১০. বলুন প্রধানমন্ত্রী, কী সংবাদ

১০

বীরহাম্বীর বললেন, ‘বলুন প্রধানমন্ত্রী, কী সংবাদ?’

জীমূতবাহন অধোবদনে দাঁড়িয়ে। তাঁর ম্লান মুখ লক্ষ্য করে বীরহাম্বীর ভ্রূ কুঞ্চিত করেন, ‘কী হয়েছে প্রধানমন্ত্রী? কোনও কারণে মনে হচ্ছে আপনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত?’

‘আজ্ঞে মহারাজ!’ জীমূতবাহন বলে ওঠেন, ‘আপনার আদেশে নিতাই সর্দার তার পাইক বাহিনী নিয়ে গিয়ে গোপালপুর চটি থেকে সুকৌশলে অপহরণ করেছিল সেই তিনটি গো-শকট।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। নানা কাজের ব্যস্ততায় আমি বিস্মৃত হয়েছিলাম। বলুন, রক্তপাত হয়নি তো?’

‘আজ্ঞে না। পথিকরা নিদ্রাচ্ছন্ন ছিল।’

‘অতি উত্তম। কী পাওয়া গিয়েছে?’

জীমূতবাহন প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে থাকেন।

‘কী হল? চুপ করে আছেন কেন?’ বীরহাম্বীর অধৈর্য হয়ে বলে ওঠেন, ‘কিছুই কি পাওয়া যায়নি? রাজজ্যোতিষীর গণনা তো ভুল হয় না।’

‘এক্ষেত্রে হয়েছে মহারাজ।’ জীমূতবাহন বলেন, ‘তিনটি গো-শকটবোঝাই যে কাষ্ঠপেটিকাগুলো নিতাই সর্দারের লোক অপহরণ করেছিল, সেগুলি আজ সকালে খোলা হয়েছে। রত্ন, অর্থ কিছু নেই, অজস্র পুঁথি।’

‘পুঁথি!’

‘আজ্ঞে মহারাজ। রাশি রাশি পুঁথি।’ ম্লানমুখে বলেন জীমূতবাহন, ‘আমি গোপনে লোকও পাঠিয়েছিলাম। বৃন্দাবন ধাম থেকে তিনজন বৈষ্ণব পণ্ডিত ওই পুঁথিগুলো নিয়ে যাচ্ছিলেন গৌড়ে। তাঁরা দলে ছিলেন জনা পনেরো। গতকাল রাত্রিবাস করেন গোপালপুরের ওই চটিতে। নৈশভোজের পর বেশ কিছুক্ষণ নামসংকীর্তনও করেন।’

‘বলেন কী!’ বীরহাম্বীর বিমুঢ়, ‘কী লজ্জার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী!’

‘হ্যাঁ মহারাজ। চটির কোনও কর্মচারী সম্ভবত কোনও পাইককে শনাক্ত করে পেরেছিল। গোপালপুর তো বটেই, কদম্বঘাটি পর্যন্ত রটে গিয়েছে যে, মল্লরাজ বৈষ্ণববিরোধী, তাই নিজে এই লুঠ করিয়েছেন।’

‘এ তো সম্পূর্ণ মিথ্যা অপবাদ। হ্যাঁ, ব্যক্তিগতভাবে আমি শিব ও মৃন্ময়ীর উপাসক। আমাদের বংশে শৈব, শাক্ত ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উপাসনা আরাধনা চলে আসছে। তবে আমি যে পরধর্মসহিষ্ণু আমার সকল প্রজা তা জানে। প্রজাদের সৎ, সত্যনিষ্ঠ ও ধার্মিক করে তোলার জন্য আমি সচেষ্ট।’ বলতে বলতে মনে পড়ে গেল বীরহাম্বীরের, ‘হ্যাঁ, আসল ঘটনাই তো ভুলে গেছি। আমার মহাসেনাপতি কুম্ভ নিজেই তো রাজ্যের অন্যতম বৈষ্ণব। তাঁর কি কখনও মনে হয়েছে, আমি বৈষ্ণবদের পছন্দ করিনা?’

‘সেই প্রশ্ন অমূলক, মহারাজ!’ জীমূতবাহন বললেন, আপনি তো জানেনই, প্রদ্যুম্নপুরের মাধব মল্ল কীভাবে নিয়মিত আপনার নিন্দা করেন। আপনি জেনেও পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তিনিই এসব ছড়াচ্ছেন।’

‘জ্যেষ্ঠতাতর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার শিক্ষা আমি পাইনি, জীমূতবাহন। তাঁকে অনুরোধ করেছি, তিনি শোনেননি। এর বেশি আমি আর কী করতে পারি! উনি বুঝতে পারেন না যে, আত্মীয়কে কালিমালিপ্ত করার অর্থ নিজেকেই ছোট করা। আর আমি আপনাকে এই লুন্ঠনে প্রথমেই নিষেধ করেছিলাম।’

কন্যার জন্মের পর থেকে যে পুলক তাঁর হৃদয় দখল করেছিল, তা উঠে গিয়েছে। সেই স্থান দখল করেছে একরাশ আত্মগ্লানি ও অনুশোচনা

অন্যান্য রাজা জমিদাররা গোপনে লুঠ করলেও বীরহাম্বীর যেন অকস্মাৎ কুৎসা ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছেন। ‘ডাকাতরাজা’ শিরোনাম সুপরিকল্পিতভাবে তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে আসমুদ্র হিমাচলে। এই কারণেই তিনি সেদিন নিষেধ করেছিলেন।

তবু আবারও কলঙ্কিত হলেন তিনি। এবং এই কলঙ্কের রেশ সম্ভবত সুদূরপ্রসারী।

নীলাচলের সেই নিমাই পণ্ডিত ইহধাম ত্যাগ করেছেন, দুই দশক হয়েছে। তারপর থেকে গোটা দেশেই ভক্তিরসের জোয়ার দেখা দিয়েছে। তাঁর নিজের রাজ্যেরও বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত মানুষ বৈষ্ণব হয়েছেন। এমনকী মহাসেনাপতি কুম্ভও কয়েকবছর আগে বৃন্দাবন ঘুরে এসে সপরিবারে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন। তাতে বীরহাম্বীর অসন্তুষ্ট নন।

কিন্তু নির্বিরোধী তিন বৈষ্ণবের ওপর আক্রমণের এই সংবাদ রাজ্যের বৈষ্ণবদের মর্মাহত করবে। কলঙ্কিত হবেন তিনি।

ভগ্নকণ্ঠে বীরহাম্বীর বললেন, ‘বাচস্পতিমশাইকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। ভ্রান্তি সকলেরই হয়। তাঁরও হয়েছে। বৈষ্ণব পণ্ডিতরা কি এখনও গোপালপুর চটিতে রয়েছেন?’

‘না মহারাজ। তাঁরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।’ প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘স্বয়ং শ্রীনিবাস আচার্য তাঁদের মধ্যে ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন দুই সহকারী পণ্ডিত নরোত্তম ঠাকুর ও আচার্য শ্যামানন্দ। তাঁরা দু’জন চলে গেছেন। শ্রীনিবাস আচার্য আশ্রয় নিয়েছেন দেউলী গ্রামের কৃষ্ণবল্লভ চক্রবর্তীর গৃহে।’

‘তিনি কি আগে কখনও মল্লরাজ্যে এসেছেন?’

‘বহুবার। চক্রবর্তীমহাশয় তাঁর পূর্বপরিচিত। মহাসেনাপতি কুম্ভ নিজেও একবার সেখানে তাঁর পদধূলি দিয়ে এসেছিলেন।’

বীরহাম্বীর অস্থিরভাবে বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, আপনি যেভাবে হোক, তাঁকে রাজবাড়িতে নিয়ে আসুন। পুঁথিগুলো তাঁর হাতে প্রত্যর্পণ করতেই হবে।’

‘সেকী!’ বিহ্বলচোখে তাকান জীমূতবাহন, ‘তবে তো লোকের ধারণা সত্য প্রতিপন্ন হবে! সবাই বুঝে যাবে, মল্লরাজাই…।’

বীরহাম্বীর বললেন, ‘বুঝলে বুঝুক। দোষ স্বীকার করতে আমার লজ্জা নেই। বরং রাজ্যের বৈষ্ণবরা বুঝবেন এই লুঠ অনিচ্ছাকৃত। প্রধানমন্ত্রী, আপনি আর বিলম্ব করবেন না। আচার্য মশায়কে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন।’

‘কিন্তু মহারাজ, শ্রীনিবাস আচার্য কিন্তু সাধারণ পণ্ডিত নন। আমি ওঁর সম্পর্কে কুম্ভের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেই বলছি। তাঁর আদি বাসস্থান নদীয়া জেলার চাখন্দিগ্রামের তিনি দেশের অন্যতম প্রভাবশালী বৈষ্ণব পণ্ডিত। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নীলাচলে তিরোভাবের পর গোটা দেশের বৈষ্ণবদের মধ্যে অনেকগুলো উপদলের সৃষ্টি হয়েছিল। কিছুজন নিত্যানন্দগোষ্ঠী, কিছুজন অদ্বৈতগোষ্ঠী, কেউ আবার শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকারের গোষ্ঠী প্রভৃতি। শ্রীনিবাস আচার্য গত কয়েকবছরে এই সমস্ত দল-উপদলকে একত্রিত করেছেন। তিনি যেমন অসাধারণ শিক্ষক, তেমনই দক্ষ সংগঠক। নরহরি সরকার থেকে শুরু করে রঘুনন্দন, নিত্যানন্দপত্নী জাহ্নবা দেবী থেকে আরম্ভ করে অদ্বৈতঘরণী সীতা দেবী, সকলের প্রীতিভাজন। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, এবং মিষ্টভাষী।’

বীরহাম্বীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। জীমূতবাহন থামতেই বলে উঠলেন, ‘তিনি মল্লরাজ্যে এসেছিলেন কেন?’

‘মল্লরাজ্যে আসেননি, এই পথ দিয়ে তাঁরা যাচ্ছিলেন গৌড়ে। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল গৌড় তথা সমগ্র বঙ্গদেশে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করা, সাধারণ মানুষকে আলোকিত করা। গৌড়ে তাঁরা ইতিমধ্যেই একাধিক মঠ স্থাপন করেছেন।’

বীরহাম্বীর কয়েকমুহূর্ত চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনি আর বিলম্ব করবেন না। নিয়ে আসুন ওঁকে। অপরাধ করলে তার জন্য ক্ষমা চাইতে আমি লজ্জিত হই না।’

১১

রাজধানী বিষ্ণুপুরের উত্তরপূর্বে দ্বারকেশ্বর নদীতীরের সমৃদ্ধ জনপদ প্রকাশ গ্রাম। একাদশ শতাব্দীর মল্লরাজা প্রকাশ মল্লের নামে নামাঙ্কিত। বন্দর সংলগ্ন নদীঘাট ও পরিচিত প্রকাশঘাট নামে। এই নদীপথে মল্লরাজ্যের সঙ্গে বহির্জগতের ব্যবসা বাণিজ্য চলে।

প্রকাশঘাটের অনতিদূরে উঁচু টিলা—হেড়ে পর্বত। নীচ দিয়ে পথ চলে গিয়েছে নদীপোতের দিকে।

চতুষ্পাঠী থেকে কাঁচা উঁচু-নীচু পথে এস্থানে দূরত্ব একদণ্ড কাল। পাদদেশে পৌঁছেই রঘুনাথ পঞ্চকল্যাণকে পিপুলগাছে বেঁধে ফেলল। দুই বন্ধু চড়াই ভেঙে উঠতে লাগল ওপরের দিকে। টিলাটির শীর্ষে উঠলে দ্বারকেশ্বর নদী দেখা যায়। দেখা যায় নদীবক্ষে নৌকো চলাচলও। ওইটিই আনন্দ।

‘অনেক ওপর থেকে নদী দেখলে নিজেকে কেমন চিলের মতো মনে হয়,তাই না রে।’ পবন উদাসচোখে বলে।

‘হু!’ রঘুনাথ একটা ঢেলা বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার ভারি বয়েই গেছে চিল হতে। অমন কাপুরুষের মতো ক্ষত্রিয়রা লুকিয়ে লুকিয়ে কাউকে আক্রমণ করে না বুঝলি! মনে নেই পণ্ডিতমশাই কী বলেছিলেন? লৌহপাত্রে জলপান, শালপাতাতে ভোজন আর অশ্বপৃষ্ঠে শয়ন—এই হল মল্লক্ষত্রিয়দের লক্ষণ।’

‘তাই?’ পবন মুখ টিপে হেসে বলল, ‘তা এমনভাবে তো পণ্ডিতমশাই বলেননি, বলেছিলেন শ্লোকে। সেটা বল দেকি! তবে বুঝব!’

রঘুনাথ অমনি অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করে ঢেলা ছুঁড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে কখনও বসে থাকেনা। ছোট ছোট ঢেলা কুড়িয়ে সমানে ছুঁড়ে চলছিল নীচের দিকে।

পবন দু’বার বারণ করেছে, কিন্তু তাতে সে কর্ণপাত করেনি। নীচ দিয়েই চলাচলের পথ। কারুর গায়ে লাগলে মুহূর্তে এক দুর্ঘটনা বাধবে।

পবন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সাড়া না পেয়ে নিজেই বলে ওঠে,

‘অয়ঃপাত্রে পয়ঃপানং শালপত্রে তু ভোজনম।

শয়নমশ্বপৃষ্ঠে চ মল্লজাতীনাং লক্ষণম…’

শ্লোক শেষ করতে না করতে ও চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওকী? কী করলি? সর্বনাশ!’

পবনের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। রঘুনাথের ঢিল ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে আঘাত করেছে নীচের এক শিবিকার বাহকের মাথায়। শিবিকাটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের।

যে শিবিকাবাহকের কপালে ঢেলাটি লেগেছে, তার গণ্ডদেশ বেয়ে লাল রক্ত গড়াচ্ছে। বাকি তিনজন বাহক কোনওমতে শিবিকাটিকে নামাচ্ছে। আহত বাহকটি পাগড়ি খুলে রক্ত চেপে ধরতে ধরতে তাকাচ্ছে ওপরের দিকে। চিৎকার করে বলছে, ‘কে রে উজবুকের দল? দাঁড়া, মজা দেখাচ্ছি তোদের!’

‘সর্বনাশ পাকালি তো? শিগগির চল নীচে।’

রঘুনাথের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ভয় পেয়েছে। তবু বন্ধুর মণিবন্ধ চেপে ধরল, ‘পাগল হয়েচিস? ওরকম ষণ্ডা চারটে লোক চেপে ধরলে আমরা আস্ত থাকব?’

পবন বিভ্রান্ত মুখে নীচে দেখল। ওরা পাহাড়ের সামনের দিকের ঢালে পঞ্চকল্যাণকে বেঁধে রেখে ওপরে উঠেছে, কিন্তু এই দিকটা খাড়া। আসল পথ পাহাড়ের পেছন দিয়ে। শিবিকাবাহকেরা সেদিকেই ছুটে যাচ্ছে। তাদের হাতে একটা করে ধারালো বর্শা।

‘চল চল। ওরা পৌঁছতে পৌঁছতে আমরা সামনে দিয়ে নেমে যাব। শিবিকাটা লক্ষ্য করেছিস? পাঞ্জা লাগানো। ভেতরে যিনি আছেন, তাঁর কাছে নিজের পরিচয় দিবি। তাহলে বেঁচে যাব।’ পবন রঘুনাথকে টানতে টানতে নামতে লাগল টিলার ওপর থেকে।

রঘুনাথ বলল, ‘কিন্তু শিবিকাটা যে রাজদরবারের। যিনি আছেন, তিনি যদি রাজবাড়িতে জানিয়ে দেন? তাহলে আমার পঞ্চকল্যাণকে নিয়ে হেড়ে পাহাড়ে আর আসা হবে না।’ ওর মুখটা কাঁদোকাঁদো হয়ে উঠল।

‘বাহকরা তোকে দেখতে পেয়ে গেছে রঘু। শিবিকায় যিনি আছেন, তিনি নিশ্চয়ই চিনবেন পঞ্চকল্যাণকে। যদি আগেভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিস, খবরটা বাড়ি অবধি নাও যেতে পারে। চল চল।’

রঘুনাথ অনিচ্ছাসত্ত্বেও পাহাড় বেয়ে নেমে এল। পঞ্চকল্যাণ নির্বিকারভঙ্গীতে পিপুলগাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছিল, রঘুনাথ ওদিকে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারল না। পবন মনুর বিধান বিস্মৃত হয়েছে, বন্ধুকে বাঁচাবার জন্য সে বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরেছে রঘুনাথের হাত।

কাছাকাছি আসতেই ওরা থমকে গেল। কারণ শিবিকা থেকে ততক্ষণে যিনি নেমে দাঁড়িয়েছেন, তিনি পুরুষ নন। এক সুসজ্জিতা কিশোরী। বোধ করি নিজের বাহকদের চিৎকার ও শিবিকা থামিয়ে দেওয়াতে কৌতূহলী হয়ে সে নেমে এসেছে।

দেখলেই বোঝা যায়, সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা। উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, ততোধিক উজ্জ্বল চোখ। যৌবনের পূর্বাভাস শরীরটিতে স্পষ্ট। কানে গলায় সোনার গহনা। বস্ত্রের ওপর জড়ানো রয়েছে রেশমের দোলাই।

কিশোরীর মুখ বিস্ময়করভাবে উন্মোচিত, অবগুণ্ঠন খসে পড়েছে পৃষ্ঠদেশে। সে ঘাড় উঁচু করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছে। তার ডান হাতে ধরা একটি পুরুষ্টু পেয়ারা। সেই পেয়ারায় সে ছোট ছোট কামড় বসাচ্ছে।

অদূরে বন্দর। পথিকরা হঠাৎ কিশোরীকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠছে। একালে কোনও ভদ্রপরিবারের রমণীকে দিবালোকে অবগুণ্ঠনহীন দেখতে পাবে, সে তাদের কল্পনাতীত!

পবন কিছু বলার আগেই রঘুনাথ ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলল, ‘কী ব্যাপার? তুমি এখানে?’

কিশোরী অমনি ভ্রূ তুলে বলল, ‘কেন, মহারাজ কি এমন আদেশনামা জারি করেছেন, যে এই নদীপোত দিয়ে তুমি ছাড়া মল্লভূমের কারুর হাঁটার নিয়ম নেই!’

রঘুনাথ উত্তর দিল না। শক্ত মুখে পবনের হাত ধরে টান দিল, ‘চলে আয়।’

পবন কিছুই বুঝতে না পেরে কিশোরীর দিকে তাকাতেই সে ফিক করে হেসে বলল, ‘নতুন সঙ্গী নাকি? চিনতে পারলাম না তো! শীতলদাদা কি জানেন যে রঘুনাথকে আবার হেড়ে পাহাড়ে নিয়ে আসা হয়েছে?’

পবন অচেনা এই কিশোরীর প্রগলভতায় চমৎকৃত হচ্ছিল। কিশোরীটি তার চেয়ে দৈর্ঘ্যে ছোট, কিন্তু পরিণত। এমন সপ্রতিভ কোন মেয়ের মুখোমুখি সে আগে হয়নি। রাজ্যের মধ্যম রাজকুমার শীতলকুমারকে ‘শীতলদাদা’ সম্বোধনের অর্থ এই কন্যা রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ।

পবন কিঞ্চিৎ ভীত হয়ে বলল, ‘না না! আ-আমি নিয়ে আসিনি। রঘু নিজেই…!’

‘অ! রঘুনাথ নিজেই এসেছে?’ মেয়েটা এবার ভারি অবাক হয়েছে, এমন ভঙ্গিতে রঘুনাথের দিকে বলল, ‘ব্যথা এরমধ্যেই কমে গেল বুঝি?’

‘ব্যথা?’ পবন থ, ‘কীসের ব্যথা?’

রঘুনাথ এবার হনহন করে এগিয়ে গিয়ে পঞ্চকল্যাণের বাঁধন উন্মুক্ত করতে উদ্যত হল। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ‘পবন, তুই যাবি কি না বল? আমি চললুম।’

মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ল। পবনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চিন্তা কোরো না। তেমন হলে আমি তোমায় পৌঁছে দেব। গত পরশু সন্ধ্যাবেলায় শীতলদাদা রঘুনাথকে যে উত্তমমধ্যম দিয়েছেন, তা জানো না বুঝি?’

পবন মেয়েটিকে দেখছিল। তার কপালের সামনের কিছু চুল গালের ওপর এসে পড়েছে, মেয়েটা অদ্ভুত দক্ষতায় সামলাতে সামলাতে কথা বলে চলেছে।

সে বোকার মতো বলল, ‘প্রহার করেছেন! কেন?’

‘ওমা, বন্ধুর কীর্তির কোনো খবরই দেখছি তুমি রাখো না।’ মেয়েটা চোখ বড় বড় করল, ‘রঘুনাথ সেদিন ওদের এক বয়স্ক ভৃত্যের পোশাকের মধ্যে যে বিছে ছেড়ে দিয়েছিল। শীতলকুমার এত রেগে গিয়েছিলেন যে রঘুনাথের পিছনে গুমগুম করে…সে কী কান্না…বাপরে বাপ! অন্দরমহল থেকেও শুনতে পাচ্ছিলাম। তার পরে দু’দিন তো রঘু ঠিকমত বসতে পারছিল না।’

রঘুনাথ এই আকস্মিক সম্মানহানিতে ক্রুদ্ধ বাঘের মতো গর্জে উঠল, ‘অ্যাই! তুমি কি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দেখতেও পাচ্ছিলে নাকি!’

‘আমি দেখতে পাব কেন? মেনকামাসি দেখেছে। সে নিজে আমাকে বলেছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কন্যা মনোহরা, বুঝলে! তোমার মতো মিথ্যা কথা বলি না।’ মেয়েটা পবনের দিকে তাকাল, ‘তুমি থাকো কোথায়?’

পবন এই আশঙ্কাই করছিল। এই কিশোরীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আড়ষ্টতায় কী উত্তর দেবে সে বুঝতে পারছিল না।

‘তোমার এত জেনে কাজ কী?’ ওর হয়ে মুখ খুলল রঘুনাথ, ‘ও আমার বন্ধু। চতুষ্পাঠীর সতীর্থ।’

মনোহরা পবনের বেশভূষার দিকে তাকাল। তার হাঁটুর ওপর উঠে থাকা মলিন ধুতি ও ঊর্ধ্বাঙ্গের ফতুয়া বড়োই বিসদৃশ, বিশেষত রাজপুত্রের পাশে। মনোহরা বলল, ‘কী নাম তোমার?’

পবন বিস্মিত। এই কিশোরীর চেয়ে সে বয়সে বড়ই হবে। অবলীলায় তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করছে? হুম, রাজবাড়ির মেয়েরা বোধহয় এমনই হয়।

ঠিক সেইসময় ছুটতে ছুটতে এল সেই চারজন শিবিকাবাহক। একজনের মাথায় লেগেছিল ফেট্টি। তাদের একজন রঘুনাথদের দিকে অঙুল তুলে বলল, ‘ওই যে…ওই ব্যাটারা মেরেছে!’

পবন দ্রুত বলল, ‘আমরা ওপরে বসেছিলাম, রঘুনাথ বুঝতে পারেনি! ওর হাত ফসকে একটা নুড়ি…!’

মনোহরা অতীব বুদ্ধিমতী, মুহূর্তের মধ্যে বুঝে ফেললো কী হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সে রঘুনাথকে কোনরকম তিরস্কার করল না। উল্টে বাহকদের বলল, ‘শান্ত হও তোমরা। ছোটরাজকুমারকে কি চেনো না যে এমন অভব্যতা করছ?’

বাহকরা পুরো হকচকিয়ে গেল। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে শুরু করল।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ মনোহরা নেত্রীসুলভ কণ্ঠে বলল, ‘উনি কিছু মনে করেননি। এই কথা যেন পাঁচকান না হয়।’

‘যে আজ্ঞে মা!’

মনোহরা পবনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। অনুচ্চ স্বরে বলল, ‘ভয় পেও না। তোমার বন্ধুর এই কাণ্ডের কথা কেউ জানবে না। আসি!’

রঘুনাথ গোঁজ হয়ে চেয়ে রইল অন্যদিকে। মনোহরা দোলাইটা অঙ্গে জড়িয়ে ঢুকে গেল শিবিকার ভেতরে। শিবিকাবাহকরা রঘুনাথের দিকে করজোড়ে নমস্কার করে ‘হুম হুম না’ সুর তুলে অগ্রসর হল নদীপোতের দিকে।

শিবিকা দৃষ্টির আড়ালে যেতে না-যেতেই পবন বলল, ‘মনোহরা মানে প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে? আশ্চর্য! হেসে হেসে কথা বলল! কী ভালো!’

রঘুনাথ ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘তুই হাসিটাই দেখলি? শূলগুলো তোর চোখে পড়ল না? বরাবর ও আমার পেছনে লাগে। সাধে কি সেবার তালপাতায় ‘মনোহরা শূর্পণখা’ লিখে ওর ঘরের জানলা দিয়ে ফেলে এসেছিলাম? হিংসুটে একখানা। বড়মা লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছেন।’

‘যাই বল ভাই।’ পবন বলল, ‘তোরা সব বড়ঘরের লোকজন, আমি হলাম গিয়ে উলুখাগড়া। যদি গিয়ে সুলুকসন্ধান করে, তখনই তো বুঝে যাবে আমি তোর সহপাঠী নই!’

‘ইইহ! অত সাহস হবে না।’ রঘুনাথ বলল, ‘এমন মজা দেখাব, যে কেঁদে কূল পাবে না। ওর গায়েতেই বিছে…!’

রঘুনাথের কথার মাঝেই হঠাৎ এক পথচারী এসে দাঁড়াল ‘আচ্ছা, বিষ্ণুপুর রাজদরবারের পথটা কোনদিকে বলতে পার?’

পবন বলল, ‘আমরা ওদিকেই যাচ্ছি। আমাদের সঙ্গে আপনি যেতে পারেন।’

‘আমাদের সঙ্গে কী করে যাবেন? রঘুনাথ বিরক্তমুখে বলল, ‘আমরা তো ঘোড়ায় যাব, ওঁর সঙ্গে তো কোনও ঘোড়া নেই। রাজদরবার চার-পাঁচ ক্রোশ দূরে।’

যুবক বলল, ‘কিন্তু নৌকোয় একজন যে বলল এক ক্রোশ হাঁটলেই রাজদরবার? তুমি ঠিক জান তো?’

‘জানেন না চেনেন না, অপরিচিত মানুষকে তুমি তুমি করছেন কেন? ‘আপনি’ বলতে পারেন না? আর আমার বাড়ি আর আমি জানব না তো কি রাস্তার লোক জানবে?’ রঘুনাথ এইটুকু বলে ফেলেই পবনের ইঙ্গিতে চুপ করে গেল।

যুবক সাগ্রহে বলল, ‘তাই? তোমার…আপনার বাড়ি? আপনি কি রাজপরিবারের কেউ?’

রঘুনাথ অসহায় চোখে পবনের দিকে তাকাল। ভুল যা করার সে করেই ফেলেছে। দিনটা তার আজ সত্যিই খারাপ।

যুবক বোধহয় রঘুনাথের মনের কথা বুঝতে পেরে গেল। হেসে বলল, ‘আমি কাউকে কিছু বলব না।’

‘না ঠিক আছে। আপনি অনেক বড়…তুমি করেই বলুন।’ রঘুনাথ ম্রিয়মাণ সুরে বলল, ‘আমি মল্লরাজ্যের ছোট রাজকুমার।’

‘আরে!’ যুবক এবার সসম্ভ্রমে নমস্কার জানাল, ‘মল্লরাজের পুত্র তুমি! বাহ, বাহ। বড় ভালো হল। আমি তো মহারাজার সঙ্গে দেখা করতেই চলেছি। তোমাদের সঙ্গেই যাই তাহলে।’

রঘুনাথ পবনের দিকে চাইল। পবন কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তাদের হেড়ে পর্বত অভিযানের কথা ফাঁস হয়ে যাবে না তো?’

‘কী ব্যাপার? তোমাদের আপত্তি নেই তো?’ যুবক বলল, ‘আমি অনেক দূর থেকে আসছি। চেনাজানা কেউ থাকলে মনে বল পাই!’

পবন বলল, ‘আমাদের অসুবিধা নেই। কিন্তু আপনি কি এতটা পথ যেতে পারবেন? আমাদের ঘোড়া তিনজনের ভার বইতে পারবে না।’

রঘুনাথ বলল, ‘তো কী আছে? উনি ঘোড়ার পিঠে চলুন, আমরা পাশে হেঁটে যাই?’ পবন যুবককে বলল, ‘আপনি কোথা থেকে আসছেন? বীরভূম থেকে?’

যুবক হাসল, ‘না। আরও অনেক দূর থেকে। নাম তন্দা।’

তন্দা? এমন দেশের নাম সে কখনও শোনেনি।

পবনও বলল, ‘সে কোথায়?’

‘সে অনেক দূর।’ যুবক উঠে দাঁড়াল, ‘গৌড়ের নাম শুনেছ? তার কাছে।’ তারপর সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল অনতিদূরে গাছের সঙ্গে বাঁধা পঞ্চকল্যাণের দিকে, ‘এই বুঝি তোমাদের অশ্ব? বাঃ! আমাদের দেশের অশ্ব খুব তেজি হয়, পাঠান দেশ থেকে আসে তো! কিন্তু এমন সুশ্রী হয় না।’

‘আপনার নাম কী?’ পবন জিজ্ঞাসা করল।

‘আমার নাম রুদ্রাক্ষ। তোমরা আমাকে রুদ্রাক্ষদাদা বলে ডেকো।’

১২

রাজশিবিকা যখন দেউলী গ্রাম থেকে এসে পৌঁছল বিষ্ণুপুর রাজদরবারে, শ্রীনিবাস আচার্য তখন পরিশ্রান্ত। আকস্মিক পুঁথিলুণ্ঠনে তিনি এমনিতেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, রিক্ত। বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীদের থেকে অনেক যত্নে তিনি গৌড়ে নিয়ে আসছিলেন বৈষ্ণব সাহিত্যের অমূল্য পুঁথি মণিমঞ্জুষা। অনেক আশা করে গোস্বামীরা তাঁর হাতে অর্পণ করেছিলেন সেই পুঁথি কিন্তু তাঁদের বিশ্বাস রক্ষার্থে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁরই অসাবধানতায় দস্যুরা তা অপহরণ করেছে।

কোন মুখে গিয়ে গোস্বামীদের সামনে দাঁড়াবেন তিনি? ইচ্ছা করেই অনুজ দুই পণ্ডিতকে সঙ্গী করেননি, নরোত্তমকে প্রেরণ করেছেন উত্তরবঙ্গে এবং শ্যামানন্দকে উৎকলে। দস্যুরা কোথায় যেতে পারে, তা অনুমান করা অসম্ভব, তবু চেষ্টা তো করতে হবে! এমতাবস্থায় আকস্মিক মল্লরাজার আমন্ত্রণ পেয়ে কিছুটা বিস্মিত তিনি।

তখন রাজসভায় রাজকার্য সাঙ্গ হয়েছে। রাজপণ্ডিত শ্রীব্যাস আচার্য ‘ভগবৎগীতা’-র নির্বাচিত অংশ পাঠ করে শোনাচ্ছেন। পাঠান্তে প্রাঞ্জল ভাষায় রাজাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন অন্তর্নিহিত অর্থ।

সভায় প্রবেশের পর কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত হয়েছে মাত্র, সহসা উচ্চকিত কণ্ঠে শ্রীনিবাস আচার্য বলে উঠলেন, ‘মার্জনা করবেন, রাজপণ্ডিতের ব্যাখ্যা সঠিক নয়। ভাগবদগীতার বিশ্লেষণ ত্রুটিপূর্ণ।’

মুহূর্তে সকল মানুষের দৃষ্টিপথ পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাঁরা দেখেন এক মুণ্ডিত মস্তক গৌরবর্ণ পণ্ডিত উঠে দাঁড়িয়ে তর্জনী নির্দেশ করছেন।

শ্রীব্যাস আচার্যের মুখ নিমেষে রক্তাভ। তীক্ষ্নকণ্ঠে বলেন, ‘কে আপনি? আমাকে অপমান করার স্পর্ধা আপনার হয় কী করে?’

শ্রীনিবাস আচার্য মৃদু হেসে বলেন, ‘অপমান করার অভিপ্রায় আমার নেই, পণ্ডিতমশাই। আপনি রাজপণ্ডিত। আপনার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো অর্বাচীনও আমি নই। তবে অতি বড় বিদ্বানেরও তো কখনও কখনও ভ্রম হয়। আপনারও হয়েছে। আপনি বলছেন, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে স্মরণ করাচ্ছেন, হস্তিনাপুরের সঙ্গে পাঞ্চাল রাজ্যের যুদ্ধের কথা। দ্রোণ পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের ওপর প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছেন তাঁর শিষ্য কৌরব ও পাণ্ডবদের। আপনি বলছেন, একশো পাঁচজন রাজকুমার ও কর্ণ মিলে কীভাবে পরাজিত করলেন দ্রুপদকে, সেই কথা।’

‘হ্যাঁ বলছি। তো?’ শ্রীব্যাস আচার্য বললেন, ‘কী ভুল বলেছি?’

শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘কর্ণ সেই যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন, এই তথ্য আপনি কোথা থেকে পেলেন?’

‘কোথাও থেকে পাওয়ার কী আছে!’ শ্রীব্যাস তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, ‘পাণ্ডিত্যের অর্থ শুধু স্মৃতিধর হওয়া নয়, নিজের মস্তিষ্ককে উন্নত করাও। একশো পাঁচজন রাজপুত্র যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে শামিল হচ্ছেন, সেখানে কর্ণ হবেন না কোন যুক্তিতে? বিশেষত যখন তিনি প্রথম কৌরব দুর্যোধনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু? অবশ্য যাদের বিদ্যাবুদ্ধি খুবই নগণ্য, তাঁরা এই সম্ভাবনা কল্পনাও করতে পারবেন না।’

শ্রীনিবাস আচার্য শ্রীব্যাসের শূলমাখানো কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, ‘যুক্তি এই যে, কর্ণ অন্যদের মতো দ্রোণের শিষ্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন পরশুরামের শিষ্য। তাই তিনি দ্রোণের প্রতিশোধ নেওয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি!’

শ্রীব্যাস এবার আর কোনও কথা খুঁজে পেলেন না। অস্ফুটে বললেন, ‘তাই তো!’

‘শুধু তাই নয়। কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের আকস্মিক বৈরাগ্যে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে যেভাবে বোঝাচ্ছেন কর্মের অর্থ, সেই বক্তব্যের যে অর্থ আপনি ব্যাখ্যা করছেন, তাও সঠিক নয়!’

‘অর্থাৎ?’

শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘আপনি মানুষ ও পশুর তুল্যমূল্য বিচার করছেন। বলছেন পশু অসভ্য, মানুষ সভ্য। এত স্থূলভাবে পার্থক্য করা হয়নি ভগবৎগীতায়। মানুষ পশুর চেয়ে কীসে উন্নত? চারটি কার্যকলাপ রয়েছে, যা মানুষ ও পশু উভয়ের মধ্যেই বিদ্যমান। আহার, নিদ্রা, ভয় বা আত্মরক্ষা এবং মৈথুনের দ্বারা বংশবৃদ্ধি। এই জগতের প্রতিটি প্রাণীই এই চারটি কর্ম আরও ভালভাবে সম্পাদন করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে থাকে আর এভাবেই চেষ্টা করে সুখী হওয়ার। তাহলে মানুষ ও পশুর পার্থক্য কী? কেউ বলতে পারেন?’

নিস্তব্ধ রাজসভা। বৃদ্ধ রাজজ্যোতিষী দেবনাথ বাচস্পতি একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘বিচারবোধ বা যুক্তিপূর্ণ চিন্তাক্ষমতা।’

শ্রীনিবাস আচার্য হাস্যমুখে বললেন, ‘বিচারবুদ্ধি তো কুকুর বিড়ালের মধ্যেও রয়েছে। মনে করুন একটি কুকুর আপনার দিকে আসছে। আপনি তাকে বললেন, দূর হ! সে কিন্তু তখুনি বুঝতে পারবে, আপনি তাকে চাইছেন না। কিংবা একটা বিড়াল যদি মনে করে আপনার রসুইঘর থেকে দুধ চুরি করে খাবে, সে কিন্তু যথেষ্ট যুক্তি বুদ্ধির পরিচয় দেবে। সে নিবিষ্টমনে লক্ষ্য করতে থাকবে, কখন রসুইঘর ফাঁকা হবে। সুতরাং কিছু বিবেচনাশক্তি তাদের রয়েছে। যুক্তিশীলতাও রয়েছে। পশু ও মানুষের মধ্যে একমাত্র পার্থক্যসূচক বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি হল, কেন আমি দুঃখ ভোগ করছি, এই যুক্তিবোধটি। মানুষই পারে এই উপলব্ধি করতে। পশুরা জানে তারা দুর্দশা ভোগ করছে, কিন্তু জানে না কীভাবে সেই দুর্দশা লাঘব করা যায়। আর এই দুঃখের কারণ অন্বেষণই হল পরম তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের প্রাথমিক ধাপ!’

‘আপনার পরিচয় কী?’ অনুদাত্ত স্বরে এবার বললেন শ্রীব্যাস আচার্য, ‘ভালো বলেছেন আপনি।’

‘আমি বলিনি।’ মৃদু হেসে বললেন শ্রীনিবাস আচার্য, ‘মহাভারত স্মরণ করুনঃ

আহার নিদ্রা ভয় মৈথুনঞ্চ সামান্যমেতদপশুভির্নরাণাম।

ধর্মোঃ হি তেষামধিকো বিশেষো ধর্মেন হীনাঃ পশুভি সমানাঃ।।

আমি এই শ্লোকটিই ব্যাখ্যা করেছি মাত্র। ভগবান শ্রীকৃষ্ণও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনকে এই উপদেশই দিয়েছিলেন, যে পরম সত্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করো। সেই উপদেশই হল ভগবৎগীতা।’

বীরহাম্বীর এতক্ষণ নিবিষ্টমনে শুনছিলেন দুই পণ্ডিতের তরজা, এবার তিনি বললেন, ‘আপনার পরিচয় কী, মহোদয়? কে আপনি?’

শ্রীনিবাস আচার্য যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বেদ উপনিষদ চর্চার মধুর জগত থেকে ভূপতিত হলেন নিষ্ঠুর বাস্তবে। ধীর লয়ে বললেন, ‘নমস্কার মহারাজ। আমি শ্রীকৃষ্ণের চরণে আশ্রিত এক দাস, নাম শ্রীনিবাস। আগেও এই রাজ্যে এসেছি, আপনার সাক্ষাৎলাভের সুযোগ হয়নি। এক দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত হয়ে দেউলী গ্রামে আশ্রয় নিয়েছি। সেখানে আজ রাজশিবিকা গিয়েছিল, আপনি নাকি আমাকে ডেকেছেন?’

বীরহাম্বীর চমকিত হয়ে ওঠেন, চকিতে তাকান অদূরে প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহনের দিকে। সংকুচিত হয়ে বলেন, ‘কী দুর্ঘটনা, পণ্ডিতমহাশয়?’

শ্রীনিবাস আচার্যের অভিব্যক্তি নিমেষে পরিবর্তিত হয়ে যায়, গতরাতের কথা বলতে বলতে অশ্রুরুদ্ধ হয়ে আসে তাঁর কণ্ঠস্বর।

‘মল্লরাজ! এর চেয়ে কেউ আমার হৃদপিণ্ড উপড়ে নিলেও আমার এত কষ্ট হতো না। আমরা বৃন্দাবনের জ্যেষ্ঠগোস্বামীদের থেকে অত্যন্ত মহার্ঘ্য পুঁথি নিয়ে যাচ্ছিলাম গৌড়ে। কিন্তু কাল রাতে সমস্ত পেটিকা অপহৃত হয়েছে। যে পুঁথিগুলি অমূল্য রত্নবিশেষ, যাদের গায়ে লেগে রয়েছে স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভুর স্পর্শ, সেগুলো এভাবে হারিয়ে ফেলা যে কতটা গ্লানির, তা বোঝাবার সাধ্য আমার নেই!’

শুনতে শুনতে অস্থির হয়ে ওঠেন বীরহাম্বীর, এগিয়ে আসেন জীমূতবাহন। সেই মুহূর্তে দুজনে শ্রীনিবাস আচার্যকে নিয়ে যান গোপন কক্ষে।

কক্ষের একপ্রান্ত থরে থরে সাজানো রয়েছে কয়েকটি কাষ্ঠপেটিকা।

শ্রীনিবাসের সামনে রাজা উন্মুক্ত করেন পেটিকাগুলোর অর্গল।

‘একি!’ শ্রীনিবাস আচার্য বাকরুদ্ধ! তিনি যেন স্বচক্ষে বারবার দেখেও বিশ্বাস করতে পারছেন না! সেই পুঁথিগুলো। প্রবল আবেগে কাঁপছেন, ‘এগুলো এখানে কীভাবে এল?’

বীরহাম্বীর নতমস্তকে দাঁড়ালেন। তাঁর সর্বাঙ্গ অনুশোচনায় দীর্ণ, অধরোষ্ঠ থরথর কম্পমান। শ্রীনিবাস আচার্য আবারও অধীর হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কীভাবে এখানে এল?’

বীরহাম্বীর রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করুন আচার্যমহাশয়! আমি না জেনে এক বড় পাপকার্যে লিপ্ত হয়েছিলাম। ক্ষমা করুন, আমায় ক্ষমা করুন।’

শ্রীনিবাস আচার্য কয়েক মুহূর্ত সময় নিলেন গোটা বিষয়টি অনুধাবন করতে। তিনি আর্দ্রকণ্ঠে বললেন, ‘আহা! অনুশোচনার পর সব পাপ ধুয়ে যায় গো! তোমারও গিয়েছে বীর! কৃষ্ণপদে তোমার মতি হোক!’

বলতে বলতে মল্লরাজকে জড়িয়ে ধরলেন বক্ষে।

১৩

মেনকা অনেকক্ষণ একইভাবে শুয়েছিল। এই ঘরটা ভারি অদ্ভুত, সূর্যের আলো ভেতরে ঢোকে না। দ্বিপ্রহরেও ভেতরে জ্বলছে একটা বাতি। সেই বাতির ম্রিয়মাণ আলোয় চারপাশ রহস্যময় হয়ে উঠেছে।

ওপরের খড়ের চালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মেনকা এবার কিঞ্চিৎ আদুরে কণ্ঠে বলল, ‘কপাটের আড়ালে সোহাগের শেষ নেই। এদিকে লোকজনের সামনে অমন দুচ্ছাই কেন করো গো আমায়!’

ছোট একটি তক্তপোশ। তাতে পূর্ণদৈর্ঘ্য একজন মানুষ কোনওমতে শুতে পারে। এখন সেখানে শঙ্খবদ্ধ সর্পের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে কিলবিল করছে দুই প্রাপ্তবয়স্ক নরনারী। তারা সম্পূর্ণ নগ্ন, রতিক্লান্ত, ঘর্মাক্ত।

কেশব একটা হাত মাথার পেছনে দিয়ে শুয়েছিল। তার শরীর থেকে ঘামের ভীষণরকম দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।

তবু মেনকা পাশ ফিরে তার রোমশ বুকে মুখ ঘষে ফের বলল, ‘উত্তর দাও না কেন গো মহাদানীমশাই?’

কেশব তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘জ্বালাসনি। ঘরে যা।’

মেনকা মুখ ফুলিয়ে বলল, ‘এত যখন জ্বালাতন করি, তো ডাকো কেন? তখন তো মেনকা ছাড়া জোটে না!’

‘জুটবে না কেন?’ কেশব খিঁচিয়ে উঠল, ‘ধবাডাঙায় গিয়ে দু-চার তঙ্কা ফেললেই সুড়সুড় করে চলে আসবে। নেচে গেয়েও সুখ দেবে। কেশব ছড়াকারকে রদ্দি ভাবিসনি। আমি না থাকলে তোর নিত্যনতুন নাকছাবি, বাউটি কোত্থেকে জুটবে, সেটা ভাব! নিজেই তো বলিস, রানীমা আজকাল মোটেও হাত উপুড় করেন না।’

‘বারে, শুধু গয়না দিলেই হল বুঝি?’ মেনকা ঠোঁট ফোলায়।

‘তবে? আর কী চাই তোর?’

মেনকা এবার কেশবের স্তনবৃন্তে ঠোঁট স্পর্শ করল। বিপরীতমুখী এই সোহাগ কেশবের বড় প্রিয়, সে জানে। আদুরে গলায় ফিসফিস করল, ‘মহাদানীমশাইয়ের হাতের সিঁদুর চাই গো সিঁথিতে! তবেই আমার শান্তি!’

কেশব এবার অট্টহাস্য করে উঠল, ‘মাতা খারাপ হল নাকি তোর? তোকে বে করতে যাব আমি? কেন, মল্লভূমে কি ভদ্দর মেয়ে কম পরেচে নাকি যে রাজবাড়ির দাসীকে গলায় ঝোলাব?’

তারপর বেশ সুর কেটে সে বলল,

‘গাই আনবি ঝাপড়ি, বৌ আনবি ফেতড়ি।’

বুঝলি, দাপুটে গরু আনো ঠিক আছে, বউ চাই ফেতড়ি—মানে সাধাসিধা। তোর মতো খনখনে দেমাকি মাগীকে আনতে যাব কেন?’

মেনকার মুখটা কালো হয়ে গেল। তবু সে হাল ছাড়ল না, বলল, ‘এহ, দেমাকি হব না কেন শুনি? রাজবাড়ির কতজন আমার জন্যে পাগল, তা জানো?’

কেশব মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গী করে বলল, ‘যা—যা! দিনরাত সব কুলি, মজুরদের সামনে দিয়ে পাছা দুলিয়ে ঘুরে বেড়াস, হায়া শরম কিচ্চু নেই, তোর মতো মেয়েকে বে’ করে নাকি কেউ? সাজ দেখলে ওই ধবাডাঙার লটিগুলোও লজ্জা পাবে। পোঁদ ন্যাংটা, মাথায় ঘোমটা! তার ওপর বংশপরিচয় নেই, বাপের ঠিক নেই। দূর হ!’

মেনকা এবার সরে গেল। কেশবের গায়ের গন্ধ বড় কটু হয়ে ঝাপটা মারল। তক্তপোষ থেকে নেমে সে লইয়াটা গায়ে জড়াতে লাগল।

কেশব কিছুক্ষণ তীক্ষ্নচোখে দেখল। তারপর চেঁচিয়ে উঠল, ‘কোথায় যাচ্চিস? কোন মজুরের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে? নাকি তোর সেই হাঁটুর বয়েসি নাগরটা দাঁড়িয়ে আচে বাইরে?’

মেনকা উত্তর দিল না। হুড়কো টেনে দিয়ে সে বেরিয়ে এল। তার চোখে জল এসে গেছে। আজ পর্যন্ত সে যে কেশবের কাছে কম অপমানিত হয়েছে তা নয়, কেশব ছড়াকারের জিভের ধার যেকোন মানুষকে ক্ষতবিক্ষত করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আজকের শূলগুলো যেন বড্ড সূঁচলো!

মেনকা নিজে ভেবে পায় না, কেন এই লম্পট ও মিথ্যাবাদী মানুষটার কাছে সে বিকিয়ে দিয়েছে নিজের সবকিছু!

ভালোবাসায় বোধহয় কোনও হিসাব চলে না। শত লাঞ্ছনা, অপমানেও প্রেমিকের দিকে ফল্গু নদীর মতোই তা ধাবিত হয়।

আজ মেনকা একুশের পরিপূর্ণ নারী। কেশবের সঙ্গে যখন তার জীবন জড়িয়ে গিয়েছিল, তখন সে বছর ষোলোর এক সতেজ তরুণী।

আর অন্নদা যখন তাকে নিয়ে ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে রাঢ়বাংলার এই রুক্ষপ্রান্তরে এসেছিল, তখন মেনকা মাত্র আট। তার মধ্যেই তাদের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে ঝড়ঝঞ্ঝা। অন্য কেউ হলে কবেই নিজের জীবন শেষ করে দিত। কিন্তু অন্নদা অন্য ধাতুতে গড়া।

রাজমাতার পরিচারিকা অন্নদা একটু বড় হতেই মেনকাকে নিযুক্ত করে দিয়েছিল রানী শিরোমণির কাছে। মেনকার উদ্ভিন্ন যৌবনে আকৃষ্ট কে না হয়েছে! কর্মচারীরা তো বটেই, এমনকি মল্ল হিকিম জগত কুমারও তার সঙ্গকামনা করেছেন।

তা মেনকা যদি সত্যিই চরিত্রহীনা বেশ্যা হত, তবে কি নিজের সুবিধার জন্য সে রাজ্যের কুমারের প্রস্তাব গ্রহণ করত না?

হতে পারে, মহারাজা বীরহাম্বীর খুবই চরিত্রবান পুরুষ, তাঁর আমলে রাজ্যের কুমাররা কেউই প্রকাশ্যে রক্ষিতা রাখতে পারেন না, নৈতিক চরিত্র ও মূল্যবোধের উপর মহারাজের কঠোর দৃষ্টি, কিন্তু যাদের মনেই পাপ, তাঁরা আড়ালে আবডালে এসব করেনই।

মেনকা জগত কুমারকে তুষ্ট করলে তিনি তাকে কেশবের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বিলাসিতায়, অলঙ্কারে ভরিয়ে দিতে পারতেন।

মেনকা জগত কুমারের প্রস্তাব তো গ্রহণ করেইনি, উল্টে মহারানীকে বলে জগত কুমার যাতে দুঃসাহসী না-হয়ে ওঠেন, সেই পথও বন্ধ করেছিল।

কারণ ততদিনে তার শরীর মন সব অধিকার করে নিয়েছে কেশব ছড়াকার। তখন লোকটা এখনকার মতো শুধু গায়ে জ্বালা ধরানো ছড়া কাটত না। মেনকার কোমল বুকে ঝড় তোলা কাব্য লিখত, আর একচিলতে ঘরে কানে ফিসফিস করে সেই কাব্য বলার সঙ্গে সঙ্গে মেনকার নিরাবরণ দেহে মাখিয়ে দিত নিজের ঘাম। সেই কাব্যের প্রতিটি শব্দই নাকি তখন সে লিখত মেনকার কথা ভেবে। প্রতিটি অক্ষরে মিশে থাকত মেনকার নবযৌবনা দেহের আশ্লেষ!

কেশব মানুষটি এক বিচিত্র লোক। সে বিষ্ণুপুর নগরে এসেছিল পরিণত বয়সে। আগে তার বাসস্থান কোথায় ছিল, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। কেউ বলে সে রাজগ্রামের লোক, কেউ কেউ আবার মনে করে, ওর বাড়ি সামন্তরাজ্য তুঙ্গভূমের দিকে। এতকালের ঘনিষ্ঠতার পর সে নিজের সম্পর্কে মেনকাকেও কিছু বলেনি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তিকে সে হাত করে ফেলেছিল।

মেনকার নাহয় বংশপরিচয় নেই, কেশবেরই বা কী আছে? পুরুষমানুষ বলে সব দোষ মাফ? নিজের মনে ফুঁসতে থাকে মেনকা।

তার উপর বছরদুয়েক কেশবকে মহাদানী করে দেওয়ার পরে কলাগাছ ফুলে আরও ঢোল হয়েছে! কেশব মহাদানীর জন্য ধার্য করা হয়েছে ভদ্রাসন। তবু মেনকার সঙ্গে শারীরিক চাহিদা মেটাতে তাকে নিয়ে আসে এই ঘরেই।

কেন এত লুকোছাপা? মেনকার এতদিন কান্না পেত, কিন্তু এখন মনে হয়, গিয়ে কেশবের দু-গালে দুটো চড় কষায়। কিন্তু পারে না।

কেশবের হাত যে অনেক লম্বা! চাইলে সে মেনকাকে জ্যান্ত কেটে ব্রীড়াবতী নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারে।

মল্লরাজারা পুরোহিত, সেবাইত, সাধু সন্ন্যাসীদের নিষ্কর জমি দান করেন, সেইসব দানকাজ সম্পদনার জন্যে মহাদানীদের নিয়োগ করা হয়। এক অদ্ভুত যোগাযোগে কেশব বহিরাগত হয়েও মহাদানী হয়েছে।

তবে লোকটা যতই কদর্য স্বভাবের হোক, পাণ্ডিত্য আছে। মুখে মুখে অমন ছড়া বানানো সহজ কর্ম নয়। তবে আজ এটা স্পষ্ট যে, এত বছর ধরে সে শুধুই মেনকাকে ভোগ্যপণ্য হিসেবেই দেখে এসেছে! মেনকার মনে নানা কথা পাক খাচ্ছিল। ভাবতে ভাবতে সে ম্লানমুখে হাঁটছিল। দেরি হলে আবার রানীমা সন্দেহ করবেন। এইসময় দেখা হল লালের সঙ্গে।

লাল অশ্বারোহী সৈনিক। বয়স চোদ্দো-পনেরো। এত ছোট বয়সে সেনাদলে যোগ দেওয়া যায় না, কিন্তু তার ব্যুৎপত্তি দেখে তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। লালের পিতাও সেনাবাহিনীর অশ্বারোহী ছিল, মোঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে মারা যায়। মা রাজবাড়িরই এক পরিচারিকা।

মেনকাকে দিদির মতো ভালোবাসে লাল। মেনকাও তাকে বড় স্নেহ করে। নোংরা কেশবটা লালকে ইঙ্গিত করেই বলেছিল, হাঁটুর বয়সি নাগর।

রাগে ঘৃণায় মেনকার দু-চোখ জ্বালা করে উঠল। রক্তের সম্পর্ক না থাকলে কি ভাইয়ের মতো ভালোবাসা যায় না?

মেনকা বলল, ‘কীরে লাল! কী খবর?’

লাল একগাল হেসে বলল, ‘মতিচুর খাবি, মেনকাদিদি?’

‘কোত্থেকে পেলি?’

বলল, ‘সেনাপতিমশাই খুশি হয়ে দিয়েছেন, তোর সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাব বলে রেখে দিয়েছি।’

‘বেশ করেচিস।’ মেনকা সস্নেহে লালের মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বলল, ‘ওবেলা আসিস’খন। চিত্রকূট বানিয়েছি।’

‘আচ্ছা!’ লালের মুখ আলো হয়ে উঠল।

লালের সঙ্গে কথা বলে মেনকার মনের মেঘ কিছুটা কেটে গেল। অন্দরমহলে ঢুকেই ও অন্নদার মুখোমুখি পড়ে গেল।

অন্নদা উল্টোদিক থেকে আসছিল। মধ্যত্রিশেও তার শরীরের বাঁধুনি এখনও অটুট। মুখের অস্পষ্ট বলিরেখাগুলো তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সাক্ষী। অন্নদাও সবসময় পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত থাকতে ভালোবাসে।

মেনকাকে দেখে অন্নদা ভ্রূ কুঞ্চিত করল, ‘এই অবেলায় কোথায় গিয়েচিলি?’

মেনকা চোখ নামাল। যতই মুখরা হোক, অন্নদাকে সে যমের মতো ভয় পায়। তার সামনে মিথ্যাভাষণ করার ক্ষমতা মেনকার নেই। অন্নদা ফের কেউটে সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলল, ‘আবার তোর সেই আধবুড়ো নাগরটার কাচে গেচলি?’

মেনকা নির্বাক, নতমস্তকে এক পা দিয়ে অন্য পায়ের নখ খুঁটতে থাকে।

অন্নদার মুখ হিংস্র হয়ে উঠল। চাপাস্বরে গর্জে ওঠে, ‘যমের অরুচি আবাগী, কতবার তোকে বলেচি নজর উঁচু তারে বাঁধ? বে’ করলে ভালো লোককে করো?’

মেনকা এবার ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, ‘এতই যখন আমার বে’র জন্য চিন্তা, তো অ্যাদ্দিন ধরে ঘুমুচ্চিলে কেন?’

অন্নদা মুখ বিকৃত করে বলল, ‘ওরে মুখপুড়ি, কেন ঘুমুচ্চিলাম জানিস না? এই দশটা বচ্ছর ধরে তোকে কীভাবে সামলে রেকেচি, মায়ের স্নেহে আগলেচি, সব ভুলে গেলি?’

মেনকার চোখ ছলছল করে উঠল। বলল, ‘তাহলে এতদিন যখন একা ছিলাম, একাই কেটে যাবে জীবনটা। আমাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করো।’

‘না।’ অন্নদা বলল, ‘আমার যা হয়েচে হয়েচে, শপথ করেচিলাম, শেষ দিন অবধি তোকে হাসিমুখে রাকব। আর ভয় নেই। এতগুলো বছর যখন কেটে গেচে, সে আর আসবে না!’

‘আসবে না’ বলার সময় ওর গলাটা একটু কেঁপে গেল।

‘একটু থেমে বলল, ‘তবে কারুর রক্ষিতা নয়, বউ হয়ে সংসার করবি তুই। আমি তোর জন্য ভালো একটা পাত্তর ভেবেচি, মেনকা!’

‘কে?’

অন্নদা বলল, ‘মহারাজের পায়ে পায়ে যে ঘোরে, সে।’

‘শ্রীধর?’

‘হ্যাঁ। শ্রীধর লোক ভালো, একা মানুষ, সাধাসিধা। শাউড়ি ননদ সতীন কেউ নেই, দিব্যি একলা ঘরের গিন্নি হবি, চাবি ঝুলিয়ে লাইতে যাবি! এমন ভালো পাত্তর থাকতে তুই কিনা হতচ্ছাড়া লম্পটটার কাছে ছুটচিস!’

মেনকার চোখ ছলছল করে উঠল। ধরাগলায় বলল, ‘আর ছুটব না গো। সে আমায় বে’ করবে না বলেচে।’

‘তবেই বোঝ!’ অন্নদা বলল, ‘তোর আগাপাছতলা না জেনেই বলচে বে’ করবে না। জানলে তো ঝেঁটিয়ে বিদায় করত রে হতভাগী!’

‘সে তো তোমার শ্রীধরও জানতে পারলে…!’

‘থাম!’ ধমকে ওঠে ‘জানতে পারলে…! জানবেটা কী করে? সে কি তোর ওই ছড়াকারের মতো এ-দেশ ও-দেশ ঘুরে বেড়ায়! সরল সাদা লোক। এই রাজবাড়িটাই তার পিতিবি! বুঝলি?’

মেনকা, মৃদু স্বরে ‘এখন আসছি। রানীমার স্নানের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ বলে এগিয়ে যায়।

রাজবাড়ির প্রশস্ত অলিন্দ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বহুযুগ আগের এক গোধূলি বেলার ছবি যেন তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

তার বিস্মৃতপ্রায় শৈশবে যে সদ্য তরুণটি গোধূলিবেলায় কনে দেখা আলোর মাঝে তার সিঁথি রাঙিয়ে দিয়েছিল, তার মুখ প্রাণপণ মনে করার চেষ্টা করে মেনকা। কষ্টে তার মাথা যন্ত্রণা করে, চোখ বুঁজে আসে। তবু মনে পড়ে না। মনে হয় সে’সব যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি।

১৪

সন্ধ্যা হতে না হতে আজ আকস্মিক কালবৈশাখী উঠেছে। সেই ঝড়ের তোড়ে ঝলসে যাচ্ছে মাঠঘাট, নুয়ে পড়ছে বনস্পতিরাও। পশুপাখি যে যেখানে পেরেছে পালিয়েছে, আশ্রয় নিয়েছে কোনও ছাদের নীচে।

ঝড় যে এত জোরে আসবে তা একটু আগেও কল্পনা করা যায়নি। আকাশ ছিল পরিষ্কার, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছিল। এখন এই প্রচণ্ড বজ্রবিদ্যুতের তীব্রতায় চারপাশ যেন ঝলসে যাচ্ছে।

ঈশানকোণে প্রায় অর্ধশতাব্দী দাঁড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষটি এমন বিপজ্জনকভাবে দুলছে, মনে হচ্ছে যে-কোনও মুহূর্তে সেটি আছড়ে পড়বে পাশের মিনারের ওপর। রাজপ্রাসাদের চার কোণের চারটি মিনারই কেমন নিস্তব্ধ সাক্ষীর মতো প্রত্যক্ষ করে চলেছে ঝঞ্ঝাকে।

প্রাসাদটি পুরোটাই ইষ্টকনির্মিত। চারদিকে চারটি মিনার, সেগুলির প্রথম তলায় একটি করে কেন্দ্রীয় কক্ষ। কক্ষগুলির চতুর্দিক ঘিরে রয়েছে সংকীর্ণ অলিন্দ এবং উপরে ওঠার সিঁড়িপথ। মিনারগুলির ওপরের ছাদ বৃত্তাকার গম্বুজ। পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের জন্য রয়েছে অনেক খিলানও।

কিন্তু এখন সেই খিলান দিয়ে এমন জোরে বাতাস ঢুকছে, চর্তুদিক ধূসর হয়ে উঠছে।

রাজবাড়ির দক্ষিণদিক হিকিমমহল। রাজার জ্যেষ্ঠপুত্র সিংহাসনে আরোহণের পর দ্বিতীয় পুত্র হন এদেশের হিকিম। বর্তমান হিকিম রাজমাতা স্বর্ণময়ী দেবীর নিজের পুত্র জগত কুমার। তিনি মল্লভূম রাজ্যের নাটকাঞ্চন মৌজার জমিদারও বটে।

জগত কুমার গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে আরাম পেতে মিনারের উপরতলায় উঠে বিশ্রাম করছিলেন, কিন্তু এত জোরে যে কালবৈশাখী ধেয়ে আসবে তা ভাবতে পারেননি। ঠান্ডা বাতাস অনেকক্ষণ ধরেই আসছিল, কিন্তু শেষে যখন অজস্র ধূলিকণা এসে মুখেচোখে ঢুকে যেতে লাগল, তখন তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন।

‘উমাপতি! উমাপতি! কোথায় গেলি?’

উমাপতি প্রভুর হাঁকডাক শুনে ছুটে এল, ‘আজ্ঞে হিকিমমশাই!’

জগতকুমার কটমটিয়ে বললেন, ‘কোথায় ঘুমোচ্চিস হতভাগা? ধুলো এসে যে আমার চোখেমুখে ঢুকে যাচ্চে, খিলানগুলো বোজাবেটা কে? আমি?’

উমাপতি ছুটে গেল। খিলানের টুঙ্গিগুলো ধরে বন্ধ করতে করতে দেখল, নীচে অশ্বশালায় রাখা ঘোড়ারা ছটফট করছে। এই ঝড়জলের মধ্যে তারাও উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, এত উঁচু থেকেও তাদের অস্থির হ্রেষাধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

বৃষ্টির ছাঁট সামলাতে সামলাতে দেখল, দুজন তুরঙ্গী মিলেও একটা ঘোড়াকে সামলাতে পারছে না।

উমাপতি ঘোড়াটাকে চিনতে পারল। ওর নাম পঞ্চকল্যাণ। কনিষ্ঠ রাজকুমার রঘুনাথের অশ্ব।

উমাপতি চোখ বড়বড় করে এসে বলল, ‘বাপরে বাপ! আকাশ কি আজ ভেঙে পড়বে নাকি হিকিমমশাই?’

জগতকুমার চিৎ হয়ে শুয়ে ধীরে ধীরে ডালিমের রস পান করছিলেন। বললেন, ‘কেন, ভেঙে পড়লে তোর বিশেষ সুবিধে হয় বুঝি? নিজে তো ফড়িং-এর মতো পালিয়ে যাবি, ভাঙলে তো আমার ঘাড়েই পড়বে!’

উমাপতি হেসে ফেলল, ‘কী যে বলেন আজ্ঞে!’

‘তো এইসব অলুক্ষুণে কথা বলচিস কেন?’ জগতকুমার তরলটুকু গলাধঃকরণ করে বললেন, ‘দেকচিস না, রাজ্যিশুদ্ধু লোক অনর্থ বাধাতে উঠে পড়ে লেগেচে? কোনও তিথি মানা নেই, নক্ষত্র মানা নেই, যা’হোক করে মন্দির বানাতে শুরু করে দিলেই হল? ভোলানাথের কোপে সব ছারখার হয়ে যাবে।’

উমাপতি লম্বা মাথা দোলাল, ‘যথার্থ বলেছেন কর্তা! রাজপণ্ডিতমশাইও নাকি খুব কুপিত হয়েচেন।’

‘কুপিত হওয়ারই কথা!’ জগতকুমার সুবিশাল মুখগহ্বরের ভেতর থেকে ডালিমের বীজ বের করতে করতে বললেন, ‘ধম্মপুরাণে তো লেকাই আচে বংশে মেয়ে জন্মালে কিচু করতে নেই। তা কে শোনে কার কতা! রাজা হয়ে লায়েক হয়ে গিয়েচে কিনা!’

উমাপতি কথাগুলো গিলছিল। হিকিমমশাইয়ের কথায় সঙ্গত দেওয়াই তার কাজ। এসব কথার বাজারমূল্য দারুণ। কোন কথা কোথায় কত দামে বিক্রয় করতে হয়, সে ব্যাপারে সে রীতিমতো পাণ্ডিত্য অর্জন করেছে। জগতকুমার থামতেই সে বলে উঠল, ‘আজ্ঞে, রানীমারও তো আঁতুড়ঘরে যায় যায় অবস্থা হয়েচিল।’

জগতকুমার খর চোখে বললেন, ‘তা তিনি আচেন কেমন? আচেন না গেচেন?’

‘আজ্ঞে মেয়েছেলার পরাণ, কই মাছের সমান কর্তা! এখন ভালো আচেন শুনিচি।’

জগতকুমার মুখব্যাদান করে একবার গাত্রোত্থান করার চেষ্টা করলেন, পারলেন না।

বছরকয়েক হল অজানা কারণে তাঁর দেহ স্ফীত থেকে স্ফীততর হয়ে উঠছে। চিকিৎসার কোনও ত্রুটি হয়নি, বহু খ্যাতনামা আয়ুর্বেদ চিকিৎসক এসেছেন, নানাবিধ ভেষজ দেশ-বিদেশ থেকে আনা হয়েছে, নানারকম ধাতু ও উপধাতু শোধন ও মারণ করে প্রয়োগ করা হয়েছে, ফল হয়নি। রাজবৈদ্য কৃষ্ণবল্লভ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন।

তবে জগতকুমারের শরীরে এই অস্বাভাবিক স্থূলত্ব ছাড়া অন্য কোনও খারাপ লক্ষণ প্রকট হয়নি, নিদ্রা থেকে ক্ষুধা কিছুতেই তাঁর সমস্যা নেই। তাই ধীরে ধীরে সবাই দুশ্চিন্তা ত্যাগ করেছে।

উমাপতি পশ্চাতে গিয়ে প্রভুর বাহুমূলের নীচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে জোরে চাপ দিল। জগতকুমার পশ্চাতে গিয়ে মুখ বিকৃত করে প্রশন্ত কলাগাছের মতো পা-দুটিতে কিছুটা ভর দিয়ে অবশিষ্টটা উমাপতির ওপর ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।

বললেন, ‘হ্যাঁ রে উমাপতি, আর কোনও খবর আছে নাকি?’

উমাপতি দন্তবিকশিত করে হাসল, ‘আজ্ঞে খপর তো রাখতেই হয় কত্তা! খপর না রাখলে কি হয়? খপর এক, ইন্দ্রহাসের মোঘল চৌকি থেকে আজকেও হামলা হয়েচে। দুজন কর্মকারের মাথা ফেটেচে। খপর দুই, কোত্থেকে এক বৈষ্ণব বামুন এসেচেন রাজ্যে, তিনি সারাক্ষণ মহারাজের গায়ে লেপ্টে রয়েচেন। তিথি নক্ষত্র যে কিচু নয়, মনে ভক্তি থাকলেই যা কিচু করা যায়, এসব তিনিই বেশি করে রাজামশাইয়ের মাথায় ঢোকাচ্চেন। ভট্টঠাকুর থেকে রাজপণ্ডিত সকলেই বড় অসন্তুষ্ট। খপর তিন, মহারানীমা মনোহরার বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র সন্ধান করচেন। অনেক সম্বন্ধ আসবে। খপর চার, ছোটরাজকুমারের সঙ্গে এক নতুন বিদেশি পায়ে পায়ে ঘুরচে। কী মতলব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অতিথি আবাসে থাকচে।’

‘দাঁড়া দাঁড়া!’ জগতকুমার ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘ঘোড়ার দৌড়ের মতো বলে চলেছিস! মনোহরা মানে মহারানীর ওই পুষ্যিকন্যা? জীমূতবাহনের মেয়ে?’

‘আজ্ঞে কত্তামশাই!’

জগতকুমার মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘কেন, নিজের পেটের মেয়ে আসা মাত্তরই এই মেয়ের প্রতি ভালোবাসা উধাও হয়ে গেল? ভালো রগড় বাপু! দ্যাখ, কোন রাজপুত্তুর বে’ করতে রাজি হয়। অন্দরমহলটা সব নষ্ট মেয়েমানুষে ছেয়ে গেচে।’

উমাপতি চুপ করে রইল। এই সংবাদটা বলা ঠিক হয়নি। জগতকুমারের যে অন্তঃপুরের কিছু মহিলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ রয়েছে, তা সকলেরই জানা। গতবছরের ভাদুপুজোর কেলেঙ্কারিটা কে ভুলবে!

উৎসব শেষে রাতের অন্ধকারে জগতকুমার নাকি পুষ্করিণীর নির্জন পথে জাপটে ধরেছিলেন মহারানীর পরিচারিকা মেনকাকে। সেই দাসী সোজা গিয়ে নালিশ করেছিল রানীমার কাছে। মহারাজ এতটাই রুষ্ট হয়েছিলেন যে আদেশ দিয়েছিলেন জগতকুমারের শাস্তিও যেন সাধারণ প্রজাদের মতো হয়। মল্লরাজ্যে নারীদের প্রতি অশালীন আচরণের একটাই শাস্তি—মৃত্যুদণ্ড।

তারপর রাজঅলিন্দে কী কী নাটক হয়েছিল তা উমাপতি জানে না। হয়তো রাজমাতা স্বর্ণময়ী দেবীর মুখ চেয়েই সেই শাস্তি মহারাজ ঘোষণা করেননি। কঠোর আদেশ দিয়েছিলেন, জগতকুমার যেন আর কোনওদিন অন্দরমহলের দিকে না যাওয়ার চেষ্টা করেন।

সেই ঘটনার পর থেকে বীরহাম্বীরের প্রতি জগত কুমারের ক্রোধ সহস্রগুণ বর্ধিত হয়ে গিয়েছে। জগত কুমারের ধর্মপত্নী অহল্যা বহুদিন হয়ে গেল তাঁর দুই পুত্রসহ রানীমহলে থাকেন। জগতকুমার দৃকপাতও করেন না।

জগতকুমার খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘আ মলো যা। কানে কি তুলো আঁটলি নাকি?’

উমাপতি দ্রুত বর্তমানে ফিরে আসে, ‘কিছু বলচেন কর্তা?’

‘বলছি বৃষ্টির ছাঁট আসছে। নামব।’

‘আজ্ঞে কত্তা!’

জগতকুমার সাবধানে নামতে শুরু করলেন সিঁড়ি দিয়ে। ওপরের মিনারের ফাঁকফোঁকর দিয়ে বৃষ্টির জল এসে ধাপগুলোকে পিছিল করে তুলেছে। উমাপতি খুব সাবধানে ধরে ধরে নামাতে লাগল তাকে।

জগতকুমার খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘ওই বিদেশি লোকটা খুব শীঘ্রই আমার মহলে আসবে। দেখিস, কেউ যেন টের না পায়।’

উমাপতি সঙ্গে সঙ্গে মাথা হেলায়। সে জগতকুমারের খাস লোক। বারমহল থেকে বারাঙ্গনা, সবকিছু নিঃশব্দে সে-ই সামলায়।

‘সিড়ির শেষ ধাপ থেকে নেমে গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে সে বলল, ‘যে আজ্ঞে কর্তা!’

১৫

খড়বাংলা মহল্লার এক ক্ষুদ্র মৃৎকুটীর। চারিপাশে আম্রকানন।

কুটীরের দ্বারদেশে শ্রীনিবাস আচার্য কুশাসনে বসে হরিনামজপে মগ্ন। তাঁর মস্তক মুণ্ডিত, শ্বেতশুভ্র ব্রহ্মশিখা পিছনদিকে লম্বমান। দেহ কৃশকায়। শান্ত স্নিগ্ধ মুখাবয়ব।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে বিপরীতে নিশ্চুপে দণ্ডায়মান বীরহাম্বীর। ইতিমধ্যে আচার্যমহাশয় একবারও চক্ষু উন্মীলিত করেননি। অনুচর শ্রীধর একবার ডাকতে গিয়েছিল, মহারাজ তাকে ইঙ্গিতে বারণ করেছেন।

মনোরম আবহাওয়া। বীরহাম্বীর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনুভব করলেন, এভাবে নিরলস সময় তিনি বহুকাল কাটাননি। রাজ্যশাসন, প্রতিরক্ষা, প্রশাসন, প্রজাবাৎসল্যের বাইরেও যে একটি শান্ত পুষ্করিণীর মতো জীবন রয়েছে তা তিনি বিস্মৃত হয়েছেন।

বস্তুত এই বৈষ্ণব পণ্ডিতের সংস্পর্শে আসার পর থেকে তাঁর মধ্যে যে খুব ধীর গতিতে পরিবর্তন হয়ে চলেছে, রাজা নিজেই উপলব্ধি করতে পারছেন। হয়তো রাজ্যের অনেক অমাত্যই তাঁর এই কৃষ্ণপ্রেমে বিরক্ত। কিন্তু তিনি অসহায়, সম্মোহিতের মতো এগিয়ে চলেছেন এই ভক্তিপথের দিকে।

আচার্য মহাশয়ের জপ সম্পূর্ণ হল এক দণ্ডকাল পর। সামনে মল্লরাজকে দেখে তিনি প্রসন্নদৃষ্টিতে বললেন, ‘বীরহাম্বীর! কতক্ষণ এসেছ! আমাকে বলবে তো!’

‘আপনি সাধনায় মগ্ন ছিলেন আচার্যমশাই।’ বীরহাম্বীর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন, ‘আমিও গভীর আনন্দ অনুভব করছিলাম, তাই ধ্যানভঙ্গ করিনি।’

শ্রীধর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আজ পর্যন্ত মহারাজকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে সে দেখেনি, তাই মনে মনে অত্যন্ত আশ্চর্য হল। তবু স্বভাবজাত অভ্যাসে সে নির্বাক হয়ে আচার্য মহাশয়ের জন্য আনা ফলমূল ও মিষ্টান্ন একে একে কুটীরের সামনের উঠোনে রাখতে লাগল।

 খড়বাংলা মহল্লায় এই বৈষ্ণব পণ্ডিতের জন্য মহারাজ কিছুদিন আগে এই কুটীর নির্মাণ করে দিয়েছেন। দিয়েছেন দুজন ভৃত্যও।

শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘এই আনন্দ অনুভব করাটাই জীবনের পরম লক্ষ্য, বীর। জগত যে আনন্দময়, এর আদি, মধ্য, শেষ সবই যে কেবল আনন্দ, জীবনের জাঁতাকলে সেকথা মানুষ বিস্মৃত হয়। তখনই আসে দুঃখ বেদনা হতাশা। অথচ দ্যাখো, ঋষিরা বলে গিয়েছেন—

আন্নদাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে

আনন্দেন জাতানি জীবন্তি

আনন্দং প্রযান্ত্যভিসংবিশন্তি।

এই জগত—এই ভূত আনন্দ থেকে উদ্ভুত হয়েছে, আনন্দেই বেঁচে আছে এবং আনন্দেই লীন হবে। জন্মে আনন্দ, জীবনে আনন্দ, মরণেও আনন্দ। এই জগৎ আনন্দে উন্মত্ত। আনন্দই জগত। জগতই আনন্দ।’

বীরহাম্বীর বললেন, ‘কিন্তু, জগতই যদি আনন্দ হবে, তবে মানুষের এত দুঃখ কেন?’

‘দুঃখ বলে কিছু নেই!’ শ্রীনিবাস আচার্য মৃদু হেসে বললেন, ‘দুঃখ মানুষের মনের ভ্রান্তি। এই ভ্রান্তি সরিয়ে পরমানন্দ লাভই হল সাধনা।’

বীরহাম্বীর আকুল হয়ে বলনে, ‘কোন সাধনায় এই পরমানন্দ লাভ করব, আচার্য মশাই?’

শ্রীনিবাস আচার্য হাসলেন। বললেন, ‘প্রথমে তোমাকে বুঝতে হবে, সুখ বা দুঃখ, শীত বা উষ্ণতা, এগুলো সবই মনের অনুভূতি মাত্র। মনকে সহিষ্ণু ও বশীভূত করে তুলতে পারলে সমস্ত দ্বন্দ্বকে জয় করা যায়। মনকে সহিষ্ণু করার কঠোর পথই হল সাধনা। ভগবান বলেছেন—ইন্দ্রিয়ানি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ।’

‘এর অর্থ?’

‘এর অর্থ—মন যদি চঞ্চল হয়, তবে তা ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণে বিচলিত হয়ে পড়ে। এই যে বিশ্বব্যাপী মহানন্দ, এই আনন্দের কণা প্রতিটি জীবদেহেই রয়েছে। এই আনন্দকণাই হল প্রেম ভালোবাসা বা প্রীতি। পাত্রভেদে সেই ভালোবাসার বিকাশ কখনও স্নেহ, কখনও প্রণয় আবার কখনও বা ভক্তিরূপে। নাম ভিন্ন ভিন্ন, অনুভব একই। ভক্তি থেকেই স্নেহ, স্নেহ থেকেই প্রেম। এই স্নেহ, প্রণয় বা ভক্তি যদি নির্মল হয়, নিঃশর্ত হয়, প্রত্যাশাহীন হয়, তবে মানুষ সহজেই অপার আনন্দ লাভ করতে পারে। কিন্তু বাবা, এই সব কিছুর ওপরে যে পুরু আস্তরণটি রয়েছে, সে হল আমাদের স্বার্থ। স্বার্থের মলিনতা বড় কঠিন, নিষ্ঠুর। তাই সকলের মধ্যে আনন্দকণা থাকলেও সকলের ভাগ্যে পরমানন্দ লাভ হয় না।’

নাভ কমলমে হ্যায় কস্তূরী

ক্যায়সে ভরমে মৃগ বনকা রে।

কস্তুরী রয়েছে আপন নাভিমধ্যেই, কিন্তু তা বুঝতে না পেরে কস্তুরীর সন্ধানে বনের হরিণ পাগলের মতো ছুটে বেড়ায়। দুর্ভাগা মানুষও তাই।’

বীরহাম্বীর চমকিত হয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সর্বাঙ্গে শিহরন খেলে যাচ্ছিল। মল্লভূম মন্দিরনগরী, এখানে ব্রাহ্মণের অভাব নেই। রাজপণ্ডিত, ভট্টঠাকুর থেকে শুরু করে ছোট বড় প্রচুর পণ্ডিতের সংস্পর্শে এসেছেন তিনি। কিন্তু এত প্রাঞ্জলভাবে জীবনের গূঢ় তত্ত্বগুলো কেউ বুঝিয়ে দেয়নি! কস্তুরীর মতো আনন্দও দেহের মধ্যেই থাকে?

শর্তহীন ভক্তিই সেই আনন্দের শর্ত? কী আশ্চর্য!

অধীর হয়ে তিনি বললেন, ‘প্রেম, ভক্তি বা স্নেহে স্বার্থ আসে কেন, আচার্যমহাশয়? ভালোবাসা তো নিঃস্বার্থ হওয়া উচিত!’

শ্রীনিবাস আচার্য হাসলেন, ‘স্বার্থ কোথায় নেই বাবা? তোমার পুত্ররা যে তোমায় ভক্তি করে, তা কি নিঃস্বার্থে? কিছুটা অধর্মের ভয়ে, কিছুটা রাজ্যলাভের আকাঙ্ক্ষায় এবং বাকিটা নিজেদের সুপুত্র হিসেবে দেখানোর ইচ্ছায়। তোমার স্ত্রীরা যে তোমাকে ভালোবাসেন, তাও কিছুটা ভয়ে, কিছুটা সমাজের অনুশাসনে, সঙ্গে প্রাণের টান থাকলেও থাকতে পারে। ওই প্রাণের টানটুকুই হল নিঃস্বার্থ প্রেম। সেই টান যত বাড়ে, স্বার্থও তত লোপ পেতে থাকে। তবে সকলের প্রতি সেই নিঃস্বার্থ প্রেম জাগ্রত করতে গেলে চাই সাধনা।’

‘কীভাবে রত হব সেই সাধনায়?’

শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘নিমাই পণ্ডিত খুব সহজ একটি পথ বলে গিয়েছেন। মানুষই মানুষের ভগবৎ প্রাপ্তির প্রথম সোপান, প্রধান অবলম্বন। মানবপ্রেমেই হয় ব্রহ্মলাভ। সেই প্রেমে থাকবে না কোনও জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য, থাকবে না কামনার কলুষ। জপতে হবে সেই মহামন্ত্র।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।’

‘হরে শব্দের অর্থ কী, আচার্যমশাই?’

‘হরে এসেছে সংস্কৃত ‘হরা’ শব্দ থেকে, যা রাধাকে সম্বোধন করা হয়। রাধারানীই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আনন্দময়ী শক্তি। সৃষ্টির আদিতে পরমেশ্বর রাধাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর হৃদয়ের বামপাশ থেকে। তাই রাধা ব্যতীত কেউ শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করতে পারে না।’

বীরহাম্বীর বললেন, ‘তবে নিঃশর্ত মানবপ্রেমই পরমানন্দলাভের একমাত্র পথ?’

‘শুধুমাত্র পথ নয়। মানবপ্রেম ও পরমপ্রেম একই, তবে নিষ্কাম হওয়া চাই, নিজেকে বিস্মৃত হওয়া চাই। কাম এবং প্রেম সম্পূর্ণ পৃথক দুই বিষয়। ইন্দ্রিয়সুখ ইচ্ছা ত্যাগ না করতে পারলে প্রেম হয় না।’

বীরহাম্বীর সন্দিগ্ধস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘মার্জনা করবেন, স্বয়ং রাধাকৃষ্ণের প্রেমও কি নিষ্কাম ছিল? চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে…!’

‘সাধারণ মানুষের বিনোদনের প্রয়োজনে সাহিত্য যুগ যুগ ধরেই অনেক কিছু সৃষ্টি করে, যার পুরোভাগে থাকে অতিরঞ্জন ও কল্পনা। শ্রীকৃষ্ণের চারিত্রিক স্খলন বা রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাও সেই কল্পনার রূপ।’ শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘ব্যাসদেবের মহাভারতে এগুলোর উল্লেখ পর্যন্ত নেই। কৃষ্ণ ও রাধা নিঃশর্ত প্রেমের রূপ। এবং সেই প্রেমের কোনও ভেদাভেদ নেই। সকলের মধ্যেই শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে হবে।’

বলেই শ্রীনিবাস আচার্য তাঁর উদাত্তকণ্ঠে গেয়ে উঠলেন, ‘স্থাবর জঙ্গম দেখে না দেখে কোনও মূর্তি, যাহা যাহা নেত্রে পড়ে, তাহা কৃষ্ণ স্ফূর্তি।’

বীরহাম্বীরের বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছিল না। তিনি এই বৈষ্ণব আচার্যের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ, ঈশ্বর নিষ্ঠায় অভিভূত, বিস্ময়াবিষ্ট।

তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করেছে, ভাব ও ভক্তির উচ্ছ্বাসে আপ্লুত হচ্ছে তাঁর হৃদয়। কোথায় তাঁর আত্মগরিমা, কোথায় তাঁর তেজী ক্ষাত্রশক্তি! মনে হচ্ছে মিথ্যা এই আত্মগর্ব, মিথ্যা এই অহমিকা, তুচ্ছ এই রাজসিংহাসন, তুচ্ছ এই বিলাসিতা!

রাজা লুটিয়ে পড়লেন আচার্যদেবের পদপ্রান্তে। রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘সেই পরমানন্দ লাভের দৃষ্টি আমায় দান করুন, প্রভু! আমি এত যুদ্ধ করেছি, লুণ্ঠন করেছি, মল্লরাজ্যের অধিপতি হিসেবে সদাসর্বদা প্রজাদের কল্যাণে মনোযোগ দিয়েছি, কিন্তু আপনি যে পরমানন্দ বলছেন, তা কখনও পাইনি। মনের মধ্যে সদা দ্বিধাগ্রস্থতা, হতাশা বিষাদ।’

শ্রীনিবাস আচার্য স্মিতমুখে চেয়ে রইলেন রাজার দিকে।

বীরহাম্বীর আবার বললেন, ‘ঈশ্বরের কৃপায় অযাচিতভাবেই আপনাকে পেয়েছি, প্রভু। আপনি…আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না। মল্লভূমিতে আপনাকে বড় প্রয়োজন!’

‘যেতে আমাকে হবেই, বীরহাম্বীর! একস্থানে বদ্ধ হয়ে থাকলে কি জলপ্রপাতের চলে? যেতে আমাকে হবেই। তবে এখন নয়। তোমার রাজ্যে ঘনিয়ে আসছে একটি ঘূর্ণিঝড়। সেই ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে সব। প্রকৃতি আবার শান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমি এখানে থাকব। পরমানন্দ লাভের দৃষ্টি তুমি অর্জন করবে, বীরহাম্বীর! আমি তোমায় সাহায্য করব।’ শ্রীনিবাস আচার্য রাজাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

পরের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে দীক্ষা নিলেন মহারাজ বীরহাম্বীর। নতুন জীবনে তাঁর নাম হল শ্রীচৈতন্য দাস। সম্মোহিত ভুজঙ্গের মতই তিনি হয়ে উঠতে থাকলেন শান্ত সমাহিত।

নিজেই রচনা করলেন,

প্রভু মোর শ্রীনিবাস

পুরাইলে মনের আশ

তোয়া বিনে গতি নাহি আর।

আছিনু বিষয় কীট

বড়ই লাগিত মিট

ঘুচাইলা রাজ অহংকার।।

১৬

মল্লেশ্বর শিবমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হওয়ার পর থেকে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। মন্দিরের কারণে ভট্টাচার্যপল্লীতে জনসমাগম অনেক বেড়ে গিয়েছে। এই পল্লীতে প্রধানত কুলীন ব্রাহ্মণদের বসবাস।

এখন এখানে সকাল হতে না হতেই কারিগরদের হই-হট্টগোল। গোটা কুড়ি গোশকট মোতায়েন করে রাখা আছে, যখন যা প্রয়োজন, সরবরাহের জন্য। একসঙ্গে জনাপঞ্চাশেক শ্রমিক কাজ করে চলেছে। সূর্যোদয়ের সময়ে স্নান করে কাজ শুরু করতে হচ্ছে প্রতিটি শ্রমিককে, চলছে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। মাঝে তিনদণ্ড করে ভোজন বিরতি।

জনাদশেক রাজকর্মচারী সারাক্ষণ তদারক করে চলেছে। তবে এত পরিশ্রমের মাধ্যেও সকলের মনে আনন্দ। এ তো লোকের বাড়ি বানানো নয়, রাজার কাজ, মোটা পারিশ্রমিক। তাছাড়া এতদিন রাজপ্রাঙ্গণে মল্লভূমের মা মৃন্ময়ী প্রধান দেবতা হিসাবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সবসময় সাধারণ মানুষের যাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু শিবঠাকুর থাকবেন এই নগরপল্লীতেই। যে-কোনও সময়ে ভক্তি নিবেদন করা যাবে।

মন্দিরের দায়িত্বে রয়েছে বিখ্যাত শিল্পী কার্তিক ফৌজদার। কার্তিক ফৌজদার এই মুহূর্তে বিষ্ণুপুরের সবচেয়ে খ্যাতনামা শিল্পী ও মন্দির কারিগর। তার হাতে মন্দিরের ভাস্কর্য যেন কথা বলে ওঠে। দিল্লি থেকে ঘুরে এসে আকবরের রাজ্যশাসনের অনুকরণে বীরহাম্বীর অনেককেই ফৌজদার, সিকদার, মুন্সী, বক্সী এইসমস্ত পদবি দান করেছেন।

কার্তিক ফৌজদারের চেহারাটি অদ্ভুত। তার দিকে তাকালেই আগে যেদিকে চোখ যায়, সেটি হল তার নাক। দেহের বাকি অঙ্গের তুলনায় তার নাকটি যেন একটু বেশিই লম্বা।

দুর্গাপ্রসাদ সতর্কদৃষ্টিতে সমস্তকিছু করছিলেন। প্রতিদিন প্রত্যুষে রাজকার্য শুরু হওয়ার আগে তিনি এখানে চলে আসেন, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শ্রমিকদের কাজ বা অন্যান্য সবকিছু ঠিকমতো এগোচ্ছে কিনা দেখে, চলে যান রাজসভাতে। তাঁর ওপর অগাধ আস্থা মহারাজার, বিবিধ বিষয়ে তিনি দুর্গাপ্রসাদের ওপর নির্ভর করে থাকেন।

দুর্গাপ্রসাদ মধ্যবয়স্ক, গৌরবর্ণ, কেশবিহীন। চোখদুটির অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। তাঁর মাথায় ছাতা ধরে আছে নিজস্ব ভৃত্য প্রহ্লাদ।

আজ দুর্গাপ্রসাদের সঙ্গে রয়েছে মহাদানী কেশব ছড়াকারও। সেও সবকিছু দেখছিল। দেখতে দেখতে বলে উঠল, ‘অ্যাই! অ্যাই কাত্তিক, ও কী হচ্ছে?’

শশব্যস্তে এগিয়ে এল কার্তিক, ‘আজ্ঞে। কী হয়েচে মহাদানীমশাই?’

‘আরে, এ তো দশাবতার তাস বানানোর কাজ নয়, স্বয়ং বাবা ভোলানাথের কাজ।’ কেশব দুহাত কপালে তুলে প্রণাম করল, ‘তোর লোকেরা যে মুড়ি কলা খেয়েই কাজে লেগে যাচ্ছে, হাত-পা-মুখ ধুয়ে শুদ্ধ হতে হবে না?’

কার্তিক তৎক্ষণাৎ তার শ্রমিকদের দিকে চলে গেল। কেশব বলল, ‘ঘোষমশাই, মহারাজা আপনার ওপর এই মন্দিরের দায়িত্ব দিয়েচেন। বেশ জাঁকালো একখানা মন্দির বানান দিকি!’

‘না কেশব। এই মন্দির অন্যান্যগুলোর মতো অত জাঁকালো হবে না, তেমনটাই মহারাজের ইচ্ছা। ভোলাবাবা শিব যেমন সাধারণ আড়ম্বরহীন, তাঁর মন্দিরও তেমনটাই হবে।’ দুর্গাপ্রসাদ ঘোষ মন্দিরের নির্মাণের ভিত্তির ওপর হাত রাখলেন। অনুচ্চকণ্ঠে নিজের ভৃত্য প্রহ্লাদকে বললেন, ‘কী বুঝছিস প্রহ্লাদ?’

প্রহ্লাদ নামক ভৃত্যটি মনিব মতামত চাইলেই তালগোল পাকিয়ে ফেলে। তড়বড়িয়ে বলে উঠল, ‘আজ্ঞে, যখন রাজামশাই এসেছিলেন ভিতপুজোতে, তকন তো ভিড় উপচে পড়েচিল! কিন্তু একন কোন লোক নেইকো!’

দুর্গাপ্রসাদ কিছু বলার আগেই কেশব তাচ্ছিল্যভরে বলল, ‘হুঁ—! মহারাজ ঢালাও মণ্ডামিঠাইয়ের আয়োজন করেছিলেন যে! ওদিকেই সবার ঝোঁক বেশি কিনা।’

কার্তিক তার লোকদের ওপর চিৎকার করছিল, দুর্গাপ্রসাদ বললেন, ‘ঠিক আছে। ওদের কাজ করতে দে।’

‘যে আজ্ঞা ঘোষমশাই। আপনি বসুন না!’

‘আমি ঠিক আছি।’ দুর্গাপ্রসাদ বললেন, ‘সব মনে আছে তো কার্তিক? প্রবেশ তোরণের নকশাটা পত্রাকৃতির করবি। তার ওপরে আমলক আর কলস থাকবে। মহারাজার ইচ্ছে।’

‘আজ্ঞে ঘোষমশাই। খিলানের ওপরে একটা কুলুঙ্গি হবে, তাতে হস্তীমূর্তি থাকবে। প্রতিষ্ঠাফলকটা থাকবে তার ওপরে।’ কার্তিক বলল, ‘আচ্ছা ঘোষমশাই, হস্তীর সঙ্গে কি মহামাত্রের মূর্তিও রাখব?’

‘রাখতে পারিস।’ হস্তী থাকলে তো হস্তীচালককেও রাখতে হবে।’

ঠিক তখনই একটি রাশভারী কণ্ঠ শোনা গেল, ‘আপনি ঘোষ মহাশয় তো? আশা করি সব কুশল।’

দুর্গাপ্রসাদ একটু চমকে দেখলেন রাজ্যের নবাগত পণ্ডিত শ্রীনিবাস আচার্য এসে উপস্থিত হয়েছেন। অদূরে দণ্ডায়মান তাঁর শিবিকা।

পণ্ডিতকে দেখামাত্র কেশব ছড়াকারের মুখ পলকের জন্য সামান্য বিকৃত হয়েই স্বাভাবিক হয়ে গেল।

দুর্গাপ্রসাদ শশব্যস্ত হয়ে নমস্কার করলেন, ‘আরে পণ্ডিতমশাই! আপনি? আসুন আসুন!’

শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘বহুদিন ধরেই ভাবি আসব আসব। এত বড় মন্দির নির্মিত হচ্ছে, দেখার প্রবল বাসনা ছিল। বীরের অনুরোধেও সময় হয়ে উঠছিল না।’

তিনি চোখ বুজে করজোড়ে মন্ত্রোচ্চারণ করলেন,

‘প্রভুমীশ মনীশম শেষগুণং

গুণহীন মহীশ গলা ভরণম।

রণ-নির্জিত-দুর্জয়-দৈত্যপুরং

প্রণমামি শিবং শিবকল্পতরুম।।’

ভক্তিভরে প্রণাম করে শ্রীনিবাস আচার্য প্রধান কারিগর কার্তিকের উদ্দেশে বললেন, ‘শোন, মন্দির চত্বরের দক্ষিণদিকে ছাদসমেত একটি বাঁধানো পুষ্করিণী কাটতে হবে। তার মধ্যে এক শুভলগ্নে প্রতিষ্ঠিত হবেন জলেশ্বর শিবলিঙ্গ। তোমাকে সব বলা হয়েছে তো?’

কার্তিক ওঁকে চেনে না, কিন্তু যিনি স্বয়ং মল্লরাজাকে নাম ধরে ডাকতে পারেন, তাঁর ক্ষমতা সম্বন্ধে বলার অপেক্ষা রাখে না।

সে সসম্ভ্রমে মাথা নাড়ল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ ঠাকুরমশাই।’

শ্রীনিবাস আচার্য হৃষ্টচিত্তে বললেন, ‘উত্তম। তোমার বাস কোথায়? এখানে?’

‘আজ্ঞে না।’ কার্তিক বলল, ‘আমার বাস পলাশডাঙা।’

‘সেটা কোথায় গো কেশব?’ শ্রীনিবাস আচার্য কেশবকে জিজ্ঞাসা করলেন।

রাজগ্রামে সেই প্রথম পরিচয়ের পর কেটে গিয়েছে বেশ কিছুদিন। এরমধ্যে দুজনের আর সাক্ষাৎ হয়নি। অথচ কেশব লক্ষ্য করল, পণ্ডিত এমনভাবে তার সঙ্গে কথা বললেন, যেন অনেকদিনের চেনা। ‘আপনি’ নেমে এসেছে ‘তুমিতে। অবশ্য মল্লরাজ নিজেই যখন ‘তুমি’, সে কোথাকার কে! কিছু বুঝতে না দিয়ে সে সুর করে বলল,

‘নাক লম্বা, গলা ঢেঙা

দেখে চিনবি পলাশডাঙা।’

ছড়ার মাধ্যমে ‘তুমি’-র চাপানে ‘তুই’-এর উতোর দিয়ে কেশব বেশ তৃপ্তি পেল। কিন্তু শ্রীনিবাস ভ্রূক্ষেপ করলেন না। হেসে উঠলেন। বললেন, ‘বাবা, আমার ভদ্রাসন খড়বাংলা। সময় করে একবার এসো!’

‘নিশ্চয়ই যাব ঠাকুরমশাই!’ কার্তিক-ফৌজদার যুক্তকরে বলল।

শ্রীনিবাসর আচার্যের গমনপথের দিকে কেশব বক্রদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। চাপা স্বরে বলল, ‘বাঃ! মহারাজা হলেন ‘তুমি’। শিবলিঙ্গ কোথায় প্রতিষ্ঠিত হবে, তাও বলে দেবে এই বোস্টমটা। কী বুঝচেন? এ যে কড়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ!’

দুর্গাপ্রসাদ চুপ করে রইলেন। এই পণ্ডিত যে সোজা লোক নন, সেই সংবাদ তাঁর জানা। কিন্তু তাই বলে বৈষ্ণব হয়ে রাজ্যের নবতম শিবমন্দিরের বিষয়ে উপদেশ দেওয়া তাঁরও কাছে ভালো লাগছিল না।

১৭

সুলতান কররাণী বললেন, ‘ফারমুলী! তুমি এখনও ভেবে দ্যাখো। তোমার ওপর আমার ভরোসা আছে।’

আজই সুবিশাল সৈন্যদল নিয়ে সেনাপতি মহম্মদ ফারমুলী যুদ্ধযাত্রা করবেন। এতদিন বঙ্গভূমির দিকে দিকে উঠত ত্রাস—’কালাপাহাড় আসছে’, এবার তা ছড়িয়ে যাবে বাইরেও।

সেনাপতিকে বিদায় জানানোর উদ্দেশ্যে সুলতান আজ রাজধানীর উপকণ্ঠে বিশাল মহলে আয়োজন করেছেন উৎসবের। এলাহী ভোজন, সঙ্গে দুই হাতির লড়াই। খাদ্যতালিকায় রাখা হয়েছে ঘোড়ার মাংস থেকে শুরু করে পিলাও, সমরকন্দের পেস্তা, আখরোট, খুবানি থেকে শুরু করে ভালো শিরাজি।

কালাপাহাড় মখমলের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে অর্ধশায়িত বসেছিলেন। সামনে প্রকাণ্ড জানলা। সামনের খোলা মাঠ ও রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ দৃশ্যমান। প্রস্তুতি চলছে হস্তী দ্বৈরথের।

শ্বশুরের কথার উত্তর সরাসরি না দিয়ে তিনি বললেন, ‘পিলাওয়ের সুবাস পাচ্ছেন জাহাপনা?’

সুলতান আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘পাচ্ছি। কেন?’

‘পশতুন পিলাও কীভাবে তৈরি হয়? খুসবুদার চাল, মশলা, ঘি সব একসাথে দেওয়া হয়। মাঝখানে বসিয়ে দেওয়া হয় একটা আস্ত জ্যান্ত হাবগি মুরগি। মুরগিটার পা’গুলো বেঁধে রাখা হয় নীচে। তাপ বাড়তে থাকে। পানি ফুটতে থাকে। মুরগিটা ছটফট করতে থাকে, পালাতে চায়। পারে না। ফুটন্ত পানি উপরে উঠতে থাকে। সেই গরম পানিতে সেদ্ধ হয়ে সে জ্যান্ত মরে। তাই না?’

‘তাজ্জুব বাত ফারমুলী! আমি নিজে পশতুন, তুমি জন্মেছিলে ব্রাহ্মণ পরিবারে!’ সুলতান বলেন, ‘সেই তুমি আমায় পশতুন পিলাও শেখাচ্ছ!’

‘গোস্তাকি মাফ করবেন জি! আমার খোয়াইশ হল এই দুনিয়ায় যত আদমি মন্দির মন্দির করে লাফায়, সবাইকে এইভাবে পশতুনি পিলাওয়ের হান্ডায় ফেলে দিই। গরম পানিতে খতম হোক সব। কামরূপের রাজা নরনারায়ণই বলুন কিংবা উৎকলের রাজা মুকুন্দদেব, এদের রাজ্যে অলিতে গলিতে মন্দির। রাজধানীর মধ্যিখানে তাঁদের যদি এইভাবে সেদ্ধ করি! কেমন হবে হুজৌর?’

সুলতান হাসতে গিয়েও পারেন না। কালাপাহাড়ের এই হিংস্রতা দেখে তাঁর অস্বস্তি হয়।

একটু চুপ করে থেকে বলেন, ‘তুমি বাংলার সেনাপতি। তোমার কাজ দুশমনকে যুদ্ধে হারানো, ব্যস। এইসব তকলিফ দেওয়ার জরুরত নেই!’

‘বেশক জরুরত আছে হুজৌর!’ কালাপাহাড় বলে উঠলেন, ‘ওরা সব ভণ্ড! ওদের তিলে তিলে মারা উচিত! জানেন, আমাকে কত নফরত করে ওরা? জানেন টিকিধারী বামুনের দল কী করেছে? আমি হলুদ রঙের পিলাও খেতে ভালোবাসি বলে অশৌচে হলুদ দিয়ে রাঁধা বারণ করেছে। আমি মুসুরির ডাল খেতে পছন্দ করি বলে ঘোষণা করেছে ওটা আমিষ। ওদের পুজো-আচ্চার দিনে, বিধবার খানায় মুসুরির ডাল এখন নিষিদ্ধ বস্তু!’

এমন সময় সামনে খুব জোরে শিঙা বেজে উঠল।

সামনে হাতির লড়াই শুরু হয়েছে। যদিও আজকের এই মেহফিলে আছেন শুধু সুলতান ও সেনাপতি, তবু তামাশা দেখতে বাইরের উন্মুক্ত চত্বরের চারপাশে ভিড় জমিয়েছে সাধারণ জনতা।

তিন হাত চওড়া ও ছয় হাত লম্বা একটা মাটির দেওয়াল তৈরি করা হয়েছে। দুটো প্রকাণ্ড হাতি দেওয়ালের দুদিক থেকে মন্থরগতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেক হাতির পিঠে রয়েছে দুজন করে মাহুত। সামনের মাহুত হাতির কাঁধের ওপর বসে লোহার ডাঙ্গস দিয়ে হাতি চালাচ্ছে। কখনও সে আদরে ডাকছে হাতিকে, কখনও আবার দিচ্ছে নানারকম সাঙ্কেতিক ভাষায় গালাগালি। ‘ব্যাটা কাপুরুষ’ বলে প্ররোচিত করছে সম্মুখসমরে।

দেখতে দেখতে সুলতান বললেন, ‘তোমার দোস্তকে মল্লভূম পাঠিয়েছ শুনলাম।’

আগেরদিনই তো বললাম, হুজৌর! ফেরার সময় আমার নিশানা হল মল্লভূম।’

‘বলেছ। কিন্তু এটা তো বলোনি যে মল্লভূমের মতো একটা ছোট রাজ্যে তোমায় এত আগে থেকে জাসুসি করতে হচ্ছে কেন।’

‘ধরে নিন, মল্লরাজার সব দুশমনকে আগে থেকে একসঙ্গে করার জন্যই পাঠিয়েছি।’

‘নেহি! অন্য কেউ বিশ্বাস করলেও, আমি করছি না। তোমার যা সিপাহী, তোমার যা বুদ্ধি আর তাকত, তাতে তোমার একটা নিঃশ্বাসে ওই রাজ্য উড়ে যাবে।’

কালাপাহাড় চুপ করে রইলেন।

ওদিকে হাতির লড়াই চলছে পুরোদমে। দেওয়ালটা দুই তরফের প্রচণ্ড আক্রমণে মাটিতে মিশে গেছে। দুজন দুজনকে প্রকাণ্ড গজদন্ত দিয়ে আঘাত করছে, শুঁড়ে পেঁচিয়ে এ ও’কে পিষে দেওয়ার চেষ্টা করছে। উত্তেজিত জনতা চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে। একটা হাতির সামনের মাহুত হঠাৎ টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। মাটিতে পড়ার আগের মুহূর্তেও সে পাদানিটাকে ধরে খড়কুটোর মতো বাঁচার চেষ্টা করল, কিন্তু তাও ফসকে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে পিষে গেল অন্য হাতির পায়ের তলায়।

খেলা থামল না! এরকম প্রায়ই হয়, সেইজন্য আরেকজন করে মাহুত বসে থাকে হাতির পিঠে। দ্বিতীয় মাহুতটি এগিয়ে এল, তারপর ডাঙ্গুস দিয়ে হাতি চালাতে লাগল। মাহুতের রক্ত, মাংসের ওপরেই চলতে লাগল দুই পশুর হিংস্র লড়াই।

সুলতান আবার বললেন, ‘বলো ফারমুলী! চুপ করে থেকো না। আমার এটা জানার হক আছে।’

‘আমার দোস্তকে মল্লভূমে পাঠানোর সঙ্গে রাজ্যের কোনও লেনাদেনা নেই, হুজৌর! সেই কারণ একেবারেই ব্যক্তিগত।’ কালাপাহাড় শান্তকণ্ঠে উত্তর দিলেন। তাঁর চোখেমুখে সহসা বিষণ্ণতার ছায়া। প্রতিহিংসার সেই উল্লাস এখন অদৃশ্য।

‘তবে?’ সুলতান বিস্মিত, ‘ব্যক্তিগত হলেও আমার জানার অধিকার আছে, ফারমুলী! আমি শুধু তোমার সুলতান নই, আমি তোমার আব্বুজানও।’

জনতার মধ্যে উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে। উৎসাহের আতিশয্যে কেউ কেউ চেষ্টা করছে দড়ির প্রাচীর ছিঁড়ে এগিয়ে আসার। কর্মীরা আটকাচ্ছে তাদের। বলশালী হাতিটি অন্য হাতিটাকে তাড়া করে নিয়ে গিয়ে মাটির সঙ্গে শুঁড় দিয়ে চেপে ধরেছে। বাজছে শিঙা, সবাই চিৎকার করছে।

খেলা প্রায় শেষের দিকে। দুর্বল হাতিটির শ্বাসরোধ হয়ে আসছে, কিন্তু কিছুতেই তার ওপর থেকে শক্তিশালী হাতিটিকে সরানো যাচ্ছে না। উন্নত মানুষজাতি তার মধ্যে এত ভয়ঙ্কর ঘৃণা, ক্রোধ প্রতিহিংসা সঞ্চারিত করে দিয়েছে যে, সে প্রবল আক্রোশে স্বজাতিহত্যায় ব্যস্ত। তাকে নিবৃত্ত করতে ফাটানো হছে বাজি!

এমন সময় কালাপাহাড় মুখ খুললেন।

‘আমি ওকে একজনের সন্ধানে পাঠিয়েছি হুজৌর!’

‘কে সে?’

‘রাধামোহন লাহিড়ী। আমার পূর্বতন দুই স্ত্রী রুপালী আর রূপানীর বাবা। আমি যখন পুরী মন্দিরে পাণ্ডাদের কাছে লাঞ্ছিত হচ্ছিলাম, সেইসময়েই ভাদুড়িয়ায় কিছু স্থানীয় সমাজপতি মিলে আমার দুই স্ত্রীকে গৃহত্যাগ করতে বাধ্য করে। ওদের পিতা রাধামোহন লাহিড়ী এসে নিয়ে যান।’

সুলতান বলেন, ‘সেকী! তারপর?’

কালাপাহাড় গম্ভীর মুখে বলে চলেন, ‘কিন্তু তাঁকেও কন্যাদের নিয়ে স্বগৃহে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তখন রাতের অন্ধকারে তিনি ওদের নিয়ে পালিয়ে যান।’

‘আজিব সি বাত! তিনি তন্দায় এলেন না কেন? তোমার কাছে তো স্বচ্ছন্দে থাকতে পারতেন! তাঁর দুই বেটি তো তোমার ঘরওয়ালি!’

কালাপাহাড় ম্লান হাসেন, ‘প্রাণ থাকতেও মুসলমান জামাতার কাছে তিনি আসবেন না হুজৌর! তার মেয়েরাও ধর্মান্তরিত স্বামীর ঘরকে ঘর মনে করে না। সম্প্রতি জানতে পেরেছি, তিনি নাকি মল্লরাজ্যে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে ওদের কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি।’

সুলতান চুপ করে থাকেন।

কালাপাহাড় অস্ফুটে বললেন, ‘জানেন, আমি এর মধ্যে অনেককে দিয়ে তালাশ করিয়েছি! ফায়দা হয়নি। তাই আমার দোস্ত ওখানে কিছুদিন থেকে যদি ওদের খুঁজে পায়…!’

‘কী করবে? খুঁজে পেলে?’ সুলতান বলেন, ‘তোমার কাছে তারা তো আসবে না!’

‘না আসুক। মল্লভূম ছারখার করে দেওয়ার আগে ওদের সরিয়ে দেব। ব্যস, হুজৌর!’ কালাপাহাড় শক্ত মুখে সামনে তাকালেন।

খেলায় যবনিকা পতন ঘটেছে। ক্ষমতাধর হাতিটিকে সরিয়ে আনা হলেও শেষরক্ষা হয়নি। অন্য হাতিটি রক্তাক্ত নিথর অবস্থায় পড়ে রয়েছে। চারপাশে জনতার উল্লাস। পড়ে রয়েছে নিহত মাহুতটির দলাপাকানো দেহও।

হাতির লড়াইয়ে আসা সব মাহুতই বাড়ি থেকে শেষ বিদায় নিয়ে আসে। তারা সব জেনেও আসে। কারণ যারা বেঁচে যায়, তাঁদের তৎক্ষণাৎ পুরস্কার দেওয়া হয় স্বর্ণমুদ্রার থলি। অবশ্য মরলেও লোকসান নেই। আজীবন বিধবা স্ত্রী পাবে ভাতা, পুত্র থাকলে সে বহাল হবে চাকরিতে।

তিন মৃত্যুঞ্জয়ী মাহুত ও জয়ী হস্তীকে ঘিরে চলছে জনতার উল্লাস। একইসঙ্গে পালিত হচ্ছে জীবন ও মৃত্যু!

১৮

বীরহাম্বীর উঠে দাঁড়ালেন। মহাসেনাপতি কুম্ভকে বললেন, ‘আপনি এবং প্রধানমন্ত্রী নিভৃতকক্ষে আসুন। বিশেষ বিষয়ে আলোচনা আছে।’

রাজদরবার থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার আগে আবার পিছনে ফিরলেন মহারাজা, শ্রীনিবাস আচার্যের উদ্দেশে বললেন, ‘আচার্যমশাই, আপনিও আসবেন অনুগ্রহ করে।’

নিভৃতকক্ষটি রাজদরবারের সংলগ্ন একটি ঘর, যার চারপাশে অতন্দ্র প্রহরা। মহারাজ তাঁর অমাত্যবর্গের সঙ্গে গুপ্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য এই কক্ষ ব্যবহার করেন।

জীমূতবাহন ও কুম্ভ পরস্পরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করলেন।

শ্রীনিবাস আচার্য মল্লভূমে এসেছেন কয়েক মাস। তিনি যেন এরমধ্যেই একরকম মহারাজকে সম্মোহিত করে ফেলেছেন। যে-কোনও বিষয়ে রাজা নির্দ্বিধায় তাঁর সঙ্গে আলোচনা করছেন, তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করছেন। এমনকী প্রতিরক্ষাবিষয়ক গুপ্ত আলোচনাতেও!

প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহনের মুখ কুঞ্চিত হয়ে উঠল।

গোপন কক্ষে প্রবেশ করে বীরহাম্বীর বললেন, ‘আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে, খুব শীঘ্র রাজ্যে মোঘল আক্রমণ হবে।’

মহাসেনাপতি কুম্ভ বললেন, ‘মুনিম খাঁয়ের সেই শোচনীয় পরাজয়ের পরেও?’

বীরহাম্বীর বললেন, ‘ভুলে যাবেন না, আহত পশুরাজ বেশি ভয়ংকর। মল্লরাজ্যের মতো এত ক্ষুদ্রদেশের কাছে পরাজয় বাদশাহ বেশিদিন সহ্য করতে পারবেন না। সীমান্তে প্রহরীর সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দিন। সবচেয়ে আগে সুরক্ষিত করতে হবে রাজদরবার ও রাজদুর্গকে। মোগলরা আগে এই দুটোকেই দখল করার চেষ্টা করবে। রাজপ্রাঙ্গণকে কেন্দ্র করে পরিখা খনন করে জলদুর্গ নির্মাণ করান, যত শীঘ্র সম্ভব। পরিখার পাড়ে পাড়ে বিষাক্ত কাঁটা লাগাবেন, আর কামান রাখবেন, সঙ্গে সৈন্য। শত্রু এলে যাতে প্রথমে বিভ্রান্ত হয়ে পরিখার গভীরতায়, পরে কামানের গোলার সামনে পড়ে!’

বীরহাম্বীর এক মুহূর্ত থামলেন। তারপর শ্রীনিবাস আচার্যের দিকে তাকিয়ে সসম্ভ্রমে বললেন, ‘আচার্যমহাশয় এই জলদুর্গ নির্মাণের বুদ্ধি দিয়েছেন। কাঁটা ও কামান রাখার চিন্তাও তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত।’

জীমূতবাহন মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, উষ্মা গোপন করে বললেন, ‘আদেশ শিরোধার্য মহারাজ।’

বীরহাম্বীর বললেন, ‘রাজ্যের বাকি গড়গুলোতেও একই ব্যবস্থা নেবেন। আর সামন্তদেরও বার্তা পাঠান। করাসুর গড়, শ্যামসুন্দরগড়, হোমগড় এইসব অঞ্চলের সামন্তরা যেন সতর্ক থাকেন। প্রতিটি দুর্গের ছাদে কামান রেখে সৈন্যদের প্রহরা দিতে বলবেন।’

‘অন্যান্য কুমারদেরও কি জানাব? তাঁরাও তবে নিজেদের সৈন্যদল নিয়ে প্রস্তুত থাকতে পারবেন।’

বীরহাম্বীর নীরব, কিছু ভাবছেন। হিকিম জগত কুমার বছরের অধিকাংশ সময় থাকেন রাজপ্রাঙ্গণেই। বাকি রয়েছেন পাঁচজন কুমার। রসিক, যাদু, বাহাদুর, দিবাকর ও কন্দর্প। তাঁরা জ্ঞাতিভ্রাতা। প্রত্যেকেই ছোট ছোট মৌজার ভূস্বামী, সেখানেই থাকেন।

মল্লরাজবংশেও সিংহাসনের লোভে বিশ্বাসঘাতকতা হতেই পারে। কার মনে কী খেলা করছে, তা না জেনে নিজেদের গুপ্ত পরিকল্পনা প্রকাশ করা কি ঠিক হবে? হয়তো জগতকে বিশ্বাস করা যেতে পারে, কারণ সে এখানেই থাকে। তাছাড়া সে রাজমাতার পুত্র।

কিন্তু চমক ভেঙে বীরহাম্বীর বললেন, ‘না। এখনই কিছু জানাতে হবে না। আমি নিজে আজ জগতের সঙ্গে কথা বলব। জগতের নাটকাঞ্চনমৌজার লেঠেলরা সবচেয়ে দক্ষ। বলতে গেলে ওরাই আমার শক্তি।’

জীমূতবাহন বললেন, ‘মহারাজের পরিকল্পনাশক্তি সত্যিই প্রশংসনীয়।’

বীরহাম্বীর শ্রীনিবাস আচার্যের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘আপনি কী বলেন আচার্যমশাই?’

শ্রীনিবাস আচার্য অনেকক্ষণ কথা বলেননি। বললেন, ‘প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্ত করা তো উত্তম প্রস্তাব। তবে আক্রমণ যে শুধুমাত্র মোঘলদের দিক থেকেই হতে পারে, এমন ধারণা ভ্রান্তও হতে পারে।’

বীরহাম্বীর চক্ষু সরু করে বললেন, ‘মোঘল ছাড়াও আপনি আক্রমণের আশঙ্কা করছেন?’

শ্রীনিবাস আচার্য কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘সুলতান সুলেমান কররাণীর সেনাপতি কালাপাহাড়ের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই?’

‘কালাপাহাড়?’ বীরহাম্বীর বললেন, ‘সুলেমানের হিন্দু জামাতা যে মুসলমান হয়েছে?’

প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘ওঁর নাম তো মহম্মদ ফারমুলী! না?’

শ্রীনিবাস আচার্য অপাঙ্গে একবার প্রধানমন্ত্রীকে দেখে বললেন, ‘হ্যাঁ। তবে তাকে সবাই কালাপাহাড় নামেই চেনে। হিন্দু দেবদেবী ধ্বংস করে সে পৈশাচিক আনন্দ পায়। আমাদের মঠেও তার সেনারা হামলা চালিয়েছে। আমার কাছে সংবাদ আছে, বাংলার অসংখ্য মন্দির ধুলোয় মেশানোর পর এখন সে উড়িষ্যা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। লক্ষ্য—নীলাচলধাম। মল্লভূম দিয়ে উৎকল যাওয়া সুবিধাজনক। তাকে আমি চিনতাম বহুকাল আগে। সে যেমন মেধাবী, তেমনই জেদী। গুণী মানুষের ওপর শয়তান ভর করলে সে বড় ভয়ংকর।’

শ্রীনিবাস আচার্য বড় নিঃশ্বাস ফেললেন, ‘মল্লভূম মন্দিরনগরী। দানবের হাত মন্দির দেখতে পেলেই নিশপিশ করে ওঠে ধ্বংসের জন্য। এখান দিয়ে যাওয়ার সময় সেকি মল্লভূমকে ছেড়ে দেবে?’

বীরহাম্বীর উদ্বিগ্নচোখে শুনছিলেন। বলে উঠলেন, ‘আপনি কি মনে করেন, উৎকলযাত্রার সময় সে মল্লভূম আক্রমণ করবে?’

শ্রীনিবাস আচার্য মাথা নাড়লেন, ‘তার অভিসন্ধি এখনও স্পষ্ট নয়। আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে, মল্লভূম রাজ্যে অদূর ভবিষ্যতে অতি বড় যুদ্ধের আভাস ঘনাচ্ছে।’

বীরহাম্বীরের মনে পড়ে গেল, কিছুদিন আগে রাজসভায় গণেশ কর্মকারের কথাগুলো। মোঘল কারিগরদের কথা,—’মোঘল পাঠান ভাই ভাই, হিঁদুদের ঠাঁই নাই!’

তবে কি মোঘল ও পাঠানরা সম্মিলিত আক্রমণ করবে মল্লভূমে? দুই মহাসাগরীয় প্রলয় এসে আছড়ে পড়বে তাঁর এই ছোট্ট রাজ্যে?

আকাশপাতাল ভেবে চলেছিলেন রাজা, শ্রীনিবাস আচার্যের কথায় তাঁর চিন্তার জাল ছিন্ন হল।

‘বীরহাম্বীর! সুলতানের রাজধানী তন্দা থেকে এক বিদেশি আসছিল এই রাজ্যে। তার সঙ্গে কি তোমার সাক্ষাৎ হয়েছে?’

‘না তো!’

‘অদ্ভুত!’ শ্রীনিবাস আচার্য চিন্তান্বিত স্বরে বললেন, ‘এতদিন হয়ে গেল, সে এখনও সাক্ষাৎ করেনি? যাইহোক, সম্ভবত খুব শীঘ্রই সে তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। অত্যন্ত সতর্ক হয়ে তার সঙ্গে কথা বোলো। তার উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। আর মোঘল হোক বা কালাপাহাড়, দুদিককেই সামলানোর জন্য তোমার ওই পরিখা ও দুর্গের পরিকল্পনা উত্তম। এখনই কাজ শুরু করে দাও। জয়স্তু!’

১৯

‘ও খুড়িমা, খুড়িমা! শুনেছ, রাজু সুলতানের মেয়েকে বিয়ে করেচে?’

রাজীবলোচনের মা গঙ্গা থেকে স্নান করে ফিরছিলেন। পুত্রের বাল্যবন্ধুর ডাকে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘শুনেছি বাছা। রাজু বড় হয়েছে। শিক্ষাদীক্ষাও রয়েচে যথেষ্ট। সুলতানের মেয়েকে নিশ্চয়ই তার ঘরণী হিসেবে উপযুক্ত মনে হয়েচে, তাই বে’ করেচে। এতে আমার কী বলবার আচে? আগের দুই বউকে হাসিমুখে বরণ করেছি, এই বউকে নিয়ে গাঁয়ে এলেও নিশ্চয়ই বরণ করব।’

রুদ্রাক্ষ চমৎকৃত হল। বলল, ‘সেকি গো! পুত্র যবন কন্যা বিবাহ করল, চণ্ডীমণ্ডপে সমাজপতিরা মিলে তোমাদের একঘরে করল, তার প্রিয় বন্ধু বলে আমাকেও নিষ্কৃতি দিল না, আর তোমার এতে কোনও আপত্তি নেই?’

রাজীবলোচনের মা বন্দনা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর ধীরে ধীরে দুদিকে মাথা নাড়লেন, ‘না।’

‘কিন্তু খুড়িমা…!’

বন্দনার ঠোঁট কেঁপে উঠল। ইতস্তত করে তিনি বললেন, ‘দ্যাখ বাছা, তোকে তো রাজুর চেয়ে আলাদা করে কখনও দেখিনি। তাই সাহস করে মনের কতাখানা কইছি। শাস্ত্র আমিও কিছু পড়েছি। এটুকু জানি যে, সুলতান হলেন আমাদের রাজা। শাস্ত্রে রাজাকে দেবতা বলে। তা, দেবতার আবার জাত কী? স্বয়ং ভগবান নরক অসুরের কন্যাকে বিবাহ করেননি? মহাভারতে রাজা শান্তনু জেলের কন্যা সত্যবতীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেননি? জাম্ববতী ভল্লুকের কন্যা ছিলেন না? তাঁদের বেলায় দোষ না হলে আমার রাজুর বেলায় হবে কেন?’

‘কিন্তু খুড়িমা, চণ্ডীমণ্ডপের নিদান তো তবে শাস্ত্রমতে হয়নি! তারা যে এর উল্টোদিকে হাঁটে।’

প্রৌঢ়া হাসলেন। বললেন, ‘লোকে যে আসল শাস্ত্র শুনতে চায় না, ধর্ম জানতে চায়না। তারা হুজুগে মাতে। আমি বুঝি আমাদের নিমাইপণ্ডিতকে। যে যবন, শূদ্র, কোন ভেদাভেদ মানেনি। যবন হরিদাসকেও যেমন ভালোবেসেচে, শূদ্র রাম রায়কেও তেমনই আদরে ভরিয়ে দিয়েচে। সে তো আর মানুষ ছিল না, ছিল সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ। সে কি ভুল করতে পারে?’

রুদ্রাক্ষ বলল, ‘কিন্তু খুড়িমা, রাজুর পিতামহ, মানে আপনার শ্বশুর মহাশয় তো কূপিত হয়ে কাশীবাসী হচ্ছেন। রাজুর দুই স্ত্রীকেও এত লাঞ্ছনা করা হচ্ছে, তারাও বোধহয় আর থাকবে না। আপনি একঘরে হয়ে কীভাবে থাকবেন?’

‘আমি একা বিধবা মানুষ, একঘরে এমনিও আচি, অমনিও থাকব।’ বন্দনা ম্লানমুখে হাসলেন, ‘তুই তন্দায় ফিরে যা বাছা। রাজুকে বলিস, আমার চিন্তা যেন না করে! একবেলা যাহোক ফুটিয়ে নেব, আমার ঠিক কেটে যাবে। তার সুখেই আমার সুখ।’

সে কবেকার কথা! অথচ আজও স্মৃতিপটে এত উজ্জ্বল, এত জীবন্ত, যেন মনে হয় গতকালের ঘটনা। রুদ্রাক্ষ শিহরিত হয়ে উঠল।

দুর্ভাগ্য! সেই কথোপকথনের কয়েকমাস পর রাজু যখন ফিরে এসেছিল গ্রামে, ততদিনে তার মা জগতের যাবতীয় মায়া ছিন্ন করে চলে গিয়েছেন।

এত বছর, এত দেশ ঘুরেও কি খুড়িমার মতো মুক্তমনা মানুষের সন্ধান রুদ্রাক্ষ পেয়েছে?

না! খুড়িমা জীবিত থাকলে রাজু পারত না এত হিংস্র হয়ে উঠতে। মাতৃস্নেহ তাকে বিপথে যেতে দিত না। খুড়িমা বেঁচে থাকলে রুদ্রাক্ষকেও বোধহয় এই পাপকর্মের ভাগীদার হতে হত না।

পবন বলল, ‘ও রুদ্রাক্ষ দাদা, তন্ময় হয়ে কী ভাবচ গো?’

রুদ্রাক্ষ বাস্তবে ফিরে এল। মাথা নেড়ে বলল, ‘না, কিছু না। এ আবার কী খেলা? গোলগোল কী এগুলো?’

রঘুনাথ উবু হয়ে বসে সোৎসাহে তাসগুলো পরপর সাজাচ্ছিল। রুদ্রাক্ষের প্রশ্নে সে বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ওমা! তুমি ওরক খেলা জানো না?’

‘ওরক! মানে তাস? জানব না কেন?’ রুদ্রাক্ষ বলল, ‘তন্দায় তো সবাই খেলে। কিন্তু সে তো চৌকো! আমরা বলি গাঞ্জাফা।’

‘বাহ, উনি জানবেন কী করে? এটা তো মল্লভূমের নিজস্ব খেলা।’ পবন রুদ্রাক্ষের দিকে তাকাল, ‘এগুলো হল দশাবতার, রুদ্রাক্ষ দাদা। বছর কয়েক আগে রাজামশাই সেই যে দিল্লি গেলেন, মোঘল দরবারে গাঞ্জাফা খেলা দেখে এসে আমাদের শিল্পী কার্তিক ফৌজদারকে বললেন, ওইরকম খেলা আমাদের বানিয়ে দিতে। কিন্তু মল্ল রাজ্য মানেই তো ঠাকুর দেবতা, তাই কার্তিক ফৌজদার ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের অনুকরণে এইগুলো বানাল। সবচেয়ে ভালো দশাবতার খেলেন কামদারঞ্জন লাহিড়ী। লাহিড়ী পাড়ায় গিয়ে তাঁর খেলা দেখলে তোমার তাক লেগে যাবে।’

হেড়ে পাহাড়ের মাথায় ওরা তিনজন বসেছিল। পঞ্চকল্যাণ এখন তিনজনকে বহন করতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। রামেন্দ্রসুন্দর তর্কালংকারের চতুষ্পাঠীর বাইরে রুদ্রাক্ষ অপেক্ষা করছিল, রঘুনাথের পড়া এবং পবনের পরিমার্জন শেষ হতেই তিনজনে আবার চলে এসেছে এখানে।

কিছুদূরে নদীপোত। নদীর শীতল বাতাস, মেঘহীন নীল আকাশ, তারই মধ্যে রঘুনাথ তার ঝোলা থেকে বের করেছে বড় বড় রঙিন গোলাকার এই তাস বা ওরকগুলো।

রুদ্রাক্ষ বলল, ‘কিন্তু আমাদের গাঞ্জাফা তো হয় বাহান্নটা। এগুলো তো সংখ্যায় তার চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে হচ্ছে।’

‘ঠিকই বলেছ।’ পবন বলল, ‘আমাদের দশাবতার হল একশো কুড়িটা। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, বলরাম, পরশুরাম, রাম, জগন্নাথ এবং কল্কি, এই দশটা অবতারের প্রতিটির জন্য থাকে বারোটা করে। আবার এই বারোটার মধ্যে প্রথমটা হল রাজা, দ্বিতীয়টা মন্ত্রী।’

রুদ্রাক্ষ আগ্রহের সঙ্গে বুঝতে চেষ্টা করছিল, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও। একই অবতারের বারোটা তাসের মধ্যে কোনটা রাজা, কোনটা মন্ত্রী, বুঝব কী করে?’

পবন সামনে মৎস্য অবতারের বারোখানা ওরক পরপর বিছিয়ে দিল, তারপর বলল, ‘এই দ্যাখো। প্রথমটায় মৎস্য রয়েছেন দেউলের মধ্যে। দেউলের মধ্যে উপবিষ্ট ওরকটা হল রাজা। দুপাশে দুই সহচরও থাকে এই ওরকে। কিন্তু মন্ত্রীর ওরকে দ্যাখো, শুধু মৎস্যের ছবি রয়েছে। আর বাকি দশখানায় দ্যাখো অবতারের কোন ছবি নয়, এক থেকে দশ পর্যন্ত প্রতীক রয়েছে শুধুমাত্র। মৎস্য অবতারের প্রতীক মৎস্য, কূর্মের কচ্ছপ, বরাহের শঙ্খ, নৃসিংহের চক্র, বামনের কমণ্ডলু, বলরামের গদা, পরশুরামের টাঙি, রামের তির আর কল্কির খড়গ।’

‘শিল্পী কল্কি অবতারের ছবিতে তো মুঘল বাদশাহকে এঁকেছেন মনে হচ্ছে!’ বিড়বিড় করল রুদ্রাক্ষ, ‘অথচ অবতারদের পোশাক আশাক উড়িষ্যার হিন্দুদের মতো!’

পবন শুনতে পেল না। সে একমনে খেলার নিয়মকানুন শিখিয়ে যেতে লাগল। দশাবতার তার প্রিয় খেলা। এই খেলায় সঙ্গী প্রয়োজন হয় পাঁচজন। কিন্তু তারা আছে তিনজন। সে, রঘুনাথ আর রঘুনাথের দাদা মধ্যম রাজকুমার শীতল। শীতলকুমার যদিও নিয়মিত ওদের চতুষ্পাঠীর পেছনের সেই গোপন আস্তানায় আসেন না, কিন্তু এলে খেলতে বসে যান। কিন্তু বাকি সঙ্গী পাওয়া যায় না। কখনও-সখনও বাগদীদের ছেলেদের মাঠ থেকে ধরে এনে রাজি করানো গেলেও তারা সেভাবে খেলাটা না জানায় মজা হয় না।

রুদ্রাক্ষদাদা শিখতে পারলে দলে আরও একজন অন্তত বাড়বে।

পবন একেকটা করে ওরক তুলে দেখাচ্ছিল, ‘প্রথমে পাঁচজনেই চব্বিশটা করে ওরক পাবে। তারপর পরশুরামের সাত, কল্কির আট, পদ্মের নয় আর দশ রাজার আসনের জন্য দিতে হবে। যে প্রথম অবতার কূর্ম পাবে, সে খেলা আরম্ভ করবে। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ ও বামন, প্রথম পাঁচ অবতারের জন্য রাজা মন্ত্রীর পরে সর্বোচ্চ স্থান হল দশের, তারপর হল তিরি দুরি টেক্কা। অন্যদের জন্য আবার সবচেয়ে ওপরে টেক্কা। তারপর আছে টিপসই, সটিপ, জোড়টিপ, বোজ…।’

শুনতে শুনতে রুদ্রাক্ষের সব গুলিয়ে যাচ্ছিল! সে বাধা দিয়ে বলল, ‘বাপরে! এতো ভয়ঙ্কর জটিল খেলা!’

‘মোটেই নয়।’ রঘুনাথ মাছি বিতাড়ণের ভঙ্গিতে বলল, ‘পবন, তুই তোর সেই আর্যাটা রুদ্রাক্ষদাদাকে মুখস্থ করিয়ে দে না!’

‘ঠিক বলেছিস।’ পবন বলল, ‘আমি একটা আর্যা বেঁধেছি। এটা মুখস্থ করে নাও।’

ছবিগুলি চিনে নিয়ে ভালো করে মিশাইয়ে

গণ্ডা গণ্ডা করে দাও বিলাইয়ে।।

সাত ভৃগু আট কলি নয় দশ পদ্ম ফেলি

প্রভুর আসনখানি দাও সাজাইয়ে।।

প্রথম অবতার যার, দু’দস্ত হবে তার

আরও হবে জোড় ভেঙে, ঠেক খেয়ে সেরোয়া।।

জোড় টিপ, টিপসই, কিংবা টিপ হলে

দু’দস্ত হয় অন্যে পাওয়া।।

তারও হবে জোড় ভেঙে, ঠেক খেয়ে সেরোয়া।

না থাকিলে বোজ হয়ে যায় বাঁয়ে পাওয়া।।

‘দাঁড়াও দাঁড়াও। এত বড় আর্যাটা তুমি নিজে বেঁধেছ?’ পবনকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল রুদ্রাক্ষ।

পবন লজ্জা পেল, ‘হ্যাঁ। আমি পুরোটা বলে দিই, তুমি মুখস্থ করে নাও। দেখবে অসুবিধা হবে না।’

রঘুনাথ উঠে গেছে। টিলা থেকে একটু নীচে নেমে পঞ্চকল্যাণের উদ্দেশে চিৎকার করে কিছু বলছে। শোনা যাচ্ছে না। রুদ্রাক্ষ সহসা স্বর নামিয়ে বলল, ‘পবন, তোমার ইচ্ছা হয় না, রঘুনাথ বা আর পাঁচজন ভদ্র সন্তানের মতো পড়াশুনো শিখতে?’

‘বাহ, আমি তো সবই জানি।’ হাসতে হাসতে বলল পবন, ‘সেইজন্যই এত তদ্বির করে চতুষ্পাঠীর কাজটা নিয়েছিলুম। বিশ্বাস না হলে তুমি যেকোন প্রশ্ন জিগ্যেস করো, রঘুর চেয়ে আমি ভালো বলতে পারব।’

‘সে আমি জানি।’ পবনের উদ্দেশে বলল রুদ্রাক্ষ, ‘কিন্তু এতসব জেনেও তো তুমি চিরকাল সকলের নীচে থাকবে পবন! কারণ তুমি জন্মেছ শূদ্র পরিবারে। আর মল্লভূম বিশ্বাস করে, শূদ্রের কাজ হল অন্যদের সেবা করা।’

পবন মাথা নামাল। তার মুখের হাসি অদৃশ্য। করুণকণ্ঠে বলল, ‘সে আর কী করা যাবে! ভবিতব্য! এইজন্মে হল না, পরজন্মে হয়তো মল্লেশ্বর আমায় ভদ্রসমাজে স্থান দেবেন।’

রুদ্রাক্ষ পবনের দু’কাঁধ শক্ত করে ধরল, ‘না পবন! চাইলেই তুমি, তোমার মতো হাজার হাজার পায়ের নীচে পড়ে থাকা মানুষ পারো এক লহমায় নিজেদের ভবিষ্যৎ বদলে ফেলতে। চাইলেই পার মাথা উঁচু করে বাঁচতে! অন্য জন্মের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না, হবে এজন্মেই!’

‘কী করে?’

রুদ্রাক্ষ বলল, ‘আমাদের তন্দায় তো এমন নয়। সুলতানের পাঠশালায় সকলে পড়বার সুযোগ পায়! পাঠান শাসকরা অনেক মুক্তমনা, পবন! জাতপাতের বাড়াবাড়ি একটুও নেই। সবাই সমান। তোমরাও পারো ভালোভাবে বাঁচতে!’

পবনের ভ্রু কুঞ্চিত। এই পড়ন্ত বিকেলে তার হঠাৎই যেন অচেনা লাগতে শুরু করে এই বিদেশিকে। বলে, ‘কিন্তু কীভাবে?’

‘বলছি। তার আগে বলো, তুমি লাহিড়ীপাড়ায় সবাইকে চেনো?’

পবন একটু ভেবে বলে, ‘মোটামুটি। কেন?’

‘রাধামোহন লাহিড়ী নামে কাউকে চেনো তুমি? বয়স্ক ভদ্রলোক, দুই কন্যা?’

‘রাধামোহন লাহিড়ী?’ পবন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘নাহ! মনে পড়ছে না! কেন গো?’

রুদ্রাক্ষ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বলতে পারে না।

সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে রঘুনাথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *