১০. ফেভারিট

বিদ্যাময়ী ইস্কুল শহরের নামকরা মেয়েদের ইস্কুল। বিদ্যাময়ী দেবী নামে শশিকান্ত নাকি সূর্যকান্ত মহারাজার বোন ইস্কুলটি বানিয়েছিলেন। দেয়াল ঘেরা বিশাল সবুজ মাঠের ওপর লাল দোতলা দালান। বট অশ্বত্থ গাছে ছাওয়া। মাঠের একপাশে পদ্মপুকুর। ইস্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় আমি টিকে গেলে, ঝুনুখালা, এ ইস্কুলে লেখাপড়া করেছেন যেহেতু, কোনটি কোন ক্লাসঘর, কোনটি মাস্টারদের বসার ঘর, কোনখানে এসেম্বলি হয় আমাকে চিনিয়ে বসিয়ে দেন চতুর্থ শ্রেণীকক্ষের প্রথম সারিতে। বসিয়ে, কানে কানে বলেন, মুচকি হেসে, তরে কিন্তু বড় ক্লাসের মেয়েরা আইসা একটা জিনিস কইতে পারে।

— কি কইতে পারে ঝুনুখালা?

আমার ভয় ধরা মুখে তাকিয়ে খালা হেসেছেন, রহস্য ভাঙেননি।

ঘটনা প্রথমদিন ঘটেনি, ঘটেছে দ্বিতীয়দিন। দুপুরবেলা টিফিনের একঘন্টা ছুটি হয় ইস্কুলে, টিফিন খেয়ে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে মেয়েরা মাঠে বৌচি খেলছে, দেখছি, একা দাঁড়িয়ে দেখছি, হঠাৎ চোখে পড়ে এক মেয়ে স্পষ্টতই ওপরের ক্লাসের, আমি চিনি না, রেলিংএ ভর দিয়ে আমাকে দেখছে, মুখে হাসি। আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে ক্লাসঘরের দিকে দু’পা যেই বাড়াই, মেয়েটি পেছন থেকে ডাকে, এই মেয়ে শোনো।

আমি থমকে দাঁড়াই।

মেয়েটি কাছে এসে জিজ্ঞেস করে–তোমার নাম কি?

আমি বলি–নাম জিগাস করেন ক্যান?

লম্বা, শ্যামলা, চুল বেনি করা মেয়েটি হেসে বলে–তুমি তো খুব সুন্দর, সেজন্য।

মেয়েটি আমার হাত টেনে নেয় মুঠোয়, হাতের আঙুলে অল্প অল্প চাপ দেয়। ছাড়িয়ে নিয়ে আমি গা কাঠ করে দাঁড়িয়ে থাকি।

মেয়েটি, কি নাম জানি না, বলে–ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমি তোমারে কিচ্ছু করব না।

চোখ আমার মাটিতে, বুক ধুকপুক করে। মেয়েটি আরও কাছ ঘেঁসে কেউ যেন শুনতে না পায়, বলে–তুমি আমার ফেভারিট হবা?

ফেভারিট হওয়া কাকে বলে আমি জানি না। চোখ উপচে জল নামে আমার। মেয়েটি আমার চোখের জল আঙুলে মুছে দিয়ে বলে–কি বোকা মেয়ে, কাঁদো কেন!

একদল মেয়েকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে দেখে মেয়েটি দ্রুত সরে যায়।

ক্লাসঘরের সিলিং জুড়ে লম্বা রঙিন কাপড়ের পাখা, ঘরের বাইরে বসে আয়ারা টানে, পাখা দোলে, ওই টানা পাখার নিচে বসেও ভেতরে ঘামতে থাকি ভেবে যে একটি ওপরের ক্লাসের মেয়ে নিশ্চয় আমাকে ফুঁসলিয়ে কোথাও নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কোথায় কে জানে!

মেয়েটি পরদিন টিফিনের সময়, সেদিনও আমি সিঁড়ির কাছে একা দাঁড়িয়ে, হাতে একটি পাকা পেয়ারা দিয়ে বলল–এই লাজুক মেয়ে, ফেভারিট হবা না আমার? বল, হবা। আমি তোমারে অনেক অনেক আদর করব।

বুজে আসা স্বরে বলি–না।

মেয়েটি মিষ্টি হেসে আমার হাত ধরে, আমি মুঠি করে রাখি হাত।

ক্লাসের কিছু মেয়ে, আমি তাদের নামও তখন জানি না, ইস্কুল ছুটির পর গায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে–তোমার ফেভারিট কে? ওইযে লম্বা আপাটা তোমার ফেভারিট, না?

আমি কিছু বুঝে পাই না ফেভারিট ব্যাপারটি কি! মেয়েরা কার ফেভারিট কে, এই নিয়ে কানাকানি করে। কেউ তার ফেভারিটের নাম বলে না, সব যেন বড় গোপন এক ব্যাপার।

ঝুনু খালার কাছে গোটা ব্যাপারটি পরে জানা হয় আমার। বিদ্যাময়ী ইস্কুলে এ খুব পুরোনো নিয়ম যে ওপরের ক্লাসের মেয়েরা নিচের ক্লাসের সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে ফেভারিট পাতে। একধরনের সই পাতার মত। ঘটনাটি আর সবার কাছে গোপন থাকা চাই। কেউ যেন না দেখে তারা ইস্কুল ছুটির পর নয়ত খেলার ঘন্টায়, নয়ত টিফিনের সময় গাছের তলে, পুকুরঘাটে, দেয়ালের আড়ালে দেখা করে, হাতে হাত রেখে গল্প করে, বড় মেয়েটি ছোট মেয়েটিকে এটা ওটা উপহার দেয়। ঝুনু খালার ফেভারিটের নাম ছিল বিউটি। অসম্ভব সুন্দর একটি মেয়ে। ঝুনুখালা যখন বিউটির কথা বলেন, মিষ্টি হাসেন, সেরকম মিষ্টি হাসি লম্বা মেয়েটিও হেসেছিল।

দিন যেতে থাকে, আর আমার মনে হতে থাকে ফেভারিট ব্যাপারটি বিষম এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার। ইচ্ছে করে আবার কেউ এসে একবার ফেভারিট হতে বলুক আমাকে। একবার কেউ ডাকলেই আমি চলে যাব, চলে যাব সুতোর ওপারে। ক্লাসের সুন্দর মেয়েগুলো টিফিনের ঘন্টা পড়লে পাখির মত উড়াল দিয়ে কোথায় যে যায়! কান পাতলে মেয়েদের কানাকানি শুনি যে মমতার গলার নতুন মালাটি ওর ফেভারিট দিয়েছে। শাহানার ফেভারিটের নাম বন্যা। কেউ বলে বন্যা নয়, কেউ বলে না বন্যাই, বন্যার সঙ্গে বট গাছের আড়ালে কেউ ওকে ঘনিষ্ট দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।

আমি এক বোকাচন্দ, লজ্জাবতী লতা। ফেভারিট নেই, ক্লাসেও কোনও বন্ধু নেই, কেউ আমাকে খেলায় নেয় না, ক্লাসে পড়া ধরলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকি। গানের, নাচের, খেলার ক্লাসেও আমার মত লাড্ডু আর একজনও নেই। বাংলা ক্লাসে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল–একটা ফুলের নাম বল তো দেখি! আমি ভাবছিলাম, ফুল তো অনেকই আছে, কিন্তু খুব সুগন্ধ ছড়ায় কোন ফুল, গোলাপ না কি দোলন চাঁপা নাকি শিউলি নাকি বেলি, নাকি রজনীগন্ধা।

মাস্টার আমার নৈঃশব্দ্য দেখে রাগ করে বললেন–মেয়েটা কি বোবা নাকি!

বোবাই। বোবা বলে, সে, যেহেতু ক্লাসে দাঁড়িয়ে বলতে হবে মাস্টারকে মে আই গো টু দ্য বাথরুম? এরকমই বলার নিয়ম, ইংরেজিতে, আর মাস্টার ইচ্ছে করলে বলতে পারেন, হ্যাঁ অথবা না, না বললে বসে থাকতে হবে শ্বাস বন্ধ করে, যা যে কেউ দেখলেই বুঝবে কেন, আর হ্যাঁ বললে সবার চোখের সামনে দিয়ে আমাকে দৌড়ে নয়ত ঠ্যাং চেপে হাঁটতে হবে–সকলে ভাবতে বসবে আমি বড়টির জন্য যাচ্ছি নাকি ছোটটির জন্য, এসব জিনিস যে জনসমক্ষে চাপা বড় লজ্জা, তাই আমি মে আই গো টু জাতীয় কোনও বাক্যে না গিয়ে বোবা হয়ে ছিলাম। শক্তি দিয়ে ঠেকাচ্ছিলাম। ঠেকিয়েছিলাম, মাস্টার চলে গেলে, কেউ যেন না বোঝে কোথায় যাচ্ছি, গিয়ে মাঠের যে কোণাটিতে পায়খানা, সে কোণায় ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঠেকিয়ে। পরে আসা মেয়েগুলো আমাকে ডিঙিয়ে এক এক করে সেরে আসে। আমার আর সারা হয় না। বেগবান জিনিস শরীর থেকে বেরোতে হাত পা ছুঁড়ে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ হওয়া নিরস্ত্র হওয়া আমার সঙ্গে। মনে মনে বলি আর একটু সবুর কর বাবা। সবুর কার এত সয়! শেষ অবদি মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে যোদ্ধার দল। শাদা পাজামা মুহূর্তে রঙিন হয়ে ওঠে। আমি দাঁড়িয়ে থাকি লজ্জায় মুখ নিচু করে, দেয়ালে শরীর সেটে, একা। আমি জানি না কে আমাকে ওই বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। উদ্ধার করতে অবশ্য একজন এগিয়ে আসে, যে মেয়েটি আমার সামনে এসে মিষ্টি হেসে বলে কি হয়েছে, এখানে একা একা দাড়ায়া আছ কেন? সে ওই লম্বা মেয়েটি, চোখের জল মুছে দেওয়ার, পাকা পেয়ারার। ধরণী আসলে দ্বিধা হয় না কখনও, যত তাকে হতে বলা হোক না কেন। অথবা হয়, সীতা হলেই হয়, আমি কি আর সীতা হতে পেরেছি! আমার মাথা ঘাড় থেকে ঝুলে থাকে, যেন এক্ষুণি ছিঁড়ে পড়বে, মেয়েটি বুঝে আমার করুণ দশা, হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে আমার বই খাতা ক্লাস থেকে নিজেই নিয়ে এসে ইস্কুলের মেথরানি রামরতিয়াকে সঙ্গে দেয় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। এ কাজটি যদি অন্য কেউ করত, সইত।

বাড়িতে খবরটি গোপন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। সম্ভব হয়নি। অসময়ে ইস্কুল থেকে হলুদ পাজামার ফেরা, সঙ্গে মেথরানি। বাড়ির বড়রা মুখ টিপে হাসে, ছোটরা গলা ফাটিয়ে। দাদার নিজের একার দুর্নাম ঘুচল এবার, সাত পাক নেচে বলে–

বিদ্যাময়ীর হাগড়া গাড়ি শাদা পাজামা হলুদ করল
অসময়ে ইস্কুল থেইকা রামরতিয়ায় নিয়া আইল।

পুরো মাস আমাকে গুয়ের চারি, রামরতিয়ার সই বলে ডাকা হল বাড়িতে। মা অবশ্য মাঝে মধ্যে ধমকে সরান দাদাকে, বলেন ওর পেটটা খারাপ আছিল।

মা’র আস্কারা পেয়ে আমি দাদাকে ভেংচি কেটে বলি–তুমিও তো ইস্কুলে হাগ্যা দিতা!

দাদা বলে–ইহিরি, তর মত বড় হইয়া হাগছি নাকি, আমি তহন ছোট্ট, ওয়ানে পড়ি মাত্র।

দাদাকে নিতে এক্সপেরিমেন্টাল ইস্কুলের রিক্সা আসত, বাচ্চারা যেন সিট থেকে পড়ে না যায় সামনে বেল্ট বাঁধা থাকত। প্রায়ই ইস্কুল ছুটির আগেই দাদাকে বাড়ি দিয়ে যেত রিক্সাঅলা। দু’আঙুলে ধরা থাকত দাদার গুয়ে মাখা হাফপ্যান্ট। একদিন রেগেমেগে রিক্সাঅলা বলল ছেলের পেট ভালা কইরা পরে ইস্কুলে পাঠাইয়েন।

মা বলেন–একবার এক কৌটার দুধ খাওয়ানোর পরে নোমানের পেট যে খারাপ হইল তো হইলই। আইজও ওর পেটটা ভালা না।

এটি হচ্ছে দাদার জন্মের দোষে নাকি কৌটোর দুধের দোষে, মা নিশ্চিত নন।

দাদার হেগে দেওয়া প্রসঙ্গ এলে আমি স্বস্তি বোধ করি। অন্তত আমি যে একা একটি বিশ্রি কান্ড ঘটাইনি, তা ভেবে। কিন্তু ইস্কুলে সে স্বস্তি জোটে না আমার।

ইস্কুলে কারও ফেভারিট হওয়ার সম্ভাবনা, আমি বুঝি, আমার আর নেই। লম্বা মেয়েটিকে দূর থেকে দেখেই উল্টো হাঁটি। যে কেউ আমার দিকে তাকালে মনে হয় সে বুঝি আমার পাজামা হলুদ করার ঘটনাটি জানে। লজ্জায় আমার কান নাক লাল হয়ে থাকে।

যুদ্ধ শেষ হলে যখন ইস্কুল খোলে, বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়াই আমাদের ওপরের ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়। পাক সর জমিনের বদলে ইস্কুলের এসেম্বলিতে নতুন পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে গাইতে হয় আমার সোনার বাংলা। মানুষের দৈর্ঘ প্রস্থ বদলে গেছে, ভাবনা ভাষা আরও সতেজ, দীপ্ত, আরও প্রাণময়। যেন বয়স ন’ মাসের বদলে বেড়ে গেছে ন’ বছর। যেন বালিকারা এখন আর বালিকা নয়, তরুণী। কারও বাড়ি পুড়েছে, কারও ভাই হারিয়েছে, কারও বাবা, কারও ধর্ষিতা বোনের জরায়ুতে ফুলে ফেঁপে বড় হচ্ছে অনাকাংখিত শিশু। এরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সকলে আমরা হেঁটে এসেছি, লাশ দেখতে দেখতে, আর্ত চিৎকার শুনতে শুনতে।

তখন কোনও এক বালিকা-বেলায় শাদা পাজামা হলুদ করে বাড়ি ফিরেছিলাম এ নিতান্তই বিস্মৃত হওয়ার মত তুচ্ছ।

অপেনটো বায়োস্কোপ
নাইন টেন তেইসকোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা

বলে মেয়েদের গলায় মালা পরিয়ে নিজের দলে নিয়ে গোলাপ পদ্ম খেলতে, আমার আর কান গরম হয় না শরমে। খেলার ঘন্টা বাজলে জিমনেসিয়ামে দৌড়োনো, টিফিনের সময় দৌড়ে দাঁড়িয়াবান্ধার কোট দখল করায় আমি আর আড়ষ্ট হই না। বৈাচি খেলতে আর সবার মত আমিও নামি। অবশ্য বার্ষিক খেলা প্রতিযোগিতায় আমি যে লাড্ডু, সে লাড্ডুই থাকি। শাহানা আর তার চার বোন, হীরা, পান্না, মুক্তা, ঝর্ণা লেখাপড়ায় লাড্ডু হয়েও খরগোসের মত ছোট দৌড়, বড় দৌড়, বিস্কুট দৌড়, ব্যাঙ দৌড় এরকম একশ রকম দৌড়ে সবকটি পুরষস্কার জিতে নিয়ে যায়। শাহানার দিকে বিস্মিত মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি আমি। ইস্কুলের সেই দুর্দান্ত মেয়ে শাহানার সঙ্গেও আমার বিষম ভাব হয়ে গেল একদিন।

এতসবের মধ্যেও, আমার কিন্তু বুক ধুপপুক করেছিল আরও একবার, চোখ নত হয়েছিল, লজ্জায় লাল হয়েছিল নাকের ডগা, আমার হাতখানা সে ছুঁয়েছিল বলে সারা গা কেঁপেছিল আমার, তাকে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠতাম, সারাদিন তাকে মনে করে আমার ঠোঁটে খেলত মিষ্টি হাসি। ঘুমোতে গেলে চোখে ভাসত মেয়েটির মুখ, তার হাসি, তার কথা বলা, তার হেঁটে আসা, তার হাত নাড়া, তার পিঠের ওপর কোঁকড়া চুলের বেণি। আমার মনে হত জগতে আমি এত আশ্চর্য সুন্দর কাউকে দেখিনি। জগতে আর কারও চোখ এত সুন্দর নয়। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে, আমি জগত ভুলে যাই। আমার সারা গায়ে অদ্ভুত, অদ্ভুত শিহরণ হয়।

ঘটনাটির শুরু এরকম, ইস্কুলে যাচ্ছি, ছোটদা আর তাঁর এক বন্ধু, মিলু, পথে আমাকে থামিয়ে একটি চিঠি দিলেন হাতে, রুনি নামের এক মেয়েকে, মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে, হোস্টেলে থাকে, দিতে। চিঠিটি মিলুর লেখা। বলা হল, ব্যাপারটি যেন বাড়ির কেউ না জানে, ইস্কুলের কোনও মেয়েও। এ আর এমন কি, রুনিকে খুঁজে বের করে চিঠিটি দিই। চিঠিটি রুনি তখন পড়ে না, জামা সরিয়ে বুকের ভেতরে কোথাও রেখে দেয়। আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম রুনির চোখে। সেই আশ্চর্য সুন্দর দুটো চোখে। আমার ইচ্ছে করেছিল রুনি দাঁড়িয়ে থাকুক আমার সামনে আরও আরও, আমি তার চোখদুটোর দিকে আরও আরও তাকিয়ে থাকি। রুনি সেদিন চিঠি নিয়ে চলে যাওয়ার পর আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম হোস্টেলের দেয়ালে পিঠ রেখে, ক্লাসের ঘন্টা আমাকে সচল করার আগ অবদি। সেই থেকে আমার তৃষ্ণার্ত চোখ খোঁজে তাকে হাজার মেয়ের ভিড়ে। ক্লাসঘরের জানালায় বসে তাকিয়ে থাকি বাইরের মাঠে, যদি তাকে হাঁটতে দেখি, যদি একপলক দেখা হয় আবার হঠাৎ কখনও।

দু’দিন পর ইস্কুল ছুটি হলে পদ্মপুকুর পাড় থেকে দৌড়ে এসে আমাকে একটি চিঠি দেয় রুনি, মিলুকে দিতে। চিঠিটি হাতে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। রুনি মিষ্টি হেসে বলে–কিছু বলবে?

আমি মাথা নাড়ি। আমার আর কি বলার ছিল!

— তুমি খুব লাজুক মেয়ে। এত কম কথা বল। হোস্টেলে এসো, তোমার সঙ্গে গল্প করবখন। বলে রুনি আমার হাত ধরে কাছে টানে তার, রুনির শরীরে ফুলের গন্ধ। রুনি যেন রূপকথার দোলনচাপা, প্রাণ পেয়ে রাজকুমারি হয়েছে। আমার সারা শরীর কাঁপে ভাল লাগায়। বুক ধুকপুক করে। আমার ভেতরে কোথাও কোনও পুকুরে একশ পদ্ম ফোটে। মিলু আরও চিঠি দিক, রুনি তার উত্তর দিক প্রতিদিন, তাহলেই আমি রুনির আরও আরও কাছে যাব, রুনি আমার চিবুকে আঙুল রাখবে, চমৎকার ভাঙা কণ্ঠে কথা বলবে, কপালের চুলগুলো উড়বে হাওয়ায়। আমি তার বুকে মুখ রেখে দোলনচাপার গন্ধ নেব।

পড়ালেখায় মন বসে না, খাতায় শতবার করে নাম লিখি রুনির। অঙ্ক করতে করতে, কখন বুঝি না মার্জিনের বাঁপাশে রুনির কালো দুটো চোখ আঁকি। হোমওয়ার্কে গোল্লা পেতে থাকি দিনদিন। রুনি আমার জীবন জগত, জানি সে ক্ষুদ্র, গ্রাস করে নেয়। খেলার মাঠ আমাকে আর আগের মত টানে না, পুকুর ঘাটে একা বসে থেকে রুনিকে ভাবি, পুকুরের কালো জলে রুনির চোখ দেখি। যে বাহুতে আমার স্পর্শ করেছিল রুনি, সে বাহুতে হাত বুলিয়ে মনে মনে আবার তার স্পর্শ নিই। আমার পুতুল খেলা, গোল্লাছুট, অপেনটো বায়োস্কোপ তুচ্ছ করে উদাস বসে থাকি কদম গাছের তলে, রুনির স্পর্শ পাওয়ার তৃষ্ণায় গোপনে আকুল হই।

রুনির সঙ্গে আসলে দীর্ঘ দীর্ঘ ক্ষণ বসে কখনও আমার গল্প করা হয়নি। আমার সাধ না মেটা যেটুকু অল্প সময় রুনির জুটত, ও নিজে গল্প বলেছে, আমি মুগ্ধ হয়ে কেবল শুনেছিই, হোস্টেলের সিঁড়িতে বসে, ওর বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে। যেন রূপকথার বইএর ছবি থেকে নেমে আসা দোলনচাপা-রাজকুমারি এক নিবিড় বনে চুল খুলে গান গাইছে। ওকে কেবল ভীষণ রকম ভালবাসতে ইচ্ছে করত আমার, খুব গোপনে ভীষণ রকম। ওর চোখের দিকে একবার তাকালে আমার সারা জীবনের গল্প ওকে বলা হয়ে যায়। ওকে একবার স্পর্শ করলেই জগতের সব সুখ আমার হাতের মুঠোয় চলে আসে। রুনি আমার হাতে রেশমি চুড়ি পরিয়ে দেয়, গলায় মালা। রুনির শরীর ঘনিষ্ঠ হতে থাকে আমার শরীরের সঙ্গে, আর আমি গন্ধ পেতে থাকি দোলন চাঁপার। আমি ওকে আরও আরও ভালবাসতে থাকি। শরমে চোখের পাতা নুয়ে আসে আমার।

সেই চুড়ি মালা অবশ্য বাড়ি এসে খুলে রাখতে হয়। বাবা জামা জুতো ছাড়া শরীরে বাড়তি কোনও জিনিস পছন্দ করেন না। অলংকার পরাবেন আশায় আমার দু’কান ছিদ্র করেছিলেন মা, দেখে মা’কে যা তা গাল দিয়েছেন বাবা। কখনও চুড়ি মালা দুল পরতে দেননি, ইস্কুল থেকে ফেরার পথে ফুটপাতের চুড়িঅলার কাছ থেকে একবার এক হাত কাচের চুড়ি কিনে বাড়ি ফিরেছিলাম, দেখে ভেঙে টুকরো টুকরো করে সবকটা চুড়ি, গালে চড় কষিয়ে বাবা বলেছিলেন–ফের যদি দেখি এইসব পরছস, তর হাড় গুঁড়া কইরা দিব।

পায়ে একবার আলতা পরেছিলাম, বাবা খামচে ধরে বলেছিলেন–কি ব্যাপার, রক্ত কেন তর পায়ে, কাইটা গেছে নাকি!

মা প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলেছিলেন–রক্ত হইব কেন, মেয়েরা লাগায়, শখ হইছে, লাগাইছে।

রুনির দেওয়া চুড়ি মালা আমার পরার দরকার হয় না, ওর ভালবাসা আমি অন্তরে অনুভব করি। রুনির সঙ্গে গভীর গোপন ভালবাসায় আমি যখন মগ্ন, সে সময় এক রাতে, আমার শরীর জেগে ওঠে শুভ্র বিছানায়। কে যেন আমাকে নিজের বিছানা থেকে নামিয়ে নিঃশব্দে হাঁটায়, হাঁটিয়ে মেঝেয় পাতা ছোটলোকের মলিন বিছানায়, অন্ধকারের কাঁথায় ঢেকে শরীর, শোয়ায়। মণি আবার ফেরত এসেছে এ বাড়িতে, এসেছে ডাঙর হয়ে। দুপুররাতে বাবার সঙ্গে হাতে নাতে ধরা পড়ার পর রেনুর মা’কে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন মা, এরপর আকুয়ার বস্তি থেকে এক এক করে অনেককেই এনে গতর খাটিয়েছেন, শেষে পুকুরপাড়ে একা বসে থাকা, না খাওয়া মণিকেই তুলে আনেন। মণির শরীর নিয়ে আমি খেলি, ওকে উলঙ্গ করে, ওর বুকে হঠাৎ কবে বড় হওয়া দুটো পেয়ারা দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে। মণির জামার তলে লুকিয়ে এত সুন্দর স্তন কেউ ছোঁয়নি; আমি কেবল ছুঁই, আমি কেবল দু’হাতে, ঠোঁটে, নাকে ছুঁয়ে দিই, যেন কতকালের পুরোনো সইএর সঙ্গে নতুন করে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। রথের মেলা থেকে কিনে আনা মণি আমার শখের পুতুল, আমার জ্যান্ত পুতুল। আমার বুকে তখন কেবল গোলাপ ফুটছে, কুঁড়ির ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া গোলাপের ঘুমঘুম চোখ শরমে বুজে আসে আলোয়। অন্ধকারে সেই চোখ চুমু খায় মণির পাকা পেয়ারায়।

মধ্যরাতের গোপন খেলা
খেলেই চলি সইয়ের সনে,
কেউ জানে না।

এ যেন বালিকার গোল্লাছুট। গোল্লা থেকে ছুটতে ছুটতে, ভুলে ধুলোকাদার ঘর, মিছিমিছির রান্নাবাড়ি, পুতুল বিয়ে, টগবগ করা জীবনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দু’চোখে রাজ্যির বিস্ময় নিয়ে খুলে খুলে শরীর দেখি, শরীরের ভেতরে দেখি লুকোনো আরও এক গোপন শরীর।

বোকাচন্দ মেয়েটি গোপনে গোপনে এমন কান্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে! রুনিকে, মিলুর চিঠি আর সে দেয় না, এখন নিজেই সে ফুলপাখিপাতার আল্পনা আঁকা কাগজে চিঠি লেখে, দাদার ড্রয়ার থেকে চুরি করা কাগজে, বুকের বাগান থেকে একটি একটি করে শব্দের ফুল তুলে সে মালা গাঁথে। রুনি উত্তর লেখে। রুনির চিঠিতে সে দোলনচাঁপার ঘ্রাণ পায়। তার নিরাভরণ নিস্পন্দ জীবন দুলে ওঠে ফুলের দোলনায়। কে জানে বাড়ির! কেউ না। একই সঙ্গে দুটো জীবন যাপন করি আমি, বাবা মা’র গাল, চড় থাপড় খাওয়া বাইরের আমি, আর ভেতরের অন্য আমি, গোল্লা থেকে ছোটা আমি, প্রেমের জলের ডুবুরি।

ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ। ছাত্রদের তপস্যাই হওয়া উচিত অধ্যায়ন। জ্ঞানের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নাই। বড় বড় মনীষীরা বলে গেছেন। কী বলে গেছেন? আমার উত্তর দেবার দরকার হয় না, কারণ বাবাই বলবেন কি বলে গেছেন মনীষীরা। বলে গেছেন কষ্ট করিলে কেষ্ট মেলে। সুতরাং তুমাকে আদা জল খেয়ে লাগতে হবে। খেলাধুলা বাদ, আরাম আয়েশ বাদ। শুধু বিদ্যা অর্জন কর। বিদ্বান হও। তুমাকে দশটা লোকে সম্মান করবে, সমাজে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবা। আমারে দেখাইয়া লেখাপড়া কইর না, নিজের জন্য কর। পাগলেও নিজের বুঝ বুঝে।আর যদি লেখাপড়া না কইরা ভাদাইম্যা হও, ভাব বাপের হোটেলে থাকি, গায়ে ফুঁ দিয়া বেড়াব, তাইলে কী হবে ভবিষ্যত? রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে হবে। সুতরাং জ্ঞানী হও। বিদ্যা অর্জন কর। মানুষের মত মানুষ হও। কষ্ট কর, তাইলেই কেষ্ট মিলবে। কষ্ট কইরা চাষাবাদ করার পর চাষীরা ফসল ঘরে তুলে। কষ্ট না কইরা তুমি খেলা নিয়া থাকলে, আড্ডা মারলে, তামাশা করলে কেষ্ট মিলবে না। কষ্ট কইরা রাইত দিন খাইটা লেখাপড়া কইরা মানুষ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়, জজ ব্যারিস্টার হয়। রাত দশটার আগে ঘুমানি চলবে না। টিউটর আসে ঠিকমত?

এই উত্তরটি বাবা দেবেন না, আমাকেই দিতে হবে, হ, আসে।

সামনের পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হইলে, বাবা চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, পিঠের চামড়া তুইলা ফেলব, বইলা দিলাম।

জুতোর মচমচ শব্দ শুনে বুঝি বাবা এখন সরেছেন দরজা থেকে। দরজায় দাঁড়িয়ে এরকম বাণী বর্ষণ করা তাঁর প্রতিদিনের স্বভাব। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে যে করেই হোক মস্ত কিছু বানাবেন তিনি, এরকমই তাঁর পণ। মেট্রিকে খারাপ ফল করার পর দাদা বাড়ি ফেরেননি তিনদিন ভয়ে। বাবা সন্ধি বেত হাতে নিয়ে দাদার অপেক্ষায় বসেছিলেন, মাথায় লোটা লোটা ঠান্ডা পানি ঢেলেছিলেন। দাদার বন্ধুরা যারা একই রকম পাশ করেছিল, তাদের বাবারা মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরেছে, আত্মীয় স্বজনকে ছেলে-পাশের মিষ্টি খাইয়েছে। তিনদিন পর দাদাকে খুঁজে বার করে কান টেনে বাড়ি নিয়ে আসেন বাবা। সাফ সাফ বলে দেন, আইএসসিতে ভাল ফল না পেলে এ বাড়ি থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। দাদার জন্য তিনটে মাস্টার রেখে দিলেন। পরীক্ষায় তারপরও দাদা দ্বিতীয় বিভাগ। দাদা নিজে অবশ্য বলেন হায়ার সেকেন্ড ডিভিশন। তাঁর ওই হায়ার দিয়ে কাজ হয় না। মেডিকেল কলেজে দু’দুবার ভর্তি পরীক্ষায় বসেও পাশের লিস্টিতে নাম পাওয়া যায় না তাঁর। দাদার এ অবস্থায় বাবার রক্তচাপ বাড়তে থাকে। মুড়ির মত ওষুধ ছুঁড়তে থাকেন মুখে। অক্ষমাযোগ্য অপরাধ করে দাদা লক্ষ করেন সংসারে তাঁর আদর কমছে, তিনি দিন দিন উদাস হতে থাকেন। খেতে বসে বাবা ছোটদার পাতে মাংসের ভাল টুকরোগুলো তুলে দেন, দাদা ঝোল মেখে ভাত ডলতে থাকেন, পাতে একখানা কেবল চোষা হাড়।

ছোটদার জন্য চারটে মাস্টার, অঙ্কের, পদার্থ বিদ্যার, রসায়নের, ইংরেজির। ছোটদা মাস্টারদের বাড়িতে পড়তে যান বিকেলে। আমার মাস্টার আসেন বাড়িতে। ইয়াসমিনের মাস্টারও। ইস্কুল থেকে ফিরে জিরোতে না জিরোতে মাস্টার আসেন। যত ওপরের ক্লাসে উঠছি, তত গৃহশিক্ষক বাড়ছে। দাদা আর ছোটদার জন্য সন্ধে থেকে রাত বারোটা অবদি পড়া, আমার জন্য দশ, ইয়াসমিনের জন্য রাত আট, বাবা এরকম নিয়ম করে দেন। দাদারা বড় বলে শব্দ করে না পড়লেও চলবে, কিনতু আমাদের, আমার আর ইয়াসমিনের শব্দ করে পড়তে হবে, বাবা যেন তাঁর ঘরে বসে শুনতে পান আমরা ঘুমোচ্ছি না, পড়ছি। এদিকে ঘড়ির কাঁটা আটের ঘরে এলে আমার চোখ ঢুলে আসে, বাবা পা পা করে এসে আমাকে হাতে নাতে ধরে বলেন যাও চোখ্যে সরিষার তেল দিয়া আসো, তাইলে ঘুম আসবে না। চোখের রোগীরা যেমন করে চোখে ওষুধ দেয়, আমাকে ঠিক ওরকম করে ঘাড় পিঠের দিকে ঝুলিয়ে শিশি থেকে ঢালতে হয় চোখে সর্ষের তেল, চোখ জ্বালা করে বিষম কিন্তু বাবা স্বস্তি পান ভেবে যে ঘুম এখন বাপ বাপ করে পালাবে। পড়তে বসে সন্ধে থেকে টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমোতে থাকেন ছোটদা। কালো ফটকের শব্দ শুনলে ধাক্কা দিয়ে ছোটদাকে জাগিয়ে দিই, উঠ উঠ বাবা আইছে। ছোটদা ধড়ফড়িয়ে মাথা তোলেন, মুখের লালায় বই ভেজা, লালার শাদাটে দাগ নেমে গেছে ঠোঁটের কিনার থেকে গালে, চোখদুটোয় শুকনো মরিচের লাল। পা নাড়তে নাড়তে তিনি পড়তে শুরু করেন। আসলে তিনি কিছু পড়েন না, গাঁগোঁগাঁগোঁ ধরনের শব্দ করেন। দূর থেকে বাবা সম্ভবত ভাবেন তাঁর পুত্রধন এবারও স্টার পেয়ে বাবার মান রক্ষা করবেন।

বাবা যতক্ষণ বাড়ি থাকেন, সকলে গলা নিচু করে কথা বলে। বাড়িতে কবরের স্তব্ধতা, যেন চারটে লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে একেকজন বড় বড় দার্শনিক বা বিজ্ঞানী হতে যাচ্ছে। দাদার বেলা বাবার বাণী এরকম–এই গাধারে দিয়া কিচ্ছু অইল না। মেডিকেলে পড়াইতে চাইলাম। চান্স পায় নাই কোথাও। বি এস সি পরীক্ষা দিয়া এখন কেরানিগিরি ছাড়া তর ভাগ্যে আর কি জুটব! দেখ কুনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইতে পারস কি না। তরই বন্ধু জাহাঙ্গীর ডাক্তারি পড়তাছে। ফয়সল পড়তাছে। তর কি মগজ কিছু কম ছিল ওদের চেয়ে! ওরা ভাত খাইছে, তুই খাস নাই? এত এত মাস্টার রাইখা পড়াইলাম, তাও পরীক্ষায় একটা ফার্স্ট ডিভিশন পাইলে না। লজ্জা করে না মুখ দেখাইতে। আমি হইলে কচুগাছে ফাঁসি নিয়া মরতাম।

ছোটদার বেলায়–দুনিয়া ভুইলা যাও কামাল। এখনই তুমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। তুমি মেট্রিকে স্টার পাওয়া ছাত্র। তোমার ভবিষ্যত এখন ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্টের ওপর নির্ভর করতাছে। এই রেজাল্ট আরও ভাল না করলে কমপিটিশনে টিকতে পারবা না বাবা। ডাক্তারি পড়তে হইব। ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হইতে হবে। বন্ধুদের নিয়া আড্ডা বাদ। খাইটা পইড়া মেডিকেলে ভর্তি হও। আমার খুব আশা ছিল বড় ছেলে ডাক্তার হইব। পারল না। এখন তুমিই আমার ভরসা। পড়ায় মন দাও বাবা। দিনে আঠারো ঘন্টা কইরা পড়। ভাল রেজাল্ট কইরা বাপের মুখ রাখো। আমি চাষীর ছেলে ডাক্তার হইছি। তুমি আমার চেয়ে বড় ডাক্তার হইয়া দেখাইয়া দেও।

সকাল বেলা ঘরে ঘরে বাণী বিতরণ করে বাবা বাড়ি থেকে বেরোন। তখনই এক সঙ্গে চারটে চেয়ার সরার শব্দ হয়, সরিয়ে কেউ মাঠে যায় দৌড়ে, কেউ রেডিওর নব ঘোরায়, কেউ গলা ছেড়ে গান গায়, এক লাফে বিছানায় শোয়। কালো ফটকটি আমাদের একধরনের জীবন বাঁচায়, খটাস করে শব্দ হয়ে সংকেত দেয় বাবার আসার, অথবা যাওয়ার। বাবার শব্দটির একটি আলাদা ধরন আছে, বাবা ফটক খুললে যে ধরনের শব্দ হয়, তা বাবা খুললেই হয়। চোখ বুজে আমরা বলে দিতে পারি এ বাবা নাকি বাবা নয়। বাবা অবশ্য রূপকথার দৈত্যদের মত নানারকম চালাকি করেন। রাতে বাড়ি ফিরবেন বলে বেরিয়ে দুপুরে ফেরেন, দুপুরে ফিরছেন বলেন, ফেরেন রাত করে। বাবার বলাকথায় আমাদের খুব একটা আস্থা নেই। চব্বিশ ঘন্টা আমরা সতর্ক থাকার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে ফটকও বেশ নিঃশব্দে খোলার চেষ্টা করেন তিনি যেন হাতে নাতে সবাইকে ধরতে পারেন। কখনও সখনও যে তিনি আচমকা পেছনে এসে দাঁড়াননি আমাদের সতর্ক হবার আগে, তা নয়। আমাকে রান্নাঘরের বারান্দায় বসে সজনে বাছতে দেখে সেই সজনে দিয়ে পেটাতে পেটাতে পড়ার টেবিলে এনে বসিয়েছিলেন, পাড়ার মেয়েদের নিয়ে মাঠে খেলতে দেখে চড়িয়ে ভেতরে এনেছেন, সব ক’টি মেয়েকে ধমকে বাড়ির বার করেছেন। বাবার হাতে মার খেয়ে মনে মনে কত যে বাবার মৃত্যু কামনা করেছি, যেন বাবা আজই ভীষণ অসুখ হয়ে মরে যান। বাবা এমন শক্ত শরীরের মানুষ, সামান্য জ্বরজারিও হত না কখনও। এদিকে আমাকে জ্বরে ধরত বেশ, জ্বর হয় হোক, কিন্তু ওষুধ নৈব নৈব চ। আর টিকার নাম শুনলে তো গায়ে জ্বর চলে আসে। ইস্কুলে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়ার লোক যখনই আসত, পায়খানায় লুকোতাম। বাড়িতেও লোক আসত, ব্যস, বাড়ি থেকে সারাদিনের জন্য হাওয়া। শুকনো মুখে রাস্তায় ঘুরঘুর করতাম যতক্ষণ না দেখছি ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। টিকা নিইনি, বাবার কাছে ধরা পড়ে গিয়ে এমন কান্ড হয়েছিল যে বাবা নিজেই আমার হাতে জন্মের যন্ত্রণা দিয়ে টিকা দিলেন। আর যার হাত থেকেই বাঁচি, বাবার হাত থেকে বাঁচার আমার কোনও সাধ্য ছিল না।

বছরে এক ক্লাসে তিনবার পরীক্ষা হয়, প্রথম ষৈনমাসিক, দ্বিতীয় ষৈনমাসিক, তৃতীয়টি হচ্ছে বার্ষিক, বার্ষিকে উতরে গেলে ওপরের ক্লাসে বসতে হয়। প্রথম ষৈনমাসিক পরীক্ষায় ইংরেজিতে তেত্রিশ পেয়ে ঘরে ফিরেছি। তেত্রিশ হচ্ছে পাশ নম্বর, এর নিচে পেলে আর কালো কালিতে নম্বর লেখা হয় না, হয় লাল কালিতে। মানে সব্বনাশ। তেত্রিশ পেয়ে সেদিন আমার সারাদিন মন খারাপ। ভয়ে জিভ শুকিয়ে আসছে। বারবার জল খাচ্ছি। মা’র শরীর ঘেঁসে বসে থাকি যেন মা আমার সহায় হন। মা’কে বলিও যে মা ঠিকই বলেন দুনিয়াদারির লেখাপড়ার মত বাজে ব্যাপার আর নেই। বাবাকে দেখাতেই হবে প্রগেস রিপোর্ট, এটি দেখলে পিঠে কি রকম বেত পড়বে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। মা বলেন মোটা জামা পইরা ল, পিঠে লাগব কম। গায়ে মোটা জামা পরে গরমে সেদ্ধ হতে থাকি কিন্তু বাবা ফিরে আমাকে মারধোর না করে শান্ত গলায় বলেন আজ থেইকা আমি তরে ইংরেজি পড়াব। এর চেয়ে যদি পিটিয়ে আমার পিঠের চামড়া তুলতেন, খুশি হতাম। এ যেন বাঘমামা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলছেন আজ থেকে প্রতিদিন আমি তোকে খাব। বাবা যা বলেছেন তাই, হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। রাত আটটায় রোগী দেখে বাড়ি ফিরে শার্ট প্যান্ট খুলে পেটের ওপর লুঙ্গির গিঁট দিয়ে, চোখে চশমা পরে, তোষকের তলে রাখা সন্ধি বেতটি নিয়ে আমার পড়ার টেবিলে এসে বসেন নতুন কানাই মাস্টার। আমার এক চোখ থাকে সন্ধি বেতে, আরেক চোখ বইয়ে। ইংরেজি গ্রামার শেখান বাবা আমাকে। পড়তে পড়তে হাই উঠলে ঘুমের, সপাং করে বেত পড়ে পিঠে, গা কেঁপে ওঠে আমার। পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার টেন্স, নানারকম তার শাখা প্রশাখা, বাবা আমার মগজ খুলে মগজে নিজ হাতে ঢুকিয়ে দেন, ঢুকিয়ে বেত মেরে খুলি জোড়া দেন, যেন জীবনে কখনও আর এগুলো বেরিয়ে না আসে। জীবনের কথা দূরে থাক, পরদিনই ভুল করি, প্রতিদিনকার মত এক চোখ টেবিলের চকচকে বেতে, আরেক চোখ বইয়ে, টান টান করা পিঠ, বাবা বলেছেন সোজা হয়ে বসতে, বাঁকা হয়ে বসে অলস লোকেরা। ভুল যখনই হল, সপাং সপাং। যত সপাং সপাং তত ভুল। চোখে জল আসে। চোখে জল আসলে সপাং সপাং। যত সপাং সপাং তত জল। চোখে জল নিয়ে বলেছিলাম পানি খাইয়াম, বাবা বলে দিলেন পানি খাওন লাগব না। বাবা পড়াতে বসলে আমার পেশাব পায়খানা পাওয়া নিষেধ, তেষ্টা পাওয়া, ক্ষিধে পাওয়া নিষেধ। বাবা বলেন ওসব পাওয়া নাকি পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার কায়দা।

পড়া শেষ হলে মা পিঠের দাগের ওপর মলম লাগাতে লাগাতে বলেন–এইভাবে গরুর মত পিটাইয়া কুনো লাভ আছে? যার হয়, তার নয়ে হয়; যার হয় না, তার নব্বইয়েও হয় না। সারাদিন গপ্পের বই পড়লে কি কইরা পরীক্ষায় ভালা করব! বাপে বাড়িত থাকলে বেহেই পড়ার টেবিলে, না থাকলে বাড়িটা মাছের বাজার হইয়া যায়। আর এইডা হইল মিরমিরা শয়তান। নাটের গুরু। কারে কুন দিয়া খুচাইব, এই তালে থাকে। এহন ভাল হইছে না! মাইর খাইয়া উপুড় অইয়া পইরা থাহস!

প্রতি রাতে মার খেতে খেতে এমন হয় যে, ইস্কুলের পড়া বাদ দিয়ে ইংরেজি ব্যাকরণ মুখস্ত করি দিনরাত। ওদিকে হোমওয়ার্কে গোল্লা জোটে। অঙ্কের খিটখিটে শিক্ষক ক্লাসে নিল ডাউন করিয়ে রাখেন। বেঞ্চের ওপর দু’ কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বিজ্ঞান ক্লাসে, আবার কোনও কোনও শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে এনে ক্লাসের সবাই যেন দেখতে পায় বকের মত এক পায়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন, ইস্কুলে গবেট ছাত্রী হিসেবে রাতারাতি আমার নাম উঠে আসে এক নম্বরে। এদিকে বাড়িতে মুখস্ত করা ব্যাকরণও সব গুলিয়ে যায় বাবার গর্জন শুনে, পিঠে বেতের সপাং সপাং চলতেই থাকে। দ্বিতীয় ষৈনমাসিক পরীক্ষায় ইংরেজিতে আমার নম্বর ওঠে বারো। নম্বর দেখে মা বাঁকা হেসে বলেন–ক্লাস সেভেনে যহন পড়তাম, ক্লাসের টিচার জিগাস করল মেয়েরা তুমরা কেউ গোবর ইংরাজি জান? কেউ জানে না, আমি ছাড়া। কইলাম, সারা ক্লাস শুনাইয়া, কাউ ডাং। পড়ালেখাডা চালাইয়া যাইতে পারলে আমি আইজ ইংরেজির মাস্টার হইতাম। নম্বর দেখে বাবার রক্তচাপ এমনই বাড়ে যে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

বাবা হাসপাতালে, বাড়ি আবার মাছের বাজার। হই চই হুল্লোড়। পড়ার টেবিলে ধুলো জমতে থাকে। কে আর ছায়া মাড়ায় ওসবের! গল্পে, আড্ডায়, গানে মজে থাকি সারাদিন, নিষিদ্ধ ছাদে কাটে বিকেল, রাত কাটে গল্পের বইএ, লুকোছাপার দরকার হয় না, ঠ্যাংএর ওপর ঠ্যাং তুলে, প্রকাশ্যে। বই জোটে ইস্কুলের মমতা নামের এক মেয়ের কাছ থেকে। মমতাকে বলা হত বইয়ের পোকা। ওই পোকার সঙ্গে আমার আবার হঠাৎ খাতির হয়ে যায়। ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে সে মাস্টারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেবল বই পড়ত। ইস্কুল ছুটির পরও একদিন পড়ছিল ক্লাসঘরে, একা। দফতরি এসে দরজায় তালা দিয়ে যায় বাইরে থেকে। সে মেয়ে আটকা পড়ে যায় পরদিন সকাল হওয়াতক। খবরটি প্রথম জানতে পাই আমি, কারণ পরদিন আমিই সকালবেলা সবার আগে ক্লাসে ঢুকেছিলাম। মমতা ঘুমোচ্ছিল বেঞ্চে শুয়ে। কি ব্যাপার! বলল কাল বিকেলে ক্লাস থেকে বেরোতে গিয়ে দেখে দরজা বন্ধ। ডাকাডাকি করে কাউকে সে পায়নি, সারা ইস্কুল ফাঁকা। আমি আঁতকে উঠি। তারপর? তারপর আর কি করি, মমতা হেসে বলল, বইটা পড়া শেষ করে অনেক রাতে শুয়েছি। কী সে বই! মমতা দেখালো নীহাররঞ্জন গুপ্তেরর কিরীটি অমনিবাস। ও এতটুকু ভাবছিল না বাড়িতে ওর মা কি করছে ওর না ফেরায়। ও দিব্যি ক্ষিধে লেগেছে বলে বেরিয়ে গেল। বইটি রয়েই গেল আমার কাছে। মমতাকে এরপর দু’দিন ইস্কুলে আসতে দেয়নি ওর মা। বইটি পড়ে ওকে যেদিন ফেরত দিলাম, ও বিষম খুশি হল, ভেবেছিল ওর বই হারিয়ে গেছে। এরপর থেকে ও যে বইই পড়ত, আমাকে দিত। কেবল আমাকেই দিত।

যাই হোক, বাবা হাসপাতালে। প্রতি বিকেলে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার ভরে নিয়ে হাসপাতালে যান মা। বাবা এক বিকেলে মা’কে বলে দিলেন তাঁর দু’মেয়েকে তিনি দেখতে চান। কেন দেখতে চান, দেখতে চাওয়ার হঠাৎ কি হল ইত্যাদি প্যাঁচালের পর ভাঙা গলায় বললাম আমার জ্বর জ্বর লাগতাছে, তাছাড়া আমার মাস্টার আইব। ইয়াসমিনরে নিয়া যাও। যে যুক্তিই দিই না কেন, খাটে না, মা আমাকে নিয়ে যাবেনই। আমাদের গিয়ে দাঁড়াতেই হয় হাসপাতালের কেবিনে, যেখানে বাবা ডেটলের গন্ধের সঙ্গে শুয়েছিলেন। বাবার মুখে দাড়ি গজিয়ে গেছে। দাড়ি গজানো বাবাকে কখনও দেখিনি আগে। বয়স মনে হল বছর কয়েক বেড়ে গেছে বাবার। আমাকে কাছে ডেকে, একেবারে নাগালের মধ্যে, মলিন কণ্ঠে বললেন–

এখন নিশ্চয় তুমারা বলতাছ
যম গেছে যমের বাড়ি
আমরা হইলাম স্বাধীন নারী।

বাবা তবে জেনে গেছেন তাঁর নাম দিয়েছি আমি যম। বাবাকে বাবা সম্বোধন করা বাদ দিয়েছি সে অনেক বছর, আর আড়ালে যে বাবা বলি, তাও বাদ দিয়েছি তিনি আমার মাস্টার হওয়ার পর। শ্রেফ যম। নামটি তোফা হয়েছে ছোটদা মন্তব্য করেছিলেন যেদিন তিনি জুতো কেনার টাকা চেয়েও বাবার কাছ থেকে পাননি। আমি আশংকা করছিলাম হাসপাতালের শাদা বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে এই বুঝি তিনি আমার হাড় গুঁড়ো করবেন, তাঁকে যম নাম দেওয়ার অপরাধের শাস্তি। তা না করে আমাকে অবাক করে তিনি বললেন–মা গো কি দিয়া খাইছ আজ?

বাবার কোমল স্বরে স্বস্তি পেয়ে বলি–ডিম দিয়া।

— আমি বাড়ি গিয়াই তোমাদের জন্য বড় বড় রুইমাছ নিয়া আসব, মুরগি নিয়া আসব। বাজারে ফজলি আম উঠছে, আম নিয়া আসব ঝুড়ি ভইরা।

আমি মাথা নেড়ে আচ্ছা বলে।

বাবার যে কোনও কথায় হুঁ হ্যাঁ আচ্ছা ঠিক আছে বলে যত শীঘ্র হাসপাতাল থেকে বিদেয় হওয়া যায়, ততই মঙ্গল। কিন্তু আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বাবা তাঁর বুকের ওপর আমার মাথা টেনে এনে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন–চুলে তেল দেও নাই কেন? চুলে তেল দিয়া আচড়াইয়া ফিতা দিয়া বাইন্ধা রাখবা। তাইলে তো সুন্দর দেখা যায়।

আমি শ্বাস বন্ধ করে রাখি। বাবা তাঁর খড়খড়ে গাল আমার গালে ঘসে বলেন– তুমার যে মেধা আছে তা আমি জানি মা। তুমাকে পড়াতে গিয়া সেইটা বুঝছি। বল ত মা, মাই ফাদার হ্যাজ বিন ক্রাইং ফর মোর দেন টু আওয়ারস কি টেনস?

— প্রেজেন্ট পারফেক্ট কনটিনিউয়াস। মিনমিন করে বলি।

— এই তো আমার লক্ষ্মী মা, এই তো সব পারে আমার মা।

বাবা আমার পিঠে হাত বোলান, বেতে-কাটা ঘাএ স্পর্শ রেগে যন্ত্রণায় ধনুকের মত বেঁকে ওঠে পিঠ। তবু অসাড় শুয়ে থাকি। বাবার জন্য হঠাৎ আমার মায়া হতে শুরু করে।

হাসপাতাল থেকে বাবা সুস্থ হয়ে ফিরে এলে মাছের বাজারে নেমে আসে মাঝরাতের ঠান্ডা স্তব্ধতা। আমার জীবনেও। আমাকে ইস্কুল বদলাতে হবে। বিদ্যাময়ী ভাল ইস্কুল, এতে কোনও দ্বিমত নেই বাবার, কিন্তু আরও একটি ভাল ইস্কুল খুলেছে, রেসিডেনসিয়াল মডেল ইস্কুল, ওতে আমাকে পড়তে হবে। ততদিনে বিদ্যাময়ীতে আমার বান্ধবী বেড়েছে, রুনির সঙ্গে আমার গোপন আত্মীয়তা হয়েছে, আর আমাকে কি না সবার মধ্য থেকে বলা নেই কওয়া নেই, বাজপাখি এসে ঝাঁ করে তুলে নিয়ে যাবে! বলি, উদ্বাস্তু হওয়ার আগে মাটি আঁকড়ে ধরার মত–আমি বিদ্যাময়ী ছাইড়া কুথাও পড়তে চাই না।

বাবা ধমকে বলেন–তুই চাওয়ার কে? আমি চাই তরে মডেলে পড়াইতে।

আমি ফুঁপিয়ে বলি–বিদ্যাময়ী ভাল ইস্কুল।

বাবা কেশে বলেন–মডেল আরও ভাল।

যত সাহস আছে শরীরে, সবটুকু ঢেলে, চোখ শক্ত করে বুজে, দাঁতে দাঁত চেপে বলি — আমি অন্য ইস্কুলে পড়ব না।

বাবা আয়নার সামনে গলায় টাই বাঁধতে বাঁধতে বলেন–তুই পড়বি, তর ঘাড়ে পড়বে।

নতুন ইস্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে এইম ইন লাইফ বলে একটি রচনা লিখতে বলা হয়েছিল। ওই একটি কাজই পরীক্ষার খাতা জুড়ে করি, রচনা লিখি, লিখতে লিখতে লক্ষ করি ইংরেজি ভাষাটি কড়া কথা বলার জন্য, রাগ করার জন্য, গাল দেবার জন্য বেশ চমৎকার। ঝড়ের মত আবেগ নামে বাংলায়, মায়ামমতা বুকের দরজা খুলে হুড়মুড় বেরিয়ে আসে বাংলায় তাই ভাষাটিকে অন্তত সেদিনের জন্য এড়িয়ে চলি। আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিই আমার জীবনের এইম নয় এই ইস্কুলে পড়া। ইস্কুলটি একটি ভূতুড়ে বাড়ির মত। আমি একটি ইস্কুলে পড়ছি, সেটি খুবই ভাল, এবং আমি সেটিতেই পড়তে চাই। আমার ইচ্ছের বাইরে বাবা আমাকে দিয়ে তাঁর যা ইচ্ছে তা করাতে চান, এ আমার সয় না। তিনি যদি চান আমাকে ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দেবেন, তিনি দেবেন কারণ তিনি চেয়েছেন ভাসিয়ে দিতে। আমি ভাসতে চাই কি না চাই, তা তিনি পরোয়া করেন না। আমার জীবনটি কি আমার, না তাঁর? যদি আমার হয়, যা আসলে আমারই, তবে আপনাদের কাছে সর্নিবদ্ধ অনুরোধ, আমাকে এই ইস্কুলে ভর্তি করাবেন না। আমার জীবনের এত বড় ক্ষতি আপনারা করবেন না আমার বিশ্বাস।

প্রশ্নপত্রের আর কোনও প্রশ্নের দিকে ফিরে তাকাই না। বাবাকে বেশ জব্দ করা গেল বলে একধরনের সুখ হয় আমার।প রীক্ষার শেষ ঘন্টা পর্যন্ত খামোকা বসে থেকে যখন বেরিয়ে আসি, করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা, উড়ে এসে জিজ্ঞেস করেন–পরীক্ষা কেমন হইছে?

বলি, শুকনো মুখে–ভাল।

বাবা হেসে বলেন–সব প্রশ্নের উত্তর দিছ তো!

— হ। সুবোধ কন্যার মত মাথা নেড়ে বলি।

— খুব কড়াকড়ি। পরীক্ষা দিল দুইশ জন। নিবে মাত্র তিরিশ জন। বাবার কপাল ঘামে দুশ্চিন্তায়।

মিথ্যে কথা বলার অভ্যেস নেই, কিন্তু এই মিথ্যেটি আমি চোখ বুজে অনেকক্ষণ আওড়েছিলাম যেন চোখ কান নাক সব বন্ধ করে একবার বলে ফেলতে পারি কোনওরকম।

বাবা আমাকে সোজা নিয়ে গেলেন নতুন বাজারে বাবার ওষুধের দোকানে, দোকানের ভেতরে রোগী দেখার কোঠা তাঁর। অন্যের ফার্মেসিতে বসার দরকার হয় না বাবার আর, যুদ্ধের পর নানার দোকানের দু’কদম দূরে দোকান কিনে নাম দিয়েছেন, আরোগ্য বিতান। ভেতরে তাঁর গদির চেয়ারটিতে আমাকে বসিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম কিনে এনে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন–ভাল কইরা লেখাপড়া করবা। প্রত্যেক ক্লাসে তুমার ফার্স্ট হওয়া চাই। আদা জল খাইয়া এহন থেইকা লাগো। বাবার স্বপ্ন যে ক’দিন পরেই মরা পাতার মত ঝরে পড়বে, তা তিনি না জানলেও আমি জানি। আমার এই জানা, মণিকে গভীর রাতে ন্যাংটো করার ঘটনার মত গোপন।

ক’দিন পর বাবা সুখবর আনলেন নতুন ইস্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় আমি পাশ করেছি। মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। এ কী করে সম্ভব! হ্যাঁ, বাবা যা ইচ্ছে করেন, তাই সম্ভব হয়। অন্তত অন্য কোথাও না হলেও, আমার জীবনে। সেই প্রায় বিস্তীর্ণ মরুভূমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা নির্জন নিরব ইস্কুল নামের বাড়িটিতে এনে বাবা বললেন ব্রহ্মপুত্রে তুমারে আমি ভাসাইয়া দিতে চাই না। তুমি আমার মেয়ে। আমার আত্মজা। আমি ছাড়া তুমার ভাল কেউ চায় না। ব্রহ্মপুত্রে যদি তুমি ডুবতে থাকো, তুমারে বাচাইয়া আনতে যদি কেউ ঝাঁপ দেয়, সে আমিই।

সারা ইস্কুলে হাতে গোণা ক’জন ছাত্রী মাত্র। পাঁচ ছ’জন মাস্টার। চোখের জল দু’হাতের তালুতে ঘন ঘন মুছে আমাকে বসতে হয় ক্লাসঘরে। ওদিকে বন্ধুরা বিদ্যাময়ীতে বিক্ষোভ করছে বাজ পাখির বিরুদ্ধে, যুদ্ধ-দেখা যুদ্ধংদেহি বন্ধুরা।

নতুন ইস্কুলে আমার মন বসে না। ইয়াসমিনেরও মন বসে না রাজবাড়ি ইস্কুলে। যুদ্ধের পর খিস্টান মিশনারিদের চালানো মরিয়ম ইস্কুল বন্ধ হয়ে গেলে ওকে রাজবাড়িতে ভর্তি করা হয়। টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার বা হামটি ডামটি স্যাট অন এ ওয়াল এর বদলে ওকে এখন পড়তে হয় তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে। ইস্কুলের মাদার ওকে কোলে নিয়ে আদর করত বলেই কিনা নাকি বেশিদিন এক জায়গায় কাটানোর পর একধরনের মমতা জন্মায় বলে ও ফাঁক পেলেই বিকেল বেলা বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা-পথ মরিয়ম ইস্কুল, গিয়ে তালা বন্ধ লোহার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। ইস্কুলের দালান ফেটে বটগাছের চারা বেরোচ্ছে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর এত মমতা বাড়িটির জন্য, বাড়িটি ভাঙা হোক কি মলিন হোক; বাড়ির পাশের গাছটির জন্য, গাছের পাশে মাঠটির জন্য, মাঠের পাশে পুকুরটির জন্য, ইস্কুলের দোলনাটির জন্য ও এত মন খারাপ করে থাকে যে বাবা ওর জন্য বাড়ির মাঠে একটি দোলনা বসিয়ে দিলেন। দোলনায় দুলতে দুলতে ও চোখ বুজে, মনে নিয়ে এটি ওর পুরোনো ইস্কুলের মাঠ, গায়– হাউ আই ওয়ান্ডা হোয়াট ইউ আর। পেছনে আমি কি ফেলে এসেছি ভাবি। কোনও দোলনা বা দালানের জন্য আমার মন কেমন করে কি আদৌ! না। রুনির জন্য করে, টের পাই। কেবল রুনির জন্যই কি! না। রুনি অনেকটা ধ্রুবতারার মত, তীব্র আলো ওর, কিন্তু বড় দূরের। ওকে অবশ্য দূরেই থাকা মানায়। ধুলো কাদায় আমার সঙ্গে প্রতিদিনকার লুটোপুটিতে ওই রূপসীকে আমি টানি না। যাদের নাকে সর্দি, দাঁতে ময়লা, চুলে উকুন, তাদের সঙ্গে আমার অভ্যস্ত জীবনের জন্যও মন কেমন করে। অভ্যস্ত জীবন এমনই, যে, মানুষ, বিশেষ করে সে যদি অন্তর্মুখি হয়, বোধহয় ভয় পায় সে জীবন থেকে দূরে এসে আবার নতুন কিছুতে অভ্যস্ত হতে। তৃণের সঙ্গে তৃণের দৈনন্দিন প্রীতি গড়ে উঠতে সময় নেয় না হয়ত, কিন্তু, তৃণ বটে আমি, ভিন্ন জাতের তৃণ, কুঁকড়ে থাকা।

নতুন ইস্কুলে আবার টিফিন নিজেদের নিয়ে আসার নিয়ম। বাবা প্রতিরাতে চাক চাক করে কাটা বড় ফ্রুট কেক নিয়ে আসেন বাড়িতে, ইস্কুলের টিফিন। টিফিন নিয়ে আসি ঠিকই, খেতে ইচ্ছে করে না। তার চেয়ে মনে হয় পুরোনো ছেঁড়া জুতো বেচে যে কটকটি পাওয়া যায়, খেতে আরাম হত। স্বাদ বদলাতে ইচ্ছে করে আমার। ফ্রুট কেক জগতে সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার বলে বাবা বিশ্বাস করতে পারেন, আমি করি না। অন্তত এইটুকু স্বাধীনতা আমার তো আছে, এ জিনিস আমার পছন্দ না করার এবং না খাওয়ার। সেদিন, টিফিন টিফিনের মত ফেলে রেখে বারান্দার রেলিং ধরে একা দাঁড়িয়ে ছিলাম, সামনে দেখার কিছু ছিল না পচা ডোবা বুজে মাঠ-মত বানানো ঊষড় জমি ছাড়া, আমাকে বিষম চমকে দিয়ে পিঠে হাত রেখেছিল রুনি। রুনিকে দেখে পেছোতে থাকি একপা দু’পা করে। ও আমার বেশি কাছে এলে যদি বুকের ধুকপুক আর রোমকূপের রিনরিন শুনে ফেলে, তাই পেঁছোই। রুনি পা পা করে সামনে এগোতে এগোতে বলতে থাকে, তেমনই মিষ্টি হেসে, আমি এখন এ ইস্কুলের টিচার্স কোয়ার্টারে থাকব। কী মজা তাই না! রেবেকা আপাকে চেনো? ইস্কুলের ডাক্তার। সে আমার বড় বোন।

আমি একটি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে রুনিকে দু’চোখ ভরে দেখতে থাকি। রেবেকা আপাকে আমি চিনি কি চিনি না তার উত্তর দিতে ভুলে যাই। আমাকে মূক করে ফেলে ধূমকেতুর মত রুনির পতন আমার নিঃসঙ্গ আঙিনায়। ভালবাসা, ভাবি, খুব গভীর হলেই সম্ভবত পারে কাংখিত মানুষকে চোখের সামনে এনে দাঁড় করাতে। রুনি আমার দিকে এগোতে থাকে হাত বাড়িয়ে, পেছোতে পেছোতে আমি দেয়ালে সেঁটে যাই।

— এই এত লজ্জা কেন তোমার! বলে সে কাঁধে হাত রাখে আমার। শরীরের ভেতর জাগে সেই অদ্ভুত শিহরণ, আমি যার অনুবাদ জানি না। দ্রুত শ্বাস পড়ে আমার, এত দ্রুত যে শ্বাস আড়াল করতে আমি দু’হাতে মুখ ঢাকি।

— বনভোজনে যাবে না? ইস্কুল থেকে সবাইকে বনভোজনে নিচ্ছে ধনবাড়ির জমিদার বাড়িতে। আমি যাব। সেই কতদূরে ধনবাড়ি। আমার খুব দূরে যেতে ইচ্ছে করে। রুনির দু’চোখে অল্প অল্প করে চোখ রাখি, দু’চোখে তার আকাশের সবটুকু নীল। ইচ্ছে করে পাখা মেলে উড়ি। রুনির নিটোল শরীর হেসে ওঠে আমার আধফোটা চোখে চেয়ে। এমন করে হাসতে পারে রুনি ছাড়া আর কে! রুনিকে আমি ভালবাসতেই পারি, ওকে যে কেউ যে কোনও দূরত্ব থেকে ভালবাসতে পারে। কিন্তু আমার প্রতি ওর ভালবাসা, জানি না এর নাম ভালবাসা কি না, সম্ভবত স্নেহ অথবা একধরনের প্রশ্রয় আমাকে বড় অপ্রতিভ করে। ও আমাকে যত কাছে টানে, তত আমি ক্ষুদ্র হতে থাকি। মহিরূহ যদি কোনও তুচ্ছ তৃণের দিকে ঝুঁকে থাকে, তবে তৃণ যে তৃণই তা বিষম প্রকট হয়ে ওঠে! আমি নিজের কোনও অস্তিত্ব অনুভব করি না রুনি যখন আমাকে ভালবাসে, বুঝি।

গাঢ় অমাবস্যায় যদি হঠাৎ চাঁদ উঠে জ্যোৎস্নায় ভিজেয়ে ফেলে চারদিক আর সেই জ্যোৎস্না যদি আমাকে ভাসিয়ে নেয় দোলন চাঁপার বাগানে, তবে! রুনি চলে যাওয়ার পরও আমি দাঁড়িয়েই থাকি সেখানে, যেন এটিই আমার একমাত্র গন্তব্য যেখানে পৌঁছব বলে স্বপ্ন দেখছি সহস্র বছর। হঠাৎ নতুন ইস্কুলের মরা গাছপালাকেও বড় জীবন্ত মনে হয়। ইস্কুলের দালানগুলোকে বড় প্রাণবান মনে হয়। ধুলো ওড়ানো হু হু হাওয়াকেও মনে হয় চমৎকার দখিনা বাতাস। ধুসর মাটিও রুনির পা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবুজ হয়ে উঠেছে। ইচ্ছে করে খালি পায়ে দৌড়ে যাই ঘাসে।

বনভোজনে যেতে হলে দশ টাকা চাঁদা দিতে হবে ইস্কুলে। বাবার কাছে দশ টাকা চাইলে শান্ত কণ্ঠে বললেন–যাওয়ার দরকার নাই।

এও কি হয়! আমি বলি–যাইতেই হইব।

বাবা খেঁকিয়ে ওঠেন–যাইতেই হইব! কে তরে জোর করবে! বনভোজন কি কোনও সাবজেক্ট? না গেলে নম্বর কম ওঠে!

বাবা টাকা দিলেন না।

এদিকে ইস্কুলে মেয়েরা বনভোজনে যাওয়ার খুশিতে বুঁদ হয়ে আছে। আমি কেবল একা আহত পাখির মত তড়পাচ্ছি। আমাকে বাঁচায় আয়শা নামের এক মেয়ে, বলে তুমার টাকা না থাকলে আমার কাছ থেইকা কর্জ নেও। সে দিব্যি দশ টাকা কর্জ দিয়ে দিল। বনভোজনে যাওয়ার লিস্টিতে নাম উঠল আমার। ভোরবেলা ট্রাকে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ধনবাড়ি। রুনি বসেছিল মাস্টারদের আর বড় ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে বাসে। বড় বড় ডেকচি পাতিল, চাল ডাল, থালবাসন বাসের ছাদে তুলে মাইকে গান বাজিয়ে রওনা হয়ে গেল আমাদের যন্ত্রযান। ধনবাড়িতে রুনির সৌন্দর্য আমি দূর থেকে দেখি, ও বামে গেলে আমি ডানে ফিরি, ও ডানে গেলে আমি বামে। ও চোখের আড়াল হলে আমি অস্থির হয়ে খুঁজি ওকে। ওকে দৃষ্টির নাগালে রেখে আমি বসে থাকি চুপচাপ গাছের ছায়ায় কিম্বা সিঁড়িতে, একা। বনভোজন থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধে পার হয়ে যায়, বাড়ি ফিরে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায় আমার অপেক্ষায়।

— এত দেরি হইল ক্যান ইস্কুল থেইকা ফিরতে? বাবা খপ করে ধরলেন আমাকে।

নখ খুঁটতে খুঁটতে জবাব দিলাম–বনভোজনে গেছিলাম।

বাবা টেনে আমাকে উঠোনে নিয়ে কাঁঠাল গাছের ডাল ভেঙে এনে পেটান। বাবা মা পেটালে পিঠ পেতে রাখতে হয়, এরকমই নিয়ম। পিঠ পেতে রাখি আমি। মনের ঝাল মিটিয়ে পিটিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করেন–টেকা কেডা দিছে বনভোজনে যাওয়ার? স্বর ফুটতে চায় না গলায়, তবু বলি, যেহেতু বাবা মা কোনও প্রশ্ন করলে উত্তর দিতেই হয়, যে ক্লাসের এক মেয়ে কর্জ দিছে।

বাবা এবার জোরে এক থাপ্পড় কষান গালে। কর্জ কইরা বনভোজন করস। এত শখ ক্যান? তর শখ আমি পুটকি দিয়া বাইর করাম।

পরদিন সকালে বাবা বেরিয়ে যাওয়ার আগে ইস্কুলে যাওয়া আসার রিক্সা ভাড়ার জন্য বরাদ্দ এক টাকার সঙ্গে দশ টাকার একটি নোট ছুঁড়ে দিয়ে বলেন–এরপর থেইকা যদি কথা না শুনস, যেইভাবে কই সেইভাবে না চলস, তাইলে তর পিঠে উঠানে যত খড়ি আছে, সব ভাঙবাম।

বনভোজন পার হওয়ার পর, রব ওঠে ইস্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, যে যা জানে নাচ, গান, আবৃত্তি তাই নিয়ে মঞ্চে দাঁড়াতে হবে। কমন রুমে হারমোনিয়াম বাজিয়ে মেয়েরা গান মকশো করে। রবীন্দ্রনাথের পূজারিণী কবিতার ওপর ছোট একটা নাটকমতও। আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা গানটির সঙ্গে সঙ্গে নাচ আর চকখড়িতে ধানের ক্ষেত, শাদা মেঘের ছবি আঁকার আয়োজন হয়। এসব দেখতে দেখতে একটি হাওয়াইন গিটার হাতের কাছে পেয়ে এক ফাঁকে ছোটদার গানের খাতা দেখে গোপনে শেখা ‘এত সুর আর এত গান যদি কোনওদিন থেমে যায়, সেইদিন তুমিও তো ওগো, জানি ভুলে যাবে যে আমায়’ বাজিয়ে বসি। শুনে মেয়েরা ধরল অনুষ্ঠানে আমাকে গিটার বাজাতে হবে। বাজাতেই হল। আঙুল কাঁপছিল, পা কাঁপছিল, ওই কাঁপাকাঁপির মধ্যেই যেটুকু বেরিয়ে এল তাতে শুনেছি, অনেকে বলেছে বাহ। নতুন ইস্কুলে ততদিনে ভাল ছাত্রী বলে আমার বেশ নাম হয়েছে। ড্রইং ক্লাসে আমাকে বলা হয় জিনিয়াস, ইংরেজি ক্লাসে বলা হয়, এক্সেলেন্ট, এক্সেলেন্ট রচনা নাকি লিখেছি ভর্তি পরীক্ষায়। বাংলার মাস্টার বলেন–তুমি তো দেখছি কবি হে।

ইস্কুলে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শুরু হল গার্লস গাইডে মেয়ে নেওয়া। শারীরিক কসরত শুরু হল। গলায় ড্রাম বেঁধে ড্রাম বাজানো শিখছি। সার্কিট হাউজের মাঠে বিজয় দিবসে গার্লস হাইডের দল গিয়ে কাঠি নাচ নেচে এলাম। যা কিছুই করি, মুখ থাকে নিচু, চোখ লজ্জায় আনত। নাচের মাস্টার যোগেশ চন্দ্র আসেন ইস্কুলে মেয়েদের নৃত্যনাট্য শেখাতে, রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা। লজ্জাবতী লতাকে খপ করে ধরে বলেন–এই, চিত্রাঙ্গদা হবি? লজ্জাবতী যোগেশ চন্দ্রের ঠ্যাংএর ফাঁক গলে পালায়। চিত্রাঙ্গদার মহড়া শুরু হয়। মহড়া দেখে উত্তেজিত আমি বাড়ি ফিরে ইয়াসমিনকে সখী বানিয়ে বাড়ির মাঠ জুড়ে নেচে নেচে গাই গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে, পর্বত শিখরে অরণ্যে তমস ছায়ায়। আমিই হই চিত্রাঙ্গদা, আমিই হই অর্জুন, মদন। ইস্কুলে মহড়া চলে, আর বাড়িতে চলে আমার মঞ্চায়ন। দর্শকের সারিতে মা, মণি, দাদা, ছোটদা, পপি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *