১০. বোধ
[এক]
আজ সকাল সকাল বের হতে হবে শাওনকে। দুই জায়গায় দুটি শিডিউল দেওয়া আছে তার। প্রথমেই যেতে হবে গৌরিপুর হাসপাতালে। সেখানে মামুনের স্ত্রীকে ভর্তি করানো হয়েছে। ডেলিভারি কেইস। গতকাল রাত দেড়টায় মামুন ফোন করে জানিয়েছে তার স্ত্রীর রক্ত লাগবে। একেবারে সকাল সকাল না পেলে অবস্থা বেগতিক আকার ধারণ করবে। ফোনে মামুন পারলে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়! অনুরোধের সুরে বারবার বলতে লাগলো, ‘দোস্ত, আসবি তো? বল না রে! সত্যি সত্যিই কি আগামীকাল আসবি হাসপাতালে? তোর ভাবির খুব ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশান যাচ্ছে। তুই ছাড়া এমন কেউ নাই যে আগামীকাল ভোরে এসে রক্ত দিতে পারবে। প্লিজ দোস্ত, কথা দে আসবি?’
এমনিতেই ফোনের রিংটোন বেজে ওঠায় মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেছে শাওনের; তার ওপর মামুনের এ রকম ন্যাকা-কান্না শুনে তার সত্যি সত্যিই রাগ চড়ে গেলো। মাথাটাও ঘুরতে লাগলো ভনভন করে। ফোনের ওপাশে মামুনের নাক্যামো মার্কা কান্না যেন থামছেই না। একপর্যায়ে শাওন বিরক্ত হয়ে বললো, ‘থামবি তুই? বললাম না আগামীকাল ঠিক সময়েই হাসপাতালে থাকব? একটা কথা কি হাজারবার বলা লাগে?’
শাওনের একপ্রকার ধমক শুনে একটু থামল মামুন। বললো, ‘দোস্ত, রাগ করিস না। ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশানে পড়েই তোর কাছে ধরনা দিয়েছি। আমার হাতে যদি আরও কয়েকটি অপশান থাকত তাহলে তোকে এভাবে জ্বালাতন করতাম না। বিশ্বাস কর।’
শাওন রাগতস্বরে বললো, ‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কিছু নেই। তোকে আমি বেশ স্বাভাবিকভাবেই বলেছি যে, আগামীকাল ঠিক সময়ে আমি উপস্থিত হয়ে যাবো। কিন্তু তুই বেচারা তো আমার কোনো কথাই শুনছিস না। কানের ওপর ঘ্যানর ঘ্যানর করেই যাচ্ছিস। তার ওপর তোর নাকি-কান্না তো আছেই। বিরক্তি উঠে যায় না একটা মানুষের, বল?’’
শাওনের গোছালো শাসনে মামুন চুপ মেরে গেলো। কারও মুখেই কোনো কথা। নেই। দুই প্রান্তেই এক নিঃসীম নীরবতা। নীরবতা ভেঙে শাওন বললো, ‘চিন্তার কিছু নেই। আগামীকাল যত যা-ই হোক, তুই আমাকে ঠিক সময়ে হাসপাতালে দেখবি। এইটুকু ভরসা তুই আমার ওপরে রাখতে পারিস।’
মামুন খুব ধীর এবং শান্ত গলায় বললো, ‘ধন্যবাদ দোস্ত।’
মামুনের ধন্যবাদ শোনার জন্য ফোনের ও’প্রান্তে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকবে–এতো ধৈর্য আর শাওনের কই? তার ধন্যবাদ বাতাসের তরঙ্গে ভেসে তার কান অবধি পৌঁছানোর আগেই সে ফোনের লাইন কেটে শুয়ে পড়েছে।
শাওনের অন্য শিডিউলটি ক্যাম্পাসের। তাদের আজ একটা ডিপার্টমেন্টাল প্রোগ্রাম আছে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো প্রোগ্রামের সব দায়-দায়িত্ব চেপেছে শাওনের কাঁধেই। মোটামুটি রকমের একটা ঝামেলায় পড়ে গেলো সে। দুই জায়গায় যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে যথাসাধ্য কার্য সমাধা করা সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটা বাদ দিয়ে আরেকটা বেছে নেওয়ার মতো সুযোগ এখানে নেই।
সকালে বের হওয়ার পথে শাওনের মা ডাক দিয়ে বললো, ‘এতো তাড়াতাড়ি তো কখনোই যাস না। আজ যাচ্ছিস যে?’
শাওন ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর দিলো, ‘কখনোই যাই না বলে যে আজ যেতে পারবো না–এমন কোনো নিয়ম আছে নাকি?’
ছেলের কথা শুনে শাওনের মা চুপ মেরে গেলেন একদম। তিনি খুব ভালো করেই জানেন তার ছেলে কোনোদিন সোজা কথার সোজা উত্তর দেয় না। তাকে যখন মাছের কাঁটা বেছে মাছ খেতে দেওয়া হতো সে প্লেট ঠেলে দিয়ে বলতো, ‘কাঁটার জন্য মাছ খাবো না–তা তো বলিনি। মাছ খাবো না বলেছি, কারণ–মাছ খেতে আমার ভালো লাগে না। শুধু শুধু বাড়তি আদিখ্যেতা দেখাতে এসো না প্লিজ। বিরক্তি লাগে।
ছেলের এমন অদ্ভুত আচরণে খুব আহত হন রাহেলা বেগম। বাপ-মরা একমাত্র ছেলে তার। কতো স্বপ্ন যে ছিলো তাকে ঘিরে! কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে ও এমন বেপরোয়া হয়ে উঠলো যে রাহেলা বেগম এখন নিজের ছেলেকেই মাঝেমধ্যে চিনতে পারেন না। এ যে তার পেটে ধরা সন্তান–সেটাও কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকে। স্বভাবে, আচরণে সে এখন চরম খিটখিটে। যে দু’চোখে রাহেলা বেগম ছেলেকে নিয়ে একরাশ স্বপ্ন বুনেছিলেন এতোদিন, তা আজ কান্নার অথৈ সাগরে পরিণত হয়েছে। স্বামী আযহার উদ্দিনের স্বপ্ন ছিলো ছেলেকে আলেম বানাবেন। শাওনের যখন সাড়ে তিন বছর বয়স তখন থেকেই তাকে নিয়ে রোজ মসজিদে চলে যেতেন। আযহার উদ্দিন। ছেলেকে পাশে দাঁড় করিয়ে সালাত আদায় করতেন তিনি। এতো ছোট্ট বাচ্চাকে মসজিদে আনতেন বলে অন্য মুরব্বি-মুসল্লীরা প্রায়ই দু-চারটি কথা শোনাতেন আযহার সাহেবকে। কিন্তু এসবে একেবারেই পাত্তা দিতেন না তিনি। তার কথা একটাই–ছোটো বাচ্চারা ছোটোকালে যা শেখে সেটা তারা সব সময় মনে রাখতে পারে। মসজিদে আসা শিখলে বড় হয়েও মসজিদে আসবে।
আযহার উদ্দিনের এই চিন্তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাবার হাত ধরে খুব ছোটোবেলাতেই মসজিদে আসা-যাওয়া করা ছেলেটি বড়ো হয়ে মসজিদমুখী হয়নি। বললেই চলে। বাবার শেখানো সব বিদ্যে সে ভুলে বসে আছে। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে একেবারে বখে গেছে সে। অথবা হতে পারে অবাধ স্বাধীনতাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাহেলা বেগম প্রায়ই বিড়বিড় করে বলেন, ‘অতিরিক্ত স্বাধীনতাও একরকম পরাধীনতা।’
পায়ে মোজা পরতে পরতে শাওন বললো, ‘দুপুরে খাবো না। ফোন কোরো না।’
রাহেলা বেগম জানতে চাইলেন, ‘খাবি না কেন? কোথায় খাবি তাহলে?’
মায়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টি দিলো সে। তার চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি ঠিকরে বের হচ্ছে। খুব কঠিন চেহারায় সে বললো, ‘জাহান্নামে খাবো, বুঝতে পেরেছো? কতবার বলেছি আমার ব্যাপারে বেশি নাক গলাতে আসবে না। যখন বলেছি খাবো না, তখন খাবো না, ব্যস। বারবার প্রশ্ন করে জানতে চাইবে না–কেন খাবো না, কোথায় খাবো যত্তসব!
রাহেলা বেগম দ্বিতীয়বারের মতো চুপ মেরে গেলেন। ছেলের এমন স্বভাবের সাথে তিনি আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এমন কদর্য ব্যবহারে আগে রাহেলা বেগমের চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি ঝরতো; এখন আর তেমনটা হয় না। এখন চোখ আর মন–দুটোই কেমন যেন শক্ত হয়ে যাচ্ছে। সময় যে মানুষকে কতভাবে ভাঙে-গড়ে–ভাবেন রাহেলা বেগম। আগে কষ্ট লাগত, বুক ফেটে চৌচির হতো ছেলের এহেন আচরণে। আজকাল এসব দেখে মনের ভেতরে আর হাহাকার হয় না। বুক ফেটে কান্না আসে না। মাঝে মাঝে রাহেলা বেগমের মরে যেতে ইচ্ছে করে। সিজদায় লুটিয়ে পড়ে আল্লাহর কাছে নিজের মৃত্যু কামনা করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু চাইলেই তো আর পারা যায় না। হাদিসে নিজের মৃত্যু চাইতে নিষেধ করা হয়েছে বলে তিনি ধৈর্য ধরে আছেন।
শাওন যখন বের হতে যাবে তখন তিনি আবার বললেন, ‘যদি একটু সময় দিতি তাহলে টিফিন ক্যারিয়ারে হালকা কিছু নাস্তা দিয়ে দিতাম। তোর জন্য ভোর থেকেই শীত-পিঠা বানাচ্ছিলাম।’
কিছুই বললো না শাওন। শুনতে পায়নি–এমন ভান করে বাসা থেকে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো। তার চলে যাওয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। রাহেলা বেগম। ছেলের চলে যাওয়ার দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে যায় অতীতের কথা। শাওন যখন তার বাবার সাথে মসজিদে যাওয়ার জন্য অথবা স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হতো, তখন সে বারবার পেছন ফিরে মায়ের দিকে তাকাতো। হাত নেড়ে মুচকি হেসে মাকে বিদায় জানাতো। দরজার আড়াল থেকে তিনিও হাত নেড়ে ছোট্ট সোনামণিটাকে বিদায় দিতেন। মা-ছেলের চোখে চোখে কথা হতো। সেই ছেলে আজ এতো অবাধ্য, এতো উদ্ধৃঙ্খল আর বেপরোয়া হয়ে পড়বে–তা। রাহেলা বেগম স্বপ্নেও ভাবেননি।
[দুই]।
শাওন কথা রেখেছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই সে গৌরিপুর হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে। রোগীদের আসা-যাওয়া এবং চিৎকার-চেঁচামেচিতে গমগম করছে পুরো হাসপাতাল এলাকা। শাওনকে দেখামাত্র একরকম দৌড়ে তার কাছে এলো মামুন; চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ। চিন্তা আর অস্থিরতায় শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে সে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে শাওনকে বললো, ‘থ্যাংক ইউ, দোস্ত। অনেক বড়ো উপকার করলি আজ। তুই না এলে…’–মামুন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার অব্যক্ত এবং অসমাপ্ত কথাগুলো শোনবার সময় কিংবা ইচ্ছে–কোনোটাই হয়তো নেই শাওনের। সে মামুনকে থামিয়ে দিয়ে জিগ্যেশ করলো, ‘ভাবির কী অবস্থা এখন?
‘অবস্থা তো খুবই ক্রিটিক্যাল। ব্যাপক ব্লিডিং হয়েছে। দ্রুত ব্লাড না দেওয়া গেলে…’
‘ব্লাড নেওয়া হবে কখন?’
‘এই তো, আর একটু পরেই।’
শাওন আর কোনো কথা বললো না। হাসপাতালের করিডোরে পেতে রাখা একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বাম পায়ের ওপর ডান পা রেখে সে চোখ দুটো বন্ধ করলো– অপেক্ষা কখন ডাক্তারের ডাক আসবে আর তাকে রক্ত দেওয়ার জন্যে যেতে বলবে। মামুনও বিশেষ কোনোকিছু বলতে গেলো না আর। তার রগচটা বন্ধু শাওনকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। পরোপকারী, কিন্তু ভীষণ আত্মাভিমানী। বেশ অহংকারীও–কিন্তু তা কেবল পরিস্ফুটিত হয় নিজের আত্মমর্যাদা এবং আত্ম-জগতের বেলাতেই।
শাওনের যে অন্য আরেকটা জায়গাতেও জরুরি তলব আছে–তা মামুনকে বলতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত বলা গেলো না। তার বিপন্ন আর বিপর্যস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হলো–শাওনের অন্য কাজের গুরুত্ব বুঝবার মতন অবস্থা এখন মামুনের নেই। বিপদগ্রস্ত মানুষের কাছে নিজের বিপদ ব্যতীত বাকি দুনিয়াটাই গৌণ।
ব্লাড দেওয়া শেষে শাওন আবার হাসপাতালের করিডোরে ফেরত এলো। তাকে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল মামুন। শাওনের আজকের উপকারের কথা সে কোনোদিন ভুলবে না, বন্ধুর এই ঋণ কোনোভাবেই শোধ করতে পারবে না সে–এ জাতীয় কথা বলতে বলতে একেবারে শিশুদের মতন। কাঁদতে লাগলো। তার কান্না দেখে আশপাশের লোকজনও ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। ওদের দিকে। শাওন যে বিরক্ত হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে যে কড়া কোনো ধমক দিয়ে থামিয়ে দেবে–সেটা করা যাচ্ছে না। বেচারা পত্নী আর অনাগত সন্তানের জন্য চরম দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় কাতর। এহেন মুহূর্তে তাকে সান্ত্বনা না দিয়ে শাসন করতে গেলে সে ভেতর থেকেই ভেঙে পড়তে পারে।
শাওন বললো, ‘আমাকে বেরুতে হবে এবার। একটা জরুরি কাজ আছে হাতে।’
তার চলে যাওয়ার কথা শুনে মামুন শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বললো, ‘চলে যাবি মানে? আমার সন্তানের মুখ দেখে যাবি না?’
শাওন খেয়াল করলো সন্তানের কথা বলতে গিয়ে বেশ অদ্ভুতরকমভাবে, ভোজবাজির মতন পাল্টে গেলো মামুনের চেহারা। বিষণ্ণতায় নুইয়ে পড়া মুখাবয়বে হঠাৎ যেন আনন্দের ঝিলিক খেলে গেলো। মামুনকে এ রকম উৎফুল্ল আর উৎসুক দেখে শাওন জানতে চাইল, ‘সন্তানের জন্য অধীর অপেক্ষায় আছিস মনে হচ্ছে!’
হেসে ফেলল মামুন। কান্নার আবহ-মিশ্রিত সে এক অদ্ভুত সুন্দর হাসি! তাকে দেখে কে বলবে যে–খানিক আগেও সে একেবারে বাচ্চা মানুষের মতন কেঁদেছিল? তার চেহারা এবং মনের এমন ত্বরিত পটপরিবর্তন দেখে শাওনও সামান্য বিভ্রান্ত হলো।
মামুন বললো, ‘সন্তান যে কী জিনিস তা বাবা হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনোদিন বুঝবি না।’
শাওন চুপ করে রইলো। মামুনের কথাটার ভারত্ব আর নিগূঢ় অর্থটা তাকে একটা সজোরে আঘাত দিয়ে গেলো যেন। কিন্তু সে আঘাত অপমানের নয়, অপরাধবোধের। সন্তানের বাবা না হওয়া পর্যন্ত এই আনন্দ, এই দুশ্চিন্তা, এই আবেগ আর অপেক্ষার মর্ম বোঝা কোনোদিন কি সম্ভব নয়? শাওনের মনে পড়ে গেলো তার বাবার কথা। যেদিন সে পৃথিবীতে আসে সেদিন তার বাবাও কি এমন অধীর আগ্রহে প্রহর গুনেছিল তার জন্যে? এ রকম কোনো এক ভোরে, হাসপাতালের কোনো এক করিডোরে তার বাবাও কি ভয় এবং আশার সম্মিলিত আনন্দ আর দুর্ভাবনা নিয়ে পায়চারি করেছিলো একদিন? বাবার স্মৃতি আবছা আবছা মনে করতে পারে সে। সেই আবছা স্মৃতির সবটুকু বাবার আদর আর ভালোবাসায় মাখামাখি। বাবার কাঁধে উঠে বেড়ানো, বুকের ওপর ঘুমিয়ে পড়া, বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, একসাথে আইসক্রিম খেতে খেতে বাসায় ফেরা–স্মৃতির কুয়াশা ভেদ করে সমস্ত কিছু যেন আজ শাওনের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে চাইছে।
মামুনের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো। সে বললো, ‘কী হয়েছে রে? বেশ চিন্তিত লাগছে তোকে।’
অস্ফুট হেসে মামুনের আশু দুর্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে শাওন বললো, ‘না, ও কিছু না। আচ্ছা, ভাবির কী অবস্থা বল তো? তোর মতোই কি অনাগত সন্তানের জন্য দিলপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে অপেক্ষা করছেন?’
আবার হেসে উঠলো মামুন। এবারের হাসিতে দুর্ভাবনার কোনো চিহ্ন নেই; বরং তাতে সাহস আর শক্তির এক অদ্ভুত আভাস দেখতে পেলো শাওন।
মামুন বললো, ‘কী যে বলিস তুই! একজন মা তার সন্তানের জন্য যে ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষা করে, একজন বাবার ব্যাকুলতা তার হাজার ভাগের এক ভাগও হবে না। অসহ্য সব যন্ত্রণা আর ভোগান্তি মুখ বুজে সহ্য করে দশটা মাস যে জঠরে বড় করে তোলে সন্তানকে, ভাবতে পারিস কতটা ত্যাগ তাতে জড়ানো থাকে? একবার কী হয়েছে জানিস? আমার স্ত্রী একদিন আমায় বললো, যদি সন্তান জন্মের সময় অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, হয় সন্তান বাঁচবে না-হয় মা; তখন কিন্তু তুমি আমার কথা মোটেই মাথায় আনবে না, বুঝলে? আমার সন্তানই যেন আমার ওপরে প্রাধান্য পায় তোমার কাছে। আমি না থাকলেও সে যেন বেঁচে থাকে এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে।’
সেদিন তার কথাগুলো শুনে আমার এতো খারাপ লেগেছিল, তাকে জড়িয়ে ধরে আমি হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম।
শাওনের কোনো ভাবান্তর নেই। মুখাবয়বের অবস্থা দেখে মনে হলো সে মামুনের কথাগুলো শুনতেই পায়নি। কিন্তু তা সত্য নয়। শাওনের মনের ভেতর যে অশান্ত ঝড় উঠেছে, বোধোদয়ের যে তীব্র জলোচ্ছ্বাস শাওনের বুকের ভেতর তাণ্ডব চালাতে শুরু করেছে-তা বহু কষ্টে সে লুকোনোর চেষ্টা করছে। একজন মা যে নিজের জীবন বিপন্ন করে দিয়ে হলেও অনাগত সন্তানের সুরক্ষার কথা ভাবতে পারে–শাওন তা কোনোদিন কল্পনাতেও ভাবেনি। তিলে তিলে নিজের শরীরের ভেতরে যে আরেকটা শরীর একজন মা বড় করে তোলে, তার জন্যে কী অপরিসীম মায়া, কী অফুরান ভালোবাসা জমা করে রাখে বুকে–সেই চিন্তা করবার ফুরসতও। কোনোদিন মেলেনি শাওনের। কী বোকা, নির্বোধ, নির্লজ্জ আর অকৃতজ্ঞ শাওন!
এমন সময় শাওনের কল্পনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটা নারীমূর্তির ছায়া। সেই ছায়া আর কার হবে, রাহেলা বেগম ছাড়া? সেই মায়াজােনো দুটো হাত, সেই আদর-বিগলিত মধুমাখা ডাক, সেই ভালোবাসা-মিশ্রিত স্পর্শ–ছোটোবেলার স্মৃতির অন্ধকার কুঁড়ে আজ সদলবলে যেন শাওনের সামনে জড়ো হতে শুরু করেছে। শাওন আবার ভাবনার অতলে তলিয়ে যায়। সে দেখতে পায় তার বাবার হাত দুটো বেশ শক্তভাবে ধরে আছে তার মা রাহেলা বেগম। চোখের জলে তার বুক ভেসে যাচ্ছে। বাবাকে উদ্দেশ্য করে তার মা বলছে, ‘যদি সন্তান জন্মের সময় অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, হয় সন্তান বাঁচবে না-হয় মা; তখন কিন্তু তুমি আমার কথা মোটেই মাথায় আনবে না, বুঝলে? আমার সন্তানই যেন আমার ওপরে প্রাধান্য পায় তোমার কাছে। আমি না থাকলেও সে যেন বেঁচে থাকে এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে।
কল্পনায় ছেদ পড়লো শাওনের। পাশের অপারেশন থিয়েটার থেকে উঁচু স্বরে ভেসে আসছে এক নবজাতকের চিৎকার-কান্না। সেই কান্নায়, শাওন দেখতে পেলো– সবচেয়ে বেশি ধড়ফড়িয়ে উঠেছে মামুন। উন্মাদের মতো করে সে এক দৌড়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে চলে গেলো। এতোটা তাড়িত-স্বভাব মামুনের মাঝে কখনোই দেখা যায়নি আগে। তবে কি, সন্তানের সাথে সাথে বাবা-মায়েরও নতুন করে জন্ম হয়?
শাদা-পোশাক পরা একজন নার্স অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এলেন। তার কোলে তোয়ালেতে মোড়ানো এক নবজাতক, যার কান্না হুড়মুড় করে বাড়িয়ে দিয়েছে হাসপাতাল করিডোরের ব্যস্ততা। নার্স হাসিমুখ করে বললেন, ‘এই যে মামুন সাহেব, আপনার মেয়ে হয়েছে।’
সন্তান লাভের সে অপার্থিব আনন্দে চোখমুখ ঝলমল করে উঠলো মামুনের। চোখে অশু তো আগে থেকেই আছে, এবার সে অশু পারলে নায়াগ্রার ঢল হয়ে নামতে শুরু করে! নার্সের কোল থেকে একপ্রকার ছোঁ মেরে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মামুন সে কী কাণ্ডকারখানা সেদিন শুরু করেছিলো তা দেখে অ-মুখরা স্বভাবের শাওনও একবার হেসে ফেলল। সন্তান পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠা মামুনকে দেখে শাওনের ভেতরে এক নতুন অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সেই অনুভূতি শাওনকে চমকিত করে। সে অনুভূতি শাওনকে এনে দাঁড় করায় ভাবনার এক নতুন দ্বারে।
[তিন]
বাইরে বেরিয়ে আসে শাওন। সকালের সোনা-রোদ এখনো মিলিয়ে যায়নি। মোবাইল বের করে একবার দেখে নেয় সে। অজিত, মিঠু, মনির আর সাব্বিরদের অসংখ্য মিসড-কলে ভর্তি মোবাইলের স্ক্রিন। ধ্রুব তো মেসেজে লিখেই বসল, ‘গাধা! সবকিছু পণ্ড করে দিবি নাকি তুই? এখনো আসছিস না যে? কারও কলও ধরছিস না।’
ঠিক, শাওন আজ সবকিছু পণ্ডই করে দেবে। এতোদিনকার চলে আসা সব রীতি আর নীতিতে আজ ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে শাওন। তবে সেই ধ্বংসযজ্ঞের একটা জায়গায় সৃষ্টির প্রাণবন্ততা আছে, আছে প্রত্যাবর্তনের অপরিসীম আর অপার্থিব আনন্দ। শাওনের ভাবনাজুড়ে যে সুর বারে বারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যে শৈশব স্মৃতির পাতা থেকে আজ ভীষণভাবে উঠে আসতে চাইছে–শাওন আজ তাতে কোনো বাধা দেবে না।
খুব করে মায়ের কথা মনে পড়ছে শাওনের। এতোগুলো দিন কতভাবে যে তাকে কষ্ট দিয়ে এসেছে সে–তা ভাবতেই নিজেকে ভারি অপরাধী মনে হচ্ছে তার। আজ সকালেও তো কেমন নির্দয়ভাবে শাসালো মা’কে। কিন্তু কী অদ্ভুত, মা একবারের জন্যও কোনো প্রতিবাদ করলো না, একবার রেগে উঠলো না পর্যন্ত। তার বদলে প্রতিবারই কেবল মুখ গুঁজে কেঁদেছে, নয়তো উদাস নয়নে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে–ভাবে শাওন। আমাকে পেটে ধরে মা কি বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে? স্বামীকে হারিয়ে সন্তান বুকে আঁকড়ে ধরে জীবনটা কাটাতে চেয়েছিল মা–এই কি তার অমার্জনীয় অপরাধ?
শাওনের চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে থাকে। এই খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে মামুনের মতো করে হাউমাউ করে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে গোঙাতে থাকে।
[চার]
ঠক… ঠক… ঠক…
বড্ড অসময়ে আজ রাহেলা বেগমের দরজায় কড়া নড়লো। দরজা খুলে সামনে শাওনকে দেখে তিনি বেশ ঘাবড়ে গেলেন। এই অসময়ে কোনোদিন তো ও বাড়ি ফেরে না। তবে আজ কেন? তবে কি ওর শরীর খারাপ করেছে? নাকি ক্যাম্পাসে কোনো ঝামেলা হয়েছে তাকে নিয়ে? রাহেলা বেগমের বুকের ভেতরটা ধড়ফড়াতে শুরু করেছে।
শাওন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো মায়ের দিকে। পলকহীন সেই তাকানোতে তাচ্ছিল্য নেই, উদাসীনতা নেই, নেই অপমান-অপদস্থ করবার কোনো উপকরণ। রাহেলা বেগমের বুকের ধড়ফড়ানি বাড়তে থাকে। ছেলের সম্ভাব্য বিপদের ফিরিস্তি তার চোখের সামনে যেন নৃত্য শুরু করে দিয়েছে।
এবার যেন বজ্রাঘাত হলো এবং সেই আঘাতে ভেঙেচুরে গেলো এতোক্ষণের সমস্ত নাটকীয়তা। শাওন এবার সত্যিই হাউমাউ করে কেঁদে রাহেলা বেগমের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লো। আকস্মিক এই নাটকীয় দৃশ্যের কোনোকিছু বুঝে উঠবার আগেই শাওন কান্না-বিজড়িত গলায় বলতে শুরু করে, ‘আমাকে মাফ করে দাও মা। তোমার সাথে আমি অনেক অন্যায় করেছি। আমি আর তোমার অবাধ্য হতে চাই না, আর তোমার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করতে চাই না নিজেকে। তুমি আমাকে আগের মতো বুকে টেনে নাও মা, প্লিজ।’
রাহেলা বেগমের বুকের ছটফটানি কমে আসে। গলা জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকা শাওনের গালে চুমু খান তিনি। শাওনের এই বোধোদয়ের জন্যই যে তার এতোদিনের অপেক্ষা! একপ্রকার হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে পুনরায় ফিরে পেয়েছেন তিনি। রাহেলা বেগমের ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে জায়নামায বিছিয়ে দুআ করতে। এমন মুহূর্তকে সামনে নিয়ে হাজার বছর যে শান্তিতে বেঁচে থাকা যায়!