বাড়ির উঠোনে ইজিচেয়ার। ইজিচেয়ারের হাতলে লাল ঠোঁটের হলুদ পাখি বসে আছে। লীলা অবাক হয়ে পাখির দিকে তাকিয়ে আছে। কাক, চড়ুই এবং কবুতর— এই তিন ধরনের পাখি মানুষের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে। অন্যসব পাখি দূরে দূরে থাকে। মানুষ দেখলেই উড়ে কোনো গোপন জায়গায় চলে যায়।
লীলা মুগ্ধ হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নড়াচড়া করতেও ভয় পাচ্ছে— পাখিটা যদি উড়ে চলে যায়! থাকুক আরো কিছুক্ষণ বসে। ধান এনে উঠোনে ছড়িয়ে দিলে কি পাখিটা টুকটুক করে ধান খাবে? বাড়ির ভেতর থেকে জলচৌকি নিয়ে লোকমান বের হচ্ছে। লীলা ইশারায় তাকে থামতে বলল। লোকমান ইশারা বুঝতে পারল না। এগিয়ে এলো। দরজার চৌকাঠের সঙ্গে জলচৌকি লেগে শব্দ হলো। হলুদ পাখি উড়ে চলে গেল। লীলার মনটা খারাপ হয়ে গেল। লোকমান বলল, আমারে কিছু বলছেন?
না, কিছু বলছি না।
লোকমান বলল, জলচৌকি কী করব?
লীলা বলল, উঠানের ঠিক মাঝখানে রাখেন। ইজিচেয়ার সরিয়ে দিন।
লোকমান ইজিচেয়ার হাতে নিয়ে এগুচ্ছে। ঠিক তখন হলুদ পাখিকে আবার দেখা গেল। সে এসে কাপড় শুকানোর দড়িতে বসল। বসেই আবারো উড়ে চলে গেল।
লীলা বলল, হলুদ পাখিটাকে কি দেখেছেন?
লোকমান বলল, জি দেখেছি।
পাখিটার নাম কী?
হইলাদা পাখি।
এই পাখিটার আর কোনো নাম নেই?
জি না। আর কী নাম থাকব?
অবশ্যই এই পাখিটার কোনো-একটা নাম আছে। টিয়া পাখির গায়ের রঙ সবুজ। তাই বলে। টিয়া পাখিকে আমরা সবুজ পাখি বলি না। কোকিলকে কালো পাখি বলি না। জলচৌকিটা রেখে আপনি লোকজনদের জিজ্ঞেস করে পাখিটার নাম জেনে আসবেন।
জি আচ্ছা।
আপনি এক কেন? আর লোকজন কোথায়?
সুলেমান চাচাজির সাথে কই জানি গেছে।
সুলেমান ছাড়াও তো এ-বাড়িতে আরো লোকজন আছে। সবাইকে আসতে বলুন।
জি আচ্ছা।
আজ এ বাড়িতে একটা বিশেষ দিন। এটা কি জানেন?
লোকমান জবাব দিল না। আজ যে এ-বাড়িতে বিশেষ দিন তা সে জানে। এ-বাড়িতে বউ আসবে। পরীবানুকে আনা হবে। তবে এই আনা অন্যরকম আনা। আনন্দ-উল্লাসের আনা না। লোকমান ভেবেছিল অন্ধকারে বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে মেয়েটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসা হবে। কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। এখন মনে হচ্ছে তা না। মোটামুটি আয়োজন করেই আনার ব্যবস্থা হচ্ছে। লোকমান নিশ্চিত চাচাজি বিষয়টা পছন্দ করবেন না। তিনি খুবই রেগে যাবেন। তবে রেগে গেলেও কিছু বলবেন না। তিনি তার মেয়েকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। এই বিষয়টা এখন বোঝা যাচ্ছে।
আপনাকে বলেছিলাম পালকির ব্যবস্থা করতে। করেছেন?
লোকমান বলল, জি-না। প্রয়োজনে সেনাবাড়ির পালকি আনা হইত। সেনবাড়ির পালকি এখন নাই।
পালকি ছাড়া নতুন বউ আসবে কীভাবে? আর কোথাও পালকি নেই?
জি না।
লীলা বলল, কাঠমিস্ত্রি খবর দিয়ে আনুন। কাঠ কিনে আনার ব্যবস্থা করুন। পালকি বানানো এমন কোনো জটিল ব্যাপার না।
লোকমান বলল, কী যে কন! পালকি বানান জটিল আছে।
লীলা বলল, জটিল না। সরল সেটা বুঝবে কাঠমিস্ত্রি। আপনি ডেকে নিয়ে আসুন। আমি কথা বলব।
জি-আচ্ছা।
লীলা বলল, এখানের দোকানে রঙিন কাগজ পাওয়া যায়? লাল-নীল কাগজ?
যাইতে পারে।
আমার রঙিন কাগজ লাগবে। খোঁজ নিয়ে দেখুন। রঙিন কাগজ পাওয়া যায় केि না।
জি আচ্ছা।
এখন বলুন আপনাকে কী কী কাজ করতে দেয়া হয়েছে?
কাঠমিস্ত্রি খবর দিয়ে আনব। রঙিন কাগজ আনব।
আরেকটা কাজ করতে বলেছিলাম। হলুদ পাখির নাম জেনে আসতে। আপনাকে তিনটা কাজ দিয়েছি, আপনি তিনটা কাজ শেষ করে যত দ্রুত পারেন চলে আসবেন।
বেলা বেশি হয় নি। নটা সাড়ে নটা বাজে। লীলার হাতে অনেক সময় আছে। পরীবানু আসবে সন্ধ্যায়, তার আগে সব কাজ গুছিয়ে ফেলা যাবে। সিদ্দিকুর রহমান তাঁর মেয়ের হাতে পরীবানুকে এ-বাড়িতে আনার সমস্ত ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিয়েছেন। লীলা কাজগুলি আগ্রহ নিয়ে করছে। সে রমিলার ঘরে ঢুকল।
রমিলা খাটে বসেছিলেন। মেয়েকে দেখে দ্রুত খাট ছেড়ে উঠে এলেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন, মাগো, বাড়িতে কি কোনো ঘটনা আছে?
লীলা বলল, আজ মাসুদের বউকে এ-বাড়িতে আনা হবে।
পরীবানু?
হ্যাঁ, পরীবানু। আপনি নাম জানেন?
জানি।
বাড়িতে নতুন বউ এলে কী কী করতে হয় আমি জানি না। আপনি আমাকে বলে দিন।
রমিলা আনন্দে হেসে ফেললেন। লীলা বলল, ঘরে তালাবন্ধ থেকে আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন না। আমি তালা খুলে দিচ্ছি।
তোমার ব্যাপজান রাগ হইব।
আমি তাঁর রাগ সামলাব। আসুন আমরা দুজনে মিলে সব আয়োজন করি।
অনেক জোগাড়যন্ত্র লাগিব গো মা। কালা গাই-এর দুধ লাগব।
দুধ লাগবে কেন?
দুধ পায়ে ঢালতে হয়।
দুধ কে ঢালিবে?
নিয়ম হইল ছেলের মা ঢালবে। তবে আমারে দিয়ে হবে না। পাগল আর বিধবা এই দুই কিসিমের মেয়ে দুধ ঢালতে পারে না। অলক্ষণ হয়।
অলক্ষণ হোক আর সুলক্ষণ হোক–দুধ আপনি ঢালবেন।
তুমি বললে ঢালব।
আরেকটা কথা মা, আপনি সবসময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন। আপনার মাথা হঠাৎ গরম হয়ে গেলে যেন আমি বুঝতে পারি। ব্যবস্থা নিতে পারি।
রমিলা বললেন, আমার একটা নতুন লাল পাইড় শাড়ি লাগব গো মা। ছেলের মা’র লাল পাইড় নতুন শাড়ি পরতে হয়।
লীলা বলল, আমি আপনার শাড়ির ব্যবস্থা করছি।
রমিলা বললেন, তোমার বাপ কিন্তু রাগ হইব।
না, বাবা রাগ করবেন না। উনি অবাক হবেন কিন্তু রাগ করবেন না। উনার সব রাগ এখন মাসুদের উপর। আমাদের উপর উনার কোনো রাগ নাই।
রমিলা বললেন, মা, তোমার খুব বুদ্ধি।
লীলা বলল, আপনারও খুব বুদ্ধি।
লীলা রমিলার ঘরের তালা খুলে দিল। রমিলা ঘর থেকে বের হলেন। চাপা গলায় বললেন, মাগো আমার খুব ইচ্ছা করতেছে দিঘিতে সিনান করি।
লীলা বলল, বেশ তো, আমিও আপনার সঙ্গে দিঘিতে গোসল করব। আমি কিন্তু সাঁতার জানি না।
রমিলা মুখ টিপে হাসছেন। লীলা সাঁতার জানে না। এই খবরে তিনি মনে হলো খুব মজা পাচ্ছেন। তার হাসি থামেই না।
সিদ্দিকুর রহমান বাড়ি ফিরলেন দুপুরে। ‘গাইড়ার ভিটা’ নামে পরিচিত দেড় শ বিঘার মতো জমির জন্যে বায়না দলিল করতে তার দেরি হলো। গাইড়ার ভিটা এই অঞ্চলের দোষী জমি। এই জমি কিনে যে ভোগদখল করতে গিয়েছে তার উপরই মহাবিপদ নেমেছে— এ-ধরনের জনশ্রুতি আছে। জমির বর্তমান মালিক কাজী আসমত খাও নির্বাংশ হয়েছেন। তার একমাত্র জোয়ান ছেলে এবং ছেলের ঘরের নাতি একই দিনে নৌকাড়ুবিতে মারা গেছে। সিদ্দিকুর রহমান এইসব কারণেই গাইড়ার ভিটা নামমাত্র মূল্যে পেয়েছেন। কাজী আসমত খাঁ বায়না দলিলে সই করার সময় নিচু গলায় বলেছেন, জমিটা যে দোষী কথা সত্য। ভোগদখলের আগে মোল্লা মুসুন্ত্রি ডাইক্যা দোয়া পড়াইতে ভুল কইরেন না। বড়ই দোষ লাগা জায়গা। সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, মানুষ দোষী হয়। জমি দোষী হয় না। মানুষের অন্তরে দোষ লাগে। জমির অন্তরে দোষ লাগে না। কথাটা বলে তার ভালো লেগেছে। তার মনে হয়েছে কিছু না বুঝেই তিনি খুব একটা ভাবের কথা বলে ফেলেছেন। এই ভাবের কথার মর্ম সবাই ধরতে পারবে না। ভাবের কথার মর্ম বুঝতে পারার জন্যে ভাবের জগতে থাকতে হয়। বেশিরভাগ মানুষ ভাবের জগতে থাকে না।
গাইড়ার ভিটা কেনার পেছনে সিদ্দিকুর রহমানের বিশেষ একটা উদ্দেশ্য কাজ করছে। এই উদ্দেশ্যের সঙ্গে ভাবের জগতের কিছু যোগ আছে। জমি দলিলে রেজিস্ট্রি হবার পর তিনি তার উদ্দেশ্য প্রকাশ করবেন। তাও সবার সঙ্গে না। দুএকজনের সঙ্গে। সেই দুএকজন কে তা তিনি ঠিক করে রেখেছেন।
কাজী আসমত খাঁর বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে আসতে তার একঘণ্টার মতো লাগল। সঙ্গে ছাতা নেয়া হয় নি। কড়া রোদের সবটাই মাথায় পড়েছে। তার দ্রুত হাঁটার অভ্যাস। শেষের দিকে তার হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে এলো। বুকে চাপা। ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। তিনি নিজের দুর্বলতা অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে হাঁটার গতি বাড়াতে চেষ্টা করলেন। হাঁটার গতি তেমন বাড়ল না, বুকের চাপ ব্যথাটা শুধু বাড়ল। সুলেমান চিন্তিত গলায় বলল, চাচাজির শইল কি খারাপ লাগতেছে? তিনি প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বাড়ি পৌছানোর পর চোখ বন্ধ করে ইজিচেয়ারে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হবে। মাথা থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে পাঁচ-দশ মিনিট মরা মানুষের মতো পড়ে থাকলেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে।
বাড়িতে পা দিয়ে তিনি ধাক্কার মতো খেলেন। বাংলাঘরের উঠানে দুই কাঠের মিস্ত্রি সমানে করাত চালাচ্ছে। তাদের তিনজন জোগালি কাঠে রান্দা দিচ্ছে। একটু দূরে লোকমান শুকনামুখে বসে আছে। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ঘটনা। কী? লোকমান চট করে জবাব দিতে পারল না, হড়বড় করতে লাগল। সিদ্দিকুর রহমান কড়া গলায় বললেন, ঘটনা কী বলো? এরা কী বানায়? পালঙ্ক?
লোকমান বলল, জি না।
তাহলে বানাইতাছে কী?
পালকি।
পালকি কী জন্যে?
বইনজির হুকুমে পালকি বানাইতাছে। বইনজিটা কে?
লীলা বইনজি।
সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, পালকি দিয়া কী হবে? সে কি পালকি দিয়া যাতায়াত করবে?
নতুন বউ পালকি দিয়া আসবে।
সিদ্দিকুর রহমান আরো অবাক হয়ে বললেন, নতুন বউ কে?
লোকমান ভীত গলায় বলল, মাসুদ ভাইজানের ইসাতিরি। পরীবানু।
সিদ্দিকুর রহমান ধাক্কার মতো খেলেন। মাসুদের স্ত্রীকে যে আজই এবাড়িতে আনার কথা সেটাই তার মনে নেই। মেয়েটার নাম যে পরীবানু তাও মনে ছিল না। সুলেমান বলল, চাচাজি, কাজ কি বন্ধ করে দিব?
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমার মেয়ে যে কাজ শুরু করেছে সেই কাজ আমি বন্ধ করব এটা কেমন কথা?
সুলেমান বলল, কাজ বন্ধ না কইরা উপায়ও নাই। একদিনে কাজ শেষ হইব না। অসম্ভব।
সিদ্দিকুর রহমান গম্ভীরমুখে বললেন, অসম্ভব বলে কোনো কথা নাই। দুইজন মিস্ত্রি না পারলে দশজন মিস্ত্রিরে কাজে লাগাও। জোগালি বাড়ায়ে দাও। পালকি এমন কোনো জটিল জিনিস না যে বানাতে একবছর লাগবে।
সুলেমান বিড়বিড় করে বলল, কথা সত্য। সিদ্দিকুর রহমান মিস্ত্রিদের দিকে বললেন, কী, তোমরা দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবো?
মিস্ত্রিদের একজন বলল, চেষ্টা নিব।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, চেষ্টা নেওয়া-নেওয়ির কিছু নাই। হয় পারবা, না হয়। পারব না। দুই-এর মাঝামাঝি কিছু নাই।
পিনিছিং ভালো হইব না। তয় কাজ চলব।
সিদ্দিকুর রহমান আর কথা বাড়ালেন না। বকুলগাছের ছায়ার নিচে তার ইজিচেয়ার পাতা আছে। তিনি চেয়ারে শুয়ে পড়লেন। বুকের চাপা ব্যথা আরো বেড়েছে। পানির পিপাসা হয়েছে। তীব্র পিপাসা নিয়ে পানি খেতে নেই। তিনি পানির পিপাসা কমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। শরীরটাকে ঠিক করতে হবে। মাসুদের বউ আসবে। কিছু ব্যবস্থা তাকে নিতে হবে। এখন আধমরার মতো বিছানায় শুয়ে থাকা যাবে না। সমস্যা হলো মানুষ ইচ্ছা করলেই তার শরীর ঠিক করতে পারে না। মানুষ তার শরীর যেমন ঠিক করতে পারে না, মনও ঠিক করতে পারে না। মন এবং শরীর কোনোটার উপরই মানুষের কোনো দখল নেই।
সিদ্দিকুর রহমান চাপা গলায় ডাকলেন, বদু কি আছ আশেপাশে?
বদু দৌড়ে এলো। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, নাপিত ডাক দিয়া আনো। নাপিতরে বলো সে যেন মাসুদের মাথা কামায়ে দেয়।
জি আচ্ছা।
মাসুদরে বলবা, এটা আমার হুকুম।
জি আচ্ছা।
সিদ্দিকুর রহমান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তার ঘুম পাচ্ছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। ঘুমের মধ্যেই মনে হচ্ছে–আল্লাহপাক মানুষ নামে এক আশ্চর্য জিনিস তৈরি করেছেন, যে-জিনিসের কোনো নিয়ন্ত্রণ তার নিজের কাছে নাই। নিয়ন্ত্রণ অন্য কোনোখানে। তিনি ইচ্ছা করলেও এখন জেগে থাকতে পারবেন না। তাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। সিদ্দিকুর রহমান ঘুম-ঘুম চোখে ডাকলেন, সুলেমান।
সুলে মান ভীত গলায় বলল, জি।
আমি যদি ঘুমায়ে পড়ি কেউ যেন আমার ঘুম না ভাঙায়।
জি আচ্ছা।
আমার শরীর ভালো না। আমি কিছুক্ষণ শান্তিমতো ঘুমাব।
সুলেমান বলল, জি আচ্ছা।
বড় দেখে একটা তালা জোগাড় করো।
জি আচ্ছা।
মাসুদের বউ ঘরে আসার পরে আমি মাসুদকে তালাবন্ধ করে রাখব।
জি আচ্ছা।
সিদ্দিকুর রহমানের ঠোঁটের কোনায় সামান্য হাসির আভাস দেখা গেল। তার মাথায় অন্য একটা চিন্তা এসেছে। কোনো মানুষেরই তার নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু একজন মানুষ ইচ্ছা করলে অন্য একজন মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয় নি। কিন্তু অন্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়েছে। বড়ই জটিল অঙ্ক।
সুলেমান!
জি চাচাজি?
পানি খাব। পানির পিপাসা হয়েছে।
সুলেমান ছুটে গেল পানি আনতে। পানির জগ এবং গ্লাস হাতে ফিরে এসে সে দেখে, সিদ্দিকুর রহমান গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন। সুলেমান তার ঘুম ভাঙালি না। ইজিচেয়ারের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে রইল যেন কোনো অবস্থাতেই কেউ সিদ্দিকুর রহমানের কাছে যেতে না পারে। দুনিয়া উলট-পালট হয়ে গেলেও চাচাজির ঘুম ভাঙানো যাবে না।
শহরবাড়ির বারান্দায় আনিস বসে আছে। তার শরীর পুরোপুরি সারে নি। দুপা হাটতেই শরীর ভেঙে আসে। তবে জ্বর আসছে না। খাওয়ায় রুচি ফিরে এসেছে। মজার ব্যাপার হলো, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় নি। ময়মনসিংহ পর্যন্ত তাকে নিয়ে যেতেও হয় নি। গৌরীপুর জংশনে হঠাৎ সে উঠে বসে বলেছে, আমার শরীর ঠিক হয়ে গেছে।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কীভাবে ঠিক হয়ে গেল?
আনিস বলল, কীভাবে ঠিক হয়েছে জানি না। কিন্তু এখন ঠিক আছে।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ঠিক আছে বেঠিক হতে কতক্ষণ?
আনিস বলল, বেঠিক হবে না।
সতীশ ডাক্তার থার্মোমিটারে জ্বর মেপে বলল, জ্বর নাই।
সিদ্দিকুর রহমান রোগী নিয়ে ফিরে এলেন।
এখন আনিসের গায়ে একটা কম্বল। সে কম্বলের ভেতর থেকে পা বের করে খালি পা রোদে মেলে আছে। কার্তিক মাসের রোদটা খুবই আরামদায়ক মনে হচ্ছে। সে আগ্রহ নিয়ে মাসুদকে দেখছে। মাসুদ বকুলতলায় বসে আছে। একজন নাপিত তার মাথা কামিয়ে দিচ্ছে। আনিস শুনেছে মাসুদের আজ বিয়ে। যে ছেলের বিয়ে তার মাথা কামিয়ে দেয়া হচ্ছে কেন তা সে বুঝতে পারছে না। এই বাড়ির অনেক কিছুই তার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়।
দিঘির পানিতে পা ড়ুবিয়ে লীলা বসে আছে। সে খুবই অবাক হচ্ছে— এই দিঘির পাড়া-ঘেঁসে সে বেশ কয়েকবার আসা-যাওয়া করেছে। অথচ কখনো চোখে পড়ে নি এই দিঘির বাঁধানো ঘাট অসম্ভব সুন্দর। আগে জানলে সে ঘাটে এসে পা ড়ুবিয়ে বসে থাকত।
রমিলা মাঝপুকুরে। তিনি মনের আনন্দে সাঁতার কাটছেন। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না। সাঁতার কাটা কোনো পরিশ্রমের কাজ। মনে হচ্ছে মানুষটা পাখির পালকের মতো হালকা। নিজে নিজেই পানির উপর ভেসে আছেন। মাঝে মাঝে বাতাস আসছে। বাতাস মানুষটাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।
লীলা বলল, মা, আপনি বেশি দূরে যাবেন না। আমার ভয় লাগে।
রমিলা বললেন, কিসের ভয় গো মা?
লীলা বলল, আমার শুধু মনে হচ্ছে হঠাৎ আপনি সাঁতার কাটতে ভুলে যাবেন আর টুপ করে পানিতে ড়ুবে যাবেন।
সাঁতার কেউ ভোলে না।
লীলা বলল, আপনাকে সাঁতার কাটতে দেখে আমার নিজেরও সাঁতার কাটতে ইচ্ছা হচ্ছে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে সাঁতার কাটা খুব সহজ কাজ। আপনি কি আমাকে সাঁতার কাটা শিখিয়ে দিতে পারবেন?
হুঁ পারব।
লীলা বলল, সাঁতার কাটা শেখার পর আমি রোজ দুপুরে আপনাকে নিয়ে দিঘিতে সাঁতার কাটব।
রমিলা বলল, কুমারী মেয়ের এই দিঘিতে নামা নিষেধ আছে গো মা। তোমার বাবার কঠিন নিষেধ আছে।
লীলা অবাক হয়ে বলল, কেন?
রমিলা বললেন, দুইজন কুমারী মেয়ে এই দিঘিতে সাঁতার দিতে গিয়ে মারা গেছে। এইজন্যেই নিষেধ। তোমার বাবার ধারণা দিঘিটা দোষী। উনি নিজেও কোনোদিন দিঘিতে নামেন না।
লীলা বলল, মা, আপনি উঠে আসুন তো, আমার ভালো লাগছে না।
রমিলা বললেন, আরেকটু থাকি গো মা। কতদিন পরে দিঘিতে নামলাম। মা শোনো, কুঁজা মাসস্টার হাসপাতাল থাইকা ভালো হইয়া ফিরছে কিন্তু তুমি তারে দেখতে যাও নাই এইটা কেমন কথা!
আমি যে দেখতে যাই নাই আপনাকে কে বলল?
রমিলা হেসে দিলেন। হাসতে হাসতে পানিতে ড়ুব দিলেন। লীলার মনে হলো, দিঘির ভেতর থেকে তার হাসির শব্দ আসছে। আতঙ্কে লীলার হাত-পা জমে আসছে।
অনেকক্ষণ পরে রমিলার মাথা ভেসে উঠল। তিনি দিঘির ঘাটে উঠে এলেন। লীলার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বললেন, মাগো, আমারে তাড়াতাড়ি ঘরে নিয়া তালাবন্ধ করে রাখো। আমার ভালো লাগতেছে না। মাথা যেন কেমন করতেছে।
লীলা মায়ের হাত ধরল। রমিলা থারথার করে কাঁপছেন।
সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের ঘুম ভাঙল আছরের পর। তিনি হাত-মুখ ধুয়ে আছরের নামাজ পড়লেন। সুলেমানকে বললেন, অবেলায় কিছু খাবেন না। শুধু ডাবের পানি খাবেন।
আছরের নামাজ শেষ করে তিনি পালকি দেখতে গেলেন। পালকি বানানো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। দেখতেও যে খারাপ হয়েছে তা না। তিনি লোকমানকে ডেকে বললেন, এদের প্রত্যেককে একটা করে নতুন লুঙ্গি যেন বখশিশ হিসেবে দেয়া হয়। লুঙ্গি আর পাঁচ টাকা করে বখশিশ।
সিদ্দিকুর রহমান বাড়ির উঠানে ঢুকে চমৎকৃত হলেন। উঠানের মাঝখানে জলচৌকি বসানো। জলচৌকিতে নকশা করা হয়েছে। জলচৌকির চারপাশে চারটা কলাগাছ। রঙিন কাগজের মালা দিয়ে গাছ সাজানো। বন্ধুবরণের ব্যবস্থা। তাঁর মন হঠাৎ অসম্ভব ভালো হয়ে গেল। তাঁর ইচ্ছা করতে লাগল লীলাকে ডেকে তার ভালো লাগার কথাটা বলবেন। তিনি তা না করে সুলেমানকে ডাকলেন। শান্ত গলায় বললেন, তোমারে বড় তালার জোগাড় দেখতে বলেছিলাম। দেখেছ?
সুলেমান বলল, জি চাচাজি, তালার জোগাড় হয়েছে।
মাসুদের স্ত্রীর নাম যেন কী?
পরীবানু।
পরীবাবু বাড়িতে ঢোকার পরপরই মাসুদরে তার ঘরে তালা দিয়ে আটকায়ে রাখবে।
জি আচ্ছা।
এইটা আমার হুকুম। হুকুমের যেন নড়াচড় না হয়।
জি আচ্ছা।
ভেতরবাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। রমিলা চিৎকার করে কী যেন বলছেন। মাথা দিয়ে কাঠের দেয়ালে ধাক্কা দিচ্ছে। সন্ধ্যার আগে-আগে রমিলার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। আজ মনে হয় বেশি এলোমেলো হয়েছে।
সিদ্দিকুর রহমান বড় করে নিঃশ্বাস নিলেন। হাতের ইশারায় সুলেমানকে ডাকলেন। শান্ত গলায় বললেন, জামাইয়ের মাথা কি কামানো হয়েছে?
সুলেমান বলল, জি।
মাথা কামানোর সময় জামাই কি চোখের পানি ফেলেছে?
জি। খুব কান্নাকাটি করেছে।
এখন লীলাকে বলো, মাসুদের স্ত্রীকে আনার জন্যে যেন পালকি যায়।
জি আচ্ছা।
হিন্দুবাড়ি থেকে ঢোল করতাল বাজাবার কিছু লোকজন আনো। আমার ছেলে গানবাজনার এত বড় সমাজদার! তার স্ত্রী এই বাড়িতে ঢুকবে গানবাজনা ছাড়া— এটা হয় না। যাও বাজনাদার আনো।
মাসুদকে সত্যি সত্যি তালাবন্ধ করা হয়েছে। তার মাথা কামানো। সে হলুদ রঙের একটা চাদর গায়ে দিয়েছে। তাকে দেখাচ্ছে হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো।‘
বাড়ির উঠানে বাজনাদাররা এসে বাজনা বাজাচ্ছে। বাজনার শব্দ তার কানে যাচ্ছে। রমিলা চিৎকার করছেন। রমিলার ঘর মাসুদের ঘরের কাছে না। অনেকটা দূরে। তারপরেও বাজনার শব্দ ছাপিয়ে রমিলার কান্নার শব্দ মাসুদের কানে আসছে। মাসুদ একসময় চাপা গলায় ডাকল, বুবু। বুবু।
লীলা এসে মাসুদের সামনে দাঁড়াল।
মাসুদ বলল, বুবু, আমি কিন্তু এর শোধ তুলব। আমি অবশ্যই শোধ তুলব।
লীলা বলল, এখনই এত অস্থির হয়ো না।
মাসুদ বলল, বাবা সব মানুষকে গরু-ছাগল মনে করে। এটা ঠিক না বুবু।
কয়েকটা দিন যাক, সব ঠিক হয়ে যাবে।
মাসুদ বলল, ঠিক হোক, বেঠিক হোক আমি এর শোধ তুলব। বাবা কী করবে না করবে সেটা যেমন আগে কেউ বুঝতে পারে না, আমি কী করব সেটাও বাবা বুঝতে পারবে না। সমানে সমান।
সমান হবার চেষ্টা করা ভালো না মাসুদ।
মাসুদ হাউমাউ করে কাঁদছে। লীলার মন খারাপ লাগছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, জটিল একটা খেলা শুরু হয়েছে। তাকে এখানে রাখা হয়েছে দর্শক হিসেবে। এর বাইরে তার কোনো ভূমিকা নেই।
বাজনা শুরু হবার পরপরই রমিলা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছেন। তার মনে পড়েছে যে আজ এ বাড়িতে ছেলের বউ আসবে। তাকে বধূবরণ করতে হবে। তিনিও চাপা গলায় ডাকছেন, লীলা, ও লীলা।