বিকেল যখন হয়ে এলো তখন শুয়ে থেকে তাহমিনা ভাবল, আশরাফ বলে গেছে যেতে না গেলে ভালো দেখাবে না। তাছাড়া আজ দুপুরের ঘটনাটা যদি তার কানে যায় আর সে না যায় চায়ে, তাহলে দুয়ে মিলে একটা কিছু হতে পারে। তা হতে দেবে না তাহমিনা। আর সে না গেলে ফারুক যে একেলা যাবে, তারই বা কী মানে আছে?
অবশেষে বিছানা ছেড়ে উঠে—- তারপর এই প্রথম উঠল—- বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো ভালো করে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছল রগড়ে। প্রসাধন করল। পরল ফিকে সবুজ জমিনের ওপর পাড় দেয়া শাড়ি আর সাদা সার্টিনের ব্লাউস। আবদুলকে ডেকে বলল, ফারুককে তৈরি হয়ে বেরুবার জন্যে খবর দিতে। না, সে সঙ্কোচ করবে না।
দুজনের দেখা হোলো। কথা বলল না। চুপচাপ নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে তারা। হাঁটতে লাগল। পথের দুপাশে বেতের কচি সবুজ পাতা। ইতস্তত শাল আর সুন্দরী। এদিকে বন। ঘন নয়। এদিকে মানুষের বসতি আছে। সব কেমন যেন চুপ এই মুহূর্তে। গাছের পাতাও নড়ে না। পাখিও ডাকে না। যে বনে পাতা পড়ে কুলো হয় সেখান থেকে কোনো আওয়াজও আসে না। সমস্ত এলাকাটা শুধু স্তব্ধ। দুএকটা বসত বাড়ির উঠোন কী অসম্ভব রকম তকতকে, ঠাণ্ডা আর নিঃশব্দ। দুজনেই যেন বধির হয়ে গেছে এমনি চুপচাপ, তাদের যেন আর কিছু ভাবার নেই এমনি নিশ্চিন্ততায় পরস্পর হেঁটে চলল।
ফারুকের মনে এখন নেই আতঙ্কের স্বাদ, নেই ভীত অনুভূতি। তাহমিনার ভাবনা এখন খর নদীর স্রোতের মতন।
দুজনের স্তব্ধতা এখন মুখোমুখি।
তারা এসে পৌঁছুলো। আশরাফ তখন তৈরি হয়ে নিয়েছে, ওদের সাথে চা খেয়ে একসাথে বেরুবে। ওরা বাংলোয় যাবে। আর সে বোটে করে ছনম্বর প্লটে। আশরাফ দূর থেকে দেখেই এগিয়ে এল। বলল, আসুন, আসুন। এসো, তাহমিনা। খোকা, তোর আম্মাকে খবর দিয়ে আয় তো।
ওরা যখন গিয়ে বসলো বসবার ঘরে, তখন তফিয়া এলো। অত্যন্ত কম আসবাবে সাজানো প্রসস্ত কামরা। নিচু আর গভীর বসবার আসন। একধারে আলমিরায় কিছু বই। দেয়ালে একটা চিতল হরিণের ছাল ঝুলিয়ে রাখা। ফারুক আর তাহমিনা সেদিকে তাকাল, নামিয়ে নিল দুজনেই দৃষ্টি। তারপর ফারুক চোখ ফেরালো আফিয়ার দিকে। ভারী, গোলগাল, স্নেহময়ী মানুষটি। গালের গভার ট্রোল আর ঠোঁটের নিঃশব্দ হাসি লেগেই আছে। উজ্জ্বল ফর্সা রংয়ের সাথে চাপা রংয়ের শাড়িটি মানিয়েছে অপূর্ব। পান খেয়েছেন কখন, এখনও ঠোঁটজোড়া স্বচ্ছ লাল হয়ে আছে। দেখলে শ্রদ্ধা হয়, দুদণ্ড বসতে ইচ্ছে করে। আফিয়া তাহমিনাকে শুধালো উদ্বিগ্নস্বরে, কী হয়েছে তোমার বলো তো?
কই, কেন, কিছু নাতো।
কিন্তু মুখ কেমন ভারী দেখাচ্ছে দেখছি।
ফারুক অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। তাহমিনা উত্তর করল, দুপুরে শুয়ে শুয়ে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি তাই।
ও।
কিছুটা শঙ্কিত স্বরে আফিয়া অনুমোদন করলো।
তারপরেই সহজ হয়ে এলো আবহাওয়া। বিকেলের চায়ের নামে আফিয়া যা করেছে তাকে ফারুক আর বিকেলের চা বলতে সাহস পেল না। হাতে তৈরি তিন রকম মিষ্টি থেকে শুরু করে, পরোটা, কিছুটা ঝাল আর নিখুঁত করে বানানো চা। বসে বসেই ফারুক শুনলো ওদের সংসারের গল্প। বড় দুছেলে চাটগাঁয়ে আছে। বোর্ডিং থেকে পড়ছে। আশরাফ চায় না ওরা এই বুনো ব্যবসা ধরুক। তারপর এক মেয়ে ছিল, সে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। সে কথা বলতে গিয়ে আফিয়ার চোখ কিছুটা ভিজে উঠলো আজো। দেয়ালে সেই মৃতা কন্যার ছবি। কিশোরী তনুতে সে সখ করে পরেছে বার্মিজ দেহাভরণ। আর তাইতে লাজুক দেখাচ্ছে আরো। তারপরে এই ছেলে। ওদের সাথেই এখনো আছে। আফিয়া দুবেলা পড়ায়। বড় হলে তাকেও পাঠিয়ে দেবে চাটগা কী ঢাকায়।
এই ছোট্ট সংসারের কথা শুনতে শুনতে ফারুক ভাবল, তাহমিনা কি ভাবছে এখন? সে আড়চোখে তাকাল তার দিকে। গভীর আগ্রহ নিয়ে, যেন নতুন কোন গল্প শুনছে এমনি তন্ময়তায় সে শুনছে। আর তার উন্নত বুক ছোটখাট ফুলে উঠছে মৃদু নিঃশ্বাসের দোলায়। অবশেষে উঠবার সময় হোলো। আফিয়া বলল, তাহমিনা থাক। অনেকদিন আসেনি। আমরা দুজনে গল্প করি। আবদুল এসে নিয়ে যাবে। আর আপনি আর একবার আসবেন।
ফারুক এইখানে হেসে বলল, দেখি। তরপর বলল, আসব নিশ্চয়ই।
আশরাফ বলল, আপনি একটু দাঁড়ান। আমি ভেতর থেকে আসছি। এক সাথেই বেরোই। সবাই চলে গেলে ফারুক একেলা বসে রইল সেই কামরায়। শুধু মাত্র সে। এই মুহূর্তে সে অনুভব করতে পারল তার সত্ত্বাকে, তার পৌরুষত্বকে। সেই শঙ্কা যা সারা বিকেল তাকে ভর করে ছিল, এখন তা নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে গেল। অনুভব করল সাহসের স্বাদ। সে কিছুতেই তাহমিনাকে এমনি করে একটি নিষ্ফল আকাক্ষার মত মরে যেতে দেবে না। না—-তাকে সে মরতে দেবে না। আস্তে আস্তে এই সিদ্ধান্তের অনুরনণ যেন ছড়িয়ে পড়তে লাগল তার সারাটা শরীরে। তার চোখ স্থির নিবদ্ধ হলো মেঝের একটি বিন্দুতে। সে ভাবল। সে তাহমিনার কথা ভাবল। তাহমিনা কত বদলে গেছে তবু সে তার সেদিনের তাহমিনা। পার। হয়ে এসেছে তারা দীর্ঘ একটি সময়ের ব্যবধান তবু এই ব্যবধান—-আজ এক মুহূর্তে এমন কি অকারণে, এই কামরায়, বিলীন হয়ে গেল। অদ্ভুত এক ভাবনা তাকে মৃদু বিস্মিত করলো যেন সে এ কামরায় আজ নতুন আসেনি, বহু দিন বহু কাল ধরে আসছে, আবিষ্কার করেছে ঠিক এই কামরায় এই একই চেয়ারে ঠিক এমনি ভঙ্গিতে বসে মেঝেতে চোখ রেখে হৃদয়ের একেকটা উপলব্ধি, যেন জন্মান্তর থেকে এখানে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছে, আজো নিয়েছে। এমনি সহজ, এমনি ঋজু। কোনো অভাবনীয়তা নেই। কোনো। সংশয় নেই। একদিন সে তাকে ভালবাসতো। হঠাৎ সে আবিষ্কার করেছে আজো তাহমিনাকে সে ভালবাসে। আরো আপন করে, আত্মার মুখোমুখি তাকে সে ভালবাসে।
একটু পর আশরাফ এলো। ও চমকে উঠে দাঁড়াল দ্রুত পায়ে। শুধালো, আপনার জিনিস পত্র?
আগেই বোটে চলে গেছে।
ও।
আশরাফকে সে এগিয়ে দিয়ে এলো ঘাট অবধি। আস্তে আস্তে বোট ছেড়ে দিল। পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আশরাফ হাত নাড়ল। সেও প্রত্যুত্তরে হাত নাড়ল। বোটমাঝি গফুর হাত তুলে। সালাম করল তাকে।
ফারুক অবসাদের ভঙ্গিতে হাত নামালো। মুখ ফেরাল বাংলোর দিকে। আবদুল পেট্রোম্যাকস জ্বেলেছে। উজ্জ্বল আলো তার চোখে আসছে এখান থেকেই। প্রথম সন্ধ্যে। আকাশে দুএক টুকরো মেঘ। একটি বড় তারা। দুদিকে শাল আর সুন্দরী গাছ দূরে দেয়ালের মত সিধে ওপরে উঠে গেছে। আর তারি পাতা বিছানো পায়ে চলা ফিরতি পথ ধরল ও। রক্তের ভিতর অনুভব করল—- অরণ্যের এক অদ্ভুত রহস্যময় আকর্ষণ আছে। সে শুধু কাছে টানে। কাকে যেন টানে। জড়িয়ে ধরতে চায় অমোঘ অলস মৌতাতের মত। ইচ্ছে হয় এখানে এই ভিজে ছায়ায় শুয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে। অথবা হারিয়ে যেতে এই অরণ্যে। এখানে যারা আসে, তাদের কোনো দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই, বাধা নেই, সংকোচ নেই। কিছুই নেই। সমস্ত মুখোশ খুলে আদিম নগ্ন মানুষ হয়ে ওঠে তারা। ফারুকের রক্তের ভিতরে অণুতে অণুতে প্রবাহিত হয়ে গেল এই গান।