॥ ১০ ॥
ফেলুদা ফিরেছে কখন জানি না। আমি যখন উঠে নীচে নেমেছি, তখন ওর ঘরের দরজা বন্ধ; তখন বেজেছে সোয়া সাতটা। বুঝলাম দু রাত না ঘুমিয়ে সকালে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে।
ন’টার সময় ও দরজা খুলল। ফিটফাট দাড়ি কামানো চেহারা, চোখে-মুখে কোনও ক্লান্তির ছাপ নেই। বুড়ো আঙুল নেড়ে বুঝিয়ে দিল রাত্রে কিছু ঘটেনি।
সাড়ে ন’টায় জটায়ু এলেন।
‘দেখুন তো কীরকম জিনিস।’
জটায়ু তাঁর কথামতো তাঁর ঠাকুরদাদার ঘড়িটা নিয়ে এসেছেন। রুপোর ট্যাঁকঘড়ি, তার সঙ্গে ঝুলছে রুপোর চেন।
‘বাঃ, দিব্যি জিনিস,’ ঘড়িটা হাতে নিয়ে বলল ফেলুদা। ‘কুককেলভির বেশ নাম ছিল এককালে।’
‘কিন্তু সে জিনিস তো হল না’—আক্ষেপের সুরে বললেন লালমোহনবাবু। ‘এ তো কলকাতায় তৈরি ঘড়ি।’
‘কিন্তু আপনি সত্যিই এটা আমাকে দিচ্ছেন?’
‘উইথ মাই ব্লেসিংস অ্যান্ড বেস্ট কম্প্লিমেন্টস। আপনার চেয়ে সাড়ে তিন বছরের বড় আমি, সুতরাং আমার কাছ থেকে আশীর্বাদ নিতে আপনার আপত্তি নেই নিশ্চয়ই।’
ফেলুদা ঘড়িটাকে রুমালে মুড়ে পকেটে রেখে টেলিফোনের দিকে এগোল। কিন্তু ডায়াল করার আগেই রাস্তার দিকের দরজার কড়াটায় নাড়া পড়ল।
খুলে দেখি গিরীনবাবু। ইনি কাল হিন্ট দিলেও, সত্যি করে যে আসবেন, আর এত তাড়াতাড়ি আসবেন, সেটা ভাবিনি। কাজে বেরিয়েছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে। পোশাক দেখে—কোট প্যান্ট, হাতে একটা ব্রিফকেস।
‘টেলিফোনে দশ মিনিট ডায়াল করেও লাইন পেলাম না। কিছু মনে করবেন না।’ ভদ্রলোকের হাবভাব চনমনে, নাভাস।
‘মনে করবার কিছু নেই। টেলিফোন তো না থাকারই সামিল। কী ব্যাপার বলুন।’
ভদ্রলোক সোফায় না বসে একটা চেয়ারে বসলেন। আমি আর জটায়ু তক্তপোষে, ফেলুদা সোফায়।
‘কার কাছে যাওয়া উচিত ঠিক বুঝতে পারছিলাম না’, রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন গিরীন বিশ্বাস, ‘পুলিশের ওপর খুব ভরসা নেই, ফ্র্যাঙ্কলি বলছি। ঘটনাচক্রে আপনি যখন এসেই পড়লেন…’
‘সমস্যাটা কী?’
গিরীনবাবু গলা খাক্রে নিলেন। তারপর বললেন, ‘দাদার মাথায় গাছ পড়েনি।’
আমরা তিনজনেই চুপ, ভদ্রলোকও কথাটা বলে চুপ।
‘তা হলে?’ প্রশ্ন করল ফেলুদা।
‘মাথায় বাড়ি মেরে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল তাকে।’
ফেলুদা শান্তভাবে চারমিনারের প্যাকেটটা ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিলে তিনি প্রত্যাখ্যান করাতে সে নিজের জন্য একটা বার করে বলল, ‘কিন্তু আপনার দাদা নিজে যে বললেন গাছ পড়েছিল।’
‘তার কারণ দাদা মরে গেলেও তার নিজের ছেলের নাম প্রকাশ করবে না।’
‘নিজের ছেলে?’
‘প্রশান্ত। বড় ছেলে। ছোটটি বিলেতে।’
‘কী করে প্রশান্ত?’
‘কী না-করে সেইটে জিজ্ঞেস করুন। যত রকম গর্হিত কাজ হতে পারে। গত তিন-চার বছরে এই পরিবর্তন। দাদা দুই ভাইকে সমান ভাগ দিয়ে উইল করেছিল। বউদি মারা গেছেন সেভেনটিতে। মাসখানেক আগে দাদা প্রশান্ত-র ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে তাকে শাসায়; বলে তাকে উইলচ্যুত করবে, সব টাকা সুশান্তকে দিয়ে দেবে।’
‘প্রশান্ত আপনাদের বাড়িতেই থাকে তো?’
‘থাকার অধিকার আছে, তার জন্য ঘর আছে আলাদা, তবে থাকে না। কোথায় থাকে বলা শক্ত। তার দল আছে। জঘন্যতম টাইপের গুণ্ডা সব। আমার বিশ্বাস সেদিন ও খুনই করে ফেলত, যদি না সাংঘাতিক ঝড়টা এসে পড়ত।’
‘আপনার দাদা এ বিষয় কী বলেন?’
‘দাদা বলছে সত্যই গাছ পড়েছিল। সে জেনে-শুনেও বিশ্বাস করতে চাইছে না যে তার ছেলে তার মাথার জখমের জন্য দায়ী। কিন্তু দাদা যাই বলুক না কেন— আমার নিজের ভাইপো হলেও বলছি—আপনি একটা কিছু বিহিত না করলে সে আবার খুনের চেষ্টা দেখবে।’
‘নরেনবাবু যদি নতুন উইল করেন তা হলে তো আর তার ছেলের তাকে খুন করে কোনও আর্থিক লাভ হবে না।’
‘আর্থিক লাভটাই কি বড় কথা মিস্টার মিত্তির? সে তো খেপে গিয়েও খুন করতে পারে। প্রতিশোধের জন্য কি মানুষ খুন করে না?—আর দাদা উইল চেঞ্জ করবে না। তার মাথার ঠিক নেই। অপত্যস্নেহ যে কদ্দূর যেতে পারে তা আপনি জানেন না মিস্টার মিত্তির। এ ক’দিন আমি বাড়িতেই ছিলাম, কিন্তু আজ আমাকে একটু কলকাতার বাইরে যেতে হচ্ছে দু-তিন দিনের জন্য, ব্যবসার কাজে। তাই আপনার কাছে এলাম। আপনি যদি ব্যাপারটা…’
‘মিস্টার বিশ্বাস,’ ফেলুদা প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা ছাইটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে বলল, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আমি আরেকটা তদন্তে জড়িয়ে পড়েছি। আপনার দাদার প্রোটেকশনের একটা ব্যবস্থা করা উচিত নিশ্চয়ই, কিন্তু এটাও ঠিক যে তিনি নিজেই যদি জোর গলায় বলেন যে তাঁর মাথায় গাছ পড়েছিল, তাঁকে কেউ হত্যা করার চেষ্টা করেনি—তা হলে পুলিশের বাবাও কিছু করতে পারবে না।’
গিরীনবাবু অনেকদিন-পরে-রোদ-ওঠা সকালের মেজাজটা বিগড়ে দিয়ে বিদায় নিলেন।
‘বিচিত্র ব্যাপার’, বলে ফেলুদা সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে টেলিফোনে নম্বর ডায়াল করল।
‘হ্যালো, সুহৃদ? আমি ফেলু বলছি রে…’
সুহৃদ সেনগুপ্ত ফেলুদার সঙ্গে কলেজে পড়ত এটা আমি জানি।
‘শোন—তোর বাড়িতে একটা প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনের শতবার্ষিকী সংখ্যা দেখেছিলাম—তোর দাদার কপি—যদ্দূর মনে হয় পঞ্চান্নতে বেরিয়েছিল—সেটা আছে এখনও?…বেশ, ওটা তুই বেরোবার সময় তোর চাকরের হাতে রেখে যাস, আমি দশটা-সাড়ে দশটা নাগাত গিয়ে নিয়ে আসব…’
আমরা চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তিন জায়গায় যাবার আছে ফেলুদার— নরেনবাবু, বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ড আর পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান। নরেনবাবু শুনে একটু অবাক হলাম। ফেলুদাকে বলতে বলল, ‘গিরীনবাবুকে মুখে যাই বলি না কেন, ওঁর কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছি না। কাজেই একবার যাওয়া দরকার। তৃতীয় জায়গাটায় তাদের না গেলেও চলবে, তবে রাত্রের পাহারাটায় আজ ভাবছি তোদের নিয়ে যাব। গোরস্থানে মাঝরাত্তিরের অ্যাটমোসফিয়ারটা অনুভব না করা মানে একটা অসামান্য অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হওয়া।’
‘জয় মা সন্তোষী,’ বললেন লালমোহনবাবু। তারপর মাঝপথে একবার বললেন, ‘মশাই, সান অফ টারজনের মতো সান অফ সন্তোষী করা যায় না?’— বুঝলাম পুলক ঘোষালের অফারটা নিয়ে ভদ্রলোক এখনও ভাবা শেষ করেননি।
নরেনবাবু যদিও শরীরের দিক দিয়ে অনেকটা সুস্থ—বললেন ব্যথা-ট্যথা প্রায় সেরে গেছে, কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যান্ডেজ খুলবেন—তবু ওঁর চাহনিটা ভাল লাগল না। কেমন যেন শুকনো, বিষণ্ণ ভাব।
‘আপনাকে শুধু দু-একটা প্রশ্ন করার আছে,’ বলল ফেলুদা, ‘বেশি সময় নেব না।’
ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে একটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না—আপনি কি কোনও তদন্ত চালাচ্ছেন? আপনি গোয়েন্দা জেনেই এ প্রশ্নটা করছি।’
‘আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন’, বলল ফেলুদা। ‘সে ব্যাপারে প্রচুর সাহায্য হবে যদি আপনি সত্য গোপন না করেন।’
ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করলেন। অনেক সময় যন্ত্রণাবোধ করলে সেটাকে সহ্য করার চেষ্টায় মানুষে যেভাবে চোখ বন্ধ করে এও সেই রকম। মনে হল উনি আন্দাজ করেছেন যে ফেলুদার জেরাটা ওঁর পক্ষে কষ্টকর হবে। ফেলুদা বলল, ‘আপনি হাসপাতালে জ্ঞান হবার পরমুহূর্তে উইল সম্পর্কে কিছু বলতে চাইছিলেন।’
নরেনবাবু সেইভাবেই চোখ বন্ধ করে রইলেন।
‘উইলের উল্লেখ কেন সে সম্বন্ধে একটু আলোকপাত করবেন কি?’
এবার নরেন বিশ্বাস চোখ খুললেন। তার ঠোঁট নড়ল, কাঁপল, তারপর কথা বেরোল।
‘আমি আপনার কথার জবাব দিতে বাধ্য নই নিশ্চয়ই?’
‘নিশ্চয়ই না।’
‘তা হলে দেব না।’
ফেলুদা কয়েক মুহূর্ত চুপ। আমরা সবাই চুপ। নরেনবাবু দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েছেন।
‘বেশ আমি অন্য প্রশ্ন করছি,’ বলল ফেলুদা।
‘জবাব দেওয়া না-দেওয়ার অধিকার কিন্তু আমার।’
‘একশোবার।’
‘বলুন।’
‘ভিক্টোরিয়া কে?’
‘ভিক- টোরিয়া…?’
‘এখানে বলে রাখি আমি একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছি। আপনার ব্যাগের ভিতরের কাগজপত্র আমি দেখেছি। তাতে একটি স্লিপ-এ—’
‘ও হো হো!’—ভদ্রলোক আমাদের বেশ চমকে দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়লেন।—‘ও তো মান্ধাতার আমলের ব্যাপার! আমিও প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি তখনও চাকরিতে। এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কাজ করত আমাদের আপিসে—নর্টন—জিমি নর্টন। বললে তার ঠাকুমার লেখা গুচ্ছের চিঠি রয়েছে তাদের বাড়িতে। সে চিঠি আমি চোখেই দেখিনি। এই ঠাকুমা নাকি মিউটিনির সময় বহরমপুরে ছিলেন—তখন পাঁচ-সাত বছর বয়স। চিঠিগুলো পরে লেখা, কিন্তু তাতে তার ছেলেবেলার অভিজ্ঞতার কথা আছে। আজকাল তো এসব নিয়ে বই-টই খুব বেরোচ্ছে, তাই নর্টনকে বলেছিলাম কিছু বিলিতি পাবলিশারের নাম দিয়ে দেব। সে নিজে এসব ব্যাপারে একেবারে আনাড়ি। দাঁড়ান—কাগজটা বার করি।’
নরেনবাবু বাঁ হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপরের দেরাজটা খুলে ব্যাগ থেকে তার স্লিপটা বার করলেন।
‘এই যে—বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ড। ওকে বলতে চেয়েছিলুম খোঁজ করে দেখতে পারে, ওখানে ওর ঠাকুরমার কোনও ছবি পাওয়া যায় কি না। আর এই যে সব পাবলিশারের নামের আদ্যক্ষর। এ কাগজ আর তাকে দেওয়া হয়নি, কারণ নর্টনের জনডিস হয়। দেড়মাস ট্রিটমেন্টে ছিল, তারপর চাকরি ছেড়ে দেয়।’
ফেলুদা উঠে পড়ল। ‘ঠিক আছে, মিস্টার বিশ্বাস—শুধু একটা ব্যাপারে আক্ষেপ প্রকাশ না করে পারছি না।’
‘কী ব্যাপার?’
‘আপনি ভবিষ্যতে কোনও লাইব্রেরির কোনও বই বা পত্রিকা থেকে কিছু ছিঁড়ে বা কেটে নেবেন না। এটা আমার অনুরোধ। আসি।’
ঘর থেকে বেরোবার সময় ভদ্রলোক আর আমাদের মুখের দিকে চাইতে পারলেন না।
বেণীনন্দন স্ট্রিটের সুহৃদ সেনগুপ্তের চাকর একটা ঢাউস বই এনে ফেলুদাকে দিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনের শতবার্ষিকী সংখ্যা। সেটা ফেলুদা সারা রাস্তা কেন যে এত মন দিয়ে দেখল, আর দেখতে দেখতে কেন যে বার তিনেক ‘বোঝো ব্যাপারখানা’ বলল সেটা বুঝতে পারলাম না।
বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ডে ঢুকে ফেলুদা দশ মিনিটের মধ্যে একটা বড় লাল খাম নিয়ে বেরিয়ে এল। দেখেই বোঝা যায় তার মধ্যে বড় সাইজের ফোটো রয়েছে।
‘কীসের ছবি আনলেন মশাই?’ জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
‘মিউটিনি,’ বলল ফেলুদা। আমি আর লালমোহনবাবু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। ফেলুদার কথার মানে ছবিগুলো নট ফর দ্য পাবলিক।
‘গোরস্থানে আর আপনাদের ভেতরে টানব না; আমি শুধু দেখে আসি সব ঠিক আছে কি না।’
আমরা গাড়িটা ঘুরিয়ে গোরস্থানের ঠিক সামনেই পার্ক করলাম। ফেলুদা যখন গেট দিয়ে ঢুকল, তখন দেখলাম দারোয়ান বরমদেও বেশ একটা বড় রকমের সেলাম ঠুকল।
দশ মিনিটের মধ্যে ফেলুদা ফিরে এসে ‘ওকে’ বলে গাড়িতে উঠল। ঠিক হল রাত সাড়ে দশটায় আমরা আবার এখানে ফিরে আসছি।
আমার মন বলছে আমরা নাটকের শেষ অঙ্কের দিকে এগিয়ে চলেছি।