ভগ্নহৃদয় হুমায়ূন আগ্ৰায় পৌঁছেছেন। ফরমান জারি করেছেন, তিনি মাগরেবের নামাজের আগে কারও সঙ্গেই দেখা করবেন না। সম্রাট রোজা রেখেছেন। সূর্যাস্তের পর রোজা ভেঙে নামাজ আদায় করবেন। তারপরই যদি তার মন চায় তিনি পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন। ঘনিষ্ঠজনদের একটি তালিকাও তিনি জওহর আবতাবচির কাছে দিয়েছেন। তালিকায় আছেন তাঁর মা, কামরান মীর্জার মা এবং বোন গুলবদন।
সম্রাট বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। তাঁর সামান্য শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। গঙ্গা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় ডানপায়ে ব্যথা পেয়েছিলেন। সেই ব্যথা এখন প্রবল। পা ফুলে উঠেছে। তাঁর শোবার ঘরের দরজা আধাখোলা। দরজার বাইরে রুপার ছোট ঘণ্টা। সেই ঘণ্টা বেজে উঠল। সম্রাট বিরক্ত গলায় বললেন, আমি ফরমান জারি করেছি। কারও সঙ্গেই সাক্ষাৎ করব না।
কোমল নারীকণ্ঠ দরজার বাইরে থেকে বলল, আমি সম্রাটের কাছে আসি নি। আমি আমার ভাইয়ের কাছে এসেছি।
গুলবদন! কী চাও?
আমি আমার ভাইকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদতে চাই।
এসো। ভেতরে এসো।
গুলবদন ছুটে এসে বিছানায় শোয়া হুমায়ূনকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
হুমায়ূন বোনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিজেও কাঁদলেন। একটি শের আবৃত্তি করলেন। যার অর্থ, পৃথিবীর পবিত্রতম বস্তু হলো গভীর দুঃখ থেকে নিঃসৃত অশ্রুধারা।
গুলবদন বললেন, আমি সম্রাটের জন্যে দুটি আনন্দসংবাদ নিয়ে এসেছি। সম্রাট অনুমতি দিলে সংবাদ দুটি তাঁকে দেব।
হুমায়ূন বললেন, আমার বোন গুলবদন সম্রাটের অনুমতি ছাড়াই যা ইচ্ছা বলতে পারে। সে সম্রাটের অনুমতির ঊর্ধ্বে।
প্রথম সুসংবাদ। আপনার বিদ্রোহী ভাইদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হয়েছে। তারা আপনার ক্ষমার অপেক্ষায় আছে। মোঘল সাম্রাজ্যের প্রবল দুঃসময়ে তারা একত্রিত হয়ে আপনার সঙ্গে শের শাহ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবে। কামরান মীর্জা পঁচিশ হাজার সৈন্য নিয়ে প্রস্তুত। আপনার অনুমতি পেলে সে শের শাহ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবে।
সম্রাট বললেন, এই সংবাদে আমি পরম করুণাময় আল্লাহপাকের দরবারে শুকুরগোজার করছি। দ্বিতীয় সুসংবাদটি বলো।
আপনি কামরান মীর্জার কাছ থেকে জাদুবিদ্যার একটি বই অনেকদিন থেকে চাচ্ছিলেন। কামরান মীর্জা বইটি নিয়ে এসেছেন। তিনি নিজে আপনার হাতে তুলে দেবেন।
সম্রাট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, জাদুবিদ্যার অতি মূল্যবান একটি বই আমাকে শের শাহ্ দিয়েছিলেন। আফসোস সেই বইটা নাই। হারিয়ে ফেলেছি।
গুলবদন বললেন, সম্রাট শুধু বই কেন, অনেক কিছুই তো আপনি হারিয়ে ফেলেছেন।
ঠিক বলেছ। আমার প্রাণপ্ৰিয় কন্যা আকিকা বেগম নাই। তাকে নিয়ে অদ্ভুত সব দুঃস্বপ্ন দেখি। পালিয়ে যাওয়ার আগে কেন যে মেয়েটাকে নিজের হাতে হত্যা করলাম না!
গুলবদন বললেন, যা কিছু ঘটে আল্লাহপাকের নির্দেশেই ঘটে। এই ভেবে শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করুন।
সম্রাট বললেন, এই ভেবে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা আমি সবসময় করি। তাতে লাভ হয় নি। মন শান্ত হয় না। মনের উপর কর্তৃত্ব মানুষের নেই। মন’ আল্লাহপাকের হাতে।
কথা শেষ করেই সম্রাট হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে তার আদরের কন্যাকে ডাকতে লাগলেন, মা আকিকা। আয় আমার কোলে আয় মা।
হতাশ এবং ক্লান্ত হুমায়ূন আগ্ৰায় ফিরে প্রবল জ্বরের মধ্যে পড়লেন। কোনো চিকিৎসাতেই জ্বরের উপশম হলো না। হুমায়ূনভগ্নি গুলবদন ভাইয়ের রোগমুক্তির জন্যে এক মাস রোজা মানত করলেন।
জ্বরের দশম দিনে সম্রাট বিছানায় উঠে বসলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, শাসনকার্য পরিচালনায় তিনি এখন সক্ষম। আগামীকাল থেকে দরবারে বসবেন।
হুমায়ূনের রোগমুক্তি উপলক্ষে আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করা হলো। সম্রাটের ওজনের সমপরিমাণ ওজনের রৌপ্যমুদ্রা গরিবদুঃখীদের বিতরণ করা হলো।
সম্রাট দরবারে বসেছেন। তাঁর ভাইরাও উপস্থিত। হুমায়ূন তিন ভাইয়ের জন্য উপহার ঘোষণা করলেন। প্রত্যেকেই একটি করে ঘোড়া, পোশাক, এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পেলেন। তিনজনকেই একটি করে নীলকান্তমণি দেওয়া হলো। দরবারে উপস্থিত আমীররা নীলকান্তমণির সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে মারহাবা মারহাবা ধ্বনি দিলেন। সম্রাট অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় বললেন, আমার তিন ভাই আমার সর্বশক্তির উৎসস্বরূপ। তারা কিছু ভুল-ভ্ৰান্তি করেছে। মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করার প্রধান সমস্যা হলো, মাঝে মাঝে ভুল-ভ্ৰান্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করা। আমি আমার প্রাণপ্রিয় ভাইদের সকল ভুল ক্ষমা করে দিলাম।
আমীররা আবারও বললেন, মারহাবা! মারহাবা! সম্রাট সিংহাসন থেকে নেমে এসে তার ভাইদের আলিঙ্গন করলেন। আবারও আনন্দ ধ্বনি-মারহাবা! মারহাবা!
এই দরবার আমজনতার জন্যে উন্মুক্ত না। হুমায়ূনের তিন ভাই ছাড়া আমীররা আছেন, সেনাপতিতা আছেন। পারস্য-সম্রাটের একজন দূত আছেন। রাজমহিষীরা আছেন চিকের আড়ালে। প্রথম দরবারে কী হয় তা তাদের দেখার ইচ্ছা। ভাইদের মিলানদৃশ্য দেখার নাটকীয়তা থেকে তারা নিজেদের বঞ্চিত করতে চাচ্ছেন না।
দরবারের বাইরে প্রধান ফটকে এক নাটক শুরু হয়েছে। নগ্নপদের এক লোক দরবারে ঢুকতে চাচ্ছে। তার গায়ে সস্তা উড়নি। গরমের মধ্যেও উড়ুনির উপর একটা নোংরা চাদর। মুখভর্তি খোচা খোচা কাঁচাপাকা দাড়ি। চোখ রক্তবর্ণ। সে বলছে তার নাম নিজাম। সে ভিসতিওয়ালা। সম্রাটের জীবনরক্ষাকারী।
প্রধান প্রহরী বলল, তুমি যথেষ্ট বিরক্ত করেছ। এই মুহুর্তে বিদায় না হলে তোমাকে কারাগারে ঢোকানো হবে।
নিজাম ভিসতি বলল, সম্রাট আমাকে দেখলেই চিনতে পারবেন। আমাকে একবার সাক্ষাতের সুযোগ দিন।
সম্রাটের সাক্ষাৎ পেতে যে যোগ্যতা লাগে তা তোমার নেই। তোমার পোশাক মলিন। পা খালি। তুমি সম্রাটের জন্য কোনো উপহার আনো নি। প্রহরীদের পরিতোষক তো অনেক পরের ব্যাপার।
নিজাম ভিসতি বলল, সম্রাট আমার কাছে ওয়াদা করেছেন আমাকে একদিনের জন্য সিংহাসনে বসাবেন। সম্রাট তার ওয়াদা রক্ষা করলেই আমি আপনাদের সবার পারিতোষিকের ব্যবস্থা করব।
প্রধান প্রহরী বলল, আমি আমার জীবনে অনেক হাস্যকর কথা শুনেছি, এমন শুনি নাই।
বিশ্বাস করুন, সম্রাট আমাকে দেখামাত্র চিনতে পারবেন। তিনি যদি চিনতে না পারেন তাহলে বাকি জীবন আমি অন্ধকূপে কাটাতে রাজি আছি।
ভিসতি নিজামের কথা সত্যি হলো। সম্রাট দেখামাত্র তাকে চিনলেন। হাসিমুখে বললেন, তুমি ভিসতি নিজাম না?
নিজাম কুর্নিশ করতে করতে বলল, জি আলামপনা। আপনার স্মৃতিশক্তি প্রশংসারও ঊর্ধ্বে।
আমি তোমাকে বলেছিলাম একদিনের জন্যে হলেও তোমাকে সিংহাসনে বসাবা। আজ অর্ধেকবোলা পার হয়ে গেছে, তারপরেও তুমি চাইলে আজই সিংহাসনে বসতে পার। তুমি কি আজই সিংহাসনে বসতে চাও?
সম্রাটের অনুগ্রহ এবং মহানুভবতা সমুদ্রের পানির চেয়েও বেশি। আমি আজই সিংহাসনে বসতে চাই।
সম্রাটের তিন ভাই স্তম্ভিত। আমীররা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন। কী ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সম্রাট বললেন, এই ভিসতিওয়ালা তার মিশকের সাহায্যে আমার জীবন রক্ষা করেছে। জীবনরক্ষার পুরস্কার হিসেবে সে আধাবেলার জন্য সিংহাসনে বসবে। আমীররা তার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবেন। একজন সম্রাটের প্রাপ্য সম্মানের পুরোটাই ভিসতি নিজাম পাবেন। ভিসতি নিজাম ইচ্ছা করলে রাজকীয় ফরমানও জারি করতে পারবেন।
দরবার কিছুক্ষণের জন্য শব্দহীন হয়ে গেল। সামান্য ভিসতিওয়ালা দিল্লীর সম্রাট? এ কেমন কথা? সবার দৃষ্টি ভিসতি নিজমের দিকে। দরবারের শান-শওকত দেখে সে খুব যে বিচলিত তা মনে হচ্ছে না। তার দৃষ্টি সম্রাটের দিকে নিবদ্ধ।
কামরান মীর্জা সম্রাটের দিকে এগিয়ে গেলেন। নিচুগলায় বললেন, আমি কি ভারতবর্ষের সম্রাটের সঙ্গে কিছু কথা বলতে পারি?
হুমায়ূন বললেন, অবশ্যই পার। তবে ভারতবর্ষের সম্রাট এখন আমি না। সম্রাট হলেন ভিসতিওয়ালা নিজাম।
আমি আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চাচ্ছি।
বলো।
আমার কথায় কোনো অসৌজন্য প্রকাশ পেলে আগেই মার্জনা চাই। সম্রাট আমার কথায় আহত হলেও কথাগুলি আমাকে বলতে হবে।
বলো। তবে বারবার আমাকে সম্রাট বলে সম্বোধন করবে না। তোমাকে বলা হয়েছে সম্রাট এখন ভিসতি নিজাম।
ভিসতি নিজাম এখনো সিংহাসনে বসে নি। দরবারে দাঁড়িয়ে আছে। সে যখন সিংহাসন বসবে তখন তার প্রতি যোগ্য আচরণই আমি করব।
কী বলতে চাও বলো?
আমার যা বলার তা আমি আলাদা করে শুধু আপনাকেই বলতে চাই। সবার সামনে বলতে চাই না।
হুমায়ূন বললেন, পবিত্র কোরান শরীফে একটি আয়াত আছে, সেখানে আল্লাহপাক বলছেন, তোমরা দুজন যখন কথা বলো তখন তৃতীয়জন হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত থাকি।
কামরান মীর্জা বললেন, অনেক কথা আছে যা আল্লাহপাক শুনলে ক্ষতি নেই, অন্য কেউ শুনলে ক্ষতি আছে।
হুমায়ূন কিছুক্ষণের জন্যে দরবার থেকে বিদায় নিয়ে চিকের পর্দার আড়ালে গেলেন। সেখানে রাজমহিষীদের অনেকেই ছিলেন। তাঁরা কৌতূহলী চোখে ভিসতি নিজামকে দেখছেন এবং তাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছেন। সম্রাটকে আসতে দেখে সবাই সরে গেলেন, শুধু গুলবদন থেকে গেলেন। তিনি হুমায়ূনের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললেন, আপনাদের আলোচনায় আমি কি থাকতে পারি?
সম্রাট কিছু বলার আগেই কামরান মীর্জা বললেন, আমার বোন থাকতে পারে। আমি কী বলছি তার একজন সাক্ষী থাকারও প্রয়োজন। হুমায়ূন হাতের ইশারা করলেন। এই ইশারার অর্থ গুলবদন থাকতে পারে।
কামরান মীর্জা বললেন, এক সামান্য ভিসতিওয়ালাকে দিল্লীর সিংহাসনে বসানোর কিছু নেই। তাকে ধনরত্ব দেওয়া যেতে পারে, জায়গির দেওয়া যেতে পারে। সিংহাসনে কেন বসানো হবে?
হুমায়ূন বললেন, আমি কথা দিয়েছি। এইজন্যে বসানো হবে।
আপনি ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে কথা দিয়েছিলেন। তখন আপনার মস্তিষ্ক কাজ করছিল না। আপনি ছিলেন প্রবল ঘোরের মধ্যে। আমরা দুঃসময়ে অনেক কথা বলি, সবই অর্থহীন কথা।
আমার কাছে অর্থহীন কথাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
কামরান মীর্জা বললেন, মোগল সাম্রাজ্য বিরাট বিপদের মুখে। এখন আপনার উচিত শের শাহ নামের দস্যুকে কীভাবে শায়েস্তা করবেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। একজন মিসকিনকে সিংহাসনে বসানোর ছেলেখেলার সময় এটা না।
আধাবেলার ব্যাপার।
এক পলকের ব্যাপারও হতে পারে না। দিল্লীর সিংহাসন দড়ির চারপাই না। যাকে তাকে সেখানে বসানো যায় না।
তোমার কথা কি শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ।
আমার নির্দেশ-তুমি দরবারে যাবে এবং নতুন সম্রাটকে কুর্নিশ করে সম্মান প্ৰদৰ্শন করবে।
আপনার নির্দেশ পালন করা আমার কর্তব্য। কিন্তু আমি অপারগ। কারণ আমি অসুস্থ বোধ করছি। শারীরিক এবং মানসিক দুইভাবেই অসুস্থ।
তুমি দরবারে যাবে না?
না। এবং আমি আশা করব আপনিও যাবেন না। নতুন সম্রাট সিংহাসনে বসবেন আর আপনি অন্যসব দরবারির মতো তাকে সম্মান দেখাবেন তা হতে পারে না। নিজেকে হাসি-তামাশার বিষয়ে পরিণত করবেন না।
গুলবদন বললেন, কামরান মীর্জার কথা যুক্তিপূর্ণ।
হুমায়ূন বললেন, যুক্তিই সবকিছু না। যুক্তির উপরে অবস্থান করে হৃদয়।
কামরান মীর্জা তিক্ত গলায় বললেন, এই বিষয়ে নিশ্চয়ই আপনার শের মুখস্থ আছে। শেরটা বলুন শুনি।
হুমায়ূন শের আবৃত্তি করলেন। শেরটির ভাবাৰ্থ এ রকম—
হে প্রিয়তমা!
যুক্তি বলছে তোমাকে পাওয়া আকাশের চন্দ্রকে হাতে পাওয়ার মতোই দুঃসাধ্য। মন বলছে তোমাকে পেয়েছি। মনের কথাই সত্য। তুমি আমার।
ভিসতি নিজাম গম্ভীর মুখে সিংহাসনে বসে আছেন। তার চেহারা মলিন, পোশাক মলিন। তবে রাজমুকুট এবং পাদুকা ঝকঝকি করছে। পাদুকা সরবরাহ করা হয়েছে। রাজমুকুট স্বয়ং হুমায়ূন নিজামের মাথায় পরিয়েছেন। পাদুকা তিনি পায়ে পরেন নি, কারণ তাঁর পা অনেক বড়। মাপে হয় নি। পাদুকার উপর পা রেখে তিনি বসেছেন।
প্রধান নাকিব ঘোষণা করল, আল সুলতান আল আজম ওয়াল খাকাল আল মুকররাম, জামিই সুলতানই হাকিকি ওয়া মাজাজি ভিসতি নিজাম পাদশাহ্।
আমীররা কুর্নিশ করলেন।
নতুন সম্রাট পাশে দাঁড়ানো আমীরকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে নিচুগলায় জানতে চাইলেন, দুপুরের খাবার কখন দেওয়া হবে? তাকে সময় বলা হলো। তিনি বললেন, দিল্লীতে তাঁর দূরসম্পর্কের এক দেশিয়াল ভাই আছেন। দুপুরের খানায় তাকে কি আমন্ত্রণ জানানো যাবে?
অবশ্যই যাবে। তাকে আনতে এক্ষুনি হাতি পাঠানো হবে।
খাওয়ার পর আমার দেশিয়াল ভাইকে নিয়ে আমি কি মোগল হেরেম পরিদর্শনে যেতে পারি।
আপনি যখন ইচ্ছা তখন যেতে পারবেন, তবে আপনার ভাই যেতে পারবেন না। সম্রাট ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।
আমি যদি ফরমান জারি করি?
আপনি ফরমান জারি করলেও হবে না। সম্রাটকেও নিয়মকানুনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
আমার ভাইয়ের খুব শখ ছিল হেরেম পরিদর্শন করা। কোনো উপায় কি আছে?
একটা উপায় আছে। আপনার ভাইকে খোজা করানো হলে উনি যেতে পারবেন। সেই ব্যবস্থা কি করব?
নতুন সম্রাট গম্ভীর হয়ে গেলেন।
সন্ধ্যাবেলায় নতুন সম্রাটের সময় শেষ হলো। তিনি প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে নিজ গ্রামের দিকে রওনা হলেন। তিনি নিজে ঘোড়ায় করে যাচ্ছেন, তাঁর পেছনে পেছনে দুটা গাধা। গাধার পিঠে স্বর্ণমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা। তাঁকে নিরাপদে বাড়িতে পৌছে দেওয়ার জন্যে দশজন অশ্বারোহীর একটি দল আগে আগে যাচ্ছে।
দিল্লীর উপকণ্ঠে ভিসতি নিজামের উপর ডাকাত দল ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা অনেকক্ষণ ধরেই নিজামকে অনুসরণ করছিল। ডাকাতের ছদ্মবেশে এরা সবাই কামরান মীর্জার দেহরক্ষী বাহিনী। নিজামকে রক্ষাকারী দলের সবাই ঘটনা বুঝতে পেরে দ্রুত পালিয়ে গেল। ডাকাত দল ধনরত্ন এবং ঘোড়া নিয়ে চলে গেল। আধাবেলার দিল্লীশ্বরের মৃতদেহ নর্দমায় পড়ে রইল। তার উপর নীল রঙের স্বাস্থ্যবান মাছি ভনভন্ন করতে লাগল। দুটি গাধার একটি প্রভুর মৃতদেহের দিকে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। (*’গুলবদনের লেখা হুমায়ূননামায় বলা হয়েছে, নিজাম ভিসতি দুই দিনের জন্যে দিল্লীর সিংহাসনে ছিলেন। অন্য কোনো সূত্র তা সমর্থন করে না। নিজাম ভিসতি অর্ধদিবসের সম্রাট—এই তথ্যই প্রতিষ্ঠিত।)