১০. ব্রাহ্মণ

ব্রাহ্মণ

পাল-চন্দ্র-কম্বোজ পর্বের ব্রাহ্মণেতর অন্যান্য বর্ণ উপবর্ণ সম্বন্ধে যে-সব সংবাদ পাওয়া যায় তাহা একত্রে গাঁথিয়া মোটামুটি একটা চিত্র দাঁড় করাইবার চেষ্টা করা গেল। দেখা যাইতেছে এ-যুগের রাষ্ট্রদৃষ্টি বর্ণসমাজের নিম্নতম স্তর চণ্ডাল পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য বর্ণসমাজের মাপকাঠি ব্রাহ্মণ স্বয়ং এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও ধর্ম। সমাজে ইঁহাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তির বিস্তার ও গভীরতার দিকে তাকাইলে  বর্ণসমাজের ছবি স্পষ্টতর ধরিতে পারা যায়। এক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার তারতম্য এবং বিশিষ্টতা অনেকাংশে কোন বিশেষ ধর্ম ও ধর্মগত সংস্কার ও সমাজব্যবস্থার প্রসারতার দ্যোতক।

পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতি প্রসার আগেই লক্ষ্য করা হইয়াছে। সমাজে ব্রাহ্মণ্য বর্ণব্যবস্থাও সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশঃ প্রসারিত হইতেছিল। যুয়ান্‌-চোয়াঙ, ও মঞ্জুশ্ৰীমূল-কল্পের গ্রন্থকার শশাঙ্ককে বলিয়াছেন বৌদ্ধবিদ্বেষী। সত্যই শশাঙ্ক তাহা ছিলেন কিনা সে-বিচার এখানে অবান্তর। এই দুই সাক্ষ্যের একটু ক্ষীণ প্রতিধ্বনি নদীয়া বঙ্গসমাজের কুলজী গ্রন্থেও আছে, এবং সেই সঙ্গে আছে শশাঙ্ক কর্তৃক সরযূনদীর তীর হইতে বারো জন ব্রাহ্মণ আনয়নের গল্প। শশাঙ্ক এক উৎকট ব্যাধিদ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিলেন; ব্যাধিমুক্তির উদ্দেশ্যে গৃহযজ্ঞ করিবার জন্যই এই ব্রাহ্মণদের আগমন। রাজানুরোধে এই ব্রাহ্মণেরা গৌড়ে বসবাস আরম্ভ করেন এবং গৃহবিপ্র নামে পরিচিত হন; পরে তাহাদের বংশধরেরা রাঢ়েবঙ্গে ও বিস্তৃত হইয়া পড়েন এবং নিজ নিজ গাঞী নামে পরিচিত হন। বাংলার বাহির হইতে ব্রাহ্মণ্যগমনের যে ঐতিহ্য কুলজী গ্রন্থে বিধৃত তাহার সূচনা দেখিতেছি শশাঙ্কের সঙ্গে জড়িত। কুলজীগ্রন্থের অন্য অনেক গল্পের মত এই গল্পও হয়তো বিশ্বাস্য নয়, কিন্তু এই ঐতিহ্য-ইঙ্গিত সৰ্বথা মিথ্যা না-ও হইতে পারে। মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের গ্রন্থকার বলিতেছেন, শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ; ব্রাহ্মণের পক্ষে ব্রাহ্মণ্যপ্রীতি কিছু অস্বাভাবিক নয়, এবং বহুযুগস্মৃত শশাঙ্কের বৌদ্ধবিদ্বেষ কাহিনীর মূলে এতটুকু সত্যও নাই, এ-কথাই বা কি করিয়া বলা যায়। সমসাময়িক কাল যে প্রাগ্রসরমান ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম ও সংস্কৃতিরই কাল তাহা ত নানাদিক হইতে সুস্পষ্ট। আগেই তাহা উল্লেখ করিয়াছি। যুয়ান্‌ চোয়াঙ্‌, ইৎসিঙ্‌, সেংচি প্রভৃতি চীন ধৰ্ম পরিব্রাজকেরা যে সব বিবরণী রাখিয়া গিয়াছেন তাহা হইতে অনুমান করা চলে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থাও বেশ সমুদ্ধই ছিল, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ-তথ্য অনস্বীকার্য যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থা তাহার চেয়েও অনেক বেশী সমুদ্ধতর ছিল। বাংলার সর্বত্র ব্রাহ্মণ দেবপূজকের সংখ্যা সৌগতদের সংখ্যাপেক্ষ অনেক বেশি ছিল, এতথ্য যুয়ান্‌-চোয়াঙই রাখিয়া গিয়াছেন। পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারের তথা বৰ্ণব্যবস্থার প্রসার বাড়িয়াই চলিয়াছিল, এ সম্বন্ধে দেবদেবীর মূর্তি-প্রমাণই যথেষ্ট। জৈন ধর্ম ও সংস্কার তো ধীরে ধীরে বিলীন হইয়াই যাইতেছিল। আর, বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কারও ব্রাহ্মণ্য সমাজাদর্শকে ধীরে ধীরে স্বীকার করিয়া লইতে ছিল, পাল-চন্দ্র-কঙ্গোজ রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শের দিকে তাকাইলেই তাহা সুস্পষ্ট ধরা পড়ে। যুয়ান্‌-চোয়াঙ কামরূপ প্রসঙ্গে বলিতেছেন, কামরূপের অধিবাসিরা দেবপূজক ছিল, বৌদ্ধধর্মে তাঁহারা বিশ্বাস করিত না; দেবমন্দিব ছিল শত শত, এবং বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের লোকসংখ্যা ছিল অগণিত। মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি বৌদ্ধ ছিল তাঁহারা ধর্মানুষ্ঠান করিত গোপনে। এই ত সপ্তমশতক কামরূপের অবস্থা; বাংলা দেশেও তাহার স্পর্শ লাগে নাই, কে বলিবে? মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের গ্রন্থকার স্পষ্টই বলিতেছেন, মাৎস্যন্যায়ের পর গোপালের অভ্যুদয় কালে সমুদ্রতীর পর্যন্ত স্থান তীৰ্থিক (ব্রাহ্মণ?) দের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল; বৌদ্ধমঠগুলি জীর্ণ হইয়া পড়িতেছিল, লোকে ইহাদেরই ইটকাঠ কুড়াইয়া লইয়া ঘরবাড়ী তৈয়ার করিতেছিল। ছোটবড় ভূস্বামীরাও তখন অনেকে ব্রাহ্মণ। গোপাল নিজেও ব্রাহ্মণানুরক্ত, এবং বৌদ্ধ গ্রন্থকার সেজন্য গোপালের উপর একটু কটাক্ষপাতও করিয়াছেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের ক্রমবর্দ্ধমান প্রসার ও প্রভাব সম্বন্ধে কোন ও সন্দেহই আর করা চলে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *