১০. প্রোটাগোরাস
সক্রেটিস-পূর্ব দর্শনের যেসব ধারা সম্পর্কে আমরা আগের অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করছিলাম, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তা একটি সংশয়বাদী আন্দোলনের মুখোমুখি হয়। সে-আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন সফিস্টদের নেতা প্রোটাগোরাস। শুরুতে সফিস্ট শব্দটির কোনো নেতিবাচক ব্যঞ্জনার্থ ছিল না : এ যুগে অধ্যাপক বলতে আমরা যা বুঝি সে যুগে সফিস্ট শব্দটির অর্থ ছিল তারই কাছাকাছি। একজন সফিস্ট ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি তরুণ-যুবকদের কতিপয় বিষয়ে শিক্ষাদানের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করতেন। যেসব বিষয়কে তখনকার সমাজে ব্যবহারিক, বাস্তব জীবনে দরকারি ও উপকারী মনে করা হতো সেগুলোই ছিল সফিস্টদের শিক্ষাদানের বিষয়। সে রকম শিক্ষাদানের কোনো সরকারি ব্যবস্থা সে যুগে ছিল না বলে সফিস্টরা শুধু তাদেরই শিক্ষা দিতেন যাদের নিজেদের বা তাদের পিতামাতাদের আর্থিক সঙ্গতি ছিল। ফলে সফিস্টদের মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণির প্রতি পক্ষপাত ছিল, যা ওই সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশের দ্বারা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এথেন্স ও অন্য অনেক নগরীতে রাজনৈতিকভাবে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছিল, কিন্তু প্রাচীন অভিজাত পরিবারগুলোর অর্থ-সম্পদ প্রায় অক্ষত ছিল। আমাদের কাছে হেলেনিক সংস্কৃতি বলে যা প্রতিভাত হয় তা ছিল মূলত ওই ধনীদের সংস্কৃতি। তাদের শিক্ষা ছিল, অবকাশ ছিল, পর্যাপ্ত ভ্রমণের ফলে তাদের জাতীয় সংস্কারাদি দূর হয়েছিল এবং তত্ত্বালোচনায় তারা যে সময় অতিবাহিত করত তার ফলে তাদের বুদ্ধি শাণিত হয়েছিল। যে ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলা হতো তা দাসপ্রথাকে স্পর্শ করেনি। আর দাসপ্রথার কল্যাণে ধনীদের সম্পদ ভোগের জন্য মুক্ত নাগরিকদের শোষণ-নিপীড়ন করার প্রয়োজন হতো না। অবশ্য অনেক নগরীর, বিশেষত এথেন্সের, দরিদ্রতর নাগরিকরা ধনীদের প্রতি দ্বিগুণ শত্রুমনোভাবাপন্ন ছিল, তাদের প্রতি তাদের হিংসা ছিল, তাদের ঐতিহ্যের প্রতি ছিল বিদ্বেষ। সাধারণত এবং প্রায়ই ন্যায্যত, মনে করা হতো যে ধনীরা পাপী, তারা প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসকে নষ্ট করছিল এবং সম্ভবত গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছিল। এভাবে এমনটা ঘটে যে, রাজনৈতিক গণতন্ত্র ছিল সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, আর সাংস্কৃতিক দিক থেকে যারা নব্যপন্থী ছিল তাদের রাজনৈতিক ঝোঁক ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। কিছু মাত্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে আধুনিক আমেরিকায়, যেখানে ট্যামমানি মূলত একটি ক্যাথলিক সংগঠন হিসেবে আলোকায়নের ধাক্কা সামলাতে প্রাচীন ধর্মতাত্ত্বিক ও নৈতিক অন্ধবিশ্বাসগুলো রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত। কিন্তু আমেরিকার আলোকপ্রাপ্তরা এথেন্সের আলোকপ্রাপ্তদের চেয়ে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল। কারণ তারা ধনিকতন্ত্রের স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থকে মেলাতে পারেনি। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত বুদ্ধিমান শ্রেণি আছে যারা ধনিকতন্ত্র রক্ষার পক্ষে কাজ করছে। তারা হচ্ছে করপোরেশন আইনজীবী শ্রেণি। এথেন্সের সফিস্টরা যা করেছিলেন, কিছু দিক থেকে আমেরিকার করপোরেশন আইনজীবীদের কাজকর্ম সে রকম।
দাস ও নারীদের কোনো জায়গা ছিল না এথেন্সের গণতন্ত্রে, এ দিক থেকে ওই গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা ছিল বিরাট। কিন্তু তা সত্ত্বেও এথেন্সের গণতন্ত্র আজকের যুগের যেকোনো আধুনিক ব্যবস্থার চেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক ছিল। বিচারক ও অধিকাংশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা নির্বাচিত হতেন জনগণের দ্বারা, তাদের কার্য মেয়াদ ছিল সংক্ষিপ্ত। এ দিক থেকে তারা ছিলেন আমজনতার শামিল, আমাদের জুরিদের মতো। সাধারণ নাগরিকদের মতো তাদেরও পেশাদারি মনোভাবের অভাব ছিল এবং তারা নানা সংস্কারে আচ্ছন্ন ছিলেন। সাধারণত বিচারকের সংখ্যা হতে প্রচুর, তারা প্রত্যেকটি মামলা-মোকদ্দমা শুনতেন। বাদী-বিবাদী, অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত ব্যক্তি সশরীরে হাজিরা দিতেন, পেশাদার আইনজীবী নিয়োগের ব্যবস্থা ছিল না। ফলে স্বভাবতই সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করত সাধারণ্যে প্রচলিত বিশ্বাস, নীতি ও মূল্যবোধকে সন্তুষ্ট করতে পারার দক্ষতার ওপর। যেকোনো ব্যক্তিকে নিজের বক্তব্য নিজেকেই পেশ করতে হতো। তবে তিনি নিজের বক্তব্য লেখার জন্য একজন পেশাদার বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করতে পারতেন, অথবা অনেকেই যেটা করতেন, আদালতকে অর্থ প্রদানের বিনিময়ে বক্তব্য প্রদানের কলাকৌশলসংক্রান্ত নির্দেশনা পাওয়া যেত। ধারণা করা হয় যে, আদালতে বক্তব্য প্রদানের কলাকৌশলও সফিস্টরা শিক্ষা দিতেন।
এথেনীয় ইতিহাসের পেরিক্লিস যুগের সঙ্গে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের ভিক্টোরীয় যুগের তুলনা করা চলে। এথেন্স ছিল সম্পদশালী ও ক্ষমতাধর, যুদ্ধসংক্রান্ত সমস্যাদি তার বিশেষ ছিল না এবং ওই নগরীর একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো ছিল, যা অভিজাতদের দ্বারা পরিচালিত হতো। অ্যানাক্সাগোরাসের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, পেরিক্লিসের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক পক্ষ ক্রমে শক্তি অর্জন করে এবং তার মিত্রদের একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে। পেলোপনেসীয় যুদ্ধ আরম্ভ হয় খ্রি.পূ. ৪৩১ অব্দে। এথেন্স (আরো অনেক স্থানের মতো) প্লেগ মহামারীতে কাহিল হয়ে পড়ে। সেখানকার জনসংখ্যা-যা ছিল প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার-ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। পরে আর কখনোই ওই নগরীর জনসংখ্যা বেড়ে আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি। ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পেরিক্লিস নিজে জেনারেলের পদ থেকে উৎখাত হন এবং সরকারি অর্থের অসদ্ব্যবহারের দায়ে তার জরিমানা হয়। তবে অচিরেই তিনি পুনর্বাসিত হন। তার দুই বৈধ পুত্র প্লেগ রোগে মারা যায় এবং পরের বছর (৪২৯ খ্রি.পূ.) তারও মৃত্যু ঘটে। ফিডিয়াস ও অ্যানাক্সাগোরাসের শাস্তি হয়, অধর্মাচার ও বাসভবন বিশৃঙ্খল করে রাখার দায়ে আসপিয়াসের বিচার হয়, তবে তিনি খালাস পেয়ে যান। এ রকম একটি সমাজে, যেখানে গণতন্ত্রী রাজনীতিকদের শত্রুতার শিকার হওয়ার ঝুঁকি সবারই ছিল, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই লোকজন মামলা-মোকদ্দমা লড়ার কৌশলাদি রপ্ত করতে চাইত। এথেন্সে যদিও শাস্তিপ্রদান ও মামলা বাজির প্রবণতা প্রকট ছিল, তথাপি এক দিক থেকে ওই সমাজ আধুনিক আমেরিকার চেয়ে অধিকতর উদারপন্থী ছিল। কারণ যাদের বিরুদ্ধে অধর্মাচার বা যুবসমাজকে পথভ্রষ্ট করার অভিযোগ আনা হতো, তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হতো।
এ থেকে একটি শ্রেণির মধ্যে সফিস্টদের জনপ্রিয়তা এবং অন্য শ্রেণির মধ্যে তাদের প্রতি বিদ্বেষের ব্যাপারটি বোঝা যায়। কিন্তু সফিস্টদের নিজেদের মানসিকতার কথা বললে, তারা কাজ করতেন বেশ নৈর্ব্যক্তিকভাবে। এটাও পরিষ্কার যে, তাদের অনেকেই সত্যিকারভাবে দর্শনের প্রতি মনোযোগী ছিলেন। প্লেটো অবশ্য সফিস্টদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করার ও তাদেরকে খলচরিত্ররূপে তুলে ধরার কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু প্লেটোর রচনাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন চরিত্রের বাকবিতণ্ডাকে ভিত্তি করে সফিস্টদের বিচার করা উচিত হবে না। প্লেটো বেশ হালকা মেজাজে ইউথাইডেমাস নামে যে সংলাপটি রচনা করেছেন, সেখানে এক জায়গায় ডায়োনিসোডরাস ও ইউথাইডেমাস নামে দুই সফিস্ট ক্লেসিপাস নামে এক সরলমনা ব্যক্তিকে বোকা বানাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। সংলাপটির একটি অনুচ্ছেদ নেওয়া যাক; ডাইনোসোডরাস ক্লেসিপাসকে আক্রমণ করছেন–
আপনি বলছেন, আপনার একটি কুকুর আছে?
ক্লেসিপাস বললেন, হ্যাঁ, পাজির পাজি একটি।
আর সেটির কয়েকটি বাচ্চা আছে?
হ্যাঁ, সেগুলো ওইটার মতোই।
আর কুকুরটা ওই বাচ্চাগুলোর বাপ?
তিনি (ক্লেসিপাস) বললেন, হ্যাঁ, আমি ওটিকে আর ওই বাচ্চাগুলোর মাকে একসঙ্গে দেখেছি।
তাহলে কুকুরটা আপনার নয়?
নিশ্চয়ই আমার।
তাহলে সে একটি বাপ, আর সে আপনার। অতএব, সে আপনার বাপ, আর তার বাচ্চাগুলো আপনার ভাই।
একটু গুরুতর মেজাজে প্লেটোর সফিস্ট নামের সংলাপটি বিবেচনা করা যাক। এটি বিভিন্ন বিষয়ের সংজ্ঞা নির্ণয় সম্পর্কিত একটি আলোচনা, যা একজন সফিস্ট একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই আলোচনার যুক্তি এ মুহূর্তে আমাদের বিবেচ্য নয়, এই সংলাপটির চূড়ান্ত উপসংহারটিই আমি এ মুহূর্তে উল্লেখ করতে চাই : ধন্ধ লাগানোর কালোয়াতির উদ্ভব ঘটেছে কপট একধরনের আত্মদর্পী ভান বা অনুকৃতি থেকে, কাজটা সাদৃশ্য তৈরির মতো, এসেছে মূর্তি তৈরি থেকে, যা কোনো ঐশ্বরিক গুণ নয়, বরং মানুষেরই কর্ম, কথার ছায়াবাজি মাত্ৰ-একজন সাচ্চা সফিস্টের রক্তে বংশপরম্পরায় কাজ করে এটাই। (কর্নফোর্ডের অনুবাদ)
প্রোটাগোরাস সম্বন্ধে একটি কাহিনি প্রচলিত আছে, নিঃসন্দেহে প্রশ্নসাপেক্ষ কাহিনি সেটি। সেখানে জনমনে আইন-আদালতের সঙ্গে সফিস্টদের সম্পর্কের বিবরণ পাওয়া যায়। বলা হয় যে, প্রোটাগোরাস এক যুবককে শিক্ষাদান করতেন, তবে তা এই শর্তে যে, ওই যুবকটি তার প্রথম মোকদ্দমায় জিতলেই শুধু প্রোটাগোরাসকে সে তার পারিশ্রমিক প্রদান করবে, অন্যথা নয়। যুবকটি তার প্রথম মোকদ্দমায় জিতেছিল এবং প্রোটাগোরাস তার পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন।
যাই হোক, এখন এসব প্রাথমিক কথাবার্তা ছেড়ে আমাদের এখন দেখা উচিত প্রোটাগোরাস সম্বন্ধে আসলে কী জানা গেছে।
পোটাগোরাসের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে অ্যাবডেরা নগরীতে, যে নগরীর সন্তান ছিলেন ডেমোক্রিটাস। প্রোটাগোরাস এথেন্স সফর করেছিলেন দুই বার, দ্বিতীয় সফরটি কোনোক্ৰমে খ্রি.পূ. ৪৩২ সালের পরে নয়। ৪৪৪-৪৪৩ সালে তিনি ওই নগরীর জন্য একটি আইন-বিধি তৈরি করেছিলেন। শোনা যায় যে, অধর্মাচারের দায়ে তার বিচার হয়েছিল, কিন্তু তা সত্য বলে মনে হয় না। অবশ্য তিনি On The Gods নামে একটি বই লিখেছিলেন, যা শুরু হয়েছে এভাবে : দেবতাদের সম্বন্ধে বলতে গেলে, আমি নিশ্চিত নই তারা আছেন, না নেই, বা আকারে-প্রকারে তারা কেমন, কেননা বিষয়বস্তুর দুর্বোধ্যতা এবং মানবজীবনের স্বল্পায়ু ইত্যাদি অনেক কিছুই আছে যার কারণে শুদ্ধ জ্ঞান বাধাগ্রস্ত হয়।
প্লেটোর প্রোটাগোরাস নামের সংলাপে এথেন্সে প্রোটাগোরাসের দ্বিতীয় সফরের বিবরণ রয়েছে খানিকটা বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে, আর থিয়াটেটাস সংলাপে তার মতবাদগুলা গুরুতর ভঙ্গিতে আলোচিত হয়েছে। প্রোটাগোরাসের পরিচিতি মূলত তার এই মতবাদের কারণে যে, মানুষ হচ্ছে সবকিছুর মাপকাঠি। মানুষ যা তারও মাপকাঠি মানুষ, মানুষ যা নয় তারও মাপকাঠি মানুষ। এ কথার অর্থ এই যে, প্রত্যেকটি মানুষ সব কিছুর মাপকাঠি; যখন একাধিক মানুষের মধ্যে মতের পার্থক্য ঘটে তখন এমন কোনো বিষয়গত সত্য থাকে না যার কল্যাণে একজন মানুষের মত সঠিক হয় আর অন্য জনের মত ভুল হয়। এই মতবাদ সারত সংশয়বাদী এবং অনুমান করি, এর ভিত্তি হচ্ছে এই যে, ইন্দ্রিয়গুলো আমাদেরকে প্রতারিত করে।
প্রয়োগবাদের তিন প্রবর্তকের অন্যতম এফসিএস শিলার নিজেকে বলতেন প্রোটাগোরাসের শিষ্য। আমার ধারণা, এর কারণ প্লেটো তার থিয়াটেটাস সংলাপে দেখিয়েছেন যে, প্রোটাগোরাস মনে করতেন একটি মত অন্য একটি মত থেকে অধিকতর উত্তম হতে পারে, কিন্তু অধিকতর সত্য হতে পারে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, মানুষ জন্ডিসে আক্রান্ত হলে সবকিছু হলুদ দেখতে পায়। এ কথা বলার কোনো মানে হয় না। যে, বস্তুগুলো আসলে হলুদ নয়, বরং নীরোগ স্বাস্থ্যের অধিকারী একজন ব্যক্তির চোখে যে রঙের দেখায় তাই। তাহলে আমরা বলতে পারি, যেহেতু অসুস্থতার চেয়ে সুস্থতা উত্তম সেহেতু একজন সুস্থ ব্যক্তির মত একজন জন্ডিস রোগীর মতের চেয়ে উত্তম। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি স্পষ্টতই প্রয়োগবাদের মতো।
বিষয়গত সত্য বলে কিছু নেই-এ রকম বিশ্বাস থেকে অধিকাংশ মানুষ বাস্তবিক কারণে নির্দেশ করে থাকেন যে কিসে বিশ্বাস করতে হবে। এ থেকেই প্রোটাগোরাস আইন, প্রচলিত রীতিনীতি ও ঐতিহ্যগতভাবে চলে আসা নৈতিকতার পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। আমরা দেখেছি যে তিনি দেবতাদের অস্তিত্ব আছে কী নেই তা জানেন না, কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে দেবতাদের উপাসনা করা দরকার। যে ব্যক্তির তত্ত্বগত সংশয়বাদ পরিপূর্ণ এবং যৌক্তিক, তার পক্ষে এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই সঠিক।
প্রোটাগোরাস তার সাবালক জীবন কাটিয়েছেন গ্রিসের বিভিন্ন নগরীতে ঘুরে ঘুরে ক্রমাগত বক্তৃতার মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে। এই শিক্ষাদানের বিনিময়ে তিনি অর্থ গ্রহণ করতেন। অর্থের বিনিময়ে তিনি তাদেরকে শিক্ষা দিতেন, যারা ব্যবহারিক জীবনে দক্ষতা আর উচ্চতর মানসিক সংস্কৃতি অর্জনের আকাক্ষা পোষণ করতেন (Zeller, p. 1299)। শিক্ষাদানের বিনিময়ে সফিস্টরা যে টাকা-পয়সা নিতেন তাতে প্লেটোর আপত্তি ছিল। তার সেই আপত্তিকে বর্তমান যুগের বিবেচনায় খানিকটা নাক-উঁচু ভাব বলে মনে হবে। প্লেটো স্বয়ং ছিলেন আর্থিকভাবে যথেষ্ট সচ্ছল, কিন্তু যাদের আর্থিক অবস্থা তার মতো ছিল না, তিনি তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো মেটাতে সক্ষম ছিলেন না। এটা বেশ অদ্ভুত একটি ব্যাপার যে আধুনিককালের অধ্যাপকরা, যারা বেতন-ভাতা গ্রহণ না করার কোনো কারণ দেখেন না, তারা প্রায়ই প্লেটোর ওই নীতির কথা বলেন।
আরো একটি দিক থেকে সফিস্টরা তাদের সমসাময়িক অন্য সব ধারার দার্শনিকদের চেয়ে আলাদা ছিলেন। সাধারণত, সফিস্টরা ছাড়া আর সব শিক্ষাগুরুই একটি করে বিদ্যালয় বা পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করতেন, সেগুলোর বৈশিষ্ট্য হতে ভ্রাতৃসংঘের মতো, সেখানে সবাই একটি বারোয়ারি জীবনযাপন করতেন। মাঠের লোকজনেরা যেসব নিয়মকানুন মেনে একসঙ্গে বাস করে ওই পাঠশালাগুলোতেও অনেকটা সেরকম কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলা হতো এবং এমন কিছু গূঢ় বিদ্যা বা গুহ্যজ্ঞান তারা নিজেদের মধ্যে চর্চা করত যা তারা জনসমক্ষে প্রকাশ করত না। বিশেষত যেসব জায়গায় অজিম থেকে দর্শনের উদ্ভব ঘটেছে সেসব জায়গায় এই ব্যাপারগুলো ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সফিস্টদের মধ্যে এসবের কিছুই ছিল না। তারা যা শিক্ষা দিতেন তাদের বিবেচনায় সেসব বিষয়ের সঙ্গে ধর্ম বা সদগুণাবলির কোনো সম্পর্ক ছিল না। তারা তর্ক-বিতর্কের কলাকৌশল শিক্ষা দিতেন এবং এই কলা রপ্ত করার কাজে সহায়ক জ্ঞান শিক্ষা দিতেন। মোটা দাগে বললে, তারা ছিলেন আধুনিককালের আইনজীবীদের মতে, যেকোনো মতের পক্ষে বা বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শনে প্রস্তুত; কোনো ব্যাপারে নিজস্ব মতের পক্ষে ওকালতি করা তাদের কাজ ছিল না। ফলে, যাদের কাছে দর্শন ছিল ধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত একটি জীবনব্যবস্থা, তারা সফিস্টদের এহেন প্রবণতায় বেশ আঘাত পেয়েছিলেন। তাদের কাছে সফিস্টদেরকে মনে হতো অসার, মূর্খ এবং নীতিহীন।
সফিস্টদের ব্যাপারে প্রাচীন গ্রিসের জনসমাজে বেশ নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা হতো। শুধু যে সাধারণ নাগরিকরাই তাদের নিন্দার চোখে দেখত তাই নয়, প্লেটো এবং তার পরবর্তীকালের দার্শনিকরাও তা-ই করতেন। সফিস্টদের বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা ছিল তাদের বিরুদ্ধে এই ঘৃণার কিছুটা কারণ, তবে এই কারণটা কতখানি ছিল তা এখন বলা অসম্ভব। পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে সত্যের সন্ধান করতে হলে নৈতিক বিবেচনাগুলোকে অগ্রাহ্য করতে হবে। কোনো সমাজে হিতকর বলে যা বিবেচিত, অনুসন্ধানের ফলে প্রাপ্ত সত্যটি তা-ই হবে কি না তা আমরা আগে থেকে জানি না। কোন বিতর্ক শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছুবে সেই চিন্তা না করেই সফিস্টরা তর্ক চালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলেন। প্রায়ই তর্কগুলো গিয়ে ঠেকত সংশয়বাদে। অন্যতম। সফিস্ট গরজিয়াস মনে করতেন যে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। যদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব থেকে থাকে তবে তা জ্ঞেয় না এবং এটা যদি নিশ্চিতও হয় যে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে এবং তা কোনো ব্যক্তি বুঝতে পারে, তথাপি ওই ব্যক্তি কখনো তা অন্যদের জানাতে বা বোঝাতে পারে না। আমরা জানি না গরজিয়াসের যুক্তিগুলো কী ছিল, কিন্তু আমি বেশ কল্পনা করতে পারি যে তার যুক্তিগুলোর এমন যৌক্তিক শক্তি ছিল যে তার বিপক্ষের লোকজন বাধ্য হতো হিতাহিতবিষয়ক প্রসঙ্গের আশ্রয় নিতে। প্লেটো সব সময়ই এমন সব দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে কথা বলতেন যেগুলো তার বিবেচনায় মানুষকে সদগুণাবলি অর্জনে সহায়তা করবে। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে সৎ ছিলেন এটা বলা যায় না, কারণ তিনি বিভিন্ন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বিচার করতেন সেগুলোর সামাজিক প্রভাব-পরিণতির দ্বারা। এমনকি এই ক্ষেত্রেও তিনি সৎ ছিলেন না। তিনি ভান করতেন যে তিনি বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক মানদণ্ড ধরে ধরে যুক্তি উত্থাপন করছেন এবং বিচার করছেন। কিন্তু আসলে তিনি তার আলোচনাকে নিয়ে যেতেন একটি সদগুণাত্মক ফলাফলের দিকে। তিনি এই দোষটি ঢুকিয়েছিলেন দর্শনের মধ্যে, তার পর থেকেই দর্শনে এটা রয়ে গেছে। সম্ভবত সফিস্টদের প্রতি বৈরী মনোভাবের ফলেই তার রচিত সংলাপগুলোর বৈশিষ্ট এ রকম হয়েছে। প্লেটোর পর থেকে সব দার্শনিকের অন্যতম দোষ হচ্ছে এই যে, নীতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে তাদের সব অনুসন্ধান অগ্রসর হয় এমন কিছু উপসংহারের দিকে যা তাদের আগে থেকেই জানা থাকে।
মনে হয়, পঞ্চম শতকের শেষ পর্বে এথেন্সে কিছু ব্যক্তি ছিলেন যারা এমন সব রাজনৈতিক মতবাদ শিক্ষা দিতেন যেগুলো তাদের সমসাময়িকদের কাছে অনৈতিক বলে বিবেচিত হতো এবং যা বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক জাতিগুলোর কাছেও তাই মনে হতে পারে। প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থের প্রথম পুস্তকে থ্রেসিমেকাস বলেন, সবলের স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো ন্যায়বিচার নেই, আইনগুলো তৈরি করা হয় শাসকদের নিজ সুবিধার্থে, ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতায় নৈর্ব্যক্তিক কোনো মানদণ্ড নেই। প্লেটোর বর্ণনা অনুসারে, গরজিয়াস সংলাপে ক্যালিক্লিসও একই ধরনের মতবাদ পোষণ করতেন। তিনি বলেন, প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে সবলের আইন, তবে সবলকে নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে মানুষ কতকগুলো প্রতিষ্ঠান ও নৈতিক বিধান প্রতিষ্ঠা করেছে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচীনকালের তুলনায় বর্তমান যুগে অধিকতর স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবে সেগুলোর ব্যাপারে যা-ই মনে করা হোক না কেন, সফিস্টদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তা ছিল না।
কালক্রমে সফিস্টদের মধ্যে যে পরিবর্তনই ঘটে থাকুক না কেন, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকজুড়ে এথেন্সে ধীর-বুদ্ধি ও অনড় শুদ্ধবাদী সারল্য থেকে একধরনের উত্তরণ ঘটে। ধীর-বুদ্ধিবাদী প্রবণতা ও ক্ষীয়মাণ ধর্মীয় গোঁড়ামির সঙ্গে ক্ষিপ্র-বুদ্ধি ও একধরনের নির্মম অসুয়াবাদের সংঘাতের ফলে একটি পরিবর্তন সূচিত হয়। ওই শতাব্দীর শুরুর দিকে আয়োনিয়ার বিভিন্ন নগরীতে পারস্যের ওপর এথেন্সের আধিপত্য দেখা যায় এবং খ্রি.পূ. ৪৯০ সালে ম্যারাথন নামক স্থানে এথেন্স যুদ্ধে জয়ী হয়। আর শতাব্দীর শেষ দিকে, ৪০৪ সালে স্পার্টার কাছে এথেন্সের পরাজয় ঘটে এবং ৩৯৯ সালে সক্রেটিসের প্রাণদণ্ড হয়। এরপর থেকে রাজনৈতিকভাবে এথেন্সের গুরুত্ব লুপ্ত হয় কিন্তু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ওই নগরী নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে, যা কিনা খ্রিস্ট ধর্মের বিজয় পর্যন্ত অটুট ছিল।
প্লেটোকে এবং তার পরবর্তীকালে পুরো গ্রিক মনীষাকে বোঝার জন্য খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের এথেন্সের ইতিহাসের কিছু অংশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম পারস্য যুদ্ধে ম্যারাথনে বিরাট বিজয়ের কারণে ওই যুদ্ধজয়ের প্রধান কৃতিত্ব গিয়েছিল এথেন্সের হাতে। তার দশ বছর পর দ্বিতীয় যুদ্ধের সময়েও এথেনীয়রা নৌশক্তিতে ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ, কিন্তু স্থলযুদ্ধে বিজয় ঘটেছিল প্রধানত স্পার্টানদের কল্যাণে, যারা হেলেনিক জগতের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্পার্টানরা চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে ছিল মফস্বলী ধরনের এবং পারসিকদের বিরুদ্ধাচরণ করা তারা থামিয়ে দেয় যখন তাদেরকে গ্রিসের ইউরোপীয় অংশ থেকে বিতাড়িত করা হয়। এশীয় অঞ্চলগুলোর গ্রিকদের রক্ষা করা এবং পারসিকদের দখলকৃত দ্বীপগুলোকে মুক্ত করার কাজ বেশ সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছিল এথেন্সের দ্বারা। এথেন্স এক শীর্ষস্থানীয় নৌশক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং আয়োনীয় দ্বীপগুলোতে উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। মধ্যপন্থী গণতন্ত্রী ও মধ্যপন্থী সাম্রাজ্যবাদী পেরিক্লিসের নেতৃত্বে এথেন্স অগ্রগতি অর্জন করেছিল। পারস্যের সম্রাট ক্ষারভেস এথেন্সের যেসব মন্দির ধ্বংস করেছিলেন সেগুলো তিনি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন এবং আরো কিছু নতুন মন্দির স্থাপন করেছিলেন। এথেন্সের বিরাট মহিমামণ্ডিত যেসব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায় সেগুলো নির্মিত হয়েছিল তারই উদ্যোগে। এথেন্সে নগরী খুব দ্রুত গতিতে সম্পদে ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। আর এ রকম সময়ে যেমনটি স্বাভাবিকভাবে ঘটে থাকে, বিশেষত যখন বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে সম্পদ বৃদ্ধি ঘটে, তখন চিরাচরিত নৈতিকতা ও প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর বিলোপ ঘটতে থাকে।
এই যুগে এথেন্সে বেশ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতিভাবান মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল। এস্কাইলাস, সফোক্লিস এবং ইউরিপাইডিসের মতো মহৎ নাট্যকাররা ছিলেন পঞ্চম শতকেরই মানুষ। এস্কাইলাস ম্যারাথনের যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং সালামিসের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সফোক্লিস অবশ্য তখনো ধর্মীয়ভাবে গোড়াপন্থী ছিলেন। তবে ইউরিপাইডিস প্রোটাগোরাসের দ্বারা এবং সে সময়ের মুক্তচিন্তার লোকজনদের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন; পুরাণের ব্যাপারে তার বিচার ছিল সংশয়বাদী এবং নাশকতাপূর্ণ। কমিক কবি অ্যারিস্টোফ্যানিস সক্রেটিস, সফিস্ট এবং দার্শনিকদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সিম্পোজিয়াম নামক সংলাপে প্লেটো সক্রেটিসের সঙ্গে অ্যারিস্টোফ্যানিসের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি, স্থপতি ফিডিয়াস ছিলেন পেরিক্লিসের বন্ধুবৃত্তের অন্তর্ভুক্ত।
এই যুগে এথেন্সের উৎকর্ষ ঘটেছিল বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি শিল্পকলার ক্ষেত্রে। একমাত্র সক্রেটিস ছাড়া পঞ্চম শতকের কোনো বড় গণিতজ্ঞ বা দার্শনিকই এথেনীয় ছিলেন না। আর সক্রেটিস লেখক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এমন। একজন মানুষ যিনি নিজেকে মৌখিক আলাপ-আলোচনার কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ সালে পেলোপনেসীয় যুদ্ধ বেধে গেলে এবং ৪২৯ সালে পেরিক্লিসের মৃত্যু হলে এথেনীয় ইতিহাসে এক অন্ধকার যুগের সূচনা ঘটে। এথেনীয়রা ছিল নৌশক্তিতে সেরা, কিন্তু স্থলশক্তিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল স্পার্টানরা এবং ওই বছরের গ্রীষ্মকালের মধ্যে তারা এথেন্স ছাড়া বারবার আটিকা দখল করে। ফলে এথেন্স জনভারে বিপন্ন হয় এবং প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবে বেশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। ৪১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স সিরাকুজ দখলের উদ্দেশ্যে এক বিরাট অভিযান চালায়, যে সিরাকুজ ছিল স্পার্টার মিত্র। কিন্তু এথেন্স তা দখল করতে ব্যর্থ হয়। যুদ্ধের ফলে এথেনীয়রা দুর্ধর্ষ ও নিষ্ঠুর শাস্তিপরায়ণ মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে ওঠে। ৪১৬ সালে তারা মেলোস নামে একটি দ্বীপ জয় করে, সেখানকার যুদ্ধ করতে সমর্থ সব লোককে হত্যা করে এবং অন্যান্য অধিবাসীদের দাস বানিয়ে ফেলে। ইউরিপাইডিসের দি ট্রয়ান উইমেন নাটকটি ছিল এ ধরনের বর্বরতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। সংঘাতটির একটি মতাদর্শগত দিক ছিল, কারণ স্পার্টা ছিল ধনিকতন্ত্রের পক্ষে, আর এথেন্স ছিল গণতন্ত্রের পক্ষে। এথেনীয়রা যে তাদের নিজেদের অভিজাত শ্রেণির কাউকে কাউকে রাষ্ট্রদোহী বলে সন্দেহ করেছিল তার কিছু কারণ ছিল। মনে করা হতো যে, ৪০৫ সালের এগোসপটামির যুদ্ধে এথেন্সের নৌশক্তির চূড়ান্ত পরাজয়ের জন্য অংশত এথেন্সের অভিজাত সম্প্রদায়ের একটি অংশ দায়ী ছিল।
স্পার্টানরা যুদ্ধ শেষে এথেন্সে একটি ধনিকগোষ্ঠীর সরকার গঠন করে, যারা তিরিশ স্বৈরশাসক বলে পরিচিত। এই তিরিশ স্বৈরশাসকের নেতা ছিলেন ক্রিটিয়াস। তিনিসহ আরো কয়েকজন একসময় সক্রেটিসের শিষ্য ছিলেন। তারা কারণসঙ্গতভাবেই অজনপ্রিয় ছিলেন এবং এক বছরের মধ্যেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। স্পার্টার সম্মতিক্রমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিল একটি তিক্ত গণতন্ত্র। ওই গণতন্ত্রে অভ্যন্তরীণ শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সব ব্যবস্থাই ছিল, অভিযুক্তদের রাজক্ষমতা প্রদর্শনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, বরং যেকোনো অজুহাতে তাদের দণ্ড দেওয়ার ব্যাপারে খুব উৎসাহ ছিল। সক্রেটিসের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড এ রকম একটি পরিবেশেই কার্যকর হয়েছিল।