১০. বিছানা ছেড়ে উঠতে

দশ

সকালে তারাপদর আর বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। ঘুম ভেঙে যাবার পরেও সে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল। শরীর যেন ভেঙে যাচ্ছে, হাত-পা ভার, চোখ জ্বালা করছিল। সারা রাত জ্বরের ঘোরে পড়ে থাকার পর সকালে ঘুম ভাঙলে যেমন লাগে, সেই রকম লাগছিল। শরীরের দোষ নেই, আজ ক’দিনই একটা-না-একটা এমন কিছু ঘটে যাচ্ছে যাতে মাথার ঠিক থাকে না, একের পর এক ভাবনা সারাক্ষণ জট পাকিয়ে থাকে মাথায় । রাত্রে ঘুম হয় না ভাল করে। তার ওপর কালকের ঘটনার পর তারাপদ একেবারেই ঘুমোত পারেনি। বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে, মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠেছে বাবা-মা-পরীর কথা ভেবে। তবু বাবা কিংবা মা তাকে এমন করে বিহ্বল করে যায়নি। পরীই যেন সব উলটে-পালটে দিয়ে গেল। তার আত্মা তারাপদর গায়ের কাছে, সামনেই এসে দাঁড়াল, গন্ধ শুকিয়ে দিল, চুলের ছোঁয়া দিল মুহূর্তের জন্যে, একটা মোমের আঙুলও রেখে গেল চিহ্ন হিসেবে। এরপর তারাপদ কেমন করে স্থির থাকবে! সে কাকে বোঝাবে, এই ছোট্ট বোনটিকে সে কতদিন কোলে করে একটু বসে থাকার জন্যে মায়ের কাছে আবদার করত!পরী তখন চার ছ’মাসের বাচ্চা! ওইটুকু বাচ্চা কিছুই তো বোঝে না, তবু তারাপদ বিকেলে খেলাধুলো ছেড়ে বোনের পাশে শুয়ে-শুয়ে কাগজের ফুল দেখিয়েছে, ঝুমঝুমি নেড়েছে, প্রাণপণে ছড়া কেটেছে। পরী আরও যখন বড় হল একটু, তারাপদ বোনকে বসতে, পা-পা করে হাঁটতে, একটা দুটো আধো-আধো কথা বলতে শিখিয়েছিল। সেই বোন যখন থাকল না–তখন তারাপদর বুক ভেঙে গিয়েছিল। সমস্ত বাড়ি অসাড় থাকত তখন; মা আড়ালে বসে কাঁদত, বাবা কেমন পাথরের মতন হয়ে গিয়েছিল, আর তারাপদ বেড়াল-ছানার মতন সারা বাড়ি কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়াত।

সেই পরী কাল এসেছিল। তারাপদ তাকে চোখে দেখতে পেল না বটে, তবে আসার প্রমাণ তো পেল। পরী আজও কোথাও-না-কোথাও রয়েছে এটা জানার পর বুকের মধ্যে কেমন হয় এ-কথা শুধু তারাপদই বুঝতে পারে। আর কেউ বুঝবে না।

মাঝরাত পর্যন্ত চন্দনকে জ্বালিয়ে শেষরাতে তারাপদ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর এখন উঠল বেশ খানিকটা বেলায়, ঘরে রোদ ঢুকে পড়ার পর ।

চন্দন বিছানায় নেই । অনেক আগেই বোধ হয় উঠে পড়েছে ।

শেষ পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে উঠল তারাপদ, অনেকটা জ্বোরো রোগীর মতন বেখেয়ালে মুখটা ধুয়ে এল। একজনকে দেখতে পেয়ে চা দিতে বলল রুক্ষ গলায়। কেন যে রুক্ষ হল নিজেও বুঝল না।

ঘরে বসে যখন চা খাচ্ছে তারাপদ, চন্দন এল।

“ঘুম ভাঙল তোর?” চন্দন বলল।

“হ্যাঁ। তুই কোথায় গিয়েছিলি?”

চন্দন হাত বাড়িয়ে নিজের জন্যে এক পেয়ালা চা ঢেলে নিল; কথা বলল প্রথমটায়, তারপর বলল, “রোগী দেখতে!”

অবাক হয়ে তারাপদ বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

চন্দন বলল, “সাধুমামার বুকে ব্যথা উঠেছিল।”

“সাধুমামার?”

“ভোর রাতে আমায় মৃত্যুঞ্জয় ডাকতে এসেছিল। তোকে আর আমি জাগাইনি। একটু আগে আর একবার দেখতে গিয়েছিলাম সাধুমামাকে।”

তারাপদ উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “কী হয়েছে সাধুমামার? কেমন আছে?”

“ভালই আছেন এখন!”

“বুকে ব্যথা কেন? হার্টের গোলমাল?” চন্দন পর পর দু’ চুমুক চা খেল। সিগারেটও ধরাল। শেষে হেঁয়ালি করেই যেন বলল, “হতে পারে।”

“হতে পারে মানে?”

“বলতে পারছি না। হার্টের গোলমাল ধরা কঠিন। আমার কাছে স্টেথোও নেই। তবে ব্যথাটা হার্টের দিকটাতেই।”

“তোর কাছে তো ওষুধও নেই কিছু?”

“না। দু-চারটে যা এনেছি, তাতেই আপাতত কাজ চালিয়ে দিচ্ছি।”

তারাপদ কিছুই বুঝতে পারছিল না। সাধুমামার বুকের ব্যথা যদি এতই বেশি তাহলে চন্দন তেমন গা করছে না কেন? আশ্চর্য! যে ডাক্তারের না আছে স্টেথোসকোপ না কোনো ওষুধপত্র, সে-ডাক্তার কেন রোগীর ভার নেবে! তারাপদ বলল, “তুই সবে পাশ করেছিস, তোর কাছে ওষুধপত্র নেই–কেন তুই এই দায়িত্ব মাথায় নিচ্ছিস? সাধুমামা বুড়োমানুষ, একটা-কিছু হয়ে গেলে তখন সামলাতে পারবি না। তার চেয়ে ভুজঙ্গদের বল–কোনো ডাক্তার-টাক্তার ডেকে আনবে।”

চন্দন কথাগুলো কানে শুনেও গা করল না, বলল, “বোকার মতন কথা বলিস না। আমি যেমন ডাক্তারই হই বিপদে পড়ে কেউ যদি আমায় ডাকতে আসে আমি না বলতে পারি না। তা ছাড়া এখানে ধারেকাছে কোনো ডাক্তার নেই । হয় মধুপুর না হয় দেওঘর থেকে ডাক্তার আনতে হবে। তার মানে গোটা একটা দিনের ব্যাপার । তোকে বলেছি না–কাজে লাগতে পারে ভেবে আমি দু-একটা ইনজেকশানের ওষুধ নিয়ে এসেছিলাম। তার মধ্যে একটা হার্টের ওষুধ ছিল। ভেবেছিলাম ভুজঙ্গ অক্কা পাবার আগে কাজে লাগবে। সাধুমামার দরকারে লেগে গেল ।…যাক গে, সাধুমামা এখন ঘুমোচ্ছে; ইনজেকশান দিয়ে দিয়েছি ভোর রাতেই। মনে হচ্ছে, কোনো গণ্ডগোল হবে না। এর পর ভুজঙ্গ কী করবে না-করবে সেটা তার ব্যাপার। আমার যা করার করেছি, যা বলার মৃত্যুঞ্জয়কে বলেছি।”

তারাপদ চা শেষ করে ফেলল। হাই তুলল আবার। চা খাওয়ার পর সামান্য আরাম লাগছিল।

চন্দন বলল, “একবার কিকিরার কাছে যেতে হবে।”

“কেন?”

“চল না; গেলেই বুঝতে পারবি।”

মাথা নাড়ল তারাপদ। “আমার ভাল লাগছে না।”

“এই বাড়িতে বসে বসেই বা তোর কী ভাল লাগবে?”

কথার জবাব দিল না তারাপদ।

অপেক্ষা করে চন্দন হঠাৎ বলল, “তুই যদি আমার সঙ্গে না যাস, তারা–আমি কিন্তু আর এ-বাড়িতে ফিরব না; কিকিরার কাছে দুপুরটা কাটিয়ে বিকেলের ট্রেনে কলকাতা ফিরে যাব।”

তারাপদ বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন চন্দনের হঠাৎ এই মত পালটে ফেলার ব্যাপারটা বুঝতে না-পেরে তাকে লক্ষ করতে লাগল।

চন্দনও চা শেষ করে ফেলল। তারাপদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল্।” ।

তারাপদ বলল, “কী হবে কিকিরার কাছে গিয়ে?”

“কী হবে না-হবে, তোর কাছে আমি এখন বলব না। যদি তুই না যাস, আমি বুঝব তুই ভুজঙ্গর ফাঁদে ধরা পড়ে গিয়েছিস। আমি আর এখানে থাকব না।“

চন্দনের মুখ দেখেই তারাপদ বুঝতে পারল, ও বাজে কথা বলছে না। সত্যিই-সত্যিই তারাপদকে রেখে চন্দন চলে যাবে। ও বরাবরই জেদী, একবার যা ঠিক করে নেয় তার নড়ানো যায় না। তবু তারাপদ বলল, “কী হল ব্যাপারটা? হঠাৎ তুই এরকম করছিস?”।

চন্দন চাপা গলায় বলল, “এখানে বসে সব কথা বলা যাবে না। তুই হয় আমার সঙ্গে চলনা হয় তুই এই লাখটাকার সম্পত্তির জন্যে ভুজঙ্গর কাছে বসে থাক–আমি থাকব না।”

তারাপদর কানে কথাটা বড় লাগল। আহত হয়ে বলল, “তুই আমায় এত লোভী ভাবলি?”

চন্দন বলল, “এই বাড়িতে বসে আমি আর একটা কথাও বলব না। যদি তোর ইচ্ছে না থাকে, তুই যাস না। আমি যাচ্ছি।”

তারাপদর সাধ্য হল, না চন্দনকে ছেড়ে দেয়। সে স্পষ্টই বুঝল, চন্দন তাকে। মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছে না–সত্যিই ও চলে যাবে, যা একগুঁয়ে ছেলে। তা। ছাড়া তারাপদর সন্দেহ হল, চন্দনের যেন কিছু বলার আছে, গোপনে বলবে। অগত্যা তারাপদ বলল, “বেশ। আমি যাব। “

তারাপদ আর চন্দন বেরিয়ে পড়ল । মৃত্যুঞ্জয় তাদের দেখেছিল, কিছু বলল না। কেউ যে নজর রাখছে, তাও মনে হল না।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঠ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চন্দন বলল, “তোকে একটা কথা বলি তারা, কিছু মনে করিস না। ভুজঙ্গ তোকে জব্বর প্যাঁচ মেরে কবজা করে ফেলেছে।”

তারাপদ রেগে গেল। বলল, “কেন? কী করে বুঝলি?”

“বুঝেছি। তোকে আমি বুঝব না? তুই বরাবর নরম ধাতের । একটুতেই কেঁদে ফেলিস, বুক চাপড়াস, ছটফট করিস। তোর মতন সেন্টিমেন্টাল ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। তোর মনে কোনো জোর নেই।”

চন্দন আরও কী বলতে যাচ্ছিল, তারাপদ বাধা দিয়ে রাগের গলায় বলল, “লেকচার মারিস না, চাঁদু । আমি অনেক লেকচার শুনেছি।”

“তুই চটে যাচ্ছিস কেন?”

“আলবাত চটব। তুই আমায় লোভী বলবি, সেন্টিমেন্টাল বলবি–আর আমি চটব না!”

চন্দন বন্ধুর রাগ দেখে হেসে ফেলল। তারাপদর রাগ ভাঙাবার জন্যে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “তুই মিছিমিছি চটছিস। সকলের মন কি একরকম হয়? কারুর মন শক্ত হয়, কারুর নরম; কেউ নিষ্ঠুর হয় তোর ভুজঙ্গ-পিসেমশায়ের মতন, কেউ বা সাধুমামার মতন দুর্বল হয়। তোর মন নরম বললে তুই চটবি কেন?”

“তুই আমায় লোভী বলেছিস।”

“লোভ সব মানুষেরই অল্পস্বল্প থাকে, তারা। পড়ে-পাওয়া সম্পত্তির লোভ ভাই আমারও থাকত। যাকগে, তুই লোভী নোস, যা বলেছি–ভুল করে বলেছি। এবার হল তো?”

তারাপদ কোনো কথা বলল না। চন্দন বন্ধুর গলা জড়িয়েই হাঁটতে লাগল। খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, “ভুজঙ্গ তোকে বশ করে ফেলছে, তারা। ধীরে ধীরে তোকে মুঠোয় পুরে ফেলছে। এরপর তুই আর পালাতে পারবি না, সে-ক্ষমতা তোর থাকবে না। আমিও তোকে সাবধান করে দিচ্ছি।”

তারাপদ বলল, “যা মনে করিস বল, আমি কিছু বলব না।”

“তুই সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করিস তোর মা-বাবার আত্মা আসে? তুই কি বাস্তবিকই মনে করেছিস–কাল তোর কাছে পরী এসেছিল?”

“হ্যাঁ, পরী এসেছিল।”

“আমি বিশ্বাস করি না। এ অসম্ভব।”

“তুই বিশ্বাস না করতে পারিস, কিন্তু আমি করি। যদি পরী না আসবে তবে কে আমার নাকের কাছে গন্ধ শুকিয়ে যাবে, কার মাথার চুল আমার মুখে লাগবে? কার আঙুলের ছাঁচ পড়ে থাকবে?”

চন্দন বন্ধুর গলা থেকে হাত সরাল। মুখোমুখি তাকাল। বলল, “তুই পাগলের মতন কথা বলছিস। পরী মারা গিয়েছিল ছোট্ট বয়সে, তুই বলিস বছর দুই-তিন বয়েসে । শোন তারা, যা বলছি ভেবে দেখ । পরী যখন মারা যায় তখন তুই নিজেই ছেলেমানুষ; পরীর ঠিক-ঠিক বয়েস কত হতে পারে তুই জানিস না। দু-তিন বছর হতে পারে, আবার চারও হতে পারে। সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু ছোট্ট পরী কি মরে গিয়েও পরলোকে বাড়ছে?”।

তারাপদ কথাটা বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে বলল, “মানে?”

চন্দন বলল, “এটা তো সোজা ব্যাপার। আমরা চেয়ারে বসেছিলাম–ঠিক কিনা বল? একটা তিন-চার বছরের মেয়ে মাথায় কত লম্বা হবে রে যে তোকে গন্ধ শুকিয়ে যাবে, মুখে চুলে ছোঁয়া দিয়ে যাবে? যদি মেয়েটা কম করেও ফুট চারেকের মতন লম্বা না হয়, কখনোই আমরা চেয়ারে বসে থাকার সময় মুখে মাথার চুল ছোঁয়াতে পারে না। এটা সোজা অঙ্কের ব্যাপার। চেয়ারে বসে থাকার সময় আমাদের মুখ মাটি থেকে অন্তত সোয়া তিন সাড়ে তিনি ফুট উঁচুতে থাকে, ওই হাইটের কোনে মেয়ে পাশে না দাঁড়ালে তার চুলের ছোঁয়া তোর মুখে লাগতে পারে না। অবশ্য যে-মেয়ে মাথায় আরও লম্বা সে কিন্তু ঘাড় নামিয়ে হেঁট হয়ে তোর মুখে চুলের ছোঁয়া লাগাতে পারে। এবার তুই বল, মারা যাবার পর স্বর্গে গিয়ে পরী কি তোর-আমার মতন বছরে বছরে বাড়ছে? তা যদি বাড়ে–তবে তার বয়েস আজ ষোলো সতেরো হতে পারে।”

তারাপদ বোকার মতন বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কথা বলতে পারল না। পরীর মুখ কিংবা স্মৃতি যেটুকু মনে আছে তারাপদর, তাতে সেই ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে কখনোই মাথায় অত লম্বা হতে পারে না। বড় জোর বছর তিনেকের ছিল পরী। সে কতই বা লম্বা হবে? তা ছাড়া তার মাথার চুল ছিল ঝাঁকড়া, কিন্তু বল্‌ করে ছাঁটা। সেই চুলই বা কেমন করে মুহূর্তের জন্যে পালকের ছোঁয়ার মতন তারাপদর গালে লেগে সরে যাবে? মোমের আঙুলের যে ছাঁচ তারাপদ দেখেছে–সেটাও তো কচি মেয়ের নয়। তা হলে? আত্মারা কি মানুষের মতন পরলোকে গিয়ে বয়েসেও বাড়ে? যদি তা বাড়ত–তবে হাজার-হাজার আত্মার বয়েস শ, দুশ, পাঁচশ বছর হয়ে গেছে।

তারাপদ এরকম একটা হেঁয়ালির কোনো কূলকিনারা খুঁজে পেল না। বলল, “কী জানি, আমি কিছু জানি না। তবে ভুজঙ্গ তো আগেই বলেছে–পরী আর অত ছোট্টটি নেই। আত্মাদের অন্য কোনো ব্যাপার আছে।”

“কোনো ব্যাপার নেই”, চন্দন ঘাড় নেড়ে বলল, “আমি তোকে বলছি–যে-মেয়েটি আমাদের সঙ্গে টেবিলে বসে, আত্মা নামাবার মিডিয়াম হয়–সেই মেয়েটাই কাল পরী সেজে তোর কাছে এসেছিল।”

তারাপদ প্রবলভাবে বাধা দিতে গেল, চন্দন শুনল না। বলল, “মেয়েটার মাথায় অনেক চুল, সব সময় চুল এলো করে থাকে, মাথায় লম্বা, গায়ে রোগা–তারা, এই মেয়েই কাল পরী সেজে এসেছিল।”

চন্দন আরও কী বলতে গিয়ে থেমে গেল। পরে বলল, “কিকিরার কাছে চল । কিকিরা তোকে বুঝিয়ে দিতে পারবেন ভুজঙ্গ কেমন করে আত্মা নামায়।”

.

মাঠেঘাটে নয়, কিকিরা বাড়িতে চন্দনদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। বাড়ি মানে সেই হরিরামের আস্তানা। বালিয়াড়ির আড়ালে মাঠকোঠা ধরনের বাড়ি, দোতলা, কাঠের সিঁড়ি, মাথায় খাপরার চাল। চারদিকেই কিছু-না-কিছু গাছপালা। বাড়ির একপাশে বাঁধানো কুয়ো।

হরিরাম খেতখামার নিয়ে পড়ে থাকত একসময়, ছেলে গোরখপুরে বড়সড় ব্যবসা ফাঁদার পর বাবার কাছে বড় একটা আসতে পারে না। হরিরামের স্ত্রী মারা গিয়েছে বছর কয়েক আগে। সংসারে একলা মানুষই এখন হরিরাম। খেতখামারের ওপর তার আর টান নেই, ধর্মকর্ম নিয়েই দিন কাটায়। বাড়িতে জোয়ান বয়েসের কাজের লোক আছে একটা, আর আছে পাঁড়েজি, বুড়ো বামুন।

কিকিরা দোতলার ঘরে ডেকে নিলেন চন্দনদের। ঘরটা কাঠের, শীতের রোদ খেয়ে মোটামুটি গরমই লাগছিল, সরাসরি রোদ পড়েছে পেছন দিকটায়, সামনে সরু বারান্দা।

কিকিরার ঘরে একটা তক্তপোশ, টিনের চেয়ার আর কাঁঠালকাঠের টেবিল ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। দড়ির আলনায় জামাটামা ঝুলছে কিকিরার।

চন্দনরা বসার পর কিকিরা তারাপদর মুখ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, “রাত্তিরে ঘুম হয়নি, স্যার?” বলে একটু হাসলেন।

চন্দন বলল, “ওর ঘুম তো গেছেই, সঙ্গে-সঙ্গে আমারও। কাল সারারাত তারা যা করেছে–ভাবছিলাম ওকেই একটা ইঞ্জেকশান ঠুকে দিই।”

“কেন কেন?” কিকিরা কৌতূহল বোধ করে বললেন।

চন্দন বলল, “বলছি। তার আগে আর-একটা খবর আছে। সাধুমামার আজ শেষরাত থেকে শরীর খারাপ। বুকে ব্যথা। মৃত্যুঞ্জয় আমায় ডাকতে এসেছিল শেষরাতে।”

কিকিরা কেমন ব্যস্ত হয়ে বললেন, “বুকে ব্যথা? কী হয়েছে?”

“আমার মনে হল, অনেকদিন ধরেই উনি কোনো দুঃখ-দুভাবনার মধ্যে রয়েছেন, শরীরটাও দুর্বল। হার্টের কিছু গোলমাল হয়ে থাকতে পারে। আমার কাছে স্টেথেসকোপও নেই। নাড়ি ধরে কতটুকু আর বুঝব! প্রেশার, হার্টসই দেখানো দরকার। তবে এই ব্যথাটা বোধ হয় মনের ভীষণ দুভাবনা থেকে হয়েছে।” বলে চন্দন অল্প সময় করে থেকে তারাপদকে দেখল দু পলক, শেষে কিকিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যখন সাধুমামাকে দেখছিলাম, মৃত্যুঞ্জয় আমার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন নিচে এসে ইনঞ্জেকশান নিয়ে আবার ওপরে গেলাম তখন আমি মৃত্যুঞ্জয়কে ঘর থেকে সরিয়ে দিলাম কায়দা করে।”

“কেমন করে?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।

“ব্যাপারটা সহজ। বললাম, আমার কাছে ইথার-টিথার নেই, ইনজেকশানের সিরিঞ্জ আর ছুঁচ স্টেরিলাইজ করতে হবে। গরম জলে এগুলো ফুটিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন তাড়াতাড়ি।”

কিকিরার মুখ দেখে মনে হল তিনি চন্দনের উপস্থিত বুদ্ধিতে খুশি হয়েছেন।

চন্দন বলল, “সাধুমামার মুখ চোখ দেখে আমি আগেই বুঝেছিলাম তিনি আমায় কিছু বলতে চান। তাই কায়দা করে মৃত্যুঞ্জয়কে সরালাম। ঘরে যখন আমি আর সাধুমামা ছাড়া অন্য কেউ নেই, তখন সাধুমামা বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা একটা চিরকুট বের করে আমার হাতে গুঁজে দিলেন। বললেন, আপনার কাছে চিরকুটটা দিতে।” বলে চন্দন প্যান্টের পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করল।

তারাপদ বোকার মতন বসে থাকল । অবাক চোখ করে, সে একবার চন্দনকে দেখছে, একবার কিকিরাকে। কী যে হয়ে যাচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছিল না। বেশ বোঝা যাচ্ছে সাধুমামা কিকিরাকে জানেন। এটাও জানেন যে কিকিরা এখন এখানে। তারাপদদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। সাধুমামাও যেন এক রহস্য।

কিকিরা চিরকুটটা নিয়ে পড়লেন। বার দুই মনে হল, চঞ্চল হয়ে পড়েছেন; প্রকাশ করতে চাইলেন না। কী মনে করে একটা সিগারেট চাইলেন চন্দনের কাছে, তারপর সিগারেটটা ধরিয়ে হঠাৎ উঠে গেলেন।

ঘরে তারাপদ আর চন্দন।

তারাপদ বলল, “কিসের চিরকুট?”

চন্দন বলল, “কিকিরা বলবেন।”

“তুই দেখিসনি?”

“দেখেছি। বুঝতে পারিনি।” চন্দন এ কথা এড়িয়ে গেল ।

তারাপদ একটু চুপ করে থেকে বলল, “সাধুমামা তোকে চিরকুট দিল কেন?”

চন্দন বলল, “তোকে দিয়ে লাভ হত না বলে। কিংবা তোকে দেবার কোনো সুযোগ ছিল না বলে।”

তারাপদর সন্দেহ হল। কিছু যেন ভাবল তারাপদ; বলল, “তুই কী বলতে চাসবুকের ব্যথার নাম করে সাধুমামা তোকে ডেকে ওই চিরকুটটা দিয়েছে?”

“আমার তাই মনে হয়,” চন্দন ছোট করে জবাব দিল।

“সাধুমামাও তাহলে কিকিরাকে চেনে?” তারাপদ বলল।

চন্দন চুপ করে থাকল।

কিকিরা ফিরে এলেন। ফিরে এসে বসলেন না, ঘরের মধ্যে বার দুই পায়চারি করলেন, তারাপদকে দেখলেন বারবার। তারপর বললেন, “একটু দেহাতী চা খেয়ে নিন স্যার, তারপর কথা বলা যাবে।”

তারাপদর ধৈর্য থাকছিল না। সাধুমামা কেন চিরকুট পাঠিয়েছে কিকিরাকে? কী লিখেছে চিরকুটে? অসহিষ্ণু হয়ে তারাপদ বলল, “সাধুমামা আপনাকে কী লিখেছে?”

কিকিরা প্রথমটায় জবাব দিলেন না। পরে বললেন, “সবই বলব স্যার, রয়েসয়ে শুনতে হবে। তার আগে বলুন, ভুজঙ্গ কাল আপনাকে কোন্ খেলা দেখিয়েছে?”

তারাপদর রাগ হল। খেলা? কিকিরা সব জিনিসকেই খেলা মনে করেন? রাগ করে তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গ যা যা দেখায়, সবই আপনি খেলা মনে করেন?

কিকিরা তারাপদর রাগ বুঝে যেন মনে-মনে হাসলেন। চন্দনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনিই বলুন স্যার।”

সাধুমামার চিরকুটে কালকের কথার একটু-আধটু উল্লেখ ছিল । কিকিরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন কাল ভুজঙ্গ কোন্ খেলা দেখিয়েছে। তবু, সবটাই শুনতে চান তিনি। কাল যা যা ঘটেছে চন্দন বলতে লাগল ।

ওরই মধ্যে কাঁচের বড় বড় গ্লাসে চা এল। দেহাতী চা না দুধ-চা বলা মুশকিল, দুধে সাদা হয়ে রয়েছে, সর ভাসছে ওপরে।

চন্দন কথা শেষ করে থামল।

কিকিরা সব শুনে তারাপদর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “আপনি ঠিক জানেন আপনার বোনের আত্মা এসেছিল?”

তারাপদ জেদীর মতন বলল, “আসেনি তার প্রমাণ কোথায়?”

চন্দন চা খেতে খেতে বলল, “তারা, তোর মতন মুখ্য আমি আর দেখিনি। তোকে আমি অত করে বোঝালাম সাধারণ নিয়মে এটা হতে পারে না, অসম্ভব ব্যাপার।”

তারাপদ বলল, “জগতে অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয়। ভুজঙ্গ আমার পিসেমশাই হয়ে ডেকে পাঠাবে এটাই কি সম্ভব?” চন্দন ভীষণ বিরক্ত বোধ করে চুপ করে গেল ।

সামান্য চুপচাপ। কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, আপনি তা হলে বিশ্বাস করেন, আত্মা আছে, আর পরলোক থেকে সেই আত্মারা ভুজঙ্গর ডাকে মাটিতে। নেমে আসে?”

তারাপদ একগুঁয়ের মতন বলল, “হ্যাঁ করি। আমি যা দেখেছি তা অবিশ্বাস করব কেমন করে?”

কিকিরা কয়েক মুহূর্ত তারাপদর দিকে তাকিয়ে থেকে মজার গলায় বললেন, “আপনি যা যা দেখেছেন আমি যদি আপনাকে সেগুলো দেখাতে পারি তাহলে কি আপনি স্বীকার করবেন ভুজঙ্গ আপনাদের ধোঁকা দিয়েছে?”

তারাপদ প্রথমে অবাক হল, তারপর অবিশ্বাসের চোখে কিকিরার দিকে তাকাল।

কিকিরা তাঁর আলখাল্লার মতন জামাটা খুলে ফেললেন। মাথার সেই টুপিটাও খুললেন। বড় রোগা দেখাচ্ছিল তাঁকে; রোগা আর রুগ্ন। মাথার চুলও কিছু কিছু সাদা, লম্বা লম্বা চুল, ঘাড় পর্যন্ত নামানো ।

কিকিরা বললেন, “চলুন আমরা নিচে যাই। নিচের তলায় হরিরামের একটা গুদোমঘর আছে। পুরনো, পোড়ো, ঘর। ঘরটা বেশ অন্ধকার। সেখানে আমরা এই সাত-সকালেই আত্মা নামাব ।” বলে কিকিরা যেন হাসলেন; বললেন, “ভুজঙ্গর আত্মা-নামানোর ঘরে অনেক ব্যবস্থা আছে। সেটা স্যার মডার্ন । আমাদের পোড়ো গুদোমঘরে কিছু নেই। তবু দেখা যাক সেখানে আত্মা নামে কি না?”

তারাপদ এবার কেমন বিব্রত বোধ করল । ভুজঙ্গর আত্মা-নামানোর ব্যপারটা পুরো ধোঁকা এ-কথা এখন প্রমাণ হয়ে গেলেও তার যেন ভাল লাগবে না। অথচ এটা যে মিথ্যে তাও জানা দরকার।

কিকিরা বললেন, “চলুন স্যার, দিনের বেলায় আত্মারা বড় একটা আসতে চায় না, তবু একবার চেষ্টা করা যাক। কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান অনেকদিন পরে তার খেলা দেখাবে।” বলে ঠাট্টার গলায় হাসলেন কিকিরা। তারপর জাদুকরের ভঙ্গিতে পিঠ নুইয়ে মাথা নিচু করে অভ্যর্থনার ভঙ্গি করে ডাকলেন তারাপদদের, “আসুন।”

চন্দন প্রথমে উঠে দাঁড়াল, তারপর তারাপদ। তারাপদ কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছিল।

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামবার সময় কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, একটা কথা আপনাকে বলে দি। ভুজঙ্গ যতবড় শয়তান তার চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান। কিন্তু বুদ্ধিমানও ভুল করে। ভুজঙ্গ মস্ত বড় ভুল করেছে। বারবার একই ফন্দি কাজে লাগে না। পরীর আত্মা নামিয়ে সে আপনার বাবাকে পাগল করেছিল। তাঁকে মেরেছিল বলা যায়। ওই একই কায়দা করে সে আপনাকে হাতের মুঠোয় ধরে ফেলেছে। কিন্তু ও জানে না–একই ফাঁদে দু’বার শিকার ধরা যায় না।”

বাবার কথায় তারাপদ সিঁড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

কিকিরা কিন্তু দাঁড়ালেন না। রোগা, রুগ্ন, হাড় জিরজিরে মানুষটির মুখে ঘৃণা এবং প্রতিহিংসা যেন জ্বলে উঠেছিল।

তারাপদ কিকিরার এমন মুখ কখনো দেখেনি। তার কেমন যেন ভয় হল।

কিকিরা নিচে নেমে গেলেন।