১০. বার্ড ফ্লু
মানুষের যে রকম ফ্লু হয়, পাখিদের সে রকম ফ্লু হয় আর সেই ফ্লয়ের নাম বার্ড ফ্লু। মানুষের ফ্লু আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে নিই না, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যার এক-দুই বার ফ্লু হয় নি। দুই-চার দিন নাক দিয়ে পানি ঝরেছে, ফ্যঁচ ফ্যাঁচ করে হাঁচির সাথে গা ম্যাজ ম্যাজ করেছে, দুই-চারটা এসপিরিন খেয়ে নিজে থেকে ভালো হয়ে গেছে। মানুষের ফুঁ নিয়ে যদি আমরা ব্যস্ত না হই তাহলে পাখির ফুঁ নিয়ে আমরা এত ব্যস্ত কেন? হাঁস-মুরগি কবে থেকে মানুষ থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল?
বিষয়টা বোঝার জন্যে আমাদের ব্যাপারটা আরেকটু খুঁটিয়ে দেখতে হবে। ফ্লু হয় একধরনের ভাইরাসের কারণে। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে কিছু হলে আমরা আমাদের শরীরকেই তার সাথে যুদ্ধ করতে দিই, শরীর যখন যুদ্ধ করে ভাইরাসকে পরাজিত করে তখন আমাদের খুব বড় একটা লাভ হয়, আমাদের শরীরে সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্যে এক ধরনের এন্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। সেই এন্টিবডির কারণে সেই ভাইরাস আমাদের শরীরে ভবিষ্যতে আর কখনো বিশেষ সুবিধে করতে পারে না। একবার চিকেন পক্স হলে তাই আর দ্বিতীয়বার চিকেন পক্স হয় না। যদি দ্বিতীয়বার হয়েও যায় সেটা হয় খুব নিরীহ এক ধরনের চিকেন পক্স। ফ্লুটাও হয় ভাইরাস থেকে আর কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হলো একবার ফ্লু হলেও তো আরো অনেকবার ফ্লু হতে পারে–তার কারণটা কী? ফ্লুয়ের জন্যে শরীরে কেন এন্টিবডি তৈরি হয় না? এর কারণটা খুব চমকপ্রদ। ফ্লুয়ের ভাইরাস খুব ধুরন্ধর প্রকৃতির ভাইরাস–তারা প্রতিনিয়ত তাদের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে, কাজেই আমাদের শরীর তার সাথে তাল মিলিয়ে থাকতে পারছে না। আমাদের শরীরকে খুব সতর্কভাবে এন্টিবডি তৈরি করতে হয়–যেটা শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় কোনো কারণে তার বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে ফেললে আমরা মহাবিপদে পড়ে যাই। শরীরকে শুধুমাত্র ক্ষতিকর জিনিসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করতে হয় আর কোনটা ক্ষতিকর সেটা বোঝার জন্যে শরীরের নিজস্ব কিছু পদ্ধতি আছে। ভাইরাসের বাইরের প্রোটিনের আবরণ দিয়ে তারা সেটা চিনতে পারে। ফ্লুয়ের ভাইরাসের একটা চমকপ্রদ ক্ষমতা রয়েছে, তারা যখন একজন মানুষকে আক্রান্ত করে তখন সেখানে একটুখানি চেহারা পরিবর্তন করে ফেলতে পারে (সত্যি করে বলতে হলে বলা যায় বাইরের প্রোটিনের গঠনটুকু), তাই আমাদের শরীরের প্রতিষেধক নূতন ফ্লুয়ের ভাইরাস দেখতে পেলে একটু বিভ্রান্ত হয়ে যাই। প্রতিবার যে ভাইরাসটা আসে সেটাকে নূতন একটা ভাইরাস হিসেবে বিবেচনা করে–তাই মানুষ অসংখ্যবার ফ্লু দিয়ে আক্রান্ত হতে পারে।
তবে বিষয়টাকে যত খারাপ ভাবা হচ্ছে সেটা আসলে তত খারাপ না। আমাদের শরীর ফ্লুয়ের বিরুদ্ধে আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। কথাটুকু সত্যি কিন্তু যেটুকু দিচ্ছে সেটাও কিন্তু কম নয়। আমরা ফ্লুকে ভয়ঙ্কর রোগ হিসেবে বিবেচনা করি না, কারণ এর কারণে খুব বেশি মানুষের মৃত্যু হয় না। কিন্তু যে মানুষের শরীরে কোনো ধরনের ফ্লুয়ের এন্টিবডি নেই তাদের জন্যে এটা ভয়ঙ্কর একটা রোগ। শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা যখন তাদের শরীরে করে এই ভাইরাস আদিবাসীদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল, তখন আদিবাসীদের জনপদের পর জনপদ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
ফ্লুয়ের ভাইরাসে আট টুকরো RNA আছে, যদি মানুষের শরীর দুটি ভিন্ন RNA দিয়ে আক্রান্ত হয় তাহলে RNAগুলো নিজেদের ভেতরে তাদের অংশ বিশেষ দেয়া-নেয়া করতে পারে–তার কারণে নূতন যে ভাইরাসটা তৈরি হয় সেটা আগেরটা থেকে ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। সাধারণত নূতন ভাইরাসগুলো আগেরটা থেকে খুব বেশি ভিন্ন হয় না, তবে মাঝে মাঝে তার ব্যতিক্রম ঘটে যেতে পারে। হঠাৎ করে এমন একটা ফ্লু ভাইরাসের জন্ম হতে পারে যেটা পুরোপুরি ভিন্ন, আমাদের শরীর যেটার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত নয়। যার ফলাফল হবে। ভয়ঙ্কর–যে রকম হয়েছিল 1918 সালে। পৃথিবীর 98 শতাংশ মানুষ এই ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল, 28 শতাংশ মানুষের ফ্লু হয়েছিল এবং তাদের ভেতর 3 শতাংশ মানুষ মারা গিয়েছিল। মানুষের মৃত্যু হয়েছিল প্রায় 40 মিলিয়ন বা চার কোটি । 1918 সালের হিসেবে সেটা ছিল পুরো পৃথিবীর এক শতাংশ মানুষ। যে কোনো হিসেবে এই সংখ্যাটি অচিন্তনীয়।
এতক্ষণ আমরা মানুষের ফুয়ের কথা বলছিলাম, এবারে বার্ড ফ্লুয়ের মাঝে ফিরে আসতে পারি। এটি সত্যি কথা যে বার্ড ফ্লু হচ্ছে বার্ড বা পাখিদের অসুখ তাই এই অসুখটা এক পাখি থেকে অন্য পাখিদের মাঝে ঘুরে বেড়ানোর কথা। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি ফ্লুয়ের ভাইরাস হচ্ছে ধুরন্ধর প্রকৃতির ভাইরাস, এটা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবার সময় খানিকটা পরিবর্তন হয়ে যায় এবং এই পরিবর্তনটুকু নিয়েই ভয়। কে জানে একটু-আধটু পরিবর্তন হয়ে হঠাৎ করে না পাখিদের ফ্লু মানুষের ফ্লু হয়ে যায়! মানুষের শরীর মানুষের ফ্লুয়ের জন্যে প্রতিষেধক তৈরি করে রেখেছে কিন্তু পাখির ফ্লুয়ের জন্যে তো কোনো প্রতিষেধক নেই, তাই হঠাৎ করে বার্ড ফ্লু যদি মানুষকে সংক্রমণ করতে পারে তাহলে মানুষ একেবারেই অসহায়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর মানুষ যে বার্ড ফ্লু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সেটার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে H5N1, এটা মানুষের মাঝে সংক্রামিত হতে পারে। 1997 সালে এটা হংকংয়ে 18 জন মানুষকে আক্রান্ত করেছিল, তার মাঝে ছয়জনই মারা গিয়েছিল। মানুষের শরীর এই ভাইরাসের জন্যে প্রস্তুত নয়, তাই আমরা সাধারণ ফ্লুকে যেভাবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই এই H5N1 ভারাইসকে সেভাবে তুড়ি দিয়ে ওড়াতে পারব না। জানুয়ারি 2009 পর্যন্ত সময়টিতে সারা পৃথিবীতে 270 জন বার্ড ফ্লু দিকে আক্রান্ত হয়েছিল এবং মারা গেছে 164 জন, সংখ্যাটি হচ্ছে শতকরা ষাট জন। যে রোগে মৃত্যুর হার শতকরা ষাট জন সেই রোগটি একটি ভয়ঙ্কর রোগ–মানুষকে সেই রোগকে ভয় পেতে হয়। পৃথিবীর মানুষ তাই বার্ড ফ্লুকে ভয় পায়।
তবে এখানে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে, সেটি হচ্ছে এই বার্ড ফ্লু রোগটি ছড়ায় কেমন করে? 1918 সালে যে ফ্লুটি পৃথিবীর ৩৪ শতাংশ মানুষকে আক্রান্ত করেছিল সেটি ছড়িয়েছে একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষের মাধ্যমে। বার্ড ফ্লু ছড়ায় একটি পাখি থেকে একটা মানুষের মাঝে–তাই 1997 সালে বার্ড ফ্লুয়ের মহামারি বন্ধ করার জন্যে হংকংয়ে 12 লক্ষ মুরগিকে মেরে ফেলতে হয়েছিল। আমরা সব জায়গাতেই তাই দেখি বার্ড ফ্লু দেখা গেলে সেটা যেন ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্যে সব হাঁস মুরগিকে মেরে ফেলা হয়। অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটা প্রক্রিয়া কিন্তু আর কিছু করার নেই।
সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা কিন্তু নিশ্বাস বন্ধ করে আছেন–এই বার্ড ফ্লুয়ের দুটি খুব মারাত্মক বিশেষত্ব আছে–এক, এটি যখন মোরগ-মুরগিকে আক্রান্ত করে তখন খুব দ্রুত নূতন নূতন রূপে দেখা দেয়। এরকম একটি নূতন রূপ কখন আরো ভয়ঙ্কর হয়ে যাবে কেউ জানে না। দুই. এটা যতই পরিবর্তন হচ্ছে মনে হচ্ছে ততই স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্যে আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বার্ড ফ্লু পাখিদের জন্যে খুব ভয়ঙ্কর রোগ হলেও মানুষের জন্যে ভয়ঙ্কর নয়, কারণ এই রোগের সংক্রমণ হওয়া কঠিন। যেহেতু এটা হাঁস-মুরগি থেকে আসে তাই এর ঝুঁকি বেশি যারা পোলট্রি ফার্মে কাজ করে তাদের সাধারণ মানুষের বলতে গেলে কোনো ঝুঁকি নেই। যেহেতু এটা খাবারের ভেতর দিয়ে আসে না তাই বার্ড ফ্লু আক্রান্ত হাঁস-মুরগি খেয়ে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হবে তারও সে রকম আশঙ্কা নেই। বিশেষজ্ঞরা তবুও অবশ্যি সবসময়েই বলেন হাঁস-মুরগি বা ডিম খুব ভালো করে রান্না করে খেতে। এখন পর্যন্ত দেখা গেছে যেসব মানুষেরা বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন তারা সবাই পোলট্রি ফার্মের কর্মী, সেটা একমাত্র ভরসার কথা। একটি হাঁস বা মুরগি থেকে একজন মানুষ আক্রান্ত হলে সেখান থেকে মানুষকে রক্ষা করার একটা উপায় আছে। একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষ যদি আক্রান্ত হয় তাহলে কিন্তু যে মহামারি শুরু হবে তার থেকে মানুষকে রক্ষা করা খুব সহজ নয়। 1918 সালে পৃথিবীর 98% মানুষ সংক্রামিত হয়েছিল, এখন যদি হয় তাহলে কত মানুষ সংক্রামিত হবে কেউ কী অনুমান করতে পারে? আগে এক দেশ থেকে অন্য দেশে একজন মানুষের যেতে দীর্ঘ সময় লাগত কাজেই সেই মানুষের কাঁধে ভর করে বার্ড ফ্লুকেও এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে সময় লাগত বেশি। জেট বিমানের যুগে এখন কয়েক ঘণ্টায় এক দেশের মানুষ অন্য দেশে যায়, কাজেই এরকম একট ভাইরাস কয়েকদিনে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পারবে। যদি তার থেকে শতকরা ষাট জন মারা যায় তখন কী হবে?
আশার কথা সেটি এখনো ঘটে নি, বার্ড ফ্লু এখনো একজন মানুষ অন্য মানুষকে দিতে পারে নি। ভাইরাসটি হাঁস-মুরগির ভেতর দিয়ে রূপ পরিবর্তন করে সেরকম একটা ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা সেই ধুরন্ধর ভাইরাসের সেই ভয়ঙ্কর এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করার চেষ্টা করছেন।
দেখা যাক কে জেতে।