১০. বামুনের বাড়া পান্ডা

বামুনের বাড়া পান্ডা

পান্ডাদের থেকে বড় ধর্মগুরু কাশী শহরে আর কেউ নেই। দেশের আরও আরও জায়গার মতোই এখানেও পেশাটা মৌরসি। পান্ডারা কেউ ব্রহ্মচারী নয়। তাদের ধন দৌলতও বেশুমার। লোচ্চামি, জাল-জুয়াচুরি আর বজ্জাতি হল এদের আমদানির আর একটা ফিকির। ওয়াজেবের কথা যদি বলেন তবে সেসব কোনও কালেই তাদের ছিল না। পোপ যেমন ভান করেন এই দুনিয়ার দায় তাঁর আর তাই তাঁর এখতিয়ারের ভিতর পড়ে আম-আদমির খবরদারি করা। মাঝে মাঝে এই হামবড়া মেজাজ টমাস-এ-বেকেট (Thomas-a-Becket)-কেও ছাড়িয়ে যায়। নানা সব নামী-দামি মন্দিরে সারাদিনের যে আমদানি তার জিম্মেদার হচ্ছে সেখানকার বড় পুরোহিত। তাকে আবার অন্য পান্ডাদের কাছে হিসেব দাখিল করতে হয়। মন্দিরের সালানা রোজগার এলাহি। পোপের গির্জার মতোই হিন্দুধর্মেও আছে গুনাহ থেকে রেহাই পেতে নানা দান-খয়রাতের বন্দোবস্ত। বদখেয়াল হোক বা খুন, গুনাহ যত বেশি তত পাল্লা দিয়ে বাড়বে দানের পরিমাণ আর সেই সঙ্গে পূজারির মুনাফা। মামুলি উৎসব, অনুষ্ঠান কিংবা দান খয়রাতি সামাল দেবে পূজারি। আচ্ছা রকমের কোনও মওকা এলে দর্শন পাওয়া যাবে পান্ডাদের। ধরা যাক কোনও দৌলতমন্দ রাজা বা মালদারবাবু হাজির হয়েছে কাশীতে। ইচ্ছে এলাহি দান খয়রাত করে গুনাহ থেকে আজাদ হওয়া। তখনই হুঁশিয়ার হয়ে উঠবে শ্রীপান্ডাজির চ্যালা চামুণ্ডারা। শুরু হবে তাদের বেপরোয়া কাজ-কাম। একদিকে লোভ আর অন্যদিকে কুসংস্কার মিলেমিশে যাবে আমদানির হাতছানিতে।

একবার রাজাধিরাজ পেশোয়া কুমার হাজির হল কাশী। ইচ্ছে বাপের খোয়াহিশ পুরো করা। ডাক পড়ল বিশ্বেশ্বর মন্দিরের বড় পান্ডার। পান্ডা সরাসরি খারিজ করে দিল তার আর্জি। অজুহাত যতক্ষণ না মন্দিরের চাতাল সে চাঁদিতে ঢেকে দিচ্ছে ততক্ষণ তার খোয়াহিশ পুরো হওয়ার নয়। হিসাব কষে দেখা গেল কাজটার জন্য জরুরত পড়বে এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকা। এই টাকাতে কেবল পান্ডার ছোট হাজারি হবে। তার ভুখ কী এত সহজে মেটার। আর একদিন কুমার গেছে মন্দির দর্শন করতে। কয়েকজন সেবায়েত এসে তাকে ঘিরে ধরল। কবে নাকি সে তাদের বলেছিল একটা মুজরার বন্দোবস্ত করবে। সেখানে হাজির করা হবে হিন্দুস্থানের বাছাই করা হুরি পরিদের। তাদের নাচগান দেখে মশগুল হবে তারা। পান্ডাদের উমর যত বাড়ে ততই তারা খুবসুরতির সমঝদার হয়ে ওঠে। দেখবেন যত কমছে টাকার মোহ ততই বাড়ছে রূপের মোহ। পান্ডারা হামেহাল হাজির থাকবে আসরে যাতে কায়েম রাখা যায় তাদের ইজ্জত।

পান্ডাদের মসনদ হল মৌরসি। সংসার বাড়তে থাকলে মন্দির থেকে আসা আমদানিরও ভাগ বাটোয়ারা হয়। এই নিয়ে নিজেদের ভিতরই বেধে যায় তুমুল কাজিয়া। তখনই এই সহজ কামাই গিয়ে ঢোকে দেওয়ানি আদালতের উকিলদের পকেটে। কার কত রোয়াব, কে পারবে বেশি প্যাঁচ খেলতে তাই দিয়ে ঠিক হয় আখেরে কে হবে পান্ডাজি।

আমাদের একটু ভুল ভাবনা আছে। পান্ডাদের সব কাজ কারবারই নাকি মন্দির ঘিরে। আসলে দেখা যাবে তাদের বহু ধান্দা। জমি, জায়গা, তেজারতি। নানা কারবারে জড়িয়ে পড়ে বলে তাদের দুশমনও কম নয়। তাদের জোচ্চুরি আর ফেরেব্বাজি বরদাস্ত করতে না পারলেই শুরু হয় বদলা নেওয়ার চেষ্টা আর সেই সঙ্গে রিশবত কা খেল। দু’ হাতে বিলোনো হয় রিশবত। পুলিশ-পেয়াদাকে কব্জা করে চেষ্টা চলে কী করে আদালতে পাওনাদারদের বরবাদ করা যাবে। আয়ারূপ কুমার স্বামী (Ayarub Kumar Swami) ছিল হিন্দুদের কাছে তেমনই এক মহাগুরু। দাক্ষিণাত্য (Dukhan) থেকে তার বিপুল আমদানি হত। লাখ, লাখ রুপিয়া এসে জমা হত তার ঝোলায়। স্বামী তার ভক্তদের খুশ রাখতে মাঝে মাঝেই পূজা-পাঠ আর বলি চড়ানোর ঢং করত। এমন একটা ভেক যে মনে হয় লোকেদের উপকার করাটাই তার একমাত্র কাজ। এই করেই এককাট্টা করেছিল তার বেশুমার ধন-দৌলত, একের পর এক মকান, বিঘা-বিঘা জমি, এমনকী একটা পুরো গ্রাম। সাঁজ বেলায় কুমার স্বামী চলেছে কেদারনাথ মন্দিরে পূজা-পাঠ করবে বলে। মন্দিরে ঢোকার আগে সে একটু পায়চারি করে নিচ্ছিল। এই সময় কেউ সিধা গুলি দেগে দিল তার ছাতিতে। মন্দিরের হুদ্দায় তখন কয়েকশো আদমি। তাদের নজরের সামনেই হল হাদসা। কিন্তু কেউ কাতিলকে দেখতেই পেল না। মওকা বুঝে সে সরে পড়ল। তল্লাশি জারি থাকল। আর কিছু দিন পরে তিলিঙ্গায় (Telingah) বদমাশদের ঘাঁটিতে গ্রেফতার হল এক আদমি। বজ্জাতটার ডান হাত বারুদে ঝালসানো। ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর অনেক সাবুদ এককাট্টা করে তাকে ফাঁসিতে লটকালেন। কে যে তাকে খুন করতে ভাড়া করেছিল তা অজানাই থেকে গেল। এই সব মামলায় দেখবেন মিলছে হাজারটা উড়োখবর আর রিপোর্ট। সেই রিপোর্টগুলো থেকে যা জাহির হয় তা হল আয়ারূপ কুমার স্বামী কোনও দৌলতমন্দ আদমিকে তার দুশমন বানিয়ে তুলেছিল। স্বামী তাকে এমন বেহাল করে যে সে মজবুর হয় খুনটা করাতে।

রকম বেরকমের কালো ধান্দা চলতে থাকে পূজারি আর পান্ডাদের কোঠিতে। শোনা যাবে ঘণ্টার ভারী আওয়াজ। দলে দলে জোয়ান পূজারি মন্দিরে মন্দিরে বাজাবে শাঁখ। সেই শাঁখের আওয়াজ ধাক্কা খেয়ে ফিরবে মন্দির ঘিরে থাকা ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে আর তাতেই চাপা পড়বে মজলুমদের (mazlum) আখরি চিৎকার। বেয়াদব চ্যালাকে শায়েস্তা করা, হিংসার বলি চড়ানো বা কোনও গুনাহ চাপা দিতে চলে জুলুম। দরকার হলে জহর ইস্তেমালেও তারা পিছু হটে না। তবে এইসব খবরের কোনওটাই পায় না পুলিশ। তার থেকে বলা ভাল পুলিশকে জানতে দেওয়া হয় না। মন্দির ঠিক করে কার এক্তিয়ার আছে এই সব মকান আর কোঠিতে ঢোকার। কেবল ভরসার আদমিদেরই ইজাজত থাকে অন্দরমহলে যাওয়ার, যেখানে চলে জুলুম। লোকের মুখে শোনা (আমি মুসলমান তাই আমার এক্তিয়ার নেই যে মন্দিরে যাব) যে এই মন্দিরগুলোর খাস মহলে থাকে দেবী বা ভবানীর মুরত। যে আবার খুন পিয়াসি। কোনও খাস তোহার (tyohar) থাকলে তার সামনে বাচ্চাদের বলি চড়ানো হয়। পুলিশের কাছে শুধু খবর হয় কোনও বাচ্চা গুম হয়ে গেছে। যারা খবর দিতে এসেছে তারাও বলতে পারে না কোথায় মিলবে হদিশ। কোনও দিনই আর খোঁজ মেলে না ওই বাচ্চাদের। আমি যে হাদসার কথা বললাম হতেই পারে বাচ্চারা তারই শিকার!

এক পান্ডা গেছে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দরবারে। সে জানতে চায় তার দায়াদের তকদিরে কী লেখা। পণ্ডিত ইশারা করল এই বাচ্চার তাসির (tasir) তার জীবনে ভাল হবে না। পান্ডা বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল। আখেরে যখন তাকে মায়ের হাতে তুলে দিল তখন তার মৌত হয়েছে। পান্ডা এমন কায়দায় বাচ্চাটার টুঁটি চেপে ধরে যাতে পণ্ডিতদের গণনা ভেস্তে না যায়। ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরের কাছে কয়েকজন নিজের থেকেই এ নিয়ে মামলা দায়ের করল। তলব করা হল পান্ডাকে। সে নানা ফিকিরে কেবলই এড়িয়ে যেতে লাগল হুজুরকে। শেষে জবরদস্তি তাকে হাজির করা হল। রিশবত আর দৌলতের যেখানে ছড়াছড়ি সেখানে হুজুরই বা কী করেন? কোনও কানুনি সাবুদ দাখিল করতে না পারায় রেহাই হয়ে গেল পান্ডার।

পূজারিদের নাম যেমন হাজারটা লোকের জানা তেমনই তাদের কালো ধান্দাও একটা চর্চার বিষয়। কোনও দৌলতমন্দ আদমি যার ওয়াসিয়াত নেই, মৌত হলেই তার সম্পত্তির দখল নেয় পূজারিরা। দেওয়ানি আদালতের অর্ধেক মামলাই তাদের এই মালিকানা নিয়ে তানাজা (tanaza)। সাধুসন্তরা যে কঠিন রীতি রেওয়াজ মেনে চলেন এরা তার উলটো। একজন আদমির যা যা বদখেয়াল থাকতে পারে এদের ভিতর তার সব এসে জমা হয়েছে। হালফিলের হিন্দুরা ধীরে ধীরে এদের খপ্পর থেকে বের হয়ে আসছে। তারা মনে করে মানুষের সৃষ্টি একেশ্বর ব্রহ্মা থেকে। সবাই যে পূজারি আর পান্ডাদের হাত থেকে রেহাই পেতে চায় সে কথাও বলা যাবে না। একটা রেওয়াজ বহুদিন থেকে চালু। বিয়ে হল কিন্তু ইচ্ছাপূরণ হচ্ছে না। স্বামী তখন নিজের বউকে নিয়ে যায় বাছাই করা কোনও কোনও মন্দিরে। দেবতার নামে পুজো চড়িয়ে রেখে আসে বউকে। দেখা যায় এই রেওয়াজ এতটাই ফায়দামন্দ যে স্ত্রী গর্ভধারণ করছে। আর পিতৃগর্বে তখন গর্বিত হয়ে ওঠে স্বামী।

১. বেশুমার: অগণিত, অগণ্য

১. মজবুর: বাধ্য হয়ে, বাধ্য করা

১. দায়াদ: উত্তরাধিকারী, জ্ঞাতি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *