১০. বিশাখজ্যোতি

১০. বিশাখজ্যোতি

শিবিরের মশালগুলি এখনও দীপ্যমান। কুরুক্ষেত্রের সংশপ্তক সেনাদলের অন্যতম সেনাধ্যক্ষ বিশাখজ্যোতি। কৃষ্ণের নির্দেশেই নারায়ণী সেনা পক্ষ নিয়েছিল দুর্যোধনের। প্রায় কেউই আর জীবিত নয়। যুবরাজ দুর্যোধন। রক্তাপ্লুত অবস্থায় রক্তবমনে মারা গেলেন। তাঁর সমীপে তখন ছিলেন দ্রোণাচার্যপুত্র অশ্বত্থামা।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ তখন প্রাচীন হয়েছে। পাণ্ডবেরা নিরঙ্কুশ সিংহাসনে। অভিষিক্ত হয়েছেন। শত্রুপক্ষ নিঃশেষিত। তবুও দ্বারকা নগরীতে দিবালোকে প্রত্যাবর্তন করার সাহস নেই বিশাখজ্যোতির। গুরুদেব অর্কজ্যোতি রয়েছেন কারাগারে। তিনি তখনও চার্বাকদর্শনের প্রতিষ্ঠা আশা করেন। সেদিন নগরীতে সংবাদ পেয়েছেন বিশাখজ্যোতি, কৃষ্ণ তাঁকে খুঁজছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর জীবিত নারায়ণ? সেনাদলের কেউ এখন তাঁর মিত্র নন। তিনি কি বিশাখজ্যোতিকে দণ্ড দিতে চান? অপালার কাছে কেশব দূত প্রেরণ করেছিলেন। পুত্র রূপজ্যোতির জন্য পাঠিয়েছিলেন বহুমূল্য উপহার।

কেন তিনি তাঁকে খুঁজছেন? পঞ্চপাণ্ডবদের পুত্রদের নিহত করার সংকল্প নিয়েছিলেন অশ্বত্থামা একা, কোনো ভূমিকা সেই হীনকার্যে বিশাখজ্যোতির ছিল না। তবুও তিনি দীর্ঘদিন মগধ দেশে ছদ্মবেশে ছিলেন।

দিনে দিবাকর তপ্ত হলেও রাত খুব সুখদায়ক। অপালার চন্দনচর্চিত ত্বকের স্পর্শ পেতে হৃদয় উন্মুখ হয়ে রয়েছে। যোনিদ্বারে জিহ্বা লেহন করে অভিমানপর্ব ভাঙতে হবে। নারায়ণী সেনারা ছিলেন অজেয়। কৃষ্ণের চেয়েও দ্বারকাবাসী উন্মুখ ছিল বিজয়ী নারায়ণী সেনাদের প্রত্যাগমনে। বরাবরই সংবর্ধিত হয়ে এসেছে এই সৈন্যদল। এখন দ্বারকা নগরী জুড়ে ব্যাপ্ত অমানিশা। পুরুষেরা কর্মহীন, মাধ্বী সেবনেই তারা অপগত করছেন আয়ু। কৃষ্ণের বিরোধিতায় ধিক্কার উঠছে আকাশে বাতাসে। রাজপুরুষদের অধিকাংশ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। কিছু নপুংসক এখনও কৃষ্ণের জয়ধ্বনি করছে। এরাই রাতে কৃতকর্মের অনুশোচনার কারণে মাধ্বী সেবন করে। নিষাদ শ্রেণিভুক্তদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, কারণ রাজ্য জুড়ে প্রঘোষণ রয়েছে ওদেরই কারও হাতে নিহত হবেন কৃষ্ণ। কংসের মতো বীরকে যিনি পরম চাতুর্যে হত্যা করেছিলেন বালক বয়সে এবং অবলীলায় ভীমসেনকে দিয়ে হত্যা করিয়েছিলেন জরাসন্ধকে– তাঁর কাছে বিশাখজ্যোতির নিধন খুব গৌণ প্রয়াস। নিহতকে হত্যার মুহূর্তেও তিনি অমায়িক সম্ভাষণ করেন। পাপ-পুণ্যের যাবতীয় নির্ধারক তিনি। তাঁর সহচর বলরাম আরও নিষ্ঠুর। মাধ্বী সেবনে ওঁর নয়ন সর্বদাই আরক্ত থাকে। ভয় হয় পুত্র রূপজ্যোতির জন্যও। রমণীমোহন যুবক সে। বিদ্যার্থী এবং অস্ত্রচালনায় নিপুণ।

কৃষ্ণের কোনো অভিপ্রায়ই বিনা স্বার্থে পরিচালিত হয় না। কেন তিনি খুঁজছেন বিশাখজ্যোতিকে! এই চিন্তাটা বার বার প্রশ্রয় পাচ্ছে মস্তিষ্কে। এই সময় বোধ হয় মধুমাস, বসন্তকাল। বৃক্ষের তলদেশ শুষ্কপত্রে আকীর্ণ। গুরুদেব অর্কজ্যোতি জ্যোতিষশাস্ত্র অবজ্ঞা করেন। তিনি একমাত্র স্বীকার করেন জ্যোতির্বিদ্যা। তিনি বলেন নক্ষত্রও অজর, অমর কিছু নয়। তাদেরও ধ্বংস, নিবৃত্তি প্রভৃতি রয়েছে। কৃষ্ণও দেবতা নন। তিনি মূলত পার্থসখা। তিনি যুগের অগ্রগমন চান না। তিনি প্রাধান্য দেন ব্যক্তিস্বার্থকে, পাণ্ডবদের স্বার্থকে। তবে তিনি পারঙ্গম ছিলেন এই যুদ্ধ, এই লোকক্ষয় নিবৃত্ত করতে। তিনি তা করেননি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ তাকে নতুন অভিধা দিয়েছে। তিনি চার্বাককে ঘৃণা করতেন অথচ তিনি অনেকটাই জানেন। গ্রহবিজ্ঞানও তাঁর করায়ত্ত। এককালের গোপালক হয়েও তিনি জনপদের চরিত্র নন। কোনো কিছুই শাশ্বত নয়, অবিনশ্বর নয়। জন্ম-মৃত্যুর খেলা চলেছে কল্পিত দেবলোকেও। এইসব বলার কারণে অর্কজ্যোতি কারাগারে বন্দিদশা কাটাচ্ছেন। তিনি স্পষ্টবাক কিন্তু ধুরন্ধর। পুত্র রূপজ্যোতি ওঁর ভবিষ্যৎ। তিনি ওকে দীক্ষা দিয়েছেন, ওঁর অদ্ভুত ভাবনার ঋত্বিক করেছেন অর্কজ্যোতিকে। সেও নিশ্চয় কৃষ্ণরোষে বিপন্ন। প্রাথমিকভাবে কৃষ্ণ যাবতীয় পরিস্থিতি উপলব্ধি করে রূপজ্যোতির জন্য উপহার প্রেরণ করেছেন। মৈত্রীর শেষ আবেদন। কৃষ্ণের একান্ত প্রিয় মৃত্যু-মৃত্যু খেলা। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, ‘জয়ের জন্য গর্ব কোরো না। কৌরবরা ছিল মহাবীর। ওদের পরাজয় ছিল অসম্ভব। আমার কারণেই এটা সম্ভব। হয়েছে।

অশ্বের গতি বাড়ান বিশাখজ্যোতি। ধুলায় কীর্ণ প্রাচীন পথ। রাজপথে নাগরিকেরা বিজয়ী সৈন্যদলকে সংবর্ধিত করে, সে এক অসাধারণ মুহূর্তের দ্যোতনা। কৃষ্ণের নির্দেশেই পাণ্ডবেরা বিজয় উৎসব করেননি এবং লুক্কায়িত থেকেছে নিহত অগণিত পরিবারবর্গের বিলাপ। নারীরা অনেকেই গণচিতায় সহমরণে গিয়েছে। অপালারও হয়তো নিয়তি ছিল তাই। তিনি ভাগ্যক্রমে জীবিত রয়েছেন। পলক্ষেপের ব্যবধানে তিনিও শত্রুর কোষমুক্ত তরবারির শীতল অনিবার্য মৃত্যুমুখ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। স্বয়ং প্রত্যক্ষ করেছেন বৃকোদর কী অসম্ভব প্রতিহিংসায় দুঃশাসনের বক্ষ দীর্ণ করে রক্তপান করছেন। কৃষ্ণ উপভোগ করেছেন সেই দৃশ্য, কারণ তিনিও দ্রৌপদীর একান্ত সুহৃদ। বহুবল্পভা সেই নারী যিনি কিনা গণিকার চেয়েও শ্ৰেয় জীবনযাপন করেন তিনিই এই সভ্যতার পরিচালিকা। অনাথবতীর কৃত্রিম বিলাপে, অভিমানে এই সমূহ রক্তক্ষয়। দীর্ঘযুদ্ধে রাজকোষ শূন্য। রাজস্বের কারণে পীড়নে প্রজারা গৃহহারা। দ্বারকার প্রাসাদে বসবাসকারী কৃষ্ণস্তু ভগবানের উপর ঘৃণা জন্মায় বিশাখজ্যোতির।

.

১১. অর্কজ্যোতি

এই কারাগারের অভ্যন্তরে ‘উৎকোচ’ খুব আদরণীয় বস্তু। হত্যার অভিযোগে দণ্ডিত অপরাধীও রাজসুখ ভোগ করে। আর নিঃস্ব বৃদ্ধ জ্যোতির্বিদ অর্কজ্যোতিকে নিদারুণ কায়িক শ্রম দিতে হয়। তিনি এতে ব্যথিত ছিলেন।, সম্মানহীনও মনে করতেন না। এই বয়সেও ওঁর আসুরিক শক্তি। স্বল্পাহারে তিনি অভ্যস্ত। কৃষ্ণ কৌন্তেয় অর্জুনকে বলেছিলেন, ‘ন মাং কর্মানি নিষ্পন্তি ন মে কর্মফলে স্পৃহা। ইতি মাং যোহভিজানতি কর্মভির্ন। স বধ্যতে।’ অর্থাৎ কোনো কর্মের দ্বারাই তিনি প্রভাবিত নন আর তিনি কোনো কর্মফলেরও আকাভক্ষা করেন না। আর তাঁর এই তত্ত্ব যিনি জানেন, তিনি কখনো সকাম বন্ধনে আবদ্ধ হন না। তবে অর্কজ্যোতিও তো তাই। তিনিও তো ফলের আশা করেন না। যস্য সর্বে সমারম্ভাঃ কামসংকল্পবর্জিতঃ। জ্ঞানাসিদ্ধকৰ্মানং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ। যাঁর সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টা কাম ও সংকল্পরহিত; তিনি পূর্ণজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সমস্ত কর্মের প্রতিক্রিয়া পরিশুদ্ধ জ্ঞানাগ্নি দ্বারা শুদ্ধ হয়েছে।

চমৎকার দ্বন্দ্বে রয়েছেন অর্কজ্যোতি। কৃষ্ণের দ্বৈত সত্তায় কেমন যেন বিভ্রান্তি আসে।

অতি প্রত্যূষে বন্দিদের সম্পূর্ণ নগ্ন করে প্রতিদিনই প্রাঙ্গণে আনা হয়। কারাগৃহের প্রাঙ্গণশাখায় নানা প্রকার ক্রীড়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। বারাঙ্গনাদের পরিত্যক্ত পীঠমর্দেরা এখানে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে রয়েছে। সবটাই রাজাজ্ঞা। এই কৃষ্ণ আর দার্শনিক প্রবচনে পটু কৃষ্ণ এক নন। কারারক্ষী কৃষ্ণের সাক্ষাতের পরই তাঁর প্রতি বিনম্র ব্যবহার করছেন। কায়িক শ্রম থেকেও তিনি নিষ্কৃতি পেয়েছেন। নিরাশীৰ্যতচিত্তাত্মা ত্যক্তসর্বপরিগ্রহঃ। শারীরং কেবলং কর্ম কুর্যন্নাপোতি কিলিষম্।

জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁর মন ও বুদ্ধিকে সর্বতোভাবে সংযত করে। তিনি প্রভুত্ব করার প্রবৃত্তি পরিত্যাগ করে কেবল জীবনধারণের জন্য কর্ম করেন। কারারক্ষীর কণ্ঠস্থ কৃষ্ণের যাবতীয় প্রবচন। আজকাল প্রায়ই তাকে শোনানো হয়। হয়তো উদ্দেশ্য পূঢ় কিছু। অভিপ্রায়ও ভিন্ন নয়। তবে তিনিও অবাক হচ্ছেন এই গোপালকের পাণ্ডিত্যে। সত্যিই কি অর্কজ্যোতি সঠিক দিশায় চলেছেন? কৃষ্ণের মুখমণ্ডলে সেদিন বিষাদের ছায়া ছিল যেমন কবিদের হয়ে থাকে। দুস্তর ব্যবধান রেখেছিলেন অর্কজ্যোতিও। ব্যাসদেবের আশীর্বাদে সঞ্জয় নাকি দিব্যচক্ষু প্রাপ্ত হয়েছিলেন। গৃহে উপনীত থেকেও ধৃতরাষ্ট্রকে শুনিয়েছিলেন কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের ইতিবৃত্ত। এইসব কল্পকথা অর্কজ্যোতি কখনো বিশ্বাস করেননি, কিন্তু কৃষ্ণের আগমনের পর থেকেই তাঁর নিজের সঙ্গেই ছায়াযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তিনি কেশবকে অস্বীকার করতে যেন ক্রমশ অপারগ হয়ে উঠছেন। কোনো বিভা যেন তাঁর দর্শনে রয়েছেই। মুদ্রার বিনিময়ে এক কৃষ্ণাঙ্গী বারাঙ্গনার কাছ থেকেই রাতের আকাশের পাঠ শিখেছিলেন অর্কজ্যোতি। কারাগারের মহাপার্শ্বরা তাঁর চেনা। এখানে। তারা সুহৃদের মতোই আচরণ করে।

শত্রাজিৎ এরকমই একজন মহাপার্শ্ব। বরাদ্দকৃত অন্ন গ্রহণ করার সময় উন্মুক্ত আকাশ দেখা যায়। প্রান্তর-প্রাঙ্গণে আনয়ন করা হয় বন্দিদের। শত্রাজিৎ এগিয়ে এসে অর্কজ্যোতির কানের কাছে মুখ রাখলেন।

–কাল প্রভাতেই বন্দিরা সবাই মুক্তি পাবেন।

–হঠাৎ এই দয়াভিক্ষা।

–দ্বারকা নগরীতে কলি প্রবেশ করেছে। ওর ভয়ংকর মূর্তি দেখে নারীরা মূৰ্ছা যাচ্ছে।

–আর পুরুষেরা?

–নিহত হচ্ছে। বন্দিদের মুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলেন রাজা উগ্রসেন।

–প্রকৃত প্রস্তাব কার?

–ভদ্রে, আপনি তো জানেন। সূচনা সবটাই কৃষ্ণের দেওয়া। উগ্রসেন আজ্ঞাবহ মাত্র।

–বন্দিরা মুক্তি পেয়ে কী করবে?

–ব্যাবসা এবং রাষ্ট্রের সেবা।

–তাদের চরিত্রের পরিবর্তন কি এর দ্বারা সম্ভব?

–আমি জানি না। তবে দ্বারকা নগরী যেখানে অরক্ষিত, বন্দিশালা রেখেই-বা কী লাভ?

–সঠিক কথা। কৃষ্ণ কি কারাগার পরিদর্শনে আসবেন?

–আসবেন। গভীর রাত্রে তাঁর আগমন ঘটবে। সম্ভবত তিনি আপনার কাছেই আসবেন।

বিভিন্ন দণ্ডাজ্ঞা ভোগকারী বন্দিদের মধ্যে অর্কজ্যোতির অপরাধ ছিল রাতের আকাশের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে একটি উচ্চারণ: ‘সূর্য একটি মধ্যভরের নক্ষত্র মাত্র।

ব্যাপক আলোড়ন উঠেছিল রাজসভায়। ইন্দ্রপ্রস্থেও সংবাদ পৌঁছে যায়। কৃষ্ণের ভগবৎদর্শনকে প্রত্যক্ষভাবে অস্বীকার। ভগবান নাকি সূর্যদেবকেই প্রথম সৃষ্টিরহস্য বলেছিলেন। সপ্ত-অশ্বের আরোহী তিনি সূর্যদেব।

রাতের অন্ধকারে সত্যিই কৃষ্ণ এলেন অর্কজ্যোতির কাছে। পীতবস্ত্র ধারণ করেছেন তিনি। অর্কজ্যোতি কেশবকে প্রণাম করলেন।

–আগামীকল্য মুক্তি পাচ্ছেন।

–কারাগৃহ শূন্য হয়ে যাবে।

–রাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠিরের অভিপ্রায়।

–আপনিও স্বীকার করেছেন, কেন? যাদবকুল ধ্বংসের মুখে উপনীত হয়েছে বলে?

৫২

–সত্যের পরিভাষা কী?

–একেক জনের কাছে একেক রকম।

–ঠিক তাই।

–আপনি কি সেটা সম্মান করেন!

–এই কারণেই আমার আসা। আচার্য অর্কজ্যোতি, আপনার জয় হল।

–কেন?

–বন্দিরা মুক্তি পেলেন।

–জয় বা সত্য কি সমার্থক, কেশব?

–সত্যের উচ্চারণে প্রত্যয় থাকে।

–আর স্পর্ধা।

–আবশ্যক নয়।

–সৃষ্টিরহস্য কি আপনার করায়ত্ত?

–এতে কারও সংশয় নেই।

–স্বয়ং আপনার রয়েছে, কারণ ধ্বংসোন্মুখ যাদবকুলকে তবে আপনি রক্ষা করছেন না কেন?

–যাদবেরা আমায় কখনো অনুসরণ করেনি। তারা নিজেদের মতোই চলেছে।

-সখা পার্থ তো আপনাকেই অনুসরণ করেছিল। সে তো এখন নির্বীর্য।

–সময়ের জালে কৃষ্ণ স্বয়ং বন্দি।

–তবে কালই তো ঈশ্বর।

–কালের ঘূর্ণন অমোঘ, তবে তার নিজস্ব কোনো দর্শন নেই। তার কোনো অবয়ব নেই।

–মাত্রা তো রয়েছে।

–আমি তা বরাবর নির্ধারণ করে এসেছি। জন্মের কল্পস্তর থেকে।

–এটা আপনার কল্পনা।

-কল্পনা জ্ঞানের চেয়েও অগ্রগামী। আপনার জ্ঞানে সেই কল্পনা নেই? তাই ঈশ্বরও নেই।

–সত্য তো রয়েছে?

–যেটুকু প্রত্যক্ষ তার মধ্যেই সেই সত্য সীমাবদ্ধ। আর আমার সত্য প্রসারিত।

–তবে সেই সত্য দিয়ে রাধাকে ব্রাত্য করলেন কেন?

–চিরায়ু করেছি তাকে। তিনি আমার কল্পনার রং।

–সূর্যদেবতারও দুই প্রান্তে দুটি রং রয়েছে।

–উষা নির্গত হওয়ার আগে আমাকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

–আমার প্রণাম গ্রহণ করবেন।

–ব্যাবসা বা রাষ্ট্রের সেবা– আপনি কোনটি গ্রহণ করবেন।

–রাষ্ট্রের সেবা।

কৃষ্ণ হাসলেন।

–রাষ্ট্রদ্রোহিতা!

–সত্যের পরিভাষা একেক জনের কাছে ভিন্ন ভিন্ন।

–আচার্য, আমায় বিদায় দিন।

–হে মহাজ্ঞানী, পুনর্বার আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। কৃষ্ণ অর্কজ্যোতিকে আলিঙ্গনে বদ্ধ করলেন।

তখন অর্কজ্যোতি কৃষ্ণকে বললেন, ‘পার্থকে আপনি বলেছেন আপনার থেকে শ্রেষ্ঠ কেউ নেই। ‘ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগনাইব।’ অর্থাৎ ‘সূত্রে যেমন মণিসমূহ গাঁথা থাকে, তেমনি সমস্ত বিশ্বই আপনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে।’

–আসলে আমি সেই পরমেশ্বরকে জানি, যার থেকে সত্য আর কিছু নেই। তিনি ক্ষুদ্রতম থেকে ক্ষুদ্রতর এবং মহত্তম থেকে মহত্তর। তিনিই পরমব্যোমকে আলোকে বিস্তার করেন, আবার তিনিই বৃক্ষের মতো মৌন।

অর্কজ্যোতি এবার প্রণাম মন্ত্রের মতোই উচ্চারণ করলেন:

‘নিতো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্।
একো বহুনাং যো বিদধাতি কামান্।‘

–আপনিই কি তবে এক থেকে বহু হয়েছেন?

–আপনার বিজ্ঞানও তাই বলে। ভস্মীভূত দেহ মাটিতে মিশে যায়– এটা কোনো বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের অহংকার মাত্র। আপনার মতোই জগতে সকলে একে প্রত্যক্ষ করছে। মায়ার দ্বারাই আপনার স্মৃতিবাহী। চেতনা লুপ্ত হয়েছে আর আপনি এবং চার্বাক বলছেন, ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতাঃ। বিজ্ঞানের তো কোনো ছেদরেখা নেই, সে তো অনন্ত।

–কিন্তু কেশব, আপনার কথাগুলিও তো অপ্রমেয় নয়।

–’বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্মাং প্রপদ্যতে।‘ আসলে বহু বহু জন্মে ভগবদ্ভক্তি সাধনা করার পর বিশুদ্ধ ভক্তি জন্মে। আমার সখা পার্থের তাই ছিল। আপনি যে কারাবাস করেছেন সেটা কি অপ্রমেয়?

–আমি তো প্রত্যক্ষ জ্ঞান থেকে বলেছি।

–প্রত্যক্ষ জ্ঞানের মধ্যে কি সংশয় থাকে না?

–সেখানে সংশয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই।

–তার প্রমাণও আমাকেই দিতে হবে?

–হ্যাঁ। দর্শনের প্রবক্তা ও স্রষ্টা যখন আপনি স্বয়ং…

–নিজের মৃত্যু দিয়ে আমি তা রচনা করেছি, ‘জরা’ ব্যাধ তার প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভুল থেকেই আমায় হত্যা করবে।

অর্কজ্যোতি নতজানু হয়ে বললেন, ‘কেশব, আমি কি এক বার আপনার সচ্চিদানন্দ রূপের দর্শন পাব, যেমন শ্রীরাধিকা পেয়েছিলেন?

কৃষ্ণ হেসে বললেন, ‘অর্জুন ব্যতীত রাধার কাছেও ব্রহ্মজ্যোতির আবরণ ভেদ করে প্রকাশিত হইনি। আমি তার প্রেমিক, ভগবান নই।’

–আর আমার কাছে?

–বিজ্ঞান-যোগ।

–আমার প্রতি আপনার আদেশ?

–’জরামরণমোক্ষায় মামাশ্ৰিত্য যতন্তি যে।’ জরা, মৃত্যু, ব্যাধির দ্বারা এই দেহ আক্রান্ত। কলির মহাক্ষয় শুরু হয়েছে। নিজত্ব হারিয়ে আপনিও কাউকে তুষ্ট করবেন না। বস্তুবাদ এই যুগের ধর্ম। আপনি হয়তো এর ঋত্বিক। ইচ্ছাদ্বেষ সমুখেন দ্বন্দ্বমোহেন ভারত। অর্কজ্যোতি, এই ভারতবর্ষের দায়িত্ব আমি আপনাকে অর্পণ করলাম।

–দ্বন্দ্বের দ্বারা মোহিত আমার কি মুক্তি নেই? কৃষ্ণ হাসলেন।

–আর নয়, এবার আমায় বিদায় দিন। বিশাখজ্যোতিকে অযথা উদবেগে থাকতে নিষেধ করবেন। অকারণে আমি কাউকে হত্যা করি না।

–প্রভু, এক বার রাধার সঙ্গে দেখা করবেন?

–না।

.

১২. বিশাখজ্যোতির অরণ্যযাত্রা

মালভূমি এখানেই শেষ, তারপরেই গভীর খাদের পাশ দিয়ে চলে গেছে সংকীর্ণ পথ। সংকীর্ণ এবং এই পথই সম্ভবত শেষ হয়েছে গভীর অরণ্যপ্রান্তে। নিষাদ শ্রেণিদের বাস ওখানেই। শিকার থেকে লব্ধ জীব এদের প্রিয় আহার। সুস্বাদু মনুষ্যমাংস ভক্ষণও এদের অনেকের রুচির মধ্যেই পড়ে। এক যুবক সৈনিক বিশাখজ্যোতিকে অনুগমন করছে দীর্ঘপথে। যেহেতু পথ অতি দুর্গম, অরণ্যবহুল বিশাখজ্যোতি মৃদু ভর্ৎসনা করলেও একপ্রকারের স্বস্তিও অনুভব করছেন। যুবকের অশ্ব কখনো কখনো বল্গাহীন হয়ে উঠছে। নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রায়ই অপারগ হচ্ছে যুবক। সূর্য অনেকটা উপরে উঠে এসেছে। বন্য অন্ধকার শুরু হতেই সূর্যের আলোর প্রকাশও দুর্লভ হয়ে পড়ছে। দিবাভাগ বলে অরণ্যের এই মেঘচ্ছায়া দীর্ঘ অশ্বারোহণের পক্ষে সুখদায়ক মনে হচ্ছে। বিশাখজ্যোতি জানেন না তিনি কোনো অনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবমান হয়েছেন কি না। পুত্র রূপজ্যোতি এবং তার মাতা অপালার সঙ্গে সাক্ষাতের কারণে হৃদয়। উন্মুখ হয়ে রয়েছে। পাণ্ডবেরা পরাজিতদের আর হত্যা করবেন না– এরকম প্রঘোষণ থাকলেও খুব নিশ্চিত হতে পারছেন না বিশাখজ্যোতি। তদুপরি স্বয়ং কৃষ্ণ ওঁকে অন্বেষণ করছেন। এটাই ঘটনাপ্রবাহের সুলক্ষণ আভাসিত করে না।

যুবক এখনও জানে না তাঁরা কোনোরকম প্রত্যাবর্তন করছেন না। তাই নগরে প্রত্যাবর্তনের আনন্দে, তৃষ্ণা ও ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছে এবং বল্গাহীন অশ্বকেও আগের চেয়ে খানিকটা প্রত্যয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে।

বৃক্ষরাজিতে নবপত্রের আভাস দেখে বোধগম্য হচ্ছে বর্ষাঋতু আগত। ভারী বর্ষণ না হলেও, কিঞ্চিৎ বারিধারাও পথকে করে তুলছে। পিচ্ছিল। যদিও গাঙ্গেয় ভূমির মতো এখানে প্রান্তর কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে না, তবুও অশ্বারোহণ কষ্টকর হয়ে উঠবে, পথ হবে অগম্য। যদিও বিশাখজ্যোতির মন এইসব শঙ্কা থেকে বিস্তৃত যোজন দূরে অবস্থান করছে। প্রবাসী পুরুষেরা এই সময়েই স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে। প্রোষিতভর্তৃকা নারীরা এই সময়েই মিলনসুখ উপভোগ করে। স্বামীর প্রবাসকালে নারীরা কেশচর্চা করে না। শুধু কেশগুচ্ছের অগ্রভাগে গ্রন্থি দিয়ে রাখে যা কিনা একমাত্র প্রিয় পুরুষের প্রত্যাবর্তনেই মোচন করা হয়। তারপরেই প্রারম্ভ হয় যথোচিত কেশচর্চার।

প্রোষিতভর্তৃকা অপালা তাই এখন পথিকবনিতা। তার কেশও হয়তো দীর্ঘদিন অচর্চিত।

কৃষ্ণের তো প্রোষিত-প্রেয়সীর সংখ্যা অগণ্য। তিনি একাই উপভোগ করেছেন এদের সুভগ পুরুষ মেঘের মতো। শোনা যায়, এক বিবাহিতা নারীর বিলাপে মথুরায় অবস্থানকালে কৃষ্ণের চিন্তায় সাময়িক জাড্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। লোকশ্রুতি রয়েছে, তিনি আয়ান ঘোষের পরিত্যক্তা স্ত্রী শ্রীরাধিকা’। কাম ও রমণ যার নিত্যসঙ্গী, প্রেম তার কাছে বহুল ব্যবহৃত আসবাবের মতোই জীর্ণ। তবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই কৃষ্ণের দৃষ্টিতে নাকি সেই চাতুর্য, বিন্যাস, বিভ্রম অনুপস্থিত। প্রাণহরণকারী প্রীতির স্পর্শ ওর দৃষ্টি থেকেও লুপ্ত হয়েছে।

.

