১০. ফজলুল করিম সাহেব

ফজলুল করিম সাহেব তেমন কিছু খাচ্ছেন না। প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করছেন। প্লেটে ডাল নিতে গিয়েও নিলেন না। অথচ সজনে দিয়ে ব্রাধা ডাল তার অতি প্রিয়। রেশমী বলল, আপনার কি হইছে?

কিছু হয় নাই। আমার ক্ষিধা একেবারেই নাই।

দুপুরে স্কুলে কি খাইছেন?

দুপুরে কিছু খাইনি। এই জন্যেই মনে হয় পিত্ত পড়ে গেছে। কিছু খেতে ভাল লাগছে না।

জ্বর জ্বারি হয় নাই তো?

রেশমী ফজলুল করিম সাহেবের কপালে হাত রাখল। ফজলুল করিম সাহেবের মনে হল উত্তাপ দেখতে যতটুকু সময় লাগে রেশমী যেন তার চেয়ে বেশি সময় হাত কপালে রাখল।

আপনি কি কিছু নিয়া চিন্তিত? উঁহুঁ।

নতুন স্কুলে না-কি আপনার স্কুলের সব ছাত্র চইল্যা যাইতেছে। তা যাচ্ছে।

রেশমী হাসি মুখে বলল, খালি স্কুল নিয়ে আপনি বইস্যা আছেন। দোকান আছে, দোকানদার আছে সওদা নাই।

হাসি তামশা কিছু হয়নি রেশমী। হসিবে না।

মনের ভুলে হাসছি। পান দাও রেশমী, পান খাব।

রেশমী পান এনে দিল। ফজলুল করিম সাহেব পান মুখে দিতে দিতে বললেন, খালি স্কুল আবার পূর্ণ হবে।

ক্যামনে হবে? এবার এসএসসির রেজাল্ট হলেই দেখবে ছাত্র ছাত্রীরা আবার আসতে শুরু করেছে।

কেন?

ষ্টান্ড করবে। অবশ্যই করবে। গ্রামের স্কুল থেকে স্ট্যান্ড করলে সবার নজর পড়বে স্কুলের দিকে। আমাদের কয়েকজন ভাল ছাত্র এইবার আছে। এর মধ্যে একজন আছে–খুবই ভাল। শুধু হাতের লেখাটা খারাপ। লেখাটা যদি একটু ভাল হত।

ছাত্রটা কে বদরুল আলম

ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন,তুমি জান কিভাবে? রেশমী হাসিমুখে বলল, আপনার স্কুলে কি হইতেছে না হইতেছে আমি জানব না?

অবশ্যই জানবে। কেন জানবে না?

আপনে স্কুল নিয়া অত চিন্তা কইরেন না। অত চিন্তার কি আছে?

চিন্তা করব না কি বল তুমি। স্কুল যদি উঠে যায়?

উঠে গেলে কি আর করণ। দুনিয়ায় কিছু টিক্যা থাকে না।

ফজলুল করিম সাহেব তাকিয়ে রইলেন। রেশমী বলল, একটা স্কুল চইল্যা গেলে চইল্যা যাবে। আরেকটা নয়া স্কুল হইছে। আফনে আমার একটা কথা হুনবেন?

কি কথা?

আফনে গিয়া নীলগঞ্জ ইস্কুলের হেডমাস্টার হন।

নতুন স্কুলের হেডমাস্টার হব?

হুঁ। আপনের ছাত্র পড়ানি দিয়া কথা। কোন ইস্কুল সেইটা দিয়া দরকার কি? তার উপরে এমন না যে এই ইস্কুল আফনে বানাইছেন।

ফজলুল করিম সাহেব আহত গলায় বললেন, এই নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করতে চাচ্ছি না। চুপ কর। যা জান না তা নিয়ে তর্ক করাও ঠিক TI

রেশমী আহত গলায় বলল, আমি হইলাম দাসী বান্দি–আমার জানা অজানার দাম কি?

সে তার ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে রইল। রাতে ভাত খেল না। ফজলুল করিম সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, আজকাল তোমার হয়েছে কি বল

তো দেখি–কথায় কথায় রাগ।

রেশমী জবাব দিল না।

এরকম করলে কিন্তু আমি চলে যাব। স্কুল ঘরে রাত কাটাব। সেটা ভাল হবে

রেশমী দরজা খুলে বের হয়ে এল। সে কাঁদছিল। তার গাল ভেজা। ভেজা গাল সে মুছল না। ভেজা গালেই খেতে বসল। ফজলুল করিম সাহেব মোড়া টেনে তার পাশে বসলেন। রেশমী বলল, কেউ চাইয়া থাকলে আমি খাইতে পারি না। আপনে অন্য ঘরে গিয়ে বসেন। তিনি নড়লেন না। রেশমীর কোন কথা তিনি শুনতে পাচ্ছেন বলে মনে হল না। তিনি তাকিয়ে আছেন রেশমীর দিকে, কিন্তু ভাবছেন অন্য কথা। পাশ বই-এ তাঁর কিছু টাকা আছে। গ্রামের বসতবাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করে নগদ টাকা রেখে দিয়েছিলেন ভবিষ্যতের জন্যে। নব্বই হাজারের মত। সুদ টদ নিয়ে সেই টাকা এখন বেড়ে এক লাখ তিরিশ হাজার হয়েছে। এই টাকা ব্যবহার করা যেতে পারে। তার স্ত্রীর কিছু গয়না আছে। সামান্যই–গয়না এখন আর কি কাজে আসবে? সকাজ তো তেমন কিছু তিনি করেননি। সামান্য সৎকাজ করা হল।

স্কুলের কত ছাত্র দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের কাছে কোনমতে খবরটা পৌছাতে পারলেও তো কাজ হবে।

রেশমী বলল, কি ভাবেন?

না কিছু ভাবি না।

আপনে দিন রাইত ভাবেন। অত ভাইব্যা ফয়দা নাই। যা হওনের হইব।

ফজলুল করিম জবাব দিলেন না। যা হবার তা হবে ঠিকই–তবু চেষ্টা করে যেতে হবে।

বেতন দিতে না পারলে স্কুলের শিক্ষকরা থাকবেন না। শিক্ষক না থাকলে ছাত্র থাকবে না… আচ্ছা সিরাজ সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করলে কেমন হয়? তিনিও তো সাহায্যের কথা বলেছিলেন। তিনি যদি তার মার নামে স্কুল না দিয়ে কলেজ দিতেন তাহলে খুব ভাল হত। ছাত্ররা তার স্কুল থেকে পাশ করে পাশেই কলেজে ভর্তি হয়ে যেতে পারত।

চা খাইবেন? এটু চা বানাইয়া দেই?

দাও।

রেশমী চা বানাতে বানাতে বলল, চিন্তায় চিন্তায় আফনের চউক্ষের নিচে কালি জমছে। আফনের অত কি চিন্তা? এই ইস্কুল কি আফনের একলার ইস্কুল?

স্কুল সবার। কিন্তু আমি হচ্ছি স্কুলের প্রধান।

 

বারান্দায় বসে ফজলুল করিম সাহেব চা খাচ্ছেন। একটু দূরে খুঁটিতে হেলান দিয়ে রেশমী বসে আছে। রেশমী হাসছে। অকারণেই খিলখিল করে হাসছে। হাসির কোন কথা তো হয়নি। মেয়েটা হাসছে কেন? ফজলুল করিম সাহেব বললেন, হাস কেন?

রেশমী মুখে আঁচল চাপা দিতে দিতে বলল, নিজেই জানি না ক্যান হাসি। আফনে যখন ঘরে থাকেন না তখন আরো বেশি হাসি। হি হি হি।

হাসি সামলাবার জন্যে রেশমী ঘরে ঢুকে গেল। চায়ের কাপ হাতে অস্বস্তি ও বিস্ময় নিয়ে ফজলুল করিম সাহেব বসে রইলেন। তাঁর ইচ্ছা করছে রাতে একবার স্কুলে যেতে! লাইব্রেরী ঘর খালি করে চারটা ছেলেকে রাখা হয়েছে। ওরা পড়াশোনা কেমন করছে না করছে দেখা দরকার। অবশ্যি শিক্ষকদের ডিউটি ভাগ করে দেয়া হয়েছে। মৌলানা ইরতাজউদ্দিন রাত এগারোটা পর্যন্ত থাকবেন। আবার ফজর ওয়াক্তে ফজরের নামাজের পর ছাত্রদের ঘুম থেকে ডেকে তুলবেন। খুব ভোরবেলা অংক করার জন্য সবচে ভাল সময়। বিনয় বাবু নীলগঞ্জ স্কুলে যোগ দিলেও ভোরবেলা এসে অংক করিয়ে দেন। অনেকদিন বিনয় বাবুর সঙ্গে দেখা হয় না। লজ্জায় পড়েই বোধ হয় বিনয় বাবু তাকে এড়িয়ে চলেন। নীলগঞ্জ স্কুলে গিয়ে একবার বিনয় বাবুর লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের সুদিন যদি আসে বিনয় বাবু ফিরেও আসতে পারেন। তার মত অংক জানা একজন লোক থাকা স্কুলের জন্যে বিরাট ব্যাপার।

রেশমী।

জ্বি।

একটু স্কুলে যাচ্ছি।

এই রাইতে?

দেখে আসি ছেলেগুলি কি করে। তাছাড়া রাতের খাবারের পর একটু হাঁটাহাটি করা শরীরের জন্যে ভাল। কথায় আছে আফটার ডিনার ওয়াক এ মাইল।

চলেন যাই।

ফজলুল করিম বললেন, তুমিও যাবে?

সুন্দর চান্নি পসর রাইত। হাঁটতে ইচ্ছা করতাছে।

ফজলুল করিম সাহেব চুপ করে রইলেন। রেশমী বলল, নয়া ইস্কুলে কি–কি দোলনা বসাইছে–দেইখ্যা আসি।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, দোলনা, সি সো স্লাইড এইসব বসিয়ে পার্কের মত করেছে। ছাত্ররা খেলাধুলা করে। আমরাও ইনশাআল্লাহ্ বসাব। তুমি কি সত্যি যাবে?

হুঁ।

চল তাহলে।

কাপড়টা বদলাইয়া একটা ভাল কাপড় পরি।

রেশমী স্কুল ঘরে ঢুকল না। স্কুলের বাইরে বকুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রইল। ফজলুল করিম সাহেব একাই গেলেন। মওলানা ইরতাজউদ্দিন আছেন। বারান্দায় জায়নামাজ পেতে তসবি পড়ছেন। ছেলেরা হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ছে। হরিপদও আছে। তার এখন দিন রাত্রি ডিউটি। রাতে বারান্দায় মশারি খাটিয়ে শুয়ে থাকে। ছাত্রদের কখন কি দরকার হয়। রাতে তার ভাল ঘুম হয় না। সে ভূতের ভয়ে অস্থির থাকে। লাইব্রেরী ঘরেই সে জীবন বাবুর ভুত দেখেছিল। ছাত্রদের সে এই ঘটনা বলেনি। বাচ্চা মানুষ শুধু শুধু ভয় পাবে, কি দরকার।

মওলানা জায়নামাজ থেকে উঠে এলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, পড়াশোনা চলছে ঠিক মত?

জি চলছে। আপনার আসার দরকার ছিল না। অনেকটা পথ। এসেছেন কিভাবে? হেটে?

হুঁ। চাঁদনী আলোয় হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি। চলুন ছেলেদের দেখে আসি।

চলুন যাই, আপনাকে দেখলে ওরা উৎসাহ পাবে।

ছেলেরা হেড স্যারকে দেখে অভিভূত হয়ে গেল। মওলানা বললেন, তোমরা এমন পাথরের মুর্তির মত বসে আছ কেন? স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম কর। দোয়া পাবে। দোয়াটা খুব দরকার। আল্লাহ্ পাক বলেছেন–আমি যাহাকে ইচ্ছা সম্পদ দেই। যাহাকে ইচ্ছা সম্মান কেড়ে নেই।

ছাত্ররা সালাম করতে এগিয়ে এল। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, বদরুল তোমার হাতের লেখার অবস্থাটা কি? কিছু উন্নতি হয়েছেঃ

বদরুল মাথা নিচু করে রাখল।

রোজ কুড়ি পাতা করে হাতের লেখা লেখার কথা, লিখছ তো?

জ্বি স্যার।

কই আজকে কি লিখলে দেখি।

বদরুল কাগজের তাড়া নিয়ে এল। হাতের লেখার তেমন উন্নতি হয়নি, তবে আগের চেয়ে পরিস্কার হয়েছে।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, এই স্কুল রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের উপর। তোমরা যদি অসাধারণ রেজাল্ট করে সবাইকে চমকে দিতে পার তাহলে আমরা টিকে যাব। পারবে না বাবারা?

কেউ জবাব দিল না। তারা হেড স্যারকে অসম্ভব ভয় পায়। হেড স্যারের সামনে কথা বলা তাদের পক্ষে সম্ভব না।

মওলানা হেড স্যারকে এগিয়ে দিতে আসছেন। বকুল গাছের কাছে এসে চমকে উঠে বললেন, এ কে?

রেশমী চট করে আড়ালে সরে গেল। ফজলুল করিম সাহেব বললেন–ও রেশমী। আমার সঙ্গে এসেছে। চাদনি পসর রাত দেখে তার হাঁটার শখ হয়েছে।

মওলানা গম্ভীর গলায় বললেন, ও আচ্ছা।

নতুন স্কুলটাও দেখতে চেয়েছিল। দেখায়ে এনেছি।

ভাল।

মওলানা তাদের জীবন বাবুর কাঠের পুল পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। সারা পথে কঠিন দৃষ্টিতে রেশমীর দিকে কয়েকবার তাকানো ছাড়া একটি কথাও বললেন না। ফজলুল করিম সাহেব অনর্গল কথা বলে গেলেন বুঝলেন মওলানা সাহেব, শিক্ষকদের বেতনের একটা ব্যবস্থা করেছি। অস্থায়ী ব্যবস্থা স্থায়ী কিছু চিন্তা করতে হবে। বাজারে যে জমি স্কুলের আছে সেখানে ঘর তুলে দিলে কেমন হয়? ভাড়া যা আসবে তাতে স্কুলের কিছু আয় হবে। কিছু জমি বিক্রির ব্যাপারও চিন্তা করা যেতে পারে। স্কুল কমিটির সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতদিনের স্কুল বানের জলে ভেসে যেতে পারে না। কি বলেন! তবে সরকারী অনুদানটা চলে এলে অবস্থা অন্য রকম হয়ে যাবে কি বলেন?

মওলানা শুধু মাথা নাড়ালেন, কিছু বললেন না।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আমার এখন পরিকল্পনা হল স্কুলের ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে পুরানো ছাত্রদের ঠিকানা বের করা। সাহায্য চেয়ে এদের সবার কাছে চিঠি যাবে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিব।

হুঁ।

আমি আশা হারাবার কিছু দেখছি না।

মওলানা ক্ষীণ গলায় বললেন, মাহবুব সাহেব নীলগঞ্জ স্কুলে এ্যাসিসটেন্ট হেড মাষ্টার হিসেবে জয়েন করেছেন, শুনেছেন বোধ হয়।

ফজলুল করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, শুনিনি তো।

আজই জয়েন করেছেন।

একটা স্কুল থেকে রিজাইন না করে অন্য স্কুলে জয়েন করবেন কিভাবে?

রিজাইন করেছেন। আমার কাছে রেজিগনেশন লেটার দিয়ে গেছেন।

উনি চলে যাবেন ভাবিনি!

উনার দেখাদেখি আরো অনেকেই যাবে। কে জানে হয়ত আমিও যাব। শুধু আপনি একাই থাকবেন।

রেশমী হাসছে। প্রথমে চাপা হাসি। তারপর মুখে আঁচল মুখে খিলখিল হাসি। ফজলুল করিম সাহেব মেয়েটির হঠাৎ হঠাৎ হাসির কারণ ধরতে পারছেন না। এটা কি হাসির সময়? ভার তীব্র মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে। হঠাৎ করে মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। প্রেসার কি বেড়ে গেল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *