১০. বৈদেশিক নীতিমালা

অধ্যায় : ১০ – বৈদেশিক নীতিমালা

Foreign Affairs

সকল প্রকার তথ্য, তা প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য যাই হোক না কেন, তা একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ও সার্বিকভাবে প্রতিরক্ষানীতি নির্ধারণে সাহায্য করে। এ দু’টো নীতি নির্ধারণে গোয়েন্দা তথ্যের সুনির্দিষ্ট সহায়তার মাঝে মাঝে সমায়নুযায়ী তারতম্য ঘটে থাকে। সাধারণত ধরে নেয়া হয় যে, আহরিত শতকরা পঞ্চাশভাগ ইন্টেলিজেন্স’ বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে এবং বাদবাকি পঞ্চাশ ভাগ প্রতিরক্ষা বা রণনীতি নির্ধারণে সহায়তা করে। এ দুটো ক্ষেত্রের বিশেষ প্রকৃতিই তাদের মধ্যে একটি বিশেষ সম্পর্কের সৃষ্টি করে থাকে। এটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, ‘স্টেশন চিফ’ বা ‘কেস অফিসারের’ (অপারেশনের প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়) সাধারণ কার্যপ্রণালী, যেখানে তিনি দূতাবাসে, হাইকমিশনে বা কনস্যুলেটের কোনো কর্মকর্তার পরিচয়ের আড়ালে কাজ করে থাকেন, সেখানে তাঁর গৃহীত এই ‘আড়াল’ (Cover) অপারেটিভদের এসপায়োনেজ সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে বিশেষভাবে সাহায্য করে।

‘স্টেশন চিফের’ কূটনৈতিক কাভার একটি সুনির্দিষ্ট ও উল্লেখযোগ্য সুবিধাজনক অবস্থান সৃষ্টি করে। এ পদ্ধতি পৃথিবীর প্রায় সকল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিই অনুসরণ করে থাকে। কূটনৈতিক ছদ্মাবরণ শুধু ‘কূটনৈতিক ব্যাগে’র (Diplomatic Bag) সুবিধা গ্রহণেই সহায়তা করে না বরং এমন সব ‘নিষিদ্ধ’ জায়গায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে, যা অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়। এ সব কর্মকাণ্ডের ফলে অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম ও ততোধিক বন্ধুপ্রতিম নয় এমন সব দেশের ইন্টেলিজেন্স প্রধানদের সাথে যোগাযোগ এবং সমন্বয় সহজ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে আলাপ-আলোচনা রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে যোগাযোগ এবং সমন্বয়ও সহজ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে আলাপ-আলোচনা রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে সংঘটিত আলোচনার নীতিমালা অনুসরণ করে চালিয়ে যাওয়া হয়। সকল দেশই এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে থাকে। পারস্পরিক সুবিধার উপর নির্ভর করে তারা এ ধরনের কার্যক্রম অস্বীকার করে বসতে পারে। ‘র’ এর সাথে উন্নত ও অনুন্নত উভয় প্রকার দেশের যে সমস্ত ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির যোগাযোগ রয়েছে তা কখনই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না। এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়, যাতে ‘জন সমালোচনার পরিস্থিতির উদ্ভব হলে একপক্ষ আরেক পক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার কথা সহজেই অস্বীকার করার সুযোগ পায়।

সময় বিশেষে একজন রাষ্ট্রদূত অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যোগসূত্র উপস্থাপন করতে পারেন। ১৯৭১ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এমনও হয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের পার্শ্ববর্তী কোনো একটি দেশের ‘স্টেশন চিফ’ সমগ্র যুদ্ধাকালীন সময়ে পাকিস্তানী ইন্টেলিজেন্স পরিচালকের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছিলেন। এর উদ্দেশ্যে ছিল যে, জনসমক্ষে কোনো কিছুর প্রকাশ না ঘটিয়ে, যুদ্ধরত যে কোনো পক্ষ যদি শান্তিপূর্ণ সমাধানে এসে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়, তবে তার ব্যবস্থা করা। নিয়াজী আত্মসমর্পণে রাজি হওয়ার পর ‘র’-এর অফিস হতেই আত্মসমর্পণের চুক্তিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ ধরনের সমন্বয়ের ফলে কনফারেন্স টেবিলে যাওয়া বা রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে সরাসরি উন্মুক্ত বৈঠকি সংঘর্ষের ঝুঁকি এড়িয়ে চুক্তিতে উপনীত হওয়া সহজ হয়েছিল। যদি ইন্টেলিজেন্স চ্যানেলগুলো উন্মুক্ত রাখা যায় তবে এ ধরনের আলাপচারিতা বা সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া সুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। আর যদি তা ব্যর্থ হয়ে যায় (যা যে কোনো সময় হতে পারে) তবুও তাতে হারাবার কিছু নেই।

কোনো কোনো সময়ে যেখানে পরিস্থিতি হয়তো অন্যরূপ জটিল আকার ধারণ করতে পারতো, সেখানে অনেক অনাকাঙ্খিত অপ্রস্তুত অবস্থা হতে উপরোক্ত পদ্ধতিতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়। এ ধরনের এক ঘটনায় ‘কাশ্মীর প্রিন্সেস’ নামে ‘এয়ার ইন্ডিয়ার’ একটি বিমান হংকং থেকে ম্যানিলা যাবার পথে আকাশে বিস্ফোরিত হয়েছিল। ওই বিমানটিতে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর বান্দুং কনফারেন্সে যাবার কথা ছিল। ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো বিমানে সম্ভাব্য অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার ব্যাপারে আশঙ্কাজনক বেশকিছু খবরা-খবর জানতো। চীনা প্রধানমন্ত্রী ওই ঘটনা ঘটার সময় তাই অন্য বিমানে ভ্ৰমণ করছিলেন। এ ঘটনায় চীনাদের মনে সম্ভাব্য অন্তর্ঘাতকদের ব্যাপারে বেশ সন্দেহের উদ্রেক করে। আই বি’র বৈদেশিক ডেস্কের একজন কর্মকর্তাকে তাই ঘটনা তদন্ত ও এর পিছনের মূল নায়কদের চিহ্নিত করার জন্য হংকং পাঠিয়ে দেয়া হয়। ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স ও হংকং পুলিশের সহযোগিতায় আই বি’র কর্মকর্তা অন্তর্ঘাতের কারণ ও এর সাথে সংযুক্ত লোকদের চিহ্নিত করতে সমর্থ হন। এর পরপর খুব শীঘ্রই তাঁকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ব্যক্তিগত দূত হিসেবে চীনা প্রধানমন্ত্রীর নিকট আসল ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য পিকিং-এ পাঠানো হয়। অন্তর্ঘাতকরা তাইওয়ানী এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়, যারা ‘চো-চো’ নামে এক চীনাকে হংকং-এর ‘কাইটাক’ বিমানবন্দরে ‘এয়ার ইন্ডিয়ার’ বিমান অবতরণের পর বিমানের কার্গো হোল্ডে বোমা পাতার জন্য নিযুক্ত করেছিল 1 তদন্তের ধারাবাহিকতায় চো চো যখন ম্যাকাও যাবার ফেরিতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিল তখন সে ধরা পড়ে যায়।

আই বি’র কর্মকর্তার সাথে চৌ এন লাই-এর আলোচনা দীর্ঘ দু’ঘণ্টা পর্যন্ত চলে এবং শেষ পর্যায়ে তিনি চীনা প্রধানমন্ত্রীকে প্রকৃত ঘটনা বোঝাতে সক্ষম হন। তখন এমন একটা সময় ছিল যখন চীন-ভারত সম্পর্ক ছিল কিছুটা ‘নাতিশীতোষ্ণ’ পর্যায়ের, সেখানে তিব্বতে চীনের সার্বভৌমত্ব ছিল নিরেট বাস্তবতা ও ভারত কোরিয়া নিয়ে চীন-মার্কিন যুদ্ধ এড়ানোর মধ্যস্থতায় নিয়োজিত ছিল। চৌ এন লাই এ সময় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে এম পানিক্কার-এর সাথে সাক্ষাতকালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর শান্তি প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ও এ কথা প্রকাশ করেন যে, মার্কিনিরা ৩৮তম সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করলে চীন-কোরিয়া যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে। এভাবেই যে ঘটনা গোটা পৃথিবীতে সাংঘাতিক এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারতো তা সাফল্যজনকভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব হয়।

যদিও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয় (Ministry of External Affairs = MEA) খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্স সংস্থা’ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লোকজনের সাথে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা দেশের স্বার্থে একান্ত ভাবে প্রয়োজন তবুও তারা এ ব্যাপারটি ক্রমাগত অবহেলা করে আসছে। এ সমস্যাটি তাদের নিজেদের সাথে নিজেদের ফাঁকি দেয়ার প্রবণতার জন্য তৈরি হয় যেখানে তারা মনে করে যে, এ সমস্ত কাজ কারবার তারা নিজেরাই সহজে করতে পারবেন এবং তারাই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট। সম্ভবত চীনা ও রাশিয়ানরা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই তাদের দেশের বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির সাথে বৈরী আচরণ করে থাকে। এ সমস্যার উৎপত্তি হয় কিছু মনস্তাত্ত্বিক ভাব প্রবণতার জন্য, যেমন কোনো দূতাবাসের পররাষ্ট্র বিভাগীয় লোকজন মনে করেন যে, তাদের সাথে সংযুক্ত ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভ তাদের পদদলিত করে অনুপযুক্ত, অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সুযোগ- সুবিধা ভোগ করেন বা বিনা পয়সায় মদ, ডিউটি ফ্রি গাড়ি ও ডিউটি ফ্রি দোকানের সুবিধা আদায় করে নেন এবং তারা যত্রতত্র মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াতে পারেন যা তাদের ক্ষেত্রে অতটা ঝামেলামুক্ত ব্যাপার নয়।

ভারতে এ পরিস্থিতি সাধারণ কারণগুলো ছাড়াও এর থেকে আরেকটু ‘খারাপ’ পর্যায়ের এবং এর মূল নিহিত হচ্ছে ইতিহাসে। আসল ঘটনা হচ্ছে যে, মূল বৈদেশিক গোয়েন্দা সংগঠন অর্থাৎ আই বি’র বিদেশ সংক্রান্ত ডেস্ক গড়ে তোলা হয়েছিল মুখ্যত পুলিশ বাহিনীর (Indian Police Service বা IPS) সদস্যদের নিয়ে যাদের সিভিল সার্ভিসে ভারতীয় পররাষ্ট্র ক্যাডারের চেয়ে নীচু শ্রেণীর সার্ভিস বলে মনে করা হতো এবং এ নিয়ে তখন থেকেই অনেকে ‘ভ্রূ কোচকানো’ শুরু করেন। বাস্তবে ভারতীয় পুলিশবাহিনীতে ঢোকা বৈদেশিক সার্ভিসে (IFS) অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে সোজা হওয়ায় বৈদেশিক সার্ভিসের লোকজন এ ক্ষেত্রে তাদের প্রাধিকার দেয়া হবে বলে ভেবেছিলেন।

এ ছাড়াও অবশ্য অন্য আরো অনেক কারণের মধ্যে বৈদেশিক সার্ভিসের লোকজনের ঝুলিতে বিভিন্ন কলংকের বোঝা জমা হওয়া ও এমনকি তাদের কেউ কেউ কোনো কোনো সময় ভাসাভাসা ভাবে মস্কোর মতো জায়গাতেও চোরাকারবারে জড়িয়ে পড়াও ছিল অন্যতম।

বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন প্রাথমিক পর্যায়ে আই বি থেকে আসার কারণে বৈদেশিক সার্ভিসের লোকজন ভারতে শুরু করেন যে, তারা (IB) আসলে তাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি চালানোর জন্যই নিয়োজিত হয়েছেন এবং ইন্টেলিজেন্স লোকদের দুর্দম সৎসাহসকে তারা তাদের নিজস্ব সাম্রাজ্যে হস্তক্ষেপ বলে ঘৃণার চোখে দেখা শুরু করেন।

এ অন্তর্জালা কখনো কখনো দাবানলের মতো জ্বলে উঠতো, বিশেষ করে যখন ‘র’ এসপায়োনেজের মূল শাখায় পরিণত হয় এবং মাঠ পর্যায়ে নতুন বিধি বিধান প্রণয়ন করা হয়। ‘র’-অপারেটিভদের ব্যবহারের জন্য ভিন্ন কূটনৈতিক ব্যাগ এবং সিলমোহরকৃত রিপোর্টসমূহ নতুন করে ‘র’ কর্মকাণ্ডের ওপর গোপনীয়তার আলাদা চাদর পরিবেষ্টন করে। নিজস্ব এলাকার বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনা সংক্রান্ত সাধারণ পর্যালোচনা ‘র’ ও বৈদেশিক অফিস উভয়কেই উচ্চ পর্যায়ে জানাতে হতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘র’-এর প্রস্তুতকৃত রিপোর্ট, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব চ্যানেলের (দূতাবাস হতে) আমলাতান্ত্রিক লালফিতার প্যাচে পড়া রিপোর্ট হতে অনেক দ্রুত দিল্লীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পৌঁছে যেতো। এটা বৈদেশিক সার্ভিসের লোকজনের জন্য ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’র মতো বিবমিশা সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কোনো কোনো সময় ‘র’-ও এর পূর্বের প্রতিষ্ঠানে কিছুটা অদক্ষতা ও দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। পুলিশ ক্যাডার সার্ভিস হতে আসার ফলে এ সংস্থার অপারেটিভরা তখন কূটনৈতিক ধারার জীবনযাপন বিশেষভাবে মিশ্রিত শ্রেণীধারার’ আবর্তে নিজেদের অপ্রস্তুত বোধ করতেন। অসামঞ্জস্যতা ও ভুলত্রুটিগুলো সহজে চোখে পড়ায় সে অপারেটিভকে লক্ষ্য করে অসহনীয় পর্যায়ের রুক্ষ কৌতুক করা হতো, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে না বুঝেই দেশদ্রোহিতামূলক ভাব প্রবণতাকে উস্কে দিত। হয়ত দেখা যেত যে, অপারেটিভের ছদ্মাবরণ উন্মোচনকারী প্রথম ব্যক্তি হচ্ছেন একজন পেশাদার কূটনীতিক এবং তিনি উন্মুক্ত স্থানে “সাবধান ও একজন গুপ্তচর” এ কথাটি ব্যঙ্গচ্ছলে উচ্চারণ করে ওই ‘মহৎ কর্মটি’ সমাধা করতেন। “দ্বিতীয় শ্রেণীর কূটনীতিবিদ” অপবাদে অপারেটিভরা সকলের বিদ্রুপের পাত্রে পরিণত হতেন, কারণ তারা একজন প্রকৃত দক্ষ কূটনীতিকের আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন না।

যখন ‘র’ গঠন করা হয় এবং এ সংস্থার লোকজন ১৯৬৯ সালে সরাসরি শুধু প্রধানমন্ত্রীর নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন তখন পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় (MEA ) গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক কায়দায় তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। নতুন পদ্ধতিতে ‘র’-এর লোকজন যেখানে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে রিপোর্ট করত সেখানে বৈদেশিক দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে রিপোর্ট পেশ করতেন, যিনি পরবর্তীতে প্রয়োজনানুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে সে ব্যাপারে অবহিত করতেন। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলেও তা ছিল সাময়িক একটি ব্যাপার। পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউলের সাথে ‘র’- প্রধান আর, এন, কাও-এর বিশেষ ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি বৈদেশিক অফিসসমূহে বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্স শাখার গুরুত্ব অত্যন্ত ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন যা তাঁর অধীনস্তদেরও তদনুযায়ী কাজ করতে উৎসাহ জোগায়। কিছু রাষ্ট্রদূত যারা বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাজ কারবার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন তাঁরাও অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আপা, বি, পান্থ যিনি ইংল্যান্ড ও ইতালীতে কর্মরত ছিলেন এবং জি পার্থসারথি, যিনি পাকিস্তান ও চীনে নিয়োজিত ছিলেন, এ দু’জনেই ‘র’ অপারেটিভদের অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন ও তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে বিভিন্ন অপারেশনে নিয়োজিত ছিলেন। এ সহযোগিতা অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে বিবেচিত হয় ও পান্থ এবং পার্থসারথিকে ‘র’-অফিসারদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। এরূপ আরেকজন উল্লেখযোগ্য কূটনীতিবিদ ছিলেন ডি,পি, ধর যিনি ‘র’-এর কার্যক্রম সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধিৎসা ও উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। ধর, কাও ও মানেকশ’ ‘বাংলাদেশ অপারেশনের’ সময় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন।

অন্য যে কোনো চাকরিতে দেশের জন্য ভালো কিছু করার জন্য পুরস্কার ও পদক পাওয়া যায় কিন্তু ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির অপারেটিভ ও এজেন্টরা লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকেন ও কোনো পদক তাদের ভাগ্যে জোটে না। তাদের অবদান সকলের অনবহিত থেকে যায়।

বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস সম্পর্কে কিছু রাষ্ট্রদূত ও এ ধরনের কিছু ব্যক্তির স্বভাবগত ‘এলার্জি’ কিছুদিন চাপা পড়ে থাকে। কিন্তু জনতা সরকারের ক্ষমতারোহনের সাথে সাথে ‘র’ বিরোধী প্রচারণা পুনরায় তুঙ্গে ওঠে। পুরানো অবচেতন ঘৃণার আগুন প্রজ্বলিত হয়। পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় (MEA) আবারো ‘উল্টো ঘুরে’ তাদের মন্ত্রীকে ‘র’-এর কার্যক্রম ‘অত প্রয়োজনীয় নয়’ বলে বোঝাতে সচেষ্ট হন।

‘দুই মহারথী’র (কাও এবং নায়ার) বিদায়ের পর দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের আপাত সমাধান কল্পে অনুভূত হয় যে, পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহের ব্যাপারে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। ‘র’-প্রধান একধাপ পদাবনতির পর তাঁর এক হাত পিঠে বাঁধা অবস্থায় কেবিনেট সচিবের কাছে সকল ব্যাপারে রিপোর্ট পেশ করতেন, যিনি বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কে বেশিকিছু জানতেন না বলেই অনুমিত হয়। এরপর আবার পটপরিবর্তনের সাথে সাথে নীতিমালার পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৯৮০ সালের ৯ জানুয়ারিতে কংগ্রেস (আই) সংসদে দুই- তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে পুনরায় সরকার গঠনে সমর্থ হয়।

সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে দু’টি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে; পি এল ও কে পূর্ণ কূটনৈতিক মর্যাদা প্রদান করা হয় ও ইয়াসির আরাফাত দিল্লী সফরে আসেন এবং এর দু’দিন পর ১৯৮০ সালের ৮ জুলাই ভারত কম্পুচিয়াকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এ উভয় ঘটনা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করায় শীঘ্রই পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার প্রয়োজন অনুভূত হয়, কিন্তু তারপরও অবস্থার প্রেক্ষিতে ভারতকে তার পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্ৰণালয় ও এর বৈদেশিক দপ্তরের কর্মচারীদের পর্যালোচনার ওপর সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *