১০. ব্ল্যাক কেইমলট
সকাল ৯টা ৩২ মিনিট।
উইউইলসবার্গ, জার্মানি।
এসএস-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল হিটলারের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হিসেবে, উইউইলসবার্গ মিউজিয়ামের ভেতরে এক ঝাঁক পর্যটককে সামনে এগিয়ে নিতে নিতে জার্মান ভাষায় বলল গাইড। এসএস শব্দটির জন্ম হয়েছে জার্মান শব্দ Schutzstafel থেকে। যার অর্থ রক্ষী বাহিনী। পরবর্তীতে হিটলারের ব্ল্যাক অর্ডার-এ নিয়োজিত হয়েছিল এরা।
পর্যটকের দল সামনে এগোনোর পর একপাশে সরে গেল গ্রে। মিউজিয়ামের ডিরেক্টরের জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকে এই ক্যাসলের ইতিহাস সম্পর্কে মোটামটি জেনে নিয়েছে। ক্যাসল ইজারা নেয়া থেকে শুরু করে এরপেছনে বিলিয়ন ডলার খরচ করে হিটলার কীভাবে এটাকে ব্যক্তিগত দুর্গে পরিণত করেছিলেন সে-সব জেনে নিয়েছে গ্রে। অর্থের পরিমাণটা শুনতে অনেক মনে হলেও এই দুর্গের জন্য কত মানুষের রক্ত ঝরেছে আর ভোগান্তি হয়েছে তার তুলনায় অর্থের পরিমাণ অনেক কম।
নিডারহ্যাহেন যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পের কয়েদী পোশাকের শো-কেসের পাশে দাঁড়িয়ে আছে গ্রে।
বাইরে ঝড়ের গর্জন, আকাশে মেঘের হুঙ্কার এখনও চলছেই। বন্ধুপাতের শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠছে মিউজিয়ামের জানালাগুলো।
ফিওনার সাথে মনক দাঁড়িয়ে আছে। রায়ান আনতে গেছে ডিরেক্টরকে। ডিসপ্লেতে রাখা এসএস অফিসারদের কুখ্যাত Toten Kopf আংটি দেখছে মনক। এই আঙটিতে প্রাচীন বর্ণমালা, মাথার খুলি এবং আড়াআড়ি করে রাখা হাড়ের ছবি খোদাই করা আছে। আর্ট, প্রতীক আর শক্তি মিলিয়ে এক বিভীষিকাময় শিল্পের নিদর্শন।
এছাড়াও এখানে এসএস-দের পেশাগত বিভিন্ন জিনিসপত্র প্রদর্শন করা হচ্ছে। ছোট ছোট মডেল, দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ছবি। মজার জিনিসও আছে। যেমন হিটলারের ব্যবহৃত একটি চায়ের পট আছে এখানে! সেই পটেরও গায়েও সূর্য আকৃতির এক প্রাচীন বর্ণমালা শোভা পাচ্ছে।
ডিরেক্টর চলে এসেছেন, বলল মনক। ব্যক্তিগত দরজা থেকে একজন বেরিয়ে আসছেন, তার সাথে আছে রায়ান।
ডিরেক্টরের বয়স পঞ্চাশের শেষের দিকে। মাথায় লালচে সাদা চুল, পরনে কুঁচকানো স্যুট। সামনে এগোতে এগোতে চোখ থেকে চশমা খুললেন তিনি। এক হাত বাড়িয়ে দিলেন গ্রের দিকে।
ড. ডাইটার আলমস্ট্রম, বললেন তিনি। এই মিউজিয়ামের পরিচালক হিসেবে আছি। স্বাগতম।
ভদ্রলোকের চেহারা ভঙ্গি দেখে মনে হলো না তিনি সত্যি সত্যি স্বাগতম জানাচ্ছেন। রায়ান আমাকে আপনাদের ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছে। কোনো একটা পুরোনো বইয়ে থাকা প্রাচীন বর্ণমালার ব্যাপারে আপনারা তদন্ত করতে এসেছেন। ইন্টারেস্টিং!
উঁহু, ডিরেক্টরের হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে তিনি ইন্টারেস্ট-এর বেশি বিরক্ত হচ্ছেন।
আমরা আপনার কাছ থেকে খুব বেশি সময় নেব না, বলল গ্রে। একটা বিশেষ বর্ণের ব্যাপারে যদি আপনি আমাদেরকে সাহায্য করতে পারেন তাহলে ভাল হয়।
অবশ্যই। উইউইলসবার্গ মিউজিয়ামের ডিরেক্টর যখন হয়েছি তখন এই কাজ অবশ্যই করব। আমাদের জ্ঞান-ই তো এসব নিয়ে।
ডারউইনের বাইবেলটির জন্য ফিওনার দিকে হাত পাতল গ্রে। ফিওনা ইতোমধ্যে ওটা হাতে বের করে প্রস্তুত হয়ে ছিল। গ্রেকে দিল ও।
ব্যাক কভার বের করে দেখল গ্রে।
ঠোঁট নাড়তে নাড়তে ডিরেক্টর চোখে চশমা পরলেন। হিউগো হিরজফিল্ডের আঁকা সেই বর্ণটিকে আরও কাছে নিয়ে দেখলেন তিনি।
আমি কী বইটাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারি, প্লিজ?
একটু দ্বিধা করে গ্রে সম্মতি দিল।
বাইবেলের পাতা উল্টাতে শুরু করলেন ডিরেক্টর। মাঝেমাঝে পাখির আঁচড় দেয়ার মতো চিহ্নের জায়গাগুলোতে থামলেন। একটা বাইবেল… কী অদ্ভুত…
চিহ্নটা পেছনে, আসল জিনিসের দিকে নজর ফেরানোর চেষ্টা করল গ্রে।
অবশ্যই, অবশ্যই। এটা হলো Mensch বর্ণ।
Mensch, বলল গ্রে। জার্মান থেকে অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায় মানুষ।
ঠিক। এর আকৃতি খেয়াল করে দেখুন। মাথা কাটা কাঠির মতো দেখতে। কয়েক পৃষ্ঠা পেছনে গেলেন ডিরেক্টর। দেখা যাচ্ছে রায়ানের প্রপিতামহ অল-ফাদার এর সাথে সম্পর্কযুক্ত চিহ্নগুলোর প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন।
মানে?
বাইবেলের ভেতরের পৃষ্ঠায় থাকা চিহ্ন দেখালেন ডিরেক্টর।
এই বর্ণ দিয়ে k-কে বুঝায়, বললেন তিনি, অ্যাঙলো-স্যাক্সোন-এ এটাকে সেন বলা হয়। মানুষ বুঝাতে যে বর্ণ ব্যবহার করা হতো এটা হচ্ছে ঠিক তার আগের বর্ণ। এই বর্ণটাকে আয়নায় প্রতিবিম্ব করলে যেটা পাওয়া যাবে সেটাই হলো আগের বর্ণ। কয়েক পৃষ্ঠা পার হয়ে আরেকটি চিহ্ন দেখালেন তিনি।
এই দুই চিহ্ন হলো অনেকটা একই পয়সার এপিঠ-ওপিঠ। যেমন : ইয়িন-ইয়াং, পুরুষ-নারী, আলো-আঁধার।
মাথা নাড়ল গ্রে। বুদ্ধ সন্ন্যাসী আং গেলুর কাছ থেকে দীক্ষা নেয়ার দিনগুলো মনে পড়ে গেল ওর। পরস্পর বিপরীত বিষয়গুলো সমাজে কীভাবে মিলেমিশে থাকে সে ব্যাপারে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করেছিল তখন। সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়তেই পেইন্টার ক্রোর কথা মাথায় এলো ওর। নেপাল থেকে তার ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
মনক মূল প্রসঙ্গে ফিরল। আচ্ছা, এগুলো হচ্ছে বর্ণ? তো এই বর্ণগুলোর সাথে অল-ফাদার ব্যক্তির সম্পর্ক কী?
তিনটা জিনিস-ই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। মানে চিহেন্দ্র আকৃতিগত দিক থেকে মিল আছে। বড় বর্ণ, Mensch বর্ণগুলোকে সবসময় নরওয়েজীয় দেবতা থর-এর প্রতিনিধিত্ব করে। জীবনকে অন্য এক উচ্চতায় নেয়ার আত্মাধিক ব্যাপার জড়িত। আমাদের সবার সর্বশেষ গন্তব্য তো ওখানেই।
জবাবটিকে মাথায় সাজিয়ে নিতেই গ্রের মনে তালগোল পাকিয়ে গেল। তাহলে আগের দুটো বর্ণ… অর্থাৎ বর্ণটি হলো দুটো অর্ধ Mensch বর্ণের যোগফল।
হাহ? ঘোঁতঘোত করল মনক।
এরকম, ফিওনা বলল, ও বিষয়টা বুঝতে পেরেছে। ডিসপ্লের কাঁচের উপরে জমে থাকা ধুলোর উপরে আঙুল চালিয়ে আঁকল ও। হাততলা দুটো অর্ধ Mensch বর্ণকে পাশপাশি বসিয়ে যোগ করে দিলেই হয়ে যাচ্ছে।
Y r=Y
ঠিক, ডিরেক্টর সায় দিলেন। প্রথম দুটি বর্ণের ওপর টোকা দিলেন তিনি। এগুলো হচ্ছে সাধারণ মানুষের চিহ। এ-দুটোকে যোগ করে অল-ফাদার আকৃতি দিলে উন্নত মানব প্রজাতি পাওয়া যায়। আলমট্রম বাইবেলটি গ্রের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, এই বর্ণগুলো বোধহয় রায়ানের প্রপিতামহের মাথায় একেবারে পোকার মতো জেঁকে বসেছিল।
ব্যাক কভারে থাকা চিহ্নের দিকে তাকাল গ্রে। রায়ান, হিউগো সাহেব জীববিজ্ঞানী ছিলেন, তাই না?
রায়ানকে দেখে হতাশ মনে হচ্ছে। হ্যাঁ। তার মেয়ে টোলা-ও জীববিজ্ঞানী ছিলেন।
গ্রে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল। সুপারম্যান সম্পর্কিত মিথের ব্যাপারে নাসিরা সবসময়ই খুব আগ্রহী ছিল। অল-ফাদার বলতে আসলে আর্য জাতিদের কথা বলা হচ্ছে। এই আঁকিবুকিগুলোর অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে তাহলে? হিউগো সাহেব নাৎসিদের সেই উদ্ভট, অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন? নাহ, বিশ্বাস হচ্ছে না রে। রায়ানের মুখে হিউগোর নোটের যে বিবরণ শুনেছিল সেটা মনে পড়ল ওর। মোহমুক্ত হয়ে তিনি তার মেয়ের উদ্দেশ্যে নোটটা লিখেছিলেন। ওতে একটা গোপন বিষয়ের ইঙ্গিত দেয়া আছে। যেটা এত সুন্দর যে ওটাকে শেষ করে দেয়া যায়নি আবার ওটা এতটাই দানবীয় যে মুক্ত করাও সম্ভব হয়নি।
একজন জীববিজ্ঞানী আরেকজন জীববিজ্ঞানীর কাছে এই নোট দিয়েছিলেন।
গ্রে বুঝতে পারল প্রাচীন বর্ণ, অল-ফাদার, পরিত্যক্ত পুরোনো কোনো গবেষণা; এসব এক সূত্রে জড়িত। গোপন বিষটি যা-ই হোক না কেন সেটা খুনোখুনি হওয়ার মতো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
মুখ খুললেন আলমস্ট্রম, Mensch বর্ণগুলোকে নাসিরা একটু বেশি-ই পছন্দ করতো। তারা এটাকে ভিন্ন নামও দিয়েছিল। নামটা ছিল: leber-rune
অর্থাৎ, জীবনের বর্ণ? অনুবাদ করে প্রশ্ন করল গ্রে।
হ্যাঁ। লেবেনসবর্ন প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে এটাকে ব্যবহার করতো তারা।
সেটা আবার কী? মনক প্রশ্ন করল।
জবাবটা যে-ই দিয়ে দিল। ওটা হলো নাসদের সন্তান উৎপাদন প্রোগ্রাম। সাদা চামড়া, নীল নয়নের অধিকারী শিশু জন্মানো হতো ওই প্রোগ্রামে।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডিরেক্টর। তবে বর্ণটির মতো leben বর্ণেও বিপরীত চিত্র আছে। গ্রের হাতে থাকা বাইবেলটির উপরের দিকে নিচে আর নিচের দিককে উপরে তুলতে বললেন তিনি। leben বর্ণকে উল্টালে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পাওয়া যায়। সেই বর্ণের নাম : The toten-rune
বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে গ্রের দিকে তাকাল মনক।
গ্রে অনুবাদ করল। দ্য রুন অফ ডেথ। অর্থাৎ মৃত্যুর বর্ণ।
.
দুপুর ১ টা ৩৭ মিনিট।
হিমালয়।
মৃত্যু টিক টিক করে এগিয়ে আসছে।
o:৫৫ সেকেন্ড
মৃত মহিলার হাতঘড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পেইন্টার। পায়ে হেঁটে কোনো লাভ হবে না। বিস্ফোরণের ধাক্কা যে এলাকা জুড়ে পড়বে সেটা পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
তাহলে? প্রশ্ন করলেন অ্যানা।
হেলিকপ্টার, জানালা দিয়ে বাইরে নির্দেশ করল ও। এ-স্টার হেলিকপ্টার ইঞ্জিন। গরম অবস্থায় ক্যাসলের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বাকিরা… অ্যালার্ম বাজানোর জন্য ফোনের দিকে এগোলেন অ্যানা।
Keine Zeit, ধমকে উঠে গানথার ওর বোনকে থামিয়ে দিল। রাশিয়ান এ-৯১ বুলপাপ রাইফেল তুলে নিয়েছে হাতে। কোমরে থাকা গ্রেনেড কার্তুজ থেকে একটি গ্রেনেড বের করে সেটাকে রাইফেলের ৪০মিমি লঞ্চারে ঢোকাল ও।
Hier বড় বড় পা ফেলে এগোল অ্যানার বিশাল ডেস্কের দিকে। Schnellr
রুমের জানালার দিকে তাক করল রাইফেল।
লিসার হাত ধরে আড়ালে যাওয়ার জন্য ছুটল পেইন্টার, অ্যানাও ছুটলেন ওদের পিছু পিছু। ওদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর গানথার ফায়ার করল।
ফায়ার করেই ডেস্কের আড়ালে চলে গেছে গানথার।
বোনের হাত আর কোমর ধরে টেনে নিজের শরীরের নিচে নিয়ে আড়াল দেয়ার চেষ্টা করল ও। গ্রেনেডের শব্দে পেইন্টারের কানে তালা লেগে গেছে প্রায়, ওদিকে দুই হাত দিয়ে লিসা নিজের কান ঢেকে রেখেছে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় পুরো এক ফুট সরে গেল ডেস্ক। কয়েক টুকরো পাথর আর কাঁচ খসে পড়ল এখান সেখান থেকে। তবে ধুলা আর ধোয়ায় পুরো রুম ছেয়ে গেল।
অ্যানাকে টেনে দাঁড় করাল গানথার। কথা বলে কোনো সময় নষ্ট করল না। গ্রেনেডের সাহায্যে লাইব্রেরির ভেতর দিয়ে একটি গর্ত তৈরি করা হয়েছে। ওটা দিয়ে বাইরে বেরোল ওরা।
প্রায় ১২০ ফুট দূরে হেলিকপ্টারটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। গ্রেনেডে বিস্ফোরিত লাইব্রেরিকে পেছনে রেখে ওরা হেলিকপ্টারের দিকে ছুটল।
পেইন্টারের হাতে এখনও সেই হাতঘড়ি আছে। হেলিকপ্টারে ওঠার আগপর্যন্ত ওটার দিকে তাকাল না ও। কপ্টারের কাছে সবার আগে পৌঁছুল গানথার, পেছনের দরজা খুলে দিল। অ্যানা আর লিসাকে কপ্টারের ভেতরে ঢোকানোর পর নিজেও কপ্টারে চড়ে বসল পেইন্টার।
এরমধ্যে গানথার পাইলটের সিটে বসে পড়ে বেল্ট লাগিয়ে নিয়েছে। এবার টাইমারের দিকে তাকাল ক্রো। অবস্থা ভাল নয়। হয় ওরা কাজটা করতে পারবে নইলে শেষ!
ঘড়িতে ওঠা নাম্বারের দিকে তাকাল ক্রো। ওর মাথাব্যথা করছে, চোখ পিটপিট করল বেচারা। মাথাব্যথা এড়িয়ে কোনোমতে ডিজিটাল ঘড়িতে ওঠা সংখ্যাটা পড়ল।
০০:০৯ সেকেন্ড
সময়-ই তো নেই।
ইঞ্জিনে গর্জন তুলল গানথার। রোটর আস্তে আস্তে ঘুরতে শুরু করেছে… একটু বেশি-ই আস্তে ঘুরছে বোধহয়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ক্রো। পাহাড়ের ওপরে গতরাতের ঝড়ের ফলে জমে থাকা তুষারের ওপর ওদের হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে। মেঘলা আকাশ। বিভিন্ন পর্বতের মাথায় যেন কুয়াশায় ঘোমটা দেয়া।
সামনের সিটে বসা গানথার ঘোঘোত করল। কারণ, রোটরের গতিতে সর্বোচ্চ স্তরে না পৌঁছানো পর্যন্ত হেলিকপ্টার এখানকার এই পাতলা বাতাসে উড়তে চাইছে না।
০০:০৩ সেকেন্ড
নাহ, হলো না।
লিসার হাত ধরল পেইন্টার।
শক্ত করে ওর হাত ধরেছে পেইন্টার… এমন সময় পুরো পৃথিবী দুলে উঠল। শুরু গম্ভীর আওয়াজ হলো কোথাও। দম আটকে রইল ওরা, পাহাড়ের চূড়া থেকে ছিটকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু কিছুই হলো না। ওরা যতটা বড় করে ভাবছে আসলে ঘটনা হয়তো অত বড় নয়।
তারপর দুম করে ওদের হেলিকপ্টারের নিচে থাকা পাহাড়ের কার্ণিশটুকু ভেঙ্গে গেল। কাত হয়ে নাক নিচু করল এ-স্টার। রোটর ঘুরছে ঠিকই কিন্তু কাজ হচ্ছে না। কার্ণিশ ভেঙ্গে কাত হয়ে যাওয়ায় ওটার গা বেয়ে পিছলে যাচ্ছে কপ্টার।
পাহাড়ের কিনারের দিকে এগোচ্ছে ওরা।
ভূমি আবার কেঁপে উঠল… আরেকটা বিস্ফোরণ…।
কপ্টার লাফিয়ে উঠল কিন্তু বাতাসে নিজেকে মেলে দিল না।
কন্ট্রোল নিয়ে গানথার রীতিমতো যুদ্ধ করছে।
পাহাড়ের কিনারা ছুটে আসছে ওদের দিকে। তুষার কেটে কপ্টারের পিছলে যাওয়ার আওয়াজও কানে আসছে।
পেইন্টারের দিকে আরও ঘেষে এলো লিসা। পেইন্টারের আঙুলগুলোকে শক্ত করে আকড়ে ধরায় ওর নিজের হাত সাদা হয়ে গেছে। অন্যদিকে অ্যানা সোজা হয়ে শক্ত করে বসে রয়েছেন। চেহারায় কোনো অভিব্যক্তি নেই। দৃষ্টি সামনে।
গানথারও চুপচাপ আছে, কোনো আওয়াজ করছে না।
বরফ কেটে এগোচ্ছে এ-স্টার। প্রতি মুহূর্তে পিছলে যাওয়া গতি বেড়ে যাচ্ছে। ওরা কেউ কোনো শব্দ করছে না। কপ্টারের রোটর ওদের হয়ে আর্তনাদ করছে।
বাতাসে নিজেকে মেলে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল কপ্টার! নিচু হয়ে যাওয়া নাক সোজা হলো ধীরে ধীরে। কন্ট্রোল নিয়ে ব্যস্ত গানথার কপ্টারকে উঁচুতে তুলে নিল।
ওদের সামনের অংশের কার্ণিশ হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল বিস্ফোরণের ধাক্কায়।
ক্যাসলের ক্ষয়-ক্ষতি দেখার জন্য যথেষ্ট উঁচুতে উঠেছে কপ্টার। ক্যাসলের সামনের অংশে থাকা জানালাগুলো দিয়ে ভকভক করে ধোয়া বেরোচ্ছে। দরজাগুলো গায়েব। ক্যাসলের ওইপাশে থাকা হেলিপ্যাড থেকে কালো ধোয়ার কলাম উঠে যাচ্ছে। আকাশে।
জানালার কাঁচে হাত রেখে বললেন অ্যানা, প্রায় দেড়শ নারী-পুরুষ ছিল।
অনেকে হয়তো বাইরে ছিল… মিনমিন করে বলল লিসা।
ওরা কারও নড়াচড়া দেখতে পেল না।
শুধু ধোয়া আর ধোয়া।
ক্যাসলের দিকে নির্দেশ করে অ্যানা বললেন, যদি সার্চ করা যেত…
কিন্তু কোনো সার্চ পার্টি কিংবা উদ্ধার অভিযান তো এখানে সম্ভব নয়।
হবেও না।
হঠাৎ করে চোখ অন্ধ করে দেয়ার মতো উজ্জ্বল আলো ঝলসে উঠল ক্যাসলের জানালাগুলো দিয়ে। এ যেন সোডিয়ামের উজ্জ্বল আলোর এক সূর্য। কোনো আওয়াজ নেই। তবে চোখের মণি জ্বালিয়ে দিল এটা। দৃষ্টিশক্তি অকার্যকর করে দিল।
অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পেইন্টারের মনে হলো কপ্টার বোধহয় একদিকে হেলে পড়েছে। পাইলটের সিটে বসা গানথারও ভড়কে গেছে। এবার একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাহাড় ভাঙ্গার শব্দ, অসম্ভব জোরে হচ্ছে শব্দটা। যেন ভূগর্ভস্থ প্লেটগুলোকে কেউ গুড়ো করে দিচ্ছে।
বাতাসে ভেসে থাকা কপ্টারটা কেঁপে উঠল।
চোখে ব্যথা দিয়ে দৃষ্টিশক্তি ফিরে এসেছে এবার।
জানালা দিয়ে নিচে তাকাল ক্রো।
ও খোদা…
পাহাড়ের ধুলোরাশির জন্য ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না তারপরও ধ্বংসলীলা তার নিজের অস্তিত্বের কথা ঠিকই জানান দিল। পাহাড় দুমড়ে গেছে। ধসে গেছে ক্যাসলের গ্রানাইটের অংশটুকু। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, ক্যাসল- সুদ্ধ পাহাড়ের বড় একটি অংশ স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে! একদম গায়েব!
Unmoslick, বিস্মিত হয়ে বিড়বিড় করলেন অ্যানা।
কী?
এরকম ধ্বংসলীলা… এটা ZPE বোমের কাজ। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি।
ব্যাখ্যা শোনার জন্য পেইন্টার অপেক্ষা করছে।
zPE অর্থাৎ Zero Poin Energy; আইনস্টাইনের সূত্রকে কাজে লাগিয়ে সর্বপ্রথম নিউক্লিয়ার বোমা বানানো হয়েছিল, যেটাতে কয়েকটা ইউরোনিয়াম অ্যাটমে এনার্জী সঞ্চয় করা যেত। যদিও প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম থিওরিতে থাকা পাওয়ারের সাথে ওটার কোনো তুলনাই চলে না। প্ল্যাঙ্কের থিওরি দিয়ে বানানো বোমা দিয়ে বিগ-ব্যাং ঘটিয়ে দেয়া সম্ভব। এতই এনার্জী!
কপ্টারের কেবিনে থাকা কেউ কোনো কথা বলল না।
মাথা নেড়ে অ্যানা আবার শুরু করলেন। বেল-এর জন্য জ্বালানি হিসেবে দরকার… জেরাম-৫২৫… এটাকে জিরো পয়েন্ট এনার্জীর ক্ষেত্রে একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা কখনও বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখিনি।
কিন্তু অন্য কেউ করেছে, বলল পেইন্টার। মৃত নারী আততায়ীর কথা মনে পড়ল
অ্যানা পেইন্টারের দিকে তাকালেন। তার চেহারায় ভয় আর আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। তাদেরকে থামাতে হবে আমাদের।
কিন্তু তারা কে বা কারা?
মনে হয় আমরা সেটা জানতে পারব। সামনের দিকে দেখিয়ে বলল লিসা।
সামনে দাঁড়ানো পাহাড়ের চুড়োর ওপর দিয়ে তিনটি কপ্টার এগিয়ে আসছে। তুষার অঞ্চলে ছদ্মবেশ নেয়ার জন্য সাদা রং করা হয়েছে ওগুলোকে। একটু ছড়িয়ে গিয়ে এ-স্টারের দিকে এগোচ্ছে ওগুলো।
আকাশে যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে জ্ঞান থাকায় গ্রে তিনটা কপ্টারের এরকম আচরণের অর্থ ভাল করেই বুঝতে পারল।
এটা হচ্ছে অ্যাটাক ফরমেশন।
অর্থাৎ, এখন ওদের ওপর হামলা হবে।
.
সকাল ৯টা ৩২ মিনিট।
উইউইলসবার্গ, জার্মানি।
নর্থ টাওয়ার এদিকে, বললেন ড, আলমস্ট্রম।
মনক, গ্রে ও ফিওনাকে মেইন হলের পেছন দিকে নিয়ে গেলেন ডিরেক্টর। রায়ান একটু আগে মিউজিয়ামের এক স্লিম মহিলা দলিল তত্ত্বাবধায়কের সাথে চলে গেছে। হিউগো হিরজফিল্ডের চিঠিপত্র কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পেলে সেগুলো কপি করে আনবে সে। কিছু জিনিস গ্রে নিজে নিজে উপলব্ধি করতে পারলেও সবকিছু পরিষ্কার হওয়ার জন্য ওর আরও তথ্য প্রয়োজন।
তথ্য হাতে না আসা পর্যন্ত ডিরেক্টরের সাথে হিমল্যারের এই ক্যাসল ঘুরে দেখা যাক। এখান থেকেই হিউগো সাহেব নাৎসিদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। গ্রে বুঝতে পারল, সামনে এগোতে হলে ঘটনার পেছনের গল্প জানতে হবে। আর সেই গল্প শোনানোর জন্য স্বয়ং মিউজিয়াম ডিরেক্টরের চেয়ে ভাল আর কে হতে পারে?
নাৎসিদেরকে ভালভাবে বুঝতে হলে, সামনে এগোতে এগোতে আলমস্ট্রম বললেন, প্রথমে তাদেরকে একটা রাজনৈতিক পার্টি হিসেবে মনে করা বন্ধ করতে হবে। তারা নিজেদেরকে Nationalsozialistische Deutsche Arbeiterpartei বলে ডাকত। ইংলিশে বললে… ন্যাশনাল স্যোসালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি… নামে একটা দল হলেও তারা আসলে কাল্ট ছিল।
কাল্ট? প্রশ্ন করল গ্রে।
এসব প্রতীক আর চিহ্ন নিয়েই তো তাদের কারবার ছিল, তাই না? একজন আত্মাধিক নেতা ছিল তাদের যাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। সেই নেতার সব অনুসারীরা আবার একই রঙের পোশাক পরে। গোপনে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান আর রক্ত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করানো হতো। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো উপাসনা করার জন্য শক্তিশালী চিহ্ন তৈরি। জার্মান ভাষায় যেটার নাম Hakenkreluর, অর্থাৎ—ভাঙ্গা ক্রস। যেটাকে স্বস্তিকা নামেও ডাকা হয়ে থাকে।
হরে কৃষ্ণ-ও বলা যায়। বিড়বিড় করল মনক।
মজা করবেন না। নাৎসিরা এসবের ক্ষমতা বুঝতে পেরেছিল। বন্দুক কিংবা রকেটের চেয়েও এসবের শক্তি বেশি। ধর্ম দিয়ে পুরো একটা জাতির মগজধোলাই করে বশে আনা যায়। নাৎসিরা সেটাই করেছিল।
বিদ্যুৎ চমকাল বাইরে। বজ্রপাতের কম্পন ওদের পায়ের তলা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। মিট মিট করল লাইট। বন্ধ হয়ে চাচ্ছে।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই।
একটা চামবাদুড়… বিড়বিড় করে মনে করিয়ে দিল মনক। যদি একটা ছোট বাদুড়ও বের হয় রে…।
আলো বাড়ল লাইটের। সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সামনে এগোল ওরা। হলের এ-অংশ একটা কাঁচের দরজার সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। বড় একটা রুম আছে দরজার ওপাশে।
obergruppenfahrersaal, এক গোছা ভারি চাবি বের করে দরজা খুলতে খুলতে বললেন আলমস্ট্রম। এটা হলো ক্যাসলের ভেতরের পবিত্র স্থান। সাধারণ দর্শনার্থীদেরকে এটা দেখতে দেয়া হয় না। তবে আপনাদের কথা আলাদা।
দরজা খুলে ওদেরকে ঢুকতে দিলেন তিনি।
ভেতরে ঢুকল ওরা। বৃষ্টির ছাট এসে জানালায় পড়ছে… সেটার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে পুরো চেম্বার জুড়ে।
রাজা আর্থারের দুর্গের ভেতরের অংশের অনুকরণে হিমল্যার এই রুম বানিয়ে ছিলেন। এমনকি ওক কাঠ দিয়ে বিশাল এক গোল টেবিলও বানিয়ে ছিলেন তিনি। ব্ল্যাক অর্ডার প্রজেক্টের ১২ জন অফিসার সাথে নিয়ে এখানে মিটিং ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতেন।
ব্ল্যাক অর্ডার জিনিসটা কী? মনক প্রশ্ন করল।
এটা হিমল্যারের এসএস-এর আরেক নাম। তবে আরেকটু সঠিকভাবে বলতে গেলে…schwarze Auftrag…ব্ল্যাক অর্ডার…নামটা হিমল্যারের ভেতরের গোষ্ঠীদের দেয়া ছিল। একটা গোপন চক্র যাদের শিকড় গিয়ে ঠেকেছে ঠুলি সোসাইটিতে।
মনোযোগ দিল গ্রে। ঠুলি সোসাইটির কথা উঠেছে আবার। হিমল্যার এই দলের সদস্য ছিলেন, রায়ানের প্রপিতামহ হিউগো হিরজফিল্ডও সদস্য ছিলেন এখানকার। যোগসূত্র পাওয়া গেল। এই গুপ্ত চক্রের সদস্য ও বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতো এককালে উন্নত প্রজাতির মানুষেরা পৃথিবীতে রাজত্ব করে গেছে এবং সামনে আবার করবে।
ডিরেক্টর বলে যাচ্ছেন, হিমল্যার বিশ্বাস করতেন এই রুম আর টাওয়ার হলো নতুন আর্য জাতির আত্মাধিক ও ভৌগোলিক কেন্দ্রস্থল।
কেন? প্রশ্ন করল গ্রে।
শ্রাগ করে রুমের মাঝখানে গেলেন ড. এই অঞ্চলেই টিউটন-রা রোমানদেরকে পরাজিত করেছিল। জার্মানির ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল সেটা।
রায়ানের বাবার কাছ থেকেও গ্রে এরকম একটা গল্প শুনে এসেছে।
তবে এখানে আরও কিছু কারণ থাকতে পারে। লোককাহিনি এখানে খুবই শক্তিশালী। এই ব্যাপারে এখানকার অবস্থা অনেকটা সেই আদিম পাথুরে যুগের মতো। অনেকে বলে থাকে নরস ওয়ার্ল্ড ট্রির শেকড়ইগড্রাসিল, এটার নিচে অবস্থিত। এছাড়া ডাইনিরা তো আছেই।
তাদেরকে এখানে খুন করা হয়েছিল, বলল গ্রে।
প্যাগান ধর্মের অনুসারী বলে মহিলাদেরকে খুন করা উচিত বলে হিমল্যার বিশ্বাস করতেন কিংবা ন্যায্য বলে মনে করতেন। স্ক্যান্ডেভিয়ান আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে মহিলারা। তাই তাদের রক্ত দিয়ে এই ভূমি পবিত্র করা হয়েছিল।
যে প্রতিষ্ঠানগুলো জমি-ফ্ল্যাট বিক্রি করে ব্যাপারটা অনেকটা তাদের মতো হয়ে গেল, আবার বিড়বিড় করল মনক। জায়গা, জমি নিয়ে বকবক করে সবাই।
মনকের এরকম উদ্ভট মন্তব্য শুনে ভু কুঁচকালেন আলমস্ট্রম। সে যা-ই হোক, এই হলো উইউইলসবার্গ-এর গোড়াপত্তনের কাহিনি। মেঝের দিকে নির্দেশ করলেন তিনি।
আধো অন্ধকারের ভেতরে সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর গাঢ় সবুজ টাইলস দেখা গেল। দেখতে অনেকটা সূর্যের মতো… সেখান থেকে ১২টা বজ্রপাতের রেখা বেরিয়ে এসেছে।
Schwarze Sonne, অর্থাৎ-কালো সূর্য। বৃত্তের চারিদিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন আলমস্ট্রম। এই প্রতীকের শেকড় গিয়ে অনেক মিথের সাথে মিশেছে। তবে নাসিরা এই প্রতীককে ব্যবহার করেছে অল-ফাদারের ক্ষেত্রে। ইলি, হাইপারবোরিয়া, আগারথা… বিভিন্ন নাম আছে এখানে। সবমিলিয়ে এই প্রতীক দিয়ে সেই সূর্যকে বোঝানোনা হয়েছে যেটার অধীনে আর্য জাতি নতুন করে জন্ম নেবে।
আবার অল-ফাদারে ফিরলাম আমরা, বলল গ্রে, প্রাচীন বর্ণগুলো ওর মনে ভেসে উঠল।
নাৎসিদের মূল লক্ষ্য ছিল ওটা… কিংবা বলা যায়, এটা হিমল্যার ও তার ব্ল্যাক অর্ডারের লক্ষ্য ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জার্মানদেরকে পুনরায় ঈশ্বরসুলভ আসনে বসানো। সবমিলিয়ে এসব কারণেই হিমল্যার এই প্রতীককে তার ব্ল্যাক অর্ডারের জন্য ঠিক করে ছিলেন।
হিউগো সাহেব কোন ধরনের গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল গ্রে। একজন জীববিজ্ঞানী যদি এই উইউইলসবার্গের ক্যাসলের সাথে জড়িত থাকে তাহলে সে কী নিয়ে গবেষণা করতে পারে? হিউগো কী Lebensbom প্রজেক্টের সাথে যুক্ত ছিলেন? কিন্তু সেই প্রজেক্টের জন্য আজও কেন মানুষ খুন হয়ে যাচ্ছে? গবেষণা করে কী এমন পেয়েছিলেন যে সেটাকে পরিবারের বইয়ে গোপনে কোড করে রাখতে হলো?
মেয়ে টোলার কাছে তার পাঠানো চিঠিটার কথা ভাবল গ্রে। এমন একটা গোপন বিষয়ের ইঙ্গিত হিউগো দিয়ে গেছেন যেটা এত সুন্দর যে ওটাকে শেষ করে দেয়া যায়নি আবার ওটা এতটাই দানবীয় যে মুক্ত করাও সম্ভব হয়নি। জিনিসটা কী? হিউগো সাহেব তার উপরস্থ নাৎসি সদস্যদের কাছ থেকে কী লুকোতে চেয়ে ছিলেন?
বিজলি চমকানো আলো জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। সেই আলোতে ঝকঝক করে উঠল কালো সূর্য। ইলেকট্রিক লাইটগুলো কেঁপে উঠল বজ্রপাতের গুড়গুড় আওয়াজে। এরকম ঝড় হলে সাধারণত কারেন্ট থাকে না।
তা-ই হলো এখানে। আকাশে আবার বিজলি চমকাতেই নিভে গেল ইলেকট্রিক লাইটগুলো।
অন্ধকার।
যদিও জানালা দিয়ে আবছা আলো ভেতরে আসছে।
দূরে কোথাও একটি কণ্ঠ হাঁক ছাড়ল।
জোরে শব্দ হলো কাছে কোথাও।
সবার চোখ শব্দের উৎসের দিকে ঘুরল।
দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল চেম্বারের দরজা। সোয়েটারের নিচে থাকা পিস্তলের বাটে গ্রের হাত চলে গেল।
সিকিউরিটি লকডাউন, নিশ্চিত করলেন আলমস্ট্রম। ভয়ের কিছু নেই। ব্যাকআপ জেনারেটর চালু হয়ে যাবে…
ইলেকট্রিক লাইটগুলো আবার জ্বলে উঠল।
মাথা নাড়লেন আলমস্ট্রম, এই তত! আলো এসেছে। বিব্রতকর মুহূর্তের জন্য দুঃখিত। এদিকে আসুন।
চেম্বার থেকে বাইরে বেরিয়ে সবাইকে নিয়ে মেইন হলের দিকে না এগিয়ে পাশে থাকা সিঁড়ির দিকে এগোলেন তিনি। ক্যাসল পরিদর্শন এখনও শেষ হয়নি।
পাশের রুমে ওই বাইবেলে থাকা বিভিন্ন বর্ণের চিত্র আঁকা আছে। আশা করি, বিষয়টা আপনাদের কাছে ইন্টারেস্টিং লাগবে।
হল থেকে পায়ের শব্দ শোনা গেল। দ্রুত এগিয়ে আসছে।
সেদিকে ঘুরল গ্রে, ওর হাত এখনও পিস্তল ছুঁয়ে আছে। না, হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করার কোনো প্রয়োজন নেই। রায়ান আসছে ওদের দিকে, হাতে একটা বাদামি খাম। কিছুটা হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের কাছে এসে পৌঁছুল রায়ান। ich glaube… জার্মান বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল। চিঠিসহ সব কাগজপত্র আছে এখানে।
এবার তাহলে আমরা এই ছাতার জায়গা থেকে কেটে পড়তে পারি। খাম হাতে নিয়ে বলল মনক।
হয়তো ওদের এখন চলে যাওয়াই উচিত। ড. আলমস্ট্রমের দিকে তাকাল গ্রে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। এই সিঁড়ি উপরে নয়, নিচে নেমে গেছে।
ওদের দিকে এগোলেন ডিরেক্টর। যদি আপনাদের তাড়া থাকে তাহলে…
না, তাড়া নেই। আপনি প্রাচীন বর্ণ নিয়ে কী যেন বলছিলেন? গ্রে বলল। ক্যাসলের পুরোটা না দেখে যাওয়াটা বোকামি হবে।
এক হাত নাড়িয়ে সিঁড়ি দেখালেন আলমস্ট্রম। নিচে থাকা চেম্বারে গেলেই আপনি প্রাচীন বর্ণগুলো দেখতে পাবেন। এই ক্যাসলের আর কোথাও ওগুলো পাবেন না। অবশ্য বর্ণের সাথে কিছু থাকলে বর্ণের প্রকৃত মর্ম বোঝা যায়…
কী থাকলে?
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডিরেক্টর। হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বললেন, চলে আসুন। তাড়াতাড়ি দেখিয়ে দেই। লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলেন তিনি।
রায়ান ও ফিওনাকে সাথে আসার জন্য গ্রে ইশারা করল। গ্রে যখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন চোখ পাকাল মনক, ভূতোমার্কা ক্যাসল এটা… এখান থেকে চলে যাই…
ক্যাসল থেকে বের হওয়ার জন্য মনক কেন এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সেটা গ্রে-ও টের পেল। প্রথমে মার্সেডিজ কাহিনি তারপর কারেন্ট চলে যাওয়া। যদিও এখনও খারাপ কিছুই ঘটেনি। আসলে বাইবেলে থাকা প্রাচীন বর্ণ আর ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগটা গ্রে হাতছাড়া করতে চাইছে না।
নিচ থেকে আলমস্ট্রমের কণ্ঠ শোনা গেল। Obergruppenfuuhrersaal- এর ঠিক নিচেই এই চেম্বার অবস্থিত।
চেম্বারের দরজায় মোটা-পুরু কাঁচ দেয়া। ডিরেক্টর দরজা খুলতে খুলতে ওরা সবাই ওখানে পৌঁছে গেল। দরজা খুলে ওদের সবাইকে ঢুকতে দেয়ার পর ভেতরে ঢুকলেন তিনি।
এই চেম্বারটাও গোল কিন্তু এখানে কোনো জানালা নেই। দেয়ালে থাকা কয়েকটি মোমদানি থেকে আলো ছড়াচ্ছে। তাতে অন্ধকার পুরোটা দূর হয়নি, আধো-আলো, আঘো-অন্ধকার হয়ে আছে চেম্বারটা। ১২টা গ্রানাইট কলাম দাঁড়িয়ে আছে চেম্বারের চারদিক জুড়ে। ছাদের অংশটুকু ডোম আকৃতির। নিচ থেকে তাকালে দেখা যায়, ছাদের গায়ে একটা স্বস্তিকা আঁকা আছে।
এটা হচ্ছে ক্যাসলের ভূগর্ভস্থ কক্ষ। জানালেন আলমস্ট্রম। রুমের মাঝখানে একটা কূপ আছে। মারা যাওয়া এসএস অফিসারদের কোট আনুষ্ঠানিকভাবে পুড়িয়ে ওখানে ফেলা হতো।
ইতোমধ্যে পাথুরে কূপটা গ্রের চোখে পড়েছে। উপরে আঁকা স্বস্তিকার ঠিক নিচেই আছে ওটা।
আপনারা যদি কূপের কাছে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে তাকান তাহলে এখানে চিত্রিত Mensch বর্ণমালাগুলো দেখতে পাবেন।
ডিরেক্টরের কথা মতো কূপের কাছে গেল গ্রে। পাথরে দেয়ালে বর্ণমালাগুলো আঁকা রয়েছে। এখন গ্রে আলমস্ট্রমের কথার মানে বুঝতে পারল। বর্ণের সাথে কিছু থাকলে বর্ণের প্রকৃত মর্ম বোঝা যায়…
এখানে থাকা সব বর্ণমালা উল্টো করে লেখা।
Toten-runes অর্থাৎ, মৃত্যুর বর্ণ।
আবার দড়াম করে শব্দ হলো। একটু আগেও এরকম শব্দ হয়েছিল। এবারের শব্দ পুরো প্রতিধ্বনি তুলল পুরো চেম্বার জুড়ে। তবে এবার কারেন্ট গেল না, কারণ এই চেম্বারে তো কারেন্ট-ই নেই। ভুল বুঝতে পেরে ঘুরল গ্রে। কৌতূহলের কারণে নিরাপত্তার দিক ভুলে গিয়েছিল ও। ড, আলমস্ট্রম ঘুরে ফিরে সবসময় দরজার কাছেই ছিলেন। দরজা থেকে খুব একটা দূরে কখনই সরেননি।
ডিরেক্টর এখন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তালা লাগিয়ে দিচ্ছেন।
কাঁচের ওপাশ থেকে চিৎকার করে বললেন তিনি, এবার আপনারা মৃত্যুর বর্ণ এর আসল মর্ম বুঝতে পারবেন। দরজার কাঁচটা নিশ্চয়ই বুলেটপ্রুফ।
আরেকটা শব্দ হলো। সব মোমবাতি নিভে গেল এবার। কোনো জানালা না থাকায় পুরো চেম্বারে কালি গোলা অন্ধকার নেমে এলো।
বিস্ময়ের ধাক্কায় সবাই চুপ হয়ে আছে। এমন সময় হিংস্র হিসহিসানির আওয়াজ হলো।
তবে আওয়াজটা কোনো সাপ থেকে আসেনি।
জিহ্বায় অন্যরকম স্বাদ পেল গ্রে।
গ্যাস।
.
দুপুর ১টা ৪৯ মিনিট।
হিমালয়।
হেলিকপ্টার তিনটি আক্রমণ করার জন্য ধেয়ে আসছে।
বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে কপ্টারগুলোকে পর্যবেক্ষণ করল পেইন্টার। বেল্ট খুলে কো-পাইলটের সিটে নিজের সুবিধামতো অবস্থানে বসল ও। ধেয়ে আসা কপ্টারগুলোকে চিনতে পেরেছে : ইউরোকপ্টার টাইগার, ওজনে মাঝারি, গান পড় আর মিসাইলের ব্যবস্থা আছে। উড়তে উড়তে অন্য কোনো আকাশযানে হামলা করার সামর্থ্য রাখে ওগুলো।
আমাদের কপ্টারে কোনো অস্ত্র আছে? গানথারকে জিজ্ঞেস করল পেইন্টার ক্রো।
গানথার মাথা নাড়ল। নেই।
পেছন থেকে ধেয়ে আসতে থাকা শত্ৰু কপ্টারের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজের কপ্টারের গতি বাড়িয়ে দিল গানথার। এই একটা অস্ত্র-ই ওদের কাছে আছে। সেটা হলো : গতি।
ওদের এই এ-স্টার কপ্টার ওজনে হালকা, অস্ত্র ও গোলা-বারুদ না থাকায় বাড়তি কোনো ওজন নেই, চটপট এদিক-ওদিক ঘোরানো যায়। এ-স্টার কপ্টারের সুবিধা বলতে এগুলো-ই। একদম সীমিত।
ধাওয়া খেয়ে গানথার কোন দিকে এগোচ্ছে সে-সম্পর্কে পেইন্টারের পরিষ্কার। ধারণা আছে। এই অঞ্চলের ম্যাপ দেখে নিয়েছে ও। মাত্র ৩০ মাইল সামনেই চীনা সীমান্ত।
পেছনের হেলিকপ্টারগুলো থেকে রক্ষা পেলেও চীনা আকাশ রক্ষীরা ওদেরকে ছাড়বে না। তার ওপর বর্তমানে নেপাল সরকার আর মাওবাদীদের মধ্যে চলমান গণ্ডগোলের কারণে চীনা সীমান্তে কড়া পাহাড়া দেয়া হচ্ছে। পেইন্টারদের অবস্থা খুব করুণ। অনেকটা জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ-এর মতো।
হঠাৎ অ্যানা চিৎকার করে উঠলেন। মিসাইল!
তার চিৎকারের আওয়াজ শেষ হতে না হতেই ওদের কপ্টারের পাশ দিয়ে ধোয়া তুলে একটা মিসাইল বেরিয়ে গেল। মাত্র কয়েক ফুটের জন্য মিস করে গেছে। সামনে থাকা একটা পাহাড়ের গায়ে গিয়ে আঘাত করল মিসাইল। উপত্যকার বড় একটা অংশ মিসাইলের আঘাতে ধসে গেল। আগুন আর পাথরের মিশ্রণ ছিটকে উঠল উপরে।
বিক্ষিপ্তভাবে ছিটকে আসা বিভিন্ন টুকরো থেকে বাঁচতে গানথার হেলিকপ্টারকে সরিয়ে নিল।
পাহাড়ের দুই ঢালের ভেতর দিয়ে হেলিকপ্টারকে উড়িয়ে নিল ও। সরাসরি ওদের গায়ে এখন মিসাইল লাগানো সম্ভব হবে না।
আমরা যদি নিচে নেমে দ্রুত দৌড় দেই… বললেন অ্যানা।
পেইন্টার মাথা নাড়ল। কপ্টারের ইঞ্জিনের আওয়াজকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য উঁচু কণ্ঠে বলল, এই টাইগার কপ্টারগুলোকে আমার চেনা আছে। ইনফ্রারেড আছে ওগুলোতে। আমাদের শরীরের তাপমাত্রার চিহ্ন ওরা পাবেই। নিচে নেমে কোনো লাভ হবে না। নিচে নামলে পিস্তল কিংবা মিসাইল… কোনোকিছু থেকেই মুক্তি নেই।
তাহলে আমরা কী করব?
ওই সাদা আলোর বিস্ফোরণের পর থেকে পেইন্টারের মাথা এখনও ধরে আছে। ও ঠিকভাবে মাথা খাটাতে পারছে না।
পেছনের সিট থেকে সামনে ঝুঁকে কম্পাস দেখতে দেখতে লিসা বলল, এভারেস্ট।
কী?
আমরা তো এখন এভারেস্টের দিকে এগোচ্ছি। কম্পাস দেখি বলল লিসা। আমরা যদি ওখানে ল্যান্ড করে পর্বতারোহীদের মাঝে মিশে যেতে পারি…
লিসার পরিকল্পনাটা মাথায় রাখল ক্রো। আইডিয়া মন্দ নয়।
ঝড়ের ফলে পাহাড়ে আরোহীদের নির্ধারিত শিডিউল পিছিয়ে গেছে। আমি যখন ওখান থেকে রওনা হয়েছিলাম তখন প্রায় ২০০ জন ব্যক্তি ভাল আবহাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। কিছু নেপালিজ সৈনিকও ছিল তার মধ্যে। মঠে আগুন লাগার পর নেপালিজ সৈন্যদের পরিমাণ হয়তো আরও বেড়েছে।
অ্যানার দিকে তাকাল লিসা। ওর চেহারা অভিব্যক্তি পেইন্টার ঠিকই বুঝতে পারল। পেছনে থাকা শত্রুদের হাত থেকে নিজেদের জীবন তো বাঁচাতে হবেই, তার ওপর সঙ্গী হিসেবে তাদেরকে পাশে পাচ্ছে যারা কি-না মঠে আগুন দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান হুমকির পরিমাণ অনেক বেশি। অনেক বেশি ভয়াবহ। অ্যানা নির্দয়ভাবে মঠ ধ্বংস করেছিলেন তার নিজের সুবিধার জন্য। অন্যদিকে এখন যারা পিছু লেগেছে এরা অ্যানাকে থামিয়ে তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চাচ্ছে।
পেইন্টার জানে, এই ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যাবে না। এ তো সবে শুরু। ওরা সবে মাত্র ছোট্ট একটা আক্রমণ এড়াতে চাচ্ছে। সামনে যে আরও কতকিছু মোকাবেলা করতে হবে। অ্যানার কথাগুলো এখনও পেইন্টারের কানে বাজছে।
ওদেরকে থামাতে হবে আমাদের।
ওখানে অনেক স্যাটেলাইট ফোন আছে, বেজ ক্যাম্প থেকে ভিডিও সম্প্রচারের ব্যবস্থাও আছে। ওরা হয়তো হামলা করার সাহস পাবে না। লিসা ওর কথা শেষ করল।
আমরা আশা করতে পারি, ওই পর্যন্তই। বলল পেইন্টার। যদি ওরা তারপরও হামলা করে তাহলে আমাদের কারণে আরও অনেক জীবনহানি হবে।
সিটে হেলান দিয়ে পেইন্টারের কথাগুলো হজম করল লিসা। পেইন্টার জানে, বেজ ক্যাম্পে লিসার ভাইও আছে। ওদের দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল।
কিন্তু বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, বলল লিসা। ঝুঁকি নেয়া ছাড়া উপায় নেই। এই খবর বাইরের পৃথিবীকে জানাতেই হবে!
ক্রো চোখ সরিয়ে নিল।
এভারেস্টের কাঁধের ওপর দিয়ে উড়ে গেলে অল্পের মধ্যে পৌঁছুনো যাবে। নইলে অনেকখানি ঘুরে যেতে হবে, বাড়তি সময় লাগবে তখন। বললেন অ্যানা।
পেইন্টার জিজ্ঞেস করল, তাহলে আমরা বেজ ক্যাম্পে যাচ্ছি?
একমত হলো সবাই।
তবে পেছনের আক্রমণকারীরা একমত হয়নি।
ওদের কপ্টারের রোটরের ঠিক ওপর দিয়ে একটা টাইগার কপ্টার চলে গেল। আসলে এ-স্টারকে উল্টো ওদের দিকে ধেয়ে আসতে দেখে আক্রমণকারীরা একদম অবাক হয়ে গেছে। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে টাইগার কপ্টারটি দিক বদল করে এ স্টারের পিছু নিল।
পেইন্টার প্রার্থনা করল অন্য টাইগার কপ্টারগুলো যাতে একটু বৃত্ত রচনা করে এদিকে আসে। আপাতত এই একটা টাইগারকে সামলানো যাক।
অস্ত্রবিহীন নিরীহ এ-স্টার কপ্টার এখন তুষার আর বরফে ঢাকা গিরিখাতের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। লুকোচুরির কোনো সুযোগ নেই এখানে। এই সুযোগ লুফে নেয়ার জন্য টাইগারের পাইলটের আর তর সইল না। ধেয়ে এলো টাইগার।
এ-স্টারের প্রটল বাড়িয়ে ইঞ্জিনের ভেতর থেকে সর্বোচ্চ শক্তি বের করার চেষ্টা করল গানথার। কপ্টারের ব্লেডের গতি বেড়ে গেছে। তীর বেগে ছুটছে এ-স্টার। গতি দিয়ে হয়তো ওরা টাইগারকে হারিয়ে দিতে পারবে কিন্তু ওটা থেকে ছোঁড়া মিসাইলকে তো পরাজিত করতে পারবে না।
বলতে বলতে টাইগারের পাইলট তার কপ্টারে থাকা গান পড় তাক করে ফায়ার করতে শুরু করল। বুলেটগুলো মুখ গুজল দুই পাশে থাকা তুষার আর বরফের ভেতরে।
হারামজাদাগুলোর বড় বাড় বেড়েছে! বুড়ো আঙুল ঝাঁকিয়ে বলল পেইন্টার। যেমন কুকুর তেমন মুগুর মারতে হবে এখন।
বুঝতে না পেরে ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল গানথার।
টাইগার ভারি কপ্টার, পেইন্টার ব্যাখ্যা করল। আমরা আমাদের কপ্টারকে আরও উঁচুতে নিয়ে যেতে পারি। যেখানে ওটা পৌঁছুতে পারবে না।
বিষয়টা বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল গানথার। কপ্টারের গতিকে সামনের দিকে না দিয়ে উপরের দিকে দিল ও। দ্রুতগতির লিফটের মতো শাশা করে ওদের এ-স্টার উপরে উঠতে শুরু করল।
এ-স্টারকে আবার ভিন্ন দিকে এগোতে দেখে টাইগার কিছুটা ভড়কে গেল। ওটার পিছু নিতে একটু সময় লাগল ওটার তবে ধাওয়া করতে ছাড়ল না।
উচ্চতা দেখার জন্য অ্যালটিমিটার দেখল ক্রো। এ-স্টার কপ্টার ব্যবহার করেই হেলিকপ্টার দিয়ে সর্বোচ্চ উচ্চতায় ওঠার বিশ্ব রেকর্ড করা হয়েছিল। রেকর্ড গড়ার সময় সেই কপ্টার এভারেস্টের চুড়োয় ল্যান্ড করেছিল তখন। যদিও আজকে ওদের অত উঁচুতে উঠতে হবে না। ২২ হাজার ফুট উচ্চতা পার হওয়ার পর থেকে টাইগারের রোটর প্রাণপণে ঘুরছে কিন্তু আর উপরে উঠতে পারছে না। অস্ত্র আর মিসাইলের ওজন এর জন্য দায়ী।
আপাতত পেইন্টারের এ-স্টার নিরাপদে উর্ব গগনে যাত্রা করতে পারছে।
কিন্তু উপরে তো আর সারাজীবন থাকতে পারবে না।
নামতে ওদের হবেই।
পানির নিচে থাকা ক্ষুধার্ত হাজারের মতো ওদের জন্য নিচে টাইগার কপ্টার অপেক্ষা করছে। পেইন্টার দেখল বাকি দুই টাইগারও এখানে হাজির হয়ে যাবে একটু পর। আসছে ওগুলো। দিক পরিবর্তন আর দ্রুতগতির ধাওয়ার ফলে ওরা একটু পিছিয়ে পড়েছিল।
কপ্টারের উপরে যাও, এত হাতের উপরে আরেক হাতের তালু এনে ইশারা করে দেখাল ক্রো।
বিষয়টা গানথার বুঝতে পারল না ঠিকই তবে আদেশ পালন করল।
পেছন ফিরল পেইন্টার। তোমাদের দুজনকে কাজ দিচ্ছি। দুপাশের জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখো। টাইগারটা যখন একদম ঠিক ঠিক আমাদের কপ্টারের নিচে থাকবে জানাবে আমাকে।
দুই নারী মাথা নেড়ে সায় দিল।
সামনে থাকা একটা লিভারের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাল ক্রো।
চলে এসেছি প্রায়! চিৎকার করে লিসা জানান দিল।
একদম! এক সেকেন্ড পরে বললেন অ্যানা।
পেইন্টার ওর সামনে থাকা লিভারটা টেনে দিল। কপ্টারের নিচে থাকা হার্নেস নিয়ন্ত্রণ করে এই লিভার। এই হার্নেসের সাহায্যেই তখন পেইন্টার রশি দিয়ে ঝুলে ছিল। তবে এবার কোনো রশি নামানো হয়নি। কোনো কারণে হার্নেস যদি জ্যাম হয়ে যায় তাহলে আপদকালীন মুহূর্তে ওটাকে ফেলে দেয়ার জন্য এই লিভার রাখা হয়েছে। লিভারটা পুরোপুরি টেনে দিল ক্রো। শুনতে পেল কপ্টারের নিচ থেকে পটাশ শব্দ করে হার্নেসের কপিকল ছিটকে পড়ে গেল।
জানালা দিয়ে তাকাল ক্রো।
গানথার ওদের দেখার সুবিধার্থে এ-স্টারকে একটু সরিয়ে নিল।
কপিকল সুদ্ধ হার্নেস গিয়ে পড়ল টাইগারের ঘুরন্ত রোটরের ওপর। যার ফল হলো অত্যন্ত ভয়াবহ। কপ্টারের ব্লেড ভেঙ্গে ছড়িয়ে গেল চারদিকে। মাতালের মতো গোত্তা খেতে লাগল টাইগার। নিচে খসে পড়ছে।
আর সময় নষ্ট না করে এভারেস্টের দিকে এগোতে বলল ক্রো।
বেজ ক্যাম্পের নিচের ঢালে পৌঁছুতে হবে ওদের। কিন্তু নিচের আকাশ তো নিরাপদ নয়।
ক্ষ্যাপা ভীমরুলের মতো নিচে দুটো টাইগার কপ্টার উড়ে বেড়াচ্ছে। এগোচ্ছে ওদের পিছু পিছু। যদিও উচ্চতার হিসেবে ওদের নিচ দিয়ে এগোচ্ছে। কিন্তু এগোচ্ছে তো।
এদিকে পেইন্টারের কপ্টারে আর কোনো হানেস কপিকলও নেই।
.
লিসা দেখল হেলিকপ্টার দুটো ওদের দিকে তেড়ে আসছে। দুটো বাঘ একটি হরিণকে ধাওয়া করছে যেন।
কপ্টারকে এভারেস্ট আর এর পাশে থাকা পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা অংশে নিয়ে এলো গানথার। পেছনে থাকা কপ্টারগুলোর আক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে পাহাড়কে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। পাহাড়ের টোলের পাদভূমিতে বেজ ক্যাম্পের অবস্থান।
ওরা যদি ওখানে পৌঁছুতে পারতো…। লিসার চোখের সামনে ভাইয়ের বোক বোকা হাসিমাখা মুখখানি ভেসে উঠল। কপ্টার ওখানে গেলে পিছু পিছু যদি ওই দুই কপ্টারও হাজির হয় তাহলে তো বিষয়টা এরকম দাঁড়াল : বেজ ক্যাম্পে যুদ্ধ টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঠিক না?
গানথারের দিকে ঝুঁকে আছে পেইন্টার। কথা বলছে কিন্তু কপ্টারের রোটরের আওয়াজে সেসব লিসার কান পর্যন্ত পৌঁছুতে পারল না। পেইন্টারের ওপর আস্থা রাখতে হবে। অযথা প্রাণহানি করবে সে।
সামনে পাহাড় উদয় হওয়ায় গানথার কপ্টারের নাক তীক্ষ্ণভাবে নিচু করল। নিজের সিট আঁকড়ে ধরল লিসা। ওর মনে হলো, এই বুঝি ও সামনে থাকা উইডশীন্ডের কাঁচ ভেঙ্গে বাইরে ছিটকে চলে যাবে। সামনে পাহাড় আর বরফ ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না।
পেছন থেকে বিকট আওয়াজ ভেসে এলো।
মিসাইল! চিৎকার করলেন অ্যানা।
এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে গানথার কন্ট্রোল স্টিক টান দিল। কপ্টারের নাক উঁচু করে ডান দিকে বাঁক নিল ও। কপ্টারের ল্যান্ডিং স্ট্যান্ডের ঠিক নিচ দিয়ে মিসাইলটা বেরিয়ে চলে গেল। অল্পের জন্য রক্ষা পেল ওরা। মিসাইল গিয়ে পাহাড়ের গায়ে হামলে পড়ল। পাথর আর বরফের বিভিন্ন খণ্ড ছিটকে আসতে শুরু করল বিস্ফোরণের ফলে। সেগুলো থেকে বাঁচতে আবার নাক নিচু করে কপ্টার ছোটাল গানথার।
জানালার কাঁচের সাথে গাল ঠেকিয়ে লিসা দেখল পেছন থেকে কপ্টার দুটো ওদের দিকে বাঁক নিয়ে ধেয়ে আসছে। দূরত্ব কমে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। তারপর হঠাৎ করেই পাহাড়ি দেয়ালের আড়ালে পড়ে গেল টাইগার দুটো।
আমরা চলে এসেছি! পেইন্টার চিৎকার করে জানাল। শক্ত হয়ে বসে থাকো সবাই।
ওদের কপ্টার নাক নিচু করে ছুটে যাচ্ছে। সামনে বেজ ক্যাম্প। ওদের গতি দেখে মনে হবে বেজ ক্যাম্পে ক্রাশ ল্যাস্ত করতে যাচ্ছে ওরা।
প্রতি মুহূর্তে তীব্র গতিতে বেজ ক্যাম্প ওদের কাছে চলে আসছে। পতাকা, তার সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন।
ল্যান্ড করতে খবর আছে আমাদের! আবার চিৎকার করল পেইন্টার।
কিন্তু গানথার কপ্টারের গতি কমাল না।
বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়াল লিসা। ওহ গড… ওহ গড়… ওহ গড়…
একদম শেষ মুহূর্তে গানথার কন্ট্রোল স্টিক টেনে ধরল। বাতাসে ভারসাম্য হাতড়ে বেড়াচ্ছে রোটর, খুব একটা সুবিধে করতে পারছে না।
সিটের হাতল খামচে ধরে আছে লিসা।
ভূমি ধেয়ে আসছে কপ্টারের দিকে।
এবং কপ্টারের ল্যান্ডিং স্ট্যান্ডের সামনের অংশ ভূমি স্পর্শ করল, বেশ জোরেশোরেই হলো সেটা। ল্যান্ডিঙের সময়ও কপ্টারের নাক একটু সামনের দিকে ঝুকানো ছিল। সিট থেকে ছিটকে যাচ্ছিল লিসা কিন্তু সিট বেল্ট বাঁচিয়ে দিল ওকে। রোটরের বাতাসে তুষার আর বরফ দূরে সরে যাচ্ছে। অবশেষে কপ্টারের ল্যান্ডিং স্ট্যান্ড পুরোপুরি ভূমি স্পর্শ করল।
বের হও সবাই! নির্দেশ দিল পেইন্টার ক্রো। ওদিকে গানথার ইঞ্জিন বন্ধ করছে।
কপ্টারের হ্যাঁচ খুলে বেরিয়ে এলো ওরা।
লিসার পাশে এসে ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে পেইন্টার এগোল। ওদের পেছন পেছন আসছে গানথার আর অ্যানা। অনেক লোক এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। পাহাড়ের গায়ে মিসাইল আঘাত করার শব্দ নিশ্চয়ই শুনেছে ওরা।
নানান ভাষায় অস্পষ্টভাবে ওদের দিকে প্রশ্ন ছোঁড়া হলো।
অবশ্য কপ্টারের শব্দে সেগুলো পুরোপুরি কানে পৌঁছুতে পারল না।
কিন্তু একটা কণ্ঠ লিসার কানে ঠিকই পৌঁছুল।
লিসা!
শব্দের উৎসের দিকে ঘুরল ও। পরনে কালো স্লেপ্যান্ট আর ধূসর থার্মাল শার্ট পরিহিত একটা পরিচিত অবয়ব লোকজনকে ঠেলে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
জশ!
হাত ছেড়ে দিয়ে ভাইয়ের কাছে লিসাকে যেতে দিল ক্রো। ছুটে গিয়ে ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল লিসা। ওর ভাইয়ের শরীর দিয়ে চমরি গাইয়ের গন্ধ বেরোচ্ছে। কিন্তু তবুও লিসার খুব ভাল লাগল।
ওদের পেছনে ঘোঁতঘোত করল গানথার। Pass auf?
সতর্কীকরণ সিগন্যাল।
আশেপাশের সবার মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল।
সবার হাত সামনের দিকে কী যেন দেখাচ্ছে।
বাধনমুক্ত হলো দুই ভাই-বোন।
সেই দুই টাইগার হেলিকপ্টার টোলের ওপরে শূন্যে ভেসে আছে। আক্রমণ করার জন্য মুখিয়ে আছে ওগুলো।
চলে যা তোরা, মনে মনে প্রার্থনা করল সিসা। খুব করে চাইল যেন কপ্টার দুটো এখান থেকে চলে যায়।
ওরা কারা? নতুন একটি কণ্ঠস্বর প্রশ্ন করল।
কণ্ঠের মালিক কে, এটা দেখার জন্য তার চেহারা দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ সিসা ভাল করেই জানে কণ্ঠটা বোস্টন ববের। এই ব্যক্তি হলো ওর জীবনের ভুল মানুষ। এই লোকের বলার ধরনে একধরনের সুর আছে যেটা শুনলেই বোঝা যায়, গায়ে পড়ে নাক গলাতে চাইছে। ফালতু লোক। নিশ্চয়ই জশের পিছু পিছু এসে হাজির হয়েছে। ওকে পাত্তাই দিল না লিসা।
কপ্টার দুটোকে দেখে লিসার মধ্যে যে উদ্বিগ্নতা তৈরি হয়েছে সেটা জশের চোখ এড়ায়নি। লিসা…?
মাথা নাড়ল ও, দৃষ্টি আকাশে ঝুলে থাকা কপ্টার দুটোর দিকে। প্রার্থনা করার জন্য একনিষ্ঠ মনোযোগ দরকার।
কিন্তু প্রার্থনায় কোনো কাজ হলো না।
হোভার বের করে ওদের দিকে যাকে এলো কপ্টার দুটো। আগুন ফুলকি দেখা যাচ্ছে ওগুলো থেকে। সমান্তরাল রেখা ধরে বুলেট ধেয়ে এসে বেজের বরফ আর তুষারের মধ্যে নাক খুঁজতে খুঁজতে সামনে এগোল।
না… গুঙিয়ে উঠল লিসা।
চিৎকার করে পিছু হটতে শুরু করল বব। কী কাণ্ড ঘটিয়ে এসেছ তোমরা?
বেজে উপস্থিত বাকিরা এরকম অতর্কিত আক্রমণে নির্বাক হয়ে পড়েছিল। তবে সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্য। যোর কাটতেই গলা ছেড়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করল সবাই। যে যেদিকে পারছে ছুটছে।
লিসার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল পেইন্টার। সাথে জশকেও নিলো। পালাতে চাচ্ছে। কিন্তু এখানে তো সেরকম কোনো জায়গা নেই।
একটা রেডিও লাগবে! জশের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়ল ক্রো। রেডিও কোথায়?
জশ কোনো জবাব না দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল।
ভাইয়ের হাত ধরে ঝাঁকি দিল লিসা। দৃষ্টি নিচে নামিয়ে এনে বলল, জশ, একটা রেডিও খুঁজে বের করতে হবে। পেইন্টারের উদ্দেশ্য ও বুঝতে পেরেছে। আর কিছু না হোক, অন্তত বাইরের দুনিয়ায় এখানকার খবরটুকু পৌঁছে দিতে হবে।
হঠাৎ কেশে উঠল জশ, নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, এদিকে আসো… মঠে মাওবাদীদের আক্রমণের পর ওরা এখানে একটা ইমার্জেন্সি কমিউনিকেশন সিস্টেম বসিয়েছে। লাল রঙের বড় এক তাবুর দিকে ওদের নিয়ে গেল জশ।
সিসা খেয়াল করে দেখল বোস্টন ববও ওদের সাথে সাথে এসেছে। বুঝতে, পারছে এখন পেইন্টার আর গানধারের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। গানথার চুপ করে থাকলেও ওর হাতে থাকা রাইফেল অনেক কথা বলে দিচ্ছে। একটু আগে লঞ্চারে আরেকটা গ্রেনেড ভরেছে গানথার। রেডিওতে কাজ করার মুহূর্তে কেউ বাগড়া দিতে এলে তাকে এক হাত দেখিয়ে দেয়ার জন্য গানথর একদম প্রস্তুত।
কিন্তু তাবুর কাছে পৌঁছানোর আগেই পেইন্টার চিৎকার করে উঠল। নিচু হও সবাই!
লিসাকে টেনে শুইয়ে ফেলল ও। ওর দেখাদেখি সবাই শুয়ে পড়ল। বোস্টন বব আমতা আমতা করছিল দেখে জশ ওর পা ধরে আছড়ে ফেলল।
নতুন অদ্ভুত একটা শব্দ প্রতিধ্বনি হলো পাহাড়ের গায়ে।
আকাশের দিকে তাকাল ক্রো।
কী…? লিসা জানতে চাইল।
দাঁড়াও… দেখি। দ্বিধা নিয়ে বলল ক্রো।
লোতসে পর্বতের কাঁধের ওপর দিয়ে দুটো মিলিটারি জেটকে উদয় হতে দেখা গেল এবার। উদয় হতে দেরি আক্রমণ করতে দেরি নেই। জেট দুটোর পাখার নিচে আগুনের ঝলকানি দেখতে পেল ওরা।
মিসাইল।
এই সেরেছে!
কিন্তু বেজ টার্গেট করে মিসাইলগুলো ছোঁড়া হয়নি। বেজের ওপর দিয়ে সামনে, এগিয়ে গেল মিসাইল দুটো।
টাইগার কপ্টার দুটো অনেকখানি নিচে নেমে এসেছিল কিন্তু জেট থেকে ছোটা মিসাইল এসে আছড়ে পড়ল তাদের ওপর। টুকরো টুকরো হয়ে গেল দুই টাইগার কপ্টার। তবে ভাগ্য ভাল, খগুলো ক্যাম্পে এসে আছড়ে পড়েনি।
উঠে দাঁড়াল পেইন্টার, লিসাকেও তুলল।
উঠে পড়ল বাকিরাও।
লিসার দিকে তেড়ে ফুড়ে এগিয়ে গেল বোস্টন বব। হচ্ছেটা কী এসব? তুমি কোন কুকর্ম করে এসে এখন আমাদেরকে এসব দিয়ে ভোগাচ্ছ?
মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরল লিসা। এর আগে এই লোকের সাথে এক বিছানায় রাত কাটিয়েছে বলেই হয়তো এতটুকু ধৈর্য দেখাতে পারছে। ভাবতেই অবাক লাগে, তখনকার লিসা আর এখনকার লিসার মধ্যে কত পার্থক্য। তখনকার লিসা যেন এই। লিসা নয়। দুজন ভিন্ন ব্যক্তি।
কুত্তী মাগী! আমাকে তোর পিঠ দেখাবি না বলে দিলাম! খেঁকিয়ে উঠল বব।
ঝট করে ঘুরল লিসা, ওর হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেছে… যদিও এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ পেইন্টার আছে তো। হাতুড়ির মতো ববের মুখের ওপর ঘুষি মারল ক্রো। ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেয়া এতদিন শুধু শুনে এসেছে লিসা, আজ স্বচক্ষে দেখল। এক ঘুষিতেই বব ভূপাতিত। হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রইল বব, আর উঠল না। ওর নাক ভেঙ্গে গেছে।
নিজের মাথা চেপে ধরল ক্রো, আবার ব্যথা হচ্ছে।
প্রথমে বিস্মিত হলো জশ, তারপর দাঁত বের করে হাসল। ওহ, এই কাজটা করার জন্য গত এক সপ্তাহ ধরে আমার হাত নিশপিশ করছিল। যাক, কাজটা হতে দেখে ভাল লাগল।
ওরা আর কিছু বলার আগে লাল তাবু থেকে হলদে চুলঅলা একজন বেরিয়ে এলো। তার পরনে মিলিটারি ইউনিফর্ম। আমেরিকার মিলিটারি। এদিকে এগিয়ে এলো সে। পেইন্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, ডিরেক্টর ক্রো? লোকটির উচ্চারণভঙ্গিতে জর্জিয়ান টান আছে। বলতে বলতে এক হাত সামনে বাড়িয়ে দিল সে।
হ্যান্ডশেক করল ক্রো।
স্যার, লোগান গ্রেগরি আপনাকে সালাম জানিয়েছেন। একটু আগে হয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল সে।
যাক কাজটা করতে লোগান দেরি করলেও… করেছে বলে ভাল লাগছে। না করার চেয়ে, দেরি করে করা ভাল। ক্রো বলল।
আপনি যদি আমার সাথে আসেন তাহলে তার সাথে কথা বলা যেতে পারে। লোকটির নাম মেজর ব্রুকস, এয়ার ফোর্স অফিসার। ওর সাথে ক্রো তাবুর ভেতরে গেল। অ্যানা আর গানথারকে নিয়ে লিসা তাবুর ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই এক হাত দিয়ে বাধা দিল অফিসার।
আমি আসছি, ওদেরকে আশ্বস্ত করল ক্রো। বেশিক্ষণ লাগবে না।
পেইন্টার তাবুর ভেতরে চলে গেল। অনেক যন্ত্রপাতি আছে ভেতরে। স্যাটেলাইট টেলিকমিউনিকেশন থেকে একজন অফিসার সরে গিয়ে পেইন্টারকে জায়গা করে দিল।
লোগান? রিসিভার তুলে জিজ্ঞেস করল ক্রো।
ডিরেক্টর ক্রো, আপনার কণ্ঠ শুনে ভাল লাগছে। পরিষ্কার স্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে।
এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত আমার।
আমরা আপনার এসওএস পেয়েছিলাম।
মাথা নাড়ল ক্রো। এই এসওএস সিগন্যাল পাঠানোর সময়ই ক্যাসলে ওর অ্যামপ্লিফায়ার বিস্ফোরিত হয়েছিল। ভাগ্য ভাল বিস্ফোরণ হওয়ার আগেই সিগন্যাল পাঠানো হয়ে গিয়েছিল, পরে অতিরিক্ত লোড নিতে না পেরে অ্যামিপ্লিফায়ার অক্কা পায়। ওই সিগন্যালের কারণে এখানে সিগমার আগমন।
আপনার ওখানে যন্ত্রপাতি তুলতে আর রয়্যাল নেপালিজ মিলিটারির সাথে সমন্বয়ের কাজগুলো খুব দ্রুততার সাথে করা হয়েছিল। ব্যাখ্যা করল লোগান।
যতই দ্রুত করা হয়ে থাকুক সেটা যথেষ্ট ছিল না। আর একটু হলেই সর্বনাশ হতে পারতো। অল্পের জন্য রক্ষা।
নিশ্চয়ই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে লোগান পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। সম্ভবত ওরা যখন ক্যাসল থেকে পালিয়ে বাইরে এসেছে তখন থেকে নজর রেখেছে লোগান। যা-ই হোক, বিস্তারিত পরে জানাবো। তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে এখন।
লোগান, সবকিছু খুলে বলার আগে আমি তোমাকে একটা অনুসন্ধান চালাতে বলব। একটা চিহ্নট্যিাটু ফ্যাক্স করে দিচ্ছি। খোঁজ নিয়ে দেখবে জিনিসটা কী। মেজর ব্রুকসকে ইশারা করে কাগজ-কলম দেখাল পেইন্টার। চাহিদা মতো কাগজ-কলম চলেও এলো। আততায়ী মহিলার হাতে যে চিহ্ন দেখেছিল সেটা দ্রুত আঁকল ক্রো। এই চিহ্ন নিয়েই এগোতে হবে ওদের।
দ্রুত কাজ শুরু করে দাও, বলল ক্রো। দেখো কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন, রাজনৈতিক দল কিংবা ড্রাগ কার্টেল-এর সাথে এই চিহ্নের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাও কি-না।
আমি এখুনি বিষয়টা দেখছি।
চারপাতার সেই ট্যাটু কোনোমতো কাগজে একে সেটাকে এক অফিসারের হাতে ধরিয়ে দিল ক্রো। অফিসার ওটাকে নিয়ে ফ্যাক্স মেশিনে দিল।
ফ্যাক্স পাঠানোর প্রক্রিয়া চলতে চলতে সবকিছুর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিল পেইন্টার। এইসময় লোগান ক্রোকে অত্যধিক প্রশ্ন করে বাধা না দেয়ায় মনে মনে ক্রো ওকে ধন্যবাদ দিল।
ফ্যাক্স পেয়েছ? কয়েক মিনিট পর প্রশ্ন করল ক্রো।
এইমাত্র হাতে পেলাম।
বেশ। খোঁজ লাগাও… এই অনুসন্ধানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে।
চুপচাপ। বেশ কিছুক্ষণ হলো কোনো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। পেইন্টার ভাবল হয়তো সিগন্যাল কেটে গেছে। হঠাৎ লোগানের কণ্ঠ শোনা গেল আবার। স্যার…
কী হয়েছে?
আমি এই চিহ্ন চিনি। গ্রেসন পিয়ার্স ৮ ঘন্টা আগে এই চিহ্ন আমার কাছে পাঠিয়েছিল।
কী?
কোপেনহ্যাগেনে গ্রের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একে একে জানাল লোগান। কথাগুলো শুনতে শুনতে ক্রোর মাথাব্যথা আবার চাড়া দিয়ে উঠল। নিজেকে সামলে ঘটনা শোনার দিকে মনোযোগ দিল ক্রো। তাতে যা বুঝল, একই গোষ্ঠীর আততায়ীরা গ্রের পেছনেও লেগেছে। অন্য একটা বেল-এর অধীনে জন্ম নেয়া Sonnekonise ওরা। কিন্তু ইউরোপে কেন? কয়েকটা পুরোনো বইয়ে কী এমন মহারত্ন আছে? ইতোমধ্যে গ্রে জার্মানি শ্রাগ করেছে, সূত্র ধরে এগিয়ে গিয়ে ঘটনার শেষ দেখতে চায়।
চোখ বন্ধ করল পেইন্টার। মাথাব্যথা বেড়ে গেছে। ইউরোপে আক্রমণ হওয়ায় এটাই প্রমাণিত হয়, কিছু একটা হচ্ছে যেটার সাথে পুরো পৃথিবীর প্রশ্ন জড়িত। কিছু একটা হচ্ছে… সেটার ফল আসন্ন।
কিন্তু কী সেটা?
শুরু করার জায়গা মাত্র একটা। একটা মাত্র সূত্র। এই চিহ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে এই চিহ্ন কাদের?
ঠাণ্ডা গলায় লোগান বলল, আমরা হয়তো উত্তরটা জানি।
কী? ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছ?
৮ ঘণ্টা সময় পেয়েছিলাম, স্যার।
ঠিক, ঠিক। মাথা নাড়ল পেইন্টার। হাতে থাকা কলমের দিকে তাকাল ও। অদ্ভুত বিষয়টা চোখে পড়ল। ওর চতুর্থ আঙুলের নখ নেই! গায়েব হয়ে গেছে। হয়তো যখন ববকে ঘুষি মেরেছিল তখন হয়েছে বিষয়টা। নখ সরে গেছে কিন্তু কোনো রক্ত বের হয়নি। স্রেফ ফ্যাকাসে শুকনো মাংস বেরিয়ে পড়েছে। ঠাণ্ডা ও অনুভূতিশূন্য। লক্ষণটা ধরতে পারল ক্রো।
হাতে আর খুব বেশি সময় নেই।
লোগান গ্রের কাছ থেকে কী কী জেনেছে সেগুলো এক এক করে বলছিল কিন্তু বাধা দিল ক্রো।
এখানকার ঘটনাগুলো সম্পর্কে গ্রেকে জানিয়েছ?
না, স্যার। এখনও জানাতে পারিনি। গ্রেকে এখন পাওয়া যাচ্ছে না।
নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভুলে ভ্রু কুঁচকাল পেইন্টার। ওকে সব খুলে বলবে, দৃঢ়ভাবে নির্দেশ দিল ক্রো। যেভাবে পারো যোগাযোগ করো। কীসের পেছনে লেগেছে সে-সম্পর্কে গ্রের কোনো ধারণাই নেই।
.
সকাল ৯টা ৫০ মিনিট।
উইউইলসবার্গ, জার্মানি।
ঘুটঘুটে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে টর্চ দিয়ে আলো জ্বালালো মনক।
গ্রে নিজের প্যাক হাতড়ে টর্চ খুঁজে বের করে জালিয়ে উপরের দিকে তাক করল। গম্বুজের পাশ দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য ছোট্ট করে ভেন্টের ব্যবস্থা রাখা আছে। সবুজ গ্যাস বেরিয়ে আসছে ওখান থেকে, গ্যাসটা বাতাসের চেয়ে ভারি। ধোয়ার জলপ্রপাতের মতো ভেন্ট থেকে গ্যাস রুমে নেমে আসছে।
ভেন্ট এর ছিদ্র বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ ওটা অনেক উঁচুতে।
গ্রের দিকে সরে এলো ফিওনা। রায়ান কূপের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের হাত দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে ও। পুরো বিষয়টা বিশ্বাসই করতে পারছে না।
নড়াচড়া হওয়ায় গ্রের দৃষ্টি মনকের দিকে ফিরল।
৯ এমএম গ্লক পিস্তল বের করে কাঁচের দরজার দিকে তাক করেছে সে।
না! মানা করল গ্রে।
কিন্তু ততক্ষণে যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। বেরিয়ে গেছে গুলি।
পিস্তলের শব্দে রুম কেঁপে উঠল। কাঁচের গায়ে হুমড়ি খেয়ে গুলি অন্যদিকে ছুটল। একটা স্টিলের ভেন্টের সাথে গিয়ে সংঘর্ষ ঘটিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরোল।
ভাগ্য ভাল এই গ্যাস দাহ্য নয়। নইলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের কারণে ওরা সবাই মারা পড়তো।
মনকও বুঝল বিষয়টা। বুলেটপ্রুফ, মুখ হাঁড়ি করে বলল ও।
ওর কথায় কথায় সায় দিলে আলমস্ট্রম জানালেন। বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখতে হয়েছে। অনেক আধুনিক-নাৎসিরা ভেতরে অহেতুক প্রবেশের চেষ্টা। করেছিল। গ্রেরা আলো জ্বালানোর ফলে সেই আলো কাছে গিয়ে প্রতিফলিত হয়ে। ফিরে আসছে। আলমস্ট্রম ঠিক বাইরের কোনো অবস্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
হারামজাদা, বিড়বিড় করল মনক। রুমের নিচের অংশ গ্যাসে ভরে যাচ্ছে। গ্যাসের গন্ধটা বেশ মিষ্টি হলেও তেতো স্বাদ দিল জিহ্বায়। যাক, অন্তত সায়ানাইড দেয়নি। এই সবুজ গ্যাসের চেয়েও জঘন্য, তিতা কাঠবাদামের মতো গন্ধ ওটার।
দাঁড়িয়ে থাকো সবাই, বলল গ্রে। মাথা উঁচু রাখো। ভেন্টগুলো থেকে দূরে… রুমের মধ্যে চলে আসো সবাই।
রুমের মধ্যে জড়ো হতে শুরু করল ওরা। গ্রের হাত শক্ত করে ধরল ফিওনা। আরেক হাত বের করে বলল, আমি ওই ব্যাটার পকেট মেরে দিয়েছি। দেখো তো, মানিব্যাগে কিছু পাও কি-না।
খুব ভাল করেছ। কিন্তু ওর চাবিগুলো চুরি করতে পারলে না? বলল মনক।
গলা উঁচিয়ে জার্মান ভাষায় রায়ান বলল, আ… আমার বাবা জানে… আমরা এখানে এসেছি। তিনি Pofitzef-দের ফোন করবেন কিন্তু।
এই তরুণের তারিফ করতেই হয়, ভাবল গ্রে। ছেলেটা তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
কাঁচের ওপাশ থেকে নতুন একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কাঁচে আলো প্রতিফলিত হওয়ায় এই ব্যক্তির চেহারাও দেখা যাচ্ছে না। আমার তো মনে হয়, তোমার বাবা আর কখনও কাউকে ফোন করতে পারবে না। কথাগুলো সে হুমকি হিসেবে বলেনি, একদম ঘোষণা দেয়ার মতো বলেছে।
এক পা পিছিয়ে গেল রায়ান। মনে হলো, ওকে কেউ শারীরিকভাবে আঘাত করেছে। একবার গ্রের দিকে আরেকবার দরজার দিকে তাকাল বেচারা।
নতুন কণ্ঠস্বরটা গ্রে ও ফিওনার পরিচিত। দুজনই চিনতে পেরেছে। নিলাম হাউজের ট্যাটুঅলা ক্রেতার কণ্ঠ এটা।
এবার আর তোমাদের কোনো কৌশল কাজে আসবে না, বলল সে। পালানোর কোনো রাস্তা নেই এবার।
মাথা খালি খালি লাগল গ্রের। ওর মনে হচ্ছে ওর শরীরের কোনো ওজন নেই, খুব হালকা লাগছে নিজেকে। মাথা ঝাঁকিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল ও। লোকটা ঠিকই বলেছে। এবার পালানোর কোনো রাস্তা নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওরা অসহায়, প্রতিরোধ করার কোনো শক্তি নেই।
জ্ঞানই শক্তি।
তোমার প্যাক থেকে লাইটার বের করো, মনককে নির্দেশ দিলো গ্রে।
মনক নির্দেশ পালন করল। এদিকে গ্রে ওর নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে নোটবুক ব্যাক করে কূপের ভেতর ফেলল।
মনক, রায়ানের কপিগুলো দাও তো। গ্রে হাত বাড়িয়ে দিলো। আর ফিওনা, তুমি বাইবেলটা দাও, প্লিজ।
নির্দেশমতো দুজনই কাজ করল।
কূপের ভেতরে আগুন লাগাও, বলল গ্রে।
লাইটার জ্বালিয়ে রায়ানের আনা কাগজগুলোকে মনক আগুন ধরিয়ে কূপের ভেতর ফেলে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আগুন আর ধোঁয়া বেরিয়ে এলো কূপ থেকে। সব কাগজ পুড়িয়ে ফেলছে। নতুন উৎপন্ন ধোঁয়াগুলো সবুজ গ্যাসকে একটু হলেও বাধা দিচ্ছে… নাকি এটা শুধু গ্রের আশা মাত্র? মাতালের মতো মাথা ঝাঁকাল ও।
দরজার ওপাশে বিড়বিড় করে ওরা কী যেন বলছে। এত আস্তে বলছে যে ভালভাবে শুনতে পাওয়া গেল না।
ডারউইন বাইবেল উঁচু করে চিৎকার করে বলল গ্রে। এই বাইবেলের ভেতরের গোপন জিনিসটা একমাত্র আমরাই জানি!
কাঁচের আড়ালে দাঁড়িয়ে সাদা-চুলঅলা লোকটি তাচ্ছিল্যের স্বরে জবাব দিলো, আমাদের যা জানা দরকার সেসব ড. আলমস্ট্রম জানিয়ে দেবেন। প্রাচীন বর্ণমালার বিষয় কোনো ব্যাপারই না। আমাদের কাছে ওই বাইবেলের কানা-কড়ি মূল্যও নেই এখন।
তাই নাকি? হাতে থাকা টর্চের আলো বাইবেলের ওপর ফেলল গ্রে। হিউগো সাহেব বাইবেলের পেছনের অংশে কী লিখেছেন সেটা আলমঈমকে দেখিয়েছি, কিন্তু সামনে কী লিখেছেন ওটা তো এখনও দেখাইনি!
কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা। তারপর ওপাশে আবার বিড়বিড় করে কথা বলার আওয়াজ পাওয়া গেল। গ্রের মনে হলো এবার এক নারী কণ্ঠও ও শুনতে পেয়েছে। হয়তো ওই ফ্যাকাসে লোকটার যমজ বোন।
আলমস্ট্রমের কণ্ঠে না শোনা গেল। রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে কিছু বলছেন তিনি।
গ্রের পাশে দাঁড়িয়ে ফিওনা টলছে। ভেঙে আসতে চাইছে ওর হাঁটু। মনক ওকে ধরে মাথা উঁচু করে রাখার চেষ্টা করল। ভারি গ্যাস রুমের নিচের অংশে ভরে এবার ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছে। কিন্তু ওর অবস্থাও সুবিধের নয়।
গ্রের হাতে আর সময় নেই।
নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য গ্রে ওর হাতে থাকা টর্চ বন্ধ করে বাইবেলটাকে কূপে ফেলে দিলো। বাইবেলের মতো পবিত্র জিনিসকে এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার কারণে চোট লাগল ওর রোমান ক্যাথলিক অন্তরে। পুরোনো পৃষ্ঠাগুলোয় সহজেই আগুন ধরে গেল। বাড়তি ধোঁয়া বেরোল এবার।
গভীর একটা নিঃশ্বাস নিল গ্রে। এবার যে কথাটা বলতে যাচ্ছে এটা যথাসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। আপ্রাণ চেষ্টা করল ও। যদি আমরা মরে যাই তাহলে ডারউইন বাইবেলের গোপন জিনিসটাও আমাদের সাথে শেষ হয়ে যাবে!
অপেক্ষা করল ও। মনে মনে আশা করছে, ওর কথায় হয়তো কাজ হবে।
এক সেকেন্ড… দুই…
গ্যাস উঠে গলার কাছে চলে এসেছে। প্রতিবার নিঃশ্বাস নিতে ভুগতে হচ্ছে খুব।
হঠাৎ হুরমুড় করে ভেঙে পড়ল রায়ান। মনে হলো ওকে যে রশি দিয়ে টেনে দাঁড় করে রাখা হয়েছিল সেটা হঠাৎ করে কেউ কেটে দিয়েছে। মনক ওকে এক হাত দিয়ে ধরতে চাইল কিন্তু তাহলে ফিওনার ভারে হাঁটু মুড়ে সে-ও পড়ে গেল। পড়ল তো পড়ল, আর উঠল না। ফিওনাও ওর সাথে ভূপাতিত হয়েছে।
দরজার দিকে তাকাল গ্রে। মনকের হাত থেকে টর্চটা পড়ে গিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাইরে কী কেউ আছে? ওর কথা বিশ্বাস করেছে ওরা?
সেটা আর গ্রের জানা হলো না।
বাকিদের মতো এবার গ্রেও আধারের কোলে ঢলে পড়ল।
.
বিকাল ৫টা ৫০ মিনিট।
হুলুহুলুই-আমফলোজি প্রিজার্ভ।
হাজার হাজার মাইল দূরে জেগে উঠল অন্য একজন।
ব্যথা নিয়ে রঙিন দুনিয়ায় চোখ মেলল সে। চোখ মেলেই দেখল ওর মুখের ওপরে পাখির পালক নাড়ানো হচ্ছে। প্রার্থনার স্তবক শুনতে পেল।
উঠেছে, জুলু ভাষায় বলল একজন।
খামিশি… নারী কণ্ঠ।
নিজের পরিচয় মনে করতে জেগে ওঠার লোকটির কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল। নিজের নাম-ধাম মনে পড়ল ওর কিন্তু স্বস্তি পেল না। গোঙানির আওয়াজ এলো। আওয়াজটা ওর গলা দিয়েই বেরিয়েছে।
ওকে বসিয়ে দিন। জুলু ভাষায় বলল নারী কণ্ঠ। যদিও তার জুলু উচ্চারণে ব্রিটিশ টান রয়ে গেছে।
পিঠের পেছনে বালিশ দিয়ে দুর্বল খামিশিকে বসিয়ে দেয়া হলো। ওর দৃষ্টিশক্তি এখন স্থির হয়েছে। নগ্ন ইটের কুঁড়েঘরের একটা রুমে আছে ওরা। রুমটায় অদ্ভুত একধরনের গন্ধ ছড়িয়ে আছে। ওর নাকের নিচ দিয়ে কিছু একটু ঘুরিয়ে আনা হলো। আমোনিয়ার তীব্র দুর্গন্ধ পেল খামিশি। দুর্গন্ধের ধাক্কায় ও মাথা পেছনে হেলিয়ে দিল।
এবার ওর চোখে পড়ল ওর ডান হাতে আইভি লাইন দেয়া হয়েছে। হলুদ তরল ভরা একটি ব্যাগ থেকে নেমে এসে ওর হাতে ঢুকেছে লাইনটা।
একপাশে নগ্ন বুক নিয়ে এক শ্যামান দাঁড়িয়ে আছে, তার মাথায় পালকের মুকুট পরা। এই লোকটি এতক্ষণ প্রার্থনার স্তবক পাঠ করতে করতে শকুনের পালক ওর মুখের ওপর ঘোরাচ্ছিল। মৃত্যুকে এভাবে তাড়ানো হয়ে থাকে।
অন্যদিকে, ড. পলা কেইন খামিশির এক হাত ধরে বসে ছিলেন, এখন হাতটাকে আবার কম্বলের নিচে রাখছেন তিনি। কম্বলের নিচে খামিশি সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় রয়েছে। ঘামে ওর সব পোশাক ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছিল।
কী…? কোথায়…? গলা কর্কশ শোনাল খামিশির।
পানি আনুন, নির্দেশ দিল পলা।
জুলু লোকটি নির্দেশ মেনে একটা টোলের ক্যানটিন এগিয়ে দিল।
ধরে খেতে পারবেন? পলা জানতে চাইলেন।
মাথা নাড়ল খামিশি, পারবে। ধীরে ধীরে ওর শক্তি ফিরে আসছে। ক্যানটিন নিয়ে কুসুম কুসুম গরম পানিতে চুমুক দিল ও। জিহ্বা ভিজতেই ঘটনাগুলো মনে পড়তে শুরু করল। এই জুলু লোকটি… খামিশির বাড়িতে ছিল।
হঠাৎ করে ওর হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। ডান হাতে আইভি লাইন দেয়া। ব্যান্ডেজ করা আছে গলার এক জায়গায়। সব মনে পড়ে গেল ওর। সেই দুই মুখঅলা। ডার্ট। ব্ল্যাক মাম্বা। সাপ দিয়ে করা সাজানো নাটক।
কী হয়েছিল?
জুলু লোকটি বয়সে বৃদ্ধ। খামিশি একে চিনতে পারল। এই ব্যক্তিই সর্বপ্রথম পার্কে উকুফা দেখে রিপোর্ট করেছিল। সেটা আজ থেকে ৫ মাস আগের কথা। অবশ্য তখন তার কথা কেউ আমলে নেয়নি। এমনকি খামিশিও পাত্তা দেয়নি তখন।
ডক্টরের সাথে কী হয়েছে… সব শুনেছি আমি। মাথা নেড়ে পলার প্রতি সমবেদনা জানাল জুলু। আর আপনি কী দেখেছেন, কী বলেছেন সেগুলোও জেনেছি। লোকজন সবাই এসব নিয়ে বলাবলি করছিল। বিষয়টা নিয়ে আপনার সাথে কথা বলার জন্য আপনার বাসায় গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি আপনি নেই। তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম। এমন সময় কয়েকজনকে আসতে দেখে লুকিয়ে পড়লাম আমি। ওরা সাপটাকে কাটল। মাম্বা সাপ। ব্ল্যাক ম্যাজিক করছিল বোধহয়। তাই আমি আর তখন বের হইনি।
চোখ বন্ধ করল খামিশি। মনে পড়ছে সব। বাসায় আসার পর ডার্টের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। পড়ে ছিল মরার মতো। কিন্তু আক্রমণকারীরা জানতো না, কেউ একজন লুকিয়ে আছে।
ওরা চলে যাওয়ার পর আমি বের হয়ে অন্যদেরকে ডেকে আনলাম। তারপর গোপনে আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। জানাল বৃদ্ধ।
বিষ আপনাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। কিন্তু আধুনিক ও প্রাচীন… দুই ধরনের ওষুধ আপনাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। গল্পের শেষটুকু জানালেন পলা।
আইভি বোতল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শ্যামানের দিকে নিল খামিশি।
ধন্যবাদ, আপনাকে।
হাঁটতে পারবেন বলে মনে হয়? শক্তি পাচ্ছেন? জানতে চাইলেন পলা। আপনার নড়াচড়া করা উচিত। বিষ দেহের সঞ্চালন সিস্টেমের জন্য হানিকারক। নড়াচড়া করলে উপকার হবে।
শ্যামেনের সাহায্য নিয়ে খামিশি উঠে দাঁড়াল। কোমরের কাছে কম্বল জড়িয়ে রাখল ও। ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোল ওরা। প্রথম পা ফেলার সময় খুব দুর্বল লাগছিল ওর কিন্তু এখন ভাল লাগছে।
দরজায় থাকা মোটা পর্দা সরিয়ে দেয়া হলো।
দিনের আলো আর তাপ ভেসে এলো ঘরের ভেতর। অত্যধিক আলোতে চোখে ঠিকভাবে কিছু দেখাই যাচ্ছে না। বিকেলের মাঝামাঝি সময় এটা, মনে মনে আন্দাজ করল খামিশি। সূর্য পশ্চিম দিকে একটু হেলে পড়েছে।
খামিশি এক হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে বাইরে বেরোল।
এটা জুলুদের ছোট্ট গ্রাম। চিনতে পারল ও। হুলুহুলুই-আমলোজি প্রিজার্ভের পাশেই এই গ্রামের অবস্থান। রাইনোটাকে ওরা যেখানে পেয়েছিল, এখান থেকে ওই জায়গার দূরত্ব খুব বেশি নয়।
পলা কেইনের দিকে ফিরে তাকাল খামিশি। দুই হাত আড়াআড়ি রেখে দাঁড়িয়ে আছেন পলা। চেহারা বিধ্বস্ত।
ওয়ার্ডেন প্রধানের কাজ এটা, খামিশি বলল। কোনো সন্দেহ নেই ওর। তিনি আমার মুখ বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন।
মারশিয়ার মৃত্যুর ব্যাপারে আপনি যা দেখেছিলেন সেটার জন্য?
মাথা নাড়ল খামিশি। হ্যাঁ।
আপনি কী…?
ওদের মাথার ওপর দিয়ে টুইন-ইঞ্জিনঅলা হেলিকপ্টার উড়ে যাওয়ায় বাক্য শেষ করতে পারলেন না পলা। রোটরের বাতাসে ঝোঁপঝাড় আর গাছপালা দুলে উঠল। দরজায় থাকা ভারি পর্দা পর্যন্ত উড়তে লাগল পতপত করে।
ভারি কপ্টারটি দূরে চলে গেল। সাভানার ওপর দিয়ে অল্প উচ্চতায় উড়ে যাচ্ছে। কপ্টারটাকে দেখল খামিশি। এটা কোনো টুরিস্ট কপ্টার নয়।
ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন পলা। চোখে বাসনেল বাইনোকুলার। কপ্টারের সাথে সাথে দৃষ্টি সরাচ্ছেন তিনি। কপ্টার যেখানে ল্যান্ড করবে ওখানে দিয়ে থামলেন। ভাল করে দেখার জন্য খামিশি সামনে পা বাড়াল।
ওর হাতে পলা বাইনোকুলার ধরিয়ে দিলেন। সারাদিন ওখানে ফ্লাইট লেগেই থাকে।
বাইনোকুলার চোখে লাগাল খামিশি। পুরো পৃথিবী এক ধাক্কায় ওর কাছে চলে এলো। ১০ ফুট উঁচু কালো বেড়ার ওপাশে কপ্টারকে ল্যান্ড করতে দেখল ও। ওই বেড়া দিয়ে ওয়ালেনবার্গ প্রাইভেট এস্টেটকে আলাদা করা হয়েছে। কপ্টারটি বেড়ার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিছু একটা হচ্ছে ওখানে, বললেন পলা।
খামিশির ঘাড়ের পেছনে থাকা ছোট চুলগুলো দাঁড়িয়ে পড়ল।
ফোকাস ঠিক করে বেড়ার ওপর ধরল ও। একটা পুরোনো গেইট আছে, কালেভদ্রে ভোলা হয়। বরাবরের মতো এখনও বন্ধ ওটা। গেইটের গায়ে পারিবারিক চিহ্ন দেখতে পেল ও। দ্য ওয়ালেনবার্গ ক্রাউন অ্যান্ড ক্রস।