৎ এবং চীন বিপ্লবের সাথে অনেক বেশী সাদৃশ্য। আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ ধর্মঘট, সাধারণ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে মুক্তির সম্ভাবনা নেই। এখানে যা ঘটবে তা হচ্ছে নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ ও কৃষি বিপ্লবের আকারে সুদীর্ঘ গৃহযুদ্ধ এবং তার পরিণামে গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের দ্বারা রাজনৈতিক দক্ষতা দখল।[১৮৪]
রণদীভের ‘অত্যাসন্ন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের’ বক্তব্যের সাথে এই বক্তব্যের বিরোধিতা খুবই স্পষ্ট। অন্ধ্র সেক্রেটারিয়েটের উপরোক্ত বক্তব্যকে খণ্ডন করার চেষ্টায় রণদীভে পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্র ‘কমিউনিষ্ট’-এ জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী এবং জুন-জুলাই সংখ্যায় পর পর চারটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।[১৮৫]
এই প্রবন্ধগুলির মধ্যে ‘জনগণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম’ নামে চতুর্থ প্রবন্ধটিতে তিনি বলেন, রুশ বিপ্লবের পুরো অভিজ্ঞতাই ভারতের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে প্রযোজ্য’ এবং রুশ ইতিহাসই হচ্ছে ভারতের আদর্শ।[১৮৬]
এই প্রবন্ধটিতেই মাও সেতুঙকে আক্রমণ করে এবং একমাত্র কমিনফর্মের প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে রণদীভে বলেন:
প্রথমেই একথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা দরকার যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন এবং স্ট্যালিনকেই মার্কসবাদের উৎস হিসেবে স্বীকার করেছে। এর বাইরে তারা কোন নোতুন উৎস আবিষ্কার করেনি। তাছাড়া এমন কোন কমিউনিস্ট পার্টি নেই যারা মাও এর দ্বারা নির্মিত বলে কথিত নয়া গণতন্ত্রের তথাকথিত তত্ত্বের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করছে এবং তাকে মার্কসবাদের একটা নোতুন সংযোজন বলে স্বীকার করেছে। এটাও খুব অদ্ভুত যে ইউরোপে নয় পার্টির (কমিনফর্ম) কনফারেন্সে মার্কসবাদের এই নোতুন সংযোজন সম্পর্কে কোন উল্লেখ করা হয়নি।[১৮৭]
কিন্তু এসব সত্ত্বেও তেলেঙ্গানার সংগ্রাম এবং অন্ধ্র পার্টি সেক্রেটারিয়েটের বক্তব্যকে গ্রাহ্যের মধ্যে না এনে রণদীভের উপায় ছিলো না। কারণ একমাত্র তেলেঙ্গানাতেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে একটা সত্যিকার সংগ্রাম এই সময়ে পরিচালিত হচ্ছিলো এবং অন্ধ্র সেক্রেটারিয়েটই সে সময় ছিলো এই সংগ্রামের পার্টিগত মুখপাত্র।
ভারত সরকার কর্তৃক হায়দ্রাবাদ দখলের পর অবশ্য তেলেঙ্গানার এই সংগ্রামের অনেক বিপর্যয় ঘটে এবং পরিশেষে তা বহুধাবিভক্ত হয়ে ছোট ছোট খণ্ড আক্রমণ ও আন্দোলনে পরিণত হয়।
ভারতে মাও সেতুঙ-এর ‘নয়া গণতন্ত্রে’র প্রয়োগ সম্পর্কে রুশ বিরোধিতার অবসান ঘটে ১৯৪৯-এর মাঝামাঝি। জুকভের সভাপতিত্বে জুন মাসে সোভিয়েট অ্যাকাডেমিশিয়ানদের একটি সভায় ‘নয়া গণতন্ত্রকে’ সারা এশিয়ার জন্যে একটা নীতি হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষণা করা হয়। জুকভ তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায় পূর্ব ইউরোপীয় এবং চীনা তত্ত্বের সাদৃশ্যের ওপর খুব জোর দেন এবং বলেন যে, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সত্ত্বেও প্রাচ্যের জনগণতন্ত্রের সাথে পশ্চিমা জনগণতন্ত্রের মৌলিক চরিত্রের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। রণ কৌশলের ক্ষেত্রে জুকভ ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বত্র সশস্ত্র বিদ্রোহকে সমর্থন জানিয়ে ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীন, মালয়, বার্মা ও চীনের বিদ্রোহের সাথে ‘ভারতের কৃষক অভ্যুত্থানের’ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, এই সংগ্রামসমূহ প্রমাণ করে যে এই সব এলাকার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম একটা ‘নোতুন এবং উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।[১৮৮]
ভারতের ওপর মূল রিপোর্টটি[১৮৯] পেশ করেন ব্যালারুশেভিচ। চীনা রণনীতি ও রণ কৌশল ভারতে কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে এ বিষয়ে তিনি একটি বিস্তৃত বিবরণ দেন। তাতে তিনি বলেন যে মধ্য বুর্জোয়াদের একটি অংশকে বিপ্লবের ‘সহযাত্রী’ হিসেবে পাওয়া যাবে। ভারতের অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ জাতিসত্তাসমূহ এবং বুর্জোয়াদের যে অংশটির স্বার্থ বিদেশী পুঁজির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তিনি সেগুলিকেই এক্ষেত্রে চিহ্নিত করেন। জুকভের মতো ব্যালারুশেভিচও ভারতে সশস্ত্র সংগ্রামকে অভিনন্দন জানান এবং ‘ভারতের জনগণতন্ত্র কায়েমের প্রথম প্রচেষ্টা’ হিসাবে তেলেঙ্গানার আন্দোলনের প্রশংসা করেন। এ ছাড়া তিনি তাকে ‘কৃষিবিপ্লবের অগ্রদূত’ এবং মুক্তি আন্দোলনের ‘সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্বস্তু হিসাবেও উল্লেখ করেন। এই পথকেই ভারতের পথ বলে ঘোষণা করে ভারতীয় কমিউনিষ্টদেরকে তা নিষ্ঠার সাথে অনুসরণের জন্যে তিনি আহ্বান জানান। এভাবেই বস্তুতঃপক্ষে মাও সেতুঙ- এর তত্ত্বের দ্বারা উদ্বুদ্ধ অন্ধ্র সেক্রেটারিয়েটের কর্মসূচীই সোভিয়েট বিশেষজ্ঞ ও সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা এই পর্যায়ে স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়।[১৯০]
এশীয় এবং অস্ট্রেলীয় দেশগুলির ট্রেড ইউনিয়নসমূহের কনফারেন্স উপলক্ষে ১৯৪৯-এর নভেম্বর মাসে যখন এশীয় পার্টির প্রতিনিধিরা পিকিং-এ সমবেত হন তখনই তাঁদেরকে চূড়ান্তভাবে এই নোতুন লাইন সম্পর্কে অবহিত করা হয়। চীনা নেতা লিউ শাও চী তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে ঘোষণা করেন যে, চীনা বিপ্লব যে, পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে সেই পথ ধরেই জাতীয় মুক্তি ও জনগণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রামের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঔপনেবেশিক এবং আধা ঔপনেবেশিক দেশগুলিকে অগ্রসর হতে হবে। এশীয় দেশগুলির জন্যে সশস্ত্র বিপ্লবকেই তিনি ‘সংগ্রামের মূল রূপ’ বলে মন্তব্য করেন। ভিয়েতনাম, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ফিলিপাইনের গৃহযুদ্ধের উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, সেই সব দেশের পার্টিসমূহ সম্পূর্ণ সঠিকভাবে কাজ করছে। ভারতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, সেখানেও মুক্তির জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়েছে। সর্বশেষে লিউ শাও চী সমবেত ডেলিগেটদের কাছে এই মর্মে আহ্বান জানান, যাতে তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের দেশের বিশেষ বিশেষ অবস্থায় ‘সংগ্রামের নির্দিষ্ট রূপ’ সম্পর্কে আলোচনা করেন। ভারতের কোন প্রতিনিধি পিকিং-এর সেই সম্মেলনে উপস্থিত না থাকায় ভারতীয় পরিস্থিতির সম্পর্কে কোন বিশেষ আলোচনা হয়নি এবং ভারত সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট রণকৌশলগত পরিকল্পনা সিদ্ধান্তও সেখানে নেওয়া হয়নি।[১৯১]
১০. কমিনফর্ম থিসিস ও ভারতীয় পার্টির নেতৃত্বে রদবদল
অনুন্নত এশীয় দেশগুলির জন্যে চীনা পার্টি অনুসৃত কর্মসূচী অনুমোদন করে কমিনফর্মের মুখপত্রে১৯২ ‘Mighty Advance of the National Liberation Movement in the colonial and Dependent Countries’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তবে এই প্রবন্ধে চীনা বিপ্লবের অনেক প্রশংসা করে অন্যান্য অনুন্নত দেশগুলির জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে তার প্রচণ্ড তাৎপর্যের বিষয় উল্লেখ করা সত্ত্বেও পিকিংয়ে পূর্বোক্ত ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলনে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপাত্র লিউ শাও চীর বক্তব্যকে অনেকাংশে তাঁরা পরিবর্তিতও করেন। লিউ শাও চী বলেছিলেন যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পথ “বিভিন্ন ঔপনিবেশিক ও নির্ভরশীল অনুন্নত দেশেরই” পথ। কিন্তু কমিনফর্মের মুখপত্রে বলা হয় যে চীনা লাইন ‘অনেক ঔপনিবেশিক ও নির্ভরশীল দেশের’ পথ। চীনা মুখপাত্র যেখানে বোঝাতে চেয়েছেন ‘সমস্ত’, কমিনফর্মের মুখপাত্ররা সেখানে বলেছেন ‘অনেক’। এর অর্থ হলো এই যে অনুন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে চীনা লাইনের ‘সার্বিক’ প্রয়োগের ওপর কমিনফর্ম জোর না দিয়ে তার ‘সাধারণত প্রয়োগের কথা উল্লেখ করেন। ভারতের প্রশ্নে কমিনফর্মের এই প্রবন্ধে বলা হয় যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে চীন এবং অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের কর্মসূচী নির্ধারণ করতে হবে।[১৯৩]
পূর্ববর্তী রুশ মুখপাত্রেরা যেখানে সশস্ত্র উপায়ে ক্ষমতা দখলের কথা বলেছিলেন সেখানে কমিনফর্ম এক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রামের কোন উল্লেখ থেকে বিরত থাকেন।[১৯৪]
এইভাবে কমিনফর্ম ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা ভারতের ক্ষেত্রে তৎকালীন পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে রণদীভের পক্ষে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে টিকে থাকা আর কিছুতেই সম্ভব হলো না। বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্বগত মুখপত্রে (Communist Review) এই সময় ‘ভারতীয় পরিস্থিতি’ নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হওয়া সত্ত্বেও বৃটিশ অথবা অন্য কোন বৈদেশিক কমিউনিস্ট পার্টিই রণদীভের বক্তব্যকে সমর্থন না করায় তাঁর পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে এবং ১৯৫০-এর মে মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বৈঠকে পুরাতন কমিটি রণদীভেকে সম্পাদকের পদ থেকে অপসারণ করে নিজেকে নোতুনভাবে গঠন করে এবং তার মধ্যে অন্ধ্রের সদস্য থাকেন চারজন। এই নোতুন কমিটি অন্ধ্র সেক্রেটারিয়েটের রাজেশ্বর রাওকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নোতুন সম্পাদক নির্বাচিত করে রণদীভে লাইনকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেন।[১৯৫] এর পর পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্র কমিউনিস্ট এর সম্পাদকীয় পরিষদকে নোতুনভাবে সংগঠিত করা হয় এবং তার পরবর্তী সংখ্যাতেই তাঁরা রণদীভের লাইনকে ‘বামপন্থী বিচ্যুতি’ ও ‘পুরোদস্তুর ট্রটস্কীপস্থি থিসিস’ বলে অবহিত করেন। এ ছাড়া সম্পাদকীয় পরিষদ ঊনত্রিশতম বার্ষিকী উপলক্ষে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে একটি অভিনন্দন পাঠিয়ে তাতে বলেন যে, ‘ঔপনিবেশিক দুনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে তাদের আদর্শ হিসাবে মনে করেন।[১৯৬]
১১. কমিনফর্ম থিসিস ও পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি
কমিনফর্ম থিসিসে পাকিস্তান, বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তান, সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট বক্তব্য না থাকলেও পাকিস্তানী ও ভারতীয় পরিস্থিতির মধ্যে কোন মৌলিক অথবা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য না করায় উভয় ক্ষেত্রের জন্যে তাঁরা একই কর্মসূচীকে পরোক্ষভাবে অনুমোদন করেন। এ জন্যেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্তসমূহ সাধারণভাবে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলো তেমনি পরবর্তী কমিনফর্ম থিসিসও প্রযোজ্য ছিলো ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে।
পূর্ব পাকিস্তানে রণদীভের থিসিস যে সব কারণে ব্যর্থ হয় তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে :
১. পূর্ব-বাঙলার শ্রেণীবিন্যাস এবং দেশভাগের ঠিক পরবর্তী পর্যায়ে ‘পাকিস্তানের’ প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গীকে সঠিকভাবে বোঝার অক্ষমতা এবং এই অক্ষমতার ফলে পূর্ব- বাঙলার বৈপ্লবিক পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে বোঝার ব্যাপারে তাঁদের পুরোপুরি ব্যর্থতা।
২. পার্টির আন্দোলন এবং ছোটখাটো অ্যাকশন মূলতঃ অমুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। এর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কৃষক শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত তাঁদের কার্যকলাপকে অনেকাংশে সাম্প্রদায়িক ভেবে তার থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখেন। সরকারী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রচারণাও এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে ভুল ধারণার সৃষ্টি করে। কিন্তু পার্টির পক্ষ থেকে উপযুক্ত প্রচার ও কার্যসূচীর মাধ্যমে তাদের এই ধারণা পরিবর্তন করা সন্তোষজনকভাবে সম্ভব হয়নি। এর ফলে বৃহত্তর জনগণের স্বার্থের সাথে পার্টির রাজনীতি ও রণকৌশলের সম্পর্ককেও তাঁরা তুলে ধরতে সক্ষম হননি।
৩. গ্রামাঞ্চলে যে সব ছোটখাটো অ্যাকশনের মধ্যে তাঁরা গিয়েছিলেন তার নেতৃত্ব ছিলো সব সময়েই পেটি বুর্জোয়াদের হাতে। এর ফলে অ্যাকশনের মধ্যে আত্মপ্রত্যয়ের নিতান্ত অভাব ছিলো। সে জন্যেই অ্যাকশনের পরবর্তী পর্যায়ে রণে ভঙ্গ দেওয়ার প্রবণতা তাঁদের মধ্যে অনেক বেশী দেখা দেয়।
৪. জেলখানা হচ্ছে শ্রেণীশত্রুর সবলতম ঘাঁটি। সেই ঘাঁটির মধ্যে তারা প্রায় সর্বশক্তিমান। সেখানে বিপ্লব সমাধা করার চেষ্টা অথবা শত্রুর সাথে একটা সরাসরি বোঝাপড়ার কার্যসূচী ছিলো নিতান্ত ভুল। শত্রুর এই সবলতম ঘাঁটিতে শত্রুকে আঘাত করতে গিয়ে সংগঠনের দিক থেকে পার্টি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫. অনশন প্রকৃতপক্ষে গান্ধীবাদী ও সংস্কারবাদী প্রভাবের ফল। একদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের
রণনীতি এবং অন্যদিকে জেলখানার মধ্যে অর্থনৈতিক দাবী এবং ঐ জাতীয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার জন্য অনশন, এই দুইয়ের মধ্যে ছিলো সামঞ্জস্যের একান্ত অভাব। এর দ্বারা তাদের চিন্তার অপরিচ্ছন্নতা এবং কর্মকৌশলের মূলগত ভ্রান্তিই ধরা পড়ে।
৬ . জনগণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে জেলখানার মধ্যে অনশন এবং নানা অ্যাকশনের ফলে বিপুলসংখ্যক পার্টি কর্মী ও নেতাদের মনোবল একেবারে ভেঙ্গে পড়ে এবং তার ফলে তাঁদের মধ্যে আসে চরম হতাশা। এই অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে পরবর্তী পর্যায়ে তাঁদের অধিকাংশ সশস্ত্র বিপ্লব অথবা অ্যাকশনের চিন্তাকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে কেবলমাত্র গণসংগঠনের মধ্যে নিজেদের কাজকে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেন। পার্টির নীতি এবং কৌশলও সেই অনুসারে নির্ধারিত হয়।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির উপদেশ ও কমিনফর্মের নোতুন সিদ্ধান্ত এবং পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নানা ব্যর্থতার পর পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিও তাদের রণনীতি ও কর্মসূচী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এই সিদ্ধান্ত পার্টিগতভাবে গৃহীত হয় ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জেলার নির্ধারিত প্রতিনিধিদের একটি কনফারেন্সে।
এই কনফারেন্সের পর পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি গণসংগঠন ও গণসংযোগের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে এবং এই কর্মসূচীকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে পরবর্তী পর্যায়ে আওয়ামী লীগ প্রভৃতির মধ্যে উপদলীয় কাজ এবং যুব লীগ প্রভৃতি গণসংগঠনের মধ্যে ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এইভাবে তারা প্রথম পর্যায়ে জনগণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এবং পরবর্তী পর্যায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের নীতিকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে পেটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
এই দুই ঝোঁকই ছিলো একই সংশোধনী বিচ্যুতের দ্বিবিধ প্রকাশ। প্রথম পর্যায়ে জনগণ থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে গণসংগঠনের অর্থনীতিবাদী ও সংস্কারবাদী কার্যসূচীর বেড়াজালে আটকা পড়ে তারা পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রায় বিলুপ্তির পথে এগিয়ে দেন এবং এই অবস্থা কাটিয়ে উঠে সঠিক রণনীতি ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে তাঁদেরকে পরবর্তী পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে অনেক নোতুন নোতুন অভিজ্ঞতা ও আভ্যন্তরীণ সংকট উত্তীর্ণ হতে হয়।
তথ্যসূত্র (সংশোধন করা হয়নি) – দশম পরিচ্ছেদ: ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস ও পরবর্তী পর্যায়
8
৫
G
১০
“Statement of Policy’, Peoples Age. V (June 29, 1947) P 6-7.
পূর্বোক্ত।
পূর্বোক্ত, Quoted in Communism in India by Gene D. Overstreet and Marshall Windmiller, University of California Press. 1959, P 260.
পূর্বোক্ত।
Peoples Age : Supplement, VI (March 21, 1948), P 4.
R. Palme Dutta, “The Mountbatten Plan for India’, Labour Monthly XXIX (July, 1947), P. 210-219. Referred in Communism in India, P262. Peoples Age, VI (August 3, 1947 ), P 116.
Peoples Age, (Sept, 14. 1947), P 1.
পূর্বোক্ত, Sept, 21, 1947. P 4.
রক্তক্ষয়ী পাঞ্জাব, ধন্বন্তরী ও পূরণচন্দ্র যোশী, ২২শে অক্টোবর ১৯৪৭। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটি, পৃষ্ঠা : অনুবাদ-প্রমথ চক্রবর্তী।
পূর্বোক্ত, পৃ ৪৬।
১২ পূর্বোক্ত, পৃ ৫৩-৫৪।
১৩ পূর্বোক্ত।
১৪
পূর্বোক্ত, পৃ ৬০।
১৫
Peoples Age: Supplement, VI (March 21, 1948), P 4.
১৬
১৭
১৮
Peoples Age, VI (Nov. 30, 1947), P 10.
পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ, ভবানী সেন, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, ১৯৪৭, পৃ ৩-৪। Peoples Age, (Oct. 12, 1947) P 5.
১৯ পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯, ১৯৪৭, পৃ ১।
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩২৩
20
২১
2
২৩
২৪
25
২৫
২৬
২৭
A. Dyakov, “The New British Plan for India’, New Times, (June 13,1947), P 12-15.
Communism in India, P 253.
E. Zhukov, ‘On the situation in India,’ Mirovc Khoziaistvo (July, 1947), P. 3-14; Quoted in Communism in India, P254-55.
Communism in India, P 256-57.
পূর্বোক্ত, পৃ ২৫৮-৫৯।
People Age, VI (August 15, 1947), P 20.
Communism in India, P 265.
Edward Kardlji, Problems of International Development : A Marxist
Analysis (Bombay : Peoples Publishing House, 1947 )
Communism in India, P 268.
২৯ পূর্বোক্ত, পৃ ২৬৮।
30 Peoples Age, VI (December. 7, 1947), P 1.
৩১
Communism in India, P 271.
৩২ পূর্বোক্ত, পৃ ২৭১.
৩৩ পূর্বোক্ত।
৩৪ পূর্বোক্ত, পৃ ২৭২.
৩৫ পূর্বোক্ত।
৩৬
৩৭
Peoples Age, VI (Nov. 30, 1947), P 10.
Communism in India, P. 272.
৩৮ Peoples Age : Supplement, VI (March 21, 1948), P 3.
৩৯
Communism in India, P. 273.
৪০ পূর্বোক্ত।।
পূর্বোক্ত।
৪২ পূর্বোক্ত।
৪৩ পূর্বোক্ত, পৃ ২৭৩-৭৪।
Communism in India, P. 274-75
Peoples Age, VI (March 14. 1948), P 10; Communism in India, P 274-75.
রণেশ দাশগুপ্ত।
88
80
8@
৪৬
৪৭ পূর্বোক্ত।
৪৮
রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সার।
89
আবদুল হক, রণেশ দাশগুপ্ত, মুনীর চৌধুরী।
৫০ পূর্বোক্ত।
৫১ পূর্বোক্ত।
৫২ রণেশ দাশগুপ্ত, মুনীর চৌধুরী।
৫৩ রণেশ দাশগুপ্ত।
৩২৪ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২
8883
Q8
৫৫
পূর্বোক্ত।
মুনীর চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্ত।
৫৬ পূর্বোক্ত।
।
৫৭ রণেশ দাশগুপ্ত |
৫৮ মুনীর চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্ত।
পূর্বোক্ত।
৫৯
৬০
পূর্বোক্ত।
৬১ পূর্বোক্ত।
৬২ রণেশ দাশগুপ্ত।
৬৩ মুনীর চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্ত।
৬৪
৬৫
রণেশ দাশগুপ্ত।
রণেশ দাশগুপ্ত, সমর সেন, আবদুল হক, শহীদুল্লাহ কায়সার।[৬৬ সমর সেন, রণেশ দাশগুপ্ত।
৬৭ মুনীর চৌধুরী, সমর সেন, আবদুল হক, রণেশ দাশগুপ্ত।
৬৮ নওবেলাল, ১২ই মে ১৯৪৯।
৬৯ পূর্বোক্ত, ১৯শে মে ১৯৪৯।
१०
পূর্বোক্ত, ২৭শে অক্টোবর ১৯৪৯।
৭১ পূর্বোক্ত
৭২
পূর্বোক্ত।
৭৩ পূর্বোক্ত।
98
পূর্বোক্ত, ২৩শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫০।
৭৫ পূর্বোক্ত, ১৩ই এপ্রিল ১৯৫০।
৭৬
নওবেলাল-এর ২৯ শে এপ্রিল ১৯৫০ তারিখের সম্পাদকীয়তে উদ্ধৃত।
৭৭ পূর্বোক্ত।
৭৮ East Bengal Assembly Proceedings, Third session, 1949, Vol. III : No. 4, P 51.
পূর্বোক্ত। পৃ ৫০।
৮০ পূর্বোক্ত।
৮১
পূর্বোক্ত, পৃ ৫২।
৮২ পূর্বোক্ত, পৃ ৫৩।
৮৩ মারুফ হোসেন।
৮৪
রণেশ দাশগুপ্ত।
৮৫
পূর্বোক্ত।
৮৬ পূর্বোক্ত।
৮৭
৮৮
পূর্বোক্ত।
East Bengal Assembly Proceedings, Third session, 1949, Vol-III: No. 4, P 54, ৮৯ রণেশ দাশগুপ্ত।
৯০
East Bengal Assembly Proceedings, Third session, 1949, Vol – III : No. 4, P 54.
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩২৫
৯১
পূর্বোক্ত।
৯২ রণেশ দাশগুপ্ত।
৯৩ আবদুল হক।
৯৪
মারুফ হোসেন।
£ R
৯৫
পূর্বোক্ত।
৯৬
পূর্বোক্ত।
৯৭
আবদুল হক, রণেশ দাশগুপ্ত।
৯৮
৯৯
রণেশ দাশগুপ্ত।
তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১/৬/১৯৪৯।
১০০ রণেশ দাশগুপ্ত।
১০১ আবদুল হক।
১০২ নওবেলাল, ৯ই জুন ১৯৪৯।
১০৩ পূর্বোক্ত।
308 EB Leagislative Assembly Proceedings, Fourth session, 1949-50, Vol.
IV. No. 5, 94, 95.
১০৫ রণেশ দাশগুপ্ত।
১০৬ পূর্বোক্ত।
১০৭ আবদুল হক।
১০৮ পূর্বোক্ত।
১০৯ রণেশ দাশগুপ্ত।
১১০ রণেশ দাশগুপ্ত, মারুফ হোসেন।
১১১ রণেশ দাশগুপ্ত।
১১২ রণেশ দাশগুপ্ত, মারুফ হোসেন।
১১৩ পূর্বোক্ত।
১১৪ মারুফ হোসেন।
১১৫ মারুফ হোসেন, রণেশ দাশগুপ্ত।
১১৬ পূর্বোক্ত।
১১৭ East Bengal Assembly Proceedings, Fourth session, 1949, Vol – I V, No. 5, P95.
১১৮ রণেশ দাশগুপ্ত, মারুফ হোসেন।
১১৯ রণেশ দাশগুপ্ত।
১২০ পূর্বোক্ত।
১২১ রণেশ দাশগুপ্ত, মারুফ হোসেন।
১২২ পূর্বোক্ত।
১২৩ রণেশ দাশগুপ্ত।
১২৪ East Bengal Assembly Proceedings, Fourth session, 1949-50,, Vol. I,
No. 5. P 93-94.
125 P 95.
৩২৬ ] বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২
126 P 95-96.
১২৭ দৈনিক আজাদ, ৮ই জানুয়ারী ১৯৫০।
১২৮ রণেশ দাশগুপ্ত, মারুফ হোসেন।[১২৯ পূর্বোক্ত।
১৩০ রণেশ দাশগুপ্ত।
১৩১ পূর্বোক্ত।
১৩২ আবদুল হক
১৩৩ রণেশ দাশগুপ্ত।
১৩৪ পূর্বোক্ত।
১৩৫ নওবেলাল, ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৪৯।
১৩৬ পূর্বোক্ত।
১৩৭ পূর্বোক্ত।
১৩৮ পূর্বোক্ত।
১৩৯ পূর্বোক্ত।
১৪০ পূর্বোক্ত।
১৪১ পূর্বোক্ত।
১৪২ পূর্বোক্ত।
১৪৩ পূর্বোক্ত।
১৪৪ পূর্বোক্ত।
১৪৫ নওবেলাল, ৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৯।
১৪৬ আবদুল হক।
১৪৭ আবদুল হক, আবদুশ শহীদ-খাপরা ওয়ার্ডে ২৪শে এপ্রিল— গণশক্তি ২৬শে এপ্রিল, ১৯৪৯।
১৪৮ পূর্বোক্ত।
১৪৯ পূর্বোক্ত এবং মনসুর হাবিব।
১৫০ আবদুল হক।
১৫১ পূর্বোক্ত।
১৫২ পূর্বোক্ত।
১৫৩ আবদুশ শহীদ- খাপরা ওয়ার্ডে ২৪শে এপ্রিল ১৯৪৯।
১৫৪ পূর্বোক্ত।
১৫৫ পূর্বোক্ত।
“
১৫৬ পূর্বোক্ত।
১৫৭ আবদুল হক।
১৫৮ পূর্বোক্ত।
১৫৯ পূর্বোক্ত।
১৬০ পূর্বোক্ত।
১৬১ আবদুশ শহীদ, খাপরা ওয়ার্ডে ২৪শে এপ্রিল ১৯৪৯ এবং শফীউদ্দীন আহমদ।[১৬২ পূর্বোক্ত।
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩২৭
১৬৩ পূর্বোক্ত।[১৬৪ পূর্বোক্ত।
১৬৫ শফীউদ্দীন আহমদ।
১৬৬ আবদুশ শহীদ, আবদুল হক, শফীউদ্দীন আহমদ।
১৬৭ শফীউদ্দীন আহমদ।
১৬৮ আবদুল হক।
১৬৯ আবদুশ শহীদ, শফীউদ্দীন আহমদ, আবদুল হক।
১৭০ আবদুল হক।
১৭১ শফীউদ্দীন আহমদ।
১৭২ পূর্বোক্ত।
১৭৩ আবদুল হক।
১৭৪ আবদুল হক, শফীউদ্দীন আহমদ।
১৭৫ আবদুল হক।
১৭৬ সত্যেন সেন, গ্রাম বাংলার পথে পথে, পৃ ৭৬ এবং আবদুল হক।
১৭৭ আবদুল হক, আবদুশ শহীদ, শফীউদ্দীন আহমদ, মনসুর হাবিব।
১৭৮ পূর্বোক্ত।
১৭৯ Commuism in India by Overstreet and Windmiller, P 285. ১৮০ পূর্বোক্ত।
১৮১ পূর্বোক্ত, পৃ ২৮৭।
১৮২ পূর্বোক্ত।
১৮৩ পূর্বোক্ত,’Struggle for People Democracy And Socialism’, Some Questions
of Strategy and Tactics Communist II, (June-July, 1949), P 71.
১৮৪ পূর্বোক্ত, পৃ ৮৩।
১৮৫ Communism in India, PP. 288.
১৮৬ পূর্বোক্ত, পৃ ২৮৯।
১৮৭ পূর্বোক্ত, পৃ ২৯১।
১৮৮ পূর্বোক্ত, পৃ ২৯৩-৯৪, পৃ ২৯৪।
১৮৯ পূর্বোক্ত, The New Stage in the National Liceration Struggle of the People
of India- Balabusheviche.
১৯০ পূর্বোক্ত, পৃ ২৯৪-৯৫।
১৯১ পূর্বোক্ত, পৃ ২৯৫-৯৬।
১৯২ For a Lasting Peace, For a People’s Decmocracy.
১৯৩ Communism in India, P296.
১৯৪ পূর্বোক্ত, পৃ ২৯৭।
১৯৫ পূর্বোক্ত, পৃ ২৯৭-৮।
১৯৬ পূর্বোক্ত, পৃ ২৯৮।
পরিশিষ্ট ১ – কবি জসীম উদ্দীন-এর পত্র
কবি জসীম উদ্দীন আমার কাছে লিখিত নিম্নের পত্রে বলেছেন, আমি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছি যে, সৈয়দ আলী আহসান তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানকে উর্দু অক্ষর প্রবর্তন করতে বিরত করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বস্তুতপক্ষে আমি সে রকম কিছু বলিনি। আমি আমার এ বইটির প্রথম খণ্ডে (প্রথম প্রকাশ, পৃষ্ঠা ২৫৮) এ প্রসঙ্গে যা বলেছি তা হলো এই: ১৯৪৮ সালে ফজলুর রহমান, সৈয়দ আলী আহসান এবং অন্যান্য কয়েকজনের সঙ্গে মওলা সাহেবের বাসায় আরবী হরফ প্রবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করেন। আলী আহসান তাকে বলেন যে, পরিকল্পনাটির সম্ভাব্যতা পরীক্ষার জন্যে ডক্টর শহীদুল্লাহই সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ব্যক্তি, কাজেই তাকে সেই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয় সংস্করণে এই অংশটিকে পরিবর্তন করার কোন প্রয়োজন বোধ না করলেও কবি জসিম উদ্দীন-এর পত্রটি এখানে প্রকাশ করলাম। কারণ এই পত্রটিতে তৎকালীন ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ফজলুর রহমান, সৈয়দ আলী আহসান ও প্রাদেশিক শিক্ষা দফতরের সচিব ফজলে করিম ফজলীর প্রকৃত ভূমিকা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জসীম উদ্দীন খুব স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন।
স্নেহের উমর,
তোমার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পুস্তকে একস্থানে তুমি লিখিয়াছ, সৈয়দ আলী আহসান মওলা মিয়ার বাসায় একটি আলোচনায় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান সাহেবকে উর্দু অক্ষর প্রবর্তন করিতে বিরত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। ইহা সম্পূর্ণ ভুল।
আমি তখন সরকারের তথ্য বিভাগের গীতি প্রচারের সংগঠক হিসাবে কাজ করি। এক সময় আমাদের ভূতপূর্ব ছাত্র আজিজুল হক আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, দেখুন আপনার বন্ধু প্রেস কনফারেন্স ডাকিয়া কি কাণ্ড করিতেছেন। তিনি বাংলার পরিবর্তে উর্দু বর্ণমালা প্রবর্তন করাইবেন। প্রেস কনফারেন্সে এই কথা ঘোষণা করিলেন।
শুনিয়া আমিতো আকাশ হইতে পড়িলাম। বাঙালী জাতির এমন সর্বনাশ তিনি কী করিয়া করিতে যাইবেন?
আমি ফজলুর রহমান সাহেবকে যাইয়া বলিলাম, ‘বর্ণমালা পরিবর্তনের ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করিতে চাই।’
তিনি আমাকে বলিলেন, আজ রাত ৮টার পরে আপনি মওলা মিঞার বাসায় আসিবেন। মওলা মিঞা তখন থাকিতেন ফুলবাড়িয়া রোডের একটি বাসায়। সেখানে যাইয়া দেখিতে পাইলাম শিক্ষা সম্পাদক মিঃ ফজলে করিম ও সৈয়দ আলী আহসান সেইখানে আগেই আসিয়াছেন। মন্ত্রী সাহেব পূর্বেই তাহাদিগকে ডাকিয়া থাকিবেন।
কুশল প্রশ্নের পর আমি বলিলাম ‘বাংলার পরিবর্তে উর্দু বর্ণমালা প্রবর্তন করিতে যাইয়া আপনি বাঙ্গালী জাতিকে জীবন সংগ্রামে পশ্চিমাদের সঙ্গে হারিয়া যাইবার সুযোগ করিয়া দিতেছেন।’ তিনি বলিলেন, ‘বাঙ্গালী জাতির প্রতি আপনার বড়ই হীন ধারণা। বাঙ্গালীরা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই উর্দু বর্ণমালা শিখিয়া পশ্চিমা ছাত্রদিগকে ডিঙাইয়া যাইবে।’ পাশে বসিয়া সৈয়দ আলী আহসান আর ফজলে করিম সাহেব মন্ত্রী সাহেবকে সমর্থন জানাইতেছিলেন।
আমি বলিলাম, ‘আপনার এই কথা আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া এখনই আমাদের দেশে প্রেস নাই, বই পুস্তক ছাপাইবার কাগজপত্র নাই। আমাদের অতীতকালের যে সব সাহিত্যিক তাঁহাদের অমর অবদান রাখিয়া গিয়াছেন তাহা উর্দু অক্ষরে রূপান্তরিত করা সরকারের সাধ্য নাই। উর্দু অক্ষর প্রবর্তন করিলে আমাদের ছাত্ররা সেইসব সাহিত্য উপভোগ হইতে বঞ্চিত হইবে।
মন্ত্রী সাহেব বলিলেন, ‘সরকার ইচ্ছা করিলে কি না করিতে পারেন। কামাল পাশা অল্পদিনের মধ্যেই তুরস্কের বর্ণমালা পরিবর্তন করিলেন।
আমি বললাম ‘কামাল পাশার মতো বড় প্রতিভা আমাদের দেশে নাই।’
তিনি বলিলেন, ‘অপেক্ষা করুন, আমিই এ কাজ করিব। দেখেন বাংলা ভাষায় কোন লাইনো টাইপ মেশিন নাই, টাইপ রাইটার নাই, উর্দু ভাষায় আছে। উর্দু বর্ণ প্রবর্তন করিলে আমরা এসব মেশিনের সাহায্য পাইব।’
আমি উত্তর করিলাম ‘পশ্চিমবঙ্গে তারও পূর্বে লাইনো মেশিন ও টাইপ রাইটার আছে।’ ফজলে করিম বলিলেন, ‘আপনি ভারতের দিকে অত তাকাইতেছেন কেন?’
একেতো ফজলুর রহমান খুব নামকরা ব্যক্তি তার উপর ফজলে করিম ও আলী আহসান তাঁর সমর্থনে এই কথা সেই কথা বলিতেছিলেন। ইহা তর্কের সময় বড়ই অসুবিধাজনক। আমি আলী আহসানকে ধমক দিয়া বলিলাম ‘আমি কথা বলিতে আসিয়াছি আমার বন্ধু ফজলুর রহমানের সঙ্গে, তোমাদের সঙ্গে নয়।’ শুনিয়া আলী আহসান চুপ করিয়া গেল। ফজলে করিম তবু থামিলেন না, আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন ‘আপনি মুসলিম সভ্যতায় বিশ্বাস করেন?
আমি বলিলাম ‘মুসলিম সভ্যতা বলিয়া কিছু আছে কিনা জানি না কিন্তু পারস্য সভ্যতা আছে। আরব সভ্যতা আছে, এমনকি বাঙ্গালী সভ্যতাও আছে।’ আমার কথা শুনিয়া ফজলে করিম আর আলী আহসান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসিলেন।
ফজলুর রহমান সাহেবকে আমি বলিলাম ‘আপনি উর্দু বর্ণমালা প্রবর্তন করিতে যাইয়া বাঙ্গালী সন্তানদিগের একটি চক্ষু কানা করিয়া দিতেছেন। রবীন্দ্রনাথ হইতে আধুনিককাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে যে অপূর্ব সাহিত্য তৈরী হইতেছে আমাদের ছেলেমেয়েরা তাহা হইতে বঞ্চিত হইবে।’
তিনি বলিলেন, ‘আমিও তাহাই চাই। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকলায় আকৃষ্ট হইয়া তাহারা আর নিজের দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হইতে পারিবে না।’
এই রূপ কথাবার্তায় অনেক রাত হইয়া গেল। সব কথা এখন ভালো করিয়া মনে করিতে পারিতেছি না। বিদায়ের সময় আমি ফজলুর রহমান সাহেবকে বলিলাম ‘আজ হইতে বর্ণমালার ব্যাপারে আমি আপনার বিপক্ষে কাজ করিব।’ সৈয়দ আলী আহসান ও ফজলে করিম সাহেব তখনও বসিয়া রহিলেন। ফজলুর রহমান বলিলেন, ‘আপনাকে একাই তাহা করিতে হইবে। কেহ আপনাকে সমর্থন করিবেন না।’
ইহার কিছুদিন পর সৈয়দ আলী আহসান যদিও বাংলায় এমএ নয় করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার প্রধান নিযুক্ত হইলেন।
জসীম উদ্দীন
পুনশ্চ: এই আলোচনা সভায় মওলা মিঞা উপস্থিত ছিলেন। তিনি কোন কথাই বলেন নাই।
রবীন্দ্র সাহিত্য বর্জনের প্রতিবাদে প্রথম সভা আমার আঙিনায় বসে। বারী সাহেব সভাপতি ছিলেন।
পরিশিষ্ট ২ – অধ্যাপক এমএ কাসেম-এর বিবৃতি
নিম্নোক্ত বিবৃতিটি ১৯৪৮ সনের ১৬ই ফেব্রুয়ারীতে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য দেওয়া হইয়াছিল। ইহাতে স্বাক্ষর করিয়াছিলেন অধ্যাপক নূরুল হক, অধ্যাপক এমএ কাসেম, অধ্যাপক রেসায়ৎ খাঁ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম (ঢা.বি.), আজিজ আহমদ, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, (তৎকালীন সাপ্তাহিক ইনসাফ-এর সম্পাদক), এম আবুল খায়ের, নঈমুদ্দীন আহমদ (ছাত্র), অলি আহাদ (ছাত্র) এবং আরও কয়েকজন।
বিবৃতির নকল
আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের নিকট আহ্বান জানাইতেছি তারা যেন বাংলা ভাষার স্বীকৃতির জন্য আগাইয়া আসেন। তাদের মাতৃভাষাকে কোণঠাসা করার জন্য যে একটি সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র চলিতেছে – তার বিরুদ্ধে আমাদের এখন হইতে তৎপর হওয়া অবশ্য কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় এখানের সংবাদপত্র ও শিক্ষিত সমাজ এখনো এ ব্যাপারে সম্যক অবহিত বলিয়া মনে হয় না। আমরা এ দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। আমাদের মনে রাখা উচিত বাঙলাব্যাপী এক আন্দোলন গড়িয়া তোলা ছাড়া বাংলা ভাষা যথাযোগ্য স্থান পাইবে না।
আরও একটি বিষয়ে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের হিতাকাঙ্ক্ষীদের সহানুভূতি কামনা করিতেছি, সমস্ত প্রদেশব্যাপী আন্দোলন করিতে হইলে আমাদের অনেক অর্থের দরকার। বাংলা ভাষার প্রচার করিতে গিয়া ইতিপূর্বেই তমদ্দুন মজলিশের অনেক আর্থিক ক্ষতি হইয়াছে। ইহা বিবেচনা করিয়া তমদ্দুন মজলিশের কেন্দ্রীয় পরিষদ একটি বাংলাভাষা প্রচার তহবিল খুলিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে। এই ফান্ডে মুক্ত হস্তে দান করিবার জন্য আমরা সকলের নিকট সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইতেছি। বিভিন্ন পত্রিকায় চাঁদা প্রাপ্তির হিসাব ও চাঁদা দাতার নাম প্রকাশ করা হইবে। অর্থাদি পাঠাইবার ঠিকানা –
অধ্যাপক এমএ কাসেম
ট্রেজারার ‘বাংলা ভাষার প্রচার তহবিল’
২৯, আজিমপুর রোড, ঢাকা।
পরিশিষ্ট ৩ – যাঁদের সাথে সাক্ষাৎ-আলাপ হয়েছে
অজিত গুহ
অলি আহাদ
আজিজ আহমদ (চীপ সেক্রেটারী তদানীন্তন )
আজহার হোসেন ( নবাবগঞ্জ)
আতাউর রহমান (রাজশাহী)
আতাউর রহমান খান
আবু জাফর শামসুদ্দীন
আবদুল রশীদ খান (রাজশাহী)
আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল)
আবদুল জব্বার খান
আবদুল মতিন (পাবনা) )
আবদুল মোতালেব মালেক
ডক্টর আবদুল হক
আবদুস শহীদ
আবুল কাসেম (তমদ্দুন মজলিশ)
আবুল হাশিম
আলী আহসান সৈয়দ
ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া)
কাজী গোলাম মাহবুব
কাজী মহম্মদ ইদরিস
কমরুদ্দীন আহমদ
করিম ডক্টর
খন্দকার গোলাম মোস্তফা
খয়রাত হোসেন
জসীম উদ্দীন (কবি)
জহুর হোসেন চৌধুরী
তাজউদ্দীন আহমদ
তফজ্জল আলী
তোয়াহা মহম্মদ
নগেন সরকার
নজরুল ইসলাম
সৈয়দ নূরুল আমীন
মনি সিংহ
মুনীর চৌধুরী
মারুফ হোসেন
মুস্তাক আহমদ খোন্দকার
মহীউদ্দিন আহমদ (বরিশাল)
মাহমুদ আলী
রণেশ দাশগুপ্ত
শওকত আলী
শেখ মুজিবুর রহমান
শফিউদ্দিন আহমদ
শামসুজ্জোহা (নারায়ণগঞ্জ)
শামসুদ্দীন আহমদ
শাহ আজিজুর রহমান
শাহজাহান ক্যাপ্টেন
শাহেদ আলী
শহীদুল্লাহ কায়সার
সমর সেন
সরদার ফজলুল করিম
হামিদা ফজলুল করিম
তর্কবাগীশ আবদুর রশীদ।