বাস্-এ উঠিয়া প্রদীপের বিস্ময়ের আর সীমা রহিল না : সামনের জায়গাটাতে পিছন ফিরিয়া উমা বসিয়া আছে। নিশ্চয়ই উমা। তাই বলিয়া এক-বাস লোকের সামনে হঠাৎ তাহাকে সম্ভাষণ করিলে সেটা বাঙলা-সমাজের রুচিতে হয়তো বাধিবে। উমা কোথায় নামে সেইটুকু লক্ষ্য করিবার জন্য প্রদীপ তাহার গন্তব্য স্থানের সীমাটুকু পার হইয়া চলিল। কেন না উমাকেও হঠাৎ চমকাইয়া দিতে হইবে।
বাস একটা গলির মোড়ে আসিয়া থাকিল। উমা এত উদাসীন যে, নামিবার সময়ও প্রদীপকে একবার লক্ষ্য করিল না, কিন্তু রাস্তায় পা দিতেই টের পাইল, পেছন হইতে কে তাহার আঁচল টানিয়া ধরিয়াছে। ভয়ে চোখ মুখ পাংশু হইয়া উঠিতে না উঠিতেই আনন্দে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল :
—“আপনি এখানে? বা রে! আর আমি আপনাকে সারা শহর খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
প্রদীপ ততক্ষণে নিশ্চয়ই তাহার আঁচল ছাড়িয়া দিয়াছে। ফুটপাতের উপর উঠিয়া আসিয়া কহিল,—“সারা শহর খুঁজে বেড়াচ্ছ কি রকম? গুপ্তচর নাকি? এখানে এলে কবে?”
উমা কহিল,—“বাঃ, এখানে এসেছি আজ ঠিক সাত দিন হ’ল। বাবা-মাও এসেছেন। বাবা দু’মাসের ছুটি নিয়েছেন যে। আমি যে বেথুন-ইস্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম।”
প্রদীপ উমারই বিস্ময়ের প্রতিধ্বনি করিল: “বাঃ, এত খবর—আমি ত’ কিছুই জানতে পাইনি।”
—“কি করে পাবেন? আমাদের খবর পাবার জন্যে ত’ আপনার আর মাথা ধরে নি! ল্যাঙ্কাশায়ারে ক’টা কাপড়ের মিল বন্ধ হ’ল এ-সব বড়-বড় খবর রাখতেই আপনাদের সময় যায় ফুরিয়ে, না? আমরা বাচলাম কি মরুলাম—তাতে আপনার বয়ে গেল।”
উমার কথার সুরে স্নিগ্ধ অভিমান ঝরিয়া পড়িল। সে যে মনে মনে কখন এমন অন্তরঙ্গ হইয়া উঠিয়াছে, প্রদীপ তাহা ভাবিয়া পাইল। কণ্ঠস্বর কোমলতর করিয়া কহিল,—“আমি যে এখানে ছিলাম বহুদিন। গিয়েছিলাম বহু দূরে—পাঞ্জাবে। জরুরি কাজ ছিল।”
একটি অস্ফুট ভঙ্গি করিয়া উমা কহিল,—“সবই ত’ আপনার জরুরি কাজ। কিন্তু যাবার আগে আমাদের আপনার ঠিকানাটা লিখে পাঠালে নিশ্চয়ই পাঞ্জাবের ট্রেন মিস করতেন না। তা’, আমাদের সঙ্গে আপনার আর সম্পর্ক কি বলুন। দাদার সঙ্গে সব ছাই হয়ে গেছে।”
রাস্তায় দাঁড়াইয়া এই সব কথার কি উত্তর দিবে, প্রদীপের ভাষায় কিছুতেই কুলাইয়া উঠিল না। এই মেয়েটির কথায় তাহার চিত্ত যেন ভরিয়া উঠিল। এই পৃথিবীর পারে কেহ তাহার জন্য একটি সশঙ্ক স্নেহ নিভৃতে লালন করিতেছে, ভাবিতে তাহার মন ভিজিয়া গেল। বলিল,-“আমার ঠিকানার হঠাৎ এত দরকার হল?”
—“না, দরকার আর কি! অজানা মানুষ, কলকাতায় এলাম— তেমন কোনো বন্ধু-আত্মীয়ও আর নেই যে, দু-চারটে উপদেশ দেবে। দাদা থাকলে বরং—”
কথাটা অসমাপ্ত রাখিয়াই উমা প্রদীপের মুখের দিকে তাকাইল এবং চোখোচাখি হইতেই সে ফিক্ করিয়া হাসিয়া ফেলিল। সেই স্বল্প সঙ্কেতময় হাসিটিতে প্রদীপের মর্মবেদনা নিমেষে মুছিয়া দিয়া উমা কহিল,—“দাদার পুরোনো ডায়রিতে আপনার মেস্-এর একটা ঠিকানা পেয়েছিলাম। সেখানে বার তিনেক লোক পাঠিয়েছি; প্রথম বার বল্লে, বাবু ঘুমুচ্ছেন; দ্বিতীয় বার বল্লে, বাবু বাড়ি নেই; তৃতীয় বার বলে, ও বাড়ীর কেউ বাবুকে চেনেই না।” বলিয়া উমা একটু নুইয়া পড়িয়া খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
প্রদীপ কহিল,—চতুর্থ বার লোক পাঠালে খবর পেতে, বাবু মাথা। ন্যাড়া করে বেলতলায় গেছেন হাওয়া খেতে। কিন্তু তোমাদের বাড়িটা কোথায়?
আঙুল দিয়া দেখাইয়া উমা কহিল,—“ঐ গলিতে। বিয়াল্লিশ নম্বর। যাবেন? গরিবদের ঘরে পায়ের ধূলো দিতে বাধা নেই ত’?”
—“তুমি কী যে বল, উমা!” বলিয়া প্রদীপ উমার হাত ধরিয়া রাস্তাটুকু পার হইয়া গলির মধ্যে আসিয়া পড়িল।
গলিতে পা দিতেই প্রদীপের কেন জানি মনে হইল, সে স্বপ্ন দেখিতেছে। কণ্টকসঙ্কুল রুক্ষ পথ-প্রান্তে কেহ তাহার জন্য একটি আশ্রয়-নীড় নির্মাণ করিয়া রাখিয়াছে ভাবিয়া, বিধাতাকে তাহার বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হইল বোধ হয়। আকাশ-বিস্তীর্ণ মহাশূন্যতায় তাহার উডডান দুই পাখা আবার ক্ষণতরে বিশ্রাম লাভ করিতে পারিবে।
এই মেয়েটি তাহার ছোট দুইটি করতলে এ কী সান্ত্বনা লইয়া আসিয়াছে! নয়, নয়—তাহার জন্য স্নেহ নয়, সেবা নয়—সুধার আস্বাদ সে এই জীবনে নাই বা লাভ করিল! তবু একবার সে এই তিমিরময়ী রাত্রির পার খুজিবে—এই নিরানন্দ পথরেখা কোথায় আসিয়া আবার সুখস্বর্গলোকে উত্তীর্ণ হইয়াছে, তাহার সন্ধান না লইলে চলিবে কেন?
বত্রিশ, তেত্রিশ—বাড়িটার কাছে আসিয়া পড়িয়াছে আর কি! উমার ডাকে সে আরেকটি দুঃখিনী নারীর অনুচ্চারিত অনুনয় শুনিয়া থাকিবে হয় ত’। আরেকটু অগ্রসর হইলেই নমিতার দেখা পাইবে ভাবিতেই প্রদীপের মন বাজিয়া উঠিল। আশ্চৰ্য, এত দিন নমিতার কথা তাহার একটুও মনে হয় নাই। সে এত দিন এত সব ভয়ঙ্কর সমস্যায় জর্জরিত হইয়া ছিল যে, তাহার কাছে কোনো ব্যক্তিবিশেষের সামান্য দুঃখ-দুর্দশা সমুদ্রের তুলনায় গোষ্পদের চেয়েও হীন ছিল। কিন্তু এখন নিবিষ্টমনে নমিতার নিরাভরণ ব্যথা-মলিন মূর্তির কথা মনে পড়িয়া গেল। তাহার ধ্যানের ভারতবর্ষ ত’ এমনই। এমনিই বিগতগগৗরব, হৃতসৰ্বস্ব। শুধু অতীতের একটি ক্ষীণায়মান স্মৃতির সুধা সেচন করিয়া নিজের বর্তমান বিকৃত জীবনকে বাঁচাইয়া রাখিতেছে। নমিতার মত তাহারো কোনো ভবিষ্যৎ নাই। এমনি মূক, এমনি প্রতিবাদহীন।
বাড়ির দরজা পর্যন্ত আগাইয়া আসিল, কিন্তু নমিতার বিষয়ে উমাকে একটা প্রশ্নও করা হইল না। সে কেমন করিয়া দিন কাটাইতেছে না জানি। প্রশ্ন করা হইল না বটে, কিন্তু উমার পদানুসরণ করিয়া উপরে আসিয়াই তাহার চক্ষু সন্ধিৎসু হইয়া উঠিল। একটা তক্তপোষের উপর বসিয়া অরুণা একটি যুবকের সঙ্গে কথা কহিতেছিলেন; প্রদীপ আসিয়া প্রণাম করিলে তিনি পা দুইটাকে একটু সরাইয়া লইলেন মাত্র, কুশলজিজ্ঞাসা বা আনন্দজ্ঞাপনের সাধারণ সাংসারিক রীতিটুকু পৰ্যন্ত পালন করিলেন না। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক বটে, কিন্তু ইহার বিসদৃশতাটা প্রথমে প্রদীপের চোখে পড়িল না; সে আপনার খুসিতে বলিয়া চলিল : “দেখা আবার হ’তেই হবে। হয় ত’ এতক্ষণে কোনো অতিথিশালায় গিয়ে পচতে হত, কিন্তু দিব্যি উমার সঙ্গে মা’র কাছে চলে এলাম। আমাকে আর পায় কে?”
এই কথাগুলির সস্নেহ প্রতিধ্বনি মিলিল না। অরুণা একটু দুরে বসিয়া কহিলেন, “তোমার এ বাড়িতে আসাটা উনি পছন্দ করেন না।”
উমা প্রখর-কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল,—“কারণ?”
মেয়ের মুখের এই প্রশ্ন শুনিবার জন্য অরুণা প্রস্তুত ছিলেন না। উমাই যে প্রদীপকে ডাকিয়া আনিয়াছে, এবং তাহাকে হঠাৎ বাড়ি হইতে চলিয়া যাইতে বলাটা যে উমার পক্ষেই অপমানকর, তাহা অরুণাকে তখন কে বুঝাইয়া দিবে? তাই তিনি রুক্ষস্বরে কহিলেন, – “কারণ আবার কি? সত্যি প্রদীপ, তুমি না এলেই উনি খুসি। হবেন।”
প্রদীপ বিস্ময়ে মূক, পাথর হইয়া গেল। মুহূর্তে ব্যাপারটা কি হইয়া গেল সে বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। সে একবার উমার মুখের দিকে তাকাইল। সে মুখ কালো, লজ্জায় বিধুর। কোথায় যে একটা কদৰ্যতা রহিয়াছে, প্রদীপ ধরিতে পারিল না। তবু কহিল,—“কোথাও বসে থাকবার সময় আমাদের এমনিই কম, তবু চেনা লোকের মুখ দেখতে পেলে তাদের পাশে একটুখানি না জিরিয়ে যেতে পারি না, মা! আমরাও না। একজনকে ত’ চিরদিনের জন্যেই হারিয়েছি, কিন্তু নমিতাকে দেখতে পাচ্ছিনে ত’। তাকে একবার ডাকবে, উমা?”
অরুণার দৃষ্টি কুটিল হইয়া উঠিল; কথা শুনিয়া তিনি এমন সবেগে ‘সরিয়া বসিলেন যে, যেন শারীরিক গ্লানি বোধ করিতেছেন। দৃশ্যটা উমা ও প্রদীপ দুই জনেরই চোখে পড়িল। কিন্তু এই আচরণের একটা বুদ্ধিসম্মত ব্যাখ্যা বাহির করিবার আগেই অরুণা কহিলেন,—“তার খোঁজে দরকার কি? সে বাপের বাড়ি আছে।”
কটুকণ্ঠস্বরে প্রদীপ সামান্য বিচলিত হইল। তবু সহজ স্বরে স্মিতমুখে কহিল,—“ভালই হ’ল। তার বাপের বাড়ি শুনেছিলাম কলকাতায়ই। ঠিকানাটা ভুলে গেছি। ঠিকানাটা বলুন না, একবার না-হয় দেখা করে রাখি। কখন আবার কোথায় যাই ঠিক নেই।”
প্রদীপের এতটা অবিনয় অরুণার সহ হইল না। তিনি একবার উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কহিলেন,—“তার ঠিকানা নিয়ে তোমার কি এমন স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটবে শুনি?”
—“আমার না ঘটলে দেশের কিছুটা ঘটতে পারে হয় ত’। নমিতার হাতে এখন আর কী কাজ থাকতে পারে? জীবনে তার যা পরম ক্ষতি ঘটেছে তাকে পরের সেবায় পুষিয়ে নিতে না পারলে নিজের কাছে লজ্জার যে তার সীমা থাকবে না।”
—“তুমি যে চমৎকার বক্তা হয়েছ দেখছি। নমিতার কি করা উচিত না উচিত তার জন্যে তার অভিভাবক আছে। তোমার মাথা না ঘামালে কোনো ক্ষতি নেই।”
প্রদীপ তবু হাসিল বটে, কিন্তু গলার স্বর ভারি হইয়া উঠিল : শাস্ত্রবিহিত অভিভাবকের চেয়ে নিজের বিবেকের শাসনই প্রবল হয়ে ওঠে, মা। বিংশ শতাব্দীর ধৰ্ম্মই এই। নমিতার কি করা উচিত না উচিত সে-পরামর্শ তার সঙ্গেই করা ভালো।”
অরুণার মূখ চোখ রাঙা হইয়া উঠিল; কহিলেন,—“তুমি বলতে চাও স্বামীর ধ্যান ছেড়ে তোমাদের এই তুচ্ছ দেশসেবায় তাকে তুমি প্ররোচিত করবে?”
–“আমার সাধ্য কি মা? নিজে না জাগলে কেউ কাউকে ঠেলে জাগাতে পারে না। যদি নমিতা একদিন বোঝে তার এই স্বামীধ্যানটাই তুচ্ছ, তা হলে সেটা দেশের পক্ষে পরম সৌভাগ্যসূচনা। কেন না দেশের সেবায়ই সে বেশি মৰ্যাদা পাবে। মরা লোককে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে আমরা আমাদের মনগুলিকে মিউজিয়মে রূপান্তরিত করি নি। যাক্, ঠিকানাটা দিন, সত্যিই আমারো বেশি সময় নেই।”
অরুণা কহিলেন,—“তোমাকে তার ঠিকানা দিতে পার্লাম না।”
প্রদীপ স্তব্ধ হইয়া গেল। বলিল,—“কারণটা জানতে পারি?”
—“নিশ্চয়। কারণ, আমরা চাই না বাইরের লোক এসে আমাদের ঘরের বউর সঙ্গে বাজে আলাপ করে।”
সমস্ত কুয়াসা এতক্ষণে পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে। প্রদীপের নিশ্বাস হালকা হইয়া আসিল। যেন সে একটা গভীর সন্দেহ ও আশঙ্কা হইতে এতক্ষণে মুক্তি পাইয়াছে। একটু হাসিয়া কহিল,—“আপনার বিধান আমি মেনে নিলাম, মা। ঠিকানা আমি তার চাইনে। যদি সত্যিই তার সঙ্গে দেখা করবার ইচ্ছাটা আন্তরিক হয়ে ওঠে, তবে একদিন দেখা তার পাবই—এ একেবারে স্বতঃসিদ্ধ। আগে ভাবতাম, নমিতা আমার বন্ধুর স্ত্রীর প্রতি আমারো দায়িত্ব আছে। এখন সে-সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিলেন বলে ভালোই হ’ল। এখন যদি নমিতার সঙ্গে কোনোদিন দেখা হয়, সে আর আমার বন্ধুর স্ত্রী নয়, মা, খালি বন্ধু। চাইনে ঠিকানা।” বলিয়া প্রদীপ দ্রুতপদে সিড়ি দিয়া সোজা নামিয়া আসিল।
হঠাৎ সিড়িতে উমার ব্যগ্র কলকণ্ঠ শোনা গেল : “দাঁড়ান দাঁড়ান। দীপ-দা। বউদির ঠিকানা নাই বা পেলেন, নিজের ঠিকানা না দিয়ে পালাচ্ছেন যে।”