১৩. কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস সকাশে

‘ন মানুষাৎ শ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ।‘ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ববাচক এই শব্দগুলি যিনি উচ্চারণ করেন, তাঁর নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। এ জগতে মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কিছু নেই। সেই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে চলেছেন রাধারমণ কৃষ্ণ। যোগপ্রভাবে ঘন নীহার সৃষ্টি করে মহর্ষি পরাশর মিলিত হলেন মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর সঙ্গে। মহাঋষির ক্ষণিক ইচ্ছায় এবং ক্ষণিক মিলনে অচিরেই সত্যবতীর সদ্যোগৰ্ভ প্রকাশিত হয়েছিল। যমুনার অন্তর্বর্তী কোনো দ্বীপের মধ্যে জন্ম হয়েছিল ব্যাসের। তাই তিনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। জন্মমাত্রেই তিনি জননীকে বলেছিলেন, ‘আমি তপস্যার জন্য যাচ্ছি। কোনো প্রয়োজন উপস্থিত হলে আমি চলে আসব।‘ এখন স্বয়ং কৃষ্ণ চলেছেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে। স্ত্রী, শূদ্র ও পতিত ব্রাহ্মণদের জন্য তিনি একটি মহাকাব্যের পরিকল্পনা করেছেন। কৃষ্ণ সেই মহাকাব্যের একজন চরিত্র। মহাভারতের গণহৃদয়ের রূপকারের সকাশে যেতে কৃষ্ণেরও প্রচুর প্রকম্পন ঘটছে। পাণ্ডবদের বিজয়ের আকাঙ্ক্ষায় তিনিও উল্লঙ্ঘন করেছেন যুদ্ধের পূর্বনির্ধারিত শর্তাবলি। মীমাংসু ঋষিরা অনেকেই হয়তো বহু প্রশ্ন নিয়ে অপেক্ষা করে থাকেন ঋষি বেদব্যাসের আশ্রমে, কৃষ্ণের ব্যাসদেবের সাক্ষাৎ পাওয়া তো একান্ত হওয়া প্রয়োজন।

‘স্বঃস্বঃ পাপিষ্ঠাদিবসঃ পৃথিবী গতযৌবনা।‘ পৃথিবীর যৌবন শেষ হয়ে গেছে। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর কবি ব্যাসদেব বলেছিলেন মাতা সত্যবতাঁকে। তিনি এসেছিলেন মাকে সংসারের মোহ থেকে মুক্ত করতে। ডাক দিয়েছিলেন ‘চলো মা, বেরিয়ে পড়ো এখান থেকে। নানা অধর্মে কলুষিত এই সংসার, এখান থেকে বিদায় নাও।’ ‘ঘোরঃ কালো ভবিষ্যতি।‘ খুব খারাপ সময় আসছে। পৃথিবী আর সুস্থ থাকবে না।

সেই পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছেন কৃষ্ণ। অধর্ম, অসাধুতায় কীর্ণ এই বসুন্ধরা। কালের গায়ে যেন কৃষ্ণবর্ণের রেখা দেখা যাচ্ছে, কলিকাল। কেউ কেউ বলে, কৃষ্ণকাল। এই কৃষ্ণকালে তিনিও কি ভুলে গেছেন ক্ষমাধর্ম?

যুদ্ধ তখন শেষ হয়ে আসছে, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য সব কৌরব সেনাপতি ভূপতিত। তখন সেই ভয়ংকর কাণ্ডটা ঘটল। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা। প্রতিশোধের আগুনে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পাণ্ডবদের পঞ্চপুত্রকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করলেন। পুত্রহারা দ্রৌপদী প্রতিকার চাইলেন মধ্যম পাণ্ডবের কাছে। কাণ্ডজ্ঞানহীন ভীমের পক্ষে অসম্ভব ছিল অশ্বত্থামা সংহার। ফলে অর্জুনের সঙ্গে তাঁকেও যেতে হয়েছিল। পাণ্ডবদের সম্মিলিতভাবে আসতে দেখে ভীত অশ্বত্থামা প্রয়োগ করলেন ব্রহ্মশিরা। এই অস্ত্রের প্রভাবে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, তাই অর্জুন প্রশমন অস্ত্র প্রয়োগ করলেন।

তারপর উত্তরার গর্ভস্থ শিশুর বিনিময়ে প্রাণরক্ষা হল সকলের। শিশুহত্যায় অভ্যস্ত অশ্বত্থামার এতে কোনো ভাবোদয় না হওয়ায় কৃষ্ণ অত্যন্ত কুপিত হলেন। তিনি উত্তরার গর্ভকে অক্ষত রেখে হীন জীবনে নির্বাসনে পাঠালেন অশ্বত্থামাকে। সেই অশ্বত্থামা এখনও আশ্রিত রয়েছেন ব্যাসদেবের কাছে। ওঁর শতপুত্রকে সংহারের কারণে গান্ধারী অভিশাপ দিয়েছেন কৃষ্ণকে। সমস্ত সংসার, সমস্ত মানুষের জন্য একদা যে প্রেম তার মধ্যে ছিল এখন যেন অনুপস্থিত। অভিশাপের বলয়ের মধ্যে থেকে ব্রহ্মজ্ঞানকেও অতিক্রম করতে পারে যে-ভালোবাসা তাঁর অনায়াস চরিত্র-সম্পদ ছিল– আজ যেন শূন্যতায় অভিষিক্ত। বিদ্যা, বিনয়সম্পন্ন প্রজ্ঞাও তিনি হারিয়েছেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। ধর্মের কারণে তিনি আর উচ্চকিত হতে পারেন না। ধর্ম অল্পতর হলেও সেটাই শ্লাঘার– তাঁর এই উচ্চারণ বৃন্দাবনের গোপিনীরাও বিশ্বাস করবে না। আর রাধা, সে তো বিরহব্যথায় কাতর হয়ে বলেছিল, ‘রাধারমণ, প্রিয় আমার! আমায় পরিত্যাগ কোরো না।’

মোক্ষগন্ধী অরণ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন কৃষ্ণ। অদূরে মন্দাকিনী প্রবাহিত হচ্ছিল। ঘন বৃক্ষরাজির মধ্য দিয়ে তিনি দেখলেন, কিন্নর দেশের অপ্সরার দল সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে স্নান করছে। কোনো প্রতিক্রিয়া হল না তাঁর। আশঙ্কা হল, তবে কি তিনি নিগ্রন্থ ঋষি হয়ে গেলেন। এবার কৃষ্ণ প্রকাশিত হয়ে অপ্সরাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। স্নানসিক্তা নগ্ন নারীদের মধ্যে কৃষ্ণকে দেখে কোনোরকম ভাববিকার হল না। তিনি যেন অনুভব করছেন তাঁর দেহ জড়বৎ বস্তুপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। এ যেন তিনি ব্যাসপুত্র শুঁকের মতোই আচরণ করছেন। একাদশ বর্ষব্যাপী গর্ভযন্ত্রণায় কাতর ব্যাসপত্নী বীটিকাকে গর্ভযন্ত্রণা থেকে মুক্ত করার জন্য একদা তাঁকে আসতে হয়েছিল মহর্ষি ব্যাসের কাতর আহ্বানে। পৃথিবীতে জন্ম নিলেই মায়া আক্রমণ করে। মায়া তাঁরই সৃষ্টি। তিনি মন্দাকিনী নদীর শরীরে সেই মায়াজাল বিস্তার করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হল কই।

নিজের পুত্র পৌত্রদের দৃষ্টান্তে ধর্মাধর্মের যৌক্তিকতা জগতে স্থাপন। করার জন্য মহর্ষি ব্যাসদেব এক মহাকাব্য রচনা করছেন। কৃষ্ণ নিশ্চয়ই এই মহাকাহিনির সূত্রধর। কবির চোখে সবটাই ধরা পড়ে। এই প্রেমহীন কৃষ্ণের প্রতি ব্যাসদেব কি সামান্য অনুকম্পাও দেখাবেন? অন্তিম চরণ অবধি জয়ী রাখবেন বাসুদেবপুত্র কৃষ্ণকে, রাধারমণকে?

.

১৪. ভীষ্ম

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস যে-মহাকাব্য আখ্যান রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই আখ্যানের বেশিরভাগ ঘটনাবলির সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে। আর সব ঘটনার সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগ রয়েছে। তাই তিনি ব্রহ্মাকে বলেছিলেন, ‘কৃতং ময়েদং ভগবন্ কাব্যং পরম পূজিতম্ অর্থাৎ আমার কাব্যভাবনা শেষ। প্রজাপতি ব্রহ্মাই লিপিকার নির্বাচন করলেন গণেশকে। গ্রন্থকার্যের স্থূল পরিশ্রমটুকু করবেন গণেশ। ব্রহ্মার নির্দেশে ব্যাস তাঁকে গণনায়ক ‘সম্বোধনে’ আহ্বান করলেন। সেই গণেশ, যাঁর হস্তীমুণ্ড দেখে মুখ হিসেবেই বিভ্রান্তি আসে। বিজ্ঞতার বহিরঙ্গে কোনো প্রকাশ নেই। দেবী সরস্বতী জন্মলগ্নেই তাঁকে ‘বর্ণলোচনা লেখনী দিয়েছিলেন। তাঁর লেখনীর মধ্যে রয়েছে দ্রুতলেখন-পটুতা। গণেশকে ব্যাসদেব সংক্ষেপে এটুকু বলেছিলেন, ‘আমি শ্লোক বলব, তুমি লিখবে।’ গণেশ কিন্তু শর্ত দিলেন, ‘লিখতে বসলে আমি কিন্তু থামব না।’ বিপদে পড়লেন ব্যাসদেব। রাজপুত্রদের কাহিনি তিনি জানেন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের চরিত্রও তিনি সম্পূর্ণ অবগত রয়েছেন কারণ পিতা তাঁর পুত্রকে জানবেন না এ তো হয় না। কিন্তু ভাবাও তো জরুরি। মহাভারতের তো বার্তা থাকবে। এতদ্ব্যতীত তিনি একজন তপস্বী ঋষি। মাতা সত্যবতীর আহ্বানে জড়িয়ে পড়েছিলেন কৌরব বংশের সঙ্গে। জনপদের সঙ্গে তো তার দীর্ঘকালের যোগ নেই। প্রবহমাণ সাধারণ গার্হস্থ্য ধর্মও তিনি জানেন না। নিরর্থক বলে গেলে তো অভিজ্ঞতা সঞ্চারের আর কোনো উপায় নেই। বুদ্ধি করে গণেশের গোঁ খানিকটা আটকালেন। ‘অবুদ্ধা না লিখ ক্কচিৎ। না বুঝে কিছু লিখবে না।

মৃগয়ায় এসেছেন শান্তনু। এটা তিনি প্রায়ই করেন। গাঙ্গেয় তীরভূমিতে বার বার এসে উপস্থিত হন। হয়তো খোঁজেন কিছু। বিলাসিনী রমণীর আঙ্গিকে বয়ে যায় নদী। বোঝার উপায় থাকে না নদীর কোনো বিরহব্যথা। রয়েছে কি না। কাল অতীত হয়ে যায়। স্মৃতি শুধু থেকে যায়। গঙ্গার সঙ্গে রমণসুখের স্মৃতি। সেই নদী-নারী কখনো-বা করত রমণপূর্ণ শৃঙ্গার, কখনো সম্ভোগ, কখনো-বা নৃত্যগীত হাস্য-লাস্যে ভরে তুলত তাঁদের একান্ত আলাপ। শান্তনু কখনো তাঁকে হস্তিনাপুরে নিয়ে আসতে পারেননি। গঙ্গার মহিনী মায়া এখনও তাঁর মন জুড়ে রয়েছে।

সেদিন মৃগয়া শেষে শান্তনু জল দেখে বড়ো অবাক হয়ে গেলেন। জলপ্রবাহ অত্যন্ত ক্ষীণ। নদী যেন আগের মতন বইছে না। তটরেখা ধরে শান্তনু এগিয়ে গেলেন। হৃদয়ে অদম্য কৌতূহল, হয়তো আশাও। বিরহকাতর হয়েছেন বুঝি গঙ্গাও। এই সময় তিনি একটি বালককে দেখেন। ক্ষুধার্ত কিশোর শরীর কিন্তু মহাবলবান ও তেজস্বী। বালক একটার পর একটা বাণ গেঁথে গঙ্গার স্রোতরাশি রুদ্ধ করে দিয়েছে।

এইবার প্রকাশিত হলেন সেই রমণী। নির্মল শুভ্র বসন, সর্বাঙ্গে অলংকার। হয়তো শান্তনু হৃদয় থেকে ডেকেও থাকতে পারেন, ‘গঙ্গা, গঙ্গে!

এই কয়েক বছরে সেই রমণীর বয়স বেড়েছে। প্রগৰ্ভতার পরিবর্তে মাতৃত্বের গাম্ভীর্য এসেছে মুখমণ্ডলে। কিশোর বীরটির ডান হাত শান্তনুর দিকে এগিয়ে দিয়ে গঙ্গা বললেন, ‘মহারাজ, এটি তোমার অষ্টম পুত্র। আমি ওকে যথাচিত শিক্ষা দিয়েছি। এবার তুমি ওকে নিয়ে যেতে পারো। তোমার পুত্র এখন সুরাসুর যাবতীয় রাজনীতিশাস্ত্রে পরম অভিজ্ঞ।’

ভীষ্মর সঙ্গে কৃষ্ণের প্রথম সাক্ষাৎ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে। যুধিষ্ঠির এসেছেন পিতামহ ভীষ্মের কাছে জানতে রাজসূয় যজ্ঞের শ্রেষ্ঠ উপহারটি কোন যোগ্যতম পুরুষের প্রাপ্য। ভীষ্ম অনুধাবন করেছেন, তাঁর যুগে ক্ষত্রিয়ের শক্তি যেভাবে ব্যবহার হত তা এখন আর নেই। রাজনৈতিক জটিলতা এখন তুঙ্গে উঠেছে। এই সভায় উপস্থিত যাদবকুলের প্রতিনিধি কৃষ্ণ তাঁর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী রাজাদের প্রতিপক্ষতা করে জয়লাভ করেছেন রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার জোরেই। অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ। হওয়া সত্ত্বেও তিনি তরুণ কৃষ্ণকে নির্বাচন করলেন শ্রেষ্ঠ সম্মাননার প্রাপক হিসেবে। সভায় উপস্থিত শিশুপাল ও তাঁর অনুগামীরা এই সিদ্ধান্তে ভীষ্মকে অকথ্য গালিগালাজ করতে থাকলেন। মৌনতার উপেক্ষাই ছিল সেদিন তাঁর একমাত্র অস্ত্র। অবশেষে শিশুপাল কৃষ্ণকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন এবং কৃষ্ণের হাতে তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উত্থান ঘটল এক নতুন রাজনৈতিক শক্তির। উত্তর ভারতীয় এই মিত্রশক্তির মধ্যে থাকলেন। পাণ্ডবেরা, পাঞ্চাল দ্রুপদ এবং পশ্চিম ভারতের প্রবাদপুরুষ কৃষ্ণ।

জনপদবাহিনী মায়ের কাছে বাল্যকাল অতিক্রান্ত করেছিলেন বলেই ভীষ্মের কৃষ্ণকে চিনে নিতে অসুবিধে হয়নি। হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে বসে থাকা দুর্যোধন বুঝতে পারলেন না। কর্ণের তিরস্কারের নিদারুণ প্রতিশোধ ভীষ্ম নিলেন কৃষ্ণকে সম্মানিত করার মধ্য দিয়ে।

কৃষ্ণ কিন্তু বরাবরই শ্রদ্ধা পেয়ে এসেছেন এই পিতামহ ভীষ্মের কাছ থেকে। আর অন্যদিকে কৃষ্ণ একটু দূরে দণ্ডায়মান থেকেছেন যখন যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কাছে গেছেন রাজনীতির উপদেশ শুনতে এবং পাণ্ডবদের পিতামহ তখন শরশয্যায় শুয়ে অপেক্ষা করছেন মৃত্যুর।

তাঁর মৃত্যুদিনে আর দূরে থাকতে পারেননি কৃষ্ণ। কাছে আসতেই চিরভক্তের মতোই তার জয়গান করেছেন। অবশেষে বলেছিলেন, এবার আমায় অনুমতি দাও। অনুজ্ঞা মাং কৃষ্ণ। আমার সময় হয়েছে। তিনি বলতেন, ‘কৃষ্ণ যেখানে, ধর্ম সেখানে। ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যুবরণ এক আশ্চর্য দৃশ্য। শরবর্ষায় বিদ্ধ অঙ্গগুলি থেকে প্রাণমুক্ত হওয়ার পর থেকেই বাণগুলি ঝরে পড়ে যেতে থাকল। ভীষ্মের প্রাণ একসময় উল্কার আলোর মতো। আকাশে মিলিয়ে গেল।

মহাভারতের কথকঠাকুর বৈশম্পায়ন বলেছেন, মহাভারতের ইতিহাস আসলে ভীষ্মের ইতিহাস। তবে ভীষ্ম চরিত্রের মূল কথা হল, প্রখর বাস্তবজ্ঞান। তিনিই কৃষ্ণকে প্রথম সম্মান করেন। আর সেদিনের শিশুপালবধের প্ররোচনাতেও ছিলেন মহামতি ভীষ্ম। এইভাবেই পরাক্রান্ত জরাসন্ধ হীনবল হলেন। রাধারমণ প্রেমিক কৃষ্ণের অনুপ্রবেশ ঘটল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস তাঁকে দেবতাদের দেবতা বলেন। কিন্তু সে তো ছিল কবির স্বীকৃতি। কৌরব বংশের প্রধান পুরুষই তাঁকে পতোক্ষভাবে যুক্ত করেছিলেন উত্তর ভারতের রাজনৈতিক আবর্তে।

দুর্যোধনের সভায় কৃষ্ণের হয়তো কিছু ছলও ছিল। যুদ্ধের নিবৃত্তি তিনি চাননি। কিন্তু সেকালের নীতি অনুযায়ী দূত ছিল অবধ্য। দুর্যোধন সেই শিষ্টাচারও উল্লঙ্ঘন করতে চেয়েছিল। বনানীর গন্ধের সঙ্গে আরও কিছু কটুগন্ধ নাকে এসে লাগছে। বোধ হয় পশুমাংসের গন্ধ। কৃষ্ণ তবে অজান্তেই নিষাদদের পল্লিতেই প্রবেশ করেছেন। ভীষ্মের অবর্তমানে সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত বিদ্যা পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

.

১৫. অশ্বত্থামা

দীপে অগ্নিসংযোগ করলেন অশ্বত্থামা। গাঢ় অন্ধকার এতটাই পরিব্যাপ্ত যে কুটিরের বেশিরভাগ অংশই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে রইল। মস্তিষ্কে অসম্ভব পচন শুরু হয়েছে। মাথায় আর মুকুট ধারণ করতে পারছেন না। কটিবস্ত্রে একটি ক্ষুদ্র ছুরিকা লুক্কায়িত রয়েছে। ব্যাসদেবের আশ্রম থেকে বিদায় নিয়ে এই নিষাদপল্লিতে আত্মগোপন করে রয়েছেন অশ্বত্থামা।

নিষাদপল্লি হলেও অশ্বত্থামা যেখানে রয়েছেন কুটিরের চারপাশ বেশ পরিচ্ছন্ন। বন্য কুসুমের উৎকট গন্ধ নাকে, এসে লাগছে। এই গন্ধ। সরীসৃপদের অতি প্রিয়, তাই কুটিরের মধ্যে আলো জ্বেলে রেখেছেন। তিনি ছদ্মবেশ ধারণ করে রয়েছেন।

ব্যাসদেবের কথায় কৃষ্ণ তাঁকে ছেড়ে দিলেও সম্পূর্ণ নিরাপদ তিনি এখনও নন। আশ্রয়দাতা আরণ্যক নিষাদেরা অশ্বত্থামার প্রকৃত পরিচয় এখনও জানে না। ক্ষত্রিয় কুমারেরা একসময় এইসব অরণ্যে মৃগয়া করতে আসতেন। এই অরণ্যে রয়েছে শৃগাল, বন্য বরাহ, নানা ধরনের মৃগ এবং বহু রকমের পক্ষীদল।

মিথ্যাচার সভ্যতার অঙ্গ এবং বাসুদেব কৃষ্ণের মতো কপটতার শিক্ষা আর ক-জনেরই-বা রয়েছে। অগ্নিপক্ক মৃগমাংস এনে দিয়েছে ব্যাধপত্নী। ব্রাহ্মণের ফলাহারের আয়োজন ওদের পক্ষে অসম্ভব, ওটা হত এক ধরনের উৎপীড়ন। জলের উৎস অন্বেষণ করতে গিয়ে অশ্বত্থামা এই অরণ্যে প্রবেশ করেছিলেন। ব্যাসদেবও তাঁকে প্রায়শ্চিত্তের কথা বলেছিলেন। নির্জনে মহাদেবের ধ্যান করলেও অনুতাপের আগুনে একটুও দগ্ধ নন তিনি। অনুতাপ যদি হয় তবে তা কৃষ্ণের হওয়া উচিত। পরস্ত্রী হরণকারী কৃষ্ণ এই যুগের মহানায়ক। ওঁর অভিশাপে মরণাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত তিনি। পিতা সেদিন কৌরববাহিনীর মধ্যভাগের রক্ষক। তিনি তো শুধু অশ্বত্থামার পিতা ছিলেন না, তিনি গুরু, আচার্য এবং অর্জুনের মতো সর্বজয়ী শিষ্যের গুরু। ঋষি ভরদ্বাজের ক্ষণিক অস্থিরতায় জাত এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের পরিচয় ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্ষত্রিয়ের কর্মকারী দ্রোণাচার্য।

গুরু-শিষ্য সেদিন প্রথম মুখোমুখি। দ্রোণের রথের উপর সোনার। যজ্ঞবেদি বাঁধানো, তাতে সোনার মণ্ডলু। রক্তাশ্ববাহন দ্রোণের রথের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল শ্বেতাশ্ববাহন অর্জুন। প্রথম দিনের যুদ্ধে রথোপরি যজ্ঞবেদি-কমণ্ডলুর ব্রহ্মধ্বজখানি কর্তিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। দ্রুতগামী অশ্বের সাহায্যে কোনোক্রমে দ্ৰোণ পালিয়ে গেলেন।

অশ্বত্থামা একবার দূরের আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশের সমগ্র অংশ নীলরঙে মার্জিত। হস্তিনাপুরের নাগরিকদের মুখচ্ছবি ম্লান হয়ে আসছে। পিতা তো কখনো গেলেন না দ্রুপদরাজ্যের অর্ধেক অংশে। অশ্বত্থামাও গুরুপুত্র হিসেবে রাজপুত্রদের সঙ্গে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছিলেন। এই অরণ্যও নগরের প্রান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। কৌরবদের রাজপ্রাসাদ সে তো কম সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল না। কী তার স্থাপত্য! গ্রামের সব গৃহ থেকে, নগরের সব গৃহ থেকে দাসেদের এনে হস্তিনাপুর নগরী সুসজ্জিত হয়ে উঠেছিল।

অদূরে কোথাও শঙ্খধ্বনি হচ্ছে। বহু জোড়া শঙ্খের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই অভিবাদন তো অনার্য নীতিতে নেই। কেমন শঙ্কা হল অশ্বত্থামার। কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খের ধ্বনি নয় তো? দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। আবার কোনো অভিসন্ধি নিয়ে কৃষ্ণ আসছেন! ভয়ে, আতঙ্কে অশ্বত্থামার ইচ্ছে হল শম্বুকের মতো তার দেহের মাংসল অংশ কোনো শক্ত খোলের অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট করে।

রাত্রি গভীর, মধ্যযাম উত্তীর্ণ হচ্ছে। আর শঙ্খধ্বনি নেই। অশ্বত্থামা হয়তো ভুল শুনেছেন। এরকমই শেষ রজনির আলো-আঁধারি যুদ্ধে দ্রুপদ মারা গেলেন। মহামতি দ্রোণের শরবৃষ্টির আঘাতে পাঞ্চালরা নিহত হচ্ছিল। পাণ্ডবেরা রীতিমতন ভয় পেয়ে গেছিলেন। পিতা দ্রোণ মেতে উঠেছিলেন পাণ্ডবদের নিধনযজ্ঞে। কৃষ্ণ উপলব্ধি করলেন যুদ্ধ করে দ্রোণকে নিরস্ত্র করা যাবে না। অগত্যা ধর্মের মুখোশে অধর্মের আশ্রয়। এরপরেও কৃষ্ণকে অনেকেই মহাত্মা বলে থাকেন। একমাত্র কোনো বিষাদ-সংবাদেই তিনি অস্ত্রত্যাগ করতে পারেন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে অশ্বত্থামার পিতা দ্রোণ স্বয়ং জানিয়েছিলেন।

কৃষ্ণ তখন যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যা উচ্চারণের জন্য প্ররোচনা দিলেন। ‘অনৃতং জীবিতস্যার্থে বদন্য স্মৃশ্যতে নৃত্যৈঃ।’ এতগুলি মানুষের জীবন যেখানে বাঁচে, মিথ্যে স্পর্শ করে না বক্তাকে। ভীম যুক্ত করলেন, ‘তোমাকে। সকলে সত্যবাদী বলে জানে, তুমি অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ দাও দ্রোণকে।’

উষার প্রকাশ ঘটছে। অশ্বত্থামা ইষ্টভৃতি মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। পাখিদের কূজন শোনা যাচ্ছে। সত্যভাষী যুধিষ্ঠির আচার্য দ্রোণের সামনে এসে উচ্চারণ করলেন অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ। অব্যক্ত স্বরে বললেন, ‘হাতি কিন্তু।’ সে-শব্দ দ্রোণের কর্ণে প্রবেশ করল না। প্রিয় পুত্রের মৃত্যুসংবাদ যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে শোনার পর থেকে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন রাজগুরু দ্রোণাচার্য। ‘পুত্রব্যসনসন্তপ্তে নিরাশশা জীবিতে ভবৎ’। তখনই ধৃষ্টদ্যুম্ন অস্ত্রবৃষ্টি শুরু করলেন। দ্রোণ শুধুমাত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে প্রতিরোধ করতে থাকলেন। শোকাচ্ছন্ন অবস্থাতেও তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুক কেটে দিলেন।

বারংবার তৃতীয় বার উচ্চারিত হল অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ। ভীম তো ব্রাহ্মণ হয়ে তাঁর ক্ষত্রিয়বৃত্তি নিয়ে উপহাস করেই চলেছেন।

একমুহূর্তের মধ্যে দ্রোণ ত্যাগ করলেন অস্ত্রশস্ত্রের ভার, তৃণীয় ধনুক বাণ। বিশাল রণক্ষেত্রের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো উচ্চকণ্ঠে ডাকলেন, কর্ণ, দুর্যোধন, তোমরা শুনতে পাচ্ছ? এই আমি অস্ত্রত্যাগ করে সেনাপতির ভারমুক্ত হলাম। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাও। সংগ্রামে ক্রিয়তাং যত্নো ব্ৰবীমেষ পুনঃ পুনঃ।

পিতা দ্রোণাচার্যের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অশ্বত্থামা যুদ্ধক্ষেত্রেই ঘোষণা করলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন বধের। তরবারির এক কোপে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের মাথা কেটে ফেলেছিলেন। অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। তিনি পাঞ্চালীর গর্ভজাত পুত্রদেরও হত্যা করে প্রতিশোধস্পৃহা নিবৃত্ত করতে পারেননি।

বৈদান্তিক ব্রহ্মভাবনা এই উষাকালে জাগ্রত হলেও জীবনের ক্ষেত্রে আধিদৈবিক দুঃখের নিবৃত্তি তাঁর হয় না। তিনি অক্ষরস্বরূপ ভগবান বিষ্ণুর পরমপদ কল্পনার চেয়ে ধনুক-বাণ হাতে পাণ্ডবদের সঙ্গে নতুন যুদ্ধযাত্রার পরিকল্পনা এখনও ত্যাগ করতে পারেন না। আর তিনি ঘৃণা করেন। রাধারমণ কৃষ্ণকে।

তবে শিশুহন্তারক অশ্বত্থামার ঘুম হয় না দীর্ঘদিন। ঋতুর পরিবর্তন হয়, কুটিরের অগ্নি নির্বাপিত হয় আবার জ্বলে ওঠে কিন্তু অশ্বত্থামা নিদ্রাহীন থেকে যান রাতের পর রাত। দিবসে ব্যাধের দল আসে। প্রধানত এরা যাযাবর শ্রেণির। মৃগচর্ম পরিধান করে। বহুবিধ যাদুবিদ্যাও জানে। এতদিনে এরাও জেনে গেছে ইনিই দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা। ওদের পূর্বপুরুষ মহাবীর একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ গুরুদক্ষিণা হিসেবে নিয়েছিলেন দ্রোণাচার্য। দ্রোণের কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে পুত্র। কালান্তক ব্যাধি আশ্রয় করেছে ওঁর শরীরে। নিষাদেরা অশ্বত্থামাকে হত্যা করে না। বরং ওঁর জীবনূত দশা উপভোগ করে। আবার দয়া প্রদর্শন করে অগ্নিপক্ক মৃগমাংসও দেয়। কখনো কখনো সুরা-জাতীয় পানীয়ও এনে দেয়। মুখমণ্ডলে বিকৃতি এলেও অশ্বত্থামা এসব গ্রহণ করেন। এখনও তিনি সৈন্যদলের অশ্বারোহণের শব্দ শুনতে পান। সেই পাঞ্চজন্য শঙ্খও শ্রুতিগোচর হয়। তবুও তিনি কৃষ্ণ ভগবানকে স্বীকার করেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে পিতার স্কন্ধহীন দেহ থেকে। নির্গত উষ্ণ রক্তধারার আতপে এখনও তিনি ম্লান হন। শত অনুজ্ঞার ধ্যানেও পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর লালিত ঘৃণা প্রশমিত হয় না। তিনি মান্য করতে পারেন না কৃষ্ণকে, যাকে কিনা মহর্ষি ব্যাসদেবও দেবকল্প বলেই অভিহিত করে থাকেন।

.

১৬. একটি অলীক সাক্ষাৎকার

বিশাখজ্যোতি ভেবেছিলেন এই অরণ্য অতিক্রম করে তিনি দক্ষিণায়নের দিকে চলেছেন। হয়তো একদিন সমুদ্র দর্শন পাবেন। কিন্তু এই অরণ্যের যেন প্রান্তসীমা নেই। দূরে পাহাড়শ্রেণি দেখা যাচ্ছে। অদূরে একটি কুটিরে অগ্নিসংকেত দেখে তিনি খানিকটা উল্লসিতও হলেন। ক্ষুধা, তৃষ্ণা অনতিক্রম্য হয়ে উঠছিল। বারংবার আতঙ্কিত হচ্ছিলেন এই বুঝি মহাশক্তিমান কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খের গগনভেদী হুংকার ওঁর শ্রুতিগোচর হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে কৌরবপক্ষের সৈন্যদল যখনই এই শঙ্খধ্বনি শুনতে পেত, বিহ্বল অবস্থা হত দুর্যোধনের সংশপ্তক বাহিনীর। অর্জুনের শরবৃষ্টিতে রক্তপাত হত ধরিত্রীর। কৃষ্ণ নাকি বলেন, এরই নাম ধর্মবিজয়। এবার তিনি অধর্মের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষকে মুক্তির দিশা দেখাবেন।

বিশাখজ্যোতির অনেকসময় মনে হয়েছে, হস্তিনাপুর নগরীর কোনো চেতনা নেই। বিশেষভাবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অব্যবহিত পর এই নগর গভীর সুষুপ্তির মধ্যে রয়েছে। নাগরিকদের দ্বারগুলি সর্বদাই বন্ধ অবস্থায় থাকে। যদিও মহারাজ যুধিষ্ঠির প্রজাদের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের জন্য জীবনযাপন করবেন বলেছেন। তিনি এক্ষেত্রে শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের উপদেশও স্মরণ করেছেন। তবুও নাগরিকদের আতঙ্ক কাটেনি। বিশ্বাস বস্তুটা আর অবশিষ্ট নেই। ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ এবং তার বার্তা সাধারণ সৈনিক প্রজাদের গৃহের অভ্যন্তরেও সঞ্চারিত হয়েছে। তুলনায় এই অরণ্যের অনেক ভাষা রয়েছে। কুটিরের অবস্থান দেখে আরও একটু আহ্লাদিত হয়েছেন বিশাখজ্যোতি। অরণ্যে আশ্রয় এবং আহার দুর্লভ বস্তু। তবে নিদ্রা নেই। অপালা ভালোবাসত একদম বিপরীত জীবন। নাগরিক জীবনপ্রবাহ ওর খুব প্রিয় ছিল। মহাযুদ্ধের পরও সেই জীবনপ্রবাহে কোনো ছেদ পড়েনি। কত আলো-আঁধারি রাতে মহান যোদ্ধারা অস্তমিত হয়েছেন। মাত্র কয়েক দিবসের জন্য সেই গৃহে হয়তো অরন্ধন থেকেছে। তারপর সবটাই স্বাভাবিক। পাণ্ডবদের রাজত্বকালে প্রজারা যে অপেক্ষাকৃত সুখে থাকবে এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। মহাযুদ্ধে যে-ক্ষয় হয়েছে, যত শস্যভূমি বিনষ্ট হয়েছে, তার চেয়েও বেশি ভূমি ম্লান হয়েছে সাধারণ সৈনিকের রক্তে। দ্রুপদরাজ্য প্রায় যুবকহীন, যদিও তারা পাণ্ডবদের সঙ্গেই ছিল। জয়ীরা তাদের জয় উপভোগ করতে পারছেন কই। যুদ্ধ একমাত্র তৃপ্তি দিয়েছে পাঞ্চালীকে। সেই কৃষ্ণা নারীর হৃদয়েও সুখ কোথায়! পুত্রহারা জননীর ক্রন্দন বৃকোদরও কোনো মূল্যে প্রত্যর্পণ করতে পারেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে বিশাখজ্যোতি স্বয়ং দেখেছেন, ধৃষ্টদ্যুম্নকে কাতর অনুরাধে করছেন অর্জুন, আচার্য দ্রোণাচার্যকে সংহার করতে। যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী ফলাফল কোনো ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে আর থাকেনি। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের মতোই সমগ্র উত্তর ভারতে প্রকৃত জ্ঞানের অন্ধত্ব ঘটেছিল। এর মধ্যেই কৃষ্ণের প্রয়াস, ভীষ্মের অসহায়ত্ব কালের বুকে লেখা রইল। আশ্চর্য, সাধারণ মানুষ এইসব প্রজ্ঞা থেকে বহুদূরে অবস্থান করে। জনসংখ্যার অস্বাভাবিক হ্রাসে খাদ্য ব্যবস্থায় তেমন কোনো আশঙ্কা এখনও পরিলক্ষিত হয়নি। জীবন একই রকমের উপভোগ্য রয়েছে।

কুটিরে প্রবেশ করে বিশাখজ্যোতি দেখলেন অভ্যন্তরে কেউ নেই। তবে মৃত্তিকাশয্যায় যে কেউ শয়ন করেছিল তা অস্পষ্ট নয়। রাত্রি গম্ভীর হলেও কারও সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না। বাইরে তখন চন্দ্রালোকিত শুক্লপক্ষের অরণ্য। অপরূপ শোভা বনানী জুড়ে। অপালার কথা খুব মনে পড়ছে। মনে পড়ছে হাস্য চঞ্চলতামুখর গার্হস্থ্যজীবন। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত চরাচরের দিকে তাকিয়ে মনে হল, ধরিত্রী কত রহস্যময়। নাগরিকজীবনে এই রহস্য লীন হয়ে থাকে প্রত্যহের ব্যস্ত জীবনযাত্রায়। তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করছেন তিনি। অরণ্যের জ্যোৎস্নাবিধৌতলোকে তিনি যেন ছায়াশরীর নিয়ে অপালাকে দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু অচিরেই ভুল ভাঙল বিশাখজ্যোতির। একজন কৃষ্ণকায়, দীর্ঘাঙ্গ মানুষ তাঁর সামনে এসে দণ্ডায়মান হয়েছেন। লক্ষ জ্যোতিষ্ক যেন এই বিশালদেহী মানুষটিকে ঘিরে আবর্তন করছে। বিশাখজ্যোতি নিম্নস্বরে ডাকলেন, ‘কে আপনি? চন্দ্রালোকে প্রতিভাত হল কৃষ্ণবর্ণের মানুষটির হাসির উজ্জ্বলতা।

বংশীধ্বনির মতো উত্তর এল, ‘আমি কৃষ্ণ।’

বিশাখজ্যোতির মনে হল যেন মাথার উপরে দ্যুলোক, ভূলোক মহাবেগে আবর্তিত হচ্ছে। আকাশের মেঘরাজি হঠাৎ ছিন্নভিন্ন হয়ে ছুটে চলেছে। বিশাখজ্যোতি কম্পমান স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী দণ্ড আমায় দেবেন?’

–আমি তোমার কাছ থেকে অমৃতের আস্বাদ পেতে চাই।

–কিন্তু প্রভু, এ কি পরিহাস নয়?

বাতাসের সঙ্গে ক্ষীণ শব্দ ভেসে এল। চমকে উঠলেন বিশাখজ্যোতি। এ তো তারই অন্তরের সংলাপ। কৃষ্ণ তো কোথাও নেই। উত্তরদেশ বিশাখজ্যোতির স্বদেশ। তিনি বহুদূরে চলে এসেছেন। বন্ধ জলাশয়সদৃশ মনে হচ্ছিল হস্তিনাপুর নগরীকে। শুধু যুদ্ধ, রক্তক্ষয়। জ্ঞানের চর্চা প্রায় লুপ্ত। ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা অবিকৃত রাখার হুংকার। তবে তিনি জ্যোৎস্নার আলোকে শুধু ভ্রম দর্শন ও শ্রবণ করলেন!

শাস্ত্র ও দর্শনগুরু অর্কজ্যোতি প্রায়ই বলতেন, বিশাখজ্যোতির চরিত্রে ব্যাপক দ্বন্দ্ব রয়েছে। আবার হাওয়ায় ভাসছে কণ্ঠস্বর। সেই বংশীধ্বনি।

–কৃষ্ণ কখনো পরিহাস করেন না।

–কিন্তু আপনি স্বয়ং অমৃতপুরুষ। মানুষ তো আপনার সমীপে আসে অমৃত আহরণ করবে বলে।

–অমৃত অপ্রদেয়।

–অর্জুনকে যে আপনি সারাসার শুনিয়েছেন।

–আমি কিছু বলিনি। জ্ঞাতিভ্রাতা, আচার্য, পিতামহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অসন্মত অর্জুন তখন এমন এক মার্গে অবস্থান করছিল যে, আমার মুখ থেকে নিঃসৃত শব্দাবলি তার কাছে অমৃত মনে হয়েছিল।

–ধ্যান, যোগবলে আপনি তো অমৃতের উদ্ভাস উপভোগ করেন।

–সেই অমৃতযোগে আমি ক্লান্ত।

–তবে কী চান আপনি?

–নর-নারীর রমণে যে-অমৃত নির্গত হয়, তারই ভিক্ষা চাই তোমার কাছে।

–আপনি স্বয়ং রমণীমোহন। রাধা এবং গোপিনীদের সঙ্গে আপনার প্রণয়লীলা মথুরা, বৃন্দাবনের বাতাসে বাতাসে আন্দোলিত।

–আমি বিভ্রান্ত। এই অরণ্য, নিষাদকুল একদিন আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি এককালে বংশীবাদকও ছিলাম।

–আপনার বংশীধ্বনির আহ্বানেই তো রাধা গৃহত্যাগ করেছিলেন।

–কখনো ভাবিনি পশ্চিম ভারত থেকে সম্পূর্ণ ঘটনাচক্রে কৌরবদের রাজসূয় যজ্ঞে অর্থাৎ আর্যাবর্তের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থিত হব।

–রাজন, সেই সভায় আমিও ছিলাম। ভীষ্ম আপনাকে শ্রেষ্ঠ পুরুষের সম্মান দিলেন এবং শিশুপাল শুরু করলেন নিন্দনীয় তিরস্কার।

–শিশুপাল বধ্য হতেনই।

–এরকম কেন বলছেন?

–ঘটনাপ্রবাহের ইঙ্গিতই তাই নির্দেশ করছিল।

–তবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আপনি কেন পার্থসারথি হলেন? তখনও সময় ছিল রাধারমণের প্রেমের সমীপে প্রত্যাবর্তন করা।

–আমার তো প্রারম্ভ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ নিবৃত্তির দূত হয়ে। সেটা তো প্রায় অগস্ত্যযাত্রাই ছিল।

–মহামতি কৃষ্ণ কখনো বধ্য হতে পারেন না।

–কেন?

–আপনার আত্মপ্রত্যয়। নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তির উপর প্রগাঢ় আস্থা।

–ভদ্রে, সেদিন আমি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ছিলাম।

–একটা পরিহাস করব। এই নির্জন অরণ্যে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই, ফলে আপনি অনেক কিছুই বলতে পারেন। কালচক্র যখন আপনারই আদেশে ঘূর্ণিত হয়, প্রত্যাবর্তন করুন-না এক বার সেই চক্রে; যেখানে আপনি শুধুই রাধারমণ–যোদ্ধা নন, রাজা নন, প্রেমিক মাত্র।

–তাহলে যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যাবতীয় মৃতদেরও প্রাণসঞ্চার করতে হয়। আবার হবে জতুগৃহ, জরাসন্ধ, কীচকবধ। শুধু রাধার প্রণয় তো প্রত্যাবর্তন করবে না।

–কৃষ্ণ, আপনি তো ব্রহ্মবিৎ পুরুষ, এবার না-হয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রশমন করবেন।

–অর্জুনকে যে-মহাজ্ঞান আমি প্রদান করেছি, সে তো অশ্রুত থেকে যাবে।

–শুনেছি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এক মহাকাব্য রচনা করছেন, যাতে আপনিই মহানায়ক।

–মহানায়ক শুধু কালচক্র, আর কেউ নয়। অর্জুনকে বলেছিলাম, তুমি যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইছ না, ওরা যে সব মৃত। কালই ওদের আয়ু জয় করে নিয়েছে।

–দেবী রাধা কি জীবিত রয়েছেন?

–আমি জানি না।

–কেন?

–সেও হয়তো তাই চেয়েছে। পরস্ত্রীকে সম্ভোগ করেছি। কৃষ্ণ যদি যুগনায়ক হয়েও থাকে, সেও তো সামাজিক বিন্যাসকে অস্বীকার করতে পারে না।

–এই চেতনা তো আপনার পূর্বে থাকা উচিত ছিল?

–রাধার কাছ থেকেই আমি প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছি। আয়ান নিমিত্ত মাত্র।

–ব্রহ্মজ্ঞান!

–রমণই তো শ্রেষ্ঠ ব্ৰহ্মজ্ঞান। সৃষ্টির বিকাশ, ক্রমধারাবাহিকতা জীবনের, প্রাণের– সে তো নর-নারীর যৌনসম্ভোগ থেকেই।

–কিন্তু সে তো বিধিসম্মত যৌনমিলন থেকে।

–অপালা ব্যতীত কোনো নারীকে তুমি উপভোগ করনি?

–না।

-বারাঙ্গনা গৃহে গমন করনি কখনো।

–অকস্মাৎ প্রবেশ করেছিলাম মাত্র।

–সেই বারাঙ্গনা যদি এখনও তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে?

–আমি তো অপেক্ষা করতে বলিনি।

–তোমার গৃহে কোনো শূদ্র দাসী ছিল না?

–এখনও আছে। তবে আমি তাকে উপভোগ করিনি, প্রবৃত্তিও হয়নি।

–এক নারীতে তুমি সম্পৃক্ত!

–আর তো প্রয়োজন দেখি না।

–বহু নারীসঙ্গ আমার জীবনে ঘটেছে। রাধা তাদের মধ্যে একজন। তবে তিনি ব্যতিক্রম ছিলেন। রতিক্রিয়ায় এত পটুত্ব আমি দ্বিতীয় কোনো নারীর মধ্যে পাইনি।

–তিনি কখনো গর্ভবতী হননি?

–ওঁর গর্ভে ভ্রূণের আবির্ভাব হলেই আমি নাশ করতাম।

–তবে অশ্বত্থামাকে আপনি শাস্তি প্রদান করলেন কোন অধিকারে? এতদ্ব্যতীত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ঘোষণা অনুযায়ী আপনার ভূমিকা অনুঘটকের। অথচ আপনার সক্রিয় অংশগ্রহণ অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টিতে এসে যায়।

–যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সাধারণ প্রজা এমনকী সভ্যতাও রক্ষিত হত না।

–তাই আপনি যুদ্ধের পূর্বশর্তগুলি উল্লম্বন করতে প্ররোচিত করেছেন?

–এটা কৌরব বংশের উপর দেবতার অশেষ কৃপা। উল্লঙ্ঘন কিছু নয়, প্রয়োজনে পুনর্বিন্যাস।

–ভগবন্‌, আমাকে আপনার প্রয়োজন কেন?

–ওই যে দূরের পাহাড়, অরণ্যপথ– আমি ভেবেছিলাম একদিন রাধাকে সঙ্গে নিয়ে পরিব্রাজকের জীবন নির্বাহ করব।

–প্রতিবন্ধকতা তো কিছু ছিল না! মহাজ্ঞানী, আমার বিনতি আপনি অশ্বত্থামাকে শাপমুক্ত করুন।

–রাধার সঙ্গে আমার সহবাস পার্থিব কোনো প্রণয়ের সঙ্গে তুলনীয় নয়। আমাদের সন্তানও বীরত্বব্যাঞ্জক কিছু হত না। শাম্বের রূপও সে প্রাপ্ত হত না। কখনোই সামাজিক অনুশাসনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। কৃষ্ণও তো কখনোই নন।

–নিয়োগপ্রথা তো আমাদের সমাজে ব্রাত্য নয়। মহাভারতের নতুন কবি ব্যাসদেব রানি সত্যবতীর আদেশে তো এটাই সম্পন্ন করেছিলেন। আয়ান তো সন্তান উৎপাদনে অক্ষম ছিলেন শুনেছি।

–সামাজিক অনুশাসন অনুযায়ী এইসব পুরুষের বিবাহ নিষিদ্ধ। কিন্তু রাধা আমার জীবনের অপার্থিব আলো। সত্য বলতে, আমি এখন ওকে অন্বেষণ করছি। আমার শরীরে কোনো ব্যাধি না থাকলেও মন ভঙ্গুর শকটের মতো পরিত্যক্ত। আর্যাবর্তের রাজনৈতিক আবর্তে আমি সেই প্রণয়কে হারিয়ে ফেলেছি।

–অন্তর্ভেদ দিয়ে আপনি তো পারেন শ্রীমতী রাধারানিকে খুঁজে নিতে।

–লোকচিত্তের কাছাকাছি থাকার ক্ষমতা আমি হারিয়েছি। হয়তো অপ্রমত্ত হয়ে কর্তব্য সম্পাদন করার যে-শক্তি এতদিন আমার মধ্যে ছিল– আর নেই।

–বিক্ষোভ ওঠে না? আপনার কালেই নারীরা ক্রমশ পুরুষের ইচ্ছের দাস হয়ে উঠছে। উৎকৃষ্ট জীবনের দ্বার মধ্যম ইচ্ছের মানুষের দ্বারা রুদ্ধ।

–নারী কোনোকালেই পুরুষের দাস হতে পারে না। তবে হ্যাঁ পুরুষের হৃদয় বিচিত্রগামী, বহুগামীও আবশ্যিকভাবে।

–আয়ান ঘোষ নপুংসক হওয়া সত্ত্বেও আপনার ডাকে রাধা প্রথমেই সাড়া দেননি।

সে বলেছিল, আয়ান সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষ। তারপর এল হেমন্তকাল। বনপথেই অচিরেই রহস্যময়ী রাধার সঙ্গে দেখা হল। আবৃত কুয়াশায় রাধা আমাকে চিনতে পারেনি। হেমন্তকাল হলেও আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ শুভ্র মেঘের আনাগোনা ছিল। রাধা আর নিজেকে প্রতিহত করতে পারেনি।

–ক্লীব পতিকে ত্যাগ করার অধিকার তো নারীর রয়েছে। সেই নারীর বিবাহ করার অধিকারও রয়েছে।

–এক বর্ষণমুখর রাতে রাধার বুনো ফুলের মালা ফেলে রেখে আমি চলে এসেছিলাম হস্তিনাপুরে। কুয়াশা যেমন চাঁদকে ঢাকে, রাধাও হারিয়ে গেল।

–বৈদ্যুতিন যন্ত্রে আপনি তো তার বার্তা পেয়েছেন?

–সে নিশ্চয় এখন যৌবন-উত্তীর্ণা। আমার যৌবনও অস্তমিত। আবার যদি দেখা হয় রাধা-কৃষ্ণের যৌবন-প্রণয় যে আর থাকবে না। মৃত্যু ঘটবে প্রণয়রহস্যের।

–ঋদ্ধিমান পুরুষ তো পারেন প্রণয়ের আয়ু বাড়িয়ে দিতে।

বনানীর গভীরে শুকতারা আর চাঁদের আলো মিলেমিশে গেছে তখন। বিষণ্ণ কৃষ্ণ বললেন, ‘তা আর হয় না। রাধার মতো রমণীরা পুরুষের অবোধ্য। আমি অন্তর্যামী তখনই যখন ধ্যাননিমগ্ন পারাবারে বিক্ষোভের তরঙ্গ ওঠে না। অবশিষ্ট আমি সময়ের বিন্দুতে বাঁধা।’

–কৃষ্ণ, আপনি কি লক্ষ্যভ্রষ্ট?

–পারস্পরিক হিংসায় অনুঘটকেরও পরিত্রাণ নেই। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে আমি থামাতে পারিনি। দূর করতে পারিনি আত্মজনদের দুঃখ। যাদবকুল ধ্বংসের পর আমার মনে হয়েছে এবার আমার আশ্রয় হোক গুহাকন্দর। স্থৈর্য নেই আমার। নিজপুত্র শাম্বকে অভিশাপ দিয়েছি। আমার সন্তানেরা বিপথগামী। চারপাশের পৃথিবী যেন ভেঙে পড়েছে। তোমার কাছে। অপালার প্রেম রয়েছে, আর আমি রিক্ত, নিঃস্ব দেবতা।

বিশাখজ্যোতি দেখলেন উষার প্রকাশ ঘটছে। বনানীর বৃক্ষরাজির ফাঁক দিয়ে দেখলেন মেঘেরা দূর প্রবাসে ভাসমান।

কূট দার্শনিক প্রশ্নের মীমাংসা অসমাপ্ত রেখে কখন চলে গেছেন কৃষ্ণ। হয়তো সবটাই তার মনের বিকার। সূর্যের অহনা আলোয় দেবতার নির্যাস দিয়ে গড়া কালপুতুল ক্রমশ রক্তাভ হয়ে উঠছে।

.

১৭. কৃষ্ণের আঘ্রাণ

এই অরণ্যে অশ্বত্থামা যেন কৃষ্ণের আঘ্রাণ পাচ্ছেন। চিরকালই তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় প্রখর। সুপক্ক শূকরের মাংস দিয়ে গেছে এক নিষাদ রমণী। অন্নটাও উত্তম; সঙ্গে মধু, পায়েসান্ন। এদের বোধ হয় কোনো উৎসব রয়েছে। এ ছাড়াও রমণীটি চমৎকার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে পারে। ব্যাসদেবের আশ্রম পরিত্যাগ করে এই অরণ্যে এসেছেন উনিশ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা সমস্ত শরীর জুড়ে। তবে এই নিষাদদের মধ্যে অশ্বত্থামা ইতিমধ্যে কৃষ্ণের প্রতি ঘৃণা সঞ্চারিত করতে সমর্থ হয়েছেন। এখনও সেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার রাত্রিটি স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করে এক স্বর্গীয় উল্লাস অনুভব করেন তিনি। প্রার্থনায় কোনো ফল নেই। ক্ষমতাভেদ জীবজগতের নিয়ম। কৃষ্ণ উপভোগ করছেন। জয়ীদের উল্লাস তখন স্তব্ধ। হয়েছে। দীর্ঘ যুদ্ধকালীন শ্রমে গভীর সুষুপ্তিতে রয়েছেন পাঞ্চালকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন। ঘুমিয়ে রয়েছে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র। যদিও অশ্বত্থামার অনুমান ছিল ওরাই পঞ্চপাণ্ডব। অপ্রস্তুত ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিদ্রা থেকে উত্থিত করে হত্যা করলেন অশ্বত্থামা। তারপরে একে একে প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শত্যনীক। ভীত ত্রস্ত পাণ্ডব শিবিরের অবশিষ্টরা পলায়ন করেও রক্ষা পেলেন না। কারণ দ্বারে অপেক্ষারত কৃতবর্মা ও কৃপাচার্য।

নিদ্রিত, সুপ্তজনকে হত্যা ক্ষত্রিয়বিরোধী কর্ম–কৃষ্ণ ব্যাসদেবকে বলেছিলেন। আর নিরস্ত্র, ধ্যানস্থ আচার্য দ্রোণাচার্যকে হত্যা খুবই সঙ্গত। পিতৃবধের প্রতিশোধ তখনও প্রজ্বলিত অশ্বত্থামার ধমনিতে। বোধিচিত্ত উন্মুক্ত হওয়ার ক্ষণ এটি নয়। ধ্যানমার্গে বিচরণ অশ্বত্থামাও কম করেননি। মহাদেবের বরে তিনি অজেয়, অবধ্য। সেদিনই প্রদোষকালের প্রাক্‌মুহূর্তে ভগ্ন-উরু দুর্যোধনের পতন ঘটেছিল। রক্তবমন নিবৃত্ত হচ্ছিল না কিছুতেই।

দায়বদ্ধতা যদি কিছু থাকে তবে অশ্বত্থামার ছিল মহারাজ দুর্যোধনের প্রতি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সেদিন ছিল অষ্টাদশ দিবস। ঊরুভগ্ন দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরদেশে পড়ে রয়েছেন। কৌরবপক্ষে জীবিত শক্তিধর তখন মাত্র তিন জন–কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মা। দুর্যোধনের আর্ত হওয়ার সংবাদ শুনে তাঁরা ছুটে এসেছিলেন দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে। মরণ মুহূর্তে দুর্যোধন কৃপাচার্যকে বললেন, ‘আচার্য, আপনাদের সম্মুখেই আমি দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামাকে সেনাপতির কর্মে অভিষিক্ত করলাম। অশ্বত্থামা শেষ বারের মতো রাজা দুর্যোধনকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলেন। এই বিস্তীর্ণ অরণ্যেই সেদিন তাঁরা এসেছিলেন। নিদ্রায় আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা। কিন্তু ক্রোধে, রোষে, আত্মগ্লানিতে দগ্ধ অশ্বত্থামার ঘুম আসছিল না। তিনি জাগ্রত ছিলেন এবং হঠাৎই প্রত্যক্ষ করলেন রাত্ৰান্ধ বায়সদের নিদ্রিত অবস্থায় একে একে ভক্ষণ করছে এক রাত্রির পেচক।

তখনও মহারাজ দুর্যোধনের জ্ঞান ছিল। অশ্বত্থামা তাঁকে মরণঘুম থেকে উত্থিত করে শোনালেন অমৃতকাহিনি– পাণ্ডবদের সংহারের সংবাদ। মাংসাশী গৃধ্র অপেক্ষা করে রয়েছে তার মৃত শরীরের জন্য। তবুও তিনি মাথাটি ঈষৎ তুলে ধন্যবাদ জানালেন অশ্বত্থামাকে।

নিষাদেরা অশ্বত্থামার হত্যাকারী পরিচয় জানে না। তিনি চিরায়ু কিন্তু কৃষ্ণ বধ্য। মাংসাশী পেচকের বায়স ভক্ষণ দৃশ্য এখনও তাঁকে রোমাঞ্চিত করে। তিনি কৃষ্ণের অবসান চান। এই অরণ্যে লুক্কায়িত রয়েছে সে। মনোহর বৃষ্টিপাত শুরু হল। আত্মমগ্নতা নিয়ে এই অভিনব অরণ্য পরিবেশে কৃষ্ণের মৃত্যু কল্পনা করলেন অশ্বত্থামা। অবর্ণনীয় আনন্দ হচ্ছে তার। শীতল বায়ুর স্রোতে ক্ষতস্থানে এক ধরনের সাময়িক আরোগ্য প্রলেপ অনুভব করেন অশ্বত্থামা। যদিও তা প্রতিহিংসা থেকে উদ্ভূত। অরণ্যে ঝিল্লির ঝংকার যেন শব্দ হয়ে উঠছে। অদূরে যেন শতসহস্র নর্তকীর নূপুরধ্বনি শ্রুত হচ্ছে। অশ্বত্থামা ঘ্রাণেন্দ্রিয় আরও প্রখর করার চেষ্টা করলেন। নিঃসংশয় হলেন কৃষ্ণগন্ধই ধেয়ে আসছে নিবিড় অন্ধকার ভেদ করে। মৃত্যুগন্ধের বিবরে প্রবেশ করছেন রাধারমণ।

.

১৮. পুনরাগমনায় চ

হেমন্তের এক প্রভাত। বাতাসে হিমশিশির। দূর থেকে ভেসে আসছে। তুরী-ভেরি-দুন্দুভির ধ্বনি। সূর্য উঠলেন সেদিন দ্বিখণ্ডিত হয়ে।

সঞ্জয় বললেন ধৃতরাষ্ট্রকে, ‘এই সেই দেশ ভারতবর্য। অতীতে এখানে অনেক পুণ্য প্রচারিত হয়েছিল। তবে বর্তমান প্রভাতে এক মহাযুদ্ধ আরম্ভপ্রায়।’ সময় সূচনার সংকেত জানিয়ে ভীষ্ম শঙ্খনাদ করলেন। আর তখনই কুরুক্ষেত্রের প্রান্তর ব্যাপ্ত করে ধ্বনিত হল আরও আরও শঙ্খ, ঢাক, তুরী, মৃদঙ্গ। কৃষ্ণচালিত কপিধ্বজ রথে আরূঢ় অর্জুন এলেন কৌরব এবং পাণ্ডব সেনানীর মধ্যস্থলে। হঠাৎ প্রতারক অশ্রু উর্গত হল তাঁর অক্ষিদ্বয় দিয়ে, পাপের ভয়ে প্রকম্পিত হল স্নায়ুতন্ত্র। তিনি অজান্তেই উচ্চারণ করলেন, ‘ন যোৎস্যে’। এই অরণ্য অত্যন্ত বিস্তীর্ণ। বৃক্ষসমূহ পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নিবিড় বন্ধনে। লাঙ্গের লতাগুল্মও নানা জটে পরিপূর্ণ। বন্যপুষ্প বর্ণিল তবে সুগন্ধযুক্ত নয়। এক ধরনের বুনো গন্ধ ওদের ত্বক থেকে নির্গত হচ্ছে। অবশ্য এর মধ্যেই বিহঙ্গের কূজন শ্রুত হচ্ছে। আবার শ্বাপদের হিংস্র হুংকার অমানিশার অন্ধকারেও শ্রুতিগোচর হয়েছে। এখন দিবার প্রকাশে কৃষ্ণ অবলোকন করলেন, কপোতের পাশেই সুখে নিদ্রা যাচ্ছে কুণ্ডলীকৃত সরীসৃপ। নিষাদের দল এই অরণ্যেই রয়েছে। তারা বিধিবিধান থেকে মুক্ত নানাবিধ কুসংস্কারের দাস। রাধারমণ কৃষ্ণকে এরা ঘৃণা করে। এদের উপাস্য বৃক্ষ, পাথর, আকাশ ইত্যাদি। কৃষ্ণ প্রবল চেষ্টা করছেন তাঁর চিন্তা এবং দৃষ্টিকে জগৎ সীমান্তের ঊর্ধ্বলোকে সংহত করতে। তিনি চাইছেন এক নিষ্প্রাণ নিদ্রা এবং স্বপ্নের সেই গভীর তলদেশ যেখানে শুধুমাত্র রাধা এবং গোপিনীরা দৃশ্যমান হচ্ছে। অবশিষ্ট সময় ধরে তিনি শুধুমাত্র হাঁটতে চাইছেন দীর্ঘ প্রেমের পথ। কিন্তু স্মৃতিদংশনকারী অসংখ্য মক্ষিকা তাঁকে বার বার প্রত্যাগমন করাচ্ছে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে। তিনি কখনো সেই মহাযুদ্ধের স্মৃতি থেকে উত্তীর্ণ হতে পারছেন না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভ লগ্নে ব্যাসদেব এসেছিলেন তাঁর অন্ধপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। দুজনেই অযযাদ্ধা কিন্তু কবি ব্যাসদেব ত্রিকালদর্শী। তিনি বলেছিলেন, ‘পুত্র, এই যুদ্ধে তোমার পুত্ররা ও অন্যান্য রাজগণ বিনষ্ট হবেন। তুমি শুধুমাত্র কাল বিপর্যয় লক্ষ করো। যদি যুদ্ধ ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে চাও আমি তোমাকে দৃষ্টি দিতে পারি। ধৃতরাষ্ট্র একজন বিবরণকারী চাইলেন। যুদ্ধের কথক হিসেবে নিযুক্ত হল সঞ্জয়। অর্জুনের গাণ্ডীব যখন খসে পড়েছে কিঞ্চিৎ উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন ধৃতরাষ্ট্র। হয়তো কেশব জানাবেন অর্জুনকে এবং বলবেন, ‘ক্ষমা ব্রহ্ম, ক্ষমা তপঃ, ক্ষমা সত্য’। কিন্তু কেশবের উচ্চারণ হল একদম ভিন্ন। এক যুদ্ধদর্শন নির্গত হল কৃষ্ণের মুখ দিয়ে, ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ’। ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ’। অর্জুনকে তিনি যুদ্ধের পক্ষে এনে ভর্ৎসনা করলেন। সে ক্লীব, পুরুষত্বহীনের মতো আচরণ করছে। কোনো রকমের পুনর্বিবেচনার সময় কৃষ্ণ দিলেন না। বিভিন্ন জীব ও জাতির প্রতিপালিকা এই পৃথিবী। আর ভারতবর্ষ কত সম্পদশালী। সুখদায়ক ঋতু। সূত সঞ্জয় অবিকল যুদ্ধবৃত্তান্ত বর্ণনার আগে প্রকম্পিত হলেন। গবলগ্ন পুত্র সঞ্জয় মুনিতুল্য বলেই কৃষ্ণকে ভগবান জ্ঞানে পুজো করে এসেছেন। অর্জুন তখন ঊরুস্তম্ভে অভিভূত হয়েছেন। আর তিনি দাঁড়াতে পারছিলেন না। যুদ্ধ নিবৃত্তির অন্তিম দৌত্যকর্ম করলেন। অর্জুন এবং কৃষ্ণ উল্লঙ্ঘন করলেন শান্তির যাবতীয় স্বস্তিবচন। তিনি হয়ে উঠলেন প্ররাচেক এবং উচ্চারণে ‘উত্তিষ্ঠস্ব বিষাদেং মা কৃথা বীর স্থিরো ভবে’। ‘জরা’ ব্যাধের নিশ্বাসের ধ্বনি স্পষ্ট শ্রুত হচ্ছে কৃষ্ণের। অগণ্য নারীর ক্রন্দনধ্বনিও তিনি প্রায়ই শুনতে পান। মৃত্যুর বংশীধ্বনি হয়তো-বা অদূরের প্রান্তে আর নেই। মৃত্যুকে সামনে রেখে কৃষ্ণ এক রকমের স্বগতোক্তি করলেন, ‘ধর্ম অতি সূক্ষ্ম, হয়তো অনির্ণেয়। আমাদের পক্ষে তার অবস্থান নির্ণয় বিভ্রান্তিজনক। আসলে ধর্ম হয়তো বহুরূপী ধারণা। ক্ষমাকে স্থান দিতে গিয়ে প্রতিহিংসা বর্জন করে না।‘ কৃষ্ণের। মোবাইলে আবার টি টি শব্দ হচ্ছে। মেসেজ বক্স খুললেন তিনি। রাধা নদীর ঘাটের ছবি পাঠিয়েছে। যমুনার কৃষ্ণজল বলেই ভ্রম হচ্ছে। কৃষ্ণ এবার তৎক্ষণাৎ মেসেজের টাইপ অপশনে গিয়ে লিখলেন গীতার সেই কথাগুলি, ‘শ্রেয়া স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ অনুষ্ঠিতাং’–সম্যকভাবে পরধর্ম অনুষ্ঠানের চেয়ে আংশিকভাবে স্বধর্ম পালন করা ভালো। স্বভাব নির্দিষ্ট কর্ম করলে পাপাক্ত হতে হয় না। মেসেজটা খুব দ্রুত প্রেরণ করলেন কৃষ্ণ। এই সময় ফোন কল এল। রাধা! অনেক অনেক বছর পর প্রিয় নারীর কণ্ঠস্বর শুনবেন। তিনিও উদবেল। প্রিয় সংলাপ শুরু করার আগে খুব কোমল স্বরে বললেন, ‘হ্যালো রাধা।‘ কোনো উত্তর এল না। শুধু হাসির শব্দ। অট্টহাসি বলেই ভ্রম হয়। সেই হাসি যেন জন্মমৃত্যুরহিত কিছু। তিনি কি উন্মাদ হয়ে গেছেন। এই অরণ্যে প্রযুক্তির কোনো ছায়া পড়ার কথা নয়। তবে কি সবটাই ভ্রম! অরণ্যচারী হওয়ার আগে কৃষ্ণ সত্যভামাকে একটি দামি আইপড কিনে দিয়ে এসেছেন। তাঁর অন্যান্য পত্নীদেরও চলভাষ যন্ত্রগুলি অত্যন্ত মূল্যবান। স্মৃতির প্রতিবিম্ব প্রতিস্থাপন করা যায়, সংগীত শোনা যায় এবং আরও প্রচুর আয়োজন। রয়েছে। তুলনায় কৃষ্ণের মোবাইল বা চলভাষটি খুবই সস্তা মূল্যের, নিতান্ত অপারগ না হলে তিনি এটি ব্যবহার করেন না। এই অরণ্যে অবস্থানকালে কৃষ্ণের মনে পড়ছে সেই মলিনবর্ণ নিষাদ বালকটির কথা। একলব্য। সাধনার ফলে সে ছিল অর্জুনতুল্য ধনুর্বর। এই স্বাধ্যায়বান বালকের কাছ থেকে দ্রোণাচার্য এক অদ্ভুত গুরুদক্ষিণা আদায় করেছিলেন। এইভাবেই পার্থ হয়েছিলেন যোদ্ধাশ্রেষ্ঠ। কৃষ্ণ স্বয়ং পার্থসখা। বহুবিশ্রুত সেই পরিচয়। নিষাদেরা এই কারণেও কৃষ্ণকে খুঁজছে। অপূর্ব মহাকাব্য মহাভারতের নির্মাণপর্ব শুরু হয়ে গেছে। কৃষ্ণ নিশ্চিত, মহাভারত আসলে তাঁরই কীর্তিকাহিনি। ব্যাসদেব বলেই রেখেছেন অন্তিম চরণের উপসংহার, ‘বাসুদেবো কীর্ততে’। ব্যাসের জন্মভূমি যমুনার অন্তর্গত একটি দ্বীপ। সেই যমুনার ছবি রাধা পাঠিয়েছে। সেই তটভূমিতে কত বার কৃষ্ণ তাঁর মধুর মুরলীতে পঞ্চম রাগ বাজিয়েছেন। জলে সিক্ত রাধার নগ্ন দেহ উপভোগ করেছেন। সুশ্রোণি শ্যামা পাঞ্চালীও কৃষ্ণের গভীর বান্ধবী। অর্জুন কখনো বা মগ্ন থেকেছেন উলুপীতে, কখনো-বা চিত্রাঙ্গদায়। তাই কৃষ্ণ বরাবরই স্নেহসিক্ত পক্ষপাত সঞ্চিত রেখেছিলেন দ্রৌপদীর জন্য। রাধা শ্যামাঙ্গী। মথুরার কৃষ্ণও নীরদঘনকান্তি’। মহাভারতও কৃষ্ণমানুষেরই মহাকাব্য। রাধার প্রেরিত ঘাটের ছবিতে কীর্তির পশ্চাতে ধাবমান কৃষ্ণও উদবেলিত হয়েছেন। তাঁর বংশীতেই সেই যমুনার ঘাটে বসেই বেজেছে কখনো ভৈরব, কখনো সারং, কখনো বাহার, কখনো-বা চন্দ্রকোষ। আকাশের সন্ধ্যাতারা গোনা শেষ করে রাধা তখন পানসি নৌকায় কৃষ্ণের সঙ্গে আরোহী হয়েছেন। দাঁড়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের ফাঁকে ফাঁকে কৃষ্ণের। আশ্লেষ চুম্বন। ছই-এর মাথায় রাখা আলোর বাতি নির্বাপিত। কৃষ্ণ রাধার। উন্মুক্ত পৃষ্ঠদেশ জিহ্বা দিয়ে লেহন করছেন। তাই কৃষ্ণের হৃদপিণ্ড-জড়ানো নদী যমুনা। এরপরই শঙ্কিত হলেন কৃষ্ণ। রাধার মেসেজ এবং হাসির অন্য কোনো গূঢ় অর্থ রয়েছে কি! রাধা কি কৃষ্ণের ‘অন্তর্জলি’ যাত্রার আহ্বান করছে? পুত্রেরা কোনোক্রমে মুখাগ্নি করে ভাসিয়ে দিয়েছে শব। যমুনার জোয়ারের জলে ভেসে যাচ্ছেন তিনি। কোথাও কোনো প্রকৃত সন্তাপ নেই তাঁর মৃত্যুতে। কালের অধীশ্বর তিনি ভেসে যাচ্ছেন প্রবহমাণ নদীতে খুব সাধারণ শব হয়ে।

.

১৯. মুহূর্তিকা

মহাপার্শ্ব অসম্ভব ধূর্ত প্রকৃতির লোক। তার উপর সে প্রচার করে বৃন্দাবনের একদা অধিবাসী হওয়াতে কৃষ্ণ তার সখা। ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান’ ধ্বনি দিয়ে সে যাবতীয় পাপকর্ম করে থাকে। তবে মুহুর্তিকাকে নিয়ে সে ব্যাপক চিন্তিত। একদা এই দেহজীবী গ্রাম্য বালিকা ছিল। রাজগৃহের প্রান্তবর্তী গ্রামে কৃষক পরিবারে ওর জন্ম। তখন সেসব প্রান্তবর্তী পল্লিগুলিতে দারুণ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। বালিকা চুরি যাচ্ছে প্রতি রাতেই। অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষে জনাকীর্ণ পল্লিগুলিতে দরিদ্র মানুষদের বাস। মহাভয়ে তারা রাত কাটাচ্ছিল। রাজার কর্ণগোচর হয়েছিল সেই সংবাদ। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ। তখন সন্নিকটে। পূর্ব ভারতেও সেই যুদ্ধের কারণে রণসজ্জা শুরু হয়ে গিয়েছে। রক্ষীরা সতর্ক হল, কিন্তু মহাপার্শ্ব খুব সহজেই এই বালিকাকে চুরি করেছিল সামান্য কাহ্নপণের বিনিময়ে। তখনই কৃষ্ণকে মনে হয়েছিল প্রকৃত সখা। তাঁর অপ্রত্যক্ষ নির্দেশেই এইসব অপহরণকান্ড খুব সহজেই সংঘটিত হচ্ছিল এবং জনশ্রুতি ছিল যে নরমাংসভুক কোনো রাক্ষস বালিকাদের নরম মাংসের লোভে এই হরণকার্য চালাচ্ছে। অপ্রাকৃত এই প্রাণীটির নিধনের কারণে অচিরেই ভগবান কৃষ্ণ রাজগৃহে আসবেন। সেই বালিকা একদিন কিশোরী হল, তারপর যুবতী। অসাধারণ রূপবতী বহু রাজপুরুষের যৌনলিপ্সা সার্থকভাবে মিটিয়েছে এবং প্রচুর সম্পদও আয় করেছে। এখন সে মুহূর্তিকার কী হয়েছে সে আর ত্বকের মার্জনা করে না। মহাপার্শ্বের আনীত খদ্দেরদের নানা অজুহাতে ফিরিয়ে দেয়। তার গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে যে যেন বানপ্রস্থে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। অথচ এই উদ্যোগ একজন সাধারণ গৃহীর পক্ষেও বেশ আড়ম্বরপূর্ণ। আর মুহূর্তিকার ধর্মই-বা কী! তার তো কোনো গভীর আত্মিক সংকট থাকার কথা নয়। অতি সাধারণ রমণীদের মতোই নিরাভরণ সজ্জা নিয়ে থাকে সে। মধ্যাহ্ন পার হয়ে গিয়েছে। পথটি ছায়াময়। নগরের রক্ষীরা মহাপার্শ্বের পরিচিত, ওদের কাছ থেকেই জানা গেল তথ্য। গোপিনীদের মতোই বিরহকাতর মুহূর্তিকাটির জন্যই তার এই সংবাদ অনুসন্ধান। রাজপুরুষটির নাম বিশাখজ্যোতি। কৌরব পক্ষের সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। বর্তমানে কর্মহীন। ওঁকে অন্বেষণ করছে গুপ্তচরবৃন্দও। কৃষ্ণ চাইছেন ওঁকে। অভিপ্রায় অজানা। রাজপুরুষটি কোনো নগরে নেই। উত্তর ভারত ব্যাপী ওঁর খোঁজ এখনও চলছে। পূর্ব ভারতে মুহুর্তিকার গৃহে অবস্থানের দিনক্ষণ জেনে নিল রক্ষীদলের প্রধান। নতুন কোনো বিপত্তির উন্মেষ হতে পারে। মুহুর্তিকাটির প্রয়োজন হতে পারে, রক্ষীপ্রধান জানালেন এবং সে যেন কোনো কারণেই নগর ত্যাগ না করে।

–ত্যাগী কোথাও আবদ্ধ থাকেন না।

–বেশ্যা রমণীর গৃহে যে এসেছিল, সে আবার ত্যাগী পুরুষ!

–তিনি আমার তৃপ্ত করেছেন।

–এলেন কেন তবে?

–বিশ্রামের কারণে।

–তোর ওসব কলা দিয়ে ওকে তৃপ্ত করিসনি মাগি! তোর শরীর ওই রাজপুরুষ জিহ্বা দিয়ে লেহন করেনি?

–তিনি যেন ছিলেন মাটির গভীর গর্তে নির্বাপিত আগুন! সেই আগুনের নির্বাপিত সুখ আমি প্রাণভরে উপভোগ করেছি।

–দ্বিধা, দোলাচল চিত্ত নিয়ে তিনি তোর কাছে এসেছিলেন। হয়তো তেমন কামুক পুরুষ তিনি নন যে ধর্ষকামের সুখ উপভোগ করবেন।

নগরদ্বার থেকে ঘন্টাধ্বনি ভেসে আসছিল। মুহূর্তিকাটি নিশ্বাসের বাতাস উড়িয়ে দিয়ে স্তব্ধ থাকল।

–এরা আমাদের প্রাপ্য কেড়ে নিতে এসেছে।

–তোমাকে কোনো উৎকোচ তিনি দেননি পিতা?

–উৎকোচ! তস্করের মতোই প্রবেশ করেছিল তোর গৃহে।

–তিনি ছিলেন দেবতার মতো সৌম্যদর্শন। বেদজ্ঞ পুরুষই হবেন। আবার ক্ষত্রিয়ের মতোই তাঁর বক্ষদেশ।

–পুরুষাঙ্গটিও নিশ্চয় দীর্ঘ এবং দৃঢ়।

–তেজের অভাব তাঁর ছিল না। নারীকে তৃপ্ত করতে তিনি জানেন।

–রাজশক্তির পরিবর্তন হয়েছে, নীতিও এখন স্বতন্ত্র। তোর রাজপুরুষটি মহারাজ দুর্যোধনের প্রিয়পাত্র ছিলেন। চার্বাক মুনির শিষ্য অর্কজ্যোতি ওর গুরুদের। মহামতি কৃষ্ণের প্রধান প্রতিপক্ষ।

–তবে তিনি কোনো আচার্য বা চিন্তক হবেন।

–গুরুর আশীর্বাদ লাভ না করলে বেদ হৃদয়স্থ হবে না। চার্বাক বেদবিরোধী, কৃষ্ণবিরোধী, কোনো পরম্পরা মানেন না। জীবনযাপনে সুখভোগই ওঁর কাছে মোক্ষ।

–তবে তো এই বিশাল কর্মকান্ডের অনেকটা মিধ্যে হয়ে যায়।

–যাগযজ্ঞ, সাধুসমাবেশ, দান-দক্ষিণা এসবের যেন কোনো মূল্য নেই। ওঁরা বলেন যজ্ঞ মানে মানসযজ্ঞ। অরণ্য, মৃত্তিকা, সমুদ্র, পর্বত, আকাশসমন্বিত এই পৃথিবীর অন্তরে প্রবেশ করা। সৃষ্টিতত্ত্বের মূলে উপনীত হওয়া।

–পিতা, আমাদের কাব্যে তো এসব আসতে পারে। তুমি তো এরকম কাব্য রচনা করতে পারো।

–সহস্ব মুদ্রার বিনিময়ে একেকটি রাত রাজপুরুষেরা ক্রয় করতে আসে। দেহজ সুখের পরিবর্তে এইসব জটিল তত্ত্বের আলোচনা বারাঙ্গনা গৃহে আরম্ভ হলে তোদের আহৃত চারুকলা, নৃত্যকলা, মদিরা সেবন এবং মূল্যবান মানুষদের প্রাণের আরাম বিঘ্নিত হবে। এ ছাড়াও আমার বয়স হয়েছে, তোর যৌবনও ক্ষণস্থায়ী, সম্পদ আহরণ এই কালে না করতে পারলে ভিখারিনির দশাপ্রাপ্ত হবি। আমাদের কী প্রয়োজন রয়েছে মস্তিষ্কের চতুর উদ্ভাবন খেলায় কালাতিপাত করায়!

–কিন্তু সে এক রাতের জাদুর খেলা আমি যে কখনো ভুলতে পারব । আগের জন্মের পূণ্যের ফলে আমি তাঁকে পেয়েছিলাম। পিতা, এই বারাঙ্গনার কাছে তুমি তাঁকে আরেক বার মাত্র নিয়ে এসো।

–মা, তোর অতুলনীয় আঁখি, ওষ্ঠাধর, পদ্মকোরকের মতো বক্ষ, যেখানে প্রতি রাতে কত ভ্রমর আসে মধুপানে উন্মত্ত হবে বলে; এবং সবেশী সহচরী বারাঙ্গনারাও তোকে ঈর্ষা করে। সে তুই সকল সৌন্দর্যের সার হয়েও একজন রাষ্ট্রদ্রোহীর জন্য অপেক্ষায় জীবনকে কন্টকযুক্ত করছিস।

–পিতা, আমি যে তাঁকে প্রতি রাতেই স্বপ্ন দেখি। দুগ্ধধবল অশ্বের বাহন হয়ে তিনি এলেন। টানা টানা কালো চোখ, কিঞ্চিৎ রক্তিম। ঠোঁট দুটো টুকুটুকে লাল। সুরু গুফের রেখা। আকুঞ্চিত কেশদাম। প্রশস্ত বক্ষে যূথিকামাল্য, শুভ্র পট্যবস্ত্র পরে রয়েছেন। হাতে তাঁর মুরলী।

–ওর ত্বক কি নীলাভ? স্বপ্নে কী দেখেছিস।

–বুঝেছি পিতা, তুমি কৃষ্ণের কথা বলছ। না, তা নয়। তিনি অসম্ভব কান্তিবান।

–রাজপুরুষ মুরলী হাতে! তুই কি উন্মাদিনী হয়ে গেছিস? আসলে তুই কৃষ্ণস্তু ভগবানকেই স্বপ্নে দেখেছিস, তিনি তো ভাবগ্রাহী জনার্দন। তোর কল্পিত রূপেই দেখা দিয়েছেন।

–শুনেছি তাঁর ষোলোশো গোপিনী, তিন জন মহিষী এবং একনন রক্ষিত রয়েছে রাধা।

–তিনি পুরুষোত্তম। সমস্ত নারীরাই তাঁকে কামনা করে।

–আমি করি না। আমি চাই বিশাখজ্যোতি। তিনি আমার প্রার্থিত পুরুষ।

–ধিক্ তোকে।

মুহূর্তিকাটি বাইরের আকাশের দিকে তাকাল, সেখানে তরঙ্গায়িত মেঘ। সূর্যদেব এখন মধ্যগগনে। রাত্রিকালেই পিতার সঙ্গে প্রচুর বাদানুবাদ হল। এই মহাপার্শ্বকেই সে বালিকা বয়স থেকে পিতা বলে ডাকে। যদিও তার পিতামাতা ভিন্ন। ওদের স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে আসছে। প্রত্যূষে উঠতে বিলম্ব হয়েছে। রাত্রে কয়েক বারই ওই কক্ষের দরজায় আঘাত হয়েছে ক্রেতাদের। রাত্রিকালে ওরা উন্মত্ত থাকে। বন্যপশুদের মতোই ওরা নারীমাংসলোলুপ। এতদিন সেই মাংসের পসরা সাজিয়ে বসতে হত আকর্ষণ করার কারণে। আজ যেন দেবতার জন্য শুধু পুষ্পচয়নের আকাঙ্ক্ষা জন্মেছে। আর ইচ্ছে করছে ধ্যানমগ্ন অপেক্ষার। সে অপেক্ষা ভুলিয়ে দিচ্ছে পলের দ্রুত গমন। কখন দিবা অতিক্রান্ত হয়ে মধ্যাহ্ন হয়েছে।