দশম পরিচ্ছেদ
০১.
তখন রাজনগরের সবচাইতে বড় সংবাদ রানীমার জন্মতিথির উৎসব। তা যে সমাসন্ন তা ক্রমশই গ্রামবাসীদের চালচলন কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিলো। আর তার নিকটবর্তী গ্রামগুলোর পণ্য-উৎপাদকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো।
মুনিষ লেগেছে মাটি ঢেলে পিটে গ্রামের প্রধান পথগুলোকে সমান করতে, পথের ধারের আগাছা কেটে তুলতে। অত বড়ো রাজবাড়ি সাফ সুতরো করা, রং করা এসব তো আছে। যারা কিছু করছে না তারাও আলো, আতসবাজি, ভোজ, থিয়েটারের চিন্তায় উত্তেজিত আলাপ করছে। গ্রাম ভেঙে আসবে সেই সন্ধ্যায় রাজবাড়িতে।
প্রকৃতপক্ষে বলা যায় না এ রকম কেন হতো। বোধ হয় সেবার উৎসবে আমন্ত্রিতদের মধ্যে রাজনগরের একজনই মাত্র যোগ দেয়নি। অন্যান্যবার বাগচী অনুপস্থিত থাকতো। সেবার, তার ডায়েরিই প্রমাণ, সর্বরঞ্জনপ্রসাদই ছিলো একমাত্র আমন্ত্রিত যে যায়নি।
উৎসবের দিন সকালে, ছুটির দিন, একটু বেলায় ব্রেকফাস্ট শেষ করে উঠেছে তখন বাগচী, সর্বরঞ্জনপ্রসাদ তার কুঠিতে এসেছিলো, তার কথা অনুসারে, সম্মান জানাতে। রবিবারে ছুটি থাকে বটে, কিন্তু সকালগুলো তার প্রার্থনাতে কাটে, এবং সে অনুমান করে হেডমাস্টার সাহেবেরও তাই হয়। আজ অন্য একটা ছোট্ট প্রশ্ন তার মনে নেই এমন নয়।
এসব আলোচনার পর সে একটু চিন্তা করে নিয়ে সেই প্রশ্নটায় এলো। সূত্রপাতে বললো–মিস্টার ও সুলিভানের সঙ্গে দেখা হলো। অনেকটা আলাপ করলেন।
মিস্টার শব্দটা বাগচীকে বিপথে নেওয়ার সে জিজ্ঞাসা করলো কে?
নিয়োগী বললো–দু-তিন দিন হয় এসেছেন আবার। এক নৌকা মদ এনেছেন নাকি।
বাগচী বললো–ওহো, ওসুলিভান! এত আগেই এসে গিয়েছে? তা তো আসবেই, সে তো ফেলিসিটার নামে মদ-ব্যবসায়ীর কর্মচারী। এই প্রথম দেখলেন বুঝি? ওসবই বোধ হয় মরেলগঞ্জের জন্য।
নিয়োগী বললো–শুধু কি তাই, রাজবাড়িতেও আলো আতসবাজি ইত্যাদিতে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হবে। সেসবেও আর এক নৌকো।
বাগচী হাসিমুখে বললো, তাহলে এজন্যই তাড়াতাড়ি এসেছে। আলো আতসবাজিতে এমন অনেক খরচ হয় বলেই গ্রামের লোকেরা তার প্রতীক্ষা করছে। আমাদের কাছে পাঁচ হাজার টাকা অবশ্যই অনেক, এক বৎসরে উপার্জন হয় না।
-তাহলেই দেখুন। আর তা শুধু এক বীভৎস পুতুলপূজার আড়ম্বর বাড়াতে। কী অপব্যয়, অর্থের কী অপচয়! আশ্চর্য, গ্রামের লোকেরা একটা প্রতিবাদ করে না, বরং নির্লজ্জের মতো উত্তেজিত! ভাবতে গিয়ে আজ সকালেই মনে হলো, এসব টাকাও তো রায়তকে শোষণ করে। উৎসব তো রাজবাড়ির, তোমাদের কী? এমন নির্বুদ্ধিতা দেখলে রাগ হয় না?
বাগচী আলাপটাকে হালকা রাখার চেষ্টায় একটু ভেবে নিয়ে বললো– রায়তের কাছে খাজনা পৃথিবীর সব দেশেই এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়, তাই না? তাছাড়া যদি ভেবে দেখেন, ভগবানই যেন মানুষকে কেমন নির্বোধ করেছেন! বিখ্যাত একটা মন্দির বা চার্চের ছবি দেখলে আমরা খুশি হই, অন্যের বাগানে ফুলের সমারোহেও তা হই, আকাশে রামধনুর মতো অলীক নিয়ে তো কবিতাই আছে। হিমালয়ের কাছে গেলে সে আমাকে ক্ষেপও করে না, অথচ তার জন্য আমার বলে গর্ব বোধ হয়।
সর্বরঞ্জন আলোচনায় সুবিধা করতে পারলো না। সে বললেও–তাহলেও কিন্তু এই উৎসবে, আমন্ত্রিত হলেও আমাদের যাওয়া উচিত হচ্ছে না। আপনি কি এই উৎসবে যোগ দিয়ে থাকেন?
বাগচী বললো–এবার যাবো স্থির করেছি।
নিয়োগীকে চিন্তিত দেখালো। একটু পরে সে বললো–আমার এই প্রথম শিক্ষক হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েও না-যাই যদি তবে তাকীরাজবাড়ির, বিশেষ দেওয়ানজির, অসন্তুষ্টির কারণ হয়?
বাগচী বলল–তা আমার মন হয়না। আমন্ত্রিতদের কে এলো গেলো তা খেয়াল রাখার জন্য নিশ্চয়ই কেউ কেউ আছেন, কিন্তু আপনি না-গেলে তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে মনে করি না।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থেকে সর্বরঞ্জন ভারী মনে বিদায় নিয়েছিলো।
সর্বরঞ্জনপ্রসাদ চলে গেলে বাগচী অনুভব করলো, কী যেন একটা ব্যথার কথা হচ্ছিলো? ও, সার্ক–রায়ত। হ্যাঁ, নিদারুণ পরিশ্রম আর দারিদ্র্য। কিন্তু ওরাই পাবে। সে আপন মনে হাসলো। না, এটা কারণ নয় যে দরিদ্র বলে পাবে। হয়তো দারিদ্র্য আর শ্রমে পাপ-বিলাসের অবকাশ কম। রোমের সেনেটার লাঙল দিয়ে জমি চাষ করতো এমন গল্প আছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে, সেই গমের ক্ষেতে এবং অলিভ-বাগিচায় যারা কাজ করতো তারা ক্রীতদাস, যেমন এখনো আমেরিকার তুলার ক্ষেতে। হয় ক্রীতদাস, নয় রায়ত। ইংল্যান্ডে তো বটেই, ফরাসী বিপ্লবের পরেও ইউরোপে রায়ত থেকে গেলো। আর তারা খাজনা দেয়। আচ্ছা, আচ্ছা, মনে মনে এই বলে সে হাসলো, খাজনা মানে ফসলের উদ্বৃত্ত অংশ পরিবারের যা লাগে তার উদ্বৃত্ত। ওহো, এই উদ্বৃত্ত যদি রায়ত না-দেয় হেডমাস্টার খায় কী? উদ্বৃত্ত নিজের ইচ্ছায় দেবে এমন হয় কি? অন্যদিকে দ্যাখো, কি ইংল্যান্ডে কি ভারতে রায়ত সুখে নেই।
এটা সে সময়ের একজনের চিন্তার প্রতিচ্ছবি হতে পারে, ব্যক্তিবিশেষের চরিত্রের এক পাশ। এমনও বলা যায়, বাগচী উৎসবে যোগ দেওয়া স্থির করেছিলো বলেই তার চিন্তা এই পথে চলেছিলো; নিয়োগী উৎসবে যোগ দেবে না বলেই রায়তদের কথা তুলেছিলো।
বাগচী পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখলো, বসবার ঘরে যেখানে বেশ খানিকটা রোদ এসে পড়েছে সেখানে কেট চেয়ার টেনে কিছু করছে। সে আবার মনে মনে হাসলো, ওয়েল, ওয়েল, এটা সেই এমারেল্ড গাউনটা। ক্যাপ আর গ্লাভস, দ্যাখো, গ্লাভসটাও এমারেল্ড! আর সব ঢেকে গাঢ় নীলের এই ক্যাপটা থাকবে কেটের। এটা কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, দারুণ সাহসী পদক্ষেপ এটা কেটের এই নিজে থেকে উৎসবে যাওয়া। কিন্তু পদক্ষেপটা কোন দিকে? কেট তার হালকা নীল সোয়েডের উঁচু গোড়ালির জুতোজোড়া রোদে দিতে। এসে থমকে দাঁড়ালো। বিবর্ণ হলো তার মুখ। বাগচীও উৎকর্ণ হয়েছিলো। হেসে বললো, ঢাক বলে। বোধ হয় একসঙ্গে একশোটা।
.
০২.
একশো না-হোক পঞ্চাশ হতেই পারে। পূজার বা উৎসবের অঙ্গ হিসাবে না-হতে পারে, হয়তো তারা এতক্ষণ পুরো দলটা একত্র হয়েছে বলেই তারা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে ঢাকগুলোর মাথায় খাড়া করা চামর দুলিয়ে, দুলে দুলে, বাতাসে হেলান দিয়ে জোড়কাঠিতে তেহাই দিয়ে হাসি হাসি মুখে পরস্পরের ওস্তাদির তারিফ করলো।
তা হতেই পারে। পূজা তো সেই মাঝরাতে, উৎসব শুরু হয়েছে ভোরের সানাইয়ে। সন্ধ্যায় তা হাউই, তুবড়ি, রংমশালের ঝাড়ে উৎসারিত হবে! হাউই-তুবড়ির উচ্ছ্বাস মিটতে মিটতে কাছারির চত্বরে শুরু হবেনাকি ঠিয়াটার যা কলকেতায় হচ্ছে। ভিনগ্রামের আমন্ত্রিতরা। আগেই জলযোগে বসে যাবে কাছারির ঘরে ঘরে, এমনকী অন্দরেরও কোনো কোনো হলে। রাত গম্ভীর হবে ক্রমশ, ফেলিসিটারের চেষ্টা সত্ত্বেও অভিনয়ের আসর ছাড়া অন্যত্র আলোগুলো লালচে হয়ে আসতে থাকবে। আর তখন অন্দরে যাওয়ার পশ্চিমের খিলানের ওপারে একটা স্তিমিত ঔজ্জ্বল্য দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। আর সেখানে তখন সারাদিন এখানে ওখানে কারণে-অকারণে চমকে দিয়ে যে ঢাকগুলো বেজেছে সে সবগুলো একসঙ্গে বেজে উঠবে, পুরোহিতের উচ্চকণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যাবে, আর তা ছাপিয়ে কারো কারো মা মা ডাক।
সকাল থেকে শুরু, মাঝরাত অবধি ভিড়। সে ভিড় বাড়ে, কমে, সরে, নড়ে, আর তাতে বোঝা যায় উৎসবের কোন অংশ কোথায় গুরুত্ব পাচ্ছে। আর ভিড়ও উৎসবকে মনে করিয়ে । দিচ্ছে, তা সারাদিন ধরেই। কর্মচারী, দাসদাসী, বরকন্দাজ, বরদার, এরা তো ভিড়ের সর্বত্রই, সকলেই সজ্জিত। তাদের পরনে নতুন কোরা ধুতি শাড়ি, পুরুষদের মাথায় নতুন গামছা, কারো মাথায় তা পঙ্গু করে বাঁধা। দাসীদের মুখ পানে রাঙা, পায়ে আলতা, তাদের অনেকেই রেশমী ধাকড় পেয়েছে, কেউ কেউ পশমী বনাতও।
উৎসবের আসল ব্যাপারটা অর্থাৎ যেখানে পূজা সেখানে সকাল থেকে ভিড়ের চেহারা স্বতন্ত্র। উঁই করা ফুল বেলপাতা প্রকাণ্ড রূপার পুষ্পপাত্রে বেছে দেখে সাজানো হচ্ছে। ডাঁই করা আনাজ তেমনি প্রকাণ্ড পিতলের কাঁসার পরাতে। চাল, ডাল, মশলার স্তূপগুলোকে ঝেড়ে বেছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া চলছে। হাত চলেছে, মাথা দুলছে, কোথাও চুড়ি বালার শব্দ, কিন্তু কথা কম, খুবই কম, হু-হার বেশি নয়। সাবধান থুতু না-ছেটায়। এ তো সেই ভয়ঙ্করী, এই ভয়ানক দুঃসময়ে যার কঠোর কর্কশতায় লুকানো স্নেহই একমাত্র ভরসা।
এসব তো প্রতি উৎসবেই। এবার কি কিছু পার্থক্য চোখে পড়ছে? মণ্ডপে রানীমাকে দেখা যাচ্ছে না বরং নয়ন-ঠাকরুণ মাঝে মাঝে ঘুরছে। রানী কাল তাকে গোপনে ডেকে বলেছিলেন বটে, মণ্ডপে থাকতে হবে, আমি পারছি না। মণ্ডপে যেমন নয়নতারা, অন্দরের জলযোগের হলগুলোতে তেমন হৈমী, দরবার হলের মাঝামাঝি তেমন নায়েবগিন্নি।
শীতের সন্ধ্যা ঝুপ করে নামে। বাইরে আকাশে কিছু আলো, কিন্তু মণ্ডপের দরদালানে আলো জ্বালাতে হয়। প্রতিমার চোখ আর তিলক নিয়ে কিছু অসুবিধা ঘটেছে। এখানেই এক দিনেই তো কাঁচা মাটির প্রতিমাকে আকারে রঙে জীবন্ত করে তুলতে হবে। কী অসম্ভব ব্যাপার! নিচের মাটি সরস, উপরে রংয়ে চোখ ধাঁধাবে। আচার্যিকারিগরমশায় সাগরেদ নিয়ে তুলি হাতে রং ছোঁয়াচ্ছে, পিছিয়ে পিছিয়ে দেখছে। সন্দেহ হয়, তার চোখে কিসের চাপে জল আসছে যেন। চোখগুলি একইসঙ্গে ডাকাতের মতো তীব্র আর মায়ের মতো স্নিগ্ধ করতে হবে না? আচার্যিমশায় ফিরে ফিরে নয়নতারাকে বলছে–দেখুন, মা, এবার। ভয়ের কথা বৈকি! মাঝরাতে রানীমা নিজে এসে প্রতিমার দিকে মুখ করে বসবেন না? এখনো প্রতিমার তিনফুল নাকে সোনার নথ ওঠেনি, কানে দোলেনি কাঁধছোঁয়া কুণ্ডল।
.
০৩.
উৎসবটা ধর্মের সঙ্গে জড়িত, তারা বিশেষ নিমন্ত্রিত হলেও ক্রিশ্চান। কোন দিকে গেলে অশোভন হয় না এরকম চিন্তা ছিলো বাগচীর। রাজবাড়ির সদর-দরজায় পৌঁছলে যারা অভ্যর্থনায় তারা তো এগিয়ে এলোই, নায়েবমশাইও তাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে নির্দেশ দিলোবাগচীসাহেবকে নিয়ে আমার কামরায় বসাও। মেমসাহেবকে বড়োগিন্নির কাছে পৌঁছে দিও। নাকি, আপনারা দেওয়ানকুঠিতে যাবেন?
বাগচী মনে মনে বললো, সমস্যাটা অন্যরকম হলো দেখছি। সে বললো–এ দিকেই তো আলো, আলোরই তো উৎসব।
সন্ধ্যা থেকে আলো কিন্তু রাত যত বাড়ছে তত যেন উজ্জ্বলতর। যারা আগেও দেখেছে তাদের মনে হচ্ছে সেবার কাছারির বারান্দাগুলোতে, কামরায় কামরায়, রাজবাড়ির ঘরে ঘরে এত আলো ছিলো না। অন্যদিকে সেবারের দেওয়ানকুঠি যত উজ্জ্বল ছিলো এবার তা নয়। অনুমান সত্যই হবে। শিশাওয়াল তো এখনো ঘুরছে এখানে ওখানে তার সেই সাহেব সহকারী নিয়ে এখনো এখানে একটা বিচিত্র চেহারার ডোম, ওখানে একটা দেয়ালগিরি বসিয়ে চলেছে। কাছারি আর রাজবাড়ির মাঝের চত্বরে সেবার সামিয়ানার নিচে বেলদার ঝাড়ের আলো, সামিয়ানার থামে থামে হারিকেন ঝুলিয়ে বিদ্যাসুন্দরের পালা হয়েছিলো। এবার সেখানে থিয়েটারের মঞ্চ আলোয় ঝকঝক করছে।
একজন কর্মচারী কেটকে পথ দেখিয়ে রাজবাড়ির দিকে নিয়ে গেলো। বাগচী যেখানে বসলো কাছারির সেই ঘরে গ্রামের বিশিষ্টদের আসন। বাগচী যেন চোখ বুলিয়ে দেখলো, নিয়োগী সেখানে কোথাও আছে কিনা। নায়েবমশাই সেখানেই উঠে এলো, বললো–একটু বসে নিই, বুড়ো হয়েছি তো; কী বলে?
নায়েবমশাই বসতেই তার হুঁকাবরদার তামাক নিয়ে এলো। সে-ই বাগচীকে জিজ্ঞাসা করলো তাকেও তামাক দেওয়া হবে কিনা। বাগচী পাইপ বার করলো, হেসে বললো–আমার হুঁকো সঙ্গেই থাকে।
একজন অভ্যাগত জোতদার বললো– আমাদের এই গ্রামে আর একজনকে মাত্র এমন দেখা যেতো, শিরোমণিমশায়ের জ্যেঠা সার্বভৌমকে।
–তিনিও পাইপ নাকি? বাগচী জিজ্ঞাসা করলো।
–না, থেলো হুঁকো থাকতো সঙ্গে, কিন্তু তেমন নিটোল ছোটো খোলটি পাওয়া কঠিন। একজন রসিকতা করে বললো–কেউ জাত মেরে দেবে ভয় ছিলো নাকি?
সাধ্য কী? প্রথমজন বললো, ব্রাহ্মণের হুঁকোতেও খেতেন না। বলতেন উচ্ছিষ্ট উচ্ছিষ্টই, তা ব্রাহ্মণের হলেও।
নায়েব বললো–কড়া লোক ছিলেন। শুনেছি, নিজের গৃহবিগ্রহ নারায়ণের প্রসাদ ছাড়া অন্য পূজার প্রসাদও পেতেন না।
মনে হলো পূজার প্রসাদ দেবতার উচ্ছিষ্ট কিনা এ নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু কাছে পিঠে সদর-আমিন সোনাউল্লা কাজী ছিলো। পিছন থেকে সে বললো, তিনি কি–অর্থাৎতার কি ব্রাহ্মণী ছিলো না?
-তা ছিলো বৈকি?
–তাহলে আর উচ্ছিষ্ট মুখে না-দেওয়ার প্রতিজ্ঞা থাকে না, জী।
–মানে? নায়েব বললো–আ, সোনাউল্লা!
মুখের হাসি আড়াল করে নায়েব উঠে পড়লো। বললো, তুমি এদিকে আছো, সোনাউল্লা, আমি ওদিকে দেখি। যিনি যখনই যান, কিন্তু জলযোগ না করে নয়, দেখো।
কুল্লাযুক্ত শিরপেঁচ দুলিয়ে হেসে সোনাউল্লা জমিয়ে নেবে মনে হলো, কিন্তু একজন সোনাউল্লার কানে ফিসফিস করে বললো–মুসলমান জোতদাররা যেখানে জলযোগে বসেছেন সেখানে একবার যাওয়া দরকার। কিছু ত্রুটি থাকায় তারা মুখ টিপে হাসছেন। সুমারনবিশ ঠিক পারছেন না। পীরজাদা আপনাকে বলতে বললেন।
ঠিক এই সময়েই, সদর-দরজার পাশে পটপট দুমদুম শব্দ হলো। মঞ্চের সামনে যারা হৈ-হুঁল্লোড় করছিলো সেই ছেলের দল হো হো করে ছুটলো সদর দরজার দিকে। কাছারির বারান্দায় ভিড় করে দাঁড়ালো অনেকে। রাজবাড়ির আলোর মালার নিচে নিচে নড়াচড়া দেখে বোঝা গেলো সেখানেও আতসবাজি দেখার জন্য ভিড় হয়েছে।
একতলার হলঘরে, যাকে দরবার-হলও বলা হয়, সেখানেই মহিলা অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার ব্যবস্থা। সেখানে তেমন ভিড় ছিলোনা। কারণ সেখানে কিছুক্ষণ থেকেই মহিলারা প্রতিমা দেখতে অথবা জলযোগের ঘরে সরে যাচ্ছে। তাহলেও দরবার-ঘরের সৌন্দর্য, বিশালতা ইত্যাদির আকর্ষণ আছে। কিছু কিছু স্ত্রীলোকের যাওয়া-আসা ছিলোই। বিশেষ তারা তো ছিলোই যাদের সকলের পরনে একই রকম লালপাড় শাড়ি এবং গায়ে রেশমের চৌখুপি বোড়। কেট বুঝলো, এরা কর্মচারী। সে ঘরে একজন বর্ষীয়সীরই প্রাধান্য। কেটকে সেই কর্মচারী তার কাছে এনে উপস্থিত করে চলে গিয়েছিলো। কেট অনুমান করেছিলো, রানী অবশ্যই নয়, কারণ সেই বর্ষীয়সীর কপাল-ছোঁয়া সাদা চুলে ওড়া করে দেয়া সিঁদুর; পরনে হালকা রঙের হলেও উজ্জ্বল ব্রোকেড এবং কণ্ঠা থেকে বুক-ঢাকা। অলঙ্কার স্তরে স্তরে যেন ব্লাউজের কাজ করছে।
লোকের কথায় ঠাহর করলো কেট উনি বড়োগিন্নি। ইংরেজিতে তর্জমা করে অনুমান করলে চিফ মেট্রন হবে। তার অবশ্যই জানার উপায় ছিলো না তিনিই দোর্দণ্ডপ্রতাপ নায়িব-ই-রিয়াসতের স্ত্রী।
কেটকে তার পাশের শোফায় বসতে বললেন।
কেটের সঙ্গে গ্রামের কজনেরই বা পরিচয়! কিন্তু সে তো কৌতূহলের বিষয়। কাজেই তার চারিদিকে কিছু ভিড় হলে আবার।
যখন কেট বললো–আপনিই বড়োগিন্নি? তখন এই ভাষা শুনে এমনকী বড়োগিন্নির দূরে সরে যাওয়া দৃষ্টি যেন হেঁটে এসে কেটের সিঁদুরহীন কপালে দস্তানায় ঢাকা পুরো বাহুতে পড়লো। কিন্তু বড়োগিন্নির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেলো যখন তার সেই অনুত্তেজিত মুখে, বয়স এবং সাদা চুল সত্ত্বেও, ব্রীড়ার গভীর রং দেখা দিলো।
বড়োগিন্নি বললো–রানীমা বড়োগিন্নি বলেন। আসলে আমি গোবর্ধনের মামী। আমি কি আপনার নাম জানি?
কেট বললো–ক্যাথারিন।
বড়োগিন্নি বললো– সুন্দর নাম। ভারি সুন্দর নাম। তা, শাড়ি পরে গণেশ কোলে বসলে কাত্যায়নীর মতোই দেখাবে।
হলঘরের ভিতরে এবং বাইরে সবকিছুই উৎসবের কথাই মনে করিয়ে দিতে থাকে। গতবার, তার আগেরবার কেমন হয়েছিলো এসব আলোচনা শুরু হলো।
একজন বললো–কিন্তু যা আসছে তার তুলনায় এ কিছুই নয়।
আর একজন বললো–আমাদের রাজকুমারের বিয়ের কথা নাকি?
বড়োগিন্নি বললো–হা, সে উৎসবও নিশ্চয়ই অনেকদিন মনে রাখার মতো হবে।
অন্য একজন বললো, বিয়ের ঘটকালি নাকি ব্রহ্মঠাকরুণ করছেন? তিনি নাকি নতুন আসা নিয়োগীমাস্টারের বোন?
একজন বললো, জোগাড়ে লোক বলতে হবে। কদিন আর এসেছে, এরই মধ্যে খোদ রানীমার দরবারে।
বড়োগিন্নি কেটে দিয়ে বললো–ওটা কী আর দরকারি কথা!
কেট কৌতূহল নিয়েই শুনছিলো। আলাপটা একটু ঘোরাপথে হচ্ছে বটে, হয়তো মাধুর্যকে এমনভাবে গভীর করাই উদ্দেশ্য। সে বললো–এ বিষয়ে আসল কথা নয়ন ঠাকরুণের কাছে জানা যাবে বোধ হয়।
অনেকেই এদিক ওদিক চাইলো যেন।
কিন্তু আলাপটা এগোলো না। পটপট চড়বড় করে বাজি ফুটে উঠতেই আতস দেখবার জন্য নিমন্ত্রিতদের অধিকাংশ দরবার-ঘরের বাইরে চলে গেলো। শুধু পটকা নয়, ফানুস, উই, ফুলেন তুবড়ি, রংমশাল। কেট বসে বসে দেখছিলো। কিন্তু রংমশাল যখন কখনো নীল, কখনো লাল, কখনো সবুজ আলোয় কাছের লোকগুলিকে রঙে স্নান করাচ্ছে, ভারি সুন্দর তো বলে সে উঠে দাঁড়ালো।
বড়োগিন্নি বললো–সামনের বড়ো জানলাটার কাছে গেলে আরো ভালো দেখা যাবে। এই বলে সে নিজেও তেমন একটা জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
যারা বাইরে গেছে তারা বাইরে, ঘরে যারা ছিলো তারা কোনো না কোনো দরজা বা জানলার কাছে। কেট একটা জানলায় একাই ছিলো। আতসবাজি যখন জ্বলে ওঠে তখন যারা তৈরী করে তারাও অবাক হয়ে যায়।
হঠাৎ যেন কেউ পাশে এসে দাঁড়িয়ে, আরো ভালো করে দেখার জন্য, অথবা আনন্দের উত্তেজনায় কেটের হাতের উপরে হাত রাখলো।
একটু ফিরে দাঁড়ালো কেট। বাইরের রংমশালের আলো এসে পড়েছে মহিলাটির মুখে, সবুজ পান্নার আলো, কিংবা তা কি তার গলার পান্নার কণ্ঠীর থেকে? মাথায় ঈষৎ ঘোমটা, ঘোমটা ঘিরে রক্তলাল শাল। কী বলবে, কী বলা উচিত ভাবলো কেট এক মুহূর্ত। রংমশালটা নিবতে সাদা আলোয় চিনতে পেরে সে হেসে বললো–নয়ন-ঠাকরুণ?
নয়নতারা নিজের হাতের নিচে ধরা কেটের হাতটায় চাপ দিলো। বললো–এসেছেন শুনেছিলাম। অসুবিধা হচ্ছে না তো?
না। কিন্তু এদিকে ওদিকে চেয়ে আপনার প্রত্যাশা করছিলাম। কেট দু হাতে তার হাতের উপরে রাখা নয়নতারার হাতটাকে ধরলো। হেসে বললো–এখন তো অভিনন্দন নেওয়ার সময়, আমার অভিনন্দন নিন।
নয়নতারা একটু বিব্রত হলো। কেটের চোখের দিকে সে কিছুক্ষণ চাইলো। ঠিক এই সময়েই একটা বড়ো আকারের ফানুস উঠতে শুরু করায় তার সুবিধা হলো, সে বললো– ওই দেখন, ওই দেখুন, ভারি সুন্দর, নয়?
ফানুসটা অবাক করে দিয়ে, প্রথমে ধীরে ধীরে, পরে বেশ জোরে আর সোজা উঠে গেলো। কিন্তু আচমকা কেঁপেও গেলো।
কেট বললো–সংবাদ পেয়ে আমি যে কী সুখী হয়েছি, আমাদের দেশে হলে আপনার ঘোমটা সরিয়ে ওই সুন্দর গালে চুমু দিতাম।
কিসের সংবাদ? নয়নতারা জিজ্ঞাসা করলো, কিন্তু হঠাৎ যেন নিজেই কিছুটা আন্দাজ করলো, তার গাল দুটোর যতখানি চোখে পড়ে তা যেন রংমশালের আলো পেয়ে লাল হলো।
-কিংবা, কেট বললো, রাজকুমার নিজে বলেননি বলে আমাদের চুপ করে থাকা উচিত? কিন্তু আপনিও তো বলেননি।
সাঁ করে একটা হাউই উঠলো চমকে দিয়ে, দুম করে সেটা ফাটলো, লাল, নীল, সবুজ আলোর কয়েকটি বল শূন্যে নেচে নেচে ফেটে ফেটে আকাশকুসুম রচনা করলো, তারপর নক্ষত্ৰচুতির মতো নিবে নিবে খসে খসে পড়লো।
আর তাতেই যেন অন্ধকার হলো। তখন নয়নতারা যেন কারো ডাক শুনতে পেয়ে একটু গলা তুলে বললো, যাচ্ছি।
কেটের হাতের উপরে এবার একটু জোরে চাপ দিয়ে যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো তেমনি চলে গেলো। তার শাড়ির মৃদু খসখস শব্দ হলো একটা।
.
০৪.
আতসবাজির কাছে আসতে হরদয়ালের আধ ঘণ্টা দেরি হলো। সে বাগচীকে দেখতে পেয়ে বললো– ডানকানের জন্য অপেক্ষা করতেই দেরি। এবার ওরা আসছে! দেখছি। সেই কীবল ছোকরা বোধ হয় কালীপূজা নিয়ে আরো ঠাট্টা করেছে।
বাগচীর সেই লাঞ্চের কথা মনে পড়লো যেখানে ডানকানের কালীপূজা নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো। সে কুণ্ঠিত হয়ে ভাবলো বিষয়টাকে। ডানকান ক্রিশ্চান, তা মনেপ্রাণে না-হোক, এতদিন এ উৎসবে যোগ দিতো, এবার দিলো না। এটা কি কোনো নতুন পরিস্থিতির সূচনা? কিন্তু কী আশ্চর্য, তার চোখের সামনে একটা ফুলবাগান যা বিভিন্ন রঙের আলোর তৈরী। বাগানটা মিলিয়ে গেলো। হরদয়াল হাসিমুখে বললো–আপনি কী ঘুরে ঘুরে দেখেছেন? আসুন, আমরা রাজবাড়ির কাছে যাই।
তারা উঠে যেদিকে থিয়েটারের মঞ্চ সেদিকে হাঁটতে শুরু করলো। হরদয়াল বললো– মিসেস বাগচীও বোধ হয় ঘুরে ঘুরে দেখেননি?
তারা যখন কাছারির চত্বরের মাঝামাঝি হরদয়াল একজন দাসীকে দেখতে পেয়ে বললো–বাগচীসাহেবের মেম অন্দরে আছেন। তাকে বলো আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।
গ্রামে মেমসাহেব তো একজনই, কাজেই খুঁজে বার করে সংবাদ দিতে দাসীর অসুবিধা হলো না। ফলে থিয়েটারের সামিয়ানার কাছাকাছি হরদয়াল এবং বাগচী পৌঁছতেই কেট এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিলো।
তখন হরদয়াল বললো–এবার একটা কথা বলি। যাঁরাই উৎসবে এসেছেন তাদের সকলেরই জলযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি ভাবছিলাম মিসেস বাগচী এবং আপনার জন্য সে ব্যবস্থাটা আমার কুঠিতে কেমন হয়?
কেট বললো–না না, এসবের জন্য আপনি ভাববেন না। এটা কিছু নয়। আলোটাই আসল।
হরদয়াল বললো–আপনাদের বিশেষ ব্যবস্থা নায়েবমশায় নিশ্চয়ই করে রেখেছেন, তার বদলে যদি আমার কুঠিতে একটা ছোট্ট ডিনার-জাস্টটু কিপ এ লোশলি ব্যাচেলর কম্পানি?
বাগচী হেসে ফেলো। এরপরে আর আপত্তি করা চলে না। নটায় সে ডিনার হবে স্থির করে তারা আলোকজ্জ্বল প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেলো।
তারা একটা উঁচু আলোকিত খিলানের পথে এসে পড়লো। এরকম খিলান আরো আছে, সেগুলোর নিচে দরজা এবং সম্মুখে সিঁড়ি, এটার তলায় একটা প্রকাণ্ড ঝাড় যা নিচের পথটাকে আলোকিত করে রেখেছে। হরদয়াল বললো–এদিকেই পূজা।
বাগচী বললো–দেখবার মতো কাছে যাওয়া যায় না-ছুঁয়ে? যাবে কেট। মনে করো ডানকান বেকায়দায় একবার কালীপূজা করেছিলো।
এরপরে যা ঘটলো তা ইতিহাসের পক্ষে অপ্রয়োজনের। তারা কাছাকাছি যেতে যেন জোড়ায় জোড়ায় অনেকগুলো ঢাক বেজে উঠলো। নাচছে ঢাকীরা। ঢাকের উপরে চামরগুলো তালে তালে নাচছে, লাফাচ্ছে, ঢাকীদের মাথায় বাঁধা রঙিন নতুন গামছার পাগ। দুলছে। প্রতিমার দালানে আলোয় আলোময়। প্রতিমার দালানের মুখোমুখি রকে অনেক স্ত্রীলোকের ভিড়। তাদের রেশমে আর সোনারূপায় আলো পড়ছে। তারা থেকে থেকে বহু কণ্ঠে উলু দিয়ে উঠছে। সেই রক আর প্রতিমার দালানের মাঝখানে নিচু গলিপথ। সেই পথে অনেক পুরুষ। তারা যুক্তকরে প্রতিমার মুখের দিকে চেয়ে। প্রতিমার দালানে লোহার রেলিংয়ে দুটি ভাগ, তা যেন প্রতিমাকে কিংবা পূজার স্থলকে পৃথক করেছে। সেই ঘেরের বাইরে একজনমাত্র মহিলা যার পরনে দুধ-শাদা গরদের থান, যিনি প্রতিমার মুখের দিকে মুখ করে স্তব্ধ। ঘেরের এপারে নামাবলি গলায় দুজন পুরুষ, যারা নিশ্চয় পুরোহিত এবং তন্ত্রধার, এবং চার-পাঁচজন মহিলামাত্র। তারা একটা চালনে প্রদীপ ইত্যাদি রেখে চার পাঁচজনে একসঙ্গে ধরে প্রতিমার মুখের কাছে তুলছে, পায়ের কাছে নামাচ্ছে। কেট একটু ঠাহর করে তাদের মধ্যে বড়োগিন্নিকে দেখতে পেলো।
তারা অবশেষে সেই চালন পূজার ঘেরের মধ্যে একপাশে রেখে বেরিয়ে এলো। কেট অবাক হলো দেখে বড়োগিন্নি মুখে আঁচল দিয়ে নিঃশব্দে ফুলে-ফুলে কাঁদছে। কেট বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা না করে পারলো না।
হরদয়াল বললো–এসব আমরা বুঝি না। হয়তো মেয়ে বাড়িতে আসছে এরকম অনুভব করছেন। হয়তো সঙ্গে-সঙ্গে নিজের দুঃখের কথাও সেই মেয়েকে বলতে চাইছেন। বোধ হয় উনি নায়েবমশায়ের স্ত্রী।
কিন্তু আলোর প্রদীপমালার মধ্যে যে মধ্যমণির মত, যার সামনে দুজন পুরুষ অতি সন্ত্রস্তভাবে পূজার উপকরণ নামাচ্ছে, যা একইসঙ্গে সুন্দর, ভয়ঙ্কর, হাস্যময়ী, লোলজিহ্বা, লজ্জিতা অথচ দিগম্বরী।
কেটের মুখ নীল হয়ে উঠলো। সে বিড়বিড় করে কিছু বললো।
হরদয়াল কী লক্ষ্য করছে তা সবসময়ে বোঝা যায় না। বাগচী কথা বলার জন্য কেটের মুখের দিকে চেয়েছিলো। সে বললো–তোমার কি গরম লাগছে ডারলিং, এই শীতেও অনেক প্রদীপে জায়গাটা গরম।
হরদয়ালও বললো–হ্যাঁ চলুন, আমরা ফাঁকা জায়গায় যাই।
রাজবাড়ির বাইরে কাছারির দিকে আতসবাজি তখনো। কিন্তু লোক-চলাচলে অনুমান উৎসবের টান এখন অন্যদিকে। তাদের পথনাটকের সামিয়ানার পাশ দিয়ে। শুধু ভিড় নয়, বাজনাও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। বেহালা, সারেঙ্গী কে কে করছে, সানাই বাঁশি বাজছে, ডোল তাল ঠুকছে, সব মিলে একটা পরিচিত সুরের দিকে, কিন্তু তুলনায় শব্দ বেশি।
আড়াআড়ি ঘাসে-ঢাকা চত্বর পার হয়ে সামিয়ানার কাছে যেতেই সেদিকের এক কর্মকর্তা আসুন হুজুর; আসুন স্যার; আসুন ম্যাডাম বলে অভ্যর্থনা করলো।
সামিয়ানার নিচে মঞ্চের সামনে ডাইনে-বাঁয়ে কিছু নিচু সুদৃশ্য কৌচ। তারপর থেকে চেয়ার ও বেঞ্চ। সামনের সারিটা উচ্চস্তরের জন্য বোঝা যায়। রাজকুমার আসেননি। অভ্যর্থনাকারী হরদয়াল প্রভৃতিকে সেদিকে নিয়ে গেলো। দেখা গেলো, বাঁদিকের একটা কোচে নায়েবমশাই একা বসে, তার মুখে বিড়ম্বনা।
হরদয়াল এবং বাগচী দম্পতী বসলে নায়েবমশাই বললো–তবু যা হোক, একা ভয়ই করছিলো।
হরদয়াল হেসে বললো– রাজবাড়ির প্রাচীরের মধ্যে কী ভয়?
কিন্তু দারুণভাবে কনসার্ট বেজে ওঠায় কথা বলার সুবিধা থাকলো না। কিন্তু বাজনাটা দপ করে থামলো। তখন সেই অভ্যর্থনার কর্মচারী বললো–আর একবার ছোট্ট একটু বেজেই পর্দা উঠবে।
সেই অবসরে হরদয়াল বললো–কী নাটক হচ্ছে শেষ পর্যন্ত?
নায়েব বললো– কী যেন, একেই বলে বুড়ো শালিখ।
অভ্যর্থনাকারী বললো–আসলে নায়েবমশাই কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না দুটো নাটক।
নায়েব বললো–বেশ করেছে, বাপসকল, টাকাটা যে খরচা করলে তার যেন মান থাকে।
হরদয়াল হেসে বললো–অনেক চাইছে বুঝি?
-আর বলেন কেন? পোশাক রে, পরচুলা রে, রং রে, আবার কী ছিন-ছিনারি! তা পটো এঁকেছে ভালো। আর এবারে শিশাওয়ালও মজা পেয়েছে। সেও সব ঘোমটা পরা আলো দিয়েছে শুনি। ঠাহর পাচ্ছি না, কত বা হাঁকে।
সেই ছোটো বাজনা বেজে উঠলো। নায়েবমশায় আর হরদয়ালের গড়গড়া এসে গেলো তাদের হুঁকা বরদারদের হাতে। এটুকু করতে না-পারলে তাদের আর চাকরি কীসের? এখন বেশি আলাপের সময় নয়, সিন উঠে গেলো। নাটকটা মনে হচ্ছে প্রহসন। নাট্যকার যেভাবে হাসাতে চেয়েছিলো হাসিটা তা থেকে স্বতন্ত্র ধরনের হতে লাগলো মাঝে মাঝে। স্ত্রীচরিত্রে অভিনেতা এক ছোকরা পরচুলা নিয়ে ফ্যাসাদ ঘটাতে না-ঘটাতে, তার বক্তব্য অন্যে বলে ফেলে জিভ কাটালো। কথা শেষ করার আগেই কেউ নেপথ্যে গিয়ে ওদিকের তাড়া খেয়ে গলা বাড়িয়ে বক্তব্যের বাকিটুকু বলে দিলো। তা সত্ত্বেও ব্যাপারটার অভিনবত্ব দর্শকদের টানছে।
কখনো মানুষকে অটল গাম্ভীর্য নিয়ে থাকতে হয়। গড়গড়ার ধোঁয়ার আড়ালে নায়েব মশায় যেন কোন গোপন ব্যথায় পীড়িত। হরদয়াল মাঝে মাঝে মুখের উপরে হাত রাখছে, তাতে তার ঠোঁট দুটি আর চিবুক ঢাকা পড়ছে। বাগচী কিছু অনভিজ্ঞ। সে পাইপ কামড়াচ্ছে বটে, কিন্তু কি তার পাইপ, কি তার দাড়ি তার চোরাহাসি গোপন করতে পারছে না।
একবার সাধারণ দর্শকরা হো হো করে হেসে উঠলো। এতক্ষণ যে মোটামুটি ভালো পার্ট করছিলো, সম্ভবত লমোহরার গৌরী, সে ভুল পথে তার যেখানে আদৌ থাকা উচিত নয়, সেখানে এসে এক দারুণ বিপত্তি সৃষ্টি করে দুম দুম করে পালালো। তৎক্ষণাৎ সিন। পড়লো এবং দারুণভাবে বাজনা বেজে উঠলো।
কেট পিছন ফিরে দর্শকদের হাসিটাকে লক্ষ্য করলো যেন। কিন্তু বললো–জমিদার দেখছি অত্যন্ত প্রজাপীড়ক এবং নীতিহীন, রায়তরা ক্ষেপে না যায়। বাগচী হাসতে হাসতে বললো–নিয়োগীমশায় দেখলে ভালো করতেন। তাঁর সাসপেনশন অব ডিসবিলিফ নিয়ে ভয় রইতো না।
কিন্তু নায়েবমশায় যেন এই সুযোগের অপেক্ষা করছিলো। বললো–বুড়োমানুষ তো। একভাবে এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা কষ্টের। আপনারা বসুন। ওদিকে দেখি ঠিক চলছে কিনা।
হরদয়াল বললো–আপনাকে বলা হয়নি। মিস্টার ও মিসেস বাগচীকে জলযোগের বদলে আমার সঙ্গে রাতের খাওয়া সারতে বলেছি।
বাঃ বেশ, অতি উত্তম করেছেন। বলে নায়েব উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু যেতে গিয়ে বোধ হয় কিছু দরকারি কথা মনে পড়লো। বললো–রানীমার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো নাকি? বিকেলের দিকে খুঁজছিলেন আপনাকে, পরে বললেন, থাক আজ।
-বাইরে গিয়েছিলাম একটু। বললো– হরদয়াল।
-এবারের উৎসবের উপহার শুনেছেন? এবার কিন্তু বেতন বেড়ে যাচ্ছে না। বলেছেন, সব কর্মচারীকে বারো দিনের বেতন অতিরিক্ত এককালীন দেওয়া হবে। আদায় ভালো হয়নি, তাই সারা বছরের এবং ভবিষ্যতের জন্য বেতনবৃদ্ধি নাকচ করেছেন।
–কিন্তু বর্তমানে তো নগদ বেশি যাবে। হরদয়াল বললো।
-তা হবে। এবার দুটো নতুন পদ সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের মধ্যে একটি রাজকুমারের ব্যক্তিগত পরামর্শদাতার। বললেন, সে বিষয়ে আপনার সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছে। এই পদে উনি এমন একজনকে চান যিনি রাজবাড়ির ধরন-ধারণ বোঝেন, রাজকুমারকে ভালোবাসতে পারবেন, নিজে বিশেষ সচ্চরিত্র হবেন, অথচ ইংরেজিতে ভালো।
হরদয়াল বললো–এমনটি রানী কিছুদিন থেকে ভাবছেন। সেরকম একটি মানুষ পেতে হবে তো।
–দেখা যাক। বলে নায়েব চলতে শুরু করলো।
হরদয়াল ঘড়ি বার করে বললো–সে কী, পৌনে নয় হচ্ছে। আসুন মিস্টার বাগচী, এই সুযোগে আমরাও উঠি। ডিনার জুড়োতে দিলে হবে না।
.
০৫.
দেওয়ানকুঠি রাজবাড়ির প্রাচীরের মধ্যেই, সুতরাং তারও কিছু আলোকসজ্জা আছে। যদিও তা অন্যান্য অংশ থেকে স্তিমিত। আলো দেওয়ার কৌশলে কুঠির স্থাপত্য-সৌন্দর্যকেই শুধু প্রকাশ করা হয়েছে। বাগচী দম্পতিকে নিয়ে সেদিকে যেতে যেতে হরদয়ালের মন প্রথম উৎসবের দিকে ফিরে গেলো। তখন সে-ই দেওয়ান। আর গোটা উৎসবটা ছিলো তার ফরমায়েশ মতো। সেবার এতক্ষণে কুঠির হলঘরে সারেঙ্গী, পাখোয়াজ বাজছে, বাঈজী। নাচছে। ডানকান মদের ঘোরে বোকার মতো হাসছে, বাইজীদের সম্বন্ধে উত্তেজনা গোপন করতে পারছে না। শেষে পিয়েত্রো বলেছিলো তুমি বাঘে বলদে একঘাটে জল খাওয়ালে, হে দেওয়ান।
তারা দেওয়ানকুঠির সিঁড়িতে পা রাখতে হরদয়ালের ভৃত্য পর্দা টেনে ধরে দাঁড়ালো। এটা হয়তো হরদয়ালের পছন্দ যে ভিতরের ও বাইরের আলো এরকম নয়। এটা তার বসবার ঘর যেখানে টিপয়ে রাখা একটা হারিকেনমাত্র স্তিমিত আলো দিচ্ছে। কিন্তু বসবার ঘরে না বসে সে তার লাইব্রেরিতে গেলো। সেখানে জলচৌকির উপরে ঢোলক আকৃতি চকচকে কাঁচের ডোমে উজ্জ্বল মোমের শামাদান। জলচৌকির কাছাকাছি কয়েকটা সোফা, হরদয়ালের নিজের আরামকেদারা।
হরদয়াল বললো–মিস্টার বাগচী, ওরা টেবিল পাততে পাততে ক্ষুধা বাড়াতে একটু চলবে কি? বাগচী কিছু বলার আগে হরদয়াল নিজেই ওয়াইনের বোতল আর গ্লাস নিয়ে এলো। সে তিনটি গ্লাসে ঢাললো। কিন্তু কেট বললো–আমি এ রকম কখনোই খাই না। আপনারা খান। আমি বরং আপনার লাইব্রেরি দেখি। আগে যেমন দেখেছিলাম তার চাইতে বই আর শেলফ দুই-ই বেড়েছে মনে হচ্ছে। সে দেয়াল বরাবর সাজানো শেলফগুলোর দিকে হাঁটতে শুরু করলো। সুতরাং গ্লাস হাতে বাগচী এবং হরদয়াল তাকে অনুসরণ করলো। কেট একবার বললো–দেওয়ানজিকে কিন্তু এই লাইব্রেরিতে না-ঢুকলে বোঝা যায় না।
বিব্রত হরদয়াল বললো–না না, এ সবই রানীর আনুকূল্যে।
বাগচী বললো–কিন্তু বই বাছাই করার রুচি?
হরদয়াল তা সত্ত্বেও বললো–বই আর এত কোথায় আসছে এদেশে যে বাছাই করা হবে। যা পাওয়া যায় তাই কিনে ফেলা হয়।
কেট বললো–বই-এর জন্য টাকা খরচ কিন্তু সংস্কৃতির একটা প্রমাণ।
তারা ঘরের মাঝামাঝি একত্র হলে বাগচী ভাবলো, কালচার, ও হ্যাঁ, কালচার। সে বললো–দেওয়ানজি, রামমোহন রাজার সব বই কি আপনার আছে?
–আপনার কি বিশেষ কোনোটির কথা মনে পড়েছে?
বাগচী বললো–সেই পার্লামেন্টের উদ্দেশে লেখা প্রবন্ধ।
–কোনটি? সেই রিমারস অন দা কলোনাইজেশন অব ইন্ডিয়া বাই ইউরোপীয়ানস?
-তাই হবে নাম। যেটায় রাজা ইংল্যান্ডের কিছু লোককে জমিদার হিসাবে ভারতে স্থায়ী বসবাস করানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
হরদয়াল বললো–ওটা কিন্তু পাণ্ডুলিপিতে আছে। কলকাতায় পেয়ে নকল করে রেখেছিলাম।
-আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়, সেই প্রবন্ধের কি এই উদ্দেশ্য যে সেই ইংরেজ জমিদাররা স্থায়ীভাবে এদেশে বসবাস করলে এ দেশের টাকা এ দেশেই থাকবে, নাকি জ্ঞান বজ্ঞানের প্রসার, ইনডাস্ট্রির প্রসার, এসবের আশাও করেছিলেন।
হরদয়াল বললো–আবার তাহলে পড়তে হবে। যতদূর মনে পড়ে সেসব ছাড়াও ধর্ম এবং সংস্কৃতির কথাও ছিলো। বোধ হয় সংস্কৃতির বিনিময়ও। কিন্তু বিশ বছর আগেকার মত, রাজা কি বর্তমানে মত পরিবর্তন করতেন না? হরদয়াল হাসলো। কিন্তু তার ক্রুর কাছে গাম্ভীর্যও দেখা দিলো। সে ভাবলো, যেমন আজ ডানকানরা এলো না। সে বললো– কলকাতায় কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে ৫৭-৫৮র সেই সব ব্যাপারের পরে ইংল্যান্ডের। লোকেরা দূরে দূরে সরবে।
আলাপটা এগোলো না। টেবিল পাতা হয়েছে এই খবর জানালো হরদয়ালের ভৃত্য। অপেক্ষাকৃত ছোটো টেবিলে প্রকাণ্ড উজ্জ্বল হারিকেন ঘিরে তিনজনের ডিনার। বসা হলে হরদয়াল বললো–এক কাজ করলে হয়; আমাদের খাবারগুলো দিয়ে ওরা যদি চলে যায়, মসেস বাগচীতবে ফ্যামিলি ডিনারের মতো আমাদের সার্ভ করতে পারেন। বেশ ইনফর্মাল হয়।
কেট বললো–নিশ্চয়, সে তো খুব ভালোই হবে।
ভৃত্য ও বাবুর্চি দুজনে সার্ভ করবে স্থির ছিলো। হরদয়াল তাদের ডেকে বললো–তোমরা। কোর্স কটিকে একইসঙ্গে টেবিলে রাখো। মেমসাহেব ব্যবস্থা করবেন। তাছাড়া তোমরা তো এতক্ষণ বেরোতে পারোনি, এবার একটু ঘুরেফিরে আনন্দ করো।
তারা ব্যাপারটাকে আদেশ মনে করেই টেবিল সাজিয়ে দিয়ে চলে গেলে কেটের অসুবিধা হলো। সুপটাকে বোঝা যায়। মাছ ভাজা, মাংসের কারিকে বোঝা যাচ্ছে। লুচি নম্বন্ধেও কিছু জ্ঞান আছে তার। কিন্তু দুটো সুদৃশ্য পাত্রে দুরকমের পোলাও দেখে সে বিব্রত হলো। কোনটা কোন কোর্সে চলবে, কোনটির পরে কোনটি–এটা তাকে চিন্তিত করলো।
তখন হরদয়াল বললো–হোস্টেসের রুচিই আমাদের রুচি।
বাগচী বললো– হাসতে হাসতে-দেখ কেট, বই বাছাই-এর ব্যাপারে দেওয়ানজির রুচির কথা তুলেছিলাম, এবার কিন্তু
সুপের সঙ্গে সঙ্গে রুচির কথাকেই ফিরিয়ে আনলো হরদয়াল। বললো, বলার আগে ভাবলো, যেন নিজের মনের দিকে চেয়ে কিছু অনুভব করার চেষ্টা করলো, তাকে সলজ্জ দেখলো। -আচ্ছা, মিস্টার বাগচী, আপনার কি কখনো এমন হয়েছে যে আপনার ফেভারিট কোনো কবির চাইতে সেদিন অন্য কবিকে ভালো লাগছে।
একটু বুঝিয়ে বলুন।
মনে করুন শেলীর তুলনায় কীটস।
কীটস নিশ্চয়ই বড়ো কবি। বিশেষ কোনো মনের অবস্থায় কাউকে আরো ভালো লাগে যদি অন্যায় কী?
হরদয়াল ভাবলো, তার চিন্তাটা স্বচ্ছ হলো না। সে টেবিলে মন ফেরালো।
কিন্তু কেট মুশকিলে পড়লো। সে নিজে ভেবে ঠিক করতে না-পেরে হরদয়ালকে জিজ্ঞাসা করলো নিরামিষ পোলাও যদি আগে দিই তার সঙ্গে কী দেবো, মাছভাজা কী?
হরদয়াল বললো–সে আর কঠিন কী? কিন্তু সে থমকে যেন মনে করার চেষ্টা করলো। পরে বললো–আমার মনে হয়, সেবার রাজবাড়িতে নিরামিষ দোলমা দিয়ে খেয়েছিলাম। মাছ খেলে সুগন্ধ নষ্ট।
বাগচী হেসে উঠে বললো–দেওয়ানজি, খাওয়ার ব্যাপারে স্মৃতিতে নির্ভর করা সবসময়ে ভালো নয়। তোমার মনে পড়ে, কেট?
কেট বললো–গুড গড, এ কি সে রকম হতে যাচ্ছে নাকি? সে যেন কী? ও, বড়ি! বড়ি
হরদয়াল বললো– কী রকম?
কেট বললো–হরিবল্। সেদিন হেডমাস্টারের খেয়াল হলো নতুন লাঞ্চ খাবে। বোধ হয় ডালের সেই কোণগুলো যাকে বললো– বড়ি। বললো, কিছু করতে হবে না, চাল আর এগুলো একসঙ্গে সিদ্ধ করলে সুগন্ধে ঘরসুদ্ধ ভরে যাবে। বড়োজোর খাওয়ার আগে তেল দিয়ে নিও।
কৌতুক বোধ করে হরদয়াল বললো–আচ্ছা!
কেট বললো–সে কি খেতে পারা যায়? হরিব, স্ট্রেঞ্জ!
বাগচী বললো– কী জানি সে রকম কেন হলো! অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার সেই সাত-আট বছরে এটা ছিল একটা ট্রিট। আমার মনে হয় কিছু একটা মা দিতেন যা আমরা না-জানায় দিতে পারিনি। অবশ্য তখন আমরা খুবই গরীব ছিলাম।
কেট বললো– হেসে-সে জিনিসটার নাম নস্ট্যালজিয়া।
হরদয়াল বললো–ওইসব ভালো লাগা হয়তো বড়ো হলে চলে যায়, তখন স্মৃতিটা থাকে। এ বিষয়ে একটা প্রমাণ দিতে পারি। আমাদের রাজকুমার সবরকমই খান। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি সেদিনও, তিনি উত্তেজিত, বিরক্ত, খুব মন খারাপ করে থাকলে রানী একটা সহজ কৌশল করেন। বলেন, স্নান করে আয়, আমার সঙ্গে খাবি। সে কিন্তু নিরামিষ আর খুবই অল্প আয়োজনের। হরদয়াল হাসলো।
তখনো আতসবাজি শেষ হয়নি, কিংবা সেটা হয়তো শেষ হাউই-গোছার একটি। তার আলো কোনো জানলা দিয়ে টেবিলে এসে পড়লো। সে আলোটা সরে গেলে হরদয়াল নতুন আলাপ খুঁজে নিলো। বললো–মিস্টার বাগচী, নায়েবমশায় থিয়েটারে বলছিলেন তা কি শুনেছিলেন?
–আপনাদের বেতন বৃদ্ধির একটা ব্যাপার ছিলো।
-হ্যাঁ, সেই সময়ের কথাই। সেই নতুন দুটি পদ তৈরীর কথা। দুটির মধ্যে একটি বোধ হয় ধর্ম সম্বন্ধে-দেবত্র আর ওয়াকফ। অন্যটি রাজকুমারের প্রাইভেট সেক্রেটারি।
বাগচী বললো–হ্যাঁ, শুনেছিলাম। রাজবাড়িকে ভালোবাসবে, তার ধরন-ধারণ জানবে, ইংরেজিতে দক্ষ এবং বিশেষ সচ্চরিত্র হতে হবে। ইংরেজিতে দক্ষ মানুষ আজকাল কলকাতায় পাওয়া যায়, সচ্চরিত্র কথাটার ব্যাখ্যা নিয়ে গোলমাল আছে বটে, তবে বোঝা যায় কী বলা হচ্ছে। সে রকম পাওয়া একটু কঠিন। কিন্তু রাজবাড়িকে আপন মনে করবে, তার ধরন-ধারণ জানবে সে-লোক এ গ্রামের বাইরে কোথায়?
হরদয়াল একটু ইতস্তত করে বললো–কথাটা পরে বলবো ভেবেছিলাম, কিন্তু উঠে পড়লো। কিছু মনে যদি না করেন, বলি। প্রকৃতপক্ষে যা বলতে যাচ্ছি তাতে আমার লোকসান, গ্রামেরও ক্ষতি। কিন্তু রানী যেদিন প্রথম এ কথাটা তুলেছিলেন তখন, আমার ধারণা, তার চোখের সামনে আপনি ছিলেন।
বাগচী বলোনা না, এ আপনি কী বলছেন? ইংরেজিতে না-হয় দক্ষতা হয়েছে, আর তা ইংরেজ পরিবারে ত্রিশ বছর কাটিয়ে। কিন্তু অন্য গুণগুলো?
হরদয়াল বললো–আমি আপনাকে এত রাতে মত দিতে বলছিনা, কিন্তু ব্যাপারটা শুনুন। নায়েবমশায় এই এস্টেটে পঞ্চাশ বছর কাজ করছেন। বয়স সত্তর হয়। নিজেকে ক্লান্ত বলছেন। এ অবস্থায় রানীমা একজন কর্মচারীকে সেই পদের উপযুক্ত করে ট্রেনিং দিয়ে নিতে চান। এই প্রাইভেট সেক্রেটারির পদটা একটা স্টেপিং স্টোন। রানীর কথা শুনে আমিও ভেবেছি। স্কুলটার সর্বময় কর্তৃত্ব আপনারই থাকবে। হয়তো হেডমাস্টার অন্য কেউ হবে। আপনি কিউরেটর রূপে থাকতে পারেন। আমার মনে হয়, প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজ এক্ষেত্রে রাজকুমারকে কিছুটা পরামর্শ দেওয়াও বটে।
–কিন্তু রাজবাড়ির ব্যাপার। বাগচী বললো, আমি তো বুঝতেই পারছি না।
হরদয়াল বললো–এটা এমন নয় যে আমরা খাওয়া থামাবো। মিসেস বাগচী, এরপরে আমাদের কী দেবেন?
আমার মনে হয়, আপনি যে রাজকুমারের সঙ্গে আজকাল সন্ধ্যায় গল্পগাছা করেন তা রানী জানেন, আর তা থেকেই আপনাকে নিয়োগ করার কথা রানীর মনে হয়েছে।
হরদয়াল নতুন একটা খালি প্লেট সেকেন্ড কোর্স নেওয়ার জন্য কেটের সামনে বাড়িয়ে ধরলো। বললো–এবার যদি বিরিয়ানি দেন আমি মাছভাজা চাইব। বাগচী সাহেব যদি মাংস নেন আমার আপত্তি নেই। এই বলে সে হাসলো। প্লেটটা নিজের সামনে নামিয়ে নিয়ে মাছের ফর্ক খুঁজে নিয়ে সে খেতে আরম্ভ করে বললো– আবার, এমন হতে পারে, মশাই, রানী লক্ষ্য করেছেন সেই সব আসবে আপনি মদ খান বটে, কিন্তু তা সন্ধ্যার ঠোঁট ভিজানোমাত্র। পাইপ টানেন, তা কদাচিৎ।
বাগচীর মুখে আশঙ্কার চিহ্ন দেখা দিলো। তার উপরে নজর রাখা হচ্ছে এরকম ভেবে সে বিপন্ন বোধ করলো। হরদয়াল হেসে বললো–না, সে রকম নয়। আমাদের সকলকেই এমনভাবে দেখে নেওয়া হয়েছে। শুনেছি। নায়েবমশায় তখন আমিন যখন রানীমার হাতে এস্টেট আসে। বিচার করে তাকে নায়েব-ই-রিয়াসৎ করেছেন।
হেসে বাগচী বললো–দেওয়ানজি, আর কিছু না-হোক, রাজবাড়ির এই একটা ধরন আমার জানা হলো।
হরদয়ালও হেসে উঠলো।
.
০৬.
ডিনার ও ওয়াইন শেষ করে তারা বাইরে এলে হরদয়াল জানতে চাইলে বাগচী আর একবার থিয়েটারের দিকে যেতে চায় কিনা। ঘড়ি দেখে বাগচী বললো– রাত এগারোটা হতে চলে।
তারা সদরদরজার কাছে এসেছিলো। তখনো সেখানে বেশ লোকজন, পালকি, গোরুগাড়ি। বোধ হয় নিমন্ত্রিতরা ফিরে যেতে শুরু করেছে।
হরদয়াল হেসে বললো–রাজবাড়ির আমরা আজ কেউই ঘুমবো না। আপনাদের সঙ্গে খানিকটা চলি।
তারা পথে চলতে শুরু করলে কেট বললো–এঁরা এত রাতে ফিরছেন, পথে বিপদ হতে পারে না?
সম্ভাবনা কম, বললো– হরদয়াল। যতদূর জানি নতুন ঠগী-ঠ্যাঙাড়ের দল তৈরী হয়নি আর।
বাগচী বললো– শ্লীম্যানের কথা বলছেন? এখানে তা হলে ঠগী-ঠ্যাঙাড়ে ছিলো?
হরদয়াল কথাটা বলার আগে হাসলো, একটু দ্বিধা করে বললো–না। বছর চল্লিশ আগেকার কথা। আমদের নায়েবমশায় তখন তশীলদার। তখনকার রাজার হুকুমে বরকন্দাজ নিয়ে পথে নেমেছিলো। লোকে বলে দুই সপ্তাহে দশ দিনে পঞ্চাশজনকে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলো যাদের কিছু তখনো জীবন্ত।
কেট বললো– কী সাংঘাতিক! এই নায়েবমশায়?
বাগচীও চমকে উঠেছিলো। বললো–বটে? না, সে ভদ্রলোক তো হিসাবমতো বছর ত্রিশের একজন তখন। কিন্তু সে-ও ভাবলো, এখন সেই দুর্দম বৈর কি বয়সে নিশ্চিন্ত? হোক ঠ্যাঙাড়ে-ঠগী, তাহলেও সেভাবে বিনা বিচারে শেষ শাস্তি দেয় অতগুলো মানুষকে? সেই নৃশংসভাবে? কিন্তু এটা তো আজকের আবহাওয়া নয়। সে বরং প্রাচীরের উপর দিয়ে আলোয় উজ্জ্বল রাজবাড়ির দিকে লক্ষ্য করে বললো–অনেক খরচ হবে, কী বলেন?
শীতের রাত এগারোটা। অন্ধকার তো বটেই, বাতাসেরও কামড় আছে। সে রাতে উপরন্তু ধোঁয়ানো মশাল ছিলো পথের উপরে এখানে ওখানে। একটা-দুটো ছুটে চলা পালকি, কোথাও কাঁচকোচ শব্দ তুলে গোরুগাড়ি। পায়ে হেঁটে চাঁদরে মাথা মুড়ে পথচারী। অনভিজ্ঞ বাগচী-দম্পতির কাছে কখনো বা স্বপ্নে দেখা এমনই বোধ হতে লাগলো।
হরদয়াল হেসে বললো–আমাদের রানীর এই এক বদনাম আছে, তিনি কৃপণ। কাজেই এ ব্যাপারে হাজার পঞ্চাশের বেশি খরচ হতে দেবে না নায়েবমশায়। হরদয়াল রানীকে কৃপণ বলে বোধহয় মজা পেলো। সে বললো–আপনাকে একটা ব্যাপার বলতে পারি। রানী কয়েকটি ব্যাপারে প্রোটেস্টান্ট কিংবা পিউরিটানদের মতো যেমন নিজের খাওয়াদাওয়া, পূজাটুজা, যেমন টাকা জমানো। আপনি শুনলে অবাক হবেন, জমিদারীর লভ্যাংশের শতকরা প্রায় চল্লিশ দিয়ে প্রতি বছর, বছরে দুবার করে স্টক ইত্যাদি কেনা হয়। রেলের স্টক, কয়লাখাদের ডিবেঞ্চার, বিশেষ কম্পানির কাগজ।
তারা স্কুলবাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছিলো। বাগচী এবার বললো–দেওয়ানজি, আপনার অনুগ্রহের জন্য ধন্যবাদ। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। আপনি কুঠিতে ফিরুন।
হরদয়াল থেমে দাঁড়ালো। হাসিমুখে বললো–গুডনাইট! একটা ভালো ডিনারের জন্য এক নিঃসঙ্গ মানুষের ধন্যবাদ নিন।
একবার বাগচী ফিরে দেখলো, হরদয়াল যেন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু হরদয়ালের অজ্ঞাতসারে তার গতিবিধি লক্ষ্য করা ভালো হবে না মনে করে তারা হাঁটতে লাগলো।
কেট বললো–আশ্চর্য নয়, এই মানুষ, যাকে লোকে বাঘের মতো ভয় পায়, কত কাছে আসতে পারেন অবলীলায়!
বাগচী বললো–কিন্তু, কেট, ওটা কী দেওয়ানজির আদেশ–ওই চাকরিটা নেওয়া?
কেট ব্যাপারটার এরকম ব্যাখ্যা আশা করেনি। সে বিস্মিত হয়ে বললো–তাই মনে করো?
-দেওয়ানজি বলছিলেন রানীমা আমাকে দেখেই পদটির কথা চিন্তা করেছেন।
কেট হাই তুলো। বললো–কিন্তু ওটা কী কথা হলো পিউরিটান সম্বন্ধে?
বাগচী বললো–এরকম কথা আছে বটে। পিউরিটানরা টাকা ধার দিতে আপত্তি করেন! আধ পয়সা সুদ মাপ করাকে দলিলকে সুতরাং সত্যকে অবজ্ঞা করা মনে করেন। বলা হয়, ইংল্যান্ডের ক্যাপিটালের অনেকটা এইসব পিউরিটানের সঞ্চয়।
হরদয়াল চলতে শুরু করে পথচারীদের এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করতে লাগলো। পথচারীরা তাকে চিনতে পারলে কথা বলতে চাইবে, যা তার এখন ভালো লাগবে না।
সে রাজবাড়ির হাতায় পৌঁছালো। সদরদরজা দিয়ে খানিকটা গিয়ে পরে তার কুঠিতে যাওয়ার পথ। সে এক মুহূর্ত যেন দ্বিধা করলো কোনদিকে যাবে। আতসবাজি শেষ হয়েছে, রাজবাড়ির দেয়ালের আলোগুলোও এখন স্তিমিত। তার মন যেন একটা সুখ ও একটা নিরানন্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে নিজেকে শোনালো; কীটসই তো। এতক্ষণ তো কীটই মনে ছিলো। সে হিম ও পরিপক্ক ফলে আনত ঋতু। সেই হেমন্তের কবিতা! মনে মনে কবিতাটা আবৃত্তি করাতে গিয়ে শেষের দিকে পৌঁছে তার মন উদাস হয়ে গেলো।
সে নিজের বাংলোর দিকে চলতে চলতে ভাবলো, সে এখন তার লাইব্রেরিতে যেতে পারে। তার আর কিছুই করার নেই। বলতে পারা যায় সেই প্রথমবারের পর থেকে তার কাজ কমে যাচ্ছিলো। তাহলেও গতবারেও নায়েবমশায় কী হবে কী হবে না তা নিয়ে আলাপ করেছিলো! এবার…প্রথমবার সেই উৎসবে দেওয়ান কুঠিরই যথেষ্ট গুরুত্ব ছিলো। সেই বাঈজীনাচ যা থেকে উঠে গিয়ে পিয়েত্রো বাঘে-বলদে একঘাটে জল খাওয়ানোর কথা বলে সতর্ক করে দিয়েছিলো, দেখো স্ত্রীলোক নিয়ে নাচের আসরে গোল না-হয়। ডানকান ও সদরওয়ালা ডেপুটি দুইয়েরই তখন মদে বেসামাল অবস্থা। সেই রাতেও তার নিঃসঙ্গ মনে হয়েছিলো নিজেকে, কিন্তু পরমুহূর্তেই কর্তব্যের অনেক কোলাহল তার চারিদিকে কৌশল, মন্ত্রণা, ভবিষ্যৎদৃষ্টি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলো।
হরদয়াল তার বসবার ঘরে বসলো। চিন্তার খেই তুলে নিলো একটা। তো, বাগচীকে কিন্তু রাজবাড়ির কাছাকাছি আনলেও বলা যাবে না এই উৎসবটা প্রকৃতপক্ষে সেই একটা ঘটনার উপরে পর্দা টেনে দেওয়া। যেন কিছুই হয়নি বোঝাতে ডানকানকে নিমন্ত্রণ করা। তদন্তে এসেছে এমন সদরওয়ালাকে বিভ্রান্ত করা। বাগচীকে বলা যাবে না রানীর জন্ম বৈশাখে বলেই তার এক নাম বিশখা।
হরদয়াল জামা জুতা খুললো। তৃষ্ণা পেয়েছে তার। ডিনারে মদটা ভালো ছিলো। আর্মেনিটা এই এক ব্যাপারে ঠকায় না। সে উঠে টেবিল থেকে পোর্টের অর্ধসমাপ্ত বোতলটা এবং একটা নতুন গ্লাস নিয়ে ফিরলো। এখন পোর্টই। কলকাতায় এ রকম প্রবাদ, পোর্ট হজমের সাহায্য করে। আবার কলকাতা থেকেই বন্ধু লিখেছে মদ্যপান নিবারণের কথা, যা হয়তো এ মাসের শেষ আধুনিক কথা। ঠোঁটে সেই গাঢ় রঙের মদ তুলে হরদয়াল মনে মনে হাসলো। একেই কী বলে সভ্যতার ফল নাকি? সেনাটকে মদ্যপানকে ধিক্কার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এই, মাইকেল ডাটু মদ ছেড়েছেন কি?
গ্লাসটা শেষ করেও তৃষ্ণা না-মেটায় সে ভাবলো : বোধ হয় বাতাসে যাওয়া আরামের হবে। সে নিজেকে মৃদু ঠাট্টা করে মৃদু হেসে ভাবলো–এত রাতে কীটস আর অট হয় না!
শোবার ঘরে গিয়ে জামাজোড়া খুলে চটি পরে চাদর গায়ে দিতে গিয়ে হাতের সামনে যে শাল পেলো তাই পরে পায়চারির ভঙ্গিতে কুঠি থেকে বার হলো। বাইরের আলো শালে পড়ায় সে ভাবলো, এটা কেন? ভৃত্যদের কাজ। বালাপোষ সরিয়ে তার জায়গায় নতুন কোনো শাল রেখেছে।
আলো অনেক স্তিমিত, তাহলেও এখনো যথেষ্ট, এখনো মানুষজন চলেছে। সদরের পেটা ঘড়িতে বারোটা বাজলো।
শালটা এমারেল্ড রঙের, মহামূল্য তাতে সন্দেহ কী! য্যাকব নিজেই বলেছিলো। আজ সকালের কথাই তো। য্যাকব তার পুটুলি নিয়ে এসে খুলে শালটা বার করে বলেছিলো, এটা, সার, আপনার জন্য। হরদয়াল বলেছিলো, রাখো, রাখো। যা আছে তা পরি কখন? তখন য্যাকব বলেছিলো, রানীমা নিজে পছন্দ করে এটা আপনার জন্য পাঠিয়েছেন। আমার শুধু পৌঁছে দেওয়া।
রাজবাড়ির সেই একটা খিলান বিশেষ আলোকিত। সেখানে কয়েকজন ব্যস্ত সমস্ত দাসদাসীকেও দেখা যাচ্ছে। থিয়েটারের চত্বর পার হয়ে সে পূজামণ্ডপের খিলানটার দিকে গেলো।
আসলে তো মন্দির নয়। রাজবাড়ির অন্দরে ঘোড়া ও পালকি ঢোকার পথ। তারই পাশের দালানে রদবদল করে, দেয়াল তুলে, রেলিং-এ ঘিরে পূজার জায়গা করা হয়েছিলো। প্রথম বার এত আলো ছিলো না। কিন্তু আন্তরিকতা কি বেশি ছিলো? রাজকুমারের বিপদমুক্তির দরুন কৃতজ্ঞতা জানানোর ব্যাকুলতাও ছিলো।
হঠাৎ হরদয়াল স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। চিন্তাটা কোথা থেকে উঠলো ভেবে পেলো না। কিন্তু তা তার মনকে বিবশ করে দিলো। কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হলে সে বরখাস্তই হয়। রানী তাকে দেওয়ান পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন, কিন্তু বিতাড়িত করেননি। কুঠিতে থাকতে দিয়েছেন, তার স্কুলে টাকা দিচ্ছেন, লাইব্রেরির বই কেনার খরচ দিয়ে চলেছেন, সে কি এজন্যই যে রাজকুমারের সেই অপরাধের সংবাদ সে জানে? যে বিবেক সেবার সে বিসর্জন দিয়েছিলো রাজকুমারকে রক্ষা করতে, যার মৃত দেহটাকে যেন সে টেনে চলেছে, তা যেন তাকে অস্থির করে তুলো।
সেই প্রথমবার দেওয়ানকুঠির নাচের আসরের আলো নিবে গেলে সে এরকম মাঝরাতে এই পূজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলো। রানী উঠে এসেছিলেন। পিয়েত্রো ডানকান প্রভৃতি নাচমহলে খুশি হয়েছে জেনে নিয়ে রানী জানিয়েছিলেন পূজা শেষ হতে দেরি আছে। এখন দেওয়ান বিশ্রাম নিতে পারে।
চেহারার বৈশিষ্ট্য বলল, কিংবা বসার ভঙ্গি, অনেক ভিড়ের মধ্যেও তাকে চিনতে পারা যায়। হরদয়াল দেখতে পেলো কিছু দূর থেকেই, দালানের মেঝেতে রানী বসে আছেন। এখানকার আলো চোখ ধাঁধানো নয়। অনেক প্রদীপ, কিন্তু আলোটা কোমল। রানীর পরনে দুধ-গরদের থান, তার চোখ দুটো আয়ত।
দালানের নিচে হরদয়ালের সামনে আট-দশজন মানুষ, তারা পূজায় উৎসাহী। ওপারের রকে পুরনারীদের ভিড় এখনো রেশমে অলঙ্কারে উজ্জ্বল। পুরুষদের মধ্যে একজন কথা বললো। গলার স্বরে নায়েবমশায়কে চিনতে পারা গেলো।
নায়েবমশায় বললো–সব ব্যবস্থা ঠিক করা আছে। দশজন বরকন্দাজ ঘুরে পাহারা দিচ্ছে। এবার আমি যাই।
এ রকম অনুমতি রানীর কাছেই চাওয়া হয়। রানী বললেন–এসো, বাবা।
হরদয়াল তো দেখতেই পাচ্ছে সব ব্যবস্থা ঠিক করা আছে। নায়েবমশায়ের চালটা ধীর, কিন্তু নিশ্চয় ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকে না। বরকন্দাজদের কাঁধে আজ বন্দুক থাকবে।
কী হবে কিছু খোঁজ করে?
কিন্তু রানী উঠলেন। যেখানে নায়েবমশায় দাঁড়িয়ে ছিলো সেদিকে না গিয়ে রেলিং বরাবর সরে এলেন। বললেন–হরদয়াল? এখনো পুজো শেষ হতে ঘণ্টাতিনেক। তুমিও বিশ্রাম নিতে পারো।
আশ্চর্য নয়? হরদয়াল চোখ তুলে তাকালো, যেন ঘোমটা ঘেরা মুখটাতে সে একটু স্পষ্ট করে দেখলো।
রানী ঈষৎ হাসলেন। বললেন–শালটা ঠকায়নি। মানিয়েছে তোমাকে।
.
০৭.
দ্বিতীয় নাটক শেষ হওয়ার কিছু আগেই চিকের আসন থেকে উঠে পড়েছিলো নয়নতারা। সে পূজার কাছে আমন্ত্রিত মহিলাদের রকে গিয়ে বসলো। কে একজন জিজ্ঞাসা করলোনাটক থেকে এলেন? কেমন হচ্ছে নাটক? হচ্ছেই তো, বলে নয়নতারা পাশ কাটালো।
পুরোহিতের ঈষৎ প্রকাশিত মন্ত্রোচ্চারণ দ্রুততর হয়েছে এখন, যেন তা শব্দ ঝংকারের নেশা। মাঝে মাঝে দ্রুত লয়ে ঢাক বেজে উঠছে কিছুক্ষণের জন্য। রাত বেশি হলে তা অনুভূতিতে ধরা পড়ে।
আসল কথা, সারা রাজবাড়ি জুড়ে যে আলো ছিলো তা এখন মৃদু হয়ে আসছে। আলো এখানেও কোমল। সেজন্য বোধহয় স্ত্রীলোকদের ভিড় কচিৎ ঝিকমিক করছে। নয়নতারার মনে নিজের জড়োয়র কণ্ঠীর কথা উঠলো। সেই কবে সেটা রানীমা দিয়েছিলেন নিজে হাতে তুলে।
আলোর দিকে আবার চোখ পড়লো তার। হ্যাঁ, উৎসবই তো। নয়নতারা কিছুক্ষণ যেন এই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসায় ব্যস্ত রইলো যে মশালচিরা আন্দাজ করতে পারে কতটুকু তেলে আলোগুলো কতক্ষণ জ্বলবে, ফলে একবার জ্বেলে দেওয়ার পরে আলোগুলোকে আর উস্কে দেওয়ার দরকার হয় না।
উস্কে দিতে গিয়ে প্রদীপটা নিবে গিয়েছিলো। …কিন্তু তখন অনেক রাত হবে। দরজা খুলে অন্ধকারে রাজকুমারকে দেখে সে অবাক হয়ে গিয়েছিলো। রাজকুমারের চোখ দুটো আয়ত। কোথা থেকে একটা মদির সুঘ্রাণ উঠছে। সে নিজে বলতে পেরেছিল শুধু বসো, রাজকুমার, আমি আসছি। ফিরতে একটু দেরিই হয়েছিলো তার। ফিরে সে দেখেছিলো, রাজু তার বিছানাতে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চিন্ত ঘুমের নিশ্বাসে বুক ওঠা-পড়া করছে। একটু কি হেসেছিলো তখন সে? আর-একটু গাঢ় হোক ঘুম বোধ হয় এই ভেবে সে প্রদীপের সামনে বসে ছিলো। তখন প্রদীপটা উস্কে দিতে গিয়ে নিবিয়ে ফেলেছিলো। বিছানায় গিয়ে রাজকুমারের অধিকার করা বালিশের কোণে মাথা রেখে সেও দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। কী অবুঝ, কী কিশোর, রাজকুমার!
ঢং করে একটা শব্দ হলো। তবে একটা মৃদু প্রতিধ্বনিও উঠলো। রাত একটা হলো পেটাঘড়িতে। কে একজন পানের অভাব অনুভব করলো। পান তখনো নিশ্চয় অনেক থাকতে পারে কিন্তু ততটা রাতে কে আনবে তা জোগাড় করে?
কিন্তু নবকুমার সব জায়গাতেই থাকে। নয়নতারা উঠে দাঁড়িয়ে বললো–দেখছি।
দরবার-হলের পিছন দিকের একটা ঘরেই পান সাজা হচ্ছিলো। আর সেদিকটা, যেন হঠাৎ লক্ষ্য করলো নয়নতারা, যেন জনশূন্য হয়ে এসেছে। ছিঃ নয়নতারা!
নাটক আর পূজার আকর্ষণ তখন দাসদাসীদেরও টেনে নিয়েছে। তা বলে একেবারেই কেউ নেই এমন নয়। দূরে বাঁধানো উঠোনের একপাশে একজন এখনই বঁটা নিয়ে ব্যস্ত। ওদিকের দালানের খিলানের থামের পাশে আর একজন প্রদীপের আলোয় সলতে পাকাচ্ছে, যদি দরকার হয়। পান সাজার ঘরের ঝাড়লণ্ঠনের বেশ কয়েকটা শাখা নিবে গিয়েছে। পানের সরঞ্জামের সামনে একজন দাসী বটে। আলো যেখানে লালমেঝেতে পড়ার ফলে রঙিন, সেখানে দাসীটি পা ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ঘুমোচ্ছে। দরজার কাছে নয়নতারা বললো–শুনছো, ওরা পান চাইছে।
কথটা বলে নয়নতারা সরে এলো। তার ঠোঁট দুটিতে একটা হাসির ভাব ফুটলো। অনেকের ঘুমের ভঙ্গি হাস্যকর।
পূজার দিকটায় গুমোট, এদিকে বরং বাতাস চলছে। খিলান ধরে রাখা থামের আড়ালে টানা দালান, কিন্তু ওখানে পথটা মোড় নিয়েছে দুই দেয়ালের জোড়ে। আর জোড়ের কাছেই দেয়াল। সিঁড়িটা সন্ধ্যার মতো না-হলেও এখনো উজ্জ্বল–যেন খানিকটা জায়গায় দুধ ঢালা। এপারে ওপারে আলো কম। মাঝখানে ওটা যেন স্রোতের ব্যবধান। সাবধানে পার হতে হবে। ঝটিতি আলোটুকু পার হলো নয়নতারা। কিন্তু কোথায়?
একটা সিঁড়ি এখানে নিচের বাঁধানো চত্বরে নেমে গিয়েছে। থামের গায়ে হেলান দিয়ে কে একজন বসে সে-সিঁড়িতে। নয়নতারা চাঁদরের ঘোমটাকে কপাল মুখের দুপাশ ঢেকে ঠোঁটের কোণ পর্যন্ত এগিয়ে আনলো। সিঁড়ির লোকটি মাথা ফেরালো।
শাড়ি ঘিরে এই পশমিনা চাদর যা আর শাল নয়, মোটা বুনোটের যা আধো-অন্ধকারে গড়া থেকে পৃথক নয়। কিন্তু এ কি সত্য প্রত্যেকের হাঁটার ভঙ্গি পৃথক যাতে শুধু হাঁটা দেখে বোঝা যায় কে চলেছে? লোকটি সম্ভবত রূপচাঁদ। হয়তো এখনই জানতে চাইবে নয়নতারাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে কিনা। নয়নতারা দেয়াল ঘেঁষে সেই দেয়ালগিরি পার হয়ে এলো। ছি ছি, নয়নতারা!
চাদরটাকে একটু টেনে নিজের হাত দুখানাকেও ঢাকলো সে। সামনে একটা ছোটো দেয়াল। এখানে পথ বাছাই করতে হবে তাকে। সামনের দেয়ালটার গায়ে তার ছায়া পড়লো। মাথাটা একটু নিচু করে যেন নিজের ছায়াতে ডুবে দেয়ালটার বাঁ পাশ ঘুরে দেয়ালটাকে পার হলো সে, এবং তারই ফলে যেন উপরের মহলে যাওয়ার সিঁড়ির সামনে এসে পড়লো। উপরের মহল, যেখানে রানী এবং রাজকুমারের ঘরগুলি। রানীমা তো এখন পূজার সামনে।
কাচকড়ার দেয়ালগিরি সিঁড়িতে। কাঠের সিঁড়ি। কী অসম্ভব নির্জনতায় চওড়া, পিছল ধাপগুলো চকচক করছে। যাকে ল্যানডিং বলা হয় তার উপরে বেশ খানিকটা আলো। রাজকুমারের ঘরের দরজা ল্যানডিং থেকে একপাক ঘুরলেই। কিন্তু আলোটা কি তার ঘরের? জেগে আছে কেউ?
এ কি নিমন্ত্রিতদের জন্য পান আনতে যাওয়া?
নিশ্বাসে একটা অসমতা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু তাই বা কেন, সে তো এখনো সিঁড়ির গোড়ায়। মানসিক শ্রম? নিশ্বাসের অসমতা তার অনুভূতির ভুল ভাবতে গিয়ে তার অস্ত্রে কোথাও কাঁপন লাগলো। বুকের মধ্যে রক্ত কেমন করছে, সেজন্যই যেন ঠোঁট দুটিও ঈষৎ ফুলে গেলো।
রাজু কি জেগে আছে? এখন তো অনেক রাত, নাকি তার ত্বকেই এটা কাপন। সে নিজেই লক্ষ্য করেছে, রাজু নাটক দেখতে যায়নি।
আসলে–আসলে এইসব বিচিত্র রকমের আলোই দায়ী। ঠিক যেন আলোও নয়। রক্তস্রোতে সেই আলো মিশে গিয়ে কী সব ঘটাতে পারে।
সিঁড়ির গোড়া থেকে ডাইনে কিছু দূরে একটা বড়ো জানালা, নাকি ফ্রেঞ্চ উইনডো বলে। নয়নতারা একটু তাড়াতাড়ি সেদিকে সরে গেলো। সে তো পান নিতে এসেছে। সে বড়ো জানলাটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, আর তখন এক ঝাপটা ঠাণ্ডা বাতাস লাগলো তার কপালে।
কী আশ্চর্য! নিচে কাছারির আঙিনার এদিকে ওদিকে আলো এখন অনেক কম। সদরদরজার নিচে ঝাড়টা বেশ স্পষ্ট। কাছারির বারান্দার দেয়ালগিরি যেগুলো চোখে পড়ছে, প্রদীপের মতো মৃদু। এত সহজে এত তাড়াতাড়ি কেমন একটা পরিবর্তন হয়। রাজবাড়ির দেয়ালের আলো, কাছারির দেয়ালের আলো, সদরদরজার আলো সব মিলে আলোর একটা জাজিম বিছানো ছিলো। যেন বিভিন্ন উৎসের আলো খানিকটা গিয়ে থেমে যাচ্ছে, মধ্যে মধ্যে অন্ধকারের গলিপথ।
জানলাটার নিচে দুধাপ সিঁড়ি।
নয়নতারা নিজের গলার মধ্যে কী অনুভব করলো। যেন তা বাষ্পের মতো, যা থেকে জল হয়। হঠাৎ তার মনে হলো, কেটের অভিনন্দনই তাকে এমন কষ্ট দিচ্ছে। তার বলা উচিত ছিলো, মিথ্যা। আর বুকের মধ্যে যে-চাপ সে তো উপোসের জন্য। মিথ্যা নয়, রাজকুমারের বিয়েতে যে-উৎসব হবে এই উৎসব দিয়ে তার ধারণাই করা যায় না।
উপোস রানীমাও করছেন রাজকুমারের কল্যাণ কামনায়। অনেক বেলায় সে একবার রানীমার চোখে পড়ে গিয়েছিলো। বলেছিলেন, মুখ শুকনো দেখছি, খাওনি তুমি? সে বলেছিলো, রাত হয়ে গেলো, এখন আর খাবো না ভাবছি।
দুটো বাজলো দেউড়িতে। এরই মধ্যে! কৌতুকের তো! শব্দ লক্ষ্য করে অস্পষ্ট হলেও নয়নতারা দেউড়ির সেই বরকন্দাজকে দেখতে পেলো যে ঘড়ি পিটলো।
কিন্তু তিরস্কারে কার না চোখে জল আসে?
ওরা বোধ হয় থিয়েটারের দল যারা মঞ্চের সামনে নেমে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে তুলছে। তাদের শরীরের উপরের দিকটায় কিছু আলো।
তিরস্কার কোথায়? সেই যে ব্রহ্মঠাকুরানী একটা হাসির অঙ্কের ধাঁধা পেতেছিলো।
লোকগুলোর, দ্যাখো, পিঠে আলো পড়ছে। সুতরাং ওই ছোটো ছোটো দলগুলো যা চোখে পড়ছে, যারা দেউড়ির দিকে চলেছে, তারা উৎসব শেষে ঘরে ফেরার দল। দেউড়ির বাইরেও এই রাতেও তাহলে লোক চলেছে। তাদের কেউ কেউ নিশ্চয় সার্বভৌমপাড়ার পথ দিয়ে যাবে।
ফ্রেঞ্চ উইনডোর নিচে সিঁড়িতে পা দিলো নয়নতারা। একটু অসুবিধা হয়ই, ধাপগুলো স্বাভাবিকের চাইতে উঁচু। কিন্তু মাটিতে পা দিয়েই সে তরতর করে হেঁটে চলতে পারছে। কোনো একটা দলের পিছনে পৌঁছে, দলটার পাশ কাটিয়ে একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে তার আগের দলটিকে ধরে, এমন করে একটু তাড়াতাড়ি চলে। শাড়ি-চাঁদরে সে তো নিজেকে ভালো করেই ঢেকে নিয়েছে, সে নিজের বাড়িতে পৌঁছে যেতে পারবে। হলোই বা শেষ রাত।
প্রতিমার সামনে রাখা ঘিয়ের প্রদীপের সারিতে তন্ত্রধার পলতেগুলোকে উস্কে দিলো। পূজা এখন শেষ হতে চলেছে, বোধ হয় যজ্ঞ শুরু হবে। পুরোহিতের কিছু পিছনে যাঁকে প্রতিমার মুখের দিকে চেয়ে স্তব্ধভাবে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে, তিনি রানীমা-ই। এখানে আসবার আগে স্নান করেছিলেন। চুলগুলো ভিজে ছিলো, নির্জনতায় এখন ঘোমটার পাশ দিয়ে সেগুলোকে সামনে এনেছেন। সে চুল অজস্র, আসনের উপরে লুটোচ্ছে।
রানী ভাবলেন : ইনি মহান অর্থাৎ অনন্তকালের প্রতীক। কোটিকে কোটি দিয়ে গুণ করেও অনন্ত হয় না। যাহা হয় তাহা কালেই হয়। কালের বাইরে কিছু হয় না। হওয়া অর্থে জন্ম, বেড়ে ওঠা, মৃত্যু, মিলন, বিচ্ছেদ। আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, অনুভূতিতে ইনি সীমাযুক্তা কিন্তু অনন্ত ব্যাপ্তিতে প্রবাহিতা, সুতরাং জ্ঞান ও অনুভূতি উভয়ের প্রতি উদাস। সুখ কী? দুঃখ কী?
পুরোহিত ঘণ্টা বাজালো মৃদু শব্দ করে। ঝুঁকে পড়ে একমুঠো ফুল নিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো। দ্রুত অস্ফুট স্বরে কিছু বলছে, তার বুকের পাশ দুটো যেন ফেঁপাচ্ছে। দ্যাখো তন্ত্রধারকের গাল বেয়ে ধারা। রানীমা বলেছিলেন বটে, আমার হয়ে অঞ্জলি দিও। সে কি ভয় পাচ্ছে? ফুলের সঙ্গে সঙ্গে ফুলকে প্রতীক করে নিজের চেতনার সীমা দ্বারা আবদ্ধ সব কিছুকে সীমাহীনতায় নিমগ্ন করার ভয়?
.
০৮.
নয়নতারা তার বাড়ির কাছাকাছি এসে একটু আস্তে চলতে শুরু করলো। মৃদু ক্লান্তিও বোধ করছে সে। রাত জাগার ক্লান্তির সঙ্গে উপবাসের লঘুতা। সার্বভৌমপাড়ার এই পথেও দূরে দূরে দু-একজন লোক, গাছের ছায়ায়, আলো-অন্ধকারে চলেছে। শেষ রাতের হিমেল বাতাসে শেষ রাতের মলিন চাঁদের আলোতে পথের ধারের দুএকটা পশ্লব মৃদু মৃদু নড়ছে।
একটু চমকে গেলো সে। একটা মাঝারি চেহারার পালকি নিঃশব্দে, বিনা হাঁকে কিন্তু অস্বাভাবিক দৌড়ে, যেন তার গায়ে এসে পড়তে পারে, সে সরে দাঁড়ানোতে তার পাশ কাটিয়ে উড়ে গেল যেন। একজন ছিপছিপে চেহারার বরকন্দাজই যেন পালকির ওপাশে দৌড়চ্ছে।
নয়নতারা কৌতুক বোধ করলো। কৌতূহলও। এ পথে এখন কে এমন যায় পালকিতে? হতে পারে কোনো জোতদার যে আমন্ত্রণ সেরে ফিরছে। কিন্তু মজা দ্যাখো, হুমহাম নেই বেহারাদের। অবশ্য সে শুনেছে, জোতদাররা রাজবাড়িতে সম্মান দেখাতে রাজার নিজগ্রামে যানবাহনের ব্যবহারে বাহুল্য করে না।
কৌতূহল ও কৌতুক নয়। বিদেশী বাকরীতিতে, বিস্ময় ও ভয়ই তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। সে নিজের বাড়ির দরজায় পা দিয়ে দেখলো, পালকিটা আরো এগিয়ে তার বাড়ির উঠোনে দাওয়া ঘেঁষে নামানো হলো। মলিন নিষ্প্রভ আলো সত্ত্বেও পালকির চতুষ্কোণ গাঢ় ছায়া, বেহারাদের ছায়া কালো ঘন-সন্নিবিষ্ট দীর্ঘতা-চোখের ভুল হতে পারে না। আগের চিন্তার ছায়া পড়লো মনে, কোনো অর্থশালী জোতদার? সঙ্গে সঙ্গে কী এই একটা অনুচ্চারিত শব্দ প্রতিস্পর্ধায় তার সমস্ত চেতনায় ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো।
কিন্তু অন্যপক্ষেরও চোখ ছিলো। সেই ছদ্মবেশী বরকন্দাজ অত্যন্ত দ্রুত নিশব্দে এগিয়ে এলো। সে খুক করে কাশলো। তারপর যেন অব্যক্ত কান্নার শব্দ করলো।
রূপচাঁদ? নয়নতারা বিস্মিত প্রশ্ন করলো।
মা, আপনাকে মা-জি বলেছি সেই কতদিন আগে।
–বেশ তো! তাতে কী হলো?
–ভালোই লাগছিলো। বললেন, চল তো সব ঘুরে দেখি। এ-ঘর ও-ঘর, এখানে আলোর নিচে, ওখানে ছায়ায়, এ মহল, সে মহল, সঙ্গে বেড়াচ্ছিলাম, মনে হলো হাসছেন, মনে হলো কিছু খুঁজছেন, ক্রমশ রেগে যাচ্ছেন, এক জায়গায় হোঁচট খেলেন, তারপরে বললেন, তুই জানিস না, হতভাগা, আমি একা থাকতে পারি না? তারপর বললেন, কোথায় সে? আরো রেগে বললেন, আধ ঘণ্টার মধ্যে যদি তাকে আমার ঘরে না-আনতে পারিস, কাল সকালে তোর মুখ যেন দেখি না।
রাজকুমারের কথা বলছ, রূপচাঁদ?
–অমন রাগের কথা আমি কখনো শুনিনি। মনে হলো, ভয়ঙ্কর রকমে জোর খাটাতে চাইছেন।
-তুমি পালকি এনেছো কেন? গ্রাম ছাড়া হওয়ার ভয়ে?
তর্জন-গর্জন নয়, কিন্তু সে রাগ এতটুকু মিথ্যা নয়।
নয়নতারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো, তারপর কী ভেবে পালকিটার দিকে এগিয়ে গেলোলা। কিন্তু রূপচাঁদই এগিয়ে এসে পালকির দরজা আড়াল করে দাঁড়ালো বরং।
বললো, মা-জি, মনে হলো বে-এক্তিয়ার।
-তুমি যেতে নিষেধ করছো?
–সাধ্য কী আমার? কী সর্বনাশ না-জানি হয়! আমি বরং গ্রাম ছাড়া হই এই রাতেই।
নয়নতারা চাপা গলায় প্রশ্ন করলো–খুব মদ খেয়েছেন নাকি? সে এগিয়ে গিয়ে মৃদু আলোতে পালকির দরজার চকচকে কাঁচের হাতলে হাত রাখলো। রূপচাঁদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো৷নয়নতারা নিজেই পালকির দরজা সরিয়ে হেঁট হয়ে পালকির গদিতে গিয়ে বসলো। দরজা টেনে দেওয়ার আগে বললো–পালকি তুলতে বলল রূপচাঁদ।
কাউকে কাউকে অভ্যাসবশেই মাথা খাটিয়ে চলতে হয়। রাতের শেষ প্রহরে রাজবাড়িতে পালকি করে পৌঁছলে বহু দূর দূর ছড়ানো গল্পের একটা উপকরণ হবে। গল্পটা কী হবে সেটাই আসল কথা। সে পালকির দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে রূপচাঁদকে খুঁজলো। রূপচাঁদ কি লজ্জায় পিছিয়ে পড়েছে? নয়নতারা লজ্জার মতোই কিছু অনুভব করলো, যাকে বরং গ্লানি বলা উচিত। রাজবাড়ির হাতার যে কোনো আলো-নিবে-যাওয়া নির্জন জায়গায় নেমে পালকি আর রূপচাঁদকে বিদায় দেওয়া কি ভালো হবে? রাজবাড়ির সেই জায়গাটা রাজকুমারের মহল থেকে যত দূরে হয় ততই ভালো। রূপচাঁদের কথাতেই প্রমাণ। ব্যাপারটাকে কী অর্থে নেওয়া সম্ভব।
রূপচাঁদের মনও চিন্তামুক্ত ছিলো না। যেমন সে চিন্তার ভারে পিছিয়ে পড়ছিলো তেমন চিন্তার চাপেই এগিয়ে এলো। তখন রাজবাড়ির সদর দরজায় ঝুলানো ঝাড়ের আলো পড়ছে বেহারাদের মুখে।
বেহারারা অদ্ভুতভাবে নিঃশব্দ, তাই রূপচাঁদের চাপা গলা শুনতে পেলো নয়নতারা। আপনি কি পূজার আঙিনায় নামবেন, মা-জি?
এটাই কি ভালো হয়? বেচারারা যদি তাদের অভিজ্ঞতার গল্প করে, বলবে, পূজায় কী দরকার পড়ায় সার্বভৌমপাড়া থেকে নয়ন-ঠাকরুনকে আনতে হয়েছিলো। নয়নতারা ভাবলো, এটা কি একটা ধোঁকা তৈরী করছে রূপচাঁদ? কিংবা সে কি ভাবছে, তার এখন রানীমার কাছে আশ্রয় নেওয়া উচিত? পালকি নিশব্দ হলেও দ্রুতগতি। কী গ্লানি!
নয়নতারা একটু হাসলো যেন, বললো, বলো কী রূপচাঁদ? সেখানে পূজার ভিড়ে কোথায় কোন কাজে আটকে পড়বো। গলার কাছে একটা বাধা। সেটাকে গিলে ফেলে সে বললো–গাড়ি বারান্দা থেকেই রাজকুমারের মহল কাছে হবে।
গাড়িবারান্দার আলোটা যেন বাসি। গাড়ি বারান্দা থেকে হল, হল পার হয়ে ঢাকা অলিন্দ দিয়ে সিঁড়ির ঘর, এখন সব জায়গাতেই আলো কম। আলো থেকে দূরে দূরে যে অন্ধকার তাই বরং গুণবান, তার স্নিগ্ধতা আছে।
সিঁড়ির মাথায় চৌকোণ জায়গাটা যাকে ল্যানডিং বলা হচ্ছে সেখানে একটা আলোর পাত। নয়নতারা সেখানে পৌঁছতে রাজচন্দ্র বলে উঠলো–কে নয়ন? কথা ছিলো।
এখন নয়নতারার অবাক লাগলো যে তার এত নিশব্দ চলার শব্দও রাজকুমার শুনেছে। এই রাতে, রাত যখন শেষ হতে চলেছে, সে জেগে আছে! কিন্তু এসবের আড়াল থেকে তার মনে হলো, কী ঘটেছে যে ঘুমোত পারেনি? কী আশায় জেগে আছে?
একটু সাহসের সঙ্গে আধখোলা দরজাটার কাছে গিয়ে সে বললো–এই দেখুন, সকলের মধ্যে থেকে যদি এমন করে অনুরোধ করবেন?
রাজচন্দ্র বললো, রাজকুমারের মনে থাকে না। কী করি? তুমি যে আমার নয়ন, বড়ো লাজুক। অথচ নিচে ওই যে জনারণ্যে যার কথা হচ্ছে সে কিন্তু বেশ সাহসিকা।
নয়নতারা বললো–ঘুমোননি কেন?
তোমাদের এই উৎসবের এত সোরগোল! এই বলে রাজচন্দ্র সরে এসে নয়নতারার মুখোমুখি দাঁড়ালো, বললো–বাহ কী সুন্দর এই চুল কয়েকটি!
নয়নতারা ভাবলো, কার কথা বলছে রাজু? কে যথেষ্ট সাহসিকা?
রাজচন্দ্র বললো–আর দ্যাখো তো এই রূপসীর কপাল!
নয়নতারা বললো–আপনি কি কোনো পালাগানের কথা ভাবছেন, রাজকুমার?
রাজচন্দ্ৰ হেসে বললল, তুমি কী আজও আবার মনে করিয়ে দেবে বিদ্যা নামে সেকন্যে সাধারণ মানুষী নন?
-আপনি ওরকম করে কথা বলবেন না। আমি বলছিলাম, আজ নিচের চত্বরে নাটক হয়েছে। পালাগান হয়নি।
নয়নতারা ভাবলো, আশ্চর্য নয় কি যে জানলার নিচেই এত সোরগোল তুলে, ভালো হোক মন্দ হোক, একটা নতুন কিছুহলো যার নামনাটক, অথচ রাজকুমার যেন অন্য কোথাও থেকে এইমাত্র এলো! যেন রাজবাড়ির কোথাও ছিলো না!
রাজকুমার বললো–হয়নি? না হোক। কিন্তু তা বলে তোমার চুলগুলি যদি এই রাতের আলোয় কপালে লতিয়ে সুন্দর দেখায়, কেউ কি বলবে না?
–কেউ না বলে, তুমি বলো। না হয়, কাল কোথাও চলো, বেড়াতে যাবো। কিংবা কাল এই প্রাসাদের নানা নির্জন ঘরের যে কোনো একটিতে বসে আমরা সারাদিন গল্প করবো।
কিছু বোঝ না, তুমি নয়ন। আজ তোমাকে দরকার। বরং ভোরবেলায় কাক ডেকে উঠতে যখন তোমাদের পূজার সঙ্গে সঙ্গে উৎসবের রাত্রি শেষ হবে, রানীমা ঘুমোত যাবেন, তখন তাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে তুমিও বাড়ি যেয়ো। বাহ, কাছে এসো।
নয়নতারা নিজের হাতের দিকে চোখ নামালো। কখনো কখনো আঙুলগুলো অশান্ত হয়।
রাজু ল্যানডিং-এর ব্যানিস্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। বললো–তোমার প্রথমবারের উৎসবের কথা মনে আছে নয়ন? সে হাসলো যেন। সকালে উঠে অবাক! কিংবা তখন উঠিনি, ভাবছি এ কোথায়? দেখি, পাশে ঘুমিয়ে আছো তুমি। কী করে যে হয়? একটা রাত ঘুমিয়ে থাকলাম, একটা কথাও হয়নি! কোথা থেকে সুঘ্রাণ আসে?
কথার কি নিজেরই জন্মানোর ক্ষমতা আছে? নয়নতারা বললো, শুনেছি, এক রকম মৃগের ওই দশা হয়।
কিন্তু কথাটা বলে ফেলেই পিছিয়ে এলোয়নতারা, যেন অদৃশ্য কোন গণ্ডি তার পায়ের আঙুলে মুছে গিয়েছে। যেন অদৃশ্য এক পর্দা কিছু সরে গেলো হাত লেগে। এরকম অবস্থায় ভয় ভয় করে ওঠে।
কিংবা খানিকটা ভয় তার ছিলোই, যেজন্য রাজচন্দ্রকে সে ভালো করে দেখেনি। তার মনে হলো, এমন মৃদু সুরার গন্ধ ছিলো সেই প্রথম উৎসবের রাত্রিতে রাজুর মুখে! চোখের প্রান্তগুলো লাল হয়ে উঠেছে। আর যেন টালমাটাল করছে দৃষ্টি। পায়ের ডিম-ছোঁয়া ঢিলে জোব্বা, ঢিলে পালুন, চটি, ধোঁয়াচ্ছে এমন পাইপ বাঁ হাতে, একগোছা চুল কপালের উপরে। বাঁ পায়ের পাৎলুনে রক্ত!
এসো নয়ন, বললো– রাজু।
-কোথায় যাবো? নয়নতারা ভাবলো, রাজকুমরের কাছে গিয়ে কি তাকে অনুরোধ করা যায় ঘুমোতে যেতে?
রাজচন্দ্র ল্যানডিং বরাবর একটু সরলো। এমন কোনো কোনো জায়গা আছে যেখানে দাঁড়ালে কুয়োর গোড়ায় সিঁড়ির শেষ ধাপটা চোখে পড়ে। সেখানে কি কাউকে চোখে পড়লো? কেউ কি সেখানে ক্লান্তিতে বিবশ হয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে?
রাজু বললো–এখন আর আমার কিছু দরকার নেই, রূপচাঁদ। ওদিকেও পুজো শেষ হতে চললো। একবারে স্নান শেষ করে পুজোর কাছ থেকে ঘুরে এসে ঘুমোবো। তুমি ওদের ভোররাতেই গরম জল দিতে বলল।
রাজু ব্যানিস্টার থেকে সরে এলো। তার কি তখন পা টললো?
নয়নতারা বললো–কোথাও যাবে বললে?
রাজু এগিয়ে গিয়ে তার শোবার ঘরের দরজা খুললো। ঘরে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে তামাকের থলে বার করতেই নয়নতারা বললো–খুব হয়েছে! ভালো হয়েছে বাগচী মাস্টারের শিক্ষা। কিন্তু এখন অনেক রাত। রাজু পাইপ থেকে ভস্মাবশেষ গালিচার উপরেই ঢালছিলো, হাত বাড়িয়ে পাইপটা নয়নতারার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো–নাও।
রাজকুমার হেঁটে গিয়ে চেয়ারে বসলো। পিছন দিকে যেন আর একটু ঘেঁষে বসলো। কিন্তু এই চোখে কি ঘুম আসে? ইস্পাত হলে তা সাদা হতে হবে এমন নয়, নীলাভ হতে পারে। প্রান্তগুলো লাল, কোলে কালিমা।
নয়নতারা বললো–এই তামাকই ঘুম তাড়িয়েছে।
রাজু চোখ মেলে চাইলো। নয়নতারাই বরং চোখ নামালো। রাজু হাসলো। অনুচ্চ, কিন্তু তা যেন সেই গ্রামের তুলনায় তরল। যেন কয়েকটি কাঁচের গুলি একসঙ্গে গড়িয়ে গেলো। সে বললো–বলো এখন কী করি? কিংবা দ্যাখো আমাদের দুজনকে ঘিরে কেমন নিস্তব্ধ অগাধ রাত্রি এই মহলে। তুমি কি ওই দেয়ালগিরি দুটোকে নিবিয়ে দেবে?
নয়নতারা জিজ্ঞাসা করলো–তুমি এতক্ষণ কী করছিলে, রাজকুমার?
রাজকুমার বললো–সে এক ভারি মজার ব্যাপার! রূপচাঁদকে সঙ্গে নিয়ে রাজবাড়ির নিরাপত্তা পরীক্ষা করতে বেরিয়েছিলাম। (মুখটা কঠিন হলো যেন)। রূপচাঁদ হয়তো গুলি খেয়েছিলো, আমি মদ ছাড়া কিছু খাইনি। জানো, একবার রূপচাঁদকে জিজ্ঞাসা করলাম, বল তো কোন ঘরটা মানায় নয়নকে?
-কিন্তু তার জন্য রাত জাগতে হবে কেন?
বাহ, অন্যান্য দিন দেখার সুবিধা কোথায়? লোকজনে আসবাবপত্রে গিস্ গি করে? জানো, অনেক কিছু জানতাম না এই রাজবাড়ির। জানো, রূপচাঁদ ক্রীতদাস? জানতে না তো? রাজু হাসলো।
-এতে হাসির কিছু নেই।
নেই? জানো রূপচাঁদের উপরে খুশি হয়ে বললাম, বাগচীমাস্টার বলেছে আইনে আর ক্রীতদাস রাখা যায় না। তুই তোর লখনউ-এ ফিরে যা। তাতে ও যেন কাদলো। নাকি আমি ভয় পেলাম। ওর চোখ দুটো ভিতরে ঢুকে গেলো যেন মড়ার খুলিতে। বললো, রাজবাড়ির বাইরে যেতে তার খুব লজ্জা করবে। আচ্ছা, আমি ঠিক উচ্চারণ করছি তো কথাগুলো?
এ রকম ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না, রাজকুমার। আমাকে কি তোমার কাছে যেতে দেবে? পা-টা একটু দেখবো।
-আসলে রূপচাঁদ ঠিকই বলেছে। আমাকে যদি কেউ রাজবাড়ির বাইরে যেতে বলে আমারও লজ্জা করবে।
-তুমি কি আজকাল রূপচাঁদের সঙ্গে তুলনা করছে নিজেকে?
কী যে বলো! রূপচাঁদ গুলি খায়! উ-উ, লাগে!
–একটু স্নানের ঘরে এসো। পা-টা ধোয়া দরকার।
-আচ্ছা, নয়ন, তেলাপোকাকে শুড় নাড়তে দেখেছো? আমার নিজেরই মনে হলো আজ তা দেখে-পণ্ডিতরা বলেন, তা করে নাকি ওরা বুঝতে চেষ্টা করে কোথায় আছে।
কথাটা অসংলগ্ন হলো। এই শীতের ভোররাতে তোমার তেলাপোকা আবিষ্কারে। উৎসাহ বোধ করছি না।
রাগ কোরো না। আমি রাজবাড়িটাকে মেপে দেখছিলাম মনে মনে। রাজকুমারের দৃষ্টিটা হঠাৎ যেন গম্ভীর হলো। সে বললো, গোড়াতে ছিলো না। পরে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মনে হলো, আমার মা, আমার নয়নতারা, আমার গ্রাম, আমার বাড়ি তার মধ্যে ঠিক যেন আমি কোথায় বুঝতে পারছিলাম না। জানো, আর বিদ্রোহ হবে না।
নয়নতারা বললো–তাও ভালো, আমি ভাবি নতুন রানী এলে তার জন্য প্রাসাদের কোথায় কী বদলাবে তাই দেখতে ঘুরছিলে।
মধুর রসিকতাটার উত্তর দিতেই যেন অভ্যাসবশে মুখটা তুলো রাজকুমার, কিন্তু উত্তরের মুহূর্তটা পার হয়ে গেলো।
নয়নতারা ভাবলো, কিছু কি দুশ্চিন্তা করতে হবে রাজকুমারের জন্য? এগুলো কি নেশার ঘোরের গোপনে জেগে ওঠা কোনো ব্যথা?
নয়নতারা বললো– রাজু, আমি তোমার বিছানায় বসলে কি তোমার ঘুম হবে?
রাজচন্দ্র বললো–না বোধ হয়। তার চাইতে চলো তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিই। অন্ধকারে খানিকটা হাঁটা হবে।
দরজায় এখন ইংরেজি কায়দায় গা-তালা। নয়নতারা চাবি ঘুরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। বললো–পকেটে হাত দিচ্ছো? তামুক খেতে ভালো লাগবে?
না, রাজকুমার বললো, গলার ভেতরটা যেন শুকিয়ে উঠেছে।
–একটু মদ খেলে কি হয়? কিংবা রাত শেষ হতে এখনো দুঘণ্টা বাকি।
-আমরা বরং…রাজু উঠলো। একটা জানালার কাছে গিয়ে সেটাকে খুললো। ফিরে দাঁড়িয়ে হাসলো। বললো, এমনকী রানীমার এই জন্মতিথি-উৎসবের মূলেও
নয়নতারা বললো–ঘটনাটা আমি জানি। তুমি আমাকে জানতে দিয়েছে। কী ভাবছে বুঝতে পারছি না। তোমার এই জবরজং জোব্বাটা খুলে দিই?
-তুমি তো জানবেই। তোমাকে বলতে পেরে ভারমুক্ত হয়েছিলাম। আর কী লজ্জা, বলল, তুমি সেই ভার নিয়ে একজনকে রাজকুমার করে ফেললে।
নয়নতারা বললো–এই উৎসবটার উৎসব হিসাবেও মূল্য আছে। সে হালকা সুরে বললো। প্রিয়জনের কল্যাণে অনেক কিছু করতে হয়। জানো, সেসব শুনে আমিও স্থির করে রেখেছি, মানুষের পানীয় জলের জন্য একটা পুকুর কাটিয়ে দেবো।
রাজচন্দ্ৰ নয়নতারার দিকে সরে এলো। যেন নয়নতারা কী বললো– তা ভালো করে বুঝতে! বললো– হেসে-এই, দ্যাখো, নৈনা, তুমিও একজনের পাপ স্খলনের চেষ্টায় আছে। একটি প্রাণ হরণ করে অন্য অনেক প্রাণ পোষণ করলে শোধ হয়?
নয়নতারা ভাবলো, এখনই রাজকুমার বললো, আর কোনো বিদ্রোহ হবে না। এমন জায়গায় কথাটা বলা হয়েছে যে মনে হবে আর একটা বিদ্রোহ হলে সে নিজেকে খুঁজে পায়, রাজবাড়ির ঘরে ঘরে নিজেকে খুঁজতে হয় না। আর তখন, নয়নতারার মনে পড়লো, সেই কিশোর রাজুকে সে বলেছিলো, যেহেতু রাজা অনেক আত্মসম্মানের প্রতীক, সেহেতু রাজাকে নিজের আত্মসম্মান রক্ষায় নির্দয় হতে হয়। সে ভাবলো, মরেলগঞ্জের কটুভাষী সেই তহশীলদারকে হত্যা করার ব্যাপারটাই তো রাজকুমারের মনে। তা হতেই পারে। এই জন্মতিথির উৎসব তো সেই নরহত্যাকে আলোর আড়ালে লুকিয়ে ফেলতেই শুরু করা হয়েছিলো। কিন্তু তাকে কি নিরর্থক আর ভয়ঙ্কর বোঝা বলে মনে হয়, যদি একজন নিজেকে আর রাজা মনে করতে না পারে! সে মনে মনে বললো, ঈশ্বর সাক্ষী, আমি তোমাকে ঠকাই নি। তখন সেই বিদ্রোহের আয়োজনে তোমাকে রাজকুমারই মনে হতো।
ব্যাকুল হয়ে বললো–রাজু, এসব তুমি ভাবছো কেন? রাজু।
নয়ন।
নয়নতারা মুখ নামালো। রাজু হাসলো। বললো–নয়ন, একবার এক বোকাছেলে তোমাকে নিজের আংটি দিয়ে তোমার আংটি নিয়েছিলো। মুখ ভোলো। এই জানলাটার পাশে আসবে, নয়ন?
নয়নতারা বললো–রাজু তোমার জোব্বাটা খোলো। বিছানায় এসো। আমি চুল খুলে দিচ্ছি।
খাটের বাজু ধরে দাঁড়ালো নয়নতারা। তারপর সে বিছানার এক প্রান্তে বসলো। রাজচন্দ্র তার সামনে এসে দাঁড়ালো। কোথা থেকে মুখে একটা হালকা হাসি আনলো, বললো–এ কী নয়ন? তোমার চোখের কোণগুলিতে মুক্তো? এসব কথা তুলে আমি অন্যায় করেছি। আমাকে মাপ করো। জানো, একা একা আমার মনে হতে লাগলো, সেই একটা মানুষ একটা গুলিতে মাটিতে পড়ে কেমন হাহাকার করেছিলো! তুমি দেখো, তুমি দেখো, এই রাত্রির প্রভাব রাত্রি শেষ হতেই শেষ হবে। তুমি মুখ তোলো, ওই জল আমার সহ্য হয় না।
নয়নতারা বললো–তোমার মদ তো এ ঘরেই থাকে, কোথায় আছে বলো।
-এঃ? রাজচন্দ্র বললো।
নয়নতারা ভাবলো, সারাদিন নির্জলা উপবাস করেই বোধ হয় তার এরকম বোধ হচ্ছে। কেমন যেন ছায়া-ছায়া নয়? অথচ দ্যাখো, রাজকুমার বিদেশী এই জবরজং পোশাকের দু পকেটে হাত দিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে। এমন তো নয় যে সে ভুলে যাবে কী করে শেষ রাতে সে নিজে এ ঘরে এসে পৌঁছলো। এটা কি এক অভিনয়ের পোশাক? কিংবা কিংবা এটাই কি একমাত্র কিছু যা রাজকুমারকে এই বর্তমানের, এই বাস্তবের অস্তিত্বে ধরে রাখছে? এমন উপবাস ভালো হয়নি। ভয় ভয় করে উঠলো তার। রানীমা কিংবা পিয়েত্রোর সম্ভাব্য বিদ্রোহের নায়ক, তার নিজের এক কাল্পনিক সিংহাসনের রাজার অস্তিত্ব থেকে সরে এসে রাজকুমার কি সত্যই অতীত এবং বায়বীয় হতে পারে? এগুলোর চাইতে বিষণ্ণ আর কী আছে?
উৎসবের রাত্রিতে তখন নিদ্রা ও বিশ্রামের শ্লথতা লেগেছে। জানলার নিচে তখন আলোর তুলনায় কোমল শীতল অন্ধকার। কালো আকাশে অজস্র হীরার টুকরার মতো তারা। হঠাৎ আবার সাড়াজাগানো ঢাকের শব্দ কানে এলো। রাজচন্দ্র বললো–দ্যাখো, দ্যাখো নয়ন, এ আবার কী জুলুস!
মশাল, পুরোহিত, ঢাক–কোথাও যাচ্ছে, সদরদরজার কাছে দেখা গেলো।
নয়নতারা উঠে এলো। রাজচন্দ্র বললো– বুঝেছি, শেয়ালকে দিতে যাচ্ছে। তাহলে যজ্ঞ শুরু হতে দেরি নেই। জানো, নয়ন, এবার উৎসবে আমার কী লাভ? রানীমা এবার আমাকে কী উপহার দিচ্ছেন? বিশেষভাবে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ একজন সবসময়ের সহচর থাকবে। নাকি প্রাইভেট সেক্রেটারি। ছোটোলাট, বডোলাট, জঙ্গি লাট সকলেরই নাকি একজন করে থাকে। রানীমার প্রস্তাব। নায়েব-ই-রিয়াসত মন্তব্যের জন্য আমাকে পাঠিয়েছিলেন। লিখে দিলাম, আপত্তি নেই।
নয়নতারা ভাবলো, কী বিষঃ রাজু! আর এ বিষণ্ণতার মধ্যে দ্যাখো ঠাট্টা যেন অপমানের মতো।
রাজু বললো–নয়ন, আমাকে মার্জনা করো। চলো না-হয় পুজোর কাছে।
নয়নতারা ভাবলো, আর আমি নিজে সময় নিয়ে অঙ্ক কষছি যেন কোন ব্রহ্মা-ঠাকরুনের অঙ্কের হিসাবে পৃথিবী চলে। এদিকে এখনই ভাবছিলাম (অনুভূতিকে ভাবনা মনে হলো), রাজু সময়ের তলায় তলিয়ে গেলো, আমরা আর-সকলে যখন অনায়াসে ভাবছি।
কিন্তু সে হাসলো, যেমন করে সেই পারে। উঠে দাঁড়াতেই তার চুলগুলো পিঠের উপরে ছড়িয়ে পড়লো। রাত জাগার কাজল চোখে, চোখ দুটো ঝিকমিক করলো। বললো, তুমি এখন ঘুমোবেনা বুঝতে পারছি। আমি এখন পুজোর কাছে যাবো। তুমি আসবে? কিংবা কিছুক্ষণ পরে তোমাকে ডাকতে পাঠাবো কাউকে।
সে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুললো।