এখনো যেন পুরোপুরি নির্ধারিত হয়নি, ভারতবর্ষ দেশটা ঠিক কাদের। হিন্দুরা অবশ্য মনে করে এ দেশটি পুরোপুরি হিন্দুদেরই, তাদের শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে আর্য রক্ত, সুপ্রাচীন কাল থেকে তাঁরা এই সমুদ্র-মেখলা, পর্বত-মুকুট ভূমির উত্তরাধিকারী। তাদের ধর্ম, তাদের কৃষ্টি, তাদের জীবনযাপন প্ৰণালী এই দেশের মাটিকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। যদিও ছশো সাড়ে ছশো বছর ধরে এ দেশ শাসনের অধিকার নেই তাদের হাতে, তবু তারা মুসলমানদের মনে করে বহিরাগত। মুসলমানদের ধর্মে প্রবল আরবি গন্ধ, তারা মক্কা-মদিনার দিকে ফিরে নামাজ পড়ে, তাদের আচার ব্যবহার সবই হিন্দুদের বিপরীত। যদিও কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলমানরা হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রেখেছিল, তবু হিন্দুরা উচ্চনাসা, আত্মাভিমানী, তারা মুসলমানদের সঙ্গে সামাজিকভাবে মেশে না। গোপনে তারা মুসলমানদের অসভ্য মনে করে।
এ দেশের অধিকাংশ মুসলমানই ধর্মান্তরিত। হিন্দুরা শৌর্য বীর্য হারিয়েছে বহু আগেই এবং যত তারা শক্তিহীন হয়েছে, ততই তাদের মধ্যে হাজার রকমের জাতপাতের সংস্কার বেড়েছে, হিন্দুরাই হিন্দুদের নিপীড়ন করেছে সবচেয়ে বেশী। নিপীড়িত হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম ধর্মের মধ্যে সাম্যের বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে সেই ধর্ম বরণ করেছে। পাঠান-মোগল যারা এদেশে বসতি স্থাপন করেছে, তারাও কয়েক শতাব্দী পর এ দেশকেই নিজ ভূমি মনে করে। মুসলমানরা যদি বহিরাগত হয়, তাহলে আর্যরাও বহিরাগত। এদেশের মূল অধিবাসীরা আদিবাসী নামে অভিহিত, এবং এই আদিবাসীদের হিন্দু মুসলমান উভয়েই বর্বর হিসেবে অবজ্ঞা করে। আবার উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের চোখেও হিন্দুরা আধা-আদিবাসী, তারা বহু দেব-দেবী পূজক, একতাহীন, কিছুটা বর্বর।
কয়েক শতাব্দী ধরে এ দেশ শাসনের ভার মুসলমানদের ওপর ছিল বলে তারা মনে করে এ দেশের মালিকানা শুধু তাদেরই। হিন্দুরা সংখ্যা বৃদ্ধিকারী প্ৰজা মাত্র। ইংরেজরা মুসলমানদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে রাজশক্তি কেড়ে নিয়েছে। সেজন্য মর্যাদাসম্পন্ন সমস্ত মুসলমানই আহত বোধ করে। তারা অন্দর মহলে সে অহংকারের সেই ক্ষত চাটে এবং ক্রোধের বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইংরেজদের প্ৰতি।
অন্যান্য ইওরোপীয় দস্যু ও ব্যবসায়ীদের দমন করে ইংরেজ এতদিনে প্রায় গোটা ভারতবর্ষটাই দখল করে ফেলেছে। ইংরেজ মানেও ইংলণ্ডের রাজশক্তি নয়, সামান্য একটি বণিক প্রতিষ্ঠান। এত সহজে এত বিশাল একটি দেশ জয় করা গেছে বলেই এ দেশের মানুষের প্রতি ইংরেজের এত অবজ্ঞা। বিপুল জনসংখ্যা, এমনকি বৃহৎ সেনাবাহিনী নিয়েও যারা দেশ রক্ষা করতে পারে না, তারা মানুষ নামের অযোগ্য। নবাবী বা বাদশাহী সেনাবাহিনীর লড়াই পদ্ধতি নিয়ে ইংরেজ ব্যারাকে এখনো প্রবল হাসাহাসি হয়। সুরার ঝোঁকে ফুর্তি-পাওয়া গোরা সিপাহী মুঘল সেনাপতির অঙ্গভঙ্গী অনুকরণ করে দেখায় এবং অন্যরা অনেকে টেবিল চাপড়ায়।
ইংরেজ মনে করে, এ দেশটা তাদের কাছে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। তারা এ দেশ নিয়ে যা খুশী করতে পারে, একে কামড়ে, চিবিয়ে, শুষে একেবারে ছিবডে করে ফেলার যাবতীয় অধিকার তাদের আছে।
সরাসরি মুসলমানদের হাত থেকে রাজ-ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে বলে ইংরেজ এখন মুসলমানদের এড়িয়ে চলে। মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের প্রতি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা বেশী, তারা হিন্দু ধনীদের বাড়ি বেশী যাতায়াত করে, আমোদ-আহ্লাদে অংশ নেয়। আহত-অহংকার নিয়ে মুসলমানরাও গুটিয়ে আছে নিজেদের মধ্যে, ইংরেজ-প্রচলিত শিক্ষা গ্ৰহণ করতে তারা হুড়মুড় করে এগিয়ে এলো না হিন্দুদের মতন।
দুই দশক আগেও আদালত বা সরকারি ভাষা ছিল ফারসী, তখন হিন্দুরাও মৌলবীদের কাছ থেকে ঐ ভাষা শিখতো। শিক্ষিত হিন্দু গড় গড় করে বলতো ফারসী ও উর্দু ভাষা। এখন তার বদলে পুরোপুরি এসেছে ইংরেজী! শুধু রাজ্য হারায়নি মুসলমানরা, ভাষার অধিকার হারিয়ে আরো হীনবল হয়েছে।
তার ফলে, কেরানী, চিকিৎসক, শিক্ষক, উকিল এবং ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সরকারের বিভিন্ন চাকরিতে (অবশ্য সব চাকরিরই দৌড় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত, তার ওপরে আর নয়) যে এক নতুন বৃত্তিধারী শ্রেণী তৈরি হলো, তাদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা নগণ্য।
এদেশে প্রতিবেশীদের মধ্যেই বৈরিতা বেশী। হিন্দু ও মুসলমান এ সময় দীর্ঘকালের জাত-বৈরী না ভুলে যেন পরস্পরের থেকে আরও দূরে সরে যেতে লাগলো। ইংরেজেরও তাতেই সুবিধে। মুসলমানরা দূরে সরে রইলো অভিমান ও ক্ষোভ নিয়ে, আর হিন্দুরা মনে করলো, ইংরেজ তাদের পরিত্রাতা। বাঙালী হিন্দুদের চক্ষে তো বটেই। তাদের মতে ইংরেজরা তাদের রক্ষা করেছে নবাবী আমলের অত্যাচার থেকে। মুসলমানও ছিল শাসকের জাতি, ইংরেজও শাসক, তবু এদের মধ্যে হিন্দুদের চক্ষে ইংরেজই শতগুণ শ্রেয়, কারণ ইংরেজ শাসনে তবু রুল অব লর আবরণ অন্তত আছে। তাছাড়া ইংরেজ ধর্মে হাত দেয় না। দু-চারজন পাদ্রী এদিক ওদিক মাতামাতি করলেও অধিকাংশ ইংরেজ এবং রাজশক্তি মাথা ঘামায় না ধর্ম নিয়ে।
হঠাৎ দেখলে মনে হয়, যেন কলকাতা তথা বঙ্গে একটা নব-জাগরণের জোয়ার এসেছে। এবং সে নব-জাগরণ শুধু হিন্দুদের মধ্যেই। হিন্দুরা কেউ ধর্মসংস্কার নিয়ে ব্যস্ত, কেউ সামাজিক রীতি ও লোকচারে পরিবর্তন আনতে চাইছে, কেউ মেতেছে ব্যবসা বাণিজ্যে, সাহিত্য রচনা ও শিক্ষা বিস্তারের দিকেও দারুণ ঝোঁক এসেছে। অবশ্য এ সবই উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে। মুসলমানরা, অপরের চক্ষে, তথ্যসূৰ্ণ নীরব। পত্রপত্রিকায় শুধু হিন্দুদেরই কথা, মুসলমানদের অস্তিত্বেরই প্রমাণ পাওয়া যায় কদাচিৎ।
কলকাতা শহরের এমন একটাও ইটের বাড়ি নেই, যা মুসলমানদের তৈরি নয়। কারণ হিন্দুরা রাজমিস্তিরির কাজ জানে না। ভদ্র ও ধনী শ্রেণীর অঙ্গে যে-সব উত্তম বস্ত্র, তাও সেলাই করে মুসলমান ওস্তাগরেরা। হিন্দুরা এক সময় সীবন শিল্প শিখে থাকলেও এখন তা ভুলে গেছে। কলকাতায় মুসলমানের সংখ্যা প্রচুর, তাদের মধ্যে অধিকাংশই অতি দরিদ্র। আর কিছু অতিশয় ধনী।
জনাব আবদুল লতীফ খাঁর বাড়িটি একটি দুর্গের মতন। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, ও গৃহে যেন কোনো মনুষ্য বসতি নেই, দরজা-জানলা সব সময় বন্ধ থাকে। যেন বাইরের বাতাসও ওখানে ঢেকে না।
দু মহলা অট্টালিকা, লতীফ সাহেব থাকেন বাইরের দিকটিতে। এ বাড়িতে পর্দাপ্রথা অতি কঠিন, এখানকার রমণীরা অচেনা লোকচক্ষুর অগোচরে তো থাকেনই এমনকি দিনের বেলা বাড়ির পুরুষদের সঙ্গেও তাঁদের দেখা হবার নিয়ম নেই।
লতীফ সাহেবের শরীরে পাঠান রক্ত আছে, কিন্তু গত দু পুরুষ ধরে তাঁরা প্ৰায় বাংলাভাষী। তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী হিন্দু। মুর্শিদাবাদের বেশ বড় একখণ্ড জমিদারির তিনি মালিক, এ ছাড়া সম্প্রতি তিনি চিনির ব্যবসাতেও কিছু অর্থ নিয়োগ করেছেন। চিনি প্ৰায় সোনার মতন, শতকরা একশো ভাগ লাভ।
খিদিরপুরে জাহাজঘাটা থেকে কিছু দূরে এই অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন তাঁর পিতা। সেই আমল থেকেই বড় বড় জমিদারদের কলকাতায় একটি বাড়ি থাকা আভিজাত্যের চিহ্ন হিসেবে স্বীকৃত হতে শুরু করেছে। কলকাতায় এসে ধনগৰ্ব না দেখাতে পারলে আর ধনী হওয়া কিসের জন্য! তাছাড়া গ্ৰামদেশে সুখের দ্রব্য সংগ্ৰহ করাই কঠিন। কলকাতায় টাকা ফেললে সব কিছু পাওয়া যায়, এমনকি বাঘের দুগ্ধ পর্যন্ত। অবশ্য বাঘের দুগ্ধ কারুর কোনো কাজে লাগে না, কিন্তু বরফের মতন এক আশ্চর্য বস্তু কলকাতা ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে? তাঁর পিতা বছরে একবার করে কলকাতায় আসতেন, লতীফ সাহেব পুরোপুরি কলকাতাতেই থাকেন। জমিদারি চালনার জন্য নিজ জমিদারি থেকে ইদানীং দূরে থাকাই প্রশস্ত। কর্মচারীরা খাজনা আদায়ের জন্য দায়ী থাকে, তারা যে কোনো প্রকারেই হোক প্রজাদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করে। জমিদার স্বয়ং উপস্থিত থাকলে প্ৰজারা অনেক সময় তাঁর পায়ে এসে কেঁদে পড়ে। সে বড় উপদ্রব!
বাড়িটি এক সময় ছিল বেশ ফাঁকা জায়গায়। এখন ধীরে ধীরে চারপাশে একটি বস্তি গড়ে উঠেছে। এত ঢাকাটুকি দিয়ে থাকা সত্ত্বেও লতীফ সাহেব মাঝে মাঝে সেই বস্তি থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। একঘেয়ে শিশু কণ্ঠের কান্না।
লতীফ সাহেব হাঁক দিলেন, মীর্জা! মীর্জা!
লতীফ খাঁর নিজস্ব হুকুমবরদার মীর্জা খুশবখত সব সময় দ্বারের কাছে অবস্থান করে। এর অঙ্গে পুরোদস্তুর সৈনিকের পোশাক তো বটেই, এমনকি কোমরবন্ধে একটি তলোয়ার পর্যন্ত ঝোলানো।
লম্বা সেলাম দিয়ে দাঁড়িয়ে সে বললো, হুজোর!
লতীফ খাঁ বললেন, কে কাঁদে? কারুর কান্না শুনতে পাচ্ছি না? নাকি আমি খোয়াব দেখছি?
মীর্জা বললো, না হুজোর, আপনি ঠিকই শুনেছেন। পাশের বস্তির বে-তমিজরা এমন গোলমাল
করে!
—যা ওদের দু চার ঘা দিয়ে আয়! কান্না থামাতে বল।
—মার খেলে মানুষ আরও বেশী কাঁদে। মানুষের এই এক দোষ।
—ওরা এখন কাঁদছে। কেন? এখন তো ওদের কেউ মারছে কি?
—হুজোর ওরা কাঁদছে ভুখে। ভুখার মার বড় মার। কথায় বলে, ভাত এমন চীজ, খোদার চেয়ে উনিশ বিশ।
—মীর্জা খুশবখত, ওরা ভাত খায় না কেন? ভাত তো গরিবেরই খাদ্য!
—কেয়া জানে সরকারী! এই বস্তির গরিব মুসলমানরা সারাদিন ঘোরে কাজের ধান্দায়। ওদের বালবাচ্চারা ঘরে থাকে। হররোজ তো কাম মেলে না, যেদিন ওদের ব্যাপজানেরা খাবার পয়সা না নিয়ে ফেরে, সেদিন তারা বালবাচ্চাগুলোনকে রাগ করে পিটায়। আর তারা ড়ুকরে ড়ুকরে কাঁদে।
লতীফ খাঁ কাতর গলায় বললেন, অত কথা আমায় বলিসনি। খেতে পায় না তো। ওরা শহরে আসে কেন? গ্রামে থাকলেই পারে। আমি কান্না একেবারে সহ্য করতে পারি না। তুই যেমন করে হোক, ওদের থামতে বল!
মীর্জা খুশবখত সেলাম বাজিয়ে চলে যায়। যে কোনো উপায়েই হোক কান্না একটু বাদে থামে। এবং তারপরই মীর্জা হাসি মুখে সঙ্গে নিয়ে আসে এক অতিথিকে। মীজাঁ জানে যে এই মানুষটিকে দেখলে তার প্রভু খুশী হয়ে উঠবেন।
ইনি মুসী আমীর আলী, দিওয়ানী আদালতের উকিল। কলকাতার মুসলমান সমাজে ইনিই একমাত্র উকিল এবং যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী। মানুষটি অতিশয় বিনয়ী এবং ধুরন্ধর হলেও রসিকও বটে। কথায় কথায় শের ও বয়েৎ বলেন। লতীফ খাঁর চেয়ে মুসী আমীর আলীর বয়েস যথেষ্ট বেশী, বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন, তবু আদি রসের দিকে এর খুব ঝোঁক আছে।
মুন্সী আমীর আলীকে দেখলে একটি প্রসিদ্ধ উক্তি মনে পড়ে; বুঢ়াপে মেঁ ইনসান কী কুওঅতে শাহওয়ানী যবন মে আ জায়া করতী হ্যায়। অথাৎ বার্ধক্যে মানুষের কামনা বাসনা সব জিভের ডগায় এসে ভর করে।
আজ কিন্তু মুসী সাহেবের সেই মজলিশী রঙ্গীন ভাবটি নেই। শুকনোভাবে সেলাম আলায়কম বলে ঘরে ঢুকে তিনি লতীফ খাঁর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে রইলেন। লতীফ খাঁ তাঁকে নানারকম ভাবে খাতির করে বসতে বললেন, কিন্তু তিনি যেন তা শুনতেই পেলেন না। তাঁর মুখে ক্ৰোধ এবং শোক একসঙ্গে মাখানো।
লতীফ খাঁ বিহ্বল হয়ে বললেন, এমন মলিন মুখ কেন জনাব, কিছু গুস্তাকি হয়েছে কি?
মুন্সী আমীর আলী চড়া মেজাজে বললেন, আজ হিন্দুস্তানে মুসলমানের চরম দুদিন, আর আজ তুমি ঘরে বসে নিশ্চিন্তে আলবোলা টানছো? ছিঃ!
—আজ? কেন, আজ কী হয়েছে?
—তুমি জানো না? আজি নবাব ওয়াজিদ আলী খাঁ কলকাতায় আসছেন, আমাদের সব মান সম্ভ্রম ধুলোয় লুটিয়ে গেল!
লতীফ খাঁ বিস্মিতভাবে বললেন, কোন নবাব ওয়াজিদ আলী খাঁ? আওধ-এর বাদশা? তিনি লক্ষ্মেী ছেড়ে কলকাতায় আসবেন, এই ইংরেজের রাজত্বে? সে কি কথা?
মুন্সী আমীর আলী ব্যঙ্গের সুরে একটি রেখতী বললেন :
চলী ওঅহাঁ সে দামন উঠাতী হুঈ
কড়ে সে কড়ে কো বজাতী হুঈ
এবার এখান থেকে আঁচল উড়িয়ে উড়িয়ে, কাঁকন বাজিয়ে বাজিয়ে ফিরে চলো!
লতীফ খাঁ তাও কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি ব্যাকুলভাবে বললেন, জনাব তাশরীফ রাখুন। কী হয়েছে, সব খুলে বলুন তো? আওধের বাদশা কলকাতায় আসবে কেন? তিনি আমাদের শেষ ভরসা!
লতীফ খাঁর তুলনায় মুসী আমীর আলী অনেক বেশী খবর রাখেন। তিনি ফারসী, উর্দুতে দক্ষ, বাংলা এবং ইংরেজিও মোটামুটি বলতে কইতে পারেন।
হতাশ ভাবে একটি কেদারায় বসে পড়েতিনি আলবোলার নলে কয়েকটি টান দিলেন। তারপর বললেন, এ বছরের গোড়ায় নবাবের কাছ থেকে লক্ষ্মেী কেড়ে নিয়েছে ইংরেজরা। সে খবরও তুমি রাখো না? ইবলিশের দোসর ইংরেজ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে নবাবের সঙ্গে। লক্ষেীতে একটা কামানও গজায়নি। একজন সিপাহীও দেশরক্ষার জন্য রাজী হয়নি, বিনা যুদ্ধে নবাবের মুকুট ছিনিয়ে নিয়েছে। হিন্দুস্তানে মুসলমানের শেষ গৌরব যে আওধ, তাও চলে গেল। ইংরেজের হাতে। আর আমাদের রইলো কী?
ঘটনার গুরুত্ব বুঝে লতীফ খাঁ হতবাক হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তাঁর মস্তক ঘূর্ণিত হচ্ছে। যেন তাঁর নিজেরই জমিদারি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এই রকম নিঃস্ব বোধ করলেন তিনি।
খানিক বাদে তিনি আস্তে আস্তে বললেন, কিন্তু লক্ষ্মেীয়ের বাদশা কলকাতায় আসছেন কেন এত দূরে?
আমীর আলী প্ৰায় ধমকের সুরে বললেন, শখসে কি আসছেন তিনি? আসছেন বন্দী হয়ে। জিঞ্জিরে হাত পা বেঁধে আনা হচ্ছে তাঁকে। হিন্দুস্তানের বাদশা দিল্লিতে কাচকড়ার পুতুল হয়ে আছেন, আর লক্ষেীয়ের নবাব বন্দী থাকবেন। কলকাতায়।
লতীফ খাঁ কপাল চাপড়ে বললেন, কিছুই বুঝলাম না! আপনার কাছেই তো শুনেছি যে নবাব ওয়াজিদ আলী সাহেব-এর মস্ত বড় পল্টন আর রিসালা ছিল। এমন কি তিনি একটি জেনানা ফৌজও গড়েছিলেন। সেই তুলনায় ফিরিঙ্গিদের ফৌজ আর কত বেশী? তবে কেন লড়াই হলো না? কমজোর, ডরপুক হিন্দুদের মতন মুসলমানও কি লড়াই দিতে ভুলে গেছে? আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন।
আমীর আলী আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটি বয়েৎ বললেন :
পরীন হুফতা রূখাঁ-ও-দেব দরকারিশমা-ও-ন ফ
বস্যখত্ অকলখ হয়রত কি ঈচে বুল আজবীস্ত
পরীরা লুকিয়ে ফেলেছে নিজেদের রূপ, এখন রাক্ষসরা দেখাচ্ছে তাদের কাণ্ড-কারখানা। কী করে যে এমন হলো, তা বুদ্ধিতে কুল কিনারা পাই না!
দোস্ত, লক্ষেীয়ের সিপাহীরা যুদ্ধ ভোলেনি, কিন্তু নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ মেতে ছিলেন নাচ-গান আর কবিতা রচনায়। সবই আমাদের নসীব! লর্ড ডালহাউসী একে একে সব খাবে, হিন্দুস্তানের সবটুকু না খেলে ওর ভুখা মিটবে না।
—নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ কি আজই আসবেন কলকাতায়?
—হাঁ। সেইজন্যই তো এসেছি তোমার কাছে। আমাদের নবাবের হাতে পায়ে জিঞ্জির বেঁধে ধুলোর মধ্যে দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাবে। তা দেখে দৃষ্টি সার্থক করবে না?
লতীফ খাঁর চক্ষু সজল হয়ে এলো। তিনি হায় আল্লা বলতে বলতে বারংবার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন।
একটু পরে তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, নবাব কলকাতায় এসে থাকবেন কোথায়?
—শুনেছি, মেটিয়াবুরুজে ইংরেজ সরকার দয়া করে তাঁকে জমি আর বাড়ি দিয়েছেন।
-হায়, হায়, হায়! বাদশাহ মঞ্জিল আর ক্যয়ন্সর বাগ ছেড়ে নবাব এসে থাকবেন কলকাতার এই জলাডাঙ্গায়! এখানে কোথায় সেই মহলসরা আর কোথায় সেই বাগিচা?
খানিক আলাপ আলোচনার পর নবাব-দর্শনে যাওয়াই ঠিক হলো। ভাগ্যহত, অধঃপতিত হলেও নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ হিন্দুস্তানের শেষ গৌরবমণি, তাঁকে একবার স্বচক্ষে দেখার লোভ সংবরণ করা যায় না।
তখনই লতীফ খাঁর চৌঘুড়ী গাড়ি প্রস্তুত করা হলো। সঙ্গে চারজন দেহরক্ষী নিয়ে তিনি মুন্সী আমীর আলীর সঙ্গে গৃহ থেকে নিৰ্গত হলেন।
খিদিরপুর ছেড়ে কলকাতার উপান্তে এসেই তাঁরা দেখলেন যে পথে পথে অজস্র মানুষের ভিড়। সেপাই শাস্ত্রী ও গোরা পুলিশ—ফৌজও টহল দিচ্ছে এবং মাঝে মাঝে লাঠি উঠিয়ে অবাধ্য জনতাকে তাড়া করছে।
শোনা গেল এই পথেই একটু বাদে নবাবের কাফিলা আসবে। গাড়িতে বসে নবাব-দর্শন অনুচিত বলে লতীফ খাঁ এবং আমীর আলী গাড়ি থেকে নেমে পথের মোড়ে এসে দাঁড়ালেন। দেহরক্ষীরা তাঁদের ঘিরে রইলো।
জনতার মধ্যে হিন্দু মুসলমান দুই-ই রয়েছে। সমস্ত মুসলমানদের মুখ স্নান। আর হিন্দুদের মুখে খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা কৌতুক। শহরের অন্যান্য হুজুগের মতন নবাবের আগমনও যেন আর একটি বড় হুজুগ তাদের কাছে।
নবাবের কাফিলাটা বিশাল। সামনে আসছে বাদ্যকররা। তারপর পরপর অনেকগুলি গাড়ির ওপর বড় বড় খাঁচায় নানারকম পশুপাখি। পাখিদের মধ্যে ময়ুর, পায়রা, সারস, হাঁস, বগলা করকর, চকোর ইত্যাদি। এক খাঁচা ভর্তি কচ্ছপ। তারপর হরিণ, তারপর চিতাবাঘ। তিনটি খাঁচা ভর্তি নানা জাতের বানর, উলুক। তারপর পায়ে হাঁটানো জিরাফ, উট, হাতি। এর পর নবাবের স্বর্ণখচিত তাঞ্জাম বয়ে আছে রঞ্জন কফি বাহক। তার পেছনে সার দিয়ে ঘেরাটোপ জেনানাদের পাখি, তার পরে দাস-দাসারা।
মুন্সী আমীর আলীর ধারণা ভুল। রাজ্যহীন নবাব ওয়াজিদ আলী শাহকে হাতে পায়ে শিকল-বেঁধে কলকাতায় আনা হয়নি। তিনি এসেছেন তাঁর সমস্ত বিলাসের উপকরণ সঙ্গে নিয়ে। রাজ্য কেড়ে নেবার পর ইংরেজরা তাঁকে লক্ষ্মৌতে থাকারও অনুমতি দিয়েছিল, সেখানে নবাব আগেকার মতন যত খুশী রঙ তামাশায় মেতে থাকুন, তাতে ইংরেজের আপত্তি নেই, শুধু রাজ্য নিয়ে মাথা না ঘামালেই হলো। কিন্তু নবাব নিজের মাথার মুকুটটি ইংরেজের হাতে তুলে দিয়ে এখন কলকাতায় আসছেন মামলা করতে। ইংরেজ নাকি আইনের নিয়ম মানে। কলকাতার সুপ্রিম কোর্টেও সুবিধে না হলে নবাব খোদ লণ্ডনে গিয়ে প্ৰিভি কেন্সিলে মামলা লড়বেন। স্বয়ং মহারানী ভিক্টোরিয়াকে প্রশ্ন করবেন, কোম্পানির ফৌজ তাঁর রাজ্য দখল করলো কোন আইনে?
পাতলা মশালিনের পদায় ঘেরা নবাবের তাঞ্জাম। রাস্তার দুপাশের মশালের আলোয় তাঞ্জামের মধ্যে নবাবের মূর্তি অস্পষ্ট দেখা যায়। তিনি সামনের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে বসে আছেন, দেখলে মনে হয় নেশাগ্ৰস্ত। শহরের জনতা সেই রকমই মনে করলো। কারণ তারা সন্ধের পর বড় মানুষদের নেশাগ্ৰস্ত অবস্থাতেই দেখতে অভ্যস্ত। আর ইনি তো নামকরা বিলাসী নবাব। কিন্তু নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ সূরা, আফিম, ভাং প্রভৃতি কোনো নেশার দ্রব্যই স্পর্শ করেন না। তাঁর প্রধান নেশা তিনটি, সুর, ছন্দ ও রমণী। এই তিন নেশাতেই তিনি আকণ্ঠ মজ্জিত।
পথশ্রমে ক্লান্ত হলেও নবাব ঘুমিয়ে পড়েননি। এই নতুন নগর দেখার আগ্রহও তাঁর নেই। তিনি গুণগুণ করে আওড়াচ্ছেন একটি গানের কলি। এই নগরে প্রবেশ করার মুখেই কলিটি তাঁর মাথায় এসেছে। রাজ্যপাটের কথা, দুৰ্দশার কথা সমস্ত বিস্মৃত হয়ে তিনি সামনের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে কলিটিতে সুর বসাচ্ছেন। নবাবের তাঞ্জাম দেখে নানাপ্রকার চিৎকার করছে জনতা, সেদিকে গ্রাহ্য নেই ওয়াজিদ আলী শাহের। তিনি গুণ গুণ করছেন, বাবুল মেরা নৈহার ছুটহি যায়-।
নবাবের তাঞ্জাম দেখে লতীফ খাঁর চক্ষু আবার অশুভারাক্রান্ত হয়ে গেল। তাঁর মতন উচ্চবংশীয় লোকের এমন পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে ক্ৰন্দন করা শোভা পায় না। কিন্তু তিনি নিজেকে সামলাতে পারছেন না। জনাব আমীর আলী ঠিকই বলেছেন, আজ মুসলমানের চরম দুর্দিন।
নবাবের তাঞ্জাম যখন কাছ দিয়ে চলে যাচ্ছে, তিনি ভগ্ন কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, খুদা নবাব সাহেবকো সালামত আর বেগম সাহেবাকি কায়েম রাখ্যে! তারপর তিনি ছুটে যেতে চাইলেন নবাবের তাঞ্জামটি একবার স্পর্শ করবার জন্য।
মুন্সী আমীর আলী এতটা আবেগপ্রবণ নন। তিনি চেপে ধরলেন লতীফ খাঁর হাত। তারপর টেনে নিয়ে এলেন ভিড়ের বাইরে।
লতীফ খাঁ ভেঙে পড়েছেন, এখন তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। গোরা পুলিশরা মানীর মান বোঝে না। লতীফ খাঁ ঐভাবে ছুটে যাচ্ছিলেন, আর একটু হলেই মস্তকে লাঠির বাড়ি খেতেন।
দুজনে এসে আবার বসলেন চৌঘুড়ী গাড়িতে। কিছুদূরে এক স্থানে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, আর পুলিশের হাতের লগুড় ধপধপ পড়ছে লোকের মাথায়। এরকম স্থানে আর একটুও থাকা উচিত নয়।
তিনি দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে বললেন, জোরসে হাঁকাতে বলো! ঘর চলো!
গাড়ির মধ্যে বসে লতীফ খাঁ সশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। মুন্সী আমীর আলী মুখে কিছু না বলে শুধু চাপড় মারছেন তাঁর এক হাতে। তাঁর মনও ভারাক্রান্ত। আওধ-এর নবাব এসেছেন কলকাতায় অথচ তাঁর সম্মানে একটা তোপও দাগ হলো না!
একটু পরে তিনি উত্তেজিত ভাবে বললেন, লতীফ, মুখ উঠাও! কান্না থামাও, হিন্দুস্তানের মুসলমান এ অপমান কিছুতেই সহ্য করবে না। লাখ লাখ সিপাহী এখনো আছে। এ দেশে, তারা লড়াই ছাড়া আর কিছু জানে না। তারা ইংরেজদের এ দুশমনীর বদলা নেবেই। আমি বলে রাখছি, শিগগিরই একটা গদর হবে, তখন আমাদের সকলকেই সামিল হতে হবে, মনে রেখো